• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৫ | জুলাই ২০২৪ | রম্যরচনা
    Share
  • পঞ্চাশ-ষাটের হারিয়ে যাওয়া কোলকাতার চালচিত্র (শেষ পর্ব) : রঞ্জন রায়



    অলটারনেটিভ প্রুফ

    আমাদের স্কুলের স্টাফরুমে ভিড় ভেঙে পড়েছে। এমন আজব ঘটনা!

    শুধু হেডস্যার আসেননি, ব্যাপারটা তাঁর কানে তোলা হয়নি, তাই। নানান ক্লাসের ছেলের দল, ল্যাব সহকারিরা মায় স্কুলের চাপরাশি বৈকুন্ঠ ও ঘনশ্যাম।

    রাজীবস্যার প্রশ্ন করেন—প্রদ্যুম্ন, নখদর্পণ হল? কী দেখলে?

    -- স্যার, আগে অনিল বলুক।

    অনিলের বর্ণনা শেষ হলে সন্নাটা সন্নাটা।

    তাহলে বিপ্লব চোর? সবার চোখ এখন ওর দিকে।

    --হ্যাঁ স্যার! প্রদ্যুম্ন নখদর্পণে নিজে বিপ্লবকে দেখেছে। ও ছাতের উপর জলের ট্যাংকের নীচে আমার ফেবার লুইবা রিস্ট ওয়াচ লুকিয়ে রেখেছে। হ্যাঁ স্যার, আমি তখন ঘড়ি দেখেছিলাম—তিনটে বেজে চল্লিশ।

    রাজেন্দ্রস্যারের নির্দেশে ঘনশ্যাম চাপরাশি ছাদে জলের ট্যাংকের নীচের থেকে ঘড়ি উদ্ধার করতে গেল।

    কিন্তু স্টাফরুমে স্যারেদের আর ক্লাস টেনের ছেলেদের মধ্যে ফিসফাস কথা শুরু হয়ে গেছে। উঠে দাঁড়িয়েছেন কেমিস্ট্রির বাণীব্রত স্যার।

    --আমাদের কোথাও কিছু একটা ভুল হচ্ছে।

    রাজেন্দ্রস্যার অবাক হয়ে কেমিস্ট্রির স্যারের দিকে তাকালেন। কী বলতে চান আপনি?

    --বলতে চাই যে প্রদ্যুম্ন বিপ্লব নয়, অন্য কাউকে দেখেছে।

    -- মানে?

    -- স্যার, আজ ওদের প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাস ছিল। তিনটের থেকে সওয়া চারটে পর্যন্ত। বিপ্লব আর অরবিন্দ একটা সল্ট টেস্ট করছিল, আমার সামনে। একবারও ক্লাস থেকে বের হয়নি। তাই তিনটে চল্লিশে ওর তিনতলার ছাতের ট্যাংকের নীচে কিছু লুকোনোর প্রশ্নই ওঠে না।

    --হ্যাঁ স্যার, ও আর আমি তখন থেকে একসঙ্গে আছি। অরবিন্দ মুখ খোলে।

    অনিল চেঁচিয়ে ওঠে। নিশ্চয় ও বাথরুম যাবার নাম করে ক্লাসের বাইরে গিয়েছিল, স্যারের মনে নেই।

    বাণীব্রত স্যার ধমকে ওঠেন—তুমি থামো হে ছোকরা!

    কিন্তু আর কেউ মুখ খোলবার আগে চাপরাশি রাধেশ্যাম ফিরে আসে। জলের ট্যাংকের নীচে কিছু নেই। বিপ্লব সরালো কখন?

    রাজেন্দ্রস্যার বলেন—এবার আমরা প্রদ্যুম্নর কথা শুনব।

    আমি একবার গোটা ঘরের সবার দিকে চোখ বু্লিয়ে নিই। সবাই কেমন অপেক্ষায় রয়েছে। এত ইম্পর্ট্যান্ট আমি!

    --স্যার, বলতে বাধ্য হচ্ছি এই তান্ত্রিকের নখদর্পণ ব্যাপারটা পুরো বুজরুকি! আমি কিচ্ছু দেখিনি। দেখা সম্ভব নয়। এসব ওই বাবাজি ও বগলা মার চালাকি। একটা অস্বাভাবিক পরিবেশ বানিয়ে জোর করে সাজেস্ট করে কিছু দেখেছি এ’রকম বলতে বাধ্য করা।

    আপনারাই বলুন, ওইটুকু নখের মধ্যে কালি লেপে স্কুলের ছাদ, জলের ট্যাংক, মানসের মুখ আর ঘড়িটা যে ফেবার লুইবা—এসব দেখা ও চিনে ফেলা সম্ভব?

    অনিল চেঁচিয়ে ওঠে—কী বলছিস কি তুই!

    ওকে রাজেন্দ্রাস্যার এক ধমকে চুপ করিয়ে দিয়ে বললেন—আর কিছু বলবে প্রদ্যুম্ন?

    --হ্যাঁ স্যার। আর একটা কারণে আমার হাতে নখদর্পণ হতে পারে না।

    --সেটা কী?

    --রাশি স্যার। আমার রাশি তো কন্যারাশি নয়। তাহলে আমি দেখলাম কী করে?

    -- তুমি—তুমি আমাকে মানে আমাদের সবাইকে মিথ্যে কথা বলে ক্লাস কেটে তামাশা দেখে এলে?

    --না স্যার! অলটারনেটিভ প্রুফ। অল্টারনেটিভ প্রুফ, বিকল্প প্রমাণ। আপনিই ক্লাসে শিখিয়েছিলেন। দ্বিঘাত সমীকরণের মূল যে দুইয়ের বেশি হতে পারে না সেটা প্রমাণ করতে ধরে নেওয়া হয় তিনটে মূল—আলফা, বেটা, গামা। তারপর এমন একটা জায়গায় পৌঁছোই যা প্রথম প্রমেয়র সংগে খাপ খায় না। তার মানে প্রথম ধরে নেওয়াটাই ভুল।

    এখানেও আমি তাই করলাম।

    আমার রাশি কন্যা নয়, বৃশ্চিক। অর্থাৎ তান্ত্রিকের লিস্টির কোন রাশি নয়। নখদর্পণ সত্যি হলে আমার নখে কিছু দেখতে পাওয়া যাবে না। তাহলে বগলা মা কী করে সব দেখালেন? অর্থাৎ প্রথম প্রেমিসটাই ভুল। ব্যাপারটাই জালি।

    রাজেন্দ্রস্যার হো হো করে হেসে উঠলেন।

    ১১

    বুঝতে পারছি যে আশ্রমে আমার আর ঠাঁই হবে না। মহারাজেরা ওই ভুখ হরতালের ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেননি। এর একটা হেস্তনেস্ত করতে চাইছিলেন। মেজ মহারাজ তাঁর পুলিশি অভিজ্ঞতায় বলেছিলেন-- দরকার একটা এগজাম্পল ক্রিয়েট করা। উনি বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছিলেন যে অমিয়দা সাস্পেন্ড হয়ে বাড়ি চলে গেলে যে অনশন সুরু হয় তার মাথা ছিল প্রদ্যুম্ন ওরফে পোদো। ওকে এবার সাস্পেন্সন নয়, সোজা ট্রান্সফার সার্টিফিকেট হাতে ধরিয়ে কোলকাতায় ফেরত পাঠিয়ে দিলে মন্দ হয় না।

    আবার কিছু নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এরিয়া লাইব্রেরি থাকার সুবাদে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের থেকে একটি ডজ ভ্যান আশ্রমকে দান দেওয়া হয়েছিল। সেটায় করে মহারাজেরা বিভিন্ন প্রোগ্রামে যাতায়াত করতেন। কেউ একজন সেটার ইঞ্জিনে একমুঠো চিনি ঢেলে দিয়েছে। ফলে মোটর জ্বলে গেছে। তাতে কার কী লাভ হল?

    পরে কানাঘুষোয় শুনেছিলাম যে ক্লাস নাইনের কিছু ছেলে ভেবেছিল এতে সরকারের টনক নড়বে, গাড়ির অপব্যবহার নিয়ে তদন্ত হবে। মাইরি বলছি, কে করেছে জানি না। কিন্তু কিছু ছেলেকে কথায় কথায় জানিয়ে দিলাম – কাজটা যে করেছে সে অত্যন্ত নাইভ, ভাল করে কারক-বিভক্তি পড়েনি। সরকারের তদন্ত করতে বয়ে গেছে।

    স্বত্ব ত্যাগ না করে দিলে সেটা দান হয় না। তাই ধোপাকে কাপড় দিলে সেটা কর্মকারক হয়, কিন্তু ভিখারীকে ভিক্ষা দিলে সেটা সম্প্রদান। সরকার একবার ডজ গাড়ি আশ্রমকে দান করেছে, তারপরে কী হল সেটা নিয়ে ওরা মাথা ঘামাবে কেন?

    কিন্তু আমার মেসেজ ঠিক জায়গায় পৌঁছতে বোধহয় দেরি হয়ে গেছল, কারণ পাম্প করে পাতকো’র থেকে ওভারহেড ট্যাংকে জলতোলার মোটরটি দু’দিনের মধ্যে একই ভাবে জ্বলে গেল। কেউ মোটরের ডিজেল ট্যাংকে চিনি ঢেলে দিয়েছিল।

    কিন্তু এইসব সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে অচলায়তনের দেয়ালের একটা ইঁটও ভেঙে পড়েনি। তবে ভোগান্তি হল আশ্রমের সাধারণ ছেলেগুলোর। দু’দিন কলের জল বন্ধ রইল। স্নান, রান্না, প্রাতঃকৃত্যের জন্যে জলের টানাটানি! শেষে দমদম থেকে মিস্ত্রি এসে সব ঠিক করে সারিয়ে দেওয়ায় সোয়াস্তি!

    কিন্তু কিছু আমোদগেঁড়ে ছেলেপুলে বেজায় খুশি। এক তো রোজের রুটিন জীবনযাত্রায় ভাঁটা পড়ল, প্রথমদিন ক্লাসে যেতে হল না। ঠিকমত নাওয়া-খাওয়া না হলে ওরা স্কুলে যাবে কী করে! দ্বিতীয় দিন সবাইকে মিছিল করে নদীতে চান করাতে নিয়ে যাওয়া হল। ঠিক শিবরাত্রির উৎসবের দিনের মত। কিন্তু আমার ঝামেলা বেড়ে গেল।

    কর্তৃপক্ষের সন্দেহ যে আমিই এসবের নাটের গুরু, আর ক্লাস নাইনের আমার ন্যাওটা ছেলেটি, মানে প্রেমাংশু হল আমার কেলে হাঁড়ি, অর্থাৎ হাতেকলমে অপকর্মটি করনেওয়ালা।

    এরপরে আরও একটা ঘটনা ঘটল। সন্ধ্যে বেলা যুদ্ধের কারণে ব্ল্যাক-আউট, সরকারের নির্দেশ। রাত্তিরে টিউটোরিয়ালের সময় জানলায় কালো কাগজ দিয়ে ঢেকে রাখা হত, আর কম ওয়াটের হলদেটে বাল্ব জ্বালানো হত। পাছে পাকিস্তানের বোমারু বিমান ওই আলোকমালা লক্ষ্য করে বোমা ফেলে!

    ওই দমবন্ধ অবস্থা থেকে নিস্তার পেতে আমাদের গ্রুপ একটা রাস্তা বের করল। তখন তামার এক নয়া পয়সা পাওয়া যেত। কোন একটা ঘরে হোল্ডার থেকে বাল্ব খুলে ফের বাল্বটি লাগিয়ে সুইচ্‌ অন করলেই গোটা দোতলায় শর্ট সার্কিট হয়ে অন্ধকার এবং ক্লাস ছুটি।

    সবাই আমাদের গ্রুপকে সাধুবাদ দিয়ে ওই ম্যাজিকের রহস্যটি জানতে চাইল। আমরা বলিনি, কিন্তু স্বামীজিদের পুরনো স্পাই মানস নাইনের ছেলেদের বলে দিল। ফলটা হল যা তা।

    দুটো ছেলে একদিন আমাদের নকল করে ওইভাবে শর্ট সার্কিট করল, কিন্তু ধরা না পড়ার জন্যে যেটা দরকার ছিল-- হোল্ডার থেকে ফের বাল্ব খুলে তামার পয়সাটা বের করে ফের ভালমানুষের মত বাল্বটি আগের জায়গায় লাগিয়ে দেওয়া—সেটা করতে ভুলে গেল। ফলে ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি যতবার সার্কিট ঠিক করে ততবার অন করলেই উড়ে যায়। শেষে ও বিরক্ত হয়ে প্রত্যেকটি ঘরের হোল্ডার চেক করতে শুরু করল। আর পেয়ে গেল কোন ঘরে তামার পয়সা লাগানো হয়েছে।

    বলা বাহুল্য, ওই ঘরের সবাই রাম ঠ্যাঙানি খেল।

    এবার ছেলেগুলো সতর্ক হয়ে লাইন শর্ট করার পর নিয়মিত তামার এক পয়সাটা বের করে নিতে থাকায় ধরা কঠিন হল যে এগুলো কার কীর্তি। স্বামীজিরা আমাদের ডেকে পাঠালেন। আমাদের বক্তব্য কেউ একজন শয়তানি করেছে বলে গোটা দোতলার ছেলেদের অপরাধী বলে দাগিয়ে দেওয়া বা তাদের শাস্তি দেওয়ার কথা ভাবা ঠিক নয়।

    মেজ মহারাজ মুচকি হেসে বললেন—অ্যানুয়াল পরীক্ষা সামনে। তোমরা পড়াশুনো করে ভালভাবে পাশ করতে চাও কি না? তাহলে এই যখন তখন লাইট চলে যাওয়ার উৎপাত বন্ধ করার দায়িত্ব তোমাদেরই নিতে হবে।

    কথাটা আমাদের মনে ধরল। ঢের হয়েছে। এবার যুদ্ধে বিরাম। ওদিকে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তেও সীজ-ফায়ার, তাশখন্দেও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তাহলে আমরা কেন বহুজন হিতায় বহুজন সুখায় মহারাজদের যুক্তিসঙ্গত প্রস্তাব মেনে নিতে পারব না? প্রায় সবাই একমত।

    কিন্তু ভগবানের সৃষ্টি এই আজব দুনিয়ায় কোন কিছুই নির্বিঘ্নে হবার নয়। তাশখন্দে চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শাস্ত্রীজি হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। এই মৃত্যু কতটা স্বাভাবিক তা নিয়ে আজও ধন্দ রয়ে গেছে।

    আমাদের এখানেও একটা নতুন ফ্যাকড়া। ক্লাস এইটের বিজিত বলে একটা রোগাপটকা হাসিমুখের ছেলে, যার হাসলে দু’পাটি দাঁতের মাড়ি দেখা যায়, এই নতুন ঘটনার বলি হল। ওকে এইটের সেই বখা ছেলেগুলো কালো বিছানার চাদরে গা ঢেকে সাদা কাগজ কেটে গায়ে আঠা দিয়ে চিপকে কংকাল সাজাল। রাত্তিরে আলো নিভলে বিজিত ছোট বাচ্চাদের ঘরের বারান্দায় ওই সাজে দৌড়ে ভয় দেখাতে লাগল।

    নীচের তলা থেকে কান্না ও চিল চিৎকারে আমরা গিয়ে প্রথমে বিজিতকে একচোট বকলাম—আমাদের পরীক্ষার প্রিপারেশনের সময় এইসব চ্যাংড়ামি করার জন্যে। তারপরে ওর নিখুঁত কংকাল চেহারা দেখে প্রাণখুলে হাসলাম।

    এরপরে আমরা যে যার ঘরে ফিরে এসে পড়তে বসলাম। কিন্তু মানসের উস্কানিতে বিজিত বার খেয়ে বিবেকানন্দ আবাসে মহারাজদের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। রাত অনেক, বন্ধ দরজা। মানস বন্ধ দরজায় দুম দুম করে দুটো ঢেলা ছুঁড়ে আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। আর কেশব মহারাজ ঘুম চোখে দরজা খুলে বারান্দায় উঁকি দিলে বিজিতের ‘কংকাল’ এমুড়ো থেকে ওমুড়ো হিলবিলিয়ে দৌড়ে গেল। মহারাজ চমকে উঠে অস্ফুট আওয়াজ করলেন।

    বিজিত প্রথম সাফল্যে আরও বার খেয়ে দু’তিনবার ওই দৌড় লাগাল। সেটাই ওর কাল হল। এবার কেশব নয়, একজন পুলিশ অফিসার চোখ কুঁচকে তামাশা দেখতে লাগলেন। ওঁর কানে এল লুকিয়ে থাকা মানস এবং কিছু ছেলেপুলের খিক খিক হাসি।

    তারপর মাঝরাতে যা হল—একেবারে গণ্ডোলায় গণ্ডগোল কেস!

    কেশব দৌড়ে ধরে ফেললেন কংকালের সাজে বিজিতকে। হাঁকডাকে চারদিকের দরজা খুলে ছেলেরা বেরিয়ে এল। একটু পরে আমরাও দোতলা থেকে নেমে এলাম।

    কেশব হাঁফাচ্ছেন, বিজিত ভয়ে কাঁপছে।

    --আমাকে ভূত দেখানো! দেখ, এবার ভূতের কী হাল করি!



    ওনার একটি আপারকাটে বিজিত প্রায় উড়ে গিয়ে একটি বন্ধ দরজার গায়ে আছড়ে পড়ল। কেশব খুশি, আমাদের প্রায় দমবন্ধ অবস্থা। সবাই চুপ করে আছি। উনি ছেলেটার কলার ধরে টেনে তুলে দাঁড় করালেন। তারপর ডান হাতে আর একটা পেল্লায় ঘুঁষি।

    এবার অংক মিলল না। বিজিত আমাদের জুনিয়র টিমের গোলকীপার, ওর অ্যান্টিসিপেশন দুর্দান্ত। ঠিক সময়ে ডাক করে বসে পড়েছে। ফলে কেশবের ফস্কানো ঘুঁষি সোজা গিয়ে লাগল দরজার লোহার কড়ায়।

    কাতরে উঠে কেশব মাটিতে বসে পড়েছেন, যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত।

    পরের দিন হাসপাতালে এক্স-রে করে দেখা গেল দুটো আঙুলে স্মলবোন ফ্র্যাকচার!

    বিজিতের সাসপেনশন ঠেকানো গেল না।


    পরীক্ষার দেড়মাস বাকি। রাত্তিরের টিউটোরিয়াল বন্ধ হল। শুধু সকালে চলবে। রাত্তিরে স্বাধ্যায়। আমরা খুশি। ব্ল্যাক-আউট বন্ধ হয়েছে, আমরা খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিতে পারছি।

    এদিকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর বাজার থেকে চাল-গম-চিনি উধাও, কেরোসিন উধাও। সরকারি রেশন ব্যবস্থায় পাওয়া যায় লালচে মোটা চাল। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্য অগ্নিমূল্য। জেলায় জেলায় কর্ডন, মানে এক জেলার চাল অন্য জেলায় যাবে না। আর রেশনেও চালের কোটা কমিয়ে গম নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। ঘরে ঘরে একবেলা রুটি খাওয়ার নতুন রেওয়াজ শুরু হল। আমরা আশ্রমে এর প্রভাব অতটা টের না পেলেও কিছু তো টের পেলাম, বিশেষ করে রুটি খাওয়ার ব্যাপারে।

    অধিকাংশ বাঙালি রুটি খেতেন জলখাবার হিসেবে—রুটিতরকারি, চিনি-রুটি, গুড়-রুটি আর চা দিয়ে রুটি।

    কিন্তু জোর করে রোজ রোজ একবেলা রুটি খেতে বাধ্য করা? নৈব নৈব চ! মনে হয় এর জন্যেই দু’বছর বাদে বঙ্গে সরকার বদলে গেল।

    আশ্রমের ক্লার্ক অচ্যুতদা, দশাসই চেহারা, একদিন কেঁদে ফেললেন। মহারাজ, অন্তত দু-হাতা ভাত দিতে বলুন। দুটো রুটি খেয়ে আমার পেট ভরে না।

    মহারাজদের মন গলেনি। বলা হল—দুটোয় পেট না ভরলে ছ’টা খাও, দশটা খাও। তাতে কোন মানা নেই। কিন্তু ভাত? তাও “শুধু একজনের জন্যে” ধম্মে সইবে না।

    শ্রীমান প্রদ্যুম্ন থুড়ি পোদোর কোন ভাবান্তর নেই। ও আগেও শখ করে একবেলা রুটি খেয়েছে। খারাপ লাগেনি। তারপর একটা বইয়ে পড়েছে যে পরিবর্তিত জলবায়ু বা পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারার জন্যেই বিশাল বিশাল ডাইনোসর, ম্যামথ সব পৃথিবীর বুক থেকে অবলুপ্ত হয়ে গেছে। কাজেই অভ্যাস বদলাতে হবে। অ্যাডাপ্ট করতে হবে, নইলে এই ধরার বুক থেকে মুছে যেতে হবে।

    কিন্তু আমার যে এই পৃথিবী থেকে মুছে যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই। বড় ভাল লাগে বেঁচে থাকতে। এখনও সেই বয়েস হয়নি যে দুবেলা ঠাকুরকে ডাকব—আমাকে ডেকে নাও, ভগবান। তোমার কোলে স্থান দাও। আমি যে আর পারছি না।

    অচ্যুতদাদের মত বাঙালিরা হয়ত মুছে যাবে, কিন্তু আমি টিঁকে থাকব।

    কিন্তু থাকবটা কোথায়? আশ্রমে তো থাকা হবে না। এটা মেনে নিতে সত্যি কষ্ট হচ্ছে। এই অচলায়তনে শুধু মহাপঞ্চক ও অদীনপুণ্যেরা আছেন এমন তো নয়। আছেন পঞ্চক, আছে অপাপবিদ্ধ বালকের দল।

    কিন্তু দাদাঠাকুর? তিনি কোথায়? তাঁকে কেন দেখতে পাই নে? তিনি সত্যি আছেন তো? নইলে কীসের ভরসায় আশ্রমে থাকা!

    না না; তিনিও আছেন বৈকি। কিন্তু আছেন নানারূপে। খণ্ড খণ্ড করে।

    তাঁকে কখনও দেখি গুরু অমিয়দার মধ্যে—সব সমস্যার মুশকিল আসান রূপে। কখনও বা অকুতোভয় রমেনের মধ্যে, যে নির্দোষ নিষ্পাপ বাচ্চাদের মধ্যে একটি শিকারী বাজ বা খট্টাসের মত ঘুরে বেড়ানো দুর্বৃত্তের অণ্ডকোষ টিপে ধরে মেসেজ দেয়—নো মোর!

    আছেন ভবদা, যিনি আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন কবিতার রহস্যময় জগতের সঙ্গে।

    আর বিপ্লব? ওকে কোন ছাঁচে ফেলব? ও এমন একজন, যাকে আমি চাই, রোজ দেখতে চাই, প্রতিমুহূর্তে কাছে পেতে চাই। কিন্তু আমি যে নিজেই সে রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছি। ওকে মেরেছি বিচ্ছিরিভাবে; লাথি মেরেছি--ছেলেদের যেখানে মারলে সবচেয়ে বেশি লাগে। এটা একেবারে ‘হোয়াট ইজ ডান্‌ কান্ট বি আন্‌ডান’ কেস। ওর সেই যন্ত্রণাকাতর অবাক চাউনি কি আমাকে আজীবন তাড়া করবে?

    না, সেই নখদর্পণে ঘড়ি চুরির অভিযোগ থেকে আমিই ওকে বাঁচিয়েছি, অযাচিতভাবে। কেন করলাম তা নিজের কাছেই স্পষ্ট নয়। আর এর পরে ও আমার দিকে এগিয়ে এসেছিল, বোধহয় চাইছিল মিটমাট করতে, আগের মতন হতে। আমি মাছি তাড়ানোর মত করে হাত নেড়ে ওসব শেষ করে দিয়েছি।

    কেন এমনি করলাম? জানি না, উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছি। কোথাও কি এই রিলেশনশিপে ভয় পাচ্ছিলাম? বা বুঝতে পারছিলাম না। ‘ইস্‌ প্যার কো, ক্যা নাম দুঁ?’

    তার চেয়ে দূরে সরে যাওয়াই ভাল। বাবা তো আসছেই পরীক্ষার পর আমাকে এখান থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে। আমাকে নাকতলা হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে বাড়িতে থেকে উচ্চ মাধ্যমিক দিতে হবে। ভালই হবে।

    কিন্তু বিশ্বস্তসূত্রে জেনেছি যে আমাদের স্বামীজিরাও বাবাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন--বাবার উচিত হবে আমাকে দিয়ে ক্ষমা চাওয়ানো এবং গার্জেনের তরফে একটি লিখিত প্রতিশ্রুতি দেওয়া যে তাঁর ছেলে এবার থেকে সিধে পথে হাঁটবে, কোন বাঁদরামি করবে না। নইলে আমাকে পত্রপাঠ টিসি ধরিয়ে এই আশ্রম এবং আশ্রমিক স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হবে।

    এই বিশ্বস্তসূত্রটি হল একদা মহারাজদের বিশ্বস্ত স্পাই মানস। ওর মধ্যে আশ্চর্য পরিবর্তন হয়েছে। সেই যে সেবার রাত্তিরে ভাঁড়ার ঘর থেকে কলা চুরির সময় প্রেমাংশু মাস্টার-কী দিয়ে মানসের তালা খুলে ওয়ার্ডেনের দরজায় লাগিয়ে ওনাকে নিজের ঘরে আটকে দিয়েছিল তখন মানস ওর তালা কী করে ওখানে গেল তার কোন সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেনি।

    ফলটা হয়েছিল নিদারুণ। কেশব মহারাজ ওকে নির্মমভাবে চাবকে ছিলেন। ও আর ওনাদের বিশ্বস্ত গুপ্তচর রইল না। ফলে ও ক্রমশ আগের সব কথা ভুলিয়ে আমাদের বিশ্বাসপাত্র হয়ে ওঠার করুণ চেষ্টা করতে লাগল।

    পরে জেনেছি যে শুধু বিজিতকে উসকিয়ে কেশব মহারাজকে কংকাল দেখানোই নয়, পড়ার সময় বিজলি লাইনে শর্ট সার্কিট থেকে বিভিন্ন মোটরে চিনি ঢেলে অকেজো করা—সবের পেছনে আসল নায়ক হচ্ছে মানস ও প্রেমাংশু।

    গুরু এবং প্রশান্তের আপত্তি সত্ত্বেও আমি মানসকে দলে টানার পক্ষপাতী; আমি হৃদয়-পরিবর্তনে বিশ্বাসী।

    বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হল। অংকে টেনেটুনে পাশ করে যাব। বাকিগুলো ভালই উতরে গেছে। হোস্টেল খালি হচ্ছে। গার্জিয়ানরা এসে ছেলেদের বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। গতকাল বিপ্লব চলে গেল। ওর দাদু ওকে নিতে এসেছিলেন। আমি সেসময়ে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে শুয়েছিলাম। একটা পায়ের শব্দ দরজার কাছে থেমেছিল, দুটো মৃদু টোকা। আমি চেঁচাই--কে ওখানে?

    কোন উত্তর নেই। আবার টোকা পড়ে। আমি উঠি না, দরজা খুলি না। পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে দূরে চলে যায়।

    দিনগুলো আর কাটতে চায় না। আমরা নিজেদের বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে নিয়ে তৈরি, কবে বাড়ি থেকে কেউ নিতে আসবে। এমন সময় প্রেমাংশু আমার ঘরে এল, সঙ্গে মানস।

    --চলে যাবার আগে আর একটা অপারেশন সিনেমা করলে কেমন হয়, পোদোদা?

    আমি চমকে উঠি, তারপর হেসে ফেলি। কিন্তু হবে কেমন করে? স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। মার্কশীট জমা হয়েছে মহারাজদের কাছে। বাড়ি যাওয়ার সময় গার্জেনদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সঙ্গে শুভকামনা—আসছে বছর আবার আসবেন!

    প্রেমাংশু বলে –কোন ঝামেলা হবে না দাদা। মানসদা হেব্বি আইডিয়া দিয়েছে। সন্ধ্যে বেলা প্রেয়ারের পর থেকে খাবার সময়টা পুরো খালি। এখন তো টিউটোরিয়াল নেই। আমরা ছ’টা-ন’টার ইভনিং শো দেখতে যাব। আলমবাজারের নিউ তরুণ হলে চলছে হিন্দি ফিল্ম ‘সাগাই’। দেখে চুপচাপ ফিরে আসব রাত ন’টার মধ্যে। আমাদের খাবার রুমমেটরা নিয়ে ঘরে ঢাকা দিয়ে রাখবে। খেয়েদেয়ে লেপের তলায়। স্বামীজিরা টের পাবেন না।

    আমি বিরক্ত মুখে বলি,--হলটা দু’ কিলোমিটার দূরে। যেতে আসতে কেউ দেখে ফেলতে পারে। আর সন্ধ্যে বেলা গেটে বিহারি দারোয়ান, বাইরে যাব কেমন করে?

    মানস হেসে ফেলে।

    --গেট দিয়ে বেরোব না, পাঁচিল টপকাবো।

    --কী ফালতু আইডিয়া! অত উঁচু পাঁচিল! আমরা কি বাঁদর?

    মানস প্রেমাংশুর দিকে তাকায় এবং ঠোঁট টিপে হাসে।

    --রেগে যাচ্ছ কেন পোদোদা? মানসদা খুঁজে পেয়েছে একটা জায়গা। লাইব্রেরির পাশে একটা নতুন ইউরিনাল হয়েছে না? যেখানে শুধু ডে-স্কলার ছেলেরা যায়? সেটার উপরে উঠলেই দেয়াল খুব কাছে। সেখান থেকে পাশের গলিতে লাফিয়ে পড়লেই হল। সন্ধ্যের সময় অন্ধকার, কেউ খেয়াল করবে না। আজ বিকেলে তুমি আর আমি গিয়ে ওই জায়গাটা, ওর হাইট দেখে আসব’খন।

    --আচ্ছা? তারপর ঘুরে বড় রাস্তায় উঠে সেই আশ্রমের মেন গেটের সামনে দিয়েই যেতে হবে তো! সামনে জয়শ্রী সিনেমা হল, ভিড় থাকবে। ওরা দেখে ফেলবে না? ভাল বুদ্ধি করেছিস।

    --আরে, দারোয়ানের মুখ তো রাস্তার দিকে নয়, আশ্রমের ভেতরের দিকে। আর শীতের সন্ধ্যায় আমরা আলোয়ানে মাথা ঢেকে পেরিয়ে যাব, কেউ চিনতে পারবে না।

    ঠিক পরের দিন সন্ধ্যে। উত্তেজনায় সান্ধ্য আরত্রিকের গানে মন লাগেনি। বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ করছে। প্রেয়ারের পর সবাই যার যার কামরার দিকে হাঁটতে শুরু করলে আমরা তিনজন পিছিয়ে পড়ি। আলোয়ানে মুখ ঢেকে লাইব্রেরির পাশের ইউরিনালের পাশে দাঁড়াই। কেউ আমাদের খেয়াল করেনি।

    সবার আগে আমি পাঁচিলে উঠে ওদিকে লাফিয়ে পড়ে হাঁটতে থাকব, তারপর প্রেমাংশু, শেষে মানস।

    নাঃ, ইউরিনালের দেয়ালে ওঠার পর পাঁচিল আর তেমন উঁচু নয়। লাফিয়ে পড়ি, গলিতে লোকজন কম। তবু কেউ হেসে ওঠে, দ্যাখ দ্যাখ! কোন কথায় কান না দিয়ে সোজা দ্রুত পায়ে হাঁটি। বড়রাস্তায় উঠে ডানদিকের আশ্রমের লোহার গেট চোখে পড়ে-- অন্ধকার মতন।

    একটু এগিয়ে গিয়ে খেয়াল করি—হ্যাঁ, সবুজ আলোয়ান মুড়ি দিয়ে প্রেমাংশু আসছে, কিন্তু মানস কোথায়? প্রেমাংশু কাছে এসে বলে পেছনে আসছে।

    নিউ তরুণ সিনেমায় গিয়ে ৪০ পয়সার কারেন্ট টিকিটের লাইনে দাঁড়াই, আমরা দু’জন। মনের মধ্যে একটা অসোয়াস্তি, মানস কোথায়? ও কি পাঁচিল টপকাতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল? প্রায় কাউন্টারের কাছে পৌঁছে গেছি তখন ওই অসোয়াস্তি বেড়ে গিয়ে মাথার ভেতর বিপদসংকেত বেজে উঠল। আমি লাইন থেকে বেরিয়ে এলাম।

    প্রেমাংশু অবাক, কী হল? পকেটে পয়সা নেই?

    --শোন, এক্ষুনি এখান থেকে চল। আমাদের কেটে পড়তে হবে।

    --সেকী, কেন?

    --উই হ্যাভ বীন কমপ্রোমাইজড।একটু পরেই আশ্রমের স্টাফ এসে এখানে আমাদের হাতে নাতে ধরে ফেলবে। মানস আমাদের প্ল্যান করে ফাঁসিয়েছে। শালা রেনেগেড, ওকে বিশ্বাস করাই ভুল হয়েছিল।

    আমার মধ্যে কি গুরুর আত্মা প্রবেশ করেছে? এত ইংরেজি ঝাড়ছি কেন?

    --কোথাও ভুল করছ পোদোদা। ও এরকম ছেলে নয়।

    --আমি কোন চান্স নেব না। শীগগির ফিরে চল।

    --কোথায়? আশ্রমে? তোমার কথা সত্যি হলে তো ওরা ক্যাচ লোফার জন্যে রেডি তৈরি হয়েই আছে।

    --না, আমাদের মাইন্ড গেমে জিততে হবে। আমরা যাব যেখানে ওরা আমাদের লীস্ট এক্সপেক্ট করবে—ঠিক আশ্রমের নাকের ডগায় জয়শ্রী হলে।

    --এঃ, ওখানে বাংলা বই চলছে—‘একটুকু ছোঁয়া লাগে’, বিশ্বজিৎ-আজরা-কিশোর কুমার। ওই ন্যাকা সিনেমা দেখবে?

    --ধেত্তেরি! এখন আমাদের শিরে সংক্রান্তি! না তাগা বাঁধবে কোথায়? শোন, আমরা এখন আশ্রমের গেটের উল্টোদিকে গিয়ে টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকে পড়ে আরামসে সিনেমাটা দেখতে দেখতে পরের স্টেপ ভাবব।

    হলের মধ্যে অন্ধকারের রূপালি পর্দার গল্পের মায়ায় খানিকক্ষণ বিপদসংকেত বাজে না। হেমন্তের গলায় ‘প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়’ আর কিশোরকুমারের পিয়ানো বাজিয়ে ‘একটুকু ছোঁয়া লাগে’ মনে স্থায়ী ছাপ ফেলে গেল।

    ইন্টারভ্যালে প্রেমাংশু ধোঁয়া খেতে বাইরে যেতে চায়, আমি বাধা দিই। বলি, এতক্ষণে ওরা হয়ত এটা আন্দাজ করেছে যে আমরা এই সিনেমা হলেও থাকতে পারি।

    সিনেমা শেষ। এবার হল থেকে বেরোনোর পালা, ভিড়ের ঠেলাঠেলি। আমি ভাবি-- তাড়াহুড়ো করে গোড়ায় বেরোলে বিপদ। মেন গেটের সামনে নিঘ্‌ঘাৎ ক্লোজ ফিল্ডিং সাজানো রয়েছে। একদম শেষে হাতে গোনা ক’জনের সঙ্গে হলে ধরাপড়ার সম্ভাবনা আরও বেশি।

    আমাদের আলোয়ানের রং তো কেউ চিনে রাখেনি। কাজেই বেরোলাম মাঝামাঝি সময়ে, যখন ওয়াচ করতে করতে ওরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। প্রেমাংশুকে বললাম—জাস্ট আমাকে ফলো কর।

    আমি জানি, আমার ভেতরে এখন গুরু অমিয়দার আত্মা বিরাজমান। জয় গুরু!

    বাইরে বেরোতেই চোখে পড়ল উলটো ফুটপাথে আশ্রমের মেনগেটে সারিবন্দী কালো কালো ছায়া। সেরেছে, কী করি? জয় গুরু।

    আমি এদিকের ফুটপাথ ধরে উলটো মুখে হাঁটতে শুরু করলাম। যা থাকে কপালে! একটু এগোতেই দেখলাম উল্টোদিকে আশ্রমের পাঁচিলের গা-ঘেঁষে একটা মিউনিসিপ্যালিটির ময়লা ফেলার পাকা চৌবাচ্চা মত।

    প্রেমাংশুকে ‘আয়’ বলে রাস্তা পেরিয়ে চৌবাচ্চার পাড়ে উঠে ফের পাঁচিল এবং ভেতর দিকে লাফ। তারপর পাঁচিলের গা ঘেঁষে আলো-আঁধারিতে স্কুল বিল্ডিঙয়ের ল্যাবের পেছনে। ভাঙা টেস্টটিউব আর বীকারের কাঁচ মাড়িয়ে মজা পুকুরের পাড় ধরে সোজা আমাদের আবাসিক ভবনের পেছনে কলতলায়।

    প্রথম কামরায় থাকেন ক্লাস ইলেভেনের শিবুদা, কারও সাতে-পাঁচে নেই, তবে আমাকে খুব ভালবাসেন। জানলায় টোকা দিতেই খুলে গেল, শিবুদার উদ্বিগ্ন মুখ। ফিসফিসিয়ে বললেন—মানস চুকলি করেছে। খাবার হলে রোল কল হল, গোটা হোস্টেলে শুধু তোমরা দু’জন অ্যাবসেন্ট। ঘরে এসে ছোট মহারাজ অনিলদা আর ওয়ার্ডেন রণজিৎদা মশারি তুলে চেক করলেন—লেপের ভেতরে কেউ নেই! তোমরা দুজন মানসের তালা খুলে ওয়ার্ডেনের ঘরের দরজায় লাগিয়ে দিয়ে ওকে বেত খাইয়েছিলে! আজ সেটার প্রতিশোধ নিল।

    আমি ভাবছি, এখন কী করা উচিত? বাথরুমের দিকে এগোতেই দোতলার অন্ধকার থেকে একটা টর্চের আলো সোজা আমার মুখের উপর।

    --প্রদ্যুম্ন, পালাবার চেষ্টা করে লাভ নেই। আমি নীচে আসছি।

    ওয়ার্ডেন রণজিৎদা! দোতলার কোন ঘরে অন্ধকারে আমাদের অপেক্ষায় ঘাপটি মেরে ছিলেন। কী সর্বনাশ! উনিও কি ওঁর বিছানায় পায়খানার অ্যাসিড ফেলার বদলা নিতে চান?

    ১২

    উপসংহার

    সে রাত্তিরটা ভোলা কঠিন।

    কখন বারোটা বেজে গেছে, কিন্তু স্বামীজিদের বিবেকানন্দ আবাসে তিনজন মহারাজই জেগে রয়েছেন। আমাদের দু’জনকে আলাদা আলাদা করে জেরা করা হয়েছে। আগে ডাকা হয়েছিল প্রেমাংশুকে।

    আমি প্রেমাংশুকে বলে দিয়েছিলাম—আমাদের কেউ সিনেমা হলে দেখতে পায়নি, হাতেনাতে ধরেনি। বাকি সব অন্যের চুগলি নির্ভর। কিছুতেই স্বীকার করবি না যে আমরা সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম।

    --কিন্তু ওরা যে ডাইনিং হলে রোল কল করেছিল, আমাদের ঘরে গিয়ে মশারি তুলে দেখেছিল!

    --তাতে কী হয়েছে? সত্যি কথা, আমরা খাবার সময় ডাইনিং হলে বা নিজেদের ঘরে ছিলাম না, কোথায় ছিলাম কেউ জানে না। তার মানে কি সিনেমা হলেই গিয়েছিলাম?

    --বেশ, তাহলে কোথায় ছিলাম?

    --আমরা ছিলাম স্কুল বিল্ডিংএর ছাদে। কেউ বলুক যে ছিলাম না! ওরা কি স্কুলের ছাদে চেক করেছিল? সিনেমা হলে তো কেউ আমাদের দেখেনি।

    --আচ্ছা, তাহলে আমরা খেতে যাইনি কেন? আর রাত্তিরে স্কুলের ছাদে গিয়ে কী করছিলাম?

    --আমরা বাড়ি ফিরে যাব, হোস্টেল ছেড়ে দেব। দুজনে ছাদে বসে ফিউচার প্ল্যানিং করছিলাম, সেটা কি অপরাধ না অস্বাভাবিক? আর আজ আমাদের খিদে মরে গেছল, ব্যস্‌।

    --তাহলে আমরা কেউই স্বীকার করব না যে পাঁচিল টপকে সিনেমা দেখতে গেছলাম?

    --প্রশ্নই ওঠে না। কোশ্চেন ডাজ নট অ্যারাইজ। ওরা কেউ আমাদের হলে দেখেনি, স্কুলের ছাদে গিয়ে দেখেনি। কাজেই আমরা যা বলব সেটাই ট্রুথ।

    খানিকক্ষণ পরে প্রেমাংশু এল, একটু অসহজ, একটু থতমত খাওয়া ভাবভঙ্গি।

    বলল ওকে বড় দুই মহারাজ খুব গ্রিল করেছে, জানতে চেয়েছে গেট পেরোলাম কী করে? দারোয়ানকে পয়সা দিয়ে, নাকি পাঁচিল টপকে?

    ছোট মহারাজ অনিলদা জানতে চেয়েছিলেন কার গান বেশি ভাল লেগেছে? কিশোরকুমার নাকি হেমন্ত?

    --আমি কিচ্ছু স্বীকার করিনি পোদোদা, শুধু ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে, পরে হাউমাউ করে কেঁদেছি। কোথায় ছিলাম তাও বলিনি। শেষে যেই বলেছি—আমার কী হবে মহারাজ? অমনি কেশব মহারাজ বললেন—এই প্রশ্নটা তোমার গুরু প্রদ্যুম্নকে জিজ্ঞেস করো গে।

    এরপর আমার পালা।

    পায়ে পায়ে গিয়ে স্বামীজিদের সামনে দাঁড়াই, কোন কথা বলি না। বড় ও মেজো মহারাজ দুটো চেয়ারে বসে, কিন্তু ছোট মহারাজ অনিলদা দাঁড়িয়ে। উনি কি কোনদিন বড় হবেন না?

    কেশব মহারাজ আমাকে সাদর অভ্যর্থনা করলেনঃ

    --এই যে, এস এস। একে আর কী বলব? দেখ, মাথা নীচু করে দু’হাত জড়ো করে কেমন দাঁড়িয়ে আছে, যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না। গুড বয়! লাইক এ গুড বয়!

    এ আশ্রমের ভাল চায়! সারাক্ষণ কোথাও কোন বেচাল দেখলে এসে নালিশ করে—মহারাজ এই হয়েছে, মহারাজ ওই হয়েছে। ওতে আশ্রমের সুনাম চলে যাবে, একটা বিহিত করুন।

    বাঃ, এখন সেই ভাল ছেলেটি রাত্তিরে পাঁচিল টপকে নাইট শোতে সিনেমা দেখতে গেছিলেন। শুধু যে নিজে বখেছেন তাই নয়, একটি জুনিয়র ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন, ওকেও বখামিতে দীক্ষা দিয়েছেন।

    --না মহারাজ!

    --মানে?

    --সিনেমা দেখতে যাইনি তো। স্কুল বিল্ডিঙয়ের দোতলার ছাদে আমি আর প্রেমাংশু কথা বলছিলাম।

    --খাওয়ার সময় চলে গেলেও? কী সেই প্রাণের কথা?

    --মহারাজ, আমরা দুজনেই ইন্ডাস্ট্রিয়াল শহরের ছেলে। ওর বাবা আসানসোল, আমি ভিলাই। আমরা আগামী বছর হোস্টেল ছেড়ে অন্য স্কুলে যাব, নিজেদের শহরে। ভাল করে পড়াশুনো করব, এই সব।

    --আচ্ছা! ভাল করে পড়াশুনো? আশ্রমের নামকরা স্কুলে পোষাল না, অন্য স্কুলে? ক্লাস ইলেভেনে? শুনলেন আপনি, বড় মহারাজ!

    --হুঁ; বেড়াল বলে মাছ খাব না, কাশী যাব?

    --শোন, আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি—তুমি উচ্চমাধ্যমিকের বেড়া ডিঙোতে পারবে না। এখান থেকে রাস্টিকেট হবে, কোথাও ভর্তি হতে পারবে না। শেষে কোলকাতার পথে পথে পকেট মেরে উঞ্ছবৃত্তি করে পেট চালাবে।

    --না, মহারাজ।

    --বিশ্বাস হচ্ছে না? পাঁচ বছর পরে আমার কথা মিলিয়ে নিও।

    --হ্যাঁ মহারাজ।

    --দুত্তোর নিকুচি করেছে তোর ‘হ্যাঁ মহারাজ’ আর ‘না মহারাজের’। দূর হ’ আমার চোখের সামনে থেকে।

    বড় মহারাজ বললেন—তোকে আর কী শাস্তি দেব? পরীক্ষা হয়ে গেছে, যেদিন গার্জেন নিতে আসবে সেদিন তোর কীর্তিকাহিনী বলে হাতে টিসি ধরিয়ে দেব। তদ্দিন আমাদের আশ্রমের অন্নধ্বংস কর।

    --হ্যাঁ মহারাজ।

    পরের দিন। দুপুরের খাওয়ার ঘন্টার আগেই গুরু অমিয়দা এবং প্রশান্তের বাড়ি থেকে লোক এল, বিছানা বাঁধা আর ট্রাঙ্ক গোছানো চটপট হয়ে গেল। যাবার আগে আমরা সবাই একে অন্যকে জড়িয়ে ধরলাম, ঠিকানা নিলাম। কিন্তু, জানি যে হয়ত আর দেখা হবে না।

    গুহ্যপক্ক পোদো কোথাও পাঠ করিয়াছিল যে এক নদীতে দ্বিতীয়বার অবগাহন সম্ভব নহে। ঘড়ির কাঁটা জোর করিয়া পিছনপানে ঘোরানো যায় না।

    গুরু অমিয়দা আগামী মার্চ মাসে বাড়ি থেকে এসে হায়ার সেকেন্ডারি দেবে, তারপর কলেজ। আমি টিসি পাচ্ছি, তায় ‘হোমোসেক্সুয়ালিটি’ হয় জেনে বাবা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে আমাকে আর কোন হোস্টেলে দেবেন না। বিপ্লবও আশ্রম এবং স্কুল ছেড়ে দেবে। রইল প্রশান্ত, নিখিলেশ ও বিশু।

    কীর্তনিয়া পরিবারের ছেলে বিশু বড্ড সেন্টিমেন্টাল। বলল—দূর, তোমরা সবাই চলে যাচ্ছ-- আমিও থাকব না।

    গুরু বলল—দূর পাগলা! লাইফ ইজ লাইক দ্যাট। কেউ কারও জন্যে বসে থাকে না, এগিয়ে যাওয়াই নিয়তি। একটা ভাল দেখে চার লাইন কীর্তন শোনা দেখি।

    --পদকর্তা জ্ঞান দাসের একটা শোনাই?

    --বেশ, আমাদের মত অজ্ঞান দাসের তাই সই।

    বিশু গলা খাঁকরে একটু গুনগুন করে সুরু করলঃ

    সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু অনলে পুড়িয়া গেল,
    অমিয় সাগরে সিনান করিতে সকলি গরল ভেল।
    সখী, কী মোর করমে লেখি!
    শীতল বলিয়া ও চাঁদে সেবিনু ভানুর উদয় দেখি।
    ওর গলা ধরে গেল, আর গাইতে পারল না।

    আমার রাগ হয়ে গেল। এসময় আর গান খুঁজে পেল না? ভোঁদাই কোথাকার! রমেন একটা হিন্দি গান শোনাক দেখি। কোন মনখারাপের গান হলে চলবে না।

    --আচ্ছা, প্যারডি শোনাই? শাম্মী কাপুরের হিট ‘জংলী’ ফিল্মের গানের?

    আমরা মহা উৎসাহে মাথা নেড়ে সায় দিই।

    --ইয়াহু! দাদা ধরে দিল যে এক জংলি মেয়ে,
    দিয়ে দিল তার সাথে আমার বিয়ে,
    আজ বিশ বছর ধরে সংসার করেও সুখ পেলাম না।

    পোড়ে রান্না, ধরে কান্না,
    সারাদিন কিছু খায় না।
    আমার মাংস, করে ধ্বংস,
    বলে স্বামীর কাছে থাকব না।

    ভাই রে, বল না,
    সত্যি কি থাকবে না?
    আশ্রমে আমার অদ্যই শেষ রজনী। আশ্রম প্রায় খালি। রাত্তিরে খাওয়ার সময় ডাইনিং হলে দু’শোর জায়গায় পঞ্চাশ জনের পাত পড়েছে। মাছের সাইজ যেন একটু বড়, নাকি আমারই মনের ভুল। খাওয়া শুরুর আগে সবাইকে চমকে দিয়ে জোর গলায় সুর করে বলে উঠিঃ
    ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্মহবির্ব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মণাহুতম্‌,
    ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্রহ্মকর্ম সমাধিনা।।
    হরি ওঁ তৎ সৎ।।
    পরের দিন। বিকেলে আমাকে নিতে ন’কাকা আসবে, মহারাজ টিসি দেবেন, সে না হয় দেখা যাবে। আমি নিজেই তো হোস্টেল ছেড়ে দিচ্ছি। নাকতলায় নতুন স্কুলে ডে-স্কলার হব।

    ভাল করে সাবান মেখে স্নান করলাম। পুকুরপাড়ে বেড়িয়ে এলাম। তারপর বেডিং, বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে সাজগোজ শুরু। নাকতলার ছেলেমেয়েগুলোকে ইম্প্রেস করতে হবে না!

    বাবার দেওয়া মাখন জিনের সাদা প্যান্ট, বাইশ ইঞ্চি ঘেরের। স্থানীয় টেলরিং শপ থেকে সেটা কাটিয়ে সাড়ে চোদ্দ ইঞ্চি করেছি, তাতে আবার খানিকটা চেন লাগানো। একটা ফুলহাতা শার্টের উপর রংচঙে সোয়েটার। ‘বিশ সাল বাদ’ সিনেমায় বিশ্বজিৎ যেমন পরেছিল। স্বামী বিবেকানন্দের স্টাইলে মাঝখানে সিঁথি কেটে ঢেউতোলা বাবরি চুল। আয়নায় নিজেকে ভাল করে দেখলাম।

    নাঃ; গুরু অমিয়দার কথা মেনে হামাম সাবান মেখে চান করেছি বটে, কিন্তু গায়ের রং সেই আলকাতরার মত রয়ে গেছে। এক পোঁচও ফিকে হয়নি।

    অবশেষে অফিস থেকে খবর এল, প্রদ্যুম্নের বাড়ি থেকে নিতে এসেছে। হাসি হাসি মুখে মালপত্র নিয়ে অফিসে হাজির হলাম। ঐ তো, অফিসের বাইরে একটা অ্যাম্বাসাডার ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। সর্দারজী ড্রাইভারকে বলতেই হেসে হাত নাড়ল। তারপর মালপত্র ডিকিতে তুলতে লাগল। আমি অফিসের ভেতরে গেলাম।



    একী! বিশ হাজার ভোল্টের শক। ন’কাকা আসেননি। ট্যাক্সি নিয়ে আমাকে নিতে এসেছেন আমার বাবা-মা। ওঁদের চেহারায় আষাঢ়ের মেঘ ঘনিয়েছে। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন না। বাবা গম্ভীর মুখে খসখসিয়ে টিসির দরখাস্ত লিখতে লাগলেন।

    অনিল মহারাজ বললেন— টিসি চাইছেন কেন? ও ছাত্র ভাল, কুসঙ্গে থেকে একটু ভুল করে ফেলেছে। সিনেমা-টিনেমা দেখেছে। অনশন করেছে। একবার ক্ষমা চাইলে আমরা ছেড়ে দেব।

    বাবা উদারার মধ্যমে বললেন—না, ও ক্ষমা চাইবে না। ট্রান্সফার সার্টিফিকেট দিয়ে দিন।

    গাড়ি রওনা দিল। গেট খুলে দিয়ে দারোয়ান হাসিমুখে হাত কচলে বখশিস চাইল। বাবা ধমকে উঠলেন। বেচারা হতভম্ব, ছুটিতে বাড়ি যাবার সময় সবাই ওকে বখশিস দেয় যে! বাবা এর আগে দিয়েছেন তো।

    নিজের রূঢ়তায় লজ্জা পেয়ে বাবা মাকে বললেন—বখশিস চাইবে না কেন? রাত্তিরে গেটের তালা খুলে দেয় যে।

    বলতে পারলাম না—কথাটা সত্যি নয়। বলতে পারলাম না যে পাঁচিল টপকানোর অনেক ক্রিয়েটিভ কায়দায় আমি পারঙ্গম।

    বরানগর গোপাললাল ঠাকুর রোডের আশ্রম থেকে পার্কসার্কাস ধাঙড় বাজারের সামনে সার্কাস মার্কেট প্লেস, দু’ঘন্টার যাত্রা। ডিসেম্বরের সন্ধ্যের দিকের উনুনের ধোঁয়া ও কুয়াশা। ঘোর শীত, অন্ধকার গাঢ়। আমি ঘুমে ঢুলতে থাকি, স্বপ্নে শুনতে পাই সন্ধ্যে বেলার আরত্রিক—“খণ্ডন- ভববন্ধন -জগবন্দন বন্দি তোমায়”।

    বাবা ঠেলা মেরে জাগিয়ে দেন, বিরক্ত মুখে বলেন—জোয়ান ছেলে, অবেলায় ঢুলছ কেন? সোজা হয়ে বস।

    বাড়ি এসে গেল।

    দাদু-ঠাকুমা, কাকু-কাকিমা হৈ হৈ করে অভ্যর্থনা; আইসে, আইসে। আইয়া পড়সে। দোতলায় উঠে ট্রাঙ্ক হোল্ড অল, সব বাইরের ঘরে নামিয়ে রাখলাম। জুতো-জামা ছাড়ার পর বাবা ডাকলেন।

    --শোন, তোমার পেছনে পাঁচ বছর যে টাকা খরচ করেছি সেটা ভস্মে ঘি ঢালা হয়েছে। তুমি আশ্রম থেকে এসেছ টেরিকাটা বাবরি চুলে যাত্রাপার্টির ললিতা সখী হয়ে। বাট ইউ আর দ্য সন অফ এ সোলজার। ডোন্ট য়ু ফরগেট দ্যাট।

    দাঁতে দাঁত পিষে বললেন—চোরের মতন হোস্টেল পালিয়ে সিনেমা দেখা! ছিঃ! আমার একটা থাপ্পড় নেবার মত ক্ষমতা তোর রোগাপ্যাটকা শরীরে নেই, নইলে-- ।

    এই প্রথম আমি আমার রোগাটে চেহারার জন্যে গর্বিত হলাম। কিন্তু সেই সুখ বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। উনি বললেন যে ন’কাকা নতুন স্কুলের ফর্ম এনেছেন। সাতদিন পরে অ্যাডমিশন টেস্ট। কাজেই ঠেসে প্রিপারেশন করতে হবে। ইংরেজি আর অংক। টাইমপিস ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে ভোর চারটেয় উঠে পড়তে বস। রাত দশটায় লাইট অফ্‌। কাকিমারা খেতে ডাকলে যাবে। দুপুরে একঘন্টা বিশ্রাম। বিকেলে আধঘন্টা ছাদে গিয়ে পায়চারি, ব্যাস।

    এই ক’দিন ফুটপাথে ক্রিকেট খেলা বা পার্কসার্কাস পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া ভুলে যাও।

    ছ’দিন কেটে গেল। কাল সকালে পরীক্ষা দিতে নতুন স্কুলে যাব। ন’কাকা ভরসা দিচ্ছেন—তুই ঠিক পারবি, ঘাবড়াস না।

    বিকেলের দিকে বাবা বাইরের ঘরে চেয়ারে বসে আমার তিন কাকার সঙ্গে চা খাচ্ছিলেন, কিন্তু একটু পরেই ভারত-পাকিস্তান, চীন-রাশিয়া, আমেরিকা-ভিয়েতনাম এইসব কঠিন কঠিন রাজনীতির তর্কে মেতে উঠলেন।

    এমন সময় ডাকপিওন এসে একটা বন্ধ ইনল্যান্ড লেটার বাবার হাতে দিয়ে গেল। আমার নামে চিঠি এসেছে টাটানগর থেকে। বাবা ভুরু কুঁচকে ঠিকানা পড়ছেন। কিন্তু প্রদ্যুম্নের পাশে ব্র্যাকেটে লাকি লেখা কেন? আর পাঠিয়েছে কোন বিপ্লব (মিতা)।

    --এসব কী? তুমি লাকি? আর মিতা কোন ব্যাটাছেলের নাম হয়?

    --না, মানে আশ্রমে সবাই বলত আমার লাক্‌ খুব ভাল। পরীক্ষায় খুব কমন প্রশ্ন পাই, তাই নাম লাকি। আর বিপ্লব আমার আশ্রমের বন্ধু। মিতা ওর বাড়ি থেকে দেওয়া ডাকনাম।

    --শোন, আমি কক্ষনো অন্যের চিঠি খুলে পড়ি না, নিজের ছেলেরটাও না। কিন্তু— এই চিঠি তুমিও পড়বে না। আশ্রমের বন্ধুদের ভুলে যাও। পেছনের ব্রিজ পুড়িয়ে ফেলে এগিয়ে যাও, নতুন জীবন শুরু কর।

    বন্ধ চিঠিটা উনি কুচিকুচি করে ছিঁড়ে হাওয়ায় উড়িয়ে দিলেন।

    আজও ভাবি, কী লিখেছিল বিপ্লব?

    হ্যাঁ, স্বপ্নে মিতা আসে, লাকির সঙ্গে কত গল্প করে। প্রথমেই বলে—কী রে লাকি, তোর খবর কী?

    আমি সত্যিই লাকি, কারণ আমার স্বপ্ন রয়েছে। দুর্ভাগা সে, যার কোন স্বপ্নই নেই।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • প্রচ্ছদ | পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০ | পর্ব ১১ | পর্ব ১২ | পর্ব ১৩ | পর্ব ১৪ | পর্ব ১৫ | পর্ব ১৬ | ১৭ | পর্ব ১৮ | পর্ব ১৯ | পর্ব ২০ | "২১" | পর্ব ২২ | পর্ব ২৩ | শেষ পর্ব
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments