|| তিন ||
যে সমস্ত বস্তু দুর্গন্ধযুক্ত, তাতে যেমন লেগে থাকে শয়তানের স্পর্শ, তারা যেমন হানিকর, তেমনি সুগন্ধি বস্তু নিশ্চয় খাঁটি, পুণ্যকর, টেঁকসই। অন্তত সে রকমই ধারণা ছিল অতীতে। রাজারাজড়া মারা গেলে তাদের মমি বানিয়ে রাখা হত, মৃতের গায়ের লাগানো হত সুগন্ধি আতরের প্রলেপ। এসব গন্ধদ্রব্য আসত কোত্থেকে? ধুনোজাতীয় গাছের আঠা বা রজন, যা পোড়ালে সুগন্ধ বেরোয়, তা তো ছিলই, যা থেকে পারফিউম অর্থাৎ ‘ধোঁয়া থেকে উৎপন্ন’ শব্দটা এসেছে। পশ্চিম ভারত থেকে মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ মরুতে যে কাঁটাগুল্ম জন্মায়, তাদের কাণ্ডের রস পোড়ালেও আগরবাতির মত গন্ধ পাওয়া যায়। তবে ফুলের পাপড়ি ছাড়া সুগন্ধের অন্যতম উদ্ভিজ্জ উৎস হচ্ছে মশলা। মিশরে পিরামিড বানানোর আগে থেকেই গন্ধদ্রব্য নিয়ে মানুষের কারবার।
সমাজের উঁচু তলার মানুষরা নিচুতলার মানুষদের বদগন্ধ সহ্য করতে পারত না বলেই এই সব সুগন্ধি জ্বালিয়ে তাদের থেকে দূরে থাকত। গাছের পাতা, বীজ, শিকড়, কাণ্ড, রসে চলল সুগন্ধির সন্ধান। বেটে গায়ে মাখলে অনেক সময় ফাটা-ছেঁড়া চামড়ায় উপকারিতা পাওয়া যায় দেখে এর ভেষজ গুণ সম্বন্ধে অবহিত হল মানুষ। কোনটা সাধারণ খাবার, কোনটা রোগির পথ্য, কোনটাই বা ওষুধ, এত সব বাছবিচারের জ্ঞান তখনও শুরু হয়নি। যা মাথায় দেওয়া যায়, তা খেতেই বা বাধা কোথায়, বিশেষ করে তাদের স্বাদ যদি হয় ঝাঁঝালো বা মিষ্টি? খাবারের গন্ধ ও স্বাদে তারতম্য আনতে মশলার ব্যবহার শুরু হল।
বহু প্রাচীনকাল থেকেই ভারতের সঙ্গে পশ্চিমের তিন তিনখানা বাণিজ্যপথ ছিল। সবচেয়ে পুরনোটা অবশ্যই পারস্য উপসাগর দিয়ে। সিন্ধুনদের মোহনা থেকে টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিসের মুখ অবধি সামুদ্রিক পথে বাণিজ্যতরণীতে, তারপর ইউফ্রেটিসের উজানে যতদূর যাওয়া যায়। সেখান থেকে সিরিয়া বা লেভান্তের বন্দরগুলো আর কত দূর? দ্বিতীয় রাস্তাটা পশ্চিমের গিরিপথগুলো দিয়ে। খাইবার পাস পেরিয়ে বলখ, সেখান থেকে নদী বা ভূমিপথে কাস্পিয়ান সাগরে, সেখান থেকে আবার নদী বা ভূমিপথে লেভান্তে। তৃতীয় পথ এডেন বন্দর হয়ে লোহিত সাগরপথে সুয়েজ, সেখান থেকে পশ্চিমে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া, পুবে টায়ার বা সিডন।
খ্রিষ্টের জন্মের অন্তত তিনশো বছর আগে থেকেই চিন, ভারত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহ, আরব ও পূর্ব আফ্রিকার মধ্যে জলপথে বাণিজ্যের রমরমা অবস্থা ছিল। চিনের পূর্ব উপকূল থেকে বাণিজ্যতরী নোঙর করত ভারতের পশ্চিম উপকূলে। গুজরাত থেকে মালাবার উপকূলের সমস্ত নাবিক তিনকোণা পাল খাটিয়ে কীভাবে সামুদ্রিক মৌসুমী বায়ুকে কাজে লাগিয়ে সমুদ্রযাত্রা দ্রুতগতিতে সমাধা করা যায়, তা জানত। গৃহপালিত উটের পিঠে চাপিয়ে রেশম, মশলাপাতি, পোর্সেলিন, আগরবাতি, নীল, হস্তিদন্ত এমনকি ক্রীতদাস বেচাকেনা হত এই নৌ-বাণিজ্যে। ভারতে মৌর্য রাজাদের সঙ্গে চিনের হান বংশের রাজাদের, পারস্য ও ভূমধ্যসাগরতীরের রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাটদের বাণিজ্যিক সু-সম্পর্ক ছিল। চিনের রেশম আর ভারতের মশলা কিনতে রোমান সম্রাটরা অকাতরে খরচ করত প্রভূত স্বর্ণমুদ্রা। রোমান ঐতিহাসিক স্ট্র্যাবো লিপিবদ্ধ করে গেছেন রোমান সম্রাট অগাস্টাসের দরবারে দক্ষিণ ভারতীয় পাণ্ড্য রাজার দূতের কথা। দার্শনিক প্লিনি তো রীতিমত চেঁচামচি করতেন, প্রতি বছর রোমান রমণীদের মনোরঞ্জনের জন্য ভারত আর চিন থেকে এই যে অন্তত দশ কোটি স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা খরচা করে মশলা, আগরবাতি আর রেশমবস্ত্র কেনা হচ্ছে, এর কত অংশ ঈশ্বরের সেবায় আর কতটাই বা মৃতাত্মাদের ভোগে লাগে? তেমনি পারস্যের রত্নরাজি বিপুল দাম দিয়ে কিনতেন ভারতের মৌর্য সম্রাট।
শুধু বস্তুই নয়, একই পথে এর সঙ্গে চালাচালি শুরু হল জ্ঞান ও ধর্মের। জৈন, বৌদ্ধ ও হিন্দুধর্ম ছড়িয়ে পড়ল পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে। অনেক পরে সেই একই পথ ধরে মুসলমান ধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটল ভারতে।
মধ্যযুগেও বাণিজ্যের এই ধারা প্রবলভাবে অব্যাহত থাকে। আরবের উমায়দ আর আব্বাসিদ খলিফারা ভারত মহাসাগরে বাণিজ্যে প্রবল উৎসাহী ছিল। মহম্মদ নিজে ছিলেন একজন ব্যবসায়ী ও বাণিজ্য-পর্যটকদলের নেতা। ধনী মুসলমান-শাসিত দেশে মূল্যবান সামগ্রীর চাহিদা প্রচুর বেড়ে যায় এই সব বাণিজ্যতরীর আনাগোনায়। চিনে টাং ও সং বংশের রাজারা সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী অবধি রেশম-বাণিজ্যে অগ্রণী ভূমিকা নেন ও জলপথে বাণিজ্যে উৎসাহ দেন। জলপথে বাণিজ্য যাতে শান্তিতে নির্বিঘ্নে সমাধা হতে পারে, তার জন্যে তারা শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। এই বাণিজ্যের ফলে ভারতে চোল রাজারা খুব লাভ করত। বিদেশী বণিকদের জন্যে তারা শহরে অপার প্রমোদের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। উপকূলে তরণী ভিড়লেই তাদের স্বাগত জানাত স্বর্ণাভরণে সজ্জিত হাতির দল। চিন থেকে আগত বাণিজ্যতরী বর্তমান ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে দিয়ে মালাক্কা প্রণালী হয়ে আসত। সেখানে ঘাটে তরণী ভেড়ানোর কর আদায় করেই শ্রীবিজয় সাম্রাজ্যের কপাল খুলে গেল। কাম্বোডিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চল খমেরের অ্যাঙ্করেও মেকং নদীকে বাণিজ্যপথ বানিয়ে ভারত মহাসাগরের পথে বাণিজ্য করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে চিনের মিং রাজাদের শাসনকালে অ্যাডমিরাল ঝেং হে সুদূর পূর্ব আফ্রিকায় হাজির হয়েছিলেন চিনের মূল্যবান রেশমের সম্ভার নিয়ে।
এ সবেরই অপার আকর্ষণে একদিন ভারতের পশ্চিম উপকূলে হাজির হয়ে গেল পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো ডা গামা।
* * *
দেশে ফিরতেই ভাস্কো ডা গামা আর তার সাঙ্গোপাঙ্গদের জন্য রাজকীয় সম্বর্ধনার আয়োজন করা হল। তারা ভারতে যাওয়ার জলপথ আবিষ্কার করে ফেলেছে, মানে খুলে গেছে মশলার বাণিজ্য করে বিপুল লাভের রাস্তা। তারা সঙ্গে এনেছে সেই মশলার নমুনা। খোদ ভারত থেকে সরাসরি এসেছে এই মশলা, আরব মুসলমানদের অশুভ-স্পর্শ নেই এতে। আহা, কী অপূর্বই না হবে এর গন্ধ, এর স্বাদ!
অভূতপূর্ব দামে সেই মশলাপাতি বিক্রি হল পর্তুগালে। তিনখানা জাহাজ নিয়ে ভাস্কোর এতদিনের যাত্রায় যত খরচ হয়েছিল, তার ষাটগুণ বেশি মুদ্রা পাওয়া গেল সেই সামান্য মশলা বিক্রি করেই।
আর এ তো কিছুই না। এই প্রথম যাত্রার উদ্দেশ্য তো মুদ্রা আয় করা ছিল না, ছিল শুধু পথটাই জেনে আসা। এতেই যদি এত লাভ হয়, তবে এর পর থেকে তো পর্তুগালের পোয়াবারো। ভাস্কোরা শুধু ভারতই দেখে আসেনি, নিজের চোখে দেখেছে সেখানেও আছে খ্রিস্টের উপাসক! এদের সৈন্যসামন্ত তেমন যুদ্ধপটু নয়, জলপথে যুদ্ধ করার কামান-টামান এদের নেই, ছোট ছোট জাহাজে মালপত্রের ব্যবসাই বোঝে এরা। তবু তো খ্রিস্টানই! যদিও তাদের গির্জাগুলো অন্যরকম দেখতে, যদিও তাদের ধর্মবিশ্বাস হয়ত একটু অন্যরকম, সে তো হতেই পারে। হয়ত তারা পুরোপুরি খ্রিস্টান হতে পারেনি এখনও। তাদের পুরোদস্তুর খ্রিস্টান বানিয়ে দিতে পারলেই হতচ্ছাড়া মুসলমানদের ওপর হানা যাবে নিরঙ্কুশ আঘাত। পুরো ভারত মহাসাগর জুড়ে পর্তুগিজদের আধিপত্য এখন ঠেকায় কে!
পর্তুগালের রাজা সাতিশয় আহ্লাদিত হলেন। তিনি নিজেই নিজেকে গিনি, ইথিওপিয়া, আরব, পারস্য ও ভারতে সাম্রাজ্যস্থাপন, যাতায়াত ও বাণিজ্যের একচ্ছত্র অধিপতিরূপে ঘোষণা করে দিলেন। প্রতিবেশী স্পেনের রাজা ফার্দিনান্দ ও রানি ইসাবেলার কাছে তার চিঠি গেল – আমার দেশের খ্রিস্টান অভিযাত্রীরা ভারতে গিয়ে দেখে এসেছে সেখানে খ্রিস্টের উপাসনা হচ্ছে, কিন্তু তারা পুরোপুরি খ্রিস্টান নয়। যখন আমরা তাদের পুরো খ্রিস্টান করে তুলতে পারব, তখন মুসলমানদের সমূহ বিনাশ করা সম্ভব হবে। মুসলমানরা ওখানকার মশলার বাণিজ্যে যে অঢেল সম্পদ কামায়, ঈশ্বরের ইচ্ছায় সেটাও এখন থেকে আমাদের হতে চলেছে।
পরবর্তী অভিযানের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল অবিলম্বে। ভাস্কোর দলের দেশে ফিরে আসার ছ’মাসের মধ্যেই দ্বিতীয় অভিযাত্রী দল রওনা দিল ভারতের উদ্দেশে। এবারে তেরোখানা জাহাজ, পনেরোশো লোক, সঙ্গে প্রচুর যুদ্ধাস্ত্র। খবর চাউর হয়ে গেলে পথে বিপদ এসে যেতে পারে অযাচিত, কোনো ঝুঁকি নেওয়ার দরকার নেই।
তবে এবারে অভিযাত্রীদলে ভাস্কো নেই। এবারের সর্বাধিনায়কের নাম পেড্রো আলভারেজ কাব্রাল। ভাস্কোর মত কাব্রালের নৌ-অভিজ্ঞতা বা মারামারি করার মনোভাব নেই, তার নির্বাচন অনেকাংশেই রাজনৈতিক। তাকে উপযুক্ত সাহায্য করার জন্যে কাস্তিলের নির্বাসিত অভিজাত সাঞ্চো দ্য তোভারকে সহ-সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ভাস্কো কালিকটে গিয়ে মারামারি করে জামোরিনের সঙ্গে ঝামেলা পাকিয়ে এসেছে। এবার যাতে সেই ভুল না হয়, তার জন্যে মূল্যবান উপহাররাজি ও রাজকীয় ভাষায় লেখা রাজা ম্যানুয়েলের গাদাখানেক চিঠি সঙ্গে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের।
পেড্রোর কপাল মন্দ। যাত্রা শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই বিশাল সমুদ্রঝড়ে তার একখানা জাহাজ এমন ক্ষতিগ্রস্ত হল, যে সেটা আর ব্যবহারযোগ্য রইল না, তাকে লিসবনে ফেরৎ পাঠিয়ে দেওয়া হল। বাকি জাহাজগুলো নিয়ে কাব্রাল পাড়ি দিল দক্ষিণ-পশ্চিম অভিমুখে। আটলান্টিকের এই অঞ্চলে তখন সেই অভিমুখেই বাতাস বইছে, ভূমধ্যরেখা অতিক্রম করলে তা ঘুরে যাবে, তখন দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে আসা বাতাস পালে লাগালে জাহাজ তরতরিয়ে তাদের নিয়ে যাবে উত্তমাশা অন্তরীপে। এ ভাবেই ভাস্কো ডা গামা ওইপথে গেছিল আগেরবার।
এবার কিন্তু অন্য রকম হল। পর্তুগাল থেকে যাত্রা শুরুর দেড় মাস পরে তারা দেখা পেল উপকূলের, কিন্তু কূলের কাছাকাছি বাতাস এত তীব্র যে সেখানে জাহাজ নোঙর করা সম্ভব হল না, ঘুরিয়ে তাদের যেতে হল উত্তরে আরও পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার। একটা ছোট নৌকায় একজন নেমে উপকূলের কাছাকাছি পৌঁছে দেখে সেখানে এক ডিঙি ভাসছে, তাতে দুজন কালো মানুষ। লোকদুটোকে ধরে নিয়ে সে ফেরত এল তাদের জাহাজে। তাদের সাথে যে ভাষাতেই কথা বলতে যায়, তারা কিছুই বোঝে না। তাদের পোশাক টোশাক পরানো হল, খেতে দেওয়া হল মধু আর কেক। মুখে দিয়েই হড়হড়িয়ে বমি করে ফেলল তারা। এমন অখাদ্য তারা খায়নি কোনোদিন! জাহাজের মধ্যে মুরগি দেখে তাদের চোয়াল ঝুলে গেল।
পরদিন সেই দুজন স্থানীয়কে নিয়ে জাহাজের দুজন গেল উপকূলে, দেখা গেল সেখানে তখন তির-ধনুক নিয়ে হাজির হয়েছে বেশ কিছু উৎসাহী স্থানীয় মানুষ। আটক দুজনের নির্দেশে তারা তাদের হাতের ধনুক ফেলে দিল। পর্তুগিজ দুজন নৌকা থেকে নেমে পাত্র ভরে জল নিয়ে এল সেখানকার এক ঝর্ণা থেকে।
পরবর্তী এক সপ্তাহে দুপক্ষের আদানপ্রদান বাড়ল খানিকটা। পর্তুগিজরা ওদের লোহার পেরেক, জামাকাপড়, মালা, ক্রুশ এসব উপহার দিল। বদলে ওরা দিল ওদের কুড়ুল, টিয়াপাখি, বাঁদর। স্থানীয়দের ভাবভঙ্গি দেখে কাব্রাল ভাবল, এখানে হয়ত সোনারুপো পাওয়া গেলেও যেতে পারে। কয়েকজন কয়েদিকে সেসব দেখার জন্যে রাত্রে স্থানীয়দের সঙ্গে ছেড়ে দেওয়া হল, বাকিরা থাকতে লাগল জাহাজেই।
সপ্তাহখানেক পরে অবশ্য কাব্রাল অধৈর্য হয়ে গেল, তার গন্তব্য তো ভারত! উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে সেখানে পৌঁছাতে অনেক দিন সময় লাগবে। এখানে পড়ে থাকলে চলবে না। সে নির্দেশ দিল সবাইকে তৈরি হয়ে নিতে। অবশ্য এই যে একটা নতুন দেশ আবিষ্কার হয়ে গেছে, এটাও তো পর্তুগালের রাজাকে জানানো দরকার। স্পেনের রাজার সহায়তায় ক্রিস্টোফার কলম্বাস নতুন দেশ আবিষ্কার করার পর স্পেনের পোয়াবারো, সেই দেশে কলম্বাস একের পর এক নতুন নতুন জাহাজ নিয়ে আসছে আর যাচ্ছে। পর্তুগালের রাজা ম্যানুয়েলও নিশ্চয় এই দেশের কথা জানলে খুশি হবেন। একটা জাহাজের ক্যাপ্টেনকে এই দেশের কথা চিঠিতে লিখে সে সেটা লিসবনে ফেরৎ যেতে নির্দেশ দিয়ে দিল, সঙ্গে দিয়ে দিল এখান থেকে পাওয়া উপহার সামগ্রীও। কয়েদিদের কয়েকজন পড়ে থাকল এই নতুন দেশেই। পরের দিন বাকি জাহাজগুলো পাড়ি দিল আফ্রিকার দক্ষিণতম প্রান্তের উদ্দেশে।
এ যাত্রাতেও প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে পড়ল কাব্রাল। চার চারখানা জাহাজ বেমক্কা ডুবে গেল সেই ঝড়ের ধাক্কায়, তাতে যারা ছিল একজনেরও খোঁজ পাওয়া গেল না। সাতখানা জাহাজও পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ রাখতে পারছিল না বলে সঙ্গে দুখানাকে রেখে বাকিগুলোকে অন্যপথ দিয়ে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যেতে বলল কাব্রাল। তাদের মধ্যে একখানাও আলাদা হয়ে গেল, তার দেখা মিলল না। বাকি তিনটে তার তিনটের সঙ্গে মিলে মোট ছখানা জাহাজ নিয়ে হাঁচোড়-পাঁচোড় করতে করতে ১৫০০ সালের এক শরত-মধ্যাহ্নে কোনমতে যখন কালিকটে উপস্থিত হল পেড্রো, ততদিনে ছমাস পেরিয়ে গেছে। কালিকটের পুরনো বৃদ্ধ জামোরিন এর মধ্যে মারা গেছেন, নতুন জামোরিন জানেন এই পর্তুগিজরা মারকুটে যুদ্ধবাজ। ঝামেলায় না গিয়ে তিনি কালিকট উপকূলে একটা কুঠি নির্মাণের অনুরোধ মঞ্জুর করে দিলেন।
কিন্তু স্বভাব যায় না ম’লে। অবিলম্বে পেড্রোর পর্তুগিজ আর বাণিজ্য করতে-আসা আরব বণিকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বেধে গেল। পর্তুগিজরা আরবদের কাছে দাবি করল, জামোরিন তাদের কুঠি বানাতে দিয়েছে মানে গোলমরিচ কেনাবেচার নিরঙ্কুশ অধিকার এখন তাদেরই। আরবরা সরাসরি গোলমরিচ কিনতে পারবে না চাষি বা ভারতীয় বণিকদের কাছ থেকে, কিনতে হলে তাদের কাছ থেকেই কিনতে হবে। আরবরা তা মানবে কেন? ফলে ব্যাপক ঝঞ্ঝাট শুরু হল। পর্তুগিজরা আরবদের একটা গোটা জাহাজ দখল করে নিল। আরবরা ক্ষেপে গিয়ে পালটা আঘাত হানতে তিরিশ-চল্লিশজন পর্তুগিজ মারা পড়ল। পেড্রো জামোরিনকে জানাল, আরবরা সমস্ত গণ্ডগোলের মূলে, জামোরিন যেন ওদের নিরস্ত করেন। জামোরিন দেখলেন ব্যাপারটা তা নয়, বরং সূত্রপাত হয়েছে পর্তুগিজদের দিয়েই, তাই তিনি নিরপেক্ষ রইলেন, ভাবলেন ওদের অন্তর্দ্বন্দ্বে তাঁর নাক না গলানোই ভাল।
রগচটা পেড্রোর সেটা সহ্য হল না, সে তার জাহাজ থেকে কালিকটের উপকূলস্থ ঘরবাড়ির ওপর গোলাবর্ষণের নির্দেশ দিল। বৃষ্টির মত গোলা ছুটে আসতে লাগল শহরে। কয়েকটা ভারতীয় জাহাজ দখল করে নিল সে। শ্রীলঙ্কা থেকে আসছিল একটা মশলাভর্তি জাহাজ, তাতে ছিল কয়েকটা হাতিও। একটা হাতিকে আর জাহাজে যারা ছিল সবাইকে মেরে ফেলতে তার একটুও হাত কাঁপল না।
দুদিন ধরে শহরে গোলাবর্ষণ চলল পেড্রোর জাহাজগুলো থেকে। কাঠের মহামূল্য প্রাসাদগুলো ধ্বংস হয়ে গেল। মারা পড়ল বহু নিরীহ মানুষ। জামোরিনের ভাগ্য ভাল, এই ব্যাপক গোলাবর্ষণের আঘাত সহ্য করতে পারল না পেড্রোর জাহাজগুলোও। প্রতিটা গোলা ছোঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে জাহাজে যে প্রতিক্রিয়া হয়, তার ফলেই জাহাজের কাঠে ফাটল ধরতে লাগল। যুদ্ধ বন্ধ করে পেড্রো জাহাজ নিয়ে চলল দক্ষিণে। সে শুনেছে কোচিনের সঙ্গে কালিকটের পুরনো ঝগড়ার কথা। কোচিনে পৌঁছে ওদের রাজার সঙ্গে হাত মিলিয়ে কালিকট ধ্বংস করতে হবে।
একশো মাইল দক্ষিণে কোচিন। সেখানকার রাজা পেড্রোর জন্যে লাল কার্পেট বিছিয়ে দিল, অনুমতি দিল যত খুশি মশলাপাতি কিনবার। একটা কুঠি বানানোর অনুমতি মিলে গেল। পক্ষকালের মধ্যেই পেড্রোর জাহাজ প্রায় ভরে উঠল মহার্ঘ মশলায়। কাছাকাছি ক্র্যাঙ্গানোর নামে এক জায়গা থেকে দুজন খ্রিস্টান পাদ্রি দেখা করতে এল পেড্রোদের সঙ্গে। ততদিনে অবশ্য পেড্রোর সঙ্গে আসা খ্রিস্টান ধর্মযাজকেরা বুঝে ফেলেছে কালিকট বা কোচিনে যাদের সঙ্গে তাদের দেখা হয়েছে, সেই দেশীয় মানুষরা খ্রিস্টান নয়, হিন্দু। কাজেই দুই খ্রিস্টান রাজ্যের সমঝোতার ব্যাপারটা এখানে আর প্রযোজ্য নয়।
এর মধ্যে খবর এসেছে কালিকটের জামোরিন তার সশস্ত্র জাহাজবাহিনি নিয়ে দক্ষিণে আসছেন পেড্রোর সন্ধানে। পেড্রোর জাহাজে যথেষ্ট মশলা এখন, তাছাড়া এত গোলাবর্ষণে জাহাজের স্ক্রু ঢিলে হয়ে গেছে বেশ। এখন আর যুদ্ধ-টুদ্ধের ইচ্ছে নেই তার। রাতের অন্ধকারে সে জাহাজ ভাসিয়ে দিল সমুদ্রে। খেয়াল পড়ল না কোচিনের কুঠিতে রয়ে গেছে জনা তিরিশেক সঙ্গী। মরুক গে, ওরা ওদের ব্যবস্থা করে নেবে ঠিক, তাছাড়া কোচিনের রাজার সঙ্গে তার বেশ সদ্ভাব হয়ে গেছে।
পরদিন অবশ্য দুই পক্ষের সাক্ষাৎ হয়েই গেল সমুদ্রে। কিন্তু আবারও ঠিক সেই সময়েই সমুদ্রের বুকে নেমে এল বিশাল কুয়াশা। চারিদিকে কিছুই দৃশ্যমান নয়। সে কুয়াশা সরে গেল যখন, জামোরিন চতুর্দিকে নজর করেও পেড্রোর জাহাজের টিকির সন্ধান পেলেন না।
পেড্রো ততক্ষণে তার জাহাজ ভাসিয়ে দিয়েছে উত্তরে। কালিকট পেরিয়ে আরও উত্তরে আশি মাইল গেলে ক্যানানোর বন্দর। সেখানকার রাজাও তার মশলা বিক্রি করতে চান পেড্রোদের। এখানে মশলা আরও সস্তা, সংগ্রহ করতে পারলে প্রচুর লাভ। ফলে ক্যানানোরে মশলায় টইটুম্বুর করে ফেলা হল সবগুলো জাহাজ।
একটা হাতি মারা হয়েছিল কালিকটে। তার মাংস লবণে জারানো হয়েছিল। সেটাই প্রধান খাদ্যবস্তু হল তাদের বাড়ি ফেরার পথে। বিপরীত যাত্রায় আর একখানা জাহাজও তলিয়ে গেল সমুদ্রে। তেরোখানা জাহাজ নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল, বাড়ি ফিরল মাত্র পাঁচখানা। ততদিনে ১৫০১ সালের সাতখানা মাস অতিক্রান্ত।
আবারও প্রচুর লাভ। আবারও উৎসব। পেড্রো পর্তুগালের রাজাকে বোঝালো, যদিও এরা খ্রিস্টান নয়, হিন্দু, তবে তাতে কোনো অসুবিধা নেই। এই হিন্দুরা আরবের মুসলমানদের মত নয়। এদের রাজাদের বশ করা অতিশয় সহজ। যুদ্ধের থেকে শান্তির দিকেই তাদের আগ্রহ বেশি।
সে অবশ্য ভালই জানে, কালিকটে তাকে আর কেউ বরণ করে নেবে না। জামোরিনের সঙ্গে এত বেশি ঝামেলা হয়েছে যে সম্পর্কের বারোটা বেজে গেছে। কিন্তু সেটাও সমস্যা নয়। কালিকটের চেয়ে কোচিন বন্দর হিসাবে অনেক ভাল, জাহাজ নোঙর করার সুব্যবস্থা প্রচুর সেখানে। গোলমরিচের চাষিদের সঙ্গে কোচিনের যোগাযোগ বেশি। আর তাছাড়া কালিকটের চেয়ে নিজেদের শক্তি কম বলে কোচিনের রাজা চান তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজের শক্তি বাড়িয়ে কালিকটকে টেক্কা দিতে। এটা এক সুবর্ণ সুযোগ।
ঠিক হল কালিকট নয়, কোচিনই হবে ভারত উপকূলে পর্তুগিজদের প্রধান ঘাঁটি।
পেড্রো আলভারেজ কাব্রাল পর্তুগাল ফিরে যাবার ছ’ মাসের মাথায় আবার এক বড়সড় অভিযাত্রীদল বেরিয়ে পড়ল ভারতের উদ্দেশে। নেতৃত্বে ফিরে এল ভাস্কো ডা গামা স্বয়ং। পনেরোটা জাহাজ ছাড়ল পর্তুগাল থেকে ১৫০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে, তাদের সঙ্গে আফ্রিকার পূর্ব উপকূল থেকে যোগ দিল আরও পাঁচখানা। এখন যখন জানা হয়েই গেছে ভারত উপকূলে ওগুলো খ্রিস্টানদের সাম্রাজ্য নয়, রাজনৈতিক ব্যাপার এবার আর নেই, পুরোপুরি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বেরোলো পর্তুগিজ দল। যত বেশি সম্ভব মুদ্রা উপার্জনই তাদের লক্ষ্য। পর্তুগালের রাজা নিজে এই অভিযানের পরিচালক, তিনি চান ভারতের সঙ্গে পর্তুগালের বাণিজ্য যেন হয় রাজ-তদারকিতে।
ভারতের কাছাকাছি আসতেই তারা দেখা পেল এক জাহাজের, তার নাম মিরি। মক্কা থেকে হজ সেরে ফিরছে পুণ্যকামী মুসলমানেরা। এই তো, এদের কাছে নিশ্চয় প্রচুর মুদ্রা আছে, ভেবে ভাস্কো আদেশ দিল তার জাহাজগুলোকে ওদের ওপর চড়াও হতে। পর্তুগিজ সেনা উঠে পড়ল মিরিতে। হজযাত্রীরা তাদের সঙ্গে যা মুদ্রা-অলঙ্কার ইত্যাদি ছিল, সেগুলো নিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়ার জন্যে কাকুতি মিনতি করতে লাগল। ভাস্কো অনড়। সেসব মুদ্রা-অলঙ্কার তো কেড়ে নিলই, জাহাজের স্টোরে ঢুকে দেখল সাজানো আছে আরও কিছু মূল্যবান বস্তু। সেগুলো নামিয়ে নিজেদের জাহাজে চড়িয়ে মিরিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে ভাস্কো জাহাজ নিয়ে এগিয়ে গেল। পর্তুগিজরা মশাল ছুঁড়ে আগুন ধরিয়ে দিল মিরিতে।
খানিকটা এগিয়ে গিয়ে ভাস্কো ফিরে তাকিয়ে দেখল, কই, দাউ দাউ করে আগুন তো জ্বলছে না সমুদ্রের ওপর। তবে কি কোনোভাবে আগুন নিভিয়ে ফেলেছে মিরির লোকজন। জাহাজ ফুরিয়ে আবার পেছনে চলল ভাস্কো। দেখল, হ্যাঁ, যেমন ভেবেছে তাই। মিরির লোকজন একসঙ্গে জলটল ঢেলে কোনোভাবে আগুন নিভিয়ে ফেলেছে। মশাল হাতে আবার চড়াও হল তারা। অসহায় মুসলমান রমণীরা তাদের কোলের শিশুকে তুলে ধরে তাদের প্রাণের জন্যে আকুলি বিকুলি করতে লাগল। গায়ের সমস্ত অলঙ্কার ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিতে লাগল পর্তুগিজদের দিকে। সেগুলো সমস্ত কুড়িয়ে নিয়ে পর্তুগিজ জাহাজে তুলে নেওয়া হল।
ঠিক যে মুহূর্তে পুণ্যার্থীরা ভাবছে তারা এ যাত্রা বেঁচে গেল, তখনই ভাস্কোর জাহাজ থেকে উড়ে এল কামানের গোলা। পুরো জাহাজে আগুন ধরে গেল। জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা গেল মিরির সমস্ত মানুষ। উল্লাসে দাপাতে দাপাতে ভাস্কোর দল এগিয়ে চলল মালাবার উপকূলের দিকে। ভারতে পৌঁছানোর আগেই তাদের বেশ কিছু রোজগার হয়ে গেছে এবার।
কালিকট থেকে একটু দূরে নোঙর করল ভাস্কো ডা গামার জাহাজগুলো। এরমধ্যে কালিকটের জামোরিনের কাছে খবর এসে গেছে মিরি জাহাজের ভয়াবহ পরিণতির কথা। তাছাড়া কাব্রাল কালিকটে গোলা ছুঁড়ে কী ভীষণ ক্ষয়ক্ষতি করে গেছে, তাও তাঁর অজানা নয়। জামোরিন ভয় পেয়ে গেছেন। ভাস্কোর কাছে তাঁর দূত এল শান্তির বার্তা নিয়ে। ভাস্কো ভেবেছিল এখানে নির্ঘাৎ ঝামেলা বাধবে, সে প্রস্তুতিও নিচ্ছিল সেই অনুযায়ী। এখন হঠাৎ মেঘ না চাইতেই জলের মত সন্ধিপ্রস্তাব আসতে তার মগজ খুলে গেল। সে দাবি করল কাব্রালের অনুচরদের কাছে যে সমস্ত জিনিসপত্র ছিল, যা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল আগেরবার, তার পুরো ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আর কালিকট থেকে আরব বণিকদের তাড়াতে হবে। ভারত থেকে মশলার বাণিজ্যের একচ্ছত্র অধিকার থাকবে শুধু তার।
দাবি শুনে জামোরিন রেগে গেলেও প্রকাশ্যে রাগ না দেখিয়ে তিনি লিখে পাঠালেন ঝামেলা বেশি করেছে পর্তুগিজরাই। কাব্রালের গোলাগুলিতে কালিকটের যা ক্ষতি হয়েছে, তার তুলনায় তাদের ক্ষতি কিছুই না। আর মিরি থেকে তারা যা ধনসম্পদ লুঠ করেছে, তা তাদের হারানো সম্পত্তির কয়েক গুণ। আর আরবরা এই দেশে বাণিজ্য করছে কত পুরুষ ধরে, তা তিনি নিজেই জানেন না। তাদের এখান থেকে চলে যাবার নির্দেশ দেওয়ার নৈতিক অধিকার তাঁর নেই।
চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি। ভাস্কো জানিয়ে দিল, তার দাবি না মানলে পরের দিন থেকে সে কালিকটে গোলা ছুঁড়তে শুরু করবে।
উপকূলে বেশ কয়েকটা ছোট ছোট নৌকা ছিল। ভাস্কো সেগুলো আটক করে তার মাঝিমাল্লাদের বন্দী করে রাখল। পরদিন দুপুরে এক এক করে তাদের ফাঁসি দেওয়া শুরু করল সে। এক এক করে চৌত্রিশজনকে ফাঁসি দিল এইভাবে। মৃতদেহগুলোর হাত পা মাথা তলোয়ারের কোপে কেটে আলাদা করে ফেলল। সকলের সেই কাটা হাত-পা মাথার টুকরোগুলো জড়ো করল একটা নৌকায় আর সেটাকে ভাসিয়ে দিল বন্দরের দিকে। সঙ্গে গেল তার বার্তা – কাব্রালের সঙ্গীদের যারা মেরেছে, তাদের মৃত্যু হবে এর চেয়েও শোচনীয়ভাবে। বন্দরের কাছে সেই নৌকাটা উলটে দেওয়া হল, কাটা হাত-পা-মুণ্ডুগুলো জোয়ারের জলে ভাসতে ভাসতে এক এক করে আসতে লাগল উপকূলের বেলাভূমিতে। সে এক শিহরণ-জাগানো দৃশ্য।
অবিলম্বে শুরু হয়ে গেল কালিকট শহরের ওপর গোলাবর্ষণও।
ভাগ্যক্রমে তখনকার জাহাজের কামানগুলো খুব বিশাল বিশাল নয়। জাহাজের ব্যারেল বানানো কাঁচা লোহার পাতলা পাত মুড়ে, তাতে বারুদ আর কতই বা ধরবে? শ’ দুই গজের বেশি দূরে তারা গোলা ছুঁড়তে পারত না। কাব্রালের গোলাবর্ষণে ক্ষতিগ্রস্ত শহরের ওপরে ফের যাতে গোলাগুলি চালাতে না পারে, তার জন্যে জামোরিন উপকূল ধরে নারকেল গাছের গুঁড়ি পুঁতে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁর দুর্ভাগ্য, সঞ্চয়ে গোলাবারুদ বা অস্ত্রশস্ত্র নেই এমন যা দিয়ে এই ভয়ঙ্কর পর্তুগিজদের মোকাবিলা করা সম্ভব। ভাস্কো তার জাহাজগুলো উপকূলের খুব কাছে নিয়ে এসে গোলা ছুঁড়তে লাগল। নারকেলের গুঁড়ি বিশেষ কাজে এল না, দুশো গজের মধ্যে যা যা ঘরবাড়ি ছিল, সব ধ্বংস হতে লাগল। দুদিন অবিশ্রান্ত এই নারকীয় ধ্বংসলীলা চালিয়ে ভাস্কো এগিয়ে গেল কোচিনের দিকে। কালিকটে রেখে গেল ছখানা জাহাজ, যাতে বন্দরে কেউ ঢুকতে না পারে, বন্দর ছেড়ে বেরোতেও না পারে।
এর মধ্যে ক্যানানোর বন্দর ছেড়ে এক আরব বণিক বন্দরের শুল্ক না দিয়েই পালাচ্ছিল, ক্যানানোরের রাজা তাকে ধাওয়া করে ধরে আনতে জাহাজ পাঠিয়েছিল। ভাস্কো তার এক জাহাজ লেলিয়ে দিল আরব জাহাজটার সন্ধানে। আরব বণিক শুল্ক দিতে বাধ্য হল। দেওয়ার সময় রাজার নামে কিছু গালাগালি করেছিল, এই অপরাধে পর্তুগিজরা তাকে মেরেধরে অজ্ঞান করে তার মুখের মধ্যে পুরীষ ঢুকিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিল।
অথচ কোচিনে এই ভাস্কোরই আবার অন্য রূপ। কোচিনের রাজার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলায় বদ্ধপরিকর। কোচিনেও আরব বণিকদের প্রাধান্য, তারা জানে কালিকটে এরা কী করে এসেছে। স্বভাবতই তারা পর্তুগিজদের দেখতে পারে না। ভাস্কো কৌশলে হিন্দু রাজার সঙ্গে তাদের বিরোধ বাধিয়ে দিল এক গরুর জীবন বাঁচিয়ে। মুসলমানরা একটা গরু বিক্রি করেছিল পর্তুগিজদের, কেটে খাওয়ার জন্যে। রাজা ক্ষুব্ধ হয়ে ভাস্কোর কাছে প্রতিবাদ করলেন, তাঁর রাজ্যে গরু কাটা নিষেধ। মুসলমানরা আবার গরু বিক্রি করতে এলেই ভাস্কো তাদের বন্দী করে হত্যা করল। রাজার কাছে খবর গেল, পর্তুগিজরা রাজার ইচ্ছামত কাজ করেছে।
এই ধরনের বর্বরতা অবশ্য শুধু মুসলমানদের ওপরেই সীমাবদ্ধ রইল না। ভাস্কো যখন কোচিনে তখন কালিকটের জামোরিনের বার্তা নিয়ে এক হিন্দু পুরোহিত কোচিনে এলে ভাস্কো তাকে আটক করে গরম লোহা দিয়ে তার সারা গায়ে ছ্যাঁকা দিতে শুরু করে। যন্ত্রণায় পুরোহিতটা স্বীকার করে যে সে একজন গুপ্তচর। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে সে কাকুতি মিনতি করতে থাকে আত্মহত্যা করার জন্যে। ভাস্কো রাজি হয় না, বলে কালিকটের জামোরিনের কাছে তাকেই পাঠানো হবে দূত হিসাবে। ভাস্কোর চিঠি নিয়ে তাকে ফেরৎ পাঠানো হল কালিকটে। তার আগে অবশ্য কেটে নেওয়া হল তার দু’ ঠোঁট। তার কান কেটে সেখানে লাগিয়ে দেওয়া হল কুকুরের কান।
এ সবের ফাঁকেই কোচিন থেকে মশলা ভরে নেওয়া হল পর্তুগিজ জাহাজে। জাহাজ সারাই করে নেওয়াও হল। কুইলন আর দক্ষিণের শহরগুলো থেকে সংগ্রহ করা হল এই সব মশলাপাতি। মাঝে একবার ক্যানানোর গিয়ে সেখানকার শাসকের সঙ্গে চুক্তি করা হল সেই বন্দর ব্যবহার করার ব্যাপারে। কোচিন থেকে পাকাপাকি জাহাজ ভাসানোর আগে কোচিনের রাজার সঙ্গে কাগজে কলমে চুক্তি স্বাক্ষরিত হল যে কোচিনে পর্তুগিজদের এক বড়সড় ঘাঁটি বানানো হবে। তাকে বলা হবে ফ্যাক্টরি। সেই ফ্যাক্টরির জন্যে একজন ফ্যাক্টরকে সেখানে রেখে দেওয়া হল, যে কাজকর্মের তদারকি করবে। তার সঙ্গে থাকবে কেরানি, মিস্ত্রি আর পাহারাদাররা। পরবর্তী অভিযানের আগে এরাই মশলাপাতি কেনাকাটা করে রাখবে নিকটবর্তী শহরগুলো থেকে।
ক্যানানোর থেকে আদা জাহাজে তোলার জন্যে ভাস্কো জাহাজ ভাসালো উত্তরে। পথে কালিকটের জামোরিনের পাঠানো বত্রিশটা বড় বড় জাহাজের এক বিশাল বাহিনী ঘিরে ধরল তাদের। প্রত্যেকটা জাহাজে কয়েকশো মানুষ আর সঙ্গে বাঁধা কিছু ছোট ছোট নৌকা। জামোরিন অনেক অপমান সহ্য করেছেন, তিনি এর শেষ দেখতে চান এবার।
ঠিকমত যুদ্ধ হলে এবার নিঃসন্দেহে ভাস্কো পালিয়ে বাঁচতে পারত না। এতগুলো মানুষকে একসঙ্গে প্রতিরোধ করার মত ব্যবস্থা তার ছিল না। কিন্তু এবারও ভাগ্য সহায় হল তার। বড় বড় কয়েকটা গোলা ছুঁড়তেই শত্রুরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। জামোরিনের জাহাজের কিছু গেল ডুবে, কিছুতে আগুন ধরে গেল। জামোরিনের চোখের সামনে তার সাধের জাহাজগুলো পুড়তে লাগল। ভাস্কো বেরিয়ে গেল ক্যানানোরের দিকে।
সেখানে জাহাজে যা জায়গা ফাঁকা ছিল, সব ভরে নেওয়া হল দামি মশলায়। ক্যানানোরেও কিছু সঙ্গীকে রেখে দেওয়া হল সেখানে ফ্যাক্টরি বানানোর জন্যে আর ভবিষ্যতে মশলাপাতি কেনাকাটা করে রাখার জন্যে। পাঁচটা জাহাজ রেখে দিল ভাস্কো ক্যানানোর আর কোচিনের ফ্যাক্টরির সুরক্ষা দেখভাল করার জন্যে। সেই জাহাজগুলোর দায়িত্ব দিল তার নিজের কাকা ভিনসেন্ট সোদ্রেকে।
১৫০২ সাল শেষ হওয়ার তিন দিন আগে ভাস্কো বেরিয়ে গেল পর্তুগালের উদ্দেশে। এবারের অভিযানে সে শুধু মহার্ঘ মশলা সংগ্রহ করেছে, তাই নয়। মালাবার উপকূলে রীতিমত ত্রাস সঞ্চার করে ভবিষ্যতে পর্তুগিজ ব্যবসার পথ প্রশস্ত করে ফেলেছে। এখানে তাদের বাধা দেওয়ার শক্তি আর এদের নেই।
পর্তুগিজ অভিযান লেগেই রইল এর পর একের পর এক। চলতে থাকল বাণিজ্য ও অকথ্য বর্বর নিষ্ঠুরতা। তবে তার জন্যে ভাস্কো ডা গামার আর প্রয়োজন হয়নি। দীর্ঘ বাইশ বছর পর ভাস্কো আবার ফিরে এসেছিল মালাবার উপকূলে, পর্তুগিজ ভাইসরয় হয়ে। তবে সেই তার অন্তিম যাত্রা। মাত্র তিনমাস পরেই কোচিনে তার মৃত্যু হয়। সান্তো আন্তোনিও চার্চে – পরে যার নাম হয় সেন্ট ফ্রান্সিস – কবর দেওয়া হয় তার মরদেহ। তারও পনের বছর পরে সেই কফিন চার্চ থেকে তুলে পর্তুগিজরা ফিরিয়ে নিয়ে যায় তাদের দেশ পর্তুগালে। পৃথিবীর প্রথম নাবিক যে ইওরোপ থেকে সরাসরি ভারতে আসার জলপথ আবিষ্কার করেছিল, যে হয়ে থাকতে পারত শ্রদ্ধেয় ও বরেণ্য, তার স্বাভাবিক বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার ওপরে উঠতে না পারার জন্যে তার শেষযাত্রাও হল সাদামাটা, তাতে শ্রদ্ধার চিহ্ন প্রকাশ পেল না তেমন।
অবশ্য ততদিনে গোয়া নামক এক অদ্ভুত সুন্দর বেলাভূমিতেও জাঁকিয়ে বসেছে পর্তুগিজরা।
* * *
সৈয়দ হুসেন খাঁ-ই যে ক’বছর পরে সুলতান হুসেন খাঁ হবে, সে কি আর ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পেরেছিল সুবুদ্ধি রায়? গৌড় শহরের শাসনকর্তা সুবুদ্ধি রায় দিঘি খোঁড়ার বরাত দিয়েছিল হুসেন খাঁকে, আর সেই কাজে নিরন্তর গাফিলতি দেখে তার শাস্তি ধার্য করেছিল প্রকাশ্যে চাবুক মারার। পরে সুলতান হলেও সে চাবুকের দাগ শরীরে রয়েই গেল হুসেন শাহের। কিন্তু সুবুদ্ধি রায়ের ওপর তার ক্রোধ জাগেনি। হাজার হোক কাজের বরাত তো সেই পেয়েছিল, যদিও দিঘি খোঁড়ার চেয়ে গোটা রাজ্যটা হাতিয়ে নেওয়াই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য।
সে কাজ সফল হলে সুবুদ্ধি রায়েরও পদোন্নতি ঘটল। শাস্তি তো নয়ই, সুলতান হুসেন শাহ তাকে মন্ত্রিত্ব প্রদান করলেন।
কিন্তু সুলতান মাপ করলে কী হয়, বেগম সাহেবার নজরে পড়ল স্বামীর শরীরে সেই লম্বা-লম্বা দাগের। অনিচ্ছুক স্বামী তার কারণ ব্যক্ত করতে নারাজ, পত্নীও ততই কৌশলী হয়ে এর ইতিহাস জানতে উৎসাহী। বেশিদিন চেপে রাখা গেল না, কথায় কথায় সুলতান বলে ফেললেন ও দাগ চাবুকের। বেগম জেনে গেলেন সেই চাবুক খাওয়ার পেছনে যিনি দায়ী তিনি স্বয়ং মন্ত্রী সুবুদ্ধি রায়। বেগম গোঁসা করলেন, সুলতান যতক্ষণ না তার ওপর অত্যাচারের প্রতিশোধ নিচ্ছেন, ততক্ষণ তিনি তার মুখদর্শনে রাজি নন। পুরুষ মানুষের পৌরুষ যদি না থাকে, যদি সে নিতান্ত ম্যাদামারা হয়, কোন স্ত্রী তার ওপর শ্রদ্ধাশীল থাকে?
অনিচ্ছাসত্ত্বেও সুবুদ্ধি রায়ের শাস্তিবিধান করতেই হল সুলতানকে। মুসলমান সুলতানের জলপাত্র থেকে জল পান করতে বাধ্য করা হল ব্রাহ্মণসন্তান সুবুদ্ধি রায়কে।
মর্মাহত সুবুদ্ধি রায় এই অনাচারের বিধান প্রার্থনা করলেন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতমহলে। নিয়ম অনুযায়ী তার ব্রাহ্মণত্ব শুধু নয়, হিন্দুত্বও চলে গেছে ম্লেচ্ছর হাতের জল পান করে। ব্রাহ্মণরা একবাক্যে বললেন, এ দোষের একটাই বিধান। জ্বলন্ত ঘি খেয়ে তাকে আত্মহত্যা করতে হবে।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় সুবুদ্ধি রায় কারো কাছে কোনো আশার বাণীই খুঁজে পেলেন না। শাসকের প্রশ্রয় হারিয়েছেন, সমাজ তাকে সমাজচ্যুত করেছে, ধর্মের ধ্বজাধারীরা তাকে পরামর্শ দিচ্ছে আত্মহত্যার। উপায়ান্তর না পেয়ে তিনি গৌড় থেকে চলে এলেন বিদ্যাতীর্থ নবদ্বীপে। সেখানে এক তরুণ ব্রাহ্মণ তর্কযুদ্ধে বেশ কিছু পণ্ডিতদের হারিয়ে বেশ নাম করেছেন, তার পরামর্শ চান তিনি।
ব্রাহ্মণ যুবক বিশ্বম্ভর মিশ্র সুবুদ্ধি রায়ের বিপদের কথা শুনে মৃদু হাস্য করে বললেন, এতে মরার কী আছে? জলের আবার হিন্দু-মুসলমান কী! তবে আপনার মনে যে গ্লানির জন্ম হয়েছে, তা থেকে তো মুক্তি চাই। এখানে লোকে এসব বুঝবে না, আপনাকে শান্তিতে বাঁচতেও দেবে না। গৌড় ত্যাগ করে বৃন্দাবনে চলে যান। কৃষ্ণের নামগান করুন, জীবনের সব গ্লানি কেটে যাবে। শান্তিতে বাঁচতে পারবেন। সুবুদ্ধি রায় যেন হাতে চাঁদ পেলেন। বিশ্বম্ভরের কথামতই হুসেন শাহের সভা ত্যাগ করে বরাবরের মত বৃন্দাবনে চলে গেলেন তিনি।
ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা। তাদের বিধান অমান্য করার সাহস দেখায় এক তরুণ!
বিশ্বম্ভর নির্বিকার। আগের মতই সমাজের মাথা থেকে অচ্ছুৎ, সবার সঙ্গে তার ওঠাবসা। যবন হরিদাসকে সে কোলে টেনে নিয়েছে। পাড়ার মস্তান জগাই-মাধাইয়ের কাছ থেকে আঘাত পেয়েও তাদের প্রত্যাঘাত তো দূরের কথা, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির দাবি সে নাকচ করে দিয়েছে এক কথায়। ফলে তার পারিষদদল বেড়েই চলেছে। যখন ইচ্ছা তার এক ডাকে রাস্তায় নেমে পড়ে অগণিত মানুষ। নগর সংকীর্তন নামে নেচে নেচে কৃষ্ণের নামগান জিনিসটা নবদ্বীপে ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। খোল করতাল মৃদঙ্গ সহযোগে এই শোভাযাত্রা যখন খুশি শুরু করে দেয় সে, চলতে থাকে সারা দিনব্যাপী। সাধারণ মানুষের মনে শান্তি নেই, তারা ভুলে থাকে এর সুরের মাহাত্ম্যে।
এলাকার শাসক মৌলানা সিরাজুদ্দিন চাঁদকাজী সম্পর্কে সুলতান হুসেন শাহের দৌহিত্র। সুলতানের আঠারো পুত্রকন্যার এক কন্যার পুত্র সে। বিশ্বম্ভরের সমৃদ্ধিবৃদ্ধিতে সে স্বভাবতই উদ্বিগ্ন। তার আরও এক কারণ আছে। শহরে গুজব রটেছে যে মুসলমানদের খেদিয়ে দেশে অবিলম্বে হিন্দুরাজত্ব আসতে চলেছে। কে সিংহাসনে বসবে তা যদিও জানা নেই, থাকলে চাঁদকাজী তার ভবলীলা সম্বরণ করে দিত লোকচক্ষুর আড়ালেই, কিন্তু এই ছোকরা পণ্ডিত যে হারে দল বাড়িয়ে চলেছে, এমন চলতে থাকলে সেই যে গদি আঁকড়ে বসে পড়বে না, তার নিশ্চয়তা কী! নবদ্বীপ-শান্তিপুরের মানুষ এক ডাকে বিশ্বম্ভরের কথা শুনছে আজকাল।
বিশ্বম্ভর মিশ্রকে সরাসরি আক্রমণ করা কঠিন, সে সবসময়েই পার্ষদ পরিবৃত অবস্থায় থাকে। সুলতান উড়িষ্যায় যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের নালিশ চাঁদকাজীর কানে যেতেই সে বিশ্বম্ভরের কয়েকজন চ্যালাচামুণ্ডাকে ধরে উত্তম-মধ্যম দিল। তারা হরিনাম-সংকীর্তন করতে করতে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, কাজীর দলবল তাদের ওপর চড়াও হয়ে বাদ্যযন্ত্র ভেঙে দিল, সঙ্গে প্রচণ্ড মারধোর।
ভাঙা মৃদঙ্গ আর ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে তারা হাজির হল বিশ্বম্ভরের ডেরায়। তাদের দেখেই দপ করে জ্বলে উঠলেন বিশ্বম্ভর। এত সাহস হয়েছে যবনটার। যত তিনি ধৈর্য ধরে এদের প্রেমমাহাত্ম্য বোঝাতে চান, ততই এরা পেয়ে বসে। দলবল নিয়ে বিশ্বম্ভর চললেন চাঁদকাজীর বাড়ি। রাস্তায় জড়ো হল তার আরও শিষ্য-শিষ্যারা। সবার আগে বিশ্বম্ভর, তার দুপাশে কপালে সিঁদুর-লেপা জগাই-মাধাই। খোল করতালে বাতাস ভারি হয়ে উঠল।
খবর পৌঁছে গেল চাঁদকাজীর কাছে। বিশাল বাহিনী নিয়ে বিশ্বম্ভর আসছেন শুনেই চাঁদকাজী দরজায় খিল দিয়ে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে পড়ল। দরজায় এসে থামল বিশ্বম্ভর বাহিনী। নামগান চলতে থাকল। দরজা খোলার নাম নেই। বিশ্বম্ভর ডাক দিলেন কাজীকে, কেউ দরজা খুলল না। বিরক্ত বিশ্বম্ভর আদেশ দিলেন দরজা ভেঙে ফেলার। মুহূর্তেই কাজীর ঘরের দরজা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল। কাজীর সুদৃশ্য ফুল ও ফলের বাগান মত্তহস্তীর মত ছারখার করে দিল ক্রুদ্ধ জনতা। তার বৈঠকখানা ধ্বংস হল। কাজীর দেখা নেই তবুও। প্রাণভয়ে ভীত কাজী কোথায় লুকিয়ে আছে কে জানে!
বিশ্বম্ভর চেঁচিয়ে বললেন, আগুন লাগিয়ে দে তোরা কাজীর বাড়িতে। জলজ্যান্ত পুড়ে মরুক ব্যাটা আজ।
এতক্ষণ বিশ্বম্ভরের কার্যকলাপ খানিকটা দূর থেকে দেখে যাচ্ছিলেন অদ্বৈত আচার্য। দেখছিলেন আর পুলকিত হচ্ছিলেন। দুষ্টের দমন করবার যোগ্য ব্যক্তি এসে গিয়েছে তাহলে। তাঁর এতদিনের স্বপ্ন সফল হতে চলেছে। শিষ্য হয়ে বসেছে এই অঞ্চলের নেতা, তার কথায় এতশত লোক ওঠে বসে। কিন্তু এই আগুন লাগানো ইত্যাদি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। কাজী যথেষ্ট ভয় পেয়েছে – প্রাণের চেয়ে বেশি ভয় আর কীসে – সে আর সহজে অত্যাচার করতে সাহসী হবে না। এগিয়ে এসে বিশ্বম্ভরের হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে এলেন জনতার মধ্যে থেকে, বললেন, থাক বাবা নিমাই, এতেই হবে। বাড়িতে আগুন দেওয়া ঠিক নয়। কুকুর মানুষকে কামড়ায় বলে কি মানুষকেও কুকুরকে কামড়াতে হবে?
নিমাই তথা বিশ্বম্ভর এতক্ষণের এই কার্যকলাপে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। গরমের বিকেল, তার জলতেষ্টা পেয়েছে প্রবল। কাছেই শ্রীধর নামে এক গরিব শাগরেদের বাড়ি, তার দাওয়ায় রাখা আছে এক লোহার কড়াই। আগের দিন বিকেলে বৃষ্টি হওয়ায় সেই কড়াইয়ে বৃষ্টির জল জমা হয়েছে। তৃষ্ণার্ত নিমাই তেষ্টা নিবারণের জন্যে ঢকঢক করে সেই বৃষ্টির জল পান করে ফেলল।
* * *
সেন বংশের বিখ্যাত রাজা ছিলেন বল্লালসেন, তার পুত্র লক্ষ্মণসেন। বল্লালসেন যখন রাজা, একসময় রাজপুত্র লক্ষ্মণসেন বেশ অনেকদিন রাজপুরীতে ছিলেন না, বন্ধুবান্ধব নিয়ে কোথাও শিকারে টিকারে গেছিলেন। তার বৌ বেচারি স্বামী বাড়ি নেই বলে দুঃখে কাতর, কিন্তু কাউকে বলতেও পারছে না। একদিন নদীতে স্নান করে ফেরার পথে দেবমন্দিরে গিয়ে মন্দিরের গায়ে কাঠকয়লা দিয়ে লিখে রেখে এসেছে এক সংস্কৃত শ্লোক –
পতত্যবিরতং বারি নৃত্যন্তি শিখিনো মুদা।
অদ্য কান্তঃ কৃতান্তো বা দুঃখস্যান্তং করিষ্যতি।।
কিন্তু দুঃখের অন্ত কে করবে? রাজা বল্লালসেন মন্দিরে গিয়ে দেখতে পেলেন সেই লেখা। অমনি খোঁজ খোঁজ, কে লিখেছে এটা! তল্লাশি করে জানতে পারলেন, এটা তার নিজের পুত্রবধূর কাজ। অমনি তিনি তার চর অনুচরদের ডেকে বলে দিলেন পরদিন সকালের আগেই যে লক্ষ্মণকে রাজপ্রাসাদে ধরে এনে দিতে পারবে, তাকে তিনি উপযুক্ত বকশিশ দেবেন।
এদিকে কুমার লক্ষ্মণ তখন বন্ধুবান্ধব নিয়ে নদীতে ছিপ ফেলে মাছ ধরছিলেন। সূর্য নামে এক মাঝি খবর পেয়ে তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ধরে নিয়ে গেল রাজার কাছে। ফলে সেই মাঝি রাজা বল্লালসেনের কাছে পুরস্কারস্বরূপ পেয়ে গেলো কতগুলো গ্রাম, তার নাম হয়ে গেল সূর্যদ্বীপ বা সূজদীয়া পরগণা। সূর্যমাঝি সেখানকার জমিদার হয়ে জাঁকিয়ে বসল। সূজদীয়া পরগণার কাছাকাছি এক অঞ্চলের জমিদার ছিলেন শরণি গুড়। এই সূর্যমাঝির পৌত্রের প্রপৌত্র, মানে অধস্তন পঞ্চম পুরুষের সঙ্গে শরণি গুড়ের পৌত্রের প্রপৌত্র রমাপতি গুড়ের কিছু বচসা হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে একপক্ষ মুসলমান শাসকের সাহায্য প্রার্থনা করলে তাকে কৌশলে জাতিচ্যুত করা হয়।
শরণি গুড়ের নামে এই গুড় শব্দটা কিন্তু খাবার জিনিস থেকে আসেনি, এটা একটা জায়গার নাম। গৌড়ের কাছেই এক গ্রাম, তার নাম গুড়। রাজা আদিশূর কনৌজ থেকে পাঁচ ব্রাহ্মণ আনিয়ে যজ্ঞ করেছিলেন, তার মধ্যে একজন ছিলেন কাশ্যপগোত্রীয় দক্ষ। দক্ষের চোদ্দটা ছেলে, একজনের নাম ধীর। ধীর আদিশূরের ছেলে ভূশুরের কাছ থেকে সেই গুড় গ্রামটা পেয়েছিল থাকার জন্যে। ধীরের অধস্তন সপ্তম পুরুষ রঘুপতি আচার্য ছিলেন পণ্ডিত মানুষ। তিনি কাশী গিয়ে সেখানকার দণ্ডিসমাজে অনেক পাণ্ডিত্য দেখানোয় তারা তাকে সোনার এক দণ্ড উপহার দিয়েছিল বলে তার উপাধি হয়ে গেল কনকদণ্ডী গুড়।
এই রঘুপতি আচার্যের পুত্রই রমাপতি গুড়। রমাপতির পৌত্রের নাম জয়কৃষ্ণ ব্রহ্মচারী, তার দুই পুত্র নাগররায় আর দক্ষিণানাথ রায়চৌধুরী। এরা ততদিনে যশোরের চেঙ্গুটিয়া পরগণার ভূস্বামী। এদের নামের এই রায় বা রায়চৌধুরী, এগুলো সব মুসলমান শাসকের দেওয়া উপাধি। এরা নিজেদের পাণ্ডিত্য দেখিয়ে রাজদ্বারে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। দক্ষিণানাথ যে মুসলমান শাসকের আনুগত্য পেয়েছিলেন, তার নাম খানজাহান। তিনি আসল বাদশা নন, বাদশা হচ্ছেন গৌড়ের পাঠান সুলতান, সে সময় নাসিরুদ্দিন মামুদ শাহ। তার কাছ থেকে সনন্দ নিয়ে বাদশার নফর খানজাহান আলি সুন্দরবনে আবাদ করতে যশোরে আসেন, সঙ্গে আনেন পিরল্যা গ্রামের এক কুলীন ব্রাহ্মণের নাতিকে। সে এক মুসলমান সুন্দরী মেয়ের প্রেমে পড়ে গেছিল, এই দোষে তাকে জাতিচ্যুত করা হয়েছে। কুলীন ব্রাহ্মণ থেকে অধঃপতিত সে এখন মুসলমান, তার নাম হয়েছে মামুদ তাহির। বাড়ি পিরল্যা গ্রামে বলে সে নিজেকে পির আলি বলেও পরিচয় দেয়।
সুন্দরবনে আবাদ করতে হলে বনজঙ্গল কেটে চাষের উপযুক্ত জমি তৈরী করতে হবে, তার জন্যে প্রচুর লোকজন চাই, খানজাহান তা কোত্থেকে পাবেন? মুসলমান রাজত্বে নিয়ম ছিল, সম্রাটের আদেশ নিয়ে কেউ কোথাও গেলে সেখানকার জমিদার তাকে সাহায্য করবেন লোকজন দিয়ে। একে বলা হত মদত দেওয়া। খানজাহান বাদশার কাছ থেকে মদত নিয়ে এলেন চেঙ্গুটিয়ার জমিদার রায়চৌধুরীদের নামে, সেখানে এসে সেই পরোয়ানা দাখিল করলে রায়চৌধুরীরা বললেন, ঠিক আছে, লোকজন যা লাগবে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, আপনি বনজঙ্গল কেটে চাষ আবাদ করুন, যে জমি আবাদ হবে তার রাজস্ব আদায়ের ভার কিন্তু আমাদের।
খানজাহানের রাজি না হয়ে কোনো উপায় নেই, তিনি তাতে রাজি হয়ে গেলেন।
বন কাটার শুরুতেই খানজাহান বুঝে ফেললেন, রাস্তা আর পানীয় জলের ব্যবস্থা না করে দিলে লোকজনের রসদ সরবরাহ করা যাবে না, তাতে তারা খাদ্যাভাবে ও জলকষ্টে মরে যাবে। তিরিশ ফুট পাকা রাস্তার পত্তন হল আর তার ধারে প্রতি ক্রোশ অন্তর একটা করে দিঘি। ছত্রিশশো কুলিমজুর এক বছর কাজ করে এক বিরাট জায়গা জঙ্গলশূন্য করে দিল, সেখানে পাকা রাস্তা ও বড় বড় দিঘি থাকায় বসবাসের পক্ষে অতি লোভনীয় জায়গা হয়ে উঠলো। গৌড়ের বাদশার কাছ থেকে সেখানকার জমিদারি স্বত্বও পেয়ে গেলেন খানজাহান আর পূর্বপ্রতিশ্রুতিমত রায়চৌধুরীদের পত্তনিও দিয়ে দিলেন তিনি। দক্ষিণানাথ রায়চৌধুরীর তো পোয়াবারো, বিশেষ কিছু না করেই তিনি এর ফলে বিশাল ভূখণ্ডের জমিদারি পেয়ে গেলেন। অবিলম্বে তাতে গ্রাম নগর পত্তন করা শুরু হল। রাজধানীও স্থাপিত হল সেই ভূ-ভাগের মধ্যে, ভৈরব নদীর ধারে। দুশো বিঘা জমির ওপরে নির্মিত হল বিশাল রাজপ্রাসাদ, তার তিন মাইল দূরে বিশাল দিঘি খোঁড়া হল, সেই দিঘি পরবর্তীতে বিখ্যাত হয়ে গেল খাঞ্জে আলির দিঘি নামে। ষাট-গম্বুজ নামে বিরাট এক মসজিদ স্থাপন করা হলো রাজপ্রাসাদের কাছে। এছাড়া তিরিশ ফুট চওড়া প্রধান সড়কের পাশে যে দিঘিগুলো খোঁড়া হয়েছিল, সব মিলিয়ে তিনশো ষাট খানা, তার প্রতিটির কাছে এক একটা করে মসজিদ বানানো হলো।
খানজাহান আলি প্রসিদ্ধ হয়ে উঠলেন, মামুদ তাহির হলেন তার উজির। রাজস্ব আদায় করতেন দক্ষিণানাথ রায়চৌধুরী। তার চার ছেলে এক মেয়ে। বড় দুই ছেলের নাম কামদেব আর জয়দেব। তারা পিতার সহকারী এবং জমিদার ও উজিরের বিশেষ প্রিয়পাত্র। আচার অনুষ্ঠানের মামুদ তাহিরের পাশেই স্থান কামদেব-জয়দেবের।
এই সুখ অবশ্য বেশিদিন সহ্য হল না তাদের।
এক শবেবরাতের বিকেলে মুসলমান উজির রোজা পালন করছিলেন। সেদিনই রোজার শেষ দিন, আর একটু সময় গেলেই উপবাস ভঙ্গ। শবেবরাতের রাত বড় মধুর, মুসলমান ধনীরা দাওয়াত দেন পরিচিতদের। রাজবাড়ি লোকে বোঝাই, বাইরে থেকেও লোকের আনাগোনা চলছে। কথাবার্তার মধ্যে প্রজাদের কেউ একজন মামুদ তাহিরকে ভেটস্বরূপ কয়েকটা গন্ধরাজ লেবু দিয়ে গেল। গন্ধরাজ লেবুর সুন্দর গন্ধ, চারদিক সেই গন্ধে আমোদিত হয়ে গেল। তাহির একটা লেবু শুঁকে পাশে বসা পাত্রদ্বয় কামদেব আর জয়দেবকে বললেন, কী সুন্দর গন্ধ না এই লেবুর? ভাইদের একজন তাকে ঠাট্টা করে বলল, হ্যাঁ, গন্ধ তো সুন্দর বটে, কিন্তু আমাদের শাস্ত্রে আছে ঘ্রাণেন অর্ধভোজনম্, মানে গন্ধ শুঁকলেই অর্ধেক খাওয়া হয়ে যায়। আপনি যে লেবু শুঁকলেন, তার গন্ধ নাকে যেতেই আপনার অর্ধেক খাওয়া হয়ে গেল, সুতরাং আজকের উপবাস আপনার বৈধ হল না। ব্যাপারটা বুঝলেন? এর মানে আপনার রোজা ভঙ্গ হয়ে গেল।
শুনে লাল হয়ে গেল মামুদ তাহিরের মুখ। এইসব অহেতুক ঠাট্টা একজন ধর্মভীরু মুসলমান উজিরের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব? এর বদলা নিতে কিছুদিন পর উজির এক মজলিসের আয়োজন করে আগে থেকেই তাদের ফাঁদে ফেলার আয়োজন করে রাখলেন।
ষাটগম্বুজ মসজিদের প্রাঙ্গনেই হয়েছিল সেই মজলিসও। তাতেও উপস্থিত আশেপাশের অনেক সম্ভ্রান্ত মানুষ। তাদের আহারের জন্যে যথেচ্ছ পেঁয়াজ রসুন সহযোগে গোমাংস রন্ধন হচ্ছিল কাছেই, তার গন্ধে চতুর্দিক ম’ ম’ করছিল। কামদেব জয়দেব সহ অন্যান্য হিন্দুরা গন্ধ পেয়ে নাকে কাপড় চাপা দিলেন। উজির বললেন, আপনারা কি গন্ধ পাচ্ছেন বলে নাকে কাপড় দিয়েছেন? ওরা বললেন, হ্যাঁ। ব্যাস, আর যাও কোথায়! উজির বললেন, তবে তো আপনাদের অর্ধেক খাওয়া হয়ে গেছে, আপনাদের শাস্ত্রেই তো আছে ঘ্রাণেন অর্ধভোজনম্। অন্য হিন্দু ব্রাহ্মণরা শুনে এদিক ওদিক দিয়ে পালিয়ে গেলেন, কিন্তু উজির আগে থেকেই ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন, কামদেব-জয়দেবকে ছাড়লেন না। এদের ফাঁদে ফেলার জন্যেই তো এত আয়োজন। ওদের বললেন, অর্ধেক খাওয়া যখন হয়েই গেছে, পুরোটা খেতে আর দোষ কী? জোর করে ওদের মুখে গোমাংস ঢুকিয়ে দিলেন তারা। তারপর বললেন, হিন্দুত্ব যখন গেছেই, তখন পবিত্র মুসলমান ধর্মই গ্রহণ করা উচিত তোমাদের। সে রাত্রেই কলমা পড়িয়ে তাদের মুসলমান বানিয়ে দেওয়া হল। পুরনো নাম ছেড়ে নতুন নাম দেওয়া হলো তাদের। কামদেব হয়ে গেলেন কামালুদ্দিন খান আর জয়দেব হলেন জামালুদ্দিন খান। এ নিয়ে যাতে বচসা না হয়, খানজাহান তড়িঘড়ি তাদের নিকটবর্তী শিঙ্গিয়া গ্রাম দান করলেন। শিঙ্গিয়া ঠিক বসবাসের উপযুক্ত নয়, তার কাছেই মাগুরা নামে এক গ্রাম ছিল, উপায়ান্তর না পেয়ে দু’ভাই গিয়ে উঠলো সেইখানে।
দক্ষিণানাথের আরো দুই পুত্র আর এক কন্যা ছিল। তাদের নাম রতিদেব, শুকদেব আর রত্নমালা। তারা তখনও দক্ষিণডিহিতেই থাকতেন। দাদাদের এই খবর পেয়ে তারা মর্মাহত হয়ে গেলেন, কিন্তু নিজের ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করা তো সম্ভব না। যতদিন মাগুরায় বাড়ি বানানো না হলো, ততদিন দক্ষিণডিহিতেই থাকতে লাগলেন বড় দু’ ভাই কামদেব জয়দেবের স্ত্রী-পুত্ররা। ভায়েরাও নিজেদের পৈতৃক বাড়িতে যাতায়াত করতে লাগলেন সম্পত্তি ও পরিজনদের কারণে। হিন্দুসমাজ একে একেবারেই ভাল চোখে দেখলো না। ফলে শুধু বড় দু’ভাই নয়, বাকিরাও সমাজের চোখে স্পর্শদোষে জাতিভ্রষ্ট বলে পরিগণিত হলো।
এসব সহ্য করতে না পেরে রতিদেব গৃহত্যাগী হলেন, তার কোনো সন্তানসন্ততি ছিল না। ছোট ভাই শুকদেবের অবস্থা আরও সঙ্গীন। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত বিবাহযোগ্যা ভগিনী রত্নমালাকে পাত্রস্থ করার দায়িত্ব এসে পড়ল তার ওপরেই, সে করতে দম বের হবার উপায় হলো শুকদেবের। বিশাল সম্পত্তির মালিক ও উচ্চ ব্রাহ্মণশ্রেণির গুড় রায়চৌধুরীদের সম্বন্ধে সকলেই ওয়াকিবহাল, তাদের সম্বন্ধে মুখরোচক গল্প ছুটেছে বাতাসেরও আগে। ফলে আশেপাশের সবাই জেনে গেছে এই পদচ্যুতির কথা। মোটা অঙ্কের বকশিস ধার্য করে একগাদা ঘটক লাগিয়েও সুবিধে হলো না। নিজেদের পরিবারের কাছে পতিত হবার ভয়ে কেউ রত্নমালাকে বিয়ে করতে চায় না। তার বয়স বেড়ে যেতে লাগলো। শুকদেবের চোখে ঘুম নেই। তার নিজের এক মেয়েও আছে, সেও বড় হচ্ছে। বোনের আগে তো মেয়ের বিয়ে দেওয়া যায় না, আর দিতে গেলেও সেই একই প্রশ্ন উঠবে।
মঙ্গলানন্দ মুখোপাধ্যায় নামে এক ব্রাহ্মণযুবক দক্ষিণডিহির কাছে ভুগীলহাটে বিদ্যাশিক্ষার জন্যে যাচ্ছিলেন – সেখানে অনেক টোল ছিল পণ্ডিতদের – পথে সন্ধ্যা নেমে যাওয়ায় জমিদার-বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেন তিনি। শুকদেব এ সুযোগ কোনোমতেই হারাতে চান না। কৌশলে প্রায় আটকে রেখে প্রচুর জমিজমা ও উপঢৌকন দানের লোভ দেখিয়ে তাকে বোঝানো হল যে এরা তাদের পালটি ঘর। যদিও মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেছে তার বড় ভাইরা, তার পরিবার উচ্চশ্রেণির ব্রাহ্মণই আছে এখনও। বিদ্যাশিক্ষার শেষে নিজের টোল খুলে সারা জীবনে যে যত আয় করতে পারবে, শুকদেব শুধু রত্নমালাকে বিয়ে করার জন্যেই তত বরপণ দিতে রাজি। বিদ্যাশিক্ষা সমাপনের আগেই চটজলদি তার সঙ্গে রত্নমালার রাতারাতি বিয়ে দিয়ে দেওয়া হল। বলাই বাহুল্য, মঙ্গলানন্দ সমাজের চোখে পতিত হয়ে গেলেন।
বোনের ব্যবস্থা হয়ে যেতেই কন্যার জন্যেই পাত্র খুঁজতে লাগলেন শুকদেব, তাতেও ভাগ্যের সহায়তার প্রভূত প্রয়োজন হল। শাণ্ডিল্য ভট্টনারায়ণ দীন কুশারীর বংশধর খুলনার পিঠাভোগের শ্রোত্রিয় জমিদার জগন্নাথ কুশারী একদিন ভৈরব নদী দিয়ে বজরায় কার্যোপলক্ষে যাচ্ছিলেন, ভৈরবতীরে দক্ষিণডিহির কেয়াতলায় এক কালীমন্দির ছিল, স্থাপন করেছিলেন শুকদেবের পিতা দক্ষিণানাথ। সন্ধ্যায় ভীষণ ঝড়জল শুরু হলে বজরা পাড়ে লাগিয়ে সেই কালীমন্দিরে আশ্রয় নিলেন জগন্নাথ ও তার সহচরেরা। মন্দিরের কর্মচারীরা খবর পাঠালে শুকদেব নিজে ঘোড়ায় চড়ে সেই ঝড়জলের রাত্রে হাজির হলেন কালীমন্দিরে, আদরযত্ন করে জগন্নাথকে নিয়ে গেলেন নিজের প্রাসাদে।
কুশারীরা ভট্টনারায়ণের পুত্র দীন কুশারীর বংশজাত। রায়চৌধুরীদের পূর্বপুরুষ যেমন গৌড়ের কাছে গুড় গ্রামে বসতি স্থাপন করেছিলেন, এরা করেছিলেন বর্ধমানের কাছে কুশ গ্রামে, পেয়েছিলেন মহারাজ ক্ষিতিশূরের কাছ থেকে। কালে এরা সচ্ছোত্রিয় বা কুলীন শ্রোত্রিয় আখ্যা পান। কুশ গ্রাম থেকে তাদের বিস্তার ঘটে অন্যান্য জায়গাতেও। জগন্নাথের পরিবার বসতি স্থাপন করেছিলেন পিঠাভোগে। দীন কুশারীর কয়েক পুরুষ পরে তাদের বংশের একজনের নাম কুমার, তার অধস্তন সপ্তম পুরুষ এই জগন্নাথ।
রাত্রে আহারাদির সময় জানা গেল জগন্নাথ অকৃতদার। অমনি মঙ্গলানন্দের মতই তার কাছে প্রস্তাব গেল শুকদেবের কন্যার জন্যে। জগন্নাথ আহারের সময় দেখলেন, কন্যাটি অতীব সুন্দরী। তিনি উদারমনা যুবক, এই বিয়েতে নিজেই রাজি হয়ে গেলেন। চুপিচুপি কয়েকদিনের মধ্যে সেই বিয়ে হয়ে গেল। বৌ নিয়ে জগন্নাথ দেশে ফিরে যেতেই শুরু হয়ে গেল জ্ঞাতিগুষ্টির কাছে গঞ্জনা। পতিত ব্রাহ্মণকন্যাকে বিবাহের অপবাদে তার সকল আত্মীয়রা তাকে পরিত্যাগ করলেন। উপায় না পেয়ে বিব্রত জগন্নাথ বৌ নিয়ে চলে এলেন শ্বশুরালয়ে। শুকদেব নরেন্দ্রপুরের কাছে উত্তরপাড়া নামে এক গ্রামসংলগ্ন বারোপাড়া গ্রাম মেয়ে-জামাইকে দান করলেন।
বারোপাড়ায় জগন্নাথ বৌ নিয়ে সংসারী হলেন। একে একে তার প্রিয়ঙ্কর, পুরুষোত্তম, হৃষীকেশ ও মনোহর নামে চার ছেলে জন্মালো। সমাজের চোখে যে তাদের অবস্থার কিছু পরিবর্তন হল, তা নয়। পিরল্যা গ্রামের সেই মামুদ তাহির তথা পির আলির দোষ লেগে তাদের বংশের নামই লোকমুখে হয়ে গেল পিরালি ব্রাহ্মণ বংশ, অর্থাৎ তারা পতিত। সদ্ব্রাহ্মণরা মরে গেলেও এদের ঘরে তাদের মেয়ের বিয়ে দেবে না। পতিত-হওয়া নিজেদের জ্ঞাতিগুষ্ঠির মধ্যেই তাদের বিয়েশাদি সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
পিরল্যা গ্রাম নবদ্বীপের কাছেই। সেখানকার বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ কমলাক্ষ ভট্টাচার্য, যাকে সবাই একডাকে অদ্বৈত আচার্য নামে চেনে, এসব অনাচারের কথা জানেন। যত দিন যাচ্ছে তত হিন্দুরা পতিত হয়ে মুসলমান হয়ে যাচ্ছে। যারা হচ্ছে না, তারা নিজেদের শুদ্ধতা বজায় রাখতে আরও গোঁড়া, আরও অনুদারমনস্ক, অত্যন্ত রক্ষণশীল হয়ে উঠছে। এই সংকীর্ণতা, এই হীনমন্যতা থেকে কে বের করে আনবে সনাতন ধর্মকে?
তাঁর একমাত্র আশা প্রাণাধিক প্রিয়পাত্র নিমাইকে ঘিরে। জগন্নাথ কুশারীর কনিষ্ঠ পুত্রটি সম্ভবত তাঁর নিমাইয়ের বয়সীই হবে।