|| সাত ||
নবদ্বীপে আসছেন দিগগজ পণ্ডিত কেশব কাশ্মীরী। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে তাঁর জ্ঞানের জয়ধ্বজা উড়িয়ে এসেছেন। রাজায় রাজায় যেমন যুদ্ধ হয়, জয়ী হন একজন, অন্যজন পরাজিত, পরাজিত রাজা জয়ী রাজার বশ্যতা স্বীকার করে তাঁকে কর দিতে রাজি হন, পণ্ডিতদের ক্ষেত্রেও বিধান একই। পণ্ডিতে পণ্ডিতে তর্কযুদ্ধ হয়। একজন রাজা অন্য রাজ্য আক্রমণ করলে দ্বিতীয় রাজার যেমন যুদ্ধ করা অথবা পরাজয় স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া অন্য কোন পথ নেই, তর্কযুদ্ধেও তাই। একজন পণ্ডিত অন্য কাউকে তর্কযুদ্ধে আহ্বান করলে দ্বিতীয়জনকে তা স্বীকার করে তর্কে নামতেই হবে, হেরে গেলে মেনে নিতে হবে আহ্বায়ক অধিকতর জ্ঞানী। কখনও কখনও দুই যুযুধান পক্ষের তর্কের মীমাংসা করার জন্য একজন তৃতীয় পক্ষকেও নিয়োগ করা হয়, সাধারণভাবে একজন নৈয়ায়িক পণ্ডিত। দু’পক্ষের বক্তব্য শুনে তিনি তাঁর রায় দেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবশ্য তার প্রয়োজন হয় না। বিপক্ষ পণ্ডিতের প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে তাঁর কাছ থেকে যুক্তিসঙ্গত উত্তর পেয়ে গেলেই তর্কে হার হয়। এই তর্কযুদ্ধই জ্ঞানের চূড়ান্ত পরীক্ষা। এখানে পাঠক্রম নেই, কী ধরনের প্রশ্ন হতে পারে তার অগ্রিম ধারণা নেই, বই দেখে উত্তর দেওয়ার বিধান নেই। শ্রুতিলব্ধ সমস্ত জ্ঞানভাণ্ডার স্মৃতিতে থাকলে তবেই এই তর্কযুদ্ধে সামিল হওয়া সম্ভব। একজন পণ্ডিত বিভিন্ন জ্ঞানকেন্দ্রে যত বেশি পণ্ডিতকে তর্কযুদ্ধে পরাস্ত করতে পারবেন, তিনি তত বড় পণ্ডিত।
কেশব কাশ্মীরী ইতিমধ্যেই পরাস্ত করে এসেছেন তিব্বত, দিল্লি, গুজরাত, বারাণসী, কাঞ্চী, ত্রৈলঙ্গদেশ, বিজয়নগর ও দ্বারভাঙার পণ্ডিতদের। ভারতের কোণে কোণে তাঁর জয়যাত্রা অব্যাহত। যেখানকার পণ্ডিতদেরই পরাস্ত করেছেন, সেখান থেকে পেয়েছেন অর্থ, ধনসম্পদ ও অন্যান্য রাজ-অনুগ্রহও। হস্তিপৃষ্ঠে সুসজ্জিত যে দোলায় চড়ে তিনি দেশ-বিদেশ পরিভ্রমণ করেন, সেটি ঈর্ষণীয় রকমের সুন্দর। সঙ্গে শিষ্যদের দল, হাতি-ঘোড়া-তল্পিবাহক-রসদ, কী নেই! রাজার মতই হাবভাব পণ্ডিতের। বেদ-উপনিষদ থেকে কাব্য-অলঙ্কার, সবকিছুই গুলে খেয়েছেন। সরস্বতীর প্রসাদ না থাকলে তো এ সব সম্ভব নয়। উত্তর-দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। পূর্ব ভারতের বিদ্যানগর নবদ্বীপের পণ্ডিতদের প্রতিনিধিকে পরাস্ত করতে পারলেই তিনি নিজেকে সমগ্র ভারতের শ্রেষ্ঠতম পণ্ডিত বলে ঘোষণা করতে পারবেন। তাঁর শিষ্য ও অনুরাগীর দল এখনই তা করা শুরু করে দিয়েছে।
দিকে দিকে এই বার্তা রটি গেল ক্রমে। নবদ্বীপের পণ্ডিত-সমাজে চিন্তার ছায়া, কে যাবে অতবড় পণ্ডিতের সঙ্গে তর্ক করতে! এতগুলো দেশের পণ্ডিতদের যিনি হারিয়ে এসেছেন, তিনি তো সাক্ষাৎ বাগদেবীর বরপুত্র, তাঁর বরেই নির্ঘাৎ অপরাজেয়, তাঁর সঙ্গে তর্কযুদ্ধে সামিল হওয়া মানেই পরাজিত হওয়া অবশ্যম্ভাবী। এতে শুধু নিজের ও পরিবারের কাছে মানহানি হয় না, শিষ্যদের কাছেও মুখ দেখানোর উপায় থাকে না। নবদ্বীপের পণ্ডিতসমাজ যথেষ্ট বিদ্বান হলেও গত বেশ কিছু বছরে তাঁরা কূপমণ্ডুক হয়ে বসে আছেন, তর্কযুদ্ধে অন্য দেশের পণ্ডিতদের হারানোয় তাঁদের মতি নেই। কেউই নিজে থেকে এগিয়ে আসতে রাজি নন। অন্য কারও নাম যে প্রস্তাব করবেন, তাও করতে পারেন না, কেননা তাতে অন্যরা ভাবতে পারে, যাঁর নাম সুপারিশ করা হচ্ছে, তিনি এঁর চেয়ে শ্রেয়।
দলবল-সহ কেশব কাশ্মীরী এসে হাজির হলেন নবদ্বীপধামে। এক প্রান্তরে তাঁদের অস্থায়ী আবাস স্থাপিত হতে লাগল। তাঁর অনুচরেরা বিভিন্ন টোলে গিয়ে পণ্ডিতশ্রেষ্ঠ কেশব কাশ্মীরীর তর্কযুদ্ধের আহ্বানপত্র দিয়ে আসতে লাগল। টোলগুলোর শিষ্যদের মধ্যে উন্মাদনা। পণ্ডিতদের কুঞ্চিত ভ্রূপল্লব দেখে তারা মজা পাচ্ছে।
হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে এই খবর নিমাইয়ের কাছে এলে সে নিজেই গিয়ে দেখা করল নবদ্বীপের পাঁচ-ছ’জন বড় বড় পণ্ডিতের সঙ্গে।
- শুনলাম বিদেশ থেকে কে একজন পণ্ডিত আসছেন। তো আপনারা কে তাঁর সঙ্গে তর্কযুদ্ধ করবেন, সেটা তো তাঁকে জানাতে হয়।
- জানাতে তো হয়, বাবা নিমাই, তবে কাজটা কত বড় ঝুঁকিপূর্ণ, তুই তো জানিসই। এর মধ্যে আবার তোর গুরু অদ্বৈত আচার্যও এখন নবদ্বীপে নেই। শুনছি সেই পণ্ডিত নাকি জ্ঞান-বিজ্ঞান সব গুলে খেয়েছে। যেমন জ্ঞানী, তেমনি অহঙ্কারী। ভেবে দেখ বাবা, তাঁকে হারানো কি মুখের কথা? আর হেরে গেলে সারা দেশে রাষ্ট্র করে বেড়াবে নবদ্বীপের পণ্ডিতদের হারিয়ে এসেছি। ঐ মাঠে যে তাঁবু ফেলেছে, তুই বাবা তোর দলবল ওর পেছনে লেলিয়ে দিয়ে ওকে ওখান থেকে উৎখাত করে দিতে পারিস না?
- এ আপনি কী বলছেন, পণ্ডিতমশাই? উনি বিদেশ থেকে এসেছেন, উনি আমাদের অতিথি। ইনি কি পিরল্যা গাঁয়ের ভণ্ড শৃগাল যে বদমায়েশি করে আমাদের জাত মারতে এসেছেন? তা তো নয়। আর অহঙ্কারের কথা বলছেন! প্রকৃত বিদ্বান মানুষের বিনয় থাকে, অহঙ্কার নয়। অহঙ্কারীর দর্প জ্ঞানেই চূর্ণ হয়।
- ও সব আমরা বুঝি, বাবা, এখন উপায় কী বল।
- আপনারা থাকতে আমি উপায় বলব? নবদ্বীপের পণ্ডিতদের মাথা তো আপনারা। এখন আর নতুন পুঁথি কেউ লিখছে না?
- কে আর নতুন পুঁথি লিখবে? শুনছি বাদুড়্যার পিপিলাই গাঁইয়ের মুকুন্দ পণ্ডিতের ব্যাটা বিপ্রদাস নাকি একখান নতুন পুঁথি লিখেছে, কিন্তু সে হচ্ছে বাংলায়। সিন্ধু ইন্দু বেদ মহী শক পরিমাণ / নৃপতি হোসেন শাহা গৌড়ের প্রধান / হেনকালে রচিল পদ্মার ব্রতগীত / শুনিয়া দ্রবিত লোক পরম পিরিত। সপ্ত সিন্ধু, এক ইন্দু, চারি বেদ, এক মহী, মানে ৭১৪১, উলটে নিলে ১৪১৭ শক, মানে মাত্রই কয় বচ্ছর আগে। তবে পদ্মার ব্রতগীত দিয়ে কি আর পণ্ডিতের সঙ্গে তর্ক করা যায়? পড়েছিস নাকি সেই পুঁথি?
- হ্যাঁ, শুনেছি কিছু কিছু। চাঁদ সদাগর আর বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনি, মা মনসার মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছে পয়ারে আর ত্রিপদীতে। ছন্দের হাতটি বেশ। চাঁদ সদাগর তো মনসাকে মানে না, কিন্তু যখন বেহুলার দৌলতে মনসার আশীর্বাদে পুত্র লখিন্দর প্রাণ ফিরে পেল, তখন চাঁদ সদাগরের মন নরম হল, সে পুজো দিতে রাজি হল। মা মনসা তখন তাকে দেখা দিল লাস্যময়ী নারীর রূপ ধরে। বিপ্রদাস পয়ারে লিখেছে –
নানারত্ন অলঙ্কার পরি অঙ্গরাগে।- তুই মনেও রেখেছিস এই পদ, নিমাই? কী করে পারিস বল তো?
কুঙ্কুম কস্তূরি গন্ধ ধায় দশ দিগে।।
বিচিত্র অম্বর পরি হৃদয়-কাঁচুলি।
কটাক্ষে মোহন কাম মনসা কুমারী।।
অজগর সর্পে পদ্ম-কৃতাসন করি।
ফণী কাল বেকাল যুগল হস্তে ধরি।।
দুই ঘট শিরে দুই পদাঙ্গুলি দিয়া।
নৃপতিরে দেখা দিল ঈষৎ হাসিয়া।।
- আমার একবার শুনলেই মনে থাকে, পণ্ডিতমশাই। শুনুন, শাপমুক্ত হবার পর বেহুলা-লখিন্দরকে রথে তুলে নিয়ে মনসা ফিরছে। পথে পড়ল বেহুলার পিত্রালয়, উজানি শহর। বেহুলা তখন ত্রিপদীতে বলছে –
ক্ষণেক বিলম্ব কর এই মোর বাপঘর
দেখি যদি দেহ গো মেলানি।
প্রভুর সংহতি যাব পরিচয় নাহি দিব
অবিলম্বে আসিব এখনি।।
শুনে মনসা রথ থামিয়ে দিল। বেহুলা-লখাই যোগি-যোগিনীর বেশে নেমে গেল সেখানে কিছুক্ষণের জন্যে।
- ধন্য তোর স্মৃতিশক্তি, নিমাই। আহা, তোর বাপটা অকালে মারা গেল। তোর ওপর কত আশা ছিল জগন্নাথ মিশ্রর। তোর বড় দাদাটার আর কোন খবর জানিস, নিমাই? সে যে বাড়ি ছেড়ে সন্ন্যাস নিয়ে চলে গেল, কত বড় পণ্ডিতটাই না সে হতে পারত! যেমন ছিল তার বুদ্ধি, তেমনি তার স্মৃতি। তুই তোর দাদার স্মৃতি পেয়েছিস, নিমাই। একে বৃথা যেতে দিসনে কখনও।
- সে না হয় দেখা যাবে, এখন বলুন এই পণ্ডিতের ব্যাপারে কী অভিমত আপনাদের? কে যাবেন তর্ক লড়তে?
- আমরা তো তোকেই আমাদের প্রতিনিধি করে পাঠাতে পারতাম, কিন্তু তুই তো বাবা ন্যায়শাস্ত্রটা ভাল করে পাঠই করলি না। শুনলাম কী একটা টীকা লিখছিলি, সেটা নাকি গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিয়েছিস।
- কী করব? বন্ধু রঘুনাথও যে ন্যায় পড়ছিল। সে একদিন গঙ্গায় এক নৌকায় চড়ে আমাকে তার টীকা দেখাতে নিয়ে এসেছিল। বলেছিল, আমার টীকাটাও সঙ্গে নিতে। আমি প্রথমে আমার টীকাটাই পড়লাম। তাতে সে এমন কান্নাকাটি শুরু করল – আমার টীকাটা নাকি তার টীকার চেয়ে ঢের ভাল হয়েছে – যে আমি আর কী করি! দিলাম আমার লেখাটাকে গঙ্গায় ভাসিয়ে। বলে দিলাম, যা, তোরটাই থাক। আমি আর জীবনে ন্যায়ের ওপর কিছু লিখবই না। তারপর আর ন্যায় নিয়ে বিশেষ পড়াশুনাও করিনি, ইচ্ছেটাই চলে গেল।
- বেশ করেছিস বাবা, এমন মহাপ্রাণ মানুষ তো আমরা ইহজীবনে দেখিনি, যে নিজের ভালটা জলে ভাসিয়ে বন্ধুকৃত্য করে। তোর কীর্তি অক্ষয় হোক। কিন্তু বাবা, তুই যে এরপর গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোলে ব্যাকরণ শিক্ষায় মনোযোগী হলি, টোল খুলে নিজেও তো দিব্যি পড়াচ্ছিস, তোর কি মনে হয় ব্যাকরণের জ্ঞান দিয়ে তুই ঐ পণ্ডিতকে ঘায়েল করতে পারবি? আমাদের কারও সাহস হচ্ছে না। তোর বয়স অল্প না হলে আমরা তোকে একযোগে আমাদের প্রতিনিধি করে পাঠাতাম, কিন্তু তুই সদ্যযুবা, অনভিজ্ঞ, পণ্ডিতের যুক্তি যে পাণ্ডিত্য দিয়ে খণ্ডন করা যায়, তা শিক্ষার বয়স তোর তো হয়নি।
- দেখুন, কাউকে না কাউকে তো কাজটা করতেই হবে। আপনারা এগিয়ে না আসলে আমাকেই যেতে হয়। তর্কে হেরে ফেরা নিশ্চয় কাপুরুষের মত তর্কে প্রবৃত্ত না-হওয়ার চেয়ে মঙ্গল।
- তা বেশ। তবে তুই-ই আমাদের পণ্ডিতসমাজের প্রতিনিধি হ’। আমাদের এই নবদ্বীপের মুখরক্ষা এখন তোর হাতে, নিমাই।
নিমাই প্রত্যেকের পাদবন্দনা করলে তাঁরা সমবেতভাবে আশীর্বাদ করলেন – জয়যুক্ত হও।
* * *
মেন্শ্ শহর থেকে জন নামে এক ছোকরা এসেছে হার্লেমে কোস্টারের কারখানায় কাজ করতে। দেখে বোঝা যায় ভাল পরিবারের ছেলে, আদব-সহবত জানে। দারিদ্র্যের জন্যেই লোকে এক শহর থেকে অন্যত্র চাকরি খুঁজতে যায়, এর অবস্থাও তাই। ছোকরার মাথায় বুদ্ধিও অনেক, কাজকর্ম চটপট শিখে ফেলল মাত্র কদিনেই। কোস্টারও খুশি জনের ওপর।
হল্যান্ডের উত্তরে হার্লেম শহর সৌন্দর্যের জন্যে বহুকাল ধরেই বিখ্যাত। ধনী বণিকদের বাস সেখানে। রাস্তার দুধারে বড় বড় গাছের শোভা। আর টিউলিপ! ইওরোপের এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে হার্লেমের টিউলিপের সমাদর হয়নি। এমন সময়ও গেছে যখন এখানকার একটা টিউলিপ কেনার জন্যে লোকে দশ হাজার ফ্লোরিন দিতেও রাজি ছিল। এখনও একশো ফ্লোরিন তো পাওয়া যায়ই।
হার্লেমের সেন্ট বেভন চার্চ দেখভাল করতেন লরেন্স জ্যান্সেন। তিনিই প্রহরী, তিনিই কোষাধ্যক্ষ, চার্চ ও তার সংলগ্ন কবরখানার জমিজমা সব তিনিই দেখাশুনা করেন। কয়েক পুরুষ ধরে এই কাজ করে আসছেন তাঁরা, তাই তাদের নামের শেষে জুটেছে কোস্টার পদবি। কোস্টার খুব সম্ভ্রান্ত পদ, শহরের সবাই কোস্টারকে সম্মান করেন। রাজপ্রাসাদের পাশেই তাঁর নিজের অট্টালিকা। সন্ধেবেলা অন্য কাজ না থাকলে তিনি পায়চারি করেন বাড়ির পিছনে বিস্তৃত উঠোনে, যার শেষপ্রান্তে মনোরম উদ্যান। নয়তো গল্প করেন ছোট ছোট নাতি-নাতনিদের সঙ্গে।
জনের সঙ্গে কারখানায় বসে একদিন গল্প হচ্ছিল কোস্টার লরেন্স জ্যান্সেনের।
- আচ্ছা, এইভাবে যে কাগজে ছাপা যায়, এই ফন্দিটা আপনার মাথায় কী করে এল, স্যার?
- যেমন করে তোমার মাথায় ফন্দিটা এল এই চাকরিটা কী করে বাগানো যায়, সেইভাবে। আমি একদিন বাগানে ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম কতগুলো বীচ গাছের ছাল উঠে গেছে। আমি সেগুলো ছাড়িয়ে ঘরে নিয়ে এসে ভাবতে লাগলাম এগুলো দিয়ে কী করা যায়, যাতে বাচ্চাদের খানিক মনোরঞ্জন করা যায়।
- বাহ, তারপর?
- ছালগুলো কেটে কেটে আমি বিভিন্ন অক্ষর বানালাম। ওদের নাম লিখতে যে অক্ষরগুলো লাগে, সেইগুলো, কিন্তু উলটো করে, মানে আয়নায় দেখলে তবে মনে হবে সোজা। অক্ষরগুলো বানিয়ে ওদের নামের বানান অনুযায়ী আঠা দিয়ে একটা কাগজের ওপর সেঁটে দিলাম। তারপর বিভিন্ন রঙ বুরুশে লাগিয়ে বুলিয়ে দিলাম ঐ ছালের উলটানো অক্ষরগুলোর ওপর। এবার সেটা অন্য একটা কাগজের ওপর বসিয়ে তার ওপর ঘষে দিতেই দিব্যি নামগুলো বিভিন্ন রঙে ছাপা হয়ে গেল কাগজে। যেভাবে শিলমোহর লাগানো হয়, তেমনই।
- বাহ, এ তো দুর্দান্ত আবিষ্কার। আপনিই নিশ্চয় প্রথম যে এমন করে ভাবতে পেরেছেন।
- আরে দূর! শিলমোহর কি আজকের নাকি? যুগ যুগ ধরে মানুষ রাজকার্যে শিলমোহর ব্যবহার করছে। আর চিনদেশে কাগজে ছাপানো মুদ্রা ব্যবহার করছেও বহুকাল ধরে। মার্কো পোলোর নাম শুনেছ?
- না। কে মার্কো?
- জানো না? তাহলে গল্পটা শোনো। ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। ভেনিসের ব্যবসায়ী দুই ভাই নিকোলো আর মাফিও পোলো ব্যবসার জন্যে কন্সট্যানটিনোপল হয়ে কৃষ্ণসাগরের উত্তরে চলে গেল জাহাজে চেপে। যত পুবদিকে যাওয়া যায়, তত বেশি লাভ, কেননা তারা জিনিস কিনতে পারে কম দামে। কন্সট্যান্টিনোপলের রাজনৈতিক অবস্থা ঘোরালো হয়ে আসায় তারা কৃষ্ণসাগরের উত্তর পাড়ে হাজির হল ক্রিমিয়ার সোলদাইয়া বলে এক জায়গায়। ভেনিসের ব্যবসায়ীদের সেখানেও নিত্য যাতায়াত, ফলে তাদের ব্যবসা ভালই চলতে লাগল। ততদিনে অবশ্য এই অঞ্চলটা আর রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে নেই, তাদের কাছ থেকে দখল করে নিয়েছে চেঙ্গিজ খানের উত্তরসূরীরা, সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চার খানের অন্যতম চেঙ্গিজের বড় ছেলে জোচির বংশধর বার্কে খানের নেতৃত্বে সোনালি যাযাবরদের রাজত্ব। বার্কে খানের রাজধানী সরাই, সেখানে বছরখানেক থাকল তারা। চার খানদের মধ্যে মাঝে মাঝে ঝামেলা পাকাত। বার্কে খানের সোনালি যাযাবরের সঙ্গে তার খুড়তুতো ভাই হুলাগু খানের ইলখানিদের ঝঞ্ঝাট। ওদিকে কন্সট্যান্টিনোপলের পতনের পর সেখানে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে বাইজ্যানটাইন শাসন, তাদের সঙ্গেও বার্কে খানের লড়াই অব্যাহত। রাজনৈতিক স্থিরতা না থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি। পোলো ভাইরা ঠিক করল এই ঝামেলায় না ফেঁসে থেকে তারা আরও পুবদিকে চলে যাবে। চলতে চলতে তারা হাজির হল মধ্যপ্রাচ্যের বুখারায়। সেখানকার শাসক হচ্ছে ইলখানিদের হুলাগু খান।
জন মন দিয়ে গল্প শুনছে। কোস্টার ভারি চমৎকার গল্প বলতে পারেন। এ রকম গুণী একজন মানুষের দেখা যদি সে মেন্শে পেত, তবে এতদূর আসার প্রয়োজন থাকত না। কোস্টার বলে চলেছেন –
- ১২৬৪ সাল, বুঝলে? হুলাগু খান ঠিক করল সে তার জ্যেঠতুতো দাদা কুবলাই খানের কাছে একদল লোক পাঠাবে। এই যে বুর্কে খান, হুলাগু খান, কুবলাই খান – এরা সব চেঙ্গিজ খানের নিজের নাতি সব, আলাদা আলাদা ছেলের ছেলে। কুবলাই খান হচ্ছে তখন গ্রেট খান, তার রাজধানীর নাম দাদু, পরবর্তীতে যেটা পরিচিত হবে বেইজিং নামে। পোলো ভাইরা গিয়ে ধরে পড়ল, তারা এই অভিযাত্রী দলের সঙ্গে যেতে পারে কিনা। ততদিনে তারা বুখারায় বছর তিনেক কাটিয়ে এদের ভাষা শিখে নিয়েছে।
- রাজি হল হুলাগু খান ওর দলের সঙ্গে এদের পাঠাতে?
- হ্যাঁ। ওর আর কী, দেখল দুজন ব্যবসায়ী মানুষ সঙ্গে যেতে চাইছে, যাক। দু বছর ধরে চলল তাদের পথভ্রমণ, সিল্ক রুট ধরে। ১২৬৬ সালে তারা হাজির হল কুবলাই খানের দরবারে। কুবলাই খান পোলোদের কাছে শুনলেন পশ্চিমী সভ্যতার কাহিনি, খ্রিস্টান ধর্মের কথা, তাদের বড় বড় আবিষ্কারের গল্প। শুনে বেশ খুশি হলেন। একটা চিঠি লিখে ধরিয়ে দিলেন ওদের হাতে। বললেন – এটা নিয়ে গিয়ে তোমাদের পোপের হাতে দেবে। বলবে, গ্রেট খান চাইছেন পোপ যেন একশো জনের এক ধর্মযাজক দল তার সভায় পাঠান, যারা তার দেশে এসে খ্রিস্টান আদব-কায়দা, পশ্চিমী সাহিত্য-বিজ্ঞান সবকিছু শেখাবে। ওদের পবিত্র প্রদীপের একটু তেল যেন উনি ওদের সঙ্গে পাঠান। পোলো ভাইদের সঙ্গে দিয়ে দিলেন কোয়েকেতেই নামের এক মঙ্গোলকে, যে তাঁর নিজস্ব প্রতিনিধি হয়ে ওদের সঙ্গে যাবে।
- গেল ওরা পোপের কাছে? একশো খ্রিস্টান যাজক পাঠালেন পোপ কুবলাই খানের দরবারে?
- সে এক মজার গল্প। কোয়েকেতেই মাঝরাস্তায় পালিয়ে গেল, ফলে ওদের দু ভাই নিজের মত করেই ফিরে এল। কুবলাই খান ওদের সঙ্গে আরও দিয়েছিলেন একফুট লম্বা তিন-ইঞ্চি চওড়া এক সোনার পাতে লেখা তাঁর নিজস্ব শিলমোহর লাগানো এক নামাঙ্কনপত্র, যেটা মঙ্গোল সাম্রাজ্যের যে কোন প্রান্তে দেখালেই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা তো বটেই, সেখান থেকে এগিয়ে চলার জন্যে ঘোড়াও মিলে যাবে।
- ওরা সেইভাবে ফিরে সোজা পোপের কাছে গেল?
- সোজা কি আর পোপের কাছে গেল? ওরা ভেনিসে ফিরে এল ভেনিস ছাড়ার দীর্ঘ উনিশ বছর পরে। বাড়িতে ধরেই নিয়েছিল এরা আর বেঁচে নেই। বড়ভাই নিকোলোর বৌ ওদের বাড়ি ছাড়ার বছরই এক সন্তানের জন্ম দিয়ে মারা গেছে। সেই বাচ্চাটা এখন বেশ তাগড়া এক যুবক, তার নাম মার্কো। মার্কো তার বাবা-কাকার কাছে নতুন দুনিয়ার গল্প শোনে আর ক্ষণে ক্ষণে শিহরিত হয়।
- তারপর? পোপের কাছে গেল না ওরা?
- যাওয়ার ইচ্ছে তো ছিলই ষোল আনা। কিন্তু পোপ চতুর্থ ক্লেমেন্ট ঠিক সেই সময়েই মারা গেছেন। পরবর্তী পোপের নাম ঘোষণা হয়নি। পোলোরা কিছুদিন অপেক্ষা করে পোপের অফিসে একটা চিঠি পাঠিয়ে দিল সবকথা লিখে। একশোজন পণ্ডিত চাই, সেপালকারের তেল চাই, ইত্যাদি। সে চিঠির কোনো উত্তর এল না। এক বছরেরও বেশি অপেক্ষা করে বিরক্ত হয়ে পোলোরা ঠিক করল ওরা নিজেরাই আবার যাবে কুবলাই খানের দরবারে, সঙ্গে নিয়ে যাবে মার্কোকেও। যেদিন তারা যাত্রা শুরু করবে, ঠিক তার কয়েক দিন আগে তাদের চিঠির উত্তর এল নতুন পোপ দশম গ্রেগরির। তিনি সদ্য পোপ হয়েছেন, অফিস থেকে পেয়েছেন পোলোর চিঠিও। এক্ষুনি একশো পণ্ডিত তিনি পাঠাতে পারছেন না, বদলে দুজন চার্চের কর্মচারী যাবে ওদের সঙ্গে।
- নাকের বদলে নরুন?
- সেই রকমই। তারা যাত্রা শুরু করে খানিকটা যাওয়ার পরই অবশ্য কোত্থেকে খবর এল, যুদ্ধ বেধে গেছে। চার্চের লোকদুটো ভয়ে আর যেতে চাইল না, ফিরে গেল নিজের দেশে। পোলোরা তিনজন আবার সিল্করুট ধরে এগোতে লাগল। ১২৭৫ সালে তারা হাজির হল কুবলাই খানের দরবারে। তরুণ যুবক মার্কোকে দেখে কুবলাই খুব খুশি। সে যাই দেখে তাতেই অবাক হয় আর সেটা খুব গুছিয়ে রংচং মিশিয়ে দুর্দান্ত গল্প বলতে পারে। কুবলাই তার ওপর ভীষণ প্রীত হয়ে ওকে নিজের প্রতিনিধি বানিয়ে পাঠাতে লাগলেন বিভিন্ন জায়গায় কূটনৈতিক মিশনে। ফিরে এসে গল্প বলে মার্কো কুবলাইয়ের মনোরঞ্জন করতে লাগল। পোলোরা ওদেশে থেকে গেল দীর্ঘ সতের বছর। এর মধ্যে যখনই তারা দেশে ফেরার নাম করেছে, কুবলাই তখনই মার্কোকে পাঠিয়ে দিয়েছেন অন্য আর একটা সফরে।
- বাহ, চাকরিটা তো বেশ মজার।
- তবে আর বলছি কী! তবে এই যে রংচং মিশিয়ে মার্কো গল্প বলত, এর ফলে কোনটা সত্যি, কোনটা গুল, লোকে ধরতে পারত না। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে তার জ্ঞান অনেক বেড়েছিল, কিন্তু এমনভাবে সে গল্পগুলো বলত, মনে হত সবই রূপকথা, সত্যি হতেই পারে না।
- ওরা দেশে ফিরতে পেরেছিল আর?
- হ্যাঁ। ১২৯১ সালে কুবলাই মঞ্জুর করলেন ওদের প্রত্যাবর্তন। তাও এক শর্তে। রাজকুমারী কোয়েকেচিনকে পৌঁছে দিতে হবে তার বাগদত্তা ইলখানিদ রাজপুত্র আরঘুনের কাছে। আগের বার কোয়েকেতেই মাঝরাস্তায় পালিয়ে গেছিল। এবারে ফেরার সফর অবশ্য সমুদ্রপথে। তাদের জাহাজ ছাড়ল চুয়ানঝৌ বন্দর থেকে। সুমাত্রা, শ্রীলঙ্কা ও ভারতের কিছু বন্দর ঘুরে পারস্য উপসাগর দিয়ে তারা প্রবেশ করল ইলখানিদদের এলাকায়। জানা গেল রাজকুমারীর বাগদত্তা আরঘুন মারা গেছে। নতুন রাজার কাছে কোয়েকেচিনকে সঁপে দিয়ে তারা ফিরে এল নিজের দেশে।
- বাহ। তারপর?
- মার্কো লিখেছিল তার ভ্রমণকাহিনি। সেই প্রথম ইওরোপিয়রা জানল কী বিচিত্র দেশ এই চিন। তবে ওই যে বললাম, সে লেখা এমন যে তার সব বিশ্বাস করাও মুশকিল। লোকে তাই তাকে মিথ্যাবাদী গুলবাজই ঠাউরেছিল। অন্যান্য অনেক বিস্ময়কর জিনিসের মধ্যে সে লিখেছিল, চিনদেশে কাগজের ওপর সিঁদুর দিয়ে ছাপানো হয় দুর্দান্ত মুদ্রা। সেটাও লোকে বিশ্বাস করেনি। কিন্তু এটা আমি জেনেছি একেবারে ঠিক। ভেবে দেখো, আজ থেকে দেড়শো বছরও আগের কথা। ওরা যদি কাগজে এত সুন্দর ছাপাতে পারে, আমরা কেন পারব না?
- তা তো ঠিকই? আপনি একাই লড়ে গেলেন এই নিয়ে?
- না। টমাসকে তো দেখেছ, টমাস পিটার, আমার জামাই। তাকে বললাম, যদি নাম ছাপানো যায়, তবে বই কেন ছাপানো যাবে না? অক্ষরের পর অক্ষর জুড়েই তো বই। যা একটা করা সম্ভব, তা কয়েক মিলিয়ন করাও সম্ভব। পিটার শুনেটুনে বলল, ঠিক। আমরা দুজনে বসে গেলাম কাঠের ওপর অক্ষরের উলটো ছাঁচ বানাতে। সময় লাগল, কিন্তু আমরা পারলাম কাঠের অক্ষর পাশাপাশি বসিয়ে কাগজের ওপর ছাপাতে। অবশ্য সাধারণ কালি দিয়ে ছাপালে প্রথম প্রথম কাগজে শুষে নিচ্ছিল বলে একদম ভাল হচ্ছিল না। আমাদের ঘন কালি বানাতে হল এর জন্যে। সে সমস্যা মিটে গেল প্রচুর দিন পরিশ্রম করে আমরা ছাপালাম একটা বই। কী ছিল জানো সেই বইতে?
- কী?
- বর্ণমালা, লর্ডস প্রেয়ার, দ্য ক্রিড অফ দ্য অ্যাপোস্লস্ আর তিনটে ছোট প্রার্থনা। এই ছাপাতেই আমাদের দম বেরিয়ে গিয়েছিল। পার্চমেন্ট কাগজের একপিঠে আমরা এটা ছাপিয়েছিলাম। যেদিকে ছাপা নেই, সেদিকগুলো আঠা দিয়ে জুড়ে দিয়েছিলাম যাতে সাধারণ বইয়ের মত দুদিকে লেখা মনে হয়। তবে অক্ষরগুলো তেমন জুৎসই হয়নি, লাইনগুলো ত্যারাব্যাঁকা, এক এক পাতায় এক এক রকম লাইন, তাদের নাম্বারিংও করতে পারিনি। খুবই সাধারণ ছিল সেই প্রথম প্রচেষ্টার ফল। তবু, বলতে বাধা নেই, আমরা যে ছাপাতে পেরেছিলাম, সেটাই ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় পুরস্কার।
- তা তো হবেই। প্রথম সন্তান সমস্ত বাবা-মায়েরই প্রিয় হয়।
- ঠিক। কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম যে নরম কাঠ দিয়ে এই কাজ হবে না। ছাপানোর সময় যে চাপ পড়ছে এই টাইপগুলোর ওপর, তাতেই তারা ক্ষয়ে যাচ্ছে, ভেঙে যাচ্ছে, ফলে ছাপাটা ধেবড়ে যাচ্ছে, ঠিকমত হচ্ছে না। আরও শক্ত কাঠ দিয়ে টাইপ বানাতে হবে, যাতে ভেঙে না যায় কিছুতেই। আবার এমন শক্ত না হয়, যেন খুব ধারালো হয়ে যায়, তাহলে কাগজ ছিঁড়ে বা ফেটে যাবে। এইসবগুলো আমরা করছি তার পর থেকে। বুঝতেই পারছ, ছাপানো জিনিসের কেমন চাহিদা। হাতে-লেখা পুঁথি আর কেউ পড়তে চাইছে না। সবাই চাইছে আজকাল ছাপানো বই। কাজেই আমাদের এই কাজকর্ম সব কিন্তু গোপন রাখবে। আমি সব্বাইকে দিয়ে শপথ করিয়ে নিই। তুমিও ঘুণাক্ষরে কাউকে বলতে যেও না যেন।
- না, না, মাথা খারাপ নাকি! আমি কাকেই বা বলতে যাব?
- তোমার এক ভাই এসেছিল সেদিন কারখানায়। তাকে কিছু বলোনি তো? সে শুনলাম স্ট্র্যাসবার্গে থাকে। কী করে সে?
- তেমন কিছু করে না। ওখানে নতুন কিছু ব্যবসার ধান্দা করছে।
- আচ্ছা। বুঝতেই পারছ, আমাদের কাজ হচ্ছে ছাপানোর প্রযুক্তিকে নতুন উচ্চতায় তুলে নিয়ে যাওয়া। আরও শক্ত কাঠের বা ধাতুর টাইপ সম্ভবত দরকার আমাদের। কালির জন্যেও নতুন করে ভাবনাচিন্তা করতে হবে।
- আমি চেষ্টা চালিয়ে যাব, স্যার।
- আমি জানি। তোমার মধ্যে শেখার ইচ্ছে আছে, তাই তো তোমাকে সব খুলে বলি। ক্রিসমাস আসছে, কী পরিকল্পনা তোমার?
- এখনও কিছু পরিকল্পনা করিনি। দেখি, হয়ত ছুটি নিয়ে মেন্শে যাব কিছুদিনের জন্যে।
- বেশ। টাইপ কী করে আরও ভাল করা যায়, সে নিয়ে চিন্তাটা কিন্তু মাথা থেকে এক্কেবারে নামাবে না।
- অবশ্যই স্যার।
১৪৩৯ সাল। ঘটা করে ক্রিসমাস ইভ পালিত হচ্ছে কোস্টারের বাসভবনে। সারা বাড়ি সাজানো হয়েছে আলো দিয়ে। বাইরে কনকনে ঠান্ডা, ভেতরে ক্যারল গাইছে তার ছোট ছোট নাতি-নাতনিরা। এ বছর ব্যবসা বেশ ভাল হয়েছে। অনেকগুলো বই ছাপানোর অর্ডার এসেছে। একটা বই ছাপাখানায় প্রায় প্রস্তুত, নতুন বছরের গোড়াতেই ডেলিভারি যাবে তার।
মাঝরাতে বাটলার এসে শুকনো মুখ করে দাঁড়াল ক্যাস্টরের সামনে।
- খুব খারাপ খবর আছে, স্যার। আদ্ধেকেরও বেশি টাইপ ছাপাখানা থেকে চুরি হয়ে গেছে।
- বলো কী! প্রহরী ছিল না ছাপাখানায়? টাইপ কে চুরি করবে? এখানে ছাপাখানা আছে আর কার?
- আমরা কেউ দেখিনি কাউকে চুরি করতে, স্যার। কিন্তু আমাদের সন্দেহ ঐ নতুন ছোকরাটার ওপর। ও ছুটি নিয়ে বাড়ি যাওয়ার আগে ছাপাখানা থেকে সরিয়ে নিয়ে গেছে টাইপগুলো। জন স্যার, জন গুটেনবার্গ।
(জন গুটেনবার্গ)
* * *
বড় জ্যাঠা সুলতান আহমদ মির্জা বাবরের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে নিজের রাজ্যে ফিরে যেতে গিয়ে রাস্তাতেই প্রাণ হারালেন। বাবরের তখন বাবার গদিতে বসার মাত্রই কয়েক সপ্তাহ পূর্ণ হয়েছে। এর মধ্যে বড় জ্যাঠা ছাড়াও বড় মামা মাহমুদ খান আর প্রতিবেশী আবু বকরকে প্রতিরোধ করা গেছে। তবু রাজ্যে শান্তি নেই। গদি লাভের দু’ মাস হয়েছে কি হয়নি, আবার শুরু হল অন্য এক ঝামেলা।
আহমদ মির্জা মারা গেলেন মাত্র চুয়াল্লিশ বছর বয়সে, উত্তরাধিকারী কোনো পুত্রসন্তান না রেখে। তার রাজ্যের আয়তন মন্দ না। সমরকন্দ, বুখারা, তাসখন্দ, সৈরাম, খুজন্দ, আউটরিপা মিলিয়ে বেশ বড়সড় এলাকা তাঁর, এর মধ্যে খুজন্দ আর আউটরিপা ছিল বাবরের ফরগনার অংশ, তিনি শেষ যুদ্ধে হাতিয়ে নিয়েছিলেন। এখন এই যে ফট করে তিনি চলে গেলেন, এর ফলে একটা অচলাবস্থা দেখা দিতে রাজ্যের বেগ-উমরাহরা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে আহমদের ছোট ভাই অর্থাৎ বাবরের ছোট জ্যাঠা সুলতান মাহমুদ মির্জাকে সঁপে দিলেন তাঁর দাদার রাজত্ব। মাহমুদ মির্জা এতদিন বদকশান, অস্ফর ও হিন্দুকুশের মাঝখানের ছোটখাট অঞ্চলের শাসক ছিলেন। হঠাৎ তাঁর হাতে এসে গেল এক বিশাল সাইজের রাজ্য, যার মধ্যে আছে সমরকন্দের মত নিখাদ সুন্দর জায়গা। তাঁর পাঁচ ছেলে বড় দুজনকে বদকশান ও বুখারার দায়িত্ব দিয়ে নিজে চলে এলেন সমরকন্দে, এখান থেকেই সমস্ত রাজ্যটা চালাবেন তিনি, দরকারে আরও বাড়িয়ে নেবেন। তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতা খারাপ নয়।
রাজ্য বাড়ানোর ফন্দি আঁটতেই নজরে পড়ল মৃত ছোটভাই উমর শেখের নাবালক পুত্র বাবরের ক্ষুদ্র ফরগনা রাজ্যের ওপর। সেখানে এখনও শান্তি ফেরেনি। তাছাড়া ওরা তিনজন ছোট ছোট ভাই – জহিরুদ্দিন মহম্মদ বাবর, জাহাঙ্গির মির্জা আর নাসির মির্জা - এদের মা-রা সবাই আলাদা। সৎভাই যখন, একজনের বিরুদ্ধে আর একজনকে লেলিয়ে দেওয়া মোটেই দুঃসাধ্য নয়। এদের আমিররাও নিশ্চয় সবাই বাবরের পক্ষে নেই, কেউ কেউ হয়ত জাহাঙ্গির বা নাসিরের সমর্থক। টোপ দিয়ে এদের কিনে নিতে পারলেই কেল্লা ফতে।
মাহমুদ মির্জার বড় ছেলে মসুদ মির্জা এখন বদকশানের দায়িত্বে। তার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হল তারই জ্যেঠতুতো বোন বাবরের বড় জ্যাঠা প্রয়াত আহমদ মির্জার মেজ মেয়ের। সেই উপলক্ষ্যে বাবর ও তার পরিবারকে বিয়ের চিঠি পাঠানো হল আবদুল কুদ্দুস বেগ নামে মাহমুদ মির্জার এক আমিরের হাত দিয়ে। মাহমুদ তার সঙ্গে পাঠালেন মূল্যবান উপহার সামগ্রীও। এসব আসলে ছল। আবদুল কুদ্দুস এসেছেন বাবরের কয়েকজন বেগকে হাত করতে। তিনি বাবরের আন্দিজান দুর্গের দ্বাররক্ষক হাসান-এ-ইয়াকুবের কেমন যেন আত্মীয়। তাঁর প্রথম লক্ষ্য অবশ্যই হাসান এবং হাসানের সূত্র ধরে অন্য আরও কয়েকজন। হাসানের সঙ্গে পরামর্শ শেষ হতেই আবদুল কুদ্দুস ফিরে গেল সমরকন্দে।
দাদিমার কথামত হাসানকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার দেওয়া হল, কিন্তু হাসান প্রথম সুযোগেই চলে গেল বিরোধী দলে, আবদুল কুদ্দুসের ঘুষ খেয়ে। তাকে বলা হল, বাবরকে হটিয়ে তার মেজভাই জাহাঙ্গিরকে গদিতে বসাতে যে সব আমিররা একটু হলেও রাজি, তাদের হাত করতে। মহম্মদ বাকির বেগ, মহম্মদ দুলদাই এ রকম কয়েকজন তো আছেই, হাসান তা জানে। সে অবিলম্বে তাদের সঙ্গে মেতে উঠল গোপন ষড়যন্ত্রে।
বাবরের রাজ্য যেমন ছোট, দলও তাই। গোপন ফিসফিসানি তার বেশিক্ষণ গোপন রইল না। কয়েকজনের কথাবার্তা, হাবভাব অস্বাভাবিক লক্ষ করেই বাবরের সমর্থক আমিররা তাদের কুমতলব বুঝে ফেললেন। খাজা কাজি, কাশিম কুচিন, আলি দোস্ত তঘাই সব ছুটে এল বাবরের কাছে, জানাল তাদের উদ্বেগ। ফের সভা বসল মাতামহী এহসান দৌলন বেগমের নিভৃত কক্ষে। সবার কথা শুনে তিনি বাবরকে বললেন, এই কাঁটা এখনই উপড়ে ফেলতে হবে। ছলে বা কৌশলে নয়, সামনাসামনি। অন্য কাউকে দিয়ে নয়, এই কাজ করতে হবে বাবরকেই। আল্লাহর ইচ্ছায় এ রাজ্য যখন সে চালাচ্ছে, এমন ষড়যন্ত্র দমন করার দায়িত্বও তার নিজের। অবিলম্বে সে যেন কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচর নিয়ে হাসানকে বন্দী করে এবং সবার সামনে শাস্তি দেয়। শয়তানরা জানুক, বাবর ছেলেমানুষ হলেও উপযুক্ত ব্যবস্থাগ্রহণে পিছপা নয়।
রাতের অন্ধকারে ঘোড়া ছুটল হাসান ও অন্যান্য বিশ্বাসঘাতকদের বন্দি করতে। অন্দিজান দুর্গের কাছে এসে জানতে পারলেন হাসান তখন অন্দিজানে নেই। বাকিদের বন্দি করা হল।
হাসান গেছিল শিকারে। বাজপাখি দিয়ে পশু শিকার তার প্রিয় খেলা। খেলতে খেলতেই খবর এসে গেল তার সমস্ত কুমতলব ফাঁস হয়ে গেছে, স্বয়ং বাবর তাকে বন্দি করতে এসেছে আন্দিজানে। শুনেই নিজস্ব অনুচরদের নিয়ে পালাল হাসান। আন্দিজানে ফেরা যাবে না, একমাত্র উপায় সমরকন্দে গিয়ে বাবরের ছোটজ্যেঠা সুলতান মাহমুদ মির্জার হাত শক্ত করা। সমরকন্দের দিকে ছুটল তাদের ঘোড়া। যেতে যেতেই হঠাৎ মাথায় নতুন ফন্দি এল – এখন তো অখসি দুর্গে বেশি লোক নেই, এটাকে দখল করে নিলেই হয়। ভবিষ্যতে এখান থেকে আন্দিজান আক্রমণ সহজ হবে। তাছাড়া সমরকন্দ না গিয়ে তাকে খবর পাঠিয়ে অখসিতে আসতে বলে তার জন্যে ওখানেই অপেক্ষা করা যাবে।
হাসান কোথা দিয়ে কোথায় যাচ্ছে, এ সব খবর দেরিতে হলেও পৌঁছে যাচ্ছিল বাবরের কাছে। বাবর আঁচ করতে পারছিল আসন্ন বিপদের কথা। হঠাৎ অখসির দিকে হাসানের দল ঘোড়া ছোটাতে এহসান দৌলত বেগমের পরামর্শে বাবর সেখানে সেনা পাঠাল দ্রুত। রাতের অন্ধকারে মুখোমুখি হল বাবরের সেনা আর হাসানের সেনা। শুরু হল এলোপাথাড়ি তির ছোঁড়াছুঁড়ি। কেউ কোথাও কাউকে দেখতে পাচ্ছে না, মাঝে মাঝে শুধু শোনা যাচ্ছে রণহুঙ্কার, সেই লক্ষ করেই ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে তির।
বেশিক্ষণ এই তামাশা চলল না। নিজের দলের কারও ছোঁড়া তির এসে ফুঁড়ে দিল হাসানকে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হল তার। হাসানকে দিয়ে বাবরের রাজ্য দখলের মতলব বানচাল হয়ে গেল ছোটজ্যেঠা সুলতান মাহমুদ মির্জার। অন্য কোন পরিকল্পনা মাথায় আসার আগেই নিজের দুই ভাইয়ের মত তিনিও মৃত্যুমুখে পতিত হলেন অল্পবয়সে, কিছুদিনের মধ্যেই।
শিশু বাবর এ যাত্রাও বেঁচে গেল।
* * *
কোস্টারের ছাপাখানা থেকে চুরি করা টাইপগুলো নিয়ে জন গুটেনবার্গ হার্লেমের পাততাড়ি গুটিয়ে পালিয়ে প্রথমে গেল অ্যামস্টারডামে, সেখান থেকে কোলনে। কোথাও নিরাপদ বোধ না করায় শেষমেষ ফিরে এল নিজের শহর মেন্শেই, এসেই খুলে বসল একটা ছাপাখানা। বছরখানেকের মধ্যেই একটা জনপ্রিয় ব্যাকরণ বই ছাপিয়ে ফেলল, বইটার নাম – Alexandri Galli Doctrinale. এর পর Petri Hispani Tractalibus Logicis নামে আর একটা বই।
জনের এক ভাই ছিল, সেও জনের মতই মেন্শ্ ছেড়ে কাজের ধান্দায় এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে আস্তানা গেড়েছিল স্ট্র্যাসবার্গে। সেখান থেকে একবার জনের কাছে গিয়ে ছিল কয়েক দিন, দেখে এসেছিল ছাপাখানার রকম-সকম। ছাপার প্রযুক্তি পেতে সবাই প্রবল উৎসুক, কেননা ব্যবসাটা বেশ লাভজনক। জনের ভাই স্ট্র্যাসবার্গে ফিরে গিয়ে কয়েকজন পার্টনার জোগাড় করে একটা কোম্পানি খুলে ফেলল, তাদের বোঝাল যে ও ওর দাদার কাছ থেকে ছাপাখানার সমস্ত কৌশল শিখে এসেছে। পার্টনাররা তাদের সঞ্চয় থেকে বেশ পয়সা ঢালল সেই কোম্পানির পেছনে। কিন্তু জনের ভাই শিখেছে তো লবডঙ্কা। ভেবেছিল কোম্পানি চালু হয়ে গেলে পরে দাদার কাছে গিয়ে শিখে আসবে ব্যাপারটা। এদিকে দাদা তো ততদিনে পালিয়েছে কোস্টারের ওখান থেকে। জনের ভাইয়ের কোম্পানি একগাদা পয়সা খরচা করে লোকজনকে খুব জানাল অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে তারা বই ছাপাবে স্ট্র্যাসবার্গে, যা পৃথিবীর অন্য কোথাও হয়নি আগে। একটা বইও ছাপানো হল না সেখানে, যদিও ছাপাখানার ইতিহাসে স্ট্র্যাসবার্গের নাম ঢুকে গেল সেই প্রচারের সুবাদে।
জন কিন্তু বসে নেই। তার ব্যবসা বাড়তে বাড়তে এমন এক অবস্থায় এল, যে আরও লোকজন চাই তার, চাই আরও কিছু লগ্নি। জন ফস্ট নামে এক ধনী স্বর্ণকার এগিয়ে এল তার সহায়তায়। ছাপা বইয়ের মধ্যে অধিকাংশই প্রার্থনার বই, তাই ছাপাখানার কাজে লিপ্ত লোকদের সম্মান খুব। তাছাড়া লাভের ব্যাপারটাও উপেক্ষা করা যায় না আদৌ। জন গুটেনবার্গের ভাইও ততদিনে স্ট্র্যাসবার্গ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে পার্টনারদের টাকা নয়ছয় করার জন্যে, তারা ক্ষেপে গিয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে সেখানে। সে ফিরে এসে দাদার কোম্পানিতে যোগ দিল। দুজনে মিলে মাথা খাটাতে লাগল কী করে ছাপার টাইপ আরও ভাল করা যায়। কাঠের টাইপে ছাপা ভেঙে আর দ্রুত ক্ষয়ে যাওয়ায় তাদের কিছুতেই পছন্দ হচ্ছিল না। প্রায় সাত বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে তারা তৈরি করে ফেলল ধাতুর টাইপ। ধাতব পাত কেটে কেটে তার মাথায় বানানো হল অক্ষরের উলটো ছাঁচ, যাতে কালি মাখালে কাঠের টাইপের মতই ছাপা হবে, পার্থক্য এটাই যে ধাতু অনেক শক্ত হওয়ায় কাঠের মত ভেঙে যাবে না, ছাপার অক্ষরগুলো হবে অনেক বেশি নিটোল, তার ধারগুলো হবে অনেক বেশি ধারালো, ধ্যাবড়া নয়।
(গুটেনবার্গ বাইবেল)
১৪৫০ সালে তাদের এই আবিষ্কার ছাপার জগতে যুগান্ত নিয়ে এল। ধাতব টাইপে প্রথম ছাপা হল পবিত্র বাইবেল। বড় বড় হরফে ৬৩৭ পৃষ্ঠার এই বইতে প্রতি পাতায় কেবল একদিকেই ছাপা হয়েছিল, প্রতি পৃষ্ঠায় ছিল দুটো করে কলাম, প্রতিটাতে ৪২ লাইন, মোট প্রায় তিরিশ লক্ষ অক্ষরে সাজানো। প্রথম বারোটা পাতা ছাপাতেই খরচা হয়েছিল চার হাজার ফ্লোরিন। পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি এই বই যখন ছাপা হল, তা দেখে অবাক হয়ে গেল সবাই। এমন সুন্দর ছাপা কেউ দেখেইনি ততদিন পর্যন্ত। প্রতি চ্যাপ্টারের প্রথম অক্ষরের জায়গাটা ফাঁকা রাখা হয়েছিল, পরে হাতে এঁকে দেওয়া হয়েছিল। উদ্ধৃতির জায়গাগুলোও ফাঁকা ছিল, লিখে দেওয়া হয়েছিল হাতে।
অবশ্য এর মধ্যে জন গুটেনবার্গের সঙ্গে জন ফস্টের ঝামেলা বেধে গেছে। দাদাকে ছেড়ে ভাইকে নিয়ে ফস্ট খুলে বসেছে আর এক পার্টনারশিপ। সেখানেও ঝঞ্ঝাট। ফস্টের টাকা আছে, ভায়ের তো স্রেফ বুদ্ধিই সম্বল। কিছুদিন যেতে না যেতেই ফস্টের সঙ্গে বিরোধ। ফস্ট তার বিরুদ্ধে কেস করলেন, হেরে গেল জন গুটেনবার্গের ভাই। যাবতীয় হরফ যা বানিয়েছিল জনের ভাই, চলে গেল ফস্টের দখলে।
ফস্ট নিয়োগ করেছিল স্কয়েফার নামে আর এক করিৎকর্মা ছোকরাকে। ছাপার হরফ নিয়ে তার উৎসাহ ব্যাপক, সে দিন নেই, রাত নেই ঐ নিয়েই পড়ে থাকে। ধাতুর পাত কেটে কেটে যে উলটানো হরফ বানানো হয়, তার দুটো পিস তো হুবহু একই করা সম্ভব হয় না। সে করল কী, একটা শক্ত ধাতু কেটে তৈরি করল একটা উলটানো হরফ। সেটাকে বলল পাঞ্চ। একটা গরম-করা নরম ধাতুতে পাঞ্চ দিয়ে আঘাত করতেই সেখানে গর্ত হয়ে পাঞ্চের ওপর লেখা হরফ বসে গেল। এবার সেটা ঠান্ডা ও শক্ত করতেই তৈরি হয়ে গেল হরফের ছাঁচ। ছাঁচের সেই গর্তের হরফের ওপর সে ঢেলে দিল উচ্চ তাপমাত্রায় গলানো ধাতু। তাতে ধাতব যে হরফটা তৈরি হল, সেটা ধাতু কেটে নয়, বরং ধাতু গলিয়ে। একই ছাঁচের ওপর গলানো ধাতু যতবার খুশি ঢেলে ঢেলে তৈরি করা সম্ভব হুবহু একই-দেখতে ধাতব হরফের টাইপ। এ রকম বেশ কিছু টাইপ তৈরি করে সে দেখাল তার মনিব ফস্টকে। ফস্ট আনন্দে আত্মহারা। ঠিক এই জিনিসেরই তো তিনি স্বপ্ন দেখে চলেছেন, এই ছোকরা এত সহজে তা বানিয়েও ফেলল! এ তো তৈরি করাও সহজ, দামেও সস্তা, আর এর ছাপা দেখতেও অনেক বেশি ভাল।
অবিলম্বে স্কয়েফারকে সামান্য কর্মচারী থেকে ফস্ট পার্টনার করে নিলেন এবং কিছুদিনের মধ্যেই তার কপালে জুটে গেল ফস্টের মেয়ে ক্যাথেরিনও, স্ত্রী হিসাবে। সীসার গলনাংক কম বলে প্রথমে শুধু সীসা দিয়ে টাইপ বানানো হচ্ছিল, পরে তার সঙ্গে অ্যান্টিমনি মিশিয়ে সেটা আরও শক্ত করে নেওয়া হল। ১৪৫৯ সালে এই কাস্ট পদ্ধতিতে এদের প্রথম বই বেরোলো – Durandi Rationale নামে।
জুনিয়র গুটেনবার্গ ফস্টের সঙ্গে বিবাদের পর মেন্শে ফিরে সেখানে কনরাড হামেরি নামে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে জোট বেঁধে নিজের ধাতুর-পাত-কাটা হরফ দিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যেতে লাগলেন এবং প্রচার করলেন মেন্শ্ই হচ্ছে ছাপাখানার আদি আবিষ্কারের আতুঁড়ঘর। ফস্ট-স্কয়েফারও প্রচার করলেন যে তারাই ছাপার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। ছাপার ব্যাপারটা এতই গোপনীয় রাখা হত, যে সমস্ত দাবিই লোকে মেনে নিত। আসল ঘটনা এই যে চিনারা কাঠে খোদাই করে এদের প্রায় হাজার বছর আগে বই ছাপিয়েছিল। হার্লেমের কোস্টার কাঠের হরফের আবিষ্কর্তা। মেন্শের গুটেনবার্গ ধাতুর পাত কেটে প্রথম হরফ বানিয়েছিলেন আর ধাতু গলিয়ে প্রথম হরফ বানিয়েছিলেন স্কয়েফার।
পঞ্চদশ শতাব্দীর এই আবিষ্কার ভাবনার আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে নিয়ে এল যুগান্তকারী প্রভাব। একের পর এক ইওরোপিয় দেশগুলোতে শুরু হল এইভাবে ছাপানো বই। ১৪৬৫ সালে রোমানদের দেশ ইটালির সুবিয়াকোতে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা হল। এর তিন বছর পর ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে, তার পরের বছরেই ফ্রান্সের প্যারিসে। স্পেনের বার্সিলোনায় ছাপা শুরু হল ১৪৭৫ সালে। শুধু খ্রিস্টানদের মধ্যেই আর সীমাবদ্ধ রইল না। ১৪৯০ সালে মুসলমান-অধিকৃত তুরস্কে পৌঁছে গেল ছাপার কৃৎকৌশল।
এ সবের পাশাপাশি চলছিল বিভিন্ন আকৃতির (পয়েন্ট) এবং বিভিন্ন ধরনের (ফন্ট) হরফ নির্মাণ। গথিক থেকে জার্মান, তা থেকে সেমি-গথিক। ১৪৬৭ সালে তৈরি হল প্রথম রোমান টাইপ, তার তিন বছর পরে ভেনিসের নিকোলাস জনসন তার প্রভূত উন্নতিসাধন করে এমন এক রূপ দিলেন পরবর্তীতে যা কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে নাম নিল টাইমস নিউ রোমান। ১৪৮৮ সালে ভেনিসের অ্যালডাস ম্যানুটিয়াস তৈরি করলেন বাঁকানো (ইটালিক) হরফ, সৌন্দর্যের জন্যে যা দ্রুত বিখ্যাত হয়ে গেল। গ্রিক থেকে হিব্রু ও অন্যান্য স্ক্রিপ্টে বই লেখা শুরু হল।
ষোড়শ শতাব্দী শুরুর আগেই ছাপা হয়ে গেল প্রচুর প্রচুর বই। খুলে গেল পৃথিবীর জানালা।
এই পৃথিবীর মানচিত্রে অবশ্য নবদ্বীপ নেই। ১৪৬৮ সালে যখন রোমান টাইপ তৈরি হয়ে গেছে রোমের ভেনিসে, তখন নবদ্বীপের এক দরিদ্র গৃহে প্রদীপের আলোয় মহাভারতের আদিপর্ব কপি করছেন জগন্নাথ মিশ্র। অতীব সুন্দর তাঁর হস্তলিপি। যদিও বঙ্গসন্তানদের অনেকেই সংস্কৃত সাহিত্যে যথেষ্ট পণ্ডিত, তাঁদের হাতে-লেখা সংস্কৃত গ্রন্থে ভুলের সংখ্যা কম নয়। এ ব্রাহ্মণ দীন হলেও ব্যাকরণে প্রকৃত পণ্ডিত, এঁর নকল-করা বইটিতে একটিও ভুল নেই।
* * *
নবদ্বীপে হাজির হওয়ার পর প্রথম পূর্ণিমা, সন্ধ্যায় কেশব কাশ্মীরীকে দেখা গেল হস্তিপৃষ্ঠে, প্রয়াত জগন্নাথ মিশ্রের ছোট ছেলে নিমাইয়ের অস্থায়ী টোলের দিকে অগ্রসর হতে। গঙ্গার ধারেই নিমাইয়ের এই টোল। সেখানে সে তার নিজের শিষ্যদের ব্যাকরণের পাঠ দিচ্ছে। বৈকালী হাওয়া তরঙ্গ তুলেছে গঙ্গাবক্ষে। সূর্য ঢলে পড়ছে পশ্চিমে, তার আভায় পশ্চিম আকাশ ও গঙ্গাবক্ষ রক্তস্নাত। যে গাছের নীচে নিমাইয়ের টোল, তার অসংখ্য নীড়ে পাখিরা তাদের সারাদিনের বিহার সেরে ফিরতে শুরু করেছে। নিমাই এই ছাত্রদের পড়াচ্ছেন ধাতুরূপের আদিপাঠ। লট্ লোট্ লঙ্ বিধিলিঙ্ লৃট্। পরস্মৈপদী আত্মনেপদী।
- তাহলে, আমি যাই যেমন অহং গচ্ছামি, তেমনি একেই বলা যায় ময়া গম্যতে। বুঝলে তো?
- না, পণ্ডিতমশাই। গচ্ছামি গম্ ধাতুর পরস্মৈপদী লট্-এর উত্তমপুরুষের একবচন। গম্যতে আত্মনেপদী, কিন্তু উত্তমপুরুষ তো নয়, প্রথমপুরুষ একবচন।
- ঠিক। পরস্মৈপদীতে আমি উত্তমপুরুষ। আমি যাচ্ছি, তাই আমি এখানে কর্তা। কিন্তু আত্মনেপদী অর্থাৎ ভাববাচ্যে যেই বলছি আমার দ্বারা যাওয়া হচ্ছে – সেই কারণেই অস্মদ্ শব্দে করণকারকে এটা হচ্ছে তৃতীয়া বিভক্তি ময়া – অমনি কর্তা কিন্তু আর আমি নই। আমাকে কেউ চালনা করে নিয়ে যাচ্ছে। কে নিয়ে যাচ্ছে তা আমি জানি না, কিন্তু সেটা যেই হোক, সে প্রথমপুরুষ। তাই ধাতুরূপেও ওটা প্রথমপুরুষে গম্যতে হচ্ছে। বোঝা গেল?
- হাঁ, পণ্ডিতমশাই।
- এবার তাহলে বলো, তুমি ভাত খাচ্ছ, এটা এই দু রকম বাচ্যে কী হবে?
- পণ্ডিতমশাই, পরস্মৈপদী হলে হবে ত্বং অন্নং খাদসি, আত্মনেপদীতে ত্বয়া অন্নং খাদ্যতে।
- একদম ঠিক।
বলতে বলতে নিমাই আত্মস্থ হয়ে গেল। আমি যাচ্ছি – অহং গচ্ছামি। আমার যাওয়া হচ্ছে – ময়া গম্যতে। কে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে? কে? এর উত্তর অজানা থাকবে কেন? কে সেই প্রথম পুরুষ যে আমাকে, আমাদের সবাইকে, চালনা করছে? কে ইচ্ছা করছে বলেই আমি করতে পারছি? আমি কার ইচ্ছার অংশ? কে আমার হৃদয়ের সমস্ত আনন্দের উৎস?
মনে পড়ে গেল ঈশ্বরপুরীর কথা। ঈশ্বরপুরী নবদ্বীপে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন নবদ্বীপের গোপিনাথ আচার্যের ঘরে। সেখানে ঈশ্বরপুরীর সংস্কৃত রচনার ভুল ধরতে গিয়ে নিমাই প্রথম হৃদয়ঙ্গম করে এই পরস্মৈপদী-আত্মনেপদীর সম্পর্ক। গঙ্গাদাসের টোলের ছাত্র নিমাই এখন অনেক পরিণত।
কেশব কাশ্মীরী নিমাইয়ের কাছে এসে বললেন, আপনার নামই নিমাই? আমি শুনেছি নবদ্বীপের পণ্ডিতগণ একজন যুবককে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করেছেন তর্কযুদ্ধের জন্য। কিন্তু আমি যেমন ভেবেছিলাম, আপনি তো দেখছি তদপেক্ষা আরও অল্পবয়স্ক।
- আপনার অনুমান যথার্থ, পণ্ডিতমশাই। আমাকে আপনি আজ্ঞে করে লজ্জিত করবেন না, আমি আপনার তুলনায় সর্বাংশেই ছোট। তুমি বললেই বাধিত হব।
- নবদ্বীপের নাম শুনেছি অনেক, শুনেছি প্রাচ্যের জ্ঞানতীর্থ এই নবদ্বীপ। এতদিন কানে শুনেছিলাম, আজ স্বচক্ষে দেখে নিচ্ছি। আচ্ছা, এই জায়গার এমন অদ্ভুত নাম কেন?
- এর নাম নবদ্বীপ, গঙ্গাবক্ষে নয় দ্বীপের সমাহার। পূর্বমুখী গঙ্গা রাজমহল পাহাড় অতিক্রম করে দ্বিধারায় প্রবাহিত, যার দক্ষিণমুখী ধারাটি এই ভাগীরথী। স্বল্পগতি ভাগীরথীর বুকে তার চলার পথে এসে মিশেছে একাধিক নদনদী। পশ্চিম থেকে অজয় নামে এক নদ যেখানে এসে ভাগীরথীর সঙ্গে মিশল, তাদের মিলনস্থলের দক্ষিণে গড়ে উঠল কণ্টকদ্বীপ, এখন তাকে লোকে বলে কাটোয়া। গঙ্গা এখানে দক্ষিণ-পূর্ব অভিমুখী। কিছুদূর গিয়েই তার গতি এমন রুদ্ধ হয়, যে সে ক্রমাগত দিক পরিবর্তন করতে থাকে। ফলে গতিপথে তৈরি হয় একের পর এক দ্বীপ। এদের শুরুতেই অগ্রদ্বীপ। সেখান থেকে গঙ্গার দক্ষিণপথে ন’টা দ্বীপ নিয়ে আমাদের এই নবদ্বীপ। প্রথমে মধ্যদ্বীপ, যার এখন নাম মাজদিয়া। তারপর সীমন্তদ্বীপ, রুদ্রদ্বীপ, অন্তর্দ্বীপ, মোদ্রদ্রুমদ্বীপ। এই যে মায়াপুর গ্রাম দেখছেন, এ হচ্ছে এই মোদ্রদ্রুমদ্বীপের অন্তর্গত। এর পর জহ্নুদ্বীপ, লোকে বলে জাননগর। তারপর ঋতুদ্বীপ, গোদ্রুমদ্বীপ আর বোলদ্বীপ। এই নয় মিলে নবদ্বীপ। আরও দক্ষিণে গেলে আপনি পাবেন খড়্গদ্বীপ, যার এখন নাম খড়দহ আর শৃগালের বিচরণভূমি শৃগালদ্বীপ অর্থাৎ শিয়ালদহ।
- বাহ, অতি চমৎকার তোমার ব্যাখ্যা, বালক। কিন্তু এই মহান নবদ্বীপের এত নাম শুনে আমি এখানে এলাম, ভাবলাম এখানে পণ্ডিতদের সমাজে কিছু সময় তর্কযুদ্ধ করে অতিবাহিত করব, কিন্তু এখানে এসে থেকে অবধি কারও সাক্ষাৎ পাওয়াই ভার হয়ে উঠছে। আমার অনুচর বেশ কয়েকটা টোলে গিয়ে তর্কের আমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছে, কারও কাছ থেকে সাড়া পাচ্ছি না। শেষে আজ শুনলাম আমাকে নিমাই পণ্ডিতের সঙ্গে তর্ক করতে হবে। তুমিই সেই নিমাই পণ্ডিত! কিন্তু নাবালক, তোমার সঙ্গে আমি কী তর্ক করব? টোল খুলে বসেছ দেখছি, তোমার তো নিজের টোলে পাঠাভ্যাসের বয়স চলে যায়নি বলেই মনে হচ্ছে। তা কী বিষয়ে পাঠ দাও তোমার এই দুগ্ধপোষ্য শাবকদের?
- আমি ব্যাকরণচর্চা করি, পণ্ডিতমশাই।
- ব্যাকরণ! সে তো শিশুশাস্ত্র। ব্যাকরণে আছেই বা কী? তুমি কাব্য-অলঙ্কার-অনুপ্রাস-উৎপ্রেক্ষা এইসব সরস বিষয় কি কিছু কিছু জান?
- অতি সামান্য, পণ্ডিতমশাই। তবে আপনার সম্বন্ধে আমি শুনেছি। আপনি মস্ত কবি। স্বয়ং দেবী বীণাপাণি আপনার জিহ্বাগ্রে অবস্থান করেন।
- ঠিকই শুনেছ, বালক। এখানে আসার আগে আমি সমগ্র ভারতবর্ষ ভ্রমণ করে সমস্ত জ্ঞানকেন্দ্রের পণ্ডিতকুলকে পরাজিত করে এসেছি। সকলেই আমার কাব্যজ্ঞানে ধরাশায়ী।
- আমিও তা শুনেছি পণ্ডিতমশাই। আমি আপনার সেই কাব্যসুষমায় অবগাহন করতেই ইচ্ছা করি।
- তোমার বচন যে অতি মধুর, তা অবশ্য আমি স্বীকার করি। শুভ্রকান্তি অনিন্দ্যসুন্দর মুখ তোমার, আয়ত চক্ষুদুটি কৌতূহলী, অবাধ্য ভ্রমরকৃষ্ণ অলকগুচ্ছ হাওয়ায় উড়ছে – ঈশ্বর তোমায় যুবতী না বানিয়ে কেন যে যুবক করে বানালেন!
- আমাকে আর লজ্জা দেবেন না, পণ্ডিতমশাই। বরং আমরা আপনার শ্লোক শুনি।
- কী বিষয়ে শ্লোক শুনতে চাও, পুত্র? আমি এখনই মুখে মুখে কিছু রচনা করে শোনাই তোমাকে।
- দেখুন পতিতপাবনী গঙ্গা কুলকুল করে বয়ে চলেছে। আজ পূর্ণিমা। রাত্রে বড় চাঁদ শোভা পাবে আকাশে। আমরা আজ গঙ্গার মাহাত্ম্যই শ্রবণ করি আপনার মুখ থেকে।
- বেশ। আমি বলে যাচ্ছি, তুমি শুনে যাও। না বুঝতে পারলে প্রশ্ন কোরো।
- অবশ্য।
ঝড়ের বেগে এরপর একের পর এক তাৎক্ষণিক স্বরচিত শ্লোক আবৃত্তি করে যেতে লাগলেন কেশব কাশ্মীরী। কখনও তা গঙ্গোত্রী থেকে উৎসারিত খরস্রোতা ঝর্ণার মত শতধারায় তীব্রগতিতে প্রবহমান, কখনও সমতলে প্রবাহিত সুবিস্তৃত মন্দগতি। শ্লোকসমূহের রসের ভারে, শব্দচয়নের বৈচিত্র্যে, অলঙ্কার-অনুপ্রাসের ঝঙ্কারে এক অসামান্য আবহের সৃষ্টি হল। নিমাইয়ের শিষ্যরা মুগ্ধ, স্তব্ধ হয়ে তারা শুনতে লাগল পণ্ডিতের আবৃত্তি। নিমাইয়েরও চক্ষুদ্বয় নিমীলিত, সেও গ্রহণ করছে এই শ্লোকমালিকার রূপ-রস-গন্ধ।
পরিস্থিতি দেখে পণ্ডিতের মুখে ফুটে উঠল গর্বের হাসি। যেমন ঝড়ের বেগে শুরু করেছিলেন, তেমনই হঠাৎ শেষ করে নিমাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন – শুনলে? কেমন লাগল?
- অসাধারণ! অদ্ভুত! অনির্বচনীয়! অকল্পনীয়!
- ধন্যবাদ তোমাকে, বালক। তুমি কি সত্যিই বুঝে বলছ, নাকি এমনিই আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলে? ভারতের অন্যান্য প্রান্তে সকলেই আমার কবিত্বশক্তির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন যদিও, তোমার এই কচি মুখ থেকে শুনতে বড় মন্দ লাগছে না।
- এবার যদি আমাদের এই শ্লোকগুলো কিঞ্চিৎ ব্যাখ্যা করে শোনান।
- কয়েকশো শ্লোক বললাম তো। কোন শ্লোকের ব্যাখ্যা শুনতে চাও? অবশ্য কোন শ্লোক বলবেই বা কেমন করে? প্রথম শ্লোকে আমি বলেছিলাম –
- হ্যাঁ, প্রথম শ্লোকে আপনি বলেছিলেন –
মহত্ত্বং গঙ্গায়াঃ সততমিদমাভাতি নিতরাং।- তোমার পুরো শ্লোকটা মনে আছে? এ তো আমি এইমাত্র রচনা করলাম। এত দ্রুত আমি শ্লোক রচনা করে বলে গেলাম, তুমি এখনই এই শ্লোক কীভাবে হৃদয়ঙ্গম করলে? এ তো অবাক কাণ্ড।
যদেষা শ্রীবিষ্ণোশ্চরণকমলোৎপত্তি সুভগা।।
দ্বিতীয়-শ্রীলক্ষ্মীরিব সুরণরৈরর্চ্য চরণা।
ভবানীভর্ত্তুর্যা শিরসি বিভবত্যদ্ভুতগুণা।।
- আহা, ও কিছু নয়। আপনি কবি, মা সরস্বতীর প্রসাদলাভে ধন্য। আমি এত দ্রুত শ্লোক রচনা করতে পারব না। তবে আমি ইচ্ছা করলে মনে রাখতে পারি। সকলে তো কবি হতে পারে না, কেউ কেউ শ্রুতিধরও হয়।
- এই বয়সে এমন শ্রুতিধর আমি আগে দেখিনি। এই শ্লোকের বিষয়ে কী জানতে চাও বলো। অর্থ নিশ্চয় দুরূহ কিছু নয়। শ্রীবিষ্ণুর চরণকমল থেকে উৎপত্তি হওয়ায় যিনি সুভগা অর্থাৎ সৌভাগ্যবতী, দ্বিতীয় লক্ষ্মীর ন্যায় যার চরণ অর্চন করেন সুর ও নরগণ, ভবানী-ভর্তা তথা শিবের শিরে বিরাজিতা সেই অদ্ভুতগুণা গঙ্গার মহত্ত্ব সতত উজ্জ্বলভাবে প্রকাশ পাচ্ছে।
- সে তো বুঝলাম। এবার এই শ্লোকের গুণাগুণ বিচার করে যদি আমাদের বলেন।
- বালক, তোমার বাক্য তুমি সংশোধন করো। গুণাগুণ মানে গুণ এবং অগুণ, উভয়ই।
- আজ্ঞে উপমা, অনুপ্রাস, অলঙ্কার তো দেখতে পাচ্ছি। এগুলো এই শ্লোকের গুণ।
- ঠিক।
- এবার অগুণগুলো যদি চিহ্নিত করে দেন, তবে সুবিধা হয়।
- আমার শ্লোকে অগুণ? তুমি জান তুমি কার সঙ্গে কথা বলছ? সামান্য ব্যাকরণ পড়ে তুমি কাব্যে অগুণ বিচার করতে চাও? তাও যদি অলঙ্কার বুঝতে!
- অলঙ্কার তেমন পাঠ করিনি সত্য, কিন্তু এই শ্লোকে অগুণ নেই বলছেন? ঠিক আছে, আমি বলে যাচ্ছি, আপনি শ্রবণ করুন। এই যে শ্লোকটা, গঙ্গার মাহাত্ম্যই তো এর উপজীব্য। অথচ আপনি বললেন মহত্ত্বং গঙ্গায়াঃ সততম্ ইদম্। ইদম্ শব্দটা ব্যবহার করলেন পরে। আগে না বসালে যে বিধেয়াবিমর্ষ দোষ হয়, সেটা খেয়াল করলেন না। শুধু ওটাতেই নয়, দ্বিতীয়-শ্রীলক্ষ্মী সমাসবদ্ধ পদেও দ্বিতীয় শব্দের ব্যবহারে গঙ্গা যে লক্ষ্মীর মতন এই উপমার রসহানি হচ্ছে, এও ঐ বিধেয়াবিমর্ষ দোষ।
- হুম। অনবধানে হয়ে গেছে, মানছি। তবে এসব তুচ্ছ দোষ, পুত্র। অতি সামান্য।
- তুচ্ছ? অতি সামান্য? তবে বলি মহাদোষটি কোথায়। চতুর্থ চরণে যে ভবানীভর্ত্তুঃ বলছেন, ভবানী হচ্ছেন ভব অর্থাৎ শিবের গৃহিণী। তার ভর্তা বলতে শিবকেই বোঝাচ্ছেন এখানে। কিন্তু খেয়াল করেননি এইভাবে ঘুরিয়ে নাক দেখাতে গেলে অর্থ বদলে যায়। ভবানীভর্তা বললে সেটা ভবানীর দ্বিতীয় স্বামী বোঝায়, শিব নয়। এ হচ্ছে বিরুদ্ধমতি দোষ। অতি গুরুতর দোষ।
- বটে!
- আহা, ক্রুদ্ধ হবেন না। আমার কথা এখনও শেষ হয়নি। চতুর্থ চরণেই বলছেন শিরসি বিভবতি অদ্ভুতগুণা। বিভবতি ক্রিয়া দিয়ে বাক্য সম্পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পরও চলে এল একটা বিশেষণ – অদ্ভুতগুণা। পুনরুক্ত দোষ হল এতে। আবার দেখুন, চার চরণের এই শ্লোকে তিন চরণে অনুপ্রাস ব্যবহার করেছেন, এক চরণে অনুপ্রাস নেই। এ যে আপনার ক্রমভঙ্গ দোষ। উপমা অলঙ্কার অনুপ্রাস সব জায়গামত লাগিয়েও এই পঞ্চদোষ শ্লোকটার সমস্ত গুণের জাত মেরে দিল। আর এও হচ্ছে স্থূল বিচার। আমি এখনও সূক্ষ্ম বিচারে যাইনি। যদি চান তো সেটা করা যেতে পারে এবার।
কেশব কাশ্মীরী হতবাক হয়ে চেয়ে রইলেন নিমাইয়ের দিকে। তার মুখে কোন কথা নেই। দাম্ভিক পণ্ডিতের দম্ভ যেন এক লহমায় ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে এক বালক। এখন মুখ খুললেই মুশকিল। স্থূল বিচারেই এতগুলো দোষ, সূক্ষ্ম বিচারে না-জানি আরও কত দোষ ধরা পড়বে। হয়ত প্রমাণ করে ছাড়বে সমস্ত শ্লোকগুলোই ভুলে ভরা। এ কেমন বালক, এই বয়সেই এত সব জেনে বসে আছে! এতদিন ধরে ভারতবর্ষের এত জায়গায় তিনি ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে এসেছেন এত জ্ঞানী-গুণী পণ্ডিতদের, পারাবার পার হয়ে এসে শেষে এই বালকের মত গোষ্পদে তিনি ডুবে গেলেন! তাঁর গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোলো না। নির্বাক হয়ে নতমস্তকে বসে রইলেন তিনি।
নিমাইয়ের শিষ্যরা তাদের গুরুর এই জয়ে উল্লসিত। তারা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে মুখ চেপে চেপে হাসছে। সেদিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে নিমাই তাদের চুপ করিয়ে দিয়ে বলল, আমার দোষ নেবেন না পণ্ডিতমশাই। আপনি অসীম ক্ষমতার অধিকারী। যে দ্রুততায় আপনি ছন্দোবদ্ধ শ্লোক রচনা করতে সক্ষম, তা খুব কম কবিই আজ পর্যন্ত করতে পেরেছেন। আমি কবি কালিদাস-ভবভূতি প্রমুখের রচনা পড়েছি, জানি না তাঁরাও এত দ্রুত শ্লোক রচনা করতে পারতেন কিনা। অতি-সূক্ষ্ম বিচারে তাঁদের কাব্যেও কি কোন দোষ বেরোবে না? নিশ্চয় বেরোবে। কিন্তু তাতে তাদের কাব্যে রসহানি হয়নি। আপনিও তেমন শ্লোক নিশ্চয়ই রচনা করতে পারবেন। বাগদেবী আপনার সহায়।
বহুক্ষণ পরে কেশব কাশ্মীরীর মুখে কথা ফুটল। তিনি বললেন, আজ তুমি আমার চোখ খুলে দিলে, বালক। তুমি অসামান্য প্রতিভাশালী। আমার জীবনে তোমার মত এত অল্পবয়সে কারও মধ্যে আমি এই প্রতিভা দেখিনি। আমি পরাজয় মেনে নিচ্ছি।
নিমাই বলল, জ্ঞানসমুদ্রে জয়-পরাজয় তুচ্ছ, পণ্ডিতমশাই। সেই বিদ্যাই সার্থক যা মানুষকে বিনয়ী করে তোলে। তৃণের চেয়েও নীচে যখন মানুষ নিজেকে নিয়ে যেতে পারে, হতে পারে তরুর চেয়েও সহিষ্ণু, যাকে অন্য কেউ সম্মান করে না তাকেও মান দিতে শেখে, সেই প্রকৃত জ্ঞানী। আপনি সেই জ্ঞানের খোঁজ করুন, নিশ্চয়ই তার সন্ধান পাবেন।
নদের নিমাইয়ের কাছে কেশব কাশ্মীরীর পরাজয়ের খবর সমগ্র নবদ্বীপে ছড়িয়ে পড়ল দাবানলের মত। পণ্ডিতকুল সবাই নিমাইয়ের বাড়ি উপস্থিত হয়ে তাকে সমস্বরে ধন্য ধন্য করতে লাগল।
- তুই যে শুধু আমাদের মান বাঁচালি নিমাই, তা তো নয়, সমগ্র নবদ্বীপ তোর কীর্তির কথা চিরকাল মনে রাখবে। যেভাবে তুই তর্কে পরাজিত করলি ঐ সবজান্তা পণ্ডিতকে, আমরা ভয়ে যার কাছে ঘেঁষতেই সাহস করছিলাম না, তা অকল্পনীয়। আজ থেকে তোকে আমরা ডাকব ‘বাদীসিংহ’ নামে।
পণ্ডিতকুল বিদায় নিতেই নিমাই ঘরের মধ্যে গিয়ে চেঁচিয়ে বলল, খুব খিদে পেয়েছে মা, খেতে দাও।
পুত্রের গৌরবে শচীর আজ গর্বের শেষ নেই। তিনি আজ রান্না করেছেন নিমাইয়ের প্রিয় পদগুলি। কলার পাতায় ভাতের ওপর হলুদ সুগন্ধী গাওয়া ঘি ঢেলে দিলেন, সে ঘি গড়িয়ে পড়ল পাতের বাইরে। স্ত্রী লক্ষ্মীদেবী কেয়াপাতার ডোঙা বানিয়ে তাতে থরে থরে সাজিয়ে দিল ব্যঞ্জন। দশ রকমের শাক, নিম-বেগুন, শুক্তো, গোলমরিচের ঝাল, ছানার বড়া, বড়ির তরকারি, দইয়ের ঘোল, দুধ দিয়ে লাউয়ের পায়েস, কুমড়োর ছেঁচকি, বাটা মশলা দিয়ে রান্না করা লাবড়া। নিমাই মোচা খেতে খুব ভালবাসে, তাই মোচার ঘন্ট, মোচাভাজা।
সবগুলো খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে নিমাই মাকে বলল, মা, তুমি যে একদিন আমাকে বলছিলে ঠাকুরদাদার ওখানে আমার একবার যাওয়া উচিত, সেখানে নাকি আমাদের জমিজমা কিছু আছে, আমি তাহলে সেখান থেকে ঘুরে আসি কিছু মাসের জন্যে?
শচী অবাক হলেন – এ যে ভূতের মুখে রামনাম! বিয়ের পর থেকে ছেলের মন বদলেছে সত্যি, এখন আর কথায় কথায় হুজ্জুতি করে না।
* * *
নিমাইয়ের বাবা জগন্নাথ মিশ্র ছিলেন বৈদিক ব্রাহ্মণ। তাঁর পূর্বপুরুষরা উড়িষ্যা থেকে পূর্বে শ্রীহট্টের হবিগঞ্জ-গোলাপগঞ্জে বসতি স্থাপন করেছিলেন। প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ হাবিবুল্লার নামে হাবিবগঞ্জ, যা পরে হবিগঞ্জ নামে পরিচিত হয়। মহাভারতের দুর্যোধনের স্ত্রী ছিলেন হবিগঞ্জের মেয়ে। সতীর বাহান্ন পীঠের দু দুখানা শ্রীহট্ট এলাকায় – শ্রীশৈল আর জয়ন্তীতে সতীর যথাক্রমে ঘাড় আর বাঁহাতের তালু পড়েছিল। অতীতে শ্রীহট্ট ছিল কামরূপ ও হরিকেলের ব্রাহ্মণ-অধ্যুষিত এলাকা। প্রথম সহস্রাব্দীতে এখানে বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটলেও পরে সেন ও দেববংশের রাজত্বকালে ব্রাহ্মণদের রমরমা ফিরে আসে।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়ায় বখতিয়ার খিলজিকে দিয়ে বাংলায় মুসলমান অনুপ্রবেশ শুরু হয়, বাংলার মসনদে বসেন মুসলমান সুলতান। শ্রীহট্ট আরও একশো বছর হিন্দু রাজার অধীনে ছিল। চতুর্দশ শতাব্দীর শুরুতে শ্রীহট্টের রাজা ছিলেন গৌরগোবিন্দ। ততদিনে অবশ্য প্রজাদের মধ্যে বাংলার তদানীন্তন সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শার প্রভাবে কিছু কিছু মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেছে। বুরহানুদ্দিন নামে শ্রীহট্টের এক মুসলমান তার পুত্রের জন্মদিন উপলক্ষ্যে প্রকাশ্যে গোরু জবাই করলে গৌরগোবিন্দ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে রাগের মাথায় শিশুটিকে হত্যা করেন, বুরহানুদ্দিনের ডান হাতও কেটে ফেলেন। ফলে ধর্মীয় অসন্তোষ সৃষ্টি হয়, যার জেরে বাংলার সুলতান ফিরোজ শাহ ভাইপো সিকন্দর খানকে শ্রীহট্ট আক্রমণ করতে পাঠান।
শ্রীহট্টে মুসলমান ধর্ম প্রচার করছিলেন হজরত শাহ জালাল নামে এক পরিব্রাজক তুর্কি সুফিসাধক। মামা শেখ কবীর তার হাতে একমুঠো মাটি দিয়ে বলেছিলেন, ঠিক ঐ রকম মাটি আছে পুবদেশের কোনো এক অঞ্চলে, সে যেন খুঁজে খুঁজে সেই অঞ্চলে গিয়ে সেখানে মুসলমান ধর্ম প্রচার করে। শাহ জালাল পুবদিকে যাত্রা শুরু করে শ্রীহট্টে পৌঁছান ও স্থানীয় পণ্ডিতদের তর্কে পরাজিত করে খুব কম সময়েই তিনি সেখানে জনপ্রিয় হয়ে যান। এক পর্বতের গুহায় মসজিদ বানিয়ে শুরু হয় তার শ্রীহট্ট-জীবন।
সিকন্দর খান দু দুবার শ্রীহট্ট আক্রমণ করেও সুবিধে করতে পারলেন না। তার সেনারা শ্রীহট্টের ভৌগোলিক এলাকার খবর রাখে না। গৌরগোবিন্দের রণকৌশলও ভিন্ন, পাহাড়ি গেরিলাদের মত। ফলে তাদের সেনাদের খোঁজ পেতেই নাকানিচুবানি খেয়ে পরাস্ত হল সিকন্দরের সেনা। ১৩০৩ সালে তৃতীয়বার শ্রীহট্ট আক্রমণ করলেন শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ। এবার আর ভাইপো নয়, পাঠালেন নিজের বিশ্বস্ত সিপাহসালার সৈয়দ নাসিরুদ্দিনকে। সেই সঙ্গে নির্দেশ গেল শাহ জালালের কাছে, হিন্দুরাজার বিরুদ্ধে তিনি যেন তার অনুচরদের কাজে লাগিয়ে বাংলার সুলতানকে সাহায্য করেন। শাহ জালালের তিনশো ষাটজন অনুচর স্থানীয় রাজা গৌরগোবিন্দের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিল।
বুরহানুদ্দিনের দেখিয়ে দেওয়া পথে বরাক নদীর ধারে পৌঁছে গেল সৈয়দ নাসিরুদ্দিনের সুলতানী সেনা। গেরিলা যুদ্ধের সুযোগ পেলেন না গৌরগোবিন্দ, যেহেতু পেছন থেকে শাহ জালালের অনুচরেরা তার সৈন্যদের বধ করতে লাগল। বাধ্য হয়ে শ্রীহট্ট ছেড়ে পালালেন গৌরগোবিন্দ। শ্রীহট্ট বাংলার সুলতানের অধীনে এসে গেল। শাহ জালাল তার সুফি আলখাল্লার গহ্বর থেকে মামার দেওয়া মাটি বের করে দেখলেন, শ্রীহট্টের মাটি আর সেই মাটি একই রকম। সেখানেই পাকাপাকি আস্তানা গাড়লেন তিনি। দলে দলে মানুষ তার কাছে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করতে লাগল।
শ্রীহট্ট দখল করার ঠিক পাঁচ বছর আগে বাংলার সুলতানের অধীনে এসেছিল সাতগাঁও। শ্রীহট্ট দখলের পরের বছর তারা দখল করল সোনারগাঁও। যদিও ১২৭২ সাল অবধি চট্টগ্রামের এক অংশ আরাকানের অধীনে ছিল, ১৩৩৮ সালে সুলতান ফকরুদ্দিন মুবারক শাহ জলপথে আরাকান আক্রমণ করে পুরো চট্টগ্রামকেই বাংলার অধীনে এনে ফেললেন।
আরাকান শব্দটা স্থানীয় ভাষায় আরখাং বা রাখাং-এর বিকৃত রূপ। ভারতের দক্ষিণতম অংশের পশ্চিম উপকূলে কেরালা যেমন এক সরু ফালি রাজ্য, ব্রহ্মদেশের (বার্মার, অধুনা মায়ানমারের) দক্ষিণের অনুরূপ অংশ হচ্ছে আরাকান। উত্তর-দক্ষিণে মোটামুটি সাড়ে ছশো কিলোমিটার, পুব-পশ্চিমে দেড়শো। কেরালার পুবদিকে যেমন পশ্চিমঘাট পর্বত, আরাকানের তেমনি ইয়োমা পাহাড় ব্রহ্মদেশের বাকি অংশের সঙ্গে আরাকানকে আলাদা করে রেখেছে। এর অধিবাসীদের বলা হয় রোহিঙ্গা বা মগ। এদের প্রকৃতি সাধারণ ব্রহ্মদেশীয়দের মত নয় আদৌ।
ফকরুদ্দিনের চট্টগ্রাম দখলের পরও অবশ্য বাংলার সঙ্গে আরাকানের সম্পর্কের বিশেষ অবনতি হয়নি। বাংলার সুলতান শক্তিশালী, সুতরাং প্রতিবেশী ব্রহ্মদেশ, ত্রিপুরা ও শান রাজ্যের থেকে সুরক্ষা পেতে বাংলার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখাই তাদের বেশি গ্রহণীয় মনে হয়েছিল। দু’ দেশের মধ্যে উপঢৌকন আদান-প্রদানও চলছিল। কিন্তু ১৪০৬ সালে ব্রহ্মদেশের রাজা মেং খামং আরাকান আক্রমণ করলে আরাকানের রাজা মিন সমোন পালিয়ে বাংলার রাজধানী গৌড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। গৌড়ে তখন রাজত্ব করছেন সুলতান গিয়াসুদ্দন আজম শাহ। চব্বিশ বছর তিনি গৌড়ে নির্বাসিত হয়ে থাকেন। সেই সময় অবশ্য জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শার্কি গৌড় আক্রমণ করলে মিন সমোন গৌড়ের তখনকার সুলতান জালালুদ্দিন মহম্মদ শাহকে প্রয়োজনীয় সাহায্য করেছিলেন। তাতে খুশি হয়ে বাংলার সুলতান ওয়ালি খান আর সিদি খানের নেতৃত্বে দুই বিশাল সেনাবাহিনী পর পর আরাকানে পাঠিয়ে ব্রহ্মদেশের সেনাদের পরাজিত করে মিন সমোনকে আরাকানের গদিতে পুনর্বহাল করেন। মিন সমোন তার পুরনো রাজধানী লঙ্গিয়েৎ ছেড়ে ম্রকিউতে নতুন রাজধানী পত্তন করেন।
পৃথিবীর তখনকার ইতিহাসে পার্শ্ববর্তী রাজ্যকে এ রকম সাহায্য করা এক বিরল ঘটনা। বাংলা আর আরাকানের মধ্যে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয় এর পর থেকে। বলতে গেলে আরাকান বাংলারই অধীন এক রাজ্য হিসাবে চলতে থাকে। তাদের মুদ্রার নাম হয় টাকা। তাদের রাজা বাংলার শাসকের মত কেবল বাদশাহ উপাধিই নয়, নিজস্ব আরাকানি নামের সঙ্গে একটা করে মুসলমান নামও গ্রহণ করে। মিন সমোনের নাম হয় সুলেমান শাহ, তার পর একে একে রাজা হয় মেং খারি তথা আলি শাহ, বাসপ্যু তথা কলিমা শাহ, ইত্যাদি।
১৪৩৪ সালে মিন সমোন তথা সুলেমান শাহের মৃত্যুর পর পরই অবশ্য বাংলা-আরাকান সম্পর্কের অবনতি ঘটে। আরাকানের পরবর্তী শাসকরা উচ্চাশাগ্রস্ত হয়ে বাংলার কর্তৃত্ব মানতে অস্বীকার করে। প্রতিবেশী দেশের শাসকের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরার ওপর চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালিয়ে কিছু কিছু অংশ ছিনিয়ে নেয়। হাবসি সুলতান বরবক শাহের সময় কলিমা শাহ চট্টগ্রাম অধিকার করে। যুদ্ধবাজ জাতি হিসাবে আরাকানিদের বদনাম ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমে ক্রমে চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে ত্রিপুরায় ও সুযোগ পেলে ত্রিপুরা পেরিয়ে শ্রীহট্টেও আরাকানি অনুপ্রবেশ ও লুঠতরাজ চালু হয়ে যায়। শাসকের অব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে যে ভূখণ্ডে রাহাজানি চালানো সম্ভব, তার সমার্থক শব্দ হিসাবে ব্যবহৃত হতে থাকে ‘মগের মুলুক’।
স্থানীয় অবস্থার অবনতি, বিদ্যাচর্চা ও গঙ্গাতীরে তুলনামূলকভাবে অধিকতর যজমান লাভের আশায় শ্রীহট্টের হবিগঞ্জ থেকে বাসস্থানের পাট গুটিয়ে জগন্নাথ মিশ্র উঠে এলেন নবদ্বীপে। শ্রীহট্ট থেকেই নবদ্বীপে উঠে-আসা ব্রাহ্মণ নীলাম্বর চক্রবর্তীর ছোটখাট চেহারার নম্রস্বভাবা কন্যা শচীর পাণিগ্রহণ করলেন তিনি। জগন্নাথের অন্যান্য আত্মীয়পরিজন অবশ্য রয়ে গেলেন শ্রীহট্টেই। বসতবাটি ও জমিজমা পড়ে থাকল তাদের তত্ত্বাবধানে।
এই জমিজমা থেকে বেশ আয়ের ব্যবস্থা ছিল নবদ্বীপে চলে যাওয়ার আগে। তার সুষ্ঠু বিলিব্যবস্থা করতে পারলে এখনও কিছু অর্থ হাতে পাওয়া যায়। পিতার মৃত্যুর পর তার পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব নিমাইয়ের ওপর, পৈতৃক সম্পত্তির কিছু উদ্ধার করতে পারলে অবস্থার কিছু সুরাহা হয়।
সেই উদ্দেশ্যেই একদিন সকাল সকাল নিমাই পাড়ি দিল পুবদেশে।