|| চার ||
বেঁটেখাটো চেহারার উমর শেখ মির্জার মুখটা ভরাট, গাল দুটো থলথলে, তাতে ভর্তি দাড়ি। মদ খেয়ে খেয়ে মোটাসোটা চেহারা তার। ঘনঘন মদ না হলে তার চলেই না। তার সঙ্গে জুটেছে মাজুন নামে আর এক মাদক, যার পাল্লায় পড়লে মাথা ঠিক থাকে না কারোরই। জমাটি আসর বসাতে তার জুড়ি নেই। মদ খাওয়া শুরু হলেই উমর শেখকে কবিতায় পায়, আর সে অনর্গল আউড়ে যেতে পারে কবিতার লাইন। তাতে ফুর্তি কত সঙ্গীসাথীদের! হাসতে হাসতে এ ওর গায়ে ঢলে পড়ে। উমরের দলে আছে তার কয়েকটা ভাইও। এক ভাই আবার অসম্ভব ধার্মিক। সংসার চুলোয় যাক, দিনে পাঁচবার নামাজ পড়তেই হবে। মদ খেতে খেতেই সে বসে যায় নামাজ পড়তে। আর সে কী মদ খাওয়া! একবার শুরু হল তো বিশ-তিরিশ দিন ধরে লাগাতার মদের ফোয়ারা ছুটল তাদের কুঞ্জে। তারপর হঠাৎ একদিন বলে বসল, নাহ, থাক। পরের বিশ-তিরিশ দিন মদ স্পর্শই করবে না সে। আর এক ভাই আবার মদের সঙ্গে অন্য ধরনের রসেও মত্ত, লাম্পট্য যাকে বলে। তার পছন্দ কিশোর তরুণদের। রাজ্যের কোথাও সুদর্শন ছেলে, যার মুখে গোঁফদাড়ি নেই, তার চোখে পড়ল তো ব্যাস, তাকে যে করেই হোক কব্জা করে বাগিয়ে ডেরায় এনে মদের ফোয়ারার সঙ্গে নিজের অন্য খিদে মেটাতে ব্যগ্র হয়ে ওঠে সে।
এখন অবশ্য মদের ফোয়ারা ছোটানোর ফুরসৎ নেই উমর শেখের। তার ছোট্ট রাজ্য ফরগনা দখল করার জন্যে দুদিক থেকে আক্রমণ শানাচ্ছে সুলতান আহমদ মির্জা আর মাহমুদ খান। আহমদ মির্জা উমর শেখের আপন বড়দা; মাহমুদ খান সম্বন্ধী, নিজের বৌয়ের দাদা। দুজনেই প্রতিবেশী আর পাশের রাজ্যগুলোর সবগুলোর শাসকরাই চেঙ্গিজ খান বা তৈমুরলঙ্গের উত্তরাধিকারী, প্রত্যেকেই চায় পৃথিবী শাসন করতে। নিজের রাজত্ব বাড়াতে গেলে পাশেরটা দখল তো করতেই হবে, সে যতই না আত্মীয় কারও রাজ্য হোক। এরা দুজন নিজেদের মধ্যে ঠিক করে নিয়েছে উমর শেখের ক্ষুদ্র ফরগনা দখল করার জন্যে দুদিক থেকে আক্রমণ করবে, যাতে উমর শেখ বুঝে ওঠার আগেই তার রাজ্য দখল হয়ে যায়। আহমদ মির্জা সৈন্যসামন্ত নিয়ে সমরকন্দ থেকে সির নদীর দক্ষিণ দিকের পথ ধরে ঢুকে পড়বেন ফরগনায়, বাধা না পেলে ঢুকে পড়বেন রাজধানী আন্দিজানে। অন্যদিকে মাহমুদ খান সির নদীর উত্তর দিক থেকে গিরিপথ পেরিয়ে ঢুকবেন, আক্রমণ করবেন ফরগনার ঐ দিকের দুর্গ আখসি।
উমর শেখ প্রমাদ গণলেও বিনাযুদ্ধে রাজত্ব ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন। নিজের কিছু বিশ্বাসী আমীর-উমরাহ ও শিশুপুত্রকে রাজধানী আন্দিজান রক্ষার ভার দিয়ে নিজে চলে গেলেন আখসি দুর্গ রক্ষা করতে। চারিদিক পার্বত্য এলাকা, ইচ্ছা করলেই যে কেউ বাইরে থেকে ঢুকে পড়তে পারে না আখসি দখল না করে। ঠিকমত সেনা মোতায়েন করতে পারলে বহুদিন আখসি ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব। মাহমুদ খানের সেনা তার চেয়ে অনেক বেশি, কিন্তু তার মানে এই নয় যে সে ফরগনা ছেড়ে পালাবে। সেও তো তৈমুরলঙ্গের নাতির নাতি।
ছোটবেলা থেকে তার এক প্রিয় খেলা পায়রা ওড়ানো। এই আখসি দুর্গেই আছে তার এক কবুতরখানা, সেখানে কয়েক হাজার পায়রা তার পোষ্য। খাড়া পাহাড়ের গায়ে প্রায় ঝুলন্ত সেই কবুতরখানা, তার একদিকে অতল খাদ, সোজা নেমে গেছে নদীর দিকে। উমর শেখের কথায় তার পায়রারা আকাশে ওড়ে, নেমে আসে তার নির্দেশে। খুবই মজার খেলা। যুদ্ধ-টুদ্ধর চেয়ে অনেক বেশি মজার।
যে-কোন দিনই আক্রমণ নেমে আসতে পারে আখসির ওপর। উমর শেখ খবর পাচ্ছেন দক্ষিণ দিক থেকে আন্দিজানের দিকে এগিয়ে আসছে নিজের দাদা আহমদ মির্জা। দুদিক সামলানো সহজ নয়। তার ছেলেগুলো নেহাৎই শিশু, আন্দিজানের দায়িত্বে রেখে আসা বড়টাও এখনও সেয়ানা হয়নি, আমীররা নিশ্চয় তাকে ও রাজধানীকে রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা করবে।
এইসব চিন্তাভাবনার মধ্যেই উমর শেখ তার পায়রাগুলো উড়িয়ে দিচ্ছিল কবুতরখানা থেকে। আকাশের বুকে তারা বিচিত্র নকশা তৈরি করে আবার নেমে আসে। সেই দিকেই নিবিষ্টমনে তাকিয়ে ছিল সে। হঠাৎই মড় মড় করে একটা শব্দ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পায়ের নীচে জমি দুলে উঠল, দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হল না। পড়ে গেল মেঝেতে। তাকে নিয়ে মেঝেও নামতে লাগল নীচে। পাহাড়ে ধস নেমেছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই উমর শেখের প্রিয় কবুতরখানা তাকে নিয়ে হারিয়ে গেল পাহাড়ের খাদে। তার আর কোনো চিহ্নই রইল না।
হৃদয়বিদারক এই খবর রাজধানী আন্দিজানে পৌঁছালো পরদিন। উমর শেখের শিশুপুত্র তখন আন্দিজানের এক বাগান চারবাগে, দুর্গের বাইরে। তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল এই খবরে। বাবা নেই, তার জন্যে শোক করবে কী, রাজ্য রক্ষা করতে হবে তো। দুদিক থেকে শত্রুর আক্রমণ, তার মধ্যে এই অবস্থা, তার কী করণীয় এখন? সঙ্গে যারা ছিল তার দেখভালের জন্যে, তাদের নিয়ে সে ছুটল আন্দিজান দুর্গের ফটকের দিকে। এখনই পরামর্শ করতে হবে বাবার সমস্ত বিশ্বস্ত আমীর-উমরাহদের সঙ্গে।
দুর্গের কাছাকাছি আসতেই তার ঘোড়া থামিয়ে দিল উমর শেখের একজন বিশ্বস্ত অনুচর। বলল, এটা কি ঠিক হচ্ছে, এই সময় দুর্গের মধ্যে ঢোকা? আমীর-উমরাহরা এখন কী ফন্দি আঁটবে, তার কি নিশ্চয়তা আছে? একেতেই দুদিক থেকে দুই শত্রু দোরগোড়ায়। এরা যদি তাদের খুশি করতে তাদের হাতে তুলে দেয় উমর শেখের শিশুপুত্রকে, তবে তো বংশের কাঁটা তুলে ফেলার সুযোগ তারা নাও ছাড়তে পারে।
সেই অনুচর শেরিম তঘাই তাকে নিয়ে ফেরৎ গেল নমাজগাঁয়ে। পরামর্শ দিল, এই সময়ে দুর্গে না যাওয়াই ভাল। সে যেন কোনোভাবে আউজকিন্টের দিকে চলে যায় আর পাহাড়ের কোলে কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকে। তারপর সময় ও সুযোগ বুঝে কোনো একসময় সেখান থেকে চুপিচুপি মামাদের কারও কাছে চলে যেতে পারে, যেখানে মনে হবে নিরাপত্তা বেশি, সেইখানে।
এই খবরও পৌঁছে গেল আন্দিজান দুর্গে। আমীর-উমরাহরা এসব শুনে আশ্চর্য। তারা যদি বিশ্বাসঘাতকই হবেন, তবে এতদিন ধরে বৃথাই নমক খেয়েছেন উমর শেখের। ইচ্ছে করলেই তো তারা হাত মিলাতে পারতেন তার দাদাদের সঙ্গে। উমর শেখের খাস দর্জি ওস্তাগর খাজা মুহম্মদকে পাঠানো হল বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাকে দুর্গে ফিরিয়ে আনতে। তাদের ভয় পাওয়ার কোনো কারণই নেই। তারা সব্বাই উমর শেখের পরিবারের বান্দা, অবশ্যই তার পুত্রেরও। সবাই মিলে একসঙ্গে এই ঘোর দুর্দিনের মোকাবিলা করবেন তারা।
