• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৮ | সেপ্টেম্বর ২০১৭ | উপন্যাস
    Share
  • মহাসিন্ধুর ওপার হতে : অমিতাভ প্রামাণিক


    || এক ||

    টলান্টিক মহাসাগরের ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে দু’খানা পালতোলা দাঁড়টানা জাহাজ, একটার নাম নিনা, অন্যটা পিন্টা। আকাশে এই মুহূর্তে অল্প মেঘ, কিন্তু দূর দিগন্তে আবার ঝড়ের পূর্বাভাস। যেদিকে তাকানো যায়, শুধু জল আর জল। এই অনন্ত বারিধিতে জাহাজের কয়েকজন ছাড়া প্রাণের কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না।

    চারদিক ভাল করে পর্যবেক্ষণ করে নিনার ডেকে এসে বসলো ক্রিস্টোফার। কতক্ষণ পরে ঝড় আসবে, কেমন সে ঝড়, কে জানে। তার এই চমকপ্রদ অভিযানের কথা লোকে জানবে কী করে, যদি সমুদ্রঝড়ে তলিয়ে যায় এই জাহাজদুটো? ক্রিস্টোফার জানে, তার বিড়ালের জীবন, অত সহজে তার মৃত্যু নেই। গত কয়েকদিন ধরে প্রবল ঝড়ের মোকাবিলা করতে হয়েছে তাদের। কিন্তু স্পেনের উপকূল এখনো বহু বহু দূর। কতদিন লাগবে পৌঁছাতে ঠিক নেই, সেখানে যদি সে আদৌ পৌঁছাতে না পারে আর! সব কথা গুছিয়ে লিখে ফেলতে হবে। লেখাটা অয়েল ক্লথে মুড়ে ঢুকিয়ে দেবে সে মোমের বাক্সের মধ্যে, সেটাকে আর একটা নিশ্ছিদ্র বাক্সে ভরে রাখলে জাহাজডুবি হয়ে তারা সবাই নিশ্চিহ্ন হলেও লেখার বাক্সটা জলে ভাসতে ভাসতে একদিন ঠিক পৌঁছে যাবে পৃথিবীর কোথাও কোনো এক মনুষ্যের চক্ষুগোচরে। এক জন জানলেই জেনে যাবে সমগ্র পৃথিবী।

    কাগজ কলম টেনে নিলো ক্রিস্টোফার। তারপর লিখতে লাগল তার অত্যাশ্চর্য অভিজ্ঞতার কথা, একটা চিঠিতে।

    সান সেবাস্তিয়ান থেকে যাত্রা শুরুর তেত্রিশ দিন পর আমরা গিয়ে পৌঁছালাম ভারত সমুদ্রে। আর সেখানে পেয়ে গেলাম লাইন দিয়ে একের পর এক ভারতীয় দ্বীপসমূহ। সেগুলোতে প্রচুর লোক, সবাইকে আমাদের রাজার বশ্যতা স্বীকার করিয়ে আমি সেই দ্বীপগুলোর আলাদা আলাদা নামকরণ করলাম। প্রথম দ্বীপটার নাম দিলাম সান সালভাদোর। এর পরে যে দ্বীপের দেখা পেলাম, তার নাম দিলাম সান্তা মারিয়া, পরেরটার ফার্নান্দিনা, তার পরেরটা ইসাবেলা, পঞ্চমটা জুয়ানা, ষষ্ঠটা এস্পানোলা। জুয়ানাটা এত বড়, যে তার শেষই নেই যেন। নিশ্চয় ওটা চিনের অংশই হবে। জুয়ানার উত্তর উপকূল দিয়ে বহুদূর অবধি জাহাজে গেলাম, শহর খুঁজলাম, খুঁজলাম শহরের শাসকদের, কিন্তু না পেলাম শহর, না কোন শাসনব্যবস্থা। পাড়াগাঁর মত রয়েছে মাত্রই কয়েকটা ঘরবাড়ি, সরকারি শাসনের কোন ব্যাপারই চোখে পড়ল না। লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারলাম না, কেননা আমাদের দেখেই ওরা ভয়ে পালিয়ে গেল। আমরা ওদের পেছন পেছন অনেকদূর গেলাম। ওরা উত্তর দিকে যাচ্ছিল, অনেকটা গিয়ে ওদের ছেড়ে দিয়ে আমরা এর পর দক্ষিণ-পূর্বে চললাম। সেখানেই পেয়ে গেলাম এস্পানোলা দ্বীপ। জুয়ানা আর এস্পানোলা দুটোই বিশাল বিশাল দ্বীপ। জুয়ানা ব্রিটেনের চেয়ে বড়, এস্পানোলাও বড়ই হবে আইবেরিয়ান উপদ্বীপের চেয়ে।

    এই দ্বীপগুলো আমরা সহজেই রাজার নামে দখল করে নিয়ে স্পেনের পতাকা উড়িয়ে দিলাম। এখানকার জমি বেশ উর্বর, নদী-খামার, বন-প্রান্তরে ভরা দারুন সুন্দর সুন্দর সব দ্বীপ। ফসলের ক্ষেত বানানো যাবে, গবাদি পশু পালন করা যাবে, শহর বসানো যাবে রীতিমত। আর এস্পানোলাতে তো মশলাপত্র বোঝাই, আছে সোনাদানা, অন্যান্য দামী রত্নরাজিও। জুয়ানার চেয়ে এ ব্যাপারে এস্পানোলাই বেশি ভাল।

    এখানকার মানুষজন যা বুঝলাম সব আদিম উপজাতি, এদের ধর্ম-টর্ম নেই। নিষ্পাপ সরল মানুষ, যুক্তি-টুক্তি বোঝে না, মোটেই আক্রমণাত্মক নয়। প্রায় উলঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়ায়, যুদ্ধ করার মত লোহার অস্ত্রশস্ত্রও নেই। সব ভিতু, শান্তশিষ্ট প্রকৃতির। সমস্ত দ্বীপগুলোতেই এরা একই ভাষায় কথা বলে। কোনকালে জাহাজ-টাহাজ দেখেনি তো, তাই আমাদের দেখে ভয় পেয়েছে মনে হয়, ভেবেছে আমরা বুঝি আকাশ-থেকে নেমে আসা ঈশ্বর। যে গুটিকয় লোকদের ধরতে পেরেছিলাম, তাদের বেশ উদার আর সাদাসিধে প্রকৃতির মনে হল। আমরা ওদের ফালতু কাচের জিনিসপত্র, ভাঙা বাসন, জুতোর ফিতে এইসব আজেবাজে জিনিস দিয়ে দেখলাম ওরা তাতেই খুশি, তার বদলে ওরা দিয়ে দিচ্ছিল সোনাদানা, তুলো। আমার সঙ্গীসাথীরা এইভাবে ওদের ঠকাচ্ছিল, সেটা আমার উচিত মনে হল না, তাই আমি তার বদলে ওদের কিছু পোশাক-আশাক দিলাম। এদের আমাদের দেশের নাগরিকের ও খ্রিষ্টান ধর্মের উপযুক্ত করে তুলতে হবে তো।

    সাদাসিধে বলে ভাববেন না এরা অলস বা অকর্মণ্য, বরং বেশ কাজের। আমরা যা বলি, ওরা চটপট সেই কথা দুই একবার শুনেই নিজেরা বলতে পারে। এরা ভাল ক্রীতদাস হতে পারবে। মেয়েরা দেখলাম পুরুষদের চেয়ে বেশি কাজের। এদের গায়ের রং কালো, তবে গিনিতে যেমন, অতটা কালো নয়। অধিকাংশই উলঙ্গ, তবে কেউ কেউ একখণ্ড বস্ত্র দিয়ে লজ্জাস্থান ঢেকে রাখে। এদের হাতে থাকে একটা ফাঁপা বেতের লাঠি। সেটা দিয়েই এরা চাষবাস করে আবার মারামারি করতে হলেও ওটাই সম্বল। রান্নায় নিশ্চয় একগাদা মশলা দেয়, খেতে ভীষণ ঝাল। পুরুষরা একটা বৌ নিয়েই সন্তুষ্ট, শুনলাম যেখানে ওদের রাজা-টাজা আছে, তাদের নাকি খুব বেশি হলে কুড়িটা বৌ থাকতে পারে। সম্ভবত এদের নিজেদের কোন সম্পত্তি নেই। ছোট্ট ডিঙি নৌকো বেয়ে এরা নদী পারাপার করে।

    স্থানীয় লোকের মুখে শুনলাম, কাছেপিঠে নাকি নরখাদক মানুষও আছে। সেই রাক্ষসরা ভীষণ আক্রমণাত্মক, তাদের লম্বা লম্বা চুল, মানুষ ধরলেই মেরে খেয়ে নেয়। আমি তাদের দেখিনি, তবে স্থানীয় লোকরা বলল ওরা নাকি দেখেছে, তাদের এক এক জনের অনেকগুলো করে ডিঙি আছে, যেগুলো নিয়ে তারা দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে যাতায়াত করে। আমি অবশ্য ওদের কথা বিশ্বাস করি না। এ রকম আবার হয় নাকি! নির্ঘাৎ এরা দূর কোন দ্বীপের সাধারণ ইন্ডিয়ানই, যাদের একটু অন্য রকম দেখতে। তারা হয়ত সমুদ্রবিদ্যা ভাল জানে, তাই অবলীলায় ঘুরে বেড়ায় এক দ্বীপ থেকে আর এক দ্বীপে। এদের কাছে শুনলাম কাছে এক দ্বীপ আছে যেখানে শুধু যুদ্ধবাজ মেয়েরা থাকে। আমার ধারণা এরা যাদের রাক্ষস বলছে, তারা হচ্ছে এই মেয়েদের স্বামী, পুরুষরা তাদের সঙ্গে সহবাসের জন্যেই ডিঙি নিয়ে দ্বীপে দ্বীপে ঘোরে। মেয়েরা যে দ্বীপটায় থাকে সেখানে নাকি প্রচুর তামা পাওয়া যায়, সেই তামা দিয়ে এরা যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র ঢাল-তলোয়ার বানায়।

    যে সব কথা সাতকাহন করে লিখল ক্রিস্টোফার, সেগুলো সব মিথ্যা না হলেও সত্যিও নয়। বেশ কিছু কথা সে লিখল স্রেফ বানিয়ে বা অতিরঞ্জিত করে। কিছু কিছু কথা সে বেমালুম চেপে গেল। অধিকাংশ কথাই তার নিজের বিশ্বাস। বস্তুত যে দ্বীপসমূহ সে আবিষ্কার করেছে, সেগুলো চীন বা ইন্ডিয়ার ধারেকাছেই নয়, পরে জানা গেছে সেগুলো আসলে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, কিন্তু ক্রিস্টোফারের জীবনের শেষ দিন অবধি তার দৃঢ় বিশ্বাস, এগুলো ইন্ডিজ অর্থাৎ ভারতই।

    ১৪৯২ সালের তেসরা অগাস্ট সন্ধ্যায় স্পেনের পালোস ডি লা ফ্রন্তেরা থেকে যাত্রা শুরু করে পরের বছর ১৫ই মার্চ সেখানে ফিরে আসে ক্রিস্টোফার। ফেরার মাসখানেক আগে প্রবল সামুদ্রিক ঝড়ে পিন্টা থেকে নিনা আলাদা হয়ে যায়, নিনাকে নোঙর ফেলতে হয় পর্তুগাল-অধিকৃত সান্তা মারিয়া দ্বীপে। সেখানে নিনার অর্ধেক দাঁড়ি-মাঝি বেঁচে যাওয়ার জন্য ঈশ্বরের উদ্দেশে তাদের প্রার্থনা জানাতে এক গীর্জায় হাজির হলে তাদের জলদস্যু সন্দেহে বন্দী করা হয়। দুদিন বন্দী থাকার পর মুক্তি পেয়ে আবার জাহাজ ছাড়লেও আবার সমুদ্রঝড়ে পড়ে তারা, বাধ্য হয়ে পর্তুগালেরই লিসবনে নিনাকে আবার দাঁড় করাতে হয়েছিল।

    যদিও ক্রিস্টোফার ফিরে এল দুখানা জাহাজ নিয়ে, গেছিল কিন্তু তিনটে নিয়ে, সবচেয়ে বড়টার নাম সান্তা মারিয়া, সেটারই ক্যাপ্টেন ছিল ক্রিস্টোফার। এই সান্তা মারিয়া ধ্বংস হয়ে গেছে সামুদ্রিক বিপর্যয়ে ক্রিস্টোফারের আবিষ্কৃত ইন্ডিজের এক দ্বীপে, যার নাম সে দিয়েছে এস্পানোলা। ক্রিস্টোফার অবশ্য সেটা পুরো চেপে গেছে, চিঠিতে লিখেছে সেই জাহাজটা সে রেখে এসেছে ওখানে তার কিছু সঙ্গীসাথীদের জিম্মায়। স্পেনের রাজা-রানিকে বোঝাতেই হবে ইন্ডিজে তার এই অভিযান সর্বাংশে সফল, তবেই না আবার পরের অভিযানের জন্যে টাকা-পয়সা মিলবে আর সে হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নৌ-সর্বাধিকারী।

    পৃথিবীটা যে গোল, সেটা সেই অ্যারিস্টটলের সময় থেকে ইওরোপের পণ্ডিতরা জানলেও তা নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনায় অসুবিধা ছিল, কেননা ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী পৃথিবী চ্যাপ্টা। শুধু তাই নয়, একই বস্তুর দু’ জায়গায় ছায়ার দৈর্ঘ্য তুলনা করে পৃথিবী নামক গোলকটার পরিধিও জানা ছিল পণ্ডিতদের। দার্শনিক টলেমি এই নিয়ে অনেক আঁকজোক করেছিলেন। নৌবিদ্যা জানা ছিল ভারতীয় নাবিকদের, সেই জ্ঞানের নির্যাস ভারতের পশ্চিম উপকূল দিয়ে আরব ব্যবসায়ীদের মারফত পারস্য উপসাগর ও লোহিতসাগর পেরিয়ে মিশর, ভূমধ্যসাগর হয়ে রোমান সাম্রাজ্যে পৌঁছাত বইকি। মিশর তো বহুদিন রোমানদেরই দখলে ছিল। ক্রিস্টোফার নিজে বইতে পড়েছে বিষুবরেখায় এক এক ডিগ্রি দ্রাঘিমা মানে সাতান্ন মাইলের কাছাকাছি। দুর্ভাগ্যক্রমে, সেই মাইল হচ্ছে আদতে আরবি মাইল, যা রোমান মাইলের চেয়ে অনেকটাই বড়। ক্রিস্টোফার মাইল বলতে বোঝে রোমান মাইল, তাই তার হিসাবে পৃথিবীর পরিধি ভুল করে হয়ে গেল উনিশ হাজার মাইল, কিন্তু আসলে এটা তো পঁচিশ হাজার মাইল।

    এই ভুলের সঙ্গে যোগ হল ইওরোপ-এশিয়া মিলে পৃথিবীর কত অংশ জুড়ে আছে, সেই গণনা। ক্রিস্টোফার শুনেছে অনেকেই বলেছেন, এই দুই মহাদেশ মিলে পৃথিবীর অর্ধেক, অর্থাৎ ভূ-গোলকের একশো আশি ডিগ্রি। কিন্তু তার নিজের বিশ্বাস, এর চেয়ে অনেক বেশিই হবে এই ভূখণ্ডের ব্যাপ্তি। নিজে গণনা করে সে সিদ্ধান্তে এসেছে, অন্তত দুশো পঁচিশ ডিগ্রি হবে এর পরিমাপ, যার সর্বপশ্চিমপ্রান্তে পর্তুগাল, সর্বপূর্বে কিপাঙ্গু অর্থাৎ জাপান। ইওরোপিয় পর্যটক মার্কোপোলো চিনকে ক্যাথে আর জাপানকে কিপাঙ্গু বলে গেছেন। তাহলে পৃথিবীর জলভাগ পড়ে থাকল তিনশো ষাট মাইনাস দুশো পঁচিশ অর্থাৎ একশো পঁয়ত্রিশ ডিগ্রি। স্পেনের অধীনে আফ্রিকার পশ্চিমে আছে যে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ, সেখান থেকে পশ্চিমে যাত্রা শুরু করলে, এর পরিমাপ আর একটু কম। আর জাপানের পূর্বে কি আর কোন দেশ নেই, যেখানে মানুষ থাকে না? অ্যান্টিলিয়া বলে যে রহস্যময় জায়গার নাম শোনা যায়, সেটা নির্ঘাৎ জাপানের পুবদিকেই হবে। তাহলে ডিগ্রি হিসাবে জলপথ আরো একটু কমে গেল। এ ছাড়া সে তো আর বিষুবরেখার ওপর দিয়ে যাচ্ছে না, যাচ্ছে আরো অনেকটা উত্তর দিয়ে, ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ বিষুবরেখার আঠাশ ডিগ্রি উত্তরে, ঐ অক্ষপথে ডিগ্রিপিছু মাইলও অনেক কম।

