রাঙাদিদা আমার জীবনের মনোরম অবকাশ যাপন। বড় হয়ে ওঠার সঙ্গী, আমার গল্পের অলঙ্কার। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ওঁর সাহচর্য আমার আনন্দকে উৎসবে রূপ দিয়েছে, যন্ত্রনার মুহূর্তে উপশম দিয়েছে। ওঁর সঙ্গে আমার কত যে ফিসফাস ছিলো, আশ্চর্য সব কথাবার্তা। আমার প্রেম, স্বপ্ন, আমার ইচ্ছে অনিচ্ছের খুব নিভৃত ভাগীদার ছিলেন রাঙাদিদা। সোমনাথ আর আমার খুব একান্তের কথা জানার জন্যে উদগ্রীব হয়ে থাকতেন রাঙাদিদা। মাঝে মাঝে আমার মনে হতো, ওঁর জীবনের অপূর্ণ সব ইচ্ছেকে আমার ভেতর দিয়ে কিছুটা মিটিয়ে নিতেন। খুব মজা লাগতো।
জীবনের অনেক গোপন সুড়ঙ্গের অন্ধিসন্ধি জেনেছিলাম রাঙাদিদার কাছেই। ওঁর ন্যাপথলিনের গন্ধ জড়ানো অ্যালবামে সাদাকালো ছবির মানুষগুলোর মধ্যে কত যে রঙের পরত দেখতে পেতাম। তাদের নিয়ে রাঙাদিদার নিজস্ব রূপকথা, শুনতে শুনতে আমি বড় হয়ে উঠছিলাম। ওঁর জীবনের বিচিত্র সব ঘটনার ভেতর দিয়ে আমি পৃথিবীর অন্য এক মিশ্র রঙের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটছিল। আমার মধ্যেও রূপকথার বীজ অঙ্কুরিত হচ্ছিল। নিজেকে ঘিরে হাজার রঙের ছবি আর শব্দ-বাক্যের বুনোট নিয়ে আমিও তৈরি হচ্ছিলাম। আমার চোখের সেই সরল সাদা পর্দা সরিয়ে দিয়ে কেউ যেন বসিয়ে দিচ্ছিল ফিলটার লেন্স। গাঢ় রঙের প্রলেপ পড়ছিল আমার পৃথিবীতে। আর রাঙাদিদা আমার সেই স্বপ্নের রঙে ইন্ধন যোগাতেন।
ওঁর নিজের জীবনে অনেক হিজিবিজি কালোদাগ ছিল। কিন্তু তাকে আমার বর্ণময় মনে হতো। ছবির মতো। ওঁর নিজেরও তো কখনও কুশ্রী লাগেনি সেইসব কালো দাগকে। নিজেই বলতেন,
-পথ চলতে গেলে ভালো-মন্দ, সাদাকালো যা হাতে আসে, সবই নিতে হয়। ভালো আসুক আর কালো আসুক, এলো তো কিছু। হাততো ভরলো। ভালোটুকু নেব আর তার গায়ে লেগে থাকা মন্দটুকুকে দূরছাই করে ফেলে দেব তা কি হয়? পথে নামলে ধুলোময়লা লাগবে না, সে তো হয় না।
এমন সহজভাবে জীবনকে নিতে পারা বড় সহজ কথা নয়। এই সহজ ভাবনার জন্যেই দুঃখ, শো্ক, অপমান, অবহেলা ওঁর জীবনকে বিড়ম্বিত করতে পারেনি।
যখন ঊনিশ বছর বয়স, তখন ওঁর স্বামী মারা যান। নিজেই বলেছেন আমাকে, - খুব যে শোক হয়েছিল, তা নয়। শুধু খুব অসহায় মনে হয়েছিল। সে বাড়িতে আমাকে ভালোবাসার মতো, আমার ভালোমন্দ নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো আর তো কেউ ছিল না। একা। কেমন যেন এক ঘরে হয়ে পড়লাম।
- বাবার কাছে ফিরে এলে না কেন?
কথাটা মনে ধরলো। বাড়ির ভাগ নেওয়ার জন্যে না, একটু আরামে থাকার জন্যে। আমার শ্বাশুড়ির একদম ইচ্ছে ছিলনা আমাকে রাখার। তবু মাটি কামড়ে পড়েছিলাম।
এই মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে গিয়ে ঊনিশ বছরের মেয়েটিকে অনেক দাম দিতে হয়েছিল। ওই পরিবারের অনেকেই তাকে নিজেদের সম্পত্তি ভেবে নিলো। কেউ কেউ যেমন খুশি ব্যবহার করলো তার শরীরটাকে। টানা দু’বছর। পেটে বাচ্চা এলো। কিন্তু বাচ্চাটা যে কার – ওঁর খুড় শ্বশুরের নাকি দেওরের, সেটা জানা গেল না। সেই সরল মোমের মতো মেয়েটাকে নিয়ে দুজনেই তো খেলেছে সুযোগ মতো। আর সে ভালো খেতে পরতে পারাটাকেই সুখ ভেবে মুখ বুঁজে সহ্য করেছে সব। ব্যাপারটা জানাজানি হতেই শ্বশুরবাড়ির পাট চুকলো। একজনও কেউ পাশে দাঁড়ালো না। ওঁর শ্বাশুড়ি আর রাখাতে চাইলেন না সেখানে। তাঁর সাফ কথা, অমন আগুনের পুটুলি আমার আর ঘরে রাখবো না। সবার মুখ পুড়বে।
সুতরাং সেখান থেকে বিদায়। বাবার ঘরের চৌকাঠও তখন দুর্লঙ্ঘ হয়ে গেছে। তবু অন্য কোনো যাওয়ার জায়গা নেই বলে বাপের বাড়িতেই ফিরতে হলো শেষপর্যন্ত। রাঙাদিদা গল্পচ্ছলে হেসে হেসেই বলেছিলেন,
- বাড়িতে নিয়ে এসে বাবা চুলের মুঠি ধরে এমন মারলেন, অন্য মেয়ে হলে বিষ খেতো। আমার তো মরতে ইচ্ছে করে না। তার ওপর পেটের মধ্যে আর একটা প্রাণ। শুধু সেই আনন্দে বাঁচার জন্যে প্রাণটা আঁকুপাকু করতো। উঠতে বসতে দাদা-বৌদিদের গঞ্জনা সহ্য করে চোরের মতো পড়ে থাকতাম।
সেই সময় বোনকে বাঁচানোর জন্যে রমলা, মানে আমার আম্মা তাকে নিয়ে এলেন এ বাড়িতে। আদর দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে তার কষ্টের দাগগুলোকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করলেন, যাতে তার গায়ে লেগে থাকা এতদিনের অপমান ভুলে সে নতুন করে বেঁচে উঠতে পারে। চোখ মুছে অমলা আবার আগের মতো সপ্রাণ হয়ে উঠলো বটে, কিন্তু বাচ্চাটাকে নষ্ট করার তোড়জোড় করতেই বেঁকে বসলো সে।
- না, আমার বাচ্চার গায়ে হাত দেবে না।
- ও কার বাচ্চা তুই জানিস?
- জানি না, জানার দরকার নেই। মানুষের বাচ্চা তো বটে।
- ওরা মানুষ? জানোয়ার, জানোয়ার। সেই জানোয়ারের বীজ তোর পেটে।
- হোক ওকে বাঁচতে না দিলে আমাকে বাঁচানোর দরকার নেই তোমার।
- আমি না বাঁচালে তুই দাঁড়াবি কোথায়? ওই বাচ্চা নিয়ে কেউ জায়গা দেবে না তোকে।
- কাউকে জায়গা দিতে হবে না। পথে পথে ঘুরবো। ভিক্ষে করে খাবো।
- ভিক্ষে করবি? তোর মতো মেয়েদের কেউ ভিক্ষে দেয় না, পেটে বাচ্চা দেয়।
অমলা পারেনি শেষ পর্যন্ত লড়াই করতে। তার যুক্তি বুদ্ধির অতো ধার ছিল না। কাজেই গর্ভের দাগ মুছে ফেলে আশ্রয় পেয়েছিলো দিদির সংসারে। সেই থেকে এখানে দিব্যি আছেন রাঙাদিদা। ওঁর যে কোথাও কোনো দুঃখ, অপূর্ণতা বা অভাব বোধ আছে, এ কথা কখনো মনে হয়নি। বরং ওঁকে এ বাড়ির সুখী তমমনুষ মনে হয়। এই বাড়ি ওঁর কাছে স্বর্গের অধিক, আর আম্মাকে মনে করেন সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের মতো।
- আমার দিদিই বলিস, আর মা-বাপই বলিস এ পৃথিবীতে ওই তো আমার একমাত্র আপনজন।
- আর আমি? আমি বুঝি তোমার আপনজন নই?
- তুই তো আমার প্রাণভোমরা, আমার চোখের মণি, আমার ইচ্ছেপূরণ।
কিন্তু আমার ইচ্ছে পূরণকে? আম্মা, মানা কি রাঙাদিদা? নাকি একটা কল্পিত সাদাপাতা, আর একটা জেদি কলম, আজও সে কথা বুঝে উঠতে পারিনি।