অবশ্য শেরিম তঘাইয়ের আশঙ্কা যে একেবারে অমূলক ছিল, তা নয়। দরবেশ গউ নামে একজন আমীর বাকিদের পরামর্শ দিল, এই ঘোর সমস্যার একমাত্র সমাধান সুলতান আহমদ মির্জার হাতে উমর শেখের শিশুপুত্রকে তুলে দেওয়া। তাতে আহমদ মির্জা সৈন্যসামন্ত নিয়ে ফরগনা ছেড়ে চলে যাবে। এইটুকু রাজ্য ফরগনা নিয়ে সে করবেই বা কী, সে বিশাল সমরকন্দের অধিপতি। বরং ফরগনার উত্তরাধিকারীকে সমূলে বিনাশ করে দিলে তার ভবিষ্যতের আশঙ্কা নির্মূল হবে চিরতরে।
তার পাতা ফাঁদে কেউ পা দিল না। বিশ্বাসঘাতক গউয়ের মুণ্ডচ্ছেদ করা হল সকলের উপস্থিতিতে। মৃত উমর শেখের পরিবারের ওপর পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করে তার বড় ছেলে, বয়সে প্রায় শিশুই, বাবরকে সম্রাটের গদিতে বসালো তারা। বহু বছর বাদে দিনলিপি লেখা শুরু করলে বাবর তার একদম শুরুতেই লিখল – হিজরি ৮৯৯ সম্বতে, রমজান মাসে, বারো বছর বয়সে ফরগনা রাজ্যের সম্রাট হলাম আমি।
* * *
খ্রিস্টের হাজারতম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনের যখন মাত্রই তিরিশ চল্লিশ বছর বাকি, তখন উত্তর ভারতের হিন্দু ও বৌদ্ধ রাজারা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে একের পর এক মুসলমান যোদ্ধাদের আক্রমণে তিতিবিরক্ত ও বিধ্বস্ত। মধ্যপ্রাচ্য থেকে এইসব হানাদাররা হানা দিতেই লাগল একের পর এক। ৯৯৭ থেকে ১০৩০ সালের মধ্যে গজনির সুলতান মামুদ একবার দুবার নয়, সতেরবার হানা দিয়ে একের পর এক রাজার সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে পালাত। তুরস্কের মামলুক অর্থাৎ ক্রীতদাস নেতা সে, সিন্ধুনদের পুব থেকে যমুনার পশ্চিমে যত ছোট ছোট রাজ্য ছিল, তারাই তার আক্রমণের মূল লক্ষ্য। ঝটিকা আক্রমণে তাদের ছারখার করে দিত সে। রাজ্য দখল নয়, তাদের খাদ্য ও সম্পদের ভাণ্ডার লুঠ করে ঝটিতিই ফিরে যেত মামুদ।
এই আক্রমণের ধারা চলতেই লাগল, যদিও ভারতবর্ষে স্থায়ী উপনিবেশ গড়ার দিকে মনোযোগ ছিল না কারোরই। এ রকম চলেছিল অন্তত আরও শ’ দেড়েক বছর। তারপর ঘোর রাজ্যের শাসক মুইজাদ্দিন মহম্মদ, যাকে মহম্মদ ঘোরি নামে লোকে চেনে, তার উদয় হল উত্তর ভারতে। তার আগের মুসলমান হানাদারদের মত সে সম্পত্তি নিয়ে তার ক্ষুদ্র দেশে ফিরে যেতে রাজি নয়, বরং যুদ্ধে জিতে পরাজিত রাজ্যে শাসন কায়েম করে তার রাজ্যটাকেই বাড়িয়ে নিতে চায় সে। মূলত মহম্মদ ঘোরির হাত ধরেই ভারতের মাটিতে মুসলমান শাসনের পত্তন হল। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে ঘোরি নিহত হন, ঘোরিরই এক ক্রীতদাস কুতুবুদ্দিন আইবক বসেন দিল্লির মসনদে। পরবর্তী তিনশো কুড়ি বছরের জন্য শুরু হয় দিল্লির সুলতানি শাসন।
আফগানিস্তানের পার্বত্য উপজাতি খিলজির এক যোদ্ধা মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি কুতুবুদ্দিন আইবকের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়। পুবদিকে উত্তর ভারতের বাদাউনে তখন শাসন করছিল মালিক হিজবারালদিন নামে একজন, সে বখতিয়ারকে তার সেনাদলে বহাল করে। বখতিয়ার অবশ্য উচ্চাকাঙ্খী, বেশিদিন বাদাউনে বসে না থেকে সে যাত্রা করে অযোধ্যা অভিমুখে, সেখানে অযোধ্যার শাসক মালিক হুসামালদিন তার পরাক্রমে মুগ্ধ হয়ে তাকে উচ্চপদে বহাল করে। এখন যেখানে মির্জাপুর, সেইখানে বখতিয়ারের জন্য এক ছোটখাট এলাকার শাসনের দায়িত্বও তুলে দেয়। দলে সাহসী ও পরাক্রমী মুসলমান যোদ্ধা নিয়োগ করে বখতিয়ার দল ভারি করে প্রায়শই পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে হানা দিতে থাকে। ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে বিহার দখল করে সেখানকার নালন্দা ও বিক্রমশীলা মহাবিহার জ্বালিয়ে দেয় বখতিয়ার। এরপর তার দৃষ্টি পড়ে আরও পুবদিকে, বাংলায়। ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে সেনরাজা লক্ষ্মণসেনকে বিতাড়িত করে বাংলার রাজধানী নবদ্বীপ দখল করে নেয় বখলিয়ার খিলজি। বাংলায় শুরু হয় মুসলমান শাসন।
১২২৭ খ্রিস্টাব্দে চেঙ্গিজ খানের মৃত্যুর পর ওগেদেই হন গ্রেট খান। তার বছর আটেক বাদে মঙ্গোলদের এক বাহিনী কাশ্মীর আক্রমণ করে তার দখল নিয়ে নেয়। সেখানে স্থাপিত হয় মঙ্গোল শাসনব্যবস্থা। প্রায় একই সময় ওতোচি নামে এক কাশ্মীরি বৌদ্ধ তার ভাইকে নিয়ে হাজির হয় ওগেদেইয়ের রাজসভায়। কাশ্মীর দখলের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মোঙ্গলদের আর এক দল দখল করে পেশোয়ার। চেঙ্গিজের তাড়া খাওয়া খোরজম রাজ্যের রাজপুত্র তার আগে ছিল পেশোয়ারে। পার্বত্য অঞ্চল থেকে জোগাড় করা সেনাবাহিনী মোঙ্গলদের মাথাব্যথার কারণ, তাই পেশোয়ারের দিকে মোঙ্গলদের চোখ ছিলই। এই যোদ্ধারা, যারা মূলত খিলজি উপজাতির, মূলতানের দিকে পালিয়ে গিয়ে দলে দলে দিল্লির সুলতানের সেনাবাহিনীতে নাম লেখাল। কুতুবুদ্দিনের পর আরাম শাহ হয়ে দিল্লির সুলতান তখন ইলতুৎমিস।
১২৪১ সালের শীতকালে মোঙ্গলদের এক দল সিন্ধুনদের অববাহিকায় আক্রমণ করে দখল করে নিল লাহোর। শহর ধ্বংস করে তারা দিল্লির দিকে অগ্রসর হতেই খবর পাওয়া গেল, গ্রেট খান ওগেদেই মারা গেছেন। পুবদিকে অগ্রসর না হয়ে তারা ওখান থেকেই পাততাড়ি গোটাল। ইলতুৎমিসের পর রুকনুদ্দিন ফিরোজ ও ভারতের প্রথম মহিলা মুসলমান শাসক সুলতানা রাজিয়া হয়ে দিল্লির মসনদে তখন মুইজুদ্দিন বাহরাম। ১২৪৩ সালে তার পর সুলতান হলেন আলাউদ্দিন মাসুদ। আলাউদ্দিনের ভাই জালালুদ্দিন মাসুদ মোঙ্গলদের ঘাঁটি মঙ্গোলিয়ার কারাকোরম রাজ্যে গিয়ে দাদাকে হটিয়ে তাকে গদিতে বসাতে মোঙ্গল সাহায্য প্রার্থনা করেন। মোঙ্গলরা তো এটাই চাইছিল, কিন্তু দিল্লির সুলতানদের সেনাসামন্ত কম নয়, তাদের সঙ্গে যুদ্ধের হ্যাপাও প্রচুর। সুলতানের ভাই যদি ঘরের শত্রু বিভীষণ হয়, তবে তো পোয়াবারো! এ সময় মঙ্গকে খান গ্রেট খানের গদিতে বসেছিলেন। জালালুদ্দিন তার রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে তার প্রার্থনা জানালে মঙ্গকে খান তা মঞ্জুর করে নিজের সেনাপ্রধান সালিকে দায়িত্ব দেন জালালুদ্দিনকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করতে। সালি মুলতান ও লাহোরে আক্রমণ চালায়, সঙ্গে পায় হিরাটের শাসককেও। লাহোর, কুজাহ, সোদরা দখল করে সেখানে জালালুদ্দিনকে গদিতে বসানো হয়।
১২৫৪ সালে কাশ্মীরে বিদ্রোহ শুরু হলে সেখানেও মঙ্গকে খান কাশ্মীরের সেনাশাসককে বদলে সালিকে নিয়োগ করলেন সেই কাজে আর শাসনের দায়িত্বে বহাল করলেন সেই কাশ্মীরি বৌদ্ধ ওতোচিকে। কাশ্মীরের বিদ্রোহী রাজা ওতোচিকে মেরে ফেললে সালি বিদ্রোহী রাজার সঙ্গে যুদ্ধে নেমে তাকে হত্যা করে বিদ্রোহ দমন করে কাশ্মীরে পুনরায় মোঙ্গল শাসন কায়েম করলেন। এই শাসন চলে বেশ কিছুকাল ধরে।
গ্রেট খান মঙ্গকে খান মধ্যপ্রাচ্য আর পশ্চিম চিনের দেখভাল করার জন্য নিয়োগ করেন ভাই হুলাগু খানকে। ১২৫৭ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির অধীন সিন্ধ রাজ্যের শাসক হুলাগুর কাছে সিন্ধ সমর্পণ করে তার বদলে দিল্লির শাসনব্যবস্থায় ফাটল ধরানোর মদত দিতে চাইলে সালি মুলতান ও তার পুবদিকে সেনাসমাবেশ করেন। কিন্তু হুলাগু দিল্লির সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে যেতে রাজি হননি। সিরিয়া ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় তার তখন অনেক সৈন্য যুদ্ধ করছে, এমতাবস্থায় দিল্লি আক্রমণ অর্থহীন। মোঙ্গলদের দিক থেকে সেনা অপসারণের খবর পেয়েই আলাউদ্দিনের পরবর্তী দিল্লির সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ মুলতান, লাহোর পুনরাধিকার করে নেন। সেখানকার স্থানীয় যোদ্ধারা যারা খোরজম আর মোঙ্গলদের যুদ্ধে সাহায্য করছিল, তাদের কিছুদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়, বাকিদের তিনি মোতায়েন করেন তার নিজের সেনাবাহিনীতে। পরবর্তী সুলতানরাও এই ধারা অনুসরণ করতে থাকলে খিলজি উপজাতির প্রচুর যোদ্ধা দিল্লির সুলতান সেনাবাহিনীতে ঢোকার ফলে সেনাদলে জাতিগত সাম্য ব্যাহত হয়।
ফলে ১২৯০ সালে দিল্লির গদি কেড়ে নেন এই উপজাতিদেরই এক নেতা জালালুদ্দিন খিলজি।
১২৬০-এর দশকে মোঙ্গলদের নিজেদের একতার মধ্যে কিছুটা ফাটল ধরে। চার অঞ্চলে বিভাজিত হয়ে যায় তাদের বিশাল অধিকৃত এলাকা। মধ্যপ্রাচ্যের শাসক হন চেঙ্গিজের মেজছেলে চাগাতাই-এর বংশধররা। ১২৮০ খ্রিস্টাব্দে দুয়া খান নামে একজন আফগানিস্তানের শাসক হন, সেখান থেকে তিনি ভারতে রাজ্যবিস্তারে উৎসাহী হন। ১২৯২ সালে তারা পাঞ্জার আক্রমণ করলে জালালুদ্দিন খিলজি তাদের শুধু প্রতিহতই করেন না, হাজার চারেক মোঙ্গল সেনাকে বন্দী করে তাদের দিল্লি এনে মুসলমান ধর্মে ধর্মান্তরিত করেন। দিল্লির অনতিদূরে মোগলপুরাতে তাদের রাখা হয়। এর পরে বেশ কয়েকবার মোঙ্গলরা দিল্লি আক্রমণ করেও সুলতানি শাসনে দাঁত ফোটাতে পারেনি। জালালুদ্দিনের পরবর্তী শাসক আলাউদ্দিন খিলজির আমলেও মোঙ্গল আক্রমণ জারি থাকে। আলাউদ্দিনের সেনাপতি উলুগ খান তাদের হটিয়ে দেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীর একেবারে শেষ দিকে মোঙ্গলরা সিন্ধ আক্রমণ করে একটা গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ দখল করে নেয়। আলাউদ্দিনের অন্য আর এক সেনাপতি জাফর খান তাদের পরাজিত করে দিল্লিতে বন্দী করে নিয়ে আসেন। এ সময় আলাউদ্দিনের প্রধান সেনাপতি উলুগ খান গুজরাত লুণ্ঠন করে ফিরছিলেন। তার অধীনে কিছু মোঙ্গল সেনাও ছিল। তারা লুঠের বখরা নিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে তাদের কঠোর হাতে দমন করা হয়।
১৩২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিচ্ছিন্নভাবে দিল্লির ওপর মোঙ্গল আগ্রাসন জারি ছিল, কিন্তু প্রতিবারই সুলতানরা তা প্রতিহত করতে সমর্থ হন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মোঙ্গলদের অপদার্থতার সুযোগ নিয়ে তারাও মোঙ্গলদের এলাকায় আক্রমণ চালাত এবং তাদের অঞ্চল দখল করেও নিত। এই ভাবে কাশ্মীরও মোঙ্গলদের হাতছাড়া হয়ে যায়।
১৩২০ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গলদের একটা দল বিতস্তা নদীর উপকূল ধরে কাশ্মীরে উপস্থিত হয় কোন বাধা না পেয়েই। কাশ্মীরের রাজা সহদেব বিপদ বুঝে যুদ্ধের বদলে প্রচুর উপঢৌকন দিয়ে তাদের প্রতিহত করতে চান। তার চেষ্টা ব্যর্থ হলে সহদেব কাশ্মীর ছেড়ে পালিয়ে যান। মোঙ্গলরা কাশ্মীর ছারখার করে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। নারী ও শিশুদের ক্রীতদাস বানিয়ে নেয়। কাশ্মীরে সে বছর শীতে প্রবল তুষারপাতে অবশ্য মোঙ্গল সেনাদের দুরবস্থা শুরু হয়, তাদের অধিকাংশই মারা পড়ে তুষারঝড়ের মধ্যে পাহাড়ি পথে দেশে ফিরতে গিয়ে।
দিল্লিতেও শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন হয়। খিলজিদের পর মসনদে বসেন তুঘলক বংশ। ওদিকে যত সময় যেতে থাকে মোঙ্গলদের বংশ বাড়তে বাড়তে নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি শুরু করে। তার সঙ্গে যুক্ত হয় ধর্মীয় সমস্যাও। মঙ্গোলরা আদিতে তাদের নিজেদের ধর্ম আচরণ করত। এই সময় তাদের কেউ আদি ধর্ম রক্ষা করে চলছে, কেউ হয়ে গেছে মুসলমান, কেউ বা ভারতীয় প্রভাবে বৌদ্ধ। এর ফলে তাদের একতার অভাব লক্ষ করা যায়। এইসব লক্ষ করে দিল্লির তুঘলক শাসক মহম্মদ বিন তুঘলক মোঙ্গলদের নিজেদের মধ্যে বিরোধ বাধিয়ে দিল্লি নিরাপদ রাখার চেষ্টা করেন। চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি চিনের ইউয়ান রাজবংশ ও পারস্যের মোঙ্গলশাসক ইলখানিদদের সঙ্গে তার মিত্রতাও চাগাতাই বংশের মোঙ্গলদের দূরে সরিয়ে রাখতে সমর্থ হয়। মরক্কোর পরিব্রাজক ইবন বতুতাকে তিনিই পাঠান মোঙ্গলদের রাজসভায়, সঙ্গে উপহার দেন শ’ দুয়েক ক্রীতদাস।
চাগাতাই মোঙ্গলদের এই ক্রম অবনতি চলতেই থাকে। তার অবসান ঘটিয়ে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষপাদে মূর্তিমান বিভীষিকার মত দিল্লিতে উপস্থিত হয় তাদের নেতা তৈমুরলঙ্গ। সে শুধু লুঠতরাজেই থেমে থাকে না, রাজ্য গ্রাস করে নিজের এলাকা বাড়িয়ে চলে আর তার সঙ্গে যুক্ত হয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের ইসলামে ধর্মান্তকরণ। ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে তার বাহিনী দিল্লি ছারখার করে দেয়। তৈমুরের পর অবশ্য আবার চাগাতাই বংশের পূর্বের ধারা ফিরে আসে। ছোট ছোট রাজ্যের শাসক হয়ে বসে মধ্যপ্রাচ্যের যাবতীয় শাসকরা।
মোঙ্গলদের মধ্যে ইসলাম প্রবেশ করেছিল তুঘলক তিমুরের আমলে। চাগাতাই খানের পৌত্র ইয়েসুন্তোয়ার প্রপৌত্র প্রথম ইসেন বুকা, তার ছেলে তুঘলক তিমুর। তুঘলক তিমুর একদিন শিকারে বেরিয়েছেন, হঠাৎ দেখেন সেই উদ্যানে এক মুসলমান ফকির, তার নাম মৌলানা আর্শাদুদ্দিন। তুঘলক তিমুর রেগেমেগে অস্থির। সে যেখানে শিকারে যাবে, তাতে এইসব অনাহূত উটকো লোক আসে কোত্থেকে! সঙ্গীকে বললেন, ওকে ধরে আনো তো। বেঁধে আনা হল ফকির আর্শাদুদ্দিনকে। তুঘলক তিমুর জিজ্ঞেস করলেন, আমার এই বাগানে ঢুকেছ, তোমার সাহস তো কম নয়! কে অনুমতি দিয়েছে তোমাকে এই বাগানে ঢোকার? ফকির বললেন, এই বাগান যে আপনার, তা তো জানি না। আমার তো মনে হয়নি আমি অন্যের জায়গায় ঢুকেছি। তুঘলক তিমুর বলল, তুমি পারস্যের লোক, তাই না? একটা কুত্তার মূল্য একটা পার্শির চেয়ে বেশি। ফকির বললেন, তা বটে, আমাদের মনে যদি সত্যিকারের বিশ্বাস না থাকে, আমরা তবে কুত্তার মূল্য বেশি ভাবব সত্যিই। তুঘলক তিমুর বলল, সত্যিকারের বিশ্বাস! সে আবার কী বস্তু হে? খায় না মাথায় দেয়?
ফকিরকে ধরে নিয়ে যাওয়া হল তুঘলক তিমুরের প্রাসাদে। সেখানে তিনি তাকে ইসলাম তত্ত্বমতে প্রকৃত বিশ্বাসের ব্যাখ্যা দিলেন। সেই দিনই তুঘলক তিমুর সেই ফকিরের কাছে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিল। ঘটা করে পালন করা হল তার সুন্নৎ। সেই দিনই তার রাজ্যের একলক্ষ ষাট হাজার মানুষ মাথা মুড়িয়ে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করল। সেই থেকে শুরু হল এই বংশের মুসলমান শাসন।
তুঘলক তিমুরের নাতি মিজগালার নাতি তাসখন্দের ইউনুস খান, তার মেয়ের নাম কুতলুগ নিগার খানুম। অপরপক্ষে তৈমুরলঙ্গের ছেলে মিরন শাহ, তার ছেলে মহম্মদ শাহ, তার ছেলে আবু সৈয়দ মির্জা, তার ছেলে উমর শেখ মির্জা।
এই উমর শেখের সঙ্গে বিয়ে হল কুতলুগের, তাদের পুত্রই জহিরুদ্দিন মহম্মদ বাবর।
* * *
বাবরের ঠাকুর্দা আবু সৈয়দ মির্জা তৈমুরলঙ্গের মেজছেলে মিরন শাহের নাতি। বাবরের দাদু মানে মাতামহ ইউনুস খান চেঙ্গিজ খানের বংশধর। সৈয়দ মির্জার সাহায্যেই তিনি এক অঞ্চলে মোঙ্গল প্রধান হিসাবে জাঁকিয়ে বসতে পেরেছিলেন। ফলে, যা হয়, দুজনের মধ্যে আত্মীয়তার বাঁধন সুদৃঢ় করতে আবু সৈয়দ মির্জা তার চার ছেলের তিনজনকে বিয়ে দিলেন ইউনুস খানের তিন মেয়ের সঙ্গে, ফলে বোনেরা সব পরস্পরের জা-ও হয়ে গেল আর ভায়েরা হয়ে গেল ভায়রা ভাইও। এই চার ভাই অবশ্য সব এক মায়ের সন্তান নয়, চারজন আলাদা আলাদা মায়ের সন্তান। তবে তাদের বাবা আবু সৈয়দ মির্জা চার ছেলেকে নিজের রাজ্য ভাগ করে দিয়ে গেলেন।
সৈয়দ মির্জার বড় ছেলে ও ইউনুস খানের বড় জামাই আহমদ মির্জার ভাগে পড়ল সবচেয়ে সম্পন্ন জায়গা সমরকন্দ ও বুখারা। মেজ ছেলে উলুগ বেগ মির্জা পেল কাবুল আর গজনি। বদকশান, খুতলান এবং হিন্দুকুশ ও সন্নিহিত অসফর পর্বতমালার মধ্যের অঞ্চল গেল সেজ ছেলে মাহমুদ মির্জার দখলে। ফলে ছোট ছেলে উমর শেখ মির্জার ভাগে পড়ে রইল ক্ষুদ্র ফরগনা, আয়তনে মেরেকেটে পঞ্চাশ হাজার বর্গমাইল।
উমর শেখ তা নিয়ে খুশি নয় আদৌ। তার উচ্চাকাঙ্খা প্রবল, কিন্তু সাধ্য সাধের চেয়ে অনেক কম। হাজার হোক তৈমুরের বংশধর, অল্পে খুশি থাকার পাত্রই নয় সে। ভাইদের জন্যে বড় বড় জায়গা, নিজের জন্যে ছোট, এ নিয়ে খুশি থাকার বদলে সে সুযোগ পেলেই পাশের রাজ্যগুলোর ওপর হামলা করতে লাগল। কিন্তু কপাল মন্দ, প্রতিবারই এই হামলার ফলে পাশের রাজ্যের কাছে যুদ্ধে হেরে তার ক্ষুদ্র রাজ্য ক্ষুদ্রতর হতে লাগল। এমনই দুর্বুদ্ধি তার, অধিকাংশ বারই সে যে রাজ্য আক্রমণ করে, তার মালিক তার নিজের শ্বশুর ইউনুস খান। একবার তো উমর শেখকে বেঁধে নিয়ে গেল সৈন্যরা ইউনুস খানের কাছে। ছোট জামাইয়ের এই অবস্থা দেখে ইউনুস তো অবাক! তার বাঁধন খুলে দিয়ে পুরো জামাইষষ্ঠীর মত আদর-আপ্যায়ন করে ভালমন্দ খাইয়ে দাইয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। নিজেও এসে মেয়ের বাড়ি কাটিয়ে গেলেন মাস দুয়েক।
ইউনুস খান শ্বশুর হিসাবে উদার ছিলেন বটে, কিন্তু তার এই উদারতা যে তার ছেলেদের মধ্যেও সঞ্চালিত হবে, তার তো কোনো মানে নেই! ইউনুস খান মারা গেলে তার রাজ্য মুঘলিস্তান দুই ভাগ হয়ে সেখানে রাজত্ব করতে লাগল দুই ছেলে মাহমুদ খান ও আহমদ খান। এরা উমর শেখের শ্বশুরের পুত্র, সুতরাং সম্বন্ধী।
উমর শেখের বড়দা আহমদ মির্জা ইউনুস খানের বড় জামাই, অর্থাৎ তার মতোই মাহমুদ-আহমদ খানের ভগ্নিপতি। ইউনুস খানের মৃত্যুর পর আহমদ মির্জার মেয়েকে বিয়ে করেছে মাহমুদ খান, ফলে তাদের মধ্যে দহরম মহরম কিঞ্চিৎ বেশিই। এসব জানা সত্ত্বেও উমর শেখের চৈতন্য হল না। সে আবার ঝামেলা বাধাতে লাগল বড়দা আহমদ মির্জা আর সম্বন্ধী মাহমুদ খানের সঙ্গে। তারা একযোগে ঠিক করে নিল উমর শেখের এই শখ চিরতরে মিটিয়ে দেবে দুজনে দুদিক থেকে ঝটিকা আক্রমণ শানিয়ে।
সে শখ তার মিটেই গেল, যদিও ঠিক এই আক্রমণ-সংক্রান্ত যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফল হিসাবে নয়।
* * *
আন্দিজানের ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলছে শত্রুসেনারা, যে কোনো মুহূর্তেই শহর অবরুদ্ধ হতে পারে। বাবরের ওপর আনুগত্য দেখিয়ে উমর শেখের বেগেরা শত্রুদের মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তারা সংখ্যায় বেশি নয়, সদ্য কাটিয়ে উঠেছে তাদের নেতাকে হারানোর মত এক মানসিক বিপর্যয়। দুর্গরক্ষার জন্য উপযুক্ত আয়োজন করার সময় পেয়েছে কোথায় তারা? এক্ষুনি যদি আক্রমণ আসে আহমদ মির্জার সেনাদের, তাদের পক্ষে দুর্গ রক্ষা অসম্ভব। একমাত্র উপায় ছলে বলে কৌশলে সময় কাটানো, যাতে সবদিক গুছিয়ে নেওয়া যায়। যুদ্ধের ভাষায় তার নাম সন্ধিপ্রস্তাব। হাজার হোক, আহমদ মির্জা বাবরের আপন বড় জ্যেঠা। বেগরাই পরামর্শ দিল বাবরকে, গুছিয়ে একখানা চিঠি লিখে জ্যেঠাকে পাঠাতে।
আহমদ মির্জার হাতে সে চিঠি এসে পড়তেই তিনি খুলে দেখলেন ভাইপো লিখেছে – ফরগনা কাউকে না কাউকে তো শাসন করতেই হবে। আপনি অত দূর থেকে নিজে তো আর এর ওপর চোখ রাখতে পারবেন না। আমি আপনার নিজের ছেলের মতই তো। আমাকেই না হয় এই দায়িত্ব দিলেন! আমি কথা দিচ্ছি আমি ভালোভাবেই সে দায়িত্ব পালন করতে পারব।
বাবর জানে, তার জ্যাঠাটি নম্র স্বভাবের, চুপচাপ, বেশি কথার মানুষ না। আদপেই কঠোর নয়। কিন্তু এই চিঠি পেয়ে অমন জ্যাঠাও গলে যাবার পরিবর্তে বাঁকা হাসি হাসলেন। আহমদ মির্জা ঠিক বুঝে গেলেন এর পেছনে আছে উমর শেখের বেগদের উচ্চাশা। তারা কোনো রকমে বাচ্চা ছেলেকে শিখণ্ডী বানিয়ে আড়াল থেকে কলকাঠি নেড়ে ক্ষমতা দখল করতে চায়। তাদের মজা দেখানোর জন্যে চিঠিটাকে একদম পাত্তা না দিয়ে আন্দিজানের ঠিক বাইরে কাবা থেকে ছাউনি তুলে ত্বরিৎগতিতে আন্দিজান অভিমুখে ঘোড়া ছোটালেন তিনি।
হতবাক হয়ে গেল বাবর ও তার অনুগামীরা। এখন উপায়! তাদের হাতে আর একেবারেই সময় নেই। দুর্গ রক্ষার কাজ মোটেই নিশ্ছিদ্র নয়। এখন যুদ্ধ শুরু হলে তাদের হার অবশ্যম্ভাবী।
হঠাৎ মেঘ না চাইতেই জলের মত বাবরের হাতে উপস্থিত হল তারই পাঠানো চিঠির মত এক বস্তু – শান্তিপ্রস্তাব!
ব্যাপার কী! আহমদ মির্জা কাবা থেকে আন্দিজান আসতে গিয়ে ভয়ঙ্কর সমস্যায় পড়ে গেছেন। পাহাড়ি রাস্তার বিষয়ে সম্যক জ্ঞান ছিল না তার সেনাদের। রাস্তার খোঁজখবর যতবার করেছে কোনো পাহাড়ি গ্রামে, গ্রামবাসীরা উল্টোপাল্টা রাস্তা দেখিয়ে তাদের বিভ্রান্ত করেছে। কৃষকদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হয়েছে তাদের। এদের নেতা উমর শেখের মৃত্যুর পর এই যে তার এক শিশুপুত্রকে গদিতে বসানো হয়েছে, এরা বুঝে গেছে এই জন্যেই শত্রুদের এই আগমন। এদের যে কোনোভাবে প্রতিহত করতে তারা যে কোনো মূল্য দিতে প্রস্তুত।
শুধু কি তাই? কোত্থেকে এক অদ্ভুত ঘোড়ারোগে পড়ে গেছে তার সৈন্যদের বহুসংখ্যক ঘোড়া। ছুটবে কী, তারা কয়েক পা গিয়েই হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ছে, নড়ছে না, মরে যাচ্ছে। একটা দুটো না, শয়ে শয়ে। ঘোড়া ছাড়া পাহাড়ি পথে যাত্রা অসম্ভব, যুদ্ধ তো দূরের কথা। সেনাদের মনোবল কমে যাচ্ছে দিনকে দিন।
মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মত ঘটে গেল আর এক ঘটনা। কাবা থেকে আন্দিজানের রাস্তায় পড়ে এক খরস্রোতা নদী। তার ওপর একমাত্র সাঁকোটি খুবই সরু ও নড়বড়ে। একসঙ্গে একগাদা সেনা ঘোড়া আর উটে চেপে তার ওপর চড়ে বসতেই সেটা দুলতে দুলতে উলটে গেল। বাহন সমেত সেনারা উলটে পড়ল সেই নদীতে, তাদের আর চিহ্ন পাওয়া গেল না। এর আগে সির নদী পেরোতে গিয়ে একই ঘটনা ঘটেছিল আহমদ মির্জার, খুব নাকাল হয়েছিলেন তিনি, আবার এই।
এ অবস্থায় যুদ্ধ করা অসম্ভব। বরং যে দেশ আক্রমণে এসেছেন, তাদের সেনারা তাকে আক্রমণ করে বসলে প্রাণ নিয়ে দেশে ফেরাই অসম্ভব। কাবা আসার পথে আউরাটিপা, খুজন্দ, মরঘিনান তাদের দখলে এসেছে। এখন মানে মানে সম্মান নিয়ে দেশে ফিরে যাওয়াই ভাল। মাহমুদ খান আখসির দিকে যা পারে একাই করুক।
তার শান্তির প্রস্তাব বাবরের কাছে পৌঁছাতেই বাবর যেন হাতে চাঁদ পেল। এ তো মেঘ না চাইতেই জল! সে কোথায় ভাবছিল কীভাবে দুর্গ বাঁচাবে, কীভাবে বাঁচাবে নিজেকে ও আত্মীয়স্বজন সেনাসামন্ত শহররক্ষীদের, এখন তার পরাক্রমী শত্রু শান্তি আহ্বান করছে! অনুচর ইয়াকুবের পুত্র হাসানকে পাঠানো হল আহমদ মির্জার কাছে শান্তির চুক্তি সম্পাদনের জন্যে। বাবর চাইল বড় জ্যাঠা যদি হাতছাড়া হওয়া আউরাটিপা, খুজন্দ আর মরঘিনান তাদের ফেরৎ দেয়। আহমদ মির্জা মরঘিনান ছেড়ে দিতে রাজি হলেন। মেনে নিল সেটা হাসান। চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে গেল ভালোয় ভালোয়। দেশে ফেরার উদ্যোগ করলেন আহমদ মির্জা।
বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎই তার মৃত্যু হল। ভাই উমর শেখ মির্জার মৃত্যুর ঠিক চল্লিশ দিনের মাথায়। বারো বছর বয়সী সম্রাট জহিরুদ্দিন মহম্মদ বাবরের প্রথম ফাঁড়া কাটল।
কিন্তু এ তো সবে কলির সন্ধে! শিয়রে শমনের মত ফরগনার উত্তরে আখসি দুর্গ ততক্ষণে অবরোধ করতে উদ্যত হয়েছেন তার বড়মামা মাহমুদ খান। বাবরের মেজ ভাই জাহাঙ্গির মির্জা তখন আখসি দুর্গে, ছোট ভাই নাসির মির্জা রয়েছে কাসান দুর্গে। বাবর যতক্ষণে আন্দিজানে আহমদ মির্জার আক্রমণ প্রতিহত করতে বেগদের সঙ্গে শলা পরামর্শ করছিল, ততক্ষণে তার পরাজয় নিশ্চিত ভেবেই কাসান দুর্গের কয়েকজন বেগ দুর্গ ছেড়ে পালানোর উপক্রম করছিল। মাহমুদ খান আখসির কাছাকাছি আসতেই ওয়েইস লাঘরি আর মির ঘিয়াস তঘাই নামে দুজন কাসান থেকে পালিয়ে মাহমুদ খানের শিবিরে যোগ দিল, সঙ্গে নিয়ে গেল বাবরের ছোট ভাই নাসির মির্জাকেও।
আখসি অবরুদ্ধ হল। কিন্তু তাতে দমে গেল না দুর্গের বেগরা। বাবরের মেজ ভাই জাহাঙ্গির মির্জা, সঙ্গে আলি দরবেশ, মির্জা কুলি কুকুলদাস, মহম্মদ বাকির, শেখ আবদুল্লা ও অন্যান্য সেনারা প্রাণপণে যুদ্ধ করতে লাগল। আখসির সুবিধে হচ্ছে এর তিনদিক পাহাড় দিয়ে ঘেরা, একদিকে গভীর খাদ, যেখান থেকে ধস নেমে মারা গেছেন উমর শেখ মির্জা। চট করে একে কব্জা করা সম্ভব নয়। মাহমুদ খান আক্রমণ করেই চলেন, বিশেষ লাভ হয় না। দুর্গের ভেতরে ঢোকা তো দূরের কথা, বাইরের চত্বরেই ঢুকতে পারে না তার সেনারা। এদিকে খবর আসে তার মিত্র আহমদ মির্জা আন্দিজান দখল করতে পারেনি, ফিরে গেছে।
অসুস্থ হয়ে পড়েন মাহমুদ খান। কতদিন আর একটা দুর্গ অবরোধ করে রাখবেন আর যুদ্ধ যুদ্ধ খেলবেন? কিছুই যখন লাভ হচ্ছে না, অন্যদিক থেকে আহমদ মির্জারও এগিয়ে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই, তখন ফিরে যাওয়াই ভাল। অবরোধ তুলে নিজের রাজ্য তাসখন্দে ফিরে যাওয়া সাব্যস্ত করলেন মাহমুদ খান। বাবরের দ্বিতীয় ফাঁড়াও কেটে গেল।
কিন্তু বিপদ যখন আসে, চারিদিক থেকে আসে। বাবার মৃত্যু ও ঘনিষ্ঠ দুই আত্মীয়ের সেনাদের দমন করার পরেও বাবরের শান্তি নেই। তার বয়স মাত্রই বারো, প্রতিবেশীদের চোখে সে নাবালক এবং অনাথ। মানে তার রাজ্য ইচ্ছা করলেই দখল করা যায়। আর প্রতিবেশী সবাই তো লতায় পাতায় সেই তৈমুর চেঙ্গিজেরই বংশধর, বাবরের মত। সবাই চায় দুনিয়ার অধীশ্বর হতে। নিজের ছোট্ট খুপরিতে বন্দী হয়ে থাকতে কে আর চায়?
অশৌচ কাটার আগেই বাবরকে তৃতীয় এক শত্রুর মুখোমুখি হতে হল। পার্শ্ববর্তী কাশগড় ও খোটানের সম্রাট আবু বকরের নজর ফরগনার ওপর। আউজকিন্টের কাছে নতুন একটা দুর্গ বানিয়ে ফরগনার ওপর নজর রেখে চলেছেন কিছুদিন ধরে, যাতে সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে দখল নিতে পারেন। এতদিন দেখছিলেন আহমদ মির্জা আর মাহমুদ খানের ক্রিয়াকলাপ, তাই নিজে চুপচাপ ছিলেন। এখন ওরা ফিরে গেছে, ফরগনায় রাজাও নেই, অন্তত তিনি তাই জানেন। উমর শেখ মারা গেছে মানে ফরগনা অভিভাবকহীন। তাকে শুধু সেনা নিয়ে হাজির হলেই ফরগনা তার অধীনস্থ হয়ে যাবে।
কিন্তু এক এক সময় মানুষ যা ভাবে, তা হয় না। বাবরের প্রতি আনুগত্যের ফলেই হোক বা প্রতিদ্বন্দ্বী দুই সম্রাটকে ফিরিয়ে দেওয়া-জনিত জয়ের আনন্দে, বাবরের সেনাদের এখন সবাই প্রবল আত্মবিশ্বাসী। আবু বকর তাদের দিকে চার পা এগিয়ে আসতেই তারা আবু বকরের সেনাদের দিকে আট পা এগিয়ে গেল। এ রকম তো ধারণাই করতে পারেননি আবু বকর। ভেবেছিলেন যুদ্ধবিগ্রহ ছাড়াই ফরগনা তার হয়ে যাবে, বড়জোর কিছু সময়ের অপেক্ষা দুর্গ অবরোধ করে এদের বশে আনার। তা তো হচ্ছে না, উলটে এরাই ধেয়ে আসছে সৈন্য নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে। আহমদ মির্জার মত তিনিও বাধ্য হলেন শান্তিপ্রস্তাব বাড়িয়ে দিতে।
এতদিনে বাবর একটু ফুরসৎ পেলেন হাঁফ ফেলবার। উমর শেখের অন্যান্য আত্মীয়স্বজন যারা আখসি দুর্গে অবস্থান করছিল, তাদের ফিরিয়ে আনা হল রাজধানী আন্দিজানে। এতদিনে প্রয়াত পিতার শেষকৃত্যাদি পালন করা হল নিয়ম মেনে। রাজ্যব্যাপী শোক পালিত হল। গরিব মানুষদের মধ্যে খাদ্য ও পোশাক বিতরণ করলেন বারো বছর বয়সী বালক সম্রাট। রাজ্য জুড়ে তার নামে জয়ধ্বনি দেওয়া হল।
ছোটবেলা থেকেই বাবরের দেখভাল করতেন তার দাদিমা, মা কুতলুগের মা এহসান দৌলত বেগম। এই এহসান দৌলত এক আশ্চর্য মহিলা। যেমন তিনি বাচ্চাদের রক্ষণাবেক্ষণে পটু, তেমনি তার মানুষের চরিত্র বোঝার ক্ষমতা। বেগরা যে তাদের পরিবারের কথামত চলত, তার এক প্রধান কারণ এই এহসানের কার্যাবলি। অন্য কারো সঙ্গে কিছু শলাপরামর্শ করার আগে তাই বাবর এসে তার কাছে হাজির হয়ে জিগ্যেস করল, দাদিমা, বলো, এবার কী করা যায়?
দাদিমা তার পিঠ চুলকে দিতে দিতে বললেন, আসল কাজে উপযুক্ত লোক নিয়োগ করবি। আজেবাজে লোক দিয়ে ভাল কাজ হয় না। এই আন্দিজানের দুর্গ রক্ষার দায়িত্ব কাকে দিবি ভেবেছিস? আমার কথা শুনিস তো সেই দায়িত্ব দে ওই হাসান ছোকরাটাকে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, হাসান-ই-ইয়াকুব। ছোকরা চটপটে, এই কাজের যোগ্য। অন্যান্য জায়গাগুলোরও সেই রকম শাসনের দায়িত্ব এক এক জনের মধ্যে ভাগ করে দে। আউশ জেলা সামলাক কাশিম কুচিন। আখসির দায়িত্বে থাক অউজুন হাসান। মরঘিনানে আলি দোস্ত তঘাই। এরা তোর কাছের লোক, এদের হাতে রাখতেই হবে। আর এই যে ঘোর দুর্দিনে এতগুলো বিপদ কাটিয়ে উঠতে পারলি, যে যেমন সাহায্য করেছে, তাকে তেমন গুরুত্ব আর মর্যাদা দিবি। এই বুঝে দায়িত্ব দে কাউকে বিলায়ত (পরগনা) দেখতে, কাউকে ইর (জমি) দেখতে, কাউকে মৌজা (কাছারি) দেখতে। অন্যদের উপযুক্ত জিগা (দায়িত্ব) আর ওয়াজাহ্ (বৃত্তি) দিবি।
দাদিমার কথামত বাবর তার কাছের লোকজনদের বিভিন্ন দায়িত্বে ন্যস্ত করে দিল।
* * *
অর্থনীতি বা সম্পদ বলতে আমরা এখন যা বুঝি, সুদূর অতীতে ভারতবর্ষে তার ধারণা ছিল বহুলাংশে অন্যরকম। সংস্কৃতে অর্থনীতি, যার ইংরাজি ইকনোমিক্স, নামে কোনো শব্দ নেই। অর্থ-মীমাংসা, ধনশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র ও বার্তাশাস্ত্র আছে, কিন্তু এই অর্থশাস্ত্র ও বার্তাশাস্ত্রের মর্মকথা ভিন্ন।
প্রাচীন ভারতে যে-কোন বিষয়ে সম্যক জ্ঞানকে বলা হত বিদ্যা বা শাস্ত্র। বিদ্যাও আবার চার প্রকারের – আন্বীক্ষিকী ত্রয়ী বার্তা দণ্ডনীতিশ্চ ইতি বিদ্যাঃ। এর মধ্যে বার্তা শব্দটা এসেছে বৃত্তি থেকে, যার অর্থ পেশা বা পেশার নিমিত্ত করণীয় কার্যসংক্রান্ত জ্ঞান। কৌটিল্য তার অর্থশাস্ত্রে বললেন, বার্তা মানে কৃষিকাজ, গবাদি পশুপালন ও বাণিজ্য – কৃষিপাশুপাল্যে বাণিজ্যা চ বার্তা। খাদ্যশস্য, গবাদি পশু, সোনাদানা, বনের ফলমূল এমনকি শ্রমিক – সবই বার্তার অন্তর্গত। বার্তার মাধ্যমেই এক ভূখণ্ডের অধিপতি তার প্রজা ও শত্রু উভয়ের ওপরেই নিয়ন্ত্রণ রাখতে সমর্থ হন। পরবর্তীতে শুক্রনীতিতে কুসীদজীবিকা অর্থাৎ টাকাপয়সা ধার দেওয়াও বার্তার অন্তর্গত হয় – কুসীদকৃষিবাণিজ্যং গোরক্ষাবার্তয়োচ্যতে। এরও পরে দেবীপুরাণে শিল্পী দ্বারা নির্মিত শিল্প তথা কর্মান্তও বার্তার অন্তর্ভুক্ত হল – পশ্বাদিপালনাদ্দেবি কৃষিকর্মান্তকারণাৎ বার্তায়াং নিত্যযুক্তঃ স্যাৎ পশুনাং চৈব রক্ষণে। আধুনিক পরিভাষায় বার্তা হয়ে দাঁড়াল পশুপালন তথা ক্যাটল রিয়ারিং, কৃষি তথা এগ্রিকালচার, বাণিজ্য তথা ট্রেড, শিল্প তথা ইন্ডাস্ট্রি এবং কুসীদজীবিকা তথা ব্যাঙ্কিং।
যাজ্ঞবল্ক্য দেশের রাজার গুণাবলির তালিকায় বার্তাজ্ঞানের উল্লেখ করেন। মহাভারতে লেখা হয়, বার্তামূলোহয়ং লোকস্য তয়া বৈ ধার্যতে সদা – এই বিশ্বলোকের মূলে বার্তা; বার্তাই এর ধারকও।
অর্থশাস্ত্র অবশ্য শুধু বার্তাতেই সীমাবদ্ধ নয়। কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রের জনক, তিনিই একে জনপ্রিয় করে তোলেন। অর্থনীতির সঙ্গে অন্যান্য সমাজশাস্ত্র যোগে নির্মিত অর্থশাস্ত্র। বিদ্যা ও অর্থশাস্ত্রের মধ্যে সম্পর্ক যেন জ্ঞান এবং পুরুষার্থের মধ্যে সম্পর্ক। ভারতবর্ষে পুরুষার্থ অর্থাৎ মানুষের লক্ষ্য বলতে বোঝাত চার-অধ্যায়ী জীবনচর্যা – ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। মানুষ অনুসরণ করত মূলত দুটি পথ – কর্মযোগ-দ্বারা প্রবৃত্তিমার্গ ও কর্মহীন নিবৃত্তিমার্গ। অর্থ ও কাম নিঃসন্দেহে প্রবৃত্তিমার্গের পথ। মোক্ষ-তে নিবৃত্তিমার্গের সূচনা হয়।
অর্থশাস্ত্র সুতরাং জীবনধারণ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও আইনপ্রণয়নের সংযোগে নির্মিত এক শাস্ত্র। এতে অর্থ কেবলমাত্র ধন নয়, পুরুষার্থও বটে। যা কিছু মানুষ লাভ করতে ইচ্ছুক – বস্তুগত বা আধ্যাত্মিক – সকলই অর্থের অঙ্গ।
জীবন ধারণের জন্যে অতীতে মানুষের প্রয়োজন ছিল তিনটি জিনিসের – অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান। গুহাবাসী মানুষ নিজের বাসভূমি তৈরি করতে শিখে যায়, কৃষিকাজ শেখে অন্ন ও বস্ত্রের সমস্যা মেটাতে। এক সময় ছিল যখন কৃষিই ছিল সমগ্র বিশ্বের একমাত্র অর্থনীতি। ভারতীয় উপমহাদেশে চাষবাস ছিল মূলত তিনটি উদ্ভিদের – চাল, গম এবং তুলো। ভাত-রুটিতে তাদের অন্নসংস্থান হত, তুলো দিয়ে বস্ত্র বানাতে শিখেছিল তারা। ভাত-রুটির সঙ্গে অন্যান্য যে সামগ্রীর দরকার হয়, যাকে বলা হত অন্নাদ্য, বর্তমানে যার নাম আনাজ অর্থাৎ তরকারি, তা পরিবেশ থেকে আপনিই সংগৃহীত হত। আলাদা করে এর চাষবাস শুরু হয় অনেক পরে। অবশ্য প্রায় একই সময়ে ভারতে ব্যাপক চাষ হত আফিমের, মূলত ওষুধ হিসাবে। ভারতের উপকূল বহুবিস্তৃত, সেখানে অনেক জায়গাতেই সমুদ্রের জল বাষ্পীভূত করে সামুদ্রিক লবণ তৈরি করা হত। শ্রীলঙ্কার উপকূলে ডুব দিলে মুক্তো পাওয়া যেত, তা থেকে প্রস্তুত করা যেত রত্নরাজি। ঘন জঙ্গলের কাঠ কেটে নিজেদের জন্যে আসবাব ছাড়াও প্রস্তুত করা হত নদী ও সমুদ্রে পরিবহন-উপযোগী ছোট-বড় নৌকা বা জাহাজ।
এই সমস্ত কাজ ছিল পুরুষদের। এ ছাড়াও পরিবারভিত্তিক সমাজে নারী ও শিশুরা কাজ করত বস্ত্র বয়নে। কার্পাস তুলো থেকে সুতো কাটা ও তা দিয়ে বস্ত্র তৈরি করার কৃৎকৌশল ভারতীয়রা শিখে গেছিল সুপ্রাচীনকালে। সাদা পোশাক তারা নীল দিয়ে ছুপিয়ে রং করতেও জানত, এই নীলও চাষ হত ভারতভূমিতেই।
কৃষিজ আখ থেকে রস বের করে তা জ্বাল দিয়ে চিনির মণ্ড প্রস্তুত করত ভারতীয় কারিগররা। কৃষিজ বস্তু ছাড়াও আকরিক লোহা থেকে লোহা নিষ্কাশনের পদ্ধতি আবিষ্কার করে তারা লৌহনির্মিত অস্ত্র ও সাধারণ ব্যবহার্য জিনিসপত্র বানাতে শেখে। শেখে বালি থেকে কাচ নির্মাণের পদ্ধতিও, যা দিয়ে ছোট ছোট গুলি বানিয়ে রত্নরাজিতে ব্যবহার করত তারা।
চিনের সঙ্গে সরাসরি ইওরোপের যোগাযোগ ব্যবস্থা তখনও শুরু হয়নি। চিনের বিখ্যাত রেশম ও মৃৎপাত্রের জন্যে পশ্চিম-দেশীয়দের নির্ভর করতে হত ভারতের ওপরেই, কেননা তখনকার যোগাযোগ ব্যবস্থার ভৌগোলিক অবস্থায় ভারত এই দুয়ের মধ্যবর্তী স্থানে। ভারতীয় শিল্পীরা খুব অল্প পরিমাণ সোনা নিখুঁতভাবে ওজন করতে পারত বলে সোনার বাটখারা তৈরি করে বিক্রি করত পশ্চিমে। চিনারাও পশ্চিমী রঙিন কাচ বা পশম কেনার জন্য দ্বারস্থ হত ভারতীয় উপকূলের।
রপ্তানীযোগ্য বস্তুতে ক্রমে ক্রমে যোগ হয় অন্যান্য বিশেষ বস্তুসমূহ। ভারতীয় ওষধি, গন্ধদ্রব্যের সঙ্গে যোগ হয় মশলা – প্রধানত গোলমরিচ ও দারুচিনি – মুক্তো, নীল ইত্যাদি। এইসব বিক্রিবাটার ফলে ভারত পৃথিবীতে বেশ ধনী দেশ রূপে পরিচিতি লাভ করে।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক লেনদেন এভাবেই শুরু হয়েছিল ভারতীয়দের। প্রথমে কেবলমাত্র উত্তর ভারত দিয়ে মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া হয়ে পূর্ব ও পশ্চিম ইওরোপে, স্থলপথে। পরে দক্ষিণ ভারতের উপকূলগুলোতে জাহাজ মারফৎ। গাধা ও উটের পিঠে চাপিয়ে বস্তু পরিবহনের চেয়ে নৌকা বা জাহাজে অনেক বেশি জিনিসপত্র পরিবহন করা যেত, ফলে নৌ-পরিবহন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দক্ষিণ ভারতের অর্থনীতি দ্রুত বিকাশ লাভ করতে থাকে। এটা মোটামুটি বুদ্ধ-মহাবীরের সময়কাল থেকে শুরু, যখন মহাজনপদগুলি ধীরে ধীরে বিস্তারলাভ করছে। ভারতীয় শাসকরা তখন থেকেই তাদের নামাঙ্কিত ধাতব মুদ্রার ব্যবহার চালু করে বস্তুর ক্রয়-বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে।
সমুদ্রের বুক থেকে মুক্তো তুলে আনত ডুবুরিরা। ভারতীয় ডুবুরিরা শ্রীলঙ্কার উপকূল থেকে মুক্তো সংগ্রহ করত, তার সঙ্গে বিভিন্ন আকৃতিতে কাটা অন্যান্য পাথর ও কাচের টুকরো মিলিয়ে রত্নরাজি তৈরি ও বিক্রির ব্যবসা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে খ্রিস্টের জন্মের অন্তত দুই শতক আগে থেকেই। এই সব রত্নরাজি বিক্রি হত পূর্বে সুদূর ফিলিপিন দ্বীপপুঞ্জ থেকে পশ্চিমে আফ্রিকা অবধি।
খ্রিস্টের জন্মের প্রায় দেড় হাজার বছর আগে মধ্যপ্রাচ্যের জর্জিয়া-আর্মেনিয়া থেকে একদল যাযাবর মানুষ দক্ষিণ-পূর্বে অগ্রসর হতে হতে বর্তমানে যেখানে তাজিকিস্তান-উজবেকিস্তান, সেখানে বসতি স্থাপন করে। তাদের অনেকে চলে যায় পারস্য ও উত্তর ভারতেও। এরা ছিল ঘোড়সওয়ার যোদ্ধা, ঘোড়া-টানা রথ নিয়ে এরা দ্রুত চলাচলে পারদর্শী ছিল। সমরকন্দ ও তার আশেপাশের এলাকা বুখারা, খুজান্দ, কেশ ইত্যাদিতে এরা জাঁকিয়ে বসে। ৫২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারস্য রাজ্য স্থাপনের সময় এদের রাজ্যও দখল করেন সাইরাস দ্য গ্রেট। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট আক্রমণের আগে অর্থাৎ ৩২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত পারস্য রাজ্যের অধীনেই ছিল এরা। এদের দুর্গে রক্ষিত ছিল সোনারুপোর এক বিশাল ভাণ্ডার। এই সোনারুপো তারা অর্জন করেছিল চিনা ও পার্শিদের কাছ থেকে, প্রধানত ঘোড়া কেনাবেচা করে। এ ছাড়াও পার্শিদের তারা বিক্রি করত চিনা রেশম আর চিনাদের বিক্রি করত পার্শি রুপো আর কাচের রত্নরাজি। এরা প্রকৃতিতে যোদ্ধা, পারস্য রাজ্যের রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল এদের অনেক লোকজন।
এই যাযাবর বণিকদের জন্যেই মধ্যপ্রাচ্য দিয়ে চিন ও ইওরোপের মধ্যে স্থাপিত হয় বিখ্যাত সিল্ক রুট। এই পথে বাণিজ্য সম্প্রসারিত হতে শুরু হলে তার সুবিধা নিতে ভারতীয়রাও নতুন নতুন শিল্পে আগ্রহী হয়। গুপ্তযুগে তারা তৈরি করে উন্নত ইস্পাত বানানোর প্রযুক্তি। চিনে আবিষ্কৃত কাগজ ভারতীয় প্রযুক্তিবিদরাও শিখে তা বিক্রি করা শুরু করে চতুর্থ শতাব্দীতে। সপ্তম শতাব্দীতে শ্রীলঙ্কায় বায়ুচালিত হাপরের সাহায্যে চালিত এক বড়সড় ইস্পাত তৈরির কারখানা স্থাপিত হয়। ঐ একই সময়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কারখানা স্থাপিত হয় চিনির মণ্ড বানানোর। এ সমস্তই তারা বিক্রি করত সিল্ক রুট ধরে চিনাদের, পার্শিদের আর ঐ যাযাবরদেরও।
টলেমিদের নৌবিদ্যা ব্যবহার করে মিশর ও পূর্ব আফ্রিকা থেকে নাবিকদের অনুপ্রবেশ শুরু হয়েছিল ভারতীয় উপকূলে, খ্রিস্টজন্মের কিছু শতাব্দী আগে থেকেই। নীলনদ ধরে লোহিত সাগরের মোহানা পেরিয়ে তারা চলে আসত ভারত মহাসাগর ও আরব সাগরের জলে। এদের সঙ্গে ভারতীয়দের বাণিজ্য প্রতিষ্ঠা হলে তুলো, রেশম, কাচ, মশলা ইত্যাদি বিক্রি হতে লাগল আরব বণিকদের কাছে। তারা নিয়ে আসত আফ্রিকার হাতির দাঁত, সোনা, ক্রীতদাস। পর্তুগিজ নাবিকদের অনুপ্রবেশের আগে প্রায় দু হাজার বছরব্যাপী এরাই ছিল আরব সাগরে মূল নাবিক বণিকশ্রেণি।
খ্রিস্টের সময় ভারতীয় উপমহাদেশের লোকসংখ্যা আনুমানিক পৃথিবীর তিরিশ শতাংশ, পৃথিবীর সামগ্রিক উৎপাদনের বত্রিশ শতাংশ ছিল ভারতবর্ষে। কোনো একক ভূখণ্ডের অর্থনৈতিক অবদান হিসাবে পৃথিবীতে সর্ববৃহৎ। ১০০০ খ্রিস্টাব্দে ভারতের লোকসংখ্যা পৃথিবীর সাতাশ শতাংশ, উৎপাদনে আঠাশ শতাংশ। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে ভারতের উৎপাদন পৃথিবীর এক-চতুর্থাংশ, যদিও মিং রাজবংশের চিন ততদিনে ভারতবর্ষের চেয়ে অর্থনৈতিক অবস্থানে খানিকটা এগিয়ে গেছে।
বাবরের পক্ষে এ সব জানা সম্ভব ছিল না, দরকারও ছিল না সম্ভবত। তার ধমনীতে বইছে যাযাবর যোদ্ধা চেঙ্গিজ ও তৈমুরের রক্ত। ঘোড়া ছুটিয়ে অস্ত্রচালনায় সে সিদ্ধহস্ত। বাবার কাছ থেকে সে পেয়েছে কাব্যপ্রীতি। ভারতের গদিতে তখন লোদি বংশের সম্রাট, কিন্তু লোদির ভারত নয়, বাবরের মন জুড়ে আছে পাহাড়-ঘেরা সমরকন্দ। সে শুনেছে সমরকন্দ এক আশ্চর্য জায়গা যার ভূমধ্যসাগরীয় হাওয়ায় বাগানে ফোটে বসরাই গোলাপ, গাছে গাছে ফলে থাকে রকমারি ফল।
সে কি পারবে বাবার ফরগনা রাজ্যের সীমা বিস্তৃত করে সমরকন্দের একচ্ছত্র অধিপতি হতে?
* * *
বাবরের চেয়ে ঠিক দশ বছরের বড় নিকোলাস, তার জন্ম পোল্যান্ডের থর্ন নামের এক শহরে। চার ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট নিকোলাসের বাবা একজন বণিক, মাও বণিকের ঘরের মেয়ে। পরিবারটি অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত, কিন্তু তাম্রব্যবসায়ী নিকোলাসের বাবা মারা যান যখন নিকোলাসের বয়স মাত্র দশ বছর। মামা লুকাস তাকে নিজের কাছে নিয়ে যান যাতে সে পড়াশুনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। আঠারো বছর বয়সে নিকোলাস ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাশ করে, একই বছরে পাশ করে তার ভাই অ্যান্ড্রুও। তারপর সে ভর্তি হয় ক্র্যাকো গণিত-জ্যোতির্বিদ্যা স্কুলের কলাভবনে। সেখানে সে বিভিন্ন নামী অধ্যাপকের সংস্পর্শে আসে, পাঠ নেয় পাটিগণিত, বীজগণিত, গাণিতিক আলোকবিদ্যা, ফলিত ও গাণিতিক জ্যোতির্বিদ্যার। সঙ্গে ছিল অ্যারিস্টটলীয় দর্শন ও অধ্যাত্মবিদ্যাও।
চার বছর ধরে চলে নিকোলাসের অধ্যয়ন, কিছু নামী অধ্যাপকদের বক্তৃতা শুনে, কিছু নিজের চেষ্টায় গ্রন্থাগারে প্রচুর বইপত্র পাঠের মাধ্যমে। অ্যারিস্টটল ও টলেমির তত্ত্ব অধ্যয়ন করে সে এক নতুন দুনিয়ার সন্ধান পেয়ে যায়।
জহিরুদ্দিন মহম্মদ বাবর যখন তার বাবার মৃত্যুর পর রাজ্যের গদিতে বসে একের পর এক যুদ্ধ সামলে নিজের অধিকার কায়েম করছে ফরগনায়, ঠিক একই সময়ে নিকোলাস ক্র্যাকো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটাও ডিগ্রি না নিয়ে ক্র্যাকো ছেড়ে চলল তার মামা লুকাসের কাছে। মামা বছর পাঁচেক আগেই ক্র্যাকো ছেড়ে চলে গেছেন ওয়ারমিয়া শহরে আর ততদিনে সেখানকার প্রধান বিশপ হিসাবে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। পরীক্ষা দিলেই নিকোলাসের ডিগ্রি হয়ে যেত আর সেই ডিগ্রির সার্টিফিকেটে তার নাম লেখা হত নিজের বাবার গ্রামের নাম কোপার্নিক অনুযায়ী – নিকোলাস কোপার্নিকাস।