    ক্রিস্টোফার হিসেব করে দেখল, ক্যানারি দ্বীপ থেকে পশ্চিমে মেরেকেটে চব্বিশশো মাইল গেলেই সে পৌঁছে যাবে পূর্ব এশিয়ায়, যেখানে পরপর আসবে অ্যান্টিলিয়া, জাপান, চিন, ইন্ডিজ অর্থাৎ ভারত।

    কিন্তু অভিযানে যে যাবে, টাকা কই? যাতায়াতের খরচের হিসাবপত্তর লিখে পর্তুগালের রাজা দ্বিতীয় জনের কাছে আবেদন পাঠাল সে। বলল তাকে শক্তপোক্ত তিনটে জাহাজ দেওয়া হোক, এক বছরের মধ্যে সে পশ্চিমপথে ইন্ডিজ যাওয়ার যাত্রাপথ বের করে দেবে। এই পথ বেরিয়ে গেলে বাণিজ্যে পর্তুগাল টেক্কা দিতে পারবে ইওরোপের সমস্ত দেশগুলোর সঙ্গে তো বটেই, আরবের বণিকদের সঙ্গেও। এর বদলে নতুন যে জায়গাগুলো সে আবিষ্কার করবে, তাকে স্রেফ সেখানকার গভর্নর নিয়োগ করতে হবে, সেই জায়গাগুলো থেকে পর্তুগালের যা রাজস্ব আদায় হবে, তার এক দশমাংশ তাকে দিতে হবে, আর দিতে হবে মহাসাগরের শ্রেষ্ঠ নৌ-সর্বাধিকারীর সম্মান।

    রাজা দ্বিতীয় জন সেই আবেদনপত্র তার দেশের বিশেষজ্ঞ নাবিকদের কাছে পাঠিয়ে তাদের মতামত চাইলে সবাই একযোগে তা নাকচ করল। মাত্র চব্বিশশো মাইল! পাগল না মাথা খারাপ! তিন বছর পর আবার সে আবেদন করল দ্বিতীয় জনের দরবারে, আবার নামঞ্জুর হল সেই দরখাস্ত। ততদিনে বার্থলোম্যু ডায়াস নামে একজন আফ্রিকার দক্ষিণতম প্রান্ত ঘুরে ফেরত গেছে পর্তুগালে, এশিয়া সেখান থেকে আর কতদূর! এখন পশ্চিম দিক দিয়ে ইন্ডিজ যাওয়ার নতুন পথ খোঁজার কোন মানেই হয় না।

    বিফলমনোরথ ক্রিস্টোফার পর্তুগালের রাজার কাছে সুবিধে না করতে পেরে চলল জেনোয়া, ভেনিস, ইংল্যান্ডে, যদি ওদের শাসকরা তার আবেদনে সাড়া দেয়। এদের কেউই তাকে শোনালো না কোন আশার বাণী। অ্যারাগনের দ্বিতীয় ফার্দিনান্দ আর কাস্তিলের ইসাবেলা বিয়ে করে তখন স্পেনের সম্রাট-সম্রাজ্ঞী। তাদের কাছে অনুরোধ পাঠালে রানি ইসাবেলা ক্রিস্টোফারকে ডেকে পাঠালেন। ক্রিস্টোফার ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে পরিবেশন করল তার স্বপ্ন। স্পেনের বিশেষজ্ঞরাও ক্রিস্টোফারকে জানিয়ে দিল, তার হিসাবপত্তর ভুল, এত কম দূরত্ব হতেই পারে না।

    তবে একেবারে নাকচ না করে স্পেনের রাজা-রানি তাকে ঝুলিয়ে রাখলেন বছরে কিছু অনুদান মঞ্জুর করে। তারসঙ্গে একটা চিঠিও লিখে দিলেন তারা – স্পেনের অধীনে যত শহর বন্দর আছে, সেখানে এই চিঠি দেখালে তাদের শাসকরা যেন ক্রিস্টোফারকে বিনামূল্যে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।

    কিন্তু এতে থেমে থাকার মানুষ তো নয় ক্রিস্টোফার। সে স্পেনের অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে তার পরিকল্পনা নিয়ে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যেতে লাগল, যাতে দরকারে তারা তাকে সমর্থন করেন। রাজা-রানির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ অবশ্য তখন নিজের ও আশেপাশের দেশ থেকে মুসলমান শক্তি হ্রাস করা। গ্রানাডার যুদ্ধে সেই সাফল্য এল অবশেষে। ততদিনে এসে গেছে ১৪৯২ সাল। যুদ্ধ জিতে একটা দুর্গে বিশ্রাম করছিলেন রাজা-রানি, সেখানেই ডেকে পাঠালেন ক্রিস্টোফারকে। আবার শোনা হল তার পরিকল্পনা। এবং, হায়, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে আবার তা নাকচ হল। যার করুণা আশা করে ক্রিস্টোফার এখানে এসেছিল, সেই রানি ইসাবেলাই নিজে এবার তাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন – না।

    ক্ষুণ্ণ ক্রিস্টোফার দুর্গ ছেড়ে ফিরে যাচ্ছে একটা খচ্চরে চেপে, হঠাৎ তার পথরোধ করে দাঁড়াল ইসাবেলার দূত। রাজা ফার্দিনান্দ এর মধ্যে তার স্ত্রীকে বুঝিয়েছেন, এই শুভদিনে ক্রিস্টোফারকে ওভাবে ‘না’ বলে দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। এতদিন ধরে সে যখন একটা স্বপ্ন বুনে চলেছে, এতবার তাদের কাছে এসেছে তা শোনাতে, দেখাই যাক না, তাতে কতটুকু দম আছে।

    রাজা-রানির সঙ্গে ক্রিস্টোফারের চুক্তি হয়ে গেল।

    সেই ক্রিস্টোফার ফিরে এল তার অভিযান সফল করে। পালোস ডি লা ফ্রন্তেরা থেকে প্রথমে সে গেছিল ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের সান সেবাস্তিয়ান ডি লা গোমেরা বন্দরে, তিনখানা জাহাজ নিয়ে। পালোসের অধিবাসীদের কাছ থেকে রাজা ফার্দিনান্দ এই খরচের সিংহভাগ আদায় করলেন। সবচেয়ে বড় জাহাজ সান্তা মারিয়ার ক্যাপটেন হল ক্রিস্টোফার, বাকি দুটো জাহাজ পিন্টা আর নিনার ক্যাপটেন করা হল দুই অভিজ্ঞ নাবিক ভাই মার্টিন আলোন্সো পিঞ্জো আর ভিনসেন্ট ইয়ানেজ পিঞ্জোকে। তিনটে জাহাজই টুকটাক মেরামত করে নেওয়া হল, তুলে নেওয়া হল যথেষ্ট খাবার, জল ও অন্যান্য রসদ। ক্যানারি দ্বীপ থেকে সেই যে ভেসে পড়ল ওরা সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখে, তারপর শুধু জল আর জল। ঘন্টা, প্রহর, দিন, সপ্তাহ পেরিয়ে যায়, মাটি আর চোখে পড়ে না। সমুদ্রে ঝড় লেগেই আছে, সঙ্গীরা দাঁড় টানতে টানতে ক্লান্ত। অবস্থা এমন হল, একদিন সবাই চেপে ধরল ক্রিস্টোফারকে, তার গণনা সব ভুল, এভাবে কোথাও পৌঁছানো যাবে না। রসদ ফুরিয়ে আসছে, সবাই মারা পড়বে। ফিরে যাওয়াই উচিত ওদের।

    চিন্তা যে ক্রিস্টোফারের হচ্ছিল না, তা নয়, কিন্তু এভাবে ফিরে যাওয়া আর মরে যাওয়ার মধ্যে পার্থক্য কোথায়? বাধ্য হয়ে ক্রিস্টোফার বলল, আর তিন দিন আমাকে সময় দাও। এর মধ্যে মাটি দেখা না গেলে আমরা ফিরেই যাব।

    বারোই অক্টোবর মাঝরাত্রে, তখন রাত দুটো, পিন্টা জাহাজের রডরিগস্‌ বলে একজন দূরবিনে চোখ লাগিয়ে দূরে জমির দেখা পেল। পিন্টার ক্যাপটেন মার্টিনকে সেটা দেখাতেই সে সাইরেন বাজিয়ে ক্রিস্টোফারকে জানিয়ে দিল কাছেই আসছে জমি। আস্তে আস্তে ভোরের আলো ফুটে উঠতেই দেখা গেল আকাশে পাখির ওড়াউড়ি, সমুদ্রের জলে ভেসে আসা কাঠের টুকরোও।

    ফার্দিনান্দ-ইসাবেলার সঙ্গে ক্রিস্টোফারের চুক্তি ছিল যে প্রথম ইন্ডিজের জমির সন্ধান পাবে, তার কপালেই জুটবে আজীবন সাম্মানিক। ক্রিস্টোফার কি তা অন্য কাউকে ছেড়ে দিতে পারে? সে ওদের জানিয়ে দিল, বেশ কয়েক ঘন্টা আগেই সে দেখেছে সামনে ভূখণ্ড আসছে, তার নিজের গণনামতই। সুতরাং সেই আবিষ্কর্তা, অন্যরা নয়।

    তারপর একে একে তারা পেয়ে গেল এক এক করে অনেকগুলো দ্বীপ। প্রথম চারটে দ্বীপই পরে বাহামা দ্বীপপুঞ্জ নামে পরিচিত হয়। সান সালভাদর যার নাম দিয়েছিল সে, তার নাম পরে হল প্লানা কেজ; নিজের জাহাজের নামে দ্বীপের নাম দিয়েছিল সান্তা মারিয়া, সে নাম বদলায়নি; পরের দুটোর নাম ছিল স্পেনের রাজা-রানির নামে। ফার্নান্দিনার নাম হল লং আইল্যান্ড আর ইসাবেলার নাম ফরচুন আইল্যান্ড। জুয়ানা হচ্ছে কিউবা আর এস্পানোলার নাম হিস্পানিওলা, যাতে আছে হাইতি আর ডোমিনিকান রিপাবলিক। বাহামার দ্বীপগুলো খুবই ছোট ছোট, সে তুলনায় ক্রিস্টোফারের জুয়ানা আর এস্পানোলা অনেক বড়। জুয়ানা থেকে এস্পানোলা যাওয়ার আগে স্থানীয় লোকেরা পাশের এক দ্বীপে প্রচুর সোনা পাওয়া যায় বলায় মার্টিন তার পিন্টা জাহাজ নিয়ে সোনার খোঁজে সেদিকে এগিয়ে যায়, ক্রিস্টোফার চলতে থাকে এস্পানোলার দিকে। সেখানে ক্রিসমাসের দিন প্রবল ঝড়ে তার সাধের সান্তা মারিয়া ভেঙে পড়ে, তাকে পরিত্যাগ করা ছাড়া উপায় ছিল না ক্রিস্টোফারের। জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দিয়ে এস্পানোলার তীরে বানানো হয় লা নাভিদাদ নামে এক অস্থায়ী দুর্গ আর স্থানীয় মানুষদের ভয় দেখানোর জন্যে কামানের গোলা ছোঁড়ার এক চাঁদমারি। অভিযান সেরে ফিরে আসার আগে সেখানে ঊনচল্লিশ জন সহযোগীকে রেখে আসে ক্রিস্টোফার, যাতে তারা দুর্গ রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারে আর স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তার সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। নিনাতে চড়ে বসে ক্রিস্টোফার, চলতে থাকে এস্পানোলার উত্তর উপকূল ধরে, কিছুদিন পরেই পিন্টার দেখা মিলে যায় তার।

    ভারতীয় মশলা যদিও মেলেনি ওদের, আসার আগে কুড়ি-বাইশজন স্থানীয় মানুষকে বন্দী করে তুলে নেয় তারা জাহাজে, রাজা-রানিকে দেখানোর জন্যে। তাদের মাত্র ছ-সাত জনই অবশ্য বেঁচে ছিল ওরা যখন স্পেন পৌঁছাল।

    ক্রিস্টোফারের সফল অভিযানের কাহিনি সারা স্পেনে তো বটেই, দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ল কিছুদিনের মধ্যেই। তার খ্যাতি বেড়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। ক্রিস্টোফারের সম্মানে ভোজসভার আয়োজন হতে লাগল বিভিন্ন শহরে। সেখানে সে রসিয়ে রসিয়ে বলতে লাগল তার অভিযানের কাহিনি।

    পরশ্রীকাতর মানুষের অভাব নেই কোন দেশেই। এক সভায় স্পেনের এক হোমড়াচোমড়া ব্যক্তি বলে বসলেন, মিস্টার ক্রিস্টোফার, আমাদের স্পেনে তো জাহাজ চালানোর লোকের অভাব নেই। আপনার মত বহু দক্ষ ও কৌশলী নাবিক রয়েছে সারা দেশেই। ইন্ডিজ তো যেখানে থাকার সেখানেই থাকত, আজ নয় কাল কেউ না কেউ ঠিক বের করে ফেলত ওটা, তাই না? এতে আপনার কৃতিত্ব কোথায়?

    ক্রিস্টোফার অল্প কথার মানুষ। সে জানে এ রকম ঠাট্টা-তামাশা যারা করে, তারা ভেতরে ভেতরে ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে মরে। সে এই মন্তব্যের কোন উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনই বোধ করল না।

    কিন্তু লোকটাও নাছোড়বান্দা। পাশে আর যারা ছিল, তাদের কয়েকজনকে নিজের দিকে পেয়ে আবার সেই একই কথা ফেঁদে আসরের মজা ভন্ডুল করার উপক্রম করতেই ক্রিস্টোফার এক বেয়ারাকে ডেকে বলল, ভাই, একটা ডিম দিয়ে যা তো। বেয়ারা ডিম এনে তার হাতে দিতেই ক্রিস্টোফার সভার সবাইকে একটা টেবিলের পাশে জড়ো করিয়ে নাটকীয়ভাবে বলল, আমি জানি আমাদের সারা দেশে বহু করিৎকর্মা পুরুষ আছে। তারা অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। কিন্তু এখানে আমার সামনে কেউ আমাকে দেখান তো এই ডিমটাকে লম্বালম্বি টেবিলের ওপর দাঁড় করিয়ে। আমি বাজি ধরছি, কেউ পারবেন না।

    সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল টেবিলের ওপর ডিম লম্বালম্বি দাঁড় করানোর খেলায়। যে যতই চেষ্টা করে, ডিম কিছুতেই দাঁড়ায় না, হেলে পড়ে আড়াআড়ি। অনেকবার চেষ্টা করে সবাই হাল ছেড়ে দিল। যিনি প্রথম ক্রিস্টোফারের পেছনে লেগেছিলেন, তিনি বলে বসলেন, এটা একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার, এটা করা যায় না। আর করা যায় না বলেই এ দিয়ে কিছুই প্রমাণ হয় না।

    ডিমটা হাতে নিয়ে ক্রিস্টোফার বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে ঠুকুস করে লম্বালম্বি টেবিলের ওপর ঠুকে দিল। তলার দিকটা একটু ভেঙে গেল বটে, তার জন্যেই ডিমটা দাঁড়িয়ে গেল টেবিলের ওপর। চ্যালেঞ্জার হাঁ হাঁ করে ওঠার আগেই ক্রিস্টোফার তার মুখের ওপর বলল, বলবেন তো এভাবে আমি কেন এটা করলাম? এ তো খুবই সহজ, তাই না? করে দেখানোর পর সব কাজই এ রকম সোজা। যে প্রথমে করে, সেই আবিষ্কর্তা। এত বছর ধরে কেউ তো স্পেন থেকে ইন্ডিজ খুঁজে পায়নি। আমি পেয়েছি, আমি, ক্রিস্টোফার কলম্বাস।

    * * *

    স্পেনের পাশেই পর্তুগাল। স্পেন নতুন জিনিস আবিষ্কার করলে পর্তুগাল কি বসে বসে দেখবে? ক্রিস্টোফার কলম্বাসের এই অভিযানের প্রায় পাঁচ বছর পর পর্তুগাল থেকে আর এক অভিযান শুরু করল ভাস্কো ডা গামা, উদ্দেশ্য সেই ভারতই। কিন্তু কলম্বাসের মত পশ্চিম দিক দিয়ে নয়, পূর্বে আফ্রিকার উপকূল বরাবর দক্ষিণে চলতে লাগল তার জাহাজগুলি। কলম্বাসের মতই ভাস্কোর সঙ্গেও তিনখানা জাহাজ, সঙ্গে একটা রসদের নৌকা। ভাস্কোর জাহাজগুলোও ছোট ছোট। ওদের মধ্যে সবচেয়ে বড় যেটা, যার নাম সাও গ্যাব্রিয়েল, মেরেকেটে চুরাশি ফুট লম্বা। তার ছটা দাঁড়, তিনটে পাল। তবে এর খোলটা গভীর, অর্থাৎ জাহাজটা সমুদ্রে ভাসার সময় বেশ উঁচু থাকে। কুড়িখানা কামান ফিট করা আছে এই জাহাজে, শত্রু দেখলেই সেখান থেকে গোলা ছোঁড়া হয়। উঁচু থেকে গোলা ছুঁড়লে তার রেঞ্জ বেশি হয়, তাতে অনেক সুবিধে।

    বার্থলোম্যু ডায়াস আফ্রিকার দক্ষিণতম প্রান্ত খুঁজে পেলেও সেখান থেকেই ঘুরে ফিরে গেছিলেন পর্তুগাল। ভাস্কো ডা গামার জাহাজ তিনটে উত্তমাশা অন্তরীপ বেড় দিয়ে আফ্রিকার পূর্ব উপকূল দিয়ে উত্তরে চলতে লাগল। ম্যাডাগাস্কার ও আফ্রিকার মূল ভূখণ্ডের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলল জাহাজগুলো, নোঙর করল কেনিয়ার মালিন্ডি বন্দরে।

    কোথায় এই মালিন্ডি বন্দর? পৃথিবীর ম্যাপে আফ্রিকার ছবিটা যদি হয় অনেকটা বাংলা ণ-র মত, তবে ঐ ণ-র শুঁড়ের ওপর-অংশটা ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণে লাগোয়া। শুঁড়ের সবচেয়ে উত্তর অংশ আর সবচেয়ে পশ্চিমের অংশের মাঝামাঝি হচ্ছে পর্তুগালের দক্ষিণতম প্রান্ত। ণ-র শুঁড়ের দক্ষিণতম অংশ আফ্রিকার ম্যাপে গিনি উপসাগর, এর অল্প একটু দক্ষিণে গেলেই বিষুবরেখা। আফ্রিকার উত্তর থেকে বিষুবরেখা পৌঁছাতে যতখানি দক্ষিণে নামতে হয়, ততখানি আরো দক্ষিণে গেলে মেলে আফ্রিকার দক্ষিণতম প্রান্ত উত্তমাশা অন্তরীপ। তাকে বেড় করে পূর্ব উপকূলে আবার উত্তরাভিমুখে চলতে শুরু করে প্রায় বিষুবরেখা ছুঁই ছুঁই অবস্থায় এলে তবেই মেলে এই মালিন্ডি বন্দর। এখান থেকে আফ্রিকার পূর্ব উপকূল বিষুবরেখার সঙ্গে মোটামুটি পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে উত্তর-পূর্বে বিন্যস্ত। উপকূল বরাবর কেউ যদি উত্তরে এগিয়ে যায়, তবে আধুনিক মানচিত্রে কেনিয়ার পরে আসবে সোমালিয়া, তারপর উপসাগরীয় অঞ্চলের ইয়েমেন, ওমান, ইরান, পাকিস্তান ইত্যাদি। আর উপকূল ছেড়ে বিষুবরেখার সঙ্গে পঁয়তাল্লিশের বদলে কেউ যদি তার অর্ধেক কোণে উত্তর-পূর্বে যাত্রা শুরু করে, তবে অচিরেই ভারত মহাসাগর থেকে গিয়ে পড়বে আরব সাগরে আর ধাক্কা মারবে ভারতবর্ষের পশ্চিমের মালাবার উপকূলে।

    ভাস্কোর জাহাজে ওর নিজের লোক ছাড়াও আছে কয়েকজন কয়েদি ক্রীতদাস। বিপজ্জনক ও খারাপ খারাপ কাজগুলো ওদের দিয়ে করানো হয়। মালিন্ডি বন্দরে পৌঁছে ভাস্কো বুঝতে পারল, এখানে অনেকেই ভারতে যাওয়ার রাস্তা জানে। আরবরা এই পথে বাণিজ্য করছে বহু বছর ধরে। আফ্রিকা থেকে পালতোলা জাহাজে ভারতে আসতে গেলে দরকার হয় সহায়ক হাওয়ার। এক এক সময় হাওয়া এক এক দিকে বয়, সেইমতন যাত্রার পরিকল্পনা করতে হয়। একজন রাস্তা-চেনা পাইলট পাওয়া গেল, তাকে জাহাজে তুলে নিয়ে অবিলম্বে জাহাজ ছাড়তেই মাত্র তেইশ দিনে আফ্রিকা থেকে ভারতের মালাবার উপকূলে পৌঁছে গেল জাহাজ।

    কালিকট বন্দরে সেই প্রথম কেউ পৌঁছাল ইওরোপ থেকে আফ্রিকা ঘুরে।

    বিদেশি জাহাজ কালিকটে লেগেই থাকে, কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে, যে আসবে সেই জাহাজ থেকে নেমে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারবে। এর জন্যে অনুমতি লাগে। কালিকটে সেই অনুমতি নিতে হয় সেখানকার শাসকের কাছ থেকে, যাকে বলা হয় জামোরিন। ভাস্কোর জাহাজ কালিকটে যখন নোঙর করল, জামোরিন তখন কালিকটে ছিলেন না। ফলে ভাস্কো সঙ্গে সঙ্গে জাহাজ থেকে মাটিতে নামতেও পারল না। এক সপ্তাহ পরে জামোরিনের লোক এসে তাদের নিয়ে গেল কোল্লামে, সেখানেই তাদের অবতরণ করানো হল।

    জামোরিনের সেই প্রতিনিধিদলে বেশ কিছু অস্ত্রধারী সৈনিক। তারা পাহারা দিয়ে ভাস্কো ডা গামা আর তার ডজনখানেক সঙ্গীদের পালকিতে তুলে নিয়ে চলল এক মন্দিরে। মন্দিরটা বেশ দূরে। পথে একজনের বাড়িতে তাদের মধ্যাহ্নভোজন করিয়ে নেওয়া হল। তারপর তোলা হল নৌকায়। ব্যাকওয়াটারের খাঁড়ি দিয়ে কালিকট শহরের উপকণ্ঠে মন্দিরে তাদের নিয়ে যাওয়া হল।

    ভাস্কো আর তার সঙ্গীরা আগে তো মন্দির নামে কিছু দেখে নি, উপাসনালয় বলতে তারা বোঝে গীর্জা। এখানে এসে তারা দেখল এখানকার যাজকদের পোশাক আলাদা, ঊর্ধ্বাঙ্গ বস্ত্রহীন, সেখানে কয়েক গাছি সরু সুতো ঝুলছে, কপালে-বুকে-হাতে সাদা রঙের মাটি মাখা। দেবালয়ে বিচিত্র মনুষ্যমূর্তি, তাদের চারটে বা তারো বেশি হাত, বড় বড় দাঁত। তবু তারা ভাবল, এ নিঃসন্দেহে একটা গীর্জা, তারা খ্রিস্টান রাজার রাজ্যেই এসেছে, এরা অন্য দেশের বলেই হয়ত এখানকার নিয়ম অন্য রকম। তারা তাদের প্রথামত হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনা সেরে নিল।

    আবার তাদের তোলা হল পালকিতে, এবার তাদের গন্তব্য কালিকটের শাসক জামোরিনের প্রাসাদ। এবারের যাত্রা আরো চমকপ্রদ। পালকির আগে আগে চলল ঢাক ঢোল কাড়া-নাকাড়া বাজানো বাদ্যের দল জগঝম্প বাজাতে বাজাতে। কৌতূহলী জনতা তাদের বাড়ির ছাদ থেকে উৎসুক দৃষ্টি মেলে বুঝতে চেষ্টা করল, কাদের এত সম্মান করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। প্রাসাদে ঢোকার মুখে তীব্র জনস্রোত, তারা সবাই অতিথিদের দেখতে চায়। রাজার অতিথি বলে কথা!

    আগন্তুকদের কাছে সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। এর কাছে কোথায় লাগে পর্তুগালের রাজা! রাজসভায় মধ্যমণি হয়ে জামোরিন বসে আছেন এক বিশাল সিংহাসনে। তার ওপরে সোনালি চন্দ্রাতপ। সোনার এক বিরাট পাত্র থেকে তাকে পান-সুপুরি সেজে দেওয়া হচ্ছে। তিনি পান চিবাতে চিবাতে পিচিক করে পিক ফেলছেন বাঁ-হাতে ধরা এক পিকদানিতে, সেটাও সোনার এবং বিরাট। ভাস্কোদের দল সভায় এলে তাদের সবাইকে পরিবেশন করা হল ফল – কলা ও কাঁঠাল। জামোরিন বললেন, আমার রাজ্যে আপনাদের স্বাগত। কী হেতু আগমন সেটা অনুগ্রহ করে আমার সভাসদকে বুঝিয়ে বলুন।

    ভাস্কোর আত্মসম্মানে লাগল। সে বলল, আমি পর্তুগালের রাজার রাজপ্রতিনিধি, সভাসদকে নয়, আপনাকেই সরাসরি আমার বক্তব্য জানাতে চাই।

    বলল বটে, কিন্তু ভুলটা হল ওখানেই। গড়গড় করে পর্তুগিজ ভাষায় বলে গেল, রাজা ম্যানুয়েলের নির্দেশে তিনখানা জাহাজ নিয়ে আমরা আপনার এখানে এসেছি, আমি এর ক্যাপ্টেন মেজর। আমাদের রাজা বলে দিয়েছেন যতদিন না আমরা পুবদেশীয় খ্রিস্টান মহান রাজার সন্ধান পাই, ততদিন যেন দেশে না ফিরি। আর তার সন্ধান পেলে আমি যেন আমাদের রাজার পাঠানো দুটো চিঠি তার হাতে তুলে দিই। যে চিঠিদুটো আছে জাহাজে, আমি পরদিন এসে আপনাকে দেব।

    কিন্তু এই পর্তুগিজ ভাষা অনুবাদ করে যখন জামোরিনকে শোনানো হল, তাতে তার মানে গেল বদলে। জামোরিনকে বিন্দুমাত্র খুশি দেখাল না।

    পরের দিন আবার রাজপ্রাসাদে আসবে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা বিদায় নিলেও পরের দিন ভাস্কোর যাওয়া হল না জামোরিনের প্রাসাদে। প্রচলিত রীতি হচ্ছে অতিথিরা নানা রকম উপহার নিয়ে রাজার কাছে যাবে, যাওয়ার আগে রাজার অনুচররা দেখবে কী সেই উপহার, তা রাজার উপযুক্ত কিনা। ভাস্কোর জাহাজে গিয়ে তারা যখন দেখল উপহারদ্রব্য হচ্ছে হাতমুখ ধোওয়ার বেসিন, টুপি, তেলের শিশি, মধু আর ছিটকাপড়, তারা মখ টিপে হাসাহাসি করতে লাগল। এই সব ছাইপাঁশ কেউ রাজাকে উপহার দেয়! অনুচররা ভাস্কোকে বলল, শোনো, বিদেশি, এসব ফালতু জিনিস নিয়ে রাজার কাছে যেও না। উনি মানী লোক, মানীর মান রাখতে তোমরা শেখোনি মনে হচ্ছে। আমরা বলে দিচ্ছি, হয় সোনার তাল নিয়ে যাও, নয় খালি হাতে যাও।

    খালি হাতেই গেল ভাস্কো তার পরদিন। রাজাকে গিয়ে বলল, সে এসেছে এক বিশাল ধনী দেশ থেকে, তাদের নানা রকম মহার্ঘ্য বস্তু বিক্রি করে এখান থেকে মশলাপাতি কিনে নিয়ে যেতে চায়। জামোরিন বিশ্বাস করতেই চান না এরা কোন ধনী দেশ থেকে এসেছে। ধনী কেউ খালি হাতে রাজার সঙ্গে দেখা করতে আসে? অনেক অনুনয় করে পর্তুগালের রাজার লেখা একটা চিঠির আরবি অনুবাদ পড়ে শোনানোর অনুমতি পেল ভাস্কো, তাতে জামোরিনের এত প্রশংসা লেখা যে তাতে তার মন গলে গেল বেশ খানিকটা। ফলে ভাস্কোকে অনুমতি দেওয়া হল, সে তার দেশ থেকে নিয়ে আসা জিনিসপত্র স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতে পারবে।

    ভাস্কোর দলবল ফিরে গেল কোল্লামে, কিন্তু জামোরিনের লোকজন তাদের জাহাজে ফিরে যেতে দেবে না এমনি এমনি। নিয়ম হচ্ছে কোন বন্দরে জাহাজ ভিড়ালে সেখানে প্রদেয় কর না দিয়ে অন্য কোথাও যাওয়া যাবে না। রাজার লোকজন ভাবছে এদের জাহাজে ফিরে যেতে দিলেই এরা পালাবে কর না দিয়ে, তাই তারা এদের ঘিরে রইল। ভাস্কোর দলবল ভাবল তাদের বুঝি এরা আটকে রাখছে, যেতে দেবে না। অচলাবস্থ চলল দুদিন ধরে। তারপর জাহাজে রাখা কিছু বিক্রয়যোগ্য মালপত্র বন্ধক রেখে ভাস্কোদের জাহাজে ফেরার অনুমতি দেওয়া হল।

    কালিকট যদিও বন্দর হিসাবে খুব প্রশস্ত নয়, কিন্তু মালাবার উপকূলে এটাই প্রধান বন্দর, এদের মূল ব্যবসাপত্তর অধিকাংশই উপসাগরীয় বন্দরগুলোর সঙ্গে। আরবি ব্যবসায়ীরা কালিকটের খুব ভক্ত। এখানকার সুরক্ষা আর ন্যায়বিচার তারা এত পছন্দ করে যে জাহাজ ভিড়ানোর পর জিনিসপত্র বেলাভূমিতে নামিয়ে বাজারে আনার সময় তাদের দেখভালের প্রয়োজনও বোধ করে না, জানে এখানে কেউ ওদের জিনিস চুরি করবে না, ঠকাবে না। রাজার শাসন এখানে সবাই মানে। আর শুধু ওদেরই না, সকলের জন্যেই এই বন্দর খোলা এবং প্রত্যেকের সঙ্গেই একইরকম ব্যবহার। সুদূর চিন বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে নিয়মিত জাহাজ এসে লাগে এই কালিকট বন্দরে।

    মুসলমানদের সঙ্গে পর্তুগিজদের সম্পর্কটা অবশ্য পুরো আলাদা, পর্তুগিজরা যে ক্যাথলিক খ্রিস্টান। আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে এদের অহরহ সংঘর্ষ লেগেই থাকত। কালিকটে হঠাৎ উদয়-হওয়া পর্তুগিজদের দেখে আরবি ব্যবসায়ীরা ঘৃণায় মুখ বিকৃত করতে লাগল। একে তো ধর্মের কারণে তারা পর্তুগিজদের দেখতে পারে না, তার ওপর এরা যদি এসে বাণিজ্যে ভাগ বসায়, তবে তো তাদের একচেটিয়া মশলাপাতির ব্যবসা লাটে উঠবে! আরবি মুসলমানরা ভাস্কোর মালপত্র ছুঁয়েও দেখল না। কেউ কেউ তাদের সঙ্গীসাথীদের বলল, এই ব্যাটারা পর্তুগালের লোক, পর্তুগালের নাম শুনেছিস তো! এরা জলদস্যু, ধরতে পারলেই আমাদের কচুকাটা করবে। এদের কাছে ভিড়িস না।

    ভাস্কো জামোরিনের কাছে এই নিয়ে নালিশ জানাতে জামোরিন তার কিছু অনুচরকে পাঠালেন কোল্লাম বন্দরে জিনিসপত্র সরেজমিন দেখে আসতে। তারা এসে দেখল বটে কিন্তু তাদেরও কোন জিনিস পছন্দ হল না, তারা কিছুই কিনল না। ভাস্কোর অনুরোধে জামোরিন রাজি হল নিজের খরচে কিছু জিনিস কালিকটে পৌঁছে দেবার, সেখানে যদি বিক্রিবাটা হয়। কিছু কিছু জিনিস বিক্রি হতে লাগল আস্তে আস্তে, কিন্তু যা আশা করেছিল ওরা, সে তুলনায় বড্ড অল্প দাম পাওয়া গেল। তবে তা দিয়েই কিনে নেওয়া গেল বেশ কিছুটা লবঙ্গ, দারুচিনি আর দামি পাথর। ভাস্কোর অনুচররাও স্থানীয় বাজারে গিয়ে নিজেদের কিছু কিছু সামগ্রী বিক্রি করে এল।

    ভারতে জাহাজ ভিড়ানোর প্রায় তিন মাস পরে ভাস্কো ডা গামা তাদের দেশ থেকে আনা কিছু উপহারসামগ্রী নিয়ে জামোরিনের কাছে খবর পাঠাল, এবার সে দেশে ফিরে যেতে চায়। খুব ভাল হয় যদি জামোরিন তার সঙ্গীদের কাউকে ভাস্কোর সঙ্গে পর্তুগালে পাঠান, তাহলে দু’ দেশের বাণিজ্যের সম্পর্ক ভালভাবে স্থাপন হতে পারে। এর বদলে সে তার সঙ্গীসাথীদের কয়েকজনকে এ দেশে রেখে যাবে, তারা অবিক্রীত মালপত্র বিক্রি করার যেমন চেষ্টা করছে, সে রকম করে যাবে। জামোরিন তার অনুচরদের বললেন, বন্দরে প্রদেয় কর না দিলে তাদের যেন ছাড়া না হয়। অনুচরেরা ভাস্কোদের কাছে কর চেয়ে তাদের ঘিরে থাকল, তীরে ভিড়ানো কোন নৌকাকে ভাস্কোদের জাহাজের দিকে যাওয়ার অনুমতি দিল না।

    দেশীয় কোন কোন ব্যবসায়ী জামোরিনের অনুচরদের এই নির্দেশ না মেনেই জাহাজে গিয়ে ভাস্কোদের সঙ্গে মোলাকাৎ করতে গেল। তাদের আঠারজনকে ভাস্কো ডা গামা ধরে আটকে রাখল জাহাজে। রেগে গিয়ে পর্তুগিজদের যাবতীয় অবিক্রীত দ্রব্যাদি বাজেয়াপ্ত করল জামোরিন। ফের শুরু হল ঝঞ্ঝাট। অনেক কথা কাটাকাটির পর ঠিক হল ভাস্কো ফেরত পাঠাবে আটক রাখা বণিকদের, ফেরত পাবে তাদের বস্তুসমূহ। জামোরিন এমনকি লিখেও দিলেন পর্তুগালের রাজার উদ্দেশে একটা চিঠি – আপনার দেশের এক ভদ্রলোক ভাস্কো ডা গামা আমার দেশে এসেছিল, তাকে দেখে আমি খুশি হয়েছি। আমার দেশ দারুচিনি, লবঙ্গ, আদ্রক, গোলমরিচ ও মণিরত্নের জন্য বিখ্যাত। এর বদলে আমরা চাই সোনা, রুপো, প্রবাল আর লালরঙের কাপড়।

    বদমেজাজী ভাস্কো ডা গামা রাজি হয়েও কথা রাখল না। নিজেদের সামান্য কিছু জিনিস ফেলে রেখে জাহাজ রওনা করে দিল বাড়ির দিকে, ছ’জন ভারতীয়কে আটক রেখেই। বেয়াদপি বরদাস্ত করলেন না জামোরিন, পরের দিনই সত্তরখানা খুদে খুদে নৌকা তাড়া করল ভাস্কোর জাহাজ। জাহাজ থেকে কামান দাগতে লাগল ভাস্কোর দলবল, তার কাছে নৌকা নিয়ে যাওয়াই সমস্যা। কিন্তু এরাও সংখ্যায় এতগুলো, ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসার মানুষ এরাও নয়। দুর্ভাগ্য এদের, এই সময়েই মাঝসমুদ্রে শুরু হল ঝড়তুফান। কাছের জিনিসই দেখা যায় না তো দূরের জাহাজ! ফলে ব্যর্থমনোরথ হয়ে ফিরে এল দেশি নৌকাগুলো।

    ভাস্কো ডা গামা যে মহানন্দে বাড়ি ফিরে গেল, তাও নয়। ফিরে যাবে বলে ভাস্কো জাহাজ ছেড়েছিল তড়িঘড়ি, কিন্তু অনভিজ্ঞ হওয়ায় বেছে নিয়েছিল ভুল সময়। হাওয়া তাদের অনুকূলে ছিল না একেবারেই। আফ্রিকার মালিন্ডি থেকে কালিকট অবধি যে পথ ওরা আসার সময় অতিক্রম করেছিল মাত্র কয়েক দিনে, তা ফেরার পথে পাড়ি দিতে লেগে গেল তিন মাসেরও বেশি। সমুদ্রযাত্রার অন্যতম দুরারোগ্য ব্যাধি স্কার্ভিরোগে মারা গেল বেশ অনেক জন। অন্য অনেকের অবস্থাও মরো মরো, জাহাজের দাঁড় টানার অবস্থায় নেই তারা। অবস্থা এমন বেগতিক দাঁড়াল যে আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে মোম্বাসা বন্দরে পৌঁছে ভাস্কো দেখল তিনখানা জাহাজ টেনে নিয়ে বাড়ি ফেরা প্রায় অসম্ভব। একটা জাহাজকে ধ্বংস করে বাকি দুটো নিয়ে ফিরে চলল তারা। আসার সময় যতজন এসেছিল, তাদের দুই-তৃতীয়াংশই আর ফিরে যেতে পারল না নিজেদের দেশে।

    * * *

    ভাস্কো ডা গামা যখন ফিরে যাচ্ছে নিজের দেশে, ততদিনে আরো দুবার তার ‘ইন্ডিজ’ অভিযান শেষ করে ফেলেছে ক্রিস্টোফার কলম্বাস। সে এখন তার এই নতুন আবিষ্কৃত ইন্ডিজের গভর্নর। তাকে যতই লোকে সমালোচনা করুক যে সে যে দেশে অভিযান করে ফিরছে তা ভারত নয়, কলম্বাস তার সিদ্ধান্তে অনড়, এটাই ভারত। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের আরও অনেকগুলো দ্বীপ আবিষ্কার করেছে সে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জামাইকা, পুয়ের্তো রিকো, ভার্জিন আইল্যান্ড।

    দ্বিতীয় যাত্রায় সতেরোটা জাহাজে সে সঙ্গে নিয়ে গেছিল বারোশো লোক, যার মধ্যে যোদ্ধা ছাড়া ছিল চাষি ও ধর্মযাজকেরাও। যোদ্ধাদের কাজ স্থানীয় তাগড়া লোকদের বন্দী করে ক্রীতদাস বানিয়ে দেশে চালান করা ও সেখানকার জমিজমা দখল করা। চাষিদের কাজ সেখানকার জমি চাষ করে ফসল ফলানো, চুক্তি অনুযায়ী এর এক অংশ হবে কলম্বাসের নিজস্ব সম্পত্তি। ধর্মযাজকেরা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ধরে ধরে খ্রিস্টান বানাবে, অধার্মিকদের নিয়ে আসবে প্রভু যিশুর পদতলে।

    যাত্রীদের মধ্যে একজন ছিল ক্রিস্টোফারের বাল্যবন্ধু মিচেল ডা কুনিও। সে তো বন্ধু ক্রিস্টোফারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। জাহাজে মিচেলকে ক্রিস্টোফার উপহার দিয়েছে সেবারের বন্দীদের মধ্যে থেকে একজন ক্যারিবিয়ান যুবতীকে। তার নিজস্ব কেবিনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে। মিচেল অবাক হয়ে দেখল যুবতীটি নগ্না, ওর পোশাক বলে কিছু নেই। মিচেল তাকে শয্যাসঙ্গিনী করতে চাইলে সে বাধা দিল প্রচন্ড, তার গায়ে ফুটিয়ে দিল বড় বড় নখ। বাধ্য হয়ে একটা চাবুক দিয়ে তাকে ক’ ঘা বসানোর পর অবশ্য সে এমন সহযোগিতা করতে শুরু করল, তেমন ব্যাপার মিচেল স্পেনের কোন অভিজাত পতিতালয়েও পায়নি।

    ক্রিস্টোফার প্রথম ধাক্কা খেল প্রথম অভিযানে ইস্পানোলাতে লা নাভিদাদ নামে যে দুর্গ স্থাপন করে এসেছিল তার প্রথম জাহাজ সান্তা মারিয়ার ধ্বংসাবশেষ দিয়ে, সেখানে গিয়ে। দেখল স্থানীয় অধিবাসীরা সেটা গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ঊনচল্লিশ জন সহযাত্রীকে সে রেখে গেছিল, তাদের এগারোজনের কঙ্কাল শুয়ে আছে সেইখানে। অবস্থা দেখে ক্রিস্টোফার ক্রুর হয়ে উঠল। স্থানীয় লোক দেখলেই তাদের বন্দী করে অত্যাচারের নির্দেশ দেওয়া হল।

    যদিও ক্রিস্টোফার কলম্বাসের অনেক শতাব্দী আগেই ইওরোপ থেকে লেফ এরিকসনের নেতৃত্বে ভাইকিং জলদস্যুরা এসে পৌঁছেছিল উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূলে, কলম্বাসের নেতৃত্বেই প্রথমে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে ও পরে দক্ষিণ আমেরিকায় শুরু হল ব্যাপক ঔপনিবেশিক শাসন। গণহারে স্থানীয় মানুষদের নির্যাতন, শোষণ ও হত্যা, খ্রিষ্টধর্ম-গ্রহণ, ক্রীতদাসত্ব-বরণ, ধর্ষণ ও নারীনির্যাতন শুরু হল। কলম্বাস দ্বীপের মানুষদের খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করার চেয়ে ক্রীতদাসরূপে ইওরোপে নিয়ে যাওয়াই বেশি পছন্দ করত, তাতেই তার নিজস্ব মুনাফা বেশি। এই কাজে তাকে বাধা দেওয়ার কেউ ছিল না প্রথম প্রথম, সেই তো গভর্নর।

    এ সুখের দিন অবশ্য তার খুব বেশিদিন রইল না।

    * * *

    ভাস্কো ডা গামার প্রথম ও ক্রিস্টোফার কলম্বাসের তৃতীয় অভিযান শেষ হয়েছে। ইওরোপের দুই শক্তিশালী দেশ তাদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য আফ্রিকার বাইরেও পেয়ে গেছে আরও দুটো মহাদেশের ঠিকানা। পর্তুগিজরা পেয়ে গেছে মশলার খনি ভারতে আসার রাস্তা। স্পেন বের করে ফেলেছে নতুন পৃথিবীর পথ, যদিও তাকে সে তখনও ইন্ডিজ নামেই জানে।

    ইন্ডিজ-এর বিপরীত গোলার্ধে ঠিক সেই সময়ে সুদূর বাংলাদেশের এক গ্রাম নবদ্বীপে এক চৌদ্দবর্ষীয় কিশোরের দৌরাত্ম্যে গ্রামবাসী অস্থির। লক্ষ্মী নামে এক মেয়েকে তার চোখে লেগে গেছে, সে চায় তাকে বিয়ে করতে, অথচ মা-বাবা রাজি নয়। সেই জন্যেই সে এমন বিচ্ছিরিভাবে ক্ষেপে গেছে না তার প্রকৃতিই এমন, তা বুঝতে পারছে না এমনকি তার বাল্যসখার দলও। নিমাইকে নিয়ে তার মা শচীদেবীর দুশ্চিন্তার অন্ত নেই।

    বাংলায় চলছে হুসেন শাহের নবাবি। নবাব হিসাবে হুসেন শাহ আগেরগুলোর চেয়ে খানিকটা ভালই বলা চলে। কিন্তু মাত্র পঁয়ষট্টি বছর আগে এই বাংলাতেই রাজত্ব করেছে হিন্দু রাজা গণেশ, তখন যে দিন ছিল, এখন কি আর তা থাকার জো আছে! নবাবের মদত থাক বা নাই থাক, তার অধীনে যে সব মুসলমান শাসক, তাদের অত্যাচারে সকলে জেরবার। এই তো নবদ্বীপের কাছেই পিরল্যা গ্রামে মাত্র পঞ্চাশ বছর আগে যা হয়ে গেল, তার দৃষ্টান্ত বিরল। চেঙ্গুটিয়ার গুড়বংশীয় ব্রাহ্মণ দক্ষিণানাথ রায়চৌধুরীর দুই পুত্র কামদেব আর জয়দেবকে গোমাংসের গন্ধ শুঁকিয়ে জোর করে কামালুদ্দিন আর জামালুদ্দিন বানিয়ে তাদের রাতারাতি জাতিচ্যুত করে দিয়েছিল বাদশা নাসিরুদ্দিন মামুদ শাহের নফর খানজাহান আলির উজির মামুদ তাহির। এর ফলে শুধু যে কামদেব-জয়দেব মুসলমান হয়ে গেল, তাই নয়, ওদের দুই ভাই রতিদেব আর শুকদেবেরও ব্রাহ্মণত্ব গেল। শোকে রতিদেব গৃহত্যাগী হলেন, বোন ও কন্যাকে পাত্রস্থ করতে অগাধ জলে পড়ে গেলেন শুকদেব। পতিত ব্রাহ্মণের ঘরে কে বিয়ে দেবে! দিলে তো তারও জাত যাবে!

    যে কোন অছিলায় হিন্দুদের জাত মেরে মুসলমান বানিয়ে দিচ্ছে এই সব নরাধমরা।

    এই অনাচার চলতে দেওয়া যায় না, যেমন করেই হোক এর শোধ তুলতেই হবে, ধানী জমির আলপথ দিয়ে প্রভাতী বাতাস খেতে খেতে ভাবছিলেন রাজা গণেশের প্রধান উজির নরসিংহ নড়িয়ালের প্রৌত্র, বিখ্যাত পণ্ডিত কমলাক্ষ ভট্টাচার্য। নবদ্বীপের শিক্ষিত সমাজ তাঁকে অদ্বৈত আচার্য নামে এক ডাকে চেনে। কিশোর নিমাইকে তিনি পছন্দ করে ফেলেছেন। ছেলেটি বেশ, ওর হাতের গুলিগুলো দেখে সবাই ভয় পায়। তবে মাথাটি তার পরিষ্কার, শাস্ত্রবিদ্যা চটপট বুঝে নিতে পারে। কমলাক্ষ ভট্টাচার্য তার শিক্ষার সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। ঠিক করে ফেলেছেন, তাকে তিনি মন্ত্রদীক্ষা দেবেন, নিমাই-ই হবে তাঁর দূরপাল্লার ঘোড়া।

    * * *

    সেই একই মুহূর্তে উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে হিন্দুকুশ পাহাড়ের এক আলপথে তেজি এক ঘোড়ায় চড়ে দূরপাল্লায় পাড়ি দিচ্ছে নিমাইয়ের চেয়ে বয়সে বছর দুয়েকের বড়, ষোড়শবর্ষীয় আর এক কিশোর। পাহাড়ি রাস্তার এক বাঁক অতিক্রম করতেই তার মুখে এসে পড়ল ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম সূর্যকিরণ, চোখ মেলে পুব আকাশের দিকে তাকাল সে। দূর-দূরান্তে পাহাড়ের বরফচূড়ায় বিভিন্ন রঙের ছটা ছড়িয়ে আকাশে উদিত হচ্ছে দিনমণি, দুই পাহাড়ের মধ্যে থেকে তার উঠে আসার শোভা অপূর্ব। যুবকটি প্রকৃতিতে কবি, ভালবাসে ফুল ও ফলের বাগান, কিন্তু তার ধমনীতে বইছে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া বীভৎস নৃশংসতার রক্ত। তার নাম জহিরুদ্দিন মহম্মদ বাবর।

    (চলবে)



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments