আমাদের বাড়ির পুরুষরা সবাই খুব বাধ্য, সচ্চরিত্র এবং মাতৃভক্ত বলে পরিচিত পাড়া প্রতিবেশিদের মধ্যে। কেউ কেউ আড়ালে অবশ্য একটু অন্যভাবে বলে - গুহবাড়ির পুরুষমানুষগুলো সব ভেড়া। যে যাই বলুক, আমি জানি তাঁদের এই বশ্যতাটা আসলে মুখোশ। ঘর শান্ত রাখার একট কৌশল। সবাই মা চণ্ডীর পায়ে মাথা ঠোকে নিজেদের দুর্বল জায়গাগুলোকে মেরামত করার জন্যে। ছোটখাটো কিছু খুচরো পাপ, সেজন্যে কিছু অপরাধবোধ, তা থেকে নিজেদের মুক্ত করার জন্যে তাঁদের এই দৈবনির্ভরতা। গৃহদেবতার কাছে আত্মসমর্পণ। কিন্তু আত্মসমর্পণ করলেও মা চণ্ডী যে সবসময় তাঁদের পাশে থেকেছেন, সেটা জোর দিয়ে বলতে পারি না। ক্ষমা হয়তো পেয়েছেন, কিন্তু অপরাধগুলো প্রকাশ হয়ে গেছে।
অল্প বয়সে পূর্ণেন্দু গুহ অর্থাৎ আমার দাদু নাকি একআধটু গল্প কবিতা লিখতেন। সেই সুবাদে বিভিন্ন পত্রিকার অফিসে অল্পবিস্তর যাতায়াত ছিল। আর তারই প্রভাবে হয়তো সেইসময় তাঁর মাথায় হঠাৎ পাব্লিকেশানের ভূত চেপে ছিল। তখনই কলেজস্ট্রিটে একটা পুরোনো দোতলা বাড়ি কিনেছিলেন। শুরুতে নাকি বেশ জমিয়ে নিয়েছিলেন। লাভও হচ্ছিল। তখনকার অনেক নামকরা লেখকের বই বেরিয়েছিল দাদুর প্রকাশনা থেকে। পরে নানা কারণে আর চালাতে পারেননি। আসলে পূর্নেন্দু গুহ কোথাও কোনো কাজে খুব বেশিদিন মনোনিবেশ করতে পারতেন না। কাজেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাঁর অমৃতধারা প্রকাশন।
অন্য এক পাবলিশারকে দোতলার অংশটা ভাড়া দিয়ে দেওয়া হয়। আর আম্মার পরামর্শে এক তলাটায় রঙের দোকান করা হয়। বার্জার-এর ডিলারশিপ ছিল আমাদের। তিন-চারজন কর্মচারিই সবকিছু সামলাতো। কিন্তু দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল মূলত মেজকার ওপর। দোতলাটা একটু নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। পাবলিকেশন হাউসটা নিজস্ব বাড়ি করে অন্যত্র উঠে যাওয়ার পর ছোটকা অনেকবার আম্মাকে বলেছেন, বাড়িটা ভেঙে নতুন করে ওখানে একটা নার্সিংহোম করার কথা। আম্মা কিছুতেই মত দেননি। দোতলাটা তাই তালাবন্ধ হয়ে পড়েছিল। বাবা মারা যাওয়ার কিছুদিন পর আম্মা হঠাৎ একদিন মেজকাকে ডেকে বললেন,
- কলেজস্ট্রীটের বাড়িটা বিক্রি করে দেব ভাবছি।
- কেন, হঠাৎ?
- হঠাৎ না, অনেকদিন থেকে ভাবছিলাম।
- কিন্তু রঙের ব্যবসাটার কী হবে?
- তিনটে বাড়ি পরে এশিয়ান পেইন্টস-এর অত বড় শোরুম রমরমিয়ে চলছে। আমাদেরটা তো খুব একটা ভালো চলে না। আর তুইও তো ওদিকে খুব একটা মনোযোগ দিতে পারিস না। শুধু মাইনে করা কর্মচারির ওপর ভরসা করে তো আর ব্যবসা চালানো যায় না দীপু।
মেজকার মনোযোগ তখন সত্যিই অন্যদিকে।
মেজকার বন্ধু এবং কলিগ নির্মাল্যকাকু অকালে মারা যাওয়ার পর থেকে শান্তা কাকিমা আর ওদের একমাত্র মেয়ে তুলতুলের দেখাশোনার দায় কবে কখন মেজকা তুলে নিয়েছেন, আমরা কেউ বুঝতে পারিনি। শান্তা কাকিমা মেজকাকিমার দূর সম্পর্কের বোনও বটে। মানবিকতার দায়টা খানিকটা অন্য স্তরে পৌঁছে গেল এক সময়। মেজকা বারাসাতের একটা স্কুলে পড়াতেন। স্কুল থেকে বেরিয়ে সোজা আনন্দপালিত রোডে শান্তা কাকিমার বাড়িতে যাওয়াটা মেজকার রোজকার রুটিন ছিল। সেই কারণেই অধিকাংশ দিন কলেজস্ট্রিটের দোকানে আর যাওয়া হতো না। এসব খবর আম্মার কাছে পৌঁছে যেত সলিলকাকার মারফত। সলিলকাকা আমাদের অনেক দূরের আত্মীয়। চাকরিবাকরি পাননি বলে আম্মা তাকে আমাদের ব্যবসার কাজে ডেকে নিয়েছিলেন। মেজকার বকলমে সলিলকাকাই রঙের দোকান সামলাতেন।
ব্যাপারটা আর একটু স্পষ্ট হলো একবার পুজোর সময়। আমাদের বাড়িতে খুব জাঁকজমক করে দুর্গাপুজো হতো তখন। মহালয়া থেকে লক্ষ্মীপুজো পর্যন্ত আত্মীয়স্বজনে বাড়ি ভর্তি থাকতো। নির্মাল্যকাকুও আসত। তুলতুলের জন্মের আগে কয়েকবার অষ্টমীর দিন শান্তা কাকিমাকে আসতে দেখেছি। সেই দেখাটা প্রচুর লোকজনের ভিড়ের মাঝে অন্যতম অতিথি হিসেবে দেখা। তবু শান্তা কাকিমা তাদের মধ্যে অনন্য বলে আমার মনে ওঁকে ঘিরে একটা মুগ্ধতা ছিল। চেহারা সাজগোজ, কথাবলার ভঙ্গী সবকিছু মিলিয়ে খুব আকর্ষণীয় লাগতো। বড়দের সঙ্গে সঙ্গে আমার আর তোতার প্রতিও সমান মনোযোগ ছিল ওঁর। আমাদেরকেও খুব গুরুত্ব দিতেন, আমাকে তো বটেই। খুব ভলোবাসতাম আমি শান্তাকাকিমাকে।
নির্মাল্যকাকু মারা যাওয়ার দু’বছর পর যেবার পুজোয় মেজকার সঙ্গে শান্তাকাকিমা এলেন, তুলতুলের বয়স তখন সাড়ে চার বছর। অসম্ভব ফুটফুটে, পাখির মতো কথা বলে। সবার আদরে আহ্লাদে ও ওর গল্পের ঝুলি খুলে দিল। মন দিয়ে আমরা সেই সব গল্প শুনছিলাম। আর ওর সেই কথার ফুলঝুরি থেকে এমন অনেক না জানা তথ্য বেরিয়ে এলো, যা মেজকাকিমার পক্ষে খুব সুখকর ছিলো না। দেখলাম আম্মাও হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন।
লক্ষ্মীপুজোর ঠিক আগের দিন মেজকার সঙ্গে মেজকাকিমার খুব ঝগড়াঝাটি হলো, যেটা সচরাচর উচ্চকিতভাবে আমাদের বাড়িতে আমরা কখনো হতে দেখিনি। মেজকাকিমা সারাদুপুর আমার মায়ের কাছে শুয়ে কান্নাকাটি করলেন। আমি আর তোতা সারাদিন মনখারাপ করে ঘুরলাম। রাতের বেলায় আম্মা মেজকাকে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে অনেক কথা বললেন। কৌতূহল থাকলেও আম্মার ঘরে যাওয়ার সাহস ছিল না, শুধু ওপরে ওঠার সময় আম্মার ঘরের পাশ দিয়ে ধীর পায়ে যেতে যেতে একবার কানে এলো আম্মার ঠান্ডা কন্ঠস্বর,
-যা খুশি তাই করার ইচ্ছে থাকলে তুমি নিজের দায়িত্বে বাড়ির বাইরে গিয়ে থাকবে।
তখন থেকে শান্তাকাকিমাদের সঙ্গে আমাদের বাড়ির যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। আমি অবশ্য আম্মাকে না জানিয়ে আরও দু’তিনবার গেছি ওদের দুজনের আকর্ষণে। লেডি ব্রেবোর্নে আমার ক্লাসমেট ছিল সায়ন্তনী। ওদের বাড়ি আনন্দপালিত রোডে। তুলতুলদের পাড়াতেই। একবার সরস্বতী পুজোর সময় সায়ন্তনীর সঙ্গে ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম। পাড়ার পুজোমন্ডপে আরো দু’তিনজন বাচ্চার সঙ্গে খেলছিল তুলতুল। আমাকে দেখতে পেয়ে টানতে টানতে নিয়ে গিয়েছিল ওদের বাড়ি। তখন মেজকার যাওয়া আস নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। কিন্তু শান্তাকাকিমার আন্তরিকতায় কোনো পার্থক্য বুঝিনি আমি।
এরপরের বছর আমি আর সোমনাথ এন্টালিতে রথের মেলায় গিয়েছিলাম, উদ্দেশ্য পাখি কেনা, বদ্রিকা। পরীবাগানের এক কোনে জাল দিয়ে ঘিরে সেখানে পাখিরালয় বানাবো এটা আমার মস্তিষ্কপ্রসূত হলেও সোমনাথেরও মনে ধরেছিল আইডিয়াটা। পাখি পোষাও হলো, আবার পাখিদের খঁচাবন্দীও হতে হলো না। এমনিতে পরীবাগানে নানারকম পাখি আসে। তারা ফল খায়, পাতা খায় উড়ে চলে যায়। আম্মার খুবএকটা পছন্দ নয় পাখি পোষা, আমি জানি। কাজেই চুপিচুপি রথের মেলায়।
পাখি দেখছি, কানে এলো ‘রূপুদিদি’। তাকিয়ে দেখি আমাদের উল্টোদিকে একটা টিয়াপাখির খাঁচার সামনে শান্তা কাকিমা আর তুলতুল। কাছে যেতেই দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো।
- রূপুদিদি তুমিও পাখি দেখতে এসেছ?
- পাখি কিনতে এসেছি।
- কিনে কী করবে?
- আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাবো।
- পাখির মাকেও নিয়ে যাবে তো?
- মাকে বাবাকে সব্বাইকে নিয়ে যাবো।
হঠাৎ দেখলাম তুলতুলের মুখটা একটু মেঘলা হয়ে গেল। নিচু হয়ে তুলতুলকে আদর করলাম। বললাম, আমি তো ভেবেছি এই পাখিটাকেও নিয়ে যাবো।
শান্তাকাকিমা সোমনাথের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি সুবিমলদার ছেলে না?
একটু থেমে তুলতুলের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে আমাকে বললেন, ওর বাবাও প্রতিবার রথেরমেলায় এসে পাখি কিনতেন। কেন জানিস? উড়িয়ে দেওয়ার জন্যে।
তুলতুল তাড়াতাড়ি বললো, পাখি ওর মায়ের কাছে ফিরে যাবে বলে।
পাখি আর কেনা হলো না। আমাদের জোর করে বাড়ি নিয়ে গেলেন শান্তাকাকিমা।
জানিনা মেজকার সঙ্গে ওঁর কতটা আবেগের সম্পর্ক ছিল। সম্পর্কটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল কি যাতে তাঁর দাম্পত্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়? নাকি মেজকাকিমা রজ্জুতে সর্প দর্শন করেছিলেন? শান্তাকাকিমাকে ঘিরে যে কোনো মানুষেরই মুগ্ধতা জাগবেই। মেজকার হয়তো মুগ্ধতার সঙ্গে কিছু সহানুভূতি মিশেছিল। আমি কেন জানি না কোনোদিন শান্তাকাকিমার প্রতি কোনো বিরূপ ধারণা অনুভব করিনি। অথচ আমার সাদাসিধে মেজকাকিমাকে আমি খুবই ভালোবাসতাম। বাড়ির সঙ্গে ওদের দূরত্বের কারণেই ধীরে ধীরে আমিও আর যোগাযোগ রাখতে পারিনি।তখন আমার নিজের জগৎ রঙিন হতে শুরু করেছে,নিজের স্বপ্ন নিয়েই আমি মশগুল। মেজকার কথা জানি না। কিন্তু গুহবাড়ির ফ্রেম থেকে আপাতদৃষ্টে ওরা মুছে গেল। কিন্তু শান্তাকাকিমা আর তুলতুল আমার মন থেকে মোছেনি কোনোদিন।
মেজকাকিমার সঙ্গে মেজকার সেই অশান্তি মিটতে অনেকদিন লাগলো। মেজকা স্কুল থেকে সোজা বাড়ি চলে আসতেন, খুব প্রয়োজনে মাঝে মাঝে যেতেন কলেজস্ট্রিটের দোকানে।
কলেজস্ট্রিটের বাড়ি বিক্রির কথা শুনে মেজকা তাই একটু অবাক। আম্মার খোঁচা সামলে নিয়ে সহজ হওয়ার চেষ্টা করলেন,
-বাড়িটা বিক্রি করবে কেন মা? অত চমৎকার পজিশান, দেবুও তো কতবার বলেছে ওখানে একতা নার্সিং হোম করার কথা। সেটাও তো করা যায়।
-দেবু সল্টলেকে নিজের ফ্ল্যাটে রোগী দেখে, ভবনীপুরের চেম্বার সামলায়। আবার একটা নার্সিংহোম করলে আমাদের ভবানীপুরের চেম্বার উঠিয়ে দিতে হবে।
-তোতাও তো আছে। ও যদি ভবিষ্যতে নিজের মত করে কিছু করতে চায় ওখানে...
-তোতার ভাবনা আমি ভাববো দীপু। তা নিয়ে তোকে মাথা না ঘামালেও চলবে। বাড়িটা আমি বিক্রি করে দেব। বেশ তুমি যা ভালো বোঝো। কাগজে বিজ্ঞাপন দেব?
-না, তার দরকার নেই। লোক ঠিক হয়ে গেছে। তোমাদের জানানো দরকার তাই জানালাম। দেবুকেও জানিয়েছি। তার কোনো আপত্তি নেই।
-কবে কবে এসব ঠিক হলো মা? কিছুই টের পেলাম না।
-এই পরিবারে আজ পর্যন্ত যা যা ঘটেছে, যেভাবে সব কাজ এগিয়েছে, তার কতটুকু তোমরা টের পেয়েছ?
আম্মার এই আকস্মিক সিদ্ধান্তে সবাই খানিকটা অবাক হলেও কেউ আর কোনো প্রশ্ন তুললো না। বাড়িটা অন্য একজনের নামে রেজিস্ট্রি হয়ে গেল। একদিন তোতার কানে এলো মেজকা আর মেজকাকিমার আলোচনা,
-তা কোটি টাকা তো হবে।
ওর বিশ্বাস কলেজস্ট্রিটের বাড়ির কথা বলছেন ওঁরা।
এটা শুনে রাঙাদিদা কিছু ভাবলেন। তারপর আমাকে চুপিচুপি বললেন,
-ও বাড়ি বিক্রি হয়নি। দানপত্র হয়েছে। যার নামে ওটা রেজিস্ট্রি হয়েছে তার নাম কৃষ্ণেন্দু গুহ। এ কথা কিন্তু কাউকে বলিস না।
আমার ভেতর মুহূর্তে বিদ্যুৎ চমক হয়। আন্দাজ করতে চেষ্টা করি কৃষ্ণেন্দু গুহ কে হতে পারে। আমার দাদু পূর্ণেন্দু গুহর সঙ্গে কোথায় যেন একটা যোগ আছে নামটার। আমাদের বাড়িতে অন্য কারো মুখে কখনো শুনিনি, কিন্তু রাঙাদিদার কাছে শুনে শুনে প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছিলাম সেই মানুষটাকে।
-কিন্তু কৃষ্ণেন্দু গুহকে চিনলেন কী করে আম্মা?
-তাদের সব খবরই রাখে তোর আম্মা। তোর দাদু মারা যাওয়ার পর বহুবার টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করেছে ওদের।
-কই আম্মাকে দেখে তো কখনও বুঝতে পারি না সে কথা।
-ওকে ঠিকভাবে কে কবে বুঝতে পেরেছে। মানুষটা যে কোন ধাতুতে গড়া সেটাই বুঝতে পারলাম না আজ পর্যন্ত।
-দাদু কবে মারা গেছেন রাঙাদিদা?
সে কথা আমিও জানিনা। তিনি মারা গেলে ওরা তোর আম্মাকেও তো জানায়নি। আসলে তোর আম্মার সামনে দাঁড়ানোর সাহস ছিল নাকি? মৃত্যুর প্রায় সাত-আট মাস পরে জানতে পেরেছে দিদি। ওরা তখন জামশেদপুরে ভাড়াবাড়িতে থাকতো। আমার শুধু একটাই খচখচানি থেকে গেল মনের মধ্যে।
-কিসের খচখচানি?
-মানুষটা চলে গেলেন, অথচ দিদি আর তার ছেলেরা কোনো পারলৌকিক কাজ করলো না।
-পারলৌকিক কাজ না করলে কী হয়?
-মানুষের আত্মা শান্তি পায় না।
-তা সময়মতো খবর না পেলে করবে কেমন করে?
-তবু পরে যখন খবর পেলো তখন তো একটু কিছু করতে পারতো। আমি কিন্তু খবর শোনার পর তিনদিন হবিষ্যান্ন খেয়েছি।
-তারপর আম্মা যখন খবর পেলেন তখন কী হলো?
-দিদি শীতলবাবুকে পাঠিয়েছিলেন জামশেদপুরে।
-কেন?
-সে আমি জানি না। তবে এর মাসখানেক পরে কৃষ্ণেন্দু এসেছিল এখানে।
-আমাদের এই বাড়িতে? আমি দেখেছি তাকে?
-দেখেছিস হয়তো, খেয়াল করিসনি। কত লোকই তো কত কাজে আসে যায়।
-ওরা এখন কোথায় থাকে?
-মামাবাড়িতে। শ্রীরামপুরে।
এই কৃষ্ণেন্দু গুহ যে পূর্ণেন্দু গুহর দ্বিতীয় উত্তরাধিকার বহন করছে, সেটা জেনে আমার খুব অবাক লেগেছিল। আমাদের পারিবারিক সম্পত্তিতে তার অধিকারকে কি তাহলে স্বীকৃতি দিলেন আম্মা? না কি এটা পূর্ণেন্দু গুহর খেয়ালখুশি বলি ওঁরই মতো অন্য একজন নারীর প্রতি সহমর্মিতা? কিংবা নিজের কাছে নিজের ভাবমূর্তিটাকে আরো খানিকতা উজ্জ্বল করে নেওয়া?
আম্মাকে আমি যত দেখেছি ততই অবাক হয়েছি। কিছুতেই পুরোপুরি বুঝে উঠতে সত্যিই পারিনি। রমলা গুহ যে সাধারণ কোনো মহিলা নন, এটা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি। বড় হয়ে আর একটা জিনিস আমি আবিষ্কার করেছি – বাবা কাকাদের নাম ছিল সব দাদুর সঙ্গে মিলিয়ে, এমনকি তাঁর দ্বিতীয় সংসারের যে ছেলে তার নামেও এই সূত্রটি রক্ষিত হয়েছিল। আমাদের প্রজন্মের বেলায় সেই সূত্রটি ছিঁড়ে দিয়েছিলেন আম্মা। সচেতনভাবেই হয়তো। আমি রূপাঞ্জনা, তোতা রূপদর্শী, আর ছোটকার দুই ছেলে রূপম আর রঙ্গন। আমরা ডাকি রূ আর রন বলে। আমাদের প্রজন্মের সূত্রটি রমলা গুহর সঙ্গে বাঁধা হয়ে গেল। রমলা গুহ যেন একটা আলাদা প্রতিষ্ঠান। যে নিজের শর্তে বাঁচে।
বাড়িতে আলাদা ঠাকুরঘর ছিল। শুনেছি আগে নিত্যপুজোও হতো। কিন্তু পুজোআচ্চা নিয়ে আম্মার নিস্পৃহতা দেখে আমার মাঝে মাঝে খুব অবাক লাগতো। আম্মা যেন এক অন্য জগতের মানুষ। দাদু চলে যাওয়ার পর আম্মা তখন তার তিন নাবালক সন্তান আর এক বিধবা বোন নিয়ে দিশেহারা, শ্বশুরবাড়ির অগাধ সম্পত্তি, তবু তার সামনে কপর্দকহীনের মতো অসহায়। কী করণীয় সেটা ঠিক করে উঠতে পারছেন না। চারপাশে কোথাও একটাও সাহায্যের হাত দেখতে পাচ্ছেন না। কারণ সবাই দাদুর বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্যে আড়ালে আম্মাকেই দায়ী করছে। সম্পর্কে আম্মার জা যিনি আম্মাকে পছন্দ করতেন, স্নেহ করতেন, একদিন সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে বললেন,
-ভগবান যা লিখে দিয়েছেন কপালে তা তো ঘটবেই। কী আর করবি, সবই ভাগ্য।
-সেকথা বললে তো আমি মানবো না। আমার ভাগ্য তো মানুষের তৈরি করা। এর মধ্যে ভগবানকে টানছো কেন?
-এই কটকটে কথার জন্যেই তোর আজ এই দশা।
-তাই যদি মনে হয় আমাকে সহানুভূতি জানাতে এসো না।
-অত গুমোর নিয়ে থাকলে বাঁচবি কী করে? নিজেকে একটু পালটা।
-নিশ্চয় পালটাবো, নাহলে টিঁকে থাকবো কী করে?
-শোন একদিন আমার গুরুদেবের কাছে নিয়ে যাবো তোকে।
-কেন?
-দীক্ষা নিবি।
-এখন হঠাৎ দীক্ষা নিতে যাবো কেন?
-দীক্ষাটা নিলে গুরুদেবই তোকে পথ দেখাবেন।
-আমার পথ আমাকে নিজেকেই দেখে নিতে হবে দিদি।
-মনটাকে তো আগে শান্ত করতে হবে। দীক্ষা নিলে মনে শান্তি পাবি। গুরুদেবই তোকে বলে দেবে কেমন করে ভগবানের চরনে আশ্রয় পাওয়া যায়।
-এখন আমার ভগবানের চরনে পৌছোলে চলবে না। ছেলেদের মানুষ করতে হবে। তাদের প্রাপ্য তাদের পাইয়ে দিতে হবে। আর শোন, দুঃখ কষ্ট আমি ভুলতে চাই না। সেটা ভুললে তো আমার লক্ষ্যে পৌঁছোনোর ইচ্ছেটাই থাকবে না। তোমরা আমাকে আশীর্বাদ করো এই কাজটুকু যেন আমি ভালোভাবে করতে পারি। আর গুরুর সাহায্য ছাড়া যদি ভগবান আমার প্রার্থনা শুনতে না পান, তোমরা কেউ ভগবানের দরবারে আমার এই ইচ্ছেটুকু পৌঁছে দিও আমার হয়ে।
আম্মা বরাবর ওরকমই। আমিও দেখেছি, প্রতিদিন সকালবেলায় স্নানটান করে একবার অবশ্য ঠাকুরঘরে ঢোকেন, প্রণাম করে বেরিয়ে আসেন। বাড়াবাড়ি নেই কোন। আম্মার সব আচরণই খুব নিয়ন্ত্রিত। মা কাকিমারাও নিয়ম করে ঠাকুর ঘরে গিয়ে দুটো ফুল দিয়ে প্রনাম করেন। প্রতিদিন সন্ধেবেলায় শঙ্খধ্বনি শোনার পর যে যেখানেই থাকুক, সেখান থেকে হাত জোড় করে কপালে ঠেকান।
ঠাকুর দেবতা নিয়ে আমারও খুব কিছু আগ্রহ ছিলা না। সেটা আম্মার প্রভাবে কিনা জানি না। কিন্তু রাঙাদিদার পূজার্চনার অভিনব প্রকরণটুকু আমি উপভোগ করতাম। অজানা এক শক্তিকে পুতুল খেলার অন্তরঙ্গতায় নামিয়ে আনার মধ্যে যে অদ্ভুত সারল্য এবং বিশ্বাসের জোর, সেটাই ভালো লাগত আমার। তাদের সঙ্গে সুখ দুঃখের কথা বলতেন, যেন কোন নিকটজনের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছেন নিজের ভালোমন্দ। আমার শুধু মনে হতো ঈশ্বরের প্রতি ভক্তির চেয়ে সন্তানের স্নেহে এঁদের লালন করার আনন্দ বেশি পেতেন।
সন্ধে বেলায় যখন পুজো আরতি করতেন, ওঁর ঠাকুরদেবতাদের শয়ন দিতেন, আমি পড়া ছেড়ে এসে প্রত্যেকদিন চুপটি করে বসে ওঁর কাজগুলো দেখতাম। বৃহষ্পতিবারে সুর করে লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়তেন, শুনতে ভালো লাগতো। আমি ওঁর পাশটিতে বসে ধুনুচিতে ধুনো ছড়াতাম, প্রদীপের সলতে উস্কে দিতাম। আড় চোখে আমার দিকে চেয়ে মুচকে হাসতেন। কখনও বলতেন, অমন ডানা মেলে বসেছিস কেন, আগুন লেগে যাবে যে। ডানা পুড়ে গেলে পরীবাগানে ওড়াউড়ি বন্ধ হয়ে যাবে। ওড়নাটা গুটিয়ে বোস।
প্রায়ই ছুটির দিনে সকালবেলায় ওঁকে ছোট্ট পিতলের বাটি ভর্তি করে চন্দন ঘসে দিতাম। রাঙাদিদা বেলপাতায় চন্দন মাখিয়ে শিবলিঙ্গের গায়ে ছোঁয়াতেন, তারপর সেটা আমার আঁচলে বেঁধে দিয়ে বলতেন-এই শিবঠাকুরকে তোর আঁচলে বেঁধে দিলাম। তার আর ছাড়ান নেই। আমি চুপটি করে বেলপাতাটাকে পুকুরের জলে ভাসিয়ে দিতাম।
ওঁর কথার ধরণই এরকম। আমার স্বপ্ন, প্রেম, প্রত্যেকটা চাওয়া পাওয়ায় রাঙাদিদার সস্নেহ প্রশ্রয় ছিল। আমার জীবনের প্রতিটি সুখের মুহূর্তকে রাঙ্গাদিদা উপভোগ করতেন, মনে হতো ওগুলো যেন ওঁরই জীবনের অঙ্গ। এখন বুঝি নিজের জীবনের সমস্ত অপূর্ণ সাধ আহ্লাদগুলো আমার ভেতর দিয়ে মিটিয়ে নিতেন।
আমার জীবন থেকে সোমনাথ অধ্যায়টা শেষ হয়ে যাওয়াতে ওঁরও যেন হঠাৎ স্বপ্নভঙ্গ হলো। যেন আরও বেশি করে নিজেকে জড়িয়ে নিলেন ওঁর ঠাকুর দেবতাদের সঙ্গে।
রাঙাদিদাকে বাদ দিলে, আমাদের পরিবারের পুরুষদেরই ঠাকুরদেবতায় বেশি ভক্তি ও দুর্বলতা ছিল। সকালে কোর্টে যাওয়ার আগে বাবাঠাকুরঘরের সামনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ করজোড়ে অনেকক্ষণ বিড়বিড় করতেন। মেজকা তো রীতিমতো ফুলচন্দন সহ তাঁর প্রার্থনা জানিয়ে তবেই বেরোতেন। এমন কি আমার ডাক্তার ছোটকাকেও ঠাকুরঘর দর্শন না করে কোনোদিন বড়ির বাইরে যেতে দেখিনি। এমনকি তোতাও।
ছোটবেলায় স্কুলে যাওয়ার সময় আমি ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে ‘মা আসি, আম্মা আসি’ বলে বেরিয়ে যেতাম। তোতা অন্য কাউকে কিছু বলতো কি বলতো না, কিন্তু ঠাকুরঘরের চৌকাঠে মাথা ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে কী সব বলে তবেই বেরোতো। একদিন বেশ অসন্তোষ নিয়ে আমাকে বললো, রূপুদি, তুই মাকে না বলে স্কুলে যাস?
অবাক হয়ে বললাম, আমি তো রোজই স্কুলে যাওয়ার সময় মাকে, আম্মাকে বলে যাই।
ও বিরক্ত মুখে বললো, ওদের কথা কে বলেছে, আমি মা চণ্ডীর কথা বলছি রে।
-তা রোজ রোজ তুই কী বলিস মা চণ্ডীকে?
-সে সব আছে আমার নিজের কথা, তোকে বলবো কেন?
আমি তো অবাক। মেজকার একমাত্র ছেলে,আমার চেয়ে মাত্র দু’বছরের ছোট। ও তো সারাদিন আমার সঙ্গে হিংসুটেপনা করে। মারপিট, ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকে। তবু আমার পিছু ছাড়ে না। আমি অন্যায়ভাবে বকলেও একটু রাগ করে থেকে আবার ঘুরঘুর করে আমার কাছে। সেদিন বুঝলাম ও আসলে বড্ড ভালোবাসে আমাকে। তাই না আমার হয়ে ওকালতি করছে।
বরাবর আমাদের খুব প্রশ্রয় দিতেন ছোটকা। আমাদের নিয়ে নানারকম খেলাধুলা করতেন, বেড়াতে নিয়ে যেতেন, গল্প শোনাতেন। সারাদিন আমাদের দুজনের নালিশ চলতো ছোটকার কাছে। শুনতেন, সমাধান করে দিতেন। কিন্তু আমাদের এত ঘন ঘন ঝগড়া হতো সব তুচ্ছ কারণ নিয়ে যে নালিশ শুনতে শুনতে ছোটকা এক একদিন খুব রেগে যেতেন, চড় চাপড়টা জুটতো অবশ্য তোতার কপালে। এতে তোতার ওপর মায়া হলেও ছোটকার ওপর আমার ভক্তি আর ভরসা বেড়ে যেতো। জিতে যাওয়ার আনন্দে মনে মনে আহ্লাদিত থাকতাম। ছোটকা ইচ্ছে করে সব সময় জিতিয়ে দিতেন আমাকে। আমার অন্যায়ের পিছনেও কিছু না কিছু যুক্তি খাড়া করতেন। কিন্তু আমার সেই জয়ের আনন্দ চুপসে গেল সেইদিন, ছোটকার বিয়ের সময় তোতা যেদিন নিতবর সেজে আলো আলো মুখ করে গাড়িতে ছোটকার পাশটিতে গিয়ে বসলো। তোতাকে অমন সুন্দর সাজগোজ করতে দেখে এতটাই কষ্ট পেয়েছিলাম, যে ওর পাশাপাশি নিজেকে ঘঁটে কুড়ুনির মতো মনে হচ্ছিল। আমার মুখ ভার দেখে ছোটকা আমার কানে কানে বললেন,
-ও তো মিথ্যে বর। মিথ্যে সেজে লাভ কী? তুই বড় হয়ে সত্যিকারের বউ সাজবি।
-তখন তো তোমার পাশে বসতে পারবো না। কাঁদো কাঁদো মুখে বললাম।
-ছোটকা আমাকে আদর করে বললেন, আমার চেয়ে অনেক অনেক ভালো একজনের পাশে বসবি।
-কে সে? আকুল হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
-সে আমি খুঁজে এনে দেবো।
নিজের অভাবিত সৌভাগ্যের কারণে তোতার বোধহয় আমার ওপর মায়া হচ্ছিল। বললো, ছোটকার সঙ্গে আমিও খুঁজবো।
এসব সেই অবুঝ শৈশবের মায়াবী রূপকথার মতো, যতই অকিঞ্চিৎকর হোক ভাবলে বুকের ভেতর একটা নির্ভার হাওয়া বয়। চোখ বুঁজে আসে।
আর সেই বন্ধ চোখের ওপারে আমার অতীত জুড়ে এক প্রসন্ন সবুজ, যা ক্রমেই ঘন নীল অন্ধকার, প্রায় বিষের মতো নীল হয়ে উঠেছিল তাকে কী করে একেবারে মুছে ফেলি? বিষের সেই বিবশতা কাটিয়ে উঠতে গিয়ে কী কী আমি হারিয়েছি আর কতটুকুই বা মুঠোয় পেয়েছি সেটা হিসেবের অঙ্কে ধরতে চাই কি আর? আজ? না চাইলেও তারা যে মুছে যায়নি মুছে যায় না কোনো কিছুই সেটা তো অনুভব করছি এই মুহূর্তে।
(পরবাস-৮৫, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২)