|| আট ||
ছোট জ্যাঠা সুলতান মাহমুদ মির্জা ধরাধাম ত্যাগ করতেই এই অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি হল। এতদিন যে পরমাত্মীয়রা শিশু বাবরের ক্ষুদ্র ফরগনা রাজ্য দখল করে নিতে উদগ্রীব ছিল, এখন তারা হয় পরাভূত অথবা মৃত। বাবরের বয়স যদিও বেশি বাড়েনি এই ক’মাসে, কিন্তু নিরন্তর যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় মেতে থেকে সে হয়ে উঠেছে অনেক পরিণত। তার ওপর দাদিমা এহসান দৌলত বেগমের ক্ষুরধার বুদ্ধি সঞ্চালিত হয়েছে তার মস্তিষ্ককোষেও। তার রক্তে যৌবনের উন্মাদনা, তার বুকে অদম্য সাহস, সে যদি শত্রুপক্ষকে প্রতিহত করতে পারে, তবে তাদের রাজ্যের দখল নিতে পারবে না কেন?
বাবরের বাবা উমর শেখ মির্জার ছোড়দা সুলতান মাহমুদ মির্জা শাসন করছিলেন স্বর্গের মত সুন্দর সমরকন্দ। তৈমুরের রাজধানী ছিল এই সমরকন্দ, এর মত পরমারাধ্য জায়গা এই দুনিয়ায় দুটো নেই। ছোট জ্যাঠার অবর্তমানে কে সেই ভূখণ্ডের মালিক হবে এখনই বোঝা যাচ্ছে না। এমন অবস্থায় বাবরই বা কেন তার ওপর দাবি জানাবে না? ফরগনা যতই ক্ষুদ্র রাজ্য হোক, বাবরের যুদ্ধ-সামর্থ্য কিছু কম তো নয়!
এহসান দৌলত বেগম বাবরের এই ইচ্ছা ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন। বললেন, এখনও তার সময় আসেনি। তুমি বাপু দূর থেকে নজর রাখো ওখানে কী ঘটছে। একটা ভুল পদক্ষেপ মানেই সমরকন্দের আশা ছেড়ে নিজের প্রাণ বাঁচানোই সমস্যা হতে পারে। বাবরের এখন উচিত হবে নিজের ঘর সামলে রাখা, শক্তি বাড়িয়ে চলা, রাজ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা আর সমস্ত আমির-উমরাহকে নিজের অধীনে ন্যস্ত রাখা।
সমরকন্দের পরিস্থিতি বেশ ঘোরালো। আহমদ মির্জার মৃত্যুর পর সুলতান হয়েছিলেন ভাই মাহমুদ মির্জা। তার মৃত্যুর খবর সঙ্গে সঙ্গে জানানো হল না, দীর্ঘ বারোদিন সে খবর গোপন করে রাখলেন তার উজির খুসরৌ শাহ। তার ফন্দি কোনোমতে অন্যান্য আমিরদের বশ করে সমরকন্দের দখল নেওয়ার। সমরকন্দের রাজকোষে প্রচুর অর্থ, তার অধিকার কায়েম করতে পারলে আর কী চাই! কিন্তু সে ফন্দি ব্যর্থ হল। খবর জানাজানি হতেই সমস্ত আমির-উমরাহদের মধ্যে ক্ষমতার অধিকার নিয়ে বেধে গেল তুমুল লড়াই। মাহমুদ মির্জার সন্তান-সৌভাগ্য ঈর্ষণীয়, তেতাল্লিশ বছর বয়সেই তিনি পাঁচ ছেলে ও এগার মেয়ের বাবা। তারা সবাই রাজ্যের দাবিদার, তার সঙ্গে ক্ষমতাশালী আমিররাও। জোরালো দাবি উঠল সমরকন্দকে ভাগ ভাগ করে এদের মধ্যে বিলি করার।
সমরকন্দের লোকজন প্রথমে বিদ্রোহ করল খুসরৌ শাহের ওপর, তারা চায় না খুসরৌয়ের মত লোভী একজন তাদের শাসক হোক। সে বিদ্রোহ অন্যান্য আমিররা দমন করে তারা খুসরৌ শাহকে সমরকন্দ থেকে বিতাড়ন করল। মাহমুদ মির্জার জ্যেষ্ঠ পুত্র মাসুদ মির্জা শাসন করছিল বদকশান, দ্বিতীয় পুত্র বৈশুঙ্ঘর মির্জা বুখারা। আমির-উমরাহরা একত্র হয়ে বুখারাধিপতি এই বৈশুঙ্ঘরকে নির্বাচিত করল সমরকন্দের সুলতান হিসাবে। বৈশুঙ্ঘর বাবরের মেজ জ্যাঠার মেজ ছেলে।
স্বাভাবিকভাবেই বড়ছেলে মাসুদ মির্জা ক্ষেপে গেল। সে শুধু পরলোকগত সুলতান মাহমুদ মির্জার বড়ছেলেই নয়, তার আগের সুলতান তার বড়জ্যাঠার মেজ জামাইও, বিয়ে করেছে নিজের জেঠতুতো বোনকে। তার আমিররা বৈশুঙ্ঘরের সুলতান হওয়া মেনে নেবে কেন? মাসুদকে সুলতান করার জন্যে তারা সাহায্য প্রার্থনা করল পার্শ্ববর্তী রাজ্যের মোঙ্গল-প্রধান মাহমুদ খানের কাছে। এই মাহমুদ খান হচ্ছে বাবরের মামা, উমর শেখের সম্বন্ধী। মাহমুদ খান দেখলেন এই সাহায্যের প্রস্তাবে সাড়া দিলে ভবিষ্যতে সমরকন্দ তার অধীনেই আসতে পারে, কাজেই প্রস্তাবটা মন্দ না। সেনাবাহিনী নিয়ে তিনি এগিয়ে গেলেন সমরকন্দের কাছে কান-বাঈ নামে এক জায়গায়। বৈশুঙ্ঘরও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়, সেও বিপুল সংখ্যক সৈন্য প্রস্তুত করে হাজির হল কান-বাঈতে। দুই পক্ষে বিপুল যুদ্ধ হল বহুদিন ধরে। যুদ্ধে হেরে গেলেন মাহমুদ খান। তার সেনাপতি ও অসংখ্য সৈন্যকে বন্দী করে বৈশুঙ্ঘর তাদের নির্মমভাবে হত্যা করার আদেশ দিল তার সেনাশিবিরের সামনেই। একের পর এক লাশ পড়তে লাগল শত্রুসেনাদের। লাশের পাহাড় জমা হতে শিবির সরিয়ে নেওয়া হল দূরে। সেখানেও চলতে লাগল সেনাহত্যা। তিন তিনবার শিবির সরিয়ে মাহমুদ খানের সেনাদের কোতল করা সম্পূর্ণ করা হল।
মাহমুদ খানের সঙ্গে যুদ্ধের আগে বৈশুঙ্ঘর মির্জা যখন সমরকন্দের সদ্য অধিপতি হয়েছে, তার নজর গেল রাজ্যের এলাকা বাড়িয়ে নেওয়ার। তার সৈন্যরা হানা দিতে লাগল রাজ্যের প্রান্তে অন্যদের এলাকায়। এর ফলে ফরগনার কিছু কিছু অঞ্চল হাতছাড়া হয়ে গেল বাবরের। প্রচণ্ড সতর্কতার সঙ্গে তাকে ফরগনার দুর্গগুলো সুরক্ষিত রাখতে হচ্ছিল।
এতে সুযোগ পেয়ে গেল বাবরের অধীন এক উপজাতি-প্রধানও। তার নাম ইব্রাহিম সারু। সে শুরুতে ছিল উমর শেখ মির্জার অধীনস্থ এক সামান্য সেনাপ্রধান, পরে পদোন্নতি পেয়ে বেগ হয়েছিল। কিন্তু লোভী হয়ে কিছু দুষ্কর্ম করায় উমর শেখ তাকে দল থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। এখন বৈশুঙ্ঘরের সেনা বাবরের রাজ্যে চোরাগোপ্তা হানাদারি চালাতে ইব্রাহিম সারু মওকা পেয়ে আক্রমণ করল অসফর দুর্গ, দখলও করে নিল। বাবরের কপালে সুখভোগ নেই, তাকে আদেশ দিতে হল পাষণ্ডটাকে দূর করে দুর্গের দখল নেওয়ার।
বাবরের সেনা অফসর দুর্গ আক্রমণ করতেই ইব্রাহিম সারু সাহায্যের আবেদন জানাল বৈশুঙ্ঘর মির্জার কাছে। কিন্তু তখন বৈশুঙ্ঘরের উপায় নেই অন্য কাউকে সাহায্য করে, কেননা মাহমুদ খান ততদিনে তার রাজ্য আক্রমণ করে বসেছে। চল্লিশ দিন বাবরের সেনাদের প্রতিহত করে রাখল ইব্রাহিম সারুর সৈন্যরা। শেষে রসদে টান পড়তে অনন্যোপায় হয়ে বিনাশর্তে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পাঠাল বাবরের কাছে। বাবর ততদিনে বিচক্ষণ হয়ে উঠেছে। ইব্রাহিমকে তার অপরাধ মার্জনা করে পুনরায় কাজে বহাল করল বাবর। সেটা ১৪৯৫ সালের মাঝামাঝি।
ভাগ্য সর্বদাই বীরের সহায়ক হয়। ভাগ্যক্রমেই হোক বা কৌশলে বা রণবিক্রমে, একের পর এক সাফল্য বাবরকে করে তুলল উচ্চাকাঙ্খী। বাবা উমর শেখ মির্জা ফরগনার যে সব অঞ্চল শাসন করতেন কিন্তু তার অকালমৃত্যুতে যেগুলো হাতছাড়া হয়ে গেছে, সেগুলো এবার পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করা দরকার। প্রথমেই মনে এল খুজন্দের কথা। খুজন্দ ফরগনার অন্তর্গত ছিল বহুকাল, বড়জ্যাঠা আহমদ মির্জা সেটা দখল করে নিয়েছিলেন। এখন তিনি বেঁচে নেই। যে শাসন করছে, সেই আব্দুল ওয়াহাব বৈশুঙ্ঘর মির্জার আধিপত্য মেনে নিয়েছিল। বৈশুঙ্ঘর কাছেপিঠে নেই, কাজেই খুজন্দ আক্রমণ করলে এখন লাভ আছে, এই ভেবে বাবর এগিয়ে গেল খুজন্দের দিকে।
যতটা প্রতিরোধ আসবে ভেবেছিল, তার কণামাত্র এল না। বাবরকে সেনাবাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখেই আব্দুল ওয়াহাব খুজন্দ দুর্গ তার হাতে তুলে দিল।
এতদিন অন্যে আক্রমণ করেছে বাবরের জমি, বাবর তা প্রতিহত করেছে। এই প্রথম তার আগ্রাসন ফলপ্রসূ হল। দাদিমা সদাসর্বদা হুঁশিয়ারি দেয়, যা করবে, বুঝে করবে। হঠকারিতা করেছ, কি মরেছ! বাবরকে প্রতি পদক্ষেপে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
খুজন্দ দখল করে ফেরার আগে শারুখিয় ঘুরে আসলে কেমন হয়! শারুখিয়তে তার বড় মামা মোঙ্গল-প্রধান মাহমুদ খান ছাউনি ফেলেছেন বলে খবর এসেছে। বাবর সিংহাসনে বসার পর পর এই মাহমুদ খান বাবরের বড়জ্যাঠার সঙ্গে হাত মিলিয়ে তার রাজ্য দখল করতে এসেছিলেন। অখসি দুর্গে ক্রমাগত আক্রমণ চালিয়েও দাঁত ফোটাতে পারেননি বাবরের সেনাদের প্রবল প্রতিরোধে। সে সময় অসুস্থ হয়ে নিজের রাজ্য তাসখন্দে ফিরে গিয়েছিলেন তিনি। এখন যদি বাবর নিজে গিয়ে তাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসে, তবে তাতে বাবরের লাভ বই ক্ষতি নেই। যতই হোক, সম্পর্কে মামা! ভাগ্নে তার সামনে হাজির হলে তিনি কি তার মাথায় আশীর্বাদের হাত রাখবেন না? বলা যায় না, খুশি হয়ে নিজের রাজ্যের কিছু অংশ দানও করে দিতে পারেন। তা না করুন, অন্তত বাবরের ক্ষুদ্র রাজ্যের দিকে নজর দেবেন না, এটুকু প্রত্যাশা করাই যায়।
মনে মনে অনেক গণনা করে মাহমুদ খানের শিবিরে এসে হাজির হল বাবর। এক সুরম্য বাগিচার মধ্যে সেই শিবির। সেখানে প্রবেশ করে মাহমুদ খানের সামনে নীচু হয়ে তিনবার কুর্নিশ করতেই মাহমুদ খান আসন ছেড়ে উঠে এসে বাবরকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আদব-কায়দা অনুযায়ী বাবর পিছিয়ে গিয়ে আবার একবার আদাব জানালে তাকে কাছে ডেকে পাশে বসিয়ে নিলেন মাহমুদ খান। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে স্নেহ প্রকাশ করলেন। খাস খানসামাকে ডেকে বাবরের জন্যে বিশেষ খানাপিনার ব্যবস্থা করতে বললেন।
দুদিন বাবর থেকে গেল সেই শিবিরেই। তারপর ফিরে গেল নিজের রাজ্যে, অখসি হয়ে আন্দিজানে। যে বিশাল প্রত্যাশা নিয়ে এসেছিল মাতুলশিবিরে, সে রকম বিশেষ কিছু পেল না যদিও, অন্তত মামা যে এখন তার শত্রুতা করবেন না, সেটুকু নিশ্চিন্ত হওয়া তো গেল!
বড়মামার সঙ্গে দেখা করার পর বাবার গেল অখসিতে। সেখানে বাবা উমর শেখ মির্জার স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন বাবর, তারপর যাত্রা শুরু করল রাজধানী আন্দিজানের দিকে।
রাস্তায় যেতে যেতে হঠাৎ খেয়াল হলো এখানকার উপজাতিদের কাছ থেকে কোনদিনই কর আদায় করা হয়নি। কাশগড়ের আগে এই পাহাড়ি এলাকায় প্রায় পাঁচ হাজার পরিবার বাস করছে, তাদের আছে প্রচুর ঘোড়া, ভেড়া আর পাহাড়ি ষাঁড়। এই ষাঁড়দের বলা হয় কুটা। পাহাড়ি এলাকায় বাস করে বলে এখানকার শাসক তাদের কাছে কর নিতে আসে না, তারাও উপযাচক হয়ে কর দিতে যায় না। বাবর তার সৈন্যদের নির্দেশ দিল এই উপজাতিদের কাছ থেকে কর আদায় করে আনতে। কাশিম বেগ নামে এক আমির গেল ওদের কাছ থেকে কর আদায় করে আনতে। যাই পাওয়া যাক, সেগুলো অন্তত সৈন্যদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া যাবে। কাশিম বেগ ফিরে এলো কুড়ি হাজার ভেড়া আর হাজার দেড়েক ঘোড়া নিয়ে। সেগুলো ভাগ করে দেওয়া হলো সৈন্যদের মধ্যে।
অল্প দিনের মধ্যেই ইব্রাহিম সারুর বিদ্রোহ দমন, খুজন্দ শহর পুনর্দখল এবং উপজাতিদের কাছ থেকে কর আদায়-–এই তিন ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য লাভ করল বাবর। এবার তার লক্ষ্য হলো আউরাটিপা দুর্গ।
আউরাটিপা দীর্ঘকাল দখলে ছিল উমর শেখ মির্জার। যে বছর তার মৃত্যু হয় সেই বছরই সুলতান আহমদ মির্জা দখল করে নেন আউরাটিপা। এখন সেই অঞ্চলে রাজত্ব করছে বৈশুঙ্ঘর মির্জার ভাই আলি মির্জা। বাবর আক্রমণ করতে আসছে জেনেই আলি মির্জা পালিয়ে গেল দুর্গম পার্বত্য এলাকায়। দুর্গ রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে গেল তার গৃহশিক্ষকের উপর। বাবর দূত পাঠালো সেই গৃহশিক্ষকের কাছে। কিন্তু সে দূতের সঙ্গে ভালো ব্যবহার না করে তাকে বন্দি করে আদেশ দিল প্রাণদণ্ডের। দূতের ভাগ্য ভালো, সে কোন রকমে পালিয়ে বাঁচল। কিন্তু সোজা বাবরের কাছে চলে আসার অবস্থায় ছিল না সে। বাবরের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হলো প্রায় মাস দুই-তিন পরে, তখন তার অবস্থা কহতব্য নয়। বাবর তাকে দেখেই রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে সৈন্য নিয়ে ঢুকে পড়ল আউরাটিপায়। উদ্দেশ্য — লুটপাট করে নিয়ে যাওয়া কিছু মূল্যবান বস্তু। ভাগ্য খারাপ, শীতকাল এসে গেছে। জমির ফসল ও পশুদের খাদ্য ঘরে তুলে নিয়েছে অধিবাসীরা। ফলে লুটপাট করার মত কিছু নেই। বাবর তাই বেশি অপেক্ষা না করে ফিরে গেল আন্দিজানে।
বাবর আউরাটিপা ছেড়ে বেরিয়ে আসতেই মাহমুদ খানের সেনারা আক্রমণ করে দখল করে নিল সেই শহর। পরবর্তী সাত আট বছর তারাই শাসন করতে লাগল আউরাটিপা।
বাবর অবশ্য হাল ছেড়ে দিল না। মানুষের সমস্ত ইচ্ছাই ফলপ্রসূ হয় না। দাদিমা বলে দিয়েছে, সব কিছুর জন্যে যোগ্যতা অর্জন করতে হয়, উপযুক্ত সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। বাবরের উচিত হবে নিজের শক্তি বাড়িয়ে নেওয়া, দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ গোলযোগ প্রতিহত করা। নইলে তার আশা আশাই থেকে যাবে।
ওদিকে বৈশুঙ্ঘর মির্জা মাহমুদ খানকে বিধ্বস্ত করে জয়লাভ করলেও খুব স্বস্তিতে নেই। খুরাসানের সুলতান হুসেন মির্জা — সে আবার তৈমুরলঙ্গের বড় ছেলের বংশধর — নজর ফেলেছে বৈশুঙ্ঘর-শাসিত অঞ্চলের দিকে। যেই শুনেছে মাহমুদ খানের সঙ্গে তার বড়সড় যুদ্ধ হয়েছে, আর যুদ্ধে জিতলেও ক্ষয়ক্ষতি তো হয়ই, অমনি সুযোগ বুঝে বিরাট সেনাদল নিয়ে এগিয়ে গেল সে সমরকন্দের দিকে। পথে পড়ল বদকশানের রাজধানী হিসার। হিসারের শাসক তখন বৈশুঙ্ঘরের দাদা মাসুদ মির্জা। সে শহর ফেলে পালাল ভাইয়ের রাজ্যে। সুলতান নেই, ফলে সমগ্র বদকশান জুড়ে শুরু হল প্রবল অরাজকতা। বৈশুঙ্ঘর হুসেন মির্জার অগ্রগতি রুখতে তার কয়েকজন প্রকৃষ্ট যোদ্ধাকে পাঠালেন হিসারে।
হুসেন মির্জা হিসার আক্রমণ করে বিশেষ সুবিধা করতে পারলেন না। বহুদিন ধরে যুদ্ধ হল, কিন্তু স্থানীয় বাহিনী প্রতিরোধ করে রইল তাদের। অগত্যা মুখরক্ষার্থে শান্তিচুক্তি। বিবাহের প্রস্তাব গেল হুসেন মির্জার পক্ষ থেকে, তার ছেলে হায়দর মির্জার সঙ্গে বৈশুঙ্ঘরের বোন বেগা বেগমের। বিয়ে হয়ে যেতে হুসেন ফিরে গেলেন নিজের রাজ্য খুরাসানের হিরাটে।
তাতে অবশ্য সমরকন্দের সমস্যা মিটলো না। রমজান মাসে বিদ্রোহ করে বসলো সেখানকার আমিররা। বৈশুঙ্ঘর নাকি হিসারের অধিবাসীদের বেশি সুবিধা দিচ্ছে। তারা সবাই মিলে বৈশুঙ্ঘরকে হটিয়ে তার ছোটভাই আলি মির্জাকে সমরকন্দের সিংহাসনে বসানোর সিদ্ধান্ত নিল। আলি মির্জাকে সমরকন্দে নিয়ে আসা হল। বৈশুঙ্ঘর ঘেরাও হল, তাকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হল দুর্গে। গুকসরাই নামে এক জায়গায় আলি ও বৈশুঙ্ঘরকে নিয়ে যাওয়া হল। এই গুকসরাই ছিল একযোগে তৈমুরের বংশধর রাজকুমারদের হত্যামঞ্চ ও অভিষেক স্থল।
গুকসরাইতে বৈশুঙ্ঘরকে হত্যা করার আগেই সে কৌশলে সেখান থেকে পালিয়ে গেল আশ্রয় নিল খাজাকি খাজা নামে একজন শক্তিশালী বেগের বাড়িতে। জানতে পেরে বিদ্রোহীরাও হাজির হলো খাজাকি খাজার বাসভবনে। তাদের হাতে বৈশুঙ্ঘরকে তুলে দেওয়ার দাবি জানাতে লাগল। খাজাকি খাজাও একজন কেউকেটা বেগ, তিনি বৈশুঙ্ঘর মির্জাকে তাদের হাতে তুলে দিতে অস্বীকার করলেন।
এদিকে এই বিদ্রোহীদের ওপর খুশি ছিল না সমরকন্দের শহরবাসী। তারা পাল্টা বিদ্রোহ শুরু করল। খাজাকি খাজার বাড়ি থেকে বৈশুঙ্ঘর মির্জাকে সসম্মানে নিয়ে গেল তারা সমরকন্দে। দুর্গের মধ্যে থাকা আলি মির্জা আর তার সমর্থক বিদ্রোহীদের আক্রমণ করলে বিদ্রোহীরা যে যেদিকে পারল পালিয়ে গেল। আলি মির্জা এই বিদ্রোহীদের হাতে বন্দি হলেন। তাকে নিয়ে যাওয়া হলো গুকসরাইয়ে।
হঠাৎ করে উল্টে গেল পাশা। গুকসরাইতে নিয়ে গিয়ে আলি মির্জাকে অন্ধ করে দেওয়ার আদেশ দেওয়া হল। গনগনে আগুনে লোহার শলাকা গরমে লাল করে সেটা চোখের সামনে দিয়ে টেনে নিয়ে গেলে দু চোখ শুকিয়ে অন্ধ হয়ে যেত। যার ওপরে এই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সে কোনো এক কারণে আলি মির্জার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে একটু দূর দিয়ে শলাকাটা টেনে নিয়ে গেল। ফলে আলি মির্জা অন্ধ হল না। সুযোগ পেয়ে পালিয়ে গিয়ে বুখারায় যোগ দিলো তার সমর্থকদের সঙ্গে।
সমরকন্দে শুরু হয়ে গেল অভ্যন্তরীণ জনযুদ্ধ। বৈশুঙ্ঘর মির্জা জানতে পারল আলি মির্জা পালিয়ে বুখারার দিকে গেছে। সে বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে সেদিকে ধাওয়া করল। আলি মির্জা ততদিনে বেশ কিছু সেনা জোগাড় করে ফেলেছে, সেও প্রস্তুত হলো যুদ্ধের জন্য। এই যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয় ঘটল বৈশুঙ্ঘর মির্জার। বাধ্য হয়ে পিছু হটে সে ফিরে গেল রাজধানী সমরকন্দে।
দূর থেকে এই সমস্ত যুদ্ধের দিকে নজর রাখছিল বাবর। তার স্বপ্নে সমরকন্দের সিংহাসন। যেই সে খবর পেল সমরকন্দে শুরু হয়েছে অভ্যন্তরীণ জনযুদ্ধ এবং সুলতান বৈশুঙ্ঘর মির্জার পরাজয় হয়েছে আলি মির্জার কাছে, বাবর উৎসাহে উদগ্রীব হয়ে উঠল। ভাবল এ এক মস্ত সুযোগ সমরকন্দ আক্রমণ করে দখল করার।
বাবরের বয়স তখনো চোদ্দ পূর্ণ হয়নি। যোগ্যতায়, অভিজ্ঞতায়, শক্তিতে সে আলি মির্জা বা বৈশুঙ্ঘর কারও সমকক্ষ নয়,যদিও তখনও পর্যন্ত বেশ কিছু যুদ্ধে তাঁর সাফল্য কম না। সে সাহসী হয়ে বেরিয়ে পড়ল সমরকন্দ অভিযানে, ১৪৯৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে।
সুযোগ বুঝে বৈশুঙ্ঘর মির্জার বড় ভাই মাসুদ মির্জাও সমরকন্দের সিংহাসনের উপর তার নিজের দাবি প্রতিষ্ঠা করতে সসৈন্যে এগিয়ে এল সমরকন্দের দিকে। এছাড়া আলি মির্জাও ধাওয়া করে এল বৈশুঙ্ঘরের পেছন পেছন।
বৈশুঙ্ঘরের সমরকন্দ তিন দিক থেকে তিনজনের সেনাবাহিনী ঘিরে ফেলল। এই অবস্থা বজায় থাকল তিন থেকে চার মাস। বৈশুঙ্ঘর প্রবল পরাক্রমে নিজের দুর্গ অক্ষত করে রাখল। সেই অবসরে আলি মির্জা কয়েকজন অমাত্য নিয়ে জোট বাঁধার প্রস্তাবে বাবরের কাছে প্রস্তাব পাঠাল। ঠিক হল বাবর এবং আলি মির্জা এক সঙ্গে এক নির্দিষ্ট স্থানে বৈঠক করবে। তিন-চার জন সেনা নিয়ে সেইমত সমরকন্দ থেকে কিছু দূরে এক গোপন স্থানে তাদের মোলাকাত হল। খুব বেশি কিছু আলাপ আলোচনা হল না যদিও, ব্যক্তিগত সৌজন্য বিনিময় করে খানিকক্ষণ কথা বলে তারা তাদের নির্দিষ্ট সেনাদের দিকে ফিরে গেল।
কিছুদিন পরেই শীত নেমে এল সমরকন্দে। শীতে এই উপত্যকায় ভয়ঙ্কর খাদ্যাভাব। তাই সময় নষ্ট না করে বাবর ফিরে গেল আন্দিজানে। আলি মির্জা ফিরে গেল বুখারায়। মাসুদ মির্জা তার অধীন এক শেখের কন্যার প্রেমে পড়ে নিজের যাবতীয় পরিকল্পনা বাতিল করে ফিরে গেল হিসারে।
মাসুদ মির্জা জানল না, আলি মির্জার সঙ্গে বাবরের গোপন বৈঠকে স্থির হয়েছিল গ্রীষ্ম ঋতু এলে আলি বুখারা থেকে আর বাবর আন্দিজান থেকে একযোগে সমরকন্দ আক্রমণ করবে।
৬৩২ সালের ৮ই জুন মদিনায় হজরত মহম্মদের মৃত্যুর পর তাঁর পরিবার ও অনুগামীদের মধ্যে বিরোধ শুরু হল। মহম্মদের মত ব্যক্তিত্ব ও কৌশল আয়ত্ত্বে না থাকায় সন্ততিদের মধ্যে সর্বজনগ্রাহ্য উত্তরসূরী পাওয়া মুশকিল হল। সে বিরোধ বাড়তে বাড়তে প্রবল আকার ধারণ করলে পরবর্তীতে এক বিরাট যুদ্ধ কিছুতেই ঠেকানো গেল না।
যুদ্ধটা হল কারবালার প্রান্তরে। ইয়াজিদ খলিফা আদেশ দিয়েছিলেন মহম্মদের পৌত্র ইমাম হুসেন যেন তার বশ্যতা স্বীকার করেন। হুসেন জানেন ইয়াজিদ মূর্তিমান শয়তান, তার বশ্যতা স্বীকারের প্রশ্নই আসে না। কিন্তু হুসেনের অনুচর খুবই কম, তাদের নিয়ে ইয়াজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া মানেই আত্মহত্যা।
কিন্তু ইমানের কাছে জান কবুল। হুসেন তাঁর পক্ষে সমর্থন সংগ্রহ করতে চিঠি পাঠালেন পুবদেশের বিভিন্ন রাজ্যে। ছোট ছোট বেশ কিছু অঞ্চলের উপজাতি শাসকেরা তার সমর্থনে এগিয়ে এল। উড়তে উড়তে এক চিঠি হাজির হল হিন্দুস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে সারস্বত ব্রাহ্মণ মহিয়ালদের এলাকাতেও। সে এলাকার শাসক রাহাব সিং দৎ। মহিয়ালরা বস্ত্র-ব্যবসায়ী, আরবদের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য বহুদিনের।
রাহাব সিং জানেন এই যুদ্ধে যোগ দিয়ে জেতার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। তবুও তিনি সাত পুত্র নিয়ে ন্যায়ের স্বার্থে হাজির হলেন মিত্র মহম্মদের পৌত্র ইমাম হুসেনের সমর্থনে। ৬৮০ সালের অক্টোবরের শীতের সেই কারবালার যুদ্ধে হুসেন নির্বংশ হলেন। রাহাব সিং দতের সাত পুত্রই মারা গেল সে যুদ্ধে। রাহাব সিং বেঁচে গেলেন, যুদ্ধের পর দেখা করতে গেলেন হুসেনের রোরুদ্যমানা ভগিনী জয়নাবের শিবিরে। নিজের পরিচয় দিয়ে ব্যক্ত করলেন তাঁর এই যুদ্ধে যোগদান ও পুত্রহীন হওয়ার কাহিনি। জয়নাবের ইচ্ছানুসারেই মহিয়াল ব্রাহ্মণরা পরিচিত হল হুসেনি ব্রাহ্মণ হিসাবে। পরবর্তীতে এই হুসেনি ব্রাহ্মণদের মধ্যে ভরদ্বাজগোত্রীয়রা দৎ ও বৈদ্, ভার্গবগোত্রীয়রা ছিব্বার, পরাশরগোত্রীয়রা বালি, কাশ্যপগোত্রীয়রা মোহন, বশিষ্ঠগোত্রীয়রা লাউ, কোশলগোত্রীয়রা ভীমওয়াল ইত্যাদি বিভিন্ন পদবি নিয়ে হুসেনি ব্রাহ্মণরা প্রতি বছর মহরমে মুসলমানদের মতই শোকপালন করে, হিন্দু-সংস্কৃতির সমস্ত আনন্দ-অনুষ্ঠান থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখে, এ মাসে তাদের বিয়ে-শাদিও নিষিদ্ধ। বক্সী, জিঙ্গরন ইত্যাদি পদবীও ওদের মধ্যে বর্তমান।
ভারতে সে সময় রাজত্ব করছেন সম্রাট হর্ষবর্ধন। চিনদেশ থেকে ভারতে পরিব্রাজক হিসাবে এসেছেন হিউয়েন সাং।
আরবের মুসলমানরা এর পর রাজ্য ও ধর্মবিস্তারে ভূমধ্যসাগরের পাড় থেকে মধ্যপ্রাচ্যে মনোনিবেশ করল। মহম্মদের মৃত্যুর একশো বছরের মধ্যেই তারা পৌঁছে গেল ভূমধ্যসাগরের পশ্চিমে, সুদূর আটলান্টিকের পাড়ে। পুবদিকে রাজত্ব বিস্তার করতে করতে তারা চলে এল সিন্ধুনদের পাড়ে। রাজা দাহির পরাস্ত হলেন তাদের হাতে। তাতে যদিও ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় ভূখণ্ডে বিশেষ প্রভাব পড়ল না। রাষ্ট্রকূট আর গুর্জর-প্রতিহাররা আরব মুসলমানদের অগ্রগতি রোধ করে রাখল। রাজপুত রাজারা শুধু তাদের ঠেকিয়েই রাখল না, মাঝে মাঝে নিজেরাও পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে আফগানিস্তানে তাদের শাসন কায়েম করেছিল। খ্রিস্টিয় দশম শতাব্দ অবধি আফগানিস্তানে হিন্দু রাজার শাসন ছিল।
তবে আরব ব্যবসায়ীরা বহুকাল ধরে — মহম্মদের জন্মের অনেক আগে থেকেই — ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে আসছিল। ভারতের পশ্চিম উপকূলের বন্দরগুলোতে লেগেই থাকত বাইজ্যান্টাইন, পারস্য, ইয়েমেনি, ওমানি এমনকি ইথিওপিয়ান নাবিকদের পণ্যজাহাজ। মক্কা থেকেও ব্যবসায়ীরা এসেছে ভারতে ব্যবসা করতে, তাদের অন্তত কয়েকজনকে মহম্মদ নিজে চিনতেন। ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে কেরালার উপকূলে চেরামন জুমা মসজিদ স্থাপিত হয়, যা ভারতের সর্বাপেক্ষা এবং পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রাচীনতম মসজিদ। স্থানীয় মন্দিরের কাঠামোর ওপরেই স্থাপিত হয়েছিল সেই মসজিদ।
মুসলমান সাম্রাজ্যের রাজধানী তখন বাগদাদ। সেখান থেকে আরব বণিকদের দল বাণিজ্য চালাত বিস্তৃত ভূখণ্ডে। ভূমধ্যসাগরের উপকূলে তাদের বণিকদের উপস্থিতি নজর কাড়ার মত। উটে চেপে আরব বেদুইনরা সাহারা মরু পেরিয়ে চলে যেত আফ্রিকায়। বাণিজ্য করত চিনের রেশম, ভারতের মশলা, তুলে আনত আফ্রিকার ক্রীতদাস। আরবরা সিন্ধ জয় করার পর সেখানেও বেচাকেনা হতে লাগল ক্রীতদাস।
রাজধানীর কাছাকাছি হওয়ায় ওদের মূল বন্দর ছিল বসরা। সেখানে ভারতীয় জিনিসের এত রমরমা যে বসরাকে আল-হিন্দ বলত তারা। আতর, গোলমরিচ, আদা, সুতিবস্ত্র, জরিবুটির ব্যাপক লেনদেন হত বসরায়। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভারতীয় পণ্য ছিল ইস্পাতের তরবারি। ধাতুবিদ্যায় ভারত উন্নতি করেছে বহু আগে। মরিচাহীন ইস্পাত দিয়ে বানিয়েছে দিল্লির স্তম্ভ। আরব সেনারা যে তরবারি ব্যবহার করত, তার অধিকাংশ তৈরি হত ভারতে। জেরুজালেমে খ্রিস্টানদের ক্রুসেডের একাধিক যুদ্ধে যে দামাস্কাস অসির ঝলকানি যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা যেত, তার অধিকাংশই হয় ভারতে নির্মিত, নয় ভারতীয় প্রযুক্তিতে বানানো।
শুধু যে আরব বণিকরা ভারতে ব্যবসা করতে আসত, তা নয়, ভারতীয় বণিকরাও একইভাবে বাণিজ্য করতে যেত আরব সাগর পেরিয়ে পারস্য উপসাগরের বিভিন্ন বন্দরে। সিরাফে আরব ব্যবসায়ীদের বার্ষিক অনুষ্ঠানে শতাধিক ভারতীয় হিন্দু ব্যবসায়ীদের নিমন্ত্রণ থাকত। ভারতের হিন্দু রাজারা আরবের মুসলমান ব্যবসায়ীদের মসজিদ ও বাসস্থান বানানোর অনুমতি দিয়ে ছেড়ে দিয়েছিলেন অনেকটা করে জায়গা। ওমান, বসরা, সিরাফ, বাগদাদ থেকে দশ হাজারের বেশি মানুষ দেশ ছেড়ে এসে পাকাপাকি বাসা বেঁধেছিল ভারতীয় উপকূলের এক সেমুর জেলাতেই। আরও দক্ষিণে, কেরালায়, তারা সেখানকার হিন্দু ও ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানদের সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করেছিল।
পারস্যে অন্তত দেড় হাজার বছর ধরে জরথ্রুস্টের উপাসকরা বসবাস করত। আরব মুসলমানদের অনুপ্রবেশ ও গণহারে ভিন্নধর্মীদের ওপর অত্যাচার ও ধর্মান্তকরণে তাদের সংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। অষ্টম শতকে তাদের এক ক্ষুদ্র অংশ ভারতের পশ্চিমে গুজরাটে এসে উপস্থিত হলে গুজরাটের তৎকালীন হিন্দু রাজা তাদের আশ্রয় দিলেন এই শর্তে যে তাদের অস্ত্র পরিত্যাগ করতে হবে ও গুজরাটি ভাষা শিখতে হবে। এ ছাড়া তাদের অন্যান্য যাবতীয় ধর্মাচরণে হস্তক্ষেপ করা হল না। গুজরাটি শিখে তারা ভারতীয় জনজীবনে মিশে গেল পার্সি নামে।
নতুন সহস্রাব্দের শুরুতে ভারতীয় উপমহাদেশে জনজীবন খুব একটা বদলায়নি। দক্ষিণের বন্দরগুলোতে বিদেশি নাবিকরা এসে তাদের জাহাজ নোঙ্গর করেছে। বিদেশি পণ্ডিত ও ছাত্ররা এসে ভিড় করেছে নালন্দা মহাবিহারে। স্থাপত্য, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান চর্চা হয়েছে, কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবন প্রায় এক হাজার বছর ধরে একই রকম চলে যাচ্ছিল। কিছু সময় অতিক্রান্ত হতেই অবশ্য তাতে এক বড় ধরনের রদবদল দেখা দিল।
দশম শতাব্দীর শেষ দিকে তুর্কি হানাদাররা আফগানিস্থানে হিন্দু-বৌদ্ধ রাজাদের ওপর আক্রমণ চালাল। ৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে তারা দখল করে নিল গজনি। সেখান থেকে তারা অহরহ আক্রমণ শাণাতে শুরু করল পুবদিকে। কাবুলের হিন্দু শাহি রাজা বাধ্য হয়ে পালিয়ে এলেন পাঞ্জাবে। শাহিরাজ বহু দশক ধরে যুদ্ধ করে তুর্কিদের প্রতিহত করে রেখেছিলেন। কিন্তু ১০০১ সালের ২৭শে নভেম্বর গজনীর মামুদ পেশোয়ারের কাছে এক যুদ্ধে তাকে পরাস্ত করলে বিধ্বস্ত শাহিরাজ জয়পাল তার ছেলের হাতে রাজ্য সমর্পণ করে আত্মহত্যা করলেন নিজের প্রজ্বলিত চিতায় আত্মাহুতি দিয়ে।
পরবর্তী পঁচিশ বছরে মামুদ ভারতে আক্রমণ চালায় সতেরো বার, এর অধিকাংশই ধনী মন্দির শহর মথুরা নগরকোট ইত্যাদিতে। মামুদের সবচেয়ে কুখ্যাত আক্রমণ ছিল গুজরাটের সোমনাথ মন্দিরে, ১০২৬ সালে। এই একটা আক্রমণেই অন্তত পঞ্চাশ হাজার লোককে হত্যা করেছিল তার সেনারা। অন্তত দু’কোটি দিরহ্যাম অর্থমূল্যের সোনা-রুপো ও ধনরত্ন নিয়ে ফিরে গিয়েছিল মামুদ। যদিও এর পরবর্তীতে সোমনাথ মন্দির আরো অনেকবার বিধ্বস্ত ও পুনর্নির্মিত হয়েছে, এই আঘাতই সবচেয়ে বেশি স্মরণযোগ্য হয়ে রইল।
যদিও বিধর্মীদের হত্যা ও ধনরত্ন লুণ্ঠন তুর্কিদের আক্রমণের প্রধান কারণ ছিল, একথা অনস্বীকার্য যে তাদের আরেক উদ্দেশ্য ছিল যে-কোনোভাবে ক্রীতদাস সংগ্রহ করা। এর পরবর্তীকালে কয়েক শতাব্দ ধরে লক্ষ লক্ষ ভারতীয় ক্রীতদাস তুর্কিরা সংগ্রহ করে পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে চালান করেছে আফগানিস্থানে ও বিক্রি করেছে মধ্য-এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের বাজারগুলোতে। পাহাড়ি আফগান রাস্তায় কনকনে প্রবল শীতে অনভ্যস্ত ভারতীয় ক্রীতদাসরা পথ চলতে চলতেই মারা যেত হাজারে হাজারে, তাদের ফেলে দেওয়া হত রাস্তার পাশের খাদে। হিন্দিতে আত্মহত্যাকে যেমন বলা হয় খুদকুশী, তেমনি গণহারে এইভাবে হিন্দুস্তানের মানুষদের হত্যা করার জন্য ওই অঞ্চল এবং পাহাড়ের নাম হয়ে গেল হিন্দুকুশ।
গজনীর মামুদের অহরহ আক্রমণ সত্ত্বেও মৌর্য বা গুপ্ত যুগে যেমন তা প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছিল, এ সময় তেমনভাবে হয়নি। উত্তর ভারতে সবচেয়ে বড় হিন্দু রাজ্য সেসময় গুর্জর-প্রতিহাররা। কিন্তু তারাও তখন তাদের শক্তির একেবারে তলানির দিকে। সে সময় সমগ্র ভারতবর্ষে সবচেয়ে বড় রাজত্ব ছিল চোল সাম্রাজ্য, কিন্তু তাদের রাজত্ব ছিল সুদূর দাক্ষিণাত্যে। তারা এই সুবৃহৎ দেশের উত্তর-পশ্চিমে তুর্কি আক্রমণ সম্বন্ধে অবগত ছিলনা। উত্তর ভারত বৃহৎ কোনো শক্তির দ্বারা পরিচালিত না হওয়ার দরুন এই অঞ্চলে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভূত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এই হচ্ছে সেই সময় যখন মধ্য ভারতে রাজত্ব করছেন একাধারে যোদ্ধা ও পণ্ডিত রাজা ভোজ এবং বুন্দেলখণ্ডে চান্দেলারা, যারা খাজুরাহোর বিখ্যাত মিথুন মন্দির সৃষ্টি করেছিল।
ভোজ রাজা ছিলেন এক বিচিত্র মানুষ। তাঁর পাণ্ডিত্য ও রঙিন স্বভাবের জন্য তাঁর নামে ভবিষ্যতে বিভিন্ন ধরনের গল্প ছড়িয়ে পড়বে। অন্যান্য কীর্তির সঙ্গে তিনি সোমনাথ মন্দিরও পুনর্নির্মাণ করেছিলেন এবং তুর্কি দস্যুদেরও প্রতিহত করেছিলেন। মধ্য ভারতের মান্ডুতে তাঁর নির্মিত দুর্গ পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ দুর্গ। শুধু তাই নয়, ভূপালে তিনি তৈরি করেছিলেন এক বিশাল সরোবর। মাটির বাঁধ দিয়ে বানানো এই সরোবর এর বিশেষ প্রযুক্তির জন্য হাজার বছর পরেও সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।
বুন্দেলখণ্ডে চান্দেলারা গুর্জর-প্রতিহারদেরই এক অংশ কিন্তু তারা নিজেদের রাজত্ব বিস্তার করেছিল মধ্য ভারতের এই অঞ্চলে এবং দশম শতাব্দীতে তাদের শক্তিও নীচের দিকে। খাজুরাহো মন্দির চত্বরের একেবারে মধ্যে মহাদেবের সবচেয়ে বড় যে মন্দিরটা, সেটা চান্দেলারা তৈরি করেছিল গজনির মামুদকে একবার প্রতিরোধ করার স্বাক্ষর হিসাবে।
গজনীর মামুদের আক্রমণ ও লুণ্ঠনের পরবর্তী শ’ দেড়েক বছর তুর্কিরা ভারতের মূল ভূখণ্ডে আর সে-রকম আক্রমণ চালায়নি। তারা সম্ভবত খুশি ছিল প্রধানত পশ্চিম পাঞ্জাবে আক্রমণ চালিয়ে তাদের রসদ সংগ্রহ করেই। তারা তো আর ভারতে রাজত্ব করতে আসেনি! এই চিত্র সম্পূর্ণ বদলে গেল ১১৯২ সালে যখন মহম্মদ ঘোরি রাজপুতরাজ পৃথ্বীরাজ চৌহানকে পরাস্ত করলেন দ্বিতীয় তরাইনের যুদ্ধে। পৃথ্বীরাজ শাসন করছিলেন দিল্লি ও আজমিরের এক বড়সড় এলাকা। তুর্কিরা দিল্লি দখল করল এবং একে একে আক্রমণ করে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে রাজত্ব বিস্তার করতে লাগল। ১১৯৪ সালে বারাণসী ও কনৌজ তাদের আয়ত্তে চলে এল। সেসময় উত্তর ভারতে সবচেয়ে বড় ও প্রভাবশালী শহর(??) ছিল কনৌজ। তুর্কি আক্রমণের প্রভাব তার ওপর এতই পড়ল যে সে আর তার হৃতগৌরব কখনই পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। কয়েক বছরের মধ্যেই তুর্কি সেনা বক্তিয়ার খিলজি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করল। নালন্দার বিশাল গ্রন্থাগার আগুনে ভস্মীভূত করে দেওয়া হলো। সেখানকার সমস্ত বৌদ্ধভিক্ষুদের মুণ্ডচ্ছেদ করা হল। নালন্দার সংস্কৃত পুঁথি পড়ার জন্য শাসকদের কেউ কেউ সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতের খোঁজ করছিলেন কিন্তু তখন সে অঞ্চলে সে রকম পণ্ডিত আর অবশিষ্ট নেই। অধিকাংশই নিহত, কেউ কেউ পালিয়ে চলে গেছেন পার্শ্ববর্তী রাজ্য তিব্বতে। নালন্দার পর পরই বক্তিয়ার খিলজি ধ্বংস করল বিক্রমশীলা ও তার পার্শ্ববর্তী অন্যান্য মহাবিহারগুলো। ভারতে এরই সঙ্গে বৌদ্ধ মহাবিহার সংস্কৃতির পরিসমাপ্তি ঘটল। কয়েক দশক পরে ১২৩৫ সালে দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিশ দখল করে ধ্বংস করল উজ্জয়িনী। উজ্জয়িনী ছিল গুপ্ত সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর এবং গণিত, সাহিত্য, জ্যোতির্বিদ্যা ও দর্শনের জন্য বিশ্বখ্যাত। ভারতে যখন একে একে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এইভাবে মুসলমান শাসকদের হাতে ধ্বংস হচ্ছে, সেই একই সময়ে পৃথিবীর পশ্চিম প্রান্তে ইংল্যান্ডে উঠে আসছে অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
এতসব আক্রমণের মধ্যেও দাক্ষিণাত্যের শহরগুলি মোটামুটি অবিকৃত ছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকে সেনাপতি মালিক কাফুর আক্রমণ চালাল দাক্ষিণাত্যে। ভারতের ইতিহাসে সে এক অসম্ভব রক্তক্ষয়ী সময়। প্রাচীন শহর, বিশ্ববিদ্যালয়, মন্দিরগুলো ধ্বংস হতে লাগলো হাজারে হাজারে। লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারাল এই অত্যাচারে। শেষ হল লৌহযুগের সময় নির্মিত গাঙ্গেয় ভারতের প্রাচীন শহরের ইতিহাস। টিঁকে রইল বিজয়নগরের মত মাত্রই কয়েকটা শহর।
ভারতবর্ষে শহর নির্মাণ শুরু হল এবার সম্পূর্ণ অন্যরকমভাবে, যেভাবে তৈরি হয়েছে পারস্য ও মধ্য এশিয়ায় মুসলমান শাসকদের নির্মিত শহরগুলো। ভারতে নবনির্মিত এই শহরগুলোর মধ্যে এই সময়ে সবচেয়ে সমৃদ্ধ হয়ে উঠল দিল্লি।
দিল্লি অতি প্রাচীন শহর। মহাভারতের ইন্দ্রপ্রস্থ যমুনা নদীর তীরে পাণ্ডবদের রাজধানী ছিল। সে ইন্দ্রপ্রস্থ সম্ভবত দিল্লির পুরানা কিলা অঞ্চলে। ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল পুরানা কিলা, এর কাছাকাছি ইন্দ্রপথ নামে এক গ্রাম এখনও আছে। অবশ্য এ শুধু অনুমান, নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। কালকাজি মন্দিরের কাছে অশোকের শিলালিপি প্রমাণ করে দিল্লি কত পুরনো শহর।
অষ্টম শতাব্দীতে তোমর রাজপুতরা দিল্লিকে তাদের রাজধানী বানিয়েছিল। দক্ষিণ দিল্লির সুরজ কুণ্ডে বহু প্রাচীন জনপদের অস্তিত্ব আছে। জলের প্রচণ্ড সমস্যার জন্য তোমররাজ অনঙ্গপাল এখানে বানিয়ে দিয়েছিলেন একটা বাঁধ। সুরজকুণ্ড নাম থেকে প্রতীয়মান হয় যে এখানে কাছাকাছি কোথাও সূর্যের মন্দির ছিল, যাতে জল সরবরাহ হত ঐ কুণ্ড থেকে। একাদশ শতাব্দীতে তোমররা পশ্চিম দিকে সরে যায় এবং যথাসম্ভব দুর্ভেদ্য অঞ্চল খুঁজে একটা বড় দুর্গ বানিয়ে তার নাম দেয় লাল কোট অর্থাৎ লাল দুর্গ। এই লাল কোট সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মিত লাল কেল্লা নয়। এর শ’ খানেক বছর পর চৌহানরা দিল্লির শাসক হয়। রাই পিথোরা অঞ্চল ছিল পৃথ্বীরাজ চৌহানের রাজধানী। মহম্মদ ঘোরির নেতৃত্বে তুর্কিরা রাই পিথোরা দখল করলে সেটা ভারতবর্ষে তুর্কিদের মূল কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। মহম্মদ ঘোরির ক্রীতদাস সেনাপতি কুতুবউদ্দিন আইবক এর কাছেই তৈরি করান এক সুউচ্চ স্থাপত্য, যার নাম হয় কুতুব মিনার। সাতাশখানা হিন্দু ও জৈন মন্দির ধ্বংস করে নির্মিত হয়েছিল এই কুতুব মিনার চত্বর। মন্দিরগুলোর বিভিন্ন মূর্তির ভাঙা টুকরো দিয়ে সেই মিনারের থাম বানানো হয়েছিল। মজার ব্যাপার এই যে তুর্কিরা প্রাচীন লৌহস্তম্ভটাকে ধ্বংস না করে রেখে দিয়েছিল তাদের মসজিদ চত্বরের একপাশে। খুব সম্ভবত তারা দেখাতে চেয়েছিল – আমার মিনার তোমাদের প্রাচীন কীর্তির চেয়ে অনেক বেশী উঁচু!
চতুর্দশ শতাব্দীতে আলাউদ্দিন খিলজী নতুন দুর্গ তৈরি করেন সিরিতে। রাজধানীর অন্যান্য কার্যকলাপ চলতে থাকে পুরনো জায়গাতেই। সুলতান সিরি দুর্গে উঠে যান, কেননা তিনি আশঙ্কা করছিলেন কেউ তাকে হত্যা করবে। সিরি দুর্গ তৈরি হওয়ার কিছুকাল পরেই দিল্লিতে আক্রমণ করে মোঙ্গলদের এক দল, সে আক্রমণে সিরি দুর্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আলাউদ্দিন সাহসের সঙ্গে মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিরোধ করেন এবং দুর্গ সংস্কার করে তার শক্তিবৃদ্ধি করেন। এটা খুব কাজের কাজ হয়েছিল, কেননা মঙ্গোলরা কিছুদিন পরেই আবার ফিরে আসে। তারা দিল্লীর অন্যান্য অঞ্চলে ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালালেও সিরি দুর্গ দখল করতে পারেনি। আলাউদ্দিন দুর্গ রক্ষা করে মঙ্গোলদের ফিরে যাওয়া অবধি সেখানে অবস্থান করতে পেরেছিলেন।
জল দিল্লির এক অন্যতম সমস্যা এবং তা চিরকালই ছিল। শহর বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে আলাউদ্দিন অনুভব করলেন জলের সমস্যার দীর্ঘসূত্রী এক সমাধান করা দরকার। তিনি হজখসে এক বিশাল জলাধার নির্মাণ করেন।
আলাউদ্দিনের মৃত্যুর মাত্র কিছু বছর পরে খিলজী বংশের পতন ঘটে। দিল্লির শাসনভার গ্রহণ করে আর এক তুর্কি বংশ, তুঘলক। তারাও অন্য এক নতুন শহর তৈরিতে মনোনিবেশ করে, তার নাম দেওয়া হয় তুঘলকাবাদ। সেটা দিল্লী শহরের পুব দিকে। তুঘলকরা যখন খিলজিদের অধীনে ছিল তখন তাদের একজন সুলতানকে পরামর্শ দিয়েছিল, পুবদিকে নতুন একটা শহর বসাতে। খিলজি মস্করা করে উত্তর দিয়েছিলেন, তুমি যখন সুলতান হবে তখন না হয় বসিও। সম্ভবত এই কারণেই সুলতান হয়ে তারা নতুন শহর পত্তনে আগ্রহী হয়েছিল।
তুঘলকাবাদের রাজপ্রাসাদ ছিল বেশ বড়সড়। গোপন সুড়ঙ্গ দিয়ে যোগাযোগ ছিল বিভিন্ন রাজপথের। ছিল গোপন কুঠুরি এবং একাধিক গোপন ও আচ্ছাদিত প্রবেশ ও প্রস্থানের জায়গা। তবে তুঘলকাবাদ বেশিদিন জনপদ হিসেবে থাকতে পারেনি। লোকজন অল্পদিন পরেই উঠে গেছিল শহর ছেড়ে, খুব সম্ভবত এখানে জল সরবরাহের সুব্যবস্থা না থাকায়।
তুঘলক বংশের দ্বিতীয় সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক দিল্লি থেকে রাজধানী উঠিয়ে এক হাজার কিলোমিটার দক্ষিণে দৌলতাবাদে নিয়ে যান ১৩২৬ সালে। দিল্লি থেকে দৌলতাবাদের যে রাস্তা এ জন্য তৈরি হয়েছিল তাকে বলা হয় দক্ষিণাপথ। মহম্মদ বিন তুঘলককে অনেকেই ক্ষ্যাপা সুলতান হিসাবে অভিহিত করলেও এই দক্ষিণাপথ পরে ব্যবহার করা হয়েছিল দাক্ষিণাত্যের উপর উত্তর ভারতের আক্রমণ চালানোর প্রধান সড়ক হিসাবে। তার এই দূরদর্শিতা প্রশংসনীয়। তবে মহম্মদ বিন তুঘলক যে খামখেয়ালি ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন দিল্লি থেকে শুধু রাজধানীই নয়, সঙ্গে দিল্লির সমস্ত জনগণকে তার সঙ্গে দৌলতাবাদে উঠে যেতে হবে। বয়স্ক, দরিদ্র, চলচ্ছক্তিহীন এক ভিখারি বয়সের ভারে ন্যুব্জ এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে পারছিল না জেনে মহম্মদ বিন তুঘলক আদেশ দিয়েছিলেন তার পা বেঁধে একটা গাড়ির সঙ্গে জুড়ে টানতে টানতে তাকে টেনে নিয়ে যেতে। চল্লিশ দিন পরে দৌলতাবাদ পৌঁছালে দেখা গেল কেবলমাত্র তার পা দুটিই এসে পৌঁছেছে।
কিছুদিনের মধ্যেই মহম্মদ বিন তুঘলকের মন বদলে গেল। দৌলতাবাদ পছন্দ হলো না। আবার তিনি দিল্লি ফিরে যাওয়া মনস্থ করলেন এবং দৌলতাবাদে যাদের টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাদের সবাইকে দলবেঁধে দিল্লি ফিরে আসার আদেশ দিলেন। দিল্লির পরিসর বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা করলেন তিনি। তাঁর রাজত্বের অন্যান্য জায়গা বিশেষ করে মধ্য এশিয়া থেকে জনগণকে দিল্লিতে বসতি স্থাপন করার আয়োজন করা হল। লাল কোটের পুরনো দুর্গ থেকে সিরি দুর্গ পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা ঘিরে দেয়াল তোলা হল।
দিল্লির আয়তন বেড়ে গেল অনেকটা। তুঘলকাবাদের পরিত্যক্ত জায়গাটাও ব্যবহৃত হতে লাগল সৈন্যসামন্ত এবং রসদ মজুত করার জন্য। নির্মিত হল বিশাল রাজপ্রাসাদ চত্বর। ইবন বতুতা মরক্কো থেকে ভারতে এসে দিল্লির এই বৈভব দেখে চমৎকৃত হয়ে গেলেন। বিন তুঘলক চাইছিলেন তার রাজসভা অলঙ্কৃত করুক সমগ্র পৃথিবীর বিখ্যাত মুসলমান পণ্ডিতরা। ইবন বতুতা মরক্কো থেকে এসেছেন জেনে সহজেই তার জায়গা হয়ে গেল তুঘলকের রাজপ্রাসাদে।
বাইরে থেকে মহম্মদ বিন তুঘলকের সেই বিশাল রাজসভায় প্রবেশ করতে হলে অতিক্রম করতে হত তিন তিনখানা বিশাল তোরণ। প্রথম তোরণের বাইরে একটা উত্থিতমঞ্চে বসে থাকতো রাজ-ঘাতকেরা। যখনই কারো মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত, তখন তাকে নিয়ে আসা হতো সেই মৃত্যুমঞ্চে, ঘাতকেরা তাদের শিরশ্ছেদ করে সেখানেই তিন দিন ফেলে রাখত। রাজ্যে যাতে অপরাধ কম হয়, অন্যদের মনে ভয় জাগানোর জন্যই এই প্রথা চালু করেছিলেন তুঘলক। এরা ছাড়াও তোরণের বাইরে থাকত নহবত ও ঢাক-ঢোল বাদকেরা। যখনই কোনো বিশিষ্ট অতিথির আগমন হত, তারা কাড়া-নাকাড়া, নহবত ইত্যাদি বাজিয়ে উচ্চৈঃস্বরে সেই অতিথির নাম ঘোষণা করত। প্রথম আর দ্বিতীয় তোরণের মধ্যে উঁচু উঁচু অনেকগুলো মঞ্চে বসে থাকত রাজপ্রাসাদের রক্ষীরা।
দ্বিতীয় তোরণের বাইরে অপেক্ষায় থাকত রাজসভার নকীব তথা উপস্থাপকরা। এদের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণি বজায় ছিল। মাথায় তারা ধাতব টুপি পরত। সর্বোচ্চ উপস্থাপকের মাথায় থাকত স্বর্ণাভরণযুক্ত টুপি। এই তোরণ পেরোলে প্রবেশ করা যেত যেখানে, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তোরণের মধ্যবর্তী সেই অঞ্চলে অতিথিদের অপেক্ষা করার জন্য একটা বিশাল হল ছিল। অতিথিরা সেখানে বসে ভেতরে প্রবেশের জন্য অপেক্ষা করত। আগন্তুকরা একে একে হাজির হত তৃতীয় তোরণে যেখানে একজন দ্বাররক্ষী তাদের নাম-ধাম এবং সেখানে আগমনের সময় লিপিবদ্ধ করে নিত। রাজসভার কোন বিশেষ ব্যক্তি যদি সভায় কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই পরপর তিনদিন অনুপস্থিত থাকতেন তবে সুলতানের বিশেষ অনুমতি ছাড়া তার ভেতরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। এই তৃতীয় দ্বার পার হলেই ছিল মূল রাজসভা, সেটা কাষ্ঠনির্মিত এক বিশাল স্থাপত্য, যাতে প্রায় হাজার খানেক স্তম্ভ। সুলতান বসে থাকতেন একটা সুউচ্চ সিংহাসনে নরম মখমলের গদি দেওয়া আসনে। তার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকত একজন ব্যক্তিগত দেহরক্ষী, তার কাজ ছিল মাঝে মাঝে একটা পাখা দিয়ে সুলতানের আশেপাশের মাছি তাড়ানোর। সুলতানের ঠিক সামনেই বসতেন সুলতানের পরিবারের সদস্যেরা, তারপর রাজসভার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা, তারপর ধর্মীয় নেতাগণ, তারপর আইন-পরিচালক কাজিরা এবং অন্যান্য ব্যক্তিরা। প্রত্যেককেই তাদের নিজস্ব সম্মান ও রাজকার্যে অবস্থান অনুযায়ী বসতে দেওয়া হতো। রাজসভায় সুলতানের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত ব্যক্তি সবাই দাঁড়িয়ে একত্রে উচ্চঃস্বরে চেঁচাত ‘বিসমিল্লাহ’ বলে। সিংহাসনের দুদিকে একশো জন সশস্ত্র রক্ষী সুলতানকে পাহারা দিত।
রাজসভার এই বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সকলেই প্রায় বিদেশি। অধিকাংশই তুর্কি, তবে বেশ কিছু খুরাসানি, মিশরীয়, সিরিয়ান প্রভৃতি। মহম্মদ বিন তুঘলক বিদেশিদের উচ্চ আসনে বসাতেন। সাধারণভাবে তার মধ্যে পক্ষপাতদুষ্টতা ছিল না। ভারতীয়রা বিশেষ করে হিন্দু এবং স্থানীয় মুসলমানেরা অবশ্য এই বিশেষ সুবিধা পেত না। বহু বছর ধরে সুলতানের রাজসভায় ভারতীয়দের গণ্য করা হতো মূলত ক্রীতদাস ও ছোট ছোট কাজের উপযুক্ত কর্মচারী হিসেবে। এই ব্যবস্থা পরিবর্তিত হতে লেগে যায় বহু শতক।
বিন তুঘলক মাঝে মাঝেই রাজসভায় বিশেষ অনুষ্ঠানের বন্দোবস্ত করতেন। এ সময় অতিথিদের বসানো হত তাদের পদ অনুসারে। প্রত্যেককেই হাতে হাতে একটা কাপে বিশেষ পানীয় দেওয়া হত, যেটা কিছু খাওয়ার আগে তাদের পান করতে হত। রসুইঘর থেকে এরপর বিশাল বিশাল পাত্রে মিছিল করে হাজির করা হত রকমারি সুখাদ্য। সেগুলো নিয়ে আসত প্রধান উপস্থাপক, যার মাথায় সোনার টুপি পরা। তার পিছনে পিছনে আসত রুপোর টুপি পরা তার সহকারি উপস্থাপক। তারা যেই খাবার নিয়ে সভায় প্রবেশ করত, সকলে চেঁচিয়ে উঠত ‘বিসমিল্লাহ’ বলে। রাজকীয় ভোজসভায় খাবারের মধ্যে থাকত রুটি, ঝলসানো গোস্ত, মুরগির মাংস, ভাত, রকমারি মিষ্টান্ন এবং সিঙাড়া। এই সব খাওয়া শেষ হলে প্রত্যেককে এক কাপ করে সাবুর জল খেতে দেওয়া হত পেট ঠান্ডা রাখতে। তারপর তাদের দেওয়া হতো সাজা পান। খানা পিনা শেষ হলেই একজন চেঁচিয়ে উঠত ‘বিসমিল্লাহ’ বলে, আর সকলে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ত।
ইবন বতুতা বহুদিন মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজসভায় উচ্চপদে আসীন ছিলেন। শেষ দিকে অবশ্য তিনি সুলতানকে বেশ ভয় পেতেন তার উল্টোপাল্টা মেজাজ এবং অবিমৃশ্যকারিতার জন্য। ইবন বতুতা ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানালেও তা মঞ্জুর হচ্ছিল না। শেষমেষ কোনমতে তিনি চিনে গ্রেট খানের দরবারে সুলতানের রাজপ্রতিনিধি হিসাবে ভ্রমণ করার এক কাজ জোগাড় করে ভারত ছেড়ে যেতে সমর্থ হন। সুলতানের প্রতিনিধি হিসাবে তার যাত্রার মধ্যপথে অবশ্য তিনি ডাকাতের হাতে পড়েছিলেন এবং তার প্রাণ সংশয়ের উপক্রম হয়েছিল। সুলতানের দূতরাও যে হাইওয়েতে নিরাপদ ভাবে যাতায়াত করতে পারতেন না, এ থেকে বোঝা যায় তুর্কি আগ্রাসনের ফলে দেশের অভ্যন্তরে কী ধরনের অরাজক শাসনব্যবস্থা চালু ছিল।
তুঘলকাবাদ, দৌলতাবাদ ও পরে এই নতুন রাজধানী নির্মিত হয়েছিল তুঘলক রাজত্বের অল্প সময়ের ব্যবধানে। বিন তুঘলকের উত্তরসূরী ফিরোজ শাহ তুঘলক নির্মাণ করলেন আরও অনেক নতুন স্থাপত্য, পুরনোগুলোরও পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করা হল। উত্তরে দিল্লিকে বাড়িয়ে নিয়ে তিনি যমুনার তীরে নির্মাণ করলেন আর এক দুর্গ-প্রাসাদ — ফিরোজ শা কোটলা। মধ্যবয়সে রাজ্যভার গ্রহণ করে তিনি রাজত্ব করেছিলেন বৃদ্ধবয়স অবধি। শেষদিকে তার সাম্রাজ্য দুর্বল হতে শুরু করে। সুযোগ পেয়ে তুর্কি-মঙ্গোল হানাদার তৈমুরলং মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসে ১৩৯৮ সালে আক্রমণ করেন দিল্লি। সুলতানের সেনা ছত্রাকার হয়ে যায়। দিল্লিতে ঢুকে বিশেষ করে তার হিন্দু অধিবাসীদের নৃশংসভাবে হত্যা করেন তৈমুর। বহুজনকে ক্রীতদাস হিসাবে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়।
দিল্লির সমৃদ্ধি এর পর থেকে পড়তে শুরু করে। পুরো পঞ্চদশ শতক জুড়ে দিল্লি নয়, ভারতের সমৃদ্ধ অঞ্চল ছিল দক্ষিণের বিজয়নগর। বহু শাসক বংশানুক্রমে এল-গেল এর মধ্যে। এমন নয় যে দিল্লিতে তাদের কোনো অবদান নেই। সিকান্দর লোদি দিল্লিতে নির্মাণ করলেন মনোরম উদ্যান ও সুরম্য প্রাসাদ।
তার রাজত্বকালেই ভারতের পশ্চিম উপকূলে পৌঁছে গেল পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো ডা গামা। ক্রমে তারা জাঁকিয়ে বসল গোয়ায়।
একই সময়ে ফরগনায় রাজত্ব করছে যে নাবালক শাসকটি, কয়েক দশক পরে যে তৈরি করবে ভারতের নতুন ইতিহাস, তার মনশ্চক্ষে তখন দিল্লি নয়, ঘন হয়ে বসে আছে পিতৃপুরুষের রাজধানী স্বপ্নের দেশ সমরকন্দ। যে কোনোভাবে তাকে দখল করতেই হবে সমরকন্দের সিংহাসন।