• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৪ | অক্টোবর ২০২১ | উপন্যাস
    Share
  • পরীবাগান ও এক গল্পের মেয়ে (১) : অঞ্জলি দাশ


    এই উপন্যাসটা লেখার একটা পটভূমিকা আছে। যা না বললেই নয়। কবিতাই আমার স্বপ্ন ও বাস্তবের পারাপারের সাঁকো। কবিতা লেখার ফাঁকে কখনোসখনো গল্পও লিখি। কিছু গল্প প্রকাশ হয়, কিছু শুধু আমার লেখা পড়তে আগ্রহী দু’একজন বন্ধুকে পড়ে শোনাই। আমার সেই দ্বিধান্বিত গল্প লেখাকে যাঁরা প্রশ্রয় দিতেন, তাঁদের মধ্যে একজন নবনীতাদি। নবনীতা দেব সেন। ওঁকে গল্প পড়ে শোনানোর যে দুর্লভ অভিজ্ঞতা আমাকে চমকিত করে তা হলো – হয়তো একটা তিন হাজার শব্দের গল্প পড়ছি, ওঁর মুখ দেখে বুঝতে পারছি না মন দিয়ে শুনছেন কি না। গল্প শেষ হলো। বললেন, তৃতীয় প্যারার দ্বিতীয় লাইনটা বেশি দীর্ঘায়িত হয়ে গেছে আর একটু গুছিয়ে লেখ কিংবা অমুক শব্দটা আরোপিত লাগছে, পালটে দে। বুঝলাম আত্মস্থ করেছেন একবার শুনেই।

    কাজেই আমার প্রায় সব গল্পের প্রথম শ্রোতা নবনীতাদি। মাঝে মাঝেই ফোনে জানতে চান নতুন কী লিখলি? আমার লেখার উৎসাহকে উসকে দেন।

    এভাবেই ‘পরীবাগান’ নামে একটা গল্প ওঁকে পড়ে শোনানোর পর বললেন, এই গল্পের চরিত্রগুলো যেভাবে ভেবেছিস, ছোটগল্পের পরিসরে তারা পুরোপুরি প্রকাশ হচ্ছে না। বিস্তার চাইছে। এটাকে নিয়ে উপন্যাস লিখে ফ্যাল। উপন্যাস লেখার কথা কখনও আমার ভাবনাতেও আসেনি। ওঁর উৎসাহ আমাকে অনুপ্রাণিত করলো। আমার মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগলো — হয়তো পারবো। শুরু করলাম। মাঝে মাঝে খোঁজ নেন লেখা কতটা এগোলো।

    লিখে ফেললাম। প্রথম পাঠক নবনীতাদি। ওঁর লেখালেখির ব্যস্ততার মাঝে প্রায় পঞ্চাশ হাজার শব্দের হাতেখড়ি উপন্যাস পড়তে বলা অন্যায়। শুধু জানালাম, উপন্যাসটা শেষ হয়েছে।

    পেরু বেড়াতে যাচ্ছেন। যাওয়ার আগে বললেল, পাণ্ডুলিপিটা আমার সঙ্গে দিয়ে দে। উপন্যাসটা আমি পড়তে চাই। ওখানে অনেক অবসর পাবো।

    আসার পর পাণ্ডুলিপি ফেরত দিলেন। মাঝে মধ্যে পেন্সিলে দু’একটা সংশোধনের পরামর্শ। আমার প্রথম উপন্যাস লেখা হলো।

    —অঞ্জলি দাশ

    ভেজা বাতাসে একটা বুনো গন্ধ ভেসে আসছে। বৃষ্টির পরে গাছের শরীর থেকে যেরকম গন্ধ উঠে আসে ঠিক তেমনি। অন্য সময় গন্ধটা আমার মন ভালো করে দেয়, এখন অস্বস্তি লাগছে। মনে হচ্ছে আমার ভিতরে, কেউ কিছু হাতড়ে বেড়াচ্ছে। বুকের মধ্যে জমে পাথর হয়ে থাকা কথাগুলোর পাশে কেউ কি কান পেতে আছে? হয়তো আছে। এই জানালাটার ওপাশে অগুনতি শাখাপ্রশাখা বাড়িয়ে যারা প্রতিদিন আমাকে সঙ্গ দেয়, ঋতুবদলের খবর দেয়, তারাই হয়তো। তারা কখনও-সখনও আমাকে ঝাঁকুনি দিতে চেষ্টা যে করে না তা নয়, আমি উপেক্ষা করি। আমার কাছে যেন কোনো প্রত্যাশা আছে ওদের। ওরাও ফিরে দেখতে চাইছে কিছু। আসলে ওরাই তো এক রূপকথার সূত্রধর।

    - রূপুদিদি!

    - কী বলছো?

    - চা এনেছি।

    - রেখে যাও।

    - আলো জ্বালোনি কেন?

    -এতক্ষণ বাইরের আলো ছিলো সেই জন্যে। জ্বেলে দাওতো আলোটা।

    গৌরীদি আলোর সুইচ অন করে চায়ের কাপ রাখলো টেবিলে। তারপর মুখের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকালো। কিছু বুঝে নিতে চাইছে।

    - রম্যর জন্যে চিঁড়ের পোলাও করেছিলাম, তোমাকে দেব একটু?

    - না। এখন কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।

    মুখ দেখে মনে হলো উত্তরটা ঠিক মনোমত হলো না। গৌরীদি বেরিয়ে যেতেই খেয়াল হলো অনেকক্ষণ আগে ফিরেছি, অথচ বাইরের জামাকাপড় না ছেড়ে একা চুপচাপ আলোআঁধারির মধ্যে বসে আছি, এটা ওর স্বাভাবিক লাগেনি। ওর তীক্ষ্ণদৃষ্টির কারণ সেটাও হতে পারে।

    কিছুক্ষণ আগে একটা মিটিং সেরে বাড়ি ফিরেছি। উপরে আসার সময় দেখেছি বসার ঘরে একজন মহিলা আর একটি অল্পবয়সী মেয়ে আম্মার সঙ্গে কথা বলছে। আমাকে ঢুকতে দেখে আম্মা কিছু বলতে চাইছিলেন। আজ আমি গাড়ি নিয়ে যাইনি বলে বিভাসদার গাড়িতে ফিরেছি। গেটের সামনে নেমে বারান্দায় উঠতে উঠতে একটু ভিজে গিয়েছিলাম বলে পাশ কাটিয়ে চলে এলাম। আন্দাজ করছিলাম ওরা কারা হতে পারে। প্রতিদিনের অভ্যেস মতো ওপরে ওঠার আগে রাঙাদিদার ঘরে মুখ বাড়াতেই আমার ধারণার স্বীকৃতি মিললো। রাঙাদিদা আগের মতো তত বেশি কথার ফুলঝুরি ছোটান না বটে, কিন্তু তথ্যটা জানানোর সময় তাঁর উত্তেজনার আঁচ টের পাওয়া গেল। একটা ইজিচেয়ারে শুয়ে চোখ বুঁজে গ্রামোফোন রেকর্ডে গান শুনছিলেন রাঙাদিদা, আমার সাড়া পেয়ে চোখ খুললেন। কাছে এলেন।

    --ভিজে গেছিস তো। আয় মাথাটা মুছিয়ে দিই। ঠান্ডা লেগে যাবে।

    --ছাড়ো তো। মাথায় দু’ফোঁটা জল পড়লেই গলে যাবো, আমি কি নুনের পুতুল নাকি ?

    --না, তুমি আমার অষ্টধাতুর পিত্তিমে। সব সয়।

    জড়িয়ে ধরে আদর করলেন।

    আমি এখন তিনতলায় থাকি। তবু এখনও আমার অবসরের অনেকখানি আলোহাওয়া জোগায় একতলার এই ছোট্ট ঘর। সেখানেই বাতাসটা কিছু ভারী মনে হলো। আর সেই ভারী বাতাসের খানিকটা বয়ে নিয়ে নিজের ঘরে এলাম। সেই ভার আমাকে কেবলই পিছনে টানছে। কেবলই অন্যমনস্ক করে দিচ্ছে।

    আজ আমাদের পরিবারে কিছু অতিরিক্ত তৎপরতা লক্ষ করেছি। কারও কারও অসন্তোষ মিশ্রিত একটা চাপা গুঞ্জন ভেসে এসেছে কখনও কখনও। কানে নিইনি। কারণ প্রায় কুড়ি একুশ বছর ধরে এই ক্ষোভ মেশানো গুঞ্জন শুনে শুনে গা সওয়া হয়ে গেছে। সারাদিন আমাকে মানুষের অনেক দাবী, হাজারটা সমস্যার কথা শুনতে হয়। সেইসব অজস্র কথার ভিড়ে এক কোণে পড়েছিল খবরটা।

    মনে পড়লো, তিন চারদিন আগে একবার তোতা কী সব যেন বলতে এসেছিল। আম্মা এখন আর আমার সঙ্গে কোনো বৈষয়িক কথা পারতপক্ষে বলেন না। আমাকে আমার জগৎ নিয়ে থাকতে দিতে চান। কিন্তু তোতাকে বোঝানো যায় না। ও সবকিছুতে আমাকে জড়িয়ে রাখতে চায়। সকাল বেলায় বেরোনোর তাড়া ছিল বলে আমি ওকে এড়িয়ে গেলাম। রাতে খাওয়ার টেবিলে সবাই উঠে যাওয়ার পর ও আবারও কথাটা তুললো।

    -- তোকে কিছু বলার ছিল রূপুদি।

    তোতার মাঝে মধ্যে সারা দুনিয়ার সমস্যা নিয়ে মাথাব্যথা শুরু হয়। আর সেগুলো সমধানের জন্যে আমাকেই ওর প্রয়োজন। আমার কাছেই আব্দার করে। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করি। কখনও কখনও এমন সব বিষয় থাকে যা সত্যিই অত্যন্ত বিরক্তিকর লাগে। তাই সতর্ক হলাম।

    -- কথাটা এই বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেকার হলে বল, নাহলে ছেড়ে দে এখন। আমার অনেক কাজ আছে।

    -- পুরোপুরি এবাড়ির নয়ও, আবার এবাড়িরও বলতে পারিস।

    -- ধাঁধাঁ নাকি?

    -- না, ধাঁধাঁ নয়, বলতে পারিস সিঁড়ি ভাঙা অঙ্ক। শেষ থেকে যার শুরু।

    -- মানে?

    -- সোমনাথদারা ওই বাড়িতে ফিরে আসতে চাইছে। পার্মানেন্টলি।

    -- তো?

    -- তুই কী বলিস?

    -- আশ্চর্য! আমি কি এ মুলুকের রাজা না কি যে, কেউ ঘরে ফিরতে চাইলে আমি মতামত দেব!

    -- সে কথা বলিনি। কিন্তু তুইতো জানিস ওবাড়ির ওপর ন্যায্যত ওদের আর কোনো দাবী থাকার কথা নয়।

    -- ব্যাস, ব্যাস, অনেক কথা বলে নিয়েছিস, আর শুনতে চাই না। আমি উঠছি।

    কথার গতিপ্রকৃতি বুঝে নিয়ে তোতাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে হাত ধুয়ে ঘরে চলে এলাম। তোতা বুঝে নিয়েছে এই প্রসঙ্গে কোনোরকম আলোচনাকে আমি প্রশ্রয় দিতে চাই না। ওকে কোনোক্রমে এড়িয়ে গেলাম বটে, কিন্তু মাথার ভেতর বিশ্রী একটা জট পাকানো অস্বস্তি অনেক রাত অব্দি আমাকে জাগিয়ে রাখলো। পরদিন অন্য কাজের চাপে বিষয়টা অবশ্য মন থেকে চলেও গেল। কেননা ওদের কোনো ব্যাপারে আমার আর কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। আমাদের ঠিক পাশেই সতেরো নম্বর গগনবাবু রোডের বাড়িটাতে যে কখনও কোনো মানুষ বাস করতো তা মনেই হয় না। এটা যে চেষ্টাকৃত তা নয়। আমার ভিতর এই পরিবর্তনটা ঘটে গেছে নিজেরই অজান্তে। আমি এখন একটা অন্য বৃত্ত রচনা করে নিয়েছি। আমাকে কেন্দ্র করে যার পরিধিতে নতুন নতুন মানুষ, অনেক। কিছু হারিয়ে যাওয়া মুখও যুক্ত হয়েছে নতুন করে। আর সেই সংযোজন আমাকে আরাম দিয়েছে। সেই বৃত্তের পরিধি থেকে ছিটকে গিয়ে দূরে সরতে সরতে একটা প্রায় ঝাপসা বিন্দুতে পরিণত হয়েছে সতেরো নম্বর গগনবাবু রোডের বাড়ি।

    সেই কতদিন আগেই ওবাড়ির আলো নিবে গেছে। ওই অন্ধকারের দিকে আর ফিরেও তাকাই না আমি। কালো মেঘ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া এক শ্রাবণ মাস বাড়িটাকে মুছে দিয়ে গেছে।

    || ২ ||

    সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে জানালার পাশে রাখা বেতের চেয়ারটায় গা এলিয়ে দেয়ার পর হালকা হাওয়ায় উড়ে বেড়ানো সেই কথাগুলোর ওপর ভর করে কিছু ছবি উঠে এসে সামনে দাঁড়ালো। কতকগুলো হিজিবিজি দাগের মতো। জট ছাড়িয়ে তাদের সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে দেখতে এক ধরনের অনীহা টের পাচ্ছি ঠিকই, তবু আমার চোখের পাতা বুঁজে আসতে চাইছে ভিতর দিকে তাকিয়ে দেখার জন্যে। রঙ জ্বলে যাওয়া পুরোনো অজস্র ছবি, তার সমস্ত ধ্বনিময়তা নিয়ে ভিড় করে দাঁড়াচ্ছে বন্ধ চোখের ওপারে। তারা পিছনে টানছে, দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাচ্ছে আমার অস্তিত্ব। এই মেঘ ছেয়ে থাকা সন্ধে আর দুই আগন্তুক যেন আমার ভিতরের সেই দুটো আলাদা মানুষকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আজ।

    এতদিন পর কিছুটা ঝাপসা হয়ে আছে। আসলে কিছুই মোছেনি। চোখের ছাউনির নিচে ভিজে যাচ্ছে পুরোনো ছবিরা। পায়ের নিচ দিয়ে তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে এক সরু নদী, যে শুধু অতীতকে বহন করে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চলে। খুব ছোট্ট, নির্বাক। তবু তার স্রোতে ভেসে ভেসে চলে এসেছে পুরোনো অধ্যায়গুলো। টুকরো টুকরো কথা, ছেঁড়া ছেঁড়া ছবি। আমার পরিবার, পরিবারের নানা ওঠানামা, ছোট ছোট কালো মেঘ। আপ্লুত করা ভালোবাসার বৃত্ত।

    এসবের বাইরে আমারই রচনা করা আরো এক গুহাচিত্র আমাকে টানছে। বুকের ভিতর থেকে ভেজা মাটির গন্ধ পাচ্ছি, আমর্ম আচ্ছন্ন করে রাখা সেই গুল্মগন্ধ। লোমকূপ ভেদ করে বেরিয়ে আসা এক সবুজ কুয়াশা ঢেকে ফেলছে আমাকে। আমার বর্তমানকে। আমি ক্রমেই যেন শ্যাওলার মত, বাকলে বলিরেখা আঁকা গাছের মতো হয়ে যাচ্ছি। দুটো হাত অসংখ্য ডালপালা হয়ে আকাশ থেকে টেনে আনছে জ্যোৎস্না আর কুয়াশা। গুচ্ছ গুচ্ছ পাতায় ঢেকে যাচ্ছে আমার সমস্ত শরীর। প্রথম সূর্যের আলো ছুঁয়ে দিলেই শুরু হবে সালোকসংশ্লেষণ। পরীবাগানের গাছেদের পাশে আমারও পা গেঁথে যাবে...... কিন্তু এসব আমি কী ভাবছি? এ তো মিলছে না আমার ভাবনার সঙ্গে। আজ আর এইসব পরাবাস্তব আবেগকে তো আমি প্রশ্রয় দিতে চাই না। চাই না ওই প্রথম আলোর স্পর্শ। প্রাণপণে অন্ধকার আঁকড়ে ঢেকে রাখতে চাইছি ওইসব অবান্তর আবেগকে। তবু যেন নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাচ্ছে। অনেক কিছুকে ছাপিয়ে সামনে দাঁড়িয়েছে। প্রায় তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছর আগের এক ঝাপসা ছবি।

    ফলসা গাছের বাঁধানো চাতাল। চাঁদের গুঁড়ো ছড়িয়ে পড়ছে বুকের ভেতর। একদিকে সূর্য উঠছে, অন্যদিকে বাসি চাঁদ লেগে আছে আকাশে। ভয়ে বিবর্ণ ঠোঁটের মাঝখানে অন্য এক ঠোঁটের সরস স্বাদ। ওটা সেই বয়স, যখন শরীরের খোপে খোপে ভয় ও বারুদ পাশাপাশি সাজানো থাকে।

    কিন্তু সেদিন কোথাও খুব তীব্রভাবে শরীর ছিল কি? মনে তো পড়ে না। ছিল শুধু পুড়ে যাওয়া হৃদপিণ্ড, অসম্ভব ক্ষিপ্র রক্তস্রোত। উষ্ণ। প্রবল আগুন। চারপাশ পাহারা দিচ্ছিল পরীবাগানের ঝুপসি গাছপালা। আর প্রথম সেইদিন, ঠিক তখন সেই অভূতপূর্ব আচ্ছন্নতার পাশাপাশি মনে হচ্ছিল ভিতরে খনন চলছে। মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে পথ খুঁজছে একটা আগুনের স্রোত। শরীরী অবশতার সঙ্গে টের পাচ্ছিলাম তলপেট ছিঁড়েখুঁড়ে নেমে আসছে একটা উষ্ণ তরল ধারা। আনন্দ যন্ত্রণা আর ভয় মিলে মিশে এক অদ্ভুত বিহ্বলতা । হৃদপিণ্ডের রক্তক্ষরণই যেন পা বেয়ে গড়িয়ে নামছিল। লজ্জায়, আতঙ্কে বিবশ হয়ে পা দুটো গেঁথে যাচ্ছিল মাটিতে। মাটিও পুড়ছিল সেই তরল আগুনে, পুড়ে পুড়ে লাল হচ্ছিল।

    ওই পরীবাগান সেইদিন থেকেই বুঝি আমার দহনের সঙ্গী।

    তখন কত আর বয়স হবে — বড় জোর এগারো বা বারো। ক্লাস সেভেনে পড়ি। সামনে হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষা। আম্মা বলতেন ভোরবেলায় মাথা পরিষ্কার থাকে, যা পড়বি তা মনে থেকে যাবে। তাই ভোর চারটেয় উঠে পড়তে বসতাম। সোমনাথ তখন ইলেভেন। সেকেন্ডারিতে চোখ ধাঁধানো রেজাল্ট করা সোমনাথ তখন লুকিয়ে কবিতা লেখে, ওর গান গাওয়া বন্ধুদের কথা জোগায়। আমার ছোটবেলার খেলার সঙ্গী। হিংসে মারামারি ঝগড়াঝাঁটি আবার গলায় গলায় ভাব। পাশাপাশি বেড়ে ওঠা।

    সেদিনও এমনি এক ভোরবেলায় উঠে পরীক্ষার পড়া পড়ছি। তখন সবে আলো ফুটেছে, পাখি ডাকতে শুরু করেছে। হঠাৎ সোমনাথ আমার জানালায় এসে ফিসফিস করে আমাকে ডাকলো। আমি বাইরে আসতেই আমার হাত ধরে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে গেল পরীবাগানে। ফলসা আর পলাশ গাছ যেখানে গা ঘেঁসাঘেসি করে দাঁড়িয়ে আছে, যাকে ঘিরে গোল বাঁধানো চাতাল, তারই নিচে। পরীবাগানের নিভৃততম জায়গা ওটা। দিনের বেলাতেও সরাসরি রোদ ঢুকতো না।

    -- চোখ বন্ধ করে গাছের গায়ে কান পাত রূপু।

    -- কেন?

    -- শুনতে পাবি।

    -- কী শুনতে পাবো?

    -- একটা কথা।

    -- কী কথা?

    -- যা অন্য সবাই জানে, আমি জানি। শুধু তুই জানিস না।

    -- কী জানি না?

    -- সে খুব সাংঘাতিক কথা, শুনলে তোর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে।

    -- তাহলে শুনবো না। তুই মুখে বল।

    -- আমি তোকে বলতে পারবো না। তুই গাছের গায়ে কান পেতে শুনে নে।

    ওর কথামতো চোখ বন্ধ করে প্রথমে ফলসা গাছের গায়ে কান পাতলাম। শুনলাম, ‘সোমনাথের বউ রূপু’। ফলসা গাছ ফিসফিস করছে। আবার পলাশ গাছের গায়ে। শুনলাম, ‘সোমনাথের বউ রূপু’। একবার দু’বার তিনবার। বুঝতে পারছিলাম সোমনাথ বলছে। তবু গাছের কাছে শোনার ভান করে শুনছিলাম। শিহরিত হওয়ার জন্যে শুনছিলাম। এক অচেনা শরীরী কম্পনের জন্যে শুনছিলাম।

    আগের রাতে আমার বাবা আর সুবিমল কাকুর কথাবার্তা আড়াল থেকে শোনার পর সারারাত ও নাকি ঘুমোতে পারেনি। ওর মনে হয়েছিল বুকের মধ্যে জ্যোৎস্না ঢুকে পড়েছে, যা সারারাত ধরে রক্তের ভিতর জোয়ার জলের মতো বেজেছে। কথাগুলো আমার দুর্বোধ্য লাগলেও নেশা ধরে যাচ্ছিল। সোমনাথ তখন কবিতায় স্বপ্ন দেখতো, কবিতায় নিঃশ্বাস নিতো। ওর কথা শুনতে শুনতে কিছু না বুঝেও আমার ঝিম ধরা অবস্থা। ফলসা গাছের গায়ে রাখা আমার হাতের ওপর তখন ওর কাঁপা আঙুল রেখেছে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার চোখে। ভেতরে আগুন, হৃদপিণ্ড ফেটে চৌচির। গলা শুকিয়ে আসছে। পালাতে গিয়ে আটকে গেলাম ওর দুই হাতের শিকলে। উত্তপ্ত নিঃশ্বাস লেগে পুড়ে যাচ্ছিল আমার মুখ ঠোঁট গলা বুক। চারপাশের বাতাস স্তব্ধ, তবু পরীবাগানের সমস্ত পাতা তিরতির করে কাঁপছিল আর ফিসফিস করছিল — ‘সোমনাথের বউ রূপু’।

    পা বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। ছুটতে ছুটতে রাঙাদিদার ঘরে। তখনও চোখ থেকে কান থেকে তাপ বেরুচ্ছে। রাঙাদিদা তাঁর অ্যান্টিক কাঠের আলমারি খুলে একমনে কিছু খুঁজছিলেন। এদিকে না তাকিয়েই আলমারির আড়াল থেকে বললেন, ভয় পেয়েছিস?

    -- কী বলছো তুমি? কীসের ভয়? প্রায় বুঁজে থাকা শঙ্কিত গলায় উত্তর দিলাম।

    -- কীসের আর, বেহ্মদত্যির। সকাল সকাল দেখলাম সোম তোকে হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল পরীবাগানে।

    -- আলমারি বন্ধ করে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন রাঙাদিদা। আমি চোখে চোখ রাখতে পারছিলাম না। তখনও ঘোর কাটেনি। আমার মুখ দু’হাতের মধ্যে নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, কোথায় হাত রেখেছে, বুকে?

    ওই বয়সে এর চেয়ে অশ্লীল বাক্য আগে শুনিনি। লজ্জায় রাগে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছিলামা। রাঙাদিদা পেছন থেকে বললেন, আমার কাছেই আবার ছুটে আসবি রে ভাই। তখন কিন্তু এসব শুনতে চাইলেও আর বলবো না। শুধু হরিনাম জপ করবো।

    বলতে বলতে হঠাৎ আঁৎকে ওঠার মতো করে বললেন, ও কী রে, তোর পায়ে রক্ত কেন? কী হয়েছে? কী করেছে ও তোকে?

    আমি ততক্ষণে কেঁদে ফেলেছি। বললাম, কিছু করেনি। শুধু কী সব বলেছে।

    রাঙাদিদা কী বুঝলেন, একটু হাসলেন।

    আমি কাতর গলায় বললাম, আমার কী হয়েছে রাঙাদিদা?

    রাঙাদিদা আমাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বললেন, এ কী, কাঁপছিস কেন! কিছু হয়নি তোর। এতদিনে মেয়েমানুষ হয়েছিস। ঋতুমতী হয়েছিস। এখন শরীরে বীজ পুঁতলেই ফল ফলবে।

    তারপর সবকিছু পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিলেন। হাতে ধরে শিখিয়ে দিলেন প্রতিমাসে এই ভেজা দিনগুলোতে কীভাবে নিজেকে সাবধানে রাখতে হয়। তারপর নিজে আমাকে স্নান করিয়ে আমার গায়ে গঙ্গাজল ছিটিয়ে ঘরে পাঠালেন। চার পাঁচদিন আর ঘর থেকে বার হইনি। নিজেকে অচেনা লাগছিল, ভয় হচ্ছিল। যেন কোনো না-চেনা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি। মনে হলো কী যেন হারিয়ে গেল আমার। একা ঘরে কান্না পেতো।

    পাঁচ ছ’দিন একবারও সোমনাথের সঙ্গে দেখা করিনি। শুধু আড়াল থেকে লক্ষ করতাম ওর চোখ সারাক্ষণ আমাদের বাড়ির দিকে কিছু যেন খুঁজছে। আর আমি বুকের মধ্যে আগলে বসে আছি সেই সরল শিহরিত মুখ। সদ্য গজিয়ে ওঠা সবুজ ঘাসের মতো গোঁফ-দাড়ি। চোখে আকাশের হাতছানি, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পুরুষটিকে। যে তার অনভ্যস্ত কাঁপা হাতে অস্ফুট পাপড়িগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে একটু একটু করে কিশোরী মেয়েটিকে পূর্ণ নারীত্বে পৌঁছে দিল।

    কৈশোরের ভয় আর ভালোলাগায় মেশা সেই স্পর্শ বুঝি তীব্রতম বিদ্যুৎ। ঘরে ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়ালেই মনে হতো সারা শরীরে সেই সব স্পর্শের চিহ্ণ ফুটে আছে। সারারাত সেই চিহ্ণগুলো থেকে সুর ওঠে, স্বপ্নে মধুক্ষরণ হয়। কী এক দুর্নিবার টানে বারবার ছুটে যাই ফলসা গাছের নিচে। যেন আমার জীবনের খানিকটা ওখানে উপচে পড়ে আছে, জীবনের প্রথম স্পর্শের মধু।

    || ৩ ||

    ম্মা কিছু বলতে চাইছিলেন তখন। পাশ কাটিয়ে চলে এসেছিলাম, জানি না কী বলতে চাইছিলেন, এখনো জানার কোনো আগ্রহ বোধ করছি না।

    শুধু মনে হচ্ছে ক্রমেই পা গেঁথে যাচ্ছে, জড়িয়ে যাচ্ছে পুরোনো শিকড়বাকড়ে। ভিজে উঠছে শক্ত মাটির স্তর। একটু একটু করে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে আসছে। আমার শরীর ছেড়ে যেন অন্য একজন ছায়ামানুষ পিছন দিকে হাঁটতে শুরু করেছে, আর চোখ বন্ধ করে বসে আমি তাকে অনুসরণ করছি।

    সদ্য ফ্রক ছেড়ে সালোয়ার কামিজ। পিঠে ডানার মতো উড়ে যাওয়া গোলাপি, সবু্‌জ, হলুদ ওড়না এক কিশোরী। যার চুলের উপর বেশিরভাগ সময় আটকে থাকে কোনো না কোনো ঝরা পাতা। দোলনচাঁপার বোঁটায় ঠোঁট রেখে মধু খেতে গিয়ে চোখ বুঁজে আসে, করবী ফুলের বীজ নিয়ে খেলতে খেলতে ভুলে যায় ওর ভিতরের বিষের কথা। এসবই তার চরিত্রের অলঙ্কার।

    আজকের রূপাঞ্জনা বড্ড বেশি নিরাভরণ। তার চেতনা জুড়ে রুক্ষ মসৃণ পাথরের পথ। কোথাও স্বপ্নের ছিটেফোঁটা দাগও নেই। আর সেই মেয়েটি একটু যেন পাখির মতো, পিঠে একটু যেন ডানার উন্মেষ। ভেজা মাটির মতো উন্মুখ, প্রাণের উচ্ছ্বাসে ভরপুর। যেকোনো কথা যেকোনো স্পর্শেই তার অকপট বিশ্বাস। এতদিন আমি ভুলে গিয়েছিলাম তার কথা। আজ সে তার সমস্ত উজ্জ্বলতা, আবেগ আর সারল্য নিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। উড়ু উড়ু চোখে সে যেন সারাদিন অপেক্ষা করে থাকে কারও ডাকের জন্যে। কারণে অকারণে কেউ তাকে ডাকে--রূপু-উ-উ-উ...আর সেই ডাকের পিছনে ছুটতে থাকে সে। সেই ডাকটা এই মুহূর্তে আমার কানেও যেন একবার বেজে তার অনুরণন রেখে গেল।


    ফলসা গাছের গায়ে দুই ডালের মাঝে একটা খোঁদল মতো ছিল। সেটাকে আড়াল করে রেখেছিল পলাশ গাছ। আমাকে দেওয়া ওর প্রথম উপহার ওইখানে লুকিয়ে রেখে এসেছিল সোমনাথ। আমার সেকেন্ডারি পরীক্ষার আগে একদিন আমি স্কুল থেকে ফিরে বাড়ি ঢুকছি, ও সাইকেল নিয়ে আমাদের গেটের সামনে দাঁড়িয়েছিল।

    -- ফলসা গাছের বুকের ভেতর তোর জন্যে একটা জিনিস রেখেছি। খুঁজে নিস। বলে সাঁ করে সাইকেল চালিয়ে চলে গেল।

    এইখানে শিকড় গেঁথেছি।
    আমার উন্মুখ ডাল ঝড় সইবে বলে
    প্রতিদিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়।
    বৃক্ষ শরীরে লগ্ন উড়ান পাগল পাখি,
    তুমি ডানায় মেখেছ মেঘ, হাওয়াকে বলেছ সরে যেতে,
    বৃষ্টি হয়ে ভাঙাবে পাতার ঘুম,
    তারপর আমাকেও উড়ান শেখাবে?
    খুঁজে খুঁজে আবিষ্কার করলাম ফলসা গাছের বুকের ভিতরের গোপন সিন্দুক। পেলাম সোমনাথের রেখে আসা উপহার এই রত্নটি, ওর লেখা কবিতা।

    তারপর আরও অনেক। যদিও ওর সেইসব কবিতার অর্থ পুরোপুরি বুঝতাম না। কিন্তু হাতে নিলে বুক কাঁপতো, চোখের সামনে সপ্ত সিন্ধু দশ দিগন্তের রহস্য দুলে উঠতো। বুঝতাম না, তবু নিজের মতো অর্থ করে নিতাম, যেমনটা হলে শরীর একটু শিরশির করে ওঠে।

    এর পর থেকে আমার কাজ ছিলো প্রত্যেকদিন একবার করে ওই জায়গাটা খুঁজে দেখা, যদি মিলে যায় কিছু। মিলতও মাঝে মাঝে। কখনও কবিতা, কখনও চিঠি। সেটা নিয়ে একছুটে রাঙাদিদার ঘরে। ওটাই তখন আমার নির্জন গোপনীয়তার একমাত্র আস্তানা। রাঙাদিদা ফলসা গাছের ওই গর্তটার নাম দিয়েছিলেন ‘হৃদয়হরণ লেটার বক্স’। সোমনাথের খুব পছন্দ হয়েছিল নামটা। ও বলতো,

    -- তোর চেয়ে রাঙাদিদার সেন্স ওফ হিউমার বেশি । আমার কবিতাগুলো নিজে নিজে বুঝতে না পারলে রাঙাদিদার কাছে জেনে নিস।

    -- কে বলেছে তোকে আমি বুঝি না তোর কবিতা?

    -- দেখে তো মনে হয় না বুঝিস কিছু। প্রতিক্রিয়াহীন।

    -- কবিতা কি বুঝতে হয়? কবিতা অনুভব করতে হয়। আমি তোর কবিতা চোখে মেখে ঘুমোই, তোর কবিতার ছবি আঁকি।

    সোমনাথ বিস্মিত হয়ে তাকালো আমার মুখের দিকে। যেন নতুন কাউকে দেখছে। বললাম,

    -- তুই কী লিখিস, কেন লিখিস আমি জানি না। জানতে চাই না। আমি যা চাই সেইমতো মানে করে নিই। যেমনটা ভাবতে ভালো লাগে ঠিক তেমনটা। এই আনন্দ তুই বুঝবি না।

    সোমনাথের অপলক চোখ আমার মুখের দিকে। আমার চোখ, নাক, ঠোঁট, গলা, বুকের খাঁজে খেলা করে বেড়াচ্ছে ওর আঙুল। আমার তখন চোখ বুঁজে আসছে, কথা জড়িয়ে আসছে।

    -- কী করছিস সোম?

    -- কবিতা লিখছি, যে কবিতা তুই বুঝতে পারবি। আমিও বুঝতে পারছি।

    কবিতা রচনার সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও যেন নতুন করে রচনা করলো।

    এ পাড়ার বহু মানুষের চোখ ছিল এই বাগানের ওপর। সেইসব চোখ কত যে গোপন ছবি তুলে নিয়েছিল চোখে। আমার পরোয়া ছিল না। কৈশোরে পা রেখেই প্রথম হৃৎস্পন্দনে পেয়েছিলাম ওকে। আমার পরিবার অজান্তেই আমার নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে বুনে দিয়েছিল সোমনাথকে। কোথাও কোনো নিষেধ তো ছিল না। একটু সন্ত্রস্ত থাকতাম আম্মার কথা ভেবে। আমার বাবা আর সুবিমলকাকু তাদের একটা গোপন ইচ্ছেকে লালন করেছিলেন বটে, প্রথম দিকে আম্মার তাতে সায় ছিল না। তীব্র আপত্তি করেছিলেন। তা সত্ত্বেও ‘সোমনাথের বউ রূপু’ এই ছেলেমানুষী কথাটা মর্মরিত হতে হতে হাওয়ায় ভেসে গগনবাবু লেনের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে যে ছড়িয়ে পড়েছিল, সে তো পরীবাগানের গাছেদের কানে কথাটা উঠেছিল বলেই। ওখানে যে হাওয়া বয়, তাতে নেশার গুঁড়ো উড়ে বেড়ায়, স্বপ্নের নেশা। প্রত্যেকটা গাছের বুকের ভিতর বুঝি একটা করে স্বপ্নের গল্প লুকোনো আছে। সূর্য ডুবে গেলেই তারা নিজেদের বুক খুলে দেয়।

    || ৪ ||

    অঞ্চলে একটা জনশ্রুতি লোকের মুখে মুখে ফিরতো যে, পরীবাগানে কেউ কখনো হাতে করে গাছ লাগায়নি। চাঁদনি রাতে উড়ে যাওয়ার সময় পরীদের মুঠো খুলে বীজ ছড়িয়ে পড়ে এখানে। সারারাত কুয়াশায় ভিজে ভিজে তার অঙ্কুরোদ্গম হয়। এভাবেই জন্ম এইসব গাছের। সোমনাথ কোনো অলৌকিক কিছু বিশ্বাস করতো না বলে নিজে চুপি চুপি কতবার বীজ এনে লাগিয়েছে। সে বীজ পচে মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছে। সুবিমলকাকুও নাকি দু’একবার চারা এনে লাগিয়েছেন। প্রথমে তা থেকে হয়তো দু’একটা নতুন পাতাও বেরিয়েছে, তবু শেষপর্যন্ত বাঁচেনি সে গাছ।

    প্রায় দেড় বিঘে জায়গা জুড়ে বাগানটা। এ তল্লাটে এমন ঐশ্বর্যময় বাগান আর নেই। সোমনাথদের অতি সাধারণ ছোট্ট বাড়িটার সঙ্গে যেন বেমানান — এটা আমাদের বাড়ির লোকদের মত। বাবা-কাকাদের মুখে একাধিকবার শুনেছি এমন কথা। কিন্তু আমার মনে হয়, ওই বাড়িটার সঙ্গে আছে বলেই পরীবাগান এমন সপ্রাণ, স্বপ্নময় আর সুরেলা। সুবিমলকাকুর হাতে অর্থ ছিল না ঠিকই, ছিল সুরের ষড়ৈশ্বর্য। খুব ভোর বেলায় বা কখনও কখনও গভীর রাতে সুবিমলকাকু এস্রাজ বাজাতেন, পরীবাগান সেই সুর গায়ে মেখে প্রতিদিন যেন আরও সবুজ হয়ে উঠতো। বাতাস বইলে পাতায় পাতায় সেই সুরের বিস্তার শোনা যেতো। অন্তত আমি তো শুনতে পেতাম, রাঙাদিদাও পেতেন। রাঙাদিদা আমাকে ডেকে বলতেন,

    -- চুপ করে চোখ বন্ধ করে শোন, কাল রাতে সুবিমল যে সুরটা বাজাচ্ছিল, এখন পরীবাগানের ভিতর থেকে ঠিক সেই সুরটা ভেসে আসছে।

    সুবিমলকাকু যখন পরীবাগানের ভিতর ঘুরে বেড়াতেন, গাছের গা থেকে আলতো হাতে শুকনো পাতা সরিয়ে ফেলতেন, এক একটা গাছের কাছে গিয়ে হাসিমুখে দু’দণ্ড চুপ করে দাঁড়াতেন, আমার মনে হতো গাছগুলো সেই হাসি ফিরিয়ে দিচ্ছে।

    বাগানটাকে খানিকটা আদিম অরণ্যের মতো লাগে। যেদিকে কাঠবাদাম গাছ, তার পাশে মনসাতলা, সেই দিকটা দিনের বেলাতেও ঘন ছায়ায় ঢাকা থাকে। কাঠবাদাম কুড়োতে গিয়ে কখনও কখনও গা ছমছম করতো। কত যে অচেনা গাছ। তাদের বয়সও অনেক। বাকলের বলিরেখা দেখে মনে হয় কত যুগ ধরে দাঁড়িয়ে আছে ওইভাবে। আমরা ছাড়া পাড়ার ছোটরা কেউ ভয়ে এ বাগানে ঢুকতো না। বড় মেয়েরা তো নয়ই। পরীর হাওয়া গায়ে লাগলে সে মেয়ের আর কখনো বিয়ে হবে না, এমন একটা বিশ্বাস করতো তাদের মা জেঠিমারা। আম্মা কোনো অলৌকিকতায় বিশ্বাস করতেন না বলে আমার কোনো নিষেধ ছিল না।

    পাশের বাড়ির জেঠিদিদা কতবার গোপনে আম্মার কান বাঁচিয়ে আমাকে সতর্ক করেছেন, পরীবাগানে অত ঘোরাঘুরি করিস না রূপু, বর জুটবে না।

    কিন্তু আমি তো জানি তখন জেনে গেছি পরীবাগানই আমার সঙ্গে গিঁট বেঁধে দিয়েছে আমার বরের। পরম নিশ্চিন্তে বনদেবীর মতো ঘুরে বেড়াতাম। আমার নিশ্বাস-প্রশ্বাস, আমার চোখের পলক পরীবাগানের গাঢ় সবুজ দিয়ে এমনভাবে আচ্ছন্ন ছিলো যে মাঝে মাঝে নিজের শরীর থেকে বুনো গন্ধ পেতাম।

    রাঙাদিদারও এমনটা মনে হত। কখনও বলতেন, নিশ্চয় তুই পরীবাগান থেকে এলি, তোর গায়ে সেগুনমঞ্জরির গন্ধ পাচ্ছি। কখনও বলতেন, কি রে শিউলি বোঁটার রস মেখেছিস নাকি?

    রাঙাদিদার মনে হতো, আমার উপর জনশ্রুতির সেই পরী ভর করে আছে। বলতেন, নিশ্চয় তোর ওপর পরীর ভর আছে, নাহলে তোর চোখ সব সময় এমন উড়ু উড়ু কেন? তুই যখন হেঁটে যাস, মনে হয় ডানায় বাতাস ধরতে ধরতে চলেছিস। বড় হয়ে ওঠার দিনগুলোতে সারাক্ষণ রাঙাদিদার কাছে এমন সব অদ্ভুত কথা শুনে বুকের ভেতর শিরশিরানি টের পেতাম। ভয় লাগতো। মনে হতো আমার পিঠে আবার ডানা গজাবে না তো? মাঝে মাঝে পিঠে হাত দিয়ে পরখ করতাম। নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্যে ভয়ে ভয়ে রাঙাদিদাকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম,

    -- রাঙাদিদা, পরীদের ছায়া পড়ে মাটিতে?

    -- না। কী করে পড়বে, ওদের শরীর কি আর আমাদের মতো রক্তমাংস দিয়ে তৈরি?

    -- তাহলে কী দিয়ে তৈরি?

    রাঙাদিদার কল্পনা এখানে থেমে গেল। কিন্তু আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। আমি তো দেখেছি খুব সকাল বেলায় যখন শিউলি ফুল কুড়োতে যাই, আমারই সমান একটা ছায়া নিচু হয়ে ফুল কুড়োয়। ছুটির দিনে দুপুর বারোটা সাড়ে বারোটায় যেদিন সাঁতার কাটব বলে পুকুরের জলছোঁয়া সিঁড়ির শেষ ধাপে এসে দাঁড়াই, আমার পায়ের কাছে লুটিয়ে থাকে আমার মতো এক ছায়া। আবার হেলে পড়া দুপুরে আম্মার ঘরের লাগোয়া বারান্দায় যখন টিউশনফেরত সোমনাথের পথের দিকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকি, তখন আমার চেয়ে অনেক দীর্ঘ একটা ছায়া গিয়ে পড়ে পরীবাগানের গাছগাছালির ওপর। আমি তো আমার ছায়াকে সঙ্গে নিয়ে থাকি। তখনকার মতো নিশ্চিন্ত হলাম।

    রাঙাদিদা অদ্ভুত সব রূপকথার বীজ পুঁতে দিয়েছিলেন আমার মধ্যে। গোপনে একটা কল্পনার জগৎ তৈরি করে নিয়ে তার ভিতর বাস করতাম। বাস্তবের পক্ষে খানিকটা বেমানান ছিলাম আমি। রাঙাদিদার সঙ্গে থেকে থেকে আমি যে পূর্ব জন্মে পরীদের আত্মীয় ছিলাম, এইরকম একটা অলীক ধারণা আমাকে পেয়ে বসেছিল একসময়। আর সেজন্যেই অবচেতনে পরীবাগানের উপর একটা আশ্চর্য অধিকারবোধ জন্মেছিল আমার।

    আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আমি পরীবাগানের মাটিতে বীজ পুঁতলে তা থেকে নিশ্চয় গাছ বেরোবে। কিন্তু কখনও চেষ্টা করিনি। বিশ্বাসটাকে অক্ষত রাখার জন্যে। এ নিয়ে কখনোসখনো সোমনাথের সঙ্গে আমার ঝগড়া হতো ছোটবেলায়। ও মাঝে মাঝে কারণেই কর্তৃত্ব দেখাতো। একটা শুকনো পাতা সরাতে গেলেও বাধা দিতো। পরীবাগানটা যে ওদের, সেই গর্বে ও নিজেকে রাজার মতো মনে করতো। কৈশোরের স্বপ্নগুলো অনেক নরম অবুঝ, বেহিসেবী থাকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই স্বপ্নের গায়ে ক্ষমতার রঙ লাগে, হিসেবের আঁচড় লাগে। লেগেছিল সোমনাথের মনে। এসব পরে বুঝেছি। চোখের ওপর থেকে স্বপ্নের ঘোর সরে গেছে বলে সব স্পষ্ট দেখতে পাই।

    || ৫ ||

    ছোটবেলায় মেজকা আমাকে আর তোতাকে গাছ চেনাতে নিয়ে যেতেন পরীবাগানে। কোন গাছের কত বয়েস সুবিমলকাকুও জানতেন না। বলতেন,

    -- এ সব গাছগাছালিতে আমাদের যেমন অধিকার, তোদেরও তেমন দাবী। গাছ তো আমাদের নয়, মাটিটুকুই শুধু আমার পিতৃপুরুষের। ওখানে হাতে করে গাছ লাগিয়ে দেখেছি, সে গাছ বাঁচেনি। বীজ লাগালে তা কখনো বা যদি অঙ্কুরিত হয়ও, কিন্তু তা থেকে গাছ হয় না। ওসব গাছ আপনিই জন্মেছে, কারো যত্ন ছাড়া বেড়েছে।

    সত্যিই তো, কাউকে কখনও এইসব গাছের পরিচর্যা করতে দেখিনি। যেটুকু যত্ন লাগে মাটিই তা জুগিয়েছে। সুবিমলকাকুর কথাগুলো শুনতে শুনতে আনন্দে আমার বুক ভরে উঠতো, আর সোমনাথ কেন যেন মুখটাকে কলো করে সরে যেতো। লক্ষ করতাম ওর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। ও বরাবরই ওইরকম অহঙ্কারী ছিল। শুধু বয়ঃসন্ধিতে শরীরের রসায়ন পালটে যাওয়ার সময় কবিতা আর প্রেম এই দুয়ে মিলে খানিকটা অন্যরকম করে দিয়েছিল ওকে। কোমল, স্বপ্নাতুর। হয়তো প্রকৃতির নিয়মে খানিকটা যৌনবোধ। কিংবা হয়তো তখন পরীবাগানের হাওয়া তুক করেছিল ওকে। কিন্তু ওই বাগান যে ওর একটা গর্বের জায়গা, আমাদের আর্থিক প্রাচুর্যের সামনে ওটাই যে ওর উজ্জ্বল অহঙ্কার, সেটা আমি বুঝতে পারতাম। ওর ওই অহঙ্কারের জায়গাটুকু আমাকেও গর্বিত করতো। সোমনাথকে রাজার মতো দেখতে আমারও ভালো লাগতো। একটা তৃপ্তি অনুভব করতাম।

    ফলের গাছ বলতে একটা কাঁঠাল গাছ আর জামগাছ। অনেক অন্যরকম গাছ ছিল যেগুলো আশপাশে সহজে দেখা যেতো না। যেমন ফলসা, আমলকী, কামরাঙা, কাঠবাদাম, হরতুকি। ছিল শিরিষ, সেগুন। আর বেতগাছের ঝোপ। গ্রীষ্মকালে বেতস লতায় থোকা থোকা ফল ধরতো। প্রকৃতির ঐশ্বর্যময় আত্মপ্রকাশ যেন পরীবাগান। ফুল বলতে বেশ কিছু রাধাচূড়া, একটা স্বর্ণচাঁপা, একটা পলাশ। হ্যাঁ, আর ছিল ঘিয়ে রঙের একটা জবা গাছ। রাঙাদিদা বলতেন— ‘ওটা পরীজবা। পরীদের গায়ের রঙ ওরকমই হয়।’ সারা বছর ফুল ফুটতো গাছটাতে। কিন্তু ও গাছের ফুল কেউ ছিঁড়তো না। সবসময় গাছটার গোড়ায় একটা মনসা-ঘট রাখা থাকতো বলে ওই জায়গাটাকে সবাই বলতো মনসাতলা। শ্রাবণ মাসে ওখানে মনসা পুজো হতো। আমরা ছোটবেলায় সচরাচর গাছটার কাছ ঘেঁসতাম না। কাঁঠাল গাছটার গা জড়িয়ে উঠেছিল একটা বেলফুলের লতা, যেটা ছিল আমার জানালার পাশে। সারাটা গ্রীষ্ম আর বসন্ত আমার ঘর ভরে থাকতো বেলফুলের গন্ধে।

    সুবিমলকাকুরা আমাদের দীর্ঘদিনের প্রতিবেশী, আত্মীয়ের অধিক। সুখে-দুঃখে হাত ধরাধরি করে পাশাপাশি চলা। আম্মা যেন একটু বেশি দায়বদ্ধ ছিলেন ওদের প্রতি। বরাবর না চাইতেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন, ছুটে গিয়ে পাশে দাঁড়াতেন। এখন মাঝে মাঝে মনে হয় ওটা কি আম্মার ইনভেস্টমেন্ট ছিল? বাগানটার প্রতি ওঁর কি অত্যধিক মনোযোগ ছিল না? হয়তো গোপনে একটা লোভও ছিল। পরীবাগান যেন আম্মার বুকের মধ্যে বসানো ছিল। আম্মা বাগানের দিকে না তাকিয়েই বলে দিতেন, জামগাছে মুকুল এসেছে। কাল রাতে গন্ধ পেলাম। কখনও বা বলতে শুনেছি— ‘ক’দিন হলো শিরিষ গাছটায় ফুল ফুটেছে, রোজ বিছানা ঝাড়তে গিয়ে ঝরা রেণু পাই।’

    সুবিমলকাকু খুব চমৎকার ফ্রি-হ্যান্ড স্কেচ



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০ | পর্ব ১১ | পর্ব ১২ | পর্ব ১৩ | পর্ব ১৪ | পর্ব ১৫ | পর্ব ১৬ | পর্ব ১৭ | শেষ পর্ব
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments