লস্ট-ওয়ার্ল্ড শব্দটা থেকে থেকে ঘুরপাক খায় রঞ্জনার মাথার ভেতর। বাইরে যাওয়া আসার সময় একবার করে চোখ চলে যায় পরীবাগানের দিকে। মনে হয় কতকালের শ্যাওলা ধরা অন্ধকার বুকে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আলো বাতাসের স্পর্শ বিহীন। কতকাল ওখানে ঢোকেনি রূপাঞ্জনা। কতদিনের চেনা পরমাত্মীয় সব। কার গায়ে ক’টা আঁচড়, কোন গাছের ডালে ডালে কাঠবিড়ালির বেশি ছোটাছুটি আর কার বুকের ভেতর কাঠঠোকরার ঘরসংসার, এসব মুখস্থ ছিল। গত বছর ঝড়ে একটা বহেড়া গাছ উপড়ে গিয়েছিল। তোতা সেটাকে কেটে পরিস্কার করবে বলে লোক ডেকে এনেছিল। রমলা জানতে পেরে বললেন, ওটা তো ভাঙেনি, শুধু উপড়ে গেছে, শেকড় অক্ষত। কেটে না ফেলে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দে। দরকার হলে আরো লোকজন ডেকে আন।
তাই করেছিল তোতা। গাছটা বেঁচে গেছে।পলাশ গাছটায় উঁই ধরেছিল।আস্তে আস্তে মরে গেছে। বাঁধানো চাতালে এখনও একা দাঁড়িয়ে আছে ফলসা গাছ। তবে কেন যেন এখন আর ফলসা হয় না। যেন সাধ আহ্লাদহীন শুধু কোনোমতে বেঁচে থাকা।
চারপাশে এত ঝকঝকে বাড়িঘর, সুন্দর রাস্তাঘাট, প্রত্যেকটা ল্যাম্পপোস্টে উজ্জ্বল আলো। তারই মাঝখানে পরীবাগানের দিকে তাকালে অনাদরের ছাপ চোখে পড়ে আর মন খারাপ হয়ে যায়। রূপাঞ্জনারও আজকাল মনে হয় জায়গাটার কিছু পরিবর্তণ দরকার। যখন কাজের জগতের মধ্যে থাকে, কখনোসখনো চন্দন সরকারের প্রস্তাবটা উঁকি দেয় মাথার মধ্যে। মোটেই অসঙ্গত মনে হয় না ভাবে এই দেড় বিঘের ঘন অন্ধকারকে মুছে ফেলে চারপাশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কিছু একটা করে তুললে বেশ হয়, আলোকিত কিছু।যাকে আর চেনা যাবে না। নিদেন পক্ষে একটা পার্ক। পুরোনো গাছগুলোকে নষ্ট না করে বাগানটাকে একটু সাজিয়ে নেওয়া যায় না? একটু শুধু প্রসাধন। সারাদিনের কেজো মানুষটার মনে উঁকি দেয় কথাটা। আবার ঘরে ফিরে যখন জানালার সামনে দাঁড়ায়, তখন ওদিকে তাকালে মনে হয়, থাক না বাগানটা তার ভালোমন্দ সমস্ত মুদ্রাদোষ আর প্রবাদ মাথায় নিয়ে ঠিক আগের মতো। শুধু একটু যত্ন, সামান্য ভালোবাসা – গাছগুলো একটু শুধু স্পর্শ চায়। একটুখানি মানবিক স্পর্শ যা বহুকাল পায় না।
রূপাঞ্জনাকে নিমরাজি ভেবে তিনচার দিন আগে তোতার হাত দিয়ে একটা ফাইল পাঠিয়েছে চন্দন। নিজের মতো করে একটা এগ্রিমেন্ট তৈরি করেছে, সঙ্গে ওর প্ল্যানের খসড়া। যদি রূপাঞ্জনার পছন্দ হয় এই আশায়। দুদিন ধরেই একটা কৌতূহল হচ্ছিল রূপাঞ্জনার। ভাবছিল একবার খুঁটিয়ে দেখবে, আসলে কী করতে চায় চন্দন। দিব্যেন্দু বরাবর রূপাঞ্জনার পালসটা বোঝে। পরীবাগান নিয়ে এইসব নানারকম মন্তব্য, বিবিধ প্রস্তাব এবং সেটা নিয়ে রূপাঞ্জনার দোলাচল বুঝতে পেরে বললো,
— কারো কথায় কান দিস না। বাগানটার যে একটা প্রাণ আছে, তুই ছাড়া অন্য কেউ সেটা ফিল করে না। করবে না। পরীবাগানকে যদি পালটাতেই হয়, সেটা তুই তোর মতো করে কর। কিন্তু কিছু নষ্ট করে নয়, আর একটু সমৃদ্ধ করে। যা করার নিজে কর, অন্যের হাতে ছাড়িস না। ওটা একটা অ্যাসেট।
কথাটা মনে ধরলো রূপাঞ্জনার। ও তো এভাবেই ভাবতে চাইছিল। ভাবনাটা জোর পেল। ও তো কোনো কিছুই নষ্ট করতে চায় না। নতুন করে সাজিয়ে নিতেই ভালো লাগে। সাজিয়ে নিতে পারে। সে ক্ষমতা ওর আছে। কিন্তু পুরোনো প্রবাদ যদি সত্যি হয়? তাহলে রূপাঞ্জনাই কি পারবে নতুন করে কোনো স্বপ্ন রোপন করতে? পরীবাগানের মাটি কি গ্রহণ করবে সেই স্বপ্নকে?
চন্দনের প্রস্তাবের ব্যাপারে ভেতরে ভেতরে তোতার বেশ আগ্রহ। মুখ ফুটে কিছু বলে না, তবু বুঝতে পারে রূপাঞ্জনা। পারিবারিক ব্যাবসা এখন তোতার দায়িত্বে। দীপ্তেন্দুর বয়স হয়েছে, রমলাও এখশন রণক্লান্ত। দিব্যেন্দু্র কোনোদিনই ব্যাবসার ব্যাপারে কোনো ইন্টারেস্ট ছিল না। পরীবাগানটা এখন পরিবারের হেডেক হয়ে গেছে। বাড়ির গায়ে জমাট বাঁধা অন্ধকার যেন। জঙ্গল আরো গভীর হয়েছে। আরো আদিম, গাছগুলোর গায়ে আরো বেশি বলিরেখা। ছোট গাছগুলোর মাথায় স্বর্ণলতা আর মাকড়সার জাল। বড় গাছগুলোকে জাপটে ধরেছে অসংখ্য পরগাছা। কেউ ওদিকটা মাড়ায় না খুব একটা।
এ বাড়ির কেউ লক্ষ্যই করে না। শুধু অমলা মাঝে মাঝে বলেন, জানিস রূপু আমার খালি মনে হয় পরীবাগান সারারাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কথাটা মাথার মধ্যে আটকে থাকে রূপাঞ্জনার। মনে হয় এখন পরীবাগানের আপনজন বলতে তো ও একাই। কোনো কোনোদিন মাঝরাতে, যেদিন ঘুম আসতে চায় না, উঠে এসে জানালায় দাঁড়িয়ে থাকে।
চোখ সরে না রাত সরে যায়।
বাড়িটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আজ রন আর তৃণা ইউমথাং গেল হানিমুনে। গতকাল সল্টলেকে ওদের রিসেপশান ছিল। রাঙাদিদা, সুতপা পৌলমী আর রম্য এখনও সল্টলেকে। অপর্ণা, দীপ্তেন্দু, তোতা আর রূপাঞ্জনা রাতেই বাড়িতে চলে এসেছে রমলা একা থাকবেন বলে। সামনের সপ্তাহে রূপমরা ফিরে যাবে ক্যালিফোর্নিয়ায়। ততদিন পর্যন্ত কিছুটা হলেও জমজমাট থাকবে বাড়ি।
মার্চ শেষ হতে চললো। এ সময় আকাশটা আশ্চর্য নীল। চারপাশে একটা অন্যরকম হাওয়া বয়। এত অজস্র রকম ফুল ফোটে চারপাশে। সব মিলেমিশে একটা মিশ্র সুগন্ধ ভেসে বাড়ায় বাতাসে, কোনো গন্ধই আলাদা করে ধরা যায় না। অনেকদিন পর নিজের ঘরের লাগোয়া এই ছোট্ট ঝুলবারান্দায় বেতের দোলনাটায় এসে বসেছে রূপাঞ্জনা। এটা সম্ভবত কৃষ্ণপক্ষের শুরু, তাই আজ অনেক রাতে চাঁদ উঠেছে। একটু ম্লান, তবু পূর্ণবৃত্তের আলো এসে পড়েছে পরীবাগানের ওপর। জ্যোৎস্না-স্নানে ঝিম ধরা গাছপালা অল্প অল্প মাথা দোলাচ্ছে।
উৎসব শেষের দিনগুলো বড্ড ক্লান্তিকর আর বিষাদময় লাগে। রূপাঞ্জনা নিজের কাজে মগ্ন থাকে বলে কিংবা নিজস্ব একটা গতি ওকে ওর নিজেরই পরিধির চারপাশে প্রদক্ষিণরত রাখে বলে বিষাদ বা ক্লান্তি ওকে খুব একটা ছোঁয় না আজকাল। এই ক’দিন ওর সেই নিজস্ব বৃত্ত থেকে বাইরে টেনে এনেছিল রনর এই বিয়ের উৎসব। ক’টা দিন একটা অন্য ছন্দের মধ্যে ছিল বলে আজ একটু বিষণ্ণ লাগছে। খারাপ লাগছে না, বরং উপভোগ করছে এই বিষাদকে। কাজের কথা ভাবতে ইচ্ছে করছে না।
রমলা এসে দাঁড়িয়েছেন পিছনে। না তাকিয়েই টের পেল রূপাঞ্জনা। পাশে রাখা চেয়ারটা নিজের আরো একটু কাছে টেনে এনে বললো, বোসো আম্মা।
— মন খারাপ লাগছে? বাড়িটা একদম ফাঁকা হয়ে গেছে। তুই আর একটা দিন দেবুর ওখানে থেকে এলে পারতিস।
— খুব ইচ্ছে করছিল, কিন্তু কী করে থাকবো বলো। অনেক কাজ পড়ে আছে।
— সারাক্ষণ এত দায় বয়ে বেড়াতে ভালো লাগে তোর?
— লাগে, তুমি বয়ে বেড়াওনি এতকাল?
— আমি বয়েছি আমার নিজের দায়, আমার আপনজনের দায়।
— আমি যাদের জন্যে ভাবি, তারাও আমার আপনজন। আপনজন ভাবলে পৃথিবী জোড়া আপনজন খুঁজে পাবে তুমি। একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখতে পাবে অনেক মানুষ হাত বাড়িয়ে আছে। সেই হাতগুলো ধরার ইচ্ছে থাকা চাই। আমি আমার কাজটাকে সেভাবেই দেখি।
— নিজের কথা ভুলে গিয়ে?
— কে বললো নিজের কথা ভুলে গেছি? আমি যা করি সবই নিজের জন্যে করি,নিজে আনন্দ পাই বলে। তুমি আসলে কী বলতে চাইছো আমি জানি আম্মা। আচ্ছা সবার জীবন কি একই রকম ফ্রেমে বাঁধা হবে?
একটু ক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,
— আমার আর হাত পাততে ভালো লাগে না আম্মা। আমার যা প্রাপ্য তা আমি নিজেই নিজের হাতে তুলে দেব। তুমি এটা নিয়ে ভেবে আর মন খারাপ কোরো না। আমি ভালো আছি।
রূপাঞ্জনা রমলার কোলের ওপর মাথা রাখলো। রমলা চুপ করে আছেন। ভেজে গলায় বললেন,
— চল ঘরে যাই। রাতের বেলায় পরীবাগানের দিকে তাকাতে আমার ভালো লাগে না। মনে হয় রাজ্যের অন্ধকার এসে জমা হয়েছে ওখানে। ওদিকে তাকালে আমি অদ্ভুত সব ছবি দেখতে পাই। হয়তো সেগুলো আলোছায়ার খেলা, তবু গা ছমছম করে। দিনের বেলাতেও চোখ বন্ধ করলে মনে হয় সুবিমল ঘুরে বেড়াচ্ছে। গাছের গায়ে হাত বোলাচ্ছে। ও বাগান তুই রাখিস না রূপু।
চমকে উঠলো রূপাঞ্জনা। এই রমলা যেন আলাদা। ভয় পাওয়া, হেরে যাওয়া, ভেঙে পড়া একজন মানুষ। কিন্তু হারটা কোথায়, কার কাছে? এত চড়াই উৎরাই পেরিয়ে শীর্ষে পৌঁছোনো রমলা গুহকে কে হারিয়ে দিয়ে মাড়িয়ে দিয়ে চলে গেল? ভেবে শিউরে উঠলো রূপাঞ্জনা। ওর ভেতর অজস্র প্রশ্ন পাক খাচ্ছে।
— তুমি যাও আম্মা, শুয়ে পড়ো। আমি যাচ্ছি।
রমলা চলে যাওয়ার পর রূপাঞ্জনার মনে হলো, একটা কঠিন প্রশ্ন নিয়ে কেউ যেন ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সেকি আম্মা? বিভাসদা? ওর নিজের ভতর থেকে অন্য কেউ? না কি শুধুই একটা প্রশ্ন, অমীমাংসিত একটা প্রশ্ন। প্রশ্নটা যেন একটা শরীরী উপস্থিতি নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। না কি ভেতরে ভেতরে একটা বোবা ইচ্ছে নিয়ে এইখানে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে ওর কলম। কল্পনার গতি এখানে থেমে গেছে? কমে গেছে ইচ্ছের তীব্রতা? গল্পটাও যেন আর এগোতে চাইছে না। এখানেই ক্লান্ত যতি। উপসংহারের ভার বা দায় সেই পুরোনো রূপাঞ্জনার ওপর।
বাড়ির ভেতর বেশ কদিন ধরে অন্য সব কথারা উড়ে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে কানে আসছে তার দু'একটুকরো... বহুকাল পরে বাস্তুর টানে ঘরে ফিরবে কেউ। ফোনে ফোনে, কখনো বা লোক মারফত সেই খবর ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বাড়িতে। কিন্তু সেইসব উড়ো খবর কেন জানি না আমাকে স্পর্শ করেনি। বিষয়টা খুব টেকনিকাল মনে হয়েছে। অনুভূতির স্তর পর্যন্ত পৌঁছোনোর মতো নয় যেন সেসব। কেননা এর মধ্যে হিসেবনিকেশের কিছু ব্যাপার মিশে আছে, যেগুলো নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। ওটা আজকাল তোতা হ্যান্ডল করে। আমি হিসেবে খুব কাঁচা বরাবর। ওইসব পুরোনো হিসেব পিছনে ফেলে অনেকটা দূর চলে এসেছি আমি। এটা নিয়ে আম্মার সঙ্গেও আমার কোনো কথা হয়নি। হয়তো এ ব্যাপারে এখন আর আমাকে জড়াতে চান না আম্মা। বাড়ির অন্য যে কোনো কথা যে কোনো সমস্যা আমার সঙ্গে শেয়ার করেন। বলা ভালো, আমার মতামত ছাড়া আম্মা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চান না। এটা তাঁর নিজের প্রতি আস্থার অভাবে নয়, আমার প্রতি নির্ভরতার কারণে। আজীবন অজস্র ভার বহন করে করে আম্মা এখন কিছুটা ক্লান্ত। না হলে এই ঊননব্বই বছর বয়সেও শারীরিকভাবে আম্মা যথেষ্ট সুস্থ ও সচল। আম্মার কোনোরকম পরনির্ভরশীলতা আমার কাঙ্খিত নয়, তবু এটাকে আমি উপভোগ করি। এ যেন এক মধুর প্রতিশোধ। আমার আর আম্মার মধ্যে একটা জায়গা বদলের খেলা, দু'জনের অজান্তেই ঘটে গেছে।
দু'দিন ধরেই মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে। নিম্নচাপের বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি মাথায় করে আজ যারা এসেছে তাদের আমি দেখিনি কখনও। ওরা আম্মার কাছে কিছু চাইতে এসেছে। কিন্তু ওরা জানে না আম্মার আজ আর কিছু দেওয়ার নেই ওদের। যদি কিছু পেতেই হয় তাহলে আমার কাছে হাত পাততে হবে। আম্মা যখন অনেক কিছু দিতে পারতেন, দিতে চেয়েছিলেন, তখন তার পেছনে কেউ অদৃশ্য সোনার গারদের ছায়া দেখেছিল। কিংবা কোনো গোপন অহঙ্কারে এ বাড়ির ছায়া থেকে সরিয়ে নিয়েছিল নিজেকে। এখন জয়া কাকিমার শরীর ভালো নেই, তাই নিজের স্বামীর ভিটেয় ফিরতে চান। ওঁর ধারণা এখানে এলে আবার সুস্থ হয়ে উঠবেন। চাকরির সিঁড়ি বেয়ে সোমনাথ এখন অনেক উঁচুতে উঠে গেছে, ইচ্ছে করলে কলকাতার বুকের মধ্যেই বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনে থাকতে পারে। রাঙাদিদার বক্তব্য – শেকড়, বুঝলি শেকড়। এখানে যে বাপ ঠাকুরদার গায়ের তাপ ছড়ানো আছে। এই মাটির গন্ধই আলাদা।
প্রতিদিনই আমার কাছে নানারকম দাবী নিয়ে আসা আরো অনেকের মতো বসার ঘরে যে দুজন মানুষ বসে আছে, তারা আমার অচেনা। তবু কি আশ্চর্য, ওরাই সেই উড়ে যাওয়া পুরোনো পৃষ্ঠাগুলো ফিরিয়ে এনেছে আমার কাছে। যার কিছু কিছু অক্ষর জলে ধুয়ে গেছে, কোনো কোনো শব্দ ঝাপসা হয়ে গেছে। তবু পরীবাগানের চালচিত্রে আটকে থাকা একটা ছবি, এখনও অবিকৃত। যা আমার কলমের আওতার বাইরে। আমার জীবনের একমাত্র মধুর বাস্তবতা। একান্ত নিভৃতের বড় প্রিয় ছবি। প্রিয় এই জন্যে যে, ওই ছবিটা না থাকলে এই জায়গায় আমার পৌঁছোনো হতো না।
ওরাও কিছু চাইতে এসেছে। আমি ইচ্ছে করলে খালি হাতে ওদের ফিরিয়ে দিতে পারি, আবার চাইলে হাতে তুলে দিতে পারি সতর নম্বর বাড়ির চাবি। যা আম্মার আঁচল থেকে আমার কাছে চলে এসেছে। আম্মাই একসময় জোর করে হাতবদল করেছেন চাবিটা। আমি সমস্ত আবেগ আর হিসেবের বাইরে বেরিয়ে ওটাকে নিজের জিম্মায় রেখেছিলাম। তোতাও অনুরোধ করেছিল আমার কাছে রেখে দেওয়ার জন্যে। কারণ তোতার মনে হয়েছিল আম্মা এখন মানসিকভাবে দুর্বল। কারণ তোতা জানে আম্মার হিসেব এখনো অসম্পূর্ণ। কিন্তু তোতা জানে না যে আমার কোনো হিসেব নেই। হিসেবের বাইরে যেটুকু সেটুকুই শুধু আমার।
সকালের ঘন মেঘ দুপুর থেকে বৃষ্টি হয়ে ঝরছে থেকে থেকে। সোমনাথের কোম্পানি ওকে কলকাতায় ট্রান্সফার করেছে। কথাটা রাঙাদিদা মারফত আমার কাছে পৌঁছেছে। রাঙাদিদা খুব নিস্পৃহভাবে, খানিকটা স্বগতোক্তির মতো কথাগুলো আমার কানে তুলে দিয়েছেন। বুঝতে পারি আমার অগোচরেই আম্মার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে সোমনাথ। সে যোগাযোগের মধ্যে আবেগের কোনো জায়গা নেই ঠিকই, কিন্তু কেন যেন একটা গোপন দায় বয়ে বেড়ান আম্মা। সেটাও আমাকে কখনও ভাবায় না। সেই কারণেই আজ রাঙাদিদার চাপা উত্তেজিত তথ্যটা তখন আমাকে একটুও স্পর্শ করেনি।
গৌরীদি চায়ের কাপ রেখে বেরিয়ে যাওয়ার পর আমি হাতমুখ ধুয়ে চা খেতে খেতে প্রথমে আমার পরের দিনের কী কী প্রোগ্রাম আছে সেটা একবার মনে মনে ভেবে নিলাম। তারপর জানালার কাছে রাখা বেতের চেয়ারটায় ক্লান্ত শরীরটাকে এলিয়ে দিতেই, রাঙাদিদার তথ্যে ভর দিয়েই যেন চোখের পাতা জড়িয়ে এসেছিলো পুরোনো ছবির ভারে।
তোতা এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়।
রূপুদি, ওদের কি অপেক্ষা করতে বলবো? মানে আম্মা বলছ… তুই কি একবার আসবি নিচেয়?
— না রে। এখন আর নিচে নামতে পারবো না আমি।
তোতা আর কিছু বলার আগেই কাঠের আলমারি খুললাম। ভেতরে একটা বড় ড্রয়ার আছে, বন্ধই থাকে। এটাতে বহুকাল হাত পড়ে না, দরকার হয় না। কারণ আলমারিটা প্রচুর অপ্রয়োজনীয় জিনিসে ঠাসা।। বলা ভালো অনেক অপ্রাসঙ্গিক স্মৃতিচিহ্ণে ভরা। যেগুলোর প্রতি আমার কোনো আকর্ষ্ণ নেই, মনেও পড়ে না।
ড্রয়ারটা টেনে এনে চাবিটা খুঁজতে গিয়েই চোখে পড়লো সেলোফেন পেপারে মোড়া একটা ছবি। বার করলাম। পিচবোর্ডের ওপর অপটু হাতের বাঁধাই করা আমার প্রথম রঙিন ফটোগ্রাফ। দুই বিনুনি, হলুদ সালোয়ার কামিজ, মুখে কৌতূকের হাসি। বারান্দার রেলিংএ পা ঝুলিয়ে বসে থাকা এক কিশোরী। সোমনাথের তোলা, ওর প্রথম ক্যামেরার ছবি। ক্যামেরাটা আম্মা ওকে উপহার দিয়েছিলেন ওর হায়ার সেকেন্ডারির রেজাল্টের পর।
এখন আর বারান্দার ওই রেলিংটা নেই। মেয়েটার সঙ্গে সঙ্গে সেও পালটে গেছে।
ড্রয়ার খুলে সতর নম্বর গগনবাবু লেনের চাবিটা বার করলাম। মরচে ধরে গেছে। এ চাবি দিয়ে তালা খুলবে কিনা কে জানে? হয়তো তালা খোলার জন্যে নয়, অধিকারটা ফিরিয়ে নেয়ার জন্যেই চাবিটা প্রয়োজন।
চাবিটা এগিয়ে দিলাম তোতার দিকে। তোতা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ও এটাই জানে যে গুহ বাড়ির সঙ্গে ওদের হিসেবপত্তর এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। তোতা টাকার হিসেব বোঝে। ও চাবি হাতে নিয়ে তখনও আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখে বললাম, চাবিটা ওদের দিয়ে আয়।
বাইরের নোনাধরা দেয়াল নতুন সিমেন্ট বালির প্রসাধনে চেহারা পালটেছে। বিদ্যুৎ সংযোগ অনেকেদিন আগেই বিচ্ছিন্ন। মোমের আলোয় অদ্ভুত রহস্যময় লাগছে সতর নম্বর বাড়িকে। পরীবাগানের অন্ধকার সমুদ্র পেরিয়ে বাড়িটাকে অনেক দূরের দ্বীপের মতো মনে হচ্ছে। চারপাঁচ দিন ধরে ওখানে মিস্ত্রি কাজ করেছে আম্মারই তদারকিতে। হয়তো তার মধ্যে আরো কেউ এসে থাকতে পারে কখনো। আমার চোখে পড়েনি। আম্মা কেন এসবের দায়ীত্ব নিয়েছেন আমি জানি না। আম্মার মধ্যে কখন কোন রসায়ন কাজ করে আমি আজও বুঝতে পারি না। তবু যেহেতু ওই বিষয়টাতে এখন আমি বিরক্তি বা আসক্তি কোনো কিছুই অনুভব করি না, তাই কিছুই বলিনি।
শরীরটা ভালো লাগছিল না বলে আজ সারাদিন কোথাও বেরোইনি। বিকেলে ম্যাটাডোরে করে কিছু জিনিসপত্র এসেছে ও বাড়িতে। সেই থেকে গোছগাছ চলেছে। একবারও সোমনাথকে দেখিনি। শুধু দুজন মেয়ে। এখন এই মধ্যরাতের আলো আঁধারিতে মনে হলো ঘরের ভেতর ঘোরাফেরা করছে একজন পুরুষও। আচরণে বোঝা যাচ্ছে সে একজন মেয়ের স্বামী, একটি মেয়ের বাবা। এ এক অন্য মানুষ। তার কিছুটা শুধু আমার একজন চেনা মানুষের মতো দেখতে।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর তোতা আমার ঘরে এলো। মোড়া টেনে নিয়ে গুছিয়ে বসলো। বুঝতে পারলাম ওর অনেক কিছু বলার আছে। ইতস্তত করছে দেখে সহজভাবে বললাম, কিছু বলবি?
— দেখ রূপুদি তুই হয়তো জানিস না কিছু, আমি জানি সুবিমলকাকু আম্মার কাছ থেকে অনেকবার টাকা নিয়েছে। আর সে অনেক টাকা। তাই অত সহজে চাবিটা দিয়ে দিতে বললি। সোমনাথদা নিজে কিন্তু জানে। তবু তো নিল। ওর আত্মসম্মানে লাগলো না?
— ভালোই তো, তোদের কাছে কেউ ঋণী হয়ে রইলো, এটা ভেবে তোর খানিকটা আত্মপ্রসাদ লাভ হবে।
— তাতে আমাদের কী উপকার হলো? শেষ বাজি কিন্তু ও জিতে গেল।
তোতার সঙ্গে মাঝে মাঝে কথা বলতে এত খারাপ লাগে, নিজের ভাই বলে সহ্য করে নিই। এখনও মনে হচ্ছে ও আমাকে কোথায় যেন টেনে নামাচ্ছে। মনে হচ্ছে ও এবার উঠে চলে যাক। চুপ করে গেল তোতা। বুঝলাম নিজের উত্তেজনা থেকে বেরোতে চেষ্টা করছে।
— যাকগে তুই যেটা ভালো বুঝেছিস করেছিস।
— এর মধ্যে আমার কোনো ভূমিকা নেই। আমি কিছু বুঝিনি, বোঝার চেষ্টাও করিনি।
— তোকে একটা কথা বলি রূপুদি। পরীবাগানটা আর ফেলে রাখিস না।কী হবে ওই জঙ্গল দিয়ে? চন্দন খুব আশা করে আছে। ঝুলিয়ে রাখিস না বেচারাকে। কিছু একটা ডিসিশান নে। সত্যি করে বল তো ওর প্রস্তাব তোর ভালো লাগেনি?
— চন্দনের প্রস্তাব মানে সেই পরীবাগানের বদলে জাপানিবাগান?
— তুই ঠাট্টা করিস আর যাই বলিস,চন্দনের কিন্তু রুচিটুচি খুব ভালো। ও যতোগুলো প্রজেক্ট বানিয়েছে, সবগুলোই তাকিয়ে দেখে লোকে।
— ও তোকে খুব ভালো হাত করেছে বোঝা যাচ্ছে।
এতক্ষণ খুব হালকা চালেই কথাবার্তা হচ্ছিল। তোতা হঠাৎ খুব গম্ভীর হইয়ে গেল। উঠে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। লক্ষ্য করলাম বাইরের অন্ধকার ভেদ করে ওর দৃষ্টি তখন সতর নম্বর বাড়ির দিকে। একটু পরে ফিরে এসে আবার নিজের জায়গায় বসলো।
— তুই ভুল ভেবেছিস আমাকে। চন্দনকে দিতে না চাইলে দিবি না। তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। তুই শুধু আমাকে অনুমতি দে, আমি ওই বাগানের সব মিথ ভেঙে ফেলে একে অন্যভাবে সাজাবো। চারদিকে উঁচু পাঁচিল তুলে দিয়ে… কিংবা…
— পরীবাগান নিয়ে এত অস্থিরতা কেন তোর? তুই কী চাস বল তো?
— ওসব হাউজিং টাউজিং না, আমি চাই ওখানে তোর জন্যে প্যালেস বানাবো। সেই প্যালেসের পায়ের কাছে ছোট্ট কুশ্রী আঁচিলের মতো লেগে থাকবে সতর নম্বর বাড়িটা। আমি এটাই চাই।
মনে হলো কথার শেষদিকে ওর গলায় বাষ্প জমে উঠেছে। উত্তেজিতভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল তোতা। চমকে উঠলাম ওর কথায়। সতর নম্বর বাড়ির মানুষ যে এত সহজ স্বাভাবিকভাবে আবার ফিরে এলো এটা মেনে নিতে ওর অসুবিধা হচ্ছে। মনে হলো এখানে ওর কোনো বৈষয়িক বোধ কাজ করেনি। যা বলে তা হলো সমনাথের প্রতি প্রচন্ড ঘৃণা ও আক্রোশ। সেই আক্রোশ যে এতটা তীব্র, ভাবিনি। আম্মার সামনে নিজেকে সবটা প্রকাশ করতে পারে না, তাই আমার সামনে এসে উগরে দিয়ে গেল। মায়া হলো। একটা পরিণত বয়সের মানুষ, চোদ্দ বছরের ছেলের দায়িত্ববান বাবা, এই মুহূর্তে তাকে আমার সেই পঁচিশ তিরিশ বছর আগের কিশোর তোতা মনে হলো।
কিন্তু আমি তো ওর মতো করে ভাবতে পারছি না। তোতার ওই আবেগ তো আমার মধ্যে কাজ করছে না। তাই রাগ বা বিদ্বেষ কিছুই বোধ করছি না। আমার লেখা গল্পের কোনো পরিচ্ছেদেই তো আলাদা করে এই সোমনাথের কোনো জায়গা নেই। যেটুকু আছে, তা গগনবাবু লেনের পথঘাট, বাতিস্তভের মতো, পরীবাগানের নাম ভুলে যাওয়া গাছের মতো। আম্মার কথানুযায়ী আমাকে কিছুই ঘসে তুলতে হয়নি। নতুন করে লেখা পরিচ্ছেদের নিচে ও আপনিই চাপা পড়ে গেছে।
কিন্তু তোতা যা চায়, তা কি সম্ভব? আমিই কি চাই সেটা? সারাদিনের কাজের মধ্যে ডুবে থাকা যে রূপাঞ্জনা, তার হয়তো চোখে পড়ে না, কিন্তু দিনের শেষে গল্পের শব্দবন্ধ ছেড়ে বেরিয়ে আসা যে মানুষটা একা জানালার সামনে এসে দাঁড়ায় মাঝে মাঝে, তার জন্যে ওই একটুকরো পরীবাগান বড় জরুরি। আম্মা আমাকে যা যা দিতে চেয়েছিলেন, তার মধ্যে একমাত্র ওটাই আমার অধিকারের সীমায়। আম্মার সেই উপহারটুকু যত্ন আর পরিচর্যা দিয়ে সাজিয়ে আমার কর্মক্লান্ত একলা দিনের শেষের যে একান্তের বিশ্রাম, তার পাশে যদি রেখে দিই ক্ষতি কি?
জীবনের বাকি প্রাপ্তি যা কিছু, সে সবই তো সেই গল্পের মেয়ের। তার মধ্যে কোথাও ছিঁটে ফোঁটা ব্যক্তিগত আবেগ নেই। আবেগ ছাড়া মানুষ স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে পারে কি?
খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো। তখনও ভালো করে আলো ফোটেনি। বাসি চাঁদ লেগে আছে আকাশে। জানালার পর্দা সরাতেই চোখ চলে গেল ও বাড়ির জানালায়। কাল রাতের আলো আঁধারিতে দেখা সেই মানুষটাই আজ পরীবাগানের দিকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে আছে। একবার যেন এদিকে এই জানালার দিকে ঘুরে গেল তার দৃষ্টি। তাকে এবার যেন একটু চেনা লাগছে। এক মুহূর্তের জন্যে মনে হলো ও যেন সেই কিশোর। বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেঁপে গেল আমার!
কী দেখছে সোমনাথ? ওর চোখেও কি ধরা পড়ছে ফলসা গাছের ছায়ায় আটকে থাকা সেই ছবিটা? কি ওকেও ছুঁয়ে গেল? অ-প্রাপ্তবয়স্ক দুই কিশোর কিশোরী আর তাদের প্রথম কম্পন, রোদ বৃষ্টি কুয়াশা মাখা তাদের নানা মুহূর্ত? ওরও কি চোখের আরাম হচ্ছে? না কি নিজের অধিকার হাত ফসকে চলে গেলে যে অপার শূন্যতা কামড়ে ধরে চারপাশ থেকে, তার মধ্যে দাঁড়িয়ে নিজেকে যাচাই করছে?
এবার আমি নিজের মুখোমুখি। কেন মনে হচ্ছে সবকিছু মিলিয়ে এই গোটা ছবিটা বেশ উপভোগ্য। ওই যে চোখের সামনে একজন মানুষ, সে একটা স্মৃতির ধ্বংসস্তুপ হাতড়ে কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে, আর খুঁজতে খুঁজতে তার ভেতর যেন একটু জ্বালা, আনন্দ বেদনার মিশ্রণে হয়তো এক পলকের ভালোলাগা।
আমার এভাবেই ভাবতে ভালো লাগছে। ও হয়তো পিছন ফিরে তাকাচ্ছে, ওর সঙ্গে আমিও পিছন দিকে হাঁটছি। এক সঙ্গে নয় হয়তো কিন্তু আমাদের গন্তব্য তো একই দিকে। হঠাৎ মনে হলো যেন ওভারল্যাপ করে যাচ্ছে দুটো মানুষ - এক কিশোরী আর আমার গল্পের মেয়ে। আমি উপভোগ করছি দৃশ্যটাকে। না হয় আমার গল্পের সঙ্গে না-ই মিললো। গল্পের বাইরের এই বিনোদনটুকু আমি গ্রহণ করতেই পারি। করলে দোষ কী ?আর সেই বিনোদনটুকুর মূল্য প্রোমোটারের ধার্য মূল্য কিংবা তোতার কল্পিত রাজপ্রাসাদের চেয়ে অনেক বেশি কাঙ্খিত মনে হলো।
মনে হলো ওটাও যেন আমার বহুকাল আগে পড়া ভালোলাগা কোনো ছোট গল্প। একটা অর্ধসমাপ্ত স্বপ্নের গল্প। যার সঙ্গে আজকের রূপাঞ্জনার কোনো সম্পর্ক নেই। স্বপ্ন একটা ছবি বইতো নয়। সাধ্যের শেষ সীমায় গিয়ে হৃদয়ের সবটুকু মাধুর্য নিংড়ে দিয়ে তিলে তিলে ফুটিয়ে তোলা একটা বিমূর্ত ছবি। সেটা উড়ে যেতে পারে পুড়ে যেতে পারে, জলে ধুয়ে গিয়ে সাদা ক্যানভাস হয়ে যেতে পারে। কিন্তু স্বপ্নের কোনো নবীকরণ হয় না বলে আমার নতুন লেখা গল্পে সেই পুরোনো রঙটুকুই ঝাপসা হয়ে লেগে রইলো।