• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৯ | জানুয়ারি ২০২৩ | রম্যরচনা
    Share
  • পঞ্চাশ-ষাটের হারিয়ে যাওয়া কোলকাতার চালচিত্র (১৮) : রঞ্জন রায়



    ।।৮।।

    ভগবান আছেন, ঠাকুর আছেন, ঠাকুরের আশীর্বাদ আছে।

    তাই পনেরোদিনের মাথায় রমেন আশ্রমে ফিরে এল। রামকানাই মহারাজ ওকে মাপ করে দিয়েছেন। আমাদের আনন্দ ধরে কে?

    ক'দিন ধরে বেশি রাত অব্দি আড্ডা, টিচারদের নিয়ে মিমিক্রি, রমেনের সাসপেনশন পিরিয়ডে দেখা তিনটে সিনেমার গল্প আর বৈজয়ন্তীমালার 'ক্যা করু রাম মুঝে বুঢ্ঢা মিল গয়া' নাচের নকল করার অক্ষম চেষ্টা সব মিলে সকালে ঘুম আর ভাঙছিল না। সবাই প্রেয়ারে গেল, আমরা মশারির ভেতরে। তিনজন ধরা পরে গেলাম। ডাক পড়ল অফিস ঘরে। আমি বিপ্লব আর প্রশান্ত।

    গুটি গুটি পায়ে দুটো বিল্ডিং পেরিয়ে যেতে যেতে ডিফেন্স স্ট্র্যাটেজি ঠিক করা হল।

    প্ল্যান-এঃ সত্যি কথা বলা; স্বীকার করা যে আড্ডা এবং সিনেমাঘেঁষা অশ্লীল নাচগানের ফলে ঘুম থেকে উঠতে পারিনি।

    --ক্যানসেল; এটা স্বীকার করা মানে বাড়ি ফিরে যাওয়া, ঠিক রমেনের মতো।

    প্ল্যান-বিঃ আমাদের কেউ ডেকে দেয় নি।

    --- চলবে না; ঘন্টা বেজেছে। আবার ডাকা কিসের? বাকি ছেলেদের কে ডেকেছে?

    প্ল্যান –সিঃ কোন ডিফেন্স নয়; কথার উত্তর না দেওয়া। প্রশ্ন করলে মাথা না তুলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা। শাস্তি ঘোষণা হলে কেঁদে ফেলে ক্ষমা চাওয়া আর একটা চান্স দিতে অনুরোধ করা। তাতে কয়েকদিন খেলা বন্ধ হতে পারে, প্রেয়ার হলে তিনদিন মেজে মোছার দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে, মায় বাগানের আগাছা সাফ করা। কিন্তু ঠিকমত ঠাকুরের নাম নিয়ে চোখের জল ফেলে অনুতপ্ত হলে সাসপেনশন হবার চান্স নেই বল্লেই চলে।

    অগত্যা; এই চলুক।

    কিন্তু রমেনের জিভে আজ দুষ্ট সরস্বতী ভর করেছেন।

    -- শোন; এটা সেই আমাদের বইয়ের কমলাকান্তের দপ্তরের কুক্কুর জাতীয় পলিটিক্স হল। ছ্যাঃ ছ্যাঃ; আমরা করব বৃষজাতীয় পলিটিক্স। অফেন্সে খেলব, ডিফেন্সে নয়।

    -- সে আবার কী?

    -- আরে আমার মাথায় একটা মারকাটারি প্ল্যান এসেছে। যদি ঠিকমত খেলতে পারিস-- বিপ্লব পারবি, এই পোদো হাঁদাটাকে নিয়েই ভয়।

    বিপ্লব দাঁড়িয়ে পরে। আরে সবাই পারবে, তুই আমাদের ঠিক করে বুঝিয়ে দে কী কী করতে হবে।


    ফিস্ফিস্ ফিস্ফিস্। হি-হি-ই-হি-হি-ই-ই।

    এবার সবাই গম্ভীর। বুক ঢিপ ঢিপ করছে। মারকাটারি প্ল্যানই বটে!


    অফিসে অনিল মহারাজ টেবিলের সামনে নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে। আমাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন বোঝা যাচ্ছিল। তবু তিন মূর্তিকে দেখে গম্ভীর মুখ করে একটা রাইটিং প্যাড টেনে নিয়ে কিসব আঁকিবুকি কাটতে লাগলেন।

    -- তোমাদের কিছু বলার আছে?

    আমরা চুপ।

    -- বলে ফেল; সত্যি কথা বলবে। তাতেই শাস্তি কিছু কম হতে পারে।

    সন্নাটা সন্নাটা।

    -- মুখ বুজে থেকে কোন লাভ হবে না। গত মাসেও তোমরা প্রেয়ারে একদিন ফাঁকি দিয়েছিলে। আশ্রমের নিয়ম সবার জন্যেই সমান।

    ঠিক আছে। তোমাদের আজ বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আমি তোমাদের গার্জেনের নামে চিঠি লিখে দিচ্ছি। তোমরা ভোরে প্রেয়ারে আসতে চাও না। কাজেই বাড়ি যাচ্ছ। এরপর তোমাদের গার্জেনরা যা ভাল বুঝবেন।

    --- না মহারাজ।

    --- মানে? তোমাদের শাস্তি দেওয়া যাবে না? তোমরা এতই--?

    রাগে অনিলদার কথা আটকে যায়।

    এবার বিপ্লব মুখ খোলে।

    -- তা বলছি না মহারাজ। আমরা দোষ করেছি, শাস্তি দিন, এটা আমাদের প্রাপ্য। কিন্তু চিঠিতে সঠিক কারণটা লিখবেন।

    -- সঠিক কারণ?

    -- প্রেয়ারে না এসে ঘরে পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছ; এর আবার সঠিক বেঠিক কী? প্রদ্যুম্ন উসখুস করছ কেন?

    -- আসলে মহারাজ আমরা প্রেয়ারে আসতে চাইছিলাম, প্রেয়ার খুব ভাল লাগে। কিন্তু ঠিক ভোরের বেলায় নাইটফল হয়ে গেল।

    --নাইট ফল?

    অনিল মহারাজ ভিরমি খেলেন।

    -- হ্যাঁ, মহারাজ। ওই খারাপ স্বপ্ন দেখে।

    -- মানে প্যান্ট ভিজে গিয়ে আমরা অশুদ্ধ হয়ে গেছি তো! স্নানটান করে শুদ্ধ না হয়ে কি করে প্রার্থনায় যাব? তাই। এবার যা শাস্তি দেবেন। খালি সঠিক কারণ লিখে দেবেন।

    -- আচ্ছা, আচ্ছা! আমি এখনই গেটপাস লিখে দিচ্ছি। ৯ টা নাগাদ মিউনিসিপ্যাল হসপিটালে চলে যাও। আমার চিঠি নিয়ে মধুসূদন ডাক্তারবাবুকে দেখাও। পয়সা লাগবে না।

    ভগবান আছেন। আমাদের উপর ঠাকুরের কৃপা আছে।

    সবাই গেল চান-টান করে স্কুলে; আমরা তিনমূর্তি নর্থ ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল হাসপাতালে। সবুজ পর্দা ঘেরা চেম্বারের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা। চিকিৎসার জন্যে আসা অল্প বয়েসের মেয়েদের দিকে ঝারি কষা, আর তারপরে এক এক করে ডাক্তারের মুখোমুখি হওয়া; শেষে নাচতে নাচতে হস্টেলে ফেরা-- আজকে স্কুল যেতে হবে না।

    সবকটা চ্যাংড়া বিকেলে খেলতে না গিয়ে আমার ঘরে জড়ো হল, অগ্রণী অবশ্যই গুরু অমিয়দা।

    আমাদের এক এক করে বলতে হল ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে সওয়াল জবাব। কী আশ্চর্য! আমাদের সবার জন্যে ওঁদের আলাদা আলাদ প্রেসক্রিপশন। বিপ্লবকে বলা হল--রাত্তিরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়বে, আমাকে দেরি করে আর রমেনকে বলা হল ঘুমোনোর আগে বিবেকানন্দের লেখা থেকে একটা অধ্যায় পাঠ করে শুতে যেতে!

    সবাই কনফিউজড্ বল্লে কম বলা হয়।

    গুরু উবাচ-- তোরা ভেবেছিস ডাক্তারদের ঝুটমুট গল্প বলে বোকা বানিয়েছিস। আসলে ডাক্তাররা তোদের মত গাধাদের বোকা বানিয়েছে। এমন ট্রানস্পারেন্ট লাই!

    গুরু আবার চটে গেলে ইংরেজি বলে।

    তাই বললাম--চটছ কেন?

    -- চটব না? তোরা সব বালের গল্প শুনিয়ে একদিন স্কুল থেকে ফোকটের ছুটি এনজয় করবি আর আমরা?

    কী আশ্চর্য! গুরুর ডানহাত আমাকে মানে বাঁহাতকে সাপোর্ট করে বলে উঠল-- বালের গল্প কেন? ওর জোরে সাসপেনশন থেকে বেঁচে গেল, এ কি কম কথা? রমেন যদি পরপর দু'বার সাসপেন্ড হত তো?

    -- কী আর হত, আমাদের ফ্রি-তে বৈজয়ন্তীমালার নাচ দেখা বন্ধ হয়ে যেত আর ওই হারামজাদা বিমল! ও আরও ছোট ছোট ছেলেদের রেপ করত। কমসেকম রমেনের বীচি টিপে দেওয়ায় কিছুদিন সমঝে চলবে।

    সমবেত হো-হো-হি-হি-র মধ্যে রমেন হাত তুলল।

    -- কী কেস, রমেন?

    --আমি একটা কথা বলতে চাই।

    -- বল না বাল! কে তোর মুখ চেপে রেখেছে?

    -- আমরা বায়োলজির ব্যাপারে অনেক কিছু ভুলভাল জানি।

    বৈষ্ণব ছেলেটি বলল-- যথা?

    --যথা নম্বর-এক; আমরা জানতাম আশি ফোঁটা রক্ত থেকে একফোঁটা রস হয়। তাই নাইট ফল হলে আমাদের এত দুর্বল লাগে, ঘুম পায়। এই কথাটা ডাক্তারবাবুকে বলতে উনি হো- হো করে হেসে ফেললেন।

    --সে কী রে! তুই এইসব মধুসূদন ডাক্তারকে জিগ্যেস করলি? তোর ধাক আছে মাইরি! আর কী কী ভুল জানি।

    --- আরে অনেকে বলে না যে বীর্যপাত হলে শক্তিক্ষয় হয়। আর বীর্য স্টক করলে বাড়তে বাড়তে গিয়ে ব্রহ্মতালুতে ঠেকলে ব্রহ্মজ্ঞান হয়! সেটার ভ্যালিডিটি চেক করলাম। একেবারে লিটমাস টেস্ট, সোজা ডাক্তারবাবুকে।

    --- তোকে তোর বাপ-মা কী খেয়ে পয়দা করেছিল রে?

    রমেনের মুখের রঙ বদলাচ্ছিল।

    কিন্তু গুরু ঠিক সময়ে ফাউলের বাঁশি বাজাল। বলল--এই ব্যাপারে কেউ কারও বাপ-মা তুলবে না।

    প্রশান্ত বলার চেষ্টা করল-- বাপমা- রা বেশ ভারী। আমরা ছোট ছোট ছেলে, কী করে তুলব?

    --- ধূস্ শালা! ডাক্তার কী বললেন সেটা বল না!

    --- ডাক্তার পাশের চেম্বার থেকে আরও দুজন স্টেথো গলায় কাকুকে ডেকে আনলেন। ওরা বড় বড় চোখ করে আমাদের দেখে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। শেষে একজন টাকমাথা সিরিয়াস মুখ করে বলল-- শোন ছেলে। এসব বাজে গল্প; উদ্ভট কল্পনা। এসব বিশ্বাস কর না। আগামী বছর বায়োলজির বই পড়ে নিয়ো। কী করে সীমেন শুক্রাণু তৈরি হয় সব জানতে পারবে।

    --- তাহলে ফল হলে খাওয়া ভুল? স্বামীজি?

    -- অবশ্যি ভুল; কক্ষণো খাবে না। আর স্বামীজি অনেক শিক্ষিত ছিলেন। এসব গেঁয়ো অজ্ঞ লোকের তৈরি ফালতু গল্প। উনি এ'ধরণের কিছুই করেন নি।

    -- ও কে! তোর গল্প শেষ তো? আর কেউ ডাক্তারবাবুদের কিছু জিজ্ঞেস করেছে? কী রে বিপ্লব?

    -- না মানে আমি ডাক্তারবাবুকে জিগ্যেস করলাম মাস্টারবেশন করলে পাপ হয় কি না?

    -- উরি ত্তারা!

    -- উনি চশমা খুলে আবার পড়লেন, তারপর আমাকে মাস্টারবেশনের স্পেলিং জিগ্যেস করলেন।

    --- সে কী?

    --- হ্যাঁ রে! আরও জানতে চাইলেন যে এর বাংলা প্রতিশব্দটি জানি কি না? কোন ডিকশনারি আর কোথায় প্রথম শুনেছি।

    --- কী ডাক্তার মাইরি!

    --- অ্যাই, তোরা চুপ কর তো! ডাক্তার কী বললেন তাই বল--পাপ হয় কি হয় না?

    -- বললেন-- পাপ-পুণ্যের ব্যাপরটা ওনার ডিপার্টমেন্ট না; বরং মহারাজদের জিগ্যেস করলেই ভাল হয়। তবে খামোকা বেশি বেশি এই চক্করে পড়লে ক্লান্তি আসবে, পড়াশুনো থেকে মন চলে যাবে। আর কোন শারীরিক ক্ষতি হয় না।

    আমরা খানিকক্ষণ চুপ।

    অমিয়দা এবার মুখ খুলল-- আর পোদো! আমার বাঁ-হাত, তুই কিছু এমনি প্রশ্ন করিস নি?

    --গুরু, ভাবছিলাম করব, কিন্তু করি নি।

    -- বলে ফেল কী সেই প্রশ্ন যাহা জিগাইতে শ্রীমান পোদো শেষ মুহূর্তে নার্ভাস হইয়াছেন।

    --গুরু, ভাবছিলাম মধূডাক্তারকে জিগ্যেস করব যে নাইট ফল-টল কি খালি ছেলেদেরই হয়? প্রশান্ত ও নিখিলেশ আমার মাথায় তবলা বাজিয়ে দিল। এই না হলে গুরুর বাঁ-হাত! এমন আতাক্যালানে প্রশ্ন আর কার মাথায় আসবে? ভাগ্যিস মুখ বন্ধই রেখেছিলি।

    -- লাইনে আয়। এইসব সাসপেনশন, রমেনের বিমলকে মারা, হ্যানোত্যানো-তে আমার অরিজিনাল প্রোজেক্ট ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে। রাতপাহারা আর হোমোকেস দেখলে ধোলাই দেওয়া-- আবার শুরু করা যায় কি না? তোরা কি বলিস?

    নিখিলেশ বলল-- গুরু, ছেড়ে দাও। সামনে একটাই প্রোজেক্ট--অ্যানুয়াল পরীক্ষা, এখন ওইসব ছাড়। তারপর তো সবাই বাড়ি ফিরে যাবে। নতুন বছরে আবার দেখা যাবে।

    বিশু বলল-- এর মধ্যে কোনটা প্রেম আর কোনটা কাম, সেটা কী করে আলাদা করা যাবে? মানে ওই আত্মেন্দ্রিয়- প্রীতি আর কৃষ্ণেন্দ্রিয়--প্রীতি?

    প্রশান্ত-- সোজা কথা। যেখানে একপক্ষের জোরজবরদস্তি--সেটা আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি। সেরকম কমপ্লেন পেলে আমি ধরে ক্যালাবো এবং সোজা রামকানাই মহারাজের অফিসে নিয়ে যাবো। উনি করুন সাপেন্ড!

    -- সবই হল। এবার পোদো লাস্ট ডায়লগ দে।

    --গুরু, এইসব আত্মেন্দ্রিয়-কৃষ্ণেন্দ্রিয় বাতেলা ছাড়ান দাও। একটু ভাব, এসব চুলকুনি খালি আমাদের, খালি আমাদের হয় কেন? কই, আমাদের সঙ্গে যে ডে-স্কলার ছেলেগুলো পড়ে তাদের এই রোগ হয় না কেন? হুঁ হুঁ বাবা! এবার স্পিকটি নট্!

    --তুই কী বলতে চাস?

    -- আচ্ছা, ছুটিতে যে বাড়ি যাও, পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মার, তাদের কারও এইসব নিয়ে মাথাব্যথা দেখেছ?

    --- না; তা তো দেখি নি। তবে?

    --- ওরা কী নিয়ে কথা বলে?

    -- কেন, ফুটবল , সিনেমা, কেরিয়র-- আমাদের মতই।

    -- আর?

    -- মানে? আর কী? ওঃ, প্রেম, লাইন মারা; আমাদের মতই।

    -- কাদের সঙ্গে প্রেম? কাদের লাইন মারে?

    -- কাদের আবার কুসুমকলিদের। ডবকা ছুঁড়িদের।

    -- ঠিক ঠিক। আমরা কাদের লাইন মারি? কাদের প্রেমে পড়ি?

    -- ভাগ শালা! কারও প্রেমে পড়ি নি। কাউকেই লাইন মারি না।

    -- বেশ, তুমি হলে নিত্যগোপাল। কিন্তু যারা প্রেমে পড়েছে? যারা লাইন মারছে? বা প্রেমে পরার জন্যে ছোঁক ছোঁক করে ঘুরে বেড়াচ্ছে?

    প্রশান্ত হেসে ফেলে। এখানে মেয়ে কোথায়? তাই যা পাওয়া যায়।

    রমেন বলে--আমাদের বিহারেও লৌন্ডা নাচা হয়। ওদের সঙ্গে প্রেম হয়। একটু মেয়েলি ছেলেদের মাল বলা হয়।

    অমিয়দা ভীষণ রেগে যায়।

    -- শোন, এসব ফালতু ক্যাওড়ামি। যে কয়েকটা ছেলে কারও সঙ্গে কিছু করছে বা যাদের ইয়ারকি করে স্বামী-স্ত্রী বলা হচ্ছে ওদের হাতে নয়, আঙুলে গোণা যায়। তাই দিয়ে তুই আশ্রমের সবাইকে মাপবি?

    -- রেগে যেও না। একটু ভাব। তোমার পাড়াতেও কটা ছেলে মেয়ে প্রেম করে? করতে চায়, সুযোগ পায় না। পাড়ায় একটা মেয়ের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলতে গেলেই কিচাইন হবে। দুজনের বাড়িতে রিপোর্ট যাবে। ঠ্যাঙানি খাবে। রোমিও জুলিয়েট হাতে গোনাই যায়। আমি মাইন্ড সেট এর কথা বলছি। বলতে চাইছি এই ছেলেগুলো এই আশ্রমে না থেকে বাড়িতে বাবা-মা, ভাইবোনের সঙ্গে বড় হলে পাড়ার স্কুলে পড়লে কি এমন করে ছেলেদের প্রেমে পড়ত না তোমার ওইসব হোমো চক্করে নোংরামি করে বেড়াত?

    নিখিলেশ ফিচেল হাসে। ওরে আমার ধর্মাবতার যুধিষ্ঠির রে! এদিকে ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না, ওদিকে জ্ঞান দিচ্ছে! 'নেকী মাগী তোর কয় ছেলে? বড়টাকে নিয়ে নয় ছেলে'।

    আমরা হেসে গড়িয়ে পড়ি। এ আবার কী! কোত্থেকে ক্যাচ করলি?

    --আরে পাড়ার এক দজ্জাল বুড়ির ঝগড়া থেকে। কান পেতে শুনলে যা সব মণিমুক্তো কানে আসে না। কিন্তু কথা ঘোরাস না, নিজের কথা বল।

    -- তুইই বল, কী বলতে চাস?

    -- আমার বাবা ঢাক ঢাক গুড় গুড় নেই। তুই যে এতবড় লেকচার ঝাড়লি তা তোর আর বিপ্লবের ব্যাপারটা কী? আপনি আচরি ধর্ম!

    বিপ্লবের মুখ রাগে থমথম করে। বিশু আর রমেনের মুখে ফিচেল হাসি। অমিয়দা যেন ঘুম থেকে জেগে ওঠে। আমার দিকে কড়া চোখে তাকায়।

    --কী ব্যাপার রে?

    -- না মাইরি! সত্যি বলছি।

    -- কীসের না মাইরি?

    -- মানে আমাদের মধ্যে শুধু দোস্তি, খুব দোস্তি মানছি; কিন্তু আর কিছু না।

    -- না হলেই ভাল। হলে কি্ন্তু দুজনেই ধোলাই খাবি। ফিফটি-ফিফটি! আমার গ্রুপে আমি এসব সহ্য করব না। অন্যেরা যা করছে করুক গে।

    সবাই উঠে পড়ে

    । যেতে যেতে বিশু আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে গুনগুন করে—

    "রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম কামগন্ধ নাহি তায়,
    রজকিনী রূপ কিশোরী স্বরূপ দ্বিজ চন্ডীদাসে কয়"।


    গত সপ্তাহে একটা ঝড় বয়ে গেছে, শীতকালের ঝড়, শিলাবৃষ্টি সহ। তার জেরে ভেঙে পড়েছে আমাদের পুকুরপাড়ের নারকোল গাছগুলো। ভেঙে গেছে বাগানের পাঁচিল, নুইয়ে পড়েছে করবী আর কলকে ফুলের ডাল।

    কী করে বোঝাব এই ঝড়ের তাণ্ডবকে! আসলে এই ঝড় গেছে শুধু আমাদের আশ্রমের উপর দিয়েই। তার দাপটে আমরা আশ্রমিক বালকের দল হতভম্ব। মাথায় উঠেছে ডিসেম্বরের অ্যানুয়াল পরীক্ষা। কেমন অনাথ অনাথ লাগছে, আসলে আমাদের আশ্রমের প্রাণপুরুষ রামকানাইদা চলে গেছেন। চলে গেছেন গেরুয়াবস্ত্র ত্যাগ করে, ফেলে গেছেন তানপুরা, হারমনিয়াম, গানের বই আর নিজের হাতে তৈরি ব্যান্ডপার্টি ও কালীকীর্তনের দলকে। না; উনি চলে যেতে চান নি। কিন্তু চলে যেতে হল। বাধ্য হয়ে। মিশনের হেডকোয়ার্টার ওঁকে মার্চিং অর্ডার দিয়েছে--বরাবরের মতো। ওঁদেরও হয়তো উপায় ছিল না।

    না, আমাদের মতামত কেউ জানতে চায় নি, প্রশ্নই ওঠে না। আমরা যে নেহাৎই অপোগণ্ড। তাই ঝড় ঘনিয়ে আসছিল বুঝতে পারি নি। ব্যারোমিটারের পারদ নীচে নেমে যাচ্ছে--খেয়াল করি নি।

    বড়দের থেকে শুনে আর আশ্রমের বিভিন্ন ঠেকে গুজব মিলিয়ে একটা ছায়া ছায়া কাহিনী দানা বাঁধছিল।

    কিছুদিন ধরে ইলেভেন ক্লাসের ছেলেদের সঙ্গে অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ঝামেলা চলছিল। সূত্রপাত সেই বিনা নোটিশে দুধ বন্ধ করে দেওয়া আর মাছের টুকরোর সাইজ ছোট হয়ে যাওয়া। এ নিয়ে কম্প্লেইন, তর্কাতর্কি এইসব। তেমন গা করি নি। কিছু সিনিয়র ছেলে বিদ্রোহ করে প্রেয়ারে যাওয়া বন্ধ করে দেয়।

    গত মঙ্গলবারে রামকানাইদা ওদের সকালবেলায় অফিসে ডেকে পাঠিয়ে ওদের এবম্বিধ ব্যবহারের কৈফিয়ৎ চান। ওদের মতে একজন উল্টে মাসে মাসে ছ'টাকা দেওয়া সত্ত্বেও কেন দুধ দেওয়া হচ্ছে না সে নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন তোলে।

    এ হেন দুঃসাহসে স্তম্ভিত রামকানাইদা মেজাজ হারিয়ে তক্ষুণি ওদের সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত নিয়ে চিঠি লিখতে শুরু করেন। কিন্তু সেই সময় হেড কোয়ার্টার থেকে ফোন আসায় উনি ফোন ধরতে পাশের কামরায় যান।

    আসামীদের মধ্যে ছিল আমার ঘরের এক্স-ক্যাপ্টেন রাজকুমারদা। ওরা ভয় পেয়ে গেছল আর সমঝোতার রাস্তা পাওয়া যায় কি না সেই নিয়ে ফুসুর ফুসুর করছিল। রাজকুমারদার চোখে পড়ে যায় রাইটিং প্যাডের নীচের থেকে উড়ে গিয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়া একটি কাগজের টুকরো।

    সেটাকে যত্ন করে তুলে পেপারওয়েট চাপা দিয়ে রাখতে যাবে এমন সময় চোখ গেল কাগজের মধ্যে রামকানাইদার সুন্দর গোটা গোটা করে লেখা চিঠিটির দিকে। একনজর পড়েই সেটা রাজুদা পকেটে পুরে ফেলল আর সাথীদের বলল--ভগবান আছেন! উনি আমাদের ব্রহ্মাস্ত্র জুগিয়েছেন। ভয় পাস না।

    তারপর ওরা মহারাজের সমস্ত বকাঝকা মাথা নীচু করে চুপচাপ শুনল। শাস্তি ঘোষণা করে রামকানাই মহারাজ শেষ চেষ্টা করলেন। ওদের বললেন যে একদিন সময় দিলাম। ভেবে দেখ। কাল যদি তোমরা সবাই মিলে একটি কাগজে লিখে দাও যে তোমরা তোমাদের অসভ্য ব্যবহারের জন্যে অনুতপ্ত আর নিজেদের শুধরে নেবে তাহলে আমি ঘরে চিঠি দেব না। তোমরা হোস্টেলে থেকেই অ্যানুয়াল পরীক্ষা দিতে পারবে।

    ওরা মাথা হেলিয়ে সায় দিল। ঘরে ফিরে গেল। তারপর দরজা বন্ধ করে সেই কাগজের টুকরোটার হাতে লিখে পাঁচ-পাঁচটা কপি করতে বসল।

    কী ছিল সেই চিরকুটে? আমার গুরু যা জানিয়ে ছিল-- তাতে উনি কবুল করছেন টবিন রোডের বাড়ি তৈরির ও ভবিষ্যতে এই আশ্রম ছেড়ে ওখানে গিয়ে ওঠার পরিকল্পনার কথা।

    ওরা ক্ষমা চাইল না, বাড়ি ফিরে গেল না, উল্টে সেই কপি মিশনের হেডকোয়ার্টারে রেজিস্ট্রি করে পাঠিয়ে দিল। আর এক কপি দিল আশ্রমের এগজিকিউটিভ কমিটির রামকানাইদার বিরোধী গ্রুপের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির হাতে। আর নিজেরা তিনটে কপি তিনজনের কাছে রাখল।

    কমিটি ওদের চাপ দিল অরিজিনাল জমা করতে। কিন্তু ওদের একজনের উকিল বাবার পরামর্শে ওরা সেটা করতে অস্বীকার করল। শুধু দুজনকে সামনে বসে অরিজিনালের সঙ্গে কপি মিলিয়ে দেখতে দিল।

    -- কেন এমন করলে?

    --পোদো, তোর মাথায় গোবর। অরিজিনাল দিলে আমরা সবকটা মহারাজের ও আশ্রমের মিথ্যে মিথ্যে বদনাম করার অপরাধে রাস্টিকেট হয়ে যেতাম যে!

    সাতদিন। ওই সাত-সাতটা দিন ছিল ঝড়ের, ভূমিকম্পের। ধীরে ধীরে খবরটা টিচাররাও জেনে গেছেন। সবাই দম বন্ধ করে আছে। কী হ্হয়! কী হয়! অনেকেই ফেন্সিংএ বসে। কোনো পক্ষ নিচ্ছেন না।

    এই অসম লড়াইয়ে কে মাটি নেবে?

    রামকানাইদা প্রেয়ার হলে আসছেন না। অফিসেই ব্যস্ত। অনেক অচেনা লোকজন আসছে। মিটিং এর পরে মিটিং।

    রোববার রাত্তিরে অনিল মহারাজ ডাইনিং হলে ঘোষণা করলেন-- তোমাদের রামকানাইদা কাল চলে যাচ্ছেন। সকালে জলখাবারের পরে সবাই ওঁর ঘরে গিয়ে দেখা করে প্রণাম করে নিও। অনেক রাত অবদি গুলতানি চলল। সিনিয়রদের মুখে বিজয়ের হাসি। নানান ইয়ার্কি, ঠাট্টা, আগামী মহারাজ কে আসছেন, তিনি কেমন হবেন --এই নিয়ে নানা গুজব। সবাই ভাবছি কাল গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করার কথা। ঘুম হল না।

    সকাল হল। প্রেয়ার যেন শেষ হতে চায় না। আজ আর ড্রিল হল না। জলখাবারের জন্যে ডাইনিং হলে যেতে গিয়ে দেখি বাইরের বারান্দায় নোটিস বোর্ডের কাছে বাচ্চাদের ভীড়। ঘাড়ের উপর দিয়ে উঁকি মেরে দেখি ওই নোটিস বোর্ডে একটা বড় কাগজ আঠা দিয়ে লাগিয়ে দেওয়া। তাতে রামকানাইদার হাতের লেখায় গোটা গোটা করে লেখাঃ

    "ক্ষমা কর, ধৈর্য্য ধর, হউক সুন্দরতর তোমাদের মন,
    মৃত্যু নয়, ধ্বংস নয়, নহে বিচ্ছেদের ভয়, শুধু সমাপন।
    ------ আরও কতগুলো লাইন।

    আমি আর পড়তে পারছি না। সব ঝাপসা দেখাচ্ছে।


    ।।প্রথম ভাগ সমাপ্ত।।

    ।।দ্বিতীয় ভাগ।।

    ।।৯।।

    এবারের মত আকাশ ময়লা করে দেওয়া শীত আগে কখনও দেখি নি। হাওয়া নেই তবু দিনের বেলায় অভয়াশ্রম থেকে কেনা খাদির চাদরটা গায়ে জড়াই।

    এক এক করে সবাই হোস্টেলে ফিরছি। আমরা ক্লাস টেন। তাই এবার দোতলায় রুম পেয়েছি। ছোটরা একতলায়।

    স্কুল খুলতে এখনও তিনদিন বাকি। কিন্তু আশ্রমের জীবনে এমন অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে বাড়িতে গিয়ে সাতদিন ভালো মন্দ সাঁটানোর পরই একঘেয়ে লাগতে থাকে। ঠাকুমার হাতের মাছের গায়ে লম্বা করে পেঁয়াজ জড়ানো তেল-কই, কাকিমার রান্না চিংড়ির মালাইকারি কিছুদিনের মধ্যেই অর্থহীন হয়ে পড়ে।এই ব্যবহৃত ব্যবহৃত হতে থাকা গম-পেষা কলের মতো জীবনের ঘ্যানঘেনে লয় কী যা তা! কোন চমক নেই, নতুনত্ব নেই।

    একদিন ভর দুপুরে ট্রাম ধরে এসপ্ল্যানেড পৌঁছে ৩২ নম্বর বাসে চেপে বসে জয়শ্রী সিনেমার সামনে নেমে পড়লাম।

    বিশাল পোস্টার, সৌমিত্র ও সাবিত্রী-- সাবিত্রী বিধবার পোশাকে। নাঃ, বন্ধুরা কেউ নিশ্চয়ই দেখবে, এসে গল্পটা শোনাবে। আশ্রমের গেট পেরোই। খরগোস ঠোঁটের বিহারী দারোয়ান হেসে হাত তোলে। আমিও হাসি। ও হয়তো বকশিস আশা করছে। কিন্তু আমার যে খালি ফেরার বাসভাড়াটুকু সম্বল।

    ভেতরে গিয়ে আরও যা তা লাগল। চারদিক খাঁ খাঁ করছে। কেউ কোথাও নেই। রামকানাইদার অফিসের সামানে দিশি কুকুরট মাথা গুঁজে ঘুমুচ্ছে।

    মানিদা দেখতে পেয়ে একগাল হেসে কাছে ডাকলেন। আমি জিগ্যেস করলাম-- আজকাল আপনার গাঁট্টার দর কত করে?

    --- দূদ্দূর! ছেলেপুলে নেই, ডিমান্ড নেই। তোরা আয়, দেখবি গাঁট্টার দর চড়চড় করে চড়ছে। কবে আসছিস?

    -- এই তো এসে গেছি।

    --ধ্যাৎ, বিছানা বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে? আগামী সোমবারে চলে আয়! কী রে?

    --- আসব, আপনি যখন বলছেন।

    তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে গলা নামাই-- একটা কথা বলুন তো? নতুন মহারাজ কবে আসছেন?

    --- জানি না। তবে নাম ঠিক হয়ে গেছে।

    --নাম জানেন?

    -- না।

    --কোথাকার আশ্রম থেকে আসছেন?

    --- জানি না।

    হঠাৎ মানিদা গম্ভীর হয়ে গেছেন। এখন উনি সেক্রেটারি মহারাজের টাইপিস্ট বা নতুন মহারাজের সম্ভাব্য পিএ। ওঁর মুখে সেই মুখোশ এঁটে বসেছে।

    অথচ উনিই আমার ভর্তির সময় লোক্যাল গার্জেন মেজকাকে বলেছিলেন-- চিন্তা করবেন না। একটা কি দুটো বছর ওর বাড়ির জন্যে মন খারাপ করবে। তারপর আর বাড়ি ফিরতে চাইবে না। এই নাইনের ছেলেটিকে দেখুন।

    একটা উত্তমকুমারের মত কায়দা করে চুল ছাঁটা ছেলেকে উনি ইশারা করলেন। ও হেসে মাথা নাড়ল।

    তখন সেই ছেলেটার উপর খুব রাগ হয়েছিল। বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে না? এ আবার হয় নাকি? ওপরচালাক! পোঁদপাকা!

    মানিদা অফিসে ঢুকে গেলে আমি আস্তে আস্তে গেট পেরিয়ে বাসরাস্তায় দাঁড়াই। বিকেলের আগে ঘরে ফিরব।


    এখনও নতুন মহারাজ আসেন নি। কিন্তু শীগ্গিরই এসে পড়বেন। হয়তো স্কুল খুলে যাবে। তাতে কী?

    ছোট মহারাজ অনিলদাকে জিগ্যেস করি-- উনি গান জানেন?

    -- ঠাকুরের কাছে আসলে সবাইকে গান গাইতে কম-সে-কম আরাত্রিকটুকু হারমোনিয়মে বাজাতে শিখতে হয়।

    --সে তো আপনিও শিখেছেন?

    -- হ্যাঁ। শিখতে হত। ব্রহ্মচারী পর্বে।

    পাশ থেকে অমিয়দা মিচকি হাসে-- শিখে টিখে এই ফর্ম?

    -- কী ? কী বলতে চাও তুমি?

    অমিয়দা সতর্ক হয়।

    --বলছিলাম কি, ক'টা গান শিখেছেন?

    --- কেন?

    -- মানে আপনাকে বেশি গান গাইতে শুনি না তো! ওই "সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে--" আর "নাচে পাগলা ভোলা"।

    -- আরও দু-তিনটে জানি। যেমন "বিভু নামে এক রাজার ছেলে, যাত্রা করেছিল শ্রীদুর্গা বলে"। তারপর "কে গো আমার মা কি এলি", আরও একটা "ভাঙ খেয়ে বিভোর ভোলনাথ ভূতগণ সঙ্গে নাচিছে"।

    -- আর?

    অনিলদা অসহায় মুখ করে আমার দিকে তাকান। আমার খারাপ লাগে।

    -- কেন মহারাজ! আপনি আরও জানেন। সেই যে "কে ওই আসিল রে কামারপুকুরে", "এস হৃদয় দোলায় দোলাই তোমায়, প্রাণের ঠাকুর রামকৃষ্ণ মম। তুমি যে মোর প্রিয়তম, প্রাণসম প্রাণমম।"

    --ঠিক বলেছ প্রদ্যুম্ন, ,ওই গানগুলোও জানি। শোন, আজকে রাত্তিরে খিচুড়ি রান্না হয়েছে। আর এখন থেকে দুধ দেওয়া শুরু হচ্ছে। খিচুড়ির সঙ্গে একটু দুধ দিয়ে মেখে খেয়ে দেখ, খুব ভাল লাগবে।

    -- এ ম্যা! খিচুড়ির সঙ্গে দুধ? আপনি নিজে কখনও খেয়েছেন?

    --- আমি তো খাই। একবার টেস্ট করে দেখই না!

    ছোটখাট ভিড় জমেছে। একজন টিপ্পনি কাটে-- অমিয়দা, উনি কথা ঘোরাচ্ছেন। গান কোথায় গেল?

    অমিয়দা ছোটলোক। হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলে ওঠে-- অনিলদা, আমি ভেবেছিলম কি আপনি একটাই গান জানেন। মানে আপনার সবগুলো গান একইরকম শোনায়।

    সমবেত অট্টহাসির মধ্যে অনিলদা ভ্যাবাচাকা খেয়ে যান। ওঁর চোখ সবার মুখের উপর দিয়ে ঘুরে যায়। দেখতে পান-- চাপা হিংস্র আনন্দ।

    এবার উনি অমিয়দার চোখে চোখ রেখে তাকালেন-- তুমি আমাকে এইকথা বললে? উপহাস করলে? করতেই পার। তুমি ছিলে রামকানাইদার কালীকীর্তনের দলে সদস্য। কিন্তু একটা কথা শুনে যাও-- ঠাকুর আমার গলায় সুর দেন নি। বুকে ভক্তি-ভালবাসা দিয়েছেন। আমি যখনই গাই, যেমনই গাই-- ভেতর থেকে ভালবেসে গাই। তাই তোমরা হাসলেও আমার কিস্যু এসে যায় না।

    কাল থেকে ক্লাস শুরু হবে। আজকে ক্রিকেট-- গোটা মাঠ জুড়ে। কিছু ডে-স্কলার ছেলেরাও হাজির। চারদিকে অন্ততঃ চার-চারটে ছোট বড় ম্যাচ। একটা নতুন ছেলে টেনিস বলেও ভালই অফ ব্রেক করাচ্ছে; তায় আবার বাঁহাতি--সোনায় সোহাগা।

    এবার রুম অ্যালটমেন্ট একটু অদ্ভূত, অন্ততঃ আমার চোখে।

    আমার গুরু অমিয়দা রুম-ক্যাপ্টেন--কেয়াবাৎ! আর ওঁর ডানহাত-বাঁহাত, প্রশান্ত ও আমি ওর দুপাশের চৌকিতে। দরজার ডানপাশে নিখিলেশ--বাঃ!

    কিন্তু বাঁ-পাশে? মানস! মহারাজদের পুরনো দালাল বা টিকটিকি।

    বিপ্লবের ঠাঁই হয়েছে বিশুদের সঙ্গে, আমাদের থেকে তিনটে রুম পরে।

    কেন?

    আমাকে আর বিপ্লবকে নিয়ে কেউ কিছু মহারাজদের বা ওয়র্ডেনকে বলেছে নাকি? মানস সব পারে। ওকে বিশ্বাস করি না।

    ও কারও বন্ধু হতে পারে না; কিন্তু ও সবসময় মহারাজদের বিশ্বস্ত স্পাই। ও এই করেই আনন্দ পায়। ওকে কি জেনেশুনেই আমাদের রুমে দেওয়া হয়েছে? পরে ভাবব।

    আসলে আমার কিচ্ছু ভাল লাগছে না। দু-এক ওভার বল নিয়ে হাত ঘোরালাম। লেংথের কোন মাথামুণ্ডু নেই। নিজের উপর নিজেই খাপ্পা হয়ে বাগানে ঢুকে গোলাপ ও দোপাটির গাছগুলোর পাশ থেকে গোটা তিন ছোট ছোট কাঠি বা কাঠের গোঁজ তুলে নিয়ে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করলাম।

    মাত্র তিনবছর আগে,-- এইরকম এক শীতের দিনে রামকানাইদা ডাইনিং হলে নোটিস পাঠালেন যে আশ্রমের ব্যান্ডপার্টির পুনর্গঠন হবে। কারণ আগের অনেকে পাশ করে বেরিয়ে গেছে। নতুন ছ'জন ছেলেকে কেটল্ আর দুজনকে বিউগল বাজানোর জন্যে নেওয়া হবে।

    আমাদের কুড়িজনের ব্যান্ড। দুজন বড় বিড্ ড্রামের জন্যে, আর ছজন বিউগল, তিন-তিন করে দু'সারিতে। আর বারোজন বাজায় কেটলড্রাম-ছয় -ছয় করে দু'লাইনে।

    নোটিসে ছিল সাতদিন শেখা ও প্র্যাকটিসের টাইম, তারপর পরীক্ষা।

    আমি তখন সেভেনে, সোজা গিয়ে রামকানাইদাকে বললাম--আমি শিখতে চাই; কী করতে হবে?

    --- বাগান থেকে দুটো কাঠি তুলে নিয়ে আয়।

    যথা আজ্ঞা।

    উনি দুহাতে ড্রামস্টিকের আলাদা আলাদা গ্রিপ দেখিয়ে বললেন --এই এমনি করে স্ট্রোক দিবি--রাম্ পাম্, রাম্ পাম্। রাম্ পাম্, রাম্ পাম্।

    -- কই মহারাজ! কোন রাম-পাম শব্দ বেরোচ্ছে না তো?

    -- দূর ক্যাবলা! রাম-পাম শব্দটা নয়, দুটো স্ট্রোকের টেকনিকটা মন দিয়ে দেখ্ আর শব্দের ওজনের ফারাকটা দেখ।

    আমি মহানন্দে ঘরে গিয়ে প্র্যাকটিস শুরু করে দিলাম--রাম্ পাম্, রাম্ পাম্। সারাদিন।

    আমি একা নই, আরো পাঁচজন।

    রাম্ পাম্, রাম্ পাম্।

    কিন্তু পরের দিন থেকে কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়।

    আরো জনাবিশেক ছেলে ওঁর সঙ্গে দেখা করে গুরুমন্ত্র নিয়ে এসে বাগান থেকে কাঠি তুলে প্র্যাকটিস করছে। ঘরে ঘরে মাথার উপরে বেজে উঠছে--রাম্ পাম্, রাম্ পাম্।

    কয়েকটি ছেলে সিনিয়রদের হাতে ঠ্যাঙানি খাওয়ায় অভ্যাসে ভাঁটা পড়ল। তাতে কি! ঢের প্র্যাকটিস হয়েছে।

    কিন্তু পরীক্ষায় ডাহা ফেল!

    রামকানাইদা মাত্র তিনজনকে নিলেন। ওরা সিনিয়রদের থেকে টিপস্ ও ড্রামস্টিক নিয়ে রোল বাজিয়ে দিল। আমাদের গাঁইয়া প্র্যাকটিস দাঁড়াতে পারল না।

    বললেন-- হয় নি। আরও প্র্যাকটিস কর।

    আমি রাগ করে একবেলা খাই নি। তারপর অমিয়দাকে ধরে শুরুর গৎ, বড় চেঞ্জ, ছোট চেণ্জ সব তৈরি করে গেলাম। ব্যস্।

    উনি চলে গেছেন কয়েকমাস হল। ব্যান্ডপার্টির ঘরে তালা। নতুন মহারাজ কি বিউগল বাজাতে জানেন?

    আমি কাঠি তিনটে হাতে নিয়ে মাটিতে ঠুকে দেখি। তারপর ব্লেড দিয়ে চেঁছে মুখগুলো একটু গোল এবং ক্রমশঃ ছুঁচলো করে ফেলি।

    তারপর টেবিলের উপর ট্রাই করি। রোল করার চেষ্টা করি।

    কী আশ্চর্য! বেজে উঠল-- ড্রিরি-রি-রি-ড্রাঁও-ও-ও!

    চমকে উঠে আবার স্ট্রোক দিই, আবার আবার আবার!

    এর পর ব্যান্ডমাস্টারের স্টিকের ইশারায় সমবেত রেসপন্সের গৎটা বাজাতে চেষ্টা করি।

    --- ঢ্যারার‌্যার‌্যা -- ঢ্যারার‌্যার‌্যা -- ড্রাঁও!

    ঢ্যারার‌্যার‌্যা -- ঢ্যারার‌্যার‌্যা -- ড্রাঁও!

    লিড্ ড্রাম বেজে ওঠে-

    ট্যাট্ট্যারা--র‌্যাট্-ট্যারা--ট্যাট্ট্যারা-র‌্যাট্ ট্যাট্

    ট্যাট্ট্যারা--র‌্যাট্-ট্যারা--ট্যাট্ট্যারা-র‌্যাট্ ট্যাট্
    ট্যাট্ট্যারা--র‌্যাট্-ট্যারা--ট্যাট্ট্যারা-র‌্যাট্ ট্যাট্
    ঢ্যারার‌্যার‌্যা -- ঢ্যারার‌্যার‌্যা -- র‌্যাট্ ট্যাট্-ড্রাঁও!

    নাঃ, কিচ্ছু ভুলি নি।

    ব্যান্ড্ থামে না।

    এর পরে ছোট চেঞ্জ, বড় চেঞ্জ, স্টিকের গায়ে স্টিক ঠেকিয়ে তালফেরতা মত, সব একের পর এক হতে থাকে।

    কখন যেন অমিয়দা সমর রবি বিজন সব যে যার স্টিক কাঠি সব নিয়ে এসেছে আর কেটল ড্রাম বাজতে শুরু করেছে পড়ার টেবিলে ও খাটের গায়ে।

    এখন মাঘ মাস। কিন্তু ফাল্গুন-চৈত্র মাসে আশ্রমের ব্যান্ড পার্টি ভাল করে মাঠে নামবে, রিহার্সাল দেবে। পয়লা বৈশাখে মিউনিসিপ্যালিটির মাঠে পুলিশ ব্যান্ডের সঙ্গে টক্কর দেবে। রামকানাইদার নিজের হাতে তৈরি ব্যান্ড--চাট্টিখানি কথা!

    খাওয়ার ঘন্টা বেজে উঠল।

    নতুন মহারাজ এসে গেছেন। না, উনি একা নন। সঙ্গে আরেকজন। আমরা পেয়ে গেলাম বড় ও মেজ মহারাজ--একসঙ্গে। বেশ তো।

    হয়তো আমাদের আশ্রমের ডিসিপ্লিনের দেয়ালে কোথাও ফাটল ধরেছে, তাই।

    মেজ মহারাজ নাকি ইংরেজ আমলে জাঁদরেল পুলিশ অফিসার ছিলেন! চালাকি নয়। এসব উনি নিজেই প্রথম পরিচয়ে এইট ও নাইনের ছেলেদের জানিয়ে দিয়েছেন।

    কিন্তু ওঁরা কেউ হাসেন না। আমরা আশা করেছিলাম যে অনিলদা, মানে আমাদের ছোট মহারাজ, সেক্রেটারি হবেন। কিন্তু উনি সেই ছোটটিই রয়ে গেলেন। গান গাইতে পারেন না, তাই?

    কিন্তু নতুন দুজনকেও তো কোনদিন গাইতে দেখি নি। হ্যাঁ, সবাই কি আর রামকানাইদার মতো হতে পারে!

    নাঃ, আমি রামকানাইদাকে ভুলতে চাই। আপনি চলে গেছেন; বেশ হয়েছে। মুখচোরা মলয় বাড়ুরি চলে গেছে। ওকেও ভুলতে শুরু করেছি। আর সেই দিদিমণিটি? ওঁর নামটাও আর মনে পড়ে না।

    কিন্তু নতুন মহারাজেরা কেন যে বারবার রামকানাইদাকে মনে পড়িয়ে দেন! ওঁরা যদি একটু হেসে কথা বলেন তাহলেই রামকানাইদাকে ভোলা অনেক সহজ হয়ে যাবে।


    রোববারের ধর্মক্লাসে বড় ও মেজ মহারাজ এলেন। আমরা জেনেছি যে ওদের মহারাজ বলেই সম্বোধন করতে হবে। ওঁরা কখনই আগের ন'দা, রামকানাইদা বা অনিলদার মত সুবিমলদা বা বীরেশদা হবেন না। আমরা ক'দিন অনিলদাকেও মহারাজ বলে ডাকতে শুরু করলাম। উনি গম্ভীর হয়ে গেলেন। তিনদিনের মাথায় বললেন-- প্রদ্যুম্ন, তোমরা আমাকে আগের মতই অনিলদা বলে ডেকো; নইলে কি'রম যেন দূরে ঠেলে দিচ্ছ মনে হয়।

    ধর্মক্লাসে বড় মহারাজ স্বামীজির উপনিষদের গল্প বলে একটা সংকলন থেকে পড়ে শোনাচ্ছিলেন।

    গল্পটা হল--দ! দ! দ!

    আকাশের বজ্রনির্ঘোষে মানবজাতির জন্যে সন্দেশঃ দ! দ! দ!

    মানে দমন কর! দান কর! দয়া কর! ইত্যাদি।

    -- কাকে দমন করব মহারাজ, শত্রু কই?

    -- ষড়রিপুকে। সেই তোমার শত্রু, অহরহ তোমাকে ভ্রমিত করছে, ভুলপথে নিয়ে যাচ্ছে।

    --বুঝতে পেরেছি। আমার এক পিসেমশায় আছেন-- তাঁর নাম রিপুদমন রায়।

    --- তোমার পিসেমশায়ের গপ্পো বন্ধ কর; ক্লাসে মন দাও।

    চারদিকে ফিক ফিক করে হাসি শুরু হয়ে গেছে।

    এবার মেজ মহারাজ পড়ে শোনালেন ব্রহ্মজ্ঞানী মদালসার গল্প। সেই পরমাসুন্দরী বিদুষী এবং সংসারে বীতরাগ মহিলা নিজের পুত্রসন্তানের নাম রাখলেন-- অলর্ক; তার মানে পাগলা কুকুর!

    --- এই তুমি উঠে দাঁড়াও! পেছনের লাইনে বাঁদিক থেকে তিন নম্বর! কালো ছেলেটি, --তোমাকে বলছি, হাসছ কেন?

    --- মানে, উনি অত জ্ঞানী, কিন্তু নিজের ছেলের নাম রেখেছেন কুকুর, আবার পাগলা কুকুর! তা হলে উনি হলেন কুকুরের মা।

    উঠে দাঁড়িয়েছেন মেজ মহারাজ; ---আমার অফিস থেকে কেউ বেতগাছাটা নিয়ে এস। তোমার এটা শুনে হাসি পেল? এটা কি হাসির গল্প? এটা ধর্ম ক্লাস!

    ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে। আমতা আমতা করি।

    -- না , মানে ধর্মক্লাসেও তো ভয়ের গল্প, হাসির গল্প সবরকমই হতে পারে ভেবে ছিলাম। স্বামীজি তো হাসতে ভালবাসতেন। বন্ধু গিরীশ ঘোষের সঙ্গে কত ইয়ারকি ফাজলামি করতেন।

    -- কী নাম তোমার?

    --- প্রদ্যুম্ন; ডাকনাম পোদো।

    -- কেন?

    পেছন থেকে সমবেত স্বরে ফিসফিসানি শোনা গেল-- বিচ্ছিরি পাদে বলে।

    হাসির হররা!

    --সাইলেন্স! অল স্পয়েল্ড ব্র্যাটস্! এদের কী করে ঢিট্ করতে হয় জানা আছে।

    ---- প্রদ্যুম্ন! তোমার নামের মানে জান? তুমি কৃষ্ণের সন্তান। নিজের নামের অপমান কর না। এসব কী হাবিজাবি বকছ? স্বামীজি গিরীশ ঘোষের সঙ্গে ফাজলামি করতেন? কে বলেছে তোমায়?

    -- কেউ বলেনি; বইয়ে পড়েছি।

    -- কী পড়েছ? কিরকম ফাজলামি।

    ওনার গলার স্বর এখন অনেক নরম, স্কেল উদারায় নেমে এসেছে।

    আমি ভরসা পেলাম, এবার ওনাকে আমার ফান্ডা দেখিয়ে ইম্প্রেস করে দেব।

    -- উনি গিরীশ ঘোষকে শালা বলতেন, থিয়েটারে মাগী-নাচানো লোক বলতেন।

    প্রচণ্ড শব্দ করে চেয়ারটা পড়ে গেল। আমার দিকে ভারী বুট পায়ে এগিয়ে আসছেন একজন পুলিশ অফিসার। ইংরেজ আমলের। কুতকুতে চোখজোড়া জ্বলছে। ভিড় সরসর করে সরে জায়গা করে দিচ্ছে। এ কী! ওঁর পাকানো মুঠো যে ডাম্বেলের মতো।

    বিকেলবেলা বিছানায় শুয়ে গরম দুধ খেতে খেতে বিপ্লবকে বললাম-- উনি কি পুলিশ ক্লাবের বক্সিং চ্যাম্পিয়ন ও ছিলেন? জেনে নিস তো!


    নতুন মহারাজের আমলে রান্নার স্বাদ বদলে গেছে। রান্নাঘর আর ডাইনিং হলের পিঁড়িগুলো বেশ পরিষ্কার। এখন প্রত্যেক রোববারে ওসব গরম জল আর সোডা দিয়ে ধোয়া হয়। তদারক করেন ব্রহ্মচারী সুবীর আর ব্রহ্মচারী বরেন। বড় মহারাজ ওঁদের কড়া করে বলেছেন-- তোমরা রান্নার ঠাকুর আর চাকরকে খাটাও না? এখন ডাইনিং হলেই রাত্তিরে দুধ দেওয়া হয়।

    আমরা কখনও ওতে লেবু চিপে ছানা বানাই বা কলাই করা মগে দইয়ের সাজা দিয়ে পেতে দিই। সকালে উঠে যখন দেখি জমে গেছে তখন কী ভালো লাগে।

    ক্লাস ইলেভেনের অসীমদাকে মহারাজ বিশেষ পারমিশন দিলেন -- ও স্টেনলেস স্টিলের থালায় খাবে আর রোজ ওর পাতে একটা করে ডিম দেওয়া হবে। এটা ওর বাবা স্বামীজিকে অনুরোধ করে রাজি করিয়েছেন। এর পয়সাটা উনিই প্রতিমাসে জমা করে দেবেন।

    আমি বুঝতে পারি--অসীমদা বেশ বড়লোক ঘরের ছেলে। ও পাঁচটাকা দামের চটি পরে , আমরা আট আনার হাওয়াই চটি বা বারো আনার চপ্পল। ওর কাছে বেশ নগদ পয়সা থাকে। যদিও নিয়ম হল কোন আবাসিক ছাত্রের হাতে পয়সা দেওয়া যাবে না। যা দেওয়ার অফিসে জমা রাখতে হবে।

    ডাইনিং হলের দেওয়ালে বেশ বড় করে দুটো লাইন বাঁধিয়ে উঁচুতে টাঙিয়ে রাখা আছে। রামকানাইদা করে গেছলেন।

    গীতার থেকে নেওয়া দুটো শ্লোকঃ

    "ওঁ ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্মহবির্ব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মণাহুতং,
    ব্রহ্মৈবতেন গন্তব্যং ব্রহ্মকর্ম সমাধিনা।
    হরি ওঁ তৎ সৎ।"
    [ ব্রহ্মরূপী অগ্নিতে ব্রহ্মহবিঃ ব্রহ্মকে অর্পণ করে ব্রহ্মদ্বারা আহুতি দেওয়া হল। এই নৈবেদ্য ব্রহ্মকর্ম সমাপনের উদ্দেশে ব্রহ্মএর কাছেই যাবে।]

    কাগজটা হলদেটে, ফ্রেমটা একদিকের দড়ি ছিঁড়ে কেতরে রয়েছে। কেউ ঠিক করছে না। ওয়ার্ডেন অচ্যুতদাকে বলে কোন লাভ হল না, দুটো হুঁ আর হাঁ শোনা ছাড়া।

    কিন্তু আমাকে যে রোজ ডাইনিং হলে গীতা পড়তে হয় --জোরে জোরে পাঠ করি।--যতক্ষণ ভাত ডাল ও একটা তরকারি পরিবেশন সম্পূর্ণ হচ্ছে ততক্ষণ। দুবেলা। তারপর পকেট গীতা বন্ধ করে পাশে রেখে ওই দুইলাইন জোরে জোরে টেনে টেনে বলি। অনেকেই গলা মেলায়। তারপর হাপুশ হুপুশ করে খাওয়ার শব্দ। সেকেন্ড কোর্স , বেশির ভাগ দিন মাছের ঝোল দেওয় হয়।

    খাওয়া শেষ হলেও কেউ আগে উঠবে না। আমি খেয়াল করে দেখব অধিকাংশের খাওয়া হয়েছে কি না। তারপর উঁচু আওয়াজে শ্লোগান দেওয়ার মতন বলবঃ

    "জয়, গুরু মহারাজ কী জয়, --জয়!
    জয়, সাধূমহারাজ কী জয়,--জয়!
    জয়, গঙ্গা মাঈকী জয়,--জয়!"
    কখনও লখনও এই বিশেষ ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করি। মাসে একদিন মাংস আর গুঁড়োদুধের পায়েস। সেদিন কী যে হয়! পঞ্চা ঠিক করে রাঁধতে পারে না, তায় দুশো জনের রান্ন। মাংস পুড়ে যায়, পায়েসে দুধ তলায় লেগে যাওয়ায় পোড়া গন্ধ টের পাই। তবু আমরা উলুত পুলুত করে খাই।

    সেদিন মাংসটা আগে দেয়। বন্ধুরা চোখের ইশারায় বলে এবার গীতাপাঠ শেষ করে

    "ব্রহ্মার্পণং" বল্ দিকি!

    আমি দেখেও দেখি না, পাঠ চালিয়ে যাই। ওরা চোখ বড় করে, পাতে রাখা মাংসের দিকে ইশারা করে করুণ ভাব ফুটিয়ে তোলে। আমিআরও মগ্ন হয়ে সাংখ্যযোগের অধ্যায়ে ডুবে যাই-- গম্ভীর আওয়াজে পড়িঃ

    নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবক;
    ন চৈনং ক্লেদয়ন্তাপো ন শোষয়তি মারুতঃ।
    ওরা দাঁত কিড়মিড় করে ইশারায় বলে ক্যালাবে, কিন্তু জানে যে কিছুই হবে না। কারণ এই দায়িত্বটি আগে যিনি পালন করতেন সেই অমল নাগ পাশ করে যাওয়ায় কাজটা বন্ধ হয়ে গেছল। তখন ক্লাস সেভেনের প্রদ্যুম্ন গিয়ে রামকানাইদাকে বলেছিল-- আমি এটা পারব। ছোটবেলায় দাদুর সঙ্গে করে শিখেছি।

    রামকানাইদা হেসে বলেছিলেন-- পারবি? বেশ, একবার পড়ে শোনা।

    শুনে বললেন --ঠিক আছে, তবে তোর তিনটে স, মানে সন্দেশের স, শালগমের শ আর ষাঁড়ের ষ,-- সব একরকন শোনাচ্ছে। আর র ও ড়। এবং ণ। আয় ব্যাটা, দেখে নে। অভ্যাস কর। তারপর সোমবার থেকে লেগে পড়।

    নীচুক্লাসের ছেলে ডাইনিং হলে রোজ গীতাপাঠ করছে-- হল্লা হয়ে গেল। কেলটে এবং পুকুরের পচা জলে খোস-পাঁচড়া হওয়া ঘেয়ো বাচ্চা প্রদ্যুম্ন ওরফে পোদোকে সবাই সম্ভ্রমের চোখে দেখতে লাগল।

    সেভেনের বাচ্চারা গর্বিত।

    --অ্যাই পোদো, আমাকেও শিখিয়ে দে না!

    --- আচ্ছা, পোদো, প্রথম থেকে না দেখে কতট বলতে পারবি? একবার করে দেখা! বইটা কিন্তু আমার হাতে থাকবে।

    --ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ,

    মামকাপান্ডবাশ্চৈব কিমকুর্বতঃ সঞ্জয়?

    -- বারে পোদো, বেশ তো! হ্যাঁরে পোদো, তুই কি বড় হয়ে সন্ন্যাসী হবি? আমাদের রামকানাইদার মতন?

    পোদো অহংকারী ভঙ্গিতে ঘ্যাম লইয়া গম্ভীর হইয়া যায়। বিধাতাপুরুষ সেদিন অলক্ষ্যে হাসিয়াছিলেন বোধহয়।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • প্রচ্ছদ | পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০ | পর্ব ১১ | পর্ব ১২ | পর্ব ১৩ | পর্ব ১৪ | পর্ব ১৫ | পর্ব ১৬ | ১৭ | পর্ব ১৮ | পর্ব ১৯ | পর্ব ২০ | "২১" | পর্ব ২২ | পর্ব ২৩ | শেষ পর্ব
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments