রন আশা করেনি পৌনে সাতটার মধ্যে তৃণা রেডি হয়ে থাকতে পারবে। সেজন্যে দশ মিনিট দেরি করেই বাড়ি থেকে বেরোলো। এমনিতে প্রত্যেক সপ্তাহে সাতটায় বেরোয়। সল্টলেক থেকে রাজপুর পৌঁছোতে আধ ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিটের বেশি লাগে না। আজ গলফগ্রীন থেকে তৃণাকে তুলে নিয়ে যেতে হবে। বেরোনোর সময় শর্মিলা দিব্যেন্দুর কান বাঁচিয়ে আস্তে করে বলে দিয়েছিল, ওকে বলে দিস কথাবার্তা যেন একটু ফিল্টার করে বলে।
পাশ থেকে দিব্যেন্দু বললো, তোর মা কী মন্ত্র দিচ্ছে রে রন?
— বলছে, হ্যান্ডল উইথ কেয়ার।
— তৃণাকে?
রন একটু হাসলো। কোনো উত্তর না দিয়ে শর্মিলার হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো।
— কী আছে এতে?
— মায়ের নি-ক্যাপ,আর পৌলমীর জন্যে একটা শাড়ি।
— বৌদির বোধ হয় কয়েক লক্ষ শাড়ি আছে। তার ওপর আবারও?
— তোর বউ-এরও দশ আলমারি ভর্তি শাড়ি থাকবে, আক্ষেপ করিস না।
— আমার বউ, আর তার আলমারি ভর্তি শাড়ি! এতদিনে এই বুঝলে?
শর্মিলা আর কথা বাড়ালো না। রন বেরিয়ে যাওয়ার পর আপনমনে বললো, কে জানে বাড়িতে গিয়ে মহারানী আবার কী উলটো পালটা কান্ড করে বসেন।
দিব্যেন্দু খবরের কাগজ পড়ছিল, চোখ না তুলেই বললো,
— অহেতুক ভাবছো। শি ইজ কোয়াইট ইন্টেলিজেন্ট। প্রবলেম শুধু তোমার আমার মতো মনের কথা লুকিয়ে রাখতে পারে না এই যা। এটাকে দোষ ভাবলে দোষ, গুণ ভাবলে গুণ।
— সেদিন আমাকে কী বললো জানো?
— কী?
— কাকিমা তুমি চুলে ডাই করো কেন? বয়েসটাকে ওয়েলকাম করো। সব বয়েসকেই এনজয় করতে হইয়। চুলে এক আঢটু রূপোলি রেখা থাকলে এলিগেন্ট লাগে।
দিব্যেন্দু হো হো করে হাসলো,
— তুমি কী উত্তর দিলে?
— এর কি কোনো উত্তর হয়? একটু অপ্রস্তুত হয়ে অন্য প্রসঙ্গ তুললাম।
— তা রন হঠাৎ ওকে বাড়িতে নিয়ে গেল কেন?
— অনেকদিন থেকেই নাকি যেতে চাইছিল। রন তো সারাক্ষণ বাড়ির গল্প বলে। তৃণা আমাদের বাড়ির গল্প শুনতে খুব নাকি ভালোও বাসে। আমার কাছেও মাঝে মাঝে এটা সেটা জানতে চায়। আমি একবার তাই ওকে নিয়ে যেতে বলেছিলাম। জানো আমারও আজ ওদের সঙ্গে যেতে খুব ইচ্ছে করছিল।
— বাড়ির লোকের মতামত যাচাই করার জন্যে?
— বাড়ির লোকের মতামতকে থোড়াই কেয়ার করে তোমার ছেলে। রূপুর পছন্দ হলেই হলো।
— ওকে ভালো লাগবে রূপুর। এখন যদিও অনেক পালটে গেছে, কিন্তু তৃণার বয়েসে রূপুও ওরকম সহজভাবে কঠিন সত্যি কথাগুলো বলতো।
গাড়ির হর্ন শুনে গেট খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো তৃণা। রন বিস্ময়ে খানিকটা হতবাক। প্রায় হাঁ করে তাকিয়ে থাকলো।
ক্যামেরার ঝোলা, নিজের ব্যাগ ছাড়াও একটা বড় প্যাকেট হাতে নিয়ে গাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তৃণা। রন দরজা খুলছে না। এ যেন জন্মান্তরে অন্য কেউ। ছোটবেলায় রাঙাদিদার কাছে বহুবার শোনা, সেই সাপের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসা রাজপুত্তুরের রূপকথার মতো। এত সুন্দর সাজে কখনো দেখেনি ও তৃণাকে। হঠাৎ করে রূপাঞ্জনার কথা মনে পড়ে গেল। কলেজে পড়ার সময়, এমন ভাবে সাজতো দেখলেই ভালো লাগতো। এখনো দিদিভাই সেজেগুজে যখন কোথাও যায়, দেখে বলতে ইচ্ছে করে, বাহ। খুব সিম্পল, রুচিসম্মত। তাকালেই চোখ জুড়িয়ে যায়।
আজ তৃণাকে দেখে ও মনে মনে বললো, বাহ। একটা অফ হোয়াইট তাঁটের শাড়ি পরেছে তৃণা। হলুদ আর কালো মেশানো পাড়, সারা গায়ে হলুদ আর কলো বুটি। কনুই পর্যন্ত লম্বা হাতার হলুদ ব্লাউজ। চুলটা খোলা। কপালে একটা ছোট কালো টিপের নিচে আরো একটা ছোট হলুদ ফুটকি। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আগে ভেতরের আবেগ লুকিয়ে রন বললো,
— তোর হঠাৎ বুদ্ধিভ্রম হলো কেন?
— শাড়ির কথা বলছিস? কেন যেন খুব ইচ্ছে হলো। খুব বোকা বোকা লাগছে না রে?
— ঠিক বলেছিস একদম হাঁদারামের মা লাগছে।
বলেই চারদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে একটা গভীর চুমু খেলো রন। তৃণা বাধা দিল না। শুধু রন ওকে ছেড়ে দেওয়ার পর বললো, যাহ লিপস্টিকটা আর তোদের বাড়ি অব্দি পৌঁছোলো না।
রন প্রথমে বুঝতে না পেরে বোকার মতো তৃণার মুখের দিকে তাকালো। তারপর ওর ভেজা ঠোঁটের দিকে চোখ পড়তেই নিজের ঠোঁটটা মুছে নিয়ে বললো, ব্যাগে নিসনি লিপস্টিক?
তৃণা অদ্ভুত মুখ করে হাসলো, ব্যাগে লিপস্টিক বয়ে বেড়াতে হলে আমি গেছি বস। মানে ব্যাগটা ভারি হয়ে যাবে।
তৃণাকে বড্ড নমনীয় লাগছে আজ। রনর কাছে গল্প শুনে কেন যেন ওই বাড়িটা বড্ড টানে ওকে। একটা টোটাল পরিবার। অদ্ভত মায়াময় একটা পারিবারিক বন্ধন, যা ও স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি কখনো। রন শুনলে হয়তো কিছু মনে করবে, কিন্তু রনর বাবা মায়ের চেয়েও ওই বাড়ির প্রতিটা মানুষকে ওর খুব আপন মনে হয়। রনরও তো মন পাড়ে থাকে ওখানে, তৃণা জানে।রনর আসল পরিবার যেন ওখানে।
রন গল্প করেছে — ছোটবেলায় যখন ওরা সল্টলেকে দাদুর বাড়িতে চলে এসেছিল, রনর একটুও ভালো লাগেনি। মা-বাবার ওপর রাগ হতো খুব। ওর যারা প্রিয় মানুষ তাদের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা খুব কষ্ট দিয়েছিল ওকে। যখন খুশি রাঙাদিদার কাছে গল্প শোনা, চাইলেই দিভাইএর সঙ্গে পুকুরের জলে ঝাপানো, যখন তখন ছবি এঁকে দেওয়ার বায়না, মা বকলে বম্মা অর্থাৎ সুতপার কাছে গিয়ে মুখ লুকোনো, লুকিয়ে দাদাভাইএর চকলেট এনে দেওয়া, এইসব কিছুর জন্যে বুকের মধ্যে হাহাকার বয়ে বেড়াতো রন। সল্টলেকের বাড়িটাকে ও কখনো নিজের বাড়ি ভাবতে পারেনি। এসব কথা কতবার বলেছে তৃণাকে। বলেছে পরীবাগানের অদ্ভুত জনশ্রুতিও। বাড়িটা তৃণারও মনের মধ্যে বসে গেছে। প্রচণ্ড আকর্ষণ অনুভব করে। একটা অন্যরকম টান। রন আরও একটা অদ্ভুত কথা বলেছে ওকে,
—জানিস তো পরীবাগান নিয়ে রাঙাদিদার কাছে অনেক তো গল্প শুনেছি, যার কিছুটা জনশ্রুতি আর অনেকটা রাঙাদিদার কল্পনাপ্রসূত। সব মিলিয়ে পরীবাগানটা একটা রহস্যের ভাণ্ডার ছিল আমাদের কাছে। একা যেতাম না কখনো। দিভাই সঙ্গে করে কখনো সখনো নিয়ে যেত, তখন আর ভয় পেতাম না। আর দিভাই যখন পরীবাগানে ঘুরে বেড়াতো তখন ওকে আমার কেমন যেন অপ্রাকৃত লাগতো। মনে হতো ও যেন আমাদের কেউ নয়। মনে হতো, ও-ই সেই পরী কিংবা পরীদের আত্মীয় টাত্মীয় হবে। জানিস দিভাই গাছেদের সঙ্গে কথা বলতো। আমি দেখেছি।
—এতে অবাক হওয়ার কী আছে? যারা গাছ ভালোবাসে তারা গাছের হার্টবিট শুনতে পায়। গাছের ভাষা বুঝতে পারে। জগদীশ চন্দ্র বুঝতেন।
—এমন কথা তো তুই বলবিই। তোকেও আমার মাঝে মাঝে অপ্রাকৃত লাগে।
আজ তৃণাকে দেখে রনর মনে হলো ও যেন ঘোরের মধ্যে আছে। চোখের ভাষা, এমনকি শরীরের ভাষাও অনেক বেশি নমনীয়। চোখের পাতায় একটা অন্য ছায়া।
সামনের বাগান পেরিয়ে টানা লম্বা বারান্দা। মাঝামাঝি বিরাট ড্রয়িংরুম। বারান্দার বাঁদিকে একদম শেষপ্রান্তের ঘরটায় ডাক্তারি পাশ করার পর প্রথম দিব্যেন্দুর জন্যে একটা চেম্বার করে দেওয়া হয়েছিলো। সপ্তাহে দু’দিন সকালের দিকে ওখানে কিছু রোগী দেখতো দিব্যেন্দু। ওরা সল্টলেকে চলে যাওয়ার পর দীর্ঘকাল ঘরটা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়েছিল। এখন রনর জন্যে আবার সেটা সাজানো হয়েছে। প্রত্যেক সপ্তাহে রন ওখানে বসে বিনা পয়সায় রোগী দেখে। এই ব্যবস্থা হয়েছে রূপাঞ্জনার ইচ্ছেয়।
আজ বুধবার। রন আসবে। পবন খুব সকালে উঠে ঘর পরিস্কার করে দরজা জানালা খুলে রুম ফ্রেশনার স্প্রে করে দিয়েছে। গ্যারেজের পাশের গেটটার তালা খুলে রেখেছে। রন-র পেশেন্টরা ওই গেট দিয়েই যাওয়া আসা করে।
বাগানে প্রচুর গাঁদা আর চন্দ্রমল্লিকা ফুটেছে। তিনতলার বারান্দা থেকে হলুদ রঙের ফ্লাওয়ারবেড মনে হয়। পবন ভারি যত্ন করে বাগানের। আগাছা পরিস্কার করা, নিয়মিত ঘাস ছাঁটা, এগুলো ওর রুটিন কাজ। তিন চার রকমের গাঁদা লাগিয়েছে, হলুদেরই অনেকগুলো শেড। চন্দ্রমল্লিকারা সব টবে। রম্যও আজাকাল সুযোগ পেলে গাছের যত্ন নেয়। রূপাঞ্জনাই প্রথম ওকে দুট গোলাপের চারা এনে দিয়ে বলেছিল, এ দুটো তোর, এদের দেখাশোনাও তোকেই করতে হবে। ফুল ফোটাতে পারলে পুরষ্কার পাবি।
সে দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে রম্য। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে যেদিন ও বাগানের পরিচর্যা করে পবনের সঙ্গে, রমলা সামনের বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসে দেখেন। কখনো টুকটাক পরামর্শ দেন। রূপাঞ্জনা বাড়ি থাকলে সেও আম্মার পাশে গিয়ে বসে। তাতে রম্যর উৎসাহ চতুর্গুন বেড়ে যায়। ওর গোলাপ গাছেও অনেক ফুল ফুটেছে। রম্য ওর কোন বন্ধুর বাড়ি থেকে মভ কালারের কলাবতী এনে লাগিয়েছিল, একটা কোণ জুড়ে তাদেরও ফুলের বাহার। বাগানটার দিকে তাকালে মন ভালো লাগে।
সকাল সাতটা দশ বাজে।সাড়ে সাতটার মধ্যে চলে আসে রন। এসে এখানে ব্রেকফাস্ট করে। ন’টা থেকে রোগী দেখা শুরু করে। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে দরকারি ফোনগুলো সেরে নিচ্ছিলো রূপাঞ্জনা। আজ আর বেরোবে না। রন যেদিন আসে, সচরাচর বাইরে কনো কাজ রাখে না। ওর বেরোনোর কথা শুনলেই রন-র মুখভার।
—দেখ দিভাই, আমি শুধু রোগী দেখার জন্যে ছুটে আসি না। একটা গোটা দিন তোমাদের সবার সঙ্গে কাটাতে পারবো বলে আসি।
গৌরী চা রেখে গেছে। রূপাঞ্জনা চায়ের কাপে সবে ঠোঁট ছুঁইয়েছে, নিচে গাড়ির আওয়াজ পেলো। প্রথমে লক্ষ্য করেনি, রন নামার আগেই গাড়ি থেকে যে নেমে এলো তাকে দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল রূপাঞ্জনার। বলে না দিলেও ওর মন বলছে ও তৃণা। ছোটকাকিমা তৃণার সম্বন্ধে যা বর্ণনা দিয়েছে তার সঙ্গে অবশ্য মিলছে না।
রন গাড়ি ঢোকাচ্ছে, তৃণা বড় গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ও কি ভেতরে আসতে লজ্জা পাচ্ছে? এ সময় অমলা ঠাকুর ঘরে, রম্য হইয়তো ঘুম থেকে ওঠেনি। আজ তৃণাকে সঙ্গে নিয়ে আসবে রন এটা বাড়ির অন্য কেউ জানে না। নাহলে এতক্ষণে অমলা বা পৌলমী অন্তত হৈ হৈ করে ছুটে আসতো। রূপাঞ্জনা দ্রূত পায়ে নেমে গেটের কাছে গেল।
রন গাড়ি রেখে গ্যারেজের পাশের ছোট গেটটার কাছে দাঁড়িয়ে তৃণাকে ডাকছে। তৃণা সেইদিকে ঘুরতেই রূপাঞ্জনা বড় গেট খুলে গিয়ে দাঁড়ালো।
—উঁহু ওদিকে নয়। এটা গৃহপ্রবেশ, সুতরাং সদর দরজা দিয়ে এসো। বলেই তৃণার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। তৃণা এগিয়ে এসে হাত ধরলো রূপাঞ্জনার।
—তুমি দিভাই!
রূপাঞ্জনা জড়িয়ে ধরেছে তৃণাকে। রন হাসিমুখে এগিয়ে এসে টুক করে তৃণার মাথায় একটা আলতো চাটি মেরে বললো, পাশ করে গেছিস।
রূপাঞ্জনা আর তৃণা ওপরে ওঠার সিঁড়ির মুখে রমলার মুখোমুখি। রূপাঞ্জনা কিছু বলার আগেই তৃণা ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসু ভঙ্গীতে বললো, আম্ম। রূপাঞ্জনা চোখে সায় দিল। তৃণা প্রণাম করতেই রমলা ওড় থুতনিতে হাত ছুঁয়ে একটু আদর করলেন তারপর রূপাঞ্জনার দিকে তাকালেন। রূপাঞ্জনা লক্ষ্য করলো রমলার চোখে মুগ্ধতা। ও খুব স্বাভাবিক ভঙ্গীতে বললো — তৃণা, রন-র সঙ্গে এসেছে।
— তুমিও ডাক্তার?
— না। আমি স্কুলে পড়াই।
— যাও উপরে গিয়ে বোসো। আমি আসছি।
তৃণা সম্পর্কে রমলা আগে কিছু জানতেন না। রূপাঞ্জনার মনে হলো রমলার যা বোঝার বুঝে নিয়েছেন।
দোতলার বারান্দার মাঝামাঝি জয়গাটা অর্ধবৃত্তাকারে সামনের দিকে অনেকটা বাড়ানো। জায়গাটুকু গ্রিল দিয়ে ঘেরা। সেই কবেকার পুরোনো আমলের বাড়ি। বেতের সোফাসেট দিয়ে সাজিয়ে এখানে একটা বসার জায়গা করা আছে। এটা পারিবারিক আড্ডার জায়গা। নিচ থেকে লতিয়ে ওঠা মাধবীলতা আর কার্নিশে রাখা টবের মানিপ্ল্যান্ট গ্রিলটাকে প্রায় আবৃত করে রেখেছে। পাতার ফাঁক দিয়ে গলে আসা সকালবেলার রোদ্দুর মেঝেতে ভারি সুন্দর আলপনা তৈরি করেছে। কিছুদিন হলো তোতা ওর এক বন্ধুর দেওয়া দুটো টব এনে এক কোণে রেখেছে। একটাতে বাহারি বাঁশগাছ, আর একটা অশোকফুলের বনসাই। জায়গাটা বেশ তপোবন তপোবন লাগে। তৃণাকে নিয়ে ওখানেই বসলো রূপাঞ্জনা।
রন এলেই বাড়ির কেজো মুখোশটা খুলে পড়ে। প্রত্যেকের ঘরের দরজায় যেন ছুটির ঘন্টা বাজিয়ে দেয় ও। একটা অকারণ খুশির হাওয়া বইতে থাকে। অমলার পুজোর সময় সংক্ষিপ্ত হয়। রান্নাঘর থেকে বিশেষ বিশেষ খাবারের গন্ধ ভেসে আসে। রম্যর সারা সপ্তাহের জমানো কথারা ঠোঁটের আগল খুলে বাইরে বেরোয়। অন্য সময় রম্যর গলার আওয়াজ কেউ খুব একটা শুনতে পায় না। রন ওকে খুব প্রশ্রয় দেয়। কাজেই রম্যর ছোটকু বাড়ি আসা মানেই ওর উৎসবের দিন।
রন এসেছে বুঝতে পেরে প্রায় ছুটতে ছুটতে তিনতলা থেকে নামছিল রম্য। পরনে কুঁচকে থাকা সাদা পাজামা পাঞ্জাবি। ল্যান্ডিং এ এসেই চোখ পড়লো তৃণার দিকে। একটু থমকে গেল। রূপাঞ্জনা ডাকলো ওকে,
— কী রে থেমে গেলি কেন, আয়। ও তৃণা, তোর ছোটকুর… রূপাঞ্জনাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে ‘আমি জানি’ বলেই আবার তিনতলার দিকে ছুটলো রম্য। পৌলমী আর তোতার আলোচনা থেকেই হয়তো তৃণা সম্পর্কে একটা ধারণা করে নিয়েছে।
— ও কি আমাকে দেখ লজ্জা পেয়ে পালিয়ে গেল?
— না, না। হয়তো চেঞ্জ করতে গেল। ওটা ওর রাতের পোশাক।
এক হাতে তৃণার ক্যামেরার ঝোলা আর অন্য জিনিসপত্র, অন্যহাতে অমলার হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে রন বললো,
— দিভাই হাত ধরা মাত্র মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওপরে চলে এলি। তোর এইসব লাগেজ কার জন্যে রেখে এসেছিস?
— থ্যাঙ্কস।
তৃণা হাত বাড়িয়ে জিনিসগুলো নিলো। অমলা তৃণার সামনে দাঁড়িয়ে দু’হাতে ওর মুখটা ধরে একগাল হেসে বললেন, ওরে রন একে তুই কোথায় খুঁজে পেলি?
— জঙ্গলে। বলেই তৃণা নিচু হয়ে প্রণাম করলো অমলাকে।
— ও মঝে মাঝে একদম ঠিকঠাক কথা বলে। রন টিপ্পনি কাটলো তৃণার কথায়।
রম্য এবার পৌলমীকে সঙ্গে নিয়ে এলো। পৌলমী যথারীতি ওপর থেকেই হৈ হৈ করতে করতে নামলো।
— এই বাঁদর, কাল রাতে যখন কথা হলো একবারও তো বললি না তৃণাকে নিয়ে আসবি।
— আমি তো আনিনি। ও আমাকে নিয়ে এসেছে।
— দিদিভাই তুমি জানতে?
রূপাঞ্জনা মাথা কাত করলো। রম্যকে কাছে ডাকলো তৃণা। প্যাকেট থেকে বিরাট দুটো চকলেট বার করেছে। একটা রম্যর দিকে বাড়িয়ে দিলো অন্যটা হাতে ধরে বসে আছে দেখে রন জিজ্ঞেস করলো, ওটা কার?
সবাইকে অবাক করে দিয়ে তৃণা বললো,
— রাঙাদিদার।
অমলা একটু হেসে বললেন, রাঙাদিদা আর চকলেট খায় না।
— এবার থেকে খাবে। বলে চকলেটটা অমলার হাতে ধরিয়ে দিলো।
ওদের নিয়ে সারাদিন হৈ হৈ করে কাটালো সবাই। তৃণাকে দেখে মনে হচ্ছিল, এ বাড়িটা যেন ওর কতকালের চেনা। রম্যর সঙ্গে ঘুরে বেড়ালো সারা বাড়ি, পুকুরঘাটে বসে দুজনে মাছকে মুড়ি খাওয়ালো। তৃণা প্রচু্র ছবি তুললো সবার। গৌরী অন্যদিনের চেয়ে আরো বেশি উৎসাহ নিয়ে রান্নাবান্না করলো। ফিসফিস করে অমলাকে এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করে নিলো – হ্যাঁ গো রাঙাদিদা, ছোড়দার সঙ্গে কি তৃণাদিদির বিয়ে হবে? খুব মানাবে কিন্তু দুজনকে।
গৌরীর মন বোঝার জন্যে অমলা মজা করে বললেন, কী করে মানাবে? রন তো সাহেবের মতো ফর্সা, আর তৃণার গায়ের রঙ তো চাপা।
— চাপা হলেই বা। অমন সুন্দর মুখের ছবি আর কোথায় পাবে তোমরা? আর মানুষটা কত ভালো, ওর চোখে মুখে এমন ভালোবাসা, যে চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না। যেখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, জায়গাটা আলো হয়ে উঠছে।
সকাল বেলায় জলখাবার খেতে বসে প্লেটে লুচি আর ছোলার ডাল দেখে তৃণা বললো, মোহনভোগ কোথায়?
গৌরী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো — ও মা, তুমি কী করে জানলে মোহনভোগের কথা?
তৃণা মজা করে উত্তর দিলো — আমার মন বলছে, এরপর মোহনভোগ অপেক্ষা করেছে।
পৌলমী রন-কে চিমটি কেটে বললো, ভালো পড়িয়েছিস।
রূপাঞ্জনা যোগ করলো, ছাত্রীটিও মেধাবী।
রন-র খুব প্রিয় জলখাবার লুচির সঙ্গে নারকেল কুচি দেওয়া মিষ্টি মিষ্টি ছোলার ডাল আর মোহন ভোগ। ও এলে অধিকাংশ দিন ব্রেকফাস্টে এই মেনুটা থাকে।
অন্যদিন রন একটু আগেই বেরিয়ে যায়। আজ বেরোতে বেরোতে রাত প্রায় সাড়ে আটটা বেজে গেল। ওদের কেউ ছাড়তে চাইছিল না। ওরা চলে যাওয়ার পর এমনকি রমলাও সুতপাকে বললেন, মেয়েটা একটা অন্যরকম হাওয়া বয়ে এনেছিল। ঠিক আমার রূপুর মতো।
কথাটা কানে যেতেই রূপাঞ্জনার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। কিন্তু নিজের ভেতর ডুব দিয়ে তন্ন তন্ন করে কিছুতেই খুঁজে পেল না সেই রূপুকে। তাহলে কি ওর ভেতর কোথও আর নেই সেই মেয়েটি, একটুও নেই?
হয়তো নেই, শুধু বিকেল বেলায় রন যখন পরীবাগানে ঘুরে ঘুরে তৃণাকে গাছ চেনাচ্ছিল, তখন যেন এক ঝলকের বিভ্রন্তিতে ও দেখতে পেয়েছিল তাকে, একটা যুগলছবির অংশ হিসেবে।
রাতেই শর্মিলা ফোন করলো রূপাঞ্জনাকে।
— কী রে কেমন বুঝলি?
— যা বোঝার সে তো রনই ঠিকটাক বুঝে নিয়েছে কাকিমা।
— তোর তো ওর সবকিছুতেই ঘাড় কাত।
— অন্ধের মতো নয় সে তো জানো। বলতে পারো রনর পালসটা আমি তোমাদের চেয়ে ভালো বুঝি। ছোটকাকে বলো খুব তাড়াতাড়ি ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করতে। অনেকদিন বাড়িতে কোনো উৎসব হয়নি।
— তোর ছোটকা জিজ্ঞেস করছে, তৃণাকে তোর কেমন লেগেছে।
— কেমন লেগেছে এককথায় তো বলা যাবে না। সেটা ভাবার অবকাশ ও দেয়নি। শুধু বলতে পারি ও কী যেন একটা ফিরিয়ে দিয়েছে এই বাড়িটাকে। ওর হাতে একটা যাদুকাঠি আছে, যা দিয়ে এই গোমড়ামুখো বাড়িটাকে আজ জাগিয়ে দিয়ে গেছে তৃণা। ওকে সবার বড্ড দরকার।
দিব্যেন্দু চুপ করে শুনছে, কতদিন পর রূপু এতটা আবেগ নিয়ে কথা বলছে।
পার্টির কাজে প্রথমে বরানগর গিয়েছিল রূপাঞ্জনা। সেখান থেকে শ্যামবাজার। সঙ্গে আরও অনেকে আছে, তারা অন্য গাড়িতে। ওর গাড়িতেও পার্টির দুজন কর্মী। ফেরার সময় মৌলালির মোড়ে এসে একবার ঘড়ির দিকে তাকালো। তারপর সুনন্দর মোবাইলে ফোন করলো।
— সংঘমিত্রা আর শৌনককে তোমাদের গাড়িতে নিতে পারবে? ওরা পার্কসার্কাস মোড়ে নেমে যাবে।
— হ্যাঁ হয়ে যাবে দিদি।
— তাহলে গাড়িটাকে সাইড করো। ওরা নেমে দাঁড়াচ্ছে, ওদের তুলে নাও। আমি কাছেই আমার এক আত্মীয়ের বাড়ি যাবো। ফিরতে একটু দেরি হবে। তোমরা চলে যাও। আমি ফিরে গিয়ে রাতে বিভাসদার সঙ্গে কথা বলে নেব। তোমাকে কিছু বলতে হবে না।
ওদের নামিয়ে দিয়ে শঙ্করকে বললো, আনন্দ পালিত রোডে চলো। ঢুকে ডানদিকে প্রথম রাস্তায় যাবে। চলো তারপর আমি বলে দেবো। অনেকদিন আগে এসেছি, অনেক পালটে গেছে। একটু দেখে নিতে হবে। তুমি একটু আস্তে যাবে।
কিচ্ছু চিনতে পারছে না রূপাঞ্জনা। একটু নয়, আমূল বদলে গেছে। অধিকাংশ পুরোনো বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাটবাড়ি উঠেছে। রাস্তাগুলো অপেক্ষাকৃত চওড়া হয়েছে। তুলতুলদের বাড়ির উলটো দিকে একটা নার্সারি স্কুল ছিল। আর তার পাশেই একটা ব্যাডমিন্টন কোর্ট — এটা বেশ ভালো মনে আছে। আসবে আগে ভাবেনি। তাহলে মেজকাকে জিজ্ঞেস করে নিতো। হঠাৎই মনে হলো — কাছেই যখন এসেছি, একবার দেখা করে যাওয়া যেতে পারে। আলাদা করে দিনক্ষণ ঠিক করে কবে আসা হবে তার ঠিক নেই।
শঙ্কর পথ চলতি দু’এক জনকে জিজ্ঞেস করলো, কিন্তু কেউ বলতে পারলো না। তারা হয়তো এ পাড়ায় আগন্তুক। কেননা সেই অনেক বছর আগে যখন এসেছিল, সায়ন্তনীর বাবাকে নির্মাল্য সরকারের নামটা বলতেই চিনতে পেরেছিলেন।
হঠাৎ কী মনে হতেই মোবাইলটা বার করলো রূপাঞ্জনা। পরশু রাতে ফোন করেছিল তুলতুল। নম্বরটা তখন সেভ করে রাখেনি। মেজকাই রূপাঞ্জনার নম্বর রেখে এসেছিলেন ওদের বাড়ি, কোনো প্রয়োজনে ফোন করার জন্যে। কল লিস্ট খুঁজে আন্দাজে একটা নম্বরে ফোন করলো রূপাঞ্জনা। না, অন্য কেউ। পুরুষ কন্ঠ। কেটে দিয়ে তুলতুলের কলের সময়টা মনে করে এবার অন্য একটা নম্বর ডায়াল করলো। দু’বার রিং হতেই ওপাস থেকে উচ্ছ্বাস আছড়ে পড়লো।
— রূপুদি!
— তুই কোথায়?
— মায়ের ওষুধ কিনতে বেরিয়েছি। তুমি কোথা থেকে বলছো?
— আনন্দ পালিত রোড থেকে। একটা বাড়ি খুঁজছি।
— সে কী!! শোনো, তোমাকে বাড়ি খুঁজতে হবে না, বাড়িটাই তোমাকে খুঁজে নেবে। একমিনিট দাঁড়াও। নিশ্চয় গাড়ি নিয়ে এসেছ, গাড়ীর রঙটা বলো।
— সাদা।
সত্যি সত্যি এক মিনিটের মধ্যে তুলতুল গাড়ির পাশে এসে হাজির। শঙ্করের দিকে তাকিয়ে নির্দেশ দিলো, তিনটে বাড়ি ছেড়ে একটা কালো রঙের গেট দেখবে। হর্ণ দিলে দরজা খুলে দেবে, আমার নাম বলে সোজা ভেতরে ঢুকে যাবে।
গাড়ি থেকে নেমে এলো রূপাঞ্জনা। তুলতুলের সঙ্গে হেঁটে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলো, তোদের বাড়ির উলটো দিকে একটা নার্সারি স্কুল ছিল না? আমি সেটাকেই টার্গেট করে এগোচ্ছিলাম।
— ছিল তো অনেক কিছুই, এখন আর নেই। আমাদের সেই বাড়িটাকেই কি আর দেখতে পাচ্ছো?
— তাই তো! আসতে আসতে দু’এক জনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কেউ বলতে পারলো না। অথচ কলেজে পড়ার সময় আমি একা একবার এসেছিলাম সে তো অন্যের কাছে ঠিকানা জিজ্ঞেস করেই।
— রূপুদি, সেটা কত বছর আগের কথা বলো তো। এখন একটা বাড়ি অন্তত দশ বারোটা ফ্যামিলির বাসস্থান। তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছে। তারা কী করে চিনবে আমাকে। হ্যাঁ পুরোনো যারা আছে তাদের সঙ্গে তোমার দেখা হয়নি বলেই ঠিকানা জানতে পারোনি।
ওরা ততক্ষণে কালো গেটের সামনে এসে গেছে। রূপাঞ্জনা খেয়াল করলো ওরা গেট দিয়ে একটা হাউজিং কমপ্লেক্সের ভেতর ঢুকলো। পাঁচ তলা বিল্ডিং। অন্তত আট দশটা ফ্ল্যাট তো হবেই। রূপাঞ্জনাকে নিয়ে দোতলায় উঠে গেল তুলতুল। নিজেই চাবি দিয়ে দরজা খুললো। বাহুল্যবর্জিত ছিম ছাম ড্রয়িংরুম পেরিয়ে শান্তার ঘরে এলো ওরা। পিঠে বালিশ দিয়ে আধশোয়া হয়ে বিছানায় বসে আছে শান্তা। তুলতুল বেরোনোর আগে বসিয়ে দিয়ে গেছে। পাশে একটা বই দুটো পত্রিকা, আর খবরের কাগজ। বইটা পড়ছিল। একটু আগে চা দিয়ে গেছে মালতী। আজ তুলতুল অন্যদিনের চেয়ে একটু আগে কলেজ থেকে ফিরেছে। শান্তার একটা ওষুধ ফুরিয়েছে শুনে চেঞ্জ করেই আবার বেরিয়েছে ওষুধটা আনতে। ঠোটে ধরা চায়ের কাপ সরিয়ে অবাক হয়ে তাকালো শান্তা। তুলতুল কাছে গিয়ে শান্তার হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে পাশের টুলে রাখলো।
— মা, চিনতে পারছো?
শান্তা পাশে রাখা চশমাটা নিয়ে একটু দ্বিধাগ্রস্তভাবে বললো,
— আমার মন বলছে রূপু।
— তার মানে আমি তোমার মনে কোথাও না কোথাও ছিলাম।
রূপাঞ্জনা কাছে এগিয়ে এসে হাতটা ধরতেই শান্তা শরীরটাকে একটু এগিয়ে এনে জড়িয়ে ধরলো ওকে।
— ছিলিই তো। আমি কিন্তু কোথাও কারো মনেই ছিলাম না, তাই না রে?
বলেই কেঁদে ফেললো। রূপাঞ্জনা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পাশে বসলো।
— ছিলে। না হলে তুলতুলকে আমি ট্রেনের মধ্যে চিনলাম কেমন করে? সে তো তোমার মুখটা মনে ছিল বলেই।
চোখ মুছলো শান্তা। শান্তার দিকে তাকিয়ে রূপাঞ্জনারও চোখে জল আসছে। কী চেহারা হয়েছে মানুষটার! সারাক্ষণ চোখের তারায় লেগে থাকা সেই ঝকঝকে হাসি কই? তার জায়গায় ঘন হয়ে ছেয়ে আছে কষ্টের মেঘ। সবসময় টিপটপ, সতেজ একটা মানুষ এখন ঝরে পড়া পাতার মতো বিছানার ওপর পড়ে থাকা একটা জীর্ণ শরীর শুধু।
— সোজা বাড়ি থেকে এলি?
— না, বরানগর গিয়েছিলাম একটা কাজে। বড়ি থেকে বেরিয়েছি এগারোটায়। কিছু খাবো, খুব খিদে পেয়েছে।
— কী খাবি বল।
— তোমার বানানো চিকেন চাউমিন খাবো সেটা ত আর বলতে পারি না। দেখি তুলতুল কী খাওয়ায়।
— তোর মনে আছে চিকেন চাউমিনের কথা?
— সব মনে আছে।
— তাহলে আসিসনি কেন এতদিন?
— এতদিন কেন আসিনি, আজই বা কেন এলাম এসব কথার ঠিকঠাক উত্তর আমার কাছে নেই কাকিমা। আজ যখন এসে দাঁড়িয়েছি তোমার কাছে, আর কোনো ক্ষোভ রেখো না মনে। তাহলে আমার আসাটা অর্থহীন হয়ে যাবে। অভিমান যা জমেছিল, একদিনে তো হবে না একটু একটু করে ভাঙবে। ছাড়ো এখন ওসব। কী গো উজ্জয়িনী সরকার কী খাওয়াবে?
— চিকেন চাউমিনের কথা একবার বলেই দেখো না, আমাদের মালতী যে কোনো চাইনিজ কুককে হার মানায়।
মালতী নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। ও বুঝেছে এ বিশেষ কেউ। লজ্জা লজ্জা মুখ করে একটু হাসলো।
— মা শিখিয়েছে আমাকে। বানাবো মা?
— হ্যাঁ বানাবি। তার আগে ওকে একটু চা বা কফি করে দে।
— না, চা কফি কিছুই খাবো না এখন। সারাদিন অনেকবার চা খাওয়া হয়ে গেছে।
— দিদি, একটু এসো এদিকে... বলে মালতী তুলতুলকে ডেকে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল।
তুলতুল সরে যেতেই শান্তা বললো,
— ওর নিজের জীবন বলতে আর কিছু নেই রে, পঙ্গু মা আর চাকরি এই দুয়ের যাঁতাকলে পড়ে বিয়েটাও করতে পারছে না। কোনদিক সামলাবে?
জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো রূপাঞ্জনা।
— সিদ্ধার্থ ওর মা বাবার একমাত্র সন্তান। তুলতুলের তো দিনের বেশি সময়টা কেটে যায় কলেজ আর যাতায়াতে। ওদের বাড়িতেই বা থাকবে কখন আর আমাকেই বা দেখবে কখন। এ যে কী যন্ত্রনা আমার। তুই আমার তুলতুলকে কলকাতায় এনে দে রূপু। আমি জানি তুই সেটা পারিস। তোকে এটা বলেছি জানতে পারলে খুব রাগ করবে তুলতুল আমি জানি। কিন্তু আমি এখন সমুদ্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। কিছু একটা আঁকড়ে ধরে তো বাঁচতে চাইব। তুইই বল।
— বেশ করেছ বলেছ। ওটা নিয়ে আমিও ভাবছি। তুমি ভেবো না। দেখি কী করা যায়।
শান্তা হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়লো। রূপাঞ্জনা বাধা দিল না। কিছুক্ষণ কাঁদতে দিল। ওর মনে হলো এই কান্নাটার ভেতর কষ্ট নেই। জমাট বাধা শৈত্যের মাঝখানে অভাবিত উষ্ণতার ছোঁয়া পেয়ে আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েছে শান্তাকাকিমা। আনন্দ প্রকাশ করার ভাষাও ভুলে গেছে মানুষটা।