• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৫ | জানুয়ারি ২০২২ | উপন্যাস
    Share
  • পরীবাগান ও এক গল্পের মেয়ে (৭) : অঞ্জলি দাশ



    || ১১ ||

    দাদুর নিরুদ্দেশের বারো বছর কেটে যাওয়ার পর আত্মীয়রা বলেছিলেন শাস্ত্রের রীতি অনুযায়ী শ্রাদ্ধশান্তি করে নিয়ে আম্মা বিধবার জীবন যাপন করুন। আম্মা সেটা মানেননি। ধীরে ধীরে শাঁখাসিঁদুর পরা ছেড়েছেন ঠিকই, ছাড়েননি রঙিন শাড়ি। কারণ হিসেবে সবাই ধরে নিয়েছেন যে এটা আম্মার সেই বেপরোয়া জেদ, আর স্বামীর প্রতি আক্রোশ। আসল কারণটা কী সে তা কেউ জানে না, জানতে পারেনি কোনোদিন। জানতেন রাঙাদিদা আর রাঙাদিদার গোপন প্রাণবের সঙ্গী আমি কিছুটা জেনেছিলাম বড় হওয়ার পর। সতেরো বছর পর, শুভেন্দু অর্থাৎ আমার বাবা তখন ল’ পাশ করে প্র্যাকটিস করছেন, মেজকা দীপ্তেন্দু অঙ্ক নিয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েশানের পর একটা স্কুলে পড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পারিবারিক ব্যবসা দেখাশোনা শুরু করেছেন আর ছোটকা দিব্যেন্দু মেডিক্যাল থার্ড ইয়ার। মেজকাকিমা নতুন বউ হয়ে সদ্য এ বাড়িতে এসেছেন আর আমি জন্মের অপেক্ষায় সাত মাস মায়ের পেটে।

    ঠিক তখনই একদিন সন্ধেবেলায় সাদা চুল দাড়ি, এ বাড়ির সঙ্গে একেবারেই খাপ খায় না এমন অপরিচ্ছন্ন চেহারার একজন মানুষ এলেন বাড়িতে। নিজেকে পূর্ণেন্দু গুহ বলে দাবী করলেন। তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে প্রায় সকলে তাঁকে মেনে নিতে চাইলেও আম্মার কাছে গ্রাহ্য হলো না সে দাবী। চিনতেই চাইলেন না তাঁকে। বললেন,

    -লোকটা যা যা বললো, সেসব তথ্য চাইলে যে কেউ সংগ্রহ করে নিতে পারে। তা দিয়ে কিছুই প্রমাণ হয় না।

    -তবু সবার অনুরোধে আম্মা আলাদা করে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে রাজি হলেন বটে, কিন্তু কী কথা হলো তাঁদের মধ্যে, কেউ জানে না। তিনি নিঃশব্দে ফিরে গেলেন তাঁর দ্বিতীয় সংসারে। হ্যাঁ, তাঁর দ্বিতীয় সংসারে। আর কোনোদিন ফিরে আসেননি।

    আম্মা কীভাবে যে জানতে পেরেছিলেন দাদুর ওই অন্য সংসারের কথা, সেটা কেউ জানে না। সতেরো বছর ধরেই তো নিঃশব্দে খোঁজ চালিয়েছেন একা। দাদুর সেই দ্বিতীয় সংসারের কথা জানিয়েছিলেন শুধু রাঙাদিদাকে। এছাড়া কথাটা কোনদিন তৃতীয় কান হতে দেননি। আজও না। তৃতীয় কানে পৌঁছেছিল আমার প্রতি রাঙাদিদার একাত্মবোধে। যখন আমি ফার্স্টইয়ারে পড়ি, আমাকে বলার পর সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন,

    -তোর কাছে তো আমার গোপন কিছুই নেই। কিন্তু এ কথাটা তুই কোনোদিন আর কউকে বলিস না, সেটা তোর আম্মার তো বটেই, আমাদের জন্যে খুব লজ্জার হবে।

    বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সতেরো বছর পর হঠাৎ অচেনা আগন্তুকের আবির্ভাবের সেই নাটকীয় ঘটনার কথা রঙাদিদাই সবিস্তারে বলেছেন আমাকে। আম্মা চিনতে পারেননি, কিংবা হয়তো চিনতে চাননি। রাঙাদিদা নাকি দেখা মাত্র চিনেছিলেন।

    -আমার দিকে যখন তাকালেন, তখনই বুঝতে পেরেছিলাম এ তো সেই মানুষ।

    -কী করে বুঝলে?

    -বুঝবো না? বরাবর আমাকে দেখলেই তাঁর চোখে যেরকম আলো জ্বলে উঠতো, সেই আলোই দেখতে পেলাম যে।

    -এতবছর পরও তোমাকে দেখে তাঁর চোখে সেই আলো জ্বললো?

    -জ্বললো তো। আমারও যে ভালো লাগতো তাঁকে। যাই বলিস এমনিতে তো দিব্যি ভালো মানুষ। শরীরে যেমন মায়ামমতা, তেমনি হাসিখুশি, দিলদরিয়া মানুষ। সারাক্ষণ গান গাইতো। কাউকে কখনও কোনো কু-বাক্য বলতে শুনিনি। ওপর থেকে দেখলে কে বলবে এই মানুষের পেটে পেটে এতসব।

    এরপর আর একটু গলা নামিয়ে বললেন,

    -ফাঁক পেলেই আমাকে জড়িয়ে ধরতেন, গায়ে একআধটু হাতটা তো দেয়ার চেষ্টা করতেন। আমি তো সেই একুশ বছর বয়েস থেকেই এ বাড়িতে। তখন আমার ভরা বর্ষার মতো উপচে পড়া শরীর। বুঝতে পারতাম সব পুরুষমানুষদেরই চোখ আটকাতো। ভাবতাম, তাদের যদি দেখতে ভালো লাগে, দেখুক। আমার কোনো ক্ষতি তো হচ্ছে না।

    -দাদু যে তোমার গায়ে হাত দিতেন, তোমাকে জড়িয়ে ধরতেন, তোমার খারাপ লাগতো না?

    -কই কখনও তো লাগেনি।

    -কেন তোমার সঙ্গে কি তাঁর প্রেম ছিল?

    -তা ছিল না। প্রেম থাকলে তো দিদির ওপর হিংসে হতো। তা তো কখনো হয়নি। বরং মনে হতো দিদিকে সে ভালোবাসুক। দিদিকে কখনো দুঃখ না দিক এটাই তো চাইতাম মনে প্রাণে।

    -তাহলে গায়ে হাত দিলে আপত্তি করোনি কেন?

    -খারাপ লাগতো না বলে আপত্তি করিনি। শরীরেরও তো সাধ আহ্লাদ আছে। শরীর চাইলে আমি কী করবো?

    ভাবতাম শরীরের পাওনা শরীর বুঝে নিক, আমি আটকাবার কে। আমাকে তো ওইভাবে ভালোবাসার মতো কেউ ছিল না, তাই ওতে আর আপত্তি করিনি। শুধু ভয় হতো এ নিয়ে দিদি তাঁর সঙ্গে কোনো অশান্তি না করে। তা দিদি কখনো কোনো অশান্তি করেনি। টের পায়নি তা আমি বিশ্বাস করি না, তার তো মাথার চারপাশে চোখ। আমার নিজের জন্যে না, সেই মানুষটার কথা ভেবে একটু ভয় পেতাম।

    -তাঁর কথা অতো ভাবার কী আছে, তিনি তো অন্যায় করছিলেন।

    -এটাকে অন্যায় ভাবলে অন্যায়, অসহায়তা ভাবলে তাই।

    -অসহায়তা আবার কী? নিজের বউ থাকতে অন্য মেয়ের সঙ্গে…

    -তা কী আর করবে? তাকে আমি তত দোষ দিই না। তোর আম্মার মতো অতো আঁটোসাঁটো মেয়েমানুষে কি আর পুরুষমানুষদের মন ভরে?

    -আঁটোসাঁটো মেয়েমানুষ মানে?

    -বুঝলি না, যখন-তখন কাছে আসতে দেবে না, যা করার তা সময় বুঝে মেপেঝুপে করতে হবে। ওরে বাবা শরীরের খিদে কি আর দিনক্ষণ মানতে চায়, না মানতে পারে? সেইজন্যেই তো এদিক-সেদিক করতো।

    এইখানে রাঙাদিদাকে আমার খারাপ লাগতো, মুখে কিছু বলতাম না সবটা শুনবো বলে।

    -তুমি বলতে চাও আম্মা কখনো টের পাননি তোমাদের এই ব্যাপারটা?

    -তা পেয়েছে বইকি। এ বাড়ির কোন ব্যাপারটা ওর চোখ এড়ায়?

    -তোমাকে বকেননি সেজন্যে?

    -না। শুধু একদিন ডেকে বললেন, এবার বিপদে পড়লে আমি আর তোকে বাঁচাতে পারবো না। প্রশ্রয় দিস না। মানুষের শরীরের খিদে সর্বগ্রাসী।

    -শরীরের খিদে কী রাঙাদিদা?

    আমি বুঝতাম না তা নয়, তবু রাঙাদিদার মুখে শুনতে ভালো লাগতো। রাঙাদিদা একটু মুখ টিপে হাসলেন, গলাটা আরো খাদে নামিয়ে বললেন,

    -এই যেমন সোম তোকে জড়িয়ে ধরে, চুমু খায়, তোর বুকে হাত দেয়। তোরও তো তাতে কত ভালো লাগে। লাগে কি না বল? সে তো শরীরের খিদের জন্যেই।

    -যাহ। এসব বাজে কথা কে শুনতে চেয়েছে?

    শুনে যার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, সে শুনতে চাইছে। আমি কিছু দেখি না ভাবছিস?

    ধ্যাৎ, ওসব ছাড়ো না। তুমি আম্মার কথা বলো। আম্মার বুঝি আর সে খিদে ছিল না?

    -থাকবে না কেন, ছিল হয়তো। তবে সারা সংসারে অত বেশি ডালপালা মেলে বসলে কি আর নিজের খিদের কথা মনে থাকে?

    -আর তোমার?

    -আমার খিদের কথা আর বলিস না। আমি তো পেটের জ্বালায়ই মরলাম। খুব পেটুক ছিলাম। সারাদিন শুধু খিদে পেতো, খেতে ইচ্ছে করতো। লুকিয়ে খেতাম। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি গিয়েও তাই করতাম। এ নিয়ে শ্বাশুড়ি জা-য়ের কাছে কম গঞ্জন শুনেছি! শুনে কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করতাম, খানিক মুখ ভার করে থাকতাম। একটু পরেই সব ভুলে গিয়ে আবার সুযোগ বুঝে চুরি করে খেতাম।

    -এ আবার কী কথা! শুধুই খাওয়া? বিয়ের পরে অন্যকিছু ছিল না তোমার? সেই গল্প বলো।

    -আমার এক মামার বিয়েতে নেমন্তন্ন খেতে এসে আমাকে দেখে খুব পছন্দ হয়ে গিয়েছিল আমার শ্বশুরমশায়ের। বাবা বললেন, মেয়েটা আর একটু বড় হোক। তা তাঁদের তর সয় না। শরীর কী, তা বোঝার আগেই তো বিয়ে হয়ে গেল। তারপর যখন শরীরের মর্ম বুঝলাম, তখন তো সে মানুষই চলে গেলেন।

    -তার মানে তোমার বরের সঙ্গে তোমার কিছুই হয়নি কখনো?

    -হবে না কেন, হতো। তাতে তো আনন্দের বদলে আতঙ্ক হাতো বেশি। রাত হলেই ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতাম। বারোতেরো বছরের মেয়ের শরীরে আনন্দের চেয়ে কষ্টই বেশি।

    -তোমাদের মধ্যে একটুও ভালোবাসা ছিল না?

    -ওরে বাবা তখন পুরুষ মানুষদের ভালোবাসা তো ওইরকম ছিল। সে তো তার নিজের হকের ধন নিয়ে যা খুশি করবে। তাতে কার কী বলার থাকবে? ভালোবাসা হবে কি করে, সারাদিন মানুষটার মুখও দেখলাম না। রাত হলো, বিছানায় এলো। তারপর তো ধরো, খোলো আর কাজাকর্ম সেরে নাক ডাকিয়ে পাশ ফিরে ঘুমোও। এর মধ্যে ভালোবাসা থাকলেও আছে, না থাকলেও আছে। এ কি আর তোর সোমের মতো ভালোবাসা, যে গাছের খোপে ভালোবাসার কথা লুকিয়ে রাখবে?

    -তোমার ভালো লাগতো তাঁর কাছে থাকতে?

    -কেন লাগবে না, আমার ওপর তাঁর মায়া তো ছিল। কাউকে না জানিয়ে চুপিচুপি আমার জন্যে ভালো ভালো শাড়ি কিনে আনতেন, নতুন নতুন গয়না গড়িয়ে দিতেন। আমার এই যে এত গয়নাগাটি দেখছিস, সবই তো তাঁরই দেওয়া। তবে গোপনে। আমাকে সাজাতে ভালোবাসতেন। আর খেতে ভালোবাসতাম বলে লুকিয়ে লুকিয়ে আমার জন্যে এটাসেটা খাবারও এনে দিতেন। এই তুই যেমন লুকিয়ে তোর চকলেটের ভাগ দিস আমাকে।

    রাঙাদিদা সত্যিই খেতে খুব ভালোবাসেন, ওঁর জিভে যে কত স্বাদ! আমরা যখন খুব ছোট, তখন দেখতাম আর কিছু না পেলে দুপুরবেলায় লেবুপাতা, সরষের তেল আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে তেঁতুল মেখে খাচ্ছেন। আমি আর তোতা তাতে ভাগ বসাতাম। আমি একটা চকলেট পেলেও তার আধখানা রাঙাদিদাকে দিয়ে আসতাম। রাঙাদিদা আহ্লাদ করে সেটা খেতেন। ওঁর সেই তৃপ্ত মুখটা দেখতে ভারি ভালো লাগতো আমার। কখনো অন্যরকম কিছু খাওয়ার ইচ্ছে হলে চুপিচুপি আমাকে বলতেন। আমি সাধ্যমতো তাঁর ইচ্ছে পূরণের চেষ্টা করতাম। ছোটকার ছেলে রণ এসব কখনো দেখে থাকবে, ওকেও দেখেছি ছোটবেলায় আমার মতোই ওর চকলেটের ভাগ দিতো রাঙাদিদাকে।

    রাঙাদিদা নিজের কথা বলতেন, মনে হতো অন্য কারো জীবনের গল্প শোনাচ্ছেন। ভাবতে অবাক লাগে ওইরকম জীবন কাটিয়ে আসার পর একজন মানুষ এত হাসিখুশি থাকে কী করে! আম্মা বলতেন, ওর কোনো বোধবুদ্ধি আছে নাকি? ও সুখ-দুঃখের পার্থক্য বোঝেনা।


    ||১২||

    জ নিজেকে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে বুঝতে পারি আমার গোটা জীবন নির্মাণে সেভাবে কোনো পুরুষের ছায়া নেই। তিনজন নারী আমার বোধবুদ্ধি, আমার সমস্ত চৈতন্য জুড়ে আমাকে অধিকার করে রেখেছে। মা, আম্মা আর রাঙাদিদা। এদের কথা বলতে গেলে উজাড় হয়ে যায় আমার শব্দভাণ্ডার।

    অথচ আমার বাবার কথা বলতে চাইলে খুব বেশি শব্দ খুঁজে পাই না। একটা গোটা জীবনের সারাংশটুকুই বলতে পারি শুধু।

    বাবা ছিলেন দূরের মানুষ। দায়দায়িত্ব পালনে কোনো ত্রুটি ছিল না। আমাকে নিয়ে আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনাচিন্তাও করতেন হয়তো। কারণ মাঝেমধ্যে মায়ের সঙ্গে আমার পড়াশুনা নিয়ে কথা বলতে শুনেছি। অসুখ হলে উদ্বিগ্ন হতেন, রাত জেগে কখনো-সখনো সেবাও করতেন। তবু যেন বাবাকে কখনো সেভাবে ছুঁতে পারতাম না। বাবার পৃথিবী যেন আলাদা, সেখানে আমি চাইলেও কিছুতেই ঢুকতে পারিনি কখনো।

    শুধু একবার, আমি তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। তখন আমার প্রবল জ্বর হয়েছিল, ভাইরাস আক্রমন। মাঝরাতে জ্বর বাড়তে বাড়তে থার্মোমিটারের পারদ চার ডিগ্রিতে পৌঁছে গেল। প্যারাসিটামলে কাজ হচ্ছে না। বাবা সারারাত জেগে আমার মাথায় জল ঢেলে ঢেলে, কপালে জলপটি দিয়ে তাপ কমানোর চেষ্টা করে গেলেন। ভোরের দিকে জ্বরটা কমলো। আমি চোখ মেলে দেখি, বাবার হাঁটুর ওপর মাথা রেখে মা ঘুমিয়ে আছেন, বাবা তখনো এক হাতে আমার মাথায় জলপটি পালটে দিচ্ছেন আর অন্য হাতে মায়ের চুলে খুব আস্তে করে বিলি কেটে দিচ্ছেন। সেদিন বাবাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে খুব ইচ্ছে করছিল। মনে মনে চাইছিলাম আমার জ্বরটা আরো অনেকদিন যেন এমনি থাকে।

    আমাকে ঘিরে এমন আকুলতা, এই উদ্বেগের রাত জাগা, এত কাছে ঠিক এই চেহারায় বাবাকে তো আর পাইনি কখনো। জ্বর সেরে উঠে দেখি বাবা আবার কালো গাউনের আড়ালের একজন অন্য মানুষ হয়ে গেছেন। দায়িত্ববান, গম্ভীর, মাতৃভক্ত আর দৃশ্যত আমার মায়ের অনুগত স্বামী।

    বাবার প্রসঙ্গে হাতে গোনা আর যে কয়েকটি স্মরণযোগ্য কথা মনে পড়ে, অন্তত আমার মনে করতে ভালো লাগে, তার একটি হলো–বাবা বাইরে যাওয়ার সময় ঠাকুরঘরে প্রণাম সেরে নিয়ে প্রতিদিন গেট খুলে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে একবার আমার মায়ের মুখটা দেখতেন, তারপর গিয়ে গাড়িতে উঠতেন। যত ব্যস্ততাই থাকুক না কেন মা-ও ঠিক ওই সময়টায় দোতলার ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়াতেন। আর আমিও নিয়ম করে শুধু এই দৃশ্যটুকু দেখার জন্যে রোজ বারান্দার থামের আড়ালে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। এর চেয়ে মনোরম দৃশ্য আমার কাছে তখন আর কিছু ছিল না।

    রোজ বিকেলবেলায় মা নিজে গা ধুয়ে এসে সুন্দর শাড়ি পরে পরিপাটি করে সাজতেন। আমাকেও ভালো জামাকাপড় পরিয়ে দিতেন। আমি মাঝেমাঝে বিগড়োতাম। কিছুতেই চেঞ্জ করতে চাইতাম না।

    -শুধু শুধু কেন পরবো ভালো জামা, কোনোদিন কি বেড়াতে নিয়ে যাও?

    -শুধু বেড়াতে যাওয়ার জন্যে কি মানুষ সাজগোজ করে, বাড়ির ভেতরেও সুন্দর হয়ে থাকতে হয়।

    -কেন?

    -ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে তোমাকে সুন্দর হয়ে থাকতে দেখলে বাবার চোখের আরাম হয়।

    অতশত আমি বুঝতাম না, শুধু জানতাম বাবাকে সবসময় আনন্দে দেখতে চান। অধিকাংশ দিন বাবার ফিরতে রাত হতো। তবু মায়ের এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি কোনোদিন। কিন্তু আমি জানি চোখের আরামটুকু সঙ্গে নিয়েই ঘরে ফিরতেন বাবা। মায়ের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা, শ্রদ্ধা সত্বেও বাবার সেই চোখের আরাম ছিল উত্তরা পিসি, বাবার জুনিয়র।

    ভবানীপুরে আমাদের একটা বাড়ি আছে। বাবার ঠাকুর্দার আমলের। বাড়িটা বরাবর আমাদের যাবতীয় পারিবারিক ব্যবসার কেন্দ্র। একতলায় এক পাশে ডিসপেন্সারি, আর বাকি অংশের পুরোটা জুড়ে এ এলাকার সবচেয়ে বড় ইলেকট্রনিক গুডস-এর দোকান। এটা আম্মার হাতে গড়া। এই অংশে আগে নাকি রেশনের দোকান ছিল। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আম্মা তাদের তুলে দিয়ে এই দোকানটা করেছেন।

    দোতলায় ছোটকার নিজস্ব চেম্বার ছাড়াও একটা টানা লম্বা হলঘরকে পার্টিশান দিয়ে আলাদা আলাদা চেম্বার করা আছে। ছোটকা ছাড়াও আরো সাত আটজন ডাক্তার নিয়ম করে রোগী দেখেন ওখানে। ডিসপেন্সারির দেখাশোনাটা মূলত করেন শীতলজেঠু। দাদুর আমলের লোক। আম্মার বিশ্বস্ততম মানুষ। এখন তোতা ইলেকট্রনিকসের দোকান সামলেও ডিসপেন্সারির অনেকটা দায়িত্ব পালন করে।

    তিনতলায় সিঁড়ি দিয়ে উঠেই একদিকে মস্ত হলঘর, সোফা ডিভান দিয়ে চমৎকার করে সাজানো। ছোটকা, তোতা, অন্য ডাক্তাররা এসে মাঝেমাঝে বিশ্রাম করেন, গল্পগুজব করেন। তার পাশের ঘরটায় ওষুধ স্টক করে রাখা হয়। আমাদের ওষুধের হোলসেল ব্যবসা বহুকাল থেকে। দাদুর আমলে ব্যবসাটা কিছুটা খারাপ অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল, আম্মা আবার নতুন করে তার হাল ফিরিয়েছেন। ছোটকাকে ডাক্তারি পড়ানোটা হয়তো ওই হিসেব করেই।

    তিনতলার অন্য দিকটায় বাবার চেম্বার। সেখানে দেয়াল জুড়ে সারিসারি আলমারিতে মোটা মোটা আইনের বই সাজানো। ঘরের মাঝখানে কাঁচ ঢাকা বড় সেক্রেটারিয়েট টেবিল। তার একদিকে বাবার রিভলভিং চেয়ার, উলটো দিকে ক্লায়েন্টদের জন্যে সারিসারি গদি আঁটা কাঠের চেয়ার। এরই লাগোয়া একটা ছোটঘর বাবার বিশ্রামের জন্যে। সেখানে চা তৈরির সব সরঞ্জাম রাখা ছিল। বাবার ওদিকটায় কেউ বড় একটা যেতো না। ছোটবেলায় আমি অনেকবার ডাক্তার দেখাতে গিয়ে বাবার ঘরে ঢুকে দেখেছি উত্তরাপিসি বাবাকে চা করে দিচ্ছে। কখনো বা প্লেটে করে কিছু খাবার সাজিয়ে দিচ্ছে। আমাকে দেখে সঙ্কুচিত হয়ে যেত। তখন সহজ হওয়ার জন্যে আমার দিকে অতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করতো। অনাবশ্যক আমার চুলটা ঠিক করে দিত, কাউকে দিয়ে চকলেট আনিয়ে দিতো। আমাকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে বুড়ির চুল কিনে দিত, কারণ ওটা পেলেই আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম।

    একদিন আচমকা ভেজানো দরজা ঠেলে দেখি, বাবা শুয়ে আছেন, আর উত্তরাপিসি বাবার বুকের ওপর কনুই এর ভর রেখে চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। সেদিন বাবাও খুব অপ্রস্তুত হয়েছিলেন। তখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। ভালোমন্দ না ভেবেও ব্যাপারটা যে খুব স্বাভাবিক নয় এটা বুঝেছিলাম। বুঝেছিলাম, তবু কেন জানি না উত্তরাপিসিকে আমার খারাপ লাগতো না।

    কিন্তু বুঝতে পারতাম আম্মা উত্তরাপিসিকে একেবারেই পছন্দ করেন না। সেজন্যেই কথাটা আমি বাড়িতে কাউকে বলিনি। এমনকি এই একটি কথা রাঙাদিদাকেও নয়।

    অন্য সময় আমার ডাক্তার দেখানো হয়ে গেলে বাবা কাউকে দিয়ে আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন। শুধু সেই দিন বাবা আমাকে নিয়ে বিভিন্ন দোকান ঘুরে ঘুরে আমার পছন্দের অনেক জিনিস কিনে দিয়েছিলেন। তারপর আমাকে সঙ্গে নিয়ে সন্ধে হতেই বাড়ি ফিরেছিলেন।

    সেইদিন প্রথম আমার হাতে এসেছিল অয়েল কালারের সেট আর ক্যানভাস।

    সেই ভবানীপুরের বাড়িতেই আসলে ছিল বাবার চোখের আরাম। কখন কখনো ছুটির দিনেও বাবা চেম্বারে যেতেন। যথারীতি উত্তরাপিসিও। দুজনের সেই যাওয়াটা যে শুধুমাত্র আইনি প্রয়োজনে ছিল তা নয়। কিছু আইন বহির্ভুত ব্যাপারও ছিল। দুজনে মাঝে মাঝে সিনেমা বা থিয়েটার দেখতেও যেতেন একসঙ্গে। এসব খবর আমাদের ছোটদের জানার কথা নয়। আমি রাঙাদিদার কাছে শুনেছি। খবরগুলো বাড়িতে পৌঁছোতো ছোটকার মাধ্যমে। তবে আম্মার কাছে নয়, আমার মায়ের কাছে। কিন্তু আম্মার ইন্দ্রিয়শক্তি অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই সজাগ ছিল। শীতলজেঠুর কাছ থেকে কায়দা করে ওখানকার পরিস্থিতি সব জেনে নিতেন। অন্য সব খবরের সঙ্গে এটাও নিশ্চয় বলতে বাদ রাখেননি শীতলজেঠু। আর সেইজন্যেই উত্তরাপিসির প্রতি হয়তো আম্মার এই বিরাগ।

    এইরকম এক ছুটির দিনে বাবার প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয়, ভবানীপুরে বাবার চেম্বারে। ছোটকার ছোট ছেলে রন অর্থাৎ রঙ্গনের জন্মের পর থেকে ছোটকা মাঝেমাঝেই সল্টলেকে শ্বশুরের দেওয়া ফ্ল্যাটে গিয়ে থাকতেন। বড়ছেলে রূ অর্থাৎ রূপঙ্কর তখন পাঁচ বছরের। ওখানে থাকলে ওর স্কুল এবং ছোটকার প্র্যাকটিসের সুবিধে সেই অজুহাতে এই ব্যবস্থা চলছিল।

    মেজকা, মেজকাকিমাও তো তাকে নিয়ে উত্তরপাড়ায় মেজকাকিমার মায়ের বাড়ি গিয়েছিলেন। দুপুরবেলায় বাড়িতে ফোন এলো উত্তরাপিসির। আম্মা প্রথমেই ফোনে ছোটকাকে সব জানালেন। তারপর আমাকে সঙ্গে নিয়ে ভবানীপুরে এলেন। আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। সেদিন ছুটির দিন বলে আশপাশের দোকানপাট বন্ধ। রবিবারে আমাদের ডিসপেন্সারিও বন্ধ থাকে। ডাক্তাররাও কেউ আসেন না। আমরা পৌঁছে দেখি বাবা চোখ বুঁজে শুয়ে আছেন। ভীষণ ঘামছেন। কালিঘাট অঞ্চলে থাকেন শীতলজেঠুও এসে গেছেন।

    আম্মা ঘরে ঢুকে উত্তরাপিসির কাছে পুরোটা জেনে নেয়ার পর বললেন, আমরা তো এসে গেছি, দেবুও এক্ষুণি চলে আসবে। তুমি এখন এসো। ওকে তো এখন বাড়ি নিয়ে যাবো।

    আমরা পৌঁছোনোর একটু পরেই ছোটকা তার এক কার্ডিওলজিস্ট বন্ধুকে সঙ্গে করে এলেন। আম্মার বলার মধ্যে এমন কিছু ছিল, উত্তরাপিসি মুখটা ম্লান করে বেরিয়ে গেলেন। আমার কষ্ট হয়েছিল। খুব খারাপ লেগেছিল। উত্তরাপিসির সঙ্গে ছোটবেলায় আমার খানিকটা অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠেছিল বলে আম্মার আচরণে আমার খুব লজ্জা লাগছিল।

    বাবাকে হসপিটালাইজড করতে হয়নি। বাড়িতেই কুড়ি-পঁচিশ দিন বিশ্রামে ছিলেন। প্রথমদিকে প্রায় প্রতিদিন ফোন আসতো উত্তরাপিসির। মায়ের সঙ্গে সামনাসামনি পরিচয় ছিল না ওর। একদিন শুনলাম মা ফোন ধরে কাউকে বললেন

    -তুমি বাড়িতে এসে দেখে যাও ওঁকে। একদিন সকালের দিকে চলে এসো।

    আম্মা একটু অসন্তোষ নিয়েই মাকে বললেন, ওকে বাড়িতে আসতে বলার কী দরকার?

    মা নির্বিকার শান্ত মুখে বললেন, দরকারটা আমার মা।

    পরদিন সকাল সাড়ে দশটার দিকে উত্তরাপিসি এলো। আম্মার উপস্থিতিতে একবার মিনিট দুয়েকের জন্যে বাবার ঘরে গিয়ে ‘এখন কেমন আছেন স্যার’ – কুশল সংবাদটুকু নিয়ে বেরিয়ে এলেন। আর আশ্চর্য, তারপর সারাটা দিন উত্তরাপিসি মায়ের সঙ্গে গল্প করে কাটালেন। মা কি আগলে রেখেছিলেন?

    মা কেন ডেকেছিলেন উত্তরাপিসিকে? শুধু নিজের কৌতূহল মেটাবেন বলে? নাকি আড়ালটা ভেঙে দেওয়ার জন্যে? যে আড়ালের সুযোগ নিয়ে বাবার আর উত্তরাপিসির একটা নিভৃতের অবকাশ গড়ে উঠেছিল?

    এরপর প্রায়ই দেখতাম উত্তরাপিসি মাকে ফোন করে কথা বলছে। কখনও বা মা ফোন করে উত্তরাপিসির সঙ্গে গল্প করছেন। কোনোদিন ছুটির দিনে উত্তরাপিসিকে সঙ্গে নিয়ে মা বিশেষ কোথাও কেনাকাটা করতে যাচ্ছেন। কখনও নাটকের টিকিট কাটবে কিনা বা কোনো নতুন রিলিজ হওয়া সিনেমা, উত্তরাপিসি ফোন করে জানতে চাইছে। উত্তরাপিসির সেই অবকাশগুলো মা অধিকার করে নিলেন যেগুলো এতদিন উপভোগ করতেন বাবা। ছোটকা একদিন মাকে ঠাট্টা করে বললেন – বৌদি, তোমাকে দেখে কেউ ধারণাও করতে পারবে না তুমি এমন চমৎকার পলিটিশিয়ান।

    উত্তরা নামটা অনেক সহজ হয়ে গেল আমাদের পরিবারে। মায়ের সঙ্গে ওঁর এক ধরনের সখ্য গড়ে উঠলো। যেটা বাবা মারা যাওয়ার পরও অটুট ছিল। কিন্তু বাবা যতদিন বেঁচেছিলেন, এটা নিয়ে মা-বাবার সম্পর্কের মধ্যে কখনও কোনো টেনশন দৃশ্যত তৈরি হয়নি। মাকে আমার মনে হয় শান্ত স্বচ্ছ দীঘির মতো। স্রোত নেই গভীরতা আছে। অতটা গভীরতার সামনে বাবা হয়তো ততটা স্বচ্ছন্দ হতে পারতেন না। বাবার লীলাসঙ্গিনী হিসেবে সেইখানেই মায়ের ব্যর্থতা। আসলে মায়ের প্রতি বাবার ভালোবাসা ছিল খানিকটা দূরত্বমিশ্রিত শ্রদ্ধা, আর মমতায় ভরা। সেখানে কোনো খাদ ছিল না।

    আমি যখন ক্লাস টুয়েলভ-এ পড়ি, সেইসময় বাবা মারা যান। মনে আছে বাবা বেলভিউ-তে ভর্তি। মারা যাওয়ার আগের দিন আমি আর মা বাবার কেবিনে। বাবা মাকে কাছে ডাকলেন। আমি বেডের পাশ থেকে সরে গিয়ে সোফায় একটা ম্যাগাজিনে চোখ রেখে বসলাম। ওখান থেকে লক্ষ্য করছিলাম বাবার হাতের মুঠোয় মায়ের হাত। মৃদু স্বরে কিছু বলছিলেন বাবা। মা নিজের গাল দিয়ে বাবার কপাল ছুঁয়ে দিলেন। বাবার চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছিল। সেই অশ্রুপাত মা আটকানোর চেষ্টা করেননি। মুছিয়েও দিলেন না। হয়তো বাবার মনের মধ্যে যে গ্লানি, দুজনের সম্পর্কের মধ্যে যেটুকু ধুলো জমে ছিল, তাকে ধুয়ে যেতে দিচ্ছিলেন।





    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০ | পর্ব ১১ | পর্ব ১২ | পর্ব ১৩ | পর্ব ১৪ | পর্ব ১৫ | পর্ব ১৬ | পর্ব ১৭ | শেষ পর্ব
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments