(একে চন্দ্র, দু’য়ে পক্ষ। সমুদ্র মন্থনেও দুই দল, এ ধরেছে শেষনাগের মাথা তো ও মুড়ো। এদিকে বিষ্ণুর মোহিনী মায়ায় সব লণ্ডভণ্ড। উঠল গরল, উঠল অমৃত। ভাই–ভাই ঠাঁই–ঠাঁই হল। আজও সেই দায় বয়ে চলেছি আমরা। এটি তারই এক আখ্যান, এক বাঙাল কিশোরের চোখে। এর ইতিহাস হওয়ার দায় নেই।)
আমাদের বাড়িতে কেন জানি আনন্দবাজার বড়ো একটা আসত না। নিয়মিত আসত স্টেটসম্যান, যুগান্তর, আর চার কাকা ও এক পিসির সৌজন্যে ‘স্বাধীনতা’, যার স্ট্যাটাস ছিল আজকের গণশক্তির মতো। দেশভাগের পর প্রাণ হাতে করে সীমান্ত পেরিয়ে পার্কসার্কাসের দাদুর দস্তানায় মাথাগোঁজা বাইশ জনের অন্নসংস্থানের সমস্যা বড়ো সোজা ছিল না। দেশ স্বাধীন হয়েছে মাত্র এক দশক হল। বিশ্বযুদ্ধের কঠিন দিনগুলো, জাপানি বোমার ভয়, মন্বন্তর, রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহ, কালোবাজারে উধাও হয়ে যাওয়া দরকারি জিনিষপত্র, — এসব পেরিয়ে এসে মানুষ আশায় বুক বেঁধেছে, ‘আচ্ছে দিন’ এল বলে। কমিউনিস্ট পার্টিও কাকদ্বীপ-তেভাগা, দমদম-বসিরহাট এসব এক্সপেরিমেন্ট পেরিয়ে বেআইনি তকমা ছেড়ে দু-দুটো সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে দেশজুড়ে প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা পেয়েছে।
কিন্তু তখনও কমিউনিস্ট পার্টির কাগজপত্র, নিদেনপক্ষে ‘সোভিয়েত ল্যান্ড’ গোছের নিরীহ প্রচারমূলক পত্রিকা কারও হাতে দেখলেই লোকে শঙ্কিত হত। চাকরি না চলে যায়! এয়ারফোর্সের টেলিপ্রিন্টার অপারেটর কাকামণির চাকরি এভাবেই নট হয়ে গেছল। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেও কোনো লাভ হয়নি। সেজকাকা পুলিশ বিভাগে কনস্টেবলের চাকরি পেয়ে ক’দিন পরেই ছেড়ে দিলেন। বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রের অঙ্গ পুলিশের চাকরি করবেন না। বড়োভাই সলিলকুমার ফোর্ট উইলিয়ামে ল্যান্স নায়েক। ওনার মাথায় হাত, এতগুলো পেটের ভাত, ছোট ভাইবোনের পড়াশুনো, এ কি অবিবেচকের মতো কথাবার্তা! যাহোক, সেজকা ফুড ডিপার্টমেন্টে কাজ পেয়ে চলে গেল মেদিনীপুর জেলায়, বড়ো ভাইয়েরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন — যদিও দাদু-ঠাকুমার মন খারাপ। ইউনিভারসিটির ছাত্রনেতা ন’কাকা কিছুদিন পার্টি কমিউনে রইলেন।
এসব বুঝেছি বড়ো হয়ে।
তখন আমাদের ছিল একটা বড়ো সাদাকালো ছবির বই, বাঁধানো। পঞ্চাশের দশকের শেষে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেঁটে চকচকে টাক ক্রুশ্চেভ দাদু সঙ্গে বুলগানিন দাদু এসে কোলকাতায় গড়ের মাঠে বিশাল মিটিং করেছিলেন। স্বাধীন ভারতে কোন বড়ো দেশের রাষ্ট্রনেতার, বিশেষ করে কমিউনিস্ট দেশের, এই প্রথম আসা। আমাদের বাড়ির মা-কাকিমারা দল বেঁধে দেখতে গেলেন, ফিরে এলেন ওই ছবির বই নিয়ে। আমরা ছোটরা শ্রদ্ধাভরে পাতা ওল্টাতাম।
এমন সময় শুরু হল পর্তুগীজ শাসকের হাত থেকে গোয়া-দমন-দিউ মুক্ত করার আন্দোলন। সারা দেশ থেকে ভলান্টিয়ার যাচ্ছে আইন অমান্য করে জেলে যাবে বলে। এদের মধ্যে সবচেয়ে আগে কমিউনিস্টরা। সালাজারের পুলিশ গুলিও চালাচ্ছে। রোজ স্বাধীনতা পত্রিকায় ছবি দেখি পুলিশ মারছে, মাটিতে শুয়ে পড়ছে ভলান্টিয়াররা। কেন? তাহলে নাকি গুলি মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যায়!
বালকবুদ্ধিতে বলি: মনে হয় কমিউনিস্টরা কোনোদিনই জিততে পারবে না। পুলিশের আছে বন্দুক! তোমাদের কী আছে?
ছোটকা হাসে, বলে — আমাদের সঙ্গে জনগণ আছে।
(তিনদশক পরে বড়োভাই অমিতাভ ছোটোভাইকে জিগান — তেরে পাস ক্যা হ্যায়? শশী কাপুর উত্তর দেন — মেরে পাস মেরি মাঁ হ্যাঁয়।)
ছোটকার দেয়া ন্যাশনাল বুক এজেন্সির ‘পাতাবাহার’ বইয়ে সত্যজিৎ রায়, খালেদ চৌধুরি ও পূর্ণেন্দু পত্রীর অলংকরণ মুগ্ধ করে, নাড়া দেয় তাপস চৌধুরির নৌবিদ্রোহের গল্প আর ননী ভৌমিকের শালপাতার ডাক। সাঁওতাল বিদ্রোহের গল্পে ধামসা-মাদল-নাগাড়ার বোলে ভবিষ্যতের ইশারা — ডুম, ডুম, ডুম! জিতব, জিতব, একদিন জিতব।
তখন কি জানতাম যে হাওয়ায় ওড়া শালপাতার হাতছানিতে আমাকেও একদিন কিশোর বয়সেই ঘর ছাড়তে হবে?
মনিমেলার লাইব্রেরি যাওয়ার সময় পার্টি অফিসের পাস দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতাম ফর্সা টাকমাথা এক ভদ্রলোক ফুটপাথে চেয়ার পেতে বসে আছেন। কাকাদের মুখে শুনতাম — ওনার নাম হাসি দত্ত, পার্টির হোলটাইমার। ওই ইউনিটের সেক্রেটারি। ভদ্রলোক সার্থকনামা, সবসময় হাসি হাসি। আমি জানতে চাইতাম উনি কোন অফিসে চাকরি করেন? পার্টি অফিসে, তবে এটা ঠিক চাকরি নয়। সবসময় এখানে দেখি, উনি বাড়ি যান না? এটাই ওঁর বাড়ি, বিয়ে করেননি।
সদ্য আনন্দমঠ পড়েছি; ভাবি ইনি বোধহয় ভবানন্দ, জীবানন্দের আত্মীয় গোছের। উনি একা একা ফুটপাথে চেয়ার পেতে বসে থাকেন কেন? ওনার মনে কি খুব দুঃখ?
ধ্যেৎ, ভেতরে খুব গরম, পাখাটাখা নেই তো, তাই।
তবু কোন কোন দিন চোখে পড়ত ভেতরে অনেক লোকজন, দোকান থেকে চা যাচ্ছে, আর চড়া গলায় কথাবার্তা। আমাদের বাড়িতেও সেদিন শুরু হয়ে যেত তর্কবিতর্ক। আজ কাকাবাবু এসেছিলেন যে? তোমাদের আবার কাকাবাবু কে?
ওঁর নাম কমরেড মুজফফর আহমেদ, নজরুলের কবিতা পড়েছিস তো? তাঁর ভাল বন্ধু।
একবার মণিমেলার মাঠে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সাহায্যের জন্যে বিচিত্রানুষ্ঠান। স্টেজটা সাধারণ। কিন্তু দেবব্রত বিশ্বাস আসছেন। ভীড় ভেঙে পড়ল। আগে চেনাশোনা পরিবারের বাচ্চাদের কিছু নাচ গান হল। কাছেই ছিল নৃত্যগুরু প্রহ্লাদ দাসের কত্থক শেখানোর নামকরা স্কুল — নৃত্যভারতী। এই স্কুল থেকে দুটো বাচ্চা মেয়ে বেশ নাচল। দেবব্রত গাইলেন — আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।
কিন্তু বাচ্চাদের মাতিয়ে দিল ক্ষিতীশ রায়ের দলের লোকগীতি এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গ মেশানো গান।
‘মরি হায় রে হায়, কি করিনু হায়,
কোলাব্যাঙে খামছা দিছে বড়ো বাঘার গায়,
মরি হায় রে হায়।
আরে হিংস্র বাঘ আর পোষা বিড়ালে করে কানাকানি,
পায়ের ধূলা দিতে আইল ইংলণ্ডের রানী।’
ট্রাম আন্দোলন:
মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির মুখপত্র ‘একসাথে’ পিসির সৌজন্যে আমার মায়ের হাতে পড়ল। তাতে একটি কবিতা ছিল, এইরকম:
“ও মোর যাদুধন! ও মোর যাদুধন!মা সেটা পড়ে আমার একবছরের ছোট্ট ভাইকে ঘুম পাড়াতে লাগল।
তোর ঘুম কে করে হরণ?
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে?”
সেই দেখে ছোটপিসির চক্ষু চড়কগাছ।
ও বৌদি! থামুন, থামুন। করছেন কী! এই কবিতাটা ঘুমপাড়ানি গান নয়। এটা ট্রাম আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে ছেলে হারিয়ে মায়ের বিলাপ।
ট্রাম আন্দোলন? সে আবার কী?
কান পেতে শুনতে গিয়ে ধমক খাই — যা ছাদে গিয়ে খেল গে’ যা!
ভাসা ভাসা শুনে যতটুকু বুঝলাম যে কয়েকবছর আগে, ১৯৫৩ সালে, ট্রামের ভাড়া এক পয়সা বেড়েছিল, তার প্রতিবাদে কমিউনিস্ট পার্টি রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেছে। ছোটকা ক’দিন ট্রামে চড়ে বাড়তি একপয়সা দিতে অস্বীকার করে, কন্ডাক্টর সমর্থন জানিয়েছিল, কিন্তু পুরনো দামের টিকিট ওর কাছে নেই, তাই ভাড়াই নেয়নি। এরপরে গুলি চলল, ছাত্ররা ‘বিধান রায় — ডাউন! ডাউন!’ শ্লোগান দিয়ে মিছিল বের করল।
সরকার পিছু হটল।
এখন মনে হয় দেশ স্বাধীন হওয়ার ছ’বছর পরে পুলিশের লাঠিগুলি পাবলিক স্বাভাবিক মনে করেনি। তাই সমর্থনে পথে নেমেছিল। বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় ছিলেন তখনকার নামজাদা সাংবাদিক। যুগান্তর পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। যদিও উত্তর কলকাতার নামকরা কংগ্রেসি পরিবার তুষারকান্তি ঘোষদের পত্রিকা, তবু বিবেকানন্দবাবুর ওজস্বী সম্পাদকীয় পড়ার আনন্দেই আমাদের বাড়িতে নিয়মিত আসত যুগান্তর। সেই সময় উনি একটা সম্পাদকীয় লিখলেন — ‘আগামীর সংকেত’!
মন্ত্রীর কাগজে এমন সম্পাদকীয়! ওনাকে পত্রপাঠ পদত্যাগ করে আজীবন বসুমতী পত্রিকার সম্পাদনা করতে হল। যুগান্তরের জাত গেল, বসুমতী জাতে উঠল।
খাদ্য আন্দোলন:
আমাদের বাড়ি, পাশে রেজ্জাক খাঁ সায়েবের বাড়ি, নিচে মুন্নাদাদের বাড়ি — সবজায়গায় দিস্তে দিস্তে রুটি বেলা হচ্ছে আর বড়ো কড়াইয়ে রাঁধা হচ্ছে আলুর তরকারি। গাঁ থেকে দলে দলে কৃষকেরা আসছে কোলকাতায় মিছিল করে। মনুমেন্ট ময়দানে বিশাল জনসভা হবে। ওদের খাওয়াতে হবে না? পার্টির ডাকে আসছে, একটা দায়িত্ববোধ আছে না কি? আর একটা ব্যাপার হয়। এই খাওয়ানোর প্রক্রিয়ার রসায়নে অনেকগুলো পরিবার পার্টির কাজকম্মের সঙ্গে যুক্ত হয়।
সালটা ১৯৫৯। ক্লাস ফোরে পড়ি। রোজ যুগান্তর আর স্বাধীনতা থেকে খেলার ছবিগুলো কেটে কেটে একটা খাতায় লাগাই। নীল হার্ভে, নরম্যান ও’নীল, রিচি বেনো, কিথ মিলার, ট্রুম্যান স্ট্যাথাম টাইসন — এইসব। সেদিন বাড়ি থেকে বেরতে বারণ করল। মণিমেলাও ছুটি। সারা শহরে একটা চাপা অশান্তি। আজ কিছু একটা হবে। দাদু সন্ধ্যেবেলা থেকে সেই যে বাক্সরেডিও’র সামনে চেয়ার টেনে বসেছে, আর নড়ছে না। রাতের খাওয়া সারল কোনো রকমে। আমার কাকামণি, ন’কাকা এবং ছোটকা তখনও ঘরে ফেরেনি। আর দাদু ঠাকুমাকে বলছিল ধর্মতলা থেকে রাজভবনের সামনে পুলিশ গাঁ থেকে আসা চাষি ও ছাত্রদের বেধড়ক পিটিয়েছে।
সদ্য সদ্য কাশীরাম দাসের মহাভারত পড়েছি, দাদুর সৌজন্যে। তাতে শান্তিপর্বে শরশয্যায় শোয়া ভীষ্ম যুধিষ্ঠরকে উপদেশ দিচ্ছিলেন — যে রাজা ঠিকমত প্রজাপালন করে না, সে--
আমি সে রাত্তির থেকে মনে মনে কমিউনিস্ট হয়ে গেলাম, তবে কাউকে বলিনি। আসলে আরও দুটো কারণ ছিল। পাশের বাড়ির দত্ত পরিবারের দোতলা বাড়ি, দুটো গাড়ি, একফালি বাগান। ওর সঙ্গে ওদের বাগানে ক্রিকেট খেলি, শুনি ওরা এবার গরমে দার্জিলিং বেড়াতে যাচ্ছে। আমি বলে ফেলি — আমরাও যাব।
বাড়ি এসে বায়না জুড়তেই দাদু বোঝালেন যে ওরা বড়োলোক, আমরা নই। ওদের সঙ্গে খেলা ঠিক আছে, তবে সব ব্যাপারে তাল দেওয়া সম্ভব নয়। এক কাকা ছড়া কেটে শোনালেন —
বড়োলুকের আইলাইদ্যা পুলা,আকাশবাণীতে সেদিন ছিল হীরালাল সরখেলের শ্যামাসংগীত। মা-কাকিমারা দুপুরের খাওয়া সেরে মুখে পান গুঁজে গুছিয়ে বসেছেন। গান শুরু হল:
তারে দেয় হাতে মূলা।।
বড়োলোকের আদুরে ছেলে,
হাতে মুলো নিয়ে খেলে।
ভগবান, তুমি এখনও কেন যে নীরব রয়েছ তাই,হরি! হরি! তাহলে বুবুলরা যে বড়োলোক, আমরা গরীব — সেটা আমাদের দোষ নয়, ভগবানের অবিচার!
তোমার সৃষ্টি তোমার বিধান কিছু না মানিতে চাই।
দুখে সুখে যারা চিরদিন ধরে করে তব জয়গান,
তারা তো পেল না করুণা তোমার, পেল যারা ধনবান।।
কাকাদের তাক ঘাঁটতে গিয়ে একটা সুন্দর বাঁধানো বই চোখে পড়ল — ‘সঞ্চিতা’। রবীন্দ্রনাথের ‘সঞ্চয়িতা’ বা কালোবই জানি, কিন্তু এটা কী? বাঁধানো মলাটে সবুজ পাতা ও কলি, আর দুটো মারকাটারি লাল ফুল। কাকা বলল — রেড পপি।
কিন্তু পাতা ওল্টাতে গিয়ে চোখে পড়ল — দেখিনু সেদিন রেলে, কুলি বলে এক বাবুসাব তারে ঠেলে দিল নীচে ফেলে।
আরে, একবার হাওড়া স্টেশনে এরকম তো আমিও দেখেছি। পাতা উলটে যাই — ‘ফরিয়াদ’। মানে? ছোটকা বলল — নালিশ। কার কাছে? ভগবানের কাছে।
শ্বেত-পীত-কালো করিয়া সৃজিলে মানবে সে তব সাধ,আঃ, বুকের থেকে একটা পাথর নেমে গেল। এতদিন কালো বলে স্কুলে পাড়ায় কত ব্যঙ্গবিদ্রূপ সহ্য করেছি।
আমরা যে কালো তুমি ভাল জান নহে তাহা অপরাধ।
কালোভূত, কেলে, কেলটে, কাইল্যা আরও কত কি! ভাবতাম এটা আমারই দোষ; এখন নজরুল বলে দিলেন দোষ ভগবানের। উনি কেন সবাইকে ফর্সা করে দিলেন না ? তাহলেই তো ল্যাঠা চুকে যেত। এরপর কমিউনিস্ট না হয়ে উপায় আছে?
কিন্তু শেষের স্তবকে এটা কী?
ওই দিকে দিকে বেজেছে ডঙ্কা, শংকা নাহিক আর,এটা কিরকম কথা হল? আমাকে কি দত্তবাড়ির বুবুলকে মারতে হবে? কিন্তু ও যে আমার বন্ধু। সব বই পড়তে দেয়। আমাকে ভালবাসে। কেউ বললেই কি বন্ধুকে মারা যায়? মাঝে মধ্যে ঝগড়া, আড়ি আড়ি আড়ি? ও’রকম তো আমাদের বাড়িতেও হয়। কোথায় কিছু একটা গণ্ডগোল আছে, সেটা বড়ো হয়ে বুঝে নেব। এখন তো যাই কমিউনিস্ট হয়ে!
মরিয়ার মুখে মারণের বাণী উঠিতেছে মার! মার!
ইলেকশন:
সেটা বোধহয় ১৯৫৭ সাল। শিশু বিদ্যাপীঠ স্কুলে দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রথম দশক পূর্ণ হওয়া নিয়ে বড়ো দিদিমণি অনেক কিছু বললেন। আর কমিউনিস্ট পার্টি তখন ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’ শ্লোগান ছেড়ে দিয়ে বেশ কোমর বেঁধে ইলেকশনে নেমেছে।
বেলা বারোটা হবে। আমাদের ফ্ল্যাটের দরজার কড়া একটু জোরে নড়ে উঠল। মায়ের পেছন পেছন আমিও গেলাম দেখতে কে এসেছে। দরজা খুলে মা পাথর। পুলিশ! সঙ্গে একটি অচেনা লোক; তার খড়িওঠা খালি পা, পরনে হেটো ধুতি, গায়ে হাফ হাতা আকাশী রঙের জামা, তার হাতের দিকে একটু কোনা কাটা। ভয়পাওয়া চোখে উদভ্রান্ত দৃষ্টি। পুলিশ অফিসার মাকে বলল — কড়েয়া থানা থেকে আসছি। দেখুন তো ইনি সলিলকুমার রায় কি না? ঠিকানা তো এটাই?
আমি হতভম্ব। সলিল কুমার তো আমার বাবার নাম; বাবা তো এখন পারস্য উপসাগরে বাহরিন বলে একটা ছোট দ্বীপে তেলের কোম্পানিতে কাজ করে। কয়েকবছর পরে আসবে।
--- ইনি আপনার স্বামী?
মা উত্তর না দিয়ে পুলিশকে বলল — একটু দাঁড়ান, বাবাকে ডেকে আনছি।
ভেতরে গিয়ে দাদুকে বলল — বাবা, পুলিশ এসেছে। আপনার বড়োছেলেকে খুঁজছে। সাবধানে কথা বলবেন। মনে হয় ফলস ভোটের ব্যাপার।
দাদু গিয়ে বলল — না, এই লোকটি আমার বড়োছেলে নয়। সে বিদেশে চাকরি করে। গত সপ্তাহে ওর চিঠি এসেছে।
পুলিশের পেছনে পাশের ফ্ল্যাটের দরজা বেশ শব্দ করে খুলে গেল। দরজায় দাঁড়িয়ে রেজ্জাক খাঁ সাহেব।
পুলিশ বিরক্ত। আপনাকে কে জিগ্যেস করছে? গায়ে পড়ে মোড়লি করছেন কেন?
কমরেড রেজ্জাক খাঁ দমবার পাত্র ন’ন।
--- মশাই, আমি না জানলে কে জানবে? আমি ওদের নেক্সট ডোর নেবার।
ওঁর ফ্ল্যাটের দরজা দুম করে বন্ধ হয়ে গেল।
পুলিশ এবার লোকটিকে বলল — কেমন? হল তো? চল এবার।
সন্ধ্যেবেলা। ভোটপর্ব চুকে গেছে। বাড়িতে বিরাট গ্যাঞ্জাম। হাসাহাসি চলছে। পিসতুতো দাদা তপন বরাবরই অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়। স্কুলের বেড়া ডিঙোয়নি, ফলস ভোট দিতে গেছল। পার্ক ইউনিয়ন ক্লাবের ছেলেরা চিনে ফেলে প্রায় পুলিশের হাতে তুলে দেয় আর কি! বাঁচিয়ে দিল মমতাজদা, পাশের বাড়ির রেজ্জাক খান সাহেবের বড়ো ছেলে। গণনাট্য সংঘ এবং বেশ কিছু সিনেমায় অভিনয়ের কল্যাণে গোটা পার্কসার্কাস এলাকায় খুব ইজ্জত।
আমাদের বাড়ির ঘটনাটা শুনে সবাই হইহই করে উঠল। মুরলীধর গার্লস কলেজের স্টুডেন্ট ইউনিয়নের সেক্রেটারি ছোটপিসি বলল — কেন বৌদি, না হয় ওই লোকটাকে সোনাদা বলে আইডেন্টিফাই করেই দিতেন, তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হত? এই তো আমি আর স্মৃতি গিয়ে বোরখা পরে রিকশা চড়ে সার্কাস এভিনিউয়ের দুজন মুসলিম মহিলার ভোট দিয়ে এলাম।
মা চটে লাল।
এইডা কী কইল্যা? আমি যারে তারে সর্বসমক্ষে আমার স্বামী বইল্যা স্বীকার করবাম?
মা তখনও মাণিক বন্দ্যোর ‘হারানের নাতজামাই’ পড়েনি।
ন’কাকা বললেন — না বৌদি; আপনে ঠিকই করছেন।
--ঠাকুরপো, ওই লোকটার কথা ভাইব্যা খারাপ লাগতাছে। পুলিশ কি অরে মাইরধইর করব? জেলে দিব?
-- আরে না বৌদি। সারাদিন বসাইয়া রাইখ্যা বিকেলের দিকে ছাইড়্যা দিব। কংগ্রেসের ফলস ভোটারও ধরা পড়ছে।
-- তাও ভাল। আচ্ছা, রেজ্জাক খাঁ সাহেব হঠাৎ বলা নাই কওয়া নাই বাইর হইয়া তড়পাইতে ছিলেন ক্যারে?
সমবেত হাসির হররা।
--বুঝলেন না বৌদি? ওঁর ফ্ল্যাটেই তো পুরা ফলস ভোটের মেশিনারি। লিস্টি মিলাইয়া কারা কারা শহরে নাই দ্যাখা হইতাছে। সোনাদার ফলস ভোটও ওনার ঘরেই ঠিক হইছে। পাছে সেদিকে পুলিশের নজর যায়, তাই।
--আচ্ছা, ফলস ভোট মানে কী?
সবার কথা বন্ধ হয়ে গেল। কানে জুটল আড়াই পাক।
কমিউনিস্ট কারে কয়?
ভোটের দিন পাতিপুকুরের সেজপিসিমার বাড়ি থেকে বেড়াতে এল ছোড়দি, স্কুল ফাইনাল দেবে। আমার কাকা-পিসিদের চড়া গলায় ‘পার্টির সিদ্ধান্ত’, ‘পার্টি-লাইন’ এসব শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে আমার মাকে জিজ্ঞেস করল — আচ্ছা মাইমা, এইসব পাট্টি-পুট্টি কইর্যা কি কিছু অইব? আমার পাড়ায় একটা মাইয়া আছে, পাট্টি করে। অরে দেখি তেঁতুলতলার মোড়ই খাড়ইয়া একটা কৌটা লইয়া মাইনষের সামনে গিয়া ভিখারির মত এমুন এমুন কইর্যা নাড়াইয়া চান্দা চায়। মাইগগো, আমার এমুন লাজ করে!
ছোটো পিসি ধমকে উঠল — যা যা, তোকে পার্টি করতে হবে না। আগে স্কুল ফাইনাল দে ঠিক করে।
ছোড়দি যাই বলুক, আমার কাছে কমিউনিস্টরা বিরাট গ্ল্যামারাস ব্যাপার! একেবারে রূপকথার লালকমল নীলকমল; রাক্ষস খোক্কসদের সঙ্গে লড়াই করে চলেছে।
দাঙ্গার সময় ছোট দুই কাকাকে দেখেছি পুলিশের থেকে কারফিউ পাশ বের করে রাত-বেরাতে গুন্ডার আক্রমণ ঠেকাতে মুসলিম বস্তি পাহারা দিতে, আগুন নেভাতে, রিলিফ বিলি করতে আর এলাকায় শান্তি মিছিল করতে।
আর এটা চাষীমজুরের পার্টি নয়, বরং উকিল ব্যারিস্টারের দল। একগাদা বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার। ইন্দ্রজিত গুপ্ত, জ্যোতি বসু — সবাই নেহেরুর মতো বিলেতফেরত, তেমনি পার্কসার্কাসের মামুন সায়েব, দৃষ্টিহীন চমৎকার গায়ক সাধন গুপ্ত — উনিও ব্যারিস্টার। আমাদের ময়মনসিংহের রাজপরিবারের স্নেহাংশুকান্ত আচার্য — উনিও। স্কুল পেরোনোর আগে এই বিশ্বাস পোক্ত হল, কারণ খোদ লেনিন ল’ গ্রাজুয়েট। পরে দেখি মার্ক্সও তাই, দর্শনে মাস্টার্স করেছিলেন পরে। আর ওঁর ধর্ম নিয়ে বিখ্যাত উক্তিটিও তো উঠে এসেছে হেগেলের ল’ নিয়ে ধারণার ক্রিটিক তৈরি করতে গিয়ে।
সেসব অনেক পরের কথা। ছোটোবেলার কমিউনিস্টরা বর্ণাঢ্য চরিত্রের মিছিল। কবি সাহিত্যিকের ভীড়। সুকান্ত থেকে সুভাষ মুখুজ্জে, মাণিক, সমরেশ বসু, দেবেশ রায়, দীপেন বন্দ্যো — বিরাট মিছিল। এরপর যদি নাটক এবং সিনেমার কথা ধরি তো কী আর বলব! নবান্ন এবং রক্তকরবী করে শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, বিজন ভটচায — এঁরা সব কিংবদন্তী হয়েছেন। শেক্সপীয়র এবং অঙ্গার করে উৎপল হইচই ফেলে দিয়েছেন। স্টেজ এবং আলোর খেলায় খালেদ চৌধুরি ও তাপস সেন, গণসংগীত এবং লোকসংগীতে সলিল চৌধুরি, নির্মলেন্দু এবং হেমাঙ্গ বিশ্বাস কলকাতা মাতাচ্ছেন। ঋত্বিক ঘটক মৃণাল সেন, তো আছেনই। গঙ্গা সিনেমার পরিচালক রাজেন তরফদার, অভিনেতা তুলসী লাহিড়ি জ্ঞানেশ মুখার্জি কালী ব্যানার্জি এঁরা তখন অসম্ভব জনপ্রিয়। আর পাশের ফ্ল্যাটের মমতাজউদ্দিন আহমেদ বা মমতাজদা তো ছিলেনই। তাই আমাদের মতো অপোগণ্ডদের জন্যে এঁদের স্থান আনন্দমঠের ভবানন্দ জীবানন্দ এবং মহাভারতের হাহা-হুহু গন্ধর্বকুলের কাছাকাছি।
তৃপ্তি মিত্ররা (ভাদুড়ি) ছিলেন ছয় বোন। লোয়ার রেঞ্জের মোড়ের দিকে একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন মহীন্দ্র বাগচী, আমার কাকাদের মহীনদা। উনি শম্ভু মিত্রের অন্যতম ভায়রাভাই। তবে আমরা শুনতাম তেভাগা আন্দোলনের সময় ওঁর উত্তরবঙ্গে রংপুর দিনাজপুর এলাকায় তিরধনুকধারী কোচ, রাজবংশী আদিবাসীদের পাশে দাঁড়িয়ে পুলিশের সঙ্গে লড়াইয়ের গল্প।
মমতাজদার বিয়ে হল। আমাদের বাড়ির এজমালি ছাদে ম্যারাপ বেঁধে, সেই আমার কাকাদের বিয়ের সময় যেমন ভিয়েন বসত। ওইটুকু ফ্ল্যাট, কিন্তু ভীড়ে ভীড়াক্কার। কাকারা সবাই খেতে গেল। আমরা কাকিমাদের পাশে দাঁড়িয়ে বারান্দা থেকে উঁকি মেরে দেখছি, — ওই দ্যাখ কালী ব্যানার্জি, ওই দেখ নিরঞ্জন রায়। এ বোধহয় তৃপ্তি মিত্র? না দিদি, তাইন আরেকজন, নামডা মনে আইছে, মুখে আইতাছে না।
অ, ওই জে আরেকজন, কই যেন দেখছি?
আরে ভানু রে চিনলাইন না? ভানু ব্যানার্জি গো, পাশেই মোটামত জহর রায়।
আমি থাকতে না পেরে বলে উঠি — উত্তমকুমার আইব না?
কাকিমাদের হাসি অ্যার থামে না।
হ, আইব। উত্তমকুমার তর লগে দ্যাখা করতে আইব।
তখন ক্লাস ফোরের পরীক্ষা হয়ে গেছে। রেজাল্ট বেরোয়নি। ডিসেম্বরের শীত, গলিতে গলিতে ক্রিকেট। লোয়র রেঞ্জের মহীন বাগচীদের গলি থেকে একটু এগিয়ে গোটাকয়েক গা ঘেঁষাঘেঁষি বাড়ির গায়ে একচিলতে খেলার মাঠ। ওখানে নাকি একটি ছেলে রীতিমত জোরে বল করে, টেনিস বল নয়, পুরনো ক্রিকেট বলে। সেই পাড়ার প্রদীপ আমায় নিয়ে গেল ফাস্ট বোলিঙয়ের মুখোমুখি হতে — সাহস বাড়বে।
মাঝেমাঝেই বল গিয়ে পাশের একটি দোতলা বাড়িতে ঢোকে; এক মাঝবয়েসি মহিলা খুব বিরক্ত হয়ে চেঁচামেচি করেন। সে বাড়ি থেকে সদ্য স্কুল পেরনো এক রজনীগন্ধা রোজ চোখে রোদ চশমা, হাইহিল খটখটিয়ে ট্রামডিপোর দিকে যান। আমি খেলার মাঝে মুগ্ধচোখে ওঁকে দেখতে থাকি এবং বোল্ড হয়ে সবার হ্যাটা খাই।
প্রদীপ শিখিয়ে দিল ওই মাসিমাকে দেখলে আমরা বলি — ফিলিম স্টার! দেখবি খচে গিয়ে যা চেঁচাবে না!
সত্যি? উনি কি কোন সিনেমায় পার্ট করেছেন? উত্তমকুমারের সঙ্গে?
আরে, ‘কোমলগান্ধার’ কইয়া একটা যেমনতেমন ফিলিম, চলে নাই। করছে ঝিয়ের পার্ট তাতেই পাড়ায় এমন দেমাক দেখায় যে! তুই একবার ডাইক্যা দেখ, মজা দেখবি।
দু’একবার তোল্লাই দিতেই আমি চান্স নিলাম। কিন্তু দিনটা আমার ছিল না। উনি আমাকে কিছু না বলে সরু চোখ করে দেখলেন। তারপরেই এক ভদ্রলোক খাদির পাজামা-কুর্তা আর হাফ-জহরকোট পরে সাইকেল থেকে নামলেন। সাইকেলের ক্রিং ক্রিং শুনে সেই মাসিমা বেরিয়ে এসে ওঁর হাত থেকে একটা পত্রিকা নিলেন। তারপর আঙুল দিয়ে আমাকে দেখিয়ে নিচু গলায় কিছু বললেন। উনি আমাকে দেখে তেড়ে এসে বললেন — তুই! এখন এই পাড়ায় আইস্যা বখামি করস? দাঁড়া, তর কাকারে কমু, মজা দেখবি।
আমার হাত-পা ঠান্ডা! ওই জহরকোট গায়ে মুখে চাকা চাকা বসন্তের দাগ ভদ্রলোককে যে চিনি। কাকার কাছে প্রতিমাসে নিয়মিত পার্টির পত্রিকা-টত্রিকা দিতে আসেন। সেরেছে! কেন যে এদের কথায় নাচলাম?
সাতদিন কাকাকে এড়িয়ে চললেও একদিন ঠিক কাকার সামনে পড়ে গেলাম। ন’কাকা সব শুনে বলল — আর এ’রম ক্যাবলামি করিস না। উনি সুপ্তি ভাদুড়ি, তৃপ্তি মিত্রের নাম শুনেছিস তো, তাঁর আপন বোন। আর জেনে রাখ, ঋত্বিক ঘটকের ‘কোমলগান্ধার’ একটা অসাধারণ ফিল্ম। একদিন বুঝবি।
ঘটনাচক্রে বহুরূপী দল এবং পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ক্যান্সারে আক্রান্ত তৃপ্তি মিত্রের শেষ ক’টি দিন আমাদের পার্কসার্কাস বাড়ির পেছনের গুপ্তদের ফ্ল্যাটে নাট্যকর্মী অশোক গুপ্তের (আলো গুপ্ত) তত্ত্বাবধানেই কেটেছিল। সে গল্প পরের অধ্যায়ে বলা যাবে।