গাড়ির আওয়াজ শুনে কান খাড়া করলো রূপাঞ্জনা। গেট খোলার শব্দ,তারপর হৈ হৈ, সিঁড়িতে ধুপধাপ – রূ আর রন-র ‘দিভা—ই’...রূপাঞ্জনা হাতের বই বন্ধ করে দরজা খুলে ছাদে এসে দাঁড়ালো। ততক্ষণে দুজনে পৌঁছে গেছে ছাদে। ওর হাত ধরে টানতে টানতে আবার ছুটছে সিঁড়ি দিয়ে। আম্মার ঘরের সামনে বাড়ির সবাই।
আগের রাতে ফোন করে এমএ-র রেজাল্ট জানাতেই দিব্যেন্দু ধরা গলায় শুধু বলেছিল, আমি জানতাম। বল, কী নিবি?
-আমার প্রিয় গিফট কী হতে পারে তুমিই সেটা আন্দাজ করে নিও।
সেটাই দিয়েছে দিব্যেন্দু। ভাইফোঁটায় পাঁচদিন কাটিয়ে যাওয়ার পরেও সপরিবারে চলে আসাটা সেই উপহার রূপাঞ্জনার কাছে।
ভালো নম্বর। সুতপা আর রমলার প্রত্যাশা বেড়ে গেল। কলেজ সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় বসতে বললেন সুতপা। নরম করে মাকে প্রত্যাখ্যান করলো রূপাঞ্জনা।
- পাবো কি পাবো না জানি না, কিন্তু কলেজে পড়ানোতে আমার কোনো উৎসাহ নেই। এক্সাইটিং কিছু করতে চাই।
রমলা ওকে কিছু বললেন না, সুতপাকে বলেছিলেন ও আই এ এস এর জন্যে প্রস্তুতি নিক। আমি জানি ও পারবে। রূপাঞ্জনা কেন যেন কারো ইচ্ছেপূরণ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে চায়।
--আমি কী করবো সেটা ঠিক করে নিয়েছি।
গভীর আত্মবিশ্বাসের সুর রূপাঞ্জনার গলায়।
--কী করবি ভাবছিস? এখন তো ল’পড়বো। তারপর একটা কমপিটিটিভ পরীক্ষা... জুডিসিয়াল সারভিস এর। বাবার ইচ্ছে ছিল। সে সব পরে ভাবা যাবে। আমি বেশিদূর ভাবিনি এখনো। বর্তমানটাতে আপাতত কনসেন্ট্রেট করি।
সুতপার মনে পড়লো রূপাঞ্জনা যখন সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছে, শুভেন্দু একদিন ঘুমন্ত মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকাতে থাকতে বলেছিল, ওকে আমি আমার প্রফেশনে আনবো।
--তোমার চেয়ারে বসবে?
--না আমার চেয়ে উঁচু চেয়ারে। ন্যায় অন্যায়ের সিদ্ধান্ত নেবে।
রূপাঞ্জনাকে যেন নেশায় পেয়ে বসলো। নিজেকে পালটে নেয়ার নেশা। চারপাশের চাহিদাকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র নিজের সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিতে একটুও বিচলিত হয় না আর। কখনো কখনো নিজেকে যেন ছুঁতে পারে না। নিজের কেন্দ্র থেকে যেন বিচ্যুত হয়ে গেছে, যেন ভেসে বেড়াচ্ছে একটা অদ্ভুত ইচ্ছেডানায় ভর করে। সেখান থেকে তাকালে নিজের আকৈশোর লালিত স্বপ্নগুলোকে ছেলে ভুলানো খেলনার মতো মনে হয়। কারো ছায়ার নিচে দাঁড়ানোর চাইতে অন্যকে ছায়া দিতে ইচ্ছে করে। সেই ইচ্ছেটাকে একটু একটু করে সত্যি হতে দেখছিল। এই বাড়িটা, এমনকি রমলাও ধীরে ধীরে ওর ছায়ায় এসে দাঁড়ালেন।
শুধু অমলার ভেতরটাই ছটফট করে। ভেঙে পড়া, ধুলোয় লুটিয়ে পড়া রূপু সিঁড়ি ভেঙে উপরের দিকে উঠছে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন ঠিকই, কিন্তু কেবলই মনে হয় ও যেন প্রাণটাকে কোনো গোপন সিন্দুকে পুরে রেখে দিয়েছে। নিজেকে নিয়ে যেন ওর মধ্যে ছিঁটেফোটা স্বপ্ন নেই। স্বপ্ন না দেখে মানুষ বাঁচে নাকি? দেখলে মনে হয় নিজের চারপাশটাকে ভুলে, অনেক দূরের কোনো বিন্দুর দিকে চোখ রেখে নেশার ঘোরে ছুটছে। যে মেয়ে গাছের সঙ্গে কথা বলতো, বাতাসের সঙ্গে ফিসফিস করতো, রোদ্দুরের মতো ঝিলিক দিয়ে হাসতো তাকে ও কোথায় যেন লুকিয়ে ফেলেছে। আগে উড়তো, এখন ছুটছে। কোথায় যেন পৌঁছোনোর আছে। নিজেকে প্রমান করার তাগিদ। শুধুই প্রয়োজন দিয়ে বেঁধে ফেলেছে নিজেকে।
কিন্তু প্রয়োজনের পাশাপাশি কিছু অপ্রয়োজনের উচ্ছ্বাস, খানিকটা অকারণ পুলক না থাকলে মানুষ যন্ত্র হয়ে যায় না? যন্ত্রের কোনো শেকড় থাকে না। নিজের মতো করে ভেবে ভেবে অস্থির হয়ে ওঠেন অমলা। বুকের ভেতর মোচড় দেয়।
--ওরে এবার একটু আমার দিকে ফের। কোলে একটু মাথাটা রাখ।
রূপাঞ্জনা ঠাট্টার সুরে বলে, মাথাটা যে বড্ড ভারি। তোমার কোল বইতে পারবে না।
কথাটা বলেই লক্ষ্য করে অমলার মুখটা ম্লান হয়ে গেল। ওঁর অমন মুখ দেখতে অভ্যস্ত না রূপাঞ্জনা। অমলা আগের মতো আর তত মজার কথা বলেন না ওর সঙ্গে। বললেও তাতে ঝরাপাতার অবসন্নতা টের পায়। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে রাঙাদিদাকে সেই আগের মতো প্রাণপ্রাচুর্য ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু সে অবসর মেলেনা। কত কিছু যে করার আছে, সমস্ত তুচ্ছতার উর্ধে নিজেকে দেখার আকুলতায় সব আবেগ পেছনে পড়ে থাকে। কদাচিত ঘুমোতে যাওয়ার আগে পিছনে তাকাতে চেয়েও সন্তর্পণে চোখ ফিরিয়ে নেয়। চেয়ে দেখতে গেলে সঙ্গে যে আরো অনেক শ্যাওলা-পাথর, কাঁটার জঙ্গল আর ধুলোবালি উঠে আসে। সেই ধুলোয় পাছে চোখে জল আসে, পাছে সামনের পথ ঝাপসা হয়ে যায়, ভয়ে চোখ বোঁজে।
ল’ কমপ্লিট করার পর কম্পিটিটিভ পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার পাশাপাশি প্র্যাকটিস শুরু করলো। বাবার পরিচিতির সুবাদে আদালত চত্বরে প্রবেশ করলেও নিজের দক্ষতায় খুব অল্প দিনেই পশার জমলো। কেস হাতে নিলেই জয় অনিবার্য। নিজের যুক্তিবুদ্ধির ধারে নিজেই চমকে যায়। অন্যের হয়ে লড়াই করে তাকে জিতিয়ে দেয়াটা নেশার মতো পেয়ে বসলো। আর সেই নেশায় নিজের কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দেওয়ার উদ্যোগটা কেবলি পিছোতে থাকে।
সুতপাই মাঝে মাঝে মনে করিয়ে দেন। সেই মুহূর্তে ইচ্ছেটা জাগলেও নিজেকে খানিকটা দায়বদ্ধ লাগে। যে মানুষ হেরে গিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে, সে শেষ ভরসার মতো রূপাঞ্জনার কাছে ছুটে আসে। নিজের আইনের প্র্যাকটিস তাকে ও এইভাবে দেখে। নিজের ওপর মানুষের এই ভেসা দেখে আত্মতৃপ্তি অনুভব করে। সেই তৃপ্তির খানিকটা সুতপার মুখে দেখা গেলেও রমলার মুখে কেন যেন একটুও আলো নেই।
বছর চারেকের মধ্যেই রূপাঞ্জনার এমন সাফল্যে গর্বে তো তার পা পড়ে না মাটিতে। রূপু দিকে নিয়ে ওর অনেক স্বপ্ন। মাঝে মধ্যে সেই ইঙ্গিতও পায় রূপাঞ্জনা। এ বাড়ির কেউ একজন সক্রিয় রাজনীতিতে আসুক, অনেক পার্টিই বিভিন্ন সময় চেষ্টা করে সফল হয়নি। তাদের নজর কিন্তু সরেনি। রূপাঞ্জনার কাছেও প্রস্তাব আসে। মাধ্যম তোতা। ততদিনে দিব্যেন্দুর বিশেষ বন্ধু বিভাসরঞ্জন বসুর প্রভাবে রূপাঞ্জনা রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। ওর বেশ চ্যালেঞ্জিং মনে হয়েছে ব্যাপারটার মধ্যে থ্রিল আছে। শুরুটা এই অনুভুতি থেকে।
নিজের প্রফেশানে দক্ষতা প্রমানিত। এবার নিজস্ব ভাবনাচিন্তা, আদর্শকে সঙ্গে নিয়েই ভেতরে ভেতরে তৈরি করে নিলো নিজেকে। বিভাসের উদ্যোগে ক্ষেত্রটা তৈরি হয়েই ছিল।
প্রায় হাত ধরে রূপাঞ্জনাকে রাজনীতিতে নিয়ে এলেন বিভাস। দিব্যেন্দুর স্কুলের বন্ধু হওয়ার সুবাদে বরাবর বাড়িতে বিভাসের যাওয়াআসা। ছোটবেলা থেকে দেখছেন রূপাঞ্জনাকে। স্কুল পাশ করার পর দিব্যেন্দু মেডিক্যালে আর বিভাস ইকনমিকস নিয়ে প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হওয়াতে যাওয়াআসাটা কমে যায়। তবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। মাঝেমাঝেই আসতেন। রাজনীতি নিয়ে দিব্যেন্দুর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তবু বিভাসের কাছে এমনকি রাজনীতির কথাবার্তা শুনতেও খারাপ লাগে না। ওদের কথাবার্তার মাঝে কখনও কখনও সুবিমল আর দীপ্তেন্দু যোগ দেন। রমলাও দু’দন্ড দাঁড়িয়ে শোনেন। এমনি খুব সাধারণ কথাও এত চমৎকার করে বলেন। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর রূপাঞ্জনা তো তাও আড়াল থেকে শুনে উপভোগ করতো। বিভাস নিজে অধ্যাপনা করতেন তখন। কখনোসখনো তো তা আর রূপাঞ্জনাকে ডেকে কলেজ, পড়াশুনা নিয়েও কথা বলতেন।
বিভাস বরাবর চাইতেন গুহ বাড়ির কেউ রজনীতিতে আসুক। দিব্যেন্দুকে কনভিন্স করা যায়নি। পড়াশুনা আর প্রেম নিয়ে এতই মশগুল ছিল যে অন্য কোনো দিকেই কোনো আগ্রহ দেখাতো না। রূপাঞ্জনা যখন ল’ প্র্যাকটিসে বেশ নাম করেছে, তখন ওদের আলোচনায় বিভাস মাঝে মাঝে ডেকে নিতেন ওকে। বিভাসের সব কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতো ও। একটু একটু করে যে রাজনীতিতে ওর আগ্রহ জন্মাচ্ছিল, সে বিভাসের জন্যে। রমলা ব্যাপারটা খুব একটা পছন্দ করছেন না, সেটা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিতেন। দিব্যেন্দু এটা জানতো বলে বিভাসকে বলেছিল,
--রূপুটার মাথা খাচ্ছিস কেন রে বিভাস?
--রাজনীতি সচেতন হওয়াটাকে খারাপ ভাবছিস কেন।
--সচেতনতা নয়, তুই তো ওর মধ্যে ইঞ্জেক্ট করছিস তোর মতটাকে। আমি তোকে চিনি না? নিজের জীবন ও কীভাবে, কোনদিকে চালাবে তা নিয়ে ওর নিজের ভাবনা আছে।
--সে তো খুব ভালো কথা। ওর সেই পরিকল্পনার সঙ্গে আর একটা ভাবনা যুক্ত হলে তো কোনো ক্ষতি নেই।
--ক্ষতি লাভ জানি না। তবে রাজনীতিটা সর্বগ্রাসী। একটা ঘুর্ণির মতো। অন্য সব সম্ভাবনাকে গ্রাস করে নেয়। তুই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
--আমার সম্পর্কে তোর অ্যাসেসমেন্টটা ভুল। আমি নিজের লক্ষ্যেই এগিয়েছি। আমি তোদের বাড়ির কাউকে অন্তত আমার পাশে চেয়েছিলাম। তোরা তিন ভাই মায়ের ছায়ায় এতটাই ঢাকা যে তোদের আলাদা করে চেনা যায় না। ভাবলাম দেখি এই প্রজন্মের এরা কতটা নিজের মতো। রূপাঞ্জনা খুব ইনটেলিজেন্ট। ওর ভাবনাচিন্তায়ও স্বকীয়তা আছে।
--তোতাও খুব ইনটেলিজেন্ট। নিজে ডিসিশান নিতে পারে।
--দেখ দেবু, সম্পর্কের দিক দিয়ে আমার কাছে তোতাও যা, রূপাঞ্জনাও তাই। তোতাকে আমি খুবই পছন্দ করি। তবু বলবো, নাতো তাকে চাই না। কিছু মনে করিস না – তোতার যে ইনটেলিজেন্স, সেটা একজন ব্যবসায়ীর। তা দিয়ে বড়জোর ক্ষমতায় আসা যায়। আমি যে রাজনীতিটার কথা ভাবি সেটা তোতাকে দিয়ে হবে না।
--তাই বলে রূপুকে কেন টানতে চাইছিস?
--ওর সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছে, ও তোদের সবার থেকে আলাদা। নতুন কিছু ভাবতে পারে একদম নিজের মতো করে। মাথাটা খুব পরিস্কার। আর সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট রূপাঞ্জনা অত্যন্ত সেনসিটিভ। ইন্টেলিজেন্স এর সঙ্গে সেনসিটিভিটি না মিশলে এই রাজনীতির জায়গাটা একদিন মাফিয়া চক্রের আস্তানা হয়ে যাবে।
--তুই এত ভাবিস নিজের দলের জন্যে?
--আমি দলটাকে ভালোবেসে এর সঙ্গে আছি। এর বাইরে তো আমার কোনো জীবন নেই, তুই জানিস। কাজেই এই জায়গাটা যদি ডাস্টবিন হয়ে যায়, কেবল কিছু চতুর, মিথ্যেবাদী আর ধান্দাবাজের আখড়া হয়, দাঁড়াবো কোথায়?
রমলা পছন্দ করছেন না জেনেও ধীরে ধীরে রাজনীতিতে পুরোপুরি ঢুকে গেল রূপাঞ্জনা। সেকি রমলার ইচ্ছের বাইরে গিয়ে কিছু করার গোপন জেদ? নিজের ইচ্ছেপূরণের পথে অজান্তেই ক্ষমতার লোভ এসে হাত ধরল। শুধু আদর্শের জন্যে রাজনীতিতে কেউ যুক্ত হয় এ কথা ও নিজেও মানে না। আদর্শের নিচে সুপ্ত থাকে ক্ষমতা।
রূপাঞ্জনার ‘ফ্রেশ ভাবনাচিন্তা’য় দলের মধ্যে প্রবল উৎসাহ। ওকে ঘিরে অনেক নতুন স্বপ্ন, নতুন পরিকল্পনার ছক তৈরি শুরু হলো। পার্টির নেতৃস্থানীয়রা রূপাঞ্জনাকে বাদ দিয়ে কোনো মিটিং এর কথা ভাবতেই পারে না। নিজের জনমোহিনী বাকচাতুর্যে নিজেই মুগ্ধ রূপাঞ্জনা। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যায় নিজেকে দেখে। ওর উপস্থিতি মানেই জনসভা সফল। উপচে পড়া ভিড়। এরপর নির্বাচন, মনোনয়ন, প্রতিদ্বন্দিতা। মনে হলো যেন অদৃশ্যে কেউ লিখে চলেছে চিত্রনাট্য। যেন কলমের এক খোঁচায় প্রথম জয় লেখা হলো। লোকাল কাউন্সিলর হিসেবে।
চোখের পাতার নিচে গোটা অঞ্চল। ঝাপসা হয়ে গেল শুধু সতেরো নম্বর বাড়ির মানুষজন। আড়াল হয়ে গেল শুধু পরীবাগান। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা বসন্তের হিসেব মতো পরীবাগান নতুন পাতার উন্মেষ ঘটায়, নিয়ম মেনে পাতা ঝরায়। আর রূপাঞ্জনার অগোচরে সেই ঝরাপাতার নিচে একটু একটু করে চাপা পড়ে যায় একটা পরিত্যক্ত স্বপ্নের ছবি।
সতেরো নম্বর গগনবাবু লেনের বাড়িটার ওপর তোতার একটা গভীর আক্রোশ। ও প্রায়ই নানারকম প্রস্তাব নিয়ে আসে রমলার কাছে। সোমনাথরা চলে যাওয়ার চার পাঁচ বছর পর,রূপাঞ্জনা তখন ল’ পাশ করে প্র্যাকটিস শুরু করেছে। ভবানীপুরে বাবার চেম্বারে বসছে। তোতা একদিন রমলাকে বললো, দেখ আম্মা ওরা জানে কোনোদিনই তোমার সব টাকা ফেরত দিতে পারবে না, সেই জন্যেই ওদের বাড়ির চাবি তোমাকে দিয়ে গেছে। প্রকারান্তরে ওটার দাবী ওরা ছেড়েই দিয়েছে।
রমলা ভাবলেশহীন মুখে বললেন, তো?
--সতেরো নম্বর বাড়িটাকে আমার ব্যবহার করতে পারি তো।
--নিজের বাড়ির জায়গায় কুলোচ্ছে না বুঝি?
--না ঠিক তা নয়। একটু রেনোভেশন করে নিয়ে ওখানেই রূপুদির জন্যে চেম্বার হতে পারে। ও সেই ভবানীপুরের বাড়িতে না গিয়ে এখানেই বাড়ির পাশেই ...।
রমলা তোতার কথায় রাগ করলেন না। বরং এমন কৌতূককর কথা যেন এর আগে শোনেননি সেই রকম মুখ করে বললেন, ওখানে রূপুর চেম্বার! রাতে তোর ভালো ঘুম হচ্ছে না বুঝি? রূপুকেও বলেছিস নাকি এসব কথা?
অপ্রস্তুত মুখ করে পালিয়ে বেঁচেছে তোতা। এর আরো কিছুদিন পর ফের ও রমলাকে বললো, ও বাড়িটাতে একবার মিস্ত্রি লাগানো দরকার আম্মা। দেয়াল টেয়াল গুলো নোনা ধরে যাচ্ছে।
--হঠাৎ ও বাড়ি নিয়ে পড়লি কেন, অন্য কাজ পাচ্ছিস না?
--দেখ আম্মা ন্যায্যত বাড়িটা এখন আমাদেরই। ওটার দেখাশোনার দায়িত্বও আমাদের।
--এমন গুরুত্বপূর্ন কথাটা আমি তো জানিনা।
কিন্তু রমলা এমন অনেক কথা জানেন, যা তোতা জানে না। সোমনাথ দু’বার বেশ অনেক দুটো চেক পাঠিয়েছে রমলার নামে। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে, এসব কথা রূপাঞ্জনারও জানার কথা নয়। প্রায় বছর সাতেক আগের কথা। রাজনীতির পাশাপাশি তখনও ল’প্র্যাকটিস চলছে। রমলা একদিন অনেক রাতে ওর ঘরে এলেন। রূপাঞ্জনা একটা মামলার কাগজপত্র নাড়াচাড়া করছিল। ঘরে ঢুকে রমলা একটু কুন্ঠিতভাবে বললেন, কয়েকটা কথা তোর সঙ্গে আলোচনা করা দরকার রূপু।
রূপাঞ্জনা মুখ তুলে বললো, বলো।
--সোমনাথ দুটো চেক পাঠিয়েছে আমার নামে। দুমাস আগে একটা, আর গতকাল একটা।
--কেন?
--ওর বাবার দেনা শোধ করতে চায়। ও বাড়ির দলিলপত্র তো সব আমার কাছে। এমনি রেখেছিল সুবিমল। তিনচারদিন আগে ফোনও করেছিল সোমনাথ। আমার কাছ থেকে সুবিমল টাকা নিয়েছিল, তার হিসেব জানতে চাইছিল।
রূপাঞ্জনা নিঃশব্দে শুনছিল। হঠাৎ অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো ওর। রমলার সমস্যা ছাপিয়ে একটা অন্য বিষয় ঝন করে বাজলো মাথার মধ্যে। এই বাড়িতে একটা ফোন বেজেছিল, তার ওপাশে যে কন্ঠস্বরটা ছিল তা সোমনাথের। কী বলেছিল? অন্যকিছু কি জানতে চেয়েছিল? অসংখ্য প্রশ্ন একসঙ্গে গুঞ্জন করে উঠলো ভেতরে। মুহূর্তের আচ্ছন্নতা। পরমুহূর্তেই নিজেকে ঢুকিয়ে নিলো অন্য এক রূপান্তরিত মেয়ের মধ্যে। নিস্পৃহভাবে জিজ্ঞেস করলো,
--আমার কাছে কী জানতে চাইছো?
--সোমনাথ যেভাবে জানতে চাইছে, সেভাবে আমি তো হিসেব দিতে পারবো না। তবুও ও যখন একটা ফয়সালা করতে চাইছে আমি কি কাগজপত্রগুলো সব পাঠিয়ে দেব ওকে?
--দেখ আম্মা, যে বিষয়টার মধ্যে আমি কখনও ছিলাম না, আমার সম্পূর্ণ অজ্ঞাত সেই বিষয়টা নিয়ে আমি কীভাবে মতামত দিই?
রমলার মুখ দেখে মনে হলো অদ্ভুত একটা সঙ্কটে পড়েছেন। রমলা গুহর এই বিচলিত মুখ আগে কখনো দেখেনি রূপাঞ্জনা। ভাবলো আম্মার ভেতরটা কি এতটাই নড়বড়ে হয়ে গেছে? মায়া হলো। কিন্তু ওর তো কিছু করার নেই। ওর মধ্যে এখন যে মেয়ে বাস করে, সে এই বিষয়টা নিয়ে ভাববার অনুমতি দিল না ওকে। শধু খুব আলগাভাবে অনেক দূরের থেকে উচ্চারণ করলো,
--সাধারণভাবে একটা কথা বলতে পারি, হিসেবের সঙ্গে আবেগ মেশানো ঠিক নয়। কিংবা উলটো দিক থেকে বলা যায়, আবেগের মাঝখানে হিসেব আনা উচিত নয়। বিষয়টা পুরোপুরি হিসেবের ছকে পড়ে গেছে, সেইভাবে বিবেচনা করাই সমীচীন। এর চেয়ে বেশি কিছু আমি বলতে পারবো না।
--এই ব্যাপারটা তুমি তোতার সঙ্গে আলোচনা করো আম্মা। এইসব হিসেব ও খুব ভালো বোঝে। কোনো কোনো ব্যাপারে ওর খুব তুখোড় উপস্থিত বুদ্ধিও।
রূপাঞ্জনার কথাগুলো বেশ পলিটিকাল মনে হলো রমলার। সোমনাথ প্রসঙ্গে এটুকু পরামর্শও আশা করেননি রূপাঞ্জনার কাছ থেকে। রূপাঞ্জনার হাতদুটো ওঁর দু’হাতের মাঝে নিয়ে হাতের পাতায় চুমু খেলেন। তারপর – ‘তার আর দরকার নেই, যা এখন শুয়ে পড়’ বলে উঠে চলে গেলেন।
এরপর হয়তো আবারও ফোন এসেছিল, আরো হিসেবনিকেশ হয়েছে। সেগুলো সবই রূপাঞ্জনার অজান্তে। সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর পারিবারিক অনেক ব্যাপার থেকেই ও খানিকটা দূরে সরে এসেছে। ইচ্ছে করেই। ব্যবসাপত্র তো তোতা আর শীতলবাবুর সহায়তায় রমলাই এখনও নিয়ন্ত্রন করেন। দীপ্তেন্দু কোনোদিনই হেসেবপত্র ভালো বোঝে না। শুভেন্দু আর দিব্যেন্দু বুঝলেও মাথা ঘামাতে চায়নি কখনও। তাই ছেলেদের ওপর কোনোদিন নির্ভর করেননি রমলা। কিন্তু এ ব্যাপারে তোতার আগ্রহ ও দক্ষতা এখন রমলার হাত অনেকটা শক্ত করেছে। তবু যে কোনো ব্যাপারেই রূপাঞ্জনার একটুখানি সম্মতির অপেক্ষা করেন। রূপাঞ্জনার আগ্রহ না থাকলেও উপভোগ করে ব্যাপারটা।