• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯০ | এপ্রিল ২০২৩ | উপন্যাস
    Share
  • পরীবাগান ও এক গল্পের মেয়ে (১৪) : অঞ্জলি দাশ



    ।।২৫।।

    সদর দরজার গেটে হাত রেখে দাঁড়িয়েছিল লোকটা। পরনে ছাই রঙের প্যান্ট আর সাদা টি-শার্ট। গায়ের রঙ ফর্সা, কিন্তু মলিন। অযত্নের ছাপ। ভঙ্গীতে দ্বিধা। বার কয়েক এদিক ওদিক মাথা ঘুরিয়ে বাড়িটাকে দেখলো। তারপর সন্তর্পণে গেটটা একটু ফাঁক করলো। এক পা ভিতরে রেখেও আবার বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো। অমলা এতক্ষণ জানালা দিয়ে সব লক্ষ্য করছিলেন লোকটা ভিতরে ঢুকতে গিয়েও ঢুকলো না, আবার চলেও গেল না। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে দেখে কৌতূহল নিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন অমলা।

    --গেটের সামনে কে? যেই হও, ভেতরে এসো।

    গেট খুলে এবার ভিতরে এলো লোকটা। অমলা আঁচলের কোণ দিয়ে চশমার কাঁচ মুছে নিয়ে আবার চোখে পরলেন। ওঁর খুব চেনা লাগছে, কিন্তু নিশ্চিত হতে পারছেন না। লোকটা ওর কাছে এগিয়ে এসে প্রনাম করলো।

    --বড়মার সঙ্গে একটু দেখা করা যাবে?

    --এ বাড়িতে কে তোমার বড়মা বাপু?

    --রমলা গুহ।

    অমলা চমকে উঠলেন। তবে কি...

    --একটু দাঁড়াও। চলে যেওনা, আমি দেখছি এখন নিচে আসতে পারবেন কিনা।

    রমলা আগে তিনতলায় থাকতেন। সিঁড়ি ভাঙতে অসুবিধা হয় বলে বছর তিনেক হলো দোতলায় নেমে এসেছেন। কিংবা বলা যায় ওঁর নতুন উত্তরসূরিকে নিজের সিংহাসনে বসিয়ে দিয়ে চলে এসেছেন। এক তলায় থাকতে চেয়েছিলেন। কেউ রাজি হয়নি, বিশেষ করে সুতপা। সুতপাই নিজের পাশের ঘরে ওঁর ব্যবস্থা করে দিয়েছে। রাতে মাঝেমাঝে উঠে এসে দেখে যায়।

    সাড়ে তিনটে বাজে এইসময় বাড়ি শুনশান থাকে। সবাই যে যার ঘরে বিশ্রাম করে। পৌলমী আর অপর্ণার দিবানিদ্রা বাঁধা। সুতপার ঘুমোনোর অভ্যেস নেই দুপুরে। বই পড়েন বা সেলাইটেলাই করেন। রম্য স্কুল থেকে ফেরে সেই পাঁচটায়। তখন জেগে ওঠে বাড়ি। একতলায় গৌরি আর পবন বিকেলের জলখাবারের তোড়জোড় শুরু করে। পৌলমীর হাঁকডাক শুরু হয়ে যায় চায়ের জন্যে।

    রমলা জেগেই শুয়েছিলেন। অমলা দরজার পর্দা সরিয়ে সন্তর্পণে উঁকি দিলেন।

    --দিদি উঠে একবার বারান্দায় এসে নিচে চেয়ে দেখতো।

    --কেন কী হয়েছে?

    --দেখই না। কে একজন এসেছে। তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে।

    রমলা উঠে বাইরে এলেন। ওপর থেকে দেখে চিনতে পারলেন না। অমলা ফিসফিস করে বললেন,

    --আমার মনে হচ্ছে সে-ই।

    --কে?

    --শ্রীরামপুরের।

    --যেই হোক, বসার ঘরে অপেক্ষা করতে বল। আমি যাচ্ছি। আর একটু পরে পবনকে দিয়ে চা জলখাবার পাঠিয়ে দিতে বল।


    রমলা কিছুটা বিস্ময় নিয়েই ঘরে এলেন। তারপর শাড়ি পালটে নিয়ে নিচে গেলেন। রমলাকে দেখেই তটস্থ হয়ে উঠে দাঁড়ালো লোকটা। প্রণাম করলো। দাঁড়িয়েই থাকলো।

    --আমি কৃষ্ণেন্দু, চিনতে পারছেন?

    --বোসো।

    আপাদমস্তক পড়ে নিচ্ছেন রমলা। চেহারায় এত কষ্টের ছাপ কেন? তবে কি ঠিকমতো গুছিয়ে নিতে পারেনি? নিজের বিবেচনা মতো যথাসাধ্য করেছেন রমলা। সব চেষ্টা কি তাহলে জলে গেছে?

    --কোথায় থাকো এখন?

    --শ্রীরামপুরেই।

    --কী করো?

    --এল আই সি-র এজেন্সি আছে।

    --ব্যাস!

    --আরও দু’একটা ফিন্সিয়াল কোম্পানির…

    --কলেজ স্ট্রিটের বাড়িটা কী হলো?

    --কলেজ স্ট্রিটের বাড়িটাতে আমি পাবলিকেশানই শুরু করেছিলাম।

    --পাবলিকেশান! হঠাৎ পাবলিকেশানের আইডিয়া মাথায় এলো কেন?

    --একসময় বাবা তো তাই চেয়েছিলেন। তাঁর তো স্বপ্ন ছিল ওই বাড়িতে একটা বিরাট পাবলিকেশান হাউস গড়ে উঠুক।

    --কে বললো?

    --মায়ের মুখে শুনেছি। বাড়িটা আপনি আমার নামে রেজিস্ট্রি করে দেওয়ার পর মা একদিন কথাচ্ছলে বলেছিলেন। স্কুল পাঠ্য বই দিয়ে শুরু করেছিলাম। তারপর শিশু-কিশোর সাহিত্য। বেশ ভালো চলছিল।

    --এখন চলছে না?

    --মাথায় কী যে ভুত চাপলো, নামী সাহিত্যিকদের কাছে ঘুরেঘুরে তাদের গল্প উপান্যাস নিয়ে ছাপতা শুরু করলাম। একটা বইও ক্লিক করলো না। করবে কী করে, লেখকরা তাঁদের বাঁ হাতের লেখাগুলোই আমাদের মতো নতুন পাবলিশারকে দেন। ডুবেই গেল ব্যবসাটা। আমি চেষ্টা করেছিলাম, পারিনি।

    --এখন তুমি কী চাইছো? মানে আমার কাছে কেন এসেছ?

    লজ্জা পেল কৃষ্ণেন্দু। মাথা নিচু করে করে কিছুক্ষণ ভাবলো, তারপর খুব মৃদুস্বরে বললো,

    --আমি আজ কিছু চাইতে আসিনি বড়মা, একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি।

    --অনুরোধ!

    --আপনি একটি বার শ্রীরামপুর যাবেন?

    --আমি!

    --জানি অন্যায় আবদার। তবু আপনি বলেই ভরসা করে বলতে পারলাম। আপনি অযাচিত ভাবে আমাদের জন্যে অনেক করেছেন বড়মা। আজ যদি একবার...

    --কিন্তু কেন?

    --আমার মায়ের খুব ইচ্ছে আপনাকে একবার চোখের দেখা দেখবেন।

    --তোমার মাকে এখানে নিয়ে এলেই পারতে।

    যখন আসার ক্ষমতা ছিল, তখন তাঁর সাহস হয়নি। আজ আর উঠে দাঁরানোর ক্ষমতা নেই। তাই শেষ ইচ্ছেটুকু প্রকাশ করার সাহস দেখিয়েছেন।

    --কী হয়েছে তোমার মায়ের?

    --প্রথমে কিডনি অপারেশান, ইনফেকশান হয়ে গিয়েছিল। তা থেকেই নানারকম জটিলতা। একেবারে বিছানায় পড়ে গেলেন। মায়ের ইচ্ছেটুকু জানালাম আপনাকে, জোর করতে তো পারি না। যদি সম্ভব হয়...

    রমলার প্রতিক্রিয়া বোঝ গেল না। ইতিমধ্যে লুচি, তরকারি আর মিষ্টি দিয়ে গেছে গৌরী। সেদিকে ইঙ্গিত করলেন।

    --খেয়ে নাও।

    --এতসব খেতে পারবো না আমি।

    --যেটুকু ইচ্ছে হয় খাও।

    --বড়মা, আমি লুচিটা খাবো না। ভাজাভুজি খেলেই আমার অ্যাসিড হয়।

    --তাহলে শুধু মিষ্টি খাও।

    পবন চা এনে রাখতেই খুব কুন্ঠিতভাবে কৃষ্ণেন্দু বললো, আমি চা খাই না।

    রমলার ঝট করে মনে পড়ে গেল, পূর্ণেন্দু চা খেতেন না। বিকেলে খেতেন দই এর শরবত, আর সকালে ফলের রস, গ্রীষ্মকালে বেলপানা।

    --পবন ওকে শরবত করে দে।

    রমলা যেন নিশ্চিত জানেন কৃষ্ণেন্দু দই-এর শরবত ভালোবাসে।

    --তোমরা শ্রীরামপুরে মামাদের কাছে না থেকে কলেজস্ট্রিটের বাড়িতে এসে থাকতে পারতে।

    --আমার ইচ্ছে ছিল, মা কিছুতেই আসতে চাইলেন না।

    --ও বাড়ি তাহলে কোনো কাজে লাগলো না তোমার?

    --সে কী কথা! ওই বাড়িই তো বাঁচিয়ে রেখেছে আমাদের। ওটা থেকে মাসে কুড়ি হাজার টাকা পাই। মাকে এতদিন বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছি ওই টাকার ভরসায়।

    রমলার চোখে মুখে যে বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠেছিল, সেটা মিলিয়ে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস চাপলেন।

    কৃষ্ণেন্দু চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলেন রমলা। চিরকাল সমস্ত সিদ্ধান্ত একাই নিয়েছেন। তার সবগুলো যে সেই অর্থে খুব ফলপ্রসূ হয়েছে আজ আর জোর দিয়ে সেকথা ভাবতে পারেন না। নিজের জীবনের ক্ষেত্রে হয়তো ঠিকভাবে এগিয়েছে সব, কোথাও ব্যর্থ হননি। অন্তত মাথা উঁচু করে বাঁচতে পেরেছেন। কিন্তু একটি ক্ষেত্রে যে চরম ব্যর্থতা ওঁর সমস্ত মনের জোরকে ধুলোয় লুটিয়ে দিয়েছে, এটা এখন সারাক্ষণ অনুভব করেন। আর ভেতরে ভেতরে একটা অপরাধবোধ কুরে কুরে খায়। শুধু মনে হয় রূপুর এই জীবনের জন্যে সমস্ত দায় তাঁর, তাঁরই ভুলগুলো বহন করে চলেছে রূপু, যেখান থেকে নিজেই নিজের জন্যে একটা পথ তৈরি করে নিয়েছে ও।

    এখন কেন যেন নিজের জীবনের খানিকটা প্রতিফলন দেখছেন রূপুর ভেতর একটা আঘাত বা ব্যর্থতার ওপর গড়ে তোলা অন্য এক সাফল্য ওকে কতখানি তৃপ্তি দিতে পেরেছে বুঝতে পারেন না।

    ওর ভেতর কি কোনো গোপন দীর্ঘশ্বাস নেই? আছে নিশ্চয়। রূপু সেটাকে সযত্নে আড়াল করে রাখে। একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। সন্ধে হয়ে এসেছে। শঙ্খ বাজাচ্ছেন অমলা। বাড়ির বাইরের সবগুলো আলো ভেদ করে পরীবাগানের অন্ধকার নিয়ে এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া এসে গায়ে লাগলো। একটু শিরশির করে উঠলো গা টা।

    --মা, তুমি এখানে। আমি তিনতলায় খুঁজে এলাম তোমাকে। আজ বেশ হাওয়া দিচ্ছে। নাও চাদরটা জড়িয়ে নাও।

    সুতপা এসে চাদর জড়িয়ে দিল রমলার গায়ে। পবন ট্রে-তে করে দু’কাপ চা নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়। সুতপা একটা কাপ নিজে নিয়ে অন্যটা রমলার দিকে এগিয়ে ধরলো। নিলেন না। বললেন,

    --আমার চা-টা ওপরে নিয়ে যাও। আমি যাচ্ছি।

    আত্মবিশ্বাস কমে গেছে কিছু করতে গেলে এখন একটু সাপোর্টের দরকার হয় রমলার। আর সেই সাপোর্টটা রূপাঞ্জনার কাছ থেকে পেলেই মনের জোর পান। কিন্তু শ্রীরামপুরের ব্যাপারটা নিয়ে ওর সঙ্গে কিছু তো বলতে পারছেন না, তাই নিজের সঙ্গে যুদ্ধ চলছে। বিষয়টাকে এতদিন যখন সবার অগোচরে রাখতে পেরেছেন, চান না আজ সবাই জানুক। অমলাই একমাত্র সব ঘটনার সাক্ষী। কিন্তু তার মতামত নেওয়া না নেওয়া সমান। সারাজীবন আবেগে চললো। যুক্তির কোনো ধার ধারে না। কাজেই নিজেই ভরসা।

    চা খেতে খেতে সুতপার সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প করলেন। সুতপার শুধু মনে হচ্ছিল, অন্যমনস্ক হয় আছেন রমলা। কিন্তু কারণ জানতে চাইল না। সুতপা জানে বলার মতো হলে নিজে থেকেই বলবেন, না হলে একটি শব্দও জানা যাবে না। কথা না বাড়িয়ে খালি কাপ নিয়ে নিচেয় নেমে গেল।

    শীতলবাবু রমলার সব কথা বেদবাক্যের মতো মনে করেন। সারাজীবন রমলার সমস্ত নির্দেশ অত্যন্ত বিশ্বস্ততা আর গোপনীয়তার সঙ্গে পালন করে এসেছেন। সুতপা চলে যাওয়ার পর শীতলবাবুকে ফোন করলেন রমলা।

    --পরশু বিকেলে আমার সঙ্গে বেরোবে। তিনটে নাগাদ চলে এসো আমি রেডি হয়ে থাকবো।

    --কোথায় যাবেন বড়মা?

    --শ্রীরামপুরে। তুমি বাড়ি চিনে যেতে পারবে তো?

    শ্রীরামপুর শুনে একটু ক্ষণ চুপ করে থাকলেন শীতলবাবু।

    --ঠিক আছে আমি চলে আসবো। বাড়ি আমি চিনে নেবো।

    অমলা দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। নিজের কৌতূহল চেপে রাখতে পারলেন না।

    --দিদি তুমি সত্যিই শ্রীরামপুর যাবে?

    --মিথ্যে আবার যাওয়া যায় নাকি?

    অমলা বুঝলেন এ ব্যাপারে এর চেয়ে বেশি একটা শব্দও শোনা যাবে না।

    ।।২৬।।

    বিভাসরঞ্জন বসুর বাড়িটাই এখন কিছুটা দলীয় কার্যালয়ের মতো। প্রায় সাত আট কাঠা জায়গা জুড়ে নিচু পাঁচিলঘেরা পুরোনো আমলের বাড়ি। মরচে ধরা লোহার গেট দিয়ে ঢুকে সামনে অনেকটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দু’চারটে জবা, টগর আর একটা বড়সড় চাঁপা ফুলের গাছ, যার চারপাশটা গোল করে বাঁধানো।

    ফাঁকা জায়গাটা পেরিয়ে এসে বসার ঘর। পুরোনো দিনের বৈঠকখানার মতো ঢাউস কাঠের সোফা। হাতলওয়ালা কয়েকটা কাঠের চেয়ার। ইদানিং কিছু প্লাস্টিকের চেয়ারও ঢুকেছে – দেয়ালের মলিন হয়ে যাওয়া অয়েল পেন্টিং-এর সঙ্গে যা একান্তই বেমানান। গোটা দুয়েক কাঠের আলমারিতে ঠাসা আইনের বই। অপেক্ষাকৃত নতুন আলমারিটায় রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, জীবনানন্দের পাশাপাশি কার্ল মার্ক্স থেকে রামকৃষ্ণ কথামৃত। দোতলাটা ছোট ভাই বিবেকের। সেখানে আধুনিক গৃহশয্যা। বিবেক চাকরিসূত্রে যদিও সপরিবারে দিল্লিতে থাকে। ওপরটা তাই তালা বন্ধই থাকে। মা এবং জনাকয়েক কাজের লোক নিয়ে এক তলাটা জুড়ে বিভাসের রাজত্ব। মা এখনও তার অভিভাবক। অকৃতদার এই মানুষটি সজ্জন ও সহৃদয় বলে পাড়ায় যথেষ্ট সুনাম ও সম্মান।

    সামনেই দার্জিলিং এ পার্টির জেলা সম্মেলন। এখান থেকে কে কে যাবে তাই নিয়ে মিটিং চলছে। দার্জিলিং বলেই অনেকেরই যাওয়ার ইচ্ছে। কিন্তু এখানকার লোকাল কমিটি থেকে চার পাঁচজনের বেশি নেওয়া যাবে না, বিভাস সেটা জানিয়ে দিয়েছেন। রূপাঞ্জনা সহ আর তিন চারজন যাবে। রূপাঞ্জনার অবশ্য যাওয়ার খুব একটা ইচ্ছে নেই। একটু সঙ্কোচের সঙ্গেই বলেছিল, আমি না গেলে হয় না বিভাস দা? সেই কথার সূত্র ধরেই একজন বললো,

    --ম্যাডাম যখন যেতে চাইছেন না, তখন তার জায়গায় অন্য কাউকে ভাবলে হয় না বিভাস দা?

    --তোমাদের ম্যাডাম কিন্তু একবারও বলেননি যে তিনি যেতে চান না। যে কোনো কথার সঠিক অর্থ করতে শেখো। উনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘আমি না গেলে হয় না’? আমি বলছি, হয় না। আমি পাহাড়ের মানুষকে পার্টির কোমল মুখটা দেখাতে চাই। তোমাদের মুখে বড় বেশি রাফনেস। তোমাদের ম্যাডামকে দিয়ে যে অ্যাপ্রোচটা সম্ভব, অন্য কাউকে দিয়ে সেটা সম্ভবনা। কোনো অবজেকশান?

    ওঁর যুক্তির কাছে সবারই ঘাড় কাত। কাজেই রূপাঞ্জনাকে যেতেই হবে দার্জিলিং।

    টু-টিয়ার এসির এই কম্পার্টমেন্টে ওদের পাঁচজনের তিন জায়গায় সিট পড়েছে। সবগুলোই আপার বার্থ। শেষ মুহূর্তে রিজার্ভেশান হয়েছে। কৃষ্ণনগর গার্লস কলেজের পনেরো ষোলো জনের একটা দল উঠেছে এই কম্পার্টমেন্টে। তাদের মধ্যে তিনজন অধ্যাপিকা। রূপাঞ্জনার পাশাপাশি সহযাত্রী যে তিনজন, তাদের একজন অধ্যাপিকা বাকি দু’জন ছাত্রী। ওর ঠিক উলটো দিকে জানালার পাশে যে মেয়েটি বসেছে, পরনে হলুদ সালোয়ার কামিজ, সাদার ওপর হলুদ প্রিন্টের ওড়না। বয়স তিরিশের নিচে, হাতে অনেকগুলো পত্রিকা, মন দিয়ে তাই দেখছে আর মোবাইলে মাঝে মাঝে কাউকে ফোন করার চেষ্টা করছে। পাচ্ছে না, বিরক্ত মুখে আবার পত্রিকায় চোখ রাখছে। চোখে মুখে বিরক্তির সঙ্গে একটা উদ্বেগও ফুটে আছে। বারবার ওর দিকে চোখ চলে যাচ্ছে রূপাঞ্জনার। তার কারণ মেয়েটি খুবই সুশ্রী বলেই শধু নয়, মুখটা খুব চেনা চেনা লাগছে। বিশেষ করে যখন হাসছে বা ঘাড় বাঁকিয়ে কিছু বলছে তখন।

    এক সহকর্মী নাম ধরে ডেকে কিছু বলছিল বলে নামটা জানা গেল, উজ্জয়িনী। মাথার মধ্যে ঘুরছে ব্যাপারটা আর মাঝেমাঝে সেজন্যে একটু অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে রূপাঞ্জনা।

    জানালা পাওয়া যায় না বলে আপার বার্থ একদম পছন্দ করে না রুপাঞ্জনা। ট্রেনে খুব একটা ঘুম হয়না ওর। ট্রেনে যেতে যেতে স্টেশানের নাম পড়তে খুব ভালো লাগে। যদিও রাতের ট্রেন, তবু প্ল্যাটফরমের আলোয় নামগুলো দেখা যায়। তাছাড়া রাতের স্টেশানের একটা আলাদা রূপ আছে, যেটা খুব উপভোগ করে ও। আপার বার্থের আর একটা সমস্যা শাড়ি পরে ওপরে ওঠানামা করা।

    কোথাও বেড়াতে গেলে সাধারণত সালোয়ার কামিজ পরেই যায়। আজ একটা মিটিং থেকে সরাসরি স্টেশানে চলে এসেছে বলে চেঞ্জ করতে পারেনি। পবন ব্যাগ আর খাবার স্টেশানে পৌঁছে দিয়েছে। খাবারের ব্যাপারটা কিছুতেই আটকাতে পারলো না রূপাঞ্জনা।

    ও বলেছিল, বিভাসদা একা হলে তাও একটা কথা ছিল, ভাগ করে খেয়ে নিতাম। সঙ্গে আরো চার পাঁচজন যাচ্ছে। তাদের মাঝখানে আমি একা খাবার বার করে খেতে পারবো না।

    সুতপা আর রমলাকে বোঝানো গেলেও গৌরী যে বুঝতে চায়নি সে তো বোঝাই গেল।

    --ম্যাম আপনার আপার বার্থ?

    নীল জিনস আর হালকা গোলাপি টপ পরা মেয়েটি রূপাঞ্জনার কাছে জানতে চাইলো। ও এতক্ষণ উজ্জয়িনীর সঙ্গে নিচু গলায় কিছু বলছিল। উজ্জয়িনী একবার রূপাঞ্জনার দিকে তাকালো।

    --হ্যাঁ, কেন বলো তো?

    --আপনি আমার সঙ্গে এক্সচেঞ্জ করবেন? আমার লোয়ার বার্থ।

    --সানন্দে। জানালা পাওয়া যায় না বলে আমি আপার বার্থ একদম পছন্দ করিনা।

    --ওহ, বাঁচা গেল। আই হেট লোয়ার বার্থ। আমি ঘুমিয়ে থাকবো, আর জনগন আমার ঘুমন্ত শরীরে চোখ বুলিয়ে যাবে! ইমপসিবল! ভাবলেই আমার কাতুকুতু লাগে। ঘুমই আসবে না।

    --থ্যাঙ্কস। কী নাম তোমার?

    --মৌলী।

    --কোথায় যাচ্ছো তোমরা?

    --প্রথমে কালিম্পং ফর এক্সকারশান। তারপর দার্জিলিং ফর কাঞ্চনজঙ্ঘা।

    মৌলী নিশ্চিন্ত হয়ে হাত পা ছড়িয়ে আরাম করে বসলো। তারপর কাঁধের ব্যাগ খুলে মুড়ে রাখা আধ খাওয়া চকলেটে কামড় দিল। ওর বউ উলটোদিকে বসা মেয়েটিকে বললো – সরি ঋতু, এটা আমার এঁটো চকলেট। তোকে অফার করতে পারলাম না।

    রূপাঞ্জনার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বললো, অনেকটা সময় একসঙ্গে কাটাতে হবে, ইন্টড়োডিউস করিয়ে দিই– ও ঋতুপর্ণা আমার ক্লাসমেট। একশোয় একশোদশ পাওয়ার মতো ছাত্রী। আর ইনি আমাদের বটানির ম্যাম উজ্জয়িনী সরকার।

    উজ্জয়িনী একটু হাসলো। রূপাঞ্জন হাসি ফিরিয়ে দিতে গিয়ে আবার আটকে গেল ওর মুখে। কোথাও আঁতিপাতি করে খুঁজছে। কার মুখ ঠিক এইরকম… জানালার কাঁচের ভেতর দিয়ে বাইরের চলমান আলো দেখতে দেখতে ভাবছে।

    --ম্যাডাম বিভাসদা জানতে চাইছেন আপনার কাছে কি খাবার আছে? আমার খাবারের অর্ডার দিচ্ছি।

    --হ্যাঁ বাড়ি থেকে খাবার পাঠিয়েছে, তোমরা খেয়ে নাও।

    একটা খবরের কাগজ দিয়ে চলে গেল সুনন্দ। পার্টির উদীয়মান নক্ষত্র, বিভসদার ভাব-শিষ্য। বিভাস প্রায়ই রূপাঞ্জনাকে বলেন, সুনন্দর মতো তরুণ তুর্কিরাই তমার সৈনিক। স্বচ্ছ আলোকিত ভাবনা, খোলা মনে নতুন কিছু গ্রহণ করার ক্ষমতা ও সদিচ্ছায় ভরপুর ছেলেটা। ওকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে সুবিধা হবে তোমার। আমরা তো দরকচা মেরে গেছি। আর দু’দিন পরে বাতিলের দলে পড়ে যাবো।

    রূপাঞ্জনা মনে মনে হাসলো, আজ সারাদিন কাগজ দেখার সময় হয়নি, ঠিক খেয়াল করেছেন বিভাসদা। না হলে রাতের বেলায় খবরের কাগজ পাঠানোর কথা মনে হতো না। পরশুর জনসভায় রূপাঞ্জনার বক্তৃতা। ভদ্রলোকের এত তীক্ষ্ণ নজর সব দিকে!

    দার্জিলিং-এ আসার জন্যে পার্টির অনেকেই আগ্রহী থাকলেও বিভাসরঞ্জন বসুর ইচ্ছের ওপর কেউ দ্বিমত পোষণ করে না। তার কারণ ওঁর ব্যক্তিত্ব এবং যেকোনো ব্যাপারে নির্ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। এজন্যে পার্টিতে ওঁর গুরুত্ব সবাই জানে। কিন্তু তবু রূপাঞ্জনার মনে হয় বিভাসদা ওর ব্যাপারে সবসময় খানিকটা পক্ষপাতিত্ব করেন।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০ | পর্ব ১১ | পর্ব ১২ | পর্ব ১৩ | পর্ব ১৪ | পর্ব ১৫ | পর্ব ১৬ | পর্ব ১৭ | শেষ পর্ব
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments