• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭২ | সেপ্টেম্বর ২০১৮ | রম্যরচনা
    Share
  • পঞ্চাশ-ষাটের হারিয়ে যাওয়া কোলকাতার চালচিত্র (১) : রঞ্জন রায়


    (একে চন্দ্র, দু’য়ে পক্ষ। সমুদ্র মন্থনেও দুই দল, এ ধরেছে শেষনাগের মাথা তো ও মুড়ো। এদিকে বিষ্ণুর মোহিনী মায়ায় সব লণ্ডভণ্ড। উঠল গরল, উঠল অমৃত। ভাই–ভাই ঠাঁই–ঠাঁই হল। আজও সেই দায় বয়ে চলেছি আমরা। এটি তারই এক আখ্যান, এক বাঙাল কিশোরের চোখে। এর ইতিহাস হওয়ার দায় নেই।)

    ভণিতা

    ‘কলিকাতা চলিয়াছে নড়িতে নড়িতে’

    ।। ১ ।।

    সেইসব দিন। সেইসব দিনকালে শহর কোলকাতায় ফ্লাইওভার–মাল্টিস্টোরিজ–হাইরাইজ– সুপারমল—আইনক্স কিস্যু ছিল না। মোবাইল দূরের কথা, এসটিডি বুথও ছিল না। বুথ ভুলে যান, ঘরে ঘরে আজকের মত টেলিফোন ছিল না। স্যাম পিত্রোদার নামও কেউ শোনেনি। ফোন করতে হলে স্থানীয় ডাকঘরে বা কোন ওষুধের দোকানে লাইন লাগাতে হত।

    মিনিবাস–অটোরিকশা নেই, পুল-কার ঝাঁ-চকচকে মোটরবাইক নেই। খালি নেই আর নেই। তবে ছিল–টা কি?

    ট্রাম ছিল, বাস ছিল — বাঘমার্কা সরকারি, দোতলা ও একতলা; আর সবুজরঙা পেরাইভেট। ট্যাকসি আছে, সর্দারজি ও বিহারী ড্রাইভার। রয়েছে রিকশা, পাড়ার ভেতরে ঢুকতে; করপোরেশন এলাকায় মানুষে টানে, মিউনিসিপ্যালিটি এলাকায় সাইকেলে।

    ও হ্যাঁ, পাড়ায় পাড়ায় রোলের দোকান গজায়নি। ফুচকাওলারা ছিল। ঘুগনি–আলুকাবলি খেয়ে-খাইয়েই স্কুলের ছেলেমেয়েরা খুশি হয়ে যেত। তবে চারআনা দামে কালো কোকাকোলা ছিল। আর দু’পয়সায় বরফ ঘসে তাতে লাল–সবুজ–হলুদ মিষ্টি সিরাপ ঢেলে কাঠি লাগিয়ে চাটা যেত। ম্যাগনোলিয়া আর কোয়ালিটি আইসক্রিমের ঠেলা থেকে দু’আনায় দুধ আইসক্রিম পাওয়া যেত। কাপ কিনলে চারআনা।

    বিস্কুট? লেড়ো, হাতিঘোড়া, ব্রিটানিয়া থিন এরারুট, সারকাস আর লিলি – কোলে কোম্পানির। বড়লোকেরা খেত ক্রিমক্র্যাকার।

    হজমিগুলি, ত্রিফলা লজেন্স। একটু পয়সা পেলে লর্ডসের জেলিভরা লজেন্স, মর্টনের টফি; ক্যাডবেরি নয়।

    একটু বড় হলে চপ-কাটলেট-মোগলাই; শ্যামবাজারের পাঁচ মাথার মোড়ে পাঞ্জাবীর দোকান, অনাদি ও দিলখুসা। না, স্যাঙ্গু ভ্যালি, বিজলিগ্রিল বা আমিনিয়া আউট অফকোর্স। বড়জোর গরমের দিনে বান্ধবীকে লস্যি খাওয়ানো। মোকাম্বো মূল্যাঁরুজ? স্বপন দেখার সাহসও নেই।

    সিগ্রেট? চারমিনারের প্যাকেট ২৮ পয়সা, পানামা ও কাঁচি ৫ পয়সা। ক্যাপস্টান ও উইলস ৮পয়সা, ফিল্টার হলে ১০। পাড়ার দোকানে কাঁচের গেলাসে চা দু’আনা। ওমলেট চার আনা। কফিহাউসে কফির কাপ চার আনা, কোল্ডকফি চল্লিশ পয়সা। ইউনিভার্সিটি ক্যানটিনে কোন ধিনিকেষ্ট ২৫ নয়া পয়সার প্যাকেজে এক টুকরো প্লাম কেক, এক কাপ কফি ও একটি পানামা সিগ্রেট দিয়ে দিত।

    হ্যাঁ, তখনও ১৯৫৭-তে শুরু হওয়া মেট্রিক পদ্ধতির নয়া পয়সা, সংক্ষেপে লেখা হত ন’প, প্রচলিত ছিল।

    মদের দোকান লজ্জায় অধোবদন হয়ে গড়িয়াহাট–ভবানীপুর–চৌরঙ্গী–শ্যামবাজারে নেতাজির ঘোড়ার লেজের দিকে ছোট্ট করে ঝাঁপ খুলত। খালাসিটোলার সন্ধান উঠতিরা পেত না।

    খেলাধুলো? মধ্য কোলকাতায় অলিগলিতে পিচের রাস্তায় ইঁটের উইকেটে বেদম ক্রিকেট পিটিয়ে দোতলা বাড়ির জানলার কাঁচ ভেঙে ভারি ক্যাচাল। কিন্তু শহরতলির বাঙাল পাড়াগুলোতে জলকাদার মাঠে ফুটবলের ধূম।

    আর স্কুল কলেজ? হাতে গোণা ইংরেজি মিডিয়ামের এলিট স্কুল ছাড়া কোন কো–এড ছিল না। মধ্যবিত্ত বাঙালি সহশিক্ষাকে ভাল চোখে দেখেনি। সাকুল্যে তিনটে পরীক্ষা হত। কোয়াটার্লি, হাফ–ইয়ার্লি, অ্যানুয়াল। ইউনিট টেস্ট, উইকলি টেস্টের উপদ্রব তখনো অজানা।

    সরস্বতী পুজো ছিল ছাত্রছাত্রীদের কার্নিভাল। সেদিন অবাধ মেলামেশার সাহস। টিচাররাও চোখ ফিরিয়ে নিতেন।

    এমনি এক বসন্ত পঞ্চমীর সন্ধেতে স্কুলের ফাংশান থেকে ফেরার পথে নাকতলা শক্তি সংঘের মাঠের পাশে হলদেটে বাতির আলোছায়ায় শানু বা শান্তশ্রীর রাস্তা আটকে চয়ন বলল –তোমাকে আমার খুব ভাল লাগে।

    শানুর চকচকে চোখ হেসে ওঠে -- ধ্যেৎ!

    — কেন, আমি কি খুব খারাপ?

    — তা নয়, তুমি দেরি করে ফেলেছ। আমি এখন এনগেজড।

    — বিশ্বাস করি না। তুমি কথা ঘোরাচ্ছ। আমি ছেলেদের কাছে খোঁজ নিয়ে তবে এগিয়েছি।

    — সত্যি বলছি, বিদ্যা ছুঁয়ে। এখন বিশ্বাস করা না করা--!

    — ছেলেটাকে? নাম বলতে আপত্তি আছে?

    — ছেলে নয়, স্যার! অংকের স্যার বিশ্বনাথদা।


    এহ বাহ্য। এসব তো ষাটের দশকের শেষ। আমাকে ফিরতে হবে গোড়ায়। ১৯৫০-এর মার্চ মাসে। মাতৃজঠরে দোলা খেতে খেতে এক বাঙালশিশুর ভ্রূণ অবস্থায় কোলকাতা পোঁছনোর দিনের কথকতা থেকে, তবে তো “লীলে পোষ্টাই হবে”, বুইলেন কি না! তাই এই ভণিতা।

    গৌরচন্দ্রিকা-১
    জলে বাঘ ডাঙায় কুমির



    ৯৫০-সালের মার্চ মাসের এক রাত্রি। শিয়ালদহ স্টেশনের বড় ঘড়িতে বারোটা বাজিয়া দশ মিনিট। একটি পরিবার একের পর এক ট্যাক্সিচালককে কাকুতিমিনতি করিতেছে — বাপধন হে! আমাদের লইয়া চল, বাড়িতে পৌঁছাইয়া দাও। আমরা দ্বিগুণ ভাড়া দিব, তোমাকে প্রাণ ভরিয়া আশীর্বাদ দিব। পাঁচজন মহিলা, একজন পুরুষ এবং এক বালক; সাকুল্যে সাড়ে ছয় জন। কিন্তু গন্তব্যস্থানের নাম— পার্কসার্কাস বাজারের সামনে — শুনিবামাত্র সবাই দুই দিকে মাথা নাড়িয়া সরিয়া যাইতেছে।

    উহা নাকি মুসলমান অধ্যুষিত দাঙ্গাপ্রবণ এলাকা! কিন্তু পরিবারের অন্য সদস্যরা বিগত দুই বৎসর যাবৎ ওইখানেই বসবাস করিতেছে। প্রতিবেশি মুসলমান বটেন, কিন্তু কোন অসদ্ভাব অথবা জানমালের ব্যাপারে কোন দুশ্চিন্তা কখনও মনে উদিত হয় নাই।

    এক ছোকরা ড্রাইভার বলিল— ওপার থেইক্যা শ্যাকের লাথ খাইয়া এপারে আইলেন, কিন্তু আস্তানা করলেন নাইড়াদের মইধ্যে! আর কুনখানে বাড়ি পান নাই? হেইখানে ছিল জলে বাঘ, এইখানে ত ডাঙায় কুমির।

    আগন্তুক পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি মুখ খুলিলেন — তুমি তো দেহি, আমরার মত, কইলকাতার ঘটি না । দেশ কোথায়?

    — ঢাকা; শাঁখারিপাড়া।

    — আমরা পাঁচজন মাইয়ামানুষ নিয়াও ভয় পাই নাই, তুমি ঢাকার ছ্যারা, ডরাইতে আছ?

    —না, ডর কিসের? তবে কখন যে কী হয়!

    শেষে অনেক দরাদরির পরে পরিবারটি বাইশ টাকা ভাড়া—প্রায় দশগুণ — দিয়া রাত্রির দ্বিতীয় যামে পার্কসার্কাস ধাঙড় বাজারের সার্কাস হোটেলের সামনে ১/সি, সার্কাস মার্কেট প্লেস এর ভাড়াবাড়িতে পৌঁছিতে পারিল।

    এক ট্যাক্সিতে সাড়ে ছয়জন এবং কয়েকটি বাক্স-পিটারা!

    না, কল্পকথা নহে। চল্লিশ হইতে পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় যে ট্যাক্সি কলিকাতার রাজপথে দেখা যাইত, তাহার আকার ও ভিতরে যাত্রীর স্থান বর্তমান প্রজাতির হইতে কিঞ্চিৎ বৃহৎ ছিল। বর্তমান প্রজাতি, অর্থাৎ পিছনে তিন ও সামনে একজনের বসিবার স্থান, যাহার আবির্ভাব কয়েক বছর পরে বিড়লার আনুকূল্যে, তাহার নামকরণ হইয়াছিল ‘বেবি ট্যাক্সি’। এক দশক পরে ‘বেবি’ বড় হইয়া বাবা হইল। প্রাচীন বাবাদের কলিকাতা ভুলিয়া গেল। যেমন নয়া-পয়সা ভুলিয়া কেবল পয়সা হইয়াছে।

    তিনটি ঘর, সামনে টানা বারান্দা, একটি পাকের ঘর ও একটি স্নানঘর ও লাগোয়া পায়খানা। এই দাদুর দস্তানায় সদস্য সংখ্যা ক্রমে বাড়িতে লাগিল এবং অচিরাৎ বাইশজনে গিয়া জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে বিরাম লাগিল।

    পরিবারটি হিন্দু কায়স্থ, সাকিন আঠারবাড়িয়া ও বাজিতপুর। মহকুমা কিশোরগঞ্জ, জেলা ময়মনসিংহ, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বৃহত্তম জেলা। ইহা শেরশাহ সুরির সময়কালীন তৈরি হাজরাদি পরগণার অন্তর্গত।

    জনান্তিকে বলি, এই পরগণার মানুষজনের কুতার্কিক বলিয়া বিশেষ খ্যাতি আছে। তর্কচূড়ামণি নীরদ সি চৌধুরি, রাজ্যসভার তার্কিক ভূপেশ গুপ্ত (সিপিআই), র‍্যাংলার আনন্দমোহন বসু, ব্রাত্য গায়ক জর্জ বিশ্বাস, ভারতবিদ্যার বিশেষজ্ঞ নীহাররঞ্জন রায় ও বঙ্গজননীর মুখোজ্জ্বলকারী বংশ উপেন্দ্রকিশোর, তস্য পুত্র সুকুমার রায়, তস্য পুত্র সত্যজিৎ ও তস্য পিতৃশ্বসা লীলা মজুমদার সকলে একই পরগণা ও মহকুমার সন্তান।

    যাহা হঊক, দাঙ্গাবিধ্বস্ত সীমান্ত পার হইয়া নগর কলিকাতায় ঠাঁই প্রাপ্ত এই পরিবারটির পদবী ‘ইন্দ্র’, কিন্তু দুই জেনারেশন হইতে ইঁহারা তালুকদারি পদবি ‘রায়’ লিখিতে অভ্যস্ত হইয়াছেন।

    সাতদিনের মধ্যে ইঁহারা বুঝিলেন যে নবীন পরিস্থিতির সাথে মানাইয়া লইতে হইবে। ইহাই রাষ্ট্রবিপ্লবের কালে আত্মরক্ষার উৎকৃষ্ট পন্থা। অর্থাৎ?

    অর্থাৎ, এক, আঠারবাড়িয়ার আটচালা বাড়ি, ভিতরের বিরাট উঠান, সামনে বিশাল পুষ্করিণী, ও গোবিন্দজীউর নাটমন্দির ভুলিয়া যাইতে হইবে।

    দুই, বাইশজন সদস্যকে তিনকামরায় চৌকি ও মাটিতে বিছানা করিয়া শুইতে হইবে। এইভাবে বাইশজনের স্থান সংকুলান না হওয়ায় ছাতের সিঁড়ির ‘ল্যান্ডিং’ — বাঙাল জিহ্বায় ‘হাঁটুভাঙ্গা’ — এবং ছাতের চিলেকোঠায় তথা খোলা ছাতে আবশ্যকতানুসার আশ্রয় লইতে হইবে।

    এই প্রাচীন মুসলমানী কায়দার ফ্ল্যাট বাড়িতে দোতলায় চারিখানি তিন কামরার ফ্ল্যাট। তাহারা আয়তক্ষেত্রাকারে বিস্তৃত। দুইটি ফ্ল্যাট সার্কাস মার্কেট প্লেসের উপর ও বাকি দুইটি কড়েয়া রোডের উপর। অর্থাৎ, ইহার দুইটি বাহু দুই রাস্তার সংযোগস্থলে একটি সমকোণ নির্মাণ করিয়াছে।

    তিন, বাড়ির মহিলাদের আব্রু সুরক্ষিত নয়। কারণ ঘর হইতে বারান্দা দিয়া বাথরুম যাইতে হইলে তাঁহারা রাস্তার বিপরীত ফুটপাথে অবস্থিত সার্কাস হোটেলের কর্মচারি, খরিদ্দার, গ্রাহক ইত্যাদি ইতরজনের নয়নপথে দৃশ্যমান হয়েন। অবিলম্বে পুরানো শাড়ি কাটিয়া পর্দা বানাইয়া সমগ্র বারান্দার রেলিং-এর উপর তারের সহায়তায় টাঙাইয়া মহিলা সদস্যদের অসূর্যম্পশ্যা করা হইল। রাত্রিকালে বাতি নিভিলে হাওয়ার আগমন হেতু পর্দা সরাইয়া দেওয়া হইত। বাড়িতে ডিসি কারেন্ট, কোন পাখা নাই। তালপত্রের চিত্রিত পাখা কয়েক গণ্ডা আনা হইয়াছে। তাহাতেই নিশাকালে ব্যজন করিতে করিতে মানুষজন ঘুমে ঢুলিয়া পড়িতেন।

    চার, সভয়ে মহিলারা আবিষ্কার করিলেন যে পাশের ১/বি ফ্ল্যাটের মুসলমান পরিবারটি শিক্ষিত ভদ্রলোক বটেন, কিন্তু বাড়ির কর্তাটি পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু নিধনের অন্যতম হোতা আকরাম খাঁ সায়েবের জামাই। আক্রাম খাঁ স্বনামধন্য পুরুষ ছিলেন। ভুক্তভোগী হিন্দুজন উঁহার নাম রাখিয়াছিলেন ‘আক্রমণ খাঁ’। আবার নীচের ১/এ ফ্ল্যাটেও মুসলমান — তৈয়ব খাঁ সায়েব। কী জ্বালা! কোথায় আসিলাম! রক্ষা, আয়তক্ষেত্রের বাকি দুই বাহুতে হিন্দু পরিবারের বাস।

    পাঁচ, কিন্তু নীচে সবচেয়ে বড় এক দোকান মমতাজ স্টোর্স যাহা সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করিয়া থাকে। পিছনে ডোমিনিয়ন টী এন্ড কোং এবং তাহার বিপরীতে ইসলাম টি দার্জিলিং টি’র বিক্রেতা। সর্বত্র মুসলমান, তবে নিকটেই কড়েয়া থানা। তাহাই ভরসা।

    ছয়, কিন্তু সর্বাপেক্ষা জ্বালাতন সামনের হোটেলে সকাল হইতেই গোমাংসের শিককাবাব ও বিরিয়ানি পাক করিবার কার্যবিধি। বারান্দাতেই উনান নির্মাণ করিয়া উহারা আদিম প্রক্রিয়ায় বড় বড় মাংসখণ্ড মশলা মাখাইয়া শূল্যপক্ক করিয়া উৎকট গন্ধ ছড়াইয়া থাকে।

    বাড়ির কর্তা সতীশচন্দ্র, তাঁহার মাতা সুখময়ী ও স্ত্রী সরযূবালা সকলেই দীক্ষিত বৈষ্ণব; ত্রিপুরার পত্তন গ্রামের গোস্বামী পরিবারের যজমান। সতীশচন্দ্রের প্রয়াত পিতা গগনচন্দ্র ‘পঞ্চাশোর্ধে বনং ব্রজেৎ’ এই আপ্তবাক্য অনুসরণ করিয়া সন্ন্যাস ধারণ করিয়া বৃন্দাবনে কুঠিয়ায় থাকিয়া মাধুকরী বৃত্তির মাধ্যমে জীবনযাপন করিতেন। সুখময়ী প্রত্যহ স্নান সমাপনে শ্বেতচন্দন পিষিয়া তিলক ধারণ করিতেন। এখন কিম কর্তব্যম?

    ধীরে ধীরে উঁহাদের উপলব্ধি হইল যে নীচের ছাপোষা পরিবারটি নিরীহ ভদ্রলোক। আর আক্রাম খাঁর জামাই আব্দুর রেজ্জাক খান অনুশীলন দলের প্রাক্তন স্বাধীনতা সংগ্রামী। কালাপানির সাজা কাটাইয়া দেশ স্বাধীন হইলে মুক্তি পাইয়া তথা অনেক কালাপানিতে সাজাপ্রাপ্তদের মত কমিউনিস্ট হইয়া কলিকাতায় আসিয়াছেন। ইনি বঙ্গদেশের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। আড়াই দশক পরে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় সিপি আইয়ের প্রতিনিধি হইবেন তাহাই বিধিলিপি।

    এই সময় এই উদ্বাস্তু পরিবারে শুধু বড় ছেলের বিবাহ হইয়াছে এবং বড় বৌমা সন্তানসম্ভবা। বড় ছেলে ভারতরাষ্ট্রের নিষ্ঠাবান সৈনিক। ফোর্ট উইলিয়ামে ডিউটি করিয়া সন্ধ্যায় হাঁটিয়া বাড়ি ফেরে।

    যথাসময়ে আমার জন্ম হইল। জন্মস্থান কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজের জেনারেল ওয়ার্ডের মাটিতে টানা বিছানায়। সেই দুর্দিনে মাতা ঠাকুরাণীর খাট জোটে নাই। কর্তৃপক্ষ ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই’ বলিয়া প্রসূতিকে ফিরাইয়া দিতে তৎপর। শেষে ধরাধরি করিতে পাওয়া গেল ডঃ ক্ষিতীন্দ্রমোহন গুণ-কে, পরবর্তীকালের বিশিষ্ট স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। তখন উনি সদ্য পাশ করিয়া ইন্টার্নশিপ করিতেছেন। কিন্তু আত্মীয়তা বড় বালাই। উনি আমার জ্যেষ্ঠ মাতুলের শ্যালক বটেন। উহার সুপারিশে আমার মাতা স্মৃতিকণা জেনারেল ওয়ার্ডের মাটিতে অনেক আসন্ন প্রসবার পাশে একফালি জায়গা পাইলেন।

    স্মৃতিকণা বিস্মিত হইয়া দেখিলেন রোগীর দুধ বিড়ালে খাইয়া যায়, কেহ বারণ করে না। আহা কেষ্ট’র জীব! কিন্তু মধ্যরাত্রে এক বিকট আর্তনাদ ও ক্রন্দন। কোন রোগিণীর বাম পদের কনিষ্ঠা অঙ্গুলিতে বিড়াল কামড় দিয়াছে, সম্ভবত নেংটি ইঁদুর বলিয়া ভুল করিয়াছিল।

    আতংকিত স্মৃতিকণা ঈশ্বরের নাম জপিতে লাগিলেন ও গর্ভস্থ সন্তানকে অনুরোধ করিলেন শীঘ্র ভূমিষ্ঠ হইয়া তাঁহাকে এই নরকবাস হইতে উদ্ধার করিতে। পরেরদিন কৃষ্ণ জন্মাষ্টমীতে আমার জন্ম হইল। গায়ের রঙ ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। মিল আরও আছে।

    বসুদেব রাষ্ট্রবিপ্লবের সময় সন্তানকে কোলে করিয়া নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ঘোর দুর্যোগের মধ্যে যমুনা পার করিয়াছিলেন। আমার পিতা সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে লইয়া পদ্মা পার করিয়াছেন। আর যৌবনকালে শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে যাদবকুলের ষোলহাজার নারীর হৃদয়েশ্বর ছিলেন বলিয়া জনশ্রুতি।

    কিন্তু উহা দ্বাপর যুগের কথা। কাশীরাম দাস লিখিয়াছেনঃ

    “—মাংসশ্রাদ্ধ, গোমেধ, অশ্বমেধ,
    দেবর হইতে পুত্র কলিতে নিষেধ।”
    ইহার ইতরযানী রূপ হইল ‘কৃষ্ণ করলে লীলা, আর আমি করলে বিলা’।

    যাহা হউক, আমি স্বভাবে কাপুরুষের ডিম্ব, কোনক্রমে এক ঘোষ পরিবারে দার পরিগ্রহ করিয়াছি মাত্র।


    মেডিক্যাল কলেজ হইতে ছুটি পাওয়ার পূর্বে স্মৃতিকণা সভয়ে লক্ষ্য করিলেন যে সদ্যোজাত সন্তানটি হাতবদল হইয়াছে। তৃতীয় দিন ধাত্রী যে শিশুকে স্নান করাইয়া তাঁহার কোলে তুলিয়া দিল সেটি অপেক্ষাকৃত গৌরবর্ণ। তাঁহার চিল-চিৎকারে সেবিকা ও ধাত্রীর কোন চিত্তবিক্ষেপ হইল না। বৈকালে পরিবারের লোকজন আসিয়া আবার ডঃ গুণের মধ্যস্থতায় সমস্যার সমাধান করিল।

    আমি আশ্চর্য, মাতাঠাকুরাণী কেন এমন ঈশ্বরপ্রদত্ত বর, অর্থাৎ গৌরবর্ণ পুত্রের মাতা হওয়ার সুযোগ হেলায় প্রত্যাখ্যান করিলেন!

    উত্তরে উনি বলিলেনঃ

    ‘সন্তান যদি বা হয় অসিতবরণ,
    জননীর চোখে সে যে কষিতকাঞ্চন।’
    এইভাবে আমি পিতৃপুরুষের ভিটা হইতে উচ্ছেদ হওয়া এক বাঙাল পরিবারে বাইশজন সদস্যের মধ্যে গা ঘেঁষাঘেঁষি করিয়া যুদ্ধোত্তর কলিকাতায় ‘দাদুর আহ্লাইদ্যা নাতি’ হিসাবে বিশেষ প্রশ্রয়ের মধ্যে গোকুলে বাড়িতে লাগিলাম। সকলে আশা এবং বিশ্বাস করিতেন যে নবীন প্রজন্মের এই প্রথম নবজাতকটি — যে নাকি জন্মাষ্টমী তিথিতে এবং দার্শনিক রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিন ৫ই সেপ্টেম্বরে জন্মিয়াছে — সে বংশের কুলপ্রদীপ হইয়া স্বর্গে বাতি দিবে, বিদ্যাদিগ্‌গজ মহাধনুর্ধর হইবে।

    কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, আমি সকলকে হতাশ করিয়াছি। যেমন মহানগরী কলিকাতা অনেককে হতাশ করিয়াছে। আসলে আমি ও কলিকাতা একইসঙ্গে কলেবরে বর্ধিত হইয়াছি, গরিমায় নহে। কেন?

    হয়ত গোড়ায় গলদ ছিল। ইহা হয়ত আমার ও কলিকাতার প্রতি সমানভাবে প্রযোজ্য। জব চার্নকের পত্তনী বেনিয়া কলিকাতার জন্ম বঙ্গসংস্কৃতির পীঠ হুগলীর মত ঐতিহ্যবাহী নহে।

    হয়ত আমি আসলে ভ্রমক্রমে হাতবদল হওয়া ভুল সন্তান; রায় পরিবারের কেহ নই। এই সংশয়, এই দ্বিধা আমাকে আজীবন তাড়াইয়া ফিরিয়াছে।

    তাই জীবনসায়াহ্নে এই সত্তর ছুঁই ছুঁই সময়ে বিস্মৃতপ্রায় পঞ্চাশ-ষাটের কলিকাতার স্মৃতি লিপিবদ্ধ করিতে চাহি, ‘নশটালজিয়া’ সদাই মোহক, কিন্তু কর্মনাশা। অতএব, সাধু সাবধান!


    গৌরচন্দ্রিকা-২
    দিল্লি শহর যাবার রাস্তা


    বোম্বাই মেলে চড়ে বসেছি। গন্তব্য -- পুণে শহরের কলেজ অফ এগ্রিকালচারাল ব্যাংকিং।

    মাথায় নানান চিন্তা; অচেনা জায়গার অস্বস্তি, ঘরে ছেড়ে আসা বৌ–বাচ্চার ভাবনা, চিন্তার কি আর শেষ আছে? হাতের পেপারব্যাকে মন বসছে না। হঠাৎ চোখ গেল কয় জোড়া বিদেশি দম্পতির দিকে -- কটা রং, বেড়ালচোখো, নীলচোখো, তামাটেচুলো, কিন্তু সবাই খুব ফরসা। লালচে, ফ্যাটফেটে, হলদেটে -- নানান কিসিমের।

    আমেরিকান? ইংরেজ? -- না, না, রাশিয়ান। সবাই ভিলাই ইস্পাত কারখানার স্টাফ। বর্ষশেষের ছুটিতে চলেছে গোয়ার সমুদ্রতীর, সপরিবারে। বই মুখে ধরে আড়ে আড়ে ওদের দেখতে থাকি। বেশ খেতে পারে ওরা। সন্ধে পেরিয়ে গেলে সবা্ই একজায়গায় গোল হয়ে খেতে বসলো। দু'একজন দাঁড়িয়ে। দু-হাতে ধরে গাঁউ গাঁউ করে চিকেন খেল, পাকা পাকা টম্যাটো গোটা গোটা খেয়ে ফেলল। শেষপাতে দইমিষ্টি খাওয়ার মত ছোট ছোট লালচে প্লাস্টিকের থিম্বলে করে ওয়াইন খেল সবাই। তারপর মেয়েমদ্দ সবাই মিলে গান জুড়ল। সে কি গান! ভাষা বুঝিনে, কিন্তু এসি কোচের জানালার বন্ধ কাঁচে ধাক্কা খেয়ে সে গান ফিরে এসে আমার বুকের কোন ঘুমিয়ে থাকা অজানা ব্যথায় হাত রাখল। দু-তিনটে গানের পরে সুর-তাল যেন একটু বদলে গেল। গান যেন একটু চটুল,একটু লচকদার। দুয়েকজনের শরীরে নাচের দোলা।

    ভাব করলাম স্মিতমুখে একপাশে বসে থাকা দলের নেতা রুপোলি চুলের কিরিলেংকোর সঙ্গে। পাশে বসে পেপারব্যাকের পাতা ওলটাতে থাকা শ্রীমতী কিরিলেংকো এগিয়ে দিলেন গরম চায়ের কাপ। গল্প জমে উঠল। বললাম -- রুশসাহিত্যে গাঁয়ের বাড়িতে আগুনের পাশে বসে গোটা পরিবারের একসঙ্গে গান গাওয়ার সেই ট্র্যাডিশন দেখছি আজও বেঁচে আছে!

    --আছে, আবার নেইও। সুর ও ভাষা বদলেছে। নতুন প্রজন্ম ডিস্কোয় যায়। ওদের পছন্দ পপ, জ্যাজ, রকব্যান্ড।

    আগের মত ব্যালাড গাইতে চায় না।

    --তাহলে রাজকুমারী ভাসিলিসা, আলিউস্কা দিদি ও ইভানুস্কা ভাই, বোকা ইভান, শিসে ডাকাত সলভেই -- এরা সব হারিয়ে গেছে বলছেন?

    --প্রায়; আসলে পাশ্চাত্ত্য জীবনশৈলীর প্রভাব ইদানীং খুব বেড়ে গেছে। আমি জর্জিয়ার লোক, এশিয়ান। স্তালিনের দেশের। আজকের শব্দাবলীতে আমি কনজারভেটিভ। ছাড়ুন ওসব কথা। আপনার কথা বলুন। সবাই মিলে গোল হয়ে গান গাওয়া তো এশিয়াটিক ট্র্যাডিশন। গ্রামজীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আপনারাও হয়তো বাড়িতে গেয়ে থাকেন?

    বাড়িতে গান গাওয়া? সবাই মিলে? -- ও ভাই কানাই, কারে জানাই?

    আর সবাই মিলে গান? শহর কোলকাতায়? অসম্ভব। পাড়ার লোকে ভিড় করে জানতে চাইবে কী হয়েছে। কোলকাতাকেই বা কেন দোষ দিই? ছত্তিশগড়ের ভিলাই বা বিলাসপুর হলেও একই ব্যাপার। গলা ছেড়ে গান গাইতে চান, তো বাথরুমে যান। বাঙালির মাথায় জল পড়লেই গলা দিয়ে গান বেরয়। যদি সবাইকে শোনাতে চান তো একগাদা গানের ফরমাইশি চ্যানেল আছে, সিডি–এমপিথ্রি প্লেয়ার আছে, নিদেনপক্ষে এফ এম ব্যান্ড আছে। খামোকা বাড়িশুদ্দু মেয়েমর্দ মিলে চেঁচিয়ে গান গাইতে হবে কেন?

    আমরা যে শহুরে! মেপেজুকে বেশ হিসেব করে কথা বলি। কোন ইমোশনকেই উঁচু গ্রামে খেলাতে পছন্দ করি না। চেঁচিয়ে গান গাওয়াটা যে নেহাৎ গেঁয়ো ব্যাপার।

    কিন্তু যখন গ্রাম থেকে শহরে এসেছিলাম?

    আমি, মানে আমরা? অর্থাৎ আমাদের বাপদাদারা?

    মনে মনে পুরনো এ্যালবামের পাতা উল্টে যাই।




    পঞ্চাশের দশক।

    কোলকাতার পার্কসার্কাস এলাকায় ধাঙড় বাজারের সামনে দোতলায় তিনকামরার ভাড়া বাড়ি। ঘর, ছাদে চিলেকোঠা আর সিঁড়ির বাঁকে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা বাইশজনের সংযুক্ত পরিবার।

    দেশভাগের ধাক্কায় পালিয়ে এসেছে বটে কিন্তু ভাগাভাগিটা মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। একচিলতে আশা এখনো মনের কোণায় টিমটিমিয়ে আছে যে রাজনীতির উলটো ঢেউয়ে হয়তো কখনো ফেরা যাবে পূর্ব পাকিস্তানের ময়মনসিংহ জেলার মানিকখালি রেলস্টেশনে নেমে আঠারবাড়িয়া বা বাজিতপুর গাঁয়ে।

    সেখানে আটচালা বাড়ির উঠোনে নাটমন্দিরের সামনে ভোরবেলায় বাবর আলি মুন্সির লালঝুঁটি মোরগের গর্বিত বাং দেওয়া বন্ধ হবে; সন্ধেবেলা আবার শোনা যাবে গোবিন্দদাসের পদ-- ভজহুঁ রে মন, শ্রীনন্দ নন্দন অভয় চরণার বিন্দ রে।

    ঠাকুমার চোখে ঘোর লেগেছে, মনে মনে পৌঁছে গেছেন গোবিন্দজীউয়ের সন্ধ্যারতির সময়ে। ত্রিপুরার পত্তনের গোস্বামীদের বংশপরম্পরায় দীক্ষিত যজমানবাড়ির বৌ। কারা যেন খোল-করতাল বাজিয়ে গান ধরেছে-- 'কেন হে মুরারি, এ মায়া বিস্তারি, জীবের সুখের তরি, কর নিমগন?'

    গলাটা যেন চেনা চেনা লাগে! মেজজামাই যতীন দত্তের গলা কি? ঘোমটা দিয়ে সরে যাবার চেষ্টা করতেই সম্বিত ফিরল।

    পার্কসার্কাসের বাড়িতে সন্ধে নেমেছে। বড়ছেলে ফৌজি আদমি, ফোর্ট উইলিয়াম থেকে ডিউটি করে ফিরেছে। আছে খোশমেজাজে, কারণ আজই মাসপয়লা। মাইনে পেয়ে বাবার হাতে তুলে দিতে পেরেছে মাসের সংসার খরচের লেভি। ফলে গলায় খেলছে-- 'কেন হে মুরারি---' সঙ্গে মেজজামাইয়ের দোয়ারকি-- 'দিলে অনল জল, রসাল ধরাতল, দিলে না মোক্ষফল বিপুল ধরায়!'

    সরযূবালা অফিসফেরতা বড়ছেলে ও জামাইয়ের জন্যে চা নিয়ে এলেন। মনটা খুশি খুশি। কালকে মাসের বাজার হবে, ফর্দ বানাতে হবে। দু'মাস পরেই দুর্গাপুজো। বাকি ছেলেরা বোনাস পেলে পুজোর কাপড় কেনার কথা ভাবা যাবে।

    সরযূবালার আটছেলে, চারমেয়ে। ছোটছেলে এ বছর কলেজে গেছে। পাঁচছেলে চাকরি করছে, দু'জন বাংলার বাইরে। পুজোতে ঘরে ফিরবে। কিন্তু গানটি ওনার পছন্দ নয়।

    উনি গুনগুনিয়ে ধরলেন অতুলপ্রসাদ-- 'চোখ বেঁধে ভবের খেলায় বলছ হরি আমায় ধর'। বড়লোক মামাতো ভাইয়ের বাড়িতে শোনা কলের গান।

    ওনার গলায় সুর আছে, কিন্তু একটু নাকী নাকী, একটু চাপামত। তবু রেণুকা দাশগুপ্তের নকল মন্দ হয়নি।

    হঠাৎ গান থেমে গেল। দরজা ঠেলে হাসিমুখে ভেতরে ঢুকছেন মেজছেলে বিজন, হাতে ঝোলানো মস্ত এক ইলিশমাছ। ব্যারাকপুর থেকে সপ্তাহ শেষে বাড়ি ফেরার সময় শেয়ালদা’ স্টেশনের পাশ থেকে কেনা। অতবড় মাছ দেখে বাঙালবাড়িতে এমন হৈচৈ শুরু হল যেন ইস্টবেঙ্গল জিতেছে।

    স্কটিশে বাংলার ছাত্র ছোটছেলের কবি কবি ভাব। সে আওড়াতে লাগল বুদ্ধদেব বসু-–‘ইলিশ, ইলিশ! আজ ইলিশ উৎসব’।

    কিন্তু এ’ধরনের ‘এই গরু সরোনা’ ঢংয়ে ইলিশবন্দনা বাঙালবাড়িতে একেবারে বেমানান। কাজেই চতুর্থভাই শৈবাল দরাজ মেঠো গলায় গেয়ে উঠলেন-- ‘আরে ইলশা রে, ছাওয়াল কান্দাইলা মাছ, অতিথ খাওয়াইলা মাছ, শাশুড়ি ভুলাইলা মাছ, ইলশা রে’!

    চা’ দিতে এসে বড়বৌদি ঘোমটার ফাঁক দিয়ে ফরমাশ করে গেলেন-- সেজঠাকুরপো’ যেন সদ্য মুক্তিপাওয়া ছবিটিতে আব্বাসউদ্দিন সায়েবের গাওয়া পূববাংলার লোকগীতিটি শোনাতে না ভোলেন! ওই যে ‘কচুর শাক উইঠ্যা বলে আমার চিরা পাতা, আমারে খাইতে লাইগে ইলশামাছের মাথা’।

    ইতিমধ্যে সেজছেলে বিনয়কুমার উষা সেলাইমেশিনের কারখানার থেকে ডিউটি করে ফিরেছেন। সদ্য যাদবপুর থেকে পাশ করে চাকরি পেয়েছেন, কিন্তু এখনও কোলকাতার রং পুরোপুরি ধরেনি; দোমাটির কাজ চলছে।

    জুলাই মাসের গুমোট। একটা সেকেন্ডহ্যান্ড ডিসি পাখা বাড়ির বিশ্বস্ত বুড়ো চাকরের মত ধীরে ধীরে চলছে।

    ফলে উনি এসেই ধড়াচুড়ো ছেড়ে লুঙ্গি পরে ঘরের মেজেতে, বাঙালভাষায় যাকে বলে ‘ল্যাডা মাইরা’, বসে পড়েছেন। চেহারায় ফুটে উঠছে ঘামের বিন্দু। হাতে হাতে ঘুরছে তালপাতার পাখা। এবার বিনয়ের চোখ পড়ল দুধের গেলাস নিয়ে ‘কুয়ারা’ করতে থাকা আদরের ভাইপোর দিকে। কোলে টেনে নিয়ে বললেন--‘ই’ কে দেখ ইলিশমাছের পাশে, ইলিশমাছের গন্ধ পেলে--?

    –‘জিভেতে জল আসে’; প্রত্যাশিত পাদপূরণ করল আদরে–বাঁদর–হওয়া চারবছুরে ভাইপোটি।

    ঠাকুরপো’র ইশারা ধরতে বৌদির দেরি হয়নি। তাই চায়ের সঙ্গে একপ্লেট মাছভাজা এল। বাইরে গুমোট থাক, ঘরের গুমোট কেটে গেছে। বিনয় মুডে এসে গেলেন। সকলের অনুরোধে গেয়ে দেখাতে লাগলেন যে একবার আকাশবাণীর স্টাফের ভুলে পংকজ মল্লিক মশাইকে পল্লীগীতি গাইতে বাধ্য হওয়ায় কিভাবে ‘নিশীথে জাইও ফুলবনে ও ভ্রমরা’ কে ‘নিশীথৈ যেও ফুলবোনে ও ভোমরা’ করে গেয়েছিলেন।

    হঠাৎ রসভঙ্গ হল। খুদে ভাইপোটি বেগ সামলাতে পারেনি, ভিজিয়ে দিয়েছে মেজকাকার লুঙ্গি; অপ্রস্তুত কাঁদো কাঁদো চেহারা। কিন্তু ওকে বকাঝকা চলবে না। বদলে ছোটকাকা হাসিমুখে গেয়ে উঠল আব্বাসউদ্দিনের ভাটিয়ালি-- ‘আমায় ডুবাইলি রে, আমায় ভাসাইলি রে; অকূলদরিয়ায় বুঝি কূল নাই রে!’

    ভাটিয়ালির নদীপথ ধরে ওরা ফিরে গেলেন ধনু আর মেঘনা নদীর নৌকোবাইচের দিনগুলিতে। বাইচের জন্যে বিশেষ ভাবে তৈরি নৌকো, গাবের আঠা আর গলুইয়ের নকশা এবং পরিবারের ম্যানফ্রাইডে মোম আলি ওরফে লাউয়া মিঞার কথায়। বাড়ির পুরনো চাকর লাউয়া আবার সরযূবালার ছেলেদের কানমলে দেওয়া সেল্ফস্টাইলড্ অভিভাবকও ছিলেন। নিরক্ষর মিঞার রসবোধ অসাধারণ। কোলকাতায় ইঞ্জিনিয়ারিং পাঠরত বিনয় ছুটিতে দ্যাশের বাড়ি গেলে মিঞা ওঁকে একটি চিঠি পড়ে দিতে বললে বিনয় লম্প নিয়ে আসতে বলেছিলেন, সাঁঝের সময়।

    মিঞার চোখ কপালে-- এইডা কি কইল্যা? লম্প ছাড়া চিঠি পড়তে পার না? কইলকাতায় গিয়া পয়সা দিয়া পড়, নাকি ধান দিয়া?

    পুরনো স্মৃতি মনে করে বিনয়কুমারের চোখ ভিজে যায়। অন্য ভাইয়েরা শুরু করে।

    নৌকোর গলুইয়ে চড়ে কৃষ্ণলীলার গানের সঙ্গে মিঞার দু’হাতে করতাল বাজিয়ে কোমর দুলিয়ে নাচ ছিল দেখার মতন। বাইচের শুরুতে গান লীড করতেন মিঞা:

    ‘যাত্রা করিয়া মোরে বিদায় দে!
    ও মা যশোদা, মাগো যশোদারাণী,
    কালীদহে যাব আমি’।
    ‘কালীদহে’ শব্দে সমে আসার সাথে সাথে দশজোড়া বৈঠা একসাথে উঠতো আর পড়ত। (কাকাদের সম্মিলিত বর্ণনায় খুদে ভাইপোটির চোখে ঘোর লাগে। সে শুনতে থাকে গান, দেখতে পায় উত্তাল মেঘনার বুকে নৌকোদৌড়ের চলচ্চিত্র। বহুবছর পরে টিভির পর্দায় মৈমনসিংহের দিনেন্দ্র চৌধুরির গানের দলের সাজগোজ করা গুডবয় গায়কদের কোরাসে ওই গান শুনে সে উদ্দীপনা হল কই?)

    পা’ টিপে টিপে বাড়িতে ঢুকেছে ভাগ্নে তপন; সসংকোচে পেরিয়ে যাচ্ছে সরু বারান্দা। সংকোচের যথেষ্ট কারণ আছে, ক্লাস এইটের ছেলের বাড়ি ফেরার পক্ষে রাত একটু বেশি বটে। সামলে দিলেন চতুর্থ ভাই, তপনের মামামণি। উঁচু গলায় হাঁক পাড়লেন-- বৌদি, তপন আইছে, আর একবার মাছভাজা!

    তারপর বড়দের তর্জন–গর্জন শুরু হওয়ার আগেই গান ধরলেন:

    ‘আইবা নি গো, বইবা নি?
    দাওয়াত কবুল করবা নি?
    আমার বিবি রাইন্ধা থইছে
    মস্ত খাসির বিরিয়ানি’।

    গরম বড্ড বেশি, সবার গায়ে প্যাচপেচে ঘাম; হাতপাখাদের দ্রুত হাতবদল হচ্ছে। খুদেটা ঘ্যানঘ্যান শুরু করেছে, ওর চাই ‘পত্রিকা বাতাস’। সবাই একমত হলেন যে তাড়াতাড়ি বৃষ্টি না নামলে রক্ষে নেই। এই সম্মতি প্রকাশ পেল সরু মোটা নানান গলার কোরাসে--

    ‘চাচি গো,আমি মৈলাম গো,
    বড় দায়ে ঠেকাইছে আল্লা!
    ম্যাঘে দেয় না পানি, কি করি গো নানি,
    ক্ষ্যাত হইলো ফুটিফাটা গো,
    বড় দায়ে ঠেকাইছে আল্লা’!
    বড়ছেলে শংকরের খিদে আর বাগ মানছে না। ইলিশমাছ বলে কথা, তায় রান্নাঘর থেকে সিগন্যাল এসে গেছে। --সভাভঙ্গ হোক, সবাই খেতে চল।

    বাদ সাধলেন বড়দি –-না, না। আগে বাচ্চারা খাবে, তারপর বড়রা। সবার একসংগে বসে খাবার মত জায়গা কই? একি দ্যাশের বাড়ি যে ঢালা পাত পড়ব?

    ফলে খিদে ভুলতে মোক্ষম দাওয়াই-- আবার একদফা গান, গাজনের সন্ন্যাসীদের মত।

    আজকের শেষ গান, একটু আধ্যাত্মিক। এবার লীড করবেন সরযূবালা ও বকুল, মা ও মেয়ে একসংগে; ছেলেরা দোহার ধরবে।

    ‘সে কি তোমার মত, আমার মত, রামার মত, শ্যামার মত?
    ডালাকুলো ধামার মত পথে ঘাটে দেখতে পাবে!
    হাটবাজারে বিকোয় না সে,
    থাকে নাকো গাছে ফলে,
    সে যে দিল্লিশহর নয় যে রাস্তা
    করিমচাচা দেবে বলে!’
    গান চলতে থাকে, সরযূবালার খুদে নাতিটি তন্ময় হয়ে শোনে। তার মগ্নচৈতন্যে ঢুকে যায় --এক যে আছে দিল্লি শহর যার রাস্তা শুধু করিমচাচাই জানে।

    এতদিনেও দিল্লিশহর পৌঁছুতে পারিনি, করিমচাচার ঠিকানাই যে পাইনি। আজও খুঁজে চলেছি।

    ট্রেন মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাসে ঢুকছে।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণ: রাহুল মজুমদার
  • প্রচ্ছদ | পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০ | পর্ব ১১ | পর্ব ১২ | পর্ব ১৩ | পর্ব ১৪ | পর্ব ১৫ | পর্ব ১৬ | ১৭ | পর্ব ১৮ | পর্ব ১৯ | পর্ব ২০ | "২১" | পর্ব ২২ | পর্ব ২৩ | শেষ পর্ব
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments