সিনেমা, খাওয়াদাওয়া ও ঘুমের স্বর্গরাজ্য
রোববারের সন্ধ্যে। আগে থেকে জানার চেষ্টা করি আজ কি সিনেমা দেখানো হবে অথবা আদৌ কোনো সিনেমা দেখানো হবে কি না।
সাধারণত ফিল্ম ডিভিসনের সরকারি প্রচারমূলক তথ্যচিত্র ও ব্রিটিশ দূতাবাস ও কাউন্সিলের তথ্যচিত্র দেখানো হত। ফলে আমরা রানী এলিজাবেথ, রাষ্ট্রপতি জন কেনেডির ভারত ভ্রমণ, স্কটল্যান্ডের ঘোড়ার ফার্মের বা ডেয়ারি-পোলট্রির সঙ্গে কখনো কখনো গোরা চামড়ার ছেলেমেয়েদের স্কাউটিং বা ট্রেকিং, নদীতে নৌকো চালানো বা ট্রাউট মাছ ধরা এইসব দেখতে পেতাম।
ফিল্ম ডিভিসনের হিন্দি প্রচারমূলক ছবিতে দেখানো হত নেহেরু সরকার দেশের জন্যে কত কারখানা, বাঁধ, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র এই সব বানাচ্ছে।
একটি টাকমাথা টুপি-পরা চরিত্র দেখানো হত চন্দু নামে। সে বিশ্বনিন্দুক। বাসে যেতে যেতে, চায়ের দোকানে খবরের কাগজ টেনে নিয়ে লোকের গায়ে পড়ে বোঝাতে থাকে-- সরকার খালি মুখে বলে এটা করব, সেটা করব, কিন্তু করে কচু! শেষে সে অফিসে গিয়েও কাজ না করে সহকর্মীদের টেবিলে বসে মালিকের নিন্দে করতে থাকে। মালিক বুড়োহাবড়া, অকর্মণ্য, এইসব বলতে থাকে। ইতিমধ্যে মালিক এসে এককোণে দাঁড়িয়ে সব শোনে আর তক্ষুনি চন্দুকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে। তথ্যচিত্রটির শেষে দেখানো হয় চন্দু একদম পাল্টে গেছে। সরকারের তৈরি সিন্ধ্রি সারের কারখানা থেকে ডিলারশিপ নিয়ে দোকান খুলে চাষীদের মধ্যে কেমিক্যাল সারের গুণের প্রচার করছে।
যতদূর জানি সিন্ধ্রি সার কারখানা বহুদিন বন্ধ হয়ে গেছে।
আজ ভাবি, চমস্কি কথিত কনসেপ্ট-ম্যানুফাকচারিং বোধহয় সবদেশে সরকারের ধর্ম।
এ ছাড়া কখনো কখনো অ্যানিমেশন ফিল্ম দেখানো হত। আর বছরে কয়েকবার দেখানো হত কাহিনীচিত্র, প্রত্যাশিতভাবেই ধার্মিক ফিল্ম। যেমন শ্রীরামকৃষ্ণ, শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য, কংসবধ ইত্যাদি।
রামকৃষ্ণের ভূমিকায় কানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় ভোলার নয়, বিবেকানন্দের চরিত্রে আশীষ কুমারকে ভালো লাগেনি। আর চৈতন্যের ভূমিকায় বসন্ত চৌধুরি ও বিষ্ণুপ্রিয়ার ভূমিকায় সুচিত্রা সেন। কিন্তু নিত্যানন্দের ভূমিকায় পাহাড়ী সান্যাল সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন।
তবে অন্যরকম ফিচারফিল্ম দু'একটা মাঝে মাঝে দেখানো হত, সে নেহাতই ব্যতিক্রম। তার মধ্যে অজয় কর পরিচালিত মনোজ বসুর গল্প নিয়ে তৈরি স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিকায় "ভুলি নাই", শম্ভু মিত্র-তৃপ্তি মিত্র-অমর গাঙ্গুলী অভিনীত অলিভার টুইস্টের বঙ্গীকরণ "মানিক" আমাদের কিশোর মনকে ছুঁয়ে গেছল।
খালি সময়ে হস্টেলে ছেলেরা সিনেমায় দেখা সিকোয়েন্সের নকল করে আনন্দ পেত। তাতে রামকৃষ্ণ, তাঁর ভাগ্নে হৃদয়, তোতাপুরি এবং ভৈরবী(?), শম্ভু মিত্রের ফকিরচাঁদ, তৃপ্তি মিত্রের লিলি-- কাউকেই রেহাই দেয়া হত না। সেসব গল্প যথাস্থানে হবে। খালি একটা কথা বলে রাখি। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য দেখে রাত্তিরে হলে খেতে যাচ্ছি, এমন সময় এলেন আমাদের হেডমাস্টার ষোড়শীমোহন ভট্টাচার্য্যের (ছেলেরা বলত সাঁড়াশীমোহন) বড় ছেলে কৃপাসিন্ধু। আমরা তটস্থ। উনি স্মিত হেসে বল্লেন-- সিনেমা দেখলে? সুচিত্রা সেনের ওই ডায়লগ ডেলিভারিটা খেয়াল করলে?
আমতা আমতা করি-- কোনটা স্যার?
--ওই যে, যখন নিমাই সংসার ত্যাগ করছেন বৃহত্তর সংকল্প নিয়ে তখন বিষ্ণুপ্রিয়া ওঁকে বিদায়ের সময় বলছেন --- আমার কী হবে? নিমাই তো এড়িয়ে যাওয়া জবাব দিলেন, মায়ের দেখাশোনা করবে।
অনুচ্চারিত প্রশ্নটি হল -- তাহলে বিয়ে করেছিলে কেন?
তোমরা এখন ছোট। বিষ্ণুপ্রিয়ার ট্র্যাজেডি বুঝতে চেষ্টা করো। শুধু নিমাইকে পুজো করে মহাপ্রভু বানালে হবে না।
আমরা হতভম্ব।
-- স্যারটা খ্যাপা না কি রে? কীসব আলবাল বকে গেল? তুই কিছু বুঝলি?
রঞ্জন চুপ। ও হঠাৎ সেই মুহূর্তে বড়ো হয়ে গেছে।
প্রথম দু-এক বছর বিবেকানন্দ হলের নীচের তলায় ডাইনিং হলে সিনেমা দেখানো হত। হলটা ছিল হতচ্ছাড়া। মেজেয় খাবলা খাবলা সিমেন্ট উঠে গেছে। কাঠের পিঁড়িগুলোতে ময়লা এঁটে বসেছে। মাসে-ছমাসে মিদনাপুরি পাচক পঞ্চা আর তার সাঙ্গোপাঙ্গ সেগুলো পরিষ্কার করত। তখন দেখলে মনে হত পিঁড়িগুলো যেন সেলুন থেকে চুল কেটে ধোপদুরস্ত হয়ে এসেছে।
তারপর আরও গ্রান্ট এল। একজন কেন্দ্রীয় রাজ্যমন্ত্রী খান্নাসাহেব এসেছিলেন তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে, সরকারি টাকায় নতুন ছাত্রাবাস ও ডাইনিং হল পরিদর্শনে। তখনও হলের মেজে দুরমুশ হচ্ছে। তার মধ্যেই টেবিল, সুন্দর টেবিলক্লথ আর ফুলদানি দিয়ে ওঁদের সম্বর্ধনা দেয়া হল। হস্টেলের গানের ছোট্ট দলটি গাইল- "সুন্দর লালা, নন্দদুলালা, নাচত শ্রীবৃন্দাবন মেঁ।"
মন্ত্রী দম্পতি খুশি হয়ে সামনে বসা একটি ক্লাস নাইনের ছেলেকে বলিলেন—বৎস, কী বর চাই?
ছেলেটি ঘাবড়াইল, তোতলাইল, কিন্তু সাথীদের প্রম্পটিং শুনিয়া বলিল-- দেব! যদি একটি সম্পূর্ণ ক্রিকেট-সেট পাওয়া যায়?
দেবতা বলিলেন-- তথাস্তু!
তৎক্ষণাৎ মলয় পবন বহিতে লাগিল। মহারাজদের মুখ হাসি-হাসি হইল। আমরা কিষ্কিন্ধ্যাবাসী বানরের দল উদ্বাহু হইয়া নৃত্য করিতে লাগিলাম।
দেবতা কথা রেখেছিলেন। এসে গেল দুজোড়া ব্যাটিং প্যাড ও গ্লাভস্, উইকেট কীপিং-এর আলাদা গ্লাভস ও প্যাড, পার্চমেন্ট ব্যাট গোটা চারেক। ছ'টি লালরঙা ক্রিকেট বল ও নেট।
টেনিস বলে খেলা ছোটোদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল। বড়োদের খেলা বা এক্স-স্টুডেন্টদের সঙ্গে বর্তমান আশ্রমের টিমের ম্যাচ রেগুলার ক্লাব ক্রিকেটের স্টাইলে খেলা হতে লাগল।
তখন দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাত্র ষোল বছর হয়েছে। ক্রিকেট তখনও আম জনতার খেলা হয়ে ওঠেনি। তখনও ফুটবল লীগ, আই এফ এ শীল্ড-এর সঙ্গে রোভার্স এবং ডুরান্ড কাপ নিয়ে লোকে উত্তেজিত হত। বাইটন কাপ এবং কোলকাতা হকি লীগ দেখতে মাঠে ভিড় হত।
লিয়েন্ডার পেজের বাবা ডঃ ভি পেজ, কাস্টমসের ক্লডিয়াস, মোহনবাগানের ইনামূল হক, ইক্রামূল হক এবং অল্প পরে ধ্যানচাঁদ-পুত্র অশোককুমার কোলকাতায় নক্ষত্রের মর্যাদা পেতেন। সেই সময় ক্রিকেট ছিল একটি এক্সক্লুসিভ গ্রুপের খেলা, ক্রমশ জনপ্রিয় হতে চলেছে। কাজেই তখন ক্রিকেট সেট পেয়ে যা আনন্দ হয়েছিল তা আজ অনুভব করা মুশকিল।
তারপর পেছনের খালি মাঠে ইউ শেপের ডিজাইনে নতুন ছাত্রাবাস হল। তাতে কোনো হল নেই। প্রত্যেক ঘরে পাঁচটি জানালা আর পাঁচটি খাট। কয়েকটিতে কিচেন, স্টোর ও ওয়ার্ডেনের থাকার ব্যবস্থা। আর মন্ত্রীজি দেখে যাবার অল্পদিনের মধ্যেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ডাইনিং হলে অন্তত দুশো ছেলের একসঙ্গে বসে খাবার ব্যবস্থা হল। খাবার কোয়ালিটি আগের চেয়ে একটু ভালো হল, আমাদের খিদেও বেড়ে গেল।
আর ওই ইউ-শেপের বিল্ডিং-এর মাঝের খালি জায়গায় পর্দা টাঙিয়ে সিনেমা দেখানো হত। প্রোজেক্টর চালাতেন গৌরদা। ওঁর একটি হাত কব্জি থেকে কাটা। কিন্তু ওই এক হাতে ভলিবলের মাঠে নেটের ওপর ভেল্কি দেখাতেন। আর কালীকীর্তনের দলেও ভালো গলা মেলাতেন।
সাধারণত তথ্যচিত্রগুলো বহুবার ব্যবহৃত হতে হতে শুয়োরের মাংস হয়ে যায়। আমরা আগে থেকেই বুঝতে পারতাম এরপর কী আসছে বা কখন রীলের ফিতে আটকে যাবে। তাই ঘুম পেত। শুধু এ ওর ঘাড়ে মাথা দিয়ে নয়, কেউ কেউ আসন-সতরঞ্চি-বালিশ নিয়ে আসত ঘাসের ওপর পেতে ঘুমোবে বলে। এই ঘুমের সময় কারও নজরদারি থাকত না, কেউ নাম নোট করত না। তাই সিনেমা শুরু হলেই আয় ঘুম।
ঘন্টা দুইয়ের এই ফিলিম-পর্ব শেষ হলে আলো জ্বললে এখানে-ওখানে যুদ্ধক্ষেত্রে কাটা সৈনিকের মতো পড়ে থাকা ছেলেগুলোকে ডেকে তুলে ঘরে পাঠানো হত। তারপর হয়তো আধঘন্টা পরে খাবার ঘন্টা বাজবে। কাঁচাঘুম থেকে ওঠা ছেলেগুলো নিজেদের ঘরে গিয়ে সোজা বিছানায় ডাইভ মারত।
খাবার ঘন্টা বাজলে আবার একপ্রস্থ ডাকাডাকির পালা।
এই নিয়ে একটা কাণ্ড ঘটে গেল।
এমনি এক রাতে সিনেমা শেষ হয়েছে। ঘরে ঘরে ছেলেরা খাবার ঘন্টা বাজার ফাঁকে ঘুমিয়ে নিচ্ছে। আমরা তিন বন্ধু একটি খেলা শুরু করলাম। একেকটি রুমে যাই ঘুমন্ত একটি ছেলের খাটের দু'মুড়োয় দুজন দাঁড়াই। একজন লাইটের সুইচের কাছে। চাপা স্বরে ওয়ান-টু-থ্রি বলার সঙ্গে সঙ্গে একজন লাইট নিভিয়ে দেয়। অন্য দুজন ঘুমন্ত ছেলেটির খাট কাত করে দেয়। ছেলেটি হড়বড়িয়ে আঁতকে ওঠে এবং মাটিতে পড়ে যায়। হাসির হররা ওঠে। আমরা পরের ঘরটিতে যাই। অ্যাকশনগুলো ক্রমানুসারে রিপিট করি। মুগ্ধ দর্শকদের সংখ্যা বৃদ্ধি হতে থাকে। এইভাবে রুম নম্বর এক থেকে শুরু করে চলতে চলতে পৌঁছে যাই রুম নম্বর কুড়িতে। সেই রুমে দেখি মাত্র একজন সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমুচ্ছে। আমরা যে যার পজিশন নিই। অপারেশন শুরু। খেয়াল করি না যে দর্শককুল উধাও। অন্ধকারে খাট কাত করতেই চাদরমোড়া ভারী শরীরটি খাট থেকে পড়ে যায়। আর দৌড়ে পালাতে পালাতে আমরা শুনতে পাই এক ক্রুদ্ধ চিৎকার--- অ্যাই কে রে? কার এত সাহস?
আওয়াজ আমাদের পরিচিত। ঝোঁকের মাথায় ভুলে গেছলাম যে এই রুমটিতে একজনই থাকেন-- নীচের তলার ওয়ার্ডেন ব্রহ্মচারী সুশীলদা।
ইন্টারক্লাস ফুটবল টুর্নামেন্ট শুরু হয়ে গেছে। সবাই হাঁ করে দেখে নোটিস বোর্ডে ফিক্সচার। ওদের সিক্স-বি'র বিপক্ষে যে টিম তার ক্যাপ্টেন গৌতম সরকার বলে একটি বেঁটেমতো স্থানীয় ছেলে।
কিন্তু ওর কী খেলা! কী হার্ড ট্যাকল! অনায়াসে বয়সে বড়ো ও লম্বা ফরওয়ার্ডের পা থেকে বল কেড়ে নেয়।
হেরে যাওয়া টিমের ছেলেরা বলাবলি করে--কেমন গাঁট দেখেছিস? নিঘ্ঘাৎ বয়স বেশি হবে। কিন্তু ওর মুখের কাঁচা খিস্তি শুনে বাচ্চা ছেলেগুলো বেশ আমোদ পায়। ঝগড়া হয় না, গালাগাল গুলো শুধু নিজের দলের প্লেয়ারদের জন্যেই বরাদ্দ-- বিশেষ করে সিটার মিস করলে বা বল বাড়াতে ভুল করলে।
না, না, পাকাচুল স্মিতহাসি যে গৌতম টিভি চ্যানেলে ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার দলগুলোর খেলার স্টাইল নিয়ে তুলনামূলক আলোচনায় মাতেন তিনি নিশ্চয় অন্যগ্রহের কেউ।
রোববারে আবার অন্য গল্প। তখন শুধু আশ্রমের আবাসিক ছেলেদের খেলা। এর মধ্যে আছেন অনন্তদা, অনন্তপ্রসাদ পাল। উনি নাকি একসময় এরিয়ান্স টিমে চান্স পেয়েছিলেন। এখন অফিসে দশটা-পাঁচটা চাকরি করেন। কিন্তু থাকেন আশ্রমে, পেটভাতায়। ওঁর বড়ো ভাই অচ্যুতদা আশ্রমের ক্লার্ক। অবিবাহিত দু'ভাই। তবু কোনো কোনো দিন স্থানীয় দু একজন বয়স্ক প্লেয়ার আসেন। আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখি অনন্তদার হঠাৎ নেওয়া ব্যাকভলি!
আমরা আগে থেকে টিম বানাই, বাড়িতে আবদার করে কালো ইল্যাস্টিক দেওয়া প্যান্ট ও অন্তত এক পায়ের জন্যে একটা অ্যাংকলেট আদায় করি। আর আমাদের দেশি কোচ গোষ্ঠদার কাছে সময় বের করে পায়ের আউটস্টেপ ও ইনস্টেপ দিয়ে বল রিসিভ করার টেকনিক অভ্যাস করি।
তারপর জলকাদায় আছাড় খেয়ে প্রাণপণে ফুটবল পেটাই, হেরে ও কাদা মেখে ভূত হই, ব্যর্থতায় নিজেদের মধ্যেই লাথালাথি ও দোষারোপ করি। তারপর যোগানন্দ ধামের সামনের এঁদো পুকুরে কাদা ধুয়ে শেষে কলতলায় গিয়ে জামাকাপড় কেচে স্নান করে প্রেয়ার হলে যাবার জন্যে তৈরি হই।
আর রাত্তিরে খবরের কাগজ বা "খেলার মাঠ", "স্টেডিয়াম" গোছের ম্যাগাজিন থেকে প্লেয়ারদের ছবি কেটে আঠা দিয়ে স্ক্র্যাপবুকে লাগাই। ফুটবল তারকাদের নামে নিজেদের নামকরণ করি।
তাই সুব্রত হয়ে যায় পুসকাস, চন্দন ডিডি, সলিল ভাভা। না কেউ গ্যারিঞ্চা বা পেলে হই না। সাহস হয় না। গ্যারিঞ্চার যে বাঁকা পায়ের ড্রিবল! আর পেলে! গোষ্ঠদা বলেন আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনি-- রঘুডাকাতের গল্পের মতো।
আর সেই যে পেলে হিল দিয়ে দুজন রাশিয়ান ডিফেন্ডারের মাথা টপকে বল গোলি আর ওদের মাঝখানে লব করে আবার বল মাটিতে পড়ার আগে দৌড়ে গিয়ে ভলিতে গোল করলেন! কল্পনায় ছবিটা ধরার চেষ্টা করি।
এবার রহড়া মিশনের মাঠে আমাদের ম্যাচ, স্থানীয় নরেন্দ্রনাথ বিদ্যামন্দিরের সঙ্গে।
দল বেঁধে সেক্রেটারি মহারাজের কছে যাই। আমাদের অন্তত মিশনের ডজ ভ্যানে করে রহড়া নিয়ে যাওয়া হোক। একজন ওয়ার্ডেন সঙ্গে যাবেন। আমরা দলের জন্যে গলা ফাটাবো।
আমরা নিশ্চিন্ত যে বিদ্যামন্দিরকে গুনে গুনে চার গোল দেব, প্রত্যেক হাফে দুটো করে।
আমাদের স্কুলের সেন্টার ফরওয়ার্ড ঐত্রী বসু রায়, দুই ইনসাইড মাখনদা, পান্নাদা আর লেফ্ট আউট সৌরেন--- আমাদের গর্ব।
আর বিদ্যামন্দির তো ছোটো স্কুল, আমাদের সঙ্গে তুলনা? হ্যাঃ!
কিন্তু রহড়া মিশনের মাঠটা মনে হল অনেক বড়ো। আমাদের ছেলেরা যেন খেলাটা ধরতেই পারল না। তিন-এক গোলে হেরে আশ্রমে ফিরলাম। ফেরার সময় মুখে কথা নেই। কিন্তু রহড়া মিশনের বিল্ডিং আর মাঠ! বড়ো হিংসে হল।
কেমন মনে হল বরানগর মিশন বেশ গরীব, আর রহড়া নরেন্দ্রপুর বড়লোক।
আর সেই সঙ্গে মনের কোণে জন্ম নিল বরানগরের জন্যে কিরকম এক কষ্ট মেশানো ভালোবাসা।
বছরে একবার করে হত কালচারাল ফাংশান, প্রায় সাতদিন ধরে। তাতে সাধুসেবা, ফিলিম শো, পূর্ণদাস বাউল এবং রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গান, ধ্রুপদ-খেয়াল-ভজন সবই হত। কিন্তু অলিখিত নিয়মে গায়িকারা অপাংক্তেয়। রাধারাণী-ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কীর্তনের কথা ভাবাই যায় না।
স্থানীয় যাত্রাপালার দল এসে অভিনয় করে যেত-- কংসবধ, যবন হরিদাস ইত্যাদি। তাতে মহিলা চরিত্রের অভিনয় পুরুষ অভিনেতাকেই করতে হবে।
যবন হরিদাস পালায় হরিদাসের জপে বিঘ্ন ঘটাতে একজন নগরবধূকে পাঠাবে কাজির দল। স্টেজে সেই নারীভূমিকার দেঁতো হাসির ছলাকলায় সেভেন থেকে ইলেভেনের ছেলের দল মুগ্ধ, হঠাৎ কেউ ফিসফিস করে দেখালে—অনিল মহারাজ চেয়ারে বসে অভিনয় দেখার সময় যতবার নারীচরিত্রটি স্টেজে উঠছে ততবার চোখে হাতচাপা দিচ্ছেন। পেছন থেকে কোন বখা ছোঁড়া চেঁচিয়ে উঠল-- ওরে, মহারাজ আঙুলের ফাঁক দিয়ে দেখছে রে!
হাসির হর্রার মাঝে অনিলদা উঠে বেরিয়ে গেলেন।
পরবর্তী জীবনে যখনই কোনো তৃণমূল স্তরের নিষ্ঠাবান সিপিএম ক্যাডারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, যাঁরা যেকোনো সমস্যার নিদান দিতে পার্টি পত্রিকার বুকনিগুলো হুবহু কোট করে নিশ্চিন্ত থাকতেন, তখনি আমার মনে পড়েছে অনিলদার কথা।
কয়েকজন গুণীলোক নিরুপায় হয়ে আশ্রমে ঠাঁই নিয়েছিলেন। এদের মধ্যে দুটো গ্রেড ছিল। কিছু ছিলেন বেতনভোগী কর্মচারী। আর বাকিরা হয় অন্য কোথাও সামান্য চাকরি করতেন বা নিজের মতো করে থাকতেন।
কিন্তু এদের মধ্যে কমন ফ্যাক্টর হল যে এরা সবাই মিশনের কোনো না কোনো কাজে অপরিহার্য ছিলেন। এবং অধিকাংশই থাকতেন পেটভাতায়, তবে মিশন এদের মাথার উপরে ছাদের নিশ্চিতি দিয়েছিল। ষাটের দশকে সেই বা কম কী!
আগে বলি রামকানাই মহারাজের গানের দলটির কথা। কালীকীর্তনের দল। সুন্দর ক্যালিগ্রাফিক স্টাইলে প্রায় তিন ইঞ্চি সাইজের অক্ষরে বড়ো বড়ো খেরো খাতায় তুলি দিয়ে গানগুলো, রাগ ও তালের সঙ্গে, লেখা থাকত। অন্তত দুটো খাতা ছিল। ফলে গোটা গায়ক দল দূর থেকেই কথাগুলো পড়ে নিত। বেশ কয়েকটি ধ্রুপদাঙ্গের চৌতালে।
যেমন "তুমি শ্যামা হর রমা সদা শিবের মনমোহিনী"--এটা দিয়েই শুরু হত। আর "নীলবরণী নবীনা রমণী, নাগিনী জড়িত জটা বিভূতিনী"। দুটোই চৌতালে, প্রথমটা জয়জয়ন্তী। আমার ফেভারিট ছিল "কেমন মেয়ে নগ্না হয়ে আসিল এ সমরে"। জয়জয়ন্তী, তেওড়া। আর "ওমা কালভয়বারিণী, কপালিনী; শম্ভুভামিনী নিশুম্ভঘাতিনী"। আর খেমটা তালে "সমরে নাচে রে কার এ রমণী, নাশিছে তিমিরে তিমিরবরণী"। এসব বোধ হয় পুরোনো যাত্রাদলের জুড়ির দলের গানের ট্র্যাডিশন থেকে এসেছে।
অন্ধ বাদক নগেশদা অসাধারণ পাখোয়াজ বাজাতেন। প্রতিদিন প্রার্থনা হল ছাড়াও সমস্ত বিশেষ গানের অনুষ্ঠানে। থাকতেন পেটভাতায়। শীতের দিনে বছরের পর বছর একটি শস্তা কালো র্যাপার।
প্রেমনাথ রায় বা প্রেমবাবু স্যার।
একটি সাদা খদ্দরের লুঙ্গিমতন, ওপরে কখনো ফতুয়া কখনো অমনই একটি সাদা খদ্দরের চাদর। চমৎকার ভায়োলিন বাজাতেন, কালীকীর্তনে তো বটেই। বিলম্বিত ধ্রুপদাঙ্গের গানের সঙ্গেও। প্রথম জীবনে হয়তো প্রাইমারি স্কুলের টিচার ছিলেন, তাই স্যার শব্দটা নামের সঙ্গে জুড়ে গেল। ডাইনিং হলের কোণে বসে চুপচাপ নিজের সামান্য খাওয়াটুকু খেয়ে উঠে যেতেন।
প্রৌঢ় মানুষটির মুখে সবসময় একটি প্রশান্তির ভাব লেগে থাকত। আমাদের মতো সিক্স-সেভেনের বাচ্চাদের আবদারে চলার পথেই দাঁড়িয়ে পড়ে বেহালায় অন্তত তিনটি রাগে (মল্লার ও দেশ মনে আছে) বন্দেমাতরম বাজিয়ে শোনাতেন।
সকালে দেখা যেত সদ্যস্নাত প্রেমবাবুস্যারকে, বুকের কাছে জোড়া হাত, "জয় গুরু, জয় গুরু, জয় গুরু, জয়", বলতে বলতে চলেছেন-- সামনে পড়ে গেলে সবাইকে প্রীতি সম্ভাষণ, সবার জন্যে শুভকামনা।
কিন্তু কুঁচোকাচার দল বড্ড বাঁদর। ওঁর নাম দিল ফটফটি বা মোটরসাইকেল। কারণ ওঁর বায়ুত্যাগের দোষ। চললে পেছন থেকে মোটরসাইকেলের সাইলেন্সারের মতো ফটফট আওয়াজ হত। উনি নির্বিকার। কিন্তু একবার খুব রেগে গিয়েছিলেন।
বিখ্যাত খেয়াল গায়ক সত্যেন ঘোষাল ও শংকর ঘোষাল আশ্রমে গান গাইতে এসেছিলেন। আগের দিন সন্ধ্যার অনুষ্ঠানের পর পরের দিন সকালে প্রেয়ার হলে ওঁরা দু’ ভাই বেশ কিছু গান গাইলেন। আমার কানে লেগে আছে ভৈরবীতে “ভবানী দয়ানী, মহাবাক্যবাণী” এবং একই সুরে কথা বদলে অতুলপ্রসাদের ‘সে ডাকে আমারে, বিনা সে সখারে, রহিতে মন নারে’। তবলায় ওঁর সুপুত্র অরুণ ঘোষাল। ওঁরা উঠে জলখাবার খেতে গেলে খালি প্রেয়ার হলে আমরা ক’জন অরুণকে ঘিরে বসলাম। আমাদের অনুরোধে ও তবলায় ছোট ছোট টুকরা বাজিয়ে দেখাতে লাগল। বোল তুলে দেখাল ‘তেরেকেটে গদিঘেনে’ কৎতা ঘিন্না’ ‘ধেরে ধেরে, দেরে দেরে’ ইত্যাদি।
তারপর ও মুখে মজার বোল বলে তবলায় বাজিয়ে দেখাতে লাগলঃ
‘কর্তা দুরুদুরু গিন্নিকে, গিন্নি দুরুদুরু কর্তাকে’ এবার গিন্নি বলছেন (তেহাই মেরে) ‘কর্তা গা-ধা, কর্তা গা- ধা, কর্তা গা-ধা’।
আমরা হেসে গড়িয়ে পড়ছি এমন সময় এলেন প্রেমবাবু স্যার। অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন—‘লিখে নাও, এসব অমৃতবাণী নিজেদের রুমে গিয়ে মুখস্থ কর। দাঁড়াও, বড়ো মহারাজকে গিয়ে বলছি এখানে কীসব কথা হচ্ছে।’ আমরা ভয় পেলাম। অরুণ ঘোষাল অবিচলিত, বলল ‘বুড়ো মানুষ, বুঝতে পারেন নি। এসব তবলচির জন্যে সাধারণ ব্যাপার।’
একবার শীতকালে আমরা টাকী মিশনের থেকে ফিরছি, মিশনের নিজস্ব ডজ ভ্যানে। অন্ধকার ঘনিয়েছে। হঠাৎ ঠান্ডা পড়ে গেছে, আমার হাফ সোয়েটারে মানছে না, কাঁপুনি ধরাচ্ছে। আমি কুঁকড়ে যাচ্ছি। উনি দেখতে পেয়ে আমাকে কাছে টেনে নিয়ে গায়ের সাদা চাদর জড়িয়ে দিয়ে বুকের কাছে পরম মমতায় ধরে রাখলেন। আমি ওঁর শরীরের ওমে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙলো যখন গাড়ি আশ্রমের গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকছে।
গোষ্ঠদা।
কাশীপুর গানশেল ফ্যাক্টরির শ্রমিক। চোখে পাওয়ারফুল চশমা। টুইলের হাফশার্ট আর ধুতি, পায়ে কেডস্। ফুটবল ও ভলিবলের রেফারি এবং কোচ। অনেক যত্ন নিয়ে শেখাতেন-- ইনস্টেপ ও আউটস্টেপ দিয়ে বল রিসিভ করা ও পাস দেওয়া। ভলিবলের ফিংগারিং।
কিন্তু ওঁর আসল প্যাশন গানের আসরে খঞ্জনি বাজানো এবং নাটকের সময় ডিরেকশন দেওয়া।
কেদার রায় নাটকের সময় রঞ্জনের বড় শখ চাঁদ রায় করে। দুটো মাত্র সীন। তাতে বিধবা মেয়ে সোনার ঈশা খাঁর সঙ্গে পালিয়ে যাওয়া এবং তাকে উদ্ধার করতে আসা কাকার ফৌজের বিরুদ্ধে নিজের হাতে তলোয়ার ধরার খবর পেয়ে পতন, মূর্চ্ছা ও মৃত্যু। কী দারুণ ক্ল্যাপস!
কিন্তু তখন চোদ্দবছর বয়স। গলা ভাঙছে। ফলে গোষ্ঠদার অনেক পরিশ্রম সত্ত্বেও সেই হাহাকার বেরোল ফাটা বাঁশের মতো কোরাস গলায়। ট্র্যাজিক সীন কমিক হয়ে গেল।
অনন্তদা ও অচ্যুতদা।
ছোটভাই অনন্ত প্রসাদ পাল সুন্দর পেটানো চেহারা। কোন একটি অফিসে কাজ করতেন ও আশ্রমে থাকতেন। সে সময় এরিয়ান্স ক্লাবে ফুটবল খেলতেন--সেটা নিয়ে ওর বড়ো ভাই ও আমাদের বেশ গর্ব ছিল। আশ্রমের হয়ে একটি ম্যাচে হাওয়ায় শরীর ছুঁড়ে ব্যাকভলি বেশ মনে আছে।
ক্রিকেটের সময় মিশনের টিমে প্রীতি ম্যাচে মিডিয়াম পেস বোলিং ও টেইল এন্ডার হিসেবে সব বলেই সিক্স মারার চেষ্টা।
কিন্তু রামকানাই মহারাজের কালীকীর্তনের টিমে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি ও কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা এই ইয়ংম্যানের সুরেলা কন্ঠস্বর আমাদের কোরাসে শক্তি জোগাত।
আবার আমেরিকার CARE সংস্থার পাঠানো গুঁড়ো দুধ গুলে বিশাল লোহার তৈরি নৌকোর মতো পাত্র থেকে স্থানীয় গরীবদের মধ্যে বিতরণের দায়িত্বও ওঁর।
কোনো কোনো ছুটির দিন দেখতাম পানা পুকুরে ওই লোহার গামলা চড়ে জলঝাঁঝি/পানা পরিষ্কার করছেন।
আমার মনে পড়ত:
"তারা ছাঁকনি চড়ে সাগর পাড়ি দেবেই দেবে,অচ্যুতদা মিশনের ক্লার্ক। পেটভাতায় ও সামান্য মাইনায় আছেন। নির্বিরোধী মানুষ। কিন্তু রুটি খেতে পারতেন না। ১৯৬৫তে ভারত-পাক যুদ্ধের সময় র্যাশনিং শুরু হল। চাল পাওয়া যায় না। সরকার একবেলা রুটি খেতে বলছেন। হোস্টেলে রাত্রে সবার জন্যে রুটি বরাদ্দ হল। উনি দু-একদিন নাড়াচাড়া করে উঠে গেলেন। তৃতীয় দিন কেঁদে ফেললেন। ওঁর কান্নাকাটি দেখে রাত্তিরে দু-হাতা ভাত ওঁর জন্যে বরাদ্দ হল।
নীল মাথাতে সবুজ রঙের চুল,
পাপাঙ্গুল।"
আজ দেখি গলিতে গলিতে মহিলারা/পুরুষরা রুটি বেলছেন, লোকে লাইন দিয়ে কিনে নিয়ে যাচ্ছে। সত্যি, গত ৫০ বছরে বাঙালির খাদ্যাভ্যাস পাল্টে গেছে।
গৌর সাহা।
একটি হাত নেই। কিন্তু একহাতেই কামাল। কালীকীর্তনে সুরে গাইছেন। ভলিবল মাঠে নেটের সামনে লাফিয়ে একহাতেই স্ম্যাশ করছেন বা প্লেস করছেন। স্বল্পবাক, স্মিতহাসি। মুখে একটা পান।
আমাদের মধ্যে উনি জনপ্রিয় কারণ রোববারে সন্ধ্যের প্রার্থনার পরে প্রোজেক্টর চালিয়ে সিনেমা দেখানোর কাজটা উনিই করতেন। ইউসিস/ ব্রিটিশ হাই কমিশনের অফিস বা ফিল্মস ডিভিশনের থেকে সিনেমার ক্যান নিয়ে আসার দায়িত্বের সাথে প্রোজেক্টরে ফিতে ফেঁসে যাওয়া, গরম হয়ে থেমে গেলে রিপেয়র করা - সব ওঁর দায়িত্ব।
ভূপতি সিংহ (বড়দা)
স্ত্রীবিয়োগের পর আমাদের সবার বড়দা দুই ছেলেকে নিয়ে আশ্রমের আশ্রয়ে এলেন। উনি ছিলেন আমাদের সিক-রুম ইনচার্জ। যোগানন্দ ধামের দোতলাটার ছোট-বড় দুটো ঘর ওঁর থাকার জন্যে এবং সিক রুম হিসেবে ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দেওয়া হল। কেউ অসুস্থ হলে তাকে সিক রুমে গিয়ে থাকতে হত। একজন এম বি ও একজন এল এম এফ ডাক্তার পালা করে আমাদের দেখতে আসতেন। তাঁদের ফি, প্রেসক্রাইবড ওষুধপত্তর আনানো, রোগীদের পথ্য--সব বড়দার দায়িত্ব। পেট খারাপ হলে যে পেঁপে সেদ্ধ দিয়ে ভাত দেওয়া হত (বার্লি দেখলেই না না করে উঠতাম) তাতেই খুশি হতাম। বাড়াবাড়ি অসুখ হলে বাড়িতে খবর দিয়ে নিয়ে যেতে বলা হত।
ক্লাস টেনে পড়ার সময় সন্ধ্যের প্রেয়ারে না গিয়ে আলো নিভিয়ে ঘরে শুয়ে ছিলাম। কপাল মন্দ, পড়বি তো পড় কেশব মহারাজের পাল্লায়। ওঁকে বললাম—আমি অসুস্থ। সঙ্গে সঙ্গে উনি আমাকে সিক রুমে ভর্তি করিয়ে দিলেন। আর বললেন সেখান থেকে নিজেদের বন্ধুবান্ধবের হোস্টেলে আসা চলবে না। পড়াশুনা সবই সিক রুমে। স্কুল যাওয়া বন্ধ। তিনদিন পর অসহ্য হয়ে ওঠায় মাপ চেয়ে হোস্টেলের ঘরে আসি।
উনি নাকি পূর্বাশ্রমে পুলিশ অফিসার ছিলেন। তিক্ত সার্কাস্টিক বাক্যপ্রয়োগ, ঠ্যাঙানোর হাত ও চিবিয়ে চিবিয়ে ইংরেজ আমলের পুলিশের ধৌঁস দেওয়া --- আমাদের গেরুয়ার প্রতি মিনিমাম শ্রদ্ধাটুকু উপে গেল। সেবার কালীপুজোর রাত্তিরে একটা রকেট বোম ওঁর দোতলায় ওঁর ঘরের জানলায় ফাটলো।
উনি সন্দেহ করলেন পরিতোষকে (নিখুঁত এক্সিকিউশনের জন্যে) আর আমাকে (প্ল্যান জোগানোর জন্যে)।
কিন্তু আজও বলছি--ওই প্ল্যান আমার ছিল না।
ঘুঁষি লাগলো দরজার লোহার কড়ায়। কড়া গেল বেঁকে। কিন্তু মহারাজের আঙুলের হাড় গেল নড়ে।
আমরা সেদিনই জেনেছিলাম-- ভগবান আছেন আর তাঁর ন্যায়ের রাজ্যে "দের হ্যায়, পর অন্ধের নহীঁ।"
বড়দার স্নেহ আমরা সবাই অনুভব করতে পারতাম।
গোড়ার দিকে মজা পুকুরের পানাভরা দুর্গন্ধ জলে কাপড় ও বাসন ধুতে এবং চান করতে করতে আমাদের বিচ্ছিরি খোস-পাঁচড়া হয়েছিল। তখন পেনিসিলিন ইনজেকশন ও সালফার মলমের ব্যবস্থা করবে কে? বড়দা।
কিন্তু একদিন উনি আমার সহপাঠী সুব্রত সাঁইয়ের কোন কথায় চটে গিয়ে দুই চাঁটি লাগিয়ে বললেন-- আমি তোর ইর্কির যোগ্য? ইর্কির যোগ্য? আইজুক্যাল তুই? আইজুক্যাল তুই? একটু পরে সুব্রত বুঝলো-- আইজুক্যাল তুই= আই ইজ ইক্যুয়াল তুই???
যোগানন্দধামে সন্ধ্যে বেলা আমাদের টিউটোরিয়াল। আমরা মানে ক্লাস এইটের আবাসিকের দল। দুটো সেকশন মিলে জনা পনেরো হবে।
যোগানন্দধাম আসলে একটি লম্বাটে দোতলা হল ঘর। পুকুরপাড়ে। এই ঘরে আমরা থাকি। মাটিতে সতরঞ্চির উপরে তোষক পেতে বিছানা। আমরা বলি-বেডিং। দিনের বেলায় এই বেডিং গুটিয়ে দেয়াল ঘেঁষে রেখে দিতে হয়। টিউটোরিয়ালের সময় শুধু সতরঞ্চি পেতে বসে পড়াশুনো। আমাদের টিচার অনিমেষদা হোস্টেলেই থাকেন। উইক এন্ডে বাড়ি যান।
হলে পাখা নেই। তাই জানলা কখনই বন্ধ করা হয় না। এই জানুয়ারি মাসের শীতেও না। তবে বর্ষার দিনের কথা আলাদা। নইলে বিছানা ভিজে যাবার ভয়। সামনের পানাপুকুর থেকে একটা আঁশটে গন্ধ ভেসে আসছে, আর নীচের তলা থেকে সোঁদা গন্ধ।
আসলে মার্কিন সংস্থা CARE-এর থেকে পাঠানো গুঁড়ো দুধে বড় গামলায় জলে মিশিয়ে সপ্তাহে তিন দিন উদ্বাস্তু কলোনির বাচাকাচ্চাদের মধ্যে বিলি করা হয়। নীচের তলায় তার গুদাম ঘর। গন্ধ আসছে সেখান থেকে। আমরা এতে অভ্যস্ত। নাকে সয়ে গেছে। সয়ে গেছে জানলা দিয়ে ক্রমাগত ধেয়ে আসা মশার ঝাঁক। পানাপুকুরটায় ওর চাষ হয় নির্ঘাত। আমি ভূগোল বই খুলে ‘আফ্রিকাকে কেন অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ বলা হয়' মুখস্থ করার ফাঁকে ফাঁকে চটপট হাত চালিয়ে মশা মারতে থাকি। কোনো কোনো মশা মারলে ওর পেট ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছিটকে পড়ে, তখন বড় আনন্দ হয়। শুকনো মরুটে মশা মেরে মজা পাইনে। তবু মশাদের শবদেহ গুনতি করে একটা টেক্কামার্কা দেশলাই বাক্সে পুরে ফেলি। বন্ধুরা আমাকে শতমশকমারীবীর টাইটেল দিয়েছে যে!
গৌতম ও সহদেবের অংকের খাতা দেখে বকুনি দেওয়ার ফাঁকে অনিমেষদার চোখ ফিরেছে আমার দিকে।
--- অ্যাই, তোর হল? নাকি স্ট্যানলি লিভিংস্টোনের মতো জঙ্গলে পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছিস? এদিকে উঠে আয়!
পাশে একটা বেত সবসময় রাখা থাকলেও উনি সেটার ব্যবহার কদাচিৎ করেন। দরকার পড়লে ওঁর হাতই যথেষ্ট। ফোরহ্যান্ড ব্যাকহ্যান্ড ঝড়ের মতো চলে। তবে মেজাজ বিগড়োলে।
আমি বই হাতে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াই। গুটি গুটি পায়ে ওঁর দিকে এগিয়ে যাই, আর বোঝার চেষ্টা করি যে ওঁর মুড এখন কী-- ইম্পারেটিভ না সাবজাংকটিভ?
পোড়োদের গলার স্বর আচমকা থেমে গেছে। কোনো ঘটনা ঘটবে। আমার কিন্তু 'কানের কাছে নানান সুরে, নামতা শোনায় একশ উড়ে' কেস।
হলের অন্য প্রান্তে দরজায় শব্দ। সবার চোখ সেদিকে ঘুরল। হোস্টেলের কাজের ছোকরা পঞ্চা ঢুকেছে, ওর সঙ্গে একটি ছেলে। শ্যামলা লম্বাটে গড়ন, মুখে একটু অপ্রস্তুত লজ্জা লজ্জা হাসি। ওর চোখ গিয়ে থেমেছে স্যারের পাশে রাখা বেতগাছার দিকে, আর চেহারায় খেলছে একটু ভয়ের ছায়া। কিন্তু এইটের ছেলে ফুলপ্যান্ট পরেছে? আর গায়ে ওটা কী? এই রকম সোয়েটার তো শুনেছি 'বিশ সাল বাদ' সিনেমার নায়ক বিশ্বজিৎ পরে। এ নিশ্চয় লুকিয়ে লুকিয়ে সিগ্রেট খায়।
ঠিক আছে; একে সময়মত ঠিক সাইজ করে নেওয়া যাবে। কোন সেকশনে ভর্তি হয়েছে? আর ওর বেডিং স্যুটকেস থালা বাটি? কোন হলে?
কৌতূহল খানিকটা মিটল। পঞ্চা স্যারকে জানিয়ে দিল যে নতুন ছেলে বিপ্লব আজই ভর্তি হয়েছে, সেকশন এ। সীট পেয়েছে বিবেকানন্দ হলে। মহারাজ ওকে অনিমেষদার টিউটোরিয়ালে বসতে বলেছেন। অনিমেষদার প্রশ্নে ছেলেটি নিজেই জানাল যে ও হেয়ার স্কুল থেকে এসেছে। ওর বাবা দুর্গাপুরে বদলি হয়ে গেছেন, তাই হোস্টেলে।
আমাকে মশা কামড়ায়; টের পাই না। হাফপ্যান্টের ফাঁকে কোথায় চুলকোতে চুলকোতে ফুলে ওঠে। ও নিয়ে ভাবি না। স্যার ওঠার আগে কালকের জন্যে টাস্ক নোট করিয়ে দিলেন, লেখা হল না।
শেষ হতেই সবাই হুড়োহুড়ি করে নীচে নামতে থাকে। নতুন ছেলেটা একটু হকবকিয়ে গেছে। আমি পা চালিয়ে ওর পাশে দাঁড়াই। বলি-- এখনই খাওয়ার ঘন্টা পড়বে। আমার সঙ্গে চল। কলতলাটা পেছল। আমি দেখিয়ে দেব। হাত মুখ ধুয়ে নাও।
পাশ থেকে কেউ ফুট কাটল-- ওর সঙ্গে যেও না খোকাবাবু। ও মহা ল্যাবা, অংক পারে না। নিজেই পা পিছলে পড়ে যায়!
-- ছাড় না! কেন ওর পেছনে লেগেছিস?
-- দ্যাখ না শালা! প্রথম দিন থেকেই নতুন ছেলেটাকে লাইন মারছে।
সমবেত হো হো হাসি! নতুন ছেলেটা অপ্রস্তুত। আমি ওর হাত ধরে ফেলি। নীচু গলায় বলি --- ফালতু কথায় কান দিও না। নিজেরা তো গত বছর গাব্বু মেরেছে!
পরের দিন রোববার।
আজকে হোস্টেলের টপ দুটো দলে ক্রিকেট ম্যাচ। বেশিরভাগ নাইন আর টেনের ছেলে, জনা দুই এগারো ক্লাস (ওদের এবার বোর্ড আছে না!)। কিন্তু দুতিনটে ক্লাস এইটের ছেলেও আছে--রিজার্ভ বেঞ্চে, আমি তাদের একজন। অফব্রেক মন্দ করি না, কিন্তু ফিল্ডিং ভালো নয়, তাই রিজার্ভের দলে।
ক্লাস টেন-এর বিকাশদা বাড়ি গেছে, একটা বোলার কম পড়েছে, মনে মনে ঠাকুর ঠাকুর করছি--আজ বোধহয় ম্যাচে একটা চান্স পাব। সাদা হাফ প্যান্ট, জামা ও সাদা রং করা কেডস্ পরে লাইনের বাইরে বসে আছি।
কিন্তু এটা কী হল?
ক্যাপ্টেন অমিতদা হঠাৎ নতুন ছেলেটাকে ডাকলেন।
--- ক্রিকেট খেলো? আগের স্কুলে খেলতে?
--হ্যাঁ, স্কুল টিমের হয়ে খেলেছি।
মিথ্যে কথা! এই মুখচোরা লালটুমতো ছেলেটা কিছুতেই হেয়ার স্কুলের মতো অভিজাত স্কুলের টিমে রেগুলার হতে পারে না। নিঘ্ঘাত ইম্প্রেস করার জন্যে ঢপ দিচ্ছে।
-- একবার ট্রায়াল ম্যাচে খেলালে হয় না? ওরা ডিউস বলে খেলে। আমদের তো টেনিস বল।
--অ্যাই! তোকে কে জিজ্ঞেস করছে? নিজের চরকায় তেল দে।
যাঃ, ক্যাপ্টেনকে রাগিয়ে দিয়েছি। আমার চান্স গেল। এই ছেলেকেই না আমি কাল হাত ধরে ডাইনিং হলে নিয়ে গেছলাম? এছাড়া কলঘর, মশারি টাঙানোর কায়দা, কিছু কিছু বিধিসম্মত সতর্কীকরণ!
ক্যাপ্টেন ভুল করেনি।
ছেলেটা ওপেনিং নেমে বেশ ব্যাট করল। দু'হাত আগে পড়ে লাফিয়ে ওঠা বলগুলোকে ব্যাকফুটে টো-এর ওপর ভর দিয়ে আস্তে করে নামিয়ে দিচ্ছিল। ফরওয়ার্ড শর্ট লেগ ও গালির ছেলেগুলো ক্যাচ নেওয়ার চেষ্টা করে মাটিতে গড়াল।
প্রথম দিনেই গোটা হোস্টেল ওর দিকে আলাদা ভাবে তাকাতে শুরু করল।
আরে! তিন দিন পরেই বেলুড়ে স্বামী বিবেকানন্দ জন্মোৎসবে ছাত্রদের দিন! বেলুড় কলেজের সঙ্গে অন্য স্কুল থেকেও কিছু কিছু চান্স দেওয়া হবে।
আমাদের ভাগ্যে জুটেছে স্বামীজির লেখা কবিতার আবৃত্তি।
বাংলা আবৃত্তিতে অবশ্যই আমি। প্রতিবার হোস্টেলে এবং স্কুলে সমস্ত ব্যাচ মিলিয়ে আবৃত্তি চ্যাম্পিয়ন। হুঁ হুঁ বাবা! বরানগরের কুঠিঘাট রোডের ভব রায় আমাকে হাতে ধরে শিখিয়েছেন। উনি ইউনিভার্সিটির দিনে কয়েকবার "সারা বাংলা আবৃত্তি প্রতিযোগিতা"র চ্যাম্পিয়ন।
ঠিক হল, বরানগর ইউনিটকে রিপ্রেজেন্ট করব আমি। সেই ‘সখার প্রতি’, সেই 'বহুরূপে সম্মুখে তোমার'। লম্বা কবিতা, প্রায় চার পাতা। কিন্তু এতবার করেছি যে মুখস্থ হয়ে গেছে। আচ্ছা, ইংরেজিটা কেউ ট্রাই করবে? The Cup? কেউ এগোয় না।
-- রঞ্জন?
এই সুযোগ, ইংরেজি বাংলা দুটোই আমি? এ যে শালা জ্যাকপট!
কিন্তু আমি দুলাইন বই দেখে বলতেই স্যার হাত তুললেন।
--শোনো, তুমি কবিতাটা বুঝতে পারোনি। এই কাপ চায়ের কাপ নয়। এ বয়সে বোঝা সম্ভবও নয়। কিন্তু এই ইংরেজি উচ্চারণ নিয়ে বেলুড়ের স্টেজে---! নাঃ, শুধু বাংলাটাই করো।
--আমি ট্র্রাই করব?
সেই নতুন ছেলেটা! মহা পাকা তো!
-- This is your cup.
The cup assigned to you from the beginning.
Nay my child,
স্যার হাত তুললেনঃ তুমি ও কে! ছোটো কবিতা, আজকে মুখস্থ করে ফেলবে। এই প্রথম বরানগর বাংলার সঙ্গে ইংরেজি রিসাইটেশনেও পার্টিসিপেট করবে।
সবাই লাজুক হেসে নিজের জায়গায় ফিরে যাওয়া ছেলেটার দিকে প্রশংসার চোখে তাকিয়ে। আমি স্যারের মাথার পেছনে সাদা দেওয়ালে একট টিকটিকি কেমন পোকা ধরছে সেটা মন দিয়ে দেখতে লাগলাম।
এই বিপ্লব ছেলেটাকে আর পাত্তা দেব না। ও কোনোদিন আমার বন্ধু হবে না।
তিন দিন পরের সকাল। আমরা কজন অনিলদা, মানে আমাদের ছোটো মহারাজ, ও একজন ওয়ার্ডেনের সঙ্গে বরানগর কুঠিঘাট থেকে নৌকোয় উঠেছি। গঙ্গার বুকে একটু কুয়াশা কুয়াশা ভাব। আমি মাঝখানে একধারে বসেছি। দেখছি যে দাঁড়ের আঘাতে জলের বুকে কেমন ছোটো ছোটো ঘূর্ণি তৈরি হচ্ছে। কোথাও এক-আধটা নিঃসঙ্গ কচুরিপানা ভেসে যাচ্ছে।
কোত্থেকে একটা বেয়াড়া লাইন মাথার ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছেঃ
ওই গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর।
দিবাকর? সূর্য? এখনও ভালো করে ওঠেনি। কেমন ফ্যাকাশে ম্যাদামারা রোদ্দুর। একটা হাফ সোয়েটার পরে আছি, শীত শীত করছে।
বিপ্লব হাসছে, আমাকে হাত নেড়ে কাছে আসতে বলছে। আমি এখানেই বেশ আছি। নৌকো পাড়ে ভিড়ল। ভাটার সময়। ঘাটের কাছে থকথকে কাদা। একটা কাঠের পাটাতন দিয়ে নৌকো থেকে যাত্রীদের কাদা এড়িয়ে শুকনো ডাঙায় পা রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিপ্লব কাঠের পাটায় পা রাখতে ইতঃস্তত করছিল। এঃ, ভয় পেয়েছে খোকাবাবু! এবার হেয়ার স্কুলের ফাট বেরিয়ে যাবে।
আমি ওর পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। ও করুণ চোখে আমাকে দেখল।
পা রাখল, পাটাতন দুলছে। অনিল মহারাজ বললেন-- কী হল? তাড়াতাড়ি কর।
ও আদ্দেক রাস্তা পেরিয়ে এসেছে। এই বার আর দুটো স্টেপ। কিন্তু পাটাতন বড্ড দুলছে যে! সবাই মন দিয়ে দেখছে।
আমি নিজের অজান্তেই কখন পাটাতনের কাছে পৌঁছে গেছি। শেষ পা রাখতেই পাটাতন বিচ্ছিরি ভাবে নড়ে সরে গেল আর বিপ্লব ব্যালান্স হারিয়ে হুড়মুড়িয়ে এক পা শুকনো মাটিতে আর এক পা কাদায় পড়ে গেল।
না, ঠিক পড়ে যায়নি। কেউ কিছু বোঝার আগেই আমি ওর এক হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মেরেছি, ও এসে হুড়মুড়িয়ে আমার গায়ে এসে পড়ল। আমিও হয়তো পড়ে যেতাম। কিন্তু তার আগেই অনিমেষদা আমাকে ধরে সামলে দিলেন। সবাই হেসে উঠল। ওর মুখটা লাল। কিন্তু আমাকে বলল-- থ্যাংকস্!
আমি বাংলায় বললাম-- ঠিক আছে।
ও কি কোনো বিশেষ সেন্ট মাখে। নইলে কেমন একটা অন্যরকম গন্ধ কেন ওর গায়ে? অচেনা গন্ধটা ভালো লাগছে।
এটা কি ইংলিশ মিডিয়াম ছেলেদের গায়ের গন্ধ? নাকি শুধু হেয়ার স্কুল হিন্দু স্কুল ছেলেদের?
আমরা এগিয়ে যাচ্ছি স্টেজের কাছে। এখনও বেশি ভিড় হয়নি। আস্তে আস্তে লোক আসছে। শীতের সকাল। গান হচ্ছে--ক্ষাত্রবীর্য ব্রহ্মতেজ মূর্তি ধরিয়া এল এবার!
অনিমেষদার পেছন পেছন আমি আর বিপ্লব স্টেজের কাছে দাঁড়াই। উনি বল্লেন-- তোমরা এখানেই অপেক্ষা করো। আমি ভেতরে গিয়ে জেনে নিচ্ছি আমাদের কখন চান্স দেবে।
বিপ্লব বলল-- গানের সুরটা বেশ ভাল লাগছে।
আমি গম্ভীর মুখে বলি-- রাগ মালকোষ, তাল তেওড়া।
ওর চোখ বড়বড়।--তুমি এসব জানো? গান শিখছ?
-- এখানে সবাইকে শিখতে হয়। তোমার ইচ্ছে থাকলে তুমিও শিখে যাবে। সবে তো এসেছ। ওর চোখে বেশ সম্ভ্রম। আমার হাত ধরে। বলে আমি নাকি কাদায় পড়ার হাত থেকে ওকে বাঁচিয়েছি। জামাকাপড়ে একরাশ কাদা নিয়ে ও কী করে স্টেজে উঠত!
যাকগে, অনিমেষদা আসলেই আমরা ব্যাকস্টেজে বড়ো ঘরটায় এন্ট্রি পাব। তখন নিশ্চয়ই স্পেশাল জলখাবার দেবে। সাতসক্কালে বেরিয়েছি। খিদে পেয়েছে চড়চড় করে।
হঠাৎ কানখাড়া হয়। কখন গান শেষ হয়ে কবিতা আবৃত্তি শুরু হয়েছে, বাংলায়।
"--- দ্বন্দ্বযুদ্ধ চলে অনিবার,আরে! এটাই তো আমার করার কথা, স্বামী বিবেকানন্দের "সখার প্রতি"! একটি কলেজের ছেলে করছে, ভারী গলা। মন্দ নয়। কিন্তু আমি এর চেয়ে ভাল করি। তাহলে?
পিতাপুত্রে নাহি দেয় স্থান।
স্বার্থ স্বার্থ সদা এই রব,
কেবা পারে ছাড়িতে সংসার?"
অনিমেষদা ফিরে এলেন। কেমন শুকনো মুখ।
-- বাংলা কবিতাটা ওরাই করে দিল; দেখলে তো? ইংরেজিটার জন্যে বিপ্লবকে ভেতরে ডাকছে। তুমি বরং রাজা মহারাজের মন্দিরের কাছে চলে যাও। ওখানে ভলান্টিয়ারদের জলখাবার দিচ্ছে। ওখানেই ডিউটি করো। সেকেন্ড হাফে সম্ভবত তোমাকে একটা চান্স দেবে। আমি তখন তোমাকে ওখান থেকে ডেকে আনব।
অনিমেষদা বিপ্লবকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। ও একবার আমার দিকে দেখল। আমি রাজা মহারাজের মন্দিরের দিকে হাঁটছি। বড্ড খিদে পেয়েছে যে! সামনে অন্য একটা মন্দির। সেখানেই দেখি ভলান্টিয়ারদের জন্যে লুচি আর আলুর ঘ্যাঁটমতো দিচ্ছে। ওখানে আমাদের হোস্টেলের ক'জনকেও দেখতে পাচ্ছি। মহা উৎসাহে ওরা আমাকে জলখাবারের লাইনে ঢুকিয়ে নিল। খাবার পর জ্যোতিষ বলল- তুই এখানে আমাদের সঙ্গেই থাক। সহজ কাজ।
কাজটা হল পাবলিকের জুতো রাখা। একদিকে সারি সারি জুতো আর চটি। অন্যদিকে বড়ো বড়ো করে নম্বর লেখা একগাদা কাগজের স্লিপ আর একটা বালতিতে জ্বাল দেওয়া ময়দার লেই।
আমি মন দিয়ে লোকের কাছ থেকে জুতো নিই। ওদের একটা নম্বরের কাগজ ধরিয়ে দিই। বলি- সামলে রাখবেন, নইলে--!
তারপর যমজ স্লিপটির নীচে বেশ করে আঠা লাগিয়ে জুতোর তলায় হাত লাগিয়ে সেঁটে দিই। এভাবে খানিকক্ষণ পরে জুতোর তলার ধুলো ও আঠা মিলেমিশে আমার হাতের চেটোয় এক বিচিত্র নকশা তৈরি করে। বন্ধুরা বলে-- যা, দুটো বিল্ডিং-এর পরে একটা কল আছে। সেখান থেকে হাত ধুয়ে একটু ঘুরেটুরে আয়।
-- মানে?
-- আরে যত কাজ তার থেকে ভলান্টিয়র বেশি। তাই আমরা মাঝে মাঝে ডিউটি বদল করব। আমরা আগে ঘুরে এসেছি। এবার তুই যা। খালি ভলান্টিয়র ব্যাজটা খুলে পকেটে ঢোকা, কোনো গেরুয়া যদি দেখে ফেলে তো চিত্তির!
আমি হাত ধুতে থাকি। ধুয়ে মুছে তারপর ব্যাজ পকেটে পুরবো। এমন সময় কাছে একটি বাঁশের খুঁটিতে বাঁধা অ্যাম্প্লিফায়ার গর্জন করে ওঠে-- This is your cup. The cup assigned to you from the beginning. বিপ্লবের গলা।
আমি আর ভলান্টিয়র ক্যাম্পে ফিরে যাই না। ঘুরে বেড়াই। মন্দির এরিয়া থেকে যতটা সম্ভব দূরে। বিশাল গঙ্গার পাড়। সবুজ ঘাস। কিছু কিছু জোড়া ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছে। তাদের অলস কৌতূহলে দেখি। এগিয়ে চলি।
নানান দোকানপাট, কেনা-কাটা। যেন হাট বসেছে। এক জায়গায় পূপস বলে একটা কোম্পানি লাল সরবত বিক্রি করছে। না, পয়সা নিচ্ছে না। অর্থাৎ বিলোচ্ছে। কাঁচের গেলাসে লাল শরবত। লোকের কাড়াকাড়ি। আমি ভিড়ের মধ্যে মাথা গলাই। লোকেদের কনুইগুলো একধাক্কায় সরিয়ে দিই। কেউ কড়া চোখে তাকালে আমার পকেটে পিন দিয়ে সাঁটা ব্যাজ দেখাই। জায়গা ছেড়ে দেয়। এভাবে দুগ্লাস মিঠে শরবত খেয়ে শরীর জুড়োয়। কিন্তু বরফে গলা খুসখুস করে।
এরপরে আর একটি ছোটোখাটো ভিড়ের দিকে গিয়ে দেখি লেক্স সিগ্রেট বিলোনো হচ্ছে। বিজ্ঞাপন। সেখানেও দুটো বাগাই--একই কায়দায়। পাটের দড়ি থেকে একটা ধরিয়ে দুটো টান মেরে কাশতে শুরু করেছি কি পেছন থেকে আওয়াজ-- এ কী প্রদ্যুম্ন! তুমি সিগ্রেট খাও?
বিপ্লব হাঁফাচ্ছে।
-- কখন থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। শোনো, অনিমেষদা তোমাকে খুঁজছেন। এই নাও খাওয়ার টিকেট। এটা নিয়ে দুপুরের প্রসাদ খেতে পারবে। কিন্তু এটা?
আমি কথা না বাড়িয়ে অন্য সিগ্রেটটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিই। খাবে?
ও চমকে যায়। তারপর হেসে ফেলে।
-- ঠিক আছে। কিন্তু তার আগে পকেট থেকে ব্যাজটা খুলে ফেলো, আমিও খুলছি।
সন্ধ্যের দিকে ফেরার পালা। নৌকোগুলোয় অসম্ভব ভিড়। স্বামীজি কিছু ছেলেকে নিয়ে আগেই দক্ষিণেশ্বর চলে গেছেন। সেখানে দর্শন করে ৩২ বা ৩৪ নম্বর বাসে ফিরবেন। আমরা ক'জন নৌকোর যাত্রী।
অন্ধকারে টেমির আলোয় অনিমেষদা টিকেট কিনলেন। অন্ধকারে ঠাহর হয় না। একজন অচেনা লোক হাত ধরে আমাকে নৌকোয় তোলে। অনিমেষদা আর বিপ্লব যে কোন দিকে বসেছে টের পাইনে।
কালো আকাশ। কালো জল। শুধু দাঁড়ের ছপ ছপ শব্দ। বড্ড শীত করছে।