• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৮ | অক্টোবর ২০২২ | উপন্যাস
    Share
  • পরীবাগান ও এক গল্পের মেয়ে (১২) : অঞ্জলি দাশ



    || ২১ ||

    গল্পের মেয়ে……


    আর একটা পুজো কেটে গেছে। আকাশ আবার ঘন নীল হয়ে উঠেছে। খোলা জানালা দিয়ে মেঘমুক্ত রোদ্দুর এসে যেন ডেকে গেল। সেই ডাকে সাড়া দিল রূপাঞ্জনা। মেঘ সরিয়ে আলোয় ফেরার জন্যে একটা পথ খুঁজছিল, সেটা পেয়েও গেল, রমলার কথার সূত্র ধরেই নিজের ধুলোজমা পড়ার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো। মনে হলো শুরুটা এখান থেকেই করা উচিত, করা সম্ভব।

    একদিন বইপত্র, পুরোনো নোটস-এর ফাইল বার করে নাড়াচাড়া করছে, ওর মনে হলো তোতা ওর ঘরের দিকে আসতে গিয়েও ফিরে গেল। তারপর সিঁড়িতে ওর পায়ের শব্দ পেল ছুটতে ছুটতে নেমে যাচ্ছে। হয়তো আম্মাকে জানাতে গেল। কয়েকদিনের মধ্যে লক্ষণীয় ভাবে বাড়ির সবার মুখের ওপর থেকে একটা কালো ছায়া সরে যেতে দেখলো। মনে হলো বাড়িটা যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। পুজোর ছুটি কাটিয়ে সল্টলেকে ফিরে যাওয়ার পরও একদিন দিব্যেন্দুরা সবাই মিলে এসে দু’তিন দিন কাটিয়ে গেল।

    রন-টা যেহেতু রূপাঞ্জনার খুব ন্যাওটা, তাই গতবছর ধরে ওরা যতবার বাড়ি এসেছে, ও মনমরা হয়ে ঘুরেছে। রূপাঞ্জনার কাছে খুব একটা ঘেঁসতো না। কী জেনেছে, শর্মিলা ওকে কী বুঝিয়েছে ওই জানে। এবার এসে পরদিন সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠেই রূপাঞ্জনার ঘরে এলো। রূপাঞ্জনা পড়ার টেবিলে বসে বইপত্র দেখছিল। রন ঘরে ঢুকে প্রথমে খুব সন্তর্পণে টেবিলের কাছে এলো। তারপর টেবিলের উপর দু’হাতের পাতায় মুখটা রেখে রূপাঞ্জনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। ওকে কাছে টেনে আদর করতেই বললো,

    --তোমার মন ভালো হয়ে গেছে দিভাই?

    রূপাঞ্জনা ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো, তারপর বললো – চল পুকুরঘাটে যাই। পবনদা দুটো রাজহাঁস পুষেছে, দেখবি চল।

    পুকুরপাড়টা রন-এর খুব প্রিয় জায়গা। ওদের দুজনের অনেক মজার মজার খেলারও জায়গা। রন গত এক বছরে ওর মনে জমে থাকা ভালোমন্দ অবরুদ্ধ আবেগের সবটুকু উজাড় করে দিলো। কিছুক্ষণ ওর সঙ্গে কাটানোর পর রূপাঞ্জনার মনে হলো বুকের ভেতর নিবে যাওয়া সবগুলো আলো জ্বলে উঠলো। এতদিন মুখ বুঁজে দাঁড়িয়ে থাকা চারপাশের বাতাসও যেন হঠাৎ বইতে শুরু করলো। সবাই যেন কিছু না কিছু বলতে চাইছে ওকে।

    বাড়ির পরিবেশ পালটাতে শুরু করলো বটে, কিন্তু এইসময় আরম্ভ হলো অন্য এক প্রহসন। কেউ কেউ নিজের মতো করে সোমনাথের বিকল্প খুঁজতে শুরু করলো। রূপাঞ্জনা কিছুতেই তাদের বোঝাতে পারছিলো না যে, মানুষ ভালো হোক খারাপ হোক তার কোনো বিকল্প হয় না। তাকে রিপ্লেস করা যায় না। টের পাচ্ছিল ভেতরে ভেতরে নিঃশব্দে চলছে প্রক্রিয়াটা। কিছু বলতে যাওয়া মানে ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দেওয়া। তাই চুপচাপ দেখে যাচ্ছিল শুধু, বিচলিত হলো না। উৎসাহ নিয়ে পড়াশুনা শুরু করতে দেখে তোতা উপযাজক হয়ে একদিন এসে বললো, রূপুদি আমাদের কলেজে পলিটিকাল সায়েন্সের একজন নতুন লেকচারার এসেছেন, দারুণ পড়ান। আমার সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গেছে। নোটস লাগলে বলিস।

    রূপাঞ্জনা ওর উৎসাহ দেখে বললো, কিছু সাজেসশান এনে দিতে পারিস? সিলেবাস তো বছর বছর পালটায়। ওটা আগে জানা দরকার। তোতা একদিন সাজেসশান সহ তার মালিককে বাড়িতে এনে হাজির। পড়াশুনার ব্যাপারে সহযোগিতার আশ্বাস পাওয়া গেল বটে, কিন্তু তোতার অতি আগ্রহে প্রমাদ গুনলো রূপাঞ্জনা। তোতা আম্মাকে কনভিন্স করে বাড়িতে নেমন্তন্ন করে খাওয়ালো ভদ্রলোককে। এবং সামান্য পরিচয়ের কারণে আতিথেয়তার সিংহভাগ রূপাঞ্জনার ওপর বর্তালো। ওর আড়ালে সবার সঙ্গে তোতার ফিসফাসও চললো। মনে মনে হাসলো রূপাঞ্জনা। কারণ ও ততদিনে ওর নিজের কলমের ডগায়, নিজের নিয়ন্ত্রণে। ততদিনে নিজের মুখে সাবলীল শব্দবাক্য জুড়ে দিতে পেরেছে। রাতে খাওয়ার টেবিলে একদিন তোতাকে ধরলো।

    --দেখ তোতা, তোর প্রসূনদার কাছ থেকে নোটস নিতে আপত্তি নেই, ওটা আমার দরকার। কিন্তু প্রেম করতে পারবো না।

    তোতা অপ্রস্তুত হেসে বললো, কেন প্রসূনদা তেমন কিছু বলেছে নাকি তোকে?

    --না। সরাসরি মনের কথা জানাবে, ততটা জোরালো ব্যক্তিত্ব নয় ভদ্রলোকের। তবে অত ঘন ঘন বাড়ি বয়ে নোটস দিতে আসাটাও খুব সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ মনে হচ্ছে না।

    --বেশ তো তোর আপত্তি থাকলে আমি কায়দা করে বলে দেব অত ঘন ঘন না আসতে।

    --তোকে কিছু বলতে হবে না। আমার সমস্যা তো প্রসূনবাবুকে নিয়ে নয়, তোকে নিয়ে। এটা মাথায় রাখিস।

    কিন্তু সমস্যা শুধু তোতাকে নিয়ে নয়, শর্মিলাকে নিয়েও। রনের জন্মদিনের পার্টিতে অভীক সেন নামে এক কার্ডিওলজিস্টের সঙ্গে রূপাঞ্জনার আলাপ করিয়ে দিলো শর্মিলা। এবং তার কানে রূপাঞ্জনা সম্পর্কে এমন গুণ গুঁজে দিতে লাগলো, অভীক দারুণভাবে ওর গুণমুগ্ধ হয়ে উঠলো। মাঝেমাঝেই ফোন করে গল্পগুজব করতে শুরু করলো। দিব্যেন্দুর খুব ঘনিষ্ঠ বলে এড়িয়ে যাওয়া যেতো না। এমনিতে তার সঙ্গে কথা বলতে খুব যে খারাপ লাগতো তা নয়। বলা ভালো হাতে কাজ না থাকলে ভালোই লাগতো। কারণ ডাক্তারি শাস্ত্রের বাইরেও নানা বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করতে ভালোবাসে অভীক। ওর কথার বিষয় বৈচিত্র এবং ভঙ্গী দুটোই চমৎকার।

    প্রথমদিকে সম্পর্কটা সহজ বন্ধুত্বের ছিল। ‘আজ ক’জন রোগীর হৃদয়ের খবর নিলেন?’ ‘কাকে ছোটকার হাতে সঁপে দিলেন’ এই জাতীয় মজা করতো। এ পর্যন্ত ঠিক ছিলো। অভীকের যে সাহচর্যটুকু ও গ্রহণ করেছে, তার মধ্যে কোনো রং ছিল না। একটা সহজ মানবিক সম্পর্কের নিরিখে দেখতো রূপাঞ্জনা। খুব নিঃসঙ্গ কিছু মুহূর্তে একজন সমমনস্ক মানুষের সঙ্গ। কিন্তু অভীক হয়তো অন্যকিছু ভেবে নিয়েছিল। একদিন এ-কথা সে-কথার পর জিজ্ঞেস করলো,

    --আমার সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?

    প্রশ্ন শুনে একটু বিপদে পড়ে গেল রূপাঞ্জনা। তবু অকপটে বললো, বলতে পারবো না।

    অভীক একটু অবাক মুখ করে বললো, মানে?

    মৃদু হেসে রূপাঞ্জনা বললো, আপনাকে নিয়ে আলাদা করে ভাবিনি কখনো, তাই বলতে পারবো না।

    অভীক কিছুটা হতাশ গলায় স্বগতোক্তির মতো শুধু বললো, আশ্চর্য!

    রূপাঞ্জনা সত্যিই ভাবেনি। যে অর্থে নিজের সম্পর্কে ওর ধারণাটা জানতে চেয়েছে অভীক, সেইভাবে ভাবার কথা কখনো মনেই আসেনি।

    এইসময় রূপাঞ্জনা লক্ষ করলো শর্মিলা আগের তুলনায় একটু ঘন ঘন বাড়িতে আসছে। দিব্যেন্দু সুতপার সঙ্গে অভীককে নিয়ে কীসব আলোচনা করছে, রূপাঞ্জনাকে দেখলেই আলোচনা থেমে যায়। উদ্দেশ্যটা বুঝতে ওর মোটেই ওর অসুবিধা হলো না। ব্যাপারটা আর বেশি দূর যাতে না এগোয় সেজন্যে সুতপাকে একদিন হালকা চালেই বললো, মা, ছোটকাকে বলো ওঁর বন্ধুর জন্যে অন্য কোথাও পাত্রী দেখতে।

    --মানে?

    --মানেটা কী সে তুমিও বোঝো।

    --কেন অভীককে তোর পছন্দ নয়?

    --তুমিও? অদ্ভুত ব্যাপার! আমার জীবনে কি ওটাই একমাত্র লক্ষ্য?

    --একমাত্র নয় অন্যতম তো বটে।

    --সেই অন্যতমকে কতটা জায়গা দেব সেটা আমি ঠিক করবো। এবার আমার জীবনটা আমাকে নিজের মতো চালাতে দাও তোমরা। আমি যখন নিজের লক্ষ্য নিয়ে এগোতে চাইছি, কেন তোমরা সেটাকে এনকারেজ করছো না? তুমি তো অন্তত বুঝতে চেষ্টা করো মা।

    সুতপাকে একটু অপ্রস্তুত লাগলো।

    --আসলে দেবু সারাক্ষণ তোকে নিয়ে নানারকম চিন্তা করে…

    --বুঝি। ছোটকা আমাকে খুশি দেখতে চায়। আমার মুখে হাসি না থাকলে ছোটকারও মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। সেটাও ফিল করি মা। সেইজন্যেই তার মতো করে একটা সাজানো গোছানো জীবন আমার হাতে তুলে দেওয়ার কথা ভাবছে। এসব আমার আর ভালো লাগছে না মা।

    এতটা কঠিন কথা যে কখনো ওর মুখ দিয়ে বেরোতে পারে, আগে জানতো না রূপঞ্জনা। তাও মায়ের মুখের ওপর। ভাবলো রমলা গুহর ইচ্ছেপুতুল নিজের মতো চলতে চাইছে তাহলে। পারবে কি না সেটা পরের কথা, ইচ্ছেটা যে জেগেছে সেটাই ওর অভিপ্রেত ছিল কি? সুতপা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। এতদিন ইঁট চাপা পড়া নিস্তেজ বিবর্ণ ঘাস কি হঠাৎ নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সচেতন হয়ে উঠলো?

    মায়ের অপ্রস্তুত মুখের দিকে তাকিয়ে একটু খারাপ লাগলো বটে, কিন্তু কথাগুলো বলে ফেলে নিজের আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল কয়েক গুণ।

    এইরকম অনেক ছোট ছোট ঢেউ-এর আনাগোনার ভেতর দিয়ে স্রোতের মতো সময় এগোলেও সেইসব ঢেউ রূপাঞ্জনার পায়ের পাতাটুকুই শুধু ভিজিয়ে দিয়ে চলে গেল, ওকে স্পর্শ করলো না। ওর তখন ঘোর লেগেছে। ও তখন ওর ধুলোয় ছড়িয়ে পড়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোকে পরম আদরে তুলে নিয়ে নতুন করে তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। এ এক অদ্ভুত আত্মপ্রেম। নিজেকে ঘিরে আশ্চর্য উন্মাদনা। নিজেকে প্রমাণ করতে হবে, কিন্তু কার কাছে? হয়তো নিজের কাছেই। মনে হলো ওর জন্যে অজস্র সম্পদ সাজিয়ে রেখেছে পৃথিবী, এতদিন চোখ তুলে দেখেনি। ভালোবেসে নিজের হাতে পৃথিবীর যাবতীয় আনন্দসম্ভার তুলে দিতে ইচ্ছে হলো।


    || ২২ ||

    চিলে কোঠার ঘরটা খুব খোলামেলা। বড় বড় দুটো জানালা, একদিকে রেলিং ঘেরা একটা ছোট্ট বারান্দাও আছে। যেখানে দাঁড়ালে গ্যালাক্সিটাকে পাশের বাড়ি বলে মনে হয়। আগে এখানে এলে রূপাঞ্জনার ভয় করতো। মনে হতো নিজের ভারসাম্য রাখতে পারবে না। ভয়ঙ্কর এক শূন্যতাবোধে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতো। এখন মনে হলো ওই শূন্যতার মধ্যেই নিজের জন্যে একটা অন্য পৃথিবী গড়ে নেওয়া খুব সহজ হবে। তা যেমনই হোক।

    পড়াশুনার জন্যে রূপু ওই ঘরটা ব্যবহার করবে শুনে রমলা লোক লাগিয়ে ঘরটাকে নতুন করে রং করিয়ে দিলেন। দিব্যেন্দু যখন কলেজে পড়তো, এটাকেই সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছিল। ইদানিং ব্যবহার হয় না। তবু পবন টবে টবে কিছু গাছ লাগিয়ে এক চিলতে বারান্দাটায় রেখেছে। মানিপ্ল্যান্ট আর জুঁইফুলের গাছ লতিয়ে লতিয়ে বারান্দার রেলিংটাকে প্রায় ঢেকে রেখেছে। নিয়মিত দেখাশোনা করে। অন্য কেউ বড় একটা আসে না ছাদে। এতবড় ছড়ানো বাড়িতে ছাদটা বড়ই একটু, আর নিরিবিলি। কেউ নির্জনতা চাইলে ওটা একেবারে আদর্শ জায়গা। দিব্যেন্দু চিলেকোঠার ঘরটাকে পড়াশুনার জন্যে যতটা না তার চেয়ে বেশি প্রেফার করেছিল অন্য কারণে। তখন ওর নির্জনতার খুব প্রয়োজন ছিল। শর্মিলার সঙ্গে তুমুল প্রেম চলছে। তখন তো চিঠি লেখালেখির যুগ।

    --জানিস তো শর্মি, আমি কতবার চুপি চুপি গিয়ে দেখে ফেলেছি ওর চিঠি। একটা কঙ্কাল সামনে দঁড়িয়ে থাকতো বটে কিন্তু আসলে তার সামনে বসে প্রেমপত্র রচনা চলতো।

    দিব্যেন্দুর বিয়ের পর সুতপা ঠাট্টা করে বলতো।

    ঘরটা নিজের মতো করে গুছিয়ে নিলো রূপাঞ্জনা। অমলা কিছুতেই কঙ্কালটাকে রাখতে দেবেন না ওখানে। কিন্তু ওটাকে সরিয়ে আর কোথায় রাখা যায় সেটা ঠিক করা যাচ্ছিল না। একসময় রূপাঞ্জনা রবীন্দ্রনাথের কঙ্কাল গল্পটা পড়ে শুনিয়েছিল অমলাকে। রূপাঞ্জনা হেসে অমলাকে বললো,

    --ওটা থাক না এখানে। যখন পড়তে ভালো লাগবে না, ওর সঙ্গে গল্পগুজব করবো।

    --ও সারাক্ষণ তোর দিকে দাঁত বার করে হাসবে, সেটা কি ভালো হবে?

    --সারাক্ষণ হাসবে কে বললো? ওর পুরোনো কোনো দুঃখের স্মৃতি মনে করে কাঁদতেও তো পারে।

    অমলা নাছোড়বান্দা। শেষ অব্দি কঙ্কালটার সামনে একটা বড় পর্দা টাঙিয়ে দেয়া হলো।

    দিনের বেলায় চিলেকোঠার ঘরে বসে পড়াশুনা করে রূপাঞ্জনা। বলতে গেলে দিনের বেশিরভাগ সময় ওখানেই কাটায়। এই স্পেসটুকু ওর দরকার ছিল নিজেকে একটা অন্য বৃত্তের কেন্দ্রে প্রতিস্থাপিত করার জন্যে। কিন্তু ওর এই নির্জনতা অমলার একদম পছন্দ না। সময় পেলেই সেই সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে ছাদে চলে আসেন। কখনো একটু গল্পগুজব হয় আবার কখনো ঘুরেফিরে আপন মনে বকে বকেই ছাদের নির্জনতা ভেঙে দিয়ে চলে যান। সবসময় সাড়া দেয় না রূপাঞ্জনা। আসলে এই একান্তের নির্জনতাটুকু দরকার ওর। নিজেকে বোঝার জন্যেও।

    নিজেরই মনে হচ্ছে হঠাৎ বয়সটা বেশ খানিকটা বেড়ে গেছে। অদ্ভুত উত্তরণ। সারাদিন ওর ডানার ছটফটানিতে এ বাড়ির শিরায় রক্ত সঞ্চালিত হতো। এখন ওকে দেখলে মনে হয় ঝড়-বৃষ্টির পরের অকম্পিত বৃক্ষশাখা। সবুজ শান্ত। ওর নিঃশ্বাসের শব্দটুকুও যেন আর টের পায় না এ বাড়ির কেউ।


    এ বাড়িতে কিছু কিছু প্রথা যা অনেকদিন থেকে চলে আসছে, সময় পালটালেও সেগুলোকে কেউ না কেউ ধরে রেখেছে। প্রত্যেক বছর কালীপুজোর দুদিন আগে থেকে রূ আর রনকে নিয়ে রূপাঞ্জনার চোদ্দ প্রদীপ গড়ার ধুম পড়ে যেত। গতবছরটা সব অর্থেই প্রায় নিষ্প্রদীপ কেটেছে। এবার অনেক আশা নিয়ে গৌরী কোত্থেকে এঁটেল মাটি জোগাড় করে এনেছে। কিন্তু রূপাঞ্জনার দিক থেকে সেভাবে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে কিছুটা হতাশ। অগত্যা অমলাকে ডেকে এনেছে। গৌরী আর অমলা দুজনেই কথা বলতে ভালোবাসে। গৌরীও সারাদিন কারণে অকারণে বকে যায়।

    --আগে রূপুদিদির ফরমায়েশে আমি অস্থির হয়ে যেতাম, তোমার মনে আছে রাঙাদিদা? বলতো, এমন পিদিম বানিয়ে দাও, অমন পিদিম বানিয়ে দাও। তখন পিদিম গড়তে গড়তে আমার হাতদুটো কত খুশি হয়ে উঠতো। আর দেখ আজ ছাদের ঘরে বই মুখে দিয়ে পড়ে আছে।

    দুহাতে কাদার তাল মাখতে মাখতে গৌরী একটা নিঃশ্বাস ফেললো। এ আক্ষেপ মনে মনে অমলারও। তবু মুখে বললেন,

    --তুই থামতো গৌরী। ভগবান যা করেন ভালোর জন্যেই করেন।

    --সবসময় করেন না। কী ভালোটা হয়েছে শুনি?

    --আগে ডানায় ভর দিয়ে চলতো, এখন মাটিতে পা দিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে। এবার মাটির সঙ্গে ভালোবাসা হবে, মাটিতে শেকড় বসবে তবে তো মহীরুহ হবে।

    --মহীরুহ কী গো রাঙাদিদা?

    --বটগাছ। আশ্রয়দাতা বৃক্ষ।

    --বুঝেছি। বড়মা যেমন। সে না হয় মহীরুহ হলো। কিন্তু রূপুদিদি অমন গম্ভীর হলে কি মানায়?

    --বড় হয়েছে বয়স বেড়েছে, একটু ভাবগম্ভীর না হলে চলে?

    --এক বছরে ক’বছর বয়েস বেড়েছে রূপুদিদির যে এমন ভারিক্কি হয়ে যাবে?

    মাটির তাল মসৃণ করতে করতে আপনমনে বকে যায় গৌরী। প্রায় বত্রিশ বছর ধরে এখানে আছে। এ বাড়ির হৃদ্‌স্পন্দনের সঙ্গে ওর প্রাণের যোগ।

    --তা ভালো, বড়মা আর ক’দিন। তারপর তো হাল ধরার মতো মানুষ চাই একজন। এ বাড়ির পুরুষ মানুষরা তো কেউ ভরসার যুগ্যি না। সব কেমন যেন ঠাঁইনাড়া।

    --ও আবার কী কথা!

    --তা নয় তো কী? অমন সব লক্ষ্মীপিতিমে নিজের ঘরে মন বসে না।

    --তোর বড় মুখ বেড়েছে গৌরী। মন না বসার কী দেখলি।

    অমলার বকুনি গায়ে না মেখে নিজের মনে ছোট ছোট মাটির দলা ভাগ করতে থাকে গৌরী।

    গৌরী বলতে গেলে জন্মের পর থেকেই এ বাড়িকে চেনে। ওর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে এ বাড়িতেই খেয়ে পরে বড় হয়েছে। এই বাড়ির উপর ওর একটা স্বতঃস্ফুর্ত ভালোবাসা আর অধিকার বোধ। রমলা ওর বিয়েও দিয়েছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই বরের সঙ্গে মারপিট করে পালিয়ে এসেছে। ওর পালিয়ে আসার কারণটা খুব অভিনব ও মজার। কী না, বর কানে কালা। চেঁচিয়ে না বললে কিছু শুনতে পায় না। বিয়ের পর প্রথমবার এখানে ফিরেই আর যেতে চায় না। জিজ্ঞেস করলে মুখ খোলে না। শেষে অমলা ওর পেট থেকে কথা বার করলেন।

    --একটা আস্তে কথা শুনতে পায় না গো রাঙাদিদা। স্বামী-স্ত্রী কি সর্বক্ষণ পাড়ার লোক জানিয়ে কথা বলবে নাকি? আস্তে করে যদি বলি ছাড়ো, তো জাপটে ধরে, আর ধরো বললে সরে যায়। কীসের সুখ বলো তো রাঙাদিদা? শুধু খাওয়াপরার জন্যে আমি পরের বাড়ি থাকতে পারবো না। আমি তাকে একটা গোপন কথা বললে সে শুনতে পায় না, তার বৌদি এসে সেটা কানে ঢুকিয়ে দিয়ে যায়। সে মাগী তো সারাক্ষণ কান পেতে থাকে আমাদের দুজনের মাঝখানে। বরের সঙ্গে দুটো গোপন কথাই যদি না বলতে পারলাম তো কীসের বিয়ে?

    - সে কথা তো ঠিক। তুমি জোর করে আর ওকে পাঠিও না সারদা। শেষে কি দমবন্ধ হয়ে মরবে মেয়েটা?

    রাঙাদিদার মনে ধরেছিল গৌরীর যুক্তি। সারদা কিছুতেই মানতে চায় না। সে মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাবেই শেষে সাতকাহন করে সেই কথা রমলার কানে তোলেন অমলা। রমলা বলেছিলেন কানের যন্ত্র কিনে দেবেন। উত্তর গৌরীর ঠোঁটের ডগায় তৈরি, যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে কি আর মনের কথা মনে যায়?

    ওর কথা শুনে বাড়ির লোক হাসবে না কাঁদবে ভেবে পায় না। গৌরী আর শ্বশুরবাড়িমুখো হয়নি। ওর বর বছরখানেক এখানে যাওয়া-আসা করেছে, সাধাসাধি করেছে। তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে নিজে আবার বিয়ে করে নিয়েছে। গৌরীকে দেখে মনে হয় না সেজন্যে ওর কোনো দুঃখ আছে। দিব্যি সকলের সুখেদুখে মিশে পরম আনন্দে থাকে।

    --গৌরীদি তোমার প্রদীপ সব কি গড়া হয়ে গেছে?

    সিঁড়িতে রূপাঞ্জনার গলার আওয়াজ পেয়ে গৌরীর মুখে হাসি ফোটে।

    --না গো। তোমার জন্যেই তো বসে আছি। শিগগিরি এসো।

    --মাটি রেখো, রূ রনও এসে পড়লো বলে। ছোটকা ফোন করেছিল।

    গৌরীর মুখ দেখে যে-কারোর মনে হবে, সলতেবিহীন প্রদীপে আলো জ্বলে উঠেছে।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০ | পর্ব ১১ | পর্ব ১২ | পর্ব ১৩ | পর্ব ১৪ | পর্ব ১৫ | পর্ব ১৬ | পর্ব ১৭ | শেষ পর্ব
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments