কিন্তু হেডস্যারের সঙ্গে ১৫ই অগাস্ট জুড়ে গেছে যে!
কোথায়? আমার স্মৃতিতে।
আমি তখনো প্রদ্যুম্ন থেকে পোদো হইনি। কচুরিপানায় ঢাকা পুকুরের ঘাটলায় শামুকপচা জলে থালাবাটি ধোয়া, কাপড় কাচা, আর স্নান করে করে হাত-পা খোস-পাঁচড়ায় ভরে যায়নি। ক্লাস সিক্সে নতুন ভর্তি হওয়া রোগা প্যাংলা ভীতু ছেলেটি তখনও মোটা ভাতের সঙ্গে আধসেদ্ধ ছরছরে ডাল, কারি পাউডারের ঝোল আর জলখাবারে ডালডা-চিনি-মুড়ি খেতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি।
এমন সময় ঘনঘোর বর্ষার মধ্যে এসে গেল স্বাধীনতা দিবস। আশ্রমের আবহাওয়া বদলে গেল। চারদিকে সাজো সাজো রব।
১৪ অগাস্টের রাত্তির থেকে সবাইকে নিজেদের বিল্ডিং ছেড়ে ক্যাম্পে থাকতে হবে। সবাই নিজে নিজের বিছানা, দুদিনের মতো জামাকাপড়, ডায়েরি, পেন সাবান, ব্রাশ ইতাদি নিয়ে চলে যাবে। ১৫ তারিখ ক্যাম্প ফায়ারের পর প্রাইজ দেওয়া হলে সবাই সে'রাত্তির ক্যাম্পে ঘুমিয়ে পরের দিন সকালে আবার পুরোনো জীবনে ফিরে আসবে।
প্রদ্যুম্ন দেখল এলাহি ব্যাপার। সমস্ত ছেলেগুলোকে আটটি গ্রুপে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। ১৩ অগাস্ট ডাইনিং হলে তাদের নাম ও গ্রুপ ক্যাপ্টেনের নাম ঘোষণা করা হল। জানা গেল যে হাইস্কুল বিল্ডিং খালি করে ধুয়ে মুছে সেটাকে দু'দিনের জন্যে ক্যাম্প ঘোষণা করা হয়েছে। সামনের আঙিনা ঘিরে গেছে অস্থায়ী পোল ও তারের বেড়ায়। একটা গেট। সেই গেটে কাঠের রাইফেল নিয়ে পাহারা দেবে একজোড়া সেন্ট্রি। দু-দু’ঘন্টা মার্চ করে করে, বাই টার্ন, সব গ্রুপ থেকে। আর কাউকে ক্যাম্পে ঢুকতে হলে গেটপাস দেখাতে হবে--সেগুলো ক্যাপ্টেনরা জারি করবেন।
গেটপাস দেখাতে না পারলে অনিল মহারাজ, হেডস্যার কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হবে না।
আগের বছর একটি গ্রুপের জোড়া সেন্ট্রি, ক্লাস এইটের দুই ছোকরা, অনিল মহারাজকে আটকে দিয়েছিল। উনি রেগে গিয়ে রামকানাইদাকে কম্প্লেন করায় জবাব পেলেন-- ওরা ওদের ডিউটি ঠিকমতো করেছে। আর সেই গ্রুপটা এই পয়েন্টে বেশি নম্বর পেল।
নম্বর অনেক কিছুতে, সেন্ট্রি দেওয়া, ঘর পরিষ্কার, কীর্তালি (কোন ভাষা?) --মানে আশ্রমের মাঠঘাট, পুকুর, নালা-নর্দমা পরিষ্কার করা, মার্চপাস্ট, ডাইরি লেখা, স্বাধীনতা দিবসের উপর রচনা, কবিতা লেখা, পাঁচ মিনিট এলোকুশন (মানে কী?), সন্ধ্যেয় ক্যাম্প ফায়ারের গান, নাটক ও ইম্প্রোভাইজড কোন স্কিট, মিমিক্রি --সবেতেই।
আর সকালে জলখাবারে মগে করে গরম চা দেওয়া হবে, আর্মি স্টাইলে। বিকেলে বৃষ্টিতে ভিজে প্রীতি-ফুটবল--স্টাফ ভার্সাস স্টুডেন্টস।
সন্ধ্যেয় অমূল্যদার ম্যাজিক লন্ঠন, অথবা কথা বলা পুতুলের কেরদানি!
তা সেই আমার জীবনের প্রথম ক্যাম্পে হেডস্যার আমাদের স্বাধীনতা দিবসের মর্ম বোঝাতে গিয়ে বললেন-- মনে রেখ, আজ থেকে মাত্র ১৪ বছর আগে এই শহরে ইউনিয়ন জ্যাক উড়ত। তোমাদের মধ্যে যাদের বয়েস ১৪ বছরের কম তারা নিজেদের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দাও; পরাধীনতার অপমান তোমাদের ভুগতে হয় নি।
এগার বছরের প্রদ্যুম্ন ভাবল -- ইস্, মাত্তর ১৪ বছর আগে এখানে ব্রিটিশরা ছিল? রাইটার্স বিল্ডিংয়ের মাথায় ইউনিয়ন জ্যাক উড়ত? কী অন্যায়! কী অন্যায়! ভগবানের একচোখোমি!
ওকে যদি ভগবান আরও দুই দশক আগে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিত তো ও নিশ্চয়ই কিছু একটা করে ফেলত। সূর্য সেন, বিনয়-বাদল-দীনেশ না হোক অন্তত ১৪ বছরের ক্ষুদিরাম। কিন্তু কোথাও একটা হিসেবে ভুল হচ্ছে না?
পাটিগণিতে কাঁচা শ্রীমান প্রদ্যুম্ন কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারল না।
সম্পাদক পদ হইতে শ্রীমান প্রদ্যুম্নের অপসারণের পিছনে একটি গল্প আছে। এই গল্পের উৎস ওই শিশুসুলভ কবিতাটি, পোদোর সম্পাদকসুলভ আভিজাত্যবোধ ও ক্ষমতার অহংকার।
এটাই কমিটির মিটিংয়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল। না, একটু ভুল হল। এ ব্যাপারে কমিটির সমর্থন ও সহানুভূতি আমার সঙ্গেই ছিল। আসল অভিযোগ হল আমি উপরোক্ত কারণের বশে, বিশেষত ক্রোধ ও মাৎসর্য্য রিপুর দাস হইয়া ক্লাস এইটের বর্বর গুন্ডাপ্রকৃতির ছেলেদের সঙ্গে, মারপিটে জড়াইয়া পড়িয়া উত্তমমধ্যম প্রাপ্ত হইয়া ক্লাস টেনের প্যাট্রিশিয়ানদের প্রেস্টিজে গ্যামাক্সিন ঢালিয়া দিই।
ফলে ক্লাস টেন নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও সিনিয়র ক্লাসের সম্মান রক্ষার্থে হা-রে -রে রবে ক্লাস এইটের সঙ্গে ক্লাস-ওয়ারে জড়াইয়া পড়ে।
অগত্যা ম্যানেজমেন্টের হস্তক্ষেপে সিজ-ফায়ার ঘোষণা হয়, কিন্তু ক্লাস এইট ও সেভেন আমাদের দেওয়াল পত্রিকায় কোন লেখা দিবে না ঘোষণা করায় সিনিয়রদের কূটনৈতিক ও রণনীতিগত লোকসান হয়।
শেষে আমাকে না জানাইয়া গুরু ও তাঁহার দক্ষিণ হস্ত ক্লাস এইটের নেতাদের সঙ্গে গোপনে আলোচনা চালায়। উহারা সমস্ত ঘটনা ভুলিয়া শেক হ্যান্ড করিতে রাজি হয় ও ম্যাগাজিন বয়কটের সিদ্ধান্ত বাতিল করে-- কিন্তু শর্ত রাখে যে নষ্টের গোড়া শ্রীমান পোদোকে পত্রপাঠ সম্পাদকের পদ হইতে নামাইতে হইবে।
ব্যাপারটা এই রকম। ক্লাস এইটের কতগুলো বখা ছেলের গ্রুপ ধীরে ধীরে আমাদের চক্ষুশূল হয়ে উঠছিল। নাইনের ছেলেদের সঙ্গে আমাদের ভাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং গড়ে উঠেছিল, কয়েকজন ব্যক্তিগত বন্ধু হল। পড়াশুনো, লাইব্রেরির বই পড়া, নাটক ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে। ওরাও আমাদের মতোই প্রথম ও ফিফ্থ পিরিয়ডে ব্যাক বেঞ্চে বসে ঘুমোত। স্যারেদের ও ডে-স্কলার ছেলেদের হাসির ও বিদ্রূপের খোরাক হত। আবার অ্যানুয়াল পরীক্ষায় মেরিট লিস্টে উপরের দিকে থাকত।
কিন্তু ক্লাস এইটের ব্যাচটা একটা ব্যাচ বটে! এদের মধ্যে বেশ কজন আমাদের ও নাইনের ব্যাচের থেকে ফেল করে ভিড় জমিয়েছে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভাল, যখন তখন কড়কড়ে নোট বের করে। এও সহ্য হচ্ছিল। জানা গেল এদের পালের গোদা দুজনের হরমোন অত্যধিক ক্ষরণের কারণে প্রায়ই বেশ কিছু বাচ্চা এদের শিকার হচ্ছে। এ নিয়ে এরা বেশ গর্বিত। এমনকি লুকোনোর চেষ্টাও করে না।
আমদের পাঁচজনের টিম এদের ব্যূহ ভেদ করতে ব্যর্থ হল। যে তিনজন মুখ খুলতে রাজি হল তারা স্বামীজির সামনে গিয়ে বেঁকে বসল। মারের ভয়!
পরে সেই মাফিয়ারাই ওই বাচ্চাদের নিয়ে মেজমহারাজের কাছে (প্রাক্তন পুলিশ অফিসার) নালিশ করাল যে ক্লাস টেনের আমরা ক'জন নাকি ওদের ভয় দেখিয়ে মিথ্যে অভিযোগ করাতে নিয়ে যাচ্ছিলাম। বোধহয় আমাদের অন্য কোন ব্যক্তিগত ইস্যু আছে।
মেজ মহারাজ চিবিয়ে চিবিয়ে ইংরেজিতে আমাদের যা বললেন তা দুটো লাইনে বলা যায়ঃ
ডক্টর, কিওর দাইসেল্প্ফ!
অয়েল ইন ইয়োর ওন মেশিন!
ওই ঘটনার পর থেকে ওরা-আমরা হল; আমরা একে অপরের ক্লাস-এনিমি হয়ে গেলাম।
এই অবস্থায় একদিন ওদের ক্লাসের দুজন বাচ্চামত ছেলে হাতে করে দুটো কবিতা নিয়ে আমাদের ঘরে এল। দেয়াল পত্রিকায় ছাপতে হবে। ওদের দেখেই আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল।
সেই দুটো বাচ্চা! যারা বয়ান বদলে আমাদের মুর্গী করেছিল!
তবু বিক্রমাদিত্যের সিংহাসনে বসলে জাজমেন্ট দেওয়ার আগে পূর্বাগ্রহ মুক্ত থাকাই আদর্শ আচরণ বিধি।
আমি ও বিপ্লব লেখাগুলো পড়তে লাগলাম।
তারপর গম্ভীর মুখে বললাম-- এটা কী লিখেছ?
--কবিতা।
--কোথায় কবিতা?
ও অবাক হয়ে মিনমিন করে বলল--কেন, পোদোদা? আপনার হাতেই তো ধরা রয়েছে। দেখুন না--বর্ষাকাল।
পোদোদা! হাড়পিত্তি জ্বলে গেল।
গম্ভীর মুখে বললাম, - হুঁ, বর্ষাকালই বটে!
বর্ষা আসিল, ডাকিয়া উঠিল আকাশের যত মেঘ?
এটা কবিতা হয় নি, শুধু অন্ত্যমিল মিলিয়ে একটা গোদা বাহ্যিক বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এটা ছাপা যাবে না। পরেরবার চেষ্টা কর।
অন্য বাচ্চাটা করুণ মুখে বিপ্লবকে বলল --আমারটা তো ঠিক আছে?
বিপ্লব খেঁকিয়ে উঠল।
-- এটা? এটা তো ডাহা চুরি! গতবারের স্কুলের বার্ষিক ম্যাগাজিন থেকে টুকলি!
বাচ্চাটার চোখে হতাশা ও আতঙ্ক।
--না, টুকলি নয়।
বিপ্লব উঠে গিয়ে ওর তাক হাতড়ে একটা বিস্কিট রঙের ম্যাগাজিন বের করে এনে দ্রুত হাতে পাতা ওল্টাতে লাগল।
--পেয়েছি; এই যে! শোন্।
একেবারে কমা-সেমিকোলন পর্য্যন্ত টোকা। না, না; এসব চালাকি চলবে না।"৩২ নম্বর বাসের তলায় ব্যাঙ রাজার মৃত্যু"
হৈ চৈ পড়ে গেছে সারা বরানগরে,
ব্যাঙেদের মহারাজা মারা গেছে আহা রে!
-- বিপ্লবদা , একটু দেখুন। দুটো এক নয়। ওটা হল ৩২ নম্বর বাসের তলায়, আর আমি লিখেচি--৩৪ নম্বর বাসের তলায়।
বিপ্লব খ্যা -খ্যা করে হাসতে লাগল।
-- ওরে একটু চুপ কর। ৩২ নম্বরকে ৩৪ নম্বর করে দিলেই কবিতা আলাদা হয়ে গেল?
-- দেখুন, দুটো বাসই তো এসপ্ল্যানেড থেকে বরানগর যায়, তবে?
আমার আর সহ্য হল না। উঠে ঠেলতে ঠেলতে বাচ্চাদুটোকে ঘর থেকে বের করে দিলাম। বললাম--কবিতা লেখা? কবি? খালি ২ কে ৪ করে লিখলি তো হয়ে গেল? ইয়ার্কিরও একটা সীমা আছে। তোদের গোটা ক্লাসটাই এইরকম গবেট নাকি?
দুটো দিন কেটে গেল।
বিকেলে ফুটবল পেটাতে না গিয়ে ম্যাগাজিনের লেখাগুলোর ফাইল খুলে বসেছিলাম, আমি আর বিপ্লব।
নরেশ আর সুদীপ এল। ক্লাস এইটের সেই মাফিয়া টাইপের ছেলেগুলো। সুদীপের একটু রোমশ চেহারা। এই বয়সেই গোঁফের রেখা দেখা দিচ্ছে।
ওকে দেখামাত্র আমার মাথায় খুন চড়ে গেল। শুনেছিলাম নতুন ছেলেদের পেছনে লাগার সময় ওর দুটো চ্যালা অনিচ্ছুক বাচ্চাটার হাত ধরে রাখে। আর গত পুজোর সময় ওর বাড়ির লোক নিয়ে যেতে এসেছিল। ও নাকি তখন ঘরের মধ্যে একটি ছেলের সঙ্গে রাসলীলায় মত্ত ছিল। বন্ধ ঘরের মধ্য থেকে বাড়ির লোককে বলে -- একটু অপেক্ষা কর। প্যাকিং করছি, জামাকাপড় বদলাচ্ছি--সময় লাগবে।
ওরা ঢুকল, একটু পেছনে আগের সেই বাচ্চা দুটো।
-- এই যে, এডিটর! এদের কবিতাগুলো রিজেক্ট করলে কেন?
-- একটা কবিতা হয় নি, অন্যটা টুকে লেখা--তাই।
--কোনটা কবিতা আর কোনটা নয়, কে ঠিক করবে? তুমি?
--আলবাত; এটাই আমার কাজ। আমাদের পত্রিকার একটা স্ট্যান্ডার্ড আছে।
---- বেশ, কোনটা তোমার কাছে কবিতা? ওই ফালতু "টিফিনেতে খেতে দেয় পাঁউরুটি-কলা"?
নরেশ দোহার দেয়,-- ওই কবিতাটার টাইটেল আবার "হেডশ্বর"! গুরুজনদের স্যারেদের নিয়ে ইয়ার্কি করলেও ম্যাগাজিনের স্ট্যান্ডার্ড থাকে, তাই না পোদো?
বিপ্লব তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলে-- অ্যাই, নরেশ! মুখ সামলে। তোর দু'বছরের সিনিয়র, প্রদ্যুম্নদা বলবি।
ওরা হেসে উঠল।
তারপর বলল, -- দু'বছর আগে আমরা ক্লাসমেট ছিলাম, তখন থেকেই ও আমাদের পোদো। কী রে, ঠিক বলেছি না?
আমি কোন কথা বলি না।
সুদীপ আবার বলে-- তাহলে আমাদের ক্লাসের দুটো কবিতা রিজেক্ট করছ?
আমি ওদের ঘাড়ের ওপর দিয়ে বাচ্চাদুটোকে দেখি--উকিল ধরে এনেছিস? লাভ হবে না। ঘরে ফিরে যা।
ওরা তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।
সুদীপদের বলি--শোন, ক্লাস-টাস নয়। একটু ভাল কবিতা নিয়ে এস, নিয়ে নেব।
ওরা চোখে চোখে কথা বলে।
তারপর সুদীপ বলে-- আধুনিক কবিতা চলবে? গদ্য কবিতা?
--হ্যাঁ হ্যাঁ। নিয়ে এস।
--অ্যাই নরেশ, তোর সেই আধুনিক কবিতাটা দেখা তো আমাদের সম্পাদককে, স্ট্যান্ডার্ডটা দেখে নিক।
নরেশ ভালমানুষের মতো মুখ করে একটা চোথা কাগজ বের করে আমার হাতে দেয়।
আমি ভাঁজ খুলে হতভম্ব, এটা কী?
--কেন, আধুনিক কবিতা।
আমার মুখের ভাব দেখে বিপ্লব কাগজটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে চোখ বোলায়, তারপর হা-হা করে হেসে ওঠে আমাকে ফেরৎ দেয়।
কাগজটায় কয়েকটি রেলস্টেশনের নাম একটি বিশেষ অর্ডারে লেখা রয়েছে।
টালিগঞ্জ-বালিগঞ্জ,আমি কিছু বলার আগে বিপ্লব হাসতে হাসতেই বলে-- সরি! এইসব অশ্লীল লেখা ছাপতে পারব না।
টালিগঞ্জ-বালিগঞ্জ,
ঢাকুরিয়া--যাদবপুর।
গড়িয়া-সোনারপুর,
বজবজ-বজবজ।
অশ্লীল লেখা! ওরা আকাশ থেকে পড়ে।
-- ওতে কোন শব্দটা অশ্লীল? নাকি দু'ক্লাস উঁচুতে পড়েন বলে যা খুশি কমেন্ট করবেন?
আমি রাগের চোটে কাগজটা নিয়ে কুচিকুচি করে ছিঁড়তে থাকি।
ওরা হাঁ-হাঁ করে ওঠে।
--এটা কী হল সম্পাদক মশাই? আপনার লেখা রিজেক্ট করার রাইট আছে; কিন্তু ছিঁড়ে ফেলা?
-- পছন্দ না হয় ফেরত দিয়ে দে। ছিঁড়লি কী করে?
--বেশ করব, এই সব অশ্লীল ইয়ার্কি আমার সঙ্গে নয়, অন্য কোথাও মারাবি!
ওরা কাগজটা কেড়ে নেবার চেষ্টায় আমার সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে। প্রথম চড় বোধহয় আমিই মেরেছিলাম। কিন্তু ওরা তৈরি হয়েই এসেছিল। আমি বা বিপ্লব কেউই মারামারিতে অভ্যস্ত নই, একটু লালুটাইপ। ফলে দুজনেই বেশ মার খেলাম। আমার বরাদ্দে একটু বেশি জুটল।
তারপর ক্লাস-স্ট্রাগল, সিজফায়ার ইত্যাদি। ওরা চ্যালেঞ্জ করে মহারাজকে বলল-- আমি ব্যক্তিগত কারণে ওদের গ্রুপের কারও কবিতা ছাপতে চাই না। তাই ওদের একটি ভাল আধুনিক কবিতাও ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি।
আমরা বললা--যা তা অশ্লীল লেখা!
--ওরা বলল বাজে কথা, পোদো কাগজটা দেখাক।
কী করে দেখাব, ছিঁড়ে ফেলেছি যে!
হেডস্যারকে দিয়ে তদন্ত করানো হল। উনি বললেন--প্রদ্যুম্ন, কাগজ নেই তো কি হয়েছে, তুমি মুখে বল বা লিখে দাও যে ওরা কী অশ্লীল শব্দ লিখেছে--মেনে নেব।
ওরা মুচকি মুচকি হাসতে লাগল।
আমার কাছ থেকে শুনে হেডস্যার সন্দিগ্ধ মুখে মাথা নাড়তে লাগলেন।
এ তো ক'টা রেলস্টেশনের নাম-- অশ্লীল কোথায়?
আমার মুখে বাক্যি নেই।
আমার অভিযোগ খারিজ হয়ে গেল, বন্ধুরা বলল আমার বোকামি আর গোঁয়ার্তুমি আমাদের গোটা ব্যাচের হাতে হ্যারিকেন ধরিয়ে দিল।
সেই থেকে আমরা ও ক্লাস এইটের ব্যাচ আশ্রমের বাকি জীবনে তীব্র জীবনমরণের শ্রেণীসংগ্রামে বৃত হইলাম।
সেই ঐতিহাসিক এডিটোরিয়াল বোর্ডের মিটিং আমাদের ঘরেই হয়েছিল। তাতে তিনজন বোর্ড মেম্বার ছাড়া অন্য বন্ধুরাও ছিল।
সবাই আমাকে খ্যাপাতে লাগল।
বলল আমি ওই অত্যাধুনিক কালজয়ী কবিতাটি ছাপিয়ে একটা শোরগোল তুলে দিতে পারতাম। তার বদলে বোকামি করে অমর হবার সুযোগ হেলায় হারালাম।
--দেখ, গুরু। তুমিও ভাল করেই জান যে কবিতা-টবিতা নয়, ওটা একটা অশ্লীল ছড়া -- যেটা নিয়ে শুধু হ্যা-হ্যা করে হাসা যায়, যেমন বিপ্লব হেসেছিল। কিন্তু ছাপানো?
-- অশ্লীল কেন? কোন অশ্লীল শব্দ তো হেডস্যারও খুঁজে পান নি।
গুরু গম্ভীর, কিন্তু চোখে দুষ্টুমি।
--আরে হেডস্যারের কথা ছাড়। তুমি ভাল করেই জান যে এর মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে একটা শরীরের ব্যাপার নিয়ে ছ্যাবলা ইয়ার্কি আছে।
প্রশান্ত ফিচেল হেসে বলল-- রবি ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসু -এঁদের কবিতায়ও কত শরীরের বর্ণনা আছে, তাতে কবিতা অশ্লীল হয়ে গেল। তোর ভাটপাড়ার টুলো পণ্ডিত হওয়া উচিত পোদো।
-- ফালতু কথা বলবি না তো! তুই কবিতার কি বুঝিস? রবি ঠাকুরের কবিতায় শরীর?
এবার বিপ্লব ফিকফিকিয়ে হাসে।
-- হল না পোদো। রাগের চোটে যুক্তি হারাচ্ছিস।
রবিঠাকুর লেখেন নি-- নিরাবরণ বক্ষে তব নিরাভরণ দেহে?
বুদ্ধদেব তো আরও এককাঠি এগিয়ে-- বক্ষ তব ঢাকিয়া দিনু চুম্বনেরই চাপে! ভাব তো-- এর চেয়ে নরেশের ওই "টালিগঞ্জ -বালিগঞ্জ" বেশি অশ্লীল কি? হেডস্যার তো ধরতেই পারেন নি।
আমি মরিয়া হয়ে বলি--ওটা কোন কবিতা হল? টিফিনেতে খেতে দেয় পাঁউরুটি কলা-- এতে অন্ত্যমিল -ছন্দ - একটা তির্যক প্রতিবাদ এসব রয়েছে। নরেশের ওটায় বখামি ছাড়া আর কি আছে? কয়েকটা স্টেশনের নাম লিখলে সেটা কবিতা হয় কি করে?
বিপ্লব আবার দাঁত বের করে।
-- শুধু স্টেশনের নাম? ওই বজবজ-বজবজের দ্বিত্ব একটি রেলওয়ে টাইমটেবিলের পাতাকে কাব্যিক সুষমায় মণ্ডিত করিয়াছে। একেবারে অনেক- কথা- যাও যে বলে -কোন কথা না বলি--হয়েছে।
সবাই টেবিল চাপড়ে হেসে ওঠে। আমি রেগেমেগে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার উপক্রম করছি, ক্লাস সেভেনের কিশোর দৌড়তে দৌড়তে ঢুকে হাঁপাতে থাকে।
-- আরে অমিয়দা, বিপ্লবদা! আপনারা সব্বাই চলুন। শীগ্গির শীগ্গির! আমাদের সুনীল স্যার আবার পরীক্ষায় ফেল করেছেন। উনি কাঁদতে কাঁদতে খেলার মাঠের পাশ দিয়ে যাচ্ছেন। কিছু একটা হয়ে যেতে পারে।
আমরা ঝগড়া ভুলে ঘর থেকে বেরিয়ে দৌড় লাগাই। ঘরে তালা দেওয়ার কথা কারও মনে নেই।
সুনীলদা আমাদের আশ্রমের একটি চরিত্র যাকে সবাই ভালবাসে। এই ভালবাসার সঙ্গে কোথায় একটু করুণা মেশানো, কারণ ওঁর ডান পায়ের পাতা দোমড়ানো মোচড়ানো; বেঁটেখাটো মানুষটি চলেন দুলে দুলে। পড়ান প্রাইমারি স্কুলে। আশ্রমে পেটভাতায় থাকেন আর রাত্তিরে ক্লাস সিক্স ও সেভেনের আশ্রমিক বাচ্চাদের ইংরেজি টেক্সট ও ট্রান্সলেশন পড়ান।
ওঁর সঙ্গে পরিচয় হলে মনে হয় ছোট বাচ্চাদের ভাল করে পড়ানো ছাড়া ওঁর জীবনে কোন উদ্দেশ্য নেই। বিয়ে করেননি। একটি সাদা হাফ শার্ট, ধুতি ও হাওয়াই চপ্পল--ব্যস্। একজন মানুষের আর কি চাই!
আমাদের উনি পড়াতেন না, কিন্তু সুনীলদা কবে গল্প বলবেন বললেই একটু ভেবে বলতেন শুক্রবার সন্ধ্যেয়। আমরা নিজেদের পড়াশুনো ছেড়ে ওঁর ক্লাসে ভিড় করতাম। অনিল মহারাজ দেখেও দেখতেন না।
সবচেয়ে বিখ্যাত গল্প হল-- যুদ্ধের সময় ছিটকে পড়া এক বন্ধু স্ট্যানলি না ব্রিয়ারলি, অন্য ছোটবেলার বন্ধুর থেকে ইয়র্কশায়ারে গাঁয়ের বাড়িতে গিয়ে দেখা করার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পেল।
তারপর কি হইল সবাই জানে।
পরে আমাকে এক স্যার বলেছিলেন ওটা ওঁদের ম্যাট্রিকের কোর্সে একটি ইংরেজি কবিতার ন্যারেশন।
কিন্তু এই সর্বজনপ্রিয় সুনীলদাও একেকদিন খেপে উঠতেন। ওঁর টিউটোরিয়ালের বেয়াড়া বাচ্চাদের ভালবেসে বুঝিয়েসুজিয়ে যেদিন পোষ মানাতে পারতেন না, সেদিন খুব হতাশ হয়ে খানিকক্ষণ মাথা নীচু করে মাটিতে পাতা সতরঞ্চির উপর বসে থাকতেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে নিজের গালে চড় মারতেন -- মুখে আওয়াজ করতেন 'ত্যাট্ ত্যাট্!'
দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলতেন--আমি এক ক্যালানে মাস্টার, সারাজীবন ধরে কেলিয়ে যাব।
ছেলের দল হেসে কুটিপাটি।
এরপর খোঁড়া পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এক খাট থেকে অন্য খাটে বাঁদরের সর্দারগুলোকে তাড়া করে বেড়াতেন। কেউ ভয় পেত না, উনি কাউকে জোরে মারতে পারতেন না, নিজেকেই শাস্তি দিতেন।
অন্য ক্লাসের ছেলেরা এসে তামাশা দেখত। তারপর বড়রা বুঝিয়েসুঝিয়ে নিরস্ত করত। তখন ওঁর চোখে জল। বাঁদর ছাত্রগুলোকে জড়িয়ে ধরতেন।
এ হেন সুনীলদা কিছুতেই আর ম্যাট্রিকের বেড়া ডিঙোতে পারলেন না। আমাদের চোখের সামনে বার তিনেক প্রাইভেটে পরীক্ষা দিলেন-- প্রত্যেকবার একই ফল, অন্তত দুই বিষয়ে ফেল। একটা অবশ্যই অঙ্ক।
এত ভাল পড়াতেন, ফেল কেন হচ্ছেন --এ এক রহস্য। আমরা এটাকে ভগবানের অবিচার মনে করতাম। পরীক্ষার ফল বেরোনোর আগে আমরাও ওঁর জন্যে প্রার্থনা করতাম--ঠাকুর, অনেক পরীক্ষা নিয়েছ, এবার তো পাশ করিয়ে দাও। পাঁচ সিকে মানত করছি।
স্যারকে বলেছিলাম--কোন চিন্তা করবেন না। আমরা সবাই আপনার জন্যে প্রেয়ার করেছি। এবার কেউ ঠেকাতে পারবে না।
কোথায় সুনীলদা?
ওই যে বেঁটে মতো ধুতি পরা লোকটি খোঁড়াতে খোঁড়াতে দ্রুত পায়ে প্রেয়ার হলের দিকে যাচ্ছে।
আমাদের আগেই উনি পৌঁছে গেছেন হলে।
আমরা ঢুকেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। কেউ কেউ বারান্দায় থেমে গিয়ে জানলা দিয়ে দেখতে লাগলাম।
প্রায়ান্ধ লোকজনহীন হল। শুধু ঠাকুর-মা-স্বামীজির ছবির সামনে পিলসূজের উপর পেতলের প্রদীপের শিখা। সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন সুনীল স্যার--আমাদের সুনীলদা। চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে দুই গাল। কেঁপে কেঁপে উঠছে ঠোঁট। অস্ফুট স্বরে শোনা যাচ্ছে বুকভাঙা হাহাকার-- ঠাকুর, এ কী করলে তুমি, ঠাকুর!