সোমনাথ যখন খড়গপুর আইআইটিতে ভর্তি হয় সেই সময়টায় সুবিমল কাকুদের আর্থিক সঙ্কট চরম ছিল। প্রচুর ধারদেনাও তো ছিল। প্রথমে সোমনাথ হঠাৎ বেঁকে বসেছিলো ও যাবে না খড়গপুর। কলকাতায় কোনো কলেজে ভর্তি হবে। সুবিমলকাকু খুব মুষড়ে পড়েছিলেন ওর এই সিদ্ধান্তে। নিজের সব ভালোমন্দ একমাত্র আম্মাকেই বলতেন। সব কথা নিজের পরিবারেও জানাতেন না।
-সোমকে নিয়ে স্বপ্ন তো অনেক, কিন্তু ওকে শেষপর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারবো কিনা জানি না।
আম্মা বলেছিলেন, কেন পারবি না? আমি তো আছি। সোমের পড়াশুনার দায়িত্ব তুই আমার ওপর ছেড়ে দে।
সুবিমল কাকু হাসিমুখে বলেছিলেন, সোমকে তো আমি তোমার হাতেই তুলে দিয়েছি, কিন্তু ওকে তোমাদের যোগ্য করে তবেই না দিতে পারবো। বাবা হিসেবে ওর প্রতি এটুকু কর্তব্য তো আমাকে করতে হবে।
-টাকার জন্যে তোর ভাবতে হবে না। আর এই ব্যাপারটা তোর আমার মধ্যে রাখ, অন্য কাউকে জানাস না। সোমকে বুঝিয়ে বল যে তোর কোন অসুবিধা হবে না। ওরও তো স্বপ্ন এটা।
ছোটবেলা থেকেই বাবা আর সুবিমলকাকু অভিন্নহৃদয় বন্ধু। সোমনাথের জন্মের আড়াই বছর পর আমার জন্ম হতেই দুজনে ঠিক করে রেখেছিলেন বন্ধুত্বকে আত্মীয়তায় পরিণত করবেন। আম্মা কথাটা শুনেই নাকি খুব ক্ষুব্ধ হয়ে বাবাকে বলেছিলেন, এসব সেকেলে পরিকল্পনা মাথা থেকে বার করে দিতে। পরে একটু একটু করে আম্মার মন পালটেছে। আম্মাও সোমনাথকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন। ওকে নিয়ে একটা অদৃশ্য পরিকল্পনা গড়ে উঠেছিল আম্মার মনে। এমনিতে সোমনাথকে আমাদের বাড়ির সবাই খুব ভালোবাসতো।
সোমনাথের যখন ফাইনাল ইয়ার, তখন আবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন সুবিমলকাকু। যন্ত্রের হৃদপিণ্ড কাজ করছিল না। এই সময়ই ওদের সবচেয়ে সঙ্কটের সময় ছিল। আম্মার কাছে দেনার দায়ে ডুবে আছেন । তবু আম্মাই পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। মেজকা সঙ্গে করে আবার নিয়ে গেলেন ভেলোর। ঋণের ভার কুরে কুরে খাচ্ছিল সুবিমল কাকুকে।
-বড়মা আমি আর ভার বইতে পারছি না। জয়া বা সোম কেউই আমার এই আর্থিক জীর্ণ অবস্থা পুরোপুরি জানে না। ওদের সামনে এলে মনে মনে আমি সঙ্কুচিত হয়ে যাই। শুভেন্দু যে আমার এত বন্ধু ওকেও কখনও কিছু বলিনি।
-নিজের দুঃখের কাহিনী জনে জনে বলে বেড়ানোর দরকার কী?
-একমাত্র তুমিই আমার অবস্থা সবটুকু জানো। তোমার কাছে তো কোনোদিন কিছু লুকোইনি আমি।
-মায়ের কাছে ছাড়া আর কার কাছে বলে মানুষ? এখন কী চাইছিস?
-পরীবাগান অন্য হাতে যেতে চাইছে। সে হাত তোমার হলেই বাগানটা বেঁচে যাবে। না হলে মানুষের লোভ থেকে একে আমি রক্ষা করতে পারবো না। কত লোক যে পেছনে লেগে আছে, হাউজিং কমপ্লেক্স করবে বলে। আমাকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না।
তুই সবাইকে বলে দিস পরীবাগান গুহরা নিয়ে নিয়েছে। কিনতে চাইলে আমার সঙ্গে কথা বলতে হবে।
-বানিয়ে বলে আর কতদিন আমি সামলে রাখতে পারবো? সে মনের জোরও আমার নেই। ঋণের ভারে আমার আয়ু কমে আসছে বড়মা। তুমি আমাকে কিছুটা ভার কমাতে দাও।
-মায়ের কাছে আবার ঋণ কিসের?
-তোমার স্নেহের ঋণ তো আমি কোনোদিন শোধ করতে পারবো না। করতে চাইও না। কিন্তু যে দায়গুলো আমার নিজের সেগুলো তো আমাকে পালন করতে দাও। নাহলে মরেও আমি শান্তি পাবো না।
-কথায় কথায় এতো মরার কথা বলিস না তো আমার সামনে।
ভেলোর থেকে ফিরে এসে তড়িঘড়ি পরীবাগান রেজিস্ট্রি করে দিলেন আম্মার নামে।
তারপর আর বছর দু’য়েক বেঁচেছিলেন। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে, একদিন সন্ধেবেলায় আমি আম্মার আলমারি গুছিয়ে দিচ্ছি, আর আম্মা কীসব হিসেবপত্রে চোখ বোলাচ্ছেন, তখন একটা ফাইল হাতে সুবিমলকাকু এলেন।
-বড়মা আমার একটা জিনিস তোমার কাছে রাখতে এলাম।
-কী?
সুবিমলকাকু ফাইলটা এগিয়ে দিলেন। আম্মার কপালে ভাঁজ। বললেন,
-এ তো মনে হচ্ছে তোর বাড়ির দলিলপত্র।
-নিজের ওপর আমার আর বিশ্বাস নেই। এটা তোমার কাছে রাখো। আমি কখনও চাইলেও আমাকে দিও না। আমি জানি তোমার কাছে থাকলে এটা সুরক্ষিত থাকবে।
আম্মা কী বুঝলেন জানি না, তীব্র আপত্তি করলেন, কিছুতেই রাখবেন না। সুবিমলকাকুও নাছোড়বান্দা।
-তুমি সবটা বুঝবে না। কিন্তু আমার কাছে থাকলে আমি রাখতে পারবো না, ওদের বাস্তুহারা হতে হবে। জামাইও অন্যরকম পরামর্শ দিচ্ছে, সে পরামর্শ আমি নিতে পারবো না। জয়ার বুদ্ধিও তো তুমি জানো। তোমাকে ছাড়া আমি কাউকে বিশ্বাস করি না। তাই তোমার কাছে এটা রেখে দিতে চাই। পরে সোমই ফিরিয়ে নেবে তোমার কাছ থেকে।
একটু থেমে সস্নেহে আমার দিকে তাকালেন। তারপর কাছে এসে মাথায় হাত রাখলেন–ধরে নাও আমার এই মায়ের জিনিস মায়ের হাতেই রেখে দিচ্ছি। তুমি পাহারাদার মাত্র।
খুব নিশ্চিন্ত লাগলো সুবিমলকাকুকে।
এর কিছুদিন পর আম্মা আমার নামে পরীবাগানের উইল রেজিস্ট্রি করে দিলেন।
কলেজে দু’তিন দিনের কী একটা ছুটিতে তখন বাড়ি এলো সোমনাথ। আমিও সেদিন কলেজ থেকে ডুব দিয়েছি। পরীবাগানে ঘুরছি দুজনে। সোমনাথকে খুব গম্ভীর লাগলো। একটু যেন অন্যমনস্ক। কিছু ভাবছে। কিছু যেন বলতে চায়, অথচ বলতে পারছে না। আমার অস্থির লাগছে।
-তোর কী হয়েছে সোম?
-কিছু হয়নি তো।
-আমি চিনিনা তোকে তাই না? কী ভাবছিস?
-তোর কথা ভাবছি।
-অন্যসময় ভাবিস না বুঝি, তখন তো এমন বাংলার পাঁচের মতো মুখ হয়ে যায় না।
-তোর জন্যে মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে।
-কেন?
-যে প্রাচুর্যের মধ্যে বড় হয়ে উঠেছিস তুই, সেখান থেকে আমাদের বিশ্রী দৈন্যের ভেতর টেনে আনতে হবে ভাবলেই নিজেকে খুব ছোট মনে হয় তোর পাশে। সব কেমন যেন বিস্বাদ লাগে।
-ফিল্মি ডায়ালগ আওড়াস না। তোর মুখ থেকে এইরকম কথা শুনতে একদম ভালো লাগে না আমার।
-তোর ভালো না লাগলেও এই সত্যিটা তো আর মিথ্যে হয়ে যাবে না যে তুই চাইলেই যেকোনো রাজপুত্তুর এসে সসম্মানে তোকে নিয়ে সিংহাসনে বসাতে চাইবে।
-তুই বুঝি সেটা চাস না?
-সে যা পারবে, আমি চাইলেও কি আর তোকে তা দিতে পারবো?
-কেন পারবি না?
-কী আছে আমার বল?
-তোর যা আছে আমি শুধু সেটুকুই চাই। সবটুকু।
-তুই একটা ঘোরের মধ্যে থেকে কথা বলছিস। হয়তো সবকথা জানিস না তাই। আসল কথা তো আমি জানি। মর্মে মর্মে টের পাই প্রতিমুহূর্তে।
-দেখ সোম, এখন আর ওসব রাজপুত্তুরটুত্তুর পাওয়া যায় না। ওসব রূপকথায় থাকে। ওসব আমার চাইনা।
-থাক বা না থাক সব মেয়ের স্বপ্নেই রূপকথা থাকে।
ওর হতাশ ভঙ্গী আমাকে কষ্ট দেয়। জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মুখ গুঁজে দিই।
আমি হাত দিয়ে পরীবাগানের চারপাশ দেখাই। তারপর ওকে জোর করে টেনে নিয়ে ফলসা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসি–এই তো আমার সিংহাসন।
-ও সিংহাসন তো আমি তোকে দিইনি। তোর আম্মা দিয়েছেন। অথচ আমিই দিতে চেয়েছিলাম। তোকে দেওয়ার মতো ওই একটাই সম্পদ ছিল আমার। তোর আম্মাই সেটা হতে দিলেন না।
‘তোর আম্মা’ শব্দটা খট করে কানে লাগলো। তবু সোমনাথের কথা শুনতে শুনতে ওর জন্যেই আমার মন খারাপ হয়ে গেল। ওর কষ্ট আমার বুকের মধ্যে কেটে বসছিল, আর আম্মার ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছিল। ওই একবারই আমার মনে হয়েছিল আম্মা এটা ঠিক কাজ করেননি। কী দরকার ছিল সোমনাথের অধিকার থেকে ওরই একমাত্র গর্বের জিনিসটা ছিনিয়ে নিয়ে আমার হাতে তুলে দেওয়ার। দিলেন যখন আবার সোমনাথকেই দিতে পারতেন উপহার হিসেবে। অপরাধী মুখে সোমনাথের দিকে তাকিয়ে দেখি সেই পুরোনো দিনের মতো ওর চোয়াল শক্ত। চোখের ভেতর লাল রঙের শিরা জেগে উঠেছে।
কেন যেন আমার বুকের ভেতর একটা ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেল। মনে হলো ঘৃণা আর আক্রোশ দিয়ে এক অদৃশ্য প্রতিপক্ষকে আঘাত করার জন্য ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। অস্ত্র সাজাচ্ছে। কিন্তু কে যে সেই প্রতিপক্ষ, কোনদিক থেকে যে তাকে আঘাত করবে, বুঝিনি। ভাবিইনি।
ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর আম্মা একদিন সোমনাথকে ডেকে পাঠালেন। আগে আম্মা ডাকা মাত্র ছুটে আসতো, সেই প্রথম দেখলাম তোতা ডেকে আসার পর সেদিন তো এলোই না, এলো দু’দিন পরে।
-আমাকে ডেকেছিলে আম্মা?
আম্মা নির্বিকার মুখে বললেন, হ্যাঁ পরশু ডেকেছিলাম।
সোমনাথও স্বাভাবিক গলায় বললো, পরশু আমি ব্যস্ত ছিলাম। ক’দিন ধরেই দম ফেলার সময় পাচ্ছি না।
-কেন পরীক্ষা তো শেষ?
-ইন্টারভিউ ছিল।
-কীসের ইন্টারভিউ?
-আমাদের ক্যাম্পাসিং চলছে।
-এখনই চাকরিতে জয়েন করার ভাবনা মাথা থেকে বার করে দে। এমটেক-টা করে নে, তারপর ওসব নিয়ে ভাবার অনেক সুযোগ পাবি। আমার খুব ইচ্ছে তুই এম বি এ কর। সেভাবেই প্রস্তুতি নে।
-ভালো অফার পেয়েছি। ঠিক করেছি বছর দুই তিন চাকরি করার পর অন্যকিছু ভাববো। ব্যাপারটা নিয়ে তুমি আর ভেবো না আম্মা।
সোমনাথের পরিবর্তনটা কি বুঝতে পারছিলেন আম্মা? আম্মার সামনে ওকে আগের চেয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী আর ঋজু মনে হলো আমার। ওর যুদ্ধটা কি তখন থেকে শুরু হয়ে গিয়েছিল? হয়তো আরো আগে থেকেই নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছিল। নিয়ন্ত্রন মুক্ত হয়ে নিজের ব্যক্তিত্ব সেই প্রথম রমলা গুহকে চ্যালেঞ্জ জানালো যেন। জানি না আমি তখন কেন কিছুতেই কোনো এক পক্ষকে সমর্থন করতে পারছিলাম না। আম্মা যে কোনো অন্যায় করতে পারেন, এটা মেনে নেওয়া যেমন আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না, অন্যদিকে সোমনাথের ক্ষোভটাকেও অসংগত মনে হয়নি।
সোমনাথ নিজের শর্তে নিজের মতো করে ওর প্রতিপক্ষকে আঘাত করে গেল, আমি বোধশক্তিহীন একটা পুতুলের মতো শুধু আমার জীবন থেকে ওর চলে যাওয়ার পথটা চোখে পড়লো আবছা হয়ে। কিছু করার ছিল না। কেননা আমাকে ওভাবেই গড়েছিলেন আম্মা। আমার জীবনের গল্পটা ওভাবেই লেখা হয়েছিল।
(ক্রমশ)