• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৭ | জুলাই ২০২২ | রম্যরচনা
    Share
  • পঞ্চাশ-ষাটের হারিয়ে যাওয়া কোলকাতার চালচিত্র (১৬) : রঞ্জন রায়



    || ৫ ||

    একটা গোটা বছর। কখন যে কীভাবে চলে গেল!

    আমার ও বিপ্লবের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব এখন হোস্টেলের গসিপ কলামে স্বীকৃত তথ্য। সিনিয়র দাদারা যারা হেয়ার স্কুল থেকে আসা ভাল ইংরেজি বলতে পারা ও কঠিন অঙ্ক কষতে পারদর্শী কোঁকড়াচুলের ছিপছিপে ছেলেটির সঙ্গে দোস্তি করতে আগ্রহী ছিল তারা ফুটে গেছে। আমি বেশ গর্বিত। বিপ্লব আমাকেই তার আসল বন্ধু ভাবে। কেন? তা জানি না।

    আমরা পড়াশুনো গান নাটক গল্পের বই পড়া এবং আড্ডা মারায় ব্যস্ত থাকি। ফুটবল খেলি না, কিন্তু ক্রিকেট ও ভলিবল খেলি। হোস্টেলে দুজন ছেলের একসঙ্গে ওঠাবসা চোখে পড়লেই সবার মুখে একটা অশ্লীল হাসি ফুটে ওঠে। তারপর কিছু তির্যক মন্তব্য।

    -- কী রে! তোদের কেমন চলছে আজকাল?

    -- মানে?

    -- মানে তোদের সংসার ধর্ম? কে কর্তা আর কে গিন্নি? এখনও পাকাপাকি ঠিক করিস নি? হেল্প চাই?

    -- ফালতু কথা বলবেন না। আমরা এসব পছন্দ করি না।

    -- আচ্ছা বাবা, আচ্ছা। ভাল হলেই ভাল। আমাদের কী?

    কখনও কোনো সিনিয়র এসে আমার পিঠ চাপড়ে দেয়। বিপ্লবের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে প্রোপোজ করেছিলাম। ও বলল যে ওর একটাই বন্ধু--প্রদ্যুম্ন; আর সংখ্যা বাড়াতে পারবে না। আমি বললাম তো ঠিকই আছে। প্রদ্যুম্ন ছেলেটা ভালো। তোদের মতো উদাহরণ এখানে খুব কম। আশা করি তোদেরটা টিকে থাকবে।

    বিপ্লব নাক কোঁচকায়। এরা এভাবে কথা বলে কেন? দুজনের বন্ধুত্বের কি একটাই মানে? সেই অনিবার্য আঁশটে ব্যাখ্যা?

    কী করা যাবে! কবে থেকে শুরু জানি না। এ চলে আসছে। কিন্তু আমরা এসবের বাইরে থাকব। বুঝলি? সে আর বলতে।

    এখন ক্লাস নাইন। ও সায়েন্স নিয়েছে, ম্যাথস্। ওর বাবা ইঞ্জিনিয়র, ছেলেও তাই হবে। আমি আর্টস্ নিয়েছি। আমি কবি হতে চাই।

    আমরা স্কুলের সময়টা বাদ দিয়ে সারাক্ষণ একসঙ্গে থাকতে চাই। প্রেয়ার হলে ডাইনিং হলে পাশাপাশি বসি। কিন্তু আলাদা রুম। দুটো আলাদা উইং।

    এবারে গরমের ছুটির পর আমাকে ৫ নম্বর ঘর অ্যালট করা হয়েছে। প্রত্যেক রুমে চারটে জানালা, পাঁচটা করে খাট, থুড়ি চৌকি। প্রত্যেক রুমে সিনিয়র ছেলেটি ক্যাপটেন। আমাদের রুমে তিনজন ক্লাস নাইনের, একজন টেন ও একজন ইলেভেন। রাজকুমারদা ইলেভেন, অতএব ক্যাপ্টেন। আমরা পালা করে ঘর ঝাঁট দিই, ঘর মুছি। সপ্তাহে একদিন প্রেয়ার হলে দল বেঁধে সাফ করতে যাই। রাজকুমারদা ওসব কিচ্ছু করে না। ওর পালিটাও আমরাই পালা করে মেরে দিই। তবে নির্ঝঞ্জাট লোক। নিজের মনে থাকে। জুনিয়রদের সঙ্গে বেশি কথা বলে না, পড়াশুনো নিয়ে জ্ঞান দেয় না। খালি বলে--ঘরের মধ্যে কেউ সিগারেট খাবে না। আমি কোনো ফালতু ক্যাচাল কমপ্লেন পছন্দ করি না। আর রাত দশটার মধ্যে সব ঘরে ঢুকবে। আমি সাড়ে দশটায় লাইট অফ করব। পড়াশুনো করতে বা গল্পের বই পড়তে হলে ভোরে উঠে লাইট জ্বালাবে। নইলে বারান্দায় চেয়ার টেনে নিয়ে যাবে।

    বই পড়া নিয়ে ওর কোন মাথাব্যথা নেই। ওদের পরিবারের চালের হোলসেল বিজনেস। টেনেটুনে পাশ করে যায়। সারাবছর স্বামীজিরা ওর মতো ছেলেদের খুব খেয়াল করে দেখেন না। কিন্তু বছরে একবার কালীপুজো বা সাধুসেবার সময় ওদের দারুণ কদর। আশ্রমের গাড়ি করে ওদের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। সঙ্গে রসিদবই নিয়ে আশ্রমের কেউ হোমরাচোমরা। উদ্দেশ্য মহৎ। ওদের বাবা-কাকাদের থেকে প্রতিমার দাম বা সাধুসেবার চালের যোগান নেওয়া।

    উত্তম কাট চুল আর মিডিয়াম পেস বোলিং-- রাজকুমারদার অনেক ফ্যান। ও কিন্তু নিজের ব্যাচ ছাড়া কারও সঙ্গে বেশি মেশে না।

    ব্যতিক্রম একজন। ক্লাস টেনের বিমানদা। বিমানদাদের বাঁকুড়া জেলায় কোথায় একটা সিনেমা হল আছে। ওই প্রথম হোস্টেলে টি-শার্ট নিয়ে আসে। ওটাকে প্রথম প্রথম বম্বে শার্টও বলা হত। বিমানদা রোজ স্নানের পর পাউডার মাখে। গলা ও ঘাড়ে দাগ দেখা যায়। বিমানদা কখনও আমাদের চোখে চোখ মিলিয়ে কথা বলে না। বড্ড ঘ্যাম। তাতে আমার কী! আমার যে কী তা আগে যদি জানতাম!

    কী করে জানব? আগে তো কখনও রাজকুমারদার সঙ্গে একরুমে জুনিয়র হয়ে থাকি নি। এখন ভাবি -- কী করে রুম বদলানো যায়। বন্ধুরা বলল-- এভাবে বদলানো যায় না। বড়দের সম্বন্ধে নালিশ করবি? তার চেয়ে মুখ বুজে চারটে মাস কাটিয়ে দে। তারপরই পুজোর ছুটি। তখন তো রুম ফের বদলে যাবে।

    বেশ, তাই সই। চার মাস? মুখ বুজে কাটাবো? কী করে?

    রোজ ভোরে উঠতে হয়। তাই সারাদিনের পর আলো নিভিয়ে বিছানায় মশারি গুঁজে গা এলিয়ে দিতেই চোখের পাতা বুজে যায়।

    কিন্তু খানিকক্ষণ পরে, বোধহয় একঘন্টা হবে, জানলায় খুটখুট শব্দ। না, আমার জানলায় নয়, ক্যাপ্টেনের জানলায়, সেও গাঢ় ঘুমে। খুটখুট এবার খটখট হয়। কেউ চাপা গলায় ফিসফিসিয়ে ডাকছে-- রাজু! এই রাজু!

    একটু ভয় পাই। কে? কে ওখানে?

    পাশের বিছানা থেকে মানস ফিসফিসিয়ে বলে-- চুপ কর। কথা বলিস না।

    তারপর ও উঠে আস্তে করে দরজার ছিটকিনি খুলে দিয়ে দ্রুত পায়ে নিজের মশারিতে সেঁদিয়ে যায়।

    একটা ছায়ামূর্তি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে; তারপর রাজু, থুড়ি রাজকুমারদার মশারি তুলে ঢুকে পড়ে। ভয়ে ও অবাক বিস্ময়ে আমার ঘুম উবে গেছে।

    মশারির মধ্যে ঘুমজড়ানো গলায় রাজকুমারদা কিছু বলে। পাশ ফিরে শোয়। আগন্তুক নাছোড়বান্দা। সে ক্রমাগত রাজু, ওঠ, আমি এসেছি বলে চলে।

    একটু পরে দুজনের চাপাগলায় গল্প শুরু হয়। একটা চড়ের মত আওয়াজ হল কি? না, ওরা তো হাসছে। হ্যাঁ, দুজনেই।

    সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ি।

    "কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে ছিল অচেতন, ও তার ঘুম ভাঙাইল রে!"
    সেদিন বিকেলে আর খেলতে যাওয়া হয় নি। মানস বলেছে প্রেয়ার হলের পেছনের বারান্দায় বিকেল পাঁচটায় দেখা করতে।

    সাদা ধবধবে শ্বেতপাথরের মেঝে। তিন দিকেই ঢালা বারান্দা। বাঁ-দিকের আর সামনের বারান্দায় লোকজনের আনাগোনা। পেছনের বারান্দায় একটু অন্ধকার মতো। কিছু জবা ও অন্য ফুলের আর বেলফলের গাছ। তারপরে মানুষপ্রমাণ এক ইঁটের পাঁচিল। তার ওপাশে দু'তিনটে বাড়ি। আমাদের ওদিকে তাকানো বারণ। কখনও ওদের জানলায় দাঁড়ানো কোনো বউ বা মেয়ের দিকে অসভ্য ইঙ্গিত করার কমপ্লেন এসেছিল। অপরাধীকে পত্রপাঠ টিসি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

    আর আশ্রমের ঘেরাটোপের বাইরে যে নানান প্রলোভন। আমরা জানি যে স্বয়ং বুদ্ধদেব আর একটু হলেই মারের আক্রমণে কাবু হয়ে যাচ্ছিলেন। শিবের তপস্যা কি এমনি এমনি ভঙ্গ হয়েছিল? মদনভস্মের গল্প আমাদের রোববারের সকালের ধর্মক্লাসে পড়ানো হয়ে গেছে। ব্রহ্মচর্য যে কতভাবে নষ্ট হয়! বাইরের দুনিয়া সারাক্ষণ চক্রান্ত করছে আমাদের ব্রহ্মচর্য নষ্ট করার জন্যে।

    একজন বলেছিল যে রবিঠাকুর একটা গান লিখেছেন—“প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে!"

    তো অনিলদা, মানে অনিল মহারাজ বললেন-- রবিঠাকুর সরস্বতীর বরপুত্র। উনি ঠাকুর। উনি এ সব ছ্যাবলা গান লিখতে পারেন না।

    আমরা কয়েকজন জোর দিয়ে বললাম যে সত্যি উনি লিখেছেন। লাইব্রেরি থেকে রচনাবলী এনে মিলিয়ে দেখা যেতে পারে। অনিলদা এত সহজে হার মানবেন কেন? উনিও সমান জোর দিয়ে বললেন যে আমরা ক্লাস নাইনেই বখে যাচ্ছি। গানের বিকৃত অর্থ করছি। রবি ঠাকুরের গানে পূজা ও প্রেম মিলেমিশে যায়। এ ফাঁদ, ঈশ্বরের ভক্তের জন্যে পাতা ফাঁদ। ওই গানটা খেয়াল কর-- বিশ্বজোড়া ফাঁদ পেতেছ কেমনে দিই ফাঁকি!

    দুঃসাহসী নিখিলেশ বিবেকানন্দের জন্যে কেউ ফাঁদ পেতে ছিল কি না জিজ্ঞেস করে বেত খেল, তবে সেদিনের মতো ধর্মক্লাসের হাত থেকে ছুটি পেয়েছিলাম।

    সে যাকগে, মানস কেন ডাকল সেটা নিয়ে একটু ভয় ছিলই। তাই আমিও একা যাই নি। বিপ্লব সঙ্গে এল।

    বিশাল বারান্দা, খালি। কেউ নেই।

    -- কী রে! ফালতু বিকেলটা নষ্ট হবে নাকি!

    ----শুয়োরের বাচ্চা আচ্ছা বোকা বানাল! ঝাড় খেয়ে এখন শোধ তুলছে!

    --আর একটু দেখি।

    -- দ্যাখ, আমি কিন্তু খেলা শেষের লম্বা ঘন্টা পড়লেই কাটব। হাত-পা ধুয়ে 'খণ্ডন ভব-বন্ধন’ করতে আসতে হবে না? ফালতু লেট এর খাতায় নাম তুলতে দেব না।

    কিন্তু ঘন্টা বাজার অনেক আগেই মানস এসে গেল। কিন্তু ও একা নয়। সঙ্গে মিথিলেশদা। আমাদের হস্টেলের টিমের গোলকীপার। পড়ে ক্লাস ইলেভেনে।

    কিন্তু মিথিলেশদা কেন? মারবে? মানস মিথ্যে কথা বলে খেপিয়ে আনে নি তো?

    আমাদের আশ্রমে বড়রা ছোটদের মারতে, থুড়ি শাসন করতে পারে। কোন আপিল চলে না। তবে বেয়াদপি বা বড়দের অসম্মান করা --এই জাতীয় ভ্যালিড কারণ থাকতে হবে। সাক্ষী থাকলে আরও ভাল।

    আর যারা মহারাজের বা ম্যানেজমেন্টের খোচরের কাজ করবে তাদের বলা হবে দালাল। তার থেকে দালু বা পচা আলু। পরে বুঝেছিলাম যে বড়দের একচেটিয়া ঠ্যাঙানোর অধিকারের বিরুদ্ধে ছোটদের একটা সেফগার্ড হল দালালদের ভয় পাইয়ে দেওয়া বা একঘরে করা।

    এই মানস ব্যাটাও ক্লাস সিক্স-সেভেনে দালাল উপাধি পেয়েছিল। শীতকালে ওর লেপে জল ঢেলে দেওয়া হয়েছিল। আমরা সবাই আশ্রমের নিয়ম মেনে কলাই করা থালা-মগ ব্যবহার করি। ও বাড়ি থেকে কাঁসার থালা নিয়ে এসেছিল। সেই থালার সদগতি হল আশ্রমের পচাপানার পুকুরে।

    আমরা ওদের দেখে উঠে দাঁড়ালাম। বসতে বলল মিথিলেশদা, একটু হাসল। এটা কি বলির আগে কাঁঠালপাতা খাওয়ানো?

    --- মানস বল; কী হয়েছে?

    মানস কাল রাত্তিরের ঘটনা সংক্ষেপে বলল। তারপর বলল--রঞ্জন মেনে নিতে পারছে না। ভাবছে মহারাজের কাছে যাবে।

    মিথিলেশদা গম্ভীর হল।

    তারপর বলল-- আর কে কে জানে? আর কাকে বলেছিস?

    -- কাউকে না। আমি আর মানস।

    -- শোন, বড়দের ব্যাপার ওদেরই বুঝে নিতে দে, নাক গলাস না। তোর প্রবলেমটা কী?

    -- না মানে মানস বলছিল--!

    --- কী বলছিল?

    --- কিছু না; রঞ্জন বলছিল যে ও তো আর্টস নিয়েছে, কবি হবে।

    -- আমার ইয়ে হবে। স্কুলের ম্যাগাজিনে চাল এর সঙ্গে ডালের মিল দিয়ে দুটো পদ্য লিখে নিজেকে রবিঠাকুর ভাবতে লেগেছে?

    ঢং ঢং করে খেলা শেষের টানা ঘন্টা বেজে উঠল। আধঘন্টা বাদে প্রেয়ারের ঘন্টা বেজে উঠবে, শুধু একবার --ঢং!

    আমরা উঠলাম। সবাই।

    মিথিলেশদা বলল--দাঁড়া। কথাটা মন দিয়ে শোন। ফালতু দালালি মেরে নালিশ করতে যাস না। কোনো লাভ হবে না। ওরা দুজন ডিনাই করবে, এরকম কিছু হয় নি। মানস বলবে-- তুই আসলে কাল খারাপ স্বপ্ন দেখে চেঁচিয়ে উঠেছিলি। তারপর আমরা কয়েকজন সিনিয়র মিলে তোকে ভাল করে ক্যালাবো, বড়দের নামে মিথ্যে মিথ্যে চুকলি করার জন্যে। আর তুই হবি তোদের ব্যাচের নতুন দালাল। এবার যা!

    ঘরে এসে আমি আর বিপ্লব নিজেদের মধ্যে অনেকক্ষণ কথা বলি। ছেলেতে ছেলেতে ভালবাসা। এ কী করে সম্ভব। যোগ দেয় নিখিলেশ আর প্রশান্ত।

    এবার দুর্গাপুজোর সময় আমাদের আশ্রমের 'এস্কার্সন' হবে দার্জিলিংয়ে। আচ্ছা, এস্কার্সন মানে কী? অমন খটোমটো কোনো শব্দ তো ক্লাস নাইন অব্দি কোনো বইয়ে পাইনি! কিন্তু বিপ্লব তো হেয়ার স্কুলের। ও আমাকে মানে বলে দিল। আমি গর্বিত। আমাদের ব্যাচে শুধু আমিই ওই কঠিন শব্দের মানে জানি।

    থাকা হবে স্নোভিউ হোটেলে; স্বামীজি, মানে রামকানাইদা অর্থাৎ শান্তিনাথানন্দ চিঠি লিখেছেন। যারা যারা যেতে চায় তাদের সবাইকে গার্জেনের চিঠি শুদ্ধু একটি নির্দিষ্ট টাকা ১৫ দিনের মধ্যে আশ্রমের অফিসে জমা দিতে হবে।

    আমি ও বিপ্লব নানা রকম প্ল্যান করি, স্বপ্ন দেখি। দার্জিলিং!! হিমালয়! বরফ! শুধু ছবিতে দেখেছি। স্কুলের পাঠ্যবই 'কিশলয়' এ জলধর সেনের বর্ণনা পড়েছি; টয় ট্রেন! ওখানে তো শুধু বড়লোকেরা যায়। যেমন আমাদের ভাড়াবাড়ির উল্টো দিকে বিশাল দোতলা বাড়ির দত্তদের ছেলেমেয়েরা। তবু আশ্রমের সুবাদে আমরাও যেতে পারব। স্টুডেন্ট কনসেশন, আরও কী কী সব। হঠাৎ বুকের মধ্যে আশ্রমের জন্যে একটা ভালবাসার জোয়ার টের পাই। রামকানাইদার জন্যেও।

    এখানের চার দেওয়ালের মধ্যে হাঁফিয়ে উঠি, খোলা আকাশের নীচে কী আনন্দ!

    বাবার চিঠি এল। গত দু'বছর পরপর আমাদের দুভাইকে বাবা এস্কার্শনে পাঠাতে কোন আপত্তি করেন নি। রাজগীর-বোধগয়া বা ম্যাসানজোড়। এবার সম্ভব হবে না। আর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন আরও দু'লাইন। এখন ক্লাস নাইনে আমার পড়াশুনো নিয়ে আরও সিরিয়াস হওয়া উচিত, নইলে পরে পস্তাতে হবে। হায়ার সেকেন্ডারিতে সমস্ত প্রশ্নপত্রে সেকশন এ বা ৫০% প্রশ্ন তো নাইন-টেন থেকেই আসবে। আমি সিরিয়স না হলে পরের দু'ভাইয়ের কী হবে? ওরা বিপথগামী হবে।

    রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে যায়।

    আমি তাহলে মেড়ার পালের সর্দার মেড়া। আমি যে দিকে যাব, ছোট দুভাইও সেদিকে? দুস্ শালা!

    দুদিন পরে বিকেলে আমি ও বিপ্লব নতুন স্কুল বাড়ির আদ্ধেক তৈরি অংশটায় মিট করি। ও বলে--শোন, একটা রাস্তা আছে। আমি বাবাকে বলে তোর পয়সাটা জমা করিয়ে দেব। তুই বাড়িতে বলবি--তোকে কনসেশন দিয়েছে।

    আমি মাথা নাড়ি। ও আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমার চোখে জল।

    বলে-- আমিও যাব না। তোকে বাদ দিয়ে অন্য ফালতুগুলোর সঙ্গে!! সেবার রাজগীর আর বোধগয়া এস্কার্শনের সময় কত আনন্দ হয়েছিল ভাব তো!

    সপ্তপর্ণী পাহাড়, বিপুলগিরি বা প্যাগোডায় আমরা একসঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি। রোজ রাত্তিরে ক্যাম্প ফায়ারে দুজনে মিলে কোনো স্কিট বানিয়ে অ্যাক্টিং করেছি। ও খুব ভাল মাউথ অর্গান বাজায়। বাজিয়েছিল-- এ অপনা দিল তো আওয়ারা, আর নতুন হিট ইংরেজি সিনেমা কাম সেপ্টেম্বরের থিম মিউজিক, রামকানাইদা সংগীত নাটক বোঝেন, পছন্দ করেন। আপত্তি করেন নি।

    তবে ফেরার পথে রাত্তিরে ট্রেনে আর একটা ঘটনা ঘটেছিল। সেটা মনে পড়তেই দুজনে হেসে উঠলাম।

    ওই প্যাসেঞ্জার ট্রেনে একটা গোটা কামরা আমাদের জন্যে রিজার্ভ ছিল; থার্ড ক্লাস। সন্ধ্যের পরেই ট্রেনের আলো নিভু নিভু হতে হতে একেবারে চলে গেল। রান্না তৈরি ছিল। সমবেত টর্চের আলোয় আমরা লুচি, আলুর শুকনো তরকারি ও তিনটুকরো মাংস দিয়ে খাওয়া সেরে নিলাম।

    সবাই শুয়ে পড়েছে।

    কিন্তু কোথা থেকে একটা গানের আওয়াজ আসছে না? আন্দাজে ভর করে এগিয়ে দেখি রামকানাইদা হারমোনিয়ামে বসেছেন। উল্টোদিকে বসে মুগ্ধ হয়ে শুনছেন রঘুনাথ গোস্বামী ও তাঁর সঙ্গিনী মহিলা। উনি তখন অ্যাডভান্সড্ পাপেট শো করিয়ে কোলকাতায় বেশ নাম করেছেন। আমরাও দেখেছি।

    একটা গান শেষ হল। রঘুনাথ দুর্গা রাগের ফরমাশ করলেন। রামকানাইদা একটা সরগম বাজিয়ে আরোহ, অবরোহ, পকড় দেখিয়ে দিয়ে গান ধরলেন, অন্তরায় ছিল--"রামকৃষ্ণ বলে আপনার মনে, কালীনাম বিনা কর্ণে নাহি শুনে"।

    এরপর টর্চের ব্যাটারি নিভে যাওয়ায় ওঁরা উঠলেন। রামকানাইদা আমাকে দেখে বললেন--- কী রে ব্যাটা! ভালো লেগেছে? আশ্রমে ফিরে চল, কথা হবে। এখন শুতে যা!

    আমি ফিরে এসে দেখি আমার আর বিপ্লবের বিছানা মুখোমুখি দুটো বাংকে। নীচের বেঞ্চের একটায় কেউ ঘুমোচ্ছে আর অন্যটায় ক্লাস টেনের অসীমদা জানলার কাছে বসে টর্চ জ্বালিয়ে বাইরে ছুটে চলা ঘন জঙ্গল দেখছে। বললাম-- সেল ফুরিয়ে যাবে যে! ঘুমোবে না?

    -- আর এক জোড়া এক্সট্রা আছে। ঘুম পাচ্ছে না। তুই শুয়ে পড়।

    আমি ওপরে উঠে শুয়ে আকাশপাতাল ভাবতে থাকি, ভেড়া গুনি, ঘুম আসে না।

    একটা চাপা হাসির শব্দ; কী রে? খুব গান শুনছিলি?

    আরে? বিপ্লব ঘুমোয় নি!

    তোর সঙ্গে কথা না বলে ঘুমোতে পারি?

