দুই ছেলের মৃত্যু ভীমের জীবনে আর একটি বড়ো পরিবর্তন এনেছিল। ও সুলোচনা সম্বন্ধে নতুনভাবে ভাবতে শুরু করেছিল। ও জানত সুলোচনার শরীরে মায়া মমতা এসব কম। সে অন্য লোকজনের সুবিধে অসুবিধে সম্পর্কে প্রায় উদাসীন এবং সে কারণে যথেষ্ট স্বার্থপর। বাচ্চাদের ওপর মায়ের যে পরিমাণ স্নেহ থাকা উচিৎ তা সুলোচনার নেই। কিন্তু এসব জানলেও ভীম তা নিয়ে আগে বিশেষ মাথা ঘামায়নি। দুনিয়ায় অনেক ধরণের লোক থাকে, সুলোচনা তাদের ভেতর একটি বিচিত্র ধরণের মেয়েমানুষ। ও ওর নিজের মতো থাক, ভীম তার নিজের মতো থাকবে। এভাবেই জীবন কেটে যাবে।
কিন্তু সন্তানশোকের অবিরাম খোঁচার ফলে ভীম ওর জীবনের এই বিপর্যয়ের জন্যে সুলোচনাকে দায়ী করতে শুরু করেছিল। সোজাসুজি না হলেও মেয়েমানুষটা পরোক্ষে দায়ী তো বটেই। ছেলেগুলোর তো কখনোই মায়ের কাছে মন খুলে কিছু চাইবার উপায় ছিল না। কোনো আবদার করলেই ওদের কপালে জুটত চড় আর থাপ্পড়। ওদের তেলেভাজা খাবার ইচ্ছে হয়েছিল তা যদি ওরা মায়ের কাছে বলতে পারত। সুলোচনা যদি কোনো ভালো জায়গার থেকে তেলেভাজা কিনে ওদের খাওয়াত! তাহলে তো ছেলে দুটো টাকা চুরি করত না, বাজে জায়গা থেকে পচা খাবার কিনে খেত না।
তবে ও সুলোচনার ওপর কোনোরকম রাগ অনুভব করেনি। কিন্তু বুঝে গিয়েছিল যে ও ওর এই পুরুষালি বৌটার থেকে মনের দিক থেকে দূরে সরে গিয়েছে — অনেক, অনেক দূরে। ও এখন ঐ মেয়েমানুষটার সঙ্গে এক ঘরে থাকে, কিন্তু এই একত্রে থাকা নেহাতই যান্ত্রিক। কিছুটা অভ্যাসের জন্যে, কিছু আবার প্রয়োজনে — একটা জায়গা কোথায় পাওয়া যাবে যেখানে ভীম আলাদা থাকতে শুতে পারবে? বৌ এর সঙ্গে এক বিছানাতেও শোয় — আর বিছানা কোথায় যে ভীম সেখানে শোবে? মাঝে মাঝে শরীরের জবরদস্ত তাগিদ জাগলে পাশে শোয়া মেয়েমানুষটার সঙ্গে দৈহিক মিলনও হয়ে যায়। কিন্তু এ-ও যান্ত্রিক, এর সঙ্গে মনের কোনো যোগ নেই। ও এখন সুলোচনা সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন, ওর ভালমন্দ, বাঁচা-মরা সবই এখন ভীমের কাছে সমান।
এভাবে ভীমের দিন কাটছিল। আর এরকম এক সময়েই ওর জানাশোনা হয়েছিল ওর জীবনের পরবর্তী নারীটির সঙ্গে।
সেদিন ভীম কারখানায় গিয়েছিল একটু শরীর খারাপ নিয়ে। বেলা একটু বাড়তেই জ্বর এসে গেল। সেই সঙ্গে মাথা ঘোরা, গা হাত পা ব্যথা। ও বুঝল বেশি দেরি করলে ও আর ঘরে ফিরতে পারবে না। ওস্তাদকে বলতে সে সঙ্গে সঙ্গে ছুটি দিয়ে দিল। অসুখ বিসুখে ছুটি দিতে ওস্তাদ কার্পণ্য করে না। কারণ বিমার আদমীকে দিয়ে কি কাজ হবে। কিন্তু ছুটি নিলে সে সব দিনের মাইনে দেয় না। ওর কথা খুব পরিষ্কার। কাম করো, তলব লে যাও। কাম নেহী তো তলব ভী নেহী।
কারখানাটা ওর ঘরের থেকে অনেক দূর, বাসে আসা-যাওয়া করতে হয়। বাসরাস্তা থেকেও বেশ খানিকটা হাঁটতে হয়। ভীম যখন ঘরে পৌঁছল তখন ওর প্রচণ্ড জ্বর, ও আর দাঁড়াতে পারছে না। ফিরবার সময় ও ভাবছিল সুলোচনা ঘরে থাকবে, নাকি কোনো বাড়িতে ওর কাজ থাকবে। ও যখন কাজে যায় তখন ঘরে তালা লাগিয়ে বেরোয়, সাত বছরের ছেলেটাকে ওর বন্ধু লতিকার ঘরে রেখে যায়। লতিকা ওদের প্রতিবেশীই বলা যায়, কয়েকটা ঘরের পরেই ওদের ঘর। লতিকা নিজের ঘরেই থাকে। ওর টাকাপয়সার অবস্থা ভাল, গায়ে খেটে কাজ করার দরকার নেই। তালার আর একটা চাবিও লতিকার কাছেই রাখা থাকে। ভীমের কাছে ঐ তালার চাবি থাকে না। তার দরকার হয় না। কারণ ফিরতে ফিরতে ওর সন্ধে হয়ে যায়, ততক্ষণে সুলোচনাও সব কটা বাড়ির কাজ শেষ করে ঘরে ফিরে আসে। কিন্তু আজ ভীম অনেক আগে ফিরেছে, লতিকার কাছে চাবি চাইতে হবে কিনা ও সে কথা ভাবছিল। ওর কাছে যেতে ভীমের একটু অস্বস্তি হয়। মেয়েছেলেটার সঙ্গে সুলোচনার সখীত্ব থাকলেও ভীমকে ও একটু বাঁকা চোখে দেখে। কিন্তু এখন তো কোনো উপায় নেই, সুলোচনা ঘরে না থাকলে লতিকার কাছে গিয়ে চাবি চাইতেই হবে।
ঘরে তালা নেই, অর্থাৎ সুলোচনা ঘরে আছে। দরজা খিল লাগিয়ে বন্ধ করা ছিল না। দরজার কপাট ঠেলে ভীম ঘরে ঢুকল, তারপর পেছনে হাত দিয়ে কপাট ঠেলে দরজা ভেজিয়ে দিল।
সে সব ভীমের চোখে পড়ল ঠিকই কিন্তু ওর তখন এসব নিয়ে ভাববার অবস্থা ছিল না। বিছানাটা ঘরের অন্য দিকে গুটিয়ে রাখা ছিল। ও নিজের চটিজোড়া দরজার পাশে খুলে রেখে মাদুরটাকে ঘুরে ওপাশে চলে গেল, বিছানাটা পেতে ফেলে সটান শুয়ে পড়ল। পায়ে অবশ্য ধুলো, তা ভীমের তখন ঘরের বাইরে বারান্দায় গিয়ে বালতি থেকে জল নিয়ে ঐ ধুলো ধুয়ে আসার মতো শারীরিক শক্তি ছিল না। এতক্ষণ ও মনের জোরে ঘরে ফিরেছিল, বিছানায় শোয়ার সাথে সাথে ও প্রায় অজ্ঞানের মতো হয়ে পড়ল।
সুলোচনা ভীম কি করে তা দেখছিল। ও এত অবাক হয়ে গিয়েছিল যে কি করবে তা বুঝতে পারছিল না। অন্য মেয়েমানুষটা ওকে ফিসফিস করে বলল, খুব জ্বর এসেছে মনে হচ্ছে। ওনার গা-টা একটু দ্যাখো।
সুলোচনা কাছে এসে ভীমের কপালে হাত ছোঁয়াল। আর সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠল। গা একেবারে পুড়ে যাচ্ছে। ও একটু ঘাবড়াল। এর আগে ও কখনো ভীমকে জ্বর-জ্বালাতে ভুগতে দেখেনি। ও নিজের বন্ধুকে বলল, খুব জ্বর। অষ্টুমী, তুইও একটু দেখবি নাকি?
ঐ মেয়েটি, যার নাম অষ্টুমী, সুলোচনাকে জিজ্ঞেস করল, ঘরে থারমোমিটার আছে?
সুলোচনা এদিক ওদিক ঘাড় নাড়ল। ও জিনিষ ঘরে নেই। দরকার হয় না, কিনে রেখে কী হবে? ছেলেদের মাঝেসাঝে জ্বর-জারি হয়েছে, আবার সেরেও গেছে। জ্বর মাপার যন্ত্র কেনার কথা মনেই হয়নি। তাছাড়া কিনলেও বা লাভ কি হত। ভীম বা সুলোচনা, ওদের কেউ ওই যন্ত্র ব্যবহার করতে জানে নাকি?
অষ্টুমীও এবার ভীমের কপালে হাত ছুঁইয়ে দেখল। সত্যিই, জ্বরটা খুবই বেশি। ও সুলোচনাকে বলল, মাথা ধুইয়ে দিতে পারলে ভাল হয়। তা না পারলে কপালে সমানে জলপটি দাও। আর ভূধর ডাক্তারকে দেখিয়ে ওষুধ দিতে পারলে ভাল হয়।
অষ্টুমী আগে রোগীর আয়ার কাজ করেছে। এ জাতীয় জ্বরজালা ও আগেও দেখেছে। এরকম হলে কি করতে হয় তা ওর অল্পস্বল্প জানা আছে।
অষ্টুমী কথাটা ঠিক বলেছে, সুলোচনা ভাবল। ভীমের যা অবস্থা তাতে ডাক্তার ডাকার দরকার। কিন্তু ভূধর বাড়ি এসে রোগী দেখলে একগাদা টাকা নেয়, অত টাকা দেয়ার ক্ষমতা সুলোচনার নেই। আর বেশিরভাগ সময়তেই ওর ডাক্তারখানায় ভিড় লেগে থাকে। সেজন্যে ও কারোর বাড়িতে বিশেষ যায় না, ওর কাছে রোগীকে নিয়ে যেতে বলে। ভূধর অবশ্য আসল ডাক্তার নয়, নেহাতই হাতুড়ে। বহুদিন আগে ও এক ডাক্তারের কম্পাউন্ডার ছিল, তারপর এদিকে এসে ডাক্তার সেজে বসে গিয়েছে। কিন্তু এ তল্লাটে ভূধর ছাড়া আসল-নকল কোনো ডাক্তারই আর নেই। কাজেই হাতুড়ে হলেও ওর যথেষ্ট পশার।
অবশ্য ভূধরকে রোগীর কি হয়েছে না হয়েছে তা বলেও ওষুধ নিয়ে আসা যায়। বেশিরভাগ লোক তাই-ই করে। রোগীর অবস্থা তার বাড়ির লোকের মুখে শুনে নিয়ে ভূধর ওষুধ দিয়ে দেয়। বিভিন্ন জ্বরজারি আর পেট খারাপের সব ওষুধ ও নিজের কাছেই রাখে। লাল, হলদে, সাদা, নানা রঙের নানা চেহারার সব বড়ি। ক্যাপসুল দিলে পাতাসুদ্ধ দেয়, মাঝে মাঝে মিকচারও দেয়। কিন্তু ভূধরের ডাক্তারখানা যেতে আসতে চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিটের রাস্তা, তার ওপর ওখানে গিয়ে লাইন দিয়ে বসে থাকতে হবে, সুলোচনার ডাক কতক্ষণে পড়বে তার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। কম করে এক ঘন্টা, সোয়া ঘন্টার ধাক্কা। ততক্ষণে অষ্টুমীর সঙ্গে ভীমকে একা থাকতে দেয়া কি উচিৎ হবে? হারাটাকেও লতিকার কাছে জিম্মা করে দেয়া আছে — একটু পরেই তো সুলোচনার ঘর বন্ধ করে কাজে বেরিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। একটা বদলির কাজ পেয়েছে মাসখানেকের জন্যে, কিছুদিন বেশিও হতে পারে। মাইনে ভাল দেবে, সেজন্যে সুলোচনা কাজটা নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু হারা থাকবে কোথায়? সাত বছর বয়েসের ছোটো একটা ছেলেকে ঘরে একা রেখে তো বেরোনো যায় না। সেজন্যে লতিকার সঙ্গে ব্যবস্থা করে নিয়েছে। দুপুরে খাওয়ার পর হারা গিয়ে লতিকার ঘরে থাকবে। লতিকা রাজী হয়েছে, কারণ ওর নিজেকে কিছু করতে হবে না। ওর বড় মেয়েটা তেরো-চোদ্দো বছরের, খুব গিন্নিবান্নি স্বভাবের। নিজের ছোটো ভাইটাকে ও-ই সামলে-সুমলে রাখে, হারাকেও ও-ই সামলে রাখবে। তা আজকে তো মনে হচ্ছে ভূধরের ডাক্তারখানার থেকে ফিরে এসেও ভীমেরই সেবা করতে হবে, আজ আর কাজে যাওয়া হবে না। বদলির কাজ, সেজন্যে কামাই করলে সেসব দিনের মাইনে কেটে নেবে। তা আর কি করা যাবে।
একটুক্ষণ অষ্টুমীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সুলোচনা। মনে মনে ভেবে নিচ্ছে, যে খটকাটা ওর মনে লেগেছে, সেটা নিয়ে ভাবছে। একবার ভাবল হারাকে লতিকার ঘর থেকে ডেকে এনে এখানে বসিয়ে দিয়ে যাবে। কিন্তু তারপরেই সে চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিল। একদিন হারাকে নিয়ে এলে আর ওকে লতিকার ঘরে রেখে বেরোনো যাবে না। অষ্টুমীকে বলবে নাকি ওর সঙ্গে ডাক্তারখানায় যেতে? না, ভীমের এই অবস্থায় ওকে ঘরে একা রেখে যাওয়া ঠিক হবে না। অষ্টুমীকে বলবে ওষুধ নিয়ে আসতে? তাও করা যাবে না। এক তো ভদ্রতায় আটকায়। তাছাড়া ভূধর হয়তো জিজ্ঞেস করবে অষ্টুমী রোগীর কে হয়, নিজের লোক না হলে হয়তো তার হাতে ওষুধ দেবে না।
সুলোচনা চট করে ঠিক করে ফেলল। অষ্টুমীকেই ভীমের কাছে রেখে যাবে। ও আয়ার কাজ জানে, ভীমের জ্বরটাকে সামাল দিতে পারবে। এখন ভীমের যা অবস্থা তাতে ওদের মধ্যে শরীরের কিছু হওয়া সম্ভব নয়। সুলোচনা অষ্টুমীকে একটু তোয়াজ করে বলল, আমি চট করে গিয়ে ওষুধ নিয়ে আসি। তুই ভাই একটু কষ্ট করে আমার কত্তার কাছে থাক।
একটা বালতিতে খানিকটা জল নিয়ে এসে সুলোচনা সেটা ভীমের বিছানার শিয়রে বসিয়ে দিল। হারার পুরোনো একটা ছেঁড়া গেঞ্জী অষ্টুমীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, একটু জলপটিও দিয়ে দিস লক্ষ্মীটি। আমি এই দৌড়ে যাব আর আসব।
ভীমের প্রায় বারো-চোদ্দো দিন লেগে গেল বিছানা ছেড়ে উঠে হেঁটে-চলে বেড়াতে, মাথা ঘুরে না পড়ে গিয়ে একা একা ঘর থেকে বারোয়ারি কলতলায় যেতে। তবে শেষের কটা দিন ও নাটক করে বিছানায় পড়ে ছিল। কারখানায় গেলেই তো সেই কোমরভাঙা খাটুনি। মাইনে অবশ্য কাটবে। তা কাটুক। সুলোচনা এদিক ওদিক ওর চেনা আর আর বাড়ির কাজ করা মেয়েদের কাছে হাত পাতবে, ওদের ধার শোধ করার জন্যে আরও কয়েকটা বাড়িতে কাজ ধরার চেষ্টা করবে। ব্যাপারটা মন্দ হবে না। ভৈরবের কাছে ভীমের দেনাটাও হয়তো একটু বেশি-ই বেড়ে যাবে। তা বাড়লেই বা কী? ওই বদমাসটার কাছে ধার তো আর কোনোদিন শোধ হবে না, আর শোধের কিস্তিও ভীম এখন যা দেয় তার চেয়ে খুব বেশি দিতে পারবে না। কাজেই ভীম এখন বিছানায় শুয়ে যে আরামটা করছে তা আরও কয়েকটা বেশিদিন করবে না কেন?
সুলোচনা ভীমের অসুখের কদিন সকালের কাজের থেকে ছুটি নিয়েছিল, ভীমের কাছে অন্য কোনো লোকের থাকার দরকার পড়েনি। কিন্তু বিকেলে বদলির কাজটায় ছুটি নেওয়ার উপায় ছিল না। কাজেই অষ্টুমীর সঙ্গেই ব্যবস্থা করে নিয়েছিল ভীমকে দেখাশোনা করার জন্যে। অষ্টুমীও কতগুলো বাড়িতে সুলোচনার মতোই ঘরদোরের কাজ করে। কিন্তু দুপুরের পর ওর কোনো কাজ আপাতত নেই, সেজন্যে ও রাজী হয়েছিল। সুলোচনার সঙ্গে এরকম কাজের অনেক মেয়েমানুষের সঙ্গে জানাশোনা আছে, কিন্তু বন্ধুত্ব কয়েকজনের বেশি কারোর সঙ্গে নেই। অষ্টুমীর ঠান্ডা, শান্ত স্বভাবের জন্যে ওই জানাশোনাটা বন্ধুত্বে গড়িয়ে গিয়েছিল। তা না হলে কেউ আর একজনের ঘরে রোগীর বিছানার পাশে বসে থেকে রোগীকে পাহারা দিতে সহজে রাজী হত না।
একেবারে ছেড়ে না গেলেও ভীমের জ্বর দু-তিন দিনের ভেতরেই অনেকটা নেমে গিয়েছিল। ভীম বিছানায় শোয়া, মাথা গা হাত পা ব্যথা, উঠে বসলে মাথাঘোরা, তাতেও ওদের ভেতর শুরু হল এটা সেটা কথাবার্তা। ভীম অষ্টুমীর অনেক খবর জেনে ফেলল। অষ্টমীর দিন জন্ম, সেজন্যে নাম অষ্টুমী। বাপ মা নেই, সৎ মায়ের সঙ্গে থাকে। দুই রোজগেরে দাদা আছে। তারা নিজেদের বৌ বাল-বাচ্চা নিয়ে আলাদা থাকে, বোন বা সৎ মায়ের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখে না। সৎমা আর অষ্টুমী দুজনেই রোজগার করে। কিন্তু সৎমা বুড়িটা একটা দুটো বাড়ির বেশি কাজ নেয় না, অষ্টুমীর রোজগারেই খায়, বাড়িভাড়া দেয়। সেলাই-এর কাজ করেও অষ্টুমী কিছু রোজগার করে, কিন্তু ওর সে টাকাও বুড়িটা নিয়ে নেয়। অনেক বছর আগে অষ্টুমীর বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু ওর বরটা ওকে ত্যাগ করে চলে গেছে। অন্য একটা মেয়েমানুষের সঙ্গে থাকে। ছেলে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে, শ্বশুর শাউরি কি আর ছেলের বৌকে ঘরে রাখে? দিয়েছে অষ্টুমীকে তাড়িয়ে। অষ্টুমীর একটা মেয়ে হয়েছিল, সেই বাচ্চাটাকে পর্যন্ত বাড়িতে রাখেনি। অষ্টুমী আর কোথায় যাবে, মেয়ে নিয়ে চলে এসেছিল এই সৎমার কাছে। বুড়িটা ভীষণ পাজি। অষ্টুমীর পয়সায় খায়, কিন্তু ওকেই দিনরাত গালাগাল দেয়। ওর মেয়েটার অসুখ করেছিল, বুড়ি ডাক্তার ডেকে দেখানো তো দূরে থাক, ভূধরের কাছ থেকে ওষুধ পর্যন্ত এনে বাচ্চাটাকে খাওয়াতে দিল না। ব্যাঁকা কোনো অসুখ করেছিল, বাঁচল না মেয়েটা। বসে কান্নাকাটি করা ছাড়া অষ্টুমীর কিছু করার ছিল না, পয়সাকড়ি তো সব ওই বুড়ির কব্জায়। বুড়িটা একবার ওকে বলেছিল রাস্তায় নেমে শরীর ভাঙিয়ে পয়সা রোজগার করে আনতে। অষ্টুমী সে কথায় কান দেয়নি। তারপর থেকে গালাগাল আরও বেড়েছে। নেহাৎ অষ্টুমীর রোজগারে সংসার চলে তাই, তা না হলে বুড়িটা ওকে এতদিনে ঘর থেকে বার করে দিত।
ওদের এই সাধারণ জানাশোনাটা দৈনিক একান্ত সান্নিধ্যে থাকার ফলে কয়েকদিনের মধ্যেই ভাব-ভালবাসায় দাঁড়িয়ে গেল। অন্তত ভীমের দিক থেকে তো বটেই। ও হঠাৎ বুঝতে পারল যে ওর এখন সুখ খুঁজবার জন্যে অতীতে ডুব দেয়ার দরকার হয় না। এখন ওর অষ্টুমীর কথা ভাবতে ভাল লাগে। সুলোচনা যতক্ষণ ঘরে থাকে তখন ও ওর বৌটার অস্তিস্ত্ব ভুলে থাকার চেষ্টা করে। চোখ বুজে শুয়ে থাকে। সুলোচনা ওষুধ আর গেলাসে করে জল নিয়ে এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে ওকে ডাকলে একবারে সাড়া দেয় না। দু-তিনবার ডাকলে চোখ খোলে, তারপর খুব ধীরে ধীরে বিছানার ওপর উঠে বসে, আস্তে আস্তে হাত বাড়িয়ে ওষুধ আর জল নেয়, ওষুধ খায়। তারপর জলের গেলাস আবার সুলোচনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে চোখ বোজে। যদিও ভীম অনেকটাই অভিনয় করে সুলোচনা তা ধরতে পারে না। ও চিন্তিত হয়। মানুষটা কবে যে আবার ঠিক হবে, কাজে বেরিয়ে টাকা আনতে পারবে। টাকা না আনতে পারলে পুরুষমানুষ তো ঘরের আবর্জনার সামিল। সে আবর্জনা আবার এমন যে ঘরেই রেখে দিতে হয়, ঝেঁটিয়ে তা বাইরে ফেলে দেয়া খুবই মুস্কিলের কাজ।
ভীম চোখ বুজে অষ্টুমীর কথা ভাবে। ওর জ্বরের বাড়াবাড়ির সময় অষ্টুমী ওকে কপালে জলপটি দিয়েছে, তখন ভীম ওর হাতের ছোঁয়া পেয়েছে। ভারি নরম আর আরামাদায়ক সেই ছোঁয়া। এখন জ্বর নেমে গেছে, জলপটি দেয়ার আর দরকার পড়ে না। ভীম এখন কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে ওর হাত ধরে, ওর হাতের ওপর নিজের জাত বোলায়। অষ্টুমী ভীমকে খানিকক্ষণ তা করতে দেয়, তারপর নিজের হাত সরিয়ে নেয়। লাই দিলে কুকুর মাথায় ওঠে, পুরুষমানুষও তাই। তখন ভীম চুপ করে যায়, চোখ বন্ধ করে অন্য পাশ ফিরে শোয়। তখন আবার অষ্টুমী ওর মাথা টিপে দেয়, কপালে হাত বোলায়।
অর্থাৎ একথা বলা যেতে পারে যে ওদের ভেতর এই নতুন তৈরি হওয়া সম্পর্কটা বেশ দ্রুতই এগোচ্ছিল। অষ্টুমী মেয়েটার গায়ের রঙ কালো, রোগা বলে গায়ে বিশেষ মাস নেই, মুখটাও যে মিষ্টি তা বলা যায় না। ওর বয়েসও ভীমের চেয়ে বেশি ছাড়া কম নয়। কিন্তু ভীম ওকে একটা বিশেষ ভাবে দেখতে শুরু করেছিল। শারীরিক দুর্বলতা থাকলেও ওর অষ্টুমীকে দৈহিকভাবে পাওয়ার ইচ্ছে মাথা চাড়া দিতে চাইছিল। বহুদিন আগে, ভূতনির সঙ্গে গাছতলায় শুয়ে পড়ার সময় যে তীব্র উত্তেজনাটা ওর মাথায় ঝাঁ ঝাঁ করত, ও এখন সেটার ঝাঁজ একটু একটু করে অনুভব করছিল।
তারপর একদিন ভীম অষ্টুমীর হাত চেপে ধরল। উত্তেজনায় গলা ভাঙা, সেজন্যে ফিস ফিস করে বলল, চলো, আমরা পালিয়ে যাই। অনেক দূরে কোথাও। তারপর বিয়ে করে নেব।
অষ্টুমীকে ভীমের এ কথা বলাটা ছিল আকস্মিক, ও আগে থেকে ভেবেচিন্তে একথা বলেনি। তবে ভীম হয়তো নিজেও জানত না ওর মনের ভেতর একটা চিন্তা দানা বাঁধছে — যে পরিবেশে ওকে এখন দিন কাটাতে হচ্ছে তার থেকে বেরিয়ে যাবার একটা চিন্তাভাবনা ওর মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। ছেলেরা বেঁচে থাকলে ভীম অষ্টুমীর দিকে আকৃষ্ট হত কিনা সন্দেহ, আর সেজন্যে পালিয়ে যাবার চিন্তাও ওর মাথায় আসত না। কিন্তু সন্তানশোক ওর মুখ সুলোচনার এই সংসারের থেকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল, ওর ভেতরে তৈরি হওয়া শূন্যতার প্রবল অনুভূতিটা হয়তো অন্য কোথাও একটা নতুন জীবন শুরু করার চিন্তার জন্ম দিয়েছিল। অষ্টুমীর দেখা পাওয়ায় ওর সেই চিন্তাটা অতি দ্রুত একটা তীব্র ইচ্ছেতে পরিণত হয়েছিল। সেই ইচ্ছেটাই ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল — চলো, আমরা পালিয়ে যাই। তবে অষ্টুমী ছিল একটা উপলক্ষ মাত্র। সেই উপলক্ষ অষ্টুমী না হয়ে কোনো একটা একাদশী বা পূর্ণিমা হলেও ভীম তাকে একই কথা বলত।
অষ্টুমী মুখ নিচু করে চুপ করে রইল। ভীম ওর হাত ধরে আছে, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করে আছে। ওর মনে নানা চিন্তা একসঙ্গে ঘুরপাক খাচ্ছিল। ভীমের বৌ আছে, একটা ছেলে আছে। দেশে মায়ের সম্পত্তি আছে সেকথাও ভীম-ই ওকে বলেছে। অর্থাৎ ভীমের অনেক পিছুটান আছে। ভীম যদি কিছুদিন পরে ওকে ফেলে রেখে আবার ফেরৎ চলে আসে? বৌ-এর সঙ্গে আবার সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে, ও বৌ এর বিছানায় তার পাশে শোবে। ভীম বলেছে বৌ আর মায়ের মিল হয় না, সেজন্যে ও বৌ নিয়ে এখানে আলাদা থাকে। ছেলের বৌ আর শাশুড়ির যদি মিলজুল হয়ে যায়? তখন ভীম তো বৌ বাচ্চা নিয়ে দেশেই চলে যাবে, বিলকুল নিপাত্তা গায়েব হয়ে যাবে। আর অষ্টুমীর কী হবে? ও থাকবে কোথায়, ওর খাওয়া জুটবে কোথা থেকে? অষ্টুমীকে কি তাই করতে হবে — সৎমা সেই যা বলেছিল — রাস্তায় লাইন দিয়ে দাঁড়াতে হবে ওকে? ভীমের কথায় রাজী হওয়াটা কি ঠিক হবে?
কিন্তু মানুষের জীবনে মাঝেমাঝে এক একটা সময় আসে যা তার জীবনের রাস্তা আমূল পালটে দেয়। সামান্য কয়েক মুহূর্তের ছোট্ট একটু সময়। সে আসে একবার একটা ঝোড়ো হাওয়ার মতো, মানুষটা জোরালো ঝুঁকির এ রাস্তায় পা বাড়িয়ে দেয়। অষ্টুমীও সেরকম একটা সময়ের একটা প্রবল ধাক্কা খেল। একটা ছবি ভেসে এল ওর সামনে, ঝাপসা একটা মুখের ছবি। ওর নিজের ঘর-সংসার, ওর নিজস্ব একটা পুরুষ, ঘরভর্তি ওর ছেলেমেয়ে। ছবিটা মিলিয়ে যায়, আবারও ফিরে আসে বর্তমান কালে। সারাদিন ঘরে কাজ, বাইরে কাজ। তার মজুরি সৎমার তাড়না, গালাগাল। দিন যায়, দিন আসে, সব দিন একইরকম, কোনো সুখ নেই, আনন্দ নেই, খালি দুঃখ, কষ্ট।
ও মুখ তুলল। ওর মুখে একটা ছোট্ট হাসি। ওর শান্ত, ঠান্ডা চোখ দুটোও হাসল। মাথাটা একপাশে হেলিয়ে ভীমের মতোই ফিস ফিস করে ও বলল, আমি রাজি।
শুয়ে পড়েই একটা লম্বা দম নিল ভীম। অষ্টুমীর দিকে তাকিয়ে দেখল। ভীম এই যে একটা কান্ড করে ফেলল মেয়েটা তাতে আবার চটে গেল না তো? অষ্টুমী শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের ঠোঁট আর মুখ ঘষে ঘষে মুছছিল — মুখে হামি টামি খাবার কোনো দাগ না থেকে যায়। তা যদি থাকে আর সৎমা ডাইনিটা যদি দেখে ফেলে তাহলে সর্বনাশ। ওর মুখে রাগ করার কোনো লক্ষণ দেখতে না পেয়ে ভীম নিশ্চিন্ত হল। বলল, দাঁড়াও, শীগগীরই পালাবার একটা পাকা মতলব ঠিক করে ফেলছি।
তবে পালাবার আগে ওদের নিয়মিত দেখা হওয়ার দরকার। কিন্তু কী করে? ভীম চিরকাল বিছানায় শুয়ে থাকতে পারবে না। কাজেই অষ্টুমীও এখানে হাজিরা দেবে না। ভীম একটা উপায় বের করল। এখান থেকে বাসে আধঘন্টা, সেখানে একটা বাজার আছে। তার গায়ে একটা রেষ্টুরেন্ট রয়েছে। চা, মামলেট, চপ, কাটলেট পাওয়া যায়। জায়গাটা খারাপ নয়, মেয়েছেলে সঙ্গে নিয়ে বসে চা খাওয়া যায়। ওখানে ওরা দেখা করবে। প্রতি শনিবার, বিকেলে চারটের সময়। সপ্তাহের ঐ দিনটা ইচ্ছে করলে হাফ ডে করা যায়, কিন্তু কারখানায় সোমবারে বেশি সময় কাজ করে পুষিয়ে দিতে হয়। ভীমও তাই করবে। আর অষ্টুমী রোজদিনই ঐ সময়টায় খালি থাকে। ভীম আগে এসে অপেক্ষা করবে, অষ্টুমী একটু দেরী করে আসবে। ও আগে এলে অসুবিধে আছে। একটা মেয়েছেলে বাজারের পাশে একটা রেস্টুরেন্টের একটা টেবিলে একা বসে আছে, লোকে অষ্টুমীকে খারাপ মেয়েছেলে বলে ভেবে নেবে।
এরপর ভীম কয়েকটা দিন যতক্ষণ জেগে রইল ততক্ষণই ওর ‘মতলবের’ কথা ভাবল। ছোট্ট ছেলেটা, হারার কথা ভেবে অবশ্য মাঝে মাঝে মনটা একটু খচখচ করছিল। তারপর ভীম মন থেকে ওই চিন্তা বাদ দিল। কত ছেলের তো ছোটো বয়েসে বাপ মরেও যায়, তারা কি আর বেঁচে থাকে না? হারাও সেভাবেই বাঁচবে। সুলোচনাকে নিয়ে ওর কোনো মাথাব্যথা নেই। মেয়েমানুষটা নিজে খেটে খাবে। রাত্রে শুয়ে ভীমের ঘুম আসে না, খালি ভাবে কি করে চুপচাপ পালিয়ে যাওয়া যায়। ঘরের জানালাটা গরমের জন্যে খোলা, জানালায় কোন পর্দা নেই, রাস্তায় ল্যাম্প পোস্টের আলো ঝাপসা হয়ে ভেতরে ঢোকে, ঘরের ভেতর সব কিছু আবছা আবছা দেখা যায়। ভীমের পাশে শোয়া সুলোচনা, তার ওপাশে হারা। দুজনেই ঘুমিয়ে কাদা। সুলোচনার গায়ের আলগা কাপড় আলুথালু, একটা স্তন উদলা হয়ে গেছে, বিসদৃশ চেহারার ক্ষুদ্র এবং শিথিল মাংসপিণ্ডটা বুকের ওপর কোনোরকমে ঝুলে রয়েছে। ওর নাক আর মুখ থেকে ফোঁস ফোঁস ভোঁস ভোঁস আওয়াজ বেরোচ্ছে, আওয়াজের সাথে সাথে মুখের কোণা দিয়ে অল্প অল্প ফেনা বেরোচ্ছে, বুড়বুড়ি কাটছে সেখানে। বিতৃষ্ণায় ভীম মুখ ঘুরিয়ে নেয়, অন্য পাশ ফিরে অষ্টুমীর সঙ্গে চুপচাপ ভেগে যাওয়ার নানারকম ছকের চিন্তাভাবনা করতে থাকে। কোনোটাই পছন্দ হয় না, ভাবতে ভাবতেই এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে।
কদিন পরে একরাতে বিছানায় শুয়ে এভাবেই চিন্তা করছিল ভীম। কী করে কী করা যায়? মাথায় কিছু আসছে না। এদিকে অনেক দিন কামাই হয়ে যাচ্ছে, এবার কারখানায় হাজিরা দেয়া দরকার। ওস্তাদ ছুটি দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু মাইনে তো কাটবে। আর বলা তো যায় না, বেশি ছুটি নিলে ব্যাটা বিগড়ে যাবে কিনা। তাহলে তো চাকরিটা নিয়েও টানাটানি পড়তে পারে। কাজে যাওয়ার দরকার। সঙ্গে দুটো বোতলও নিয়ে যেতে হবে। ভালরকম পুজো পেলে ঠাকুর দেবতারাও তো খুশি হয়ে পাপী-তাপীকে ক্ষমা করে দেন, অন্তত তাদের জামিনে খালাস দিয়ে দেন, আর ওস্তাদ কি খুশি হবে না? কি কথা বলে ওস্তাদের হাতে বোতল দুটো ধরাবে মনে মনে তার মহড়া দিচ্ছিল ভীম। তখনই ওর মাথায় বুদ্ধিটা খেলে গেল। ও ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল। ওর এই উঠে বসার ধাক্কায় সুলোচনার ঘুমেও একটু ব্যাঘাত ঘটে গেল। ওর ফোঁস ফোঁস ভোস ভোস থেমে গেল, ঘুমের মধ্যেই একটু ভুরু কুঁচকে মুখ বাঁকিয়ে ও অন্য পাশ ফিরে শুল। ভীমও আবার শুয়ে পড়ল। ওর মাথাটা এখন ঠান্ডা হয়ে এসেছে। কালকেই ও কারখানায় কাজে যোগ দেবে। একটু সকাল সকাল যাবে, তাহলে ওস্তাদকে একা পাওয়া যাবে।
পরদিন সকালে সুলোচনা ঘুম ভেঙে উঠে দেখে ভীম স্নানটান করে বেরোবার জন্যে তৈরি। কারখানায় যাবে। তাড়াতাড়ি হাজিরা দেবে, ওস্তাদ সকালের দিকে ভাল মেজাজে থাকে। সেজন্যে সুলোচনা রুটি বানিয়ে দেবে, তা খাওয়ারও সময় হবে না। আর হ্যাঁ, ওস্তাদের জন্যে বোতল কিনে নিয়ে যেতে হবে। তাতেও তো খানিকটা সময় লেগে যাবে। সুলোচনা খুশি। মানুষটা আবার কথা-টথা বলছে। এখন কাজে যাবে, টাকা রোজগার করে আনবে, সংসারের একটু সুহাল হবে। কিন্তু ভীমের কাছে বোতল কেনার টাকা নেই। ও ধার চাইল সুলোচনার কাছে। হাতে টাকা এলেই সুলোচনাকে ফেরত দিয়ে দেবে।
টাকা সুলোচনার হাতেও নেই। কিন্তু ও ভীমকে টাকা দিতে না বলল না। কিছু টাকা খর্চা করে বোতল কিনলে যদি ভীমের চাকরিটা বেঁচে যায় তাহলে সেটাই করা উচিৎ নয় কি? ও ছুটল লতিকার থেকে টাকা ধার করবার জন্যে। ওর বরটা গাড়ি চালায়, কোন একটা কোম্পানিতে ঐ কাজ করার চাকরি করে। মাস মাস ভাল মাইনে পায়। তাছাড়া প্রায়ই কোম্পানির কাজে মাল নিয়ে ছোটো লরী চালিয়ে কলকাতার বাইরে যাওয়া-আসা করে। সে সব কাজের জন্যে আলাদা করে অনেক টাকা পায়। সেজন্যে লতিকার হাতে সবসময়েই টাকা থাকে। লতিকা টাকাটা দিল, কিন্তু মুখটা একটু ব্যাজার করে। টাকাটা দিয়ে সুলোচনাকে বলল, আমার এখন একটু টানাটানি যাচ্ছে, ও মাসের গোড়ায় টাকাটা ফেরত চাই কিন্তু।
ভীম টাকাটা নিয়ে বাসে চাপল। ঐ বাজারটায় গেল, যেখানকার রেস্টুরেন্টে ও অষ্টুমীর সঙ্গে দেখা করবে। এত সকালেই ওখানে একটা মিষ্টির দোকান খোলা, গরম গরম কচুরি ভাজা হচ্ছে সেখানে। অনেকে কচুরি আর আলুর তরকারি শালপাতার ঠোঙাতে নিয়ে হাতে ধরে খাচ্ছে। পাশে রাস্তার ধারে একটা কর্পোরেশনের জলের কল, সেখানে এখন জল এসেছে। কলটার মুখ বন্ধ করার ব্যবস্থাটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে, সেখান থেকে সমানে জল পড়ে জল নষ্ট হচ্ছে আর রাস্তার পাশটা ভিজে নোংরা হচ্ছে। মিষ্টির দোকানটার ঠিক বাইরে একটা নোংরা ফেলার ছোটো ড্রাম, খাওয়া শেষ করে লোকগুলো এঁটো শালপাতার ঠোঙা ড্রামটার ভেতর ছুঁড়ে ফেলছে আর ঐ কলের জলে হাত মুখ ধুয়ে নিয়ে আর পেছনে না তাকিয়ে নিজের কাজে চলে যাচ্ছে। খাবারের দাম আগেই দেওয়া আছে। দামটা আগে না পেলে দোকানি খদ্দেরের হাতে কচুরির ঠোঙা দেয় না।
ভীমও চটপট কয়েকটা কচুরি খেয়ে নিল। ভীম যখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাচ্ছে তখন একটা লোক খাওয়া শেষ করে কুলকুচি করে মুখ ধুয়ে সেই জল মুখ থেকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলছিল। সেই জলের ছিটে ভীমের প্যান্টে এসে লাগল। অন্য সময় হলে ভীম হয়তো লোকটার সঙ্গে ঝগড়া করত, বেশ অনেকগুলো বছর কলকাতায় থেকে এখন ভীম এখানকার হালচালে দুরুস্ত হয়ে গেছে তো। কিন্তু ঝগড়া করতে গেলেই সময় নষ্ট হবে, আর ভীমের এখন দেরী হয়ে গেলে চলবে না। কাজেই ও লোকটার দিকে খালি কটকট করে তাকাল। লোকটা দৃকপাতও করল না, মুখের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে মাড়িতে লেগে থাকা কচুরির কাদা বার করে এনে টুসকি মেরে তা দূরে ফেলে দিল। তারপর নিজের প্যান্টে আঙুল মুছে হনহন করে হেঁটে চলে গেল। ভীম অস্ফুটে একটা গাল দিল, শালা শুয়োরের বাচ্চা।
ভীম বাস পেল বেশ কিছুক্ষণ পরে। অত সকালে বাস আসে অনেকক্ষণ দেরী করে করে। বোতল কিনতে হবে শহরের ভেতরের একটা দোকান থেকে। জায়গাটা এখানে থেকে দূরে আছে। বাসে যেতেও সময় লাগবে, কারণ বাস এখন চলছে টিক টিক করে। এই সময় বাসে ভিড় নেই, ক্লীনার ছোকরাটা লোক ডাকতে যাচ্ছে, ড্রাইভার ও রাস্তার পাশে লোক দেখলেই তার পাশে গিয়ে বাস প্রায় থামিয়ে দিচ্ছে। যতক্ষণ না লোক ভর্তি হবে ততক্ষণ বাস ঠিকমতো চলবে না। কাজেই যখন ভীম বোতলের দোকানের ওখানে পৌঁছোবে তখন দোকান খুলে যাবে, ওকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হবে না।
দুটোর বদলে তিনটে বোতল কিনল ভীম। দামী জিনিষ নিল, একটু পয়সাওয়ালা ভদ্দরলোকেরাই সাধারণত এ জিনিষের খদ্দের।
ওস্তাদ ভারি খুশি। বার বার ভীমের কাঁধ চাপড়ে দিল। বলল, তোর দিলটা বড়া আছে। যা, সাত দিন এখন তোর হাল্কা কাম। ভারী কাম সাত দিনকে বাদ। তোর গরহাজিরও মাপ করে দিলাম, তোর তনখা কাটা যাবে না।
ভীম দেখল এই মওকা। এখন ওস্তাদের মেজাজ ভাল আছে, একটু পরেই আবার তা বদলে যাবে কিনা কে জানে। আর এখন কারখানাতেও শ্রমিকদের বেশি ভিড় নেই। দূরে দূরে দু- একজন নিজের নিজের কাজ করছে। ও সাহস করে ওস্তাদকে ওর আশনাই-এর কথা বলে ফেলল। মেয়েটাকে নিয়ে ভেগে যাবার কথাও বলল — যা থাকে কপালে। তারপর খপ করে ওস্তাদের পায়ের ধুলো নিয়ে বলল, ওস্তাদ, একটা রাস্তা বাতলে দাও। তুমি ছাড়া আর কেউ আমাকে সাহায্য করতে পারবে না।
ওস্তাদ কয়েকমিনিট ধরে হাসল। প্রাণখোলা, ঠা ঠা করে হাসি। হাসির আওয়াজটা যথেষ্ট জোর ছিল বলে কয়েকজন শ্রমিক মুখ ঘুরিয়ে এদিকে দেখল। কি ব্যাপার, ওস্তাদ এত জোরে হাসছে কেন! অবশ্য ওদের জানার কোনো উপায় নেই। ওস্তাদ কেন হাসছে। ওরা আবার মুখ ঘুরিয়ে নিজের কাজে মন দিল। যদি বেশিক্ষণ ওস্তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে আর সেটা ওস্তাদের চোখে পড়ে যায় তাহলে হয়তো লোকটা হাসি থামিয়ে একটা গালাগাল ছুঁড়ে দেবে — কেয়া রে সুয়ার কা আওলাদ, কী দেখছিস আমার মুখে?
তবে ভীম নিশ্চিন্ত হল, যাক্, ওস্তাদ রাগ করেনি। রাগ করলে এতক্ষণে গালাগাল দিয়ে ভূত ভাগিয়ে দিত। ও একটু বেচারা বেচারা মুখ করে অপেক্ষা করে রইল কখন ওস্তাদের হাসি থামে। হাসি থামলে ওস্তাদ আবার ওর কাঁধ চাপড়ে দিল। বলল, বেটা তু বাহাদুর আদমি আছিস। আওরাৎ ফাসানা সহজ কাম নয়। তুই সেটা করতে পেরেছিস, সাবাস বেটা।
তারপর একটু গম্ভীর হয়ে বলল, ঠিক হ্যায়, আমি তোকে মদত করব। তোকে কচ্ছ ভেট দেব। ও জাগাহ্ কোথায় জানিস?
ভীম বাপের জন্মে ও জায়গার নামও শোনেনি, জায়গাটা কোথায় তা জানা তো দূরের কথা। ও মাথা নাড়ল। ও জানে না।
ও বহত দূর, ওস্তাদ বলল। উধার কোই তুসে ঢুঁন নেহী পায় গা।
ভীম খুবই রাজী। যেখানে হোক এমন একটা জায়গা চাই যেখানে ওর অতীত ওকে আর কোনোভাবে বিরক্ত করবে না, অষ্টুমীকে নিয়ে ও শান্তিতে থাকতে পারবে। কিন্তু অষ্টুমী নামটা ওর পছন্দ নয়, ও ওর নতুন প্রেমিকার নাম বদলে দেবে। একটা নাম ও ঠিক করে ফেলেছে, আলতা। বেশ নামটা। নতুন জায়গায় ওর বৌ-এর ওই নামটাই চালু করে দেবে ভীম। ও নিজের একটা নতুন নাম নেবে। দুর্যোধন নামটা নিলে কেমন হয়? ভীমের উলটো দুর্যোধন। কিন্তু ভীমের নাম বদলানোতে একটা মুশকিল আছে। ওস্তাদের কাছ থেকে তো একটা সার্টিফিকেট নিয়ে যেতে হবে যে ও কারখানার কাজে দক্ষ আর অভিজ্ঞ। ওস্তাদ তো ওর ভুয়ো নামের কোনো কাগজ লিখবে না। কিন্তু তাতেই বা অসুবিধে কী? নতুন মালিক তো ওদের সব কিছুই জানবে, কাজেই সেখানে গিয়ে মালিকের পায়ে ধরাধরি করে নিজেদের নতুন নাম লিখিয়ে নিলেই হবে। সেটাই ভাল হবে। ওখানে নিজেদের আসল নাম চালু থাকলে কে কবে কোথা থেকে খোঁজ পাবে তার কিছু ঠিক আছে?
ওস্তাদ ভীমকে কোথায় কীভাবে কার কাছে পালাতে হবে সব বুঝিয়ে দিল। ঐ যে কচ্ছ না কি একটা জায়গা সেখানেও অনেক ভেতরে রেলটিশন থেকে শও কিলোমিটার বাসের রাস্তা। সেখানে ওস্তাদের এক বহত বড়া দোস্ত বিরাট আমীর আদমী। বহুত জমি জায়দাদ কারখানা উরখানাকে মালিক। ওস্তাদ চিঠি লিখে দিলে তার সেই দোস্ত ভীমকে কোই ভি কারাখানেসে কাম মে লাগিয়ে দেবে। ওর আওরাৎটাও পেয়ে যেতে পারে সিলাই উলাই কা কাম। ওর আওরাৎটা ওই কাম জানে তো? জানে, তব তো ঠিক হ্যায়। ওস্তাদের সেই আমীর দোস্ত ভীম আর তার মেয়েমানুষকে রোজগার জুটিয়ে দেবে, থাকার জায়গাও দেবে। কিন্তু এক বাৎ। প্রথম কয়েকদিনের ভেতরেই ভীমকে ওর আওরাৎটাকে ভেজতে হবে মালিকের কাছে। এটাই ওস্তাদের আমীর দোস্তের নিয়ম। সির্ফ এক রাতের জন্যে, তার বেশি নয়। তবে হ্যাঁ, আওরাৎটা যদি খুবসুরত হয় আর মালিকের যদি তাকে পসন্দ হয়ে যায় তবে এক রাতের পরেও মাঝে মাঝে তার ডাক পড়তে পারে। কিন্তু ওস্তাদের দোস্ত কখনো কারোর জেনালাকে জবরদস্তি পাকাপাকি দখল করে না। মাঝে মাঝে উধার নেয়, তার বেশি কিছু নয়।
একটু থামল ওস্তাদ। তারপর ভীমকে জিজ্ঞেস করল, তোর আওরাৎটা দেখতে কেমন? খাপসুরৎ আছে কি?
ভীমের গলা শুকনো, বুকের ভেতর দুপদুপ আওয়াজ। অষ্টুমীকে এই শর্তের কথাটা বলতে হবে। ভীমকেই বলতে হবে। অষ্টুমী শুনে কী করবে? কী করবে তখন অষ্টুমী? ভাবতে গিয়ে ভীম ঘেমে যায়, হাত পা ঠান্ডা ঠান্ডা লাগে।
কিন্তু এখন ওস্তাদ ওর জবাবের জন্যে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, চুপ করে থাকলে চলবে না। ও ঘাড় নাড়ল, শুকনো গলায় বলল, না, সুন্দর নয়। গায়ের রঙ কালো, চেহারা রোগা, মুখটাও খুব একটা ভাল নয়।
তব তো ঠিক হ্যায়, ওস্তাদ বলল, তু বচ গিয়া। তোর আওরাৎটা একটা রাতেই ছুটকারা পেয়ে যাবে।
ওস্তাদ আবার বলল, তুই তোর আওরাৎটার সঙ্গে বাত করলে। ইয়ে শর্ত উসকা মনজুর হ্যায় কি নেহী সেটা পতা কর লে। তারপর হামাকে বোল। অগর ওহ তৈয়ার হ্যায় তো হামি চিট্ঠি পাঠিয়ে দিব। ওর জাগাহ তো বহত দূর, জবাব আতে আতে কম সে কম দো হফতা। বীচমে তু লোগ তৈয়ার হো যানা, প্যায়সা উয়সা লেকে রাখনা। সমঝা না মেরি বাত?
ভীম বাধ্য ছেলের মতো ঘাড় নাড়ল। ও ওস্তাদের সব কথাই বুঝেছে। ও এখন চিন্তা করছিল ওকে পরপর কি কি করতে হবে। প্রথম কাজ অষ্টুমীর সঙ্গে দেখা করা, ওকে সব কথা খুলে বলা। তারপর টাকাপয়সার জোগাড়, কিন্তু সে পরে। শনিবারের আগে অষ্টুমীর সঙ্গে দেখা হবে না। আসছে শনিবারটা ক’দিন পরে? ভীমের খেয়াল নেই। এতদিন বিছানায় শুয়ে থেকে ওর দিন আর তারিখের সব হিসেব গুলিয়ে গেছে। কাউকে জিজ্ঞেস করতে হবে আজ কি বার। তার পরই হিসেব করা যাবে কটা দিনের পর শনিবার আসবে। বেশি দেরি হয়ে গেলে আবার ওস্তাদের মর্জি বদলে না যায়। তখন মুখ বাঁকিয়ে ভীমকে বলে দিতে পারে, মুঝসে ওহ্ সব নেহী হোনেবালা, তু আপনা রাস্তা ঢুঁঢ় লে। তাহলে আবার এক বিপদ।
ভাবতে ভাবতে আনমনে ওস্তাদের টেবিলের পেছনের দেয়ালের দিকে তাকিয়েছিল ভীম। সে দেয়ালে একটা বড় এক পাতার ক্যালেন্ডার ঝুলছে। ওস্তাদ সকালে ওর টেবিলে বসার আগে রোজ ঐ ক্যালেন্ডারে সে দিনের তারিখটার চারপাশে পেন্সিল দিয়ে একটা বৃত্ত এঁকে দেয়। যে শেষ তারিখটা এভাবে দাগানো সেটাই সেদিনের তারিখ। ক্যালেন্ডারটার ওপর ভীমের চোখ পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে খুশির চোটে ও প্রায় লাফিয়ে উঠল। ও নিজেকে সামলে নিল। ওস্তাদ কাছাকাছিই ঘোরাঘুরি করছে, ঐ লোকটার সামনে লাফ ঝাঁপ করলে বিপদে পড়ার সম্ভাবনা আছে। দয়া — ঠাকরুণ আবার দয়া করেছেন ওর ওপর। আজকের দিনটাই শনিবার, আজকেই ব্যাপারটার একটা ফয়সালা হয়ে যাবে।
বিকেলবেলা ভীম বেশ আগেই রেস্টুরেন্টে পৌঁছে গেল। রেস্টুরেন্টের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকাটা খারাপ দেখাবে। লোকে বারবার ওর দিকে তাকাবে, বিশেষ করে রেস্টুরেন্টের যে ছোকরাগুলো খাবার দেয়, তারা। রেস্টুরেন্টের পাশেই একটা পান সিগারেটের দেয়ালে লাগানো বাঁশ ত্রিপলের ছোট্ট দোকান, ও সেখান থেকে সিগারেট কিনল। ