(একে চন্দ্র, দু’য়ে পক্ষ। সমুদ্র মন্থনেও দুই দল, এ ধরেছে শেষনাগের মাথা তো ও মুড়ো। এদিকে বিষ্ণুর মোহিনী মায়ায় সব লণ্ডভণ্ড। উঠল গরল, উঠল অমৃত। ভাই–ভাই ঠাঁই–ঠাঁই হল। আজও সেই দায় বয়ে চলেছি আমরা। এটি তারই এক আখ্যান, এক বাঙাল কিশোরের চোখে। এর ইতিহাস হওয়ার দায় নেই।)
“বেজে ওঠে রেডিও, সর্বদাই গোলমাল করতে রেডি ও”
কিশোর কবি সুকান্ত এসব ছড়া লিখেছিলেন সম্ভবতঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিনগুলিতে বেলেঘাটায় বসে। আমাদের বাড়িতে রেডিও এল ১৯৫৭ সালে, তখন ক্লাস টু’তে পড়ি। এর আগে কাকারা রেডিও ভাড়া করে আনতেন মহালয়ার একদিন আগে, বাড়ির সবাই ভোর চারটেয় উঠে ‘শ্রী মহিষাসুরমর্দিনী’ শুনবে যে! সেটা আসলে কালীবাবুর ইলেক্ট্রিকের দোকানে তৈরি লোক্যাল সেট, খালি কোলকাতা ক’ স্টেশন শোনা যায়। সে যাই হোক, ভোর ভোর রহস্যে ঘেরা সকালে বেজে ওঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের মন্দ্রস্বরে ‘যা চণ্ডী-ই -ই মধুকৈটভহারী দৈত্যদলনী, যা রক্তবীজাশনী’, একটু পরেই শোনা যায় ‘আশ্বিনের শারদ প্রভাত’। একটা হালকা চাদর গায়ে জড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে শুনি আলোর বেণু বেজে উঠছে, জেগে উঠছেন মহামায়া চণ্ডিকা। আমি শুনতে পাচ্ছি তাঁর তা-তা-থৈ তা-তা-থৈ নৃত্য। কেউ ডাক পাঠাচ্ছেন —ওগো আমার শরণময়ী আলো, জ্বালো প্রদীপ, জ্বালো। আমি ঘরে থাকতে পারি না। টুক করে দরজা খুলে ছাদে গিয়ে ঠান্ডা বাতাসে ঘুরে বেড়াই। চারপাশের সমস্ত বাড়িতে রেডিও বাজছে, ভোরের আকাশে রঙ লাগছে সমবেত প্রার্থনায় – রূপং দেহি, জয়ং দেহি, যশোদেহি দ্বিষো জহি।
একটা ঘোরের মধ্যে নীচে নেমে আসি। আজকে সবাইকে খুব ভালো লাগে। বিচ্ছিরি রান্না করে কাজের মানুষ সুবলদা, তাকেও। সামনের সার্কাস হোটেল থেকে গোমাংসের শিককাবাব সেঁকার একরকম পোড়া গন্ধ আসছে, আমি টের পাই না। নীচে কর্পোরেশনের জমাদার ময়লা তুলছে, ডাস্টবিনে জমা আবর্জনায় নাড়া পড়েছে — আমার খারাপ লাগে না। কাকিমারা বলেন – যা তো, এই কার্ড নিয়ে রাস্তা পেরোলেই দেখতে পাবি হরিণঘাটা ডেয়ারির দুধের ডিপো। সেখানে এই দুটো খালি বোতল দিয়ে হলুদ কার্ডে টিক লাগিয়ে দু’বোতল গরুর দুধ নিয়ে আয়।
আমি একছুটে চলে যাই। ডিপোর পাশেই বাজারের সর্বজনীন ইউরিনাল। জমে থাকা সবুজ পেচ্ছাপের ইউরিয়ার ঝাঁঝে শ্বাস টানা মুশকিল। আমার কিছুই মনে হয় না, আজকের দিনটা অন্যরকম। পুজো আসছে!
কিন্তু রেডিও চলে গেল। এসেছিল দু’দিনের জন্যে ভাড়া খাটতে।
বাড়ির সবার মন খারাপ, মুখ চুণ করে ঘুরে বেড়াই আমরা বাচ্চারা। মা গিয়ে ছোট দুই দেওরকে ধরেন। কী গো সমীর, কী গো ন’ঠাকুরপো? এইডা যেন কেমন হইল। কিছু একটা করেন। মা কইতাছিলেন।
দুই দেওর আমতা আমতা করে এড়িয়ে যান। রেডিও আবার এল পরের বছর মহালয়ার সময়, তবে দু’দিন আগে। আহা, কী আনন্দ আকাশে বাতাসে! রইল তিনমাস। দুপুরবেলা বাড়ি খালি। রেডিও চলছে, সামনে বসেছে মা-কাকিমা-ঠাকুমা এবং কাজের মাসি শেফালি। মাসি একটু পরে রেডিওর পেছনে গিয়ে চোখ কুঁচকে কিছু দ্যাখে। ফের দুটো গান, ফের মাসির উঁকিঝুকি। কী ব্যাপার শেফালি?
কিছু না বৌদি। আমি একটু ওই বাচ্চাটারে দ্যাখতে চাই।
বাচ্চা? কোন বাচ্চা?
ওই যে, এই বাস্কোটার ভেতরে বসে গান গাইছে যে!
দমফাটা হাসির হররা! সব শুনেও মাসির বিশ্বাস হয় না। এটা কী করে হয়? কত মাইল দূরে বসে কেউ গান গায় আর সেটা এখানে ঘরে বসে আপনারা শুনতে পান? আমি তো বুকা, তাই আমাকে নিয়ে মজা করছেন?
তিনমাস পরে সে রেডিও গেল কাকাদের ব্যাচেলর্স ডেন নয়াবাড়িতে। অর্থাৎ উল্টোদিকের দত্তদের বিশাল দোতলা বাড়ির মেজেনাইন ফ্লোরে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে গ্যারেজের উপর এক চিলতে ঘর। দাঁড়িয়ে হাই তুললে হাত ছাতে গিয়ে ঠেকে। সেখানে চারকাকা এবং পিসতুতো দাদাদের মুক্তাঞ্চল। সারি সারি ছ’টা বিছানা সতরঞ্চি পেতে পরিপাটি করে রাখা। কোণের দিকে একটা প্রাইমাস স্টোভ আর মেথিলেটেড স্পিরিটের শিশি। যখন তখন চা বানাতে অপরিহার্য। রয়েছে পাতলা কেরোসিন কাঠের টুকরো কেটে তৈরি কয়েকটি বইয়ের র্যাক, তাতে ছোট পেরেক ঠুকে পুরনো শাড়ি কেটে ছোট ছোট পর্দা — যাতে বইয়ে ধুলো না জমে।
নীচে সিঁড়ির মুখে একটা কল, মাঝে মাঝে জল পাওয়া যায়। কিন্তু আমার এক কাকা এখানে স্নান করতে আসেন না। এই আড্ডার ছায়াও মাড়াতে চান না। কারণ উনি কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারি, এজি বেঙ্গলে অডিট ক্লার্ক, এই আক্রার বাজারে সদ্য চাকরি পেয়েছেন। আর ওপরের ঘরটির দেয়াল জুড়ে মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিন, স্ট্যালিনের বাঁধানো ছবি। সুকান্ত, মাইকেল ও রবি ঠাকুরও রয়েছেন।
আর কে না জানে – যেখানেতে ঘটে যত অনিষ্টি, সকলের মূলে কমিউনিষ্টি!
সাবধানের মার নেই।
আমি গুটি গুটি সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে যাই। গোল গোল চোখ করে দাড়িওলা দেবতাদের দেখি। উনি কে?
কাকারা হাসেন। ওঁরা তোমার দাদু হন। এদিকে লেনিন দাদু, ওদিকে স্ট্যালিন দাদু। আমার এ’দুটো নাম মুখস্থ হয়ে যায়। পরে বোকারোতে বাবাকে একটা কন্ডেন্সড মিল্কের কৌটোয় অমন দাড়িওলা মুখের ছবি দেখে --এঁরা আমার দাদু, লেনিন ও স্ট্যালিন দাদু বলায় বাবার হাতের থাপ্পড় জুটেছিলো।
সে যাই হোক, আমি নয়াবাড়িতে গেলেই অন্য দুনিয়ায় এন্ট্রি পাওয়ার স্বাদ পাই। একটা অন্যরকম গন্ধ। নানারকম বই। ঘরটায় পাখা নেই। জামা খুলে বসে পড়ি। কত বই। একটা ক্রিম কালারের বই। তাতে সবুজ রঙে দুটো বাচ্চা ছেলে মেয়ের মুখ, পেছনে সবুজ গাছপালার মোটিফ। বইটার নাম পথের পাঁচালী। এতদিন লক্ষ্মী আর সত্যনারায়ণের পাঁচালী জানতাম। পাতা উল্টাই। এ কীরকম যেন!
হরিহর রায়ের জীর্ণ কোঠাবাড়ির বর্ণনা। সন্ধের দিকে এক গৌরবর্ণা বধূর ঘাট থেকে জল নিয়ে ফেরা। খোকার জন্ম। জে-জে-জে করে শিশুর অস্ফুট গানের বর্ণনা। পিসির কাছে দুর্গার ছড়া শেখাঃ
‘ও ললিতে চাঁপকলিতে একটা কথা শুন সে,এ কী ভাষা? চোর ধরা পড়ল কি না সেটা বলা নেই কেন? এই দুনিয়ার সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। কিন্তু আমাকে কোন অমোঘ আকর্ষণে টানে। চড়ুইভাতি। ম্যালেরিয়া। দুর্গার মৃত্যুর বর্ণনা। আকাশের নীল পেরিয়ে ডাক আসে। সে ডাকে সাড়া দিলে চলে যেতে হয়। শেষে একটি অমোঘ লাইন। ‘দুর্গা আর চাহিল না।’
রাধার ঘরে চোর ঢুকেছে চূড়োবাঁধা এক মিনসে।'
আমার স্বপনকুমারের ‘বিশ্বচক্র সিরিজ’-এর গোয়েন্দা গল্প পড়ে বই পড়ার দীক্ষা, পড়ি ঝড়ের বেগে। কারণ মেজদার লাইব্রেরি থেকে একদিনের কড়ারে চেয়ে আনা বই তিনজনে পড়ে ফেরৎ দেব যে। কিন্তু এই বইটি পড়তে তাড়াহুড়ো করতে মন চাইছে না। বিকেলের ছায়া নেমে আসে। ছোটকা আলো জ্বেলে দেয়। আমাকে মন দিয়ে দ্যাখে।
কী কাণ্ড! তোর কোন সাড়া শব্দ নেই, সবাই খুঁজছে। আরে প্রায় শেষ করে এনেছিস। এখন ও বাড়ি যা, মুড়ি খেতে ডাকছে। কাল দুপুরে এসে পড়ে নিস।
অসুবিধে নেই। মর্নিং স্কুলে ভর্তি হয়েছি। দুপুরে স্নান খাওয়া করে ফ্রি। হোমটাস্ক? সন্ধেয় নিয়ে বসা যাবে।
রোজ দুপুরে নয়াবাড়ি অভিযান আমার রুটিনে এসে গেল। পড়ে ফেলি জ্যাক লন্ডন। সমুদ্র, জাহাজ, মাতাল, বক্সিং আমাকে মাতিয়ে দেয়। একটা গল্পের শেষের লাইন -- ‘ঝড়ের মুখে তাকে পেয়েছিলাম, হাঙরের মুখে তাকে হারালাম’— মনে গেঁথে যায়। এরপর হাতে পাই লালচে রঙের মলাটে কালো পোঁচ দিয়ে লেখা নাম ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’। প্রথম পাতাতেই তালগাছের নীচে দাঁড়িয়ে শশী ডাক্তারের বন্ধু হারাধনের বাজপড়ায় ঝলসে যাওয়া। অল্পবয়েসি মেয়ে মোতির এক যাত্রাকরা যুবকের প্রেমে পড়ে গাওদিয়া নাকি বাজিতপুর গাঁ ছেড়ে কলকাতায় আসা। আচ্ছা, আমাদের বাড়ির সবাই তো ময়মনসিং জেলার বাজিতপুর গাঁ থেকে কোলকাতায় এসেছে। তো তোমরা এই মোতি বলে মেয়েটিকে চেন?
এটা অন্য বাজিতপুর, একটা গ্রামের নাম, ব্যস।
কিন্তু এহ বাহ্য, আসল তো রেডিও। রোজ দুপুরে এবাড়ি এসে আকাশবাণী শুনি। শনি-রবিতে অনুরোধের আসর। কোন কোন দিন ঝাঁ ঝাঁ গরমে মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম, কাকারা ঘুমোয়। আমাকে বলা হয় খুব আস্তে করে যদি শুনতে পার। আমি ভল্যুমের কান মুচড়ে কমিয়ে দিয়ে প্রায় রেডিওর গায়ে কান লাগিয়ে শুনি হেমন্তকুমারের গলায় ‘এই রাত তোমার আমার, এই চাঁদ তোমার আমার, শুধু-উ-উ দুজনে’। আমার ভরা দুপুর অন্ধকার রাত হয়ে যায়। লতার গলায় শুনি ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’। শেষে লতা যখন বলেন ‘আমি পারি নি ফিরায়ে তারে আনতে’, আমার গলার কাছে কি একটা দলা পাকিয়ে ওঠে। ছোট পিসি একদিন দেখতে পেয়ে বলে — কী হয়েছে? কেউ বকেছে?
আমি মাথা নাড়ি। তবে এই রকম করতাছস ক্যারে? আমি রেডিওর দিকে আঙুল তুলে দেখাই। পিসি বুঝতে পারে না। আমি বলি – এই গানটা। চশমার ফাঁকে চোখ আরও গোল হয়ে ওঠে।
--বেশি পাকামি করবি না, বুঝলি? আম সময়ের আগে বাত্তি হইলে পোকায় ধরে।
কিছুই বুঝি না। শেষে খড়গপুর থেকে সেজকাকা একদিন আর একটা লোক্যাল সেট রেডিও নিয়ে এল। তার পেছনে একটা চশমার কেসের মত, তাতে দুটো এভারেডি ব্যাটারি বসানো। সেটার থেকে তার বেরিয়ে রেডিওতে জুড়েছে। ব্যস, ওটা এল মূল বাড়িতে, বাইরের ঘরে। এখন সকাল থেকে গান। সাতটা চল্লিশে চারশ’ আটচল্লিশ দশমিক আট মিটারে কোলকাতা ক’ ধরলেই শুনি নামী গায়কের রবীন্দ্রসংগীত। তারপর নজরুলগীতি, পল্লীগীতি। তখনও লোকসংগীত শব্দটি বাজার চলতি হয় নি। তবে বাজারে এসে গেছে নয়া পয়সা, পড়ার বইয়েও। আমরা শিখছি চার পয়সায় এক আনা নয়, ছ’পয়সায়। দু’আনা বারো পয়সায়। কিন্তু চার আনা হল ২৫ ন প। আট আনা ৫০ ন প। এক টাকা মানে ১০০ পয়সা। নতুন শব্দ শুনলাম মেট্রিক পদ্ধতি।
রেডিও চালালে কেউ মানা করে না। খালি বিকেলের দিকে ঠাকুমা বলেন — হইছে, এইবার যন্ত্রটারে একটু বিশ্রাম দাও।
সন্ধেবেলা দাদু এসে রেডিওর পাশে চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়েন। উনি শোনেন পল্লীমঙ্গল আসরে মোড়ল, কাশীনাথ ও গোবিন্দ’র খুনসুটি। তারপর চাষবাস নিয়ে মৌসুমী ফসল নিয়ে এক্সপার্ট ওপিনিয়ন। তাকিয়ে দেখি ওঁর চোখে ঘোর লেগেছে। মনে মনে উনি এখন ময়মনসিং জেলার আঠারবাড়িয়া গ্রামে এবারের পাটচাষের হাল হকিকত নিয়ে ওঁর গোমস্তা মোম আলি ওরফে লাউয়া মিঞার সঙ্গে গভীর আলোচনায় ডুবে গেছেন। একদিন আমাকে ডেকে বললেন--শুন, আইজ তালগুড় সংঘের ম্যানেজার সোমেশ হোমচৌধুরি অতিথ, কিছু কইবেন।
আমার মাথায় একবর্ণ ঢুকল না। এই বিরস আলোচনায় আমি বাচ্চাছেলে ক্লাস থ্রিতে পড়ি — মেরা ক্যা কাম হ্যায়?
আরে, ওই সোমেশ হইল তর মাসতুতো দাদা। মেজ মাসীর ছেলে খুকু।
ওঃ খুকুদা! তাই বল, কিন্তু রেডিওতে কী করছে?
দুরহ ব্যাডা আউয়াখানা! অলম্বুষ! খুকু কমিউনিস্ট পার্টি করত ছাত্র জীবনে। তেভাগা আন্দোলনে জেলে গেল। সেইখান থেইক্যা পরীক্ষা দিয়া ম্যাট্রিক পাশ করল। পরে এম এ পাশ কইর্যাই তালগুড়ের ম্যানেজার হইছে, সরকারি চাকরি। কী বুঝলি?
জেলে তো চোর-ডাকাতেরা যায়। খুকুদা খারাপ কাজ করতে গেল কেন? আর আমার সংগে দেখা হলে এক সের তালগুড় দেবে?
দাদুর রক্তচক্ষু এবং দন্তঘর্ষণ ও আমার ছাদে পলায়ন। এরপর দাদু খবর শুনে তবে রাতের খাওয়া খেতে রান্নাঘরে যাবে। ইংরেজি খবর বুঝতাম না, কিন্তু ভাল লাগত যাঁরা পড়তেন তাঁদের গলার স্বরের ওঠা নামা। দুটো নাম মনে পড়ে – মেলভিল ডি’মেলো ও সুরজিৎ সেন। একজন মহিলাও পড়তেন, উনি নাকি সুরজিতের বোন। বাংলায় আদি যুগে ছিলেন বিজন বোস। পরে ইভা নাগ পরিশীলিত উচ্চারণে বেশ জনপ্রিয় হলেন। আর একটু পরে এলেন বিশিষ্ট স্টাইল নিয়ে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। আমরা কান পেতে থাকতাম শেষের দিকে খেলার খবরের জন্যে।
কিন্তু রাতের রেডিও নেশা ধরিয়ে দিয়েছিল বেতার নাটকের। প্রতি বৃহস্পতিবার, আবার পল্লীমঙ্গল আসরেও কোন কোন বুধবার নাটক হত। মোড়ল ওরফে সুধীর সরকার পরিচালনা ও অভিনয় দুটোই ভাল করতেন। পৌরাণিক, ঐতিহাসিক ও সামাজিক – সবরকম নাটক। রাজনৈতিক নাটক হত না। এভাবেই শুনি মাধবীকংকণ, কংসবধ, কানু কহে রাই, ভাড়াটে চাই, তাহার নামটি রঞ্জনা। এগুলোর প্রযোজনার কৃতিত্ব বাণীকুমার ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের।
নামকরা পাবলিক স্টেজের নাটক গোড়ার দিকে বেতারে হত না বললেই চলে। তবু একবার শুনেছিলাম বহুরূপীর ‘ছেঁড়া তার’, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র এবং কুমার রায়। চতুরংগ।
ষাটের দশকের শেষে পরিবর্তন এল। পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় কোলকাতার লোকায়ন বলে একটি গ্রুপ থিয়েটারের ‘দ্বীপের রাজা’ অসাধারণ লেগেছিল।
এভাবেই আমরা ভক্ত হয়ে পড়ি সলিল চৌধুরির কথা ও সুরে গাওয়া লতা মঙ্গেশকরের পুজোর গানের। প্রতিবার পুজোয় দুটো করে বেরোয়, রেকর্ডের দু’পিঠে। ‘কাজল নদীর জলে’, ‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে’, ‘না যেওনা’, আর ‘যা রে যারে উড়ে যারে পাখি’। কিন্তু কথা মুখস্থ করে স্কুলের বন্ধুদের শোনাই ‘মধুমালতী ডাকে আয়’ এবং ‘আর ডেকো না সেই মধু নামে’ — সন্ধ্যা মুখার্জীর গলার খনক অন্যরকম মায়ায় জড়ায়, বিশেষ করে ‘মায়াবতী, মেঘে এল তন্দ্রা’। বন্ধুরা অবাক হয়। রেডিওতে শুনে কথা মুখস্থ? তুই কি সেই যে শ্রুতিধর না কি বলে, তাই? গম্ভীর মুখে ঘ্যাম নিয়ে সরে যাই। ওদের বলা হয় না যে আমি ওদেরই মত। নয়াবাড়ির দোতলার দত্ত পরিবারের বুবুল আমার বন্ধু। ওদের বাড়ি গেলে ওরা একটা গ্রামোফোন নিয়ে তাতে রেকর্ড চাপিয়ে বাজায়, আমি যে গান শুনতে চাইব ওর দিদি সেটাই লাগিয়ে দেন। তারপরে একটা হাতল বাঁই বাঁই করে ঘুরিয়ে দম দেওয়া হয়। তারপর একটা স্টিলের মুণ্ডু মত, তাতে কাঁটা লাগানো, সেটা রেকর্ডের উপরে ছুঁইয়ে দেন। কয়েক সেকেন্ড পরেই বেজে ওঠে ‘মধুমালতী’। আবার সনৎ সিংহ বলে এক ভদ্রলোক বেশ মজার গান গাইতে পারেন। ‘বিদ্যেবতী সরস্বতী, এসব কথা লিখছি তোমায় নালিশ করে নয়’। কিন্তু সবসময় এত সুখ সইত না ।
কাকামণি তখন ব্যারাকপুরের এয়ারফোর্সে কাজ করেন। শনিবার শনিবার বাড়ি আসেন, গা এলিয়ে দেন নয়াবাড়ির কোন একটা বিছানাতে। উনি আমাকে ‘ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে’ গাইতে শুনে খেপচুরিয়াস। সিনেমার যত ফালতু গান! শেষে আমাকে ‘ভাল’ গান শেখাতে বসলেন। পকেট থেকে বের করলেন একটা চারপাতার কাগজ। সাদার মধ্যে কালো অক্ষরে ছাপা গোটা আটেক গান। ওপরে ছোট করে লেখা কথা ও সুর সলিল চৌধুরি। প্রথম গান —‘ধিতাং ধিতাং বোলে, মাদলে তান তোলে’। উনি পুরোটা গেয়ে শোনালেন, এবার আমার পালা। আমি বিদ্রোহ করলাম — এই ধিতাং ধিতাং এর মানে কী ? এরকম শব্দ তো কখনও শুনিনি । যত্ত আজেবাজে গান।
উনি ধৈর্য হারিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন — আজেবাজে গান! এগুলো কি সিনেমার গান?
দুপুরবেলায় এসে হাজির হতেন তাঁর এক বন্ধু হরিপ্রসাদ সেনগুপ্ত। আজকের প্রখ্যাত নাট্যপরিচালক রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের বড়দা। আমি রান্নাঘরে চায়ের ফরমাস পৌঁছে দিতাম। তারপর একটা কেটলি করে গরম চা নিয়ে আসতাম। একটু পরে দুই বন্ধুর মধ্যে তুমুল ঝগড়া শুরু হত; দীর্ঘদেহী হরিপ্রসাদ উঠে দাঁড়াতে গিয়ে নীচু ছাদে ঠোকর খেতেন। বলতেন — বিজন, এই শেষ, আর আসব না।
কাকামণি গম্ভীর মুখে বলতেন – শুনে খুশি হলাম। এসো না।
পরের দিন যথাসময়ে হরিপ্রসাদ হাজির, যেন কিছুই হয় নি। কয়েকঘন্টা পরে আবার একই নাটকের রিপিট পারফরমান্স। উনি চলে গেলে আমি ছোটকাকে বলি – এরা এত ঝগড়া করে কেন, বাচ্চাদের মত?
--ঝগড়া না তো, ওগুলো তর্কবিতর্ক।
--কেন করে?
--তুই বুঝবি না; পলিটিক্স নিয়ে তর্ক; ওরা কমিউনিস্ট পার্টি করে।
--কমিউনিস্ট হলে অমন বিচ্ছিরি ঝগড়া করতে হয়, বন্ধুর সংগে? আমি বড় হয়ে কমিউনিস্ট হব না।
ছোটকার হাসি আর থামে না। আদর করে কান মলে দিল।
কিন্তু তার পরে একটা অন্যরকম দিন এলো। কাকামণি বাড়ি এলেন এক মঙ্গলবারে। একটু পরেই হাজির বন্ধু হরিপ্রসাদ। সেদিন তাঁরা কথা বলছিলেন খুব নীচু গ্রামে, কোন ঝগড়াঝাঁটি নয়। আমি চা আনতে গেলে মা বললেন – দুধ আর চিনি ফুরিয়ে গেছে রে, মেজ ঠাকুরপো বিকেলে অফিস-ফেরতা নিয়ে আসবে।
আমি ছাদে খেলতে চলে গেলাম। দুপুরে খাওয়ার সময় কাকামণি চেপে ধরলেন — কি রে, সেই যে চা আনতে গেলি তারপর পাত্তা নেই! ব্যাপারটা কী?
আমি আমতা আমতা করে বললাম যে তোমার বন্ধুর সামনে গিয়ে সত্যি কথাটা বলতে লজ্জা করছিল, তাই।
কাকা সস্নেহে বললেন – ঘরে টাকা নেই, চায়ের দুধ চিনি নেই এতে লজ্জার কী আছে? আমরা কোন পাপ করিনি তো।
সন্ধেবেলায় বড়দের কথাবার্তা থেকে কানে এল — কমিউনিস্ট পার্টি করার দোষে কাকামণির চাকরি গেছে। এয়ারফোর্সে নাকি এসব অপরাধ।
দিন যায়, আমি এক এক করে গোটা কয়েক ক্লাস পেরিয়ে যাই। নয়াবাড়িতে এসে বইপড়ার নেশা আরও পেয়ে বসে। আমি শিশুবিদ্যাপীঠ গার্লস স্কুল থেকে ফাইভ পাস করে বরানগরে রামকৃষ্ণ মিশনের হোস্টেলে যাই। গরমের ছুটি আর পুজোর ছুটিতে বাড়ি এলেই দুপুর বেলা সেই নয়াবাড়ি। নতুন নতুন বই। অন্য ধরনের বই। পড়ে ফেলি ‘ভোলগা থেকে গঙ্গা’ আর মুলকরাজ আনন্দের ‘দুটি পাতা, একটি কুঁড়ি’। পড়া হয়ে যায় সুকান্ত, গোলাম কুদ্দুস ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা। নেড়ে চেড়ে দেখি জীবনানন্দ দাশ বলে একজন কবির বই। কাকা আবৃত্তি করে ‘বনলতা সেন’। কিছু বুঝতে পারি না, তবে ভালো লাগে। দু’একটা ম্যাগাজিন দেখি — পরিচয়, বিংশ শতাব্দী, নন্দন। ওদের গল্পগুলো কেমন কঠিন কঠিন। প্রবন্ধগুলো? ওরে বাবা!
ভালো লাগে বাংলা অনুবাদে সোভিয়েত সাহিত্য, মানে তলস্তয়, চেখভ, গোর্কি। দস্তয়েভস্কি বুঝতে পারি না। কিন্তু শলোকভের চার খণ্ডে ডন? দারুণ। আর দুটো বই খুব ভালো লেগেছিল, বুঝতে না পারলেও। একটা “হাজার বছরের প্রেমের কবিতা” – অবন্তী কুমার সান্যাল ও জয়ন্তী সান্যালের সম্পাদনায়; অন্যটি ‘পঞ্চাশ বছরের প্রেমের গল্প’ — সুবীর রায়চৌধুরি সম্পাদিত।
রবীন্দ্র রচনাবলী এসে গেছে, শতবার্ষিকী সংস্করণ। নাটকগুলো আমাকে পাগল করে। মিশনের স্কুলে অভিনীত হল শারদোৎসব আর অচলায়তন। আর ক্যাম্প হোস্টেলে আমরা করলাম ‘খ্যাতির বিড়ম্বনা’ এবং 'ডাকঘর'। ছুটিতে নয়াবাড়িতে পড়লাম চিরকুমার সভা, রক্তকরবী, মুক্তধারা আর বাঁশরী। অন্য দুনিয়া হাতছানি দিচ্ছে। উপন্যাসে দাঁত ফোটাতে পারি নি। কিন্তু অবাক করল ‘শেষের কবিতা’। এ’রকম গতিময় ভাষা আর শব্দের ছবি আগে কোথাও পাই নি। তারপর ক্লাস এইটের এক গুমোট দুপুরে পড়ে ফেললাম ‘চরিত্রহীন’। মাই গড! এ কি! কিরণময়ীর উপেন্দ্রকে লুচি বেলে দিতে দিতে সিডিউস করার চেষ্টা, সতীশের কেমন বাংলা সিনেমার আস্কারা পাওয়া নায়কের মত হাবভাব — তাতে একরকম মজা। কিন্তু উপন্যাসের শেষের দিকে বর্মায় কিরণময়ীর সংগে পালিয়ে যাওয়া দেওর দিবাকরের কিছুদিন পরে ‘বুকের ভেতর হইতে যে রাক্ষস বাহির হইয়া আসিয়াছে তাহার সহিত অবিরাম সংগ্রাম’ –! এমনও হয়? এ ও কি সম্ভব? তেরো বছরের ছেলেটার গোটা শরীর তাজ্ঝিম – মাজ্ঝিম করে উঠল।
সে বাড়ি থেকে ঝটপট বেরিয়ে আমাদের আসল বাড়ির ছাদে উঠলাম। আকাশ কালো করে মেঘ জমছে, চিলের ঝাঁক উড়ে বেড়াচ্ছে। ঝড় আসছে।
আমরা বাচ্চারা ফুটপাথ আর গলির মুখে চার আনার রবারের বল নিয়ে ক্রিকেট খেলায় মশুগুল। ব্যাট করছে নীচের তলার আখতারদা--নিলোফারের ছোড়দা-- ক্লাস এইটে পড়ে। বল করছি আমি, ক্লাস টু। লোপ্পা বলটায় আখতারদা এমন মারলো যে রাস্তা পেরিয়ে সার্কাস হোটেলের বারান্দায় শিককাবাব তৈরির উনুনের পাশে গিয়ে পড়লো। ওরা গেল খেপে, বল আটকে রেখে দিল। আখতারদা গিয়ে কীসব বলে নিয়ে এল বটে, কিন্তু তারপর ব্যাটটা অভিজিতের হাতে দিয়ে নিজে বল তুলে নিল। শুনলাম আরেকবার ওদের রান্নার কাছে বল গেলে সেটাকে উনুনে ঠুসে দেওয়া হবে। হৃদয়হীন কসাই কোথাকার! খেলার উৎসাহ কমে গেল।
খেলায় বাধা পড়ল আরেকদিক থেকে। আমি যেখানে ফুটপাথ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বোলিং করছিলাম সেখানে এসে থেমেছে দুটো ট্যাক্সি, একটা বড়, আর একটা বেবি ট্যাক্সি । সেগুলো থেকে হাসিমুখে নামছেন ধুতি শাড়িতে সুসজ্জিত কয়েকজন পুরুষ ও মহিলা। একজন কিশোরীর হাত ধরে ভ্যাবাচাকা মুখে দু’টি বাচ্চা। দলটির হাতে দুটো মাটির ভাঁড় – মুখে কাগজ চাপিয়ে নীল-সবুজ সুতো দিয়ে বাঁধা। ওতে নিঘঘাৎ রসগোল্লা ও লালচে মিষ্টি দই! কাদের বাড়ি যাবেন এরা? এবার দলবেঁধে আমাদের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছেন দেখি!
হঠাৎ চারদিক কাঁপিয়ে বেজে উঠলো তিনটে শঙ্খ। একটাকে ছাপিয়ে আর একটা। একটার দম ফুরোয় তো আরেকটা শুরু করে। বাজছে দোতলায় আমাদের ফ্ল্যাটের দোরগোড়ায়। আমি এঁদের পেছন পেছন উপরে যাব ভাবছি, দেখি ঠাকুমা, মা ও ভেলিপিসি হুড়মুড়িয়ে নেমে আসছে আর এদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে এক আশ্চর্য আদিম রণধ্বনির মত আদিম আওয়াজ — উ-লু-লু-লু-লু-লু! উ-উ-লু-লু-লু-লু-লু!
অবাক হয়ে দেখি এদের হাঁ-মুখের ভেতর জিভ নড়ছে অবিশ্বাস্য দ্রুততায়। সেই কম্পন থেকে হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে ওই শব্দের ঢেউ-- উ-লু-লু-লু-লু-লু!
আগন্তুক দলটির সদস্যরা দোরগোড়াতেই ঢিপ ঢিপ করে ঠাকুমা সরযূবালাকে পেন্নাম ঠুকতে লাগল। আমাদের বাড়ির বারান্দা থেকে একটা বাক্য হাওয়ায় ঘুরে বেড়াতে লাগল--নাইয়র আইছে, নাইয়র!
নাইয়র কারে কয়? জানি না, কিন্তু আমি ঠিকই আন্দাজ করলাম যে এবার ওই দইমিষ্টির হাঁড়িগুলো রান্নাঘরে খোলা হবে আর আমরা - বাড়ির ছোটরা — সবার আগে ভাগ পাব। এরপর কে আর গলির খেলায় খাটান দেয়!
এইভাবে বিয়েবাড়িতে কয়েকদিন আগে থেকেই একের পর এক ‘নাইয়র’ আসতে থাকেন বুড়োবুড়ি আণ্ডাকাচ্চা সমেত। আর ঘরে ঘরে ছাদে পাতা হয় ঢালা বিছানা — অনেক তোষক ও লেপ জোড়া দিয়ে। তাঁরা থাকেন বেশ কয়েকদিন। আমরা বাচ্চার পাল হঠাৎ আবিষ্কার করি যে আমাদের ছ’সাতজন ভাইবোন আছে পাতিপুকুরের তেঁতুলতলায়, আরও কিছু নিমতায়, হরিণঘাটায়, হাওড়ার শিবপুরে। এ’কদিন কেউ আর পড়তে বসার কথা বলে না। বড়রা নিজেদের গুলতানিতে মগ্ন, ছোটরা নতুন নতুন খেলায়; একেবারে ‘খাও দাও নৃত্য কর মনের আনন্দে’ কেস!
কিন্তু আত্মীয়স্বজনদের ‘নাইয়র’ বলা কেন? জিজ্ঞেস করলে বড়রা খেদিয়ে দেয়, যা যা, ছাতে খেল গে’ যা! অগত্যা দাদুকে ধরি। উনি ‘আহ্লাইদ্যা’ নাতিকে নিরাশ করেন না।
--দেশের বাড়িতে উৎসবে বিয়াশাদিতে আত্মীয়স্বজন আইতো নৌকায় চইড়্যা, তাই তারা ‘নাইয়র’। মানে যারা নাওয়ে সওয়ার হইয়া আসে।
--ক্যারে? তোমাদের গাঁয়ে রাস্তা ছিল না? গরুর গাড়ি, বাস ছিল না?
--আরে বেশির ভাগ সময় খেত থাকত জলে ডোবা, আর বাড়িগুলি উঁচা উঁচা দ্বীপের মত মাথা তুইল্যা জাইগ্যা থাকত; কাজেই নৌকাই ছিল আমাদের যাতায়াতের প্রধান অবলম্বন। সম্পন্ন ভদ্রলোকের বাড়ি নৌকা থাকত একাধিক, আইজকাইল যেমন মোটরগাড়ি থাকে আর কি!
হঠাৎ মাথায় টিউবলাইট জ্বলে।
‘কে যাস রে, ভাটিগাঙ বাইয়া,‘অনুরোধের আসরে’ শচীনকত্তার এই গান বেজে উঠলেই মায়ের মুখে আষাঢ়ের মেঘ ঘনিয়ে আসত।
আমার ভাইধনরে কইও নাইয়র নিত বইল্যা।’
জানতাম, দেশভাগের পর মামারা দিদিমাকে নিয়ে নিজেদের গ্রাম ছেড়ে আসামের শিলচরে আছে। সেখানে যেতে হলে প্লেনে যেতে হয়। বিয়ের পর মা একবারই যেতে পেরেছিল। ছোট ডাকোটা প্লেন, অনেক ভাড়া যে। ছোটমামাই বা কীকরে এত ভাড়া গুনবে? নতুন জায়গায় মাথা তোলার চেষ্টা করছে।
তাহলে এই গানটা আসলে মায়ের গান? যেমন আমার গান ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’।
ছাতে ম্যারাপ বাঁধা হয়, কী সুন্দর লাগে। কত ছায়া। একপাশে একটা কাপড়ের আড়াল দিয়ে ভিয়েন। উঁকি মেরে দেখতে থাকি ফুটন্ত কড়াইয়ে পান্তুয়াগুলো কেমন সাদা থেকে ক্রমশঃ জুতোর পালিশের মত গাঢ় রঙ নিচ্ছে।
কাকামণির বিয়ে। আমরা বরযাত্রী যাবো। বেহালার রবীন্দ্র পল্লী বলে পাড়ায়। কনের বাড়ি থেকে দু’জন প্রতিনিধি এসেছেন দুটো পেরাইভেট গাড়ি নিয়ে। এ দিয়ে কী হবে? এতজন বরযাত্রী? ওঁরা কাঁচুমাচু মুখে বলেন – এতগুলো ট্যাক্সি কোথায় পাব?
বাচ্চারা প্রায় কেঁদে ফেলি, তা’লে যাওয়া হবে না? আমরা বাচ্চারা বাদ?
আমার ছোট দুইকাকা তাচ্ছিল্যের সুরে বলেন — ক’টা চাই? তারপর ওদের ইশারায় মডার্ন স্পোর্টিং ক্লাবের ছেলেরা দশটা ট্যাক্সির লাইন লাগিয়ে দেয়। ন’কাকা ক্লাবের সেক্রেটারি যে! আমরা হৈচৈ করে ঠেসেঠুসে বসে পড়ি, যদি বাদ দিয়ে দেয়! তিনটে ট্যাক্সি ফেরত করে দেওয়া হয়।
বেহালা কত দূর? আমরা কখনও যাইনি তো! শীতের সন্ধেয় চারদিকে হলদেটে বাসি কাপড়ের মত আলো জ্বলে উঠছে। এক জায়গায় গঙ্গা পেরোলাম। এবার যেন গাঁয়ের মত। মাটির বাড়ি খড়ের চাল চোখে পড়ছে। বেশিরভাগ বাড়িতে হ্যারিকেনের আলো। সালটা ১৯৫৬ যে। একসময় একজায়গায় ট্যাক্সির বহর থামলো। একটা বড় মাটির বাড়ি, তাতে খড়ের চাল, উঁচু মাটির দাওয়া, পেছনের বট আর তেঁতুলের মাথায় জোনাকি ঝিকমিক করছে। আবার শঙ্খধ্বনি, আবার সেই উলু-লু-লু-লু-লু! আমার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে ‘হুলুরব করে অঙ্গনাসবে, মারাঠানগরী কাঁপিল গরবে’; কানে একটা টান পড়ে।
--মুখ বন্ধ রাখ পাকনা পুলা!
--দাদুর কাছে একটা কালা রঙের বান্ধানো বই আছে, সঞ্চয়িতা না কি যেন, হেইডাতে পড়ছি।
তিনধাপ মাটির সিঁড়ি বেয়ে উঠে পাতা-আসনে বসে পড়ি। ইতস্ততঃ হ্যারিকেনের নরম আলোয় চারদিক অপরূপ লাগে। আমাদের বাড়িতে কেন হ্যারিকেন জ্বলে না?
চুলে বেলফুলের গোড়ে মালা, ঝিকমিকে শাড়ি, গালে ঠোঁটে রক্তাভা – কত সব মেয়ে। এবাড়িতে সবাই এত সুন্দর কেন? খাবার ডাক পড়ে। লাইন করে সবাই বসে। কলাপাতায় নুন, লেবুর টুকরো। একটা ঠান্ডা লম্বালম্বি চেরা ল্যাতলেতে বেগুনভাজা দিয়ে গেল। কেমন মরা ইঁদুরের মত। পাশে মাটির খুরিতে জল। আমার হাত লেগে পাশের জনের পাতে জল পড়ে যায়। কিন্তু মাছ আসে, আলুবোখারার চাটনি ও শেষপাতে রসগোল্লা আসে। এবার বাড়ি ফিরতে হবে, রাত হয়েছে — শীতের রাত। সে কি, বিয়ে দেখব না?
মাটির উঠোনে হ্যাজাক বাতির আলো, লোকজনের ভিড়। কাকামণি বসে আছে আঁকিবুকি করা কাঠের পিঁড়িতে মাথায় টোপর; ওই শীতের মধ্যে ধুতি আর গায়ে একটা চাদর। উলটো দিকে শোলার চূড়ো পরা এবং মুখ নিচু করে বসে থাকা মহিলা আমার কাকিমা হবেন? মুখ দেখতে পাইনা, কিন্তু কনে-চন্দনের শোভা হ্যাজাকের আলোতেও অপরূপ লাগে।
ব্যস, হল তো? এবার বাড়ি চল। নতুন কাকিমা? কালকে আমাদের বাড়ি আসবে।
অনিচ্ছায় ট্যাক্সিতে অন্য বাচ্চাদের সংগে বসে পড়ি। শিবপুর থেকে আসা পিসতুতো বোনকে কনুইয়ের খোঁচা মারি। অন্ধকার অজানা পথে গাড়ি চলতে থাকে। আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
পরের দিন সন্ধেবেলা। নীচের থেকে একটা অস্পষ্ট হৈচৈ কানে আসে। দুটো ট্যাক্সি থেমেছে। আবার সেই হুলুধ্বনি ও শুভ্র শঙ্খরবে! ধীরে ধীরে উঠে আসেন দু’জন। গম্ভীর কাকামণি, পেছনে একজন মাথায় প্রায় সমান সমান মহিলা যার মুখ দেখা যাচ্ছে না। আর কি আশ্চর্য, একজনের শাড়ির খুঁট ও অন্যজনের গায়ের উড়ুনি গিঁট দিয়ে বাঁধা!
বাইরের ঘরে আগে থেকেই মা-ঠাকুমা-বড়পিসি আলপনা দিয়ে রেখেছিলেন। সেখানে ওঁদের বসিয়ে কড়িখেলা ও আরও কি কি খেলা চলতে থাকল। আমাদের ধমক দিয়ে সোজা রান্নাঘরে। শোবার আগে এসে দেখি বাড়ি অসম্ভব শান্ত। নতুন সদস্য মহিলাটি মাঝের ঘরের মেজেয় ওঁর দিদিশাশুড়ির বিছানায় মুখ রেখে উপুড় হয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। আমি এখনও মুখ দেখতে পাইনি। দেখছি ওঁর বিরাট খোঁপা আর তাতে সোনালি জরির ফিতে।
এ’বাড়িতে যে লুকিয়ে কাঁদার জায়গাও নেই।
দুটো দিন যেতে না যেতেই আমার মনখারাপ। নতুন কাকিমা তিনদিনের জন্যে বাপের বাড়ি যাচ্ছেন। কেন যাচ্ছেন? বড়দের কথাবার্তা থেকে কানে এল দুটো খটোমটো শব্দ — অষ্টমঙ্গলা আর দ্বিরাগমন। আমার কান্নাকাটির চোটে কাকা-কাকিমা দুজনেই আমার মায়ের আপত্তির উপরে ভেটো প্রয়োগ করে আমাকেও সঙ্গে নিলেন।
ষাট বছর আগের বেহালার রবীন্দ্রপল্লী, দিনের বেলায়। চারদিকে আমকাঁঠাল জাম সুপুরি আর নারকোলের গাছ। ফাঁকা ফাঁকা বাড়ি বিদ্যুৎ নেই। সামনে কাজলা দীঘি। রাত্তিরে তক্ষক ডাকে, ঝিঁঝি ডাকে। কখনও সখনও শেয়াল। এ তো বিভুতিভূষণের ‘লবটুলিয়া বইহার’ বা নিদেনপক্ষে নিশ্চিন্দিপুর। তাও কোলকাতার এত কাছে! আমাকে পায় কে! মামাদের সঙ্গে পুকুরে ডুব দিই, ওরা অভয় দেন--আমরা আছি। দুপুরে খুশির চোটে ঘুম আসে না। একদশক পেরিয়ে আবার আমরা দু’ভাই সেই বাড়িতে যাবার আমন্ত্রণ পেলাম। জামাইষষ্ঠীতে!
আসলে ওঁদের বড়জামাই আমার কাকামণি অকালপ্রয়াত। ফলে বাকি দুই জামাইয়ের সংগে বড়জনের প্রতিনিধি হিসেবে আমরা দু’ভাই। পরিবর্তন অনেক। মাটির বাড়ি এখন পাকা দালান। চারদিকে আরও বাড়ি উঠেছে। রাস্তা ইঁট বাঁধানো। এলাহি খাবারের আয়োজন — একটু লজ্জা লজ্জা করছিল। কিন্তু দিদিমা এসে বললেন আমাদের একটা নিয়ম আছে। ভাবলাম অক্ষয় তৃতীয়ার পুজো দিয়ে দিদিমার তৈরি একশিশি কাসুন্দি ভোজনের পর দক্ষিণা হিসেবে পাব। কিন্তু উনি বললেন — আগে বাটি ভরে কাঁঠাল ও আমের রস দেব। তোমরা হাতে নিয়ে অপেক্ষা করবে। আমি বলব – কী খাও? তোমরা বলবে – ষষ্ঠীচরণের গোদের রস-পোক খাই! তারপরে খাওয়া শুরু করবে।
আমাদের দু’ভাইয়ের খাওয়া মাথায় উঠে গেল।
এরপর এক বছর অন্তর করে একএকটি বিয়ে। সেই নাইয়রদের আগমন, হুলুধ্বনি মঙ্গলশঙ্খ ইত্যাদি। সেই ছাদে ম্যারাপ বাঁধা, ভিয়েন বসা, লম্বা কাঠের বেঞ্চিতে সাদা কাগজের রোল বিছিয়ে দিয়ে তার উপর কলার পাত, মাটির খুরিতে জল, নুন-লংকা-গন্ধলেবু। সেই মরা ইঁদুরের মত লম্বাটে ল্যাতল্যাতে বেগুন ভাজা, মাছের মাথা দিয়ে ডাল, রুইয়ের কালিয়া, মাংস, চাটনি, দই-মিষ্টি।
কিন্তু প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানো। বিয়ের আগে কনে দেখা। কান পেতে থাকি আর ধমক খাই — হাঁ কইরা বড়দের কথাবার্তা গিলতে আছস ক্যারে! যা ছাদে যা।
আমার দাদুকে নিয়ে সমস্যা! উনি যে বাড়িই যান, গিয়ে ওখানেই পাত্রী পছন্দ করে মেয়ের বাবাকে কথা দিয়ে ফেলেন, এমনকি মেয়েকে না দেখেই। ওনার সোজা কথা – ভদ্রলোকের মেয়ে, তাকে পছন্দ-অপছন্দ করার কথা উঠবে কেন?
মহিলারা দেখলেন বড় মুশকিল। বাড়ির কর্তা একবার হ্যাঁ করলে পরে কি করে না করা যায়! ঠিক হল আগে অন্যেরা দেখে ফাইনাল করলে শেষে প্রেসিডেন্টের সাইন করার মত দাদুকে নিয়ে যাওয়া হবে। তাই সই।
একজন পাত্রীকে রিজেক্ট করা হল কারণ তাঁর দাদা সিনেমাতে নিয়মিত চোরের পার্ট করে। আর একজনের বাড়ি ট্রেন থেকে নেমে খোঁজার সময় পাড়ার ছেলেছোকরারা দাঁত বের করে বলল — অ! আপনারা বুঝি প্যাটলাদাদার বাড়ি যাবেন? শেষে আমার মা একদিন বেঁকে বসলেন —আমায় মাপ করুন, আমি আর কোনদিন কারও জন্যে পাত্রী দেখতে যাব না। আসলে উনি নিমতায় এক বাড়িতে পাত্রী দেখতে গেছলেন। শিক্ষিতা চাকরি করা মেয়ে। জবরদখল করা উদ্বাস্তু কলোনিতে নতুন বাড়ি উঠেছে। দেয়ালের চুণকাম পুরো হয় নি। বাইরের ঘরে বসে এরা অনেক খেজুরে আলাপ করে ফেললেন, চা-মিষ্টি-সিঙাড়া সাঁটানো হয়ে গেল; মেয়ে আর আসে না। একটু পরে এল হাইহিল পরে।
বাড়ি ফিরে স্মৃতিকণা বললেন যে উনি শোয়ার ঘরের দেয়ালে ইঁটের অনেকটা ফাঁক দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলেন যে মেয়েটি ভেতরের ঘরে অনেকক্ষণ ধরে মুখে হাতে পায়ে পেইন্ট ঘসছে; আর হাইট বেশ কম বলে ঘরের মধ্যে হাইহিল পরে চলাফেরা করছে। স্মৃতিকণার মনে হল ওই মেয়েটি আমি বা আমার বোন হতে পারে। কী বিড়ম্বনায় আজ নিজেকে মেলে ধরতে ওকে এইসব করতে হচ্ছে। এ যে মেয়েদের অপমান! উনি নিজে মেয়ে হয়ে কেন এর ভাগীদার হবেন?
সারাজীবন আর কোন পাত্রী দেখতে যান নি। নিজের ছেলেদের জন্যেও না।
এভাবেই আমাদের দাদুর দস্তানায় একে একে বড়-মেজ-সেজ-কণাকাকিমা এলেন। আর আমরা আদরে বাঁদর হতে হতে বড় হয়ে গেলাম। রাঙা-ন’ এবং ছোটকাকিমারা এলেন অনেক পরে। ততদিনে আমরা ভাড়াবাড়ির আশ্রয় থেকে বেরিয়ে নাকতলায়।
বিয়ের হৈচৈ একটু থিতিয়ে এসেছে। সবাই নতুন বৌয়ের হাতে খেতে চায়, একসঙ্গে পাত পেড়ে বসতে চায়। সন্ধের দিকে অনুরোধ করা হল গান শোনাতে। কাকিমা উঠে গিয়ে স্যুটকেস খুলে একটি ছাইরঙা রেক্সিনে বাঁধানো খাতা নিয়ে এলেন। উঁকি দিয়ে দেখি মুক্তোর মত হাতের লেখায় অনেকগুলো গান টোকা আছে। খালি গলায় নতুন বৌ গাইলেন —‘আমরা দু’জনা স্বর্গখেলনা গড়িব না ধরণীতে’। জা’ এবং ননদেরা চোখ টেপাটেপি করে হাসলেন, কেন কে জানে। আমাদের মনে হল অপূর্ব।
তখন তখন তারাশংকরের গল্প নিয়ে তৈরি ‘রাইকমল’ সিনেমা হিট, আর পঞ্চদশী নায়িকা কাবেরী বসু এবং ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কীর্তন সুপারহিট। কাজেই ফরমাশ মেনে গাইতে হল ‘যদি আমি যাই পথে, শ্যাম যাবে সাথে সাথে, চরণে চরণ দিয়া পায়’। তারপর আখর দিয়ে ‘সাথে সাথে চলে গো! চরণে চরণ দিয়া সাথে সাথে চলে গো!’
শ্বশুর শাশুড়ি কয়েক পুরুষের দীক্ষিত বৈষ্ণব। দেশভাগের দাঙ্গায় জান-মাল নিয়ে পালিয়ে আসার সময়েও আমার প্রপিতামহী সুখময়ী রায় শালগ্রাম শিলা সঙ্গে করে আনতে ভোলেন নি। ফলে কীর্তন গেয়ে নতুন বউয়ের আসর মাত। শেষে শাশুড়ি ও দিদিশাশুড়ি ডুয়েট গাইলেন শুক-সারীর দ্বন্দ্ব — ‘শুক বলে আমার কৃষ্ণ মদনমোহন, সারী বলে আমার রাধা বামে যতক্ষণ; নইলে শুধুই মদন’।
বেশ মজা পেলাম। তাহলে কৃষ্ণও আমাদের মার্বেল খেলার বন্ধু মদনের মত! ঠাকুরকেও মদনা নামে ডাকা যেতে পারে? কিন্তু এই লাইনটার মানে বুঝলাম না – ‘সিন্দুর বিন্দু কে, সারা মুখে দিল এঁকে?’ রাধা কৃষ্ণকে এমন জেরা করছেন যেন চোরের দায়ে ধরা পড়েছে। কে সেই অপরাধী যে কৃষ্ণের মুখে একগাদা সিন্দুরের বিন্দু এঁকে দিয়েছে? কৃষ্ণ আবার লজ্জা লজ্জা মুখ করে রাধাকে কৈফিয়ৎ দিচ্ছেন — ‘তাইতে বদন শুকায়ে গেছে, কাল রাতে মোর জ্বর হয়েছে’। এক্কেবারে স্কুলে গরহাজিরির জন্যে আমরা যেমন চোর চোর মুখ করে টিচারকে বলি, কী কাণ্ড! আর বড়দের প্রশ্ন করে কিছুই জানতে পারলাম না, বরং উপরি পাওনা হল কানে আড়াই পাক। তবে বড়মা, মানে আমার বাবার ঠাকুমা বললেন – এইসব ‘মাথুর’ পালার গান, বড় হইলে বুঝবি।
কবে যে বড় হব? প্রশ্ন করলে কানমলার হাত থেকে রেহাই তো পাব!
কিছুদিনের মধ্যেই আমরা কুচোরা বড়কাকিমার ভক্ত হয়ে পড়লাম। না হয়ে উপায় আছে? ক্যারম বোর্ডে কাকিমা একা দুহাত খেলে অপজিটে দুই ছোট দেওরের গাঠবন্ধন টিমকে হারিয়ে দেয়। আমাদের লাট্টু নিয়ে হাতলেত্তি করে কায়দাটা শিখিয়ে দেয়। তারপর ইয়ো ইয়ো। কত বড় সুতো! তবু ছুঁড়ে দিয়ে হাতে ফিরিয়ে আনে। আর লুডো? মুখে জর্দা দেয়া পান ঠুসে বসে যায় যে হারছে তার পাশে। বলে তুই ছক্কাটা চালা, আমি ঘুঁটি চেলে দেব। তারপর কোথায় ঘুঁটি জোড়া করে কাকে আটকায় আর কোথায় জোড়া ভেঙে কাকে খায়, বিপক্ষ তার খেই পায় না। খানিকক্ষণের মধ্যে বোর্ডের ছবি যায় বদলে। একবছর বাদে দেখা গেল কাকিমা টুয়েন্টিনাইন বলে তাসের খেলাটাও ভালই জানে, ফিশ ও ব্রে তো নস্যি!
কিন্তু কাকিমা আমাদের জাদু করেছিল ঘুম থেকে তুলে ভাত মেখে সবকটার মুখে গরাস ঠুসে খাইয়ে দিয়ে। একটা বড় কাঁসার থালায় ভাত মাখা হত --ডাল তরকারি মাছের টুকরো, মাথাপিছু আদ্দেকটা হাঁসের ডিম (অতগুলো মুখে গোটা ডিম ছিল সাধ্যের বাইরে), দুধ-ভাত গুড় দিয়ে। মাখা হয়ে গেলে মুখ গুনে কয়লার গুল দেওয়ার মত করে গোল্লা পাকিয়ে রাখা হত। আর তার সংগে নানারকম গল্প। গল্প বলায় অসাধারণ দক্ষতা ছিল ভদ্রমহিলার। প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। র্যাপিড রীডারে ছিল রবিন হুড ও আরও কি কি বই। অল্পদিনেই ফ্রায়ার টাক, লিটল জন আমাদের বন্ধু হয়ে গেল। আর যখন মঠের শেল্টারে দুষ্টু সন্ন্যাসিনীর গোপনে রক্ত বের করে নেওয়ায় দুর্বল রবিন নিজের বৌকে বলে তিরধনুকটা নিয়ে এস, তির যেখানে গিয়ে পড়বে সেখানে আমায় কবর দিও — আমাদের কান্না থামে না, খাওয়া দাওয়া মাথায় ওঠে। এভাবেই আমরা শুনি সিন্দবাদ নাবিক, রবিনসন ক্রুশো, আর গলায় মরা সামুদ্রিক পাখি ঝোলানো এক নাবিকের গল্প।
শুনি কাকিমার এক ভাই বৈদ্যমামার গল্প। উনি নাকি ঢাকায় ব্যায়ামাগারে যেতেন। দুর্গাপুজোর ফাংশনে দাঁত দিয়ে নারকোল ছুলে দেওয়া, লোহার পাত বেঁকিয়ে দেওয়া, ঘুসি মেরে ডাব ফাটানো এসব দেখাতেন, কিন্তু মুখে রা’টি নেই। কোথাও মারামারি হলে দাঁড়িয়ে দুপক্ষের কথা শুনতে শুনতে যাকে ঠিক মনে হত তার হয়ে ঘুষোঘুষিতে জড়িয়ে পড়তেন। পরে জাহাজের চাকরি নিয়ে বিদেশ ঘুরে বেড়ালেন। কিন্তু স্বভাব যায় না ম’লে। আফ্রিকায় অমনই এক মারামারিতে দুই দশাসই আফ্রিকান জোয়ান এমন ঠ্যাঙালো যে একমাস জোহানেসবার্গের হাসপাতালে থাকতে হল। কিন্তু তাতে ওঁর কোন হেলদোল হয় নি। আমি তখনই বুঝে গেলাম যে উনি আমার রোল মডেল ন’ন।
সময় গড়িয়ে গেল। কমিউনিস্ট পার্টির সংগে যোগাযোগের অভিযোগে এয়ারফোর্স থেকে বের করে দেওয়া কাকামণি চাকরি পেলেন ইন্ডিয়ান টিউব কোম্পানিতে, পোস্টিং জামসেদপুরে। সেখানে কোয়ার্টার ঠিক করে ফ্যামিলি ওখানে নিয়ে যাবেন। আমরা দুই ট্যাক্সি ভরে হাওড়া স্টেশন গিয়ে কাকা-কাকিমা ও গুল্লু গুল্লু ভাইকে ট্রেনে তুলে দিয়ে এলাম। চোখের জল মুছলেও কাকিমার মুখচোখে এক ধরনের তৃপ্তি। বাড়ি ফিরে আমাদের মনে হল ঘরগুলো খাঁ খাঁ করছে।
ছ’সাত বছর পরে বিধবা বড়কাকিমা নাকতলায় আমাদের সংযুক্ত পরিবারে সর্বময় কর্ত্রী। আমার হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার প্রথম দিন, জোর করে সেদ্ধভাত মেখে গরাস করে খাইয়ে দিলেন। স্মৃতি কি সবসময় সুখের? জানি না। সব সুখেই কি কিছু বেদনার মিশেল থাকে না? জানি না।