    মনটা খুব ভালো হয়ে যায়। আমরা ফিসফিস করে গল্প শুরু করি। মনে হয় ট্রেনের গতি আর 'তুমি থাকো, আমি যাই’ ছন্দের দোলায় কারও ঘুম ভাঙবে না।

    কিন্তু একটু পরে অসীমদা চাপা গলায় ধমকায়-- আবে! তোদের ন্যাকড়াবাজি শেষ হয় না, অ্যাঁ? ঘুমো।

    খানিকক্ষণ সব শান্ত। ফের শুরু হয় ফিসফিসানি।

    অসীমদা তেতো গলায় বলে--ঢ্যামনাগুলোর মাঝরাত্তিরে রস উথলে উঠেছে!

    আমি বলি--আমরা কি লাকি রে! গোটা ট্রেন ঘুমোচ্ছে। শুধু আমরা দুজন জেগে আছি।

    -- তাহলে তোর নাম হল লাকি।

    -- মানে?

    -- আরে কোলকাতা পুলিশের কুকুরের নামকরা একটা জোড়া আছে না? আজকাল কাগজে ওদের কথা খুব বেরোচ্ছে।--লাকি আর মিতা।

    --- তুই তাহলে মিতা?

    --হ্যাঁ; শোন, এটা আমাদের কোড নাম। এই নামে আমরা নিজেদের মধ্যে চিঠি লিখব। নিজেদের ডাকব। কেউ টের পাবে না। কী মজা!

    ও হাত বাড়িয়ে দেয়। আমিও বাড়িয়ে দিই। কিন্তু কেউ কাউকে ছুঁতে পারি না। ও বাংকের থেকে একটু কিনারার দিকে গড়িয়ে আসে। এবার ছোঁয়া যাচ্ছে।

    আমার কী যে মনে হল-- আমি হাত বাড়িয়ে ওর কনুইয়ের ভাঁজে একটা চপ মারলাম। ও টাল সামলাতে না পেরে মাথা নীচের দিকে করে পড়ে গেল। কিন্তু ওর মাথা মাটি ছোঁয়ার আগে আমার দু'পা কাঁচির মতো ভাঁজ হয়ে ধরে ফেলেছে ওর গোড়ালি। ও ঝুলছে বিপজ্জনক ভাবে, মুখে চাপা আর্ত চিৎকার!

    নীচের থেকে অসীমদা লাফিয়ে এসে ধরে ফেলেছে ওর মাথা। ওদিকের বেঞ্চ থেকে ঘুমন্ত ছেলেটি অসীমদার ডাকে উঠে এসে ধরে ফেলেছে বিপ্লবকে। ওরা দুজনে আস্তে আস্তে নামিয়ে দেয়।

    আমি নীচে নেমে আসি। বিপ্লব স্বাভাবিক হতে একটু সময় নিল।

    -- কী করে পড়ে গেলি বলত? আর একটু হলেই বিচ্ছিরি চোট লাগত। কেউ ধাক্কা দিয়েছিল?

    আমি জানলা দিয়ে বাইরে তাকাই।

    বিপ্লব কাঁপা কাঁপা গলায় বলে-- ঝিমুনি এসেছিল, বাজে স্বপ্ন দেখছিলাম। গড়িয়ে পড়েছি।

    -- যত্ত সব ঢ্যামনামি!

    পরের দিন বিকেলের মধ্যে আশ্রমের সবাই জেনে যায় অসীমদার উপস্থিত বুদ্ধি, ক্যাচ ধরার টেকনিক আর আমাদের দুজনের ঢ্যামনামির গল্প।

    আমাদের নিজস্ব রইল শুধু দুটো শব্দ-- লাকি আর মিতা।


    কালকে দার্জিলিং যাওয়ার গ্রুপটা রওনা হয়ে যাবে। প্রায় ৪৫ জন। বাকি দেড়শ জন পুজোর ছুটিতে বাড়ি যাব সাতদিন পরে।

    অর্থাৎ এই সাতদিন লাকি একলা হয়ে যাবে, মিতা তো দার্জিলিং গিয়ে অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দে মশগুল হবে।

    আমরা যথারীতি প্রেয়ার হলের পেছনের বারান্দায় হাতধরাধরি করে দেয়ালে হেলান দিয়ে কথা বলছি।

    পুজোর পনের দিন ছুটি। লক্ষ্মীপুজোর পর হোস্টেলে ফিরতে হবে। বিসর্জনের পর বাড়িতে কেমন একঘেয়ে লাগবে। বাড়ির রান্না, পুজোর নতুন জামাকাপড়, পার্কসার্কাস পাড়ায় দুর্গোপুজো বা অষ্টমী-নবমীতে সকালের অঞ্জলি ও সন্ধ্যেয় ঘুরে ঘুরে বালিগঞ্জ ভবানীপুরের ঠাকুর দেখা-- তার রোমাঞ্চ আর আগের মতো নেই।

    মিতা বলে-- একদিন আমার বাড়িতে আয় না? দুজনে খেয়েদেয়ে ঘুরে বেড়িয়ে --।

    --- কোথায়?

    -- আমহার্স্ট স্ট্রীট পাড়ায়।

    --বেশি চিনি না। শ্যালদা চিনি, আর কলেজ স্ট্রিটে গোপাল পাঁঠার দোকান চিনি। কয়েকবার কাকার সঙ্গে মাংস কিনতে গেছি।

    --ব্যস্, ব্যস্! ওতেই হবে। তুই পার্কাসার্কাস ডিপো থেকে শ্যালদার ট্রাম ধরে আয়। তারপর হ্যারিসন রোড ধরে কলেজ স্ট্রীটের দিকে দুটো স্টপ এগিয়ে যা। ছবিঘর সিনেমার সামনে দাঁড়াবি। আমি এসে তোকে নিয়ে যাব। দুপুর একটা নাগাদ আয়।

    -- মাকে বলতে হবে। ট্রামের ভাড়া চেয়ে নিতে হবে না?

    -- হ্যাঁ, বলেই আসবি। তাইতো একটা নাগাদ আসতে বললাম। নইলে মাসিমা ভাববেন ম্যাটিনি শো'তে সিনেমা দেখার ধান্দা করেছিস।

    আমরা বেশ উদ্দীপ্ত হই। এটা দারুণ হবে।

    এমন সময় খেলার মাঠের দিক থেকে একটা বিকট চিৎকারে চমকে উঠি। নাঃ, বেশ কয়েকজনের উত্তেজিত কথাবার্তা আর চিৎকার।

    আমরা উঠে পড়ি, দ্রুত পা চালাই হট্টগোলের উৎস সন্ধানে।

    ফুটবল মাঠের কাছে বিশাল ভিড়। এর ওর কাঁধের ফোকর দিয়ে উঁকি মেরে দেখি--- আমাদের রুম ক্যাপ্টেন রাজকুমারদাকে দোতলার ওয়ার্ডেন সন্তোষদা বেধড়ক পেটাচ্ছেন। কিন্তু তালঢ্যাঙা আর পেস বোলার রাজুদাকে পেটানো সহজ নয়। ও প্রাণপণে মারগুলো ভোঁতা করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। সন্তোষদা হাঁফিয়ে উঠেছেন। এবার বেত ফেলে দিয়ে ওর কায়দা করে সিঙাড়া করা চুলের মুঠি ধরে ঘাড়ে রদ্দা।

    আর তক্ষুণি একটা তীক্ষ্ণ খ্যানখেনে গলাঃ অ্যাই ছেড়ে দিন, ওকে ছেড়ে দিন বলছি! ও কিচ্ছু করে নি। মারতে হয় আমাকে মারুন!

    বিমানদা!

    রাজুদার ভালবাসার পার্টনার!

    বিমানদা অনুরোধ করছে না, সন্তোষস্যারের কাছে ভিক্ষে চাইছে না, বরং ওর রাগে গলা কাঁপছে, ও কাঁদছে!

    সন্তোষদা হতভম্ব। ভিড়ের মধ্যে নানান আওয়াজ, অধিকাংশই সন্তোষস্যারের বেত চালানোর বিরুদ্ধে।

    উনি ছেড়ে দিয়ে বললেন-- যা! ফের কখনো--!

    বিমানদা, ক্লাস টেনের বিমানদা, কাঁদতে কাঁদতে সবার সামনে রাজুদাকে জড়িয়ে ধরে টানতে টানতে আমাদের রুমের দিকে নিয়ে যায় আর রাজুদা শরীরের সমস্ত ভার ওর ওপর ছেড়ে দিয়ে কেমন ঘসটে ঘসটে চলে যায়।

    ভিড় পাতলা হয়। অনেকের সঙ্গে আমরাও কলতলার দিকে এগিয়ে যাই। একটু পরেই প্রেয়ারের ঘন্টা বাজবে।

    প্রশান্ত আমাকে বলে--দেখলি! এই হল সত্যিকারের ভালবাসা।

    -- আচ্ছা, বিমানদা ওরকমভাবে সবার সামনে রাজুদার জন্যে স্ট্যান্ড নিল, কাঁদল; তারপর মার খাওয়া রাজুদাকে জড়িয়ে ধরে ঘরে নিয়ে গেল।

    -- গেল তো! তাতে কী হয়েছে?

    -- লজ্জা করল না?

    -- কেন করবে? ঠাকুর বলেছেন না?--লজ্জা-মান-ভয়, তিন থাকতে নয়!

    --- ভাগ শালা! কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা?

    --- হ্যাঁ হ্যা`; কোথায় নেতাজি আর কোথায় পেঁয়াজি!

    বিশু ফান্ডা দেয়-- ভুল কী বলেছে! ঠাকুর যে তিনটে আকর্ষণ বা টান এক হলে ঈশ্বর থাকতে না পেরে ভক্তকে দেখা দেন বলেছেন তার মধ্যে একটা হল --নষ্ট মেয়ের উপপতির জন্যে টান।

    --ঠাকুর এরম উদাহরণ দিতেই পারেন না।

    -- পড়িস নি তো! না পড়ে তক্কো করছিস। পড়লে জানবি ঠাকুরের উদাহরণগুলো সব গ্রামের জীবনের থেকে নেওয়া।

    প্রেয়ার হলে ঢোকার মুখে বিপ্লব থুড়ি মিতা আমার হাত ধরে টানে।

    -- লাকি, আজ বিমানদাকে দেখে কেমন সেদিনের বিশুর বলা কথাটা একটু যেন বুঝতে পারলাম।

    -- কোন কথাটা?

    -- ওই যে-- "আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা তারে বলি কাম, কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা ধরে প্রেম নাম"।

    এরপর রাত্তিরে দরজায় ঠকঠক বা চাপা গলায় রাজু-রাজু ডাক শুনলে আর বিচলিত হই না। সবার আগে গিয়ে চুপচাপ দরজা খুলে দিই। তারপর বিমানদা ক্যাপ্টেনের মশারিতে ঢুকে গেলে আমিও নিজের মশারিতে সেঁদিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। ওদের মশারি থেকে কথাবার্তা বা বেড়ালের দুধে চুমুক দেওয়ার আওয়াজ কিছুই আর আমার কানে ঢোকে না; আমি অঘোরে ঘুমোতে থাকি।


    || ৬ ||

    পুজোর ছুটির পরে হোস্টেল ফিরতে দেরি হল। ঠান্ডা লেগে বুকে সর্দি বসে ঘুসঘুসে জ্বর হয়ে সে এক কেলো!

    সপ্তমীর দিন ঠিক সকালে বেরিয়ে পায়ে হেঁটে পার্কসার্কাস থেকে যোধপুর পার্ক, আনোয়ার শা রোড পোদ্দার নগর ঘুরে বিকেলের দিকে সন্ধ্যে হয় হয়, তখন বাড়ি ফিরলাম। দুপুরে খাবার বলতে খালি বাদামভাজা, ঝালমুড়ি আর বুড়ির চুল।

    অনভ্যাসে এতটা একদিনে পায়ে হেঁটে যা ব্যথা, তারপরেই জ্বর। কিন্তু আনন্দে ছিলাম। পোদ্দারনগর কলোনীর ভেতরে রাস্তায় টিউকল থেকে জল ভরছিলেন জনাকয় মহিলা। পাশেই পুজোর প্যান্ডেল থেকে তারস্বরে বাজছে নতুন হিন্দি সিনেমার গান--- "বোল রাধা বোল সঙ্গম হোগা কি নহীঁ?"

    ত্যক্ত বিরক্ত নায়িকা হার মেনে বলে ওঠে--হোগা, হোগা হোগা!

    জল ভরতে ব্যস্ত একজন মহিলা সঙ্গিনীদের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে বাঙাল উচ্চারণে বলে ওঠেন-- হগা, হগা, হগা!

    সবাই সমস্বরে হেসে ওঠে।

    যোধপুর পার্কের পুজো প্যান্ডেলের কাছে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বাজছে-- "ত্রিবেণী তীর্থ পথে কে গাহিল গান?"

    আশ্রমে রামকানাই মহারাজ একবার বলেছিলেন-- ওই গানটা পটদীপ রাগিণীতে।

    কিন্তু ছবিঘর সিনেমার সামনে মিতার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া হল না। সিনেমার সামনে বন্ধু অপেক্ষা করছে শুনেই মায়ের চেহারা কেমন কঠিন কঠিন হয়ে গেছিল আর মাত্র জ্বরে ভুগে উঠেছি-- এই ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে মা আমার বেরনোর প্রস্তাব খারিজ করে দিলেন।

    কিন্তু বিপ্লব মানে মিতা নাকি দুঘন্টা ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল লাকি আসবে এই ভরসায়। তবে লাকির বদলে দেখা হয়ে গেল টিউটোরিয়ালের রথীন স্যার ও ক্লাস টেনের অসিতদার সঙ্গে। জেরায় জেরায় ও কবুল করল যে রঞ্জনের জন্যে দাঁড়িয়েছিল।

    ও সময়মত হোস্টেলে ফিরল। আমি সেদিন অ্যাপো ফেইল করা ও হস্টেলে ফিরে যেতে দেরির কথা লিখে একটা পোস্টকার্ড ছাড়লাম। সেটা ওর মা হোস্টেলের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলেন। চিঠিটা ওর হাতে সোজাসুজি যায় নি, গেল সেই অসীমদার মাধ্যমে। অসীমদা মহা ছোটলোক-- চিঠিটা পড়ে তবে ওকে দিল। খোলা পোস্টকার্ড বলেই কি অন্যের চিঠি পড়া যায়?

    ব্যস--, অসীমদা হোস্টেলে পুরো গল্পটা আদা নুন মাখিয়ে ছাড়ল।

    দশ দিন পরে হোস্টেলে ফিরে দেখলাম আমরা দু'জন বিরাট খোরাক হয়ে গেছি। আর তদ্দিন গোটা তামাশা শুধু বিপ্লবকে নিয়েই হয়েছে।

    রাত্তিরে ও আমাকে চেপে ধরল, বলল-- কে তোকে বলেছিল পোস্টকার্ডে লাকি-মিতা লিখতে?

    এবার ছুটির পর আবার রুম অ্যালটমেন্ট পাল্টেছে। একই ঘরে আমরা চারজন ক্লাস নাইন, শুধু একজন ক্লাস সেভেন, এবছর নতুন ভর্তি হয়েছে। হোস্টেল খুলেও স্কুল খোলেনি, খুলবে সোজা ভাইফোঁটার পর।

    অমাদের রুমের ক্যাপ্টেন বিপ্লব। সকালবেলা প্রেয়ার ও ড্রিলের পর জলখাবার, দুঘন্টা পড়া, একঘন্টা ক্রিকেট। তারপর স্নান করে সাঁটিয়ে খেয়ে কষে ঘুম। বিকেল চারটেয় উঠে জলখাবার খেয়ে খেলার মাঠ, তারপরে প্রেয়ার, টিউটোরিয়ল, খাওয়া-- শেষে সাড়ে দশটায় লাইট অফ। কিন্তু প্রথম দিন দুপুরে খালি চোখ লেগেছে এমন সময় দরজায় খটখট। অতিকষ্টে চোখ খুলে দেখি কেউ ডাকছে-- বিপ্লবদা, অ বিপ্লবদা! দরজা খোলো।

    বিপ্লব উঠল, কাঁচাঘুমে লাল চোখ।

    দরজা খুলতেই সেই নতুন ছেলেটা হুড়মুড়িয়ে ঢুকল। বিপ্লব কোনো কথা না বলে ঠাঁটিয়ে দুটো চড় মারল। তারপর আবার নিজের বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ক্লাস সেভেনের ছেলেটা গালে হাত বুলোতে বুলোতে শুতে গেল।

    বিকেলে ওকে বললাম--অমন করে মারলি কেন?

    -- দু'দিন দেখ! বুঝে যাবি।

    পরের দিন দুপুরে আমরা সবাই গাঢ় ঘুমে কাদা-- অনেক দূর থেকে কেউ যেন আমার নাম ধরে ডাকছে-- প্রদ্যুম্নদা, ও প্রদ্যুম্নদা!

    আমার খাটের কাছেই দরজা। উঠে খুলে দিতেই সেই ছেলেটা! একইরকম ভাবে হুড়মুড়িয়ে ঢুকল। আমিও সোজা দুটো চড় কষিয়ে নিজের বিছানায় ফিরে গেলাম।

    বিপ্লব উঠে লাল চোখ দিয়ে দুজনকে দেখে ফিক করে হাসল, তারপর শুয়ে পড়ল।

    কিন্তু স্কুল খোলার আগে নতুন বাওয়াল যার মাথামুন্ডু বোঝা কঠিন।

    ক্লাস সিক্সের নবারুণ বলে একটা বাচ্ছা ছেলে পাগল হয়ে গেছে!

    ফুটফুটে ছেলেটা, এবছরই নতুন এসেছে। ১৫ই অগাস্টের ক্যাম্পফায়ারে একটা মজার কবিতা বলেছিল, সঙ্গে সুন্দর অ্যাক্টিং।

    ওই রাবণ আসিল যুদ্ধে পরি বুটজুতা,
    হনুমান মারে তারে লাথি-চড়-গুঁতা।
    লাথি খেয়ে রাবণরাজা যান গড়াগড়ি,
    হনুমান করে তারে দন্ত কিড়িমিড়ি।
    জুরিদের সর্বসম্মতিতে ওকে একটা প্রাইজ দেওয়া হল। ও একটা আধুনিক গানও গেয়েছিল—
    "সূর্যমুখী সূর্যে খোঁজে সূর্য খোঁজে বিনা,
    বল তো গো-- আমি তোমার মনের মত কি না?"
    ভালই গেয়েছিল, কিন্তু অনিল মহারাজ নাক কোঁচকালেন। ফলে কোনো প্রাইজ দেওয়া গেল না।

    সেই সবার প্রিয় ছটফটে হাসিমুখ ছেলেটা পাগল হয়ে গেছে?

    হুড়মুড়িয়ে ছুটলাম অফিসের দিকে।

    লম্বা বারান্দায় একটা থামের সামনে ছোট কাঠের টুল, তাতে বসে ছোট্ট নবারুণ, কোমরের হাতদুটো পিছমোড়া করে থামের সঙ্গে গরু বাঁধার দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা। ঘোলাটে চোখে ও সবাইকে দেখছে অথবা কাউকে দেখছে না।

    কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠছে-- পোকা! পোকা!

    তারপর নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। একটু পরে আবার শুরু হল সেই পোকা পোকা চিৎকার। দেখতে দেখতে ভিড় জমে গেছে। কারো কারো চোখ গোল্লা হয়ে গেছে আর ছোট বাচ্চারা মজা পেয়ে হেসে উঠছে।

    এবার নবারুণও হাসতে শুরু করল।

    --- পোকা! পোকা! চারদিকে পোকা। পোকার বাড়ি। ছোট পোকা দুধ খাবে, বড় পোকা বাজারে যাবে। মাছ কিনে আনবে।

    আমার দমবন্ধ লাগছে। দেখলাম বড় মহারাজ অনিল মহারাজকে ডেকে কিছু বললেন, উনি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন।

    আমার কানের কাছে ক্লাস টেনের অমিয়দা ফিসফিস করল-- ওর বাড়িতে খবর দেওয়া হয়েছে। বাড়ি থেকে লোক আসছে, ওকে নিয়ে যাবে।

    কিন্তু এই তামাশা বেশিক্ষণ চলল না। আমাদের আশ্রমের এল এম এফ ডাক্তারবাবু ওঁর কালো ব্যাগ নিয়ে রিকশা থেকে নামলেন। নবারুণকে মন দিয়ে দেখে অনিল মহারাজকে ওইরকম ফিসফিসিয়ে কিছু বললেন, মহারাজও আগের মতো মাথা নাড়লেন।

    তারপর উনি একটা ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ বের করে কাউকে ইশারা করলেন। বাচ্চাটার বাঁধন খুলে দিয়ে দুজন চৌকিদার শক্ত করে ওর দুটো হাত চেপে ধরল। উনি স্পিরিট লাগানো তুলো দিয়ে বাচ্চাটার হাতে একটু ঘষে সুঁচটা পট করে বিঁধিয়ে দিলেন। একটা ওষুধ আস্তে আস্তে ঢুকছে।

    সুঁচ দেখেই নবারুণ পরিত্রাহি চিৎকার জুড়েছিল। এবার আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে পড়ল। তারপর ওর মাথাটা বুকের কাছে ঝুঁকে পড়ল। সিক রুমের বড়দা এসে এবার ওকে কোলে করে সিক বেডে নিয়ে গেলেন।


    নবারুণ চলে গেছে। ওর বাবা-কাকা এসে ওকে নিয়ে গেছেন। মহারাজ টিসি দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্নগুলো রয়ে গেল।

    কেন? কী হয়েছিল?

    ইতিমধ্যে ন'দা মানে সর্বজ্যেষ্ঠ বৃদ্ধ মহারাজ স্বামী নিরন্তরানন্দ অনেক দিন ধরে অসুখে ভুগে গত হয়েছেন।

    এখন রামকানাইদা মানে আমাদের ফেবারিট রাজসিক রুচির স্বামী শান্তিনাথানন্দ সেক্রেটারি মহারাজ।

    ন'দার চলে যাওয়াটা অদ্ভুত। দুপুর থেকেই শুনছি ডাক্তারবাবুরা জবাব দিয়েছেন, এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। সেই সময় এল রাত সাড়ে আটটায়। হঠাৎ হাঁউমাঁউ কান্না ও চিৎকারে আমরা ছেলের দল দৌড়ে গেলাম।

    খাটের উপর শুয়ে ন'দা; চোখ তুলসীপাতা দিয়ে বোজানো। খাটের চারদিকে ভিড় করে অনেক লোকজন, সবাই কাঁদছে।

    একজন সাদাচুলের মহিলা ঢুকলেন। বেশ এলিট চেহারা। উনি শায়িত দেহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বিলাপ করে কাঁদতে লাগলেন।

    -- আমি কতদূর থেকে তোমাকে দেখব বলে এসেছি, সেই সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি, কিন্তু ঠাকুর আমার ইচ্ছে পূরণ করলেন না!

    কান্নার রোল বেড়ে গেল। ইতিমধ্যে বিবাদী সুর বেজে উঠল। আশ্রমের কার্পেন্টারি বিভাগের মানিক মিস্ত্রী ভেতরে ঢুকে সরু মোটা নানান স্বরে সমবেত কান্না শুনে হঠাৎ হোঃ-হোঃ করে হেসে উঠল।

    কান্না থেমে গেল। সবার লাল চোখ ওর দিকে ফিরেছে। ও লজ্জা পেয়ে হুড়মুড়িয়ে পালিয়ে গেল।

    আমরা জানতে পারলাম যে শোকাকুল মহিলাটি ন'দার পূর্বাশ্রমের আপন বৌদি।

    উনি নাকি একসময় নেতাজির সহকর্মী ছিলেন। এ নিয়ে অনেক গল্প আছে। আমাদের ওয়ার্ডেন নন্দদা ও আরো দু'এক জন আশ্রমকর্মী বলতেন-- শৌলমারীর সাধুটি আসলে নেতাজী!

    সে যাকগে, শোনা গেল যে ক্লাস সেভেনের রুদ্রাংশু ও প্রতুল নাকি ন'দার প্রয়াণ নিয়ে প্যারডি গান বেঁধেছে, শাম্মী কাপুরের চায়না টাউনের হিট সং "বার বার দেখো, হাজার বার দেখো"র সুরে। আমাদের গুরু অমিয়দা বলল - ওই বাঁদর দুটোকে রোববার আমাদের ঘরে নিয়ে আয় তো! কী কী সব গান বেঁধেছে শুনব।

    --- শুনে? বাঁদরামির জন্যে ক্যালাবে?

    --- আমি এর মধ্যে নেই, ওরা নেহাত বাচ্চা ছেলে। যাদের ক্যালানো উচি্ত তাদের এক আঁটি কলমীশাকও ছিঁড়তে পারলে না? এবার বাচ্চাদের ওপর হাতের সুখ করবে?

    --- এই রঞ্জনটাকে নিয়ে আর পারি না। ওরা বাচ্চা, আর তোরা বুড়োর বাপ? আরে ডেকে আন, মারব কেন? যদি গান ভাল হয় তো দুপুর বেলা দু'পিস মাছ বেশি দেব।

    ওরা কাঁদো কাঁদো মুখে এল। কিছুতেই গাইবে না। অনেক করে সাধ্যসাধনা এবং ভয় দেখানোর পর ডুয়েট শুরু হলঃ

    "বল হরি বল,
    এ ন'দা মারা গেল,
    নদাকে ধরে নিয়ে টানাটানি কর ন'দা গো-ও-ও!
    ও নদা, তোমাকে ছাড়া আর চলছে না,
    মাঠে মাঠে দিনগুলো কাটছে না।
    --"।
    এমন সময় দরজায় কড়া নড়ে উঠল। আমরা হাসতে হাসতে উঠে দরজা খুলে ফ্রিজ! চৌকাঠে দাঁড়িয়ে স্বামী আপ্তানন্দ, মানে অনিলদা।

    অনিলদা বিদ্যেসাগরী চটি পরে দ্রুতপায়ে বারান্দার একমুড়ো থেকে অন্য মুড়োয় পৌঁছে যেতেন, প্রায় নিঃশব্দে। এই বিরল দক্ষতার গুণে ছেলেরা ওঁর নামকরণ করেছিল--প্রাইভেট বাস।

    ওঁর অনেক দায়িত্ব, কারণ উনি জুনিয়র স্বামীজি। সকালে কেউ প্রেয়ারে না গিয়ে ঘরেই ঘুমুচ্ছে কি না, বা প্রেয়ার হলে প্রার্থনার সময় চোখ বুঁজে ঢুলছে কি না--সব উনি সুপারভাইজ করতেন। সন্ধ্যের টিউটোরিয়লে কোন রুমে পড়াশুনো হচ্ছে আর কোন রুমে স্থানীয় মাস্টারমশাই নাক দিয়ে গিটারে সন্ধ্যা মুখার্জির লেটেস্ট গান শোনাচ্ছেন এসব দিকে ওঁর ছিল তীক্ষ্ণ নজর। আর রোববার বিকেলের দিকে ঘরে ঘরে ঢুকে ইনস্পেকশন, অর্থাৎ ঘর পরিষ্কার করা, বিছানার চাদর ধোয়া, হাত ও পায়ের নখ কাটা এগুলো দেখাও ওঁর ডিউটির মধ্যে।

    -- কী হচ্ছে এখানে?

    আমরা চুপ, কথা জোগাচ্ছে না।

    -- জুনিয়র ছেলে দুটো এখানে কী করছে? বড়দের ঘরে? বল।

    ওরা চুপ, ভয়ে কাঁপছে। করুণ মুখে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। আমরা কি ওদের ফাঁসিয়ে দেব? চোখে নিঃশব্দ বিনতি--- প্রভু মোরে, অবগুণ চিত ন ধরো!

    -- কী হল? প্রদ্যুম্ন? বিপ্লব? গলায় কিছু আটকেছে কি? দরজা বন্ধ ছিল কেন? সিগ্রেট খাচ্ছিলে?

    উঃ! অনিলদাকে নিয়ে পারা গেল না। বাচ্চাদের সঙ্গে সিগ্রেট খাব?

    --অমিয়? তুমি হলে সিনিয়র। তুমিই বল। দরজা বন্ধ করে এখানে কী হচ্ছিল? কোন মহৎ কর্ম?

    অমিয়দা থতমত খেয়ে বলে-- রিহার্সাল।

    অনিলদার ভুরু কুঁচকে যায়।

    --কিসের রিহার্সাল?

    -- গানের।

    --মানে?

    এবার আমাদের সম্মিলিত টিউবলাইট জ্বলে ওঠে।

    --হ্যাঁ মহারাজ গানের,-- গানের রিহার্সাল!

    --আসলে প্রেয়ারে একটা ছোট গানের দল সামনে বসবে, সুর ধরবে।

    মানে, ইদানীং প্রেয়ার বড্ড বেসুরো হচ্ছিল।

    -- কে বলেছে বেসুরো?

    --রামকানাইদা মানে বড় মহারাজ। উনিই তো বললেন কিছু গাইতে পারে ছেলে জোগাড় করে ওদের রিহার্সাল দিয়ে তৈরি করতে। উনি পরীক্ষা নেবেন। তারপর ওরা নিয়মিত সামনের সারিতে বসে গাইবে।

    গুরু এটা তুরুপের তাস খেলল। সবাই জানে অনিল মহারাজ বেসুরো, তাই ধ্রুপদ রাগপ্রধান পারঙ্গম বড় মহারাজ রামকানাইদা ওঁকে বেশ কৃপার চোখে দেখেন। আর অমিয়দা মহারাজের গানের দলের-- বিশেষ করে কালীকীর্তনের-- স্থায়ী সদস্য। অনিলদার সাহস নেই গান নিয়ে রামকনাইদার সামনে গিয়ে কিছু বলার।

    কিন্তু উনি ভাঙবেন তবু মচকাবেন না।

    --বেশ, কী রিহার্সাল হচ্ছিল শুনি।

    অমিয়দার ইশারায় আমি গম্ভীর হয়ে ঘোষণা করিঃ

    রাগ--মালকোষ, তাল--তেওড়া।

    তারপর সবাই মিলে উঁচু গলায় চেঁচিয়ে উঠিঃ

    “ক্ষাত্রবীর্য ব্রহ্মতেজ মূর্তি ধরিয়া এল এবার,
    গগনে পবনে উঠিল রে ঐ মাভৈঃ মাভৈঃ হুহুংকার"।
    অনিলদা কনফিউজড! সবাইকে একবার দেখে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন-- চালিয়ে যাও। কিন্তু ডাইনিং হলে আসতে দেরি কর না। এক্ষুণি বেল পড়বে।

    ও হ্যাঁ, অমিয়! তোমাদের তিনজনকে রামকানাইদা খাওয়ার পরে দেখা করতে বলেছেন। তোমরা কিসব রাতপাহারা শুরু করছ নাকি?


    রামকানাইদা ডেকেছেন!

    রামকানাইদা, মানে যিনি এখন বড় মহারাজ হয়েছেন। মোটাসোটা মাঝবয়েসী চশমা চোখে, একটু টাকমাথা, গেরুয়া পাঞ্জাবীর নীচে একটা মোটা বেল্ট দিয়ে ভুঁড়িটাকে একটু তুলে বেঁধে রাখেন। ওঁর পোশাকী নাম স্বামী শান্তিনাথানন্দ।

    তবে আমাদের সবাইকে উনি চুম্বকের মতো টানেন। আমরা সবাই ওঁর ভক্ত, ওঁর ফ্যান। উনি সাত্ত্বিক কম, রাজসিক বেশি। ওঁর ঘরের খাটে ফিনফিনে মশারিটি বেশ দামী; সিলিং ফ্যান ছাড়াও পাশের টুলে রয়েছে সিনি টেবিল ফ্যান, একটি ট্রানজিস্টর রেডিও; আর ছোট আলমারিতে বাংলা সাহিত্যের ভাল ভাল বই।

    ওঁর বাংলা, ইংরেজি ও সংস্কৃতে সমান দখল। রোজ রাত্তিরে খাওয়াদাওয়ার পরে কিছু ছেলে যায় ওঁর ঘরে। তাদের উনি অনেক গল্প শোনান। ঘরে সব আলো নিভে গিয়ে নীল আলো জ্বলে।

    আস্তে আস্তে ওঁর চোখে ঘুম নেমে আসে। কিছু বাচ্চাও হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। বাকিরা সবাইকে তুলে ঘরে ফিরিয়ে আনে।

    উনি আমাদের আশ্রমের ব্যান্ড পার্টি গড়ে দিয়েছেন। অনেকটা ইন্ডিয়ান নেভির মতো ইউনিফর্ম স্কার্ফ ও টুপি পরে আমরা ড্রাম, কেটল ও বিউগল বাজাই। আমিও শিখেছি কেটল ড্রাম বাজাতে। ১লা বৈশাখে, ১৫ অগাস্টে, ২৬ জানুয়ারিতে আমাদের ব্যান্ড পার্টি বরানগর মিউনিসিপ্যালিটির মাঠে পুলিশ ব্যান্ডের সঙ্গে পাল্লা দিত।

    উনি ক্রিকেট ম্যাচে কখনও সখনও আম্পায়ারিং করতেন। এল বি ডব্লিউয়ের নতুন নিয়ম উনি জানেন। প্রত্যেক বার আমাদের নাটকে উনি মিউজিক দিতেন। তার কিছু গান হিট হত; পরের দুয়েক বছরও সবাই সেগুলো গুনগুন করত। যেমন কুশধ্বজ নাটকে বলি চড়বার আগে মেমারির ফুটফুটে ছেলেটি গাইল-- "পায়ের ধুলো, দাও গো দাদা! সময় যে আর নাই-ই-ই; এবার আ-আমি যাই।" গান এমন হিট হল যে ছেলেটির আসল নাম হারিয়ে গিয়ে নতুন নাম হল --কুশে!


    ভর্তির সময়ই আমাদের হাতে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল একটি নীল রঙের পাতলা বই--সংগীত সংকলন, সম্পাদনা--স্বামী শান্তিনাথানন্দ।

    তাতে রামকৃষ্ণ আরাত্রিক থেকে শুরু করে প্রচুর গান-- সবগুলোর ওপরে রাগ ও তাল লিখে দেওয়া; পরিশিষ্টে মূল কয়েকটি তালের ঠেকার বোল ও মাত্রা এবং প্রধান রাগগুলোর ঠাট, জাতি, আরোহ, অবরোহ ও পকড় লিখে দেওয়া।

    সপ্তাহে কয়েকদিন সন্ধ্যেয় ওঁর ঘরে তানপুরা নিয়ে আসর বসত। আসতেন বরানগরের স্থানীয় মার্গসংগীতের গায়কেরা। আমি টিউটোরিয়াল থেকে পালিয়ে সেখানে চুপচাপ বসে থেকে শুনতাম, কখনও কেউ ধমক দেয় নি।

    সেবার টাকি মিশনের প্রোগ্রামে ওঁর সঙ্গে গেছি, স্টেজে জনৈক গায়ক গাইছেন অতি পরিচিত শ্যামাসংগীত-- "গয়া -গঙ্গা -প্রভাসাদি, কাশী- কাঞ্চী কে বা চায়; কালী কালী কালী বলে অজপা যদি না ফুরায়"।

    রামকানাইদার চোখ বড় বড়। গায়ক গান শেষ করে স্টেজ থেকে নামলে উনি তাঁকে কাছে ডেকে হাতে তাল দিয়ে দিয়ে দেখালেন যে গানটি ঝাঁপতালে, মানে ৫x২ মাত্রায়, গায়কের দম ছাড়ার ভুলে সেটা হয়ে যাচ্ছে তেওড়া, মানে ৭x২ মাত্রা।

    আমরা তিনজন বিকেলে রামকানাইদার অফিসে গেলাম। টাইপিস্ট মানিদা বসে বসে একটা চিঠি টাইপ করছিলেন। বল্লেন--তোরা একটু অপেক্ষা কর। মহারাজ একটা জরুরি ফোনে আছেন, বেলুড়ের সঙ্গে। তার পরেই আসছেন।

    অমিয়দা চুপচাপ থাকতে পারে না। বলে ওঠে -- মানিদার গাঁট্টা, পয়সায় আটটা!

    মানিদা হেসে ফেলেন।

    -- তোর কিসস্যু হবে না। সিনিয়র হয়েছিস, সেই চ্যাংড়া কে চ্যাংড়াই রয়ে গেলি! আর গাঁট্টা মারা কবেই ছেড়ে দিয়েছি, দীক্ষা নিয়েছি যে!

    অমিয়দা বলতে যাচ্ছিল যে গাঁট্টার সাপ্লাই কমে দাম বেড়ে গেছে। এখন পয়্সায় একটার বেশি হবে না, তক্ষুণি রামকানাই মহারাজ ঢুকলেন।

    কোন কারণে বেশ রেগে আছেন।

    -- তোরা এসব কী শুরু করেছিস? হয়েছেটা কী?

    আমরা চুপ। আমি টেবিল টপের সবুজ ভেলভেটের নকশা খুব মন দিয়ে দেখছি।

    -- কী রে প্রদ্যুম্ন? তোর কি মাথাটাথা একেবারেই গেছে? আর অমিয়, তুই বোধহয় পালের গোদা? রাত জেগে পাহারা দেওয়া? তাহলে পড়াশুনো কখন হবে? বাবা-মা কি এইজন্যে এখানে পাঠিয়েছে?

    কোনো উত্তর নেই। শুধু মানিদার আঙুল টাইপরাইটারে দ্রুত চলছে।

    এবার ওঁর সুর একটু নরম হল।

    --দেখ, একটা মাত্র ঘটনা ঘটেছে যেটা না ঘটলেই ভালো হত। আমার কাছে কমপ্লেন আসতেই কড়া স্টেপ নিয়েছি; ভবিষ্যতেও নেব--সে যেই হোক। তো? তোদের প্রবলেমটা কী? খামোখা স্টর্ম ইন এ টি-পট! এতে আশ্রমের বদনাম হবে না? তোরা সিনিয়র। তোদের থেকে আরও দায়িত্বপূর্ণ ব্যবহার আশা করেছিলাম। এবার যা! কোনো কিছু ঘটলে সোজা আমার কাছে আসবি।

    আমরা পেছন ফিরতেই উনি আবার ডাকলেন।

    -- প্রদ্যুম্ন, শোন। আগামী মাসেই উৎসব ও সাধুসেবা। প্রথম দিন পথের পাঁচালী সিনেমা দেখানো হবে, তারপরে পাপেট শো। পরের দিন ভক্তিগীতি-- রামকুমার চট্টোপাধ্যায় বলে ভদ্রলোক আর পূর্ণদাস বাউল; তার পরে যাত্রাপালা কংসবধ।

    শেষদিন তোদের-- ছাত্রদের। এবার কী নাটক করছিস? কর্ণার্জুন?

    -- না রামকানাইদা। ওটা গত বছর হয়ে গেছে। এবার আলেকজান্ডার-পুরু নিয়ে, নামটা মনে নেই। রিহার্সাল শুরু হয়ে গেছে।

    -- গানগুলো?

    আমি হেসে ফেলি।

    --দেখুন না; রিহার্সাল রোজ রাতে অনিলদা দেখছেন। কিন্তু একটা যুদ্ধবিজয়ের পর রাত্তিরে গ্রীকসৈন্যরা উৎসবে মেতেছে, গান গাইছে। কিন্তু অনিলদা বলছেন গানটা হবে "জয় রামকৃষ্ণ রামকৃষ্ণ বলরে আমার মন"!

    উনি হেসে ফেলেন। না; অনিলকে নিয়ে আর পারা গেল না। পুরু-আলেকজান্ডার তো বিসি জমানায়; তখন রামকৃষ্ণ?



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • প্রচ্ছদ | পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০ | পর্ব ১১ | পর্ব ১২ | পর্ব ১৩ | পর্ব ১৪ | পর্ব ১৫ | পর্ব ১৬ | ১৭ | পর্ব ১৮ | পর্ব ১৯ | পর্ব ২০ | "২১" | পর্ব ২২ | পর্ব ২৩ | শেষ পর্ব
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments