।। পুরনো কথা - ভীমের কথা ।।
বাস কন্ডাক্টারের ঠেলা খেয়ে বাসের দরজার সিঁড়ি থেকে একবার হড়াৎ করে রাস্তায় নেমে পড়েছিল ভীম। তাল সামলাতে পারে নি, ও বাসের পাশে রাস্তার ওপরেই বসে পড়েছিল — কন্ডাক্টারের ঠেলায় বাস থেকে নেমে পড়ার অভ্যেস এই শহরের লোকজনের আছে, ভীমের তো আর নেই। ভীম বাসে চড়েছেই বা কদিন? যা ও বা চড়েছে সে মফস্বলের বাস, সেখানে যাত্রী ওঠা নামা করে ধীরে সুস্থে, দাঁড়িয়ে থাকা বাসও ছাড়ে সেভাবেই। কলকাতার বাস হুশ করে থামে, হুশ করে ছেড়ে দেয় — সে বাসে তো ভীম এর আগে চলাফেরা করে নি।
বাস ভীমের নাকের ওপর ধুলো ছড়িয়ে আর ডিজেল তেল পোড়া কালো ধোঁয়া ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ভীম তখনও রাস্তার ওপর দু পা ছড়িয়ে দিয়ে যে ভাবে বসে পড়েছিল সেভাবেই বসে আছে। এবার তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল, প্যান্টের পেছনে প্রচুর ধুলো লেগেছে, দু হাত দিয়ে প্যান্টের দুই পেছন ঝাড়তে লাগল। এখন ওর সম্বল খালি একটা জামা আর একটা প্যান্ট। কবে নতুন জোগাড় করা যাবে তার ঠিক নেই, এগুলো চটপট নোংরা হয়ে গেলে ভীমের চলবে না। ভাগ্যিস প্যান্টটা কালো রঙের। সাদা হলেই হয়েছিল আর কি, এই ধুলোর দাগ আর উঠত না। এখন বর্ষাকাল নয়, সেটাও একটা ভাগ্যের ব্যাপার। কাদা লাগলে কালো প্যান্টেও পাকা দাগ হয়ে যেত। তবে এভাবে ধুলো ঝাড়তে গিয়ে দুহাত একেবারে নোংরা কুচকুচে কালো হয়ে গেল। তা আর কি করা যাবে। ধারে কাছে নিশ্চয়ই কোন টিউকল পাওয়া যাবে — তার জলে হাত ধুয়ে নিলেই হবে।
ভীম পকেট থেকে মায়ের চিঠিটা বার করে ভৈরবের ঠিকানাটা একবার দেখে নিল। কাউকে জিগ্যেস করে জায়গাটা কোথায় তা জেনে নিতে হবে। কিন্তু এটা শহরতলি অঞ্চল, রাস্তাটা মোটামুটি খালি। দু একজন লোক সাইকেল চালিয়ে রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে গেল, তাদেরকে ডেকে ঐ ঠিকানা কোথায় তা জিগ্যেস করার সাহস ভীমের হল না। ভীম বাস যেখানে থামে সেখানেই দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল, বাস ধরবার জন্যে একজন দুজন করে আরও বেশ কিছু লোক সেখানে জমা হয়ে যাচ্ছিল। ভীম তাদেরই একজনকে চিঠির ঠিকানাটা দেখিয়ে জিগ্যেস করল জায়গাটা কোথায় হবে।
কৃতজ্ঞতায় গদগদ হয়ে ভীম তার হাত ধরে ধন্যবাদ জানাতে গেল। কিন্তু তখনই মনে পড়ে গেল ওর দুহাতই খুব নোংরা। কাজেই হাত না ধরে শুধু মুখে ধন্যবাদ দিয়ে এগোল ঐ ছোট রাস্তার দিকে। যে কজন লোক জায়গাটা ঠিক কোথায় তা নিয়ে জল্পনা করছিল তারা চুপ করে গেল, কিন্তু যথেষ্ট বিরক্ত হল ঠিকানার হদিশ দেওয়া ঐ লোকটির ওপর। ওরা জায়গাটার খবর জানল না আর ঐ লোকটা জেনে গেল? ব্যাপারটা একেবারেই ঠিক হল না।
ভীম যে রাস্তাটায় ঢুকল সেটা যথেষ্ট সরু, তবে তার দুদিকই ফাঁকা ফাঁকা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে এদিকে ওদিকে এক আধটা একতলা কিম্বা দোতলা বাড়ি। রাস্তাটায় যানবাহন বিশেষ নেই — সাইকেল, সাইকেল রিক্সা, ভ্যান রিক্সা এসব ছাড়া। পেছন বা সামনে থেকে সাইকেল রিক্সার হর্ণের প্যাঁক প্যাঁক আওয়াজ শুনতে পেলেই ভীম রাস্তা ছেড়ে দিয়ে পাশের জমিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছিল। রিক্সাওয়ালাগুলো সামনে রাস্তায় পথচারি দেখলে গতি কমাবার চেষ্টা তো করছেই না, বরং আরও জোরে পেডাল চালাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। অর্থাৎ সামনে থাকা লোকটিকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে তার গায়ের ওপর দিয়ে চলে যাবে। আশেপাশে লোকজন দেখা যাচ্ছে না — কাজেই কেউ দেখবে না ভীমের কি হল। আর কেউ দেখতে পেলেও সাইকেল রিক্সা চাপা পড়া লোকের ওপর তার সহানুভূতি হবে কি? কোন গাড়ি মানুষ, এমনকি রাস্তার কুকুর চাপা দিলে সব লোকজন সেই গাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, আর গাড়ির চালককে বেধড়ক মার দেয়। সাইকেল রিক্সা মানুষ চাপা দিলে নিয়মটা উল্টো কিনা, চাপা পড়া লোকটাই মারধর খায় কিনা তা ভীমের জানা নেই। সেজন্যে ও খুব সাবধান হয়েই রাস্তায় হাঁটছিল।
কিন্তু পনেরো মিনিট পেরিয়ে গেল এখনও তো সেই ঘরের সারির দেখা নেই। ঐ লোকটা ভুল রাস্তা বলে দেয় নি তো? ভীমের বুকের ভেতর জোরে ধুকপুকুনি শুরু হয়ে গেল। বেলা পড়ে আসছে, অন্ধকার হয়ে গেলে বড় রাস্তায় ফিরে যাওয়াও মুস্কিল হবে। এ রাস্তাটায় আলোটালোও বিশেষ নেই। এক ভরসা যদি তাড়াতাড়ি করে চাঁদ ওঠে। কিন্তু এখন চাঁদ উঠবে কি? কি চলছে এখন — কৃষ্ণপক্ষ না শুক্লপক্ষ? ভীম জানে না — ও তো পাঁজি দেখে ঘর থেকে বেরোয় নি।
আরও পাঁচ মিনিট গেল, সাত মিনিট গেল, কোথায় সে সব ঘর? রাস্তাটাও একেবারে ফাঁকা, কোন লোককে যে জিগ্যেস করবে তার উপায় নেই। আজ রাতটা কি পথের পাশেই কাটাতে হবে — একটা গাছতলা দেখেটেখে নিতে হবে? রাস্তাটায় মাঝে মাঝে দুটো চারটে কুকুর দেখা যাচ্ছে। রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুর — এরা রাতে তল্লাট পাহারা দেয়। একটা অচেনা লোক গাছতলায় শুয়ে আছে দেখলে যদি চোর ভেবে কামড়ে দেয়? ভূতনিপিসীরে! তোর সঙ্গে প্রেম করে এই দুরবস্থা হবে জানলে কে তোর ধারেকাছে যেত? গাঁয়ে যে কথাটা চালু আছে, যে পুরুষ ভূতনির সঙ্গে শোয় সে-ই মরে যায় — সেটা বোধহয় মিথ্যে নয়। অন্তত সে লোক যে বিরাট গাড্ডায় পড়ে সেটা তো ভীম এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
কিন্তু চৌধুরি পুকুরের ঠাকরুণ ভীমের ওপর আবার দয়া করলেন। এবার আবছা আবছা ভীমের চোখে পড়ল, ঐ দূরে রাস্তার বাঁ ধারে লোক বসতি। আরও এগিয়ে দেখতে পেল সত্যিই তাই। একটা ছোটখাট আধাশহুরে বাজার, কয়েকটা ছোট বড় বাড়ি, পুকুর, নারকেল গাছ। আর এই তো — সেই এক সার ঘর। ঘরগুলোর সামনে একটা টিউকলও রয়েছে — বোধহয় ঐ ঘরগুলোর বাসিন্দাদের কথা ভেবেই ওটা বসানো হয়েছে। একটা পাকা চুল, কালো রঙ কিন্তু আঁটসাট বুকের বুড়ি ঐ টিউকল পাম্প করছিল। বুই বড় বড় বালতি নিয়ে এসেছে, একটা ভরতি হয়ে গেছে, অন্যটা ভরছে। ভীম এগিয়ে গিয়ে তাকে ভৈরবের ঘর কোনটা তা জিগ্যেস করল।
বুড়ি ঝুঁকে পড়ে পাম্প করছিল, পাম্প করা থামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। ভীমের চোখ বারবার বুড়ির দুই বুকের খাঁজের দিকে চলে যাচ্ছিল — পরণের সাদা থানের আঁচলটা ভাল করে বুকের ওপর টেনে দিল বুড়ি। ভীমের পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে নিল, তারপর হাত তুলে একটু আগের একটা ঘর দেখিয়ে বলল, ঐ যে ঘরটা দেখছ, ওর পাশ দিয়ে ভেতরে ঢোকার জন্যে একটা গলি পাবে। ঐ গলিটা দিয়ে ঢুকে যাও — ভেতরে ডান হাতের পাঁচ নম্বর ঘরটায় ভৈরব থাকে।
বুড়িটা কাজের লোক। তুমি কে, কোথা থেকে এসেছ, ভৈরবের সঙ্গে তোমার কি সম্পর্ক — যে সব অবান্তর প্রশ্ন বুড়িরা করে থাকে তার ধার দিয়েও গেল না। ভীমকে ভৈরবের ঘরের হদিশ বলে দিয়ে আবার জল পাম্প করতে লেগে গেল। ঝপাঝপ দ্বিতীয় বালতিটা ভরে ফেলে দু হাতে খুব সহজেই ভারি বালতি দুটো তুলে ফেলল। ভীমের দিকে আর একবারও না তাকিয়ে ঘরগুলোর গোলকধাঁধার ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল। বুড়িটা চোখের আড়াল হয়ে যাওয়ার পরে ভীমের মনে হল বুড়িটার একটু উপকার করলে হত — বালতি দুটো বয়ে দিলে হত। তারপরই আবার ভাবল, ওসব করতে যায় নি, ভালই হয়েছে। বুড়িটার জলভরা বালতি বয়ে নিয়ে যাওয়া অভ্যেস আছে, ভীমের তো নেই। ও হয়তো বালতি দুটো একটু বয়েই হাঁপিয়ে পড়ত, আর বুড়িটা তখন ওকে ঠাট্টা করে হাসত। তাছাড়া ওর দুটো হাতই নোংরা। ঐ হাতে বুড়ির বালতির হ্যান্ডেল ধরলে বালতির জলে হয়তো নোংরা পড়ত। বুড়ি তখন ওর ওপর রেগে গিয়ে ওর ওপর চ্যাঁচাত, ওকে গালাগাল দিত। কি দরকার ওসব ঝামেলায় গিয়ে?
ভীম টিউকলের জলে নিজের দু হাত ভাল করে ধুয়ে নিল। সাবধানে — জলের ছিটে লেগে প্যান্টের নিচটা ভিজে না যায়। কলটার চার পাশটা ইঁট দিয়ে বাঁধানো, কিন্তু তাতেও জায়গাটা ভিজে আর কাদা-কাদা। সব লোক জল নিতে এসে জল নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে জল ফেলে নষ্ট করে। ভীম সাবধান হয়েছিল ঠিকই, তবুও ওর প্যান্টের নিচের দিকে একটু কাদাজল লাগল। এক হাতের তালুতে একটু পরিষ্কার জল নিয়ে অন্য হাতের আঙুল দিয়ে ভীম সে জায়গাটুকু ঘষে ধুয়ে ফেলল। তবুও কাদার দাগটা পুরোপুরি গেল না। থাক ঐ দাগটুকু, কি আর করা যাবে। দাগটা এখন এমন কিছু চোখে পড়ছে না।
ভৈরবের দরজার কড়া নাড়তে দরজা খুলল একজন মেয়েমানুষ। বয়েস পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে, গায়ের রং কুচকুচে না হলেও বেশ কালো, শক্তপোক্ত গড়ন, মুখটা ভারী আর গোল, সিঁথেয় একগাদা সিঁদুর — একটু লাল গুঁড়ো নাকের ওপরেও এসে পড়েছে — মুখের ভাব কঠিন। দরজা খুলল ঠিকই, কিন্তু দুহাতে দুটো কপাট ধরে থেকে কড়া চোখে ভীমের দিকে তাকিয়ে রইল। কথা বলল না, কিন্তু চোখে প্রশ্ন পরিষ্কার — কে হে তুমি? কি চাও এখানে?
ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল মোটাসোটা গোলগাল পনেরো ষোলো বছরের একটা মেয়ে। বোধহয় ওর মেয়ে। মেয়েটা মায়ের কাঁধের ওপর দিয়ে মুখ বার করে কৌতূহলী চোখে ভীমকে দেখছিল। ভীমও মেয়েটার দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখল। বাঃ, দিব্যি দেখতে মেয়েটা। ওর মা ভীমের চাউনি লক্ষ করছিল। উটকো একটা জোয়ান বয়েসের ছেলে ওর মেয়ের ওপর নজর দিচ্ছে, ওর চোখ আরও কড়া হয়ে উঠল, কটমট করে ও তাকিয়ে রইল ভীমের দিকে।
দু হাত দূরে দাঁড়িয়ে ভীম যতটা পারে বিনীতভাবে নিজের এখানে আসার উদ্দেশ্য জানাল। আর বলা শেষ করে পকেট থেকে খামে ভরা চিঠিটা বার করে মেয়েমানুষটার দিকে বড়িয়ে ধরল। বলল, মা এই চিঠিটা ভৈরবদাদার জন্যে লিখে দিয়েছেন।
মেয়েমানুষটা হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নেবার কোনও লক্ষণ দেখাল না। সেভাবে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থেকেই বলল, দ্যাখো বাপু, আমি ওসব কিছু জানি-টানি নে। কত্তা এখন বাড়ি নেই। সে বাড়ি না এলে কোন কথা হবে না। আর তুমি থাকবে বলে এসেছ — তোমার কাপড়জামা কই? না বাপু, এরকম উটকো লোককে আমি ঘরে ঢুকতে দিতে পারব না। তুমি বাইরে বোস, কত্তা ফিরলে যা হয় হবে।
ভীম বলতে গেল যে রাস্তায় ওর কাপড়জামা সব চুরি হয়ে গেছে, কিন্তু তার আগেই ওর নাকের সামনে দরজা বন্ধ হয়ে গেল, ওর বাড়িয়ে ধরা হাতের খাম হাতেই রইল। প্রায় সাথে সাথেই ও একটা খটাশ করে আওয়াজ শুনতে পেল। অর্থাৎ ভেতর থেকে দরজায় খিল পড়ল।
ভৈরবের বাড়িতে অভ্যর্থনার প্রথম কিস্তিটা ভালই হল, ভীম ভাবল। এখন কর্তা ফিরলে দ্বিতীয় কিস্তিটা কেমন হবে কে জানে। তবে একটা ভরসার ব্যাপার আছে। ভীমের খাইখর্চার জন্যে মেনকা ভৈরবের খামের ভেতর চিঠির সঙ্গে বেশ কিছু টাকার নোট ভরে দিয়েছে, সেটা ভীম জানে। ঐ নোটগুলো হাতে পেয়ে ভৈরব নরম হবে না তা মনে হয় না। দেখা যাক্।
কিন্তু যে সব হবে ভৈরব আসার পরে, কতক্ষণে আসবে তার তো কোন ঠিক নেই। এখন যে ভীমের প্রচণ্ড ছোট বাইরে পেয়েছে তার কি করা যায়? সেই একবার করেছিল কাকভোরে, বাড়ি থেকে বেরোবার আগে। আর এখন সন্ধে হয় হয়, এর ভেতর একবারও তো নিজেকে হাল্কা করা হয় নি। এই একগাদা ঘরের লোকজনের জন্যে কোথাও কলঘর-টর নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু ভীম সেটা খুঁজবে কোথায়? ঐ কলঘরের খোঁজে ও যদি এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করতে থাকে আর এখানকার লোকজনের চোখে পড়ে যায় তাহলে ওরা হয়তো ধরেই নেবে যে ও চোর — বেধড়ক ধোলাই জুটবে কপালে, ভীমের কোন কথাই ওরা কানে নেবে না। আর একটা উপায় হচ্ছে সামনের দরজা কড়া নেড়ে খুলিয়ে ভৈরবের বৌকে জিগ্যেস করা, কিন্তু ভৈরবের বৌ কলঘরের হদিশ দেবে কি? রেগে গিয়ে মুড়ো ঝাঁটা নিয়ে ভীমকে তাড়া করবে না তো?
রাস্তায় বেরিয়ে গেলে কেমন হয়? একটা ফাঁকা জায়গা দেখে নিয়ে যদি নিজেকে ভারমুক্ত করা যায়, কিন্তু ভয় করে। এটা তো ওর নিজের গাঁ নয় যে একটা গাছের আড়াল দেখে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেই হল। যদিও এটা শহরতলি জায়গা, কলকাতার শহরতলি তো বটে। রাস্তায় কোন লোক ওকে ওভাবে দেখতে পেলে মারধর দেবে না তো? কলকাতার হালচাল তো কিছুই ভীমের জানা নেই। কিন্তু তলপেটের চাপ যে ক্রমেই বেড়ে চলেছে, তার একটা ব্যবস্থা না করলেই তো নয়। মরিয়া হয়ে ভীম ভাবছিল সামনের দরজার কড়া-ই নেড়ে দেখা যাক। ঠিক তখনই ওর মনে পড়ে গেল। এখানে আসবার রাস্তাটায় একটা ফাঁকা মত জায়গায় এক পাঁজা ইঁট রাখা আছে — সেটা ভীমের চোখে পড়েছিল। সেখান দিয়ে আসবার সময় ও তীব্র একটা গন্ধ পেয়েছিল। নিশ্চয়ই অনেকদিন ধরে অনেক লোক সেখানে পেচ্ছাপ করছে, নইলে অত কড়া গন্ধ বেরোয় না। অর্থাৎ এটাই হল এ রাস্তায় বারোয়ারি পেচ্ছাপখানা। প্রায় দৌড়ে রাস্তায় বেরিয়ে গেল ভীম। জোর পায়ে হেঁটে চলল ঐ ইঁটের পাঁজাটার দিকে।
ভীম যখন ফিরে আসছিল তখন ওর মনমেজাজ ভাল হয়ে গেছে। হবেই তো। তলপেটে কতক্ষণ ধরে একটা জোরালো চাপ ছিল, সেই চাপমুক্তি ঘটলে ভাল তো লাগবেই। কত লোকের কাজে লাগছে ঐ ইঁটগুলো। বাড়ি তৈরির সময় ইঁট গেঁথে দেয়াল তুলে সে সব ইঁট নাকি বার বার জলে ভেজাতে হয়। এই ইঁটগুলো দিয়ে বাড়ি বানালে বোধহয় তার আর দরকার পড়বে না।
ভীম যতক্ষণে ভৈরবের বাড়ির কাছে পৌঁছেছে ততক্ষণে সন্ধেবেলার বাজার বসে গেছে। মাটির ওপর চট পেতে বসেছে বাজারের দোকানি, বিক্রীর জিনিষপত্রও চট বিছিয়ে রাখা আছে। নানা ধরনের তরিতরকারি, হাঁস মুরগির ডিম, কয়েকজনের কাছে মাছ। প্রায় প্রত্যেকের সামনেই একটা করে হ্যাজাক বাতি জ্বলছে, সেগুলো সকলের ভস্স আওয়াজে বেশ একটা জোরালো জমজমাট আওয়াজ হচ্ছে। বিক্রী হচ্ছে ভালই, খদ্দেররা কেউ উবু হয়ে দাঁড়িয়ে জিনিষ কিনছে, কেউ কেউ উবু হয়ে বসে পড়ে সবজি বাছাবাছি করছে। একটা মাছউলির বয়েস কম, স্বাস্থ্য ভাল, মুখখানাতেও একটু চটক আছে — ওর সামনে বেশ জমজমাট ভীড়। ওর খদ্দেরদের ভেতর অল্পবয়েসী লোক, বুড়ো সবই আছে — বুড়োরাই সংখ্যায় বেশি। ওর পাশেই বসেছে একটা মাছওলা — একটা মাঝবয়েসী লোক, ওর সামনে কোন লোক নেই। লোকটা পাখা নেড়ে নেড়ে ওর বিক্রীর মাছের ওপর বসা মাছি তাড়াচ্ছে, আর মাঝে মাঝে রাগ রাগ চোখে পাশের মাছউলির দিকে তাকাচ্ছে। এতগুলো হ্যাজাগ জ্বলছে বলে জায়গাটা বেশ গরম — বিক্রীওয়ালা, খরিদ্দার, সবাই বেশ ঘামছে। বাজারের বাইরের দিকে, অর্থাৎ রাস্তার দিকে একটা চালার নিচে এখন একটা লোক তেলেভাজা ভাজছে — ফুলুরি, বেগুনি, আলুর চপ। খালি গা, হাফ প্যান্ট পরা বছর বারোর রোগা টিংটিং-এ একটা ছেলে লোকটাকে জোগান দিচ্ছে। অবশ্যি অল্পবয়েসী ছেলেটা মাঝে মাঝেই নাক খুঁটছে, তারপর সে হাত দিয়েই তেলেভাজাগুলো আলাদা আলাদা বড় বড় থালায় স্তূপ করে সাজিয়ে রাখছে। তবে এরকম তো হয়েই থাকে — এতে আর কি আসে যায়? চালাটার সামনে ভীড় জমেছে বিস্তর। অনেকেই তেলেভাজা কিনে নিয়ে যাছে — দোকানি শালপাতার ঠোঙায় করে গুণে গুণে তাদের তেলেভাজা দিচ্ছে — শালপাতার ঠোঙাটার জন্যে আলাদা করে দাম ধরে নিচ্ছে একটা টাকা। দু চারজন সেখানেই দাঁড়িয়ে শালপাতায় করে বেগুনি আলুর চপ খাচ্ছে। যারা ফুলুরি খাচ্ছে তাদের দু একজনের এক আধটা ফুলুরি মাঝে মাঝে পাতা থেকে গড়িয়ে মটিতে পড়ে যাচ্ছে — খদ্দের সেই ফুলুরি তুলে নিয়ে টিউকলের জলে একটু ধুয়ে নিয়ে খেয়ে নিচ্ছে। আহা, পয়সা দিয়ে কেনা এমন স্বাদের ফুলুরি, ফেলে কি আর দেয়া যায়?
ভীমও দাঁড়িয়ে পড়েছিল ঐ চালার সামনে। তেলেভাজার সুগন্ধ নাকে যেতে ও বুঝল ওর এখন জবরদস্ত খিদে পেয়েছে। সেই সকালে রেল স্টেশনের পাশের দোকানটায় বসে ভালমন্দ খেয়েছিল, তারপর তো পেটে আর কিছু পড়ে নি।
যতক্ষণ না খিদে মিটল ওখানে দাঁড়িয়ে তেলেভাজা খেয়ে গেল ভীম। গাঁয়ের ছেলে, খিদে পেলে প্রচুর খেতে পারে। দোকানি হাতে করে যখন ওর শালপাতায় বার বার আলুর চপ-বেগুনি-ফুলুরি দিচ্ছিল তখন ওর দিকে একটু সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছিল। এই যে লোকটা বার বার চেয়ে নিয়ে খেয়ে যাচ্ছে, এরপর খাবারের দাম ঠিকমত দেবে তো?
খাওয়া সেরে পকেট থেকে রুমাল বার করে আঙুলগুলো পুঁছে নিল ভীম — হাতটা নোংরা হয়নি, খালি আঙুলগুলোতেই একটু তেল লেগেছে। কত টাকার খেয়েছে তা দোকানিকে জিগ্যেস করে জেনে নিল। দোকানিকে তাতে একটু নিশ্চিন্ত দেখাল। যাক্ লোকটা খাবারের দাম দিচ্ছে তাহলে। খাবারের দাম দেবার জন্যে পকেট থেকে টাকা বার করতে যাচ্ছিল ভীম। হঠাৎ ওর মাথায় একটা মতলব খেলে গেল। ভৈরবের বাড়ির জন্যে বড় এক ঠোঙা তেলেভাজা নিয়ে গেলে কেমন হয়? তাহলে হয়তো ঐ জাঁদরেল মেয়েমানুষটা খুশি হয়ে যাবে, ভীমকে বাড়ির ভেতর বসতে দেবে। আর এমনও হতে পারে, ঐ অল্পবয়েসী মেয়েটা দরজা খুলে দিতে পারে। তাহলে মেয়েটার সঙ্গে দুটো কথা বলার সুযোগ পাওয়া যেতে পারে।
কিন্তু কড়া নাড়তে এবারেও দরজা খুলল ভৈরবের বৌ। ভীমকে দেখতে পেয়ে ওর কঠিন মুখ আরও কঠিন চেহারা নিল। নারীটি ভীমকে খুব কড়া কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই ভীম দু হাতে ধরা বড় ঠোঙাটা তার দিকে এগিয়ে ধরল। একগাল হেসে বলল, বৌদি, আপনাদের জন্যে অল্প কিছু খাবার জিনিষ নিয়ে এলাম। এই ঠোঙাটা ধরুন।
ঠোঙার ভেতরে সব তেলেভাজা একেবারে সদ্য সদ্য তৈরী হয়েছে। গরম, দারুণ খুশবু বেরোচ্ছে সেগুলোর থেকে। তার ওপর ভীম তিন চার রকম তেলেভাজা মিশিয়ে এনেছে, সব কটার গন্ধ মিলে একটা স্বর্গীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুহূর্তে মহিলার কঠিন মুখ নরম হয়ে এল এবং তাতে হাসি দেখা দিল — বিশুদ্ধ আনন্দের একটি হাসি। ভীমের দেয়া ভেট অর্থাৎ ঠোঙাটা দু হাতে নিয়ে মহিলা বলল, বসো ভাই তুমি এখানে, আমি তোমার জন্যে চা নিয়ে আসি। একটু ভেতরে ঢুকে গেল মহিলা, তারপর পা দিয়ে দরজার কপাট বন্ধ করে দিল। তার কারণ ভৈরবের পরিবার দু হাতে তেলেভাজার ঠোঙা ধরে আছে, এ অবস্থায় এক হাত ছেড়ে দিয়ে সেই হাতে দরজা বন্ধ করতে গেলে ঠোঙাটা হাত ফসকে মেঝেয় পড়ে যেতে পারে।
মাগিটা জোর হারামি, ভীম ভাবল। ঘুষ পেয়েও ঘরে ঢুকতে দিল না। অবশ্য এখন দরজাটা ভেজান রয়েছে, মেয়েমানুষটা খিল লাগাবার সুযোগ পায়নি। কিন্তু তা হলেই বা কি? ওরা কেউ না ডাকলে ভীম তো আর নিজের থেকে ভেজিয়ে রাখা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে পারে না।
একটু পরেই ভৈরবের বউ আবার দেখা দিল। হাতের পিরিচের ওপর রাখা এক পেয়ালা চা। চায়ের কাপের পাশে পিরিচের ধারে ভীমের-ই আনা তেলেভাজার থেকে নেওয়া একটি আলুর চপও রয়েছে। মেয়েমানুষটা প্রাণে ধরে একটার বেশি তেলেভাজা ভীমকে দিতে পারে নি। চপটার বেশ খানিকটা পিরিচের থেকে বেরিয়ে আছে, একটু এদিক ওদিক হলেই সেটা পিরিচ থেকে মাটিতে পড়ে যাবে। এদের বাড়িতে খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ, ভীম ভাবল। মুখে বলল, বৌদি, তেলেভাজাটা তুলে নিন — আমি খেয়ে এসেছি।
আবার পাতানো বৌদিটির দাঁত দেখা গেল, কারণ তিনি খুশি হয়ে আবার একটু হাসলেন। যাক্, তেলেভাজার একটাও এই লোকটাকে খেতে দিতে হল না। মহিলা তেলেভাজাটা দু আঙুলে সন্তর্পণে ধরে সেটা তুলে নিল এবং পিরিচ সমেত চায়ের পেয়ালাটা ভৈরবের পাশে মেঝেয় নামিয়ে রাখল। বলল, তাহলে চা টুকু খেয়ে নাও। আমি একটু পরে এসে খালি পেয়ালা-পিরিচ নিয়ে যাব।
একথা বলে মহিলা ঘরে ঢুকে গেল, দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল।
বাড়িতে ভীমের জন্যে চা আসত বড় একটা কাপে — গরম, ধোঁয়া ওঠা সুগন্ধি চা, ভাল করে দুধ আর চিনি দেয়া। এই কাপটা তার থেকে সাইজে অনেক ছোট, কানার দুতিন জায়গায় চলটা উঠে গেছে। ভেতরের চা টুকু প্রায় ঠান্ডা হয়ে গেছে, দুধ চিনিও অল্প — চা-টা বেশ বিস্বাদই বলা চলে। সেই চা-ই কয়েক চুমুকে ভীম সাবাড় করল — চায়ের তেষ্টাটা কিছুটা তো অন্তত মিটুক। কাল একটা চা খাবার জায়গা খুঁজে বার করতে হবে। সেখানে চা খেতে অবশ্য ভাল পয়সা খরচা হবে। তা হোক। এখানেও তো আর বিনে পয়সায় থাকতে খেতে দেবে না।
ভীম ওই বারান্দায় রুমাল পেতে বসে রইল দেয়ালে পিঠ ঠেসান দিয়ে। পা দুটো সামনে ছড়িয়ে দেয়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু উপায় ছিল না। কারণ এই বারান্দা দিয়ে ভেতর দিকের ঘরগুলোর বাসিন্দারা সমানে যাওয়াআসা করছিল। ওর সামনে দিয়ে যাবার সময় প্রত্যেকেই একবার করে ওর দিকে তাকাচ্ছিল। বেশির ভাগের চোখে ছিল কৌতূহল, কিন্তু কেউ কেউ ওর দিকে রীতিমতো সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছিল। যত সময় যাচ্ছিল ভীম তত ঘাবড়াচ্ছিল। কেউ যদি দাঁড়িয়ে পড়ে ওকে জেরা করতে শুরু করে দেয় তাহলে তো চিত্তির।
কতক্ষণ কাটল এভাবে ভীমের ঠিক খেয়াল নেই। ঘণ্টা দুই তো হবেই। লম্বা চওড়া টকটকে রাঙা চোখের একটা লোক এসে এই দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল আর ভীমের দিকে ঐ লাল লাল চোখে তাকিয়ে রইল। ভীম বুঝল, এই লোকটাই ভৈরব। তড়াক করে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, ভৈরবদাদা, আমি ভীম। তেঁতুল গাঁ থেকে এসেছি। আপনার জন্যে এই চিঠিটা দিয়েছেন।
পকেট থেকে খামটা চটপট বার করে ভৈরবের হাতে গুঁজে দিল ভীম। ভৈরব খামটা হাতে নিল, খামটা ছিঁড়ল। টাকার নোটগুলো দেখতে পেয়েই ওর মুখটা বেশ হাসি হাসি হয়ে গেল। ও চিঠিটা পড়ে ফেলল, আর টাকাটা নিজের পকেটে ভরল। একগাল হেসে বলল, এখন কলকাতায় থাকবে বলে এসেছ? তা বেশ কথা — প্রথম কটা দিন তো আমার এখানে থাকতেই পারো।
দরজার কড়া নাড়ল ভৈরব। ওর কড়া নাড়বার ধরনটাই আলাদা — আওয়াজ শুনলেই বোঝা যায় বাড়ির কর্তা এসেছে। সন্ধেবেলাতেই মাল খেয়ে এসেছে লোকটা, ও যখন ভীমের সঙ্গে কথা বলবার জন্যে মুখ খুলেছিল তখন গন্ধ পেয়েছে ভীম। ও তক্কে তক্কে রইল, ভৈরবের পেছন পেছন ঘরে ঢুকে পড়বে — ওই মেয়েমানুষটাকে বিশ্বাস নেই, যদি আবার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেয়।
ভৈরবের বৌ অবশ্য এবারে তা করল না, ভৈরবকে দেখে দুজনের জন্যেই দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল। ভৈরব ঢুকল, ওর পেছনে ভীম। ভৈরব দরজাটা নিজের পেছনে দু হাত দিয়ে ভেজিয়ে দিল, তারপর ভীমকে দেখিয়ে নিজের বৌকে বলল, বুঝলে — এ হচ্ছে মেনকাপিসীর ছেলে। মেনকাপিসী যার কথা লিখেছিল চিঠিতে। বলেছিলাম না তোমাকে? ও এখন কয়েকটা দিন থাকবে আমাদের বাড়িতে।
তার মানে ভীম আসবে এখানে তা জানত ভৈরবের বৌ। মেয়েমানুষটা বিলে খচ্চর — ভীম ভাবল। মিথ্যে কথা বলেছিল ওকে।
অতএব মেয়েমানুষটাকে একটু খোঁচা দিয়ে একটা কথা বলা যাক। একটা খুব নিরীহ হাসি দিয়ে ভীম বলল, বৌদি কিন্তু চোরডাকাত ভেবে আমাকে এতক্ষণ দরজার বাইরে বসিয়ে রেখেছিল।
ভৈরবের বৌ ততক্ষণে এগিয়ে গিয়ে দরজায় খিল লাগিয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়েই বলল, তা বাপু, সঙ্গে কোন কাপড়জামা বিছানা নেই, এরকম লোককে হুটহাট করে ঘরে ঢুকতে দেওয়া যায় কি? বিশেষ করে ঘরে যখন দু দুটো যুবতী বয়েসের মেয়ে রয়েছে।
একটা মেয়ে তো ঐ পনেরো ষোলো বছরের নাদুস নুদুস মেয়েটা মায়ের কাছেই ঘুরঘুর করছে, আর মাঝে মাঝে চোরা চাউনিতে ভীমকে দেখে নিচ্ছে। আর একটা মেয়ে কোথায়? এ ঘরের লাগোয়া একটা এক চিলতে ঘর, মাঝখানে একটা দরজা। ওই দরজা দিয়ে ওঘর থেকে ধোঁয়া আসছে — ওটায় বোধহয় রান্নাবান্না হয়। মাঝের দরজাটা খোলা, সেখান দিয়ে একটা রঙীন শাড়ির আঁচল দেখা গেল — সেটা আবার ভেতর দিকে সরে গেল। অর্থাৎ দ্বিতীয় যুবতী বয়েসের মেয়েটি সেখানে আছে। সেটা দেখতে কেমন কে জানে। অবশ্যি ভীম ওকে দেখতে পাবেই — এইটুকু ছোট জায়গার মধ্যে থেকে ভীমের কাছে ও অদেখা হয়ে থাকবে তা হতেই পারে না।
দরজা থেকে ঘরের ভেতর দিকে আসতে আসতে ভৈরবের বৌ আবার আগের কথার খেই ধরল, এখন দিনকাল যা পড়েছে — জোয়ান বয়েসের অচেনা একটা লোককে কি করে ঘরে ঢুকতে দেব? ঘরের পুরুষ মানুষটা যখন ঘরে নেই?
মেয়েছেলেটা বার বার একই কথা বলে — ভীম ভাবল।
ভৈরব কথাটা চাপা দিয়ে দিল। বলল, যাক্, ছাড়ান দাও ওসব কথা। এখন আমাদের একটু চা দাও দিকি।
ওর বৌ বলল, পাঁচ মিনিটে চা দিচ্ছি, খেয়ে নাও। একটু পরেই রাতের খাবার দিয়ে দেব।
চা এল। ভৈরব আর ভীম, দুজনের জন্যেই। এবারের চায়ের পরিমাণ বেশি, চা-টা খেতেও অপেক্ষাকৃত ভাল। ভৈরব সারাদিন পরে বাড়ি এসেছে, সেজন্যে ওর জন্যে চায়ের সঙ্গে বড় একবাটি তেলমাখা মুড়ি আর ভীমের আনা তেলেভাজা। ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল বলে ওগুলো তাওয়াতে আবার গরম করে ভৈরবকে দেয়া হয়েছে। ভীমকে ওসব কিছু দেয়া হয় নি — শুধু এক কাপ চা।
রাতে খাওয়ার সময় ভৈরব আর ভীমকে একসঙ্গে খেতে দিয়েছিল ভৈরবের বৌ। মেয়েদের জন্যে কোন থালা পাতা হয়নি, অর্থাৎ মেয়েরা পরে খাবে। কানা দোমড়ানো অ্যালুমিনিয়ামের থালা, তাতে কয়েকটা পাৎলা পাৎলা ছোট ছোট রুটি, অল্প একটু ডাল আর শাক ভাজা। বাড়িতে ভীমের জন্যে খানা আসত বড় সাইজের একটা কাঁসার থালায়, তাতে ভীমের নাম খোদাই করা। সেই থালায় স্তূপ করা সদ্য নামানো ধোঁয়ানো ভাত, ডালে গরুর দুধের ঘি, সাত সতেরো তরিতরকারি, অন্তত দু’রকম মাছ। কমলামাসি তো ওকে নিজের ছেলের মতই যত্ন করত। আর এখন এই খাওয়া! যে থালাটায় খেতে দিয়েছে সেটা খুব পরিষ্কার করে ধোয়া হয়নি, এ কোণে ও কোণে একটু আধটু এঁটোর দাগ শুকিয়ে লেগে রয়েছে। সব দোষ ঐ শুঁটকি আধবুড়ি পেত্নীটার। ও ওভাবে জামাকাপড় খুলে লোভ না দেখালে ভীম কি আর ওর ফাঁদে পড়ত? মায়েরও দোষ আছে — এতদিন ধরে ছেলের বিয়েশাদি দেয়নি কেন? টাকা খরচ করতে হলেই কিপটে বুড়িটার গায়ে জ্বর আসে। ছেলের বিয়ে দিলেই তো একগাদা খর্চা। ছেলের বৌকে গয়নাগাঁটি কাপড়চোপড় কিনে দাও, নেমতন্ন করে সাতভূত খাওয়াও — গাঁটের কড়ি বেশ কিছু বেরিয়ে যাবে। আর এখন? এখন তো ভীমের সঙ্গে বুড়িটাও ফেঁসেছে। চিত্ত বাউরি এসে নিয়ম করে টাকা আদায় করে নিয়ে যাচ্ছে, কতিদন ধরে ও এরকম চালাবে তার কিছু ঠিক নেই। তার ওপর ভূতনির পেটের বাচ্চাটা! সেটা যদি বেরিয়ে এসে জ্যান্ত থাকে তাহলে তো নাটক একেবারে দারুণ জমে যাবে।
ভৈরবের গলার আওয়াজে ভীমের চমক ভাঙল। ওর বৌ একশিশি কাসুন্দি ওদের থালাদুটোর মাঝখানে রেখেছিল। ভৈরব বাঁ হাতে ঐ শিশির ছিপি খুলে ফেলে তার থেকে ওর থালার ডালে কাসুন্দি ঢালতে ঢালতে ভীমকে বলল, তোমার সঙ্গে জামাকাপড় বিছানা এসব নেই কেন তা কিন্তু এখনও আমাদের বলনি।
খেতে খেতেই ভীম বলল, যতটা পারে ছোট করে। এদের বেশি কথা বলে লাভ কি?
ভৈরবের বৌ ওদের সামনে উবু হয়ে পাতে ডাল দেবার হাতা হাতে করে বসেছিল। এই একটি পদ-ই বোধহয় একটু বেশি করে রান্না করা হয়েছিল। কারণ ডালটাই মহিলা দুতিন বার করে নিজের কত্তার আর ভীমের পাতে দিচ্ছিল। হাতে ডালের হাতা উঁচু করে ধরে রেখেই সে একটি ফোড়ন কাটল, তার মানে তোমার মা সে লোকটা সত্যিকারের বিশ্বাসী কিনা সেটা বুঝতে পারেনি। ভাল করে লোক যাচাই করে তবেই তার হাতে জামাকাপড়ের বাক্স দেয়া উচিত ছিল। কথা বলার সময় ভৈরবের বৌ-এর ডান হাত নড়ছিল সেই সঙ্গে হাতে ধরে রাখা ডালের হাতাটাও।
এসব কথার ওপর কথা বাড়াতে নেই। ভীম মাথা নেড়ে মহিলার কথায় সায় দিল। মুখেও বলল, তা ঠিক।
ঘরটার পেছনদিকে একটা ছোট্ট দাওয়া, ঘরের পেছন দিকের একটা দরজা দিয়ে সেখানে যেতে হয়। পাশাপাশি ঘরগুলোর প্রত্যেকটারই একটা করে এরকম দাওয়া আছে। এগুলোর উল্টোদিকে আবার একসারি ঘরের পেছন দিকটা, সেগুলোরও লাগোয়া এরকম একই ধরনের দাওয়া। এই দু সারি দাওয়ার মাঝখানের দু ফুটটাক জায়গা দিয়ে একটা বড় নর্দমা গিয়েছে। এখনাকার প্রত্যেক দু সারি ঘরের মাঝখানে একটা করে নর্দমা রয়েছে। এগুলোতে পাঁক আর বদ্ধ দাঁড়ানো জল সবসময় থাকে। তার কারণ এগুলো নিয়মিত পরিষ্কার হয় না। বাসিন্দারা নিজেরাই মাঝে মাঝে চাঁদা তুলে ওগুলো পরিষ্কার করায়। ভৈরবের দাওয়ার এক কোণে গোটা চারেক বড় বড় জলভরা বালতি রয়েছে, একটার জলে একটা টিনের মগ অর্ধেকটা ডোবা অবস্থায় ভাসছে। খাওয়া দাওয়ার পর হাত মুখ ধোয়া ঐ বালতির জল দিয়ে। এইটুকু কাজের জন্যে বারোয়ারি কলতলায় যাওয়া পোষায় না। তাছাড়া এখন আর কলে জল নেই। জল আসে দিনে দুবার। একবার ভোরে, আর একবার বিকেল পাঁচটা নাগাদ। বিকেলের জল ঘন্টা দুয়ের বেশি থাকে না, সকালে জল কিছু বেশিক্ষণ থাকে।
ভীম ভৈরবের সঙ্গে দাওয়ায় বেরিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নিল। ওদের খেয়ে উঠতে বেশিক্ষণ লাগেনি। ওইটুকু তো খাবার — ভীম ভালই বুঝতে পারছিল যে ওর পেট ভরেনি। দাওয়ায় বেরোতেই নর্দমার পাঁকের গন্ধ ভক করে ওর নাকে লেগেছিল, গা বমি বমি করে উঠেছিল। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়েছিল ভীম। এখানে থাকতে গেলে এই গন্ধ নাকে সইয়ে নিতে হবে।
ওরা ঘরে ফেরত এল। মেয়েরা রান্নাঘরে খেতে বসেছে। ঐ তো একচিলতে একটা রান্নাঘর, তার মধ্যেই কায়দা করে তিনজন বসে গেছে, দিব্যি খেয়ে যাচ্ছে। এখনও ঐ দ্বিতীয় যুবতী বয়েসের মেয়েটাকে ভাল করে দেখতে পেল না ভীম। ভৈরবের বৌ আর মেয়ে যেভাবে বসেছে তাতে ওই মেয়েটা প্রায় আড়াল হয়ে গেছে।
ঘরের দুপাশে দুটো বিছানা গোটানো অবস্থায় রয়েছে। একটা বিছানা একজনের মত। অন্যটা তার চাইতে চওড়া, দু-জন মোটামুটি শুয়ে যেতে পারে। বড়টায় নিশ্চয়ই ভৈরব বৌকে নিয়ে শোয় — ছোটটা বোধহয় ওদের মেয়েটার জন্যে। আর রান্নাঘরটাই বোধহয় অন্য মেয়েটার শোবার জায়গা। একটা বিড়ি ধরিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে ভৈরব ধোঁয়া ছাড়ছিল। ভীম উল্টোদিকের দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে ওর বিড়ি খাওয়া দেখছিল। তখনি ওর মাথায় এল — ওর নিজের শোয়ার ব্যবস্থা কি হবে? ওর বিছানা কোথায় যে শোবে?
কঠিন সমস্যা। এর উত্তরটা কি তা ভৈরবকে জিগ্যেস করা উচিৎ হবে কিনা তা ভাবছিল ভীম, এমন সময় ভৈরবই কথা বলল। কথাটা অবশ্য আলাদা, যদিও দরকারী। তোমার তো জামাকাপড়, বিছানা, এসব কিছু নেই, ওসব তো কিনতে হবে। কথা থামিয়ে বিড়ির ছাই ঝাড়ল ভৈরব। অনেকটা ছাই মেঝেয় পড়েছিল, তা হাতের চেটোর পাশ দিয়ে ঠেলে ঠেলে মেঝের একেবারে একটা কোণে সরিয়ে দিল। ও ভীমের দিকে তাকিয়ে একটু বোকার মত হাসল। বলল, মেঝে ছাই পড়ে নোংরা হলে তোমার বৌদি চেঁচামেচি করে।
তারপরই গম্ভীর হয়ে ভৈরব ভীমকে জিগ্যেস করল, তোমার কাছে টাকা কিরকম আছে?
উত্তর দিতে একটু ইতস্তত করল ভীম। ভৈরবের এই প্রশ্নের উদ্দেশ্যটা কি সেটা ওর জানা নেই। এটা খুবই সম্ভব যে লোকটা ভীমের কাছে যা আছে তা বিভিন্ন ছুতো করে হাতিয়ে নেওয়ার ফিকিরে আছে। সেজন্যেই জানতে চাইছে ভীমের কাছে কত টাকা আছে। আগেকার দিনে গেরস্থ ডাকাতরা যেরকম রাতে পথিককে নিজের বাড়িতে থাকতে দিয়ে তার কাছ থেকে জেনে নিত তার কাছে টাকাকড়ি কি আছে, তারপর রাতের বেলায় তাকে মেরে ফেলে তার সব কিছু নিয়ে নিত। ভৈরব অবশ্য ভীমকে মেরে ফেলবে না, কিন্তু হাজারো বাহানায় টাকা তো চাইতে পারে। কিন্তু চুপ করে থাকলে হবে না। ভৈরব ওর দিকে প্যাট প্যাট করে তাকিয়ে আছে, উত্তর একটা দিতে হবে। ভীম একটু সাবধান হয়ে জবাব দিল, ঠিক কত আছে তা তো আমার হিসেব নেই। দু-আড়াই হাজার হবে হয়তো।
ভীম সত্যি কথা বলেনি। ওর কাছে এখনও হাজার পাঁচেক টাকা আছে। কিন্তু টাকার অঙ্কটা কমিয়ে বলার দরকার ছিল। নইলে ভৈরব হয়তো বেশি করে টাকা চাইবে কোন না কোন ছুতো করে, দু দিনে ভীমকে ফতুর করে দেবে।
আর ঠিক — ভীম যা ভেবেছিল তাই। ভৈরব বলল তোমার তো জামাকাপড়, বিছানা এসব কেনার দরকার। তুমি আমাকে আপাতত হাজার দুই দাও। তাতে তোমার কিছু জামা আর তোষক-বিছানা হয়ে যাবে। কাছাকাছি একজন দর্জি আছে, ও শার্ট প্যান্ট এসব বানিয়ে শস্তায় বিক্রী করে। ওর থেকেই কয়েকটা কাপড়জামা তোমার জন্যে কিনে নেব। কমসমে হয়ে যাবে।
ভীম পকেট থেকে টাকাটা বার করে দিল — হাতের আঙুলে অনুভব করে করে চারটে পাঁচশ টাকার নোট তুলল। পকেট থেকে বেশি টাকা উঠে এলে চলবে না — তাহলে ভৈরব দেখে ফেলবে ওর কাছে বেশি টাকা আছে। হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিয়ে ভৈরব চটপট নিজের প্যান্টের পকেটে ভরে ফেলল। বলল, ঠিক আছে, এতে যা হবে তাতে এখন তোমার কাজ চলে যাবে।
রাতে খাওয়ার পাট তো চুকল, ভৈরব আর ওর বৌ নিচু গলায় আলোচনা করছিল ভীমকে কোথায় শুতে দেয়া যাবে। রান্নাঘরে ভৈরবের আইবুড়ো বোন সুলোচনা শোয়, সেখানে ভীমের শোয়া অসম্ভব। ভৈরব এর ভেতর কথায় কথায় রান্না করা মেয়েটির নাম আর তার সঙ্গে ভৈরবের কি সম্পর্ক তা ভীমকে জানিয়ে দিয়েছে। ঘর বলতে সবেধন নীলমণি এই ঘরটা তাও আবার বাক্স প্যাঁটরায় তার অনেকটা ভর্তি। এই ঘরে ভৈরব তার বৌকে নিয়ে শোয়, ওর ডাগর ডোগর মেয়েটাও শোয়। কাজেই এই ঘরে ভীমের শোয়া আরও-ই অসম্ভব। ঘরের বাইরের বারান্দাটা বারোয়ারি, ওখানে ভীম শুলে লোকজনের যাতায়াতের পথটা-ই বন্ধ হয়ে যাবে। অতএব ভীমের জন্যে ঘরের বাইরে পেছনের দাওয়া-তে শতরঞ্চি পেতে দেয়া হল, তার সঙ্গে একটা ময়লা তেলচিটে বালিশ। এদের কাছে কোন অতিরিক্ত তোষক নেই। তবে কাল তো ভীমের নিজের তোষক এসেই যাবে। একটা রাতের ব্যাপার, ভীম তোষক ছাড়াই চালিয়ে নিতে পারবে।
শুয়ে পড়ে ভীম ঘুমোবার চেষ্টা করল। ভৈরব বলেছে ও কাল ভীমকে সঙ্গে করে ওদের কারখানায় নিয়ে যাবে, ওস্তাদ যে মিস্ত্রী তার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবে। ভীমের মত লোকেদের ওখানে চাকরি হওয়া আর সে চাকরি চলে যাওয়া সবই ঐ ওস্তাদের হাতে। ওকে খুশি করতে হবে। খুশি করার একটাই রাস্তা। গিয়েই এক বোতল দামী ভাল জাতের দারু ওস্তাদের হাতে ধরিয়ে দিতে হবে। লোকটার মেয়েমানুষ বা নগদ টাকার দুর্বলতা নেই, কিন্তু ঐ পানীয় ওর সব সময় চাই। সব সময়তেই দারুভূত অবস্থায় থাকে, অর্থাৎ প্রচুর পরিমাণ দারু খেয়ে থাকে, কিন্তু ওর নেশা হয় না। সকালে কারখানায় যাওয়ার পথে বোতলটা কিনে নিয়ে যেতে হবে। তাতে চাকরি নাকি হয়ে যাবেই যাবে। সন্ধেবেলা ফেরবার পথে ভৈরবের সঙ্গে ঐ কি দর্জির কথা ভৈরব বলেছিল, তার দোকানে গিয়ে শার্ট প্যান্ট এসব কিনতে হবে। আর হ্যাঁ — বাজার থেকে একটা তোষক। কাল উঠতে হবে খুব ভোরে। লোকজন জেনে উঠে কলে লাইন দিয়ে ফেললে সর্বনাশ। তার আগেই কলঘরের সব কাজ সারতে হবে, নইলে সময়মত বেরোন যাবে না। ওর সঙ্গে আবার কোন গামছা নেই — স্নান করে গা মুছবে কি করে? ভৈরবের কাছ থেকে, একটা ধার নিতে হবে, তা ছাড়া তো উপায় নেই।
ঘুম কিন্তু আসে না। শতরঞ্চিটা বহু পুরোনো, তেলচিটে নোংরা, জায়গা জায়গায় ছেঁড়া, ওটার বিভিন্ন জায়গায় আটকে রয়েছে ভাঙা বা না ভাঙা শুকনো আরশোলার ডিম। বালিশটাও পাতলা, তেল চিটচিটে ময়লা। পাশের নোংরা নর্দমা থেকে পচা গন্ধ আসছে, তার সঙ্গে মিশেছে বালিশের তেল ময়লার গন্ধ, শতরঞ্চিতে আরশোলার ডিমের গন্ধ। পায়ের কাছে জলভরা বালতিগুলো রয়েছে — পা লম্বা করে ছড়িয়ে দিতে ভয় করে, যদি পায়ের ধাক্কা লেগে বালতি উলটে গিয়ে সব জল দাওয়ায় আর ওর নিজের গায়ে পড়ে? একটা জোর কেলেঙ্কারি হবে তাহলে। এখানে মশাও আছে প্রচুর — বোধহয় জমা জলের নর্দমাটার জন্যে। কানের কাছে বিন্ন আওয়াজ করে ঘুরে যাচ্ছে — বলতে চাইছে ঘুমিয়ে পড়ো বাছাধন, তুমি ঘুমোলেই আমাদের ভোজ শুরু হবে, আমরা মহানন্দে তোমার রক্ত চুষব।
তবুও ঘুমোল ভীম। এপাশ ওপাশ করতে করতে শেষ পর্যন্ত ঘুমিয়ে পড়ল। সেই কাকভোরে উঠেছে, তারপর সারাদিনই তো হটরানির পরিশ্রম। যাকে বলে একেবারে গাঢ় ঘুম। মশার কামড়, গায়ের ওপর দিয়ে আরশোলা আর পায়ের ওপর দিয়ে ইঁদুরের ঘোরাঘুরিও ভীম টের পেল না। ঘুম ভাঙল একেবারে শেষ রাতে — মাথায় চিন্তা নিয়ে ঘুমিয়েছে, সবার আগে উঠে পড়ে জলের কাজ সেরে নিতে হবে।
ভীম কলতলায় গিয়ে দেখল কলে জল এসে গেছে। ও চটপট মুখ ধোয়া, প্রাতঃকৃত্য, এসব সেরে নিল। মুখ খুব ভাল করে আঙুল দিয়ে পরিষ্কার করে বার বার কুলকুচি করে ধুয়ে নিল। এছাড়া উপায় নেই — সঙ্গে টুথ পেস্ট, ব্রাশ যা ছিল সব সুটকেসের সঙ্গে খোয়া গেছে। দাড়ি কাটাও ঐ একই কারণে হোল না। আজ ওসব জিনিষপত্র কিনে নিতে হবে। কলতলা থেকে ভীম ফিরে আসছিল ভৈরবের ঘরের দরজা খুলেছে কিনা তা দেখবার জন্যে। মাঝ রাস্তায় ভৈরবের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ও-ও উঠে গেছে, ওকেও সকাল সকাল বেরোতে হবে তো। ওর থেকে একটা গামছা ধার নিয়ে ভীম স্নানটাও সেরে ফেলল।
কারখানায় যাবার পথে ভৈরব ওস্তাদের জন্যে দুটো বোতল কিনল। একটা হুইস্কি, একটা ব্র্যান্ডি। ভীমকে বোঝাল — একটাতে চাকরিটা হবে ও আর একটা চাকরিটা রাখবে। এদের কারখানাতে ভীমের মতো নতুন লোকেরা তো কথায় কথায় ছাঁটাই হয়ে যায়। ভৈরবের মতো যারা পুরোনো লোক তাদের অবশ্য ভয় নেই — তারা কাজে পাকা, তাই তাদের চাকরিও পাকা। কিন্তু চাকরি পাওয়া আর তা রাখার ব্যবস্থা করতে গিয়ে ভীমের পকেট প্রচুর হাল্কা হয়ে গেল — মেনকা তো আর দু বোতল দামী মদের খরচা হিসেব করে ভীমের সঙ্গে টাকা দিয়ে দেয় নি। তবে জামাকাপড়, তোষক, এসবের টাকা ভৈরবকে দেয়া আছে, সেটা একটা বাঁচোয়া কিন্তু যা টাকা বাকি রইল তাতে ভীমের আর কত দিন চলবে? এক মাসও চলবে কি?
ভীমের চাকরিটা হয়ে গেল। একসঙ্গে দু দুটো বোতল পেয়ে ওস্তাদ খুশি হয়ে গেছে। ভীমকে বলল, ঠিক হ্যায়, আজ থেকে কাম মে লাগ্ যা। ভৈরবকে বলল, তুই ওকে ছগনের সঙ্গে ভিড়িয়ে দে। ছগন এই নয়া বান্দে কো সব কাম সমঝা দেগা।
ওস্তাদ আসলে ছাপরা জিলার লোক। বহু বছর ধরে এখানে আছে, একটা বংগালি আওরাৎকে শাদিবিহা করে নিয়েছে। এখন হিন্দি বাংলা মিশিয়ে কথা বলে। তবে একটু বেশি খুশি হয়ে গেলে ওর পুরনো জুবান বেরিয়ে আসে, কারখানার মজুরদের বান্দা বলে ডাকে।
সন্ধেবেলা ভৈরব ভীমকে প্রথমে সেই দর্জির দোকানে নিয়ে গেল। ভৈরব এখন একটু খুশি মনে আছে। কারণ ভীমের চাকরি হয়ে গেল, ওর খরচার জন্যে বার বার মেনকাকে চিঠি দিতে হবে না — বিশেষত ঘন ঘন চিঠি লিখতে মেনকাই ওর ভৈরবকে ডাকে পাঠানো চিঠিতে বারণ করেছে। এখন খরচাটা সোজাসুজি ভীমের থেকেই আদায় করা যাবে। সারা ফেরার রাস্তা ভৈরব ভীমকে বোঝাতে বোঝাতে এল। ওস্তাদের মর্জি কখন কিরকম হয়, আর সেই মর্জিকে সামাল দেবার জন্যে কিভাবে কি কথা বলতে হয়। আর বোতলের যোগান — সে তো মাসে মাসে দিয়ে যেতেই হবে।
ভীম ভৈরবের বকবকানি শুনে যাচ্ছিল, হুঁ হাঁ ছাড়া বিশেষ কিছু বলছিল না। এই মুহূর্তে ও যা সবচেয়ে বেশি অনুভব করছিল তা হচ্ছে খিদে। সেই ভোরে বেরোবার আগে ভৈরবের বৌ একখানা বাসি রুটি আর একটুখানি গত রাতের বেঁচে যাওয়া শাকভাজা খেতে দিয়েছিল, সেই খাওয়ার পর পেটে আর কিছু পড়েনি। ভৈরবের জন্যে ওর বৌ টিফিন বানিয়ে দিয়েছে — বেরোবার আগে ভীমের চোখে পড়ে গিয়েছিল, ভৈরব একটা বড় সাইজের টিফিন বাক্স নিজের ঝোলা ব্যাগে ভরে ফেলছে। তেলেভাজার দোকানটা দর্জির দোকানের আগে পড়ে। ভীম সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ল, অতএব ভৈরবও দাঁড়াল। ভীম তেলেভাজা কিনল দুজনের জন্যেই — ভৈরবকে বাদ দিয়ে তো ও একা একা খেতে পারে না। ভৈরব অনেকগুলো তেলেভাজা সাঁটল, ভীমের চাইতে বেশিই খেল। খাক শালা — ভীম ভাবল। প্রথম দিকে এসব ঝামেলা তো হবেই — পরে আপনিই সব ঠিক হয়ে যাবে।
দর্জির দোকান থেকে কাপড়জামা কিনে রাস্তায় বেরিয়ে ভৈরব ভীমকে অনেক কথা বলল। দ্যাখো ভীম, এখন তোমাকে কলকাতাতেই থাকতে হবে, গাঁয়ে তো আর ফিরতে পারবে না। চাকরিও পেয়ে গেছ, এখন বিয়েশাদি করে এখানেই থিতু হও। আমি বলি কি বিয়েটা করে ফেল, করে কোথাও একটা ঘর দেখে নিয়ে বৌ এর সঙ্গে সেখানে থাকো। এই তো আমার বোন রয়েছে সুলোচনা, বল তো এক্ষুনি ওর সঙ্গে তোমার বিয়ে লাগিয়ে দি। ঘরের খোঁজও আছে — মালিক আমার চেনাজানা, আমি বললে এক্ষনি একটা ঘর ভাড়াতে দিয়ে দেবে। মেনকা বৌদিকে এক্ষুনি কিছু জানাবার দরকার নেই — বিয়েটা হয়ে গেলে ধীরেসুস্থে খবর পাঠালেই হবে। কি বল তুমি, এ্যাঁ?
ভৈরব শালা অনেক কিছু মতলব করে রেখেছে — ভীম বুঝল। সেই সঙ্গে অনেক চিন্তা দ্রুত ওর মাথায় খেলে গেল। ভৈরব কথাটা মন্দ বলেনি। এটা অবশ্য পরিষ্কার যে ব্যাটা নিজের আইবুড়ো বোনকে নিজের ঘাড় থেকে ভীমের ঘাড়ে চালান করার চেষ্টা করছে। ভীম হ্যাঁ বলে দিলে বিয়েটা প্রায় নিখরচায় হয়ে যাবে, ভৈরবের গাঁট থেকে কিছুই খসবে না। সুলোচনা মেয়েটা বয়েসে ভীমের মতই হবে, এক আধ বছরের বড় ছাড়া ছোট হবে না। গত সন্ধ্যায় ওকে যে এক ঝলক দেখেছিল ভীম তাতে ওকে দেখতে ভাল একেবারেই মনে হয়নি। তবে একেবারে কুৎসিৎ-ও নয়। মেয়েটার স্বভাব চরিত্র কেমন কে জানে। অবশ্যি যে মেয়েকেই বিয়ে করা যাক না কেন আগে থেকে তার স্বভাব জানবার উপায় খুব একটা নেই। লোকমুখে অবশ্য অনেক সময় কিছু না কিছু শোনা যায়, তবে সে সব বেশির ভাগই বাজে কথা বা বাড়িয়ে বলা কথা। বিয়ে করে বিছানায় পাশে নিয়ে না শোয়া পর্যন্ত বোঝা যায় না সে মেয়ে কেমন স্বভাবের। এ মেয়েটার চেহারাটা লম্বা-চওড়া, একটু পুরুষালি গোছের। কি কারণে ভৈরব এ পর্যন্ত বোনের বিয়ে দেয়নি বা দিয়ে উঠতে পারেনি তা আন্দাজ করা মুস্কিল। তবে হ্যাঁ, বোনের বিয়ে হয়ে গেলে পর রান্নাঘরটা খালি হয়ে যাবে, রাতে নিজের মেয়েটাকে সেখানে শুতে দিতে পারবে। মেয়ে বড় হয়ে গেছে, এখানে হয়তো ওর সঙ্গে একই ঘরে বৌকে নিয়ে শুতে ভৈরবের সংকোচ হয়। ও আর বৌ যা করার তা নিশ্চয়ই মেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার পরেই করে। কিন্তু বলা তো যায় না, মেয়ে হয়তো জেগে যায়, ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে — সব কিছু দেখে শুনে নেয়। সে তো একটা লজ্জার ব্যাপার।
আর একটা কথাও ভাবল ভীম। ভৈরব ব্যাটার সঙ্গে ওস্তাদের সম্পর্ক ভাল — ভীম যদি ওর বোনকে বিয়ে করতে রাজী না হয় তাহলে ও ভীমের নামে ওস্তাদের কাছে চুকলি কেটে ভীমের চাকরির বারোটা বাজাতে পারে। ভীমের তো এই শহরে আর কোন চেনাজানা নেই, ও তখন কোথায় কাজকর্ম চাকরি-বাকরির খোঁজ করবে? তার চেয়ে ভৈরবের কথায় রাজী হয়ে যাওয়া ভাল। আর কিছু না হোক, নর্দমার পাশে ইঁদুর আর আরশোলাদের মধ্যে তো আর শুতে হবে না। রাতে শুয়ে পাশে একটা মেয়েমানুষও পাওয়া যাবে, তা সে মেয়েছেলেটা একটু পুরুষালি হলেই বা কি আসবে যাবে।
ভৈরব ভীমের পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে ওর উত্তরের অপেক্ষায় ওর দিকে তীব্র চোখে তাকাচ্ছিল। ভীম মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। মুখেও বলল, ঠিক আছে, আমি রাজী।
ভৈরব কান এঁটো করা খুশির হাসি হাসল। ভীমের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, সাবাস।