(একে চন্দ্র, দু’য়ে পক্ষ। সমুদ্র মন্থনেও দুই দল, এ ধরেছে শেষনাগের মাথা তো ও মুড়ো। এদিকে বিষ্ণুর মোহিনী মায়ায় সব লণ্ডভণ্ড। উঠল গরল, উঠল অমৃত। ভাই–ভাই ঠাঁই–ঠাঁই হল। আজও সেই দায় বয়ে চলেছি আমরা। এটি তারই এক আখ্যান, এক বাঙাল কিশোরের চোখে। এর ইতিহাস হওয়ার দায় নেই।)
রুশ কবি ভোজনেসেনস্কির একটি অণুকবিতা এ’রকমঃ
‘আমি রকেট,কালীপুজোর সময় ছাত থেকে বোতলের সাহায্যে ছাড়া হত হাউইবাজি, পরের প্রজন্মে রকেট বোম। তারাও ফিরে আসত প্যারাবোলার পথেই। কিন্তু প্যারাবোলার গঠন তো রেললাইনের মত সমান্তরাল নয়, বরং খানিকটা চুলের কাঁটার মতো; ফলে শুরুর বিন্দু আর শেষের বিন্দু একজায়গায় মেলে না। ভূমি একই, কিন্তু দুটোর মধ্যে বেশ কিছু তফাৎ থেকে যায়।
যতদূরেই যাই
ফিরে আসি এই পৃথিবীতে
--প্যারাবোলার পথেই।’
ব্যাপারটা বুঝতে পারছি এতদিন পরে পার্কসার্কাস বাড়িতে ফিরে এসে। শেষ এসেছিলাম ছোট ভাইয়ের ক্যান্সারে ভোগার সময় শেষ ক’টা দিন পাশে থাকব বলে।
কেটে গেছে দু’টো দশকেরও বেশি। ছত্তিশগড় থেকে রিটায়ার করে ফিরে এলাম কোলকাতায়, শেষজীবন গঙ্গার পাড়ে আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের মাঝখানে কাটাবো বলে।
সুপরামর্শ পেলাম — চলে যা পার্কসার্কাস বাড়িতে; কেউ নেই, তিনটে ঘর বাথরুম রান্নাঘর, দিনে তিনবেলা কলের জল, সামনে ধাঙড় বাজার। পয়সা দিলে বাঘের দুধও পাওয়া যায়। দু’পা হাঁটলেই ট্রাম-বাস-ট্যাক্সি। তোদের দুই প্রাণীর ভালই কাটবে। আর ভাড়া? মাত্র আটচল্লিশ টাকা।
সত্যি?
সত্যি না তো কই? গত পঞ্চাশ বছরে তিনজন বাড়িওলা বদলেছে। সবাই চাইছে এই প্রাইম জায়গায় কমার্শিয়াল কমপ্লেক্স আর ফ্ল্যাট তুলতে। সমস্ত ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের কিছু টাকা নিয়ে খালি করে দিতে বলেছে। ভবি ভোলে নি। কেউ খালি করে নি। তোর কোন চিন্তা নেই। হ্যাঁ, আশি বছরের পুরনো কন্সট্রাকশন। কিছু পয়সা খরচ করে সারিয়ে নিয়ে সাজিয়ে বসবি; ব্যস। তবে শিফট করার আগে দেখে শুনে নে।
সেই দেখেশুনে নিতেই আজ আসা।
তফাৎ বেশ খানিকটা।
ছোটবেলার ধাঙড় বাজার কবেই বদলে গেছল। দোতলা হয়ে চারপাশে কাঁচ লাগিয়ে চেহারাটা কুশ্রী। আর পাশের যে খালি জায়গাটায় জলসা হত --- বিসমিল্লার সানাই, বাহাদুর খাঁর সরোদ, রৌশনকুমারীর ঘুঙুর আর শামতাপ্রসাদের তবলার বোলের যুগলবন্দীর স্বরবিতান পাশের গলির বদ্ধ হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো কাঁঠালের ভূতি আর মরা বেড়ালের ছানার দুর্গন্ধ ছাপিয়ে চারপাশের ভাড়াবাড়িতে গাদাগাদি করে মাথাগুঁজে থাকা হরিপদ কেরানিদের বৈকুন্ঠের আভাস এনে দিত — সেখানে এখন গজিয়ে উঠেছে পাকাপোক্ত নতুন বাজার। একসময় পার্ল রোডের যে দিক থেকে মুজতবা আলী হেঁটে এসে সার্কাস মার্কেট প্লেসের কোনায় আসাদ মেডিকেল হলে ডাক্তার গণির ডিস্পেনসারিতে আড্ডা দিতে আসতেন, সেই জায়গাটায় ডাস্টবিনের জঞ্জাল উপচে উঠে রাস্তার উপর ছড়িয়ে রয়েছে। সাবধানে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলি। বাড়ির মুখে এসে ধাক্কা খাই। যে ছোট্ট শানবাঁধানো গলিমত জায়গাটায় রবাবের বল দিয়ে ক্রিকেট খেলতাম সেখানে এখন গাঁ থেকে উৎখাত হওয়া একটি পরিবার মাটিতে বিছানা পেতে পলিথিন বিছিয়ে সংসার পেতেছে। এদের আস্তানার পাশেই একটা ড্রেনের জালি যার ওপাশে একটা ময়লা ফেলার ড্রাম থাকত। বৃষ্টি পড়ছে ঝির ঝির। ওরা পাশের দেয়ালে পেরেক ঠুকে পলিথিনের শিট টাঙিয়ে জলের ছাঁট থেকে বাঁচার করুণ চেষ্টা করছে। তার মধ্যেই এক নারী ছোট বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোয় ব্যস্ত, পাশেই হামা দিচ্ছে আর একটি শিশু।
সন্তর্পণে ওদের গা বাঁচিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছি চোখে পড়ে বাঁকের মুখে দেয়ালের গায়ে পেন্সিল দিয়ে অপটু হাতে লেখা — নীলি তুমি গাধা!
আরে, এটা তো আমারই লেখা, ক্লাস থ্রি-তে। মনে পড়ে নিচের তলার নীলি ওরফে নিলোফার তিনদিন আমার সংগে কথা বলে নি। দু’দিনের মাথায় আমি গিয়ে এফ বি পেন্সিলের ওই দাগ দেয়াল থেকে ঘসে ঘসে মুছে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলাম। শেষে দীনেন্দ্র কুমার রায়ের “ডাকাতের মুখোমুখি” আর খগেন্দ্রনাথ মিত্রের "ভোম্বল সর্দার” লাইব্রেরির থেকে দু’দুবার রিনিউ করিয়ে ওকে পড়িয়ে সন্ধি হয়েছিল।
নিলোফার এখন কোথায়? জানি নে।
কাকিমার কাছ থেকে শুনেছিলাম বিয়ের পর মাথায় গণ্ডগোল দেখা দিলে অতি সুভদ্র পাত্রপক্ষ বলেছিল যে ব্যামো হলে ওকে বাপের বাড়িতে ছেড়ে যাবে। সেরে গেলে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। বাবা-মা গত হওয়ায় দু’ভাইয়ের সংসার। হেঁসেল আলাদা হলেও খাবার ঘর আর খাবার টেবিল কমন। বড় টেবিলটিতে মাঝখানে কুরুশ কাঁটায় বোনা সাদা সবুজ রঙের স্কার্ফ বিছিয়ে হিন্দুস্তান -পাকিস্তান করে দেওয়া। বড় ভাইয়ের পরিবার খেতে বসবে সাদার পাশে, ছোটভাই সবুজের। দু’ভাইয়ের, থুড়ি দু’ভাইবৌদের মধ্যে শর্ত হল গলায় পড়া ছিটেল বোনটিকে পালা করে খাওয়াতে হবে। তাই নীলির থালা এক মাস টেবিলের এদিক, আর অন্য মাসে ওদিকে। কোন মাস ৩১ দিনে হলে কি লিপ ইয়ারে, এক পক্ষ থালা সরাতে ভুলে গেলেও অন্য পক্ষ খেয়াল করে ভুল শুধরে দেয়। ধুলো জমে থাকা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠি।
না; ১/বি-র ফ্ল্যাটটাতে কেউ নেই। না যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী হওয়া কমিউনিস্ট নেতা আবদুর রজ্জাক খান সাহেব, না ওঁর বড় ছেলে নামী অভিনেতা মমতাজ আমেদ, যাঁর অভিনীত সাদা-কালো ফিলিম ‘কেদার রাজা’, ‘বাঘিনী’ আজও দুপুরবেলায় বাংলা চ্যানেলে দেখা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ওই ফ্ল্যাটের বারান্দায় নগরবধূরা সেজেগুজে দাঁড়াতেন এবং নীচের থেকে বৃটিশ টমির দল উইক-এন্ডে এক কোয়ার্টার মাস্টারের নেতৃত্বে উলটো দিকের ফুটপাথ থেকে উলফ হুইসলিং করে দৃষ্টি আকর্ষণ করত এবং দরদাম করে উপরে উঠে আসত, আজ তা বিশ্বাস করা কঠিন।
বাঁদিকে ঘুরে আমাদের ১/সি ফ্ল্যাট। সবুজ দরজার পাশে সবুজ রঙ করা লেটারবক্স, তাতে সাদা রঙ দিয়ে কণা-কাকার সুন্দর হাতের লেখায় ইংরেজি হরফে লেখা ‘দি রয়েজ’। মুচকি হাসিটা গলায় আটকে যায়। এজি বেঙ্গলের অডিট ক্লার্ক ভদ্রলোক ফেবার এন্ড ফেবার থেকে নিয়মিত ধ্রুপদী ইংরেজি সাহিত্যের বই কিনতেন। এলিয়ট ছিলেন ওঁর প্রিয় কবি। এই বাড়িতেই আমার ছোট ভাইয়ের ক্যান্সারের চিকিৎসার ভার উনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। তালা না খুলে ছাদে যাই। ও পাশে গুপ্ত পরিবারের কেউ কেউ এখনও রয়েছেন। মেয়েরা বিয়ে হয়ে অন্য কোথাও মনে হয়। ওদের বড় মেয়ে নাচ্চুদি ছাদের চোর-পুলিশ খেলায় আমাদের নতুন নতুন গোনার ছড়া শেখাতেন।
যেমনঃ
‘এক লাঠি চন্দন কাঠি চন্দন বিনে কা-কা,বা
ইজি-বিজি-সিজিটা, প্রজাপতি উড়ে যা।’
‘দার্জিলিং পাহাড়ে বসে ছিল একটি মেয়ে,আর এইটাঃ
আমি তাকে বললাম--তোমার নাম কী?,
সে বলল – আমার নাম পদ্মজা নাইডু।’
‘অফ দ্য ফোর, ডব দ্য ফোর,--এই রঞ্জন, ভ্যাবলা কোথাকার! শিগগির একটা রঙের নাম বল।
মাংকি চুজ এ ব্ল্যাক বোর,
হোয়াট কালার ডু ইউ চুজ?’
--নীল।
--দূর হাবা, ইংরেজিতে।
-- ব্লু।
--ওকে; বি-এল-ইউ-ই। এক, দুই, তিন, চার-- তুই আউট!
সেই নাচ্চুদি এক মুসলমান যুবকের প্রেমে পড়ে নিকে করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। তাহলে লাভ জেহাদ সব যুগেই ছিল। একটা সিনেমা দেখেছিলাম — ‘ইশক পর জোর নহীঁ’।
অবাক কাণ্ড! ওদের ছাদের চিলেকোঠার পাশে এখনও রয়েছে কিছু নাটকের পোস্টার, পাতলা কাঠের বাটামে কিছু স্ট্রাকচার। রংজ্বলা, ভাঙা, ছেঁড়াখোঁড়া তবু রয়েছে। বুঝতে পারি এগুলো তৃপ্তি মিত্রের শেষ জীবনে নাটক আঁকড়ে বাঁচার শেষ ট্র্যাজিক লড়াই। ক্যান্সারে কুরে কুরে খাচ্ছে ভেতরটা, মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে নিজের দল ‘বহুরূপী’। মুখ ফিরিয়েছেন স্বামী-- প্রবাদপ্রতিম শম্ভু মিত্র। উনি আপোষ করবেন না, মাথা নোয়াবেন না। গুপ্ত পরিবারের ছোট ছেলে অশোক গুপ্ত (আমাদের ছোটবেলার আলো) রমাপ্রসাদ বণিকের বন্ধু, বহুরূপী থেকে বেরিয়ে এল ওর ‘জ্যেঠিমা’ তৃপ্তি মিত্রকে নিয়ে। তুলল ওই ছোট্ট ফ্ল্যাটে, রিহার্সাল চলল ছাদে, প্রপ্স চিলেকোঠায়। আমাদের মত পিগমি লোকজন দূর থেকে দেখত এক হার-না-মানা নারীর একটু একটু করে হেরে যাওয়ার নাটক।
ময়লা আকাশ। কোন ঘুড়ি ওড়ে না আজকাল। লাটাই আর মাঞ্জার দোকানগুলো কি বন্ধ হয়ে গেল? আর আওয়াজ ওঠে না – দুয়ো ক্কো! বাড়ে না ক্কো!
অর্থাৎ যে ঘুড়ি ভয়ের চোটে উঁচুতে উঠে প্যাঁচ খেলতে সাহস করছে না তাকে প্যাঁক দেওয়া।
অনেক আগে সব বাড়ির ছাদে থাকত রেডিওর এরিয়েল, বাঁশের মাথায় টাঙানো, ভাল কোয়ালিটির হলে তারের জালের বুনুনি। এল দূরদর্শন। কোলকাতার ছাদ ভরে গেল এলুমিনিয়মের পাইপ আর তার গায়ে ছোট ছোট ধাতব কাঠি, যেন পাশ্চাত্য সঙ্গীতের স্বরলিপি! মাঝে মধ্যে সেগুলো যেত হাওয়ায় নড়ে। অমনই ঘরের মধ্যে টিভির পর্দায় মানুষজন গুগাবাবা সিনেমার ভূতের নেত্য শুরু করে দিত। একজন ছাদে গিয়ে টিভি এরিয়েলকে ওয়েদার ককের মত ঘোরাত, আর চেঁচিয়ে জানতে চাইত ঠিক হয়েছে কী না!
ঠিক যেন এক্কাদোক্কা খেলার শেষ দিকে চোখ বন্ধ করে দান ফেলা আর এক পা’ এক পা’ ফেলে জিজ্ঞেস করা ‘আম রাইট? আম রাইট?’ (অ্যাম আই রাইট?)!
নেমে আসি নিচে। তালা খুলে ঘরে ঢুকি। ডিসি লাইনের কাঠের বাটাম দেওয়া ওয়্যারিং-এর গায়ে টিকটিকির দল। জানলার খড়খড়ির গায়ে ধুলো। এই জানলায় উঠে বসে শুকতারা, শিশুসাথী, স্বপনকুমার পড়তাম।
মাটিতে মাদুর পেতে বসে মা পড়ছেন রমাপদ চৌধুরির ‘লালবাঈ’। দেওর এনে দিয়েছে অফিস লাইব্রেরি থেকে। ক্লাস ফোরের বাচ্চার ওসব বই ছোঁয়া বারণ। বড়দের বই। একেই ছেলেটা সারাক্ষণ কান পেতে বড়দের ‘পেরাইভেট’ শোনে। কিন্তু গল্পের জাদুর আকর্ষণ অমোঘ, সে উঠে পড়ে জানলার ওপরে একটুখানি বসার জায়গায়। সেখানে বসে মায়ের ঘাড়ের উপর দিয়ে পড়ে ফেলে নভেল, একের পর এক। মা কি বুঝতে পারতেন না?
রান্নাঘর। কয়লা আর গুলের ড্রাম তাদের আরশোলা পরিবার নিয়ে অনেক আগেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। গ্যাসের উনুন এসেছে অনেক দিন। তাই রান্নাঘরের দুটো বিশাল উনুনও নেই। তেলজ্বলা নীলচে ধোঁয়ায় জানলার শিকে আর তেলচিটে মোটা পরত নেই। কলতলা। কলের জলের নীচে নর্দমায় আরশোলার শুঁড় দেখা যাচ্ছে। বাথরুম। একটা উঁচু চৌবাচ্চা। ছোটবেলায় মগ দিয়ে এর থেকে জল তোলা সহজ ছিল না। শ্যাওলা শুকিয়ে আছে। এখনও বাথরুম কী ঠান্ডা। নাক টানলে হারিয়ে যাওয়া সোঁদা গন্ধ টের পাচ্ছি।
এবার ফেরার পালা।
বারান্দার সিমেন্টের জাফরি কাটা রেলিঙয়ের পলেস্তারা খসে পড়ছে। ঘুলঘুলিতে আর চড়াই বাসা বাঁধে না। সামনে এত বড় বাজার। কাক চিল ওড়ে না কেন? সামনে বুবুলদের বাগানের তালগাছ কবে কাটা হয়ে গেছে!
মেজকার কোলে উঠে ওটার দিকে তাকিয়ে বলতাম — তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে।
ওদের বাড়িটা তো বিক্রি হয়ে গেছে। অচেনা সব লোকজন। আর যখন তখন ওদিকের ঘর থেকে গ্রামোফোনে কলের গান বাজে না। এখানে দাঁড়িয়েই বাচ্চাটা শুনতে পেত সন্ধ্যা মুখার্জি বলছেন — আর ডেকো না সেই মধুনামে। দুটো লাইন চমকে দিত — ‘মালারও শপথ লাগি ভুলো না আমারে, কাঁদাও কেন যে শুধু ভালোবাসো যারে।’
ধীরে ধীরে ওর মগ্নচৈতন্যে কুয়াশার মতো ছড়িয়ে পড়ত--ভালবাসায় কাঁদতে হয়, কাঁদাতে হয়।
আচ্ছা, পেছনের কুন্ডুদের বড়ছেলে বাবলুদা কি এখনও রাত বারোটায় মাতাল হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ‘যা যারে যা, যা পাখি’ গেয়ে নাচে? যেমনটি দু’দশক আগে দেখেছিলাম?
দরজায় তালা লাগিয়ে নেমে আসি। কড়েয়া রোডের দিকে বাঁক নেওয়ার মুখে এলাকার সবচেয়ে বড় ডেইলী নীডস এর দোকান – মমতাজ স্টোর্স। স্বাধীনতার আগে থেকেই দোকানটি চালু হয়েছিল। ওর শ্রীবৃদ্ধি হয় ছেলে শামসুদ্দিনের হাতে। নম্র ভদ্র ব্যবহার, সৌম্যদর্শন; ফলে গ্রাহকদের মধ্যে জনপ্রিয়। ভাবছি দোকান থেকে ভাল বিস্কুট আর একটা শেভিং ক্রিম কিনব। কাউন্টারের ওপাশে অপরিচিত সব চেহারা। মুখ ফুটে বলে ফেলি — শামসুদ্দিনকে দেখছি না?
সদ্য গোঁফের রেখা এক কিশোর বলে — বড়ে আব্বার দশ বছর হল ইন্তেকাল হয়েছে।
পেছনের রাস্তায় শেলীডাক্তারের মেডিক্যাল স্টোর্স উঠে গেছে। ওঁর ছেলেটির ছিল বদমেজাজ। ছাদ থেকে রবারের বল উড়ে এসে কাউন্টারে ড্রপ খেলে সহজে ফেরত দিত না। এখন মনে হয় আমরাও কোন ধোয়া তুলসীপাতা ছিলাম না।
উলটো দিকেই ডোমিনিয়ন টি এন্ড কোং। এক বুড়ো সাদা দাড়ি চোখে চশমা সবসময় কোন একটা বইয়ের পাতায় মগ্ন হয়ে থাকতেন। ওঁকে দেখলেই পাঠ্য বইয়ের এস ওয়াজেদ আলির ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে’ লাইনটা মনে পড়ে যেত।
আমরা গেলে কিনতাম হাতি-ঘোড়া বিস্কুট, ত্রিফলা লজেন্স আর মিষ্টি সার্কাস বিস্কুট — যার গায়ে একপায়ে ঘোড়ায় চড়ে ব্যালান্স করা একটি মেয়ের খুদে আকার দ্যাখা যেত। আসলে বাবা-কাকাদের মমতাজ স্টোর্সে কড়া হুকুম দেওয়া ছিল যে রায়বাড়ির খুদে গ্রাহকদের হাতে যেন ব্রিটানিয়া থিন অ্যারারুট ছাড়া অন্য কোন বিস্কুট না দেওয়া হয় ।
এবার রাস্তাটা বেঁকে ওয়েস্ট রো-তে মিশেছে। এই কোনাতেই পরিখার সেলুন। বিহারের কোন গ্রাম থেকে আসা নরসুন্দর পরিখা। দাদু আমাদের দুইভাইয়ের হাত ধরে ওখানেই চুল কাটাতে নিয়ে যেতেন। আমরা চাইতাম জয় হেয়ার কাটিং হলে যেতে। ওখানে অনেকগুলো আয়না, গদি আঁটা রিভলভিং চেয়ার। অনেক ছেলেরা আড্ডা দেয়, কত রঙবেরঙয়ের গল্প!
এখানে মাত্র দুটো আয়না, দুটো কাঠের চেয়ার। আর একটা কাঠের বেঞ্চি। কোনে একটা আধময়লা সিংক। দূর ছাতা! তবে এই সেলুনের রেট অনেক কম। ওটাও বন্ধ নাকি?
দরজা খোলা পেয়ে ঢুকে যাই। অন্ধকার ঘুপচি মতো প্রায় তিনকোনা একটা ছোট ঘর — তখন এত ছোট মনে হত না তো! দুটো চেয়ার। গদি ছেঁড়া, পেরেক বের করা। দুটো ছেলে খালি গায়ে বসে ছিল। আমাকে দেখে হড়বড়িয়ে জামা গায়ে দেয়। ওরা কোন খদ্দের আশা করে নি।
বলি — লাইট জ্বালাও, পাখা চালু কর।
ওরা অস্বস্তিতে মাথা চুলকায়, জানায় ওটা সম্ভব নয়। কারণ কর্পোরেশন লাইন কেটে দিয়েছে। সন্নাটা! সন্নাটা! বেরিয়ে যাব, এত অল্প আলোয় আর গরমের মধ্যে আধঘন্টা বসে চুল কাটানো সম্ভব নয়। কিন্তু কিছু না ভেবেই আমি টি-শার্ট খুলে পাশের চেয়ারের মাথায় লটকে দিয়ে অন্য চেয়ারটায় বসে পড়ি।
বেলা যায় নি। দরজাটা হাট করে খুলে রাখলে যা আলো আসবে তাতে শেভিং হয়ে যাবে। ওরা বাটি থেকে জল নিয়ে আমার গাল ভিজিয়ে কাজ শুরু করে। আমি পরিখার কথা জিজ্ঞেস করি। ওরা জানায় যে শরীর খারাপ হওয়ায় গাঁয়ের বাড়িতে শেষ জীবন কাটিয়েছে। প্রায় আশি বছর বেঁচে ছিল। এরা ওর ভাইপো ও নাতি। একটা আয়নায় জং ধরেছে। দেয়ালের এক কোণে ক্যালেন্ডার থেকে কেটে ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা ক্ষুদিরামের ফাঁসির ছবিটা ষাট বছর পরেও টিকে আছে! খালি নীল সাদা ছবিটা আরও হলদেটে হয়ে গেছে।
মন দিয়ে ছবিটা দেখি। হাত বাঁধা গলায় ফাঁসির দড়ি ডোরাকাটা জেলের পোশাক পরা ক্ষুদিরাম আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। পাশে হ্যাট কোট ক্রস বেল্ট বুট পরা জেলর সাহেব মন দিয়ে হাতঘড়ি দেখছেন। অন্য হাতে একটা রুমাল। নিচে ক্যাপশন — একবার বিদায় দে মা, ঘুরে আসি।
উকিল দাদু সেলুনে বসে ছবিটা দেখিয়ে আমাদের মজঃফরপুরের কিংসফোর্ড হত্যা মামলা এবং ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকীর গল্প শুনিয়েছিলেন।
--ইলেক্ট্রিক বিল কাহে নেহি পটায়া?
-- আমদানি নেহি হ্যায়, সরকার। চারো তরফ অচ্ছে অচ্ছে দুকান খুলা হ্যায়। ইস গলিকুচে মেঁ কৌন আয়েগা?
-- ব্যাংক সে লোন লেও। দুকান কো সাজাও। ফার্নিচার বদলো। দিক্কত ক্যা হ্যায়?
-- দিক্কত হ্যায় সাহাব। পরিখা নে দুকান কা কাগজ গবাঁ দিয়া থা। লোন ক্যায়সে মিলেগী? অব পুরানে মালিক কা লড়কেলোগ কহতে হ্যায় খালি করো। মারপিট কোর্ট কাচেরি সব হো গয়া।
দাড়ি কামানো শেষ। আফটার-শেভ নেই; তাই জল মেশানো ডেটল লাগিয়ে দেয়। কত দিতে হবে? ওরা কিন্তু কিন্তু করে বলে — আপনি যা দেবেন।
আমি পকেটে হাত দিই। একটা দশটাকার নোট হাতে ঠেকে, ওদের হাতে ধরিয়ে চটপট বেরিয়ে আসি। ওরা পড়ন্ত আলোয় নোটটা তুলে ধরে যাচাই করতে থাকে।
এবার ট্রাম ডিপোর দিকে এগনো যাক। দু’পা এগিয়ে বালু হক্কাক লেন হয়ে ঝাউতলা রোড ধরে ট্রামলাইন। ঝাউতলা রোড বললেই আমার মনে দোতারা বেজে ওঠে। বাউল পবন দাসের সাধনসঙ্গিনী মিমলু সেন। প্রেসিডেন্সি ও দিল্লিতে পড়া প্যারিস ফেরত বোলপুরে বাউলের সঙ্গে ঘর বাঁধা মিমলু এখানেই পৈতৃক বাড়িতে বড় হয়েছেন যে! আমার থেকে মাত্র একবছরের বড়। আচ্ছা, তখন যদি পরিচয় হত?
কড়েয়া রোড থেকে ডানদিকে মুড়ে বালু হক্কাক লেনে ঢুকছি, চোখে পড়ে ইংরেজ আমলের গ্যাসলাইট — দু’একটা এখনও টিকে আছে। নাঃ, শুধু লোহার খাম্বাটাই, সবুজ কাঁচে মোড়া ষটকোণীয় গ্যাসলাইট নেই। সেরকম গ্যাসলাইট লন্ডনের বেকার স্ট্রিটে রয়েছে; স্বপনকুমারের বিশ্বচক্র সিরিজের গোয়েন্দা গল্পের কভারেও ছিল। এবার ট্রামলাইন দেখা যাচ্ছে।
হঠাৎ পা দুটো পাথর। বেজে উঠেছে হারমোনিয়াম আর ঢোলক, গান শুরু হয়েছে — ‘হাওয়া, এ হাওয়া, তু মুঝকো বতা দে, দিলদার মিলা দে।’
কিন্তু – কিন্তু তখন তো ঢোলক বাজে নি, শুধু হারমোনিয়াম। সেটা ছিল ছোট্ট গায়ক দল, বাবা আর মেয়ে। কুচকুচে কালো লোকটার গায়ে শস্তা সিল্কের জামা, গলায় রুমাল, পরনে চক্রাবক্রা লুঙি। মাথায় রাঙতা দিয়ে সাজানো একটা টুপি। ওর মুখের কষ দিয়ে গড়াচ্ছে পানের পিক আর গাল বেয়ে ঘাম, বৈশাখের রোদ্দুরে পিচগলা রাস্তার মতো। তবে ওর আঙুলে জাদু আছে, হারমোনিয়াম কথা বলছে।
‘দিল দেকে দেখো, দিল দেকে দেখো, দিল দেকে দেকো জী,এই গানটা বেজেছিল? কেন?
ইয়ে দিল লেনেবালে, দিল দেনা শিখো জী।’
আরে সালটা যে ১৯৬০। আজ থেকে অর্ধশতাব্দী আগে। ভরদুপুরে রঞ্জন দরজার পাশের জানলায় চড়ে ছিটকিনি খুলে ফেলেছে। আর পা টিপে টিপে বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়। ফোর পাস করে ফাইভে উঠেছে, কিন্তু ঘরে আর মন বসে না। দুপুরে হোমটাস্ক করে রেডিও শোনা, তারপর?
ঠাকুমা আঁচল পেতে ঠান্ডা মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়েছেন। একটা নীলমাছি জানলার কাঁচে বারবার আছড়ে পড়ছে। ও জানলা খুলে মাছিটাকে বলে গুডবাই! তারপর ইশারায় ভাইকে বলে বেরিয়ে গেলে দোরটা দিয়ে দিতে। চুপিসাড়ে।
তারপর নিখাদ টো-টো কোম্পানি।
আচ্ছা, এই রাস্তাটা কোথায় গেছে? ওই বাঁদিকে বেঁকে যাওয়া গলিটা? ও হাঁটতে থাকে, হেঁটেই চলে। ওর খিদে তেষ্টা পায় না। গলা শুকোলে কর্পোরেশনের টিউকল ভরসা, একটু মিঠে কষকষ স্বাদ।
ঝিম ঝিম দুপুরে ঠেলাওয়ালারা ঠেলার উপরেই গামছায় মুখ ঢেকে ঘুমিয়ে নিচ্ছে। মণিমেলার মাঠের পাশে মস্ত বড় বটগাছ। তার নিচে একজন ছাতু মেখে বিক্রি করে। ওর খদ্দেররা এসে গাছের নিচে ফুটপাথের উপর খবরের কাগজ বিছিয়ে বসে, নয়তো হাঁটু মুড়ে উবু হয়ে। ঝকঝকে মাজা পেতলের কাঁসিতে করে দেয়া হয় একদলা ছাতু আর কাঁচা পেঁয়াজ। ঠিক কাকিমার হাতের সর্ষের তেল দিয়ে মাখা আলুসেদ্ধর গোল্লার মতো। কোথাও মাঠের মধ্যে দুই কপোত-কপোতী (এই শব্দটা রঞ্জন তখন নতুন শিখেছে) শান্তিনিকেতনি ঝোলা পাশে রেখে চিনেবাদাম খেতে খেতে বকবকম করছে। কোন মা দুরন্ত ছেলেকে কানে মোচড় দিতে দিতে ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। কোথাও দেখছি মাদারি কা খেল! ডুগডুগির আওয়াজের সঙ্গে বাচ্চা মেয়েটা কেমন একটা দড়ির উপর হাতে একটা লাঠি নিয়ে ব্যালান্স করে হেঁটে যায়!
আরে, কী সুন্দর সেতারের ঝংকার! হঠাৎ খেয়াল হয় সুরটা চেনা চেনা। ও দাঁড়িয়ে পড়ে । হ্যাঁ, আকাশবাণীতে শুনেছে আর পাশের বাড়ির গ্রামাফোনে; -- শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এল না। গানটায় কেমন কান্না কান্না ভাব। এর পাশের সিংহওলাবাড়িটা ওর চেনা। ওই ঘোষালবাড়িতে ও মাঝে মাঝে দাদুর সঙ্গে ভাগবত পাঠ শুনতে আসে। শেষ হলে বাতাসা আর নকুলদানা পাওয়া যায়। ওটাকে বলে ঘোষাল বাড়ি। ওদের বাড়ির জীবন ঘোষাল ইংরেজ আমলে স্বদেশী করতে গিয়ে চন্দননগরে ফরাসী এলাকায় লুকিয়েছিলেন। পুলিশ বাড়ি ঘিরে ফেলে। দু’পক্ষেই খানিকক্ষণ গুলি চলে। পরে গুলিতে ঝাঁঝরা শরীরটা পুকুরে ভেসে ওঠে। এসব দাদু শুনিয়েছিলেন।
কিন্তু এ বাড়ির গায়ে একটা শ্বেতপাথরের ফলকে লেখা--‘রেয়াজ’। নিচে লেখা দুটো নাম — এনায়েত খাঁ আর বিলায়েৎ খাঁ।
এইসব গুরুত্বপূর্ণ ভ্রমণের পর বাড়ি ফিরতে দেরি হবে সে আর কি এমন! তবে কয়েকবার এমন হওয়ার পর বাড়িতে বড়দের মিটিং বসল। বাপ-মা-ছোটভাই ভিলাইয়ে। এই দুটো আমাদের ভরসায়। কিন্তু এমন না বলে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ালে ভয়ের কথা। কিছু হয়ে গেলে কে দায়িত্ব নেবে? তাই হোস্টেলে দেওয়া ভালো। এমনিতে গার্লস স্কুলের ক্লাস ফাইভ, মানে এবারই শেষ। আগামী বছর যখন স্কুল বদলাতেই হবে তখন কোন হোস্টেলে কেন নয়? রামকৃষ্ণ মিশনের কোন আশ্রমে? এর বাবা-মা তো মিশনে দীক্ষিত, ওখানে দিলে কোন চিন্তা নেই। বাঁদর হয়ে ঢুকবে, মানুষ হয়ে বেরিয়ে আসবে!
অ্যাই ছেলে! কথা শোন। আর কয়েকটা মাস, লক্ষ্মী হয়ে থাক, তারপর তো আমাদের ছেড়ে যাবি। তোর ছেলেধরার ভয় নেই? বেমক্কা গাড়িঘোড়ার? কথা দে, নইলে ভিলাইয়ে ছেড়ে দিয়ে আসা হবে।
ভ্যাঁ করে কেঁদে কথা দিয়েছিলাম আর রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াব না। হোস্টেলে যাব না, আমাকে এই বাড়িতে থাকতে দাও, কাছের মডার্ন স্কুলে ভর্তি করে দাও। ওই যে যেখান থেকে ছোটকা পাশ করে স্কটিশ না কি একটা কলেজে গেছে?
ঠিক আছে; কিন্তু তুইও ভাল হয়ে থাক; আর যেন একা একা দুপুরে বেরোস না। রাজি?
কিন্তু দাদু যে শুনিয়েছিলেন রঙ্গলাল — স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে, কয়ে বাঁচিতে চায়!
কেউ চায় না, আমিও না।
আরও শুনিয়েছিলেন হেমচন্দ্র — বাজ রে শিঙ্গা বাজ এই রবে, সবাই স্বাধীন এ বিপুল ভবে, সবাই স্বাধীন মানের গৌরবে, ভারত শুধুই ঘুমায়ে রয়!
তো আমিই বা দুপুরে ঘুমিয়ে থাকব কেন? থাকব না কো বদ্ধঘরে, দেখব এবার জগতটাকে।
উনিই বা আমাকে এত সব শোনাতেন কেন? প্রথম জীবনে ইংরেজ সরকারের দপ্তরে চাকরি করে কোন গ্লানিবোধ পুষে রেখেছিলেন কি?
আচ্ছা, এই একবার, শেষবার। এই বলে বেরিয়ে পড়েছিলাম।
চটকা ভেঙে দেখি মেয়েটি। আমার চেয়ে বছর চারেকের বড় হবে, মানে মেরেকেটে চোদ্দ। তাই তখন অনেক বড় মনে হত। ওদের ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়ানো নানান মাপের দর্শকদের হাসি, সিটি ও লোভে জ্বলজ্বল চোখের সামনে ও নির্বিকার ভাবে দাঁড়িয়ে। পরনে একটা টিয়ারঙা ঘাঘরা আর গোলাপি ব্লাউজ। চোখের কাজল ঘামে লেপ্টে গেছে। ঠোঁটে গালে সামান্য রঙের আভাস। ও বাবার সঙ্গে গলা মিলিয়ে ধুয়ো ধরে। তারপর অন্তরা গেয়ে দু’পাক নেচে নেয়। সে নাচে কোন আনন্দ নেই, ওর মন নেই। কলের পুতুলের মতো একটু হাত-পা নাড়ে। মনে হয় রোজ যেভাবে ঘরে বাসন মাজে, ঘর পরিষ্কার করে, সেভাবেই এই নাচ-গান করে করে হয়তো একঘেয়ে হয়ে গেছে। আচ্ছা, ওর বাবা ওকে খেলতে দেয়? এক্কাদোক্কা? গোল্লাছুট, কবাড্ডি, দাড়িয়াবান্ধা? কমসে কম রুমালচোর? ওরা থাকে কোথায়?
গান শেষ হয়ে গেছে। মেয়েটা লোকজনের যামনে এলুমিনিয়ামের বাটি ধরে; কেউ কেউ দেয় । বেশিরভাগ দেয় না। ওরা এগিয়ে চলে পরের মোড়ের দিকে। এবার অন্য গান--
‘কয়েদ মেঁ হ্যায় বুলবুল, সইয়াদ মুস্কুরায়ে,এভাবেই একের পর এক গান শেষ হয়, ওরা পয়সা কুড়োয়, এগিয়ে চলে। মোড়ের পরে মোড়, গানের পরে গান। আর নিশিতে পাওয়া ঘোরের মতো ওদের পেছনে পেছনে চলে রঞ্জন।
কুছ কহা ভী ন জায়ে, অঊর রহা ভী ন জায়ে।’
‘খাঁচায় বন্দী বুলবুল আর ব্যাধের মুচকি হাসি,
বুক ফাটে, তবু ফোটে না যে মুখ, গলায় লেগেছে ফাঁসি।’
বেলা পড়ে আসছে। ওরা চার নম্বর পুলের কাছে। সামনে চামড়ার কারখানার চড়া গন্ধ। রঞ্জন কিছুই টের পায় না। ও একাগ্র হয়ে শুনছে নতুন গানটাঃ
‘ছুপ ছুপকে খড়ে হো, জরুর কোই বাত হ্যায়, পহলে মুলাকাত হ্যায় জী, পহলে মুলাকাত হ্যায়।’
‘দাঁড়িয়ে আছ চুপি চুপি, আছে কোন গোপন কথা,মরেছে! মেয়েটা কি ওকে দেখতে পেয়েছে? গানটা কি ওর জন্যে? সেটা আর জানা গেল না। কেননা ওর পিঠের ওপর একটা ভারি হাতের চাপ।
এ আমাদের প্রথম দেখা, এ আমাদের গোপন ব্যথা।’
--অ্যাই, তুই এখানে কী করছিস রে!
চমকে তাকিয়ে দেখে পেছনের ফ্ল্যাটের বাবলুদা। এই দিকেই কোথায় কিছু একটা করে, হয়তো চামড়ার কারখানায়।
--কী রে, তোর বাড়িতে জানে? বুঝেছি, পড়াশুনো নেই খালি টো-টো কোম্পানি? চল, বাড়ি চল।
বাবলুদা শক্ত করে ওর হাত চেপে ধরে।
নাঃ, তখনই বুঝে গেছলাম যে আমার মিশনের হোস্টেলে ভর্তি হওয়া এবার কেউ ঠেকাতে পারবে না।
কিন্তু তার আগে তো শিশুবিদ্যাপীঠ গার্লস স্কুলের গল্প শোনাতে হয়।