|| নয় ||
স্নান সেরে এসে নিমাই খেতে বসেছে। শচীদেবী কোনো কাজে বাইরে গেছেন, বৌমাকে বলে গেছেন নিমাইকে ভাত বেড়ে দিতে। লক্ষ্মী জানে, তার স্বামীটি পেটুক ও ভোজনরসিক। গঙ্গায় অনেকক্ষণ সাঁতার কেটে আসে আর গোগ্রাসে খায়। বিয়ের পর এ ঘরে যখন সে এল, তখন তার শাশুড়িই রান্নাবান্না করতেন। এখন সেও অনেক কিছু শিখে নিয়েছে। তাও লক্ষ্মী যখনই হেঁসেলে ঢোকে, শাশুড়ি পিছনে এসে দাঁড়ান, এটা ওটা এগিয়ে দেন। লক্ষ্মীর বয়স বেশি না হলে কী হয়, সে এর মধ্যেই বেশ পাকাপোক্ত গিন্নি হয়ে উঠেছে।
বড়সড় একটা কলার পাতা কেটে জলে ধুয়ে ঘরের মাঝখানে রাখা, তার ওপর সাদা ধোঁয়া-ওঠা ভাত বেড়ে দিল লক্ষ্মী। নিমাইয়ের পছন্দ গাওয়া ঘি। একটু-আধটু না, ভাতে মাখামাখি হয়ে সে ঘি যেন গড়িয়ে পড়ে কলার পাতায়। শাক, তিতো আর শুক্তো দিয়ে সে ভাত খাওয়া শুরু করতে ভালবাসে। শিষ্যদের বাড়িতে প্রায়ই নেমন্তন্ন জুটে যায় তার, খেয়ে এসে গল্প শোনায় লক্ষ্মীকে। মা-বৌয়ের জন্যেও ছাঁদা বেঁধে নিয়ে আসে কিছু। এসেই শোনাবে, জানো, আজ ওদের বাড়িতে মোচার যে কত রকম পদ খেয়ে এলাম! আর লাউ। আর কত রকমের বড়ি দিয়ে রান্না করা সে সব পদ! মরিচ দিয়ে ঝাল ঝাল একটা যা ছানাবড়া খেলাম, আহ! বলে একটা কৃত্রিম উদ্গার তুলে বুঝিয়ে দেবে কেমন মনোহারী সেই খাবার।
শুক্তো রান্না করেছে আজ লক্ষ্মী। পাতে দিতেই নিমাই বলল, এটা কী?
লক্ষ্মী বলল, শুকুতা।
নিমাই বলল, তুমি শুকুতা রান্না শিখে ফেলেছ? বাহ। এরপর বড়সড় এক গ্রাস ভাত তাই দিয়ে মেখে মুখে দিয়ে পরম তৃপ্তিতে বলল, বড় সুন্দর রান্না হয়েছে। বলো দেখি, একে শুকুতা কেন বলে?
লক্ষ্মীর জ্ঞান রান্নাতেই সীমাবদ্ধ। একে কেন শুকুতা বলে, তা তার অজানা। নিমাই বলল, সব কিছু জেনে রাখতে হয়, বুঝেছ? শুকুতা বলে, কেননা এটা শুকনো পাতা দিয়ে রান্না করা হয়। অন্তত হত তাই আগে। কই, আমার নিম্ব-বার্তাকু কই?
লক্ষ্মী বলল, সেটা আবার কী?
কেন? নব নিম্বপত্রসহ বার্তাকু ভৃষ্ট করে যেটা রোজ পরিবেশন কর, সেই নিম-বেগুন? নিম্ব মানে নিম আর বার্তাকু হচ্ছে বেগুন। আজ মা শাক তুলে আনেনি?
লক্ষ্মী বলল, এনেছেন। আজ তিন রকম শাক— কলমি, নলতে আর নটে।
খেতে খেতে কথাবার্তা হচ্ছে। লক্ষ্মী তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করছে নিমাইকে আর মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে খাবার নিয়ে আসছে রান্নাঘর থেকে। শাক পরিবেশন করতেই নিমাই বলল, জানো, সেদিন যে শিষ্যের বাড়ি গিয়েছিলাম, সেখানে অন্তত দশ রকমের শাক রান্না করেছিল। তার সঙ্গে লাউ-কুমড়ো-বড়ি দিয়ে আরও কত পদ। সব পদ ওরা সাজিয়ে দিল ছোট ছোট কেয়াপাতার বাটিতে।
লক্ষ্মী বলল, আমাকে শিখিয়ে দেবেন কী করে কেয়াপাতা দিয়ে বাটি তৈরি করে, আমিও কেয়াপাতার বাটিতে আপনাকে দেব।
নিমাই বলল, তার দরকার নেই। তুমি বরং বড়ি দেওয়া শিখে নাও মার কাছে। পাকা চালকুমড়ো শুকিয়ে বিউলির ডালবাটায় মিশিয়ে বড়ি দিতে হয়, ব্যঞ্জনে দিলে তার যা স্বাদ! কৃষ্ণকে ননীচোরা বলা হত, তা তো জানো। সেদিন দুধ দিয়ে প্রস্তুত তুম্বী আর কুষ্মাণ্ডের দুই ব্যঞ্জন খেয়ে বড় ভাল লাগল। তুম্বী বুঝলে তো? লাউ। লাউকে অলাবুও বলে। আর কুষ্মাণ্ড হচ্ছে কুমড়ো। সেদিন মা অদ্বৈত আচার্যিকে বলছিল, কৃষ্ণগাভীর দুগ্ধ একটু বেশি করে সংগ্রহ করে দিতে। মহাপুরুষের জন্যে পায়েস রাঁধবে।
লক্ষ্মী হেসে জিজ্ঞেস করল, কোন মহাপুরুষ?
নিমাই বলল, কেন, আমি? তুমি আমাকে কী ভাবো? জানো আমার জন্মের সময় আমাকে দেখে আমার মাতামহ কী বলেছিলেন?
লক্ষ্মী জানে, এবার শুরু হবে নিমাইয়ের বচন-তুবড়ি। শুনে শুনে সে কিছুটা অভ্যস্ত হয়েছে এতে, তবু তার শুনতে ভালো লাগে। তার স্বামীটি যে বড়সড় পণ্ডিত, তাতে তার সন্দেহ নেই।
নিমাই বলল, আমাকে বলেছিলেন আমার মধ্যে মহাপুরুষের সমস্ত লক্ষণই আছে। বিশ্বাস না হয় মাকে জিজ্ঞেস করে দেখো। আমার মা কি যে-সে ঘরের মেয়ে? স্বয়ং নীলাম্বর চক্রবর্তী তার পিতৃদেব। তিনিই আমাকে দেখে বলেছিলেন এই কথা। ওহো, তুমি কি জানো, মহাপুরুষের লক্ষণ কী কী?
লক্ষ্মী চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তার পিতা বল্লভাচার্যের পাণ্ডিত্য কিছু কম না, কিন্তু নীলাম্বর চক্রবর্তীর সমান হবে কিনা, তা সে নিঃসন্দেহ নয়। কিন্তু সে কী করে জানবে, মহাপুরুষের লক্ষণ কী!
নিমাই কৌতুক করে বলল, অজ্ঞ নারী, তুমি আর এসব কী করে জানবে? ঠিক আছে, আমার মত স্বামী যখন পেয়েছ, আমার কাছেই জেনে নাও —
পঞ্চদীর্ঘঃ পঞ্চসূক্ষ্মঃ সপ্তরক্তঃ ষড়ুন্নতঃ।মানে বুঝলে?
ত্রিহ্রস্বপৃথুগম্ভীরো দ্বাত্রিংশল্লক্ষণো মহান্।।
পঞ্চ সপ্ত এগুলো লক্ষ্মী ভালোই জানে। বাদবাকি কী সব বলল তার পতিদেব, তা তার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ঢুকল না।
নিমাই বলল, বুঝলে না? দ্বাত্রিংশ অর্থাৎ বত্তিরিশটা লক্ষণ দেখে বোঝা যায় জাতক মহাপুরুষ হবে কিনা। কী সেই বত্তিরিশ লক্ষণ? পঞ্চ দীর্ঘ, পঞ্চ সূক্ষ্ম, সপ্ত রক্তবর্ণ, ষট উন্নত — এই হল তোমার তেইশটা লক্ষণ। আর তিনটে করে হ্রস্ব, পৃথুল আর গম্ভীর লক্ষণ, অর্থাৎ তিন তিরিকখে নয় আর ঐ তেইশ মিলে বত্তিরিশ। বুঝলে মূর্খ রমণী? বলে নিজের রসিকতায় নিজেই হা হা করে হাসতে লাগল।
লক্ষ্মীও ফিক করে হেসে বলল, বুঝেছি।
ছাই বুঝেছ, নিমাই হাসি থামিয়ে বলল, শুধু লক্ষণ যে বত্তিরিশটা, তা বুঝলেই হবে? কেবল সংখ্যার কী মূল্য? এবার যদি জিজ্ঞেস করি, কী কী সেই বত্তিরিশটা লক্ষণ, তাহলে? তখন যে অজ্ঞানতার ফানুস আবার ফুস করে চুপসে যাবে, সে বেলা! শোনো, মূর্তিমতী অবিদ্যা, এক এক করে বলে দিই, শুনে মনে রাখবে। রাত্তিরে জিজ্ঞেস করব, ভুল উত্তর দিলে শাস্তি পাবে।
লক্ষ্মী উদ্বেল হয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইল। একসঙ্গে বত্তিরিশটা জিনিস মনে রাখা সম্ভব নাকি? তাও কী বলে দেখা যাক। রাত্তিরে জিজ্ঞেস করলে তাকে অন্যভাবে ভোলাতে হবে।
নিমাই বলল, পঞ্চ দীর্ঘ কি জানো? নাসা, ভুজ, হনু, নেত্র ও জানু — এই পঞ্চ অঙ্গ। বলে নিজের পাঁচটা অঙ্গ দেখিয়ে বলল, দেখতেই তো পাচ্ছ কেমন দীর্ঘ আমার এই পঞ্চাঙ্গ। এ শুধু এখন নয়, জন্মাবধিই এমন। মহাপুরুষ না হয়ে আমার কি পরিত্রাণ আছে?
লক্ষ্মী মনে মনে ছবিটা এঁকে নিল। চোখ-নাক-হাত-হাঁটু ঠিক আছে। হনু মানে তাহলে চোয়ালের ওপরের অংশটা? হনু শুনেই তার হনুমানের কথা মনে হয়েছে। পতিটি তার হনুমানের মতই সদাচঞ্চল।
এবার বলি পঞ্চ সূক্ষ্ম কী কী। ত্বক, কেশ, অঙ্গুলিপর্ব, দন্ত ও রোম — এই পঞ্চ অঙ্গ, এদের হতে হবে সূক্ষ্ম। অঙ্গুলিপর্ব বুঝলে তো? আঙুলের কর।
লক্ষ্মী দ্রুত মিলিয়ে নিতে লাগল। ত্বক-রোম-কেশ এদের মধ্যে সম্পর্ক আছে। কিন্তু কোথায় দন্ত আর কোথায় আঙুলের কর! সে মনে রাখবে কী করে?
সপ্ত অঙ্গ হতে হবে রক্তবর্ণ, নিমাই ফিরিস্তি দিয়ে চলল। নেত্র, করতল, পদতল, তালু, ওষ্ঠ, অধর ও নখ — এই সাতটা অঙ্গ। তোমার তো বেশ লাল লালই আছে এই সপ্ত অঙ্গ। আমারও তাই, জন্ম থেকেই, বুঝলে? এর সঙ্গে ষট অর্থাৎ ছয় অঙ্গ উন্নত হতে হবে। কোন ছয় অঙ্গ? বক্ষ, স্কন্ধ, নাসিকা, নখ, কটি ও মুখ — এই ষড়ঙ্গ।
লক্ষ্মী হাল ছেড়ে দিল। অসম্ভব এসব মনে রাখা। তার স্বামীর স্মৃতিশক্তি তাকে মুগ্ধ করতে লাগল। এত মনে রাখে কী করে? বত্তিরিশটা কি হয়ে গেল, না আরও বাকি আছে!
নিমাই বলে চলল, প্রথম লাইনের তেইশটা বললাম, এবার বাকি নটা। ওই যে বললাম তিনটে করে হ্রস্ব, পৃথুল আর গম্ভীর। হ্রস্ব মানে ছোট, পৃথুল হচ্ছে মোটা আর গম্ভীর তো জানোই। জানো তিন হ্রস্ব অঙ্গ কী কী যা দেখে বোঝা যায় মহাপুরুষের লক্ষণ?
লক্ষ্মী গম্ভীর হয়ে বলল, না।
নিমাই বলল, তবে শোনো, আনপড় বালিকা। গ্রীবাজঙ্ঘামেহনানি ত্রিহ্রস্বঃ অর্থাৎ গ্রীবা, জঙ্ঘা আর মেহন — এই তিন অঙ্গ হতে হবে হ্রস্ব। গ্রীবা মানে গলা, এই যে এইটা, বলে নিজের গলা দেখাল। জঙ্ঘা মানে ঊরু, পায়ের একেবারে ওপরের অংশটা। তারপর চারিদিক দেখে নিয়ে কাছেপিঠে মা নেই নিঃসন্দেহ হয়ে প্রায় কানে কানে বলল, আর মেহন জানো? মেহন হচ্ছে লিঙ্গ।
লজ্জায় কান লাল হয়ে গেল লক্ষ্মীর।
কটিললাটবক্ষাংসি ত্রিপৃথুঃ। মানে কী? নিমাই বলে চলে, কটি মানে কোমর, ললাট হচ্ছে কপাল আর বক্ষ মানে বুক তো জানোই। এই তিন অঙ্গ হতে হবে পৃথুল। আর নাভিস্বরসত্ত্বানীত্যাদি ত্রিগম্ভীরঃ। নাভি, স্বর মানে আওয়াজ আর সত্ত্ব অর্থাৎ বুদ্ধি হতে হবে গম্ভীর, বুঝলে? মিল পাচ্ছ আমার সঙ্গে মহাপুরুষের?
লক্ষ্মী বলল, সে তো আমি আগে থেকেই জানি যে আপনি মহাপুরুষ।
কে মহাপুরুষ? নিমাই? বলতে বলতে শচীদেবী ঢুকলেন দরজা দিয়ে। তাঁর হাতে একটা চুবড়িতে বেশ কতগুলো কুমড়োর ফুল। লক্ষ্মী উঠে গিয়ে শাশুড়ির হাত থেকে চুবড়িটা নিল। সে জানে, কুমড়োর ফুলগুলো বেসন দিয়ে ভেজে দিতে হবে তার স্বামীটিকে। এখনই দেবে নাকি রাতের খাবারের সঙ্গে দিলেই হবে?
শচীদেবী বললেন, তোকে কী বলছে রে মা? ঐ হতচ্ছাড়া মহাপুরুষ! এতকাল আমার হাড়মাস জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ভাজাভাজা করে এখন তোকে বোঝাচ্ছে সে মহাপুরুষ? মহাপুরুষগিরির নমুনা শুনবি মা? ঘরে কোথাও ওর জ্বালায় একদানা খাবার রাখার উপায় ছিল না। সব চুরি করে খেয়ে নিত। তাও ঘরের খাবার চুরি করে খেলে এক কথা। আমাদের এ পাড়ায় এমন লোক নেই, যে এসে নালিশ করেনি যে নিমাই তাদের বাড়ির খাবার চুরি করে খায়নি। হামাগুড়ির বয়স থেকেই চুরি করে খাওয়া ওর স্বভাব। লোকে ভাবত, বাড়িতে খেতে পায় না বলেই হয়ত চুরি করে খাচ্ছে। এই ভেবে কেউ হয়ত ওকে ডেকে খইটা, সন্দেশটা হাতে দিল বাটি ভরে। ও মা, সেগুলো না খেয়ে রাস্তায় বালকদের মধ্যে বিলি করে দিল! জাত-বেজাত মানামানি নেই, সবার সঙ্গে ওর ওঠাবসা। শুদ্দুরবাড়িতেও গিয়ে চুরি করে খেয়েছে। যে বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে দেখবে হাঁড়িতে খাবার নেই, সেখানে হাঁড়ি ফাটিয়ে দিয়ে আসত, এমন শয়তান। ও নাকি মহাপুরুষ!
লক্ষ্মী খিলখিল করে হেসে উঠল।
নিমাই লক্ষ্মীর দিকে তাকিয়ে কপট রাগে বলল, হাসছ? এই শুনে হাসি পেল তোমার? কই, শ্রীকৃষ্ণ যে ননী চুরি করে খেত, সে শুনে তো হাসি আসে না তোমাদের! এগুলো চুরি নয়, বুঝেছ? এ হচ্ছে লীলা। বলে নিজেই আবার হাসতে লাগল।
লক্ষ্মী শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, উনি চুরি করে খেতেন, আপনি কিছু বলতেন না?
শচী বললেন, কী বলব মা, ওর দাদার জন্মের পর আমার অনেকগুলো মেয়ে হয়েছিল, একটাও বাঁচেনি। তারপর আট বচ্ছর পর এই ছেলে। সেইজন্যেই কেউ কিছু বলত না ওকে, ইচ্ছেমত যা খুশি করে বেড়াত। যতক্ষণ দাদার সঙ্গে থাকত, ছেলে শান্ত, দাদাকে খুব ভালবাসত, দাদাও ওকে। কিন্তু দাদা তো পড়াশুনা করত খুব, অদ্বৈত আচার্যির টোলেই পড়ে থাকত সারাদিন। তখন বাড়িতে শুরু হত এর দুরন্তপনা। এই আগুনে হাত দিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলে তো পরের দিন সাপ ধরতে যায়। একবার তো ওর হাতে সোনার বালা দেখে ছেলেধরাও ওকে ধরে নিয়ে গেছিল, কিন্তু ঐ দুরন্ত বাচ্চা সামলানো ছেলেধরারও কর্ম নয়, সে ফেরৎ দিয়ে গেল। এসব দেখে চিন্তা হয় না? কত দিক আর সামলে রাখি! ওর দাদার যখন ষোল বছর বয়স, তখন তার বিয়ে দিতে চাইলাম তো সে আমাদের ছেড়ে চলে গেল সন্ন্যাসী হয়ে। তাতে আমরা আরও ভয় পেয়ে গেলাম। কিছু বলা যায়, তুমিই বল!
লক্ষ্মী চুপ করে রইল।
শচী বলেই চললেন, আবদারের তো শেষ নেই তার। একদিন বলে, আমি পাখির মত আকাশে উড়তে চাই, আমায় ডানা দাও। আবার কখনও তার চাঁদ চাই, আকাশ থেকে পেড়ে দাও। নিত্যনতুন আবদারে আমরা অতিষ্ট। আমি রঘুনাথের পুজো করছি, এসে সব উল্টে দিল। ব্রাহ্মণকে অন্নসেবা করাচ্ছি, তার পাত থেকে এক খাবলা ভাত তুলে খেয়ে নিল বা চারিদিকে ছড়িয়ে দিল। রাস্তা থেকে কুকুরছানা বাড়িতে ধরে নিয়ে এসে পুজোর নৈবেদ্য তাকে খাইয়ে দিল। সমবয়সী বন্ধুদের সবার সঙ্গে ওর ঝগড়া-মারামারি লেগেই থাকত। কী যে করব, বুঝেই পাই না। ওকে যে ধরব, উনি তখন মেঝেতে গড়াগড়ি দিচ্ছেন হাত-পা ছুঁড়ে। একমাত্র কানের কাছে হরি-হরি করলে তবে যদি কিছুটা শান্ত হয়, নইলে চলতেই থাকে তার এই বদমায়েশি।
শুনে লক্ষ্মী আবার ফিক ফিক করে হাসতে লাগল। বলল, উনি যে এ রকম করতেন, পিতাঠাকুর কিছু বলতেন না?
শচী বললেন, বলতেন না আবার! প্রহার করতেন কোনো কোনো সময়। তখন এসে মায়ের আঁচলে ঢুকে তারস্বরে কান্না! আছাড়ি-পিছাড়ি! কত সহ্য করব বলো তো! তারপর শুরু হল নদীতে দুরন্তপনা। পাড়ার বাচ্চাদের সঙ্গে চলে যেত গঙ্গায়, সেখানে সাঁতার শিখে যেতেই আর ওকে পায় কে! সারাদিন নদীতে সাঁতার, এপার-ওপার, ক্লান্তি নেই একেবারে। তার সঙ্গে নদীর ঘাটে যারাই যেত, তাদের সঙ্গে মস্করা। কারো গায়ে জল ছিটিয়ে দেয়, কারও গামছা চুরি করে জলে ডুব দেয়, কারও পা ধরে টেনে গভীর জলে নিয়ে যায়, কারও কাঁধে চেপে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে! কেউ হয়ত ঘাটে বসে ধ্যান করছে, তার মাথায় জল ঢেলে দিল। কারও শালগ্রাম শিলা চুরি করে জলে ফেলে দিল। ধুতি-উত্তরীয়-গীতা নিয়ে পালাল। নৈবেদ্যর ফলমূল পুজোর আগেই তুলে খেয়ে নিল। কেউ স্নান করে ফিরছে, তার গায়ে কাদা ছুঁড়ে মারল। অভিযোগের শেষ নেই। এত দুরন্ত বাচ্চা কেউ চোখে দেখেনি এ চত্বরে।
নিমাই কিছু না বলে একমনে খেয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্মী তার গায়ে বাতাস করছে।
শচী আবার বললেন, আর শুধু তো ছেলেদের সঙ্গে না, ছোট ছোট মেয়েদের সঙ্গেও তার সমান অত্যাচার। কারও মুখে কুলকুচির এঁটো জল ছিটিয়ে দেয় তো কারও চুলে গুঁজে দেয় ধুতুরার বিচি। অনেকেই এসে আমাকে বলেছে, নিমাই নাকি তাদের বলেছে, আমি তোকে বিয়ে করতে চাই।
শুনে লক্ষ্মীর চোখ বড় বড় হয়ে গেল! নিমাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, সত্যি?
নিমাই কপট লজ্জার ভান করে বলল, না না, এসব বানিয়ে বানিয়ে বলেছে ওরা। আমি আর বিয়ে? দাদা বিয়ে করেনি, আমিও করতে চাইনি।
লক্ষ্মী জানে এ কথা সত্যি না। নদীর ঘাটে নিমাইয়ের সঙ্গে তার নিয়মিত চোখাচোখি হত, তার চোখের ভাষা সে ঠিকই পড়েছে। লক্ষ্মীর সঙ্গেও শুরু করেছিল একইভাবে, যেমন সে করত অন্য বালিকাদের সঙ্গে। কিন্তু অন্য বালিকারা যেমন বিরক্ত হয়ে শচীর কাছে নালিশ জানাতে আসত, লক্ষ্মী তো তা করেনি। সে সমস্ত অত্যাচার সহ্য করেছে স্মিতমুখে। তার তো পতি হিসাবে এমন যুবকই পছন্দ। তবু সুযোগ পেয়ে বলল, তাহলে করলেন যে?
নিমাই বলল, আরে আমি কি বিয়ে করতে চাইছিলাম? নেহাৎ শাস্ত্রে লেখা আছে,
ন গৃহং গৃহমিত্যাহু গৃহিণীর্গৃহমুচ্যতে।এর মানে জানো? একটা বাড়ি ততক্ষণ গৃহ হয় না যতক্ষণ না গৃহিণী তাকে গৃহ বলে। তার সুরক্ষালাভের সঙ্গেই সমস্ত পুরুষার্থ লাভ হয়। আমার এই কুটিরকে গৃহ করে তুলতে একজন গৃহিণীর দরকার হয়েছিল। তাই তোমাকে নিয়ে এলাম।
তয়া হি সহিতঃ সর্ব্বান্ পুরুষার্থান্ সমশ্নুতে।।
শুনে লক্ষ্মীর মুখ আরক্ত হয়ে গেল। আরও জোরে জোরে হাওয়া করতে লাগল সে।
ন’বছর বয়সে নিমাইয়ের উপনয়ন হল। বৈশাখ মাসে অক্ষয় তৃতীয়ায় রত্নাকর নাপিত তার মস্তক মুণ্ডন করিয়ে দিল। কানে গায়ত্রী মন্ত্র দিলেন মাতামহ নীলাম্বর চক্রবর্তী। মাতামহী খাওয়ালেন হবিষ্যান্ন।
এর এক বছর আগে দাদা বিশ্বরূপ গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাস নিয়েছে। তার আগে দাদার সঙ্গে সে অদ্বৈত আচার্যের টোলে যেত। বসে বসে শুনত ওদের পাঠাভ্যাস। কিন্তু দাদা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই জগন্নাথ মিশ্র তার পড়াশুনা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পড়াশুনা শিখে নিমাইও যদি সন্ন্যাসী হয়ে যায়! ফলে নিমাইয়ের বিদ্যালাভে যতি পড়ল। উপনয়নের পর অবশ্য তাকে আবার ভর্তি করা হল গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোলে। গঙ্গাদাস ব্যাকরণশাস্ত্রে পণ্ডিত। নিমাই অসম্ভব শ্রুতিধর। একবার শুনেই তার মুখস্থ হয়ে যায় ব্যাকরণের নিয়মাদি। সতীর্থ মুরারি গুপ্ত, কমলাকান্ত, কৃষ্ণানন্দদের সে ব্যাকরণের ফাঁকি ধরে ধরে পর্যুদস্ত করতে থাকে। শাস্ত্রীয় কূট বিষয়ে তর্কে তার সঙ্গে কেউ পেরে ওঠে না। সকলের সঙ্গে ঠাট্টা করা তার স্বভাব। মুরারি গুপ্তকে বলে, তুই ব্যাটা বদ্যি, ব্যাকরণ পড়ে তুই কী করবি? পিত্ত-কফ-অজীর্ণ রোগের ওষুধ তো ব্যাকরণে নেই, শেষে কি রোগী মারবি? শুধু সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গে নয়, প্রাজ্ঞ বৃদ্ধ পণ্ডিতদের সঙ্গেও চলে তার ফাঁকি-র খেলা। শ্লোকের কূট তর্কে তাকে পরাস্ত করা এক রকম অসম্ভব হয়ে উঠল। পণ্ডিতবর্গ যত বিরক্ত হয়, অসম্মানিত হয়, তার চেয়েও বেশি বিস্মিত হয়।
এ ভাবেই দিন চলে যাচ্ছিল, অকস্মাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত জগন্নাথ মিশ্রের মৃত্যু হয়। জগন্নাথের আয় খুব বেশি না হলেও সংসার মোটামুটি সচ্ছলই ছিল। হঠাৎ তাঁর প্রয়াণে সংসারে অনিশ্চয়তা দেখা দিল।
নিমাই মাকে বলল, মা, চিন্তা কোরো না, আমি আছি কী জন্যে? আমি নিজের টোল খুলে ছাত্রদের পড়াব।
পড়াশুনা চললেও নিমাইয়ের দুরন্তপনা যে কিছু কম হয়েছিল, তা নয়। নদীর ঘাটে তার দৌরাত্ম্য বেড়েই চলছিল। সহপাঠীদের সঙ্গে শাস্ত্র নিয়ে বাদানুবাদ তো ছিলই, তার সঙ্গে পণ্ডিতদের সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে ঝগড়া। মুসলমান নবাবী আমলে হিন্দু প্রজারা কোণঠাসা হলেও জাতপাতের তীব্র দ্বন্দ্ব লেগেই ছিল। পণ্ডিতরা অব্রাহ্মণদের স্পর্শ বাঁচিয়ে চলত। ব্রাহ্মণদের মধ্যেও বৈষ্ণব আর শাক্তে লেগে ছিল মহা বিবাদ। নিমাইয়ের কাছে এও হয়ে উঠল এক খেলার বস্তু। সে জাতপাত মানে না। ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ-শাক্ত-বৈষ্ণব-হিন্দু-মুসলমান সবাই তার বন্ধু। সুযোগ পেলেই সে ব্রাহ্মণদের জাত মারার ফন্দি আঁটে।
ব্যাকরণের সঙ্গে সঙ্গে ন্যায়শাস্ত্র অধ্যয়নেও মন দিল নিমাই, লিখে ফেলল ন্যায়ের ওপর এক টীকা। কিন্তু যেই জানল সহপাঠী রঘুনাথ ন্যায়শাস্ত্র নিয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করতে চায়, দীধিতি নামে ন্যায়শাস্ত্রের এক বই লিখে ফেলেছে, অমনি তার নিজের লেখা টীকা ছুঁড়ে ফেলে দিল গঙ্গায়। গঙ্গাদাসের পর সুদর্শন ও বিষ্ণুদাস পণ্ডিতের কাছে বিভিন্ন শাস্ত্রে পাঠ নিয়ে নিমাই নবদ্বীপের অন্যতম পণ্ডিত হয়ে উঠল। এর মধ্যেই লক্ষ্মীর সঙ্গে গঙ্গাতীরে তাদের মন দেওয়া-নেওয়া সারা।
নিমাইয়ের দুরন্তপনা কমাতে শচীও চাইছিলেন তার বিয়ে দিয়ে ঘরে বৌমা আনতে। গৃহী হয়ে নিমাই যদি শান্ত হয়, সেই ভেবে। কিন্তু নিমাইকে সে কথা পাড়বেন কী করে! সংসারে কিছু আয় তো চাই। একজনের ভরণপোষণের যোগ্য না হলে তার বিয়ে দিলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা।
এদিকে নিমাই রাস্তায় পাকড়েছে বনমালী ঘটককে। বলেছে, এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে মরছ, তোমার চোখের সামনে যে একটা বিবাহযোগ্য পুরুষ ঘুরছে, তার দিকে তোমার চোখ পড়ে না?
বনমালী গেল শচীদেবীর আলয়ে। এ কথা সে কথার পর তুলল নিমাইয়ের বিয়ের কথা। নিমাই সেয়ানা হয়েছে, তার বিয়ে দেওয়া উচিত। শচী বললেন, ছেলে পিতৃহীন, তাকে তো আগে রোজগেরে হতে হবে। নইলে বিয়ে করে বৌকে খাওয়াবে কী? আমাদের সংসারের অবস্থা তো দেখছেন। আগে অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা করুক, তারপরে বিয়ে করবে।
বনমালী ক্ষুণ্ণ হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। আবার পথে দেখা নিমাইয়ের সঙ্গে। মায়ের সঙ্গে কী কথা হল, সেটা জেনে নিমাই ঘরে ঢুকেই মাকে বলল, বনমালী ঘটককে দেখলাম রাস্তায়, দেখে মনে হল মন খারাপ। সে কি আমাদের বাড়িতে এসেছিল? তুমি কি তাকে কিছু বলেছ, যার জন্যে মুখটা গোমড়া করে ফিরে যাচ্ছে? তুমি যে বলো অতিথি নারায়ণ, তবে তাকে সন্তুষ্ট করে দিলেই পারতে। খামোকা অতিথিকে কষ্ট দেওয়ার কী প্রয়োজন ছিল!
মা বুঝে গেলেন ছেলের মনের ভাব। আবার ডাক পড়ল বনমালী ঘটকের। সে ততদিনে নিমাইয়ের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে কোথায় গিয়ে প্রস্তাব পাড়তে হবে। বল্লভাচার্যের গৃহে গিয়ে নিমাইয়ের কথা পাড়ল সে। সুদর্শন, শাস্ত্রজ্ঞ ও সৎবংশজাত নিমাইয়ের কথা তখন নবদ্বীপে কে না জানে? এমন পাত্র পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু বল্লভাচার্য দরিদ্র পণ্ডিত। বনমালী বললেন, সে আপনাকে ভাবতে হবে না। প্রস্তাব এসেছে পাত্রপক্ষ থেকে, আপনি রাজি হলেই চার হাত এক করে দিই।
ষোল বছর বয়সে নিমাইয়ের ঘর আলো করে এল লক্ষ্মী।
ছেলেবেলার বন্ধু মুকুন্দসঞ্জয়ের চণ্ডীমণ্ডপে নিমাই টোল খুলে বসল। শচী ভেবেছিলেন নিমাইয়ের যা মেজাজ, ওর কাছে কেউ শিক্ষালাভ করতে আসবে না। তিনি গঙ্গাদাসের কাছে অনুরোধ করেন, তিনি যেন কিছু কিছু নাবালক ছাত্র নিমাইয়ের কাছে পাঠান। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল তাঁর আশঙ্কা অমূলক। নিমাই অতি ধুরন্ধর শিক্ষকও। তার মত ব্যাকরণ প্রাঞ্জল করে বোঝাতে পারে না আর কেউ। যেমন তার স্মৃতিশক্তি, তেমনি তার শব্দের ওপর ব্যুৎপত্তি। ছাত্র দিন দিন বাড়তে থাকে। গঙ্গাদাস পণ্ডিত মাঝে মাঝে এসে দেখে যান, উৎসাহ দেন নিমাইকে। নিমাই তখন করজোড়ে গরুড়পক্ষীটি সেজে গুরুর পাদপদ্ম পুজো করে।
ছাত্ররা কাছেপিঠে না থাকলে নিমাই অবশ্য তার নিজমূর্তি ধারণ করে। বন্ধু শ্রীবাস, মুকুন্দ দত্ত, মুরারি গুপ্ত তাকে এড়িয়ে চলে, কেননা সামনে পেলেই নিমাই তাদের সঙ্গে তর্ক করবে, হারাবে আর হ্যা হ্যা করে হাসবে। শ্রীবাস তাকে বলে উদ্ধতের চূড়ামণি। মুকুন্দ দূরত্ব বজায় রাখে। কে আর যেচে তর্কে হারতে চায়!
এর মধ্যে আবার এক নতুন অভ্যাস শুরু হয়েছে। পাঠদান শেষে পণ্ডিত নিমাই সারা নবদ্বীপ একা একা ঘুরে বেড়ায় উদ্দেশ্যহীনভাবে। চলে যায় বিশেষ করে শূদ্রপাড়ায়, যেখানে গয়লা, তাঁতি, মালাকার, তাম্বুলিদের বাস। তারা ব্রাহ্মণের আগমনে যত সন্ত্রস্ত হয়, তত নিমাই তাদের ঘরে ঢুকে দাওয়ায় বসে পড়ে, জল চায়, খাবার চায়। তাঁতির কাছে কাপড় চেয়ে নেয়, গয়লার কাছে দুধ দই, মালাকারের কাছে ফুলের মালা। অন্য সমস্ত বামুন তাদের ছায়া মাড়ায় না, অথচ এই পণ্ডিতবালক একেবারেই আলাদা। তারা নিমাইয়ের রঙ্গ বোঝে না, যা চায় তা দিয়ে দেয়। গন্ধবেনে তার গায়ে আতর লেপে দেয়। তাম্বুলি তাকে পান সেজে খাওয়ায়। শাঁখারি তার জন্যে এনে দেয় সবচেয়ে সুন্দর শাঁখ। খোলাবেচা শ্রীধর বাস করত নবদ্বীপের একেবারে এক প্রান্তে, কলা, কলার মোচা আর থোড় বিক্রি করে অতিকষ্টে তার জীবন-যাপন। নিমাই গিয়ে তার সঙ্গে মোচার দর কষাকষি করত। যে মোচা সে এমনিই দিয়ে দিতে চায়, নিমাই তা পয়সা না দিয়ে নেবে না। আবার তার যা দাম হওয়া উচিত, তাকে যেন তা থেকে কম নেওয়া হয়, তাই নিয়ে ঝুলোঝুলি করবে। শ্রীধর বুঝতে পারে না, এ কেমন মানুষ! এত বড় পণ্ডিত অথচ স্বভাবে যেন তার পাশের বাড়ির লোকের মত।
পূর্ববঙ্গে যাওয়া স্থির হতে লক্ষ্মী এসে দাঁড়াল নিমাইয়ের সামনে। বলল, আমাকেও নিয়ে চলুন। আমি আপনার সঙ্গে যেতে চাই।
নিমাই বলল, তা কী করে হয়? তুমি গেলে মাকে কে দেখবে? মা কি এখানে একা থাকবে?
লক্ষ্মী বলল, আমি একা কী করে থাকব?
নিমাই বলল, তুমি একা থাকবে কেন? তুমি আর মা থাকবে। একজন অন্যজনকে দেখে রাখবে। আমি তো আর অনন্তকালের জন্যে যাচ্ছি না। শ্রীহট্টে যাই, দেখি বিষয়সম্পত্তির কী অবস্থা। এখন তো আরও কিছু শিষ্যও জোগাড় করতে হবে, তাদের পাঠ দিতে হবে। ও দেশে কোনো পণ্ডিত থাকলে তাদের তর্কে হারাতে হবে। তোমার কী চাই বলো, আমি নিয়ে আসব।
লক্ষ্মী মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বলল, আমার কিচ্ছু চাই না। আপনি আমাকে নিয়ে যাবেন না, আমার কিচ্ছু চাই না।
নিমাই যতই তাকে বোঝাতে যায়, তাকে থাকতে হবে নৌকায়, হয়ত পদব্রজে ঘুরতে হবে বহু ক্রোশ রাস্তা, লক্ষ্মীর পক্ষে তা অসম্ভব। সে নিয়ে যাবে তার কিছু কিছু ছাত্রদের। যাত্রাপথে তারা তার দেখভাল করবে, সে তাদের পাঠদান করবে, এটাই দস্তুর। এই দলে কোনো মহিলা নেই, লক্ষ্মীকে নিয়ে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়, সে বুঝতেই চায় না। এক সময় ঘরের মধ্যে গিয়ে একা বসে বসে সে কাঁদতে লাগল। শচী প্রবোধ দিতে তার কাছে গেলে সে মুখ লুকালো তার আঁচলের তলায়।
চার-বছরের বিয়ে-করা বৌ আর বিধবা মাকে বাড়িতে রেখে কুড়ি-বছর বয়সী নিমাই জলপথে রওনা দিল পূর্ববঙ্গ। তার সঙ্গী হল কয়েকজন ছাত্র। শ্রীহট্টে পৌঁছালে তার আত্মীয়রা পরম সমাদরে তাকে গ্রহণ করল। বলল, যতদিন খুশি সে সেখানে থাকতে পারে। শচী ও লক্ষ্মীকে সঙ্গে না আনার জন্যে অনুযোগ করল তারা। বড় ছেলে জন্মাবার আগে শচী শ্রীহট্টে গেছিলেন, সেই তাদের শেষ দেখা, তারপর আর শচী সেখানে যাওয়ার সুযোগ পাননি। জগন্নাথের মৃত্যুর খবর তারা পেয়েছিলেন লোকমুখে, তার সম্পত্তির ভাগ নিমাই যখন খুশি বুঝে নিতে পারে। লক্ষ্মীর জন্যে তারা সঙ্গে দিল হাতে-বোনা সূক্ষ্ম কাপড়ের শাড়ি, সোনার অলঙ্কার। নিমাই তাদের ব্যবহারে চমৎকৃত হয়ে গেল। ভাবতে লাগল, লক্ষ্মীকে সঙ্গে আনলেই বোধ হয় ভাল হত।
আরও অবাক হল এই দেখে যে এত দূরেও তার পাণ্ডিত্যের খ্যাতি পৌঁছে গেছে। তাকে এখানে অনেকেই নামে চেনে। নবদ্বীপ থেকে নিমাই পণ্ডিত এসেছেন শুনে দলে দলে মানুষ তাকে দেখতে আসছে। সঙ্গে আনছে খাদ্য-বস্ত্র-উপঢৌকন। নিমাইয়ের জন্যে তো বটেই, তার ব্রাহ্মণীটির জন্যেও। নিমাইয়ের মন খারাপ হয়ে যায়। লক্ষ্মীর মুখ মনে পড়ে। আসার আগে সে বড় কান্নাকাটি করেছিল।
তপন মিশ্র নামে এক বিদ্বান পুরুষের সঙ্গে আলাপ হল। সাষ্টাঙ্গে নিমাইকে প্রণাম করে সে জানাল, সে নাকি স্বপ্ন দেখেছে এক দিব্যপুরুষ এসেছেন পুব বাংলায়, তাঁর কাছে দীক্ষা নিলে তার পুণ্যলাভ হবে। সে নিশ্চিত সেই দিব্যপুরুষটি নিমাই। নিমাইকে ধরে পড়ল তাকে দীক্ষা দেওয়ার জন্যে। নিমাই ছাত্রদের টোলে পড়ালেও এখনও দীক্ষা দিয়ে শিষ্য নেওয়া শুরু করেনি। তপনের ঝুলোঝুলিতে বাধ্য হয়েই একদিন সে বলল, আগামিকাল ভোরবেলা স্নান করে আমার কাছে এসো, আমি দীক্ষা দেব।
সেই রাতে নিমাই চিন্তা করতে লাগল তার ভবিষ্যতের কথা। কিছুদিন আগে অদ্বৈত আচার্যের সঙ্গে তার কথা হয়েছে, তিনি নিমাইকে অনেক কাজের দায়িত্ব দিতে চান। তার বাড়িতে ঈশ্বরপুরীর সঙ্গে নিমাইয়ের সাক্ষাত হয়েছিল, ব্যাকরণ নিয়েও কিছু কথা হয়েছিল। ঈশ্বরপুরীই একমাত্র যাকে সে তর্কে পরাস্ত করতে পারেনি। তাঁর যে শ্লোকের ভুল সে ধরেছিল, মৃদু হেসে ঈশ্বরপুরী তা খণ্ডন করে পরস্মৈপদী-আত্মনেপদীর পার্থক্য বুঝিয়েছিলেন। নিমাইয়ের কাছে লোকে দীক্ষা চাইছে, কিন্তু সে কার কাছে দীক্ষা নেবে? নিতে হলে ঈশ্বরপুরীর মতই কাউকে চাই। উপযুক্ত গুরু না পেলে ঈশ্বরপ্রাপ্তি হয় না। সমাজে এত ব্যাধি, এত অনাচার, এত হানাহানি— সামান্য ব্যাকরণ দিয়ে সে কীভাবে ব্যাখ্যা করবে? তপন মিশ্র যে আগামিকাল দীক্ষা নেবে, সে যদি পরদিন এসে তার জীবনের পরমারাধ্যের সন্ধান করে, তবে তাকে কী বলবে সে?
সময় চাই, হাতে আরও সময় চাই। নিজেকে জানার, চেনার, তার সঙ্গে আশেপাশের মানুষকে আরও নিবিড়ভাবে চেনার। ঈশ্বরের কী উদ্দেশ্য তা বুঝতে হবে। কোন মন্ত্রে তিনি জগৎ চালান, সেই মন্ত্রের স্বরূপ কী? এসব জানতে হলেও একজন উপযুক্ত গুরু প্রয়োজন। কোথায় এখন ঈশ্বরপুরী? তাঁকে সন্ধান করতে হবে। অনেক কাজ বাকি।
পরদিন প্রাতে তপন মিশ্রকে দীক্ষা দিয়ে তাকে সম্পূর্ণ অবাক করে নিমাই বলল, আমার ইচ্ছা তুমি কাশীধামে গমন করো।
তপন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বলল, কাশীধাম? সে তো বহুদূর। হঠাৎ কাশীধামে কেন?
নিমাই বলল, কাশীধাম অতি পবিত্র তীর্থ। সেখানে প্রচুর বিদ্বান পণ্ডিতের বাস। তুমি গিয়ে সেখানে বিদ্যাচর্চা করো এবং আমার অপেক্ষা করো। আমি স্থির করেছি পরিব্রাজক হিসাবে কিছুদিন ঘুরব কিছু তীর্থ এবং শেষে যাব কাশীধাম। তখন তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে। ততদিনে তুমি শাস্ত্রচর্চা করে পাণ্ডিত্য অর্জন করো। বাকি কথা সেই সাক্ষাতে বলব।
তপন বলল, গুরু-আজ্ঞা শিরোধার্য।
শ্রীহট্ট ত্যাগ করে আরও অনেক শহরে গ্রামে ঘুরল নিমাই। সর্বত্রই তাকে দেখতে উৎসুক সাধারণ মানুষ। সবাই হাত ভরে নিয়ে আসে উপহার। তার নৌকা ভরে ওঠে উপচারে। সংগ্রহ হল অনেক অলঙ্কার, অনেক বস্ত্র, অনেক খাদ্যাদি। মা নিশ্চয় খুব খুশি হবে, তার নিমাই এতগুলো মানুষের নয়নের মণি হয়ে উঠেছে। তার চেয়েও বেশি খুশি হবে লক্ষ্মী। রেশম, সুতি ও দামী পট্টবস্ত্রের অনেকগুলো শাড়ি পাওয়া গেছে, লক্ষ্মীকে পরলে খুব মানাবে। আর তো মাত্র কয়েকটা দিন, তারপরেই সে ফিরে যাবে নবদ্বীপ। ঘরে গিয়েই লক্ষ্মীকে অবাক করে দেখাবে এই শাড়ি-গয়নার পোঁটলা। তার হাসিটি বড় সুন্দর। এত সব উপহার পেলে তার হাসি নিশ্চয় থামতেই চাইবে না। এতদিনে মা নিশ্চয় তাকে আরও অনেক রান্না শিখিয়েছে। লক্ষ্মী তাকে ভাত বেড়ে দেবে। খেতে খেতে সে তাকে শোনাবে তার এই ভ্রমণের বৃত্তান্ত। অবোধ বালিকা যখন জানবে তার স্বামীটি দীক্ষা দিয়ে গুরুদেব হয়ে উঠেছে, কতই না অবাক হবে সে!
নিমাইয়ের সে স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। লক্ষ্মীর সঙ্গে তার আর সাক্ষাৎ হল না।