প্রতিবছরই হয়; এবার যেন একটু অন্যরকম। আমরা ভলান্টিয়ার যে! ভলান্টিয়ার মানে অন্যদের ওপর মাতব্বরি করার সুযোগ। খেলার মাঠ জুড়ে প্যান্ডাল বাঁধা হচ্ছে; কিছু কিছু ঘুগনি-চপ-ফুলুরির দোকান বসে গেছে। চারদিকে বেশ একটা ছুটি ছুটি ভাব; দিনের বেলায় ক্লাসে না গেলেও চলে, সন্ধ্যের থেকে উৎসব!
হেড মাস্টার বা অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মাস্টার যাই বলুন-- আমাদের ব্যাজ আছে। ডে-স্কলার ছেলেগুলো হিংসেয় জ্বলে মরে। বেশ কিছু বরানগরের স্থানীয় বন্ধুরা একদিনে অপরিচিত হয়ে যায়।
সাধুসেবার দিন নানান প্রান্ত থেকে মিশনের সাধুরা আসছেন, কেউ কেউ হিন্দি টানে বাংলা বলেন। বেশিরভাগই আমাদের পাত্তা না দিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা ও গানগল্পে মেতে থাকেন। আমরা নানারকম ফাইফরমাস খাটি।
ব্যতিক্রমী একজন--দেওঘরের মহারাজ-- আমাদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দেন। তোদের হইল কী রে! ই'রকম নিমপাতা মুখ কেন? শোন শোন, একটা ছেইলে নিমপাতা হাতে নিয়ে আসিতেছিল তো ওর নাম হইল নিমাই! যদি জামপাতা নিয়ে আসে তো কী নাম হইবে?
আমরা ইচ্ছে করে প্রত্যাশিত উত্তরটি না দিয়ে ভ্যাবাচাকা মুখ করি।
-- পারলি না তো?- জামাই--হা-হা-হা-হা!
আমরাও হেসে উঠি।
তারপর ওঁদের পাত পেড়ে খাওয়াতে লেগে যাই। কোমরে প্যান্টের ওপর সেই বাঁদিপোতার গামছা বেঁধে বালতি, পেতলের গামলা ও হাতা।
সে কী খাওয়া! বড় বড় মাছভাজা, ডিম সেদ্ধ, মাংসের ঝোল, চাটনি, ছানার পায়েস ও সন্দেশ; আর বেশ বড় বড় ফজলি আম।
কিন্তু কী আশ্চর্য! এসব সাধুদের জন্যে; আমাদের বাচ্চা ধাড়ি কারও জন্যে নয়। মনটা বিদ্রোহ করে ওঠে।
যে একান্নবর্তী পরিবার থেকে এসেছি সেখানে খাওয়াদাওয়ায় বাচ্চাদের অগ্রাধিকার। আর কাজের লোক? ওরাও একই খাবার পাবে; হয়তো মাছের পিস শুধু একটা, তবুও পাবে তো! এখানে দেখছি আমরা যা পরিবেশন করছি তা পাব না! আমাদের কপালে সেই কারি পাউডার দিয়ে রাঁধা আধসেদ্ধ ঝোল। দুস্ শালা; আমাদের নজর লেগে ঠিক মহারাজদের পেট খারাপ হবে।
বিপ্লবকে বলি--একচোখোমিটা দেখলি?
ও হাসে। আরে, ওঁরা সন্ন্যাসী, সংসার ছেড়ে এসেছেন। ত্যাগ করেছেন। একদিন একটু ভাল- মন্দ খাবেন, তাতেও তোর ইল্লি!
-- হুঁঃ, অমন খাওয়াদদাওয়া পেলে আমিও সন্ন্যাসী হব। সে ওরা খান, তাতে কিছু না। কিন্তু আমরা কেন পাব না? আমরা তো ফ্রি-তে থাকছি না। আমাদের বাবা-কাকারা রীতিমতো হোস্টেলের চার্জ পে করছেন।
বিকেল তিনটে।
ডাইনিং হল খালি। শুধু আমরা যারা পরিবেশন করেছিলাম সেই চোদ্দজনের খেতে বসা বাকি। আমার কিছু ভাল লাগছে না। বলি--খেতে ইচ্ছে করছে না। রুমে যাচ্ছি।
বিপ্লব বলে-- ঠিক আছে, তোর খাবার আমি ঢাকা দিয়ে রুমে রেখে নেব। যখন খিদে পাবে খেয়ে নিবি।
দোতলায় উঠে নিজের রুমে শুতে যাব, কিন্তু দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। বিরক্ত হয়ে খটখট করি, কোন সাড়া নেই। এবার দরজায় তিন লাথি! খোল শালা!
-- কে?
আরে! এ যে আমার গুরু অমিয়দার গলা। খোল গুরু! কী ইয়ার্কি হচ্ছে?
-- তুই একা?
-- না, বরযাত্রী নিয়ে এসেছি। খোল বলছি।
দরজা খুলে যায় আর আমি ঢোকা মাত্র বন্ধ হয়।
আমার চোখ ছানাবড়া! ঘরের মধ্যে অন্তত দশ জন। তিনটে বালতি-ভর্তি ফিশ ফ্রাই, ফজলি আম আর সন্দেশ! সবার মুখ ভর্তি। প্রাণপণে সাঁটাচ্ছে!
গুরুর মুখে লজ্জা লজ্জা হাসি।
-- এটা কী হল গুরু? এতবড় অপারেশন! তোমার ডানহাতও আছে, অন্য ছেলেরাও আছে। শুধু বাঁহাত আমিই বাদ? আমাকে বিশ্বাস কর না?
ডানহাত প্রশান্ত ফুট কাটে-- খাওয়াটা তো ডানহাতেরই ব্যাপার, বাঁ-হাত তো শুধু পোঁদ ধুতে কাজে লাগে। তখন তোকে খবর করা হবে।
বড় কিছু হবার আগেই গুরু মাঝখানে এসে দাঁড়ায়।
--ব্যস্ ব্যস্। খেতে শুরু কর। তুই রাগ করে খাস নি, খবর পেয়েছি। সবাই মিলে হাত চালা। কিছু বাঁচানো যাবে না। তারপরে খালি বালতিগুলো কায়দা করে ফেরত দিয়ে আসতে হবে। খেয়ে দেয়ে জম্পেশ ঘুম।
সন্ধ্যেয় স্নানটান সেজেগুজে প্যান্ডেলে। মেয়েদের লাইনে ভলান্টিয়ারি করা নিয়ে কম্পিটিশন আছে যে! আজ পথের পাঁচালি দেখানো হবে। বইটা পড়েছি। সিনেমাটার এত নাম! দেখতেই হবে।
কিন্তু তখন মুখের স্বাদ তেতো হয়ে গেল।
সন্ধ্যের আলো-ঝলমল মঞ্চ এখন অন্ধকার। অতিথি শিল্পীরা তাঁদের কাজ করে ভূরিভোজ খেয়ে বিদায় নিয়েছেন। এখন সিনেমা দেখানো হবে। তাই অধিকাংশ আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আমরা ভলান্টিয়াররা ফুরসত পেয়েছি; ঢের হল। আমাদের খাওয়া জুটবে সিনেমা শেষ হলে। অস্থায়ী মঞ্চের পাশে স্কুল বিল্ডিংয়ের লাগোয়া চারটে থাম দিয়ে তৈরি স্থায়ী সিমেন্টের স্টেজ। এখানেই যাত্রা হয়, নাটক হয়, বিশ্বশ্রী মনোতোষ রায় বা বরানগরের ডাবের দোকানের মালিক ভারতশ্রী বিশ্বনাথ দত্তের 'দেহশ্রী শো' হয়।
সেখানেই টাঙানো হয়েছে একটি সাদা পর্দা। ওদিকে আশ্রমের কর্মী গৌরদা ১৬ মিলিমিটারের প্রোজেক্টর নিয়ে পজিশন নিয়েছেন; স্পুল লাগানো হয়ে গেছে। ওঁর একটিই হাত, আরেকটি কব্জি থেকে নেই। কু-লোকে বলে বোমা বাঁধতে গিয়ে এই হাল। তা উনি এক হাতেই ভলিবল ম্যাচে নেটের সামনে লাফিয়ে উঠে স্ম্যাশ করেন। সেই হাতেই সিনেমার প্রোজেক্টর অপারেট করেন। পান ভরা গালে স্মিত চেহারায় এমন একটা ভাব যেন দুনিয়ার কাছে ওঁর কিছু চাইবার নেই।
সিনেমা শুরু হল। সাদা কালো।
কিন্তু খানিকক্ষণ পরেই খেই হারিয়ে ফেললাম। ঘুমে চোখ ঢুলু ঢুলু। জোর করে তাকিয়ে দেখতে গিয়ে একবার ইন্দির ঠাকরুণের গাছের তলায় শুয়ে পড়া আর ঘটি গড়িয়ে যাওয়া চোখে পড়ল।
পাশের থেকে বিপ্লব গুঁতো মারল।
--কী হচ্ছে কী?
-- লাকি, সিনেমা দেখবি না গেঁয়ো ভূতের মত ঢুলে পড়বি?
-- ঘুম পাচ্ছে রে! ঘরের চাবিটা দে তো, আমি যাচ্ছি। খাবার ঘন্টা পড়লে ডেকে দিস।
উঠে রওনা দিলাম। কিন্তু ঘর যে অনেক দূর! আর ঘুটঘুটে অন্ধকারে এই নিস্তরঙ্গ জনসমুদ্রের মধ্যে থেকে ঘুম চোখে সাঁতরে বেরোনো?
বুদ্ধি খেলল। উল্টো দিকে হাঁটি। পর্দাটার কাছে। ওখানে অন্ধকারে থামে হেলান দিয়ে চমৎকার ঘুম দেব। কেউ দেখতে পারবে না, টেরও পাবে না। কাউকে ডিস্টার্ব না করে ভদ্রলোকের মতো, জম্পেশ হবে।
যেমন ভাবা তেমনি কাজ। বাঁদিকের থামটায় হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। আমার ডান দিকে হাত পাঁচ দূরে লোহার চাকাওয়ালা ফ্রেমে সাদা পর্দায় অপু দুর্গা হরিহর কি সব বলাবলি করছে। ওদের চেহারা দেখতে পারছি না; কথা কানে আসতে আসতে অস্পষ্ট হয়ে ভ্রমরগুঞ্জন।
আঃ, কোথায় শোনা একটা হিন্দিগানের কলি মাথার ভেতরে গুনগুন করছে-- আরাম বড়ী চিজ হ্যায় মুহ্ ঢাককে শৌইয়ে!
আমি মন দিয়ে সিনেমার ডায়লগ শোনার ভান করি।
আমি কান পেতে শুনি-- অপু! দুর্গা! এরা সব গেল কোথায়?
আচমকা সব কথাবার্তা বন্ধ। কঁকিয়ে উঠেছে সেতার ও তারসানাই। সর্বজয়া কান্নায় ভেঙে পড়ছে।
ভীড় এবার যে যার ঘরমুখো হবে। আমার পকেটেই রুমের চাবি। পা চালাই।
ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখি অবাক কাণ্ড; তালা খোলা কিন্তু আলো নেভানো, আর সমস্ত বিছানায় মশারি টাঙিয়ে ভালো করে গোঁজা। আমার বিছানায় মশারি কে টাঙিয়েছে?
কাছে গিয়ে দেখি ভেতরে কেউ শুয়ে রয়েছে। রাগে পিত্তি জ্বলে গেল। আমার বিছানায় কেউ আয়েস করে ঘুমুচ্ছে কিন্তু আমিই জানি না! এ তো সেই ট্রেসপাস না কি যেন বলে! আবার ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে নাক ডাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে!
--অ্যাই কে রে! কোন শালা ঢুকেছিস? বেরিয়ে আয়!
প্রথমে কোন সাড়া নেই। কিন্তু নাক ডাকার শব্দ থেমে গেল। কী ব্যাপার?
লাইটের সুইচ টিপে দিই, আরও চড়া গলায় বলি-- বেরিয়ে আয় বলছি। ন্যাকামি হচ্ছে?
ওরে বাবারে! পুরো বাক্য শোনার আগেই টেনে ছুট লাগাই। এক শ্বাসে সোজা ডাইনিং হল। পরিবেশন শুরু হয়েছে। একটা পিঁড়িতে বসে পড়েছি। আজ আর থালা ধোয়ার ঝামেলা নেই। এই কদিনের জন্যে বেশ কিছু শালপাতা আনানো হয়েছে, একটা টেনে নিলেই হল।
আজকে খিচুড়ি আর আলুভাজা। গোগ্রাসে খাই। তারপর হাতটাত ধুয়ে বন্ধুদের খোঁজ।
--উঃ, যা ভয় পেয়েছি না! ঘর খুলেছে কে? আর ওই সব মহিষাসুর লোকজন? আমি আর আজ রাত্তিরে আমার ঘরে যাচ্ছি না।
সবাই হেসে ওঠে। প্রশান্ত খ্যা-খ্যা করে হাসে। বলে--পোদো নিঘ্ঘাৎ মহিষবাথানের কোন মোষকে খেপিয়েছে।
-- মানে?
--শোন, ওরা হল আমাদের ক্লাসের গোলকপতির বাবা-কাকা- মা-কাকিমার দল। কোলকাতার কাছেই মহিষবাথান বলে একটা গাঁ থেকে এসেছে। ওদের মাছের ভেড়ি।
-- তা আমাদের বিছানায় ঢুকেছে কেন? আর তালা খুলল কী করে? আমাদের না জানিয়ে?
-- সবটা শোন না! ওরা ঠিক করেছেন যে রাত্তিরটা এখানেই থাকবেন, সকালে ফিরে যাবেন। তাই গোলক অমিয়দাকে ধরল। তুই আগে চাবি নিয়ে গেলি। কিন্তু ঘরে ফিরিস নি। তখন আমরা অমিয়দাকে দিয়ে অফিস থেকে ডুপ্লিকেট চাবি আনিয়ে ঘর খুলেছি। পর পর দুটো ঘর ছেড়েছি। একটায় গোলকের বাবা-কাকারা, আর অন্যটায় মা-কাকিমারা।
আমার রাগ যায় না। এসব কে ঠিক করেছে?
আমাদের গুরু অমিয়দা হেসে বলে-- আমি। রাগিস না, মাত্তর একটা রাত্তির।
--আর আমরা কি সারারাত্তির নিল-ডাউন হয়ে থাকব, না মুরগী হয়ে?
আবার একপ্রস্থ হাসি।
বিপ্লব বলে-- গুরুর উপর ভরসা রাখ তবে তো ভবদরিয়া পার হবে। আরে গুরু রামকানাই মহারাজকে বলে আজকের জন্যে স্পেশাল পারমিশন আদায় করেছে--আমরা ছোট ছাদে শোব। মনটা খুশি খুশি হয়ে যায়। ছোট ছাদ? মানে আমাদের লুকিয়ে সিগ্রেট খাওয়ার ঠেক? নাঃ, গুরুর প্রতিভা আছে।
আমরা বেশিরভাগ নতুন ধোঁয়া খাওয়া শিখেছি। মিন্ট দেওয়া 'কুল' দিয়ে শুরু করে পেয়ারা পাতা চিবিয়ে ধরা পড়ার ভয় কাটিয়ে পাসিং শো, রেড অ্যান্ড হোয়াইট, লেক্স, সিজার পেরিয়ে এখন পানামায় স্থিতু হয়েছি। গুরু ও প্রশান্ত চার্মিনারে। ঘরে পাখা নেই, তাই একটা গুমোট থাকে।
ছাদে অনেক জায়গা। এদিক-ওদিক ছড়িয়েছিটিয়ে বা পাশাপাশি চাদর পেতে শুয়েছি আমরা দশ জন। আমি ও বিপ্লব একটু কোনার দিকে। ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। সবার চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একজন দুজন এখনও সিগ্রেটের শেষ টানগুলো দিচ্ছে। কেউ কেশে উঠল।
কিছু নিয়ম বদলে গিয়েছে। আগে দু-বেলাই ঘরে বসে পড়াশুনো দেখতেন আশ্রমিক টিচারেরা। এখন এক বেলা পড়াবেন বাইরে থেকে এসে প্রফেশনাল টিউটররা। এমনিভাবে পেয়েছিলাম সমীরদা বা কুঠিঘাট রোডের ভব রায়কে।
উনি শেখালেন কবিতা আবৃত্তি, উৎসাহ দিতেন কবিতা লিখতে বা দেওয়াল পত্রিকা বের করতে। আর আমার সঙ্গে কথা হত কম্যুনিস্ট পার্টি নিয়ে।
আমি দেখলাম ষাটের দশকের কম্যুনিস্টরা ভীষণভাবে রাবীন্দ্রিক, প্রায় শান্তিনিকেতনীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেন। এঁরা মাঝেমধ্যে শান্তিনিকেতনে যান। জীবনানন্দেরও ভক্ত, মাথায় অবিন্যস্ত বাবরি চুল ও দাড়ি কাটতে অনীহা। পরনে খদ্দরের গেরুয়া পাঞ্জাবি ও সাদা পায়জামা, কাঁধে একটি শান্তিনিকেতনী ঝোলা। এদের চেহারায় ক্রোধের থেকেও কেমন একটা উদাসী বাউল ভাব। যেন 'আমি রব নিষ্ফলের হতাশের দলে'।
উনি আমাকে পড়ালেন "শেষের কবিতা"। আমার দারুণ লাগল। মনে হল তাহলে একসঙ্গে দুজনকেও ভালবাসা যায়। কেটি মিত্র ঘরের পুকুর আর লাবণ্য পুরীর সমুদ্র--বাঃ!
আর একটা জীবনানন্দের কবিতা নিয়ে প্রবন্ধ। তাতে এজরা পাউন্ড, পল ভালেরি ও এলিয়ট নামগুলো শুনলাম--কিস্যু বুঝলাম না। ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও অন্য কবিদের নিয়ে কিছু কবিতা ছিল। কোন একজনের কথা ছিল যে বনে বাদাড়ে পাহাড়ে জঙ্গলে নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়ায় --কিন্তু প্রকৃতির রহস্য তার কাছে ধরা দেয় না। একটা অনুবাদ কবিতার লাইনে চোখ আটকে গেল--"তোমারে চুম্বন করি মুর্চ্ছাহত ইন্দ্রিয়সকল। ঊর্ধ্বগামী অঙ্গ মোর---"।
হে ঈশ্বর! কবিদের কি মাথাখারাপ? কাউকে ভালবেসে চুমু খেলে ইন্দ্রিয়ে পক্ষাঘাত হয়? মানুষ গ্যাসবেলুনের মত হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়? নাঃ, আমি অমন চুমু খেতে চাইনে।
ভবদার সঙ্গে এলেন এক ভদ্রলোক -- আমাদের রবীন্দ্রজয়ন্তীর জন্যে গান শেখাতে "আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে" আর "এখন আর দেরি নয়, ধর গো তোরা"।
উনি আমাদের কোন প্রাক্তন হেডস্যারের ছেলে। একবার স্পেশাল গেটপাস বানিয়ে ওঁরা আমাকে নিয়ে গেলেন নিজেদের বাড়িতে। আমাদের রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখানো স্যারের সাদা ধুতি ও ইস্তিরি করা হাতা গোটানো স্যারের পরিশীলিত পোশাক এবং চেহারার আভিজাত্যের সঙ্গে ওঁদের বাড়ির কোন মিল নেই। তবে আমরা গেছলাম ওঁদের পক্ষাঘাতগ্রস্ত বাবার সঙ্গে দেখা করতে।
বরানগরের কলোনী এলাকায় টালির চালের দুখানা ঘর। উঁচু চৌকাঠ। পায়ার তলায় ইঁট পেতে উঁচু করা চৌকির উপরে মলিন চাদরে ঢাকা বিছানায় শুয়ে আছেন এক বৃদ্ধ, উঠে বসতে পারেন না। কোমর পড়ে গেছে। গেঞ্জিটি রোজ বদলানো হয় না। পরনের লুঙ্গিটিও-ও তথৈবচ। অবিন্যস্ত সাদা চুল ও চার-পাঁচ দিনের না-কামানো দাড়ি। সব মিলিয়ে মনটা কেমন দমে যায়। উনি নাকি আমাদের স্কুলের কোন একসময়ে হেডমাস্টার ছিলেন।
কিন্তু একটু পরেই আমরা ভুলে গেলাম যে উনি অসুস্থ, চলৎশক্তিহীন। সকাল নটা-দশটার রোদ্দুর এসে পড়েছে চৌকাঠে। আর সেইখানে এবং রাস্তায় মোড়া টেনে বসে আছে পাড়ার কয়েকটি তরুণ। তারা নাকি এঁর বন্ধু! এরা বিভিন্ন পত্রিকা থেকে পড়ে শোনাচ্ছে নানা খবর। উনি মন দিয়ে শুনে মহা উৎসাহে মেতে উঠছেন তর্কে। উনি নিজের বিছানায় পাশে রেখেছেন একটি দৈনিক-- "স্বাধীনতা"। তখনকার অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা। ও, তাহলে এই স্যারও আমার কাকাদের মত পার্টি করেন!
আমার অবাক রাখল ওঁর খেলা নিয়ে আবেগ দেখে। ব্রাইটন কাপ, সন্তোষ ট্রফি হয়ে তর্ক শুরু হল এ বছর বেঙ্গলের সম্ভাব্য হকি ইলেভেন নিয়ে। ইস্টবেঙ্গল থেকে কাকে নেওয়া হবে আর কাকে কাস্টমস থেকে। ইনামূর রহমান কোথায় খেলবে, লেফ্ট ইন পজিশনে কে বেটার ইত্যাদি। নতুন প্রজন্ম মন দিয়ে শুনছে বৃদ্ধের আর্গুমেন্ট এবং সমানে সমানে তর্ক করছে।
আমার মনটা ভালো হয়ে গেল। আশ্রমে ফিরে বন্ধুদের কাছে সাতকাহন করে ওঁদের বাড়ির গল্প বললাম।
খাওয়ার আগে রামকানাইদার ঘরে গানের আওয়াজ শুনে গিয়ে জাজিমের এককোণে বসে পড়লাম।
তানপুরা ধরেছেন বরানগরের এক প্রৌঢ় খেয়ালিয়া। ওঁর মুখ যেন সপাট তান করতে করতে একদিকে একটু বেঁকে গেছে।
রামকানাইদা স্কেল চেঞ্জিং হারমোনিয়মে সা-পা টিপে গান মালকোষে ধরেছেনঃ
"তারা মুজ্বল পশিল ধরা পরআমাকে ইশারায় খঞ্জনী তুলে নিতে বলে হাতে তাল দেখিয়ে দিতে লাগলেন-- তিন তাল। অসুবিধে নেই। চৌতালের গানগুলোয় বড় মনোযোগ লাগে।
সুন্দর হৃদয় প্রকাশি।
রত্নগর্ভা নারী রত্ন প্রসবিল--
হা- আ-আ------!"
এর পর ভজন-- পগ ঘুংঘরু বন্দ মীরা নাচি রে! আবার মালকোষ এবং সেই তিনতাল। কিন্তু যেই ওই লাইনটা এল--জহর ক্যা প্যালা রাণাজী ভেজা পিবত মীরা হাঁসি রে!-- উনি এর মধ্যে একটু তানকর্তব করে নিলেন। খেয়ালিয়া ভদ্রলোক তানপুরা ছাড়তে ছাড়তে কেয়াবাৎ বলে উঠলেন।
খাওয়ার ঘন্টা পড়লে উঠে যাচ্ছিলাম। উনি ডেকে বললেন-- শোন ব্যাটা! প্রথম গানটা কার লেখা জানিস? স্বয়ং গিরিশ ঘোষের। বিবেকানন্দের উদ্দেশে। পরে আমার থেকে তুলে নিস।
খাওয়ার ঘরে যাচ্ছিলাম একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে। ইদানীং পায়খানার দেয়ালে ওঁকে নিয়ে কিছু কুকথা লেখা হচ্ছে। উনি নাকি বেনামে জমি কিনছেন বরানগরে?
না, এই লোক অমন হতে পারে না। হিসেব মিলছে না।
খেয়েদেয়ে বিছানায় এসে শার্লক হোমস খুলেছি কি গুরুর ডাক পড়ল। কথা আছে।
গিয়ে দেখি ভাল গ্যাঞ্জাম। আমাদের বন্ধুরা ছাড়াও উঁচুক্লাসের কয়েকজন রয়েছে।
এদের মধ্যে মিথিলেশদা, অসীমদা আর সেই বিখ্যাত স্বামী-স্ত্রী জোড়া রাজুদা-বিমানদাও রয়েছে। গুরু এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল-- যে কজন এসেছে তাই যথেষ্ট; অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট। অসীম, বল কী বলতে চাস্?
--বলার কী আছে? তোরা দিন দিন ঢ্যামনা হয়ে যাচ্ছিস। খেয়াল আছে যে রাত্তিরে খাওয়ার পর যে ঘরে ঘরে দুধ দেওয়া হত সেটা বন্ধ হয়ে গেছে?
-- ঠিক বন্ধ হয়ে যায় নি। হস্টেলের চাকরের পক্ষে আর ঘরে ঘরে গিয়ে 'কে দুধ খাবে' বলে সুর করে হাঁক দিয়ে বাটি বাটিতে দুধ ঢেলে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
-- কেন?
-- পঞ্চা আর আপর্তিকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তাই।
-- তাতে কী? নতুন লোক রেখে নিলেই হয়।
--- তাই তো বলছি, যখন লোক পাওয়া যাবে, তখন ফের শুরু হবে।
-- অমিয়, তোর চ্যালাটাকে চুপ করতে বল। ওরে পোদো, দুধ কী আমাদের দানছত্তর করে দেওয়া হয়? এর জন্যে আমাদের বাবা-কাকারা মাসে মাসে ছ'টাকা করে চার্জ দিচ্ছেন না? সে টাকা কোথায় যাচ্ছে?
-- কোথায় যাচ্ছে মানে? দুধের জন্যে নেওয়া টাকা দুধ কিনতে যাচ্ছে।
-- অ! তা সেই দুধ কে খাচ্ছে?
-- আমরাই খাচ্ছিলাম, এখন কেউ না।। নতুন লোক লাগাতে পারলেই ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে।
-- তুই দেখছি মহাক্যালানে! শোন, না জেনে বকবক করিস না। ওই টাকা দিয়ে টবিন রোডে জমি কিনে বাড়ি তৈরি হচ্ছে।
আমি তোতলাতে থাকি।
-- কী বলছেন? কার বাড়ি?
--কার আবার তোদের রামকানাইদার। স্বামী শান্তিনাথানন্দের।
আমার মাথায় আগুন জ্বলে যায়। অনেক সহ্য করেছি। আর নয়।
-- মুখ সামলে অসীমদা! রামকানাই মহারাজের ব্যাপারে ভাল ভাবে কথা বলবেন। সন্ন্যাসী মানুষ। উনি বাড়ি বানাতে যাবেন কার জন্যে?
মিথিলেশদা আমার গালে ঠাঁটিয়ে চড় মারে। আমি মাটিতে পড়ে যাই। বন্ধুরা টেনে তোলে। আমাদের চোখ জ্বলে ওঠে। প্রশান্ত বলে-- পোদোকে মারলেন কেন?
-- সিনিয়রদের মুখ সামলে বলেছে! আস্পদ্দা কম নয়! নিজের মুখ সামলাক।
এবার গুরু অমিয়দা এসে মাঝখানে দাঁড়ায়।
--ব্যস্ ব্যস্! আর না। পোদো তো খালি জিগ্যেস করেছে সন্ন্যাসী মানুষ খামোখা বাড়ি বানাতে যাবেন কেন?
-- ও না জেনে বালের মত কথা বলছে! আমাদের কাছে খবর আছে যে রামকানাই মহারাজ শীগ্গিরই গেরুয়া ছেড়ে সংসার ধর্মে ফিরে যাবেন।
আমাদের বাক্যি হরে গেল। এ ও কী সম্ভব? একবার গেরুয়া ধরলে সেটা ছেড়ে আবার সংসারে ফেরা যায়?
অমিয়দা বলল--যায়, কিন্তু এ নিয়ে আর কথা না। বরং ভাবা শুরু কর--কোনটা ঠিক হবে? এই দুধ বন্ধ হওয়া নিয়ে গার্জেনদের কাছে কমপ্লেইন করব? না কি রামকানাই মহারাজের কাছে গিয়ে বলব -- দুধ দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। আমাদের ছেলেরা পালা করে দুধ দেওয়ার ডিউটি করবে। ঘরে ঘরে নয়, খাওয়ার পরে ডাইনিং হলে। যার দুধ খাওয়ার সে নিজে হলে এসে গেলাসে করে নিয়ে যাবে।
এই নিয়ে কথা শুরু হতে দেখা গেল অধিকাংশের মতে প্রথম অপশনটা বড্ড তাড়াহুড়ো হয়ে যাবে। দ্বিতীয়টা বরং—
এমন সময় দোতলা থেকে একটা পরিত্রাহি চিৎকার। আবার! আবার! আবার! সেই হাড়হিম করা আওয়াজ মিলিয়ে যাবার আগেই ক্লাস এইটের সুজিত দৌড়তে দৌড়তে এল।
-- আপনারা প্লীজ শিগ্গির দোতলায় চলুন। ক্লাস নাইনের রমেন সিনিয়র বিমলদার বীচি টিপে ধরেছে, কেউ ছাড়াতে পারছে না। বিমলদা মরে যাবে।
দোতলায় ১১ নম্বর ঘরের সামনে বিমলদা শুয়ে আছে; যন্ত্রণায় বিকৃত মুখ। কিন্তু মুখের রং কেমন একটা অস্বাভাবিক ধরণের নীল।
আর রমেন পাশেই মাটিতে বসে আছে; গুম হয়ে, কোন কথার উত্তর দিচ্ছে না।
অন্যদের থেকে সারমর্ম যা বোঝা গেলঃ
আজকে ওই ঘরের টিউটোরিয়লে স্যার আসেন নি। ছেলেরা নিজেদের মধ্যে বই খুলে পড়াশুনো আড্ডা এইসব চালিয়ে যাচ্ছিল যথারীতি। নাইন সায়েন্সের জ্যোতির্ময় সন্ধ্যা মুখার্জির লেটেস্ট গান একটা চিরুনির সঙ্গে কাগজ জড়িয়ে বাঁশির মতো আওয়াজ বের করে বাজাচ্ছিল।
এমন সময় বিমলদা এসে ঢোকে। কী হচ্ছে জিগ্যেস করে আড্ডায় বসে যায়। জ্যোতির্ময়কে খেপাতে থাকে। ওকে মারবে বলে ভয় দেখায়। সবাই জানে বিমলদা বেলগাছিয়ার কোন ক্লাবের বক্সিং চ্যাম্পিয়ন। ওর লেফট হুক খেলে নাকি লেফ্ট চোয়ালের সব কটা দাঁত পড়ে যায়। বেলগাছিয়ায় রনি বলে এক মাস্তানের নাকি ওই দশা হয়েছিল। আশ্রমে সবাই বিমলদাকে ভয় পায়। কেউ লাগতে যায় না।
রমেন উঠে দাঁড়ায়।
--বিমলদা, আপনি এখান থেকে যান। এক্ষুণি! নইলে আমি চেঁচাবো।
বিমলদা তেড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু খাবার ঘন্টা বেজে ওঠায় লফড়া কেঁচে গেল।
খাওয়াদাওয়া চুকলে বিমলদা আবার ওদের ঘরে এল। এসেই রমেনের কলার চেপে বারান্দায় নিয়ে এসে দেয়ালে ঠেসে ধরল।
--কী রে! তখন খুব রোয়াব দেখাচ্ছিলি। কী ভেবেছিস কি তুই! সিনিয়রদের ঘর থেকে গেট আউট বলিস। এত সাহস!
--- আপনি সিনিয়রদের মত থাকুন না! কেন খামোখা ওকে ভয় দেখাচ্ছিলেন?
--- তাতে তোর কী? আমার ব্যাপার আমি বুঝব; তুই কি ওর গার্জেন?
--- আমি ওর রুমমেট। এটা আমার ব্যাপার। যারা আপনাকে ভয় পেয়ে চুপ করে থাকে তাদের আপনি বেশি ভয় দেখান। সব বুলি কাওয়ার্ড হয়!
--- কার কথা বলছিস?
-- আপনি ঠিকই বুঝতে পারছেন।
ভীড় জমে গেছল। সবার সামনে রমেনের এমন ধারা কথায় বিমলদা হতভম্ব। কেউ কেউ মুচকে হাসছে। আর সহ্য হয়?
--শুয়োরের বাচ্চা!
--অ্যাই, বাপ-মা তুলবেন না বলছি; ভাল হবে না।
বিমলদার এক ঘুঁষিতে রমেনের মাথা পেছনের দেওয়ালে ঠুকে গেল। টেনশন বাড়ছে। কিন্তু এরপরে যা ঘটল সেটা কেউ আন্দাজ করতে পারেনি।
রমেন একবার মাথা ঝাঁকাল। তারপর বিমলদার বাঁহাতের পাঞ্চ মুখে লাগার আগে চট করে নীচু হল। সেটা গিয়ে লাগল সোজা দেয়ালে আর বিমলদা যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল। কিন্তু সেই কঁকিয়ে ওঠা একটা ওঁক্ আওয়াজে না থেমে লম্বা মীড়ের মতো গড়িয়ে যেতে লাগল।
রমেন হাঁটু গেড়ে বসে বিমলদার অন্ডকোষ টিপে ধরে মুচড়ে দিচ্ছে।
দৌড়ে এসেছে অন্যান্যরা।
-ছাড় ছাড়্, বিমল মরে যাবে যে!
সেই রাত্রেই বিমলদাকে কাশীপুর মিউনিসিপ্যাল হসপিটালে ভর্তি করতে হল। ওর পেচ্ছাপ বন্ধ হয়ে গেছল। আর পরের দিন রামকানাই মহারাজ রমেনকে একমাসের জন্যে সাসপেন্ড করে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। ওর অপরাধ -- সিনিয়র ছাত্র বিমলের গায়ে হাত তোলা, গুন্ডামি যা ফ্যাটাল কেস হতে পারত।
আমাদের কয়েকজনের গিয়ে অনুরোধ, এবং পুরো ঘটনাটা বলা কোন কাজেই এল না।
কিস্যু ভাল লাগছে না। রমেন একমাসের জন্যে বাড়ি গেছে। ওর বাড়ি বিহারে, বাবা কোনো ব্যাংকে কাজ করেন। ও আমাদের থেকে একবছরের বড়। অঙ্কটা বেশ স্ট্রং। মুকেশ ও রফির গানগুলো ভাল গাইত। হিন্দি উচ্চারণ একেবারে অরিজিনাল গায়কদের মতো।
ওর গলায় "দিল তড়প তড়প কে কহতা" আর "আসলি ক্যা হ্যায়, নকলি ক্যা হ্যায়" আমাদের নিজস্ব অর্কেস্ট্রায় হিট গান ছিল।
ও ছিল ভারি আমুদে।
অন্য একজন মেয়েলি আওয়াজে লতার বা আশার হিট দু'কলি গাইত। আর রমেন বিছানার চাদর কুঁচিয়ে ঘাঘরার মতো করে নিয়ে একটি গামছা ওড়নার মতো করে মুখে একটা বোকা বোকা হাসি নিয়ে আমাদের আশা পারেখ বা বৈজয়ন্তীমালা হয়ে নেচে নেচে বেড়াত। লাফিয়ে খাট বা চেয়ারে উঠত অথবা ডাঁই করে রাখা বিছানার উপর।
আমরা দেখতে পেতাম নায়িকা পাহাড়ের চুড়ো থেকে তরতর করে নীচে নেমে নদীর পাড়ে গাছের ডাল ধরে নাচছে, অথবা লজ্জা লজ্জা মুখ করে আলিঙ্গন উদ্যত নায়কের হাতের ফাঁক দিয়ে গলে বেরিয়ে যাচ্ছে। হাততালি! হাততালি!
সেবার এমনি একটি নাচের সময় চটপট হাততালির মাঝখানে কেউ উঠে বাথরুম যাবে বলে দরজা খুলেছে কি অনিল মহারাজ চট করে ঢুকে পড়লেন। কেউ খেয়াল করেনি।
নর্তকী রমেনকে দেখে উনি হাসবেন না কাঁদবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। আমরা তিনজন দরজার দিকে ঘষটে গিয়ে ওনার পেছন দিয়ে কাট; উনি অবাক বিস্ময়ে শুধু রমেনকে দেখে যাচ্ছেন।
অমন রমণীয় বেশভূষা! ও কোথায় পালাবে? নিরুপায় রমেন সোজা দুহাতে মুখ ঢেকে বিছানায় ডাইভ মারল। শত বকুনিতেও মুখ তুলে তাকালো না।
সেই রমেন এখন সাসপেন্ডেড? ক্লাস মিস করছে! আমরা তো ক্লাসে যাচ্ছি, নোটস্ নিচ্ছি। সায়েন্সের ছেলেরা ল্যাব অ্যাটেন্ড করছে, রমেনও তো সায়েন্সের। অ্যানুয়াল পরীক্ষার বেশি দেরি নেই। ভগবান আছে না নেই?
রামকানাইদাকে আর একবার বলে ওর সাসপেনশনের মেয়াদ কমিয়ে দেওয়া যায় না? বলে দেখি?
রোববার দিন কলতলায়, আমরা বলতাম তেরো কলের পার্ক, কয়েকজন মিলে কাপড় কাচছি। আমি বললাম-- এই শালার আশ্রমে আমাদের কিছু হবে না। এখানে খালি অয়েলিং চলে। যে যত--!
কোথা থেকে ছুটে এসেছেন প্রাইভেট বাস অনিল মহারাজ।
-- কী বললি পোদো? কী বললি? অয়েলিং চাই, অয়েলিং না হলে কিচু হয় না? তুইও কি রমেনের মতো সাততাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে চাস?
আচমকা যেন একটা আপাত নিরীহ বল হটাৎ স্যুইং করে আমার বেল উড়িয়ে দিয়েছে। আমার মুখে উত্তর জোগাল না। এইসময় বিপ্লবের মাথায় প্রেরণা দেবী অধিষ্ঠান করলেন।
-- না মহারাজ, ও অয়েলিং বলেনি। আপনি ভুল শুনেছেন। ও বলছিল--ডিসিপ্লিন চাই, ডিসিপ্লিন না হলে এখানে কিছু হবে না।
-- কী? ডিসিপ্লিন? আমি যেন অয়েলিং শুনলাম।
ততক্ষণে আমরা গানের ধ্রুবপদ ধরে ফেলেছি।
-- ডিসিপ্লিন অনিলদা, ডিসিপ্লিন! আরও কড়া ডিসিপ্লিন চাই। আপনি ভুল শুনেছেন।
অনিলদা অন্যমনস্ক হয়ে কিছু ভাবতে ভাবতে এগিয়ে গেলেন।
--মিতা, এক প্যাকেট পানামা! আমার তরফ থেকে। খুব বাঁচান বাঁচিয়েছিস! ভগবান আছেন! সেদিন রাত্তিরে আমার জিদ চেপে গেল। কালকে ম্যাথস এর ক্লাস টেস্টে ভাল নম্বর পেতে হবে। আর্টসের ছেলে হয়েও হায়ার ম্যাথ্স কম্বিনেশন নেওয়ায় সবাই খ্যাপায়। বলে--গরীবের ঘোড়া রোগ! অতই যদি অংকের শখ তো সায়েন্স নিলি না কেন? পোঁদে নেই ইন্দি, ভজরে গোবিন্দি!
নাইনে উঠে জ্যামিতি এত কঠিন লাগছে কেন? পাইথাগোরাস অবদি ঠিক ছিল। কিন্তু অ্যাপোলোনীয়াস থিওরেম? অর্থোগোনাল প্রোজেক্শন? আর ট্রিগোনোমেট্রির হাইট অ্যান্ড ডিস্ট্যান্স? কোনটা যে অ্যাঙ্গেল অফ এলিভেশন আর কোনটা ডিপ্রেসন এর শেষ দেখে ছাড়ব। সবাই শুয়ে পড়লে বারান্দায় আলোর তলায় একটা মাদুর নিয়ে বসে পড়লাম। দূরে কোথায় বৃষ্টি নেমেছে, ব্যাঙ ডাকছে। জোলো হাওয়ায় গা জুড়িয়ে যাচ্ছে।
রাত দুটো নাগাদ সবাই কব্জায় এল। অ্যাপোলীনিয়্স আর গ্রীক রইলেন না, আমার পাড়ার কাকু হয়ে গেলেন। আনন্দে ঘুম এল না --বৃষ্টি নেমেছে ঝেঁপে। খানিকক্ষণ পরে আশ্রমের পানাপুকুর উপচে ঘরের সামনের পাকা নালায় জলের মধ্যে মাছ ভেসে বেড়াতে লাগল। ধরলে কেমন হয়? খাতাপত্তর তুলে রেখে ঘর থেকে গামছা নিয়ে নালায় নাবলাম। খলসে কইগুলো ধরেও রাখতে পারলাম না। পিছলে বেরিয়ে গেল। ধরা পড়ল গোটা কয়েক চ্যাং মাছ। কিন্তু রাখি কোথায়? ফের ঘরে গিয়ে ঘরমোছার বালতি নিয়ে এলাম। দরজায় ঠুং ঠাং শব্দে কারও ঘুম ভাঙল বোধহয়। কুছ পরোয়া নেই।
বালতিতে গামছায় বাঁধা মাছগুলো ছেড়ে দিয়ে আবার জাল পাতছি এমন সময় পিঠে কারও হাত। ভীষণ চমকে ঘুরে দেখি বিপ্লব।
--এসব কী হচ্ছে রে লাকি! বুঝেছি, কাল অংকে ভাল করবি। এখন শুতে চল। এই চ্যাং মাছগুলো নালায় ফেলে দে। ওগুলো কেউ খায় না। আর বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধালে তোর অংক পরীক্ষার হাতে হ্যারিকেন হয়ে যাবে।
--ঘুম আসছে না মিতা।
-- আমার বিছানায় চল। তোকে ঘুম পাড়িয়ে দেব।
নাঃ, ভগবান আছেন।
সত্যিই ভগবান আছেন নইলে এমন হয়!
আজ সক্কালে এক ভদ্রলোক যুগান্তর পত্রিকা হাতে করে আশ্রমে এলেন। যদুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কে?
-- মানে? আমরা ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের নাম জানি, ওইসব মোগল-মারাঠা ক্যালাকেলির ইতিহাস; তাই তো?
--- হ্যাঁ, কাকু। সেই যে আফজল খাঁ, মানে বাঘনখ?
--ধেৎ, আমি কি তোমাদের জেনারেল নলেজের পরীক্ষক? এই দেখ, বন্যপ্রাণী পোষা নিয়ে বাংলা রচনা প্রতিযোগিতায় বরানগর মিশনের ক্লাস নাইনের যদুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সারা বাংলা প্রথম হয়েছে আর ৫০০/- সরকারের থেকে প্রাইজ পেয়েছে।
--- দেখি, দেখি, তাই তো! অ্যাই যদু, শীগ্গির আয়। তোর নাম বেরিয়েছে যুগান্তরে।
-- অনেক ধন্যবাদ কাকু!
-- না, না; ভাই তুমি আমাদের বরানগরের আর স্কুলের নাম উজ্বল করেছ। তোমাকে অভিনন্দন। আমি পাশের গলিতে থাকি। খবরটা পড়ে মনে হল ছেলেটিকে দেখে আসি। ভগবান তোমার মঙ্গল করুন।
উনি চলে যেতেই বিপ্লব ঝাঁপিয়ে এল।
-- কী রে যদু? ওই সরকারী 'এসে' প্রতিযোগিতায় লেখাটা তুই নিজে লিখেছিলি? বুকে হাত দিয়ে বল তো?
গুরু অমিয়দা এগিয়ে এল। কী কেস রে?
-- এই 'এসে' টা কে লিখেছে?
--- কোন এসেটা?
--এই যে, যুগান্তর দেখ। সরকারের ফরেস্ট ডিপার্টমেট দ্বারা আয়োজিত "কোন বন্য প্রাণী তুমি পুষতে চাও" শীর্ষক বঙ্গের প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় বরাহনগর স্কুলের শ্রীমান যদুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গের সমস্ত স্কুলের মধ্যে বাংলা রচনায় প্রথম হইয়াছে। শ্রীমানের পছন্দের পোষ্য জন্তুটির নাম বাঘ। শালা, যোদো, তুই বাঘ পুষবি? বল, কে লিখে দিয়েছিল? সবার সামনে বল।
প্রশান্ত বলল-- এ নিয়ে এত ক্যান্টার করার কী মানে? ওর বাবা-কাকা বা ওর স্যার যেই লিখে দিক পত্রিকায় ওর নাম বেরিয়েছে, স্কুলের নাম বেরিয়েছে; ব্যস্। ও আমাদের খাইয়ে দিক। সবাই সায় দিল।
কিন্তু বিপ্লবের চোখ য্দুর মুখের থেকে সরছে না। যদু চোখ নামিয়ে নিল।
অমিয়দা বলল-- কী ব্যাপার রে? বিপ্লব, তুই ওর পোঁদে লাগছিস কেন?
বিপ্লব দেঁতো হেসে বলল--ওই বলুক কেন লেগে রয়েছি।
যদু কিছু বলছে না।
গুরু কিছু আঁচ করে বলল-- বেশ, এত যখন হড়কাচ্ছিস তো তুইই বল। ফালতুকার সাসপেন্স সাত সকালে কোন মানে হয়?
--- আমার সামনে যদু আমাদের প্রদ্যুম্নকে বলে রচনা লিখে দিতে। প্রদ্যুম্ন বলে যে দেবে কিন্তু এক শর্তে--যদুকে লাইব্রেরি থেকে খুঁজে বাঘের ওপর দুটো সলিড কোটেশন, বাংলায় ও ইংরেজিতে, নিয়ে আসতে হবে। যদু পরের দিন নিয়ে এল। একটা টাইগার টাইগার বার্নিং ব্রাইট, আর একটা হিংস্র ব্যাঘ্র অটবীর—
তিনদিনের মাথায় পোদো যোদোকে ৬০০ শব্দের একটা এসে লিখে দিল। আমার সামনে--বল্লে হবে।
সবার চোখ আমার দিকে ঘুরল।
-যদু কাঁদো কাঁদো হয়ে আমার হাত চেপে ধরল। ভাই প্রদ্যুম্ন, প্লীজ তোরা কজন বন্ধু ছাড়া আর কেউ যেন না জানে! প্লীজ, বাবা জানে যে আমিই লিখেছি। গতকালই আমাদের বাড়িতে সরকারি ডাকে চিঠি এসেছে। বাবা কত খুশি হয়েছে! তুই তো আবৃত্তি করিস, না্টক করে প্রাইজ পাস। আমি যে কিছুই পারি না। বাবা কত খুশি হয়েছে। টাকাটা হাতে আসুক। তোদের কজনকে আমি শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড়ের পাঞ্জাবী হোটেলের কাটলেট খাইয়ে দেব। সবাই চেঁচিয়ে ওঠে-- থ্রি চিয়ার্স ফর যোদো-পোদো!
চিৎকারের চোটে ওয়ার্ডেন শিশিরদা ছুটে এলেন।
--- সবকটাকে দিনের বেলায় তারা দেখিয়ে ছাড়ব। হয়েছেটা কী?
-- শিশিরদা, আমাদের যোদো প্রাইজ পেয়েছে।
-- কিসের প্রাইজ? কিসের কম্পিটিশন?
--- পোদো হওয়ার প্রাইজ, মানে পাদের কম্পিটিশন!
শিশিরদা চড় উঁচিয়ে অমিয়দাকে তেড়ে গেলেন।