• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৯ | জুলাই ২০২০ | উপন্যাস
    Share
  • হারাধন টোটোওয়ালা (৮) : সাবর্ণি চক্রবর্তী



    ।। ৯ ।।

    ।। আরও কিছু পুরোনো কথা ।।

    ইভাবে শুরু হয়েছিল ভীম আর ভূতনির দৈহিক সম্পর্ক, বলতে গেলে নিতান্ত আকস্মিকভাবে। তারপরে এই দেখাশোনা, এই সম্পর্ক হয়ে ওঠে নিয়মিত, দৈনন্দিন। একটা সুবিধে ছিল। এ জাতীয় দেখাশোনার জন্যে একটি নির্জন জায়গার প্রয়োজন ছিল, আর নির্জনতার জন্যে চৌধুরিপুকুরের চেয়ে ভাল জায়গা আর কিছু ছিল না। মেনকা খুশি — ছেলে আজকাল আর ঐ সব বখা বন্ধুদের সঙ্গে বেশিক্ষণ কাটায় না। সকালের দিকে অবশ্য একবার আড্ডা মারতে বেরোয়, কিন্তু ও বেলায় সন্ধে থাকতেই বাড়ি চলে আসে। ছেলের এই পরিবর্তন দেখে নিজের বাক্সের তালাটা পর্যন্ত বদলায় নি মেনকা। বাক্সের টাকা আর বিশেষ খোয়া যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। এই খুশির জেরে ছেলের হাতখরচা বাড়িয়ে দিয়েছে মেনকা। মনে মনে নিজেকে তারিফ করেছে সেদিন ছেলেকে শাসন করার জন্যে। ঐ লাঠির ঘায়ে বিষধর সাপ পর্যন্ত ঢিট হয়ে যায়, আর একটি সবে গোঁপদাড়ি বেরোন ছেলের কতগুলো কুপ্রবৃত্তি বাপ বাপ বলে ভাগবে, এ আর বেশি কথা কি?

    ভীম আর ভূতনির গোপন ঘনিষ্ঠতা নিয়ে অবশ্য গাঁয়ে কানাকানি শুরু হতে খুব একটা সময় লাগে নি। এসব ব্যাপারে গাঁয়ের লোকের তো বটেই, গাছপালারও চোখ কান একেবারে খোলা। চিত্ত বাউরির কানে ফিসফিস করে খবর আসতে থাকে — তোমার বোন কিন্তু মেনকা মাগিটার ছেলের সঙ্গে আশনাই করছে। চিত্ত চোখ কান দুই-ই বন্ধ করে থাকে। ভূতনি এখন চিত্তকে টাকা দেয়, সে টাকায় চিত্ত হাঁড়ি হাঁড়ি দেশি মদ খায়, মাছ মাংসের খানা খায়। বোন রোজগার করে এনে দাদার হাতে টাকা তুলে দিচ্ছে, সেটাই বড় কথা, কি করে রোজগার করছে সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কি দরকার? ভীমের হাতখরচার সব টাকা এখন যায় ভূতনির কাছে। ভূতনি দেখতে খারাপ, তায় আবার আধবুড়ি — কিন্তু ও তিন তিনটে পুরুষ ঘেঁটেছে, পুরুষকে খেলাবার কায়দাকানুন ওর খুব ভালই জানা আছে। নানা ছুতোয় ও প্রায়ই ভীমের থেকে টাকা নেয়। ওর খাঁই মেটাতে ভীমকে মাঝে মাঝে মায়ের বাক্সেও হাত লাগাতে হয় — তবে পরিমাণটা আগের চাইতে কম বলে মা টের পায় না। টাকা না দিয়ে ভীমের উপায় নেই — ও এখন একটা মাদী সাপের মুখে আটকানো একটা পুরুষ ব্যাঙ — সাপটা একবারে ব্যাঙটাকে গিলছে না, সময় নিয়ে একটু একটু করে ব্যাঙটাকে জীর্ণ করে ফেলছে। তবে মেনকার কানে এ কথাটা ওঠে নি। ওর কাছে এসে এ সম্বন্ধে সাহস করে কিছু বলতে যাবে কে — মাগি যা দজ্জাল। তাছাড়া এসব কুৎসা কেলেঙ্কারি মেয়েদের নামেই বেশি রটে, ছেলেরা একটু এদিক ওদিক করলে লোকে তা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না। গাঁয়ের মেয়েরাই কেচ্ছা করে বেশি — এই শুনেছিস ভূতনির কথা? মাগি এবার সাঙা না করেই পীরিত শুরু করেছে। কার সঙ্গে রে? লোকটা কে? ও-ও, মেনকার ছেলেটা — আর ও তো ভূতনির ছেলের বয়েসী। তাতে কি, ভূতনির তো একটা তাগড়া ছেলে পেলেই হল — ইসস্‌, ছোকরার মাথাটা একেবারে চিবিয়ে খাচ্ছে গা — মেনকা ছেলের বিয়ে দিয়ে দেয় না কেন? ও মাগি খালি বাগান করে পয়সা করছে — এত পয়সা কি সঙ্গে করে চিতায় নিয়ে যাবি?

    খবরের হাঁড়িটা জোরালো হয়ে ভাঙল কয়েকমাস পরে। ভূতনির পেট তখন বেশ ফুলে উঠেছে — সেদিকে তাকালেই বোঝা যায় মেনকার নাতি সেখানে বহাল তবিয়তে বড় হয়ে উঠছে। খবরটার ধাক্কায় মেনকা প্রথমে একেবারে জবুথবু হয়ে পড়েছিল। সাপ তাড়ানো লাঠি দিয়ে যে ছেলেকে পেটানো দরকার সে কথাও মনে আসে নি। শেষকালে কিনা মেনকার নাতি ভূতনি বাউরির পেটে। এর চাইতে ভীম তো বাজারের মেয়েদের কাছে গেলেও পারত। কি আর হত, বড় জোর কোন অসুখবিসুখ করত, তা সে অসুখের জন্যে মেনকা না হয় চিকিৎসা করাত। কিন্তু ভূতনি! ভীমের এই রকম রুচি হল শেষে?

    মেনকা কমলাকে চেপে ধরেছিল। তুই নিশ্চয়ই জানতিস্‌ — আমাকে আগে বলিস নি কেন? কমলা জানত ঠিকই — গাঁয়ের গুজব ওর কানে এসেছিল। কিন্তু ও কি আর সে কথা স্বীকার করে? উল্টে মেনকার ওপর চেঁচিয়েছিল — আমি ওসব কোথা থেকে জানব — হ্যাঁ? সারাদিন তোমার বাড়িতে খেটে খেটে আমার হাড় কালি হয়ে গেল — আমার ওসব কথায় কান পাতবার সময় আছে? আর আমার কথায় যদি তোমার বিশ্বাস না থাকে তাহলে আমাকে জবাব দাও, আমি আমার ঘরে ফিরে যাই।

    মেনকা চুপ করে গিয়েছিল। কমলা ওর বাড়ির কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেলে ও বিপদে পড়ে যাবে। ঘরের কাজ সামলে বাগানের দেখাশোনা করা প্রায় অসম্ভব — মেনকা আর কমলাকে ঘাঁটায়নি।

    মেনকার এই দুর্দশায় গাঁয়ের লোক অনেকেই বেশ খুশি হয়েছিল। জাঁহাবাজ বেওয়া মাগি, পয়সার জোরে কাউকে পরোয়া করে না — এবার মোক্ষম কাদায় পড়েছে। চিত্ত বাউরির বোনকে এবার ঢাক ঢোল বাজিয়ে ছেলের বৌ করে ঘরে তুলতে হবে — মাগির আর কোন উপায় নেই। গাঁয়ের দীনু গাঙ্গুলির ছেলে আইন পাশ করে সদরে উকিল, সেই সুবাদে দীনু গাঁয়ের লোকদের প্রায়ই দুটো চারটে আইনের কথা শোনায়। সেরকম কোন আইন দেশে আদৌ আছে কিনা তা নিয়ে দীনুর কোন মাথাব্যাথা নেই — গাঁয়ের লোক তো আর দীনুর কথার সত্যিমিথ্যে যাচাই করতে যাবে না। এইসব আইনের বুলি কপচানোর জন্যে লোকে দীনুকে ভয় আর সমীহ দুই-ই করত। একমাত্র মেনকা ছাড়া। ও কখনো দীনুকে কোনরকম খাতির করে নি। সেজন্যে দীনুর মেনকার ওপর রাগ ছিল। কুচক্রী ব্রাহ্মণ দেখল এই মওকা — মেনকাকে বেশ ভালরকম জব্দ করার একটা রাস্তা পাওয়া গিয়েছে। সে গিয়ে চিত্তকে বলল, তুই এবার তোর বোনকে দিয়ে পুলিশ থানায় নালিশ করা। মেনকার ছেলে তোর বোনের ওপর পাশবিক অত্যাচার করেছে — পেটে বাচ্চাও করে দিয়েছে। পুলিশ এসে ওর ছেলেকে গ্রেপ্তার করবে, কোমরে দড়ি বেঁধে হাজতে নিয়ে যাবে। কড়া সাজা দেবে জজসাহেব, অন্তত দশটি বছর জেলের ঘানি টানতে হবে ভীম বাবাজিকে।

    শয়তানি বুদ্ধিতে চিত্ত-ও কিছু কম যায় না। ও চুপ করে দীনুর কথা শুনে নিল, কয়েকবার খালি হা হুঁ করল। মেনকা ঠাকরুণের ছেলেকে জেলে পাঠিয়ে ওর কি লাভটা হবে? তাহলে ওর তাড়ির টাকা, ভালমন্দ দুটো খাওয়ার খরচা, সে সব আর আসবে কোথা থেকে? ও গেল মেনকার কাছে। একগাল হাসল, মুখ থেকে তাড়ির গন্ধ বেরিয়ে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল। গলগল করে বলে ফেলল দীনু গাঙ্গুলি ওকে কি বুদ্ধি দিয়েছে। তবে কায়দা করে এটা বলতেও ভুলল না যে দীনুর পরামর্শ ও কাজে লাগাবে না। কিন্তু চিত্ত কত গরীব, খেতে পায় না, আর মেনকাঠাকরুণের ওপর লক্ষ্মীদেবী কত সদয় — মেনকাঠাকরুণ কি একটু দয়া দাক্ষিণ্য করবে না চিত্তকে? কত বড় ঘরের মেয়ে মেনকাঠাকরুণ, সেই লক্ষণবাবু জমিদারের রক্ত তার গায়ে, সে কি একটু করুণার চোখে তাকাবে না এই হতভাগা চিত্ত বাউরির দিকে?

    মেনকা শান্ত ভাবেই চিত্তর বকবকানি শুনছিল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে রাগে জ্বলে যাচ্ছিল। খ্যাংরা ঝাঁটাপেটা করে চিত্তকে ভাগাবার একটা প্রবল ইচ্ছে হচ্ছিল। সেই সঙ্গে ওই বদমাশ বামুনটার বাড়ি গিয়ে ওকে পিটিয়ে আসবার ইচ্ছেটাও মাথাচাড়া দিতে চাইছিল। কিন্তু নিজেকে ঠান্ডা রাখল মেনকা। এটা মাথা গরম করার সময় নয়। এখন ওর একটা অবাঞ্ছিত বংশধর গোকুলে অর্থাৎ চিত্ত বাউরির বোনের গর্ভে দ্রুত বাড়ছে, এর পরিণাম যে কি হতে পারে সেটা এখনও জানা নেই। দীনুর আবার একটা উকীল ছেলে আছে। যদিও ওর বিশেষ মক্কেল টক্কেল হয় না, তবু আইন যখন পাশ করেছে ও চিত্তকে দিয়ে ভীমকে একটা কোন আইনের প্যাঁচে ফেলে দিতে পারে। আর সব প্যাঁচ খোলে কিন্তু আইনের প্যাঁচ কখনো খোলে না একথা কে না জানে। অতএব মেনকা সমঝদারের কাজ করল — ঘরে ঢুকে বাক্স থেকে টাকা বার করে এনে চিত্তর হাতে দিল। আগুনে আপাতত তো একটু শান্তির জল পড়ুক। মুখে বলল, বাবা চিত্ত, এখন তোমার আমার দুজনেরই একটু মুস্কিলের সময় পড়েছে — এখন চুপচাপ থাকো, কারোর কোন শয়তানি কথাবার্তায় কান দিও না। পুলিশ কাচারি করতে যেয়ো না, তাহলে পুলিশ রোজ এসে তোমাকেও হেনস্থা করবে — তুমিই বিপদে পড়ে যাবে। আমিও কটা দিন একটু ভেবেচিন্তে নি, তারপর একটা উপায় বার করা যাবে।

    টাকার তাড়াটা হাতে ধরে চিত্ত মেনকার কথা শুনছিল। এবার ও টাকাগুলো গুনল, মেনকার সামনেই। টাকার অঙ্কটা বোধহয় ওর পছন্দ হয়েছিল, কারণ গোনা শেষ করে ও একগাল হাসল। ওর মুখ থেকে বেরোন মদের গন্ধে মেনকার বমি আসছিল, এক পা পিছিয়ে দাঁড়াল মেনকা। সেটা না দেখার ভান করে চিত্ত ভূমিষ্ঠ হয়ে মেনকাকে প্রণাম করল। বলল, হ্যাঁ গো ঠাকরুণ, আপনি যা বলবেন, আমি তাই করব, আপনার বুদ্ধিতেই আমি চলব। খালি এই গরীবের ওপর আপনার একটুকুন করুণার দিষ্টি রাখবেন যাতে আমার ঘরের পোড়া পেটগুলোতে দুটো অন্ন দিতে পারি।

    একটু থেমে আবার বলল, আপনার নাতিকে গভ্যে ধারণ করা ইস্তক আমার হতভাগী বুনটার রাক্ষসীর খিদে হয়েছে — দিনরাত খাই খাই করছে। আমি ওকে বলি, আমি গরীব মানুষ, কোথা থেকে তোকে অত খাওয়াব তোর শাউড়ি ঠাকরুণ সাহায্য না করলে?

    আবার একটা রাগের দমক, কিন্তু ঢোঁক গিলে সেটাকে গিলে নিল মেনকা।

    মেনকার পায়ের ধুলো নিয়ে নিজের জিভে ঠেকাল চিত্ত। একটা শয়তানি হাসি দিয়ে বলল, আজ বিদেয় হলাম মা ঠাকরুণ, পরে আবার আপনার দর্শন পেতে আসব। তারপর উঠোন পার হয়ে ফটক দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে গাঁয়ের রাস্তায় উঠল। যতদূর ওকে দেখা গেল মেনকা বাঘিনীর চোখে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। ওর দুহাত বাঁধা পড়েছে, কিছু করার নেই। কিন্তু সত্যিই কি কিছু করার নেই?

    সেদিনই থানায় গেল মেনকা। সঙ্গে ওর বাগানের একজন মজুর। তার মাথায় ফল পাকুড়ে ভর্তি একটা বিরাট বড় ঝুড়ি। থানার বাবুদের পরামর্শ নিতে হবে। চুপিচুপি।

    কিন্তু বিশেষ সুবিধের পরামর্শ পেল না মেনকা। বিটলে দীনু যা বলেছে তা ঠিক, এসব ব্যাপারে আজকাল আইন বেজায় কড়া। কোন নালিশ টালিশ হলে বেদম বিপদে পড়বে ভীম। সাজা হবেই, আর কড়া সাজা হবে। সবচেয়ে ভাল হবে — মেনকা ভীমকে গাঁয়ের লোকের চোখের আড়ালে কোথাও পাঠিয়ে দিক। কেউ যেন জানতে না পারে ভীম কোথায় আছে। রটিয়ে দিতে হবে ভীম নিরুদ্দেশ, বিবাগী সাধু হয়ে কোথায় চলে গিয়েছে কেউ তা জানে না। নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে আইন আর তাকে পাবে কোথায়? বড়জোর হাত উল্টে বলবে, আসামীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না — বিলকুল লা-পতা। তবে চিত্ত বাউরি আর তার বোনকে ঠান্ডা রাখার দরকার। চিত্তকে নিয়মিত টাকা খাইয়ে যেতে হবে — উপায় নেই। আর ভূতনির পেটেরটা? মেয়েটার নাকি খালি গর্ভপাত হয়? নয়তো মরা বাচ্চা হয়? সেরকম যদি হয় তাহলে তো সে ঝামেলাটা মিটেই গেল।

    নিঃশ্বাস ফেলে ফিরে এল মেনকা। বাড়ি ফিরে এক গেলাস জল খেয়ে নিয়ে সোজা বিছানায় শুয়ে পড়ল। ক্লান্তিটা শারীরিক নয়, মানসিক। থানার বাবুদের সঙ্গে কথা বলে ও বড়ই হতাশ হয়েছে। চিত্ত হারামজাদা কত বছর বাঁচবে তার ঠিক নেই — ততদিন ওকে টাকা খাইয়ে যেতে হবে? আর ভূতনির পেটেরটা? ওটার একটা ব্যবস্থা কি করা যায় না? খুব গোপনে, কেউ যাতে টের না পায় কি করে ভূতনির পেট খালাস হল। কিন্তু চিত্ত আর তার বৌটাকে দলে টানতে হবে। ওরা রাজী হবে কী? তার জন্যে আবার চিত্ত কত টাকা দম দিয়ে বাগিয়ে নেবে কে জানে।

    আর ভীম — হতভাগা ছেলেটা। ওকে এই গাঁ থেকে একেবারে পাচার করে দিতে হবে। কিন্তু সেটা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে মেনকার। শত হলেও নিজের নাড়ী কাটা ছেলে। আর একটাই ছেলে। ওকে দিনের মধ্যে কখনও একটু চোখের দেখাও দেখা যাবে না?

    নিজেকে শক্ত করল মেনকা। ছেলের মঙ্গলের জন্যেই ওকে দূরে, চোখের আড়ালে পাঠিয়ে দিতে হবে। সেকালে তো লোকে বাণিজ্য করতেও দূর দূর দেশে যেত — বছরের পর বছর তাদের কোন খবর পাওয়া যেত না। তাদের মায়েরা কি বুক বেঁধে থাকত না? তাহলে?

    ঠিক করে ফেলল মেনকা। ভীমকে কলকাতায় পাঠাবে। ওখানে রয়েছে ভৈরব মাল, কোন্‌ একটা কারখানায় কাজ করে। ও ভীমের বাপের খুব চেনা ছিল, সেই সুবাদে মেনকাও ওকে ভাল চেনে। মেনকা ওর ঠিকানাও জানে। ভীম গিয়ে এখন ওখানেই থাকতে পারে। ভৈরবকে খবরটা পাঠাতে হবে। ভীম কেন গাঁয়ে ফিরবে না তার একটা অবশ্য কিছু অজুহাতও দিতে হবে। একটা চিঠি পাঠিয়ে দিলেই চলবে। আর হ্যাঁ, সেই সঙ্গে বেশ কিছু টাকা। নইলে ভৈরব থাকতে দেবে কেন? ভৈরব এ গাঁয়ের লোক নয়, এ গাঁয়ের কাউকে ও চেনেও না। কাজেই ওর থেকে খবরটা এখানে চাউর হবে না।

    বিছানা ছেড়ে উঠল মেনকা। হাতে অনেক কাজ। পস্ট আপিসে যেতে হবে, ইস্ট্যাম্প কিনতে হবে। বাজার থেকে কাগজ, খাম এসবও কিনতে হবে। বাড়িতে কালি আর কলম ছাড়া আর কিছু নেই।


    ।। ১০ ।।

    (আরও কিছু পুরনো কথার অনুবৃত্তি)


    তএব ভীম গেল বনবাসে, অর্থাৎ কলকাতাবাসে। তবে একটা জ্বলজ্যান্ত লোককে নিরুদ্দেশ করে দেওয়া — কাজটা তো বড় সহজ ছিল না। মেনকাকে অনেক চিন্তা ভাবনা করতে হল। ভীম নদী পার হয়ে ওপারে যাবে একেবারে কাকভোরে — প্রথম খেয়ায়, যাতে গাঁয়ের বিশেষ কোন লোকজনের সঙ্গে দেখা না হয়। ভীমের হাতে কোন বাক্স পেটরা বিছানা থাকবে না-— পরাণ মাঝি বা আর কেউ যাতে কোনরকম সন্দেহ করে প্রশ্ন টশ্ন না করে। ঝাড়া হাত পায়ে ভীম খেয়া পার হলে এই পরাণ মাঝি-ই পরে গাঁয়ের লোককে গল্প করবে — হ্যাঁ গো, ভীম দাদাবাবু এক বস্‌তোরে ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছে। আমি-ই তো ভোর ভোর খেয়া পার করলুম। জিগ্যেস করলুম — কি দাদাবাবু, এই ভোরে কোথায় যাচ্ছ? হেসে বল্লে, এই একটু সদরে কাজ আছে। আসলে মা-কে লুকিয়ে বিবাগী হয়ে পালাচ্ছিল তো — সেজন্যে সকালে মায়ের ঘুম ভাঙার আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল।

    গাঁয়ের লোক তাতে সায় দেবে। মাথা নেড়ে বলবে, ঐ ভূতনি মাগিটার জন্য ছেলেটা সাধুবিবাগী হয়ে গেল। ভূতনিটা হচ্ছে সাক্ষাৎ ডাইনি। একগাদা পুরুষ মানুষের পরাণ চিবিয়ে খেয়েছে, আর এখন একটা তরতাজা জোয়ান ছেলেকে ঘর থেকে তাড়িয়ে ছাড়লে।

    বুঝদার লোকে জল্পনা করবে — মেনকা বেওয়াটার ফলপাকুড়ের বাগান — ভীম ফিরে না এলে তার কি হবে?

    সে বারো ভূতে লুটে খাবে। ডাইনিতে গুণ করেছে — ভীম কি আর ফিরতে পারবে ভেবেছ?

    তবে ভীমকে ঝাড়া হাত পায়ে নদী পার করালেও মেনকা তো আর ছেলেকে সত্যি সত্যিই জামাকাপড় বাক্স বিছানা ছাড়া কলকাতা পাঠাতে পারে না। তার জন্যে মেনকা লাগিয়েছিল তার বাগানের এক মজুরকে। সে আগের দিন বিকেলের শেষ খেয়াতে ওপারে গিয়েছিল — তার সঙ্গে ছিল সতরঞ্চি জড়ানো একটা বালিশ আর ভীমের জামাকাপড়ের ছোট একটা টিনের তোরঙ্গ। কিন্তু যাওয়ার আগে লোকটা একটা ঝামেলা বাধিয়েছিল। মেনকাকে বলেছিল, রাতে আমি থাকব কোথায়, শোব কোথায়?

    কোথায় আবার থাকবি, কড়া গলায় বলেছিল মেনকা — খেয়াঘাটে শুয়ে রাতটা কাটিয়ে দিবি।

    লোকটা তাতে রাজী হয় নি। না গো মনিবান্‌। সে আমি পারব না, সারা রাত খোলা আকাশের নিচে ভূঁইয়ে আমি শুয়ে থাকতে পারব না।

    মেনকা একটু আধটু ধমক ধামক করেছিল, কিন্তু লোকটা তার কামড় ছাড়ে নি। বাস স্ট্যান্ডে সস্তা হোটেল আছে — সেখানে একই ঘরে মেঝেতে সার সার বিছানা পেতে মশারি লাগিয়ে দেয় — সেখানে রাতে থাকার টাকা দাও। রাতে খাওয়ার, সকালের জলখাবারের টাকা দাও। এসব না হলে কি করে যাই মনিবান্‌?

    নিতান্ত অনিচ্ছায় মেনকা টাকা দিয়েছিল। কারণ এই লোকটা ঘটনাচক্রে জেনে ফেলেছে যে ভীমকে কলকাতায় পাচার করা হচ্ছে। কাজেই এই লোকটির মুখ বন্ধ রাখা দরকার। ওকে বলা হয়েছে ভীমের কথা কাউকে না বলতে — টাকা না পেলে ব্যাটা বেইমানি করতে পারে।

    তাছাড়া মেনকা একটু তাড়াতেও ছিল। সেদিন ছিল ফলহারিণী অমাবস্যা — মেনকার তাড়াতাড়ি পুজো দিতে যাবার কথা। ঐ মজুরটার সঙ্গে টাকা নিয়ে তকরার করতে গেলে দেরি হয়ে যেতে পারে — তাহলে চলবে না। পাঁজিতে লেখা ছিল দিবা ২ঘ: ৬মি: গতে অমাবস্যা নিবৃত্তি। তার ভেতর পুজো দিয়ে সেই পুজো শেষ হওয়া চাই। তবে ফলহারিণীতে পুজোর ফল যে কি পাওয়া যাচ্ছে তা তো আর বলবার নয়। সেই ফলটি হল একটি নাতি বা নাতনি, আপাতত ভূতনি বাউরির গর্ভস্থ। তবুও পুজো দিতে হবেই। পুজো দিলেই যে দেবদেবিরা খুশি হয়ে ভাল ফলের বর দেন সেরকম নয় — কিন্তু পুজো না দিলে শাপ দিয়ে ঘর দোর জ্বালিয়ে দেন। তখন অনেক পুজো দিয়েও সেই শাপ কাটানো মুস্কিল।

    মেনকা মজুরটি নির্বাচন করেছিল একটু ভালমানুষ বোকাসোকা দেখে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গিয়েছিল যে সে যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছিল। মেনকার দেওয়া রাতে হোটেলে থাকা খাওয়ার টাকা সে অন্যভাবে কাজে লাগিয়েছিল। সন্ধের সময় খেয়াঘাটের কাছে ঠেলাওয়ালারা তাদের ঠেলা তুলে দিলে পর সে তাদের একজনকে একটি বিড়ি দিয়ে তার সঙ্গে ভাব জমায়। তার পর তার সঙ্গে তার রাতের খাবার — ছাতু আর লঙ্কা — ভাগ করে নিয়ে খায় এবং দুজনের খাওয়ার ছাতুটুকুর দাম সেই ঠেলাওয়ালাকে দিয়ে দেয়। এমন কি লঙ্কার দামও। খেয়ে উঠে সে আবার সেই ঠেলাওয়ালাকে একটি বিড়ি দেয় আর তার সঙ্গের ভীমের বাক্স বিছানা সেই ঠেলাওয়ালার জিম্মা করে দেয়। রাতের খাওয়ার ছাতু আর লঙ্কার দাম পাওয়া কৃতজ্ঞ ঠেলাওয়ালা এক কথায় তাতে রাজী হয়ে যায়। তারপর সেই মজুরটি সেখান থেকে চলে যায় বাজারের বেশ্যালয়ে। সেখানে সে যুবতি ও যৌবনবতি মেয়েদের হাঁকডাক উপেক্ষা করে একটি মাঝবয়েসী মেয়েমানুষকে বেছে নেয়। সেই মেয়েমানুষটির উদরদেশ বিশাল, স্তনদ্বয় পৃথু, কুৎসিৎ মুখে মেচেতা এবং বসন্তের দাগ, দাঁতে আর মাড়িতে মিশি আর পানের রসের পাকাপাকি ছোপ এবং মুখে উৎকট দুর্গন্ধ। কিন্তু তার সারা রাতের দরটা সস্তা, আশেপাশের যুবতি মেয়েদের তুলনায় অনেক, অনেক কম। সে হিসেব করে দেখেছিল যে তার কাছে আজ রাতের খরচা করে যা বাঁচবে তাতে আরও দু তিন রাত এই মেয়েমানুষটার ঘরে রাত কাটানো চলবে। ওদিকে সেই ঠেলাওয়ালা ঘুমোবার সময় ভীমের বাক্স বিছানা ঠেলার নিচে ভূঁইয়ে রেখে দেয় এবং যথারীতি প্রবলভাবে নাক ডাকিয়ে অত্যন্ত গভীর ঘুম ঘুমোয়। মজুরটি যখন পরদিন ভোরবেলা সেই মাঝবয়েসী নারীটির আলিঙ্গন থেকে মুক্তি পেয়ে বাক্স বিছানা নিতে আসে তখন দেখতে পায় বাক্সের তালা ভাঙা — ভীমের বেশির ভাগ জামা কাপড়ই চোরে নিয়ে গেছে, পড়ে আছে শুধু একটা লুঙ্গি আর গেঞ্জী। শতরঞ্চি জড়ানো বালিশটা অবশ্য ঠিক জায়গাতেই ছিল — চোর ঐ বস্তু দুটিকে অতি তুচ্ছ জ্ঞানে ছুঁয়ে দেখে নি। খেয়া পার হয়ে ভীম এপারে এলে মজুরটি তাকে সেই যৎসামান্য জামা, তালা ভাঙা বাক্সটা এবং শতরঞ্চি আর বালিশ দেয়। মুখ কাঁচুমাচু করে বলে যে সেই হোটেলে একই ঘরে অনেক লোক শোয়, সেজন্যে বড়ই চোরের উপদ্রব। ভীম বোঝে যে মজুরটি কিছু একটা গোলমাল করেছে। কিন্তু কি সেই গোলমাল তা ওর পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। ও ঐ কটি জামা আর ভাঙা বাক্সটা মজুরটিকে দান করে দেয়, আর সতরঞ্চি জড়ানো বালিশটি নিয়ে বাসে চেপে কলকাতা রওনা হয়ে যায়। মজুরটি তার দানে পাওয়া জিনিষ কটি পত্রপাঠ বিক্রী করে দেয়। ওগুলো অবশ্য জলের দরে বিক্রী হয়েছিল — যে ওগুলো নেবে সে আর ওগুলোর জন্যে ক পয়সা দেবে? তবুও যে কটা পয়সা পাওয়া যায় তাই তো লাভ — কটা বিড়ির খরচাও তো উঠে যায়। তারপর বোকাসোকা চেহারার বুদ্ধিমান মজুরটি ভালমানুষের মত ফিরে আসে আর মেনকার বাগানের কাজে লেগে যায়। মেনকা বেলাবেলি পুজো দিয়ে ফিরে এলে তাকে জানিয়ে দেয় — সব ঠিক আছে, দাদাবাবু বাসে উঠে কলকাতা রওনা হয়ে গেছে।

    তবে ভীমের বাক্স ভাঙা এবং জামা চুরি যাওয়ার মত অবাঞ্ছিত ঘটনাটির থেকেই বোঝা গিয়েছিল যে ভীমের কলকাতা অবধি যাত্রাটি বিশেষ সুবিধের হবে না। বাস থেকে ভীম যখন রেলস্টেশনে নামল তখন ওর পেটে তাগড়াই খিদে। ওর তখন কমলামাসির হাতে ভাজা ফুলকো লুচি আর ডবল ডিমের মামলেটের কথা মনে পড়ছিল — এমনকি ও সেই লুচি আর মামলেটের গন্ধ পর্যন্ত পাচ্ছিল। তখনই ওর চোখে পড়ে যায় রেলস্টেশনের গায়ে একটা মিষ্টির দোকান — প্রায় সব মফস্বল রেলস্টেশনের গায়েই এমনি একটা মিষ্টির দোকান গজিয়ে ওঠে — রেলের যাত্রীরা খিদে পেলেই সেখানে ঢুকে পড়ে। সকালবেলা, সেখানে তখন নোন্‌তা খাবারও তৈরী হচ্ছে — গরম গরম সিঙাড়া আর কচুরি ভাজা হচ্ছে — সেই সঙ্গে রয়েছে সদ্য ভাজা লালচে লালচে লোভনীয় চেহারার সব মোটা মোটা গাঁটওয়ালা জিলিপি, বড় বড় গামলায় চিনির রসে ডোবানো। বসে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে — সরু সরু লম্বা লম্বা টেবিল, তার সামনে ঐ একই রকম লম্বা সরু সরু বেঞ্চি পাতা। প্রচুর লোক সেসব বেঞ্চিতে বসে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে হাউহাউ করে খাচ্ছে, তাদের সামনে টেবিলের ওপর শালপাতার থালায় সিঙাড়া কিম্বা কচুরি-আলুর দম, আলাদা করে শালপাতার ঠোঙায় রসালো জিলিপি। শালপাতার ঠোঙার নিচের কোণের ফুটো দিয়ে রস চুঁইয়ে টেবিলে পড়ছে, আরও পড়ছে গরম সিঙাড়া বা কচুরির গা থেকে চোঁয়ানো তেল। দুই-এ মিলে টেবিলের ওপরটা তেলতেলে চটচটে হয়ে থাকছে। কিন্তু একজন খদ্দের উঠে গেলে পরের জনকে সে জায়গাতেই পাতা পেতে, ঠোঙা পেতে খেতে বসিয়ে দেয়া হচ্ছে। পরিষ্কার করার সময় কোথায়? তাছাড়া মফস্বল জায়গা, লোকে টেবিল পরিষ্কার করার মত বাবুয়ানি বোঝে না। ভীম আর দেরি না করে ঐ দোকানে ঢুকে পড়ল। দু পকেটে ভালই টাকা আছে, ভাল করে খেয়ে নিতে অসুবিধে নেই। ছেলেকে নির্বাসন দন্ড দিতে ভেতরে ভেতরে মেনকার যথেষ্টই কষ্ট হয়েছিল, সেজন্যে ভীমের হাতে টাকা পয়সা দিয়ে দিতে মেনকা কিপটেমি করে নি। তবে ঐ দোকানে ঢুকেও বসার জায়গা পাওয়া মুস্কিল ছিল। সব কটা জায়গা ভর্তি — লোকে বসে খাচ্ছে। আর প্রত্যেকটা বসা লোকের পেছনে একজন করে খাবারের প্রত্যাশী লোক ওৎ পেতে দাঁড়িয়ে আছে। ওৎ পাতাই বলা যায়, কারণ সামনের লোকটি খাওয়া শেষ করে পাতার পাশে মটির গেলাসে রাখা জলে হাত ডুবিয়ে হাত ধুয়ে দাঁড়িয়ে বেঞ্চি ডিঙিয়ে বেরোতে না বেরোতেই পেছনে দাঁড়ানো ক্ষুৎপীড়িত লোকটি তার পা তুলে বেঞ্চি ডিঙিয়ে সদ্য খালি হওয়া জায়গাটিতে বসে পড়ার চেষ্টা করছে — তা না হলে তার পাশে দাঁড়ানো লোকটি কনুই-এর গুঁতো মেরে তাকে সরিয়ে দিয়ে ওই সদ্য খালি হওয়া জায়গাটায় বসে পড়তে পারে। এইভাবে বেঞ্চি ডিঙিয়ে টেবিলে বসার জন্যে প্রায়ই একজনের জুতো বা চটি আর একজনের জামায়, হাঁটু জোকা ধুতিতে, লুঙ্গিতে বা প্যান্টে লেগে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে সে সব জায়গায় ময়লার একটা সূক্ষ্ম বা গভীর ছাপ পড়ে যাচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে জুতো বা জামা পরিধানকারী দুজনেই নির্বিকার, এসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবার মত সময় বা প্রবৃত্তি কোনটাই তাদের নেই। ভীম কয়েকজনকে এই ভাবে জায়গা দখল করতে দেখে নিয়ে কায়দাটা শিখে নিল। তারপর নিজের সামনের খালি হওয়া জায়গায় বসে পড়তে ওর কোন অসুবিধে হয় নি। অবশ্য ওর পাশে বসে যে লোকটি খাচ্ছিল সে একটি খালি ঝুড়ি পায়ের কাছে রেখেছিল। সেই ঝুড়িতে বোধহয় সব তাড়িভর্তি ভাঁড় চালান হয়েছিল। কারণ ঝুড়িটার থেকে অত্যন্ত টক, উৎকট একটা দুর্গন্ধ আসছিল, আর সেই দুর্গন্ধ সদ্য ভাজা গরম সিঙাড়ার খুশবুর সঙ্গে মিশে একটা বিচিত্র গন্ধের সৃষ্টি করেছিল। তবে সেই গন্ধ ভীমের ক্ষুন্নিবৃত্তিতে কোন রকম বাধা হয়ে ওঠে নি।

    ভীম যখন খাবারের দোকানের বাইরে বেরোল তখন ও পেটের ভেতর একটা অপূর্ব আরামদায়ক তৃপ্তি অনুভব করছিল। সেটা করা স্বাভাবিক ছিল। কারণ ও সিঙাড়া দু-বার চেয়ে নিয়ে খেয়েছে, কচুরি তিনবার। জিলিপিও খেয়েছে যতক্ষণ না বেশ কয়েকবার ঢেঁকুর উঠেছে। তবে বার বার চেয়ে নিয়ে খাওয়ার জন্যে ওর খেয়ে উঠতে দেরি হচ্ছিল, আর তাতে পেছনের অপেক্ষাকারি লোকটি বড়ই অধৈর্য্য, বড়ই বিরক্ত হচ্ছিল। সে নানারকম মন্তব্যও করছিল — আরে দূর মশাই, কত খাচ্ছেন, এবার উঠুন — ওই তো রোগাপটকা চেহারা, কোথায় ঠাসছেন এত সব — বাপের শ্রাদ্ধের খাওয়া খেয়ে নিচ্ছেন নাকি? ভীম নিজের পিতৃশ্রাদ্ধের খাওয়া সম্পর্কে এই মন্তব্যটি শুনে পেছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখেছিল — কে এই মন্তব্যকারি? ওর পেছনে দাঁড়ানো লোকটির গাঁট্টা গোঁট্টা ষণ্ডাগুণ্ডা চেহারা — অতএব তার সঙ্গে ঝগড়া করার কোন চিন্তাই ভীমের মাথায় আসে নি। ও একটু মুচকি হেসে লোকটিকে বলেছিল, আমার বাপ অনেক বছর আগে মারা গিয়েছে — শ্রাদ্ধের খাওয়াটা সেই সময়তেই হয়ে গিয়েছে। ভীমের একথা শুনে লোকটি একটু থতমত খেয়ে চুপ করে যায় — ভীম আবার তার সামনে রাখা সুগন্ধি এবং সুস্বাদু খাবারের সদ্ব্যবহারে মন দেয় এবং তরিবৎ করে খাওয়া শেষ করে। কিন্তু এভাবে খেতে গিয়ে যে প্রচুর সময় খরচা হয়ে গেছে সেটা ভীমের খেয়াল ছিল না। রেলস্টেশনে ঢুকে টিকিট কাটতেও অনেক সময় লাগল। কারণ টিকিট কাউন্টার একটিই খোলা, তার সামনে লম্বা লাইন — টিকিটবাবু ধীরে, অতি ধীরে যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে টিকিট দিচ্ছেন — বড় নোট দিলেই ফেরৎ দিয়ে বলছেন, খুচরো নেই, বা খুচরো দিন, এ নিয়ে অনেকের সঙ্গেই তার বাদানুবাদ হচ্ছে, তাতেও যথেষ্ট সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভীম এসব বাগবিতণ্ডার সময় লাইনে দাঁড়িয়ে ঈর্ষার চোখে দেখেছিল কত লোক, মাথায় ঝাঁকা পুরুষ-মেয়েমানুষ সোজাসুজি ভেতরে প্ল্যাটফরমে ঢুকে যাচ্ছে — তারা নিশ্চয়ই দৈনন্দিনের যাত্রী, সঙ্গে রেলের মাসিক টিকিট রয়েছে। দু-দুটো কলকাতার ট্রেন এল, আর বাঁশি বাজিয়ে স্টেশন ছেড়ে চলে গেল — টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে হতাশ চোখে ভীমকে তা দেখতে হল। শেষ পর্যন্ত যখন ভেতরে ঢুকে ট্রেনে উঠতে যাবে তখন দেখল ট্রেনে বেজায় ভীড়। অফিস টাইমের ভীড় শুরু হয়ে গিয়েছে, গাদা গাদা লোক এখন কলকাতার দিকে ছুটছে। এই যে এত লোক ধাক্কাধাক্কি করে ট্রেনে উঠেছে ওকেও তার ভেতর দিয়েই ট্রেনে উঠতে হবে — ট্রেন ওর জন্যে স্টেশনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে না। একটা ট্রেন ছেড়ে দিয়ে পরেরটার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকাতেও কোন লাভ নেই — যত সময় যাবে যাত্রীর ভীড় তত বাড়বে। ওর একটু ভয়ও হল — প্যান্টের দু পকেটে বেশ অনেক টাকা রয়েছে, কলকাতায় গিয়ে কয়েকমাস চালাবার মত টাকা মা-বুড়িটা সঙ্গে দিয়ে দিয়েছে। এই ভীড়ে, ধাক্কাধাক্কিতে কেউ আবার পকেটে হাত ঢুকিয়ে টাকাগুলো তুলে না নেয়। ট্রেনে ওঠা-নামার সময়তেই তো পকেটমারিটা বেশি করে হয়। কিন্তু কোন উপায় নেই, ভীমকে এই ঝুঁকিটা নিতেই হবে। মরীয়া হয়ে শতরঞ্চি বালিশ বগলদাবা করে দু হাত দিয়ে প্যান্টের দু পকেট সামলে লোকজন ঠেলে ট্রেনের কামরায় ঢুকে পড়ল ভীম। এই ইলেকটিরিক ট্রেনগুলো ভাল, কামরার দরজাগুলো বেশ চওড়া। ও কামরায় ওঠার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন ছেড়ে দিল, আর ও বুঝতে পারল যে ওর আর একটা ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। ও শতরঞ্চি বালিশ আর ওর সঙ্গে নেই — কোন একজন পাকা হাতের লোক ওর পকেটে হাত লাগাতে না পেরে ওর যৎসামান্য শয্যাদ্রব্যই আত্মসাৎ করে নিয়েছে। কিন্তু এই সামান্য ক্ষতির দিকে মন দেয়ার কোন সুযোগ ওর ছিল না, ও একটি ছোটখাট বিপদের সামনে পড়ে গিয়েছিল। বিরাট চেহারার একটি গ্রামীণ স্ত্রীলোক একটা বড় ঝুড়িতে সব্জী সাজিয়ে সেই কামরার দরজার প্রায় অর্ধেকটা সেই ঝুড়ি দিয়ে আটকে রেখেছিল এবং সেই ঝুড়ির ঠিক পেছনে কামরার ভেতর দিকটায় সাক্ষাৎ ঘটোৎকচের মত দাঁড়িয়ে থেকে নিজের ঝুড়ি পাহারা দিচ্ছিল। পেছন থেকে লোকজনের ঠেলা খেয়ে ভীম কামরাটায় উঠেছিল দরজাটার ঐ ঝুড়িটার দিক দিয়েই, আর সেই ধাক্কা খেয়ে ওঠার ঝোঁকে তার পায়ের লাথি লেগেছিল ঐ নারী ঘটোৎকচের ঝুড়ির সব্জীতে। তার ফলে প্রচুর সব্জী স্থানচ্যুত হয়ে ঐ কামরার মেঝেতে, বিভিন্ন যাত্রীর পায়ের ফাঁকে, জুতোর ওপরে বা নিচে গড়াগড়ি যাচ্ছিল। ভীম হঠাৎ মেঘগর্জনের মত আওয়াজে গালাগাল শুনে চমকে তাকিয়ে দেখতে পেয়েছিল যে সেই নারীটির উন্মুক্ত বিশাল মুখবিবর থেকে ভীমের বাপান্তকারি গালাগাল নিষ্ক্রান্ত হচ্ছে, তার ভাঁটার মত চোখদুটো ভীমের দিকে অগ্নিবৃষ্টি করতে করতে বাঁই বাঁই করে ঘুরছে — ওর আর ঐ স্ত্রীলোকটির মাঝখানে বড় ঝুড়িটা রয়েছে বলেই বোধহয় সে গদার মত তার দুই হাত দিয়ে ভীমের গলাটা টিঁপে ধরতে পারছে না। এই বিপদের ওপর আরও বিপদ, দেখা গেল কাছাকাছি দাঁড়ানো অন্যান্য যাত্রীরাও কেউ ভীমের ওপর খুশি নয়। তারাও টিপ্পনি কাটছে — ছোঁড়া কানা নাকি — ইসস এত টাকার সব্জী নষ্ট হয়ে গেল — ওঠার সময় লোকটা আমারও পা মাড়িয়ে দিয়েছে মশাই — ও মাসী, দাও না বেল্লিকটাকে দু ঘা লাগিয়ে —। ‘মাসী’টি যদি ভীমকে ধরে এলোপাথাড়ি পিটতে থাকে তাহলে সেটা একটা দারুণ রগড় হবে, কামরাসুদ্ধ লোক সেই তামাশা দেখার জন্যে এদিকে ঝুঁকে পড়বে, যারা কোনমতে সীট পেয়ে গিয়ে দেড়খানা নিতম্ব সীটে ঠেকিয়ে কষ্ট করে বসে আছে তারা সেই সীটের মায়া ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠবে, সামনের লোকের মাথার ওপর দিয়ে ডিঙি মেরে আগে কি হচ্ছে না হচ্ছে তা দেখার চেষ্টা করবে। একটা মেয়েমানুষ — হলই বা সে ঘটোৎকচের সমতুল — একটা ছোকরাকে ধরে বেধড়ক ঠ্যাঙাচ্ছে, একি সহজ মজা?

    কিন্তু ভীম লখনা পাইকের বংশধর, কাজেই চৌধুরিপুকুরের ঠাকরুণের আশীর্বাদ আছে তার ওপর। এই বিপদে পড়ে তার বুদ্ধির গোড়ায় হাওয়া লাগল। সে চকিতে পকেটে হাত ঢুকিয়ে তা আবার বার করে আনল, কিন্তু তখন তার হাতের মুঠোয় ধরা কয়েকটি একশো টাকার নোট। আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের মত বাক্যস্রাবী নারীটির দিকে ঐ নোট কটি বাড়িয়ে ধরে সে বলল, এই নাও মাসী, ‘খেতিপূরণ’ দিলাম। মুহূর্তে দাবানল নিভে গেল, সেই বিশাল এবং ভয়াল মুখমণ্ডলে হাসি দেখা দিল, ভাঁটার মত চোখদুটি তাদের লাটিম ঘূর্ণন থামিয়ে শান্ত হয়ে গেল। তার মুখ থেকে বেরোন মেঘের গর্জন হঠাৎ থেমে যাওয়ার ফলে কামরাটা খুব চুপচাপ হয়ে গেল — খালি বেগে ট্রেন চলার একঘেয়ে কটকট খটখট আওয়াজ শোনা যেতে লাগল। কিন্তু কামরার অন্যান্য যাত্রীরা বড়ই নিরাশ হল — এত বড় তামাশা দেখাটা ফস্কে গেল, দুত্তেরি।

    কলকাতায় ট্রেন থেকে নেমে আবার বাসে উঠতে হবে। ভৈরব থাকে কলকাতা শহরের একেবারে ধারে — রেলস্টেশন থেকে অনেকদূর। ভীম আগে কখনো কলকাতা আসে নি — কলকাতা চেনা তো দূরের কথা, কলকাতার চেহারাটা কেমন তা-ও ও আগে দেখে নি কখনো। কলকাতার লোকগুলোও যেন কেমন — সব তাড়াহুড়ো করে হাঁটছে, ভৈরবের তল্লাটে যাওয়ার জন্যে ভীম কত নম্বর বাস ধরবে সেটা বলে দেওয়ার সময়ও কারোর নেই। রেলস্টেশন থেকে বেরিয়ে ফুটপাথে সার সার ছোট ছোট দোকান। একটা ছোট গোছের দোকানে অল্পস্বল্প মনিহারির জিনিষ সাজান — সামনের দিকে কতগুলো কাঁচের বৈয়ামে লজেন্স, সস্তা চকোলেট, দু তিন রকম চানাচুর। দোকানের সামনে কোন খদ্দের নেই — দোকানের ভেতর মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা একটা বুড়ো নিষ্পৃহ উদাস চোখে সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। ভীম তাকে জিজ্ঞেস করল, অ দাদু, গান্ধী কলোনি যাব, কত নম্বর বাস যাবে এখান থেকে?

    দাদুটির মুখের ভারে কোন তারতম্য হল না, মনে হল ভীমের কথা তার কানেই যায় নি। অতএব ভীমের প্রশ্নের কোন জবাব তিনি দিলেন না। ভীম পাশের দোকানটায় গেল। এটারও একই রকম আয়তন এবং চেহারা — দোকানদার একটি হৃষ্টপুষ্ট চেহারার লোক, তার পরণে একটা লুঙ্গি এবং একটি হাত কাটা গেঞ্জী, নাকের নিচে অযত্নবর্ধিত মোটা, ভারী গোঁফ — দোকানের সামনে কয়েকজন খদ্দের দাঁড়ানো।

    ঐ খরিদ্দারদের জিনিষ কেনা শেষ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত ভীম তাদের পেছনে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। আগে দোকানদারের হাতে জিনিষ বিক্রীর পয়সা আসুক। তাহল ওর মেজাজটা একটু ভাল থাকবে, ভীমকে তার বাসের নম্বর বলে দিতে আপত্তি করবে না।

    খরিদ্দারদের মধ্যে একজনই খালি জিনিষ কিনল, কারণ তার হাতে ধরা তার ছোট একটি ছেলে ছিল, বাচ্চাটি লজেন্সের জন্যে বায়না করছিল। সে লোকটি চটপট দোকানদারের হাত থেকে লজেন্সের ঠোঙাটা নিয়ে ছেলের হাতে ধরিয়ে দিল, দোকানদারকে তার দামের পয়সা গুণে দিয়ে ছেলের হাত ধরে হেঁটে চলে গেল। বাকি কজন খরিদ্দার — তারা মেয়েমানুষ — কাঁচের রঙচঙে চুরি নাড়াচাড়া করে দেখছিল — শেষ অবধি কিনল না, ঘাড় নেড়ে ‘না’ বলে দিয়ে দোকান ছেড়ে চলে গেল। দোকানদার নির্বিকারভাবে যা জিনিষ বার করেছিল তা আবার ঠিক জায়গায় তুলে রাখল — মনে হল সে তার নারী খদ্দেরদের থেকে এ জাতীয় ব্যবহার পেতে অভ্যস্ত। তারপর তার নজর পড়ল ভীমের ওপর। এ লোকটি তার খরিদ্দার নয়, যে টাকা ফেলে জিনিষ কেনে সে এরকম কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে না। দোকানদার ভীমের দিকে তাকিয়ে নিজের দুই ভুরু তুলল, নিঃশব্দে জিজ্ঞেস করল, কি চাই? ভীম একই রকম কাঁচুমাচুভাবে যে বাস ওকে ভৈরবের বাড়ির কাছে পৌঁছে দেবে তার নম্বর জানতে চাইল।

    গান্ধী কলোনি পাঁচ সাতটা আছে, খুব তাচ্ছিল্যের সুরে বলল লোকটা। কোন্‌ গান্ধী কলোনি?

    ভীম একটু বিপদে পড়ে গেল — কোন্‌ গান্ধী কলোনি তা তো সে জানে না। ও তাড়াতাড়ি পকেট থেকে মায়ের দেয়া ভৈরবকে লেখা চিঠিটা বার করল — হ্যাঁ, এই তো লেখা আছে — বোসের মাঠের কাছে। ও দোকানদারকে বলল সে কথা।

    দোকনাদার ততক্ষণে অন্য কাজে মন দিয়েছে। দায়সারা ভাবে উত্তর দিল, আটচল্লিশের সি বাস। দোকানের সামনের বৈয়ামগুলো একটু ঠিক করে সাজিয়ে রাখতে রাখতে দোকানদার আর একটা বাক্য ছুঁড়ে দিল, রাস্তার ওপর থেকে পাওয়া যাবে। তারপর ভীমের দিকে আর তাকাল না।

    ভীম আস্তে আস্তে রাস্তার ধারে এসে দাঁড়াল, একটু ইতস্ততঃ করে ফুটপাথ থেকে রাস্তায় নামল। রাস্তা পার হতে হবে, তবে বাস পাওয়া যাবে। কিন্তু পার হবে কি করে? বাস লরী গাড়ি সব হুশহাশ করে নাকের সামনে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে — এ সবের ভেতর দিয়ে ও যাবে কিভাবে? সে চেষ্টা করলে তো ও নির্ঘাৎ চাপা পড়বে। অসহায় ভাবে ভীম এদিক ওদিক তাকাল। তখন ওর চোখে পড়ল — দু কদম দূরে একটা জায়গায় গাড়ি টাড়ি সব থেমে আছে, আর রাস্তার এপার থেকে ওপার একটা সাদা দাগ দেয়া জায়গার ওপর দিয়ে মানুষজন সারি দিয়ে পার হচ্ছে। ও ফুটপাথ ধরে জোরে হেঁটে সে জায়গাটায় পৌঁছল, তারপর সেই মানুষের সারিতে মিশে গিয়ে কিছুটা জোরে হেঁটে, কিছুটা প্রায় দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে অন্য দিকের ফুটপাথে উঠল। বাব্বাঃ বাঁচা গেল — কি করে রাস্তা পার হবে তাই ভেবে ভয় ধরে গিয়েছিল একেবারে।

    কিন্তু রাস্তা পেরোতে পারলেও বাসে ওঠা সহজ কাজ নয়। বাস এসে কোথায় দাঁড়াবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছিল না ভীম। ও দেখল একটা জায়গায় বেশ কিছু লোকজন-মেয়েছেলে জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে — বিভিন্ন বাসে এসে ঐ জায়গাটারই কাছাকাছি আগে পিছে দাড়াচ্ছে, আর সব লোক পড়িমড়ি করে দৌড়ে গিয়ে সে সব বাসে উঠে পড়ছে। মেয়েছেলেরাও দৌড়োদৌড়ি করে বাসে উঠছে। মনে মনে ভীম তাদের সাবাসি দিল। কলকাতার মেয়েছেলে — সব চালাক চতুর, তাদের রকমসকমই আলাদা।

    কিন্তু ভীম এখন বাস ধরবে কি করে? একটা বাস থামল ভীমের অনেক আগে, দৌড়ে বাসটার কাছে যেতে না যেতেই সেটা ছেড়ে দিল। আর একটা থামল ভীমকে ছাড়িয়ে, বেশ খানিকটা এগিয়ে। ভীম দৌড়ে গিয়ে বাসটার কাছে পৌঁছেছিল ঠিকই, কিন্তু এ বাসটায় ভিড় ছিল, আর সেজন্যে অনেক লোক বাসটায় উঠবার জন্যে তার সরু দরজাটার কাছে ধাক্কাধাক্কি করছিল — তার ফলে ভীম বাসের দরজার হ্যান্ডেল ধরে তার সিঁড়িতে পা রাখার আগেই বাসটা ছেড়ে দিয়েছিল। বাসে ওঠা সম্পর্কে ভীম যখন প্রায় হতাশ হয়ে পড়েছে তখন চৌধুরিপুকুরের ঠাকরুণ আবার লখনা পাইকের বংশধরের ওপর দয়া করলেন — এর পরের বাসটা ভীমের মোটামুটি সামনেই থামল, আর ভীম তাতে উঠতেও পারল।

    গান্ধী কলোনি অনেক দূরের রাস্তা। ভীম ভয় পাচ্ছিল, ও যদি ঠিক জায়গায় পৌঁছবার আগেই নেমে পড়ে? বা যদি ঐ কলোনি ছাড়িয়ে দূরে চলে যায়? সেজন্যে ও বারবার বাসের কন্ডাক্টরকে জিগ্যেস করছিল, বলছিল — ভাই গান্ধী কলোনি কি এল? এলে আমাকে নামিয়ে দেবেন কিন্তু। কন্ডাক্টর যাত্রীদের থেকে ভাড়া আদায় করে তাদের টিকিট দিতে ব্যস্ত, সে ভীমের ওপর বিরক্ত হয়ে তাকে এক খিঁচুনি দিল — বলছি তো এখনও অনেক দেরি আছে, বারবার এক কথা বলছেন কেন? ঠিক জায়গামত আপনাকে নামিয়ে দেব, এখন বিলকুল চুপ মেরে থাকুন।

    অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ভীম একটা বসার জায়গা পেয়েছিল। বাসের ঝাঁকুনিতে আর বসতে পারার আরামটুকুর জন্যে ওর দু চোখ বুজে এসেছিল, ও একটুখানি ঢুলে পড়েছিল। সেজন্যে বাস যখন জায়গামত পৌঁছে গিয়েছিল আর কন্ডাক্টর গান্ধী কলোনি, গান্ধী কলোনি বলে চেঁচাচ্ছিল তখন ভীম প্রথমে তা শুনতে পায়নি। তন্দ্রা ভেঙ্গে সেই ডাক শুনতে পেয়ে যখন ও সীট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল তখন বাস ছেড়ে দিয়েছে। এই রোখো রোখো, আমি এখানে নামব — বলতে বলতে লোকজন ঠেলে হুড়মুড় করে বাসের দরজার সামনে এসে পড়ল ভীম। কন্ডাক্টর দড়ি টেনে ঘন্টি বাজিয়ে বাস থামাল ঠিকই, কিন্তু সে ভীমের ওপর বড়ই বিরক্ত হয়েছিল বলে ভীমকে এক হাতে ঠেলা মেরে বাসের দরজার সিঁড়ি থেকে রাস্তায় নামিয়ে দিল আর অন্য হাতে অধৈর্যভাবে ঘন ঘন দড়ি টেনে ঘন্টি বাজিয়ে ড্রাইভারকে বাস চালাতে নির্দেশ দিল। মুখে অস্ফুটে ভীমকে হিন্দীতে একটা গালাগালও দিল, সাল্লা, বুরবাক কাঁহিকা।





    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার

    Tags: Haradhan Totowala, Bengali Novel, Sabarni Chakraborty
  • প্রচ্ছদ | পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০ | পর্ব ১১ | পর্ব ১২ | পর্ব ১৩ | পর্ব ১৪ | পর্ব ১৫ (শেষ)
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments