|| পাঁচ ||
ব্ল্যাক ডেথের বিভীষিকা অস্তমিত হতে ইওরোপে যেমন বাণিজ্যের দরজা খুলে গেল, এশিয়াতেও তেমনি। নৌ-পরিবহনে জোয়ার এলো। চিনের পূর্ব-উপকূলের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের ও পারস্য উপসাগরের বাণিজ্য চলতে লাগল চুটিয়ে। রাজা ও সম্রাটেরা বুঝতেন বাণিজ্যেই লক্ষ্মীলাভ, কেননা তা থেকে প্রাপ্ত কর সরাসরি জমা পড়ে রাজ-কোষাগারে, তা দিয়েই তাদের বারফট্টাই। কাজেই বাণিজ্যের সুরক্ষা আর লোক ঠকানো বন্ধ করতে বস্তুর গুণাগুণ নিয়ন্ত্রণ — সব কিছুর জন্যই রাজ-অনুগ্রহে নতুন নতুন সংস্থার জন্ম হতে লাগল। এই সংস্থার কাজ ছিল বাণিজ্যিক সংগঠনগুলোর মধ্যে সুস্থ সম্পর্ক তৈরিতে সাহায্য করা ও এমন নিয়মকানুন তৈরি করা যাতে জিনিসপত্র সহজে এবং সঠিক দামে কেনাবেচা সম্পন্ন হতে পারে। পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে চৈনিক পরিব্রাজক মা হুয়ান ভারতে এসে দেখলেন, ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে মাল চালাচালি কী দামে হবে, তা ঠিক করে দেয় এক দালাল। সেই বলে দেয় তার ওপর প্রদেয় কর কত। আগে কর চুকিয়ে দিলে তারপরই জিনিসপত্র হাতবদল হবে, তার আগে নয়। মা হুয়ান বললেন, নিয়মটা বেশ সুন্দর তো, লোকজনও ভীষণ সৎ ও বিশ্বাসযোগ্য।
বস্তুত, বাণিজ্যে সততাই একমাত্র মূলধন কথাটা আদপেই অতিশয়োক্তি নয়। বিদেশিদের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য এই নীতির ওপরেই প্রতিষ্ঠিত ছিল। তার মানে এই নয় যে প্রতিযোগিতা ছিল না। তাও ছিল ভাল ভাবেই। কোচিন উঠে আসছিল কালিকটের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে। এই প্রতিযোগিতার মূলে ছিল সহজতর কর ব্যবস্থা। কর ছাড় দিলে জিনিসের দাম কমে, ফলে সেই বস্তু কিনতে বণিকরা তো উৎসাহী হবেই। ভারত ও পার্শ্ববর্তী উপকূল থেকে বাণিজ্য-উপযোগী বস্তু আহরণ করতে তাই শুরু হল একের পর এক চৈনিক অভিযান। চিনা বণিক জেং হে এক বিশাল বাহিনী নিয়ে বের হলেন বাণিজ্য করতে। শুধু বাণিজ্যই নয়, তার উদ্দেশ্য পৃথিবীকে দেখানো, দেখো, আমাদের নৌবাহিনী কত বিশাল, আমরা সমগ্র পৃথিবীর জলপথ শাসন করতে পারি। ভারত মহাসাগর, পারস্য উপসাগর, লোহিত সাগরের বন্দরগুলোতে তার বাণিজ্যতরী ভিড়ানোর পাশাপাশি তিনি উদগ্রীব ছিলেন কোচিনের রাজার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতেও, কেননা কোচিন তখন কালিকটের সঙ্গে পাল্লা দিতে করের মাত্রা অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছিল।
চিনে সে সময় মঙ্গোল-শাসিত ইউয়ান রাজবংশের পতন হয়ে শুরু হয়েছে স্থানীয় হান উপজাতি-শাসিত মিং রাজবংশ। নতুন শাসকরা দেখাতে চায় তাদের জাঁকজমক। প্রচুর অর্থব্যয় করে ঢেলে সাজানো হচ্ছে রাজধানী বেইজিংকে। নগরীর রাজপথ ও সৌধগুলো নতুন করে নির্মাণ করা হচ্ছে, উন্নত করা হচ্ছে তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। বিশেষ করে উত্তরদিক থেকে যেন বিদেশি আক্রমণ কোনোমতেই দানা বাঁধতে না পারে, তার জন্যে শক্তিশালী করা হচ্ছে সেদিকের দুর্গগুলোকে। উত্তর-পূর্বে মাঞ্চুরিয়ায় কোরিয়া ক্রমে ক্রমে উন্নতি করছে, তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় জিততে হবে। দক্ষিণে কম্বোজ ও শ্যামের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করায় সেখানকার মহার্ঘ বস্তুসমূহ উপহার হিসাবে আসতে লাগল সে অঞ্চলের সুরক্ষার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে। ১৩৮৭ খ্রিস্টাব্দে শ্যামের রাজা পনের হাজার পাউন্ড মূল্যের গোলমরিচ আর চন্দনকাঠ উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন চিনে, দু’ বছর পরে তিনি পাঠালেন তার দশগুণ মূল্যের মালপত্র। ফলে চিনের পোয়াবারো, সে তো চাইবেই সবাইকে দেখাতে, দেখো, আমরা কী করতে পারি।
সুতরাং রাজার অনুগ্রহ নিয়ে নৌ-সর্বাধিনায়ক জেং হে বের হল অভিযানে। তার সঙ্গে ষাটখানা বড় বড় জাহাজ, কয়েকশো ছোট নৌকা এবং প্রায় তিরিশ হাজার দাঁড়ি। এই বিশাল বাহিনীর খরচা তো কম নয়। এদের সবার খোরাকি ও বেতন ছাড়াও এই কাজে প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছুর খরচ বহন করছে চিনের রাজতন্ত্র। আর তার চেয়েও বড় কথা, যেখানেই বাণিজ্যের জন্যে যাওয়া হচ্ছে, সব জায়গাতেই সেখানকার স্থানীয় শাসকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করতে তাদের জন্যে পাঠানো হয়েছে দামি উপহারসামগ্রী।
এত সম্পদ চিন পেল কোত্থেকে? এর পেছনে আছে অনেকগুলো কারণ, যার অন্যতম হচ্ছে কৃষিতে উৎপাদন সম্প্রতি বেশ বেড়ে গেছে, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে খনিজ বস্তুর উৎপাদনও। মঙ্গোলদের দেখানো পথে রাজার রাজকোষে কর সংগ্রহ বর্ধিত হয়েছে। সেইসঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে তৈমুরলঙ্গের উত্থান চিনের উন্নতির দরজা খুলে দিয়েছে।
রক্তপিপাসু তৈমুর শুধু যে ধ্বংসলীলায় ওস্তাদ, তাই নয়, চেঙ্গিজ খানের মতই ধ্বংসের পর নগরীর পুনর্গঠনেও সমান উদ্যমী। তার আমলে সমরকন্দ, হিরাট, মশাদে বহু বিশালকায় মসজিদ ও রাজভবন নির্মিত হল। এর জন্যে প্রয়োজনীয় ছুতোর, মিস্ত্রি, তাঁতি, দর্জি, রত্ন-কাটার শ্রমিক সব নিয়ে আসা হল দামাস্কাস থেকে। আনার আগে অবশ্য দামাস্কাসকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল। সমরকন্দের কাছে আক সরাই নামে এক জায়গায় তোরণ তৈরি হল সোনালি আর নীল টালির উৎকৃষ্ট কারুকাজে সজ্জিত করে। তার প্রধান অভ্যর্থনাগৃহের দেওয়ালও সজ্জিত হল সোনালি ও নীল টালিতে, ছাদের দিকটা পুরো সোনার কাজ। এই কারুকাজ অন্য জাতের, প্যারিসের শিল্পীরাও এসব করতে পারবে না। অবশ্য সমরকন্দে আর তৈমুরের নিজের রাজসভার সাজসজ্জার কাছে এ তো নস্যি। সেখানে সভার মধ্যেই বসানো হয়েছে সোনার গাছ, যার শাখাগুলো মানুষের উরুর মত মোটা মোটা। সেই গাছ থেকে ঝুলছে সোনার পাতা, যার মধ্যে দোল খাচ্ছে বড় বড় ফল। কাছে গেলেই বোঝা যায় ফলগুলো হচ্ছে বড় বড় চুনি, পান্না, ফিরোজা, নীলকান্তমণি আর নিখুঁত গোলাকৃতি বড় বড় মুক্তো।
এই সমস্ত অবশ্য তৈমুর সংগ্রহ করেছিল দিল্লিসহ সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য ছারখার করে। এ ছাড়াও মুক্তহস্তে কিনেছিল চিনের সুবিখ্যাত রেশম, চুনি, কস্তুরি ও মহার্ঘ চিনা ওষধি। এক এক দলে আটশো উটের পিঠে চাপিয়ে সমরকন্দে আসত তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। এই অর্থ বেশ ধনী করে তুলেছিল চিনের রাজতন্ত্রকে। তবে তৈমুর শেষ জীবনে বুঝতে পেরেছিল, সে যে পথে এত অর্থ রোজগার করেছে, তা পাপের পথ। পাপ স্খালন করতে হলে ভাল কাজ করতে হয়। একটা ভাল কাজ হচ্ছে ষড়যন্ত্রীদের শাস্তি দেওয়া। এই মিং রাজারা হচ্ছে ষড়যন্ত্রী, এদের জন্যেই মঙ্গোল রাজবংশের পতন, কাজেই এদের গুঁড়িয়ে দিলে তার পাপ স্খালন হবে। মিং রাজবংশের সঙ্গে সমস্ত কূটনৈতিক সম্পর্ক বন্ধ করে তৈমুর প্রস্তুত হল তাদের গুঁড়িয়ে দেওয়ার উপযুক্ত সেনাবাহিনী প্রস্তুত করতে। ছুটল তৈমুরের অশ্বারোহী বাহিনী মিং রাজপ্রাসাদ অভিমুখে। সেই রাস্তাতেই ঘোড়া থেকে পড়ে তৈমুরের মৃত্যু হয়।
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে সুলতানি শাসন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের সমাজেও বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা যেতে লাগল। গুপ্তযুগ ছিল স্বর্ণযুগ, সে সময় যে হারে শহর পত্তন হয়েছিল এবং যে গতিতে শহরগুলোর মধ্যে বাণিজ্য চলাচল হত, পরবর্তীতে তা শ্লথ হতে হতে একেবারে থেমে যায়। জমিদাররা সমাজের মাথা হয়ে ওঠে। বিদেশ থেকে যে হারে স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা আমদানি হচ্ছিল, তা কমতে কমতে তলানিতে গিয়ে ঠেকে। বস্তুবাদের বিরুদ্ধে মাথা চাড়া দেয় ভাববাদী তন্ত্রসভ্যতা, তাতে সৃজনীশক্তির বিকাশ ও উৎপাদন দুই-ই ব্যাহত হতে থাকে।
তুর্কি শাসন চালু হতে ভারতের অর্থনীতিতে খানিকটা স্থিতাবস্থা ফিরে আসে। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনীতি ও শহর সম্প্রসারণের কাজ শুরু হয় নতুন করে। ইবন বতুতা ভারতবর্ষে এসে লক্ষ করলেন, এ দেশের মাটি অত্যন্ত উর্বর, এখানে বছরে দুবার শস্য উৎপাদন হয় — শীতে রবি আর বর্ষায় খারিফ। কোনো কোনো জমিতে ধান তিনবার অবধি বোনা হয়। ধান আর আখের চাষ হয় পূর্ব আর দক্ষিণ ভারতে, গম আর তৈলবীজ প্রধানত উত্তরে। তুলোর চাষ হয় বিশাল এলাকা জুড়ে। যব, তিসি ইত্যাদি শস্য আর প্রভূত ফলফুলাদির চাষ লেগেই থাকে। গ্রামীণ অর্থনীতির একটা মূল ভিত্তি ছিল তেলের ঘানিতে পিষে তৈলবীজ থেকে তেল বের করা, গুড় বানানো, নীলের চাষ ও তা থেকে নীল তৈরি করা, তুলো থেকে সুতোকাটা ও তা দিয়ে কাপড় তৈরি। আলু, ভুট্টা, কাঁচালঙ্কা আর তামাকের চাষের কথা ইবন বতুতার লেখায় নেই, অর্থাৎ এগুলোর চাষ শুরু হয়েছে পরে উপনিবেশীয় শাসনকালে।
চতুর্দশ শতাব্দীতে মহম্মদ বিন তুঘলক আর ফিরোজ তুঘলকের বাগান তৈরির খেয়াল ছিল অবিশ্বাস্য। ফিরোজ একাই বারোশো বাগান তৈরি করেছিলেন দিল্লিতে আর তার আশেপাশে। সেখানে ফলের চাষ হত, বিশেষ করে আঙুরের। মিরাট, আলিগড়ের আঙুর দিয়ে তৈরি হত ওয়াইন, সড়কপথে তা চলে আসত দিল্লি। ঢোলপুর, গোয়ালিয়র, যোধপুরেও উন্নতভাবে ফলের চাষ হত। যোধপুরের বেদানা খেয়ে সিকান্দার লোদি বলতেন, এ জিনিস স্বাদেগন্ধে পার্সিয়ার আনারের চেয়েও ভাল। তবে এইসব বাগানের ফল মূলত বরাদ্দ ছিল শহরের মানুষের ভোগের জন্যে এবং তার মধ্যেও ধনী সম্প্রদায়ের খাবার টেবিলেই দেখা যেত। ফলের চাষ বেশ কিছু মানুষের চাষি ও ব্যবসায়ী হিসাবে অর্থনৈতিক বিকাশে সাহায্য করেছিল। জমিতে চাষের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হত গোবর সার। গবাদি পশুপালনে ব্যস্ত থাকত বহু মানুষ, তাদের প্রদত্ত করে ফুলে উঠত রাজস্বের ঝুলি। বানজারা বা যাযাবর সম্প্রদায়ের লোকও বহু গবাদি পশু নিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াত এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে। জনসংখ্যা কম থাকায় লোকপ্রতি জমির পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। ঘন অরণ্যের বিস্তারও ছিল অনেক। তবে ধনী-দরিদ্র প্রভেদও ভালই ছিল। ভূমিহীন প্রান্তিক মানুষের সংখ্যা খুব কম ছিল না।
এই সব জমিতে সেচের মূল ব্যবস্থা ছিল বৃষ্টির জলই। কুয়ো খুঁড়ে বা জমিতে আল দিয়ে সেচের জল ধরে রাখাকে পবিত্র গণ্য করা হত। রাষ্ট্র নিজের উদ্যোগেও এইভাবে জলের প্রয়োজনে পুকুর, দিঘি ইত্যাদির খননকার্য করত। চতুর্দশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে ফিরোজ তুঘলকের আমলে খাল কেটে তাদের সংযোগ করে জলের ব্যবস্থা করা হয়। যমুনা থেকে দুটো, চন্দ্রভাগা ও ঘর্ঘরা থেকে একটা করে খাল তার আমলেই কাটা হয় যা থেকে সেচের জল সরবরাহ করা হত বর্তমান হরিয়ানার হিসার অঞ্চলে। সিন্ধু ও পঞ্জাবেও এভাবে কিছু কিছু খাল কাটা হয়েছিল।
গ্রামীণ সমাজ নিয়ে ইবন বতুতা নীরব থাকলেও জৈন লেখক হেমচন্দ্রের লেখায় জানা যায় চার ধরনের মানুষের কথা। এর মধ্যে দু ধরনের মানুষ অন্যের জমিতে চাষ করত, যাদের বলা হত কর্ষক। আমরা এখন চাষিদের যে কৃষক বলি, কৃষ্ ধাতুনিষ্পন্ন এর শুদ্ধ শব্দটি কর্ষকই, কৃষক ভুল শব্দ। হেমচন্দ্রের দু ধরনের কর্ষকদের এক দল অন্যের জমিতে চাষ করে অর্ধেক ফসল জমির মালিকের হাতে তুলে দিত, তাদের বলা হত অর্ধিকা। অন্য দলের নিজস্ব হাল-বলদ ছিল, তাদের সঙ্গে জমিদারের বিনিময় প্রথা ছিল খানিকটা আলাদা, তাদের বলা হত হালভক্ষক। গ্রামে এই দুই শ্রেণিই ছিল প্রধান। যারা নিজের জমিতে চাষ করত, তাদের নাম মালিক-ই-জমিন বা খুদ-কষ্ট্। তারা বংশানুক্রমের জমির স্বত্ব ভোগ করে চলত। তাদের নিজস্ব কুটির ছিল, যার এক অংশ গৃহহীনদের থাকার জন্যেও ব্যবহার করতে দিত। চতুর্থ দল হচ্ছে গ্রামীণ শিল্পীরা — মুচি, চৌকিদার, সুতো বা দড়ি প্রস্তুতকারক প্রভৃতি। এদের মধ্যে অস্পৃশ্য জাতির লোকও ছিল, যাদের বলা হত অধম। সাধারণ মানুষের — অধম তো বটেই, এমনকি কর্ষক শ্রেণির মানুষদেরও — দারিদ্র্য ছিল অবর্ণনীয়। জমিদার সামন্তশ্রেণির বৈভবের সঙ্গে ভূমিহীন কর্ষকদের জীবনযাত্রার পার্থক্য লিপিবদ্ধ আছে ধর্মশাস্ত্র ও পদ্মপুরাণেও, যার কিছু কিছু এই সময়েই রচিত হয়েছিল। সুলতানি আমলে সুলতানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সামন্তদের বোঝাপড়া চালু ছিল, ফলে এই বৈষম্য ক্রমে ক্রমে আরও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়।
তুর্কী শাসনের ঠিক আগে শাসকদের রাজস্ব আদায় ব্যবস্থা কেমন ছিল, তা বিশেষ জানা নেই। ভাগ, ভোগ এবং কর নামে তিনটে আলাদা আলাদা রাজস্ব দিতে হত, যার মধ্যে ভাগ হচ্ছে জমির পরিমাণের সমানুপাতী, ভোগ ও কর জমির উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কোন শাসক উৎপাদনের কতটা কর চাইবে, সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোন প্রথা ছিল না সম্ভবত। ধর্মশাস্ত্রে যদিও বলা আছে, মোট উৎপাদনের এক-ষষ্ঠাংশ শাসকের প্রাপ্য, কেউ কেউ এক-তৃতীয়াংশ এমনকি দুই-তৃতীয়াংশও দাবি করতেন। চোলরাজাদের একজন দাক্ষিণাত্যে অর্ধেক উৎপাদন কর হিসাবে নিতেন।
তুর্কিরা শুরুতেই এই ব্যবস্থা বিশেষ রদবদল করেননি। গিয়াসুদ্দিন বলবন তার ছেলে বুঘরা খাঁকে বলেছিল রাজস্ব এত বেশি হওয়া উচিত না যে তাতে চাষিরা গরিব হতে হতে চাষবাস করাই বন্ধ করে দেয়, আবার এত কম হওয়াও উচিত না যে তাতে তারা সম্পদবান হয়ে শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে। চতুর্দশ শতকে আলাউদ্দিন খিলজি উত্তর দোয়াবে — আলিগড়, রাজস্থান, মালওয়ায় — রাজস্বের মাত্রা বাড়িয়ে দেন। রাজস্ব সরাসরি রাজ-কোষাগারে জমা হতে থাকে। প্রত্যেক চাষি যে পরিমাণ জমি চাষ করত, তার ওপরেই কর দিতে হত। দিল্লি ছাড়া অন্যান্য জায়গায় জমির কর ফসলের বদলে মুদ্রায় দিতে উৎসাহিত করা হতে লাগল। আলাউদ্দিন চেয়েছিলেন চাষিরা যেন তাদের মাঠের ফসল মাঠে থাকা অবস্থাতেই বানজারা বা যাযাবর ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেয় যাতে তারা সেগুলো শস্যাধারে সঞ্চয় করে পরে বেশি দামে বিক্রি না করতে পারে। এ ব্যবস্থা অবশ্য টেঁকেনি কেননা চাষিরা নিজেরাই স্থানীয় শস্য মাণ্ডিতে নিয়ে গিয়ে তাদের ফসল বিক্রি করত।
আলাউদ্দিন চেয়েছিলেন গ্রামের শোষকশ্রেণির প্রচলিত ব্যবস্থা — মূলত যারা তাদের জন্যে প্রদত্ত ‘ঘড়ি’ আর ‘চরাই’ নামে দুই কর তাদের জমিতে চাষ-করা প্রান্তিক চাষিদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিত — ভেঙে দিয়ে গরিব মানুষদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করতে। এরা এদের প্রয়োজনাতিরিক্ত ফসল পরে বেশি দামে বিক্রি করে লাভবান হত। এই ব্যবস্থা ভেঙে দেবার জন্যে তিনি যাদের নিযুক্ত করলেন, দেখা গেল তারা নিজেরাই ঠগ। ফলে এ ব্যবস্থা বেশিদিন চলেনি। আলাউদ্দিনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এর বিনাশ হয়।
গিয়াসুদ্দিন তুঘলক কিছু নতুন ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। সরাসরি সরকারি শাসনে থাকা জমির ফলন চাষি ও সরকারের মধ্যে ভাগ করার নির্দেশ জারি হয়। আগে চাষের পুরো ঝুঁকিটাই ছিল চাষির, ফলন হোক বা না হোক, তাকে কর দিতেই হত ধার্য অংশের। গিয়াসুদ্দিনের ব্যবস্থায় লাভ হোক বা ক্ষতি পুরোটাই চাষি ও সরকারের মধ্যে ভাগাভাগি চালু হল, এতে চাষের ঝুঁকি গেল কমে। গিয়াসুদ্দিন আরও একটা ব্যবস্থার কথা বলেছিলেন। যে সমস্ত জমি সরাসরি সরকারি শাসনের অধীন নয়, যার কর আদায় করে সরকারের প্রতিনিধিরা, সেই জমির ওপর কর যেন ভেবেচিন্তে ধার্য করা হয় এবং তা খুব অল্পমাত্রায় বাড়ানো হয় নির্দিষ্ট সময় অন্তর। গিয়াসুদ্দিনের মতে হঠাৎ করে কর বাড়িয়ে দিলে মানুষ গরিব হয়ে যাবে, দেশ ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাবে।
মহম্মদ বিন তুঘলক আলাউদ্দিনের ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন সারা দেশে। তাতে বিশেষ করে দোয়াব অঞ্চলে তীব্র কৃষক অসন্তোষ শুরু হয়। কোন জমিতে কেমন ফসল হয়, তার ওপর কর নির্ধারণ না করে সরকারি বাঁধাধরা হারে কর ধার্য করা শুরু হয়েছিল। ফসলের বদলে মুদ্রায় তা রাজকোষে জমা করার সময়ও ফসলের আসল দামের বদলে সরকারি হারে দাম দিতে বলায় শুল্কের পরিমাণ হয়ে যায় প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ। চাষিরা প্রবল চাপে পড়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। মহম্মদ বিন তুঘলক ব্যাপারটা বুঝতে পেরে এর উল্টো প্রথা চালু করেন। দোয়াব অঞ্চলে সরকারের সরাসরি শাসন, সেখানে চাষের উন্নতিকল্পে নিকৃষ্ট ফসলের বদলে উৎকৃষ্ট ফসলের চাষের আদেশ জারি করা হয় এবং চাষিদের সেই চাষে উৎসাহিত করতে ও জমিতে সেচ ইত্যাদির প্রয়োজনে কুয়ো খুঁড়তে দাদন প্রথা চালু করা হয়। এতে পোয়াবারো হয় ধনী চাষিদের যাদের অনেক বেশি জমিজমা। দাদন দেবে যে সরকারি কেরানি, তার তো চাষবাসের বা স্থানীয় জলবায়ুর অভিজ্ঞতা নেই। তারা নিজেদের আখের গোছাতেই ব্যস্ত। ফলে যদিও মহম্মদ বিন তুঘলকের সদিচ্ছার অভাব ছিল না, তার সমস্ত পরিকল্পনা মাঠে মারা যায়।
সে তুলনায় ফিরোজ তুঘলক খাল কেটে হরিয়ানা অঞ্চলে সেচের ব্যবস্থা করলে চাষিদের ব্যাপক সুবিধা হয়। এই সেচের জলের জন্যে তিনি দশ শতাংশ অতিরিক্ত কর ধার্য করেন, যদিও চাষিরা কী চাষ করবে তা তাদের ওপরেই ছেড়ে দেওয়া হয়। সুলতানি আমলে তার সময়টাতেই গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নতির শিখরে ওঠে। দোয়াব অঞ্চলে এমন গ্রাম ছিল না যেখানে চাষবাস হত না।
চাষবাস ছাড়া তাঁতে কাপড় তৈরি ছিল ভারতের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক স্তম্ভ। সুতি, পশম, রেশম তিন ধরনের পোশাকই তৈরি হত। সুতির কাপড় মোটা আর মিহি দু রকমের হত। মোটা কাপড় পরত গরিব মানুষ আর সাধু-ফকিররা। গ্রামের মানুষরা নিজেরাই সেগুলো তৈরি করে নিতে পারত। এর চেয়ে ভাল কাপড়কে বলা হত ক্যালিকো বা কার্পাস। এর প্রচলনই ছিল সর্বাধিক। সবচেয়ে ভাল জাতের সুতির বস্ত্র, যেমন মসলিন, তৈরি হত অল্প কিছু জায়গায় যেমন বাংলার শ্রীহট্ট, ঢাকা, মুর্শিদাবাদ বা দক্ষিণে দেবগিরিতে। সেগুলো এত পাতলা আর দামি যে খুব ধনী মানুষ ছাড়া কারও অঙ্গে উঠত না। গুজরাতের ক্যাম্বে অঞ্চলে তৈরি হত অনেক ধরনের কাপড় — মোটা-সরু দু রকমেরই — এবং ভেলভেট, সাটিন ইত্যাদির কাপড়ও। কাঠের ব্লকে কাপড়ে রং ছুপানো হত নীলগাছ থেকে পাওয়া নীল বা অন্যান্য ভেষজ রং দিয়ে। রাজস্থানে কাপড় রং করা হত কাপড়টার বিভিন্ন জায়গায় বেঁধে রঙে ডুবিয়ে, যাকে বলা হত বাঁধনি। কার্পেট, বিছানার চাদর ইত্যাদির জন্যেও গুজরাতের প্রসিদ্ধি ছিল, আর ছিল গুজরাটি পাটোলা ও জরির কাজ। চরকার প্রবর্তনে বস্ত্রশিল্পে জোয়ার আসে। সম্ভবত তুর্কিরা ভারতে চরকা নিয়ে আসে পারস্য থেকে। চরকা ছাড়াও ওরা এনেছিল তুলো ধুনার যন্ত্রও যা দিয়ে তুলো ফাঁপানো ছাড়াও সহজে তুলো থেকে তুলোর বীজ আলাদা করা যেত।
রেশমের জন্যে বিখ্যাত ছিল বাংলা, যেখানে রেশম মথের চাষ হত। চিন, ইরান আফগানিস্থান থেকেও নিয়মিত রেশমের জোগান আসত। দিল্লির সম্ভ্রান্ত মানুষেরা দাম দিয়ে রেশমের পোশাক কিনতেন। আলাউদ্দিন খিলজি গুজরাটের ক্যাম্বের মূল্যবান রেশমের মূল্য নিয়ন্ত্রণের আদেশ দিয়েছিলেন। পশমের জন্যে ভেড়ার চাষ প্রধানত পাহাড়ে হলেও সমতলেও একেবারে হত না, তা নয়। পশমের পোশাক পরতে পেত একমাত্র সম্ভ্রান্ত ধনীরাই। এর মধ্যেও সর্বোৎকৃষ্ট পোশাক বিদেশ থেকে আমদানি করা হত। কাশ্মীর বরাবরই প্রসিদ্ধ ছিল শালের জন্যে। মহম্মদ বিন তুঘলক চিনের সম্রাটকে কাশ্মীরি শাল উপহার পাঠিয়েছিলেন। উলের কার্পেটের ডিজাইনের জন্যে ইরানি ও মধ্যপ্রাচ্যের কারিগরদের আমন্ত্রণ করা হত। সম্ভ্রান্তদের উপযোগী প্রসাধনী দ্রব্য প্রস্তুতির জন্যে সরকারি নিয়োগে বহু মানুষ এক জায়গায় একসঙ্গে কাজ করত, তাকে বলা হত কারখানা। প্রায় চার হাজার রেশমশিল্পী কাজ করত মহম্মদ বিন তুঘলকের কারখানায়।
ধাতুনির্মিত বস্তুর জন্যে ভারত বিখ্যাত ছিল, মেহরৌলির মর্চেহীন লৌহস্তম্ভ তার প্রমাণ। তামা ও মিশ্রধাতুর দেবদেবীমূর্তি নির্মাণে নিয়োজিত ছিল অনেক মানুষ। যুদ্ধবিগ্রহের জন্যে বানানো রত্নখচিত ভারতীয় তলোয়ার বা ভোজালির চাহিদা ছিল সারা বিশ্বে। ব্রোঞ্জ ও তামার পাত্রও সমাদৃত ছিল। সুলতানি আমলে ভারতে যে মুদ্রা তৈরি চালু হয়, তাতে ভারতীয় ধাতুবিদদের হাতের কাজ দেখার মত। স্বর্ণমুদ্রা ও রৌপ্যমুদ্রা ছাড়াও বিভিন্ন গহনা প্রস্তুত করত তারা।
অর্থ উপার্জনের আর এক উল্লেখযোগ্য মাধ্যম ছিল সুদৃশ্য ভবন নির্মাণ। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সমস্ত রাজারাই প্রাসাদ ও প্রার্থনাস্থল নির্মাণে উৎসাহী ছিলেন। বুন্দেলখণ্ডের খাজুরাহোর বা রাজস্থানের দিলওয়ারার মন্দির, উড়িষ্যা ও গুজরাতের বহু মন্দির নির্মিত হয় সুলতানী আমলের ঠিক পূর্বে। তুর্কি সুলতানরাও বহু রম্য শহর, দুর্গ, প্রাসাদ, রাজপথ নির্মাণ করেছেন। তুর্কিদের স্থাপত্যে বৃত্তাকার আর্চ ও অর্ধগোলকের ন্যায় ডোম ও ভল্টের ব্যবহার লক্ষণীয়। ইঁট তৈরিতে নিযুক্ত থাকত বহু মানুষ। মাটির বাড়ির বদলে এই সময় থেকে লোকজন ইঁট ও পাথরের বাড়িতে বসবাস শুরু করে, যদিও গরিবদের থাকার জায়গা ছিল খড়ের চালওয়ালা মাটির বাড়িই। ইঁটের গাঁথনি সুরক্ষিত করতে চুন-সুরকির ব্যবহার শুরু হয় এই সময় থেকে। আমীর খসরুর মতে পাথর কেটে ঘরবাড়ি ও দেবালয় বানাতে ভারতীয় শিল্পীরা ছিল বিশ্বের সেরা। আলাউদ্দিন খিলজির প্রাসাদ বানাতে সত্তর হাজার মিস্ত্রি কাজ করেছিল। ফিরোজ ও মহম্মদ বিন তুঘলকও বহু নতুন শহর নির্মাণ ও পুরনো শহরের সংস্কার সাধন করেছিলেন। হিন্দু রাজারাও শহরনির্মাণে পিছপা ছিলেন না। রাজস্থানের যোধপুর শহর নির্মিত হয়েছিল সুলতানী আমলেই।
চর্ম, কাগজ, লবণ, দড়ি, মার্বেল, হীরে-মুক্তো-হস্তিদন্ত ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত প্রভূত কাজেও ব্যাপৃত ছিল বহু শিল্পী।
বস্তুত কৃষিজ ও শিল্পজ বস্তুসমূহের উৎপাদনে প্রাক্-সুলতানী ও সুলতানী আমলে ভারতবর্ষের রমরমা ছিল। সমস্ত শাসকরাই পণ্য-বিপণনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। যুদ্ধ বা অন্যান্য কোন কারণেই পণ্য চলাচল যেন বিঘ্নিত না হয়, সেদিকে নজর রাখতেন। ভারতীয় পণ্যের বিনিময়ে বিদেশ থেকে আমদানি হত আরবি ঘোড়া ও উট, ক্রীতদাস, ভেলভেট, শুকনো ফল, ওয়াইন, সোনাদানা। মঙ্গোলরা লাহোর ধ্বংস করে গেছিল বলে উত্তর ভারতে বাণিজ্যের প্রধান ঘাঁটি ছিল মূলতান। সেখান দিয়েই মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে বাণিজ্য চলত। বাংলার বন্দর দিয়ে চিন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য হত। গুজরাতের বন্দর দিয়ে আরব ও পূর্ব আফ্রিকার সংযোগ ছিল।
শান্তিপূর্ণ বাণিজ্যে ব্যস্ত ছিল ভারতের দীর্ঘ পশ্চিম উপকূলের বন্দরগুলোও। পশ্চিমঘাট পর্বতের পশ্চিমে শান্ত আরবসাগর ঘেঁষে উত্তর-দক্ষিণে নারকেল-সুপারি গাছের ছায়াঘেরা বিস্তীর্ণ বেলাভূমি। সেখানে আগমন হল লোভী, খল ও ক্রূর পর্তুগিজদের, শান্তি বিঘ্নিত হয়ে গেল।
গোকর্ণাদুত্তরে ভাগে সপ্তযোজনবিস্তৃতম্।স্কন্দপুরাণের সহ্যাদ্রিখণ্ডের এই গোবপুরীর বর্তমান নাম গোয়া। মহাভারতের ভীষ্মপর্বে একেই বলা হয়েছে গোমন্ত। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মগধরাজ জরাসন্ধকে পরাজিত করেছিলেন গোমঞ্চল পর্বতে, এই অঞ্চলেই কোথাও। গোবরাষ্ট্র নামেও এর উল্লেখ আছে। সমস্ত নামগুলোর আদিতেই যে গো, তা কি গোরু, নাকি পৃথিবী বা আকাশও হতে পারে? সংস্কৃতে গো শব্দের এই সবগুলো অর্থই সম্ভব।
তত্র গোবপুরী নাম নগরী পাপনাশিনী।।
কিন্তু সমুদ্রের তীরে লম্বালম্বি বিস্তৃত সহ্যাদ্রি পর্বতের তীরে এই অনুপম নগরী কী করে উৎপন্ন হল? তার উত্তর আছে পরশুরাম সংহিতায়। বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরাম নিজের রাজ্য হারিয়েছেন, তাঁর থাকার জায়গা নেই। সহ্যাদ্রি পর্বতের ওপর থেকে তিনি একে একে সাতখানা তির ছুঁড়লেন পশ্চিম সমুদ্রের দিকে লক্ষ করে। সমুদ্রেশ্বর ভয় পেয়ে সরে গেল খানিকটা, সে জায়গায় বেরিয়ে এল এক বিস্তীর্ণ বেলাভূমি — শূর্পারক। শূর্প মানে কুলো — কুলোর মত নখ ছিল বলেই রাবণের বোনের নাম শূর্পনখা — কুলোর মত সমুদ্রকে ঝেড়ে সরিয়ে দিয়ে উপকূলভূমি বের করে আনা হল কিনা, তাই শূর্পারক! এইভাবেই তৈরি হল কোঙ্কণ উপকূল। সেই শূর্পারক থেকেই বর্তমানে সোপারা — নালা সোপারা — একদা এক বিখ্যাত সমুদ্রবন্দর এখন মুম্বই শহরতলির অন্তর্গত। অতীতে সোপারাই ছিল পশ্চিম উপকূলে ভারতভূমির শ্রেষ্ঠ বন্দর, এর সঙ্গে বাণিজ্য চলত মেসোপটেমিয়া, মিশর, আরব, কোচিন ও আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের বন্দরগুলির।
একে একে গোয়ার অধীশ্বর হয়েছেন বিভিন্ন শাসকেরা। মৌর্য, শতবাহন, ভোজ, চালুক্য, রাষ্ট্রকূট, শিলহার রাজারা রাজত্ব করেছেন প্রথম সহস্রাব্দী। শিলহাররা ছিল রাষ্ট্রকূটদেরই এক সামন্ত। তাদের শক্তি যত কমে আসতে থাকে, ততই এই অঞ্চলে আরব বণিকরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। গোয়ার শাসন প্রায় চলে যায় তাদের হাতেই। এ তো হতে দেওয়া যায় না। অবস্থা দেখে চালুক্যদের মিত্র কদম্বরাজারা গোয়া দখল করে সেখানে আরবদের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ শাসন চালু করেন। কদম্বরা চালুক্যদের সাহায্য করেছিল রাষ্ট্রকূটদের পরাজিত করতে, বিনিময়ে চালুক্যরাজ দ্বিতীয় তৈলপ কদম্বরাজ ষষ্ঠদেবকে গোয়ার মহামণ্ডলেশ্বর উপাধি দেন। ষষ্ঠদেব শিলহারদের কাছ থেকে গোয়ার চন্দরের দখল নিয়ে সেখান থেকে গোয়ায় শাসন চালাতে থাকেন। ভোজরা যখন এই অঞ্চল শাসন করত, তখন তাদেরও রাজধানী প্রথমে ছিল এই চন্দ্রপুর বা চন্দর। পরে তা স্থানান্তরিত হয় গোপকপত্তনে। পরবর্তী রাজা প্রথম জয়কেশী কঙ্কণের বিস্তীর্ণ স্থলভূমি গোয়ার সঙ্গে যুক্ত করেন। গোপকপত্তন বন্দর দিয়ে বাণিজ্য হত সুদূর আফ্রিকার জাগুভা তথা জাঞ্জিবার, গৌড় তথা বাংলা, গুর্জররাষ্ট্র তথা গুজরাট ও সিংহল তথা শ্রীলঙ্কার সঙ্গে। যেমন সুন্দর শহর ছিল এই গোপকপত্তন, তেমনিই সর্বধর্মসহনশীল। বন্দর দিয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রের, বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন সংস্কৃতির বণিকদের বাণিজ্য চলত। শহরের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের জন্যে ছিল প্রশস্ত রাজবীথি। পশ্চিমে আফ্রিকা থেকে পূর্বে মালয়, সব অঞ্চলের জাহাজ এসে ভিড়ত এই বন্দরে। কদম্বদের রাজত্বকালই এর ধর্ম-সংস্কৃতি-বাণিজ্য-শিল্পের স্বর্ণযুগ। রাজারা শৈব ছিলেন বলে এই অঞ্চলে প্রচুর শিবের মন্দির স্থাপিত হয়েছিল। বৈদিক মতে পূজার্চনা সম্পন্ন হত। রাজারা অশ্বমেধ যজ্ঞ করতেন, সেই যজ্ঞের তেজী ঘোড়া আসত সুদূর মধ্যপ্রাচ্য থেকে, আরব বণিকদের মাধ্যমে।
কদম্বরা চার শতাব্দী ধরে গোয়া শাসন করেছিল। ১৩৪৫ সালে কদম্বরাজ সূর্যদেব নিহত হন মুসলমান শত্রুদের হাতে, গোয়া চলে যায় বাহমনি সুলতানদের হাতে। বছর কুড়ি পরেই অবশ্য বাহমনিদের কাছ থেকে গোয়া ছিনিয়ে নেয় হাম্পির বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজারা। তারা গোয়ায় রাজত্ব করে ঠিক একশো বছর। হাম্পির অশ্বশালায় অশ্ব সরবরাহ করত আরব বণিকরা, গোয়া বন্দরে এসে লাগা তাদের জাহাজে। ১৪৬৯ সালে গুলবর্গার বাহমনি সুলতান আবার গোয়ার দখল নিয়ে নেয় বিজয়নগরের রাজার কাছ থেকে। সেই সাম্রাজ্য অবশ্য কিছুদিন বাদে পতন হতে গোয়ার শাসনভার এসে পড়ে বিজাপুরের সুলতান ইউসুফ আদিল শাহের হাতে। সেটা ১৪৯২ সাল, সেই বছরেই কলম্বাস ভারতে আসতে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে। আর তার পাঁচ বছর যেতে না যেতেই পর্তুগিজরা হাজির হয় ভারতের পশ্চিম উপকূলে।
ভাস্কো ডা গামা ১৫০২ সালে দ্বিতীয়বার ভারতের পশ্চিম উপকূলে ধ্বংসলীলা চালিয়ে বিদায় নেওয়ার আগে বুঝে গেল, কালিকটের জামোরিনকে খুব সহজে বশে আনা যাবে না। যুদ্ধে হেরে গেলেও এই ভারতীয়রা আবার ফিরে আসে নতুন উৎসাহে। বন্ধু আরবদের সঙ্গে মিলে উৎখাত করতে চায় শত্রু পর্তুগিজদের। ভাস্কো যদিও সেই আরবদের কচুকাটা করেই দেশে ফিরে গেছে, সে বুঝেছে, জামোরিন আবার নতুন করে সেনা সংগ্রহ করে পরের বারও তাদের ব্যবসায় বেগ দেবে।
এর মধ্যে আর এক কাণ্ড ঘটেছে। ফিরে যাওয়ার আগে ক্যানানোরে ভাস্কোর জাহাজ থেকে পালিয়ে গেছে দু জন ইতালিয় যাত্রী, পথ খুঁজে খুঁজে এসে হাজির হয়েছে কালিকটে জামোরিনের রাজসভায়। এরা ভেনিসের গুপ্তচর, যুদ্ধ-অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী। তারা জামোরিনকে বোঝাল, পর্তুগিজদের নৌ-অস্ত্র জামোরিনের মান্ধাতা আমলের কামানের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। প্রতিশ্রুতি দিল তারা এমন কামান বানিয়ে দেবে যা পর্তুগিজদের কামানের মতদূরে গোলা নিক্ষেপ করতে পারবে।
ভাস্কো ফিরে গেল কোচিন আর ক্যানানোরের রাজার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে। ভাবল ফিরে এসে কালিকটকে যদি বাগে আনা নাও যায়, এই দুই জায়গায় তাদের ঘাঁটি শক্তপোক্ত করে ব্যবসা জমিয়ে নেবে। ফিরে যাওয়ার আগে কাকা ভিনসেন্ট সোদ্রের অধীনে রেখে গেল গোটা ছয়েক ছোট ছোট জাহাজ আর কিছু পর্তুগিজ সেনা। বলে গেল, সুযোগ পেলেই যেন তারা জামোরিনকে উত্যক্ত করে। কিন্তু তাতেও এক সমস্যা দেখা দিয়েছে। পর্তুগালের রাজা ম্যানুয়েল আদেশ জারি করেছেন গোটা ছয়েক জাহাজ নিয়ে একটা পর্তুগিজ দল যেন লোহিত সাগরের মুখে এডেন বন্দরের দিকে এগিয়ে যায়। সেখানে ধনী আরব বণিকদের ঘাঁটির খবর পাওয়া গেছে। তাদের কাছ থেকে ধনরত্ন হাতিয়ে নেওয়া এমন কিছু কঠিন হবে না হয়ত। ম্যানুয়েল এই কাজের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন ভাস্কোর কাকা ভিনসেন্ট সোদ্রেকে। সমুদ্র থেকে আরবদের জাহাজ আক্রমণ করে ধনরত্ন হাতানো যে সহজ, ভাস্কোও জানে তা, কিন্তু তার ইচ্ছা নয় কাকার হাতে এই কাজ সঁপে দেওয়ার। কোচিন-কালিকটের পুরনো ঝগড়া যে কোন মুহূর্তে যুদ্ধে পরিণত হতে পারে, হলেই তাদের কোচিনের ঘাঁটি উলটে যাবে, ভারতের সঙ্গে এই প্রবল লাভজনক ব্যবসা তাতে কেঁচে গণ্ডূষ হয়ে যাবে। কাকাকে বলে গেল, তুমি কোচিনে থেকে যেভাবে পারো কালিকটকে শায়েস্তা করার চেষ্টা করে যাও।
১৫০৩ সালের সেপ্টেম্বরে ভাস্কো ডা গামা পৌঁছালো পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে। পেশ করল তার যাত্রার রিপোর্ট। রাজাকে বোঝাল কালিকটের জামোরিন একটা ত্যাঁদড় টাইপের লোক, যাকে বাগে আনা তত সহজ নয়, কিন্তু কোচিন আর ক্যানানোরে তাদের ঘাঁটি তৈরি হয়ে গেছে। বড়সড় দল নিয়ে এবার তাদের যেতে হবে কালিকটকে গুঁড়িয়ে ভারতে পর্তুগিজ ব্যবসা পাকাপোক্ত করে তুলতে। ম্যানুয়েল অবশ্য ভাস্কোর ফিরে যাওয়া অবধি পরের দলের জন্যে অপেক্ষা করেননি। সে বছর এপ্রিল মাসেই ভারত অভিমুখে ভেসে পড়েছে তিনটে আলাদা দলে আর এক অভিযাত্রী বাহিনী, যার নেতৃত্ব তিনি সঁপেছেন আফন্সো দ্য আলবুকার্ককে, তার অধীনেই একটা দলের নেতৃত্বে আছে আফন্সোর এক খুড়তুতো ভাই, ফ্রান্সিস্কো।
এদিকে ভাস্কো বিদায় নিতেই কোচিনের রাজার কাছে খবর এল কালিকটের জামোরিন বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে তার রাজ্যে যুদ্ধ করতে আসছে। পর্তুগিজ দলের এক গুপ্তচর এই খবর এনে সোদ্রেকে বলল কোচিনের উপকূলে যেন তারা যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হয়। সোদ্রে তার এই খবরকে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়ে তার অধীনস্থ ছটা জাহাজের ক্যাপটেনকে ডেকে বলল, সে এডেন বন্দরে অভিযান করতে চায়। তারা ভাস্কোর আদেশ স্মরণ করিয়ে দিতে সোদ্রে তাদের দেখাল রাজা ম্যানুয়েলের নির্দেশ। ক্যাপটেনরা ভাস্কোর অনুগামী, তারা বুঝেছে কোচিনে থাকাই তাদের পক্ষে ভাল, ওদের দুজন সোদ্রের আদেশ মানতে রাজি হল না। তাদের বদলে অন্য দুজনকে ক্যাপটেন বানিয়ে মাত্র কয়েকজনকে কোচিনে রেখে ছখানা জাহাজ নিয়ে সোদ্রে জাহাজ ভাসিয়ে দিল মালাবার উপকূল থেকে সোজা উত্তরে। এই ছটার একখানার ক্যাপটেন হল ভিনসেন্ট সোদ্রের নিজের ভাই ব্রাস সোদ্রে। গুজরাট উপকূলে তারা পেয়ে গেল শত্রুদের এক জাহাজভরা ধনদৌলত। সেটা লুঠ করে এডেন উপসাগরে পৌঁছে লোহিত সাগরের মুখে পেয়ে গেল আরও গোটা পাঁচ আরবদের জাহাজ। সেগুলোও লুঠ করে লুঠের মাল নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করতে গিয়ে দলের মধ্যে বেধে গেল চরম বচসা। সোদ্রেরা দু ভাই হাতিয়ে নিল লুঠের সিংহভাগ, বাকিদের হাতে ঠেকাল নিমিত্তমাত্র। লুঠের মালে রাজার প্রাপ্য যে বিশ শতাংশ, তাও তারা নিজেদের ভাগে নিয়ে নিল। বাকিরা তো রেগে কাঁই। একেই এদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কয়েকজন মিত্রকে ছেড়ে আসা হয়েছে কোচিনে, তাদের এতদিনে কী অবস্থা হয়েছে কে জানে, তার ওপরে এই দুভাই তাদের হকের বখরা থেকেও বঞ্চিত করছে! হাতাহাতি কোন রকমে বন্ধ করে তারা ওমান উপকূলে এক দ্বীপে পৌঁছে জাহাজগুলো নোঙর করল। স্থানীয় লোকেরা জানাল উত্তর দিক থেকে এক প্রবল ঘূর্ণিঝড় ঘনিয়ে আসছে, তারা যেন জাহাজগুলো দ্বীপের দক্ষিণদিকে নিয়ে গিয়ে রাখে। সোদ্রে ভাইরা বাদে বাকি চারজন চলে গেল সেদিকে নিরাপত্তার খোঁজে। সোদ্রেরা ভাবল, আপদ গেছে। এরা লুঠের বখরা চায়, এরাই আসল শত্রু, ঝড়ে আর তাদের কী ক্ষতি করবে!
ভয়ঙ্কর সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় এগিয়ে এল। সামনে যা পেল তা হয় উড়িয়ে নিল অথবা ডুবিয়ে দিল সমুদ্রের অতলে। ভিনসেন্ট আর ব্রাসের ধনদৌলতসহ দুটো জাহাজই তলিয়ে গেল ওমান উপকূলে। সলিলসমাধি হল ভিনসেন্টের। ব্রাস কোনরকমে সাঁতরে কূলে পৌঁছাল যদিও, কয়েকদিন পর তারও ভবলীলা সাঙ্গ হল।
সোদ্রেদের সঙ্গী বাকি চার জাহাজের পর্তুগিজরা ওমান উপকূল থেকে কোচিনে ফেরার চেষ্টা করে এরপর। হাওয়া প্রতিকূল, জাহাজ যেন এগোতেই চায় না। তাদের যাত্রাপথ মনে হয় অতি দীর্ঘ। অতিকষ্টে বহুদিনে তারা পৌঁছায় ভারতের গোয়া ও কর্ণাটক সীমান্তের নিকটবর্তী এক দ্বীপে। জাহাজগুলোর তখন ভগ্নদশা। না সারালে তারা আর চলছে না। সেখানে স্থানীয় লোকেদের সাহায্য নিয়ে তারা যখন জাহাজ মেরামত করছে, সেই সময়েই ভাগ্যক্রমে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে যায় ফ্রান্সিস্কো দ্য আলবুকার্কের অধীনে পরবর্তী পর্তুগিজ অভিযাত্রীদলের। সেই দলের সর্বাধিনায়ক ফ্রান্সিস্কোর খুড়তুতো দাদা আফন্সো, সে আলাদা একটা দলের সঙ্গে ভারতে আসছে এদের পিছন পিছন।
ওদিকে পর্তুগিজ গুপ্তচরের কথামতই ভাস্কো ডা গামা আর ভিনসেন্ট সোদ্রের কোচিন ছাড়ার পরপরই ১৫০৩ সালের এপ্রিল মাসে কালিকটের জামোরিন প্রায় পঞ্চাশ হাজার সেনার এক বিশাল দল নিয়ে এগিয়ে এল কোচিনের পথে। নির্বিবাদ মালাবার উপকূলে ঝঞ্ঝাট বাধিয়েছে যে পর্তুগিজরা, ধ্বংস করেছে কালিকট উপকূলের ঘরবাড়ি, নির্বিচারে হত্যা করেছে জামোরিন ও কালিকটের অতিথি আরব বণিকদের, তাদের কোন সাহসে সাহায্য দেয় এই তুচ্ছ কোচিনের রাজা? কোচিন এমনিতেই একটা ছোট্ট রাজ্য। তার চেয়েও বড় কথা, কোচিনের রাজার পরিবার বড় হলেও শহরের কাছাকাছি এড়াপল্লি হ্রদের উল্টোদিকে তাদের যে বড় শরিক, তাদের সঙ্গেও তার পারিবারিক বিসম্বাদ। শোনা গেল জামোরিনের পঞ্চাশ হাজারি সেনার সঙ্গে সেই বড় শরিকের কয়েক হাজার মালাবারি যোদ্ধারাও যুক্ত হয়েছে। কোচিনে মুসলমানের সংখ্যা বড় কম নয়। তাদের প্রতি পর্তুগিজদের মনোভাব কারও অবিদিত নেই। যদিও নায়াররা বরাবরই রাজাকে সমস্ত ব্যাপারে সহযোগিতা করে, কিন্তু তারাও যদি বেঁকে বসে! পর্তুগিজ যারা রয়ে গেছে কোচিনে, তাদের তিন প্রধানকে রাজা নিয়ে তুলেছেন নিজের রাজপ্রাসাদে, বলে দিয়েছেন এমনকি বাজারে যেতে হলেও যেন তারা দেহরক্ষী নিয়ে বের হয়! এর সবগুলোই কালিকটের জামোরিনের পক্ষে অসহনীয়। তিনি কোচিনকে উচিত শিক্ষা দেবেন।
জামোরিনের বিপুল সেনাদলকে রুখে দিতে সাড়ে পাঁচ হাজারের এক সেনাদল দিয়ে এগিয়ে গেল কোচিনের রাজপুত্র নারায়ণ। এড়াপল্লি হ্রদের কাছেই তাদের তুমুল যুদ্ধ শুরু হল। কালিকটের সেনার সংখ্যা কোচিনের তুলনায় অনেক গুণ, কিন্তু নারায়ণের পরাক্রমও দেখার মত। পরমবিক্রমে সে ঠেকিয়ে রাখল জামোরিনের সেনাদের। শেষ রক্ষা হল না অবশ্য। জামোরিন যে কোন উপায়ে কোচিনকে শিক্ষা দিতে উদ্যত। ঘুষ দিয়ে তাদের নায়ার যোদ্ধাদের কিনে নিয়ে রাজপুত্রের সেনাদের দমন করলেন তিনি। বীরের মত যুদ্ধে প্রাণ দিল নারায়ণ।
নারায়ণের এই অসমসাহসিকতার ফলে তার বাবা কোচিনরাজ ও তার সহযোগী পর্তুগিজরা যথেষ্ট সময় পেয়ে গেল কোচিন ছেড়ে পালিয়ে নিকটবর্তী ভাইপিন দ্বীপে আশ্রয় নেওয়ার। ভাইপিন গাছপালায় ভর্তি ছোট দ্বীপ, তার চারদিকে জল, সেখানে কাউকে খুঁজে বের করা দুষ্কর। জামোরিন কোচিন দখল করে হুকুম দিলেন পর্তুগিজদের তার হাতে সঁপে দেওয়া হোক। সে হুকুম তামিল করবে কে? রাজা তো দ্বীপে লুকিয়ে। এমনিতেই সেখানে আক্রমণ করা মুশকিল, তার ওপর প্রবল বৃষ্টিতে তাদের খুঁজে বের করাও সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। বিরক্ত, হতাশ জামোরিন কোচিনের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে কালিকট ফেরত গেলেন। বলে গেলেন, আবহাওয়া পরিষ্কার হলেই ফের কোচিনের রাজাকে উচিত শিক্ষা দিতে ফিরে আসবেন।
এলেনও মাস চারেক বাদে, সেই বছরেরই অগাস্টে। কোচিনের রাজা ও পর্তুগিজরা আবার আগের মত সেঁদিয়ে গেল ভাইপিন দ্বীপে। কয়েকদিন দ্বীপের বাইরে অপেক্ষা করে যখন কোন লাভ হল না, জামোরিন ঠিক করলেন ছোট ছোট নৌকা নিয়ে তার সেনাদল ভাইপিন দ্বীপে উঠেই আক্রমণ করবে শত্রুদের। সেইমত নৌকা প্রস্তুত হতে লাগল।
ঠিক এই সময়েই, কোচিনের রাজার সৌভাগ্যক্রমে যেন দৈববলেই সেই জলপথে হাজির হয়ে গেল পর্তুগিজদের পরবর্তী অভিযাত্রী দলের বেশ কয়েকটা যুদ্ধজাহাজ, তাদের নেতৃত্বে ফ্রান্সিস্কো দ্য আলবুকার্ক। ভিনসেন্ট সোদ্রের দলের চারখানা জাহাজ ও নিজের অভিযাত্রীদল নিয়ে তিনি পৌঁছেছিলেন মিত্ররাজ্য ক্যানানোরে, সেখানে কোচিনের ওপর কালিকটের হামলার খবর পেয়েই বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে একদম সময়মত হাজির হয়েছেন ভাইপিন দ্বীপের জলপথে। পর্তুগিজদের যুদ্ধজাহাজ থেকে ছোঁড়া গোলার পরিণাম জানা আছে মালাবারি সেনাদের। তাদের দর্শনমাত্র জামোরিনের সেনারা ভোজবাজির মত অদৃশ্য হয়ে গেল ভাইপিনের চারপাশ থেকে। ভগ্নহৃদয় জামোরিন আবার খালি হাতে ফিরে গেলেন কালিকট।
কোচিন আবারও বেঁচে গেল কালিকটের হাত থেকে। পর্তুগিজরা কোচিনের রাজাকে বোঝাল, জামোরিন ছাড়ার পাত্র নন, তিনি আবার ফিরে ফিরে আসবেন। কোচিনের স্বার্থেই তাদের যেন কোচিনে একটা বড়সড় দুর্গ বানানোর অনুমতি দেওয়া হয়। কোচিনের রাজার উপায় ছিল না এই অনুরোধ না রেখে, তিনি কোচিনে পর্তুগিজদের দুর্গ বানানোর অনুমোদন দিলেন। চৌকো এক দুর্গ বানানো হল দুই সার পাম গাছের গুঁড়ি পুঁতে আর তার মধ্যে মাটি ভর্তি করে। চার কোণায় কামান লাগিয়ে দেওয়া হল দুর্গ রক্ষার প্রয়োজনে। এর চারিদিকে খুঁড়ে দেওয়া হল পরিখা। দুর্গের কাজ শুরু হবার আগেই অবশ্য আফ্রিকার পূর্ব উপকূল থেকে দলনেতা আফন্সো দ্য আলবুকার্ক এসে খুড়তুতো ভাই ফ্রান্সিস্কোর হাত থেকে দলের ভার নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছে।
ভারতের মাটিতে এটাই প্রথম ইওরোপিয় দুর্গ। প্রথমে এর নাম আলবুকার্কের যুদ্ধজাহাজ স্যান্টিয়াগোর নামে ফোর্ট স্যান্টিয়াগো রাখা হলেও দু বছর পরে পর্তুগালের তৎকালীন রাজার নামে এর নামকরণ করা হয় ফোর্ট ম্যানুয়েল। দুর্গ প্রতিষ্ঠার বছরখানেকের মধ্যেই দুর্গচত্বরে নির্মাণ করা হয় এশিয়ার প্রথম রোমান ক্যাথলিক চার্চ, পরে যা পাথরে বিনির্মিত হয়, যার নাম রাখা হয় সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চ।
আফন্সো দ্য আলবুকার্কের এই অভিযান শেষ পর্যন্ত অবশ্য তীব্র ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। জামোরিনের সঙ্গে ঝঞ্ঝাটের ফলে তাদের গোলমরিচ বিক্রি বন্ধ করে দেয় কালিকটের ব্যবসায়ীরা। যদিও লাভের জন্যে উৎসাহিত হয়ে কালিকটের কিছু ব্যবসায়ী তাদের মশলা কোচিনে পর্তুগিজদের পাঠাতে থাকে, প্রয়োজনের তুলনায় তা যথেষ্ট নয়। ফলে আরও দক্ষিণে কুইলন বন্দরে হাজির হয় তারা। সেখানেও জামোরিন তার প্রতিনিধি দল পাঠান কুইলনের রানিকে অনুরোধ করে যে তারা যেন পর্তুগিজদের গোলমরিচ বিক্রি না করে। রানি এই অনুরোধে কর্ণপাত না করলেও মশলা সংগ্রহে এই অভিযাত্রী দলকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। আফন্সোর খুড়তুতো ভাই ফ্রান্সিস্কো মশলা সংগ্রহ করছিল ক্যানানোর থেকে।
ফেরার পথে তাদের প্রবল সমস্যায় পড়তে হয়। দশটা জাহাজের মধ্যে মাত্র দুটো ফেরত যায় লিসবনে, অধিকাংশই হারিয়ে যায় সমুদ্রপথে। ফ্রান্সিস্কো সহ অনেকের সলিলসমাধি ঘটে।
তবু লাভের লোভে পর্তুগিজদের অভিযান লেগেই থাকে মালাবার উপকূলে। চলতে থাকে হিংস্রতা ও বর্বরতার প্রদর্শনও। ১৫০৪ সালে লোপো সোরেস দ্য অ্যালবারগারিয়া ও ১৫০৫ সালে ফ্রান্সিস্কো দ্য আলমিদার নেতৃত্বে ভারতে আসে পর্তুগিজ অভিযাত্রীদল। রাজা ম্যানুয়েলের নির্দেশে আলমিদাকে ভারতে নিযুক্ত প্রথম পর্তুগিজ ভাইসরয়ের সম্মানীয় পদ অর্পণ করা হয়। তার অভিযাত্রী দলের সদস্যরা ফিরে গেলেও সে ভারতে থেকে যায় স্থানীয় পর্তুগিজদের নেতা হিসাবে। ১৫০৯ সালের শেষদিকে তার অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই দায়িত্ব তার কাছ থেকে কেড়ে সমর্পণ করা হয় আগের অভিযাত্রী দলের নেতা আফন্সো দ্য আলবুকার্ককে।
১৫০৯ সালে কালিকট দমনে ব্যর্থ হয়ে আফন্সো দ্য আলবুকার্ক কোচিনে বসে সেনা সংগ্রহ করছিল। সে এখন ভারতে নিযুক্ত দ্বিতীয় পর্তুগিজ ভাইসরয়, এই অঞ্চলের সর্বেসর্বা। তার উদ্দেশ্য লোহিত সাগরের কাছে সুয়েজ আক্রমণ করা। মামলুকরা নাকি সেখানে ঘাঁটি গেড়েছে ভারতে মুসলমানদের ওপর পর্তুগিজ আক্রমণের বদলা নিতে। আলবুকার্কের সেনাদল বলতে এই মুহূর্তে তেইশটা জাহাজ, বারোশো পর্তুগিজ সেনা, চারশো পর্তুগিজ নাবিক, দুশো কুড়িটা কোচিনের মালাবারি সেনা আর হাজার তিনেক ক্রীতদাস যোদ্ধা। এই নিয়েই আলবুকার্ক ভেসে পড়ল, ভিনসেন্ট সোদ্রের মতই উত্তরদিকে। এক সপ্তাহ পরে তারা হাজির হল উত্তর কেরালার এড়িমালা বা মাউন্ট অফ এলিতে। সব জাহাজগুলোর ক্যাপটেনকে নিজের জাহাজে ডেকে তাদের মধ্যে আলোচনা হল। আলবুকার্ক বুঝিয়ে বলল, রাজা ম্যানুয়েলের ইচ্ছা যে আমরা হরমুজ দমন করি, কিন্তু মামলুকরা সুয়েজে যেভাবে ঘাঁটি গাড়ছে বলে শুনছি, ওদের বিনাশ না করে অন্য কিছু করা ঠিক হবে না এখন।
জাহাজ আবার ভেসে পড়ল, এসে পড়ল উত্তর কর্ণাটকের উপকূল শহর হোনাভারে। সেখানে টিমোজা নামে এক মালাবারি থিমাইয়া নেতা আলবুকার্ককে খবর দিল, এখন লোহিত সাগরের দিকে যাওয়া বিপজ্জনক, আবহাওয়া অনুকূল নয়। তার চেয়ে বরং তারা গোয়া যেতে পারে। গোয়া বন্দর খুব সুন্দর, সেখানকার শাসক বিজাপুরের সুলতান ইউসুফ আদিল শাহ সম্প্রতি মারা গেছেন, তার উত্তরাধিকারী ইসমাইল আদিল শাহ বাচ্চা ছেলে, অনভিজ্ঞ। গোয়ার অধিকাংশ মানুষ হিন্দু, তারা গত বার-তের বছরের মুসলমান শাসনে তিতিবিরক্ত। তার চেয়েও বড় কথা, জায়গাটা এখন মোটামুটি অরক্ষিত। আলবুকার্ক চাইলে টিমোজা তাকে তার দু হাজার সেনা দিয়ে সাহায্য করতে পারে গোয়া দখল করতে।
আবার দলের সমস্ত ক্যাপটেনকে ডেকে রুদ্ধদ্বার কক্ষে মন্ত্রণা করে আলবুকার্ক সবাইকে জানাল — মামলুক দমন ক্যানসেল। তারা এখন গোয়া দখল করতে চলেছে।
১৫১০ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্তুগিজ দল এসে পড়ল গোয়ার মান্ডভি নদীতে। সঙ্গে টিমোজির সেনাদল। পাঞ্জিম দুর্গের তুর্কি রক্ষী পর্তুগিজদের গোলায় আহত হয়ে দুর্গ ছেড়ে শহরের দিকে পালিয়ে যেতে খুব সহজেই সেই দুর্গ দখল হয়ে গেল। সঙ্গে উপরি পাওয়া গেল ওদের কিছু যুদ্ধাস্ত্রও। পরের দিন শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ডেকে আলবুকার্ক বলল, আপনারা মুসলমান শাসকের বিরোধিতা করে আমাকে সমর্থন করুন, আমি আপনাদের কর কমিয়ে দেব, আপনারা এখন থেকে নিজেদের ধর্মমতে পুজো-আচ্চা করতে পারবেন।
এক দিনেই গোয়া দখল হয়ে গেল। কেউ বাধা দিল না। পাওয়া গেল বিজাপুরের সুলতানের শ’ খানেক ঘোড়া আর গোটা পঁচিশেক হাতিও। কয়েকটা অসম্পূর্ণ নতুন জাহাজ। খবর দেওয়া ও গোয়ার হাল-হকিকত সম্বন্ধে অবহিত করার পুরস্কার স্বরূপ টিমোজাকে গোয়ায় পর্তুগিজ প্রতিনিধি ও প্রধান কর-সংগ্রাহকের ভূমিকা প্রদান করা হল। আলবুকার্ক ঘোষণা করল, শহরে লুণ্ঠন চালানো হবে না, কাউকে হত্যা করা হবে না।
আলবুকার্ক ভাবছিল, বিজাপুরের সুলতান কি এমনি এমনি ছেড়ে দেবে? সুযোগ পেলেই প্রত্যাঘাত হানবে। তাই শহরের রক্ষণ মজবুত করা হল। রক্ষণভাগের দেওয়ালের ফুটিফাটা সারানো হল। পরিখা আরো দীর্ঘ করা হল, ভরা হল জল দিয়ে। অস্ত্রশস্ত্র মজুত করা হল অস্ত্রাগারে। অসম্পূর্ণ জাহাজগুলো বানিয়ে নেওয়া হল, কাজে লাগানো হল পর্তুগিজদের ব্যবহারে। গোয়ার দ্বীপ থেকে মূল ভূখণ্ডে ঢোকার পাঁচ প্রধান এলাকায় মোতায়েন করা হল পর্তুগিজ সেনাদল। আলবুকার্ক শুনেছে, বিজাপুরের আগে এখানকার শাসক ছিল হিন্দুরা, বিজয়নগর সাম্রাজ্যের। তার অবস্থা যদিও পড়তির দিকে, তাতে কী! শত্রুর শত্রু তো মিত্রই।
লুই দো সালভাদর নামে এক খ্রিস্টান সন্ন্যাসীসহ এক প্রতিনিধিদলকে পাঠানো হল বিজয়নগর রাজসভায় মৈত্রীবন্ধনের প্রস্তাব দিয়ে।
আলবুকার্ক জানত না, কিছুদিন আগেই বিজাপুর আর বিজয়নগরের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। সুতরাং কোনো জায়গা আক্রমণ করতে হলে বিজাপুরকে এখন বিজয়নগরের ভয় পাওয়ার কারণ নেই। পুলাদ খান নামে এক তুর্কি সেনাপতির হাতে চল্লিশ হাজার সেনা দিয়ে ইসমাইল আদিল শাহ হুকুম দিল, যাও পর্তুগিজদের উচ্ছেদ করো। সেই সেনাদলে বহু তুর্কি ও পার্সি সেনা, তাদের সম্মিলিত আক্রমণে টিমোজার সেনারা উড়ে গেল। ইসমাইল আদিল শা নিজে তাঁবু ফেলল শহরে ঢোকার এক প্রধান তোরণের কাছেই। অপেক্ষা করতে লাগল, কখন বর্ষা আসে, এলেই পুলাদ খানকে হুকুম দেবে গোয়ার দ্বীপসমূহ থেকে পর্তুগিজদের উচ্ছেদ করার জন্যে।
ইসমাইল আদিল শাহের সেনাবাহিনীতেও এক পর্তুগিজ খ্রিস্টান সৈন্য ছিল। তাকেই দূত বানিয়ে তার মাধ্যমে আলবুকার্কের কাছে খবর পাঠানো হল, হয় তারা সবাই মিলে আত্মসমর্পণ করুক অথবা গোয়া ছেড়ে যেখানি খুশি পালাক। তিনি আরও জানালেন, ইসমাইল শহরের মুসলমানদের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে চলেছে, সে জানে পর্তুগিজরা কোথায় কতজন আছেন, তাদের প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর নজর রাখা হচ্ছে। পর্তুগিজরা দেখেছে কীভাবে অতি অল্প সেনা নিয়েও ভারতীয়দের যুদ্ধে পর্যুদস্ত করা যায়। আলবুকার্ক তার স্বদেশী শত্রুর আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন।
বর্ষা এসে গেলেই পর্তুগিজরা বুঝে গেল কত ধানে কত চাল। খাবার পচে যায়, সেগুলো মুখে দিলেই আন্ত্রিক গোলযোগে একের পর এক সেনারা মৃত্যুমুখে ঢলে পড়ে। দিনে দিনে তাদের সংখ্যা কমে আসে। অবস্থার সুযোগ নিয়ে মে মাসের মাঝামাঝি পুলাদ খান এক ঝড়জলের দিনে বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল পর্তুগিজদের ওপর। তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। স্থানীয় কিছু হিন্দুদের সাহায্য নিয়ে তারা শহরের অন্যত্র পালিয়ে গেল। মুসলমান শত্রুসেনাদের ভড়কে দিতে রাস্তায় ছিটিয়ে দিতে লাগল বস্তা বস্তা মহার্ঘ গোলমরিচ আর তাম্রপাত্র।
তবু এতে শেষরক্ষা হল না। গোয়া ছেড়ে পালাতেই হল তাদের। তবে রক্তের দোষ সহজে যাওয়ার নয়, তাই যাওয়ার আগে কাছেপিঠে যে সব মুসলমান গোয়াবাসী পুরুষদের পাওয়া গেল, সবার মুণ্ডচ্ছেদ করা হল। আদিল শাহের হারেমের রমণীদের তুলে নিয়ে গেল তারা, তাদের তুলে দেওয়া হল নিজেদের জাহাজের নাবিকদের হাতে। মে মাসের শেষ দিনে গোয়া পর্তুগিজবর্জিত হয়ে গেল অবশ্য। ইসমাইল আদিল শাহ ঢাকঢোল বাজিয়ে গোয়ার দখল নিল।
জুন মাসের প্রথম দিন আলবুকার্কের সহযোগীরা হাজির হল মান্ডভি নদীর মোহানায়। ঝোড়ো বর্ষার জন্যে তারা সমুদ্রে পড়তে পারছে না। জাহাজের মধ্যেই বন্দি হয়ে থাকল পরের মাস তিনেক। সঙ্গে খাবার অপ্রতুল। অবস্থা এমন যে ইঁদুর ধরে পুড়িয়ে খেতে হয়। নদীর জল এখানে ঘোলা, মাছ ধরার উপযুক্তও নয়। বৃষ্টি হলে পানীয় জল পাওয়া যায়, ওটাই যা রক্ষা। মাঝে মাঝে ওদের ওপর মুসলমান শত্রুরা গোলাবারুদ বর্ষণ করে। তবে তা এলোপাথাড়ি, নইলে কবেই তারা শেষ হয়ে যেত। তাও প্রাণের ভয়ে জাহাজ এক জায়গা থেকে সরিয়ে অন্যত্র ভিড়াতে হয়, ডেকে উঠে বসাও নিরাপদ নয়।
অবস্থা প্রায় বিদ্রোহ নেওয়ার পর্যায়ে চলে যাচ্ছিল। কেউ কেউ জাহাজ ছেড়ে পালিয়ে গেল। আলবুকার্ক সমস্ত জাহাজ ঘুরে ঘুরে দলের সকলের মনোবল ঠিক রাখার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল বটে, কিন্তু শেষরক্ষা বুঝি হয় না আর। অন্য ক্যাপটেনদের সঙ্গে আলবুকার্কের সম্পর্কের অবনতি শুরু হতে লাগল। একদিন জানা গেল, দলের একজন সকলের অজান্তে জাহাজ থেকে নেমে স্থানীয় একটা যুবতী মেয়ে তুলে এনে জাহাজে ফুর্তি করেছে। আলবুকার্কের আদেশ ছাড়া এমন নিয়মবিরুদ্ধ কাজ বরদাস্ত করা যায় না। আদেশ হল তার ফাঁসির। তার গলায় ফাঁস পরানো হবে, এমন সময় বাকি ক্যাপটেনরা ভীষণ আপত্তি জানাতে লাগল। তাদের আপত্তি এই কারণে নয় যে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে কেউ মৃত্যুদণ্ড পাচ্ছে। পর্তুগিজ একজন সম্মানীয় যোদ্ধার ফাঁসির মত নিকৃষ্ট শাস্তি হওয়া উচিত না, তার শিরশ্ছেদ করে তাকে সম্মান দেখানোই দস্তুর।
আলবুকার্ক তাদের কথায় কর্ণপাত করল না। ফাঁসিই হল তার।
অগাস্টের মাঝামাঝি অবস্থা কিছুটা অনুকূল হতে তারা মান্ডভি নদীর মোহানা ছেড়ে দক্ষিণে ক্যানানোরের দিকে অগ্রসর হল। উপকূলবর্তী এক দ্বীপে জল সংগ্রহ করতে নেমে তাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল আর এক দল পর্তুগিজ অভিযাত্রী দলের। রাজা ম্যানুয়েল দিয়েগো মেন্ডেস দ্য ভাস্কনসেলোসের নেতৃত্বে চারটে জাহাজ পাঠিয়েছেন সরাসরি মালাক্কার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপন করতে। ম্যানুয়েল ভেবেছিলেন, আগের বছর তিনি আর এক পর্তুগিজ নাবিককে যে পাঠিয়েছিলেন একই উদ্দেশ্যে, তারা বুঝি মালাক্কায় গিয়ে পৌঁছেছে। আলবুকার্ক ভাস্কনসেলোসকে বোঝাল, তেমন কিছু হয়নি, হলে সে জানতে পারত, সে এখন ভাইসরয়, এই অঞ্চলে পর্তুগিজদের সর্বেসর্বা। ভাস্কোনসেলোসকে বোঝাল, মালাক্কা যাওয়া নয়, তাদের উচিত এখন গোয়া দখল করা। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ভাস্কনসেলোস আলবুকার্কের কথা মেনে নিল।
হোনাভারে পৌঁছাতেই টিমোজা খবর দিল তার টিকটিকিরা খবর জোগাড় করেছে ইসমাইল আদিল শাহ ফের গোয়া ছেড়ে বেরিয়ে গেছে, এবার বিজয়নগরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে। যাদের গোয়াতে রেখে গেছিল, তাদের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে বিদ্রোহ হওয়ায় বেশ কিছু সেনা মারাও গেছে। সুতরাং আবার গোয়া আক্রমণ করা যেতে পারে।
ক্যানানোর পৌঁছে তারা জাহাজ নোঙর করে প্রথমেই জাহাজগুলো মেরামত করে নিল। রাজা ম্যানুয়েল নিয়ম করে দিয়েছেন কোন অভিযাত্রী দল ভারত অভিমুখে বাণিজ্য করতে বেরোলে পরের বছর একই সময়ে তাদের সাহায্য করতে আরও কিছু অতিরিক্ত নৌসেনা পাঠানো হবে। সেইমত ক্যানানোরে এসে পৌঁছেছে বেশ কিছু পর্তুগিজ জাহাজ ও সেনা। যে জাহাজগুলো এসেছিল, তাদের কয়েকটাতে মশলাপাতি ভরে লিসবনে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার পরেও তাদের সঙ্গে এখন ৩৪টা জাহাজ আর ১৬৮০ জন সদস্য। টিমোজা কিছু লোক জড়ো করে দিলে এখন আবার গোয়ায় হানা দেওয়া যেতেই পারে।
এর মধ্যে কোচিনের রাজা খবর পাঠিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে তাঁদের পরিবারের বড় শরিকের খুড়তুতো ভাইয়ের আবার ঝঞ্ঝাট বেধেছে, আলবুকার্ক যেন তাকে সাহায্য করে। পর্তুগালে নিয়মিত গোলমরিচ পাঠাতে হলে কোচিনের রাজাকে হাতে রাখতে হবে, কাজেই আলবুকার্ক সঙ্গে সঙ্গে কোচিনে এসে রাজার হাত শক্ত করতে ভয় পেয়েই ফিরে গেল শত্রুরা। টিমোজা আবার খবর পাঠাল, গোয়াতে এখন মাত্র আট দশ হাজার সেনা মোতায়েন করা আছে, সেগুলোর কিছু শ্বেতাঙ্গ পার্সি বা তুর্কি আর বাকিরা স্থানীয় লোক। টিমোজা এখন হাজার চারেক লোক আর গোটা ষাটেক নৌকা জোগাড় করে দিতে পারবে। হোনাভারের রাজার কাছ থেকে পাওয়া যাবে আরও হাজার পনেরসেনা।
চব্বিশে নভেম্বর পর্তুগিজ সেনাদল ফের জড়ো হল মান্ডভি নদীর মোহানায়। কিছু লোক নামিয়ে দেওয়া হল যারা চুপি চুপি শহর ঘুরে এসে রিপোর্ট দেবে গোয়ার রক্ষণের অবস্থা কেমন। আলবুকার্ক তার সেনাদলের প্রধানদের নিয়ে আবার এক রুদ্ধদ্বার মিটিং করল। ঠিক হল, নিজেদের তিনটে দলে ভাগ করে গোয়ার রক্ষণে হামলা করা হবে। এক দলের নেতৃত্বে থাকবে সে নিজে, পশ্চিম দিকে জাহাজঘাটা বিধ্বস্ত করার চেষ্টা করবে সে। নদীর ধারে শহরের উত্তর তোরণে আক্রমণ চালাবে বাকি দুই দল, যাদের একটার নেতৃত্বে থাকবে ভাস্কনসেলোস।
পঁচিশে নভেম্বর, সেন্ট ক্যাথেরিন্স ডে। সেইদিন শুরু হল পর্তুগিজ আক্রমণ। নদীর ধারের রক্ষণভাগে অতর্কিত গোলাবর্ষণে শ্বেতাঙ্গ রক্ষীরা ছত্রখান হয়ে গেল। পর্তুগিজদের পরনে ইস্পাতে মোড়া পোশাক, তির ছুঁড়ে তাদের ঘায়েল করা সহজ নয়। একের পর এক হাতবোমা ছুঁড়তে ছুঁড়তে পর্তুগিজরা এগিয়ে এল উত্তর তোরণের দিকে। দিশেহারা রক্ষীরা গেট বন্ধ করারও সুযোগ পেল না, তার আগেই বেশ কিছু পর্তুগিজ সেনা ঢুকে পড়ল রক্ষণশিবিরে। অবশ্য এর পরে তারাও খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে গেল। দু পক্ষেই অনেকে শ্বেতাঙ্গ। গেটের দু-প্রান্তে দুই দলের সেনাই একবার গেট বন্ধ করার উপক্রম করছে, আর একবার খোলার! এর মধ্যেই একজন পর্তুগিজ সেনা এক বাড়ির ছাদে ‘পর্তুগাল জিতে গেছে, পর্তুগাল জিতে গেছে’ বলে চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে পর্তুগালের পতাকা উড়িয়ে দিতে রক্ষীরা পুরো হতচকিত হয়ে গেল। শেষ চেষ্টা হিসাবে কেউ কেউ ইসমাইল আদিল শাহের রাজপ্রাসাদে ঢুকে একটা ক্ষীণ রক্ষণের প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, ভাস্কনসেলোসের দলের সেনারা এসে গোলাবর্ষণ করতে তারাও ভূপতিত হল।
মাত্র পাঁচ ঘন্টায় গোয়ার রক্ষণ বিচূর্ণ হয়ে গেল। শত্রু সেনারা এমনকি সাধারণ মানুষও দলে দলে শহর ছেড়ে পালাতে লাগল। তাদের অধিকাংশই মুসলমান, যাদের পর্তুগিজরা সহ্য করতে পারে না। পালাতে গিয়ে পরিখার সাঁকো পেরোনোর সময় নিজেদের মধ্যে হুড়োহুড়ি শুরু হতে অনেকে জলে পড়ে ডুবে মারাও গেল। স্থানীয় হিন্দুদের অনেকে পর্তুগিজদের সাহায্যে এগিয়ে এল।
আলবুকার্ক ব্যস্ত ছিল পশ্চিমে জাহাজঘাটায়, এই যুদ্ধে নিজে সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ পায়নি সে। টিমোজার সেনাদলও অনেক পরে পৌঁছেছে। শত্রুরা পালিয়ে যেতে আলবুকার্ক ভাল করে শহরের বিভিন্ন জায়গা পর্যবেক্ষণ করে নিল যাতে শত্রুদের কেউ ঘাপটি মেরে উপস্থিত না থাকতে পারে। তারপর সৈন্যদের বলল, যাও, চারদিন ছুটি, শহরে যে যা পার লুঠ করে নাও। শুধু জাহাজঘাটা আর অস্ত্রাগারে হাত দিও না, ওগুলো এখন পর্তুগালের রাজার সম্পত্তি। আর হিন্দুরা আমাদের বন্ধু, ওদের ওপর অত্যাচার কোরো না।
যে সব স্থানীয় মুসলমানরা শহর ছেড়ে পালায়নি, ইসমাইল আদিল শাহের সেনাদের সাহায্য করার অভিযোগে তাদের একে একে হত্যা করা হল। এত মানুষের লাশ শহরে ছড়িয়ে রাখলে প্লেগের প্রাদুর্ভাব হতে পারে, তাই তাদের লাশ ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেওয়া হতে লাগল নদীর জলে কুমিরদের দিকে।
যুদ্ধে পর্তুগিজদের জনা পঞ্চাশের মৃত্যু হল, তিরের ঘায়ে আহত শ’ তিনেক। আটশো শ্বেতাঙ্গ তুর্কি-পার্সি আর ছ’ হাজার স্থানীয় মুসলমান ও সেনা প্রাণ হারাল।
শহর সম্পূর্ণ পর্তুগিজ নিয়ন্ত্রণে এলে ডিসেম্বরের প্রথম দিনেই আলবুকার্ক গোয়ার শাসনব্যবস্থা ও রক্ষণ সুদৃঢ় করতে মনোযোগী হলেন। শহরের পুরনো দুর্গ ভেঙে নতুন দুর্গ ইওরোপিয় ধাঁচে প্রস্তুত করার বরাত দেওয়া হল কুড়িজন পর্তুগিজ রাজমিস্ত্রি ও স্থানীয় শ্রমিকদের। সেই দুর্গে মোতায়েন করা হল চারশো পর্তুগিজ সেনা আর আশিজন তিরন্দাজ। জলপথে শত্রু হানা রুখতে নৌসেনা গঠিত হল দুটো বড় বড় জাহাজ আর চারটে ছোটবড় যুদ্ধনৌকার সমন্বয়ে। টিমোজাকে প্রধান কর-সংগ্রাহকের পুরনো দায়িত্ব ফিরিয়ে দিলেও তার সেনাদলের বিরুদ্ধে স্থানীয় হিন্দুদের প্রভূত অভিযোগ থাকায় রক্ষণবিভাগ থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হল।
গোয়া বিজয় সমাপ্ত হতেই ভাস্কোনসেলোস আলবুকার্কের কাছে অনুমতি চাইল, তাকে এবার মালাক্কা যেতে দেওয়া হোক। আলবুকার্ক অনুমতি দিল না। ভাস্কোনসেলোস ক্রুদ্ধ হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করল, অনুমতির তোয়াক্কা না করে নিজের দলবল নিয়ে পাড়ি জমাতে উদ্যোগী হল। তাকে বন্দী করা হল, তার জাহাজগুলোর নাবিকদের ফাঁসিতে চড়িয়ে আলবুকার্ক নিজেই মালাক্কা অভিমুখে রওনা হল ১৫১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে।
ইসমাইল আদিল শাহের সেনাধ্যক্ষ পুলাদ খানের নেতৃত্বে এক বিপুল সেনাদল গোয়া পুনরুদ্ধার করতে আবার আক্রমণ করে শহরের বাইরে এক দুর্গ ও শহরে প্রবেশের নতুন সাঁকো বানিয়ে। গোয়ার দ্বীপভূমি তাদের দখলে চলে আসে। কিন্তু সেই সময় ইসমাইল আদিল শাহ পুলাদ খানকে সরিয়ে রসুল খানকে এই কাজে পাঠালে তারা গোয়ার ওপর আঘাত হানতে ব্যর্থ হয়। ১৫১২ সালের অগাস্টে আলবুকার্ক ফিরে আসে, তার সঙ্গে আসে লিসবন-প্রেরিত আরও এক বড়সড় সেনাদল। তারা রসুল খানের বাহিনীকে পর্যুদস্ত করলে তারা শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য হয়। গোয়া কাগজে কলমে পুরোপুরি পর্তুগিজদের দখলে চলে যায়।
আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের পর এই প্রথম কোন ইওরোপিয় সেনাদল ভারতের মাটিতে শুধু যুদ্ধই করল না, ভূখণ্ডে নিজের কর্তৃত্ব অর্জন করল। গোয়া দখলের ফলে পূর্ব পৃথিবীর জলপথে পর্তুগিজদের একাধিপত্য স্থাপিত হল। গোয়ার বন্দর অতি চমৎকার, ঝড়-বৃষ্টির থেকে সুরক্ষিত। উপযুক্ত সেনা মোতায়েন করলে শত্রুরা সহজে সমুদ্রপথে এখানে আক্রমণ করতেও পারবে না। এখান থেকে ভারতের পশ্চিম উপকূলের সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব কায়েম করাও অসম্ভব নয়। আর তা সম্ভব হলে পর্তুগিজদের আর রোখে কে!
ভারতের মূল ভূখণ্ডে যুদ্ধের প্রধান অঙ্গ হচ্ছে অশ্বারোহী সেনাবাহিনী। ভারতীয় অশ্ব তেমন তেজি নয়। যুদ্ধের উপযোগী সবচেয়ে ভাল ঘোড়া হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের, আরবি বণিকরা তা কেনাবেচা করে। উত্তর ভারতে দিল্লির হাটে ঘোড়া কেনাবেচা হয় বণিকদের, দক্ষিণের রাজাদের কাছে তা পৌঁছাবার একমাত্র উপায় আরব সাগরের জলপথ। আলবুকার্ক পর্তুগালের রাজাকে চিঠি লিখে জানাল যে, পারস্য ও আরব থেকে আগত সমস্ত ঘোড়া কেনাবেচার ওপর পর্তুগালের কর্তৃত্ব কায়েম করা হোক, কেননা বিজয়নগর ও অন্যান্য দাক্ষিণাত্যের রাজারা এই ঘোড়ার জন্যে যে কোন মূল্য দিতে প্রস্তুত। যার বেশি ভাল ঘোড়া, যুদ্ধে তারই জিত। রাজার স্বীকৃতি আসতেই আলবুকার্ক ডিক্রি জারি করল জাহাজে আসা আরব ও পারস্যের সমস্ত ঘোড়া একমাত্র গোয়াতেই বিক্রি করা যাবে, অন্য কোন বন্দরে নয়। পর্তুগিজ সেনারা আরব সাগরে ঘোড়াভর্তি জাহাজ দেখলেই তাদের জোর করে গোয়া পাঠাতে লাগল। বিজয়নগর ও বিজাপুর দুই রাজ্যই তাদের প্রতিনিধি পাঠাল গোয়া থেকে যুদ্ধের ঘোড়া কেনার একচেটিয়া নিলামের শর্ত নিয়ে। এরা মাঝে মধ্যেই পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধে রত হয়, কাজেই দু পক্ষেরই ভাল ঘোড়া চাই। শর্ত অনুযায়ী যে বেশি দাম দেবে, সেই ঘোড়া কিনতে পারবে, অন্য পক্ষ নয়। আলবুকার্ক দু পক্ষের প্রস্তাবেই সম্মত হয় এবং দু পক্ষকেই গোপনে অতিরিক্ত দামে ঘোড়া বেচতে থাকে। ঘোড়ার ওপর প্রদত্ত কর থেকেই গোয়ার রাজস্বের অর্ধেক উঠে আসতে থাকে।
এর পর আলবুকার্ক তার পর্তুগিজ সঙ্গীদের উৎসাহিত করতে থাকে স্থানীয় মেয়েদের বিয়ে করে গোয়াতে সংসারী হয়ে বসতে। আলবুকার্ক নিজে বিয়ে করেনি, আফ্রিকান রক্ষিতার গর্ভজাত তার এক ছেলে ছিল। সে নিয়ম জারি করল, যারাই ভারতীয় স্ত্রী গ্রহণ করবে, তারা থাকার জমিজায়গা পাবে। স্থানীয় মহিলারা সম্পত্তির অধিকার পাবে। অনেক মহিলাই খ্রিস্টান হয়ে এই মারকুটে নোংরা লোকদের বিয়ের পরিবর্তে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। অনেকে অনন্যোপায় হয়ে শান্তির পথ খুঁজতে মেনেও নেয়। এইসব বিয়ে থেকে জন্ম নেওয়া মিশ্র প্রজাতিতে পরবর্তীতে ভরে যায় গোয়ার সরকারি নিম্ন দপ্তর।
গোয়াবাসীদের সমর্থন পেতে এর সঙ্গে আলবুকার্ক আদিল শাহের আমলের কিছু কর মকুব করে দেয়। পুরনো গোয়ার বাইরে তিরিশটা গ্রামে জনগণকে তাদের ধর্মমতে পুজার্চনার অধিকার ফিরিয়ে দেয়। ক্রিস্টানরা অবশ্যই সব ব্যাপারে অগ্রাধিকার পেতে থাকে, তবে হিন্দুরাও মন্দিরে পুজোটুজো দিতে পায়। বিবাহিত পুরুষের মৃত্যু হলে বিধবা স্ত্রীর সহমরণ অর্থাৎ সতীদাহ প্রথা বন্ধ করে দেওয়া হয় গোয়ায়।
আলবুকার্কের বয়স এখন পঞ্চাশের কোঠায়, কিন্তু স্বপ্ন তার আকাশছোঁয়া। পৃথিবী মুসলমানশূন্য করতে সে ঠিক করে মিশর দখল করে নীলনদের গতিপ্রবাহ অন্য খাতে বইয়ে দেবে, যাতে জল না পেয়ে মুসলমানপ্রধান মিশর মরুভূমি হয়ে যায়। ধ্বংস করবে আলেকজান্দ্রিয়া, সুয়েজ। পুড়িয়ে দেবে মক্কা। ১৫১৩ সালে এডেন গিয়ে ভাবল লোহিত সাগরের তীরে মুসলমানদের দুর্গগুলো ধ্বংস করবে। সেই অভিযান চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়, পর্তুগিজদের প্রবল ক্ষতি হয় সেই অভিযানে।
১৫১৫ সালে তার দলহাজির হয় পারস্য উপসাগরের হরমুজ দ্বীপে। সেখানে বংশানুক্রমে যারা রাজত্ব করছিল, তাদের মধ্যে এক সমস্যা উপস্থিত হয়েছে, চতুর আলবুকার্ক তাতে মধ্যস্থতা করে দ্বীপটা বাগে আনবে ঠিক করল। সেই দ্বীপের রাজাকে বন্দী করে তার ভাইপো সিংহাসনে বসেই সিংহাসনের দাবিদার তার প্রজন্মের অন্য পনেরজন ভাইকে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে তাদের চোখের সামনে লোহিততপ্ত ধাতব শলাকা ধরে অন্ধ করে দিয়েছে। আলবুকার্ক নির্দেশ দিল এটা অমানবিক, জ্যাঠা অর্থাৎ পূর্বতন রাজাকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে ভাইপো যেন পর্তুগিজদের জাহাজে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে, সে ভাইপোকে উপযুক্ত কার্যক্রম ঠিক করতে সাহায্য করবে। ভাইপোকে পর্তুগিজ জাহাজে খুন করা হল, তার জ্যাঠা পুরনো রাজাকে বানিয়ে দেওয়া হল পর্তুগালের অধীন এক পাপোষ রাজা। সেই দ্বীপে আলবুকার্ক তুলে দিল এক বড়সড় পর্তুগিজ দুর্গ, তার মাধ্যমে স্থাপিত হল পারস্য ও ভারতের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন।
উপসাগরীয় জলবায়ু অবশ্য আলবুকার্কের সহ্য হচ্ছিল না। সেখানে আমাশায় আক্রান্ত হয়ে সে ভারতে ফেরা মনস্থ করল।
ফেরার পথে খবর পেল লিসবনে তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু হয়ে গেছে। পর্তুগালের রাজা ভাইসরয় হিসাবে তাকে সরিয়ে অন্য একজনের নাম প্রস্তাব করতে চলেছেন। অসুস্থ আলবুকার্ক এই খবর শুনে গর্জে উঠল। যার জন্যে এত চুরি, সেই বলে চোর! এ সে কিছুতেই বরদাস্ত করবে না। সে যতদিন বেঁচে আছে, ভারতে পর্তুগিজ ভাইসরয় অন্য কেউ হতে পারবে না।
নাবিকদের আদেশ দিল দ্রুত গোয়া পৌঁছানোর। সেখানে ধনী সম্ভ্রান্ত পর্তুগিজদের জন্যে বড় হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছে, দুদিন সেখানে চিকিৎসা করালেই সেরে উঠবে। তারপর দেখা যাবে, কে সেই ব্যক্তি যে তাকে টপকে ভাইসরয় হতে চায়।
মান্ডভি নদীর মোহানা ছেড়ে আলবুকার্কের জাহাজ ঢুকে পড়ল পুরনো গোয়ায়। ক্লান্ত অবসন্ন রুগ্ন আলবুকার্ক বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দেখল পরিচিত দৃশ্য। জাহাজ নোঙর করছে বন্দরে। কালো কালো ভারতীয় মাঝিমাল্লাদের হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে। সেও গলা তুলে কাউকে ডেকে কিছু বলতে চাইল। গলা দিয়ে শব্দ বের হল না, তার ডাক আর কারো কানে গিয়ে পৌঁছাল না। ততক্ষণে পরপারের ডাক এসে গিয়েছে তার।
মুসলমানদের দমন করতে হিন্দু বিজয়নগরের রাজার সঙ্গে আলবুকার্কের মৈত্রীচুক্তি ভারতে পর্তুগিজদের এক দুর্দান্ত সুবিধা এনে দিয়েছিল। বিজয়নগর বিজাপুরের আদিল শাহ বাহিনীকে উপর্যুপরি পর্যুদস্ত করে পর্তুগিজদের উৎসাহিত করে গোয়ার সংলগ্ন বিস্তৃত ভূখণ্ডে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে। পরে আদিল শাহের বংশের একজনকে সমর্থনের বদলে তার কাছ থেকে বর্দেজ ও সালসেট আদায় করে নেয় পর্তুগিজরা, সেগুলো যুক্ত করে গোয়ার সঙ্গে। এইভাবে পর্তুগিজ-শাসিত গোয়ার আয়তন পূর্বতন গোয়ার প্রায় চারগুণ হয়ে যায়।
নতুন এই গোয়াতে চার্চভীরু খ্রিস্টানদের ধর্মীয় রূপের আসল চেহারা প্রকাশ পায় বেশ কিছুটা পরে। ১৫৩৮ সালে প্রথম একজন পর্তুগিজ বিশপ হাজির হন গোয়ায়। এতদিন পর্তুগিজদের শত্রুতা ছিল মূলত মুসলমানদের ওপর, হিন্দুরা ছিল বন্ধুর মতই। এইবার তাদের কোপ নেমে আসে হিন্দুদের মাথাতেও। একের পর এক হিন্দু মন্দির ধ্বংস করা শুরু হয়। ১৫৪২ সালে ভারতে প্রথম হাজির হন একজন রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মযাজক — ফ্রান্সিস জেভিয়ার। তিনি এক অনন্যসাধারণ মানুষ, তাঁর দাপটই আলাদা। দক্ষিণ মালাবার উপকূলে এক মাসে দশ হাজার গ্রামবাসীকে জোর করে খ্রিস্টানধর্মে দীক্ষা দেওয়ার রেকর্ড গড়েন তিনি। তাঁর নেতৃত্বে শুরু হয় গণ ধর্মান্তর। ধ্বংস হওয়া মন্দিরের জায়গায় একের পর এক তোলা হয় গির্জা। মাত্র দশ বছর তিনি ছিলেন ভারত ও দূরপ্রাচ্যে, তাতেই এই অঞ্চলে ধর্মীয় সমীকরণ বদলে যায় অনেকটা।
১৫৫২ সালে তাঁর মৃত্যুর আগে তিনি পোপকে নির্দেশ দিয়ে যান গোয়াতে যেন খ্রিস্টানদের নব-প্রবর্তিত ধর্মীয় আইনটি রুজু করা হয়। পোপ তা মঞ্জুর করেন ১৫৬০ সালে। সেই নির্দেশের ফলে পরবর্তী আড়াইশো বছর ধরে গোয়াতে সাধারণ মানুষের ওপর চলতে থাকে ধর্মের নামে খ্রিস্টানি নারকীয় আইনি হত্যালীলা — গোয়া ইনকুইজিশন — যার কাছে এ যাবৎ অনুষ্ঠিত পর্তুগিজ পাশবিক প্রবৃত্তির সমস্ত উদাহরণ ম্লান।
তবে এসব বেশ কিছুটা পরের কথা। ১৫২৬ সালে পর্তুগালের রাজা তৃতীয় জনের আদেশে গোয়াকে পর্তুগালের রাজধানী ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর লিসবনের সমান আইনি গুরুত্ব প্রদান করা হয়। ততদিন পর্যন্ত পর্তুগিজ গোয়াতে নিজস্ব আইন বলতে লিখিত কিছু ছিল না। বিভিন্ন ধর্মমতে যে যেমন পারত নাটকের মত মুখে মুখে আইনের বুলি আউড়ে দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা করত।
সেই একই সময়ে দিল্লির কাছে পানিপথে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে আর এক চিত্তাকর্ষক নাটক, যার শেষ অঙ্ক স্থির করবে পরবর্তী অন্তত দুশো বছরের ভারতের ভবিষ্যৎ।