|| ছয় ||
সাল ১৪৯৫। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের হিস্পানিওলা দ্বীপের উত্তরে লা ইসাবেলার এক শীতের দুপুর। ঘন গাছপালায় ছাওয়া দ্বীপের এক স্থানে কিছু মানুষের জটলা। অধিকাংশই স্থানীয়, তাদের পরনে পোশাকের তেমন বালাই নেই, চুলে পালকের সাজ। দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন কোনো সিনেমার সেট, অনেকটা রমেশ সিপ্পির শোলে সিনেমার মত। স্থানীয় মানুষদের একজনের দুটো হাত দুদিকে দড়ি দিয়ে দুটো গাছের সঙ্গে বাঁধা। তার পেছনে বাকি স্থানীয় মানুষেরা। সামনে কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ পুরুষ, পোশাক-আচ্ছাদিত।
শ্বেতাঙ্গদের দলনেতাকে আপনারা চেনেন। তার নাম ক্রিস্টোফার কলম্বাস। আঙুল দিয়ে দাড়ি চুলকোতে চুলকোতে ক্রিস্টোফার তার দলের একজনকে বললেন, ওকে জিজ্ঞেস কর, সোনা কোথায়? পই পই করে যে পাখিপড়ার মত বুঝিয়ে দেওয়া হল আগের বার যে প্রতি তিন মাস পর পর এতখানি করে সোনা জমা দিতে হবে আমাদের কাছে, সেটা কই? ও কি জানে না আমাদের এই নিয়ম অগ্রাহ্য করার শাস্তি কি?
ক্রিস্টোফারের সঙ্গীটি হাত-পা নেড়ে শরীরী ভাষায় দড়িবাঁধা লোকটাকে কলম্বাসের প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করতে লাগল। এই এক ঝামেলা! স্প্যানিশ পর্তুগিজ কিস্যু বোঝে না এখানকার হাঁদাগুলো। কী করে বুঝবে? সভ্য জায়গায় থেকেছে কখনও! ব্যাটা জংলি জানোয়ার, প্রভু যিশুর কৃপা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত। এদের উদ্ধার করার জন্যেই না তাদের আগমন সাত সমুদ্দুরের সমান দূরত্বের মহাসাগর পাড়ি দিয়ে। রাজা-রানি দুজনেই হুকুম দিয়েছেন এদের সঙ্গে যেন খারাপ ব্যবহার না করা হয়। কিন্তু ভাল কথায় কি চিঁড়ে ভেজে! এই যে বলা হল তিন মাস পর সবাইকে কিছুটা করে সোনা নিয়ে আসতে, কে শোনে কার কথা! এত দূর থেকে যে তারা এসেছে প্রভু যিশুর বাণী দিয়ে এদের উদ্ধার করতে, এর একটা খরচা নেই? সোনা জোগাড় না হলে সে খরচা উঠবে কী করে? ক্রিস্টোফারকে অভিযানে লোকজনকে সামিল করতে রীতিমত বেগ পেতে হয়। রাজা-রানি যা পয়সা দিয়েছেন, তাতে তো রাহাখরচাও ওঠে না। অনেকে এই অভিযানের পেছনে বিনিয়োগ করেছে, ক্রিস্টোফার তাদের বুঝিয়েছে এই নতুন ভূখণ্ডে অঢেল সোনা! তো সেই সোনার কিছু নমুনা তো নিয়ে গিয়ে পেশ করতে হবে তাদের। নইলে তারা শুধু যে বেঁকে বসবে তাই না, জেলেও ভরে দিতে পারে অথবা ইচ্ছে করলে লোক লাগিয়ে খুন করে ফেলাও বিচিত্র নয়।
স্থানীয় লোকটার আচরণে বিন্দুমাত্র প্রকাশ পেল না যে সে এদের কথা আদৌ বুঝতে পারছে। তার চোখে মুখে ভয়। কী জন্যে এতজনকে ছেড়ে তাকেই এখানে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছে সে বুঝছে না। নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে এখন চুপচাপ ভাবলেশহীন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। শোলে সিনেমার এই জায়গায় গব্বর সিং আর ঠাকুরসাবের মধ্যে বেশ কিছু চোখা চোখা ডায়লগ থাকবে, এখানে তা পুরোপুরি মনোলগ। বোরিং এবং বিরক্তিকর।
কিছুক্ষণ এইভাবে চলার পর ক্রিস্টোফার বলে উঠলেন, এভাবে কাজ হচ্ছে না। এক কাজ কর, ওর হাত দুটো কেটে ফেল তরোয়াল দিয়ে। ফাজলামির একটা সীমা থাকা দরকার। শুয়োরের বাচ্চারা বুঝুক ক্রিস্টোফার কলম্বাস ইয়ার্কি মারার জন্যে আটলান্টিক উজিয়ে ইন্ডিজে আসেনি। মশলা, সোনা জোগাড় না হলে আমাদের চলবে না। অনেকবার বলা হয়েছে, এবার অ্যাকশন। নে, দেরি করিসনে, তরোয়াল বের কর। দু কোপে দুটো হাত নামিয়ে দে।
পরবর্তী অংশের সঙ্গে শোলে সিনেমার খানিকটা মিল আছে। দু’কোপে নেমে গেল স্থানীয় মানুষটার দুটো হাত। যে জায়গাটায় মিলবে না, তা হচ্ছে, হাতবিহীন অবস্থায় ঠাকুরসাব কোনোভাবে বেঁচে বাড়ি ফিরে যেতে পেরেছিলেন। এই হতভাগ্য লোকটার হাতদুটো কেটে ফেলার সঙ্গে সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। হড়াম করে উলটে পড়ল। দুই বাহুমূল থেকে হড়হড় করে রক্ত বেরোতে লাগল ফিনকি দিয়ে। লাল হয়ে ভিজে গেল ক্যারিবিয়ান মাটি। ছটপট করতে লাগল সে। রক্ত বেরোতে বেরোতেই একসময় নিষ্পন্দ হয়ে গেল দেহটা।
পেছনের জনতার সকলের মুখে ভীতির ছাপ জোরালো হয়ে এল। ক্রিস্টোফার বললেন, আরে, এর ছেলেকেও দেখেছিলাম মনে হচ্ছে আগের বার। কোথায় সে? তাকে ধরে বাঁধ এবার।
বধ্যভূমির দণ্ডায়মাণ জটলায় তার ছেলেকে খুঁজে পাওয়া গেল না। ক্রিস্টোফার দলের অন্য একজনকে নির্দেশ দিলেন, যা, ওর ছেলেকে খুঁজে নিয়ে আয় এখানে।
একজন ছুটল তার খোঁজে। অন্য আর একজনের দুটো হাত বেঁধে একই প্রক্রিয়া শুরু করা হল আবার। মৃত্যুর চেয়ে বড় ভয় আর কীসে? এদের মনে মৃত্যুভয় জাগিয়ে না তুললে সোনা আদায় সম্ভব না। সোনা না পেলে কলম্বাসের অবস্থাও এদের মত হতে পারে দেশে ফিরে।
প্রথম অভিযানে কলম্বাসের বলার মত তেমন কিছু তো ছিল না। না পেয়েছেন মশলা, না পেয়েছেন সোনা। কিন্তু তিনি তো নিশ্চিত যে ইন্ডিজে পৌঁছে গেছেন, মশলা সোনা ইত্যাদি মিলবেই। সাতকাহন করে রাজা-রানিকে বুঝিয়েছেন তিনি, নইলে দ্বিতীয়বার তারা স্পন্সর করবেন কেন! ঝামেলা তো কম না। রাজা-রানি বলে দিয়েছেন এদের সঙ্গে ভালবাসার সম্পর্ক স্থাপন করতে। শালারা ভালবাসার মর্ম বোঝে! একটু সোনা জোগাড় করে তাদের উপহার দেওয়ার যাদের মুরোদ নেই, তাদের সঙ্গে কী ধরনের ভালবাসার সম্পর্ক স্থাপন করা যায়! কলম্বাস নির্দেশ দিয়েছিলেন, এখন থেকে এই প্রভিন্সে চোদ্দ বছরের বড় যারা আছে, সবাইকে প্রতি তিন মাস পর পর নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনা তাদের হাতে তুলে দিতে হবে। বদলে তারা ওদের তামার একটা চাকতি দেবেন। সেই তামার চাকতি গলায় ঝুলিয়ে রাখতে হবে ওদের। চোদ্দ বছরের বড় যার গলাতে সেই ত্রৈমাসিক তামার চাকতি ঝুলতে দেখা যাবে না, তাদের এই বধ্যভূমিতে নিয়ে এসে হাত কেটে নেওয়া হবে। তাতে যদি রক্তক্ষরণে ওদের মৃত্যু হয়, কী আর করা যাবে?
এবারের যাত্রায় সেপ্টেম্বরের ২৫ তারিখে কাডিজ থেকে বের হয়েছিলেন তারা দুটো বড় আর পনেরটা ছোট জাহাজ নিয়ে। উদ্দেশ্য ইন্ডিজে উপনিবেশ স্থাপন। প্রায় দেড় হাজার সঙ্গী এবার ক্রিস্টোফারের। বুকভরা আশা আর লোভ নিয়ে সঙ্গে চলেছে নাবিক, যোদ্ধা, শ্রমিক, রাজমিস্ত্রি, স্যাকরা, ছুতোর, মুচি, ধর্মযাজক – সব্বাই। পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্ডারের প্রতিনিধি হিসাবে চলেছেন বার্নাডো বয়েল, তিনি ইন্ডিজের লোকদের যিশুর কৃপা বিতরণ করবেন। ক্রিস্টোফারের ভাই দিয়েগো কলম্বাস আছেন। আছেন মানচিত্র-বিশেষজ্ঞ জুয়ান দ্য লা কোসা, সেভিলের ডাক্তার দিয়েগো আলভারেজ। কিছু গরু, ঘোড়া, ভেড়া, শুয়োর। এবং কিছু গাছপালাও।
হিস্পানিওলা হচ্ছে সেই দ্বীপ যেখানে আগেরবার লা নাভিদাদ নামে একটা দুর্গ বানিয়ে তাতে নিজের কয়েকজন চ্যালাচামুণ্ডাদের ছেড়ে গেছিলেন ক্রিস্টোফার, স্থানীয় লোকজনদের ‘মানুষ’ করার উদ্দেশে। ভেবেছিলেন, এবার এসে দেখবেন তারা স্থানীয় লোকদের সঙ্গে মিশে তৈরি করে ফেলেছে এক খ্রিস্টান শহর। চাষবাস করছে, ফলাচ্ছে আধুনিক দুনিয়ার ফসল। সোনার খনি খুঁজে বের করে ফেলেছে। এবার তাঁরা এসে ওদের কাজের দায়িত্ব বিলি করে দেবেন নতুন-আসা এই উপনিবেশীদের মধ্যে। ইন্ডিজে স্পেনের আধিপত্য বিস্তার হবে। তিনি জাহাজ ভর্তি করে সোনা নিয়ে ফিরে যাবেন কাস্তিলে, তুলে দেবেন রানি ইসাবেলার হাতে। রানি চুক্তি অনুযায়ী তা থেকে দশ শতাংশ দেবেন ক্রিস্টোফারকে।
এসে যা দেখলেন, তা দেখে তাঁর মাথায় বজ্রাঘাত হল। দুর্গ পুড়ে ছাই। ভেতরে তার দলের লোকদের লাশ পচে গলে পড়ে রয়েছে। শুনলেন স্থানীয় ক্যারিব উপজাতির হিংস্র লোকেরা, যারা এখানকার অ্যারাবকদের সঙ্গে মাঝে মাঝেই মারামারি করে জিনিসপত্র কেড়েকুড়ে নিয়ে যায়, তারাই এদের মেরে রেখে গেছে।
প্রাথমিক ধাক্কা সামলে ক্রিস্টোফার ভাবতে লাগলেন, কী করা যায়। এখানে আবার বসতি স্থাপন করলে যদি আবার এরা আক্রমণ করে! লা নাভিদাদকে বিদায় জানিয়ে তারা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থান খুঁজতে চলতে লাগলেন উত্তর-পূর্বদিকে। কয়েকটা জায়গা দেখে পছন্দ হল না। শেষমেষ একটা জায়গা দেখে মনে হল এর কাছেপিঠে সোনার খনি থাকতে পারে। এখানেই পত্তন করা যাক নতুন শহর।
কাজে লেগে গেল মিস্ত্রি ও শিল্পীর দল। ক্রিস্টোফার জমিতে দাগ কেটে সবাইকে অল্প অল্প জমি দান করলেন। দাগ দিয়ে দেখিয়ে দিলেন কোথায় রাস্তা বানাতে হবে, কোথায় হাসপাতাল, কোথায় গীর্জা, কোথায় জিনিসপত্র রাখার জায়গা। পাথর আর কাঠ দিয়ে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই উঠে গেল শ দুয়েক বাড়ি।
এই সমুদ্রযাত্রায় তাঁর প্রধান পৃষ্ঠপোষক রানি ইসাবেলার নামে ক্রিস্টোফার এই শহরের নামকরণ করলেন লা ইসাবেলা।
এর মধ্যে ঝামেলাও শুরু হয়ে গেছে। গণ্যমান্য যারা এসেছিলেন, তারা ভেবেছিলেন স্বর্গে যাচ্ছেন, সেখানে অপ্সরারা তাদের পদসেবা করবে, তারা মুঠো মুঠো সোনা কুড়িয়ে পকেটে ভরবেন, রত্নরাজি পেড়ে নেবেন কল্পতরু থেকে। অথচ তিন মাস হয়ে গেল, যাত্রাপথ বিপদসঙ্কুল, এসে পৌঁছেছেন ভূতের দেশে। এক জায়গায় দেখলেন তাদের পূর্বসূরীরা মরে পচে গেছে, কেউ জানেও না। অন্য জায়গায় সোনাদানার কোনো লক্ষণই নেই। মানে কলম্বাস তাদের বোকা বানিয়ে নিয়ে এসেছেন এখানে। আর এখন নিজেদের থাকার জায়গা নিজেকেই বানিয়ে নিতে হচ্ছে! এ কি মানা যায়!
বার্নার্ডো বয়েল পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, তিনি যাজক, হেঁজিপেজি মানুষ নন, তাঁর মিস্তিরিগিরি করা কাজ না, তিনি পাথর বইতে পারবেন না। অন্য অনেকে তার সঙ্গে গলা মেলালো। এর মধ্যে বেশ কিছু মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। খাবারদাবার সহ্য হচ্ছে না নির্ঘাৎ।
সমুদ্রে লম্বা এবং অনিশ্চিত সফরে খাবার-দাবার তো ইচ্ছেমত নেওয়া যায় না। প্রথম সফরের জাহাজ তিনটে ছিল ছোট ছোট, সবচেয়ে বড়টা লম্বায় একটা টেনিস কোর্টের সাইজে। সেই জাহাজগুলোতে তোলা হয়েছিল জল, ভিনেগার, ওয়াইন, জলপাই ও জলপাইয়ের তেল, গুড়, চিজ, মধু, বাদাম, কিসমিস, চাল, মটরসহ কয়েক রকমের ডাল, রসুন, সার্ডিন ও কড মাছের শুঁটকি, কিছু কুচো মাছ যেগুলো রান্না করে এমনিও খাওয়া যায় বা টোপ হিসাবে ব্যবহার করে মাছ ধরাও যায়, গোরু ও শুয়োরের নোনা মাংস এবং সমুদ্রে খাওয়ার উপযোগী বিস্কুট। জলপাইগুলো মাটির জালায় ভেজানো থাকত জলপাই তেলে। বাকি সমস্ত খাদ্য নেওয়া হয়েছিল কাঠের বাক্সে। মাংস জারানো থাকত ঘন সমুদ্রের জলে, যাতে পচে না যায়। জল, ভিনেগার আর ওয়াইন ছাড়া বাকি সব শুকনো খাদ্য। বিস্কুটগুলো শুকনো তো বটেই, ইঁটের মত শক্ত। ভিজে না গেলে সেগুলো অনায়াসে এক বছর খাওয়ার উপযোগী থাকে। খাওয়ার সময় অবশ্য ওগুলো মাংসের স্টুতে ভিজিয়ে নিতে হয়। স্টু বানানো হত মাংসের সঙ্গে চাল বা মটরজাতীয় কোনো ডাল সিদ্ধ করে। তবে মাংসের চেয়ে মাছ খাওয়া হত বেশি।
রান্না মানে সিদ্ধ করা, মশলাপাতির ব্যাপার তো নেই। পরিবেশন করা হয় কাঠের বাটিতে। কাঁটা-চামচের ব্যাপার নেই, গেঁজেতে গোঁজা নাবিকের ছুরি দিয়ে প্রয়োজনমত কেটে কেটে খাও। সিদ্ধ করার জন্যে যে চুলো জ্বালানো হয়, তার নাম ফোগোন। তার একদিকে একটা কাঠের পর্দা, যাতে হাওয়া আড়াল করে আগুন জ্বালানো যায়। তার পাটাতনে বালি ছড়িয়ে তার ওপর কাঠ জ্বালিয়ে চুলো প্রস্তুত করা হয়।
সমস্ত খাদ্য রাখা হয় জাহাজের সবচেয়ে শুকনো জায়গায়, যাতে তাতে জল ঢুকে না যায়। তাতেও সমস্যা। মাংসের বাক্স থেকে সমুদ্রের জল চুঁইয়ে বেরিয়ে অন্য বাক্সের ওপর পড়লে চুঁইয়ে তার মধ্যেও ঢুকে যায়। শুকনো খাবার জল ঢুকে যাওয়া মানে পুরো বাক্সের খাবার নষ্ট।
এবারেও আলাদা কিছু নয়। তবে খাবারের বিষক্রিয়ায়, নাকি সঙ্গে পশু থাকায় তাদের কোনো রোগের সংক্রমণে, তা বোঝা গেল না। অসুস্থদের দিয়ে কাজ করানো যায় না। যারা কাজ করতে সমর্থ, তারা নিজেদের ক্লাস নিয়ে সচেতন, তারা কাজ করবে না। ফলে দুই দলে ঝগড়া বেধে গেল।
এখন ঝগড়াঝাঁটির সময় নয়। কলম্বাস দ্বীপে আবদ্ধ থাকতে চান না, তাকে যেতে হবে চিনের গ্রেট খানের কাছে। এদের কোনোরকমে সামলে তিনটে জাহাজ আর ছিয়ানব্বই জন সহযাত্রী নিয়ে হিস্পানিওলা ছেড়ে তিনি উত্তর-পুবে যাত্রা করলেন এবং ছ’ দিন পরে, ১৫৯৪-এর এপ্রিলের শেষদিন এসে পৌঁছালেন কিউবায়। সেখানকার স্থানীয় মানুষরা এদের জল ও খাদ্য দিয়ে অভ্যর্থনা জানাল। প্রথম অভিযানেও এই দ্বীপে এসেছিলেন কলম্বাস, আগের মত এবারেও দেখলেন এরা একটা গাছের শুকনো পাতা গোল করে পাকিয়ে নাকের মধ্যে খানিকটা ঢুকিয়ে অন্য মুখে আগুন ধরিয়ে তার ধোঁয়া টানে। কলম্বাসকে সে রকম একটা গোল পাতার রোল উপহার দিলে তিনি তার ধোঁয়া নাক দিয়ে টেনে খকখক করে কাশতে লাগলেন। একটু পরে বেশ একটু মৌতাত মত এল। তাহলে এর জন্যেই এরা এই ধোঁয়া টানছে!
সেই প্রথম কোনো ইওরোপিয় মানুষ তামাকের ব্যবহার শিখল। এ গাছ ইওরোপে নেই। কলম্বাস এর কিছু চারা তুলে সঙ্গে নিলেন।
কিন্তু গাছ নয়, তারা খুঁজছেন সোনা। সোনার দেখা পাওয়া যাচ্ছে না তো। স্থানীয়দের জিজ্ঞেস করলেন, এখানে সোনা আছে? তারা বলল, এই দ্বীপে নেই, তবে দক্ষিণে পাঁচ দিনের পথ গেলে সোনা পাওয়া যাবে।
দেরি না করে কলম্বাস দক্ষিণে জাহাজ ভাসালেন। এসে পড়লেন জ্যামাইকায়। এখানকার লোকজন কিউবার মত বন্ধুবৎসল নয়। বিদেশিদের সঙ্গে দফায় দফায় তাদের সংঘর্ষ শুরু হল। কলম্বাস মারামারি করতে চাইতেন না, রানি ইসাবেলা রাগ করবেন। কিন্তু উপায় নেই, নিজেদের লোকদের তো বাঁচাতেই হবে। উপায়ান্তর না পেয়ে স্থানীয়দের আক্রমণ করতেই হল। মারা গেল জন কুড়ি ইন্ডিজের মানুষ। অন্যরা কলম্বাসের বশ্যতা মেনে ওদের খাবারদাবার এনে দিল। তার বদলে এরা তাদের উপহার দিল ইওরোপ থেকে আনা ধাতব বস্তু। সে সব ওরা জীবনে দেখেনি, উপহার পেয়ে মহা খুশি।
কলম্বাস আবার জাহাজ ভেড়ালেন উপকূল ধরে, কিন্তু কয়েকদিন চলার পর একই দৃশ্য দেখতে থাকায় ফিরে যাওয়া সাব্যস্ত করলেন। ফেরার পথে সমুদ্রে উঠল ঝড়। কলম্বাস নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অন্য কিছু দেখার বদলে তারা হিস্পানিওলা ফিরে যাওয়াই ঠিক করলেন।
হিস্পানিওলার লা ইসাবেলায় পৌঁছাতে অগাস্টের মাঝামাঝি হয়ে গেল। পৌঁছেই দেখলেন পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ। ভাই বার্থেলোম্যু এসে গেছে তিনটে জাহাজ নিয়ে এবং পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু তার বিরুদ্ধে সরব প্রচুর লোক। দেরি না করে কলম্বাস সবাইকে একত্র করে শান্ত হতে উপদেশ দিয়ে কাস্তিলের মানপত্র ওদের দেখিয়ে বললেন – আমি এই জায়গার গভর্নর। আমার কথাই এখানে আইন। আমার বিরুদ্ধাচরণ করলে আমি শাস্তি দিতে বাধ্য হব।
বলা বাহুল্য, এতে ঝামেলা বাড়ল বই কমল না। পাদ্রী বয়েলের সঙ্গে যোগ দিল পেড্রো দ্য মার্গারিট, বার্নাল ডায়াজ। এদের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এল ক্রিস্টোফারের এক সময়ের সহচর ফ্রান্সিস্কো দ্য রোল্ডন। স্থানীয় ক্যারিবরাও মাঝে মাঝে অতর্কিতে হানা দেয়। এই ক্যারিবরা এখানকার শান্ত অধিবাসী টাইনোদের শত্রু। বিরক্ত ক্রিস্টোফার কাস্তিলে চিঠি লিখে পাঠিয়ে অনুমতি চাইলেন এদের কিছু মানুষকে তিনি ক্রীতদাস বানাতে চান। ইসাবেলা ক্রীতদাস প্রথা একেবারে বরদাস্ত করেন না, কিন্তু সে কথা না শুনে কলম্বাস ষোলোশো স্থানীয় মানুষকে বন্দী করলেন। এত লোক বন্দী হিসাবে রাখার জায়গা নেই বলে শ’ চারেককে ছেড়ে দেওয়া হল। বাকিদের মধ্যে পাঁচশো ষাট জনকে জাহাজে তুলে পাঠিয়ে দেওয়া হল স্পেনের পথে। তাদের সঙ্গে ফিরে গেল অভিযোগকারীদের এক অংশও। অসহায় লোহার শিকল-বাঁধা বন্দীরা এই ধরনের ব্যবস্থায় অভ্যস্ত নয়। রাস্তাতেই মারা গেল দুশোর ওপর লোক। স্পেনে পৌঁছাতেই তাদের হাজির করা হল বিচারসভায়। বিচারকরা রাজা-রানির মত জানেন, তারা অবিলম্বে ছাড়া পেয়ে গেল। এবং কিছু স্পেনেই ও বাকিরা জাহাজে ফেরার পথে প্রাণ হারাল।
ক্রীতদাস হিসাবে যারা লা ইসাবেলাতেই থেকে গেছিল, তাদের মধ্যে সংক্রামিত হল রোগের জীবাণু। তার ধাক্কা তারা সামলাতে পারল না। একের পর এক মানুষ মরতে লাগল অজানা রোগে।
কলম্বাস চেয়েছিলেন বিদেশিরা স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে ভালভাবে মিশে যাক। তাদের পরামর্শ দিলেন ওরা যেন ওখানকার তরুণীদের স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করে। অবাধ যৌনাচার চলতে লাগল। ফলে ইওরোপিয়রাও যৌনব্যাধি সিফিলিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ল। অসুস্থ হয়ে পড়লেন এমনকি ক্রিস্টোফারও।
কিউবা-জ্যামাইকা ঘুরে লা ইসাবেলাতে আসার পর বছর দেড়েক হয়ে গেল অথচ যথেষ্ট সোনা সংগ্রহ হল না। রানি ইসাবেলাকে গিয়ে বোঝাতে হবে, এখানকার গণ্ডগোল না মিটলে তিনি শান্তিতে কিছু কাজ করতে পারছেন না। যাই করতে যান, কেউ না কেউ বাগড়া দেয়। সোনার জন্যে তিনি যে ব্যবস্থা চালু করেছিলেন, পাদ্রী বয়েল তা নিয়ে ঘোঁট পাকিয়ে দেশে ফিরে গেছে। ওখানে রানির কান ভাঙাচ্ছে নির্ঘাৎ। কলম্বাসের উচিত হবে একবার দেশে ফিরে গিয়ে রানিকে বুঝিয়ে আবার ফেরৎ আসা।
১৪৯৬ সালের ১০ই মার্চ দেশে ফেরার পথ ধরলেন ক্রিস্টোফার। পর্তুগালের উপকূলে এসে পৌঁছালেন ৮ই জুন। সেখান থেকে স্পেন।
* * *
রানি ইসাবেলার ব্যাপারটা এবার একটু বুঝে নেওয়া যাক।
যে সময়ের কাহিনি বলা হচ্ছে, তখন স্পেন নামে কোন দেশ তৈরি হয়নি। একজন রাজা যতখানি অঞ্চলে তার প্রভুত্ব বজায় রাখতে পারবে, সেটাই তার রাজত্ব। সেই অঞ্চলকে দেশ না বলে বলা হত কিংডম বা ক্রাউন। এখন যেটা স্পেন, তখন সেখানে বড় বড় দুখানা এমন ক্রাউন ছিল। ক্রাউন অফ কাস্তিল আর ক্রাউন অফ অ্যারাগন। ইসাবেলা এই ক্রাউন অফ কাস্তিলে জন্মেছিলেন, তাই তাঁকে বলা হত ইসাবেলা অফ কাস্তিল।
ইসাবেলা অফ কাস্তিল ওর বাবা দ্বিতীয় জন অফ কাস্তিলের দ্বিতীয়া বৌ ইসাবেলা অফ পর্তুগালের মেয়ে। মা-মেয়ে দুজনের নামই ইসাবেলা, তাই পাশে জন্মস্থানের নাম না থাকলে পার্থক্য করা মুশকিল। যখন ইসাবেলা অফ কাস্তিলের জন্ম হয়, তখন তার ছাব্বিশ বছর বয়সী এক সৎ দাদা ছিল, বাবার প্রথমা স্ত্রীর পুত্র চতুর্থ হেনরি অফ কাস্তিল। এই হেনরির তখন বিয়ে হয়ে গেছে কিন্তু বাচ্চাকাচ্চা হয়নি। কাজেই বাবা দ্বিতীয় জন অফ কাস্তিলের পর কাস্তিলের সিংহাসনের এক নম্বর দাবিদার দাদা চতুর্থ হেনরি অফ কাস্তিল, দু নম্বরে ইসাবেলা অফ কাস্তিল। কিন্তু ইসাবেলার বয়স যখন দু বছর, তখন তার আর একটা ভাই হল, তার নাম আলফন্সো অফ কাস্তিল, আর সে কারণে মেয়ে বলে ইসাবেলার রাজত্বের দাবি চলে গেল তিন নম্বরে।
ছোট ভায়ের জন্মের পরের বছরেই বাবা দ্বিতীয় জন অফ কাস্তিল দেহ রাখলেন, ফলে চতুর্থ হেনরি কাস্তিলের রাজা হয়ে গেল। ইসাবেলা-আলফন্সো তখন যথাক্রমে তিন ও এক বছরের শিশু। ওরা ওদের মা সহ দাদা হেনরির অধীনস্থ হয়ে গেল, অ্যারেভালো নামের এক দুর্গে ওদের ঠাঁই হল। দুর্গটা ছোট আর স্যাঁৎসেতে, পরিবেশ ভাল না আর ওদের হাতে পয়সাকড়িও খুব কম। বাবা উইলে ওদের নামে বেশ টাকাকড়ি লিখে দিয়েছিল, কিন্তু সৎ দাদা সেই উইল মেনে চলেনি। তবু এর মধ্যেই মায়ের কড়া শাসনে ইসাবেলা পড়াশুনা ও ধর্মকর্মে বেশ পারদর্শিতা দেখাতে শুরু করল।
ভাগ্য খানিকটা বদলে গেল, যখন খবর এল বৌদি মানে সৎ দাদা চতুর্থ হেনরির বৌ জোয়ান অফ পর্তুগাল মা হতে চলেছে। হেনরি ওদের সবাইকে নিজের কাছে অর্থাৎ সেগোভিয়া দুর্গে ডেকে নিল। আলফন্সোর জন্যে গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হল। মা-মেয়ে দুই ইসাবেলা রানির খাসমহলে জায়গা পেয়ে গেল।
সেগোভিয়া বেশ বড়সড় দুর্গ, সোনা-রুপো দিয়ে স্থানে স্থানে অলঙ্কৃত। ইসাবেলা অফ কাস্তিল এখানে ভাল খাবার ও পোশাকই শুধু পেল না, বিভিন্ন শাস্ত্রে তার পড়াশুনাও চলতে লাগল। পড়া, লেখা, বানান, ব্যাকরণ, গণিত, কলা, দাবা, নৃত্য, সূচীশিল্প, সঙ্গীত ও ধর্মশাস্ত্রে তাঁর ব্যুৎপত্তি জন্মাল। যদিও সৎ দাদা তথা রাজা চতুর্থ হেনরি তাকে রাজকর্মে জড়ায়নি, দুর্গ ছেড়ে বাইরেও যেতে দিত না, তবু ইসাবেলা শিখে গেল বাইরে কোথায় কী হচ্ছে এবং কেমনভাবে সেও এই সব কর্মকাণ্ডে জড়িত।
কেননা দুর্গের বাইরে যা সব হচ্ছিল, তার অনেককিছু ইসাবেলার ভাবী বর কে হবে, তাই নিয়ে।
পঞ্চদশ শতাব্দীর ইওরোপের ভূখণ্ডগুলোতে শুধু রাজা-রানি নয়, তাদের রাজসভার নোবলম্যানরাও যথেষ্ট শক্তিশালী। নিজেরা রাজা হতে তো চায়ই, না হতে পারলে ভবিষ্যতে কে রাজা হতে পারে, তাকে সমর্থন জানিয়ে তার হয়ে যুদ্ধবিগ্রহ বাধিয়ে নিজের ক্ষমতা জাহির করা তাদের অন্যতম কাজ। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। চতুর্থ হেনরির কাছে যোদ্ধা নোবলম্যানরা দাবি করল, তার সৎ ভাই আলফন্সোকে তার উত্তরাধিকার ঘোষণা করা হোক। চতুর্থ হেনরির তা ইচ্ছে নয়, তিনি চান তাঁর ভাবী জামাই অর্থাৎ জোয়ান অফ পর্তুগালের গর্ভে জন্মানো নবজাতিকা জোয়ানার ভাবী স্বামীকে ভবিষ্যতের রাজা করতে। নোবলম্যানরা রাজার এই চুপচাপ থাকা সহ্য করল না, তারা আলফন্সোকে উস্কে নিজেরাই দায়িত্ব নিয়ে তার হয়ে চতুর্থ হেনরির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। চতুর্থ হেনরি এদের যুদ্ধে হারাতে পারলেন না, নিজেও হারলেন না, ফলে একটা মাঝামাঝি রফা হল। তিনি আলফন্সোকেই ভবিষ্যতের রাজা ঘোষণা করতে রাজি হলেন, যদি সে তাঁর মেয়ে জোয়ানাকে বিয়ে করে। এতে সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না।
সেই রকমই সাব্যস্ত হল, কিন্তু কপাল মন্দ, আলফন্সোকে রাজপুত্রের টীকা পরানোর কিছুদিন পরেই প্লেগে তার মৃত্যু হল। সেটা ১৪৬৮ সাল।
নোবলম্যানরা সন্দেহ করলেন রাজা আলফন্সোকে বিষ খাইয়ে মেরেছে। তারা তখন গিয়ে ইসাবেলাকে ধরল, তুমি তোমার ভাইয়ের এই ন্যক্কারজনক হত্যার প্রতিশোধ নাও, আমরা তোমার সঙ্গে আছি।
যুদ্ধে নোবলম্যানদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, এর পর যুদ্ধ বাধালে তারা নির্ঘাৎ হারবে, এই সাব্যস্ত করে ইসাবেলা তার সৎ দাদার সঙ্গে যুদ্ধে না গিয়ে আপোষে ব্যাপারটা মিটমাট করে নিতে চাইল। দাদার সঙ্গে দেখা করলে ঠিক হল, চতুর্থ হেনরি জোয়ানার বদলে ইসাবেলাকেই ভবিষ্যতে রাজত্বের দাবিদার করবেন, কিন্তু ইসাবেলা দাদার মত না নিয়ে কাউকে বিয়ে করতে পারবে না। ইসাবেলাও দাদাকে দিয়ে রাজি করিয়ে নিল যে, দাদাও জোর করে তার বিয়ে দিতে পারবে না।
১৪৬৮ সালে ইসাবেলার বয়স ১৭ বছর। কিন্তু তার বিয়ে নিয়ে জলঘোলা শুরু হয়েছে যখন তার বয়স মাত্রই ছ’ বছর। কাস্তিলের সিংহাসনে তখন তার সৎ দাদা ৩২ বছর বয়সী চতুর্থ হেনরি অফ কাস্তিল আর অ্যারাগনের সিংহাসনে তাদের প্রপিতামহ প্রথম জনের পৌত্র দ্বিতীয় জন অফ অ্যারাগন। সম্পর্কে দ্বিতীয় জন অফ অ্যারাগন সুতরাং হেনরি-ইসাবেলার খুল্লতাত। ইওরোপে দেশে দেশে যুদ্ধ লেগেই থাকে, নিজেদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বাড়িয়ে নেওয়া ছাড়া সুরক্ষার অন্য কোন উপায় নেই। কাস্তিল ও অ্যারাগন - এই দুই দেশের সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে তাদের দুই রাজা ঠিক করেছিলেন, দ্বিতীয় জনের কনিষ্ঠ পুত্র দ্বিতীয় ফার্দিনান্দের সঙ্গে চতুর্থ হেনরির সৎ বোন ইসাবেলার বিয়ে হবে। ছ’ বছরের কচি বয়সেই ইসাবেলা দ্বিতীয় ফার্দিনান্দের বাগদত্তা হয়ে গেল।
কিন্তু এই ব্যবস্থা ঠিক হল বলেই যে তাদের বিয়ে হয়ে গেল, তা নয়। পরের বছর দ্বিতীয় ফার্দিনান্দের কাকা পঞ্চম আলফন্সো অফ অ্যারাগন মারা যেতেই ছক বদলে গেল। পঞ্চম আলফন্সো শাসন করছিলেন সিসিলি-সার্ডিনিয়া দ্বীপ-সহ অনেকটা অঞ্চল, সেসব তার ভাই দ্বিতীয় জনের অধীনতায় এসে যেতে অ্যারাগনের আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেল, তার এখন আর কাস্তিলের চতুর্থ হেনরির সঙ্গে বন্ধুত্বে কী প্রয়োজন! অন্যপক্ষে চতুর্থ হেনরি অফ কাস্তিল দেখল অ্যারাগন শক্তিশালী হয়ে গেছে, তার দরকার অ্যারাগনের সঙ্গে টক্কর দেবার মত অন্য মিত্র, সে দ্বিতীয় জনের জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্বিতীয় ফার্দিনান্দের দাদা চার্লস অফ ভায়ানার দিকে হাত বাড়াল। চার্লসের সঙ্গে তার বাবা দ্বিতীয় জনের ছিল নিত্য ঝগড়া, তাই চুপি চুপি চার্লস যোগাযোগ করল চতুর্থ হেনরির সঙ্গে। হেনরি রাজি হল, বোনের সঙ্গে চার্লসের বিয়ে দেবার। দ্বিতীয় ফার্দিনান্দের বাগদত্তা ইসাবেলার বিয়ে মাত্র এক বছরের মধ্যে বদলে ঠিক হল ফার্দিনান্দের দাদা চার্লসের সঙ্গে, তখন তার বয়স সাত বছর।
খবর পেয়ে দ্বিতীয় জন অফ অ্যারাগন ক্ষেপে লাল হয়ে গেলেন। ইসাবেলার বিয়ে তিনি ঠিক করেছিলেন তার প্রিয় কনিষ্ঠ পুত্র দ্বিতীয় ফার্দিনান্দের সঙ্গে, আর এখন জ্যেষ্ঠ পুত্র চার্লস তাকে বিয়ে করতে চায়! রেগেমেগে তিনি চার্লসকে বন্দী করে কারাগারে নিক্ষেপ করলেন বাবার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার জন্যে। তিন বছর পরে চার্লসের মৃত্যু হল। ইসাবেলার বয়স তখন দশ বছর।
চতুর্থ হেনরির সমস্যা মিটল না। নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে সম্ভাব্য মিত্রের সঙ্গে বোনের বিয়ে দেওয়ার ফন্দিফিকির চলতেই লাগল। ইসাবেলার বয়স যখন চোদ্দ, তখন নিজের শালা পঞ্চম আলফন্সো অফ পর্তুগালের সঙ্গে তার বিয়ের ব্যবস্থা করতে লাগল হেনরি। ইসাবেলা এখন আর ছোট্টটি নেই। দাদার এই ব্যবস্থা শুনে সে রেগে গেল, প্রত্যাখ্যান করল এই প্রস্তাব।
চতুর্থ হেনরির অবস্থা দিনে দিনে খারাপ হতে লাগল। বাইরের রাজ্যের সঙ্গে টক্কর দেওয়া তো দূরের কথা, নিজের দেশের নোবলম্যানদেরই তিনি ঠান্ডা রাখতে পারছিলেন না। রাজভাণ্ডারে পয়সাকড়ি নিয়েও টানাটানি। দেশের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট দৃঢ় হতেই উপায়ান্তর না পেয়ে তিনি আবার বোনের বিয়ে দিয়ে বন্ধু জোটানোর চেষ্টা করতে লাগলেন। রাজার পছন্দের নোবলম্যান জুয়ান পাচেকোর ভাই ডন পেড্রোর সঙ্গে ইসাবেলার বিয়ে দিলে পেড্রো প্রচুর ধনরত্ন দিয়ে রাজভাণ্ডার ভরে দেবেন, এই আশ্বাস পেয়ে হেনরি এই বিয়ে পাকাপাকি করতে উঠেপড়ে লাগলেন। ইসাবেলা এই খবর পেয়ে খুব রেগে গেলেন এবং ঘৃণাভরে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন, কিন্তু হেনরির কোনো উপায় নেই। তিনি বোনের প্রত্যাখ্যান অগ্রাহ্য করলেন। নিরুপায় ইসাবেলা প্রার্থনা করতে লাগলেন যেন কোনোভাবেই এই পেড্রোর সঙ্গে তার বিয়ে না হয়। বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসছে, পেড্রো ইসাবেলার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন, এমন সময় ইসাবেলার প্রার্থনা মঞ্জুর হল। জানা গেল হবু স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে আসার পথেই অসুস্থ হয়ে পেড্রোর মৃত্যু হয়েছে।
হেনরি অন্যত্রও চেষ্টা চালিয়ে যেতেই লাগলেন। ইংল্যান্ডের রাজা চতুর্থ এডোয়ার্ড বা তার ভাই গ্লসেস্টারের ডিউক রিচার্ডকে পাত্র বানানোর চেষ্টা করে তিনি ব্যর্থ হলেন। অবশেষে দেশের নোবলম্যানরা যখন ইসাবেলার সহোদর ভাই আলফন্সোকে দেশের উত্তরাধিকার নিয়োগের জন্যে চাপ দিতে লাগল, তখন – ১৪৬৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে – হেনরি ও ইসাবেলার মধ্যে চুক্তি হল যে হেনরি যেখানে খুশি বোনের বিয়ে দিতে পারবেন না, ইসাবেলাও দাদার মত ছাড়া বিয়ে করতে পারবেন না। ইসাবেলা তখন সপ্তদশী।
এই ব্যবস্থায় রাজি হলেও হেনরি নিজের স্বার্থেই সুযোগ পেলেই চুক্তি খেলাপ করার উপক্রম করলেন। শালা পঞ্চম আলফন্সো অফ পর্তুগালের কাছ থেকে আবার প্রস্তাব এলো, তার নিজের বিবাহযোগ্য পুত্রও আছে। ইসাবেলা আলফন্সো অফ পর্তুগালকে বিয়ে করলে হেনরির মেয়ে জোয়ানা আলফন্সোর ছেলে দ্বিতীয় জন অফ পর্তুগালকে বিয়ে করবে, এতে হেনরি ও আলফন্সো মারা যাওয়ার পর জন আর জোয়ানা যথাক্রমে পর্তুগাল ও কাস্তিলের রাজত্বের দাবিদার হবে। ইসাবেলা আবার এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন এবং নিজের উদ্যোগেই তার প্রথম বাগদত্তা দ্বিতীয় ফার্দিনান্দ অফ অ্যারাগনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের বিয়ে পাকা করার ব্যবস্থা করতে ভাবি শ্বশুর দ্বিতীয় জন অফ অ্যারাগনের দ্বারস্থ হলেন।
হেনরি তখনও আশা ছাড়েননি। ফ্রান্সের রাজা একাদশ লুইয়ের ভাই ডিউক অফ বেরি চার্লসের সঙ্গে ইসাবেলার বিয়ে দিলে ফ্রান্সের সঙ্গে কাস্তিলের সুসম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে, এই আশায় এখানেও ছিপ ফেলা হল। বলা বাহুল্য, ইসাবেলা রাজি হলেন না। ততদিনে অ্যারাগনরাজ দ্বিতীয় জন ছেলে দ্বিতীয় ফার্দিনান্দের সঙ্গে ইসাবেলার বিয়ে পাকা করে ফেলেছেন। চতুর্থ হেনরির এই বিয়েতে রাজি না হয়ে উপায় নেই, তিনি বুঝতে পারছেন সৎ বোনকে আর দাবিয়ে রাখা যাবে না।
বিয়ে ঠিক হলে কী হবে, এদিকে আবার নতুন সমস্যা। ক্যাথলিক নিয়মে সেকেন্ড কাজিনদের মধ্যে বিবাহ অসঙ্গত ও বে-আইনি। একমাত্র পোপের মত পেলেই এই বিয়ে দেওয়া যায়। দ্বিতীয় জন তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে পোপের সম্মতি – পাপাল বুল – জোগাড় করলেন। ইসাবেলা অবশ্য পোপ-টোপের অপেক্ষায় বসে থাকেননি। ভাই আলফন্সোর কবর দেখতে আভিলা যাচ্ছেন, এই অছিলায় দাদার দুর্গ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। প্রণয়ী দ্বিতীয় ফার্দিনান্দও অ্যারাগন থেকে চাকরের ছদ্মবেশে কাস্তিলে ঢুকে পড়লেন। ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দের শীতে অষ্টাদশী ইসাবেলা কাস্তিলের ভালাদোলিদ শহরের পালাসিওস দে লস ভিভেরো আইনসভায় তার বারো বছরের বাগদত্তা দ্বিতীয় ফার্দিনান্দের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন।
ইওরোপের ইতিহাসে এই বিবাহ এক নতুন দিগন্ত খুলে দিল। তৈরি করল ইওরোপের এবং তদানীন্তন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ক্যাথলিক খ্রিস্টান সাম্রাজ্য। পরবর্তীতে কাস্তিল ও অ্যারাগন – এই দুয়ের মিলিত ভূখণ্ডই পরিচিত হল স্পেন নামে।
অবিশ্বাস্য দ্রুততায়, শৌর্য-বীর্য ও মস্তিষ্কের প্রভাব খাটিয়ে রানি ইসাবেলা ও রাজা ফার্দিনান্দ কাস্তিল ও অ্যারাগনে প্রতিষ্ঠা করলেন শান্তি ও সমৃদ্ধির বাতাবরণ। ইহুদিদের বললেন, হয় খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করো, নয়ত বিদেয় হও। মুসলমানদের খেদিয়ে বিদায় করলেন সমগ্র স্পেন থেকে। নোবলম্যানদের ক্ষমতা খর্ব করে নিজেদের শক্তিশালী করলেন।
এবং অন্যান্যদের মতামত অগ্রাহ্য করে তিনি কলম্বাসকে অনুমতি দিলেন পশ্চিমে পাড়ি দিয়ে পুবের দেশের সঙ্গে বাণিজ্যের পথ সুগম করতে।
* * *
ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের গোমেরাতে এসে তাঁর বাহিনী দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেল। তিনখানা জাহাজের একটা দলকে তিনি নির্দেশ দিলেন সোজা হিস্পানিওলা চলে যেতে, যাতে ওখানে যাদের ছেড়ে এসেছেন, তারা প্রয়োজনীয় রসদ পেয়ে যায়। বাকি তিনটেকে নিয়ে তিনি চললেন নতুন ভূখণ্ডের খোঁজে। এতদিন শুধু দ্বীপই খুঁজে পেয়েছেন তিনি, মূল ভূখণ্ডে – চিনে বিশেষ করে – তাঁকে পৌঁছাতেই হবে, তবেই না তিনি গ্রেট খানের মুখোমুখি হতে পারবেন।
ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ আটলান্টিকের মধ্যেই, স্পেনের দক্ষিণ উপকূল ছাড়ালেই উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মরক্কো, তার পশ্চিম উপকূলের মাঝামাঝি অঞ্চল থেকে পশ্চিমে অল্প গেলেই মহাসাগরের মধ্যে ছোট ছোট এই দ্বীপপুঞ্জ। এখানে থেকে সোজা পশ্চিমে জাহাজ ভাসালেই আটলান্টিক পেরিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় কলম্বাসের ইন্ডিজ অর্থাৎ ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে। আগে দুবার গিয়ে কলম্বাস বুঝে গেছেন, এভাবে গেলে তিনি আটকে যাচ্ছেন কোনো না কোনো দ্বীপে। কিউবা, হিস্পানিওলা, পুয়ের্তো রিকো, মনসেরাট, ডমিনিকা লাইন দিয়ে তার পথ আটকে দিচ্ছে। এদের অতিক্রম করে মূল ভূখণ্ডে পৌঁছাতে হলে হয়ত তাঁকে আরও দক্ষিণে নামতে হবে। ওখানে গিয়ে দক্ষিণে জাহাজ না ভাসিয়ে তিনি আগেই দক্ষিণে জাহাজ ভাসিয়ে তারপর পশ্চিমে যাত্রা করবেন, তাহলেই পৌঁছে যাবেন প্রার্থিত গন্তব্যে। তাছাড়া ক্রিস্টোফার শুনেছেন, যেসব জায়গায় সূর্য লম্বভাবে কিরণ দেয়, সেখানে নাকি প্রাকৃতিক সম্পদ অনেক বেশি। ক্যানারির তুলনায় কেপ ভার্দে বিষুবরেখার অনেক কাছাকাছি, এখান থেকে সোজা পশ্চিমে গেলে যে ভূখণ্ডে উঠবেন, সেটাই নিশ্চয় হবে ক্যাথে অর্থাৎ চিনের মূল ভূমি।
আফ্রিকার উপকূল ধরে দক্ষিণ-পশ্চিমে জাহাজ ভাসিয়ে তিনি ক্যানারি থেকে পৌঁছে গেলেন ভার্দে দ্বীপপুঞ্জে। কিন্তু তার পরে শুরু হল বিপত্তি। চৌঠা জুলাই জাহাজ ছেড়ে পরের আটদিন প্রবল পরিশ্রম করেও জাহাজ মাত্র নড়ল একশো বিশ লিগ। হাওয়া উল্টোদিকে। যেতে হবে সুদীর্ঘ পথ। ভাগ্যক্রমে বাইশ তারিখে হাওয়া ফিরে এল, কলম্বাস পশ্চিমে গতি বাড়ালেন। আরও ন’দিন যেতেই দেখা গেল, পানীয় জলের স্টক ফুরিয়ে আসছে। মহা মুশকিল। উপায় না পেয়ে কলম্বাস ঠিক করলেন নতুন জায়গার সন্ধান করার চেয়ে পরিচিত জায়গাতে নোঙর করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আগে তো বেঁচে থাকা, তারপর তো আবিষ্কার। ঠিক হল, আগেরবার যে জায়গাটা প্রথম দেখেছিলেন, সেই ডমিনিকাতেই গিয়ে উঠবেন তাঁরা, জল-টল পর্যাপ্ত পরিমাণে ভরে নিয়ে ফের বেরিয়ে পড়া যাবে। সেই অনুযায়ী জাহাজের গতিপথ ডানদিকে ঘুরিয়ে পশ্চিমের পরিবর্তে উত্তর-পশ্চিম অভিমুখে করে নেওয়া হল। হাওয়ার জোর সেই দিকেই প্রবল। নতুন উদ্যমে দাঁড় টানা শুরু হল। সেদিনই বিকেলের দিকে কলম্বাস দেখলেন দূরে একটা ভূখণ্ড দেখা যাচ্ছে, ডমিনিকা নয়, এতে পাশাপাশি তিনখানা পাহাড়। পবিত্র ট্রিনিটির মত যেন তারা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে।
কলম্বাস এর নাম দিলেন ত্রিনিদাদ।
ত্রিনিদাদের দক্ষিণ উপকূলে জাহাজ নোঙর করে জল ভরে নেওয়া হল। সেখান থেকে আবার জাহাজ পশ্চিমে ভাসাতেই ফের দেখা গেল নতুন স্থলভাগ।
দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের মূল ভূখণ্ড! কিন্তু কলম্বাস অতকিছু জানবেন কী করে? তিনি উপকূল ধরে চলতে লাগলেন দক্ষিণে। চৌঠা থেকে বারোই অগাস্ট এই নতুন ভূখণ্ডের বিভিন্ন জায়গায় পড়ল তার সহযাত্রীদের পদধূলি। এভাবেই কিছুদিনের মধ্যে তিনি দেখলেন এক বিশাল নদী এসে পড়েছে মহাসাগরে, তার মিষ্ট জল যে প্রবল ধারায় গিয়ে মিশছে মহাসাগরের লবণাক্ত বারিধিতে, এত স্রোত ও এত জল দ্বীপ থেকে উৎপন্ন জলাশয়ে তৈরি হওয়া অসম্ভব। কলম্বাস ধারণা করলেন, এটা নিশ্চয় মহাদেশ। এটা নিশ্চয় ইন্ডিজের মেইনল্যান্ড! তিনি এই নদীমোহানার নাম দিলেন ড্রাগনের মুখ।
পরে জানা যাবে, এটা হচ্ছে ওরিনোকো নদী, বর্তমান ভেনিজুয়েলার মধ্যে দিয়ে যার অধিকাংশ পথ চলা। দক্ষিণ আমেরিকার সর্ববৃহৎ নদীদের অন্যতম এই ওরিনোকো, প্রতি সেকেন্ডে সমুদ্রে জল নিক্ষেপের আয়তনে যার স্থান পৃথিবীতে তৃতীয় – দক্ষিণ আমেরিকারই অ্যামাজন আর আফ্রিকার কঙ্গোর পরেই এবং ভারত-বাংলাদেশের গঙ্গা-পদ্মা বা চিনের ইয়াংসির আগে।
ড্রাগনের মুখের বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁরা অবতরণ করলেন ও স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে মিলিত হলেন। স্থানীয় মানুষেরা কৌতূহলী ও অতিথিবৎসল। তারা এঁদের ভাল ভাবে আপ্যায়ন করল। এরা মুক্তো সংগ্রহ করে। বিদেশিদের ঝুটো কাচের জিনিসের পরিবর্তে এরা হাসিমুখে এদের মুক্তো বিলিয়ে দিল।
কিছুদিন পর তারা এসে হাজির হলেন মার্গারিটা দ্বীপে। এখানে মুক্তোর চাষ হয়। রাশি রাশি মুক্তো এদের সংগ্রহে, সেগুলো দিয়ে এরা মালা বানিয়ে পরে। কলম্বাস আবার এখানে নিজেদের কিছু সামান্য জিনিসের পরিবর্তে তিন বস্তা মুক্তো সংগ্রহ করলেন।
আবহাওয়ার জন্যেই হোক বা অতিরিক্ত পরিশ্রমে, কলম্বাসের শরীর খারাপ হতে শুরু করল। জ্বরে পড়তে লাগলেন তিনি ঘন ঘন। নির্দেশ দিলেন, চলো, হিস্পানিওলা ফেরা যাক। ওখানেই আছে সঙ্গীসাথীরা। ওদের কাছে ফেরৎ গেলে হয়ত শরীর ভাল হয়ে যাবে। জাহাজের মুখ ঘোরানো হল। উনিশে অগাস্ট তাঁরা হিস্পানিওলা পৌঁছালেন।
কিন্তু ফিরেই কলম্বাস টের পেলেন, হাওয়া পুরো অন্য রকম। এখানে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে। আগেরবার যাদের সঙ্গে এনেছিলেন আর এখানে রেখে গেছিলেন, তারা ভেবেছিল এই দেশে পা দিলেই পায়ে সোনা জড়িয়ে যাবে। এতদিন থেকে তাদের সে ভ্রান্তি ভেঙেছে। সোনার দর্শন পাওয়া যাচ্ছে না আদৌ। স্থানীয় জনতাকে মেরেধরেও জোগাড় হচ্ছে না এমন কিছু যা দেশে ফেরৎ নিয়ে গেলে তারা বিক্রি করে লাল হয়ে যেতে পারবেন। এর জন্যে কলম্বাসই দায়ী। সেই তো বড় মুখ করে বলে বেড়িয়েছে, গুপ্তধনের চাবিকাঠি নাকি খুঁজে পেয়ে গেছে, সেখানে গিয়ে বস্তা বোঝাই করে ধনরত্ন কুড়িয়ে নিলেই হল।
তার সঙ্গে যোগ হয়েছে স্থানীয় উপজাতি, বিশেষ করে ক্যারিব-দের অতর্কিত হানা। এরা বোধহয় নরখাদক। দূর থেকে তির ছোঁড়ে। এদের হাতে অনেকে মরেছে। বদলা নিতে এরাও জ্বালিয়ে দিয়েছে স্থানীয় মানুষদের বাড়িঘর। তারা আগে এদের দেবদূত ভেবে উপহার ফলফুলাদি দিয়ে যেত। এখন যেই বুঝেছে এরা আসলে আপদ, ওদের দিয়ে কাজ করিয়ে ওদেরই অত্যাচার করতে চায়, অমনি তারা দলে দলে জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও পালিয়ে যায়।
ভাই বার্থেলেম্যুকে দায়িত্ব দিয়ে এসেছিলেন ইসাবেলা দেখাশুনার জন্যে। দেখা গেল সে ইসাবেলা ছেড়ে ঘাঁটি তুলে নিয়ে গেছে হিস্পানিওলার দক্ষিণে স্যান্টো ডোমিনিঙ্গোতে। ঘাঁটি স্থাপন করা হয়েছে হিস্পানিওলার দক্ষিণ-পশ্চিমে জারাগুয়াতেও। তাকেই বেশিরভাগ সময় মোকাবিলা করতে হয়েছে স্থানীয়দের। কখনও ভয় দেখিয়ে, কখনও আপ্যায়ন করে সে যতটা পেরেছে করেছে। কলম্বাসদের বিরুদ্ধে যারা ঘোঁট পাকাতে গেছিল, তাদের অনেককে বন্দী করে জেলে পুরে রাখা হয়েছে সেন্টো ডোমিনিঙ্গোতে।
কিন্তু এ তো কিছুই না। আগেরবার যারা এসেছিল, তাদের অনেকে আর পাদ্রীদের কিছু স্পেনে ফিরে গিয়ে রাজা-রানির কান ভাঙাতে শুরু করেছে। বলেছে, কলম্বাসের পুরোটাই ধাপ্পাবাজি। সোনাদানা কিচ্ছু তো নেই-ই, কতগুলো কালো কালো হাবাগোবা লোক ছাড়া এখান থেকে লাভ করার আশাই বাতুলতা। যেটুকু সোনা পাওয়া গেছে, তা কলম্বাস, ওর ভাই আর ছেলে নিজেরা হাতিয়ে নিয়ে বাকিদের পশুর মত অত্যাচার করছে। দুর্গে বন্দীদের বিনা বিচারে হত্যা করেছে।
রানি ক্রিস্টোফারের ওপর সদয় ছিলেন, কিন্তু ক্রমাগত উস্কানিতে তাঁর মনোভাব বদলাতে লাগল। তাছাড়া তিনি স্মরণ করলেন, দু দুবার যাওয়া আসা করেও কলম্বাস সোনাদানা কিছুই আনতে পারেননি, অথচ ক্রমাগত দাবি করে গেছেন প্রবল লাভের। এর সঙ্গে যোগ হল পাদ্রীদের স্বচক্ষে দেখা স্থানীয় মানুষদের ওপর কলম্বাসের নিয়োগ করা নেতৃদলের অত্যাচারের কাহিনি। ওঁদের নির্দেশ অমান্য করে বিদেশে গিয়ে বিদেশিদের ওপর অত্যাচার স্পেনের সুনামের পক্ষে প্রচণ্ড ক্ষতিকর। এঁরা তা বরদাস্ত করতে পারেন না। স্থির হল, রাজসভার একজন অমাত্যকে পাঠানো হবে কলম্বাসের কাজকর্মের খতিয়ান সংগ্রহ করতে। যদি দেখা যায় কলম্বাস সত্যিই রাজ-নির্দেশ অমান্য করেছে, তবে তাঁকে স্পেনের আইন অনুযায়ী শাস্তি পেতে হবে।
ফ্রান্সিস্কো দ্য বোবাডিলা নামের সেই রাজ-অমাত্য হিস্পানিওলার স্যান্টো ডোমিনিঙ্গোতে পৌঁছালেন ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে অগাস্ট। ক্রিস্টোফার তখন জারাগুয়াতে সেখানকার ঝামেলা মেটাতে গিয়েছেন। উপকূলে স্পেন থেকে আসা জাহাজ ভিড়ছে দেখে ভাই দিয়েগো নৌকা পাঠালেন কে এসেছে দেখে আসতে। বোবাডিলা সেই নৌকা চেপে তীরে পৌঁছেই দেখলেন একটা গাছে ফাঁসির দড়ি থেকে ঝুলছে দুই স্প্যানীয় মানুষের লাশ। ক্রিস্টোফারের বিরুদ্ধে শোনা কাহিনিগুলো তাহলে নিছক গল্প নয়!
তিনি তীরে না নেমে ফিরে গেলেন জাহাজে। পরের দিন নেমে সোজা হাজির হলেন গীর্জায় মাস প্রেয়ারে। সেখানে উপস্থিত জনতাকে রানির চিঠি পড়ে শোনালেন। তার হাজির হওয়ার কারণ – কলম্বাসের বিরুদ্ধে যারা অভিযোগ করেছেন, তাদের অভিযোগের অনুসন্ধান করা।
যেহেতু ক্রিস্টোফার তখন সেখানে নেই, দিয়েগো আর বার্থেলম্যুকে তিনি নির্দেশ দিলেন অবিলম্বে তারা যে সব স্প্যানীয় মানুষদের বন্দী করে রেখেছে, তাদের যেন বোবাডিলার হাতে তুলে দেওয়া হয়। তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলবেন। তারা দুজনেই বোবাডিলাকে অগ্রাহ্য করে বললেন, তারা এই নির্দেশ মানতে বাধ্য নয়। এখানকার সর্বাধিনায়ক ক্রিস্টোফার কলম্বাস, তারা একমাত্র তার নির্দেশ মেনে চলবেন।
বোবাডিলার সঙ্গে শুধু চিঠি নয়, যোদ্ধারাও ছিল। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগকারীদের অধিকাংশ অভিযোগ সত্যি প্রমাণ হওয়ায় তিনি কলম্বাসকে তাঁর গভর্নরের পদ ও তৎসংক্রান্ত যে সুযোগ-সুবিধা তিনি পেতেন, সবকিছু থেকে তাঁকে পদচ্যুত করে দিলেন। জারাগুয়াতে এই খবর পৌঁছালে উদ্বিগ্ন ক্রিস্টোফার তাঁর সপক্ষে জনগণকে একত্রিত করে বোবাডিলাকে দেশে ফেরত পাঠানোর সুযোগ খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু তা সম্ভব হল না। স্থানীয় ও দেশি মানুষদের ওপর কলম্বাস ভাইদের অত্যাচার, সোনাদানা যা সংগ্রহ হয়েছে, সব নিজের কাছে রেখে দেওয়া, কর্মচারীদের বেতন না দেওয়া, বিনা বিচারে অনেককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা – সমস্ত অভিযোগের সপক্ষে প্রমাণ পেতেই দেশের বিরুদ্ধে কাজ করার অভিযোগে কলম্বাসদের তিনজনই কারারুদ্ধ হলেন। তাঁদের লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে ফেলা হল। গত ছ’ বছরের একচ্ছত্র আধিপত্যই শুধু হারালেন না কলম্বাস, তাঁর সমস্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করা হল। অক্টোবরের প্রথম দিকে একটা জাহাজে তিনজনকে শিকল-বাঁধা অবস্থাতেই তুলে দেশে ফেরৎ পাঠানোর ব্যবস্থা হল। জাহাজের ক্যাপ্টেন ভিলেজো কলম্বাসের প্রতি সহমর্মী ছিলেন, তিনি ওদের শিকল খুলে দেওয়ার প্রস্তাব করতে কলম্বাস তা প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি বিচার চান, দয়া নয়।
অক্টোবরের শেষদিকে সেই জাহাজ হাজির হল কাডিজ বন্দরে। কলম্বাস বন্দী অবস্থায় দেশে ফিরেছেন জেনে শহরের লোকজন আশ্চর্য হয়ে গেল। কয়েক বছর আগে যাঁর নাম গর্বের সঙ্গে ঘরে ঘরে শোনা যেত, তিনি কিনা বন্দী, তাঁর হাত-পা শিকল দিয়ে বাঁধা! এ যে অপ্রত্যাশিত।
ক্রিস্টোফারকে সেই অবস্থায় হাজির করা হল রাজা-রানির কাছে। রানি এই দৃশ্য সহ্য করতে পারলেন না। তিনি নিজে বীর, জানেন কতখানি সাহস ও দৃঢ়তা থাকলে একজন নাবিক সবার বিরুদ্ধে গিয়ে নতুন পথে নতুন জায়গা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়। তাঁর এই পরিণতি একেবারেই কাম্য নয়। তিনি অবিলম্বে কলম্বাসের বাঁধন খুলে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। একই সঙ্গে বুঝলেন বোবাডিলাও তাঁদের নির্দেশ অমান্য করে যথেচ্ছাচার করেছেন। কলম্বাস আবারও জোর দিয়ে বললেন তিনি ইন্ডিজেই পৌঁছেছেন এবং যেহেতু এগুলো দ্বীপ, হয়ত এতে খুব বেশি ধনরত্ন নেই, কিন্তু মূল ভূখণ্ডের পথও তিনি দেখে এসেছেন, এবং সেখানে হাজির হতে পারলে তাঁদের ধনরত্নের অভাব হবে না একেবারেই।
রানি আবারও তাঁর কথা মন দিয়ে শুনলেন। তাঁর ইচ্ছা হল কলম্বাসকে বিশ্বাস করার। রাজ-অনুগ্রহ সমস্তটাই ফিরে পেলেন কলম্বাস। এমনকি আর একবার তিনি অভিযানে যেতে চাইলে তাতেও সম্মত রানি ইসাবেলা। কিন্তু এতদিন যেহেতু তিনি প্রায় কিছুই সঙ্গে করে নিয়ে আসার মত পাননি, পুরোপুরি তাঁকে সমস্ত অধিকার দিয়ে দেওয়া আর সম্ভব নয়।
গভর্নরের পোস্ট আর কলম্বাসের ফিরে পাওয়া হল না। বাজেয়াপ্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি তিনি ফেরৎ পেলেন বটে, কিন্তু হৃত সম্মান আর পুনরুদ্ধার হল না। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত পাশের দেশ পর্তুগাল থেকে খবর এল, কলম্বাসের পাঁচ বছর পর যাত্রা শুরু করে ভাস্কো ডা গামা নামে এক পর্তুগিজ নাবিক আফ্রিকার দক্ষিণ ঘুরে ভারতে যাওয়ার রাস্তা আবিষ্কার করে ফেলেছে শুধু নয়, সেখান থেকে আহরণ করে এনেছে জাহাজভর্তি অতি মূল্যবান মশলা।
হায়, নিয়তি!
* * *
জাহাজ ভালই চলছিল, এসব রাস্তা এখন ক্রিস্টোফারের নখদর্পণে। ১৫ই জুনে তারা পৌঁছে গেলেন মার্টিনিকা দ্বীপে, সেখানে জামাকাপড় কাচাকুচি করে পানীয় জল আর রান্নার উপযোগী কাঠ ভরে নেওয়া হল। ছোটখাট আরও কিছু দ্বীপ ঘুরে জাহাজ চলল পশ্চিমে। এই সময় একটা জাহাজে সমস্যা তৈরি হতে কলম্বাস রানির আদেশ ভুলে হিস্পানিওলার স্যান্টো ডোমিনিঙ্গোতে জাহাজ নোঙর করে সারিয়ে নেওয়ার কথা ভাবলেন। পোড় খাওয়া নাবিক ক্রিস্টোফার সমুদ্র ও হাওয়ার গতিপ্রকৃতি দেখে বুঝতে পারছেন কিছুক্ষণের মধ্যে এখানে তীব্র সাইক্লোন আসতে চলেছে, কাজেই জাহাজগুলোকে সুরক্ষিত জায়গায় বেঁধে রাখতেই হবে।
হিস্পানিওলার গভর্নর ওভান্ডো ওদের জাহাজ নোঙর করার অনুমতি দিলেন না। কলম্বাসের প্রতিনিধি যখন তাকে জানালেন সমুদ্রে ঝড় আসতে চলেছে, সেই সতর্কবার্তাও অগ্রাহ্য করে হাসতে হাসতে বললেন, বাহানা করার আর জায়গা পাওনি! ভাগো হিঁয়াসে।
বাধ্য হয়ে কলম্বাস জাহাজ নিয়ে কোনো রকমে চলে গেলেন আজুয়া দ্বীপে, ঝড় থেকে বাঁচতে সেখানে জাহাজ বাঁধলেন। বত্রিশটা জাহাজ নিয়ে ওভান্ডোর বিশাল প্রতিনিধিদল তখন হিস্পানিওলা থেকে স্পেন ফেরত যাওয়ার তোড়জোড় করছে। সেই দলে যেমন আছে এল ডোরাডোর মত বিশাল জাহাজ, তেমনি ভাঙাচোরা এক জাহাজও, যাতে তোলা হয়েছে কলম্বাসের আমলে জোগাড় করা সোনা। রানি ইসাবেলার সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী এর দশ শতাংশের মালিকানা কলম্বাসের। ওভান্ডো ভেবেছিলেন, এই জাহাজ যদি ডুবে যায়, তবে ইসাবেলা সোনা পাবেন না, তিনি জানবেন কলম্বাসের সোনাদানার গল্প গল্পই, তাঁর রাগ গিয়ে পড়বে কলম্বাসের ওপরেই। কলম্বাসও এর দশ শতাংশের বদলে পাবেন লবডঙ্কা।
আটলান্টিকে এক দশক ধরে জাহাজ চালাচ্ছেন ক্রিস্টোফার, তিনি এই সমুদ্রের গতিপ্রকৃতি ভালই চেনেন। ঝড় এল এবং মুহূর্তেই দেশে প্রত্যাবর্তনকারীদের বত্রিশটা জাহাজের মধ্যে কুড়িটা ডুবিয়ে দিল। অন্যান্যদের মধ্যে ডুবে গেলেন ফ্রান্সিস্কো বোবাডিলা, যিনি গত বছর কলম্বাসকে লোহার শিকল পরিয়ে দেশে পাঠিয়েছিলেন। যে সামান্য কয়েকটা জাহাজ স্পেনে গিয়ে পৌঁছাল, তার একটা হচ্ছে ঐ সোনাওয়ালা ভাঙাচোরা জাহাজটা!
ওদিকে কলম্বাসের দল পশ্চিমে চলতে চলতে জ্যামাইকা ও কিউবা হয়ে পৌঁছে গেল মধ্য আমেরিকায়। পয়লা অগাস্ট ১৫০২, তারা পৌঁছাল হন্ডুরাসের উপকূলে, সেখানে প্রথম মায়া সভ্যতার মানুষদের সঙ্গে মোলাকাৎ হল এদের। আগে যত স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে এদের দেখা হয়েছে – ক্যারিব, তাইনো, অ্যারাবক – তাদের চেয়ে এরা বেশি সভ্য, এদের গায়ে পোশাকের পরিমাণও বেশি। কলম্বাসের চাই সোনা, তার খোঁজখবর করতে এরা ইঙ্গিতে বোঝাল, সোনা আছে এখানে, তবে তা আরও দক্ষিণে। কলম্বাস কালক্ষয় না করে জাহাজ ভাসালেন দক্ষিণে। হন্ডুরাস, নিকারাগুয়া, কোস্টারিকা, পানামা উপকূল ধরে তার জাহাজ চলতে লাগল।
এদিকে সমুদ্র ভয়াল হয়ে উঠেছে। একটা জাহাজের অবস্থা এর মধ্যেই খারাপ হয়ে গেছিল, অন্য একটারও যাই যাই অবস্থা। এতজন লোক নিয়ে এই অবস্থায় অভিযান চালানো অসম্ভব। কলম্বাস ঠিক করলেন, যা হয় হোক, হিস্পানিওলাতেই তাদের ফিরে যাওয়া উচিত। জাহাজগুলো সারিয়ে আবার না হয় আসা যাবে।
কিন্তু সমুদ্রে আবার ঝড় উঠল। সমুদ্রের কীট দুখানা জাহাজের তক্তা খেয়ে বড় বড় গর্ত করে দিয়েছে, সেখান দিয়ে হু হু করে জল ঢোকে, এই অবস্থায় এদের নিয়ে চলা মুশকিল। বাধ্য হয়ে তাদের পরিত্যাগ করে অতজন লোক নিয়ে দুটো জাহাজেই কোনোমতে জাহাজ চালাতে লাগলেন। সে দুটো চলছে যদিও, তাদের অবস্থাও ভাল না। ফেরার পথে কিউবা পেরিয়ে যখন তারা জ্যামাইকা উপকূলে হাজির হলেন, তখন অবস্থা দুর্বিষহ। আর এগোনো অসম্ভব। অজানা রোগে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে বেশ কয়েকজন। যারা বেঁচে আছে, তাদের অবস্থাও শোচনীয়। তারাও জ্বরে ভুগছে, পালা করে তাদের সেবাশুশ্রুষা করার দরকার, কিন্তু করবে কে? তার চেয়েও বড় কথা, খাবার জুটবে কোত্থেকে?
২৫শে জুন ১৫০৩ খ্রিস্টাব্দ। কয়েকজন সহযাত্রীকে নিয়ে কলম্বাস আটকে গেলেন জ্যামাইকা দ্বীপে। তীরে নামলেন না তারা, সমুদ্রের মধ্যেই জাহাজদুটোকে পাশাপাশি রেখে চিন্তা করতে লাগলেন, কীভাবে এখান থেকে ফেরা যায়। কোনোভাবে হিস্পানিওলায় খবর পাঠাতে হবে, যাতে তারা এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে পারে।
উপকূলে জাহাজ দেখে জ্যামাইকার স্থানীয় টাইনোরা হাজির হয়েছে। সাধারণত তারা বাইরের মানুষ বলতে কাছাকাছি দ্বীপের হিংস্র ক্যারিবদের দেখে, কিন্তু এরা তো তাদের মত নয়। নিজেদের মধ্যে সাঙ্কেতিক কথাবার্তা চালিয়ে তারা স্থির করল, এরা ক্যারিবদের মত খারাপ মানুষ নয়, এদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করা যেতে পারে। ক্রিস্টোফারের সঙ্গে যারা ছিল, তারা এদের ধাতব ঘন্টা, কাচের গুলি ইত্যাদি সঙ্গে যা টুকিটাকি জিনিস বেঁচে ছিল, সেগুলো উপহার দিল। তাই পেয়েই তারা খুব খুশি। এদের জন্যে তারা এনে দিল বনের ফলমূল। এরা তো তাই চায়!
কিন্তু এভাবে বেশিদিন চলবে না। এখান থেকে বেরোতেই হবে। ক্রিস্টোফারের অনুগত এক সঙ্গী দিয়েগো মেন্ডিজকে দায়িত্ব দেওয়া হল, যেভাবেই হোক, হিস্পানিওলায় খবর পাঠাতে যেন এখান থেকে এদের উদ্ধার করার জন্যে রসদ ও জাহাজ পাঠায় ওভান্ডো। কিন্তু দিয়েগো যে যাবে, কীভাবে যাবে? টাইনোদের এক ক্যানোতে চড়ে সে আরও কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে বেরিয়ে গেল পুবমুখে। উপকূল ধরে কিছুদূর নির্বিঘ্নেই যাওয়া গেল, কিন্তু যেই ক্যানো গিয়ে পড়ল গভীর সমুদ্রে, বোঝা গেল এই ক্যানো তার মোকাবিলা করতে পারবে না। হাওয়ার বেগ উল্টোদিকে, সমুদ্রে বড় বড় ঢেউ, আবহাওয়া বিরূপ, ক্যানো চালানো অসম্ভব। নিরুপায় দিয়েগো ফিরে এল জ্যামাইকায়।
খাবার ফুরিয়ে এল। কলম্বাসের শরীর খারাপ, তার সারা শরীরে বাতের ব্যথা। চোখেও সমস্যা। তার পক্ষে কাজ করাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সঙ্গে দুই একটা বই ছিল, তিনি সময় পেলে সেগুলো নিয়েই বসে থাকেন। দিয়েগো এবার তীরে নেমে গেল এখানকার টাইনোদের ভুলিয়ে খাবারদাবার সংগ্রহ করতে। আরও কিছু ঘন্টা ও গুলির বিনিময়ে সংগ্রহ হল আরও কিছু ফলমূল ও স্থানীয় খাদ্য।
টাইনোদের আর একটু বড় ক্যানো এবং ওদের গোটা ছয়েক লোককে সঙ্গে নিয়ে দিয়েগো মেন্ডিজ আবার বেরিয়ে পড়লেন জুলাইয়ের মাঝামাঝি। সান্তো ডোমিনিঙ্গোতে পৌঁছাতেই হবে, নাহলে এখানেই তাদের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হবে।
এর মধ্যে কলম্বাসের চুপচাপ বসে থাকা দেখে তার সঙ্গীদের মধ্যেও ফিসফিসানি শুরু হয়ে গিয়েছে, তারা আর কলম্বাসের কথা শুনতে রাজি নয়। কলম্বাস যতই তাদের বোঝান, দিয়েগোরা গেছে, তারা সাহায্য নিয়ে ফিরে আসবে, এরা তত রুক্ষ হয়ে প্রতিবাদ করেন। খাবারের জোগান কমে আসছে। স্থানীয় লোকেরা ঘন্টা-ফন্টা পেয়ে যে প্রাথমিক মজা পেয়েছিল, তার রেশ কমে যেতে তারা তাদের খাবারের দর বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা বুঝে গেছে, এরা উটকো লোক, পুরোপুরি তাদের সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল। কষ্ট করে জোগাড় করা আহার এদের তারা দেবেই বা কেন?
দিয়েগো মেন্ডিজরা যাওয়ার পর কয়েক মাস কেটে গেল। দুটো জাহাজের রসদ প্রায় শেষ। যে কয়েকটা বিস্কুট পড়ে আছে, তাতে কুকুরেও মুখ দেবে না। কলম্বাসের সঙ্গীরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একদল চায় যেন তেন প্রকারেণ এখান থেকে বেরিয়ে যেতে। তারা তীরে নেমে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারও শুরু করে দিয়েছে। এরা অতর্কিতে তাদের আক্রমণ করলে যে কী হবে, সেই নিয়ে কলম্বাস চিন্তিত। এদের বোঝালে বোঝে না। কীই বা বোঝাবেন? দিয়েগোটাই বা ফিরছে না কেন? সে কি হিস্পানিওলা পৌঁছাতে পারেনি? সমুদ্রে সলিলসমাধি হয়েছে তার?
নতুন বছর এসে গেল। ১৫০৪ সাল। বিরোধী দলের পান্ডা ফ্রান্সিস্কো দ্য পোরাস আর তার ভাই কলম্বাসকে সাফ জানিয়ে দিল, তারা বেরিয়ে যাচ্ছে। টাইনোদের ভয় দেখিয়ে তারা দশখানা ক্যানো জোগাড় করেছে, সেইগুলো নিয়ে। কলম্বাস আবার বললেন, শান্ত হও, এর মধ্যে ক্যানো নিয়ে পাড়ি দেওয়া মানে মৃত্যু ডেকে আনা। তারা শুনল না। কয়েকজন টাইনোকে ধরে ক্যানো ভাসিয়ে দিল। কিন্তু দিয়েগোদের প্রথম যে অবস্থা হয়েছিল, এদেরও তাই হল। কিছুদূর গিয়েই রণে ভঙ্গ দিয়ে তারা ফিরে এল। ক্রিস্টোফারের সঙ্গে তারা আর থাকতে চায় না। নিজেরা একটা জাহাজে চড়ে সেটাকে কলম্বাস ও তার অনুগামীদের থেকে খানিকটা দূরে বেঁধে তাতে থাকতে লাগল।
চলে গেল আরও কিছ সপ্তাহ। খাবার শেষ। ফেব্রুয়ারির শেষদিকে একদিন এমন অবস্থা যে এবার অনাহারেই মরতে হবে। কলম্বাস বইতে মুখ গুঁজে পড়ে আছেন আচ্ছন্নের মত। তাঁর মাথা কাজ করছে কিনা তাও বোঝা যাচ্ছে না।
হঠাৎ কিছু একটা পড়ে তিনি নিজের ভাই বার্থেলোম্যুকে ডাকলেন। বললেন, তীরে নেমে টাইনোদের পান্ডাদের সঙ্গে কোনোভাবে যোগাযোগ করে তিনদিন পরে একটা মিটিঙের ব্যবস্থা করতেন। তিনি ওদের কিছু বলতে চান।
১৫০৪ খ্রিস্টাব্দ লিপইয়ার। ফেব্রুয়ারিতে এক দিন বেশি। সেই অতিরিক্ত দিনে, উনতিরিশ তারিখের বিকেলে একদল জ্যামাইকান টাইনোদের সামনে ক্রিস্টোফার বক্তৃতা দিলেন, তার কথা স্থানীয়দের বুঝিয়ে দিতে লাগল একজন যে অনেকদিন ধরে এদের সঙ্গে রয়েছে। ক্রিস্টোফার বললেন, এই যে টাইনোরা বহিরাগত শ্বেতাঙ্গ মানুষদের খাবারদাবার দিয়ে সহযোগিতা করছে না, এতে শ্বেতাঙ্গদের ঈশ্বর ভয়ানক কুপিত হয়েছেন। তিনি কলম্বাসকে বলেছেন, এরা যদি এই অব্যবস্থা জারি রাখে তবে তিনি এদের অভিশাপ দেবেন। ওদের ওপর নেমে আসবে ঈশ্বরের করাল গ্রাস।
শুনে ওরা অট্টহাস্য করে উঠল। বুজরুকি মারার আর জায়গা পাওনি!
কলম্বাস বলল, হাসছ তোমরা? আজ পূর্ণিমা, আকাশে গোটা চাঁদ উঠবে। সূর্যাস্তের মধ্যে তোমরা যদি খাবার না আনো, আমি ঈশ্বরকে বলছি আজ থেকে তোমাদের এই আকাশ থেকে চাঁদকে ভ্যানিশ করে দেবে।
আনপড় টাইনোরা আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে থাকল। কলম্বাস জাহাজে ফিরে গেলেন। খুলে বসলেন আবার অ্যালমানাকটা, তাতে ১৪৭৬ থেকে ১৫০৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আকাশে কী কী ঘটবে, তার বিবরণ লেখা। এইতো পরিষ্কার লেখা রয়েছে, ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে ফেব্রুয়ারি পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ এখান থেকে দেখতে পাওয়ার কথা। ছেচল্লিশ মিনিট থাকবে, তারপর আবার উজ্জ্বল চাঁদ ফিরে পাবে আকাশ। সূর্যাস্তের কিছুটা পরেই ঘটার কথা। উত্তেজনায় তার হৃদ্পিণ্ডের গতি দ্রুত হয়ে এল। বালুঘড়িটা উলটে দিলেন তিনি।
আকাশে চাঁদ উঠল এবং কিছুক্ষণ পরেই তাতে পড়ল পৃথিবীর কালো ছায়া। আস্তে আস্তে সেই ছায়া বাড়তে বাড়তে ঢেকে ফেলল গোটা চন্দ্রমা। পূর্ণ দীপ্তি নিয়ে উজ্জ্বল থাকে যে চাঁদ, সেটা যেন আবছা এক রক্তগোলক। ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল টাইনোদের মুখ। বাড়ির দিকে ছুটল তারা। দেবতা কুপিত হয়েছেন, এবার তাদের গ্রাস করে নেবেন। যে করেই হোক, ঈশ্বরের এই দূতদের খুশি করতেই হবে। বাড়ি থেকে নিয়ে এল তারা যাবতীয় খাদ্যদ্রব্য। থরে থরে সাজিয়ে দিতে লাগল জাহাজের সামনে। কলম্বাস আর তার ছেলে ফারনান্দোকে খুশি করতে দুজন বিবস্ত্রা তরুণীকেও পাঠিয়ে দিল কলম্বাসের ডেকে ফলমূল সঙ্গে দিয়ে।
কলম্বাস মৃদু হেসে তাদের হাত থেকে ফলের চুবড়িটা নিলেন। তিনি জানেন, আপাতত মেঘ কেটে গেছে। ছেলেকে বললেন, এদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসো। সেটাই ইওরোপিয় ভদ্রতা। আর ওদের বলে দাও, আমি ঈশ্বরকে বলে দিচ্ছি তিনি যেন খুশি হয়ে চাঁদকে ফেরৎ পাঠিয়ে দেন। আর কিছুক্ষণ পরেই পূর্ণিমার চাঁদ পেয়ে যাবে ওরা।
খাবারের জোগান ফিরে এল, কিন্তু দিয়েগো মেন্ডিজের দেখা পাওয়া গেল না। বহুদিন পরে একটা ছোট্ট জাহাজ এল, তাতে করে ওদের ফেরা অসম্ভব। ওভান্ডো চিঠি লিখে পাঠিয়েছে, ওর কাছে জাহাজ নেই। স্পেন থেকে জাহাজ এলে সেই জাহাজ এদের কাছে পাঠানো হবে। সেই জাহাজ এই চিঠি ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল।
আর মানে দিয়েগো মেন্ডিজ হিস্পানিওলা যেতে পেরেছে! পেরেছে যখন, সে নিশ্চয় ফিরবে। আশায় দুলে উঠল কলম্বাসদের বুক।
কিন্তু না, চলে গেল আরও কিছু মাস। পোরাস ভাইদের সঙ্গে কলম্বাস ভাইদের বিরোধ আবার চরমে উঠল। ক্রিস্টোফার তার ভাই বার্থেলোম্যুকে দায়িত্ব দিয়েছেন নিজের অসুস্থতার জন্যে সে যেন দল পরিচালনা করে। পোরাসরা বার্থেলোম্যুর আদেশ অমান্য করতে বার্থেলোম্যু রেগে গিয়ে বিরোধীদের সঙ্গে মারপিট শুরু করল। টাইনোদের চোখের সামনে তাদের দেবদূতরা শুরু করল মর্চে-পড়া তরোয়ালের লড়াই। খুব বেশিক্ষণ চলল না অবশ্য। বার্থেলোম্যুর হোঁৎকা চেহারা, তিনি ফ্রান্সিস্কো দ্য পোরাসকে ধরে হাতদুটো বেঁধে বাকিদের বললেন, একে এক্ষুনি জলে ফেলে দেব মুণ্ডুটা কেটে যদি তোরা লড়াই না থামাস। ওদের নেতার এই দশা দেখে বাকিরা ভয়ে তার অধীনতা স্বীকার করে নিল।
জ্যামাইকাতে আটকে পড়ার এক বছরেরও পর শেষমেষ উদ্ধারকারী জাহাজ এল, ১৩ই অগাস্টে। সেখান থেকে হিস্পানিওলা হয়ে স্পেনে যখন পৌঁছালেন ক্রিস্টোফার, নভেম্বরের ৭ তারিখে, তার মধ্যে তাঁকে আরও প্রবল সামুদ্রিক ঝড়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে। রিয়্যাকটিভ আর্থ্রাইটিসের সমস্যায় তিনি পুরোপুরি কাবু।
কিন্তু তিনি বসে থাকতে চান না। ক্রিস্টোফারের ওপর যে অবিচার হয়েছে, তা থেকে মুক্তি চাই। রানির সঙ্গে লিখিত চুক্তি হয়েছিল, নতুন পৃথিবী থেকে যা লাভ হবে, তার দশ শতাংশ কলম্বাসের। নিজের ছেলের জন্যে তাকে এখন এসব দাবি করতে আবার যেতে হবে রানি ইসাবেলার দরবারে।
কিন্তু ঐ যে বলে, যখন বৃষ্টি আসে, ঝেঁপেই আসে। হোয়েন ইট রেইনস, ইট পোরস। রানির সঙ্গে দেখা করা হল না ক্রিস্টোফারের। তাঁর ফেরার মাত্র কয়েকদিন পরেই না-ফেরার দেশে চলে গেলেন রানি ইসাবেলা।
রাজা ফার্দিনান্দ কলম্বাসের কথায় বিশেষ কর্ণপাত করলেন না। যাকে গভর্নর পদ থেকে পদচ্যুত করা হয়েছে, তার আবেদনের আর মূল্য কী! ভগ্নহৃদয় কলম্বাস নিজেকে সরিয়ে নিলেন সমাজ-সংসার থেকে। এর পর মাত্রই বছর দেড়েক বেঁচে ছিলেন, নির্জনে লিখছিলেন ক্যাথলিক খ্রিস্টানধর্মের প্রতি তাঁর আনুগত্যের মর্মকথা – দ্য বুক অভ প্রফেসিস। ১৫০৬ খ্রিস্টাব্দের ২০শে মে কাস্তিলের ভ্যালাদোলিদে – সেই যেখানকার আইনসভায় বিয়ে হয়েছিল সপ্তদশী ইসাবেলার সঙ্গে ফার্দিনান্দের – মারা গেলেন ক্রিস্টোফার কলম্বাস। মাত্র ছাপ্পান্ন বছর বয়সে।
মারা যাবার সময়ও কলম্বাসের বিশ্বাস ছিল, তিনি ইন্ডিজ তথা ভারতে যাওয়ার পশ্চিমের জলপথ আবিষ্কার করেছেন। কলম্বাসের এই দাবি ভিত্তিহীন, বললেন তাঁরই স্বদেশীয় আমেরিগো ভেসপুচি। আমেরিগোর মতে কলম্বাস যে জায়গাটা আবিষ্কার করেছেন, তা ইওরোপ-আফ্রিকা ও ভারত-চীনের মধ্যে যে সমুদ্র, তার মধ্যের এক সম্পূর্ণ অন্য স্থলভূমি।
কলম্বাসই প্রথম সেই স্থলভূমির খোঁজ দিয়েছিলেন বিশ্ববাসীকে। তবু নিয়তির আর এক পরিহাসের মতই সেই স্থলভাগের নাম আমেরিগো ভেসপুচির নামে পরিচিত হল আমেরিকা নামে।
* * *
কৃষিবিপ্লব সম্ভব হয়েছে পশুপালনের জন্যেও। গৃহপালিত পশুদের উপযোগিতা অসীম। ঘোড়া দিয়ে লাঙল টানানো যায়; গবাদি পশু ও ভেড়া থেকে পাওয়া যায় মাংস, চামড়া, উল; শুয়োর থেকেও আসে মাংস ও চামড়া; খচ্চরে গাড়ি টানে; গরু থেকে পাওয়া যায় দুধ, মাখন, চিজ। গরু-ঘোড়া-শুয়োর-ছাগল-ভেড়া এই পাঁচ গৃহপালিত পশু দিয়ে ভর্তি তখন ইওরোপের সমস্ত খামার ও মাঠ।
উত্তর-দক্ষিণ মিলিয়ে আমেরিকাতেও তখন প্রায় দশ কোটি স্থানীয় মানুষ। মেসো-আমেরিকা জনাকীর্ণ ভূখণ্ডই শুধু হয়, এর সভ্যতাগুলোও তাৎপর্যপূর্ণ। আটলান্টিক উপকূল ধরে ছোট ছোট অগণিত গ্রাম এবং মাঠ। আন্দিজ পর্বতমালার শিখরে রাজত্ব করছেন দেবতাদের মত পরাক্রমী রাজন্যবর্গ। অ্যামাজন মিসিসিপির মত অজস্র বিশাল বিশাল নদী, তাদের দুই তীরে তৈরি হয়েছে অজস্র শহর, তাতে অসামান্য স্থাপত্য-সম্বলিত ভবন। প্রাচীন সেই দুনিয়ায় তখন বাস করছে শিকারী মানুষ, ফলমূল খেয়ে বেঁচে থাকা সংগ্রহকারী মানুষ, মৎস্য-শিকারী মানুষ, চাষি, রাজা ও তার যোদ্ধার দল, ক্রীতদাস। মিসিসিপি নদীর অববাহিকায় বিভিন্ন জ্যামিতিক আকারের নগর পত্তন করেছে তারা। দেখলে মনে হবে যেন প্রাকৃতিক কিন্তু আসলে মানুষের তৈরি সেই সব নগর। তারা চাষ করে এক বিশেষ ধরনের শস্য, বাইরের পৃথিবীতে কেউ তার হদিশ পায়নি তখনও। তার নাম ভুট্টা। এ এক অবাক পৃথিবী! প্রায় ছয় হাজার বছর ধরে ধাপে ধাপে ভুট্টার প্রজাতির উন্নতিসাধন করেছে তারা। শুরুতে যা ছিল রোগা ঘাসের মত টিংটিঙে এক বীরুৎ, যাতে সরু সরু বীজের মত ফলত কয়েকটা ভুট্টার দানা, সেই বস্তুটার ক্রমাগত সঙ্করায়নে তৈরি করেছে তারা মোটা মোটা ভুট্টার ফল – নিঃসন্দেহে নিঃশব্দ জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে। আর শুধু তাই নয়, আন্দিজের পাহাড়েও তারা ফলাতে পারে এই ভুট্টা।
দক্ষিণ আমেরিকার বিশাল উপকূল ধরে ইনকা সাম্রাজ্য। পাহাড়ের ওপর প্রত্যন্ত অঞ্চলে তারা বানিয়েছে অনুপম প্রাসাদ, শস্য সংগ্রহশালা, দুর্গ। সেখানে ষাট লক্ষেরও বেশি মানুষের বাস। তাদের কোনো গৃহপালিত পশু নেই, তারা চাকার ব্যবহারও শেখেনি। মানুষের কাঁধে চেপে পাহাড়ে উঠেছে বিশাল বিশাল পাথরের চাঁই সেইসব প্রাসাদ নির্মাণের জন্যে। আর এই কাজে মানুষকে খাদ্য হিসাবে শক্তি জুগিয়েছে যে বস্তুটা, সেটার অস্তিত্ব সম্বন্ধেও বাইরের পৃথিবী অজ্ঞ। তার নাম আলু। আট হাজার বছর আগে দক্ষিণ আমেরিকার যে অঞ্চলটা পরবর্তীতে পেরু আর বলিভিয়া নামে পরিচিত হবে, সেখানকার স্থানীয় মানুষরা প্রথম শিখেছে আলুর চাষ। অন্তত এক হাজার প্রজাতির আলু চাষ করে তারা। তার কিছু কিছু বিষাক্ত, কিছু আবার মাংসাশী উদ্ভিদও। আর শুধু চাষই নয়, তারা জানে আলুর সংরক্ষণ ব্যবস্থাও। জমিতে খড়ের মত শস্যের শুকনো অংশ বিছিয়ে তার ওপর ছড়িয়ে দেয় আলু। সেই আলুর ওপর দাঁড়িয়ে নেচে নেচে পা দিয়ে আলু চটকে তার রস নিংড়ে আলুকে শুকনো ছিবড়ে করে রোদে শুকিয়ে নেয় তারা। এইভাবে রাখলে আলু খাদ্যোপযোগী থাকে প্রায় দশ বছর। কোনো বছর কোনো কারণে ফসল না ফললে যাতে না খেয়ে মারা না যেতে হয়। পাহাড়ের ঢালু জায়গায় ধাপ বানিয়ে তার ওপর আলু চাষ করে তারা, পাহাড়ের মাথাতেও আলু ফলাতে পারে। আর এই সমস্তই করে শুধুমাত্র নিজস্ব পেশিশক্তি ব্যবহার করে বড়জোর কাঠের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে।
ভুট্টা আর আলু – এই হচ্ছে আমেরিকার তখনকার মূল কৃষিজ ফসল। গৃহপালিত পশু নেই বললেই চলে। ইনকা সাম্রাজ্যের চাষিরা অবশ্য পালন করত লামা। লামা বড়সড় জন্তু, মাংসের পক্ষে আদর্শ। তাদের বর্জ্য কৃষিতেও কাজে লাগে, চামড়া দিয়ে শীতবস্ত্র বানানো যায়। তবে এরা জমি চাষের পক্ষে সুবিধের না, দুধ দেয় না, মাল পরিবহনেও অকেজো। এদের উল অবশ্য খুব কাজের। ভেড়ার তুলনায় বেশি গরম আর হালকা। অ্যাজটেকরা টার্কি পালন করত। তা থেকে মাংস পাওয়া যেত ভালই। অন্যান্য পশু যা ছিল, তাদের গৃহপালিত করা তেমন সম্ভব ছিল না।
আমেরিকার সেই স্থানীয় মানুষরা দেখে শিখেছিল যে বাজ পড়ে ঘাসে আগুন লেগে গেলে সেই ঘাস পরে আরও ঘন হয়ে জন্মায়। তাই দেখে ওরা নিজেরাই প্রেইরি অঞ্চলের ঘাসে নিজেরাই আগুন ধরিয়ে দিত। এর ফলে সেখানে পরে ঘাসের ঘন জঙ্গল তৈরি হত। এ ছাড়াও এর আর একটা মস্ত সুবিধে ছিল এই যে, ঘাসের জঙ্গলে আগুন লেগে তা দূরের বনে ছড়িয়ে গেলে বন ছেড়ে তৃণভোজী ও তাদের যারা খাদক সেই মাংসাশী প্রাণীরা বেরিয়ে আসত ফাঁকা মাঠে। তখন তাদের শিকার করা সহজ হত। এইভাবে শিকার করা হত বাইসন। বাইসনের মাংস সুস্বাদু, আর এর চামড়া দিয়ে পোশাক বানানো যায়, হাড় দিয়ে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। এভাবে শিকার করা সত্ত্বেও বাইসনের সংখ্যা কম ছিল না। প্রধানত উত্তরে ঘনসন্নিবিষ্ট বাইসন আগুনের তাড়া খেয়ে দক্ষিণে নামতে নামতে পুরো আমেরিকাতেই ছেয়ে ফেলে। কলম্বাসের অভিযানের সময় কোটি তিনেক বাইসন ছিল আমেরিকায়।
স্থানীয় মানুষদের পশু শিকার করার জন্যে না ছিল বন্দুক, না ঘোড়া। তারা দল বেঁধে ছুটে ছুটে শিকার করত। নিজেকে লুকিয়ে রাখার জন্যে গায়ে পরে নিত পশুচর্মের পোশাক। তাদের অস্ত্র মানে তির-ধনুক। সেই তির তৈরি হত পশুদের হাড় দিয়ে, কাঠ দিয়ে, পাথর দিয়ে। বাইসন শিকার করা ছাড়া উপায় কী!
ইওরোপে তখন শিকার করা বস্তুটা প্রেস্টিজের ব্যাপার। কেবলমাত্র নোবলম্যান আর রাজা-রাজড়াই শিকার করতে পারত। চাষাভুষো লোক শিকার করলেই তাদের বিরুদ্ধে বে-আইনি পশুহত্যার শমন ধরিয়ে দেওয়া হত। আর শিকার করার মত বন্যপশুর সংখ্যাও অঢেল ছিল না।
কলম্বাসের সময়কার ইওরোপ মানুষের তৈরি জনপদে পরিণত হয়ে গেছিল। কৃষিকাজ ও নগরায়নের ফলে অরণ্য ধ্বংস হয়ে পশুরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। সমস্ত ভূখণ্ডই মানুষের অধিকারে। এক সময় জলে মাছ ছিল অপ্রতুল। খ্রিস্টধর্মে মৎস্যভোজনে বাধানিষেধ নেই, যত খুশি খেতে পার, পশুমাংস বছরে একশো দিনের বেশি খাওয়া গর্হিত। ব্যাপক কৃষিকাজ ও নগর পত্তনের ফলে অবশ্য ভূমিক্ষয় বিশাল আকার ধারণ করলে নদী ও জলাশয়গুলোতে তার ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে লাগল। একসময় যে স্যামন মাছ নদীতে জাল ফেললেই পাওয়া যেত, তা পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠল। নদীতে বাঁধ দেওয়ার ফলেও জলজ ইকো-সিস্টেম ব্যহত হয়ে পড়ল। বাধ্য হয়ে ইওরোপিয়ানরা তাদের দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সমুদ্রে। সমুদ্র রত্নাকর, সেখানে ভূরি ভূরি মাছ। কড আর হেরিং-এ ভর্তি। শুরু হলে সমুদ্রগর্ভ থেকে মাছ তুলে নেওয়ার প্রতিযোগিতা। সেই মাছ শুকিয়ে বাণিজ্যের জন্যে চলে যেত উত্তরে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোতে, ইংল্যান্ডেও। শুঁটকি রপ্তানি হয়ে উঠল এক একটা দেশের বড় অংশের আয়ের প্রকরণ।
মানুষ যেখানেই হাত দেয় ব্যবসা বাণিজ্য করে আয় ও মুনাফার লোভে, সেখানেই ধ্বংসের বীজ বপন করে। মাছেদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যহত হল, প্রজাতির সুরক্ষার্থে স্বাভাবিক সময়ের আগেই মাছেদের ডিম পাড়া শুরু হল, নোংরা জল ছেড়ে তারা চলে যেতে লাগল সুরক্ষিত স্থানের খোঁজে, কিছু কিছু প্রজাতি বিনষ্টও হয়ে গেল। ইওরোপের সমুদ্রেও এক সময় মাছ অপ্রতুল হয়ে পড়ল।
কলম্বাসের আমেরিকার জলাশয়গুলিতে কাচের মত স্বচ্ছ জলে খেলে বেড়ায় কোটি কোটি মাছ। এখানকার স্থানীয় মানুষরা জাল ফেলে তুলে নেয় যতটুকু তাদের প্রয়োজন। তারা জলশক্তির ব্যবহার জানে না, জানে জলপথে পাড়ি দিতে। অজস্র বড় বড় নদীপথে সেই মাছ চলে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। আন্দিজের পাহাড়ের মাথায় যারা বাস করে, তারাও নিয়মিত জোগান পেয়ে যায় প্রশান্ত মহাসাগরের কূলে ধরা মাছের। মধ্যবর্তী স্থলভূমিতে থাকে যারা, তারাও পায় আটলান্টিক উপকূলের মাছ। জলে শুধু মাছ নয়, খেলা করে বড় বড় তিমি আর ডলফিনও।
কলম্বাসের সময় আমাজন অববাহিকা জনমানবপূর্ণ। হাজার হাজার মানুষের বাস সেই অরণ্যসঙ্কুল প্রাকৃতিক পরিবেশে। প্রকৃতির সঙ্গে তারা একাত্ম। ওর মধ্যেই তারা তৈরি করে রকমারি ফলের বাগান – পেঁপে, আম, কোকো, নাটস। তারা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। তাদের মধ্যে বহু রকমের সামাজিক আচার। প্রায় পঞ্চাশ হাজার বর্গমাইল জুড়ে বিশাল এলাকা তারা জুড়ে ফেলেছে সেতু, নালা ও সর্পিল সরণী দিয়ে। নদীর জল তীর ভাসিয়ে তৈরি করে প্রাকৃতিক ঘাসের জমি – সাভানা। এরা সেগুলোতে আগুন ধরিয়ে তার রকম বদলে দেয়, তৈরি হয় বিস্তৃত ঘাসের মাঠ। তার ওপর জন্মায় এমন সব নতুন নতুন গাছপালা যারা আগুনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।
উত্তরে মেক্সিকোয় সভ্যতা তৈরি হয়েছে, বিনষ্টও হয়েছে। চকো ক্যানিয়নের অ্যানাসাজি গোষ্ঠি থাইম আর জুনিপারে ঢাকা বিস্তৃত বনভূমির মধ্যে তাদের বসতি স্থাপন করেছিল। তাদের স্থাপত্য দর্শনীয়। তারা নির্মাণ করেছিল ছশো ঘরওয়ালা বহুতল ভবন, সেখানে বাস করত কয়েক হাজার মানুষ। এই বহুতল ভবন পাথরে তৈরি, কোনো পশু সেই পাথর বহন করে ওপরে তুলে দেয়নি। পুরোটাই সেই মানুষদের কীর্তি।
ইওরোপে অরণ্য কমে আসছিল। বনের গাছপালা বিনষ্ট করে তার কাঠ দিয়ে তৈরি হচ্ছিল নগর। সুরম্য ভবন প্রস্তুতিতে দরকার হয় প্রচুর প্রচুর কাঠ। পরিবহনের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয় কাষ্ঠনির্মিত যান। ব্যবসা ও নদী পরিবহনের জন্যে তৈরি হতে লাগল বড় বড় জাহাজ, তাদের মাস্তুলের জন্যে স্প্রুস, তক্তার জন্যে লার্চ, ক্যাপস্টানের জন্যে এল্ম, কাঠামোর জন্যে ওক গাছ ভূপতিত হতে লাগল একের পর এক। ছাপাখানার মেশিন আবিষ্কার হয়ে গেছিল, কাগজে ছাপা হচ্ছিল বই, বিশেষত বাইবেল। কাগজের জন্যে চাই কাঠ। ধর্ম সংস্থাপনের পবিত্র উদ্দেশ্যে জবাই হতে লাগল বৃক্ষরাজি।
এই প্রেক্ষিতে কলম্বাসের পশ্চিমমুখী যাত্রা। সঙ্গে সাতাশিটা লোক। অশিক্ষিত, খুনি, কয়েদি, শুয়োরপালক সাধারণ মানুষ, কেউ যোদ্ধা, জোর করে তাদের জাহাজে চাপানো। এরা আবিষ্কার করল এক স্বর্গ। পেয়ে গেল জয় করার জন্যে নতুন ভূখণ্ড, স্বধর্মে পরিণত করার জন্যে নতুন মানুষ, বরবাদ করার জন্যে নতুন ধনদৌলত। প্রথম যাত্রার পর ‘ইন্ডিজ-সংক্রান্ত’ কলম্বাসের যে চিঠি রানির হাতে পড়ল, তা গোপন থাকল না। তার কপি ছাপা হতে লাগল একের পর এক ছাপাখানায়, তা পরিণত হল গোটা ইওরোপের সর্বালোচিত নথি হিসাবে। নতুন দেশ, নতুন ঐশ্বর্য সেখানে। সবাই উৎসাহী, তারাও চেখে দেখতে চায় সেই অমৃত। ব্যবসায়ী থেকে পুণ্যলোভী, সবার মনে একই কামনা।
সতেরটা জাহাজে পনেরশো মানুষ নিয়ে কলম্বাসের দ্বিতীয় অভিযান। সেই অতি-উৎসাহী মানুষেরা ও তাদের পরবর্তী অনুসরণকারীরা ক্রমে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ল বিভিন্ন জায়গায়। নতুন মানুষের পদতলে পিষ্ট হতে লাগল আমেরিকার ঘাসজমি, বনজঙ্গল, পাহাড়পর্বত, নদীনালা। লোভ গ্রাস করে নিল সমস্ত ঐশ্বর্য। এল নতুন অস্ত্র। আমেরিকাতে একটাও ঘোড়া ছিল না, ইওরোপিয়রা নিয়ে এল তেজি অশ্ব। ঘোড়সওয়ার দ্রুতগামী শ্বেতাঙ্গরা দ্রুত ভস্মীভূত করে দিল বহু হাজার বছরের মনুষ্যসভ্যতা। মাত্র চল্লিশ বছরে আন্দিজ পর্বতের সানুদেশের ইনকা থেকে মধ্য আমেরিকার অ্যাজটেক – সব ধ্বংস হয়ে গেল। কালো স্থানীয় মানুষদের শহর, নগর, বাসভূমি সব চলে গেল লোভী মানুষদের করাল গ্রাসে। জঙ্গল দখল করে নিল মনুষ্যসভ্যতা।
ইওরোপিয় ঘোড়া বংশবিস্তার করল আমেরিকার ঘাস খেয়ে। তারা হয়ে উঠল আরও বলবান, আরও তেজি। যে বিস্তৃত ভূমিতে একটাও ঘোড়া ছিল না, পরের তিনশো বছরে তারা সমগ্র মধ্য আমেরিকা ও রকি পর্বত ছেয়ে ফেলল। উনবিংশ শতাব্দীর আগেই তারা পৌঁছে গেল ক্যানাডায়। দেড়শো বছর পরে সত্তর লক্ষ বুনো ঘোড়ায় ভরে গেল আমেরিকা। যাযাবর মানুষদের কাছে ঘোড়া এক অন্যতম সম্পদ। মানুষদের জীবননযাত্রা বদলে দিতে ঘোড়ার ভূমিকা প্রচুর।
এল শুয়োর। এ এক এমন পশু, যাদের পালন করতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না। এরা ঘাসপাতা সব খায় আর তীব্রভাবে বংশবিস্তার করে। এক একটা মাদি শুয়োরের এক একবারে দশ দশটা বাচ্চা হয়। অভিযাত্রীদের কাছে শুয়োর হচ্ছে জীবনধারণের সবচেয়ে সহজ উপায়। শুয়োর নিজের মত বেড়ে ওঠে, বাচ্চা দেয়। মানুষের কাজ হচ্ছে শুয়োর ধরে কেটে খেয়ে নেওয়া। এদিকে স্থানীয় মানুষদের নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম। তাদের ভুট্টাক্ষেতে তারা বেড়া দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেনি কোনোদিন। ফাঁকা মাঠ, সেখানে ভুট্টাচাষ করে তারা, মানুষ ছাড়া সে ভুট্টা খায় না কেউ। ইওরোপিয়ান শুয়োরের পাল ঢুকে পড়ল আমেরিকান ভুট্টাক্ষেতে, ছারখার করে দিল পুরো ক্ষেতের ফসল। শুধু ভুট্টা তো নয়, তার গাছ, তার বীজ, তার চারা, সব। আর শুধু তাই নয়। এই রকম পুষ্টিকর খাদ্য তারা নিজের দেশে খায়নি। আমেরিকান ভুট্টা খেয়ে ইওরোপিয়ান শুয়োর গায়ে গতরে বাড়তে লাগল তেজে, খামারের শান্তশিষ্ট ভোলেভালা শুয়োর মাত্র কয়েক প্রজন্ম পরেই পরিণত হল তেজী বন্য বরাহে। হাতির মত তাদের দাঁত গজালো, তারা হয়ে উঠল হিংস্র।
দ্বিতীয় অভিযানে কলম্বাস মাত্র আটখানা শুয়োর সঙ্গে এনেছিলেন। মাত্র কুড়ি বছর পরে কেবলমাত্র কিউবা দ্বীপেই দেখা গেল তিরিশ হাজারের বেশি শুয়োরের। তারা ছেয়ে ফেলল আন্দিজ অ্যামাজন উত্তর আমেরিকা। অভিযাত্রী দলের সঙ্গে প্রায় লুকিয়ে আনা পশু শুয়োর আর ঘোড়া পাল্লা দিয়ে বংশবিস্তার করতে লাগল বিদেশী আবহাওয়ায়।
তবে এরা নয়, সর্বনাশ ডেকে আনল যে সমস্ত প্রাণীদের খালি চোখে দেখা যায় না, তারা। বিদেশিরা যেই দেশিদের সংস্পর্শে এল, তাদের সামান্য স্পর্শেই পরস্পরের শরীরে হস্তান্তরিত হল শরীরবাহিত জীবাণুর। ইওরোপিয়রা যেসব জীবাণুতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, যাদের প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তাদের শরীরে বিদ্যমান, তা এই হতভাগ্য আমেরিকান স্থানীয়দের নেই। ফলে দুই দলের খুব অল্প সময়ের মিশ্রণেই তাদের শরীরে বিচিত্র উপসর্গ দেখা যেতে লাগল। একের পর এক স্থানীয় মানুষের শরীর জুড়ে গোটা গোটা জলভরা গুটি গজিয়ে উঠল রাতারাতি, সঙ্গে তীব্র জ্বর। গুটিবসন্ত! গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যেতে লাগল সেই মড়কে। এক জায়গায় মড়ক লাগলে তার তীব্রতা পৌঁছে যেতে লাগল অন্যান্য জনপদেও। তারা বুঝতেও পারল না কী অসম শত্রুর সঙ্গে তাদের যুদ্ধ চলছে, যাকে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, যার স্পর্শ মানেই মৃত্যু। জীবাণু ছড়িয়ে যায় অতি দ্রুত। শুধু গুটিবসন্ত নয়, হাম আর ইনফ্লুয়েঞ্জার মত আপাত-নিরীহ রোগের মহামারীতেও মৃত্যুবরণ করতে লাগল হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ স্থানীয় মানুষ।
কলম্বাসের আমেরিকা পদার্পণের মাত্র ৫০ বছরের মধ্যেই আমেরিকার স্থানীয় মানুষদের – যাদের সংখ্যা ছিল প্রায় দশ কোটি, তার – নব্বই শতাংশ ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে। প্রকৃতি দখল করে নিল মনুষ্যবসতি। যেসব জায়গা মানুষের কার্যকলাপে মুখরিত থাকত, সেখানে গাছপালা গজিয়ে গেল।
স্বর্গে অনুপ্রবেশ ঘটেই চলল ইওরোপ থেকে। পরের দিকে যারা এল, তারা দেখল, এই নতুন মহাদেশ তাদের জন্যে অপেক্ষা করেই আছে, গিয়ে বসে পড়লেই হল। বাধা দেওয়ার কেউ নেই। অনুপম সৌন্দর্যে ভরপুর এক নতুন বিশ্ব, যেখানে হাজার রকমের পাখপাখালি, গাছপালা, মৎস্য ও জলচর প্রাণী, অরণ্যের আদিম স্তব্ধতা।
তার আগে অবশ্য তার কিছু কিছু নমুনা পাঠানো শুরু হয়ে গেছে স্পেনে। চলে গেছে ভুট্টা, কাঁচালঙ্কা, কুমড়ো, টমেটো, আলু। কয়েক বছরের মধ্যেই স্পেন থেকে আলু চলে গেল ইতালি, উত্তর ও পূর্ব ইওরোপের দেশগুলিতে। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অস্ট্রিয়া, হল্যান্ড, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, জার্মানিতে আলুর প্রবল জনপ্রিয়তা দেখা দিল। আলুকে সবচেয়ে বেশি করে আঁকড়ে ধরল আইরিশরা। গৃহযুদ্ধে কাবু আয়ারল্যান্ডে খাদ্যসমস্যা প্রচণ্ড। আলু পেয়ে তাদের তো পোয়াবারো। মাটির নীচে গজায় বলে ঠান্ডাতেও কাবু হয় না আলু। একশো বছরের মধ্যে আলু খেয়ে আয়ারল্যান্ডের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেল। সপ্তদশ শতাব্দী জুড়ে পুরো ইওরোপ জুড়ে দেখা গেল অভাবনীয় জনসংখ্যার স্ফীতি।
কলম্বাস চেয়েছিলেন ধনরত্ন আহরণের বদলে অভিযাত্রীরা যেন স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে ভালভাবে মিশে যায়। ওদেশীয় তরুণীদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। বিয়ের বদলে তাদের ক্রীতদাসী হিসাবে নিয়োগ ও অবাধ যৌনাচারই প্রাধান্য পেয়েছিল অবশ্য, যতদিনে না তারা জীবাণুবাহিত রোগে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। বদলে ইওরোপিয়ানরাও পেল এক অযাচিত উপহার। ফ্রেঞ্চ পক্স বা স্প্যানিশ সিকনেস নামে পরিচিত এই বেদনাদায়ক রোগটার ডাক্তারি নাম সিফিলিস। ইওরোপের পতিতালয়গুলো ভরে গেল আমেরিকা থেকে আগত এই রোগের প্রকোপে।
তবে এ তো কিছুই না। ইওরোপের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন দেশের মানুষের ভিড় বাড়তে লাগল আমেরিকায়। সপ্তদশ শতাব্দীতে পরাক্রমী স্পেন পরাজিত হল ইংল্যান্ডের কাছে। ইংরেজ অভিযাত্রীরা বসে থাকার পাত্র নয়, তারা সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপন করল ভার্জিনিয়ায়। তৈরি হল নিউ ইংল্যান্ড। শুরু হয়ে গেল ব্রিটিশ ট্রেডিং কোম্পানির যাতায়াত।
নিজের দেশে যা করেছে, এদেশেও সেই একই ধ্বংসলীলা চালাতে লাগল তারা। লক্ষ লক্ষ টন নদীর মাছ আমেরিকার জলাশয় থেকে তুলে সরবরাহ হতে লাগল জাহাজে ভরে ইওরোপে। লোভী বণিকরা এক একটা জাহাজে এত মাছ তুলে দেশে পাঠাতে লাগল যে ভুলে গেল জাহাজের সুরক্ষার কথা, কিছু কিছু জাহাজ ওতে ভরা মাছের ওজনেই ডুবে গেল মাঝদরিয়ায়। একই রকম ভাবে আমেরিকার বন কেটে স্থাপন করল বসতি। ঠান্ডার দেশ, গাছের কাঠ জ্বালিয়ে সেই ঘর গরম করা হতে লাগল। ইওরোপের মতই আমেরিকার অরণ্যানীও অবিলম্বে পড়ে গেল ধ্বংসের মুখে।
এর পর এল ইওরোপীয় নারীরা। তদের গর্ভে আমেরিকায় জন্মালো ইওরোপীয় জাতক-জাতিকা। কয়েক প্রজন্ম পরে তাদের আর আলাদা করা গেল না, তারা হয়ে গেল আমেরিকার অধিবাসী। স্থানীয় মানুষদের সংখ্যা হ্রাস পেতে পেতে নগণ্য হতে শুরু করায় শ্রমিকের কাজ করার জন্যে আফ্রিকা থেকে শত শত জাহাজ বোঝাই করে আনা হতে লাগল ক্রীতদাস। কয়েক বছরেই কোটিখানেক আফ্রিকান ক্রীতদাস কাজ করতে লাগল আমেরিকার জমিতে।
এল ইওরোপীয় প্রাণী ও উদ্ভিদ। গরু-ছাগল-মুরগি। এল ইওরোপিয় শস্য – গম, ওট, যব, রাই। ভুট্টা ও আলুর পাশাপাশি চাষ হতে লাগল এদের। এদের সঙ্গে এল আগাছাও। সারা আমেরিকা ভরে গেল ইওরোপিয় আগাছায়। স্থানীয় প্রাণী ও উদ্ভিদের সে সাম্যাবস্থা ছিল, তা বদলে গেল অতি দ্রুত। যেখানে এক সময় চরে বেড়াত বন্য বাইসন, সেখানে চরতে লাগল ইওরোপ থেকে আনা পোষ্য গরু-ছাগল-শুয়োর-ভেড়ার দল। তারা খেতে লাগল আমেরিকার ঘাস পাতা, বাড়তে লাগল হু হু করে। এল ইওরোপিয় পতঙ্গও। প্রতি পনের মাসে গবাদি পশুর সংখ্যা দ্বিগুণ হতে পাগল।
এক সময় যে ভূমিতে সুরম্য প্রাসাদের বসতি স্থাপন করেছিল ইনকা-অ্যাজটেক সভ্যতার মানুষরা, নিজেদের পিঠে বয়ে নিয়ে যেত পাথরের চাঁই, সেখানে ঘোড়া-গাধা-ক্রীতদাস ও মেশিন দিয়ে সুরক্ষিত দুর্গ বানানো হতে লাগল। স্থানীয় গাছগাছালি পরিবর্তিত হয়ে ইওরোপিয় গাছগাছালিতে পূর্ণ হতে লাগল আমেরিকার জনস্থান। প্রেইরির স্বাভাবিক তৃণভূমির জায়গায় এল ইওরোপিয় গবাদি পশু চরানোর মাঠ। তাদের মাংসে উদরপূর্তি করতে লাগল ইওরোপিয় উপনিবেশকরা। অপ্রতুল ঘাস পেয়ে দ্রুত বাড়ে গবাদি পশুরা, তাদের মাংস অতি সহজলভ্য আমেরিকায়। অঢেল খাবার তাই এই নতুন পৃথিবীতে।
গবাদি পশুর সঙ্গে এল ইওরোপিয় ফলের চারাও। নাসপাতি, জলপাই, কলা, পিচ, প্লাম, ফিগ, আপেল লাগানো হল আমেরিকার জমিতে। এসব গাছ এখানে একটাও ছিল না, অবিলম্বে তাদের সংখ্যা বাড়তে লাগল পশুদের মতই। মধুর জন্যে আনা হল ইওরোপিয় মৌমাছিও। আমেরিকার মৌমাছি কেবলমাত্র পরাগমিলন করত স্থানীয় উদ্ভিদদের মধ্যেই, দেখা গেল যোদ্ধা লোভী ইওরোপিয়দের মত ওদের দেশের মৌমাছিরাও সমস্ত ফুলের মধু খেতে উদগ্রীব। তৈরি হল ফল ও সবজির কৃত্রিম উদ্যান ও বনভূমি। শুরু হল এক অভূতপূর্ব বায়োলজিক্যাল ইম্পিরিয়ালিজম।
আমেরিকার আরও কিছু কিছু জন্তু ও উদ্ভিদও এল ইওরোপে। মুলোর মত দেখতে এক ধরনের টিউবার পাওয়া গেল, খেতে অখাদ্য এবং খেলেই পেটে গ্যাস হয়, কিন্তু বাড়ে অতি দ্রুত এবং গরীব-গুর্বোদের খাইয়ে দেওয়া যায় বলে ইওরোপে তার ব্যাপক চাষ হতে লাগল। এল টার্কি, এবং তৎসংক্রান্ত উৎসবাদিও। নোবলম্যানদের জন্যে আমেরিকা থেকে এল বিলাসী খাবার – চিনি ও সিগার। ইওরোপের বন আগেই ধ্বংসের মুখে পড়েছিল। আরও গাছ কেটে সেখানে চাষ করা হতে লাগল আখ ও তামাকের। আমেরিকার প্রান্তরে এসব চাষের জন্যে লাগানো হল আফ্রিকা থেকে ফেরি করে আনা লক্ষ লক্ষ ক্রীতদাসদের।
স্থানীয় প্রায় সমস্ত মানুষ প্রাণ দিল এই আঘাতে। প্রাণী ও উদ্ভিদের রকম-সকম বদল হতে হতে এক সময় স্থিতাবস্থা প্রতিষ্ঠিত হল, যখন মনে হতে লাগল, হয়ত এটাই আমেরিকা, এই রকমই ছিল সবসময়ই, এটাই স্বাভাবিক। ১৮০০ সালের মধ্যেই এই মেটামরফোসিস সম্পূর্ণ হয়ে গেল।
মাত্র তিনশো বছরে দু দুটো গোটা মহাদেশের ভূগোল সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে গেল। তার প্রভাবে বদলে গেল গোটা দুনিয়ার ইতিহাস। ক্রিস্টোফার কলম্বাস, তার দু চোখের স্বপ্ন আর মাত্র তিনখানা জাহাজ – নিনা, পিন্টা এবং সান্টা মারিয়া – পালটে দিল পুরো পৃথিবীটা।