• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮১ | জানুয়ারি ২০২১ | উপন্যাস
    Share
  • হারাধন টোটোওয়ালা (১০) : সাবর্ণি চক্রবর্তী


    ।। পুরনো কথা - ভীমকাহিনী ।।

    ভীমের জীবনের ঘটনাচক্র প্রমাণ করে দিয়েছিল যে চৌধুরি পুকুরের ঠাকরুণের শক্তি অপরিসীম নয়। কারণ তা ভীমের মাথার ওপর দাম্পত্যজীবনের গিরি গোবর্ধনের আকস্মিকভাবে চেপে বসা আটকাতে পারেনি। তবে একেবারে গোড়ার দিকে এই জীবন ভীমের ভালই লেগেছিল। নতুন ঘর, নতুন পারিপার্শ্বিক, নতুন বিছানা, তাতে বৌ হয়ে শোয়া নতুন একটা মেয়েছেলে — সবই নতুন নতুন চোখে রঙ লাগানো। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বাস্তবের কঠিন মূর্তি ভীমের সামনে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগল। বিয়ে নামের দিল্লীর লাড্ডুটি খেতে মন্দ নয়, জিভে একটা সুস্বাদের অনুভূতি দেয়। কিন্তু জিভ থেকে সেটা যখন পেটে যায়, তখন হজমের অনেক গোলমাল হয় — অম্বল, পেট গুড়গুড়, এমনকী পেট ছেড়েও দিতে পারে। কয়েক মাসের মধ্যেই ভীম টের পেল সুলোচনার অসম্ভব মেজাজ, কথায় কথায় ওর রাগ হয়, আর রাগ হলে মুখের সঙ্গে ওর হাতও ভালই চলে। ভৈরবের ঘরে যে দু চারদিন ছিল সে সময় ভীম এসব কিছু জানতে পারেনি। জানবার সময় ছিল না, কারণ চটপট বোনের বিয়েটা সেরে দিয়ে ভৈরব ওদের আলাদা জায়গায় ভাড়ার ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছিল। এখন মাঝে মাঝে ভীমের কানে টুকরো টুকরো কথা উড়ে আসতে লাগল — সুলোচনার এই মেজাজের জন্যেই নাকি ভৈরব ওর বিয়ে দিয়ে উঠতে পারছিল না। যখনই কোথাও ওর বিয়ের কথাবার্তা হত তখনই ভাংচি পৌঁছে যেত সেখানে। বিয়ের কথাবার্তা তখনই খতম। সে জন্যেই ভীমের সঙ্গে ওর বিয়ের জন্যে তাড়াহুড়ো করেছিল ভৈরব — বোনকে ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার জন্যে একটা বকরা পাওয়া গেছে, ওর কানে কোন কথা গিয়ে ও আবার বিগড়ে না যায়। কিছুদিনের ভেতর বিছানায় বৌকে নিয়ে শোবার সুখও ভীমের কাছে পুরোনো হয়ে গেল। ভূতনিটা একটা হতকুৎসিৎ পোড়াকাঠ, কিন্তু ও পুরুষ মানুষের সঙ্গে শোয়ার অনেকরকম খেলাধুলো জানত। ও বেশ কয়েকটা পুরুষের হাত ঘোরা মেয়েমানুষ তো। এসব ব্যাপারে সুলোচনা একেবারে বিনা তেলের আলুনি আলুসেদ্ধ — এমনকী ডিম সেদ্ধ পর্যন্ত নয়। ঘুম পেয়ে গেলে মেয়েমানুষটা বেশিক্ষণ খেলাধুলো পছন্দ করে না, ভীম সে চেষ্টা করলে বিরক্ত হয়। সেই বিরক্তি ভীম টের পায় পরের দিন সকালে। কোন একটা ছোট ব্যাপার নিয়ে সুলোচনা ঝামেলা শুরু করে দেয়। চীৎকার চেঁচামেচি তো আছেই, চড় থাপ্পড়ও আছে। বেড়াল তাড়ানোর লাঠিটাও ও মাঝে মাঝে ব্যবহার করে। এসব দেখেশুনে ভীম একটা সিদ্ধান্তে এসেছে — ওর লম্বা চওড়া চেহারার বৌটার গায়ে বেশ কিছু পরিমাণ পুরুষের রক্ত আছে।

    দিল্লীর লাড্ডু খাওয়ার আর একটি অবধারিত ফলও ভীম কয়েক মাসের ভেতরেই টের পেল। টাকার টানাটানি শুরু হয়ে গেল। কারখানায় ভীম সপ্তাহে সপ্তাহে রোজ পায়। চার পাঁচ দিনের ভেতরেই টাকাগুলো যে কোনখান দিয়ে উড়ে যায় সেটা ও টেরই পায় না। ভীম যখন গাঁয়ে মায়ের ঘাড়ে ছিল তখন ইচ্ছেমত টাকা খরচা করেছে, হিসেব করে চলতে তো শেখেনি। শেখা উচিত ছিল, এখন সেটা ভীম হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। একটা বড় খরচা হয় কারখানার ওস্তাদকে বোতলের যোগান দিতে। তা না দিলে আজ চাকরি আছে, কালও যে থাকবে এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। আর বেশি দামেরটাই দিতে হয়। প্রথমে বেশি দামের জিনিষ দিয়ে শুরু করেছে, এখন আর কম দামেরটায় নামতে পারে না। তাছাড়া দামী জিনিষ পেয়ে ওস্তাদ ‘হারামজাদ’ বলে ডাকে, কম দামের বোতলে নামলে হয়তো ‘শুয়ার কা বালা’ বলে সম্বোধন করবে। যদিও দুটোর অর্থই এক, পরেরটা বেশি জোরালো গালাগাল হয়ে কানে লাগে। সুলোচনা অবশ্য এবাড়ি ওবাড়ি ঘর পরিস্কার করা, বাসন সাফা করার কাজ করে। কিন্তু ওর কাজ অনিশ্চিত, সেজন্যে আয়টাও তাই। প্রায়ই মেজাজ করে ও কোনো না কোনো বাড়ির কাজ ছেড়ে দেয় — তারা আর বাকি মাইনেপত্রও দেয় না। সেজন্যে মাসের মধ্যে পনেরো দিন ও ঘরেই বসে থাকে। ওর নিজের কাজ করার খুব যে একটা গরজ আছে তাও নয়। খাওয়া তো জুটেই যাবে, সোয়ামিটা রয়েছে কিসের জন্যে?

    কাজেই ভীম ভৈরবের কাছে ধারের খপ্পরে পড়ে গেছে। মাসের গোড়াতেই ঘরভাড়া দিতে হয়, তার জন্যে টাকা রাখতেই হবে। বাড়িওলাটা একটা গুণ্ডা ধরনের লোক, ওর হাতে অনেক ষণ্ডাগুণ্ডা শাগরেদও আছে। তাকে ঘরভাড়া না দিয়ে খালি কথা বলে ভোগা দেয়ার চেষ্টা করলে বিপদ আছে। হয়তো ভীম আর তার বৌকে গলা ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বার করে দিয়ে ওদের জিনিষপত্র ছুঁড়ে রাস্তায় ফেলে দেবে। চারপাশের সব ঘরের লোকজন ভীড় করে দাঁড়িয়ে মজা দেখবে। ভীমের পক্ষ নিয়ে কেউ একটা আঙুল পর্যন্ত নাড়বে না। অতএব টাকা ধার করতে হবে। কিন্তু ধার পাওয়া যাবে কোথায়? ভীমকে কে চেনে, কে ওকে টাকা ধার দেবে?

    সুতরাং ভীম গিয়েছিল ভৈরবের কাছে। ভৈরব দিয়েছিল টাকা, কিন্তু একথাও বলে দিয়েছিল যে সুদ দিতে হবে। দ্যাখো ভীম, ও টাকাটা ব্যাঙ্কে রাখলে তো সুদ বাড়ত — সেজন্যে, বুঝতেই তো পারছো, যে টাকাটা তোমাকে দেব তার সুদ না নিলে আমার তো লোশকান হয়ে যাবে। হিসেবটা না হয় আমিই রাখব। তুমি খালি মাসে মাসে এসে টাকার যা কিস্তি চাইব তা আমাকে দিয়ে যাবে।

    সেই থেকে ভৈরবের সঙ্গে ভীমের টাকা দেয়ানেয়ার ব্যাপারটা চলছে। কত ওর এল, কত ওর কাছে থেকে গেল ভীম তার কোন হিসেব রাখে না। হিসেব রাখার কোন চেষ্টাই করে না। ও খালি জানে ভৈরব সুদ নেয়, আর সুদটা মোটারকমই নেয়। সেই সুদ আবার আসল হয়ে গিয়ে সুদে বাড়ে। ছেলেবেলায় ও যখন ইশকুলে যেত তখন সেখানে এক মাস্টারমশাই ওদের কেলাসে একটা গল্প বলেছিলেন। লোকে নাম জানে না এরকম একজন দেবী নিজের মাহাত্ম্য লোককে জানাবার জন্যে একজন লোককে ধরে তাকে তিনটে বর দেবার কড়ার করেছিলেন। লোকটা দুটো বর চেয়ে নিল। তৃতীয় বর হিসেবে চাইল আরও তিনটে বর। দেবী চটে গিয়ে তাতে আপত্তি করলেন। তখন লোকটা নিজের পক্ষে একটা চমৎকার যুক্তি দাঁড় করাল। ঐ তৃতীয় বরটাই হচ্ছে আরও তিনটে বর। শুধু তাই নয়। এরকম প্রত্যেক তিন বরের তৃতীয় বরটা হবে আরও তিনটে বর। ওই মাস্টারমশাই আরও অনেক গল্প বলেছিলেন। কারণ বাচ্চারা কেলাসে চেঁচামেচি গোলমাল করলে তিনি মারধর না করে গল্প বলে তাদের ঠান্ডা করতেন। ঐ দেবীর বর দেয়ার গল্পটা ভীমের মনে থেকে গিয়েছিল। ও এখন বুঝে গিয়েছে ভৈরবের ধারের সুদ হল ঐ গল্পের দেবীর তৃতীয় বর। নিজের থেকেই তার বংশবৃদ্ধি হয়।

    সুতরাং অন্যান্য খরচার সঙ্গে ভৈরবের ধারের কিস্তি শোধ করতেও ভীমের অনেক টাকা বেরিয়ে যায়। তবে একটা সুবিধে হয়েছে। ভৈরবের বাড়ি গেলে ওর বৌ ভীমকে একটু খাতির বেশি করে। ভীম সুলোচনার বর বলে নয়। মেয়েমানুষটা জানে যে আজকাল ভীমকে দোহন করে ভৈরব টাকা কামায়। সেজন্যে ভীমের সঙ্গে হেসে কথা বলে, বসবার জন্যে জলচৌকিটা এগিয়ে দেয়। চায়ে চিনিটাও একটু বেশি দেয়, একের বদলে দু চামচ।

    এমন নয় যে মেনকা ছেলেকে টাকা পাঠাবার কোন চেষ্টা করেনি। শত হলেও মায়ের মন, কিছুদিনের মধ্যেই ওর রাগ পড়ে গিয়েছিল। ভীম নেই, বাড়িটা কীরকম খাঁ খাঁ করে, নিজের বুকের ভেতর একটা খালি খালি ভাব হয়, মাঝে মাঝে মনে হয় চোখে জল এসে যাচ্ছে। মাথায় উটকো সব চিন্তা আসে। ভীমের বন্ধুরা বাড়ির টাকায় বাজারি মেয়েমানুষদের কাছে যায়, মেনকাও তো ভীমকে তা করতে দিতে পারত। আর কিছু নয়, ভীম ওর বাক্স থেকে টাকা সরালে চোখে বুজে থাকলেই তো হত। তাছাড়া কমলা ওকে অনেকবার বলেছিল ভীমের বিয়ে দেবার জন্যে, ও কোন গা করেনি। একটা জোয়ান বয়েসের ছেলে, কদিন আর রাতে একা একা শোবে? ওই একা শোয়ার জন্যেই ভীম এরকম একটা উৎপটাঙ কাজ করে ফেলল কিনা কে জানে। আর ওই ভূতনি মাগিটাও কি কম শয়তান? মেনকা লুকিয়ে কমলাকে চিত্তর কাছে পাঠিয়েছিল গোপনে ভূতনির পেট খসানোর ব্যবস্থা করা যায় কিনা সে সব কথাবার্তা বলতে। চিত্ত মোটামুটি পথে এসে গিয়েছিল। মোটারকম টাকা পেলে ও আপত্তি করত না। কিন্তু ভূতনি সোজা না বলে দিল। ও বোধহয় ভেবে রেখেছে বাচ্চাটা হলে সেটাকে নিয়ে এসে মেনকাকে দেখাবে। বলবে, আমাকে এবার ছেলের বৌ কর। মাগির কতবড় আস্পর্ধা! কিন্তু সত্যিই যদি সেরকম হয় তাহলে তো মেনকা মোক্ষম প্যাঁচে পড়ে যাবে। সেই প্যাঁচ কেটে বেরোবার কোন উপায় তো এখনও কিছু দেখা যাচ্ছে না। ভূতনির যে নিজের থেকেই গর্ভপাত হয়ে যায় বা ও মরা বাচ্চা প্রসব করে তাই এখন ভরসার কথা। আর এক ভরসা হচ্ছে চৌধুরিপুকুরের ঠাকরুণ। ঠাকরুণ একটু মুখ তুলে তাকালেই ভূতনির পেট খালাস হয়ে যাবে। ঠাকরুণ কি করবে না দয়া? লখনা পাইকের রক্ত যাদের শরীরে আছে তাদের থেকে কি ঠাকরুণ মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারবে?

    ভীমের বিয়ের খবরটা ভৈরব মেনকাকে চটপট পাঠায়নি, ধীরেসুস্থে সময় নিয়ে পাঠিয়েছিল। ওর চিঠি মেনকার কাছে পৌঁছে ছিল ভীমের বিয়ে হয়ে যাবার দিন কুড়ি পঁচিশ পরে। ভীম ওকে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে তা জেনে মেনকা রেগে উঠেছিল, চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছিল। ওকে থামিয়েছিল কমলা। সোজা বলেছিল, তোমার মাথাটা একটু ঠাণ্ডা কর তো দিদি। মেয়েমানুষের রাগ হল অলক্ষ্মী। ছেলের ওপর টাকা চুরি করার জন্যে রাগ করে শেষ পজ্জন্ত ছেলেটাকে নিরবাসনে পাঠিয়েছ, নিজেও গাড্ডায় ফেঁসে আছ। আবার যদি রাগ কর তাহলে কি হবে কে জানে। তার চেয়ে চেষ্টা দেখ, ছেলেটাকে একটু টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করতে পার কিনা।

    কমলার কথা পছন্দ না হলে মেনকা সাধারণত ওকে খেঁকিয়ে ওঠে। অবশ্য তাতে কমলার কোনই হেলদোল হয় না, মেনকার কথা ওর কানেই যায়নি এরকম ভাব দেখিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। কিন্তু এবার মেনকা আর কোন কথাই বলেনি, একেবারে চুপ মেরে গিয়েছিল। অর্থাৎ মনে মনে কমলার কথা মেনে নিয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে টাকাটা পাঠাবে কি করে? পোস্টাপিস থেকে মানি অর্ডার করা যায়। কিন্তু সে চেষ্টা করলেই দীনু গাঙ্গুলী ভীমের ঠিকানা জেনে ফেলবে। এখানকার পোস্টাপিসটা ছোট, পোস্টবাবু ছাড়া নগেন বলে একটা ছোকরা আছে। ও ছোকরাই মানি অর্ডার নেয়, চিঠিপত্র বেঁটে বিলি করে। বলতে গেলে ওই নগেনটাই এই পোস্টাপিসের সব কিছু। দীনু কি ওকে হাত করে রাখেনি? হাত করা, সে আর শক্তটা কি? শখানেক টাকা ওর হাতে গুঁজে দিলেই হল। ভীমের নামে মেনকা বুড়ির কাছ থেকে যে সব চিঠিপত্র, মানিঅর্ডার যাবে তার ঠিকানাটা ও টুকে রাখবে, দীপুকে সেই ঠিকানা দিয়ে দেবে। তা হলেই তো বারোটা বেজে গেল। অবশ্য মেনকাও নগেনকে টাকা দিতে পারে ওই ঠিকানা কাউকে না দেয়ার জন্যে। কিন্তু তাহলে নগেন দুদিক থেকেই খাবে আবার মেনকাকে হয়তো ফাঁসিয়েও দেবে। কাজেই ভীমের সঙ্গে সোজাসুজি যোগাযোগ করা বা ওকে টাকা পাঠানো সম্ভব নয়। কিছু পাঠাতে হলে কারোর মারফৎ পাঠাতে হবে। ভৈরব ছাড়া সেরকম কোন লোককে মেনকা জানে না।

    অতএব মেনকার লোক গিয়েছিল ভৈরবের কাছে। ভৈরবের নামে একটা বড় খাম নিয়ে গিয়েছিল ওর কাছে। সেই খামের ভেতর ভৈরবের জন্যে দু ছত্রের চিঠি আর ভীমের নামে একটা মুখ আঁটা খাম। খামের ভেতর মেনকা ভীমের জন্যে চিঠি দিয়েছিল, আর দিয়েছিল কিছু নগদ টাকা। কিন্তু ভীম নিজের নামের কোন খাম পায়নি, কোন টাকাও নয়। ভৈরব ওর হাতে যা পৌঁছে দিয়েছিল তা হল এক পাতা কাগজের ভীমকে লেখা তার মায়ের চিঠি। চিঠিতে মেনকা লিখেছিল — বধূমাতাকে আশীর্বাদপূর্বক তোমাদের কিছু টাকা পাঠাইলাম, পরে সময় সুযোগ মত আরও পাঠাইব। ভীম ভৈরবকে জিজ্ঞেস করেছিল, চিঠির সঙ্গে টাকা ছিল না ভৈরবদা?

    ভৈরব আবার মুখ করে জবাব দিয়েছিল, কই, না তো। কোন টাকা তো ছিল না চিঠির সঙ্গে।

    হ্যাঁ, মা তো তাই লিখেছে চিঠিতে। এই যে, পড়ো না।

    ভৈরব চিঠির ঐ জায়গাটাতে চোখ বোলাবার ভান করেছিল। তারপর একটু তাচ্ছিল্য করেই বলেছিল, তাহলে মেনকাপিসী টাকাটা সঙ্গে দিতে ভুলে গিয়েছে। বয়েস তো হয়েছে, এরকম তো হতেই পারে।

    ভীম আর কিছু বলেনি। আসলে কি হয়েছে সে তো জলের মত পরিষ্কার। কিন্তু এ নিয়ে কিছু করার নেই। মেনকাকে দু ছত্র লিখে দিয়েছিল। টাকা পাইনি, চিঠির সঙ্গে কোন টাকা ছিল না। তুমি হয়তো দিতে ভুলে গিয়েছিলে। আরও লিখেছিল, আমরা ভালই আছি। এভাবে টাকা পাঠানোর দরকার নেই।

    আর কিছু লেখে নি ভীম। ভৈরবের হাত দিয়ে চিঠি পাঠাতে গেলে এর বেশি কিছু লেখা যায় না। ভৈরবের হাতে বন্ধ খাম দিয়েও লাভ নেই। হয়তো ভৈরব সেই খাম ছিঁড়ে চিঠি বার করে পড়ে নেবে। তারপর আবার নতুন খামে মেনকার ঠিকানা লিখে তাতে ভীমের চিঠিটা ভরে দেবে। সেজন্যে এটুকু লেখাই ভাল। মেনকার বাস্তববুদ্ধি অত্যন্ত টনটনে, মহিলা যা বোঝার ঠিক বুঝে নেবে।

    ভীমের পক্ষে ভৈরবের হাত দিয়ে চিঠি পাঠানো ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। মেনকার পাঠানো লোককে ও সোজাসুজি দেখা দিতে পারে না। তাহলেই ফাঁস হয়ে যাবে যে ভীম নিরুদ্দেশে যায়নি, কলকাতার অমুক জায়গায় গিয়ে লুকিয়ে আছে। পোস্টাপিস দিয়েও চিঠি পাঠানো যাবে না। সে চিঠি নগেন মেনকাকে না দিয়ে দীনু বামুনটার হাতে তুলে দিতে পারে। রেজিস্টারি করে চিঠি পাঠালে তো আরও সর্বনাশ। নগেন খামের ওপর থেকে যে পাঠিয়েছে তার ঠিকানাটুকু নেবে। তারপর ওটা দীনুর হাতে দেবে, তার জন্যে দীনুর থেকে মোটা বকশিশও আদায় করে নেবে।

    আপাতত ওর আর কিছু করার নেই। ভীম চুপচাপ রইল। কয়েকমাস কেটে গেল। তারপর আবার মেনকার চিঠি এল। ভৈরবের কাছেই বুড়ি আবার লোক পাঠিয়েছে, ভৈরবই নিয়ে এল চিঠিটা। কিন্তু এবারে ওর মুখ গম্ভীর, কিছুটা বিরক্ত। কারণ শুধু চিঠিই এসেছে, সঙ্গে টাকা ছিল না। ভীমের হাতে চিঠি দেবার সময় ভৈরব বলেই ফেলল, বারবার এরকম চিঠির দেয়ানেয়া করা তো আমার পক্ষে অসুবিধের ব্যাপার — আমার এত সময় কোথায়? মেনকাপিসীকে লিখে দাও সে কথা।

    ভীম চুপচাপ চিঠিটা নিয়ে নিল, ভৈরবের এই বিরক্তির উত্তরে কিছু বলা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। মায়ের চিঠিটা পড়ল। একবার পড়ল। চিঠির একটা বিশেষ জায়গা আবার পড়ল। এখন জষ্টি মাসের সন্ধেবেলা। এই ঘরের ভেতর হাওয়া খেলে না। ঘরে বিজলী পাখাও নেই, ঘরের ছাত থেকে পাখা ঝোলাবার কোন ব্যবস্থাই নেই। সুতরাং ঘরের ভেতর পচা গরম। কিন্তু ভীমের মনে হল ঘরের ভেতর বসন্তকালের ফুরফুরে হাওয়া ছেড়েছে। চৌধুরিপুকুরের ঠাকরুণ, আবার দয়া করেছেন তিনি। ও সুলোচনাকে বলল, ভৈরবদাকে একটু চা-টা দাও। রাতে না খাইয়ে আজ দাদাকে ছাড়া হবে না। তারপর চটপট গায়ে শার্ট প্যান্ট চাপিয়ে মানিব্যাগ নিয়ে দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। মোড়ের খাবারের দোকানটার থেকে ভাল কিছু কিনে আনবে। ওরা নিজেরা খাবে, ভৈরবকেও খাওয়াবে। ভৈরবই তো মায়ের চিঠিটা হাতে করে নিয়ে এসেছে। আজ বড় আনন্দের দিন। ভীমের জীবনের সব সুখ কালো কালো মেঘ জমে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। আজ সেই মেঘ ছিঁড়ে গেছে, এক মুঠো আনন্দ সেই ছেঁড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে ভীমের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসেছে।

    মেনকার চিঠিতে প্রথমে কিছু মামুলি কথাবার্তা। আমরা কুশলে আছি, তোমাদের সকলই কুশল তো — এইসব। তারপর আসল খবর। বুড়ি লিখেছে — গ্রামে একটি ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহা তোমাকে জানানো প্রয়োজন মনে করি। চিত্ত বাউরির বিধবা ভগিনী ভূতনি, যাহাকে তুমি ভূতনিপিসী বলিয়া সম্বোধন করিয়া থাক, একটি মৃত সন্তান অকালে প্রসব করিয়াছে। উহার কুৎসায় এখন গ্রামে কান পাতা ভার। পোড়ারমুখী কাহার সহিত এই দুষ্কর্ম করিয়াছিল কে জানে। সে নিজেও বিছানা লইয়াছে। গুরুতর সূতিকা রোগ উহাকে ধরিয়াছে, উঠিয়া বসিবার সামর্থটুকুও তাহার নাই। তাহার দাদা চিত্ত বাউরিও অত্যন্ত অসুস্থ। অত্যাধিক পানাসক্তির জন্য তাহার যকৃতে পচন ধরিয়াছে। তথাপি মদ্যপানে তাহার কোন বিরতি নাই।

    তারপর মেনকা আরও কিছু লিখেছে, ভীম সে সব আর ভাল করে পড়েনি, মনেও রাখেনি। সন্তানের মৃত্যু হলে সচরাচর বাপ দুঃখ পায়। তার প্রথম এবং অবাঞ্ছিত সন্তানের মৃত্যুতে ভীমের হাড়ে বাতাস লেগেছিল। এবারে খালি চুপ করে বসে থাকা। কদ্দিনে ওই ভাই বোন দুটোর পটল তোলার খবর আসে।

    বেশি দেরি হয়নি। মাসকয়েকের মধ্যেই সেই খবর এসেছিল। প্রথমে গেছে ভূতনি, তার পরেপরেই চিত্ত। অবশ্য এই ভাইবোনের গঙ্গাযাত্রায় মেনকার যে কোন হাত ছিল না তা নয়। ভূতনির ওপর খুব দরদ দেখিয়ে কবিরাজ ডাকিয়ে ওকে দেখিয়েছিল। চিত্ত বা ভূতনি কেউই তাতে কোন আপত্তি করেনি। বরং খুশিই হয়েছিল। কিন্তু গোপনে সেই কবিরাজকে নিজের বাড়িতে ডেকে মেনকা কথা বলেছিল। তার হাতে দিয়েছিল একমুঠো টাকা আর ভবিষ্যতে আরও টাকা দেবে এই অঙ্গীকারও করেছিল। টাকা দেয়ার কারণটা বলেছিল চুপি চুপি। কবিরাজ বুদ্ধিমান এবং বাস্তববাদী লোক। টানাটানি করে সংসার চলে, মেনকার টাকাটায় তার অনেক উপকার হবে। মিছিমিছি আদর্শবাদী হয়ে মেনকার টাকা ফেরৎ দেয়া মানে নিজের পায়ে কুড়ুল মারা। ভূতনি তো যাবেই, আজ না হলে কাল। বিষ তো আর দেয়া যাবে না। তবে কিছু জড়িবুটি এক বছরের আয়ুকে তিন মাস করে দিতে পারে। এর ভেতর অন্যায় কিছু নেই। মরার পরে ডাক্তারি কাটাছেঁড়া করলেও কিছু পাওয়া যায় না। মেনকার কাজ পাকা। বুড়ি চিত্তর কথাও চিন্তা করে রেখেছিল। ওকে টাকা তো দিতই, তার সঙ্গে শুরু করেছিল সব থেকে কড়া চোলাই মদ ওকে সোজাসুজি পাঠিয়ে দেয়া। ধুরন্ধর বুড়ি জানত চিত্তকে যত দেয়া যাবে ও তত খাবে — এমনকী ওর বৌও বেশ কিছু টানবে। মেনকার লোক ওর ঘরে সব ভরা বোতল নিয়ে যেত আর ওর ঘর থেকে খালি বোতলগুলো নিয়ে আসত। তা না হলে চিত্ত মরার পর ওর ঘর থেকে খালি বোতলের পাহাড় বেরোত। গাঁয়ের লোক বুঝে যেত মেনকা ইচ্ছে করে মদ খাইয়ে খাইয়ে চিত্তকে মেরেছে। এ নিয়ে বিটলে দীনু আবার হয়তো একটা ঝামেলা করত, চিত্তর বৌকে দিয়ে থানায় একটা নালিশ টালিশ লেখাবার চেষ্টা করত।

    এই চিঠি মেনকা সোজাসুজি ভীমের কাছেই পাঠিয়েছিল। এখন দীনু ভীমের ঠিকানা জানতে পারলেও কোন ক্ষতি নেই। যাদের হাতে নালিশ করার ক্ষমতা ছিল তারা এখন ফৌত হয়েছে। তবে কোন টাকাপয়সা পাঠায়নি। ভূতনি আর চিত্তর খবর ছাড়া লিখেছিল, বধূমাতাকে একবার দেখিতে ইচ্ছা করি। উহাকে লইয়া একবার এখানে আসিও।

    অর্থাৎ মেনকা আগে ছেলের বৌকে নেড়ে চেড়ে দেখবে। তারপর তাকে পছন্দ হলে তবেই হাত উবুড় করবে। তবে ভীমেরও এখন মতলব ছিল দেশে ফিরে যাওয়া। এখানে কারখানায় হাড়ভাঙা খাটুনি। তাতেও যা রোজগার তাতে সংসার চলে না, ওভারটাইম খাটলেও না। ভৈরবের কাছে হাত পাততে হয়। তাছাড়া এখন সুলোচনার পেটে বাচ্চা এসেছে, নেন্ডী গেন্ডী হবার পর তো খরচা আরও বাড়বে। সে জায়গায় যদি দেশে ফিরে গিয়ে সেখানে থেকে যাওয়া যায় তাহলে আরামে আলসেমিতে দিন কাটানো যাবে, কমলামাসির রান্নাখানা খাওয়া যাবে। সংসার সাইজে বাড়লেও রোজগারের ভাবনা ভাবতে হবে না। কিন্তু দুটো ব্যাপার আছে। সুলোচনা ভীমের সঙ্গে ওর গাঁয়ে যেতে রাজী হবে কিনা। আর সেখানে গেলে শাশুড়ির সঙ্গে বনিবনা করে থাকবে কিনা। তা প্রথমটা ভীমের চেষ্টায় হতে পারে। পরেরটা ঠাকরুণের দয়া।


    ভীম উঠে পড়ে বৌকে তোয়াজ করতে লেগে গেল। শরীরের এই অবস্থায় বৌটার একটু নোলা হয়েছে, বিশেষ করে মিষ্টি খেতে চায়। সেজন্যে ভীম ভাল মিষ্টি কিনে আনে, হাতে করে বৌ এর মুখে দিয়ে খাওয়ায়। বেশি আদিখ্যেতা করলে অবশ্য সুলোচনা মুখ ঝামটা দেয়। ভীম তাতে হাসে, পরের দিন আবার মিষ্টি নিয়ে আসে। ভৈরবের কাছে ধার অবশ্য বেড়ে চলেছে। তা বাড়ুক, মহারাণীর তুষ্ট হওয়াটা প্রথম দরকার। তেল মেরে মেরে ওর মনটা নরম হলে তবেই ভীম দেশে যাওয়ার কথাটা পাড়বে। তা না হলে এক কথায় মামলা খারিজ হয়ে যেতে পারে।

    তোয়াজে কে না বশ হয়? তাও যদি আবার বেশ কিছুদিন ধরে সেই তোয়াজ টানা চলতে থাকে। সুলোচনা ভীমের সঙ্গে ওর দেশে যেতে রাজী হয়ে গেল। ওখানে গিয়ে থেকে যাওয়ার কথা ভীম তখনই কিছু বলল না। ওখানে যাক, গিয়ে হাত পা ছড়িয়ে খাটপালঙ্কে ঘুমোক, কমলামাসীর হাতে রান্না জিভে জল ঝরানো খাবার খাক, তারপর বলা যাবে।

    তবে ভীম চাকরি ছেড়ে দিল না। খালি দু সপ্তাহের ছুটি নিল। বলা তো যায় না, যদি ফিরে আসতে হয়? তখন চাকরি না থাকলে খাবে কি?

    সুলোচনা আগে কখনো গাঁয়ে থাকেনি। শ্বশুরবাড়িতে এসেই নাক সিঁটকোল। এসব জায়গায় মানুষ থাকে নাকি? ইলেকটিরি লাইট কই! চান করার আলাদা জায়গা কই! কলের জল কই! হ্যারিকেনের আলো, পুকুরে চান — আরে ছোঃ। আর জল সরতে বাড়ির বাইরে যাওয়া? ঝোপঝাড়ের আড়ালে গিয়ে বসা? বাপের জন্মে এসব কথা কেউ কখনো শুনেছে নাকি? ভীমের ওপর হুকুম হয়ে গেল — চটপট বাড়ি ফিরে চলো।

    মেনকাও একেবারেই চায়নি যে ভীম বৌ নিয়ে এখানে থাকুক। সুলোচনাকে ওর পছন্দ হয়নি বললে কম বলা হবে। খুব বেশিরকম অপছন্দ হয়েছে। এতো মেয়ে নয়, একটা শাড়ি পরা পুরুষ। তাছাড়া শাশুড়িকে ছেদ্দাভক্তি করা এই মেয়েটার একেবারেই আসে না তা মেনকা বুঝে নিয়েছে। কমলার সঙ্গে তো ওর ব্যবহার যথেষ্ট খারাপ। ছেলের বৌ এর মুখ দেখা হয়ে গেছে, মেনকা তাকে একটু সোনা দিয়ে আশীর্বাদও করে দিয়েছে, এবার ওদের এখান থেকে তাড়াতাড়ি বিদেয় হওয়াই ভাল। কিছু ওজনদার সোনার গয়না মেনকা বানিয়ে রেখেছিল — ছেলের বৌ পছন্দমত হলে সে সব তাকে দেবে বলে। সেগুলো আর ওর বাক্স থেকে বেরোয়নি। থাক ওগুলো এখানে। নাতবৌ যদি পছন্দমত হয় তাহলে সে এসব পাবে।

    ভীম বৌকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে এল, নিজের সেই পুরনো কুঠুরিতে। ও এজন্যে দুঃখ করেনি, কারণ ঠাকরুণের নিশ্চয়ই ইচ্ছে ছিল না যে ভীম দেশে থেকে গিয়ে আয়েস করে। আবার ভীমের নিয়ম করে কারখানায় হাজিরা দেওয়া, ওস্তাদকে বোতলের জোগান দেয়া। মনে এখনও একটু আশা — মায়ের মনটা সময় গেলে হয়তো একটু নরম হবে, তখন কিছু টাকাপয়সা মাঝে মাঝে পাঠাবে।

    মেনকা টাকা পাঠায়নি। মামুলি চিঠি মাঝে মাঝে পাঠিয়েছে, কিন্তু কোন টাকা কখনো নয়। ওর টাকায় ওর ওই খাণ্ডার ছেলের বৌ কলকাতায় বসে আরাম করবে তা হবে না। ছেলেটা অবশ্য একটু কষ্ট পাবে। তা পাক। ওই মেয়েকে বিয়ে করে যে অন্যায়টা সে করেছে তার শাস্তি তাকে পেতে হবে। নাতি নাতনি এসব হোক, তখন মেনকা চিন্তা করবে ছেলেকে সাহায্য করা উচিৎ কি না।

    ভীম সুলোচনাকে নিয়ে পরের বার দেশে গিয়েছিল প্রায় দশ বারো বছর পরে। সঙ্গে তিন ছেলে! মেনকা লিখেছিল ভীম যেন সম্ভব হলে তাকে তার নাতিদের দেখিয়ে নিয়ে যায়। সুলোচনাকে নিয়ে যাওয়ার কথা কিছু লেখেনি। কোন চিঠিতেই মেনকা সুলোচনা সম্বন্ধে কিছু লিখত না, মামুলি একটা আশীর্বাদের কথা ছাড়া। কিন্তু ভীমের ছেলেরা ছোট, বিশেষ করে সবচেয়ে ছোটটা তো একেবারে ছোট, ওরা তো মাকে ছাড়া যেতে পারবে না। এবারে যেতে সুলোচনা খুব একটা আপত্তি করেনি। কয়েকটা দিন একটু বেড়িয়ে এলে মন্দ কি? কাজের বাড়িগুলো হারামি, এমনিতে ছুটি দিতে ঘোর ঝামেলা করে। সোয়ামির দেশের বাড়িতে শাশুড়ির অসুখ, তাকে দেখতে যাবে শুনলে মুখ ব্যাজার করবে কিন্তু ছুটি দিতে আপত্তি করতে পারবে না। অসুস্থ শাশুড়িকে তার বাড়ি গিয়ে দেখা করার মত মহৎ কাজে বাগড়া দিতে পারবে না। অসুখের কথাটা অবশ্যি মিথ্যে করে বলতে হবে। কিন্তু এছাড়া উপায় কি? মিথ্যে কথায় কাজ হয়, সত্যি কথা বললে তো আর তা হয় না।

    এবারেও ভীমের মতলব ছিল পারলে ওখানেই পাকাপাকি থাকবে। কিন্তু গিয়ে আবার বুঝল ঠাকরুণের সেটা ইচ্ছে নয়। মেনকা আর সুলোচনার বহুবছর পরে চার চোখে আবার দেখা হল কিন্তু এবারও বনিবনা হল না। মেনকা অবশ্য নাতিদের খুবই আদরযত্ন করল, কাপড়জামা জিনিষপত্রও কিনে দিল। সুলোচনাও যে একখানা ভাল শাড়ি পেল না তা নয়। কিন্তু ভাবে ভঙ্গীতে মেনকা ছেলে আর তার বৌকে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিল যে এই আদরযত্ন দিন কয়েকের বেশি নয়। এই কদিন এখানে খাও দাও, আয়েস কর, তোমাদের ছেলেরা হুল্লোড় করে বেড়াক। তারপর কলকাতায় নিজেদের ইঁদুরের গর্তে ফিরে যাও। সুলোচনাও আপোষের কোন চেষ্টা করেনি। রাগী কঠিন মুখ করে থেকেছে, আর রাতে পাশে শোয়া ভীমকে ফিস ফিস করে প্রচুর গালাগাল দিয়েছে। কলকাতায় ও ভীমকে জোরগলায় ধমক চমক করে। সেটা ওখানে মানিয়ে যায়। কারণ ওখানে প্রায় রোজই কোন না কোন ঘর থেকে স্বামী-স্ত্রীর সশব্দ ঝগড়ার আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়। এখানে গলা তুলে ভীমকে ধমক দেওয়া সম্ভব নয়। মেনকা আর কমলা, দুজনেই শুনতে পাবে।

    বৌ আর ছেলেদের নিয়ে কয়েকদিন পরে ফিরে এসেছিল ভীম। আর কোনোদিন ওর দেশের বাড়িতে যাওয়া হয়নি।


    সেবার দেশের বাড়ি থেকে ফেরার পরেই ঘটেছিল ভীমের জীবনের সবচেয়ে বড় অশুভ ঘটনা — ওর বড় দুই ছেলের মৃত্যু। শোক নামের অনুভূতিটির সঙ্গে ভীমের আগে কোন পরিচয় হয়নি। ওর বাপ যখন মারা যায় তখন ও অপরিণত বয়স্ক। সেই মৃত্যু ওর মনে কোন দাগ ফেলতে পারেনি। এখন ও বুঝল মানুষের দুঃখ কতখানি তীব্র এবং কষ্টদায়ক হতে পারে। মেজ ছেলেটা মরাতে ভীম অত কিছু চোট পায়নি। কিন্তু বড়টা — ওহ্‌। ওর বড় ছেলেটা! ও যে বড়ই ভীমের কাছ ঘেঁষা ছিল! ও যখন একেবারে ছোট ছিল তখন তো ভীমেরই কোলে পিঠে উঠেছে, মায়ের চেয়ে বাপের আদর কেড়েছে বেশি। একটু বড় হয়ে বাপের কোল থেকে নামল, কিন্তু তখন সব খেলা, আর ভীমের সঙ্গেই যত খেলা। সেই সঙ্গে নানা কথা, নানা প্রশ্ন — এটা কি, ওটা কেন? সুলোচনার কাছে খুব বেশি ঘেঁষত না — কোন মেয়েমানুষের শরীরে দয়ামায়ার ঘাটতি থাকলে বাচ্চারা সেটা ভালই টের পায়। অবশ্য ছেলেদের মারা যাওয়াতে সুলোচনা দুঃখ পায়নি এমন নয়। দু চারদিন হাঁউমাউ করে কাঁদল, তারপর কান্না থামাল। যেটুকু দুঃখ পেয়েছিল ঐ কদিনের চোখের জল তা ধুয়েমুছে দিয়েছিল। প্রতিবেশী মেয়েরা তার আগেই নিজেদের কান্না থামিয়ে দিয়েছিল। পাশের ঘরের বা পাশের পাশের ঘরের মেয়েছেলেটার দুটো ছেলে মারা গেছে, তার জন্যে কদিন আর দুঃখ দেখানো যায়? প্রত্যেকেরই তো নিজের নিজের কাজ রয়েছে। মেনকাও এসেছিল, কান্নাকাটির পাট চুকিয়ে দিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে গিয়েছিল।

    ভীম পুরুষমানুষ, ও চোখের জল ফেলেনি, সেজন্যে বুকের ভেতরের দগদগে দুঃখটাকে ভুলতে পারেনি। কিন্তু ও একেবারে চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। দিন সাত দশ কাজে গেল না, ঘরে খালি শুয়ে শুয়ে রইল। কাজে যেতে শুরু করার পরও ঘরে ফিরে চুপ মেরে বসে থাকত। ওর ব্যাপার দেখে সুলোচনাও একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিল। মানুষটা পাগল টাগল হয়ে যাবে না তো? তাহলে তো বিপদ, ঘরের মধ্যে একটা পাগল মানুষ নিয়ে ও থাকবে কি করে? পাগলের চিকিৎসায় খরচ করার তো কথাই ওঠে না, ওর খাওয়ার খরচই বা সুলোচনা জোগাবে কোথা থেকে? ছোট ছেলেটার খাওয়া পরার পেছনেও তো খরচা আছে। তার ওপর ওর পাগলামি যদি দিন দিন বাড়তে থাকে তাহলে হয়তো ওকে বেঁধে রাখতে হবে। তাছাড়া পাগল যদি ঘরের মধ্যেই পেচ্ছাপ পায়খানা শুরু করে দেয় তাহলে সে সব পরিষ্কার করবে কে? সুলোচনা? এঃ, ম্যা গো। নাঃ, গোড়াতেই ওকে সরকারি পাগলখানায় ভর্তি করে দেবে। তারপর ওর যা হয় তা হবে।

    তবে সুলোচনার ভয় পাবার কারণটা অমূলক ছিল। ভীমের মাথা যথেষ্ট ঠান্ডা ছিল। ও খালি চুপ করে চিন্তা করত, শোকের এই তীব্র পীড়নে নানারকম চিন্তা ঘুরত ওর মাথায়। একটা প্রশ্ন ওর মনে প্রায়ই আসত — ঠাকরুণ সহায় থাকতে কি করে ওর জীবনে এতবড় একটা দুঃখের ঘটনা ঘটে যেতে পারল। ও জানত না যে ঠাকরুণের ক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রেই সীমিত, যেখানে তীব্র দৈব প্রতিকূল সেক্ষেত্রে উপদেবীটির ক্ষমতা একেবারেই অসহায়। অনেক সময় ও নিজেকেই দায়ী করত ওর এই দুর্ভাগ্যের জন্যে। ওর-ই তো ভুল হয়েছিল, ও কেন নিজের জামার পকেটে অতগুলো টাকা রেখে দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছিল। যখন এই চিন্তা মাথায় আসত ও ভেতরে ভেতরে ছটফট করত — আহা, যদি একবার মাথায় খেলত যে ছেলেরা ঐ পকেটে হাত ঢোকাতে পারে। তবে ওই বুদ্ধিটা নিশ্চয়ই মেজ ভাইটা দিয়েছিল। ও দেখতে অনেকটা ভৈরবের মত ছিল, শয়তানি বুদ্ধিটাও বোধহয় মামার মতই ছিল। বড় ছেলেটা নিজে থেকে বদমায়েসিটা করেনি, একথা ভেবে ভীম অনেকটা সান্ত্বনা পেয়েছিল। এসব ভাবতে ভাবতেই একবার ভীমের মনে পড়ে গিয়েছিল ছেলেদের যখন পোড়াতে নিয়ে যাওয়া হয় বড়টার গায়ে মেনকার দেওয়া একটা জামা ছিল।

    চুপ করে থাকার একটা সুফল পেয়েছিল ভীম। প্রতিবেশীদের ওর ঘরে এসে ওকে সান্ত্বনা দেয়াটা খুব শীগগিরিই কমে গিয়েছিল। ভীমের অসহ্য লাগত তাদের জ্ঞান দেয়া সব সহানুভূতি — বাড়িতে ছেলে থাকলে তাদের সামনে টাকাপয়সা রেখে দিতে নেই। ছেলে ছোকরাকে বিশ্বাস আছে? আরে মশাই, আমার চেনা একজন লোকের বারো বছরের ছেলে — বলা নেই, কওয়া নেই, মায়ের আলমারি থেকে টাকা বার করে নিয়ে বাড়ি থেকে পিটটান। আলমারির চাবি বন্ধ করে রাখেনি, আর দুপুরে মা ঘুম দিচ্ছে, সেই সুযোগে এই কাণ্ড। তারপরে থানাপুলিশ — এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি — সে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার —

    প্রতিবেশীরাও নিজেদের ভেতর ভীমকে নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা করেছিল। ভীমের এরকম চুপ মেরে যাওয়াতে তাদের মনে কোন সন্দেহ ছিল না যে লোকটা পাগল হয়ে যাবে। এমনিতেই ওর বৌটা ওকে মারধর করে, পাগল হয়ে গেলে তো বৌটা লোকটাকে চোরের মার মারবে। ওকে তো দড়ি দিয়ে কড়াক্কড় বেঁধেও রাখতে হবে। পাগলটা তখন চেঁচাবে, বৌকে কুৎসিত অশ্লীল গালাগাল করবে। সে একটা খুব রগড়ের ব্যাপার হবে। ওই পল্লীরই একটি ঘরের গিন্নী অবশ্য একথার প্রতিবাদ করেছিল। আহা, মানুষগুলোর যেরকম কথা। কত লোকেরই তো ছেলে মরে, সবাই কি পাগল হয় নাকি? এরকম রসভঙ্গকারী কথা শুনে তার কর্তা চটে গিয়েছিল। খেঁকিয়ে উঠেছিল, এহ্‌, মাগির কত দরদ। লোকটার সঙ্গে কখনো এক বিছানায় শুয়েছিলি নাকি? নারীটি তার কর্তার এরকম মনোমুগ্ধকর কথা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং বলে, কি বললি আঁটকুড়ির ব্যাটা? আর একথা বলার সাথে সাথেই সে ঘরের কোণে রাখা কয়েকটি অ্যালুমিনিয়ামের থালা বাটি তার পুরুষটির দিকে সবেগে ছুঁড়ে মারে। পুরুষটি তার দু হাত দিয়ে কোন রকমে ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকে ঠেকায় আর একই সঙ্গে পায়ে পায়ে তার অর্ধাঙ্গিনীর কাছে এগিয়ে গিয়ে এক হাতে তার চুলের মুঠি ধরে এবং অন্য হাতে নারীটির ওপর কিল, চড় ইত্যাদি বর্ষণ করতে থাকে। অতিক্রুদ্ধা বনবিড়ালীটি তখন আঁচড় কামড়ের সাহায্য নেয় আর স্বামী স্ত্রী দুজনের চীৎকারে আকৃষ্ট হয়ে সেখানে অতিদ্রুত দর্শকদের একটা ভীড় জমে যায়। মেয়েরা তাদের ছাড়িয়ে দেয়, কিন্তু কিছুক্ষণ পরে, যখন ওই যুযুধান পুরুষ এবং নারী দুজনেই শক্তিক্ষয়ে যথেষ্ট ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

    দিন কেটে মাস, মাস কেটে বছর। ভীমের ব্যবহারে কোন তারতম্য নেই। সকালে উঠে তাড়াহুড়ো করে তৈরি হয়ে নিয়ে কারখানায় যাবার জন্যে বেরিয়ে যায়, সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে জামা ছাড়ে, তারপর হাঁটু ভাঁজ করে দেয়ালে ঠেস দিয়ে মেঝেয় বসে চুপ করে বিড়ি খায়। বিড়ির ছাই ঘর নোংরা করে, কিন্তু সুলোচনা ওকে এ নিয়ে কিছু বলে না। চুপ করে বসে বিড়ি টানছে টানুক, মানুষটা পাগল যে হয়নি এই যথেষ্ট। প্রতিযোগীরা কেউ ওর সঙ্গে গল্প করবার জন্যে আসে না। তারা হতাশ এবং ভীমের ওপর কিছুটা বিরক্ত। লোকটা পাগল না হয়ে সুস্থ রইল? এরকম তো কথা ছিল না।

    ভীমও কখনো কাউকে বলবার চেষ্টা করেনি যে এই ঘর, তার পারিপার্শ্বিক, এসব ওর পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। ঘরটা যেন বড় বেশি খালি। দুটি বালক, ও নিজে যাদের এই দুনিয়ায় এনেছিল, তারা এই ঘরে ছিল, কিন্তু এখন আর নেই। তারা এই ঘরে খুনসুটি দুষ্টুমি করত, দৌড়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে যেত, আবার ছুটে এসে দড়াম করে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে পড়ত। এখন সে সব হয় না। সব কিছু, নিষ্ঠুরভাবে শান্ত। এই খালি ভাবটা ওর বুকে জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে থাকে, এই শূন্যতা ওর শরীর মনের ভেতর হু হু করে ছুটে বেড়ায়। ওর গলার ভেতর কিছু আটকে আছে মনে হয়। বার বার ঢোঁক গিললেও সেটা আবার ফিরে আসে, গলার ভেতর চেপে বসে থাকে। অতএব ভীম পালাতে চায় এই বর্তমান কালটার থেকে যার প্রতিটি মুহূর্ত তাকে দুরমুশ করে, কষ্ট দেয়। সুলোচনা ভীমের এই মানসিক অবস্থার কোন আঁচ পায় না। আঁচ পাওয়া তার পক্ষে সম্ভবও ছিল না, তার কারণ সেই ক্ষমতা নিয়ে সে এই দুনিয়াতে জন্ম নেয়নি। সে মাঝে মাঝে মুখে বা হাতের দু আঙুলে বিড়ি ধরা ভীমের দিকে তাকায় — দেয়ালে ঠেস দিয়ে শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে তার পুরুষটি, জ্বলন্ত বিড়িটার থেকে একটা সরু ধোঁয়ার রেখা ধীরে ধীরে সোজা ওপরে উঠছে।

    ভীম ফিরে যায় তার ছোটবেলায়। ও কমলামাসীর কোলে বসা, মাসি ভাত মেখে তাকে খাইয়ে দিচ্ছে। ভীমের তখন দশ এগারো বছর বয়েস, ওই বয়েসের সঙ্গী সাথীদের সাথে ও খুব ডাণ্ডাগুলি খেলত। সনাতন জেলের ছেলে বিন্দাবন খুব ভাল খেলতে পারত, এক একটা মারে গুলিটাকে কোথায় কোথায় দূরে দূরে পাঠিয়ে দিত। একবার এই গুলি খুঁজতে গিয়ে ভূতের ভয় পেয়েছিল ভীম। ও ঢুকেছিল একটা জংলা জায়গায়, সেখানে সব বুনো ঝোপ, আগাছার জঙ্গল, একটা প্রকাণ্ড শিরীষ গাছ তাদের মাঝখানে তার প্রচুর ডালপালা আর পাতার ঘন জঙ্গল নিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে। কোন লোক ও জায়গায় যেত না। কারণ শিরীষ গাছটার বদনাম ছিল। অনেক কাল আগে, সে ভীমের জন্মেরও বহু আগে এই গাঁয়ের একটা মেয়ে গলায় নিজের শাড়ির ফাঁস দিয়ে এই গাছের একটা শক্তপোক্ত ডাল থেকে ঝুলে পড়েছিল। এই আত্মহত্যার সম্ভাব্য কারণ নিয়ে গাঁয়ের লোক অনেক চর্চা করেছিল। হতে পারে স্বামীর ঘরে শাশুড়ির অত্যাচার। বা এও হতে পারে যে তার স্বামী যখন রোজগারের জন্যে ঘর ছেড়ে অনেকদিন ধরে বাইরে তখন তার একটি গোপন প্রেমিক জুটে গিয়েছিল, সেই লোকটি প্রেমের তীব্রতায় তাকে গর্ভবতী করেছিল, আর মেয়েটির পক্ষে তার গর্ভস্থ সন্তানকে তার মন্ত্র পড়ে বিয়ে করা স্বামীর দান বলে চালিয়ে দেওয়া কোনমতেই সম্ভব ছিল না। কিন্তু তারপর থেকে মেয়েটি আর সে জায়গা ছেড়ে যায়নি, তার বায়বীয় অস্তিত্ব নিয়ে ঐ গাছের আরামদায়ক ডালপালার বাসাতেই থেকে গিয়েছিল। এ কথা জোর গলায় প্রচার করেছিল গ্রামেরই বাসিন্দা ভূতেশ্বর ওঝা। ওর আসল নাম অন্য কিছু ছিল, কিন্তু গাঁয়ের মেয়েদের ভূতে ধরলে লঙ্কার গুঁড়োর ধোঁয়া এবং কঞ্চির প্রবল পিটুনি দিয়ে সেই ভূত ও-ই ছাড়াত বলে লোকের মুখে মুখে ঐ ভূতেশ্বর নামটাই চালু হয়ে গিয়েছিল।

    খেলার ঝোঁকে ভীম শিরীষ গাছটার বিশেষত্ব ভুলে গিয়েছিল, একেবারে গাছটার গোড়ায় গিয়ে সেখানে পড়ে থাকা হলদে হয়ে যাওয়া শুকনো পাতার গাদার ভেতর গুলিটা খোঁজাখুঁজি করছিল। কিন্তু সেই সময় হঠাৎ একটা জোরালো হাওয়া দেয়, সেখানকার ঝোপে ঝোপে, গাছটার পাতায় পাতায় শোঁ শোঁ শন শন শব্দ ওঠে আর সেই সব পড়ে থাকা হলদে শুকনো পাতা প্রাণ পেয়ে গিয়ে ভীমের চারপাশ ঘিরে উড়তে শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে ভীমের গাছটির ইতিহাস মনে পড়ে যায়। ও বোঝে যে ওর হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, ওগুলো ও এখন নাড়তে পারছে না। কিন্তু সেই সময় ও হঠাৎ মনের ভেতর ঠাকরুণের নির্দেশ পায়, কোন ভয় নেই, ছুট্টে বেরিয়ে যাও এ জায়গার থেকে। ঠাকরুণের দয়ায় সেদিন প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল ভীম। তবে গুলিটা উদ্ধার করে আনতে পারেনি, ঠাকরুণ তুচ্ছ একটা ডান্ডাগুলি খেলার গুলি নিয়ে মাথা ঘামান নি। কিন্তু ভীম একটু দুঃখিত হয়েছিল, কারণ ওটি ভীমেরই সম্পত্তি ছিল। ওটা খোয়া যাবার পরে বহুদিন আর ওদের ডান্ডাগুলি খেলার আসর বসেনি।

    আবার ও ফিরে আসে ওর এই ঘরটায় ও এই ঘরের ভেতরেই সুখের স্মৃতি খোঁজে। একটা মাস ছয় আটের বাচ্চা হামা দিয়ে এই ঘরের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে, ভীম ঘরের মেঝেয় বসা। বাচ্চাটা জোরে হামা দিয়ে ভীমের কাছে চলে আসে, ভীমের হাঁটু ধরে দাঁড়িয়ে ওঠার চেষ্টা করে। ভীম ওকে দু হাতে ধরে দাঁড় করায়। ভারি খুশি হয় বাচ্চাটা, ফোকলা দুটো মাড়ি বার করে মিটমিট করে হেসে ওঠে। আবার ভীম দেখতে পায় হামা দিতে দিতে হঠাৎ থেমে বাচ্চাটা মেঝেয় পড়ে থাকা এক টুকরো নোংরা খুব মন দিয়ে দেখছে। তারপর কচি কচি আঙুল দিয়ে নোংরাটা মেঝে থেকে খুঁটে তুলে নেয়, টুক করে সেটা নিজের মুখের ভেতর ভরে দেয়। ভীম দৌড়ে আসে, শিশুটির মুখের ভেতর আঙুল চালিয়ে নোংরাটা ওর মুখ থেকে বার করে নেয়। কিন্তু ভীমের এই অনধিকার চর্চায় বাচ্চাটা বড়ই চটে যায়, উঁ উঁ উঁ করে জোরালো শব্দে ভীমের এই অন্যায় কাজের তীব্র প্রতিবাদ করে আর দুই মাড়ি দিয়ে ভীমের আঙুলটা জোরে কামড়ে ধরে। তখন রীতিমতো চেষ্টা করে ভীমকে নিজের আঙুলটা ছাড়াতে হয়।

    এমন অনেকদিন হয়েছে যে বেশি রাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে ভীম রতিকর্মের জন্যে সুলোচনাকে তৈরি করতে ব্যস্ত। ছেলে অয়েলক্লথ নোংরা করে ফেলে ঘুম ভেঙে কেঁদে উঠেছে। থেমে গেছে ভীম, মুখ ফিরিয়েছে বাচ্চার দিকে। সুলোচনা হয়তো নিচুগলায় বলেছে, কাঁদুক না ছেলে, ওকে পরে দেখা যাবে এখন। কিন্তু ভীমের সন্তানস্নেহ ওর কামতাড়নাকে ছাপিয়ে গিয়েছে। ও ছেলেকে পরিষ্কার করতে, অয়েলক্লথ পাল্টাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। পরিষ্কার অয়েলক্লথে শুয়ে ছেলে যতক্ষণে ঘুমিয়েছে সুলোচনাও ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে, একটু আধটু ফুড়ুৎ ফুর করে আওয়াজ বেরোচ্ছে ওর নাক দিয়ে।

    অতএব ভীমের এই শোকগ্রস্ত মানসিক অবস্থায় ও সুখ পেত। ওর ছোটবেলায় ফিরে গিয়ে বা ওর সন্তানের স্মৃতির ভেতর। ভূতনি বা সুলোচনার সঙ্গে শারীরিক ঘনিষ্ঠতার ছবি ওর মনে যে আসেনি তা নয়। কিন্তু তাতে সুখ কই, আনন্দ কোথায়? ভীম এটা বেশ বুঝেছিল যে ওসব তাৎক্ষণিক দৈহিক উত্তেজনা ছাড়া আর কিছুই নয়। ও সবের মধ্যে চিরস্থায়ী আনন্দ কিছু নেই, সেসব ঘটনা পেটের বেগমোচনের মত। শেষ হয়ে গেলেই শরীরের স্বস্তি।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • প্রচ্ছদ | পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০ | পর্ব ১১ | পর্ব ১২ | পর্ব ১৩ | পর্ব ১৪ | পর্ব ১৫ (শেষ)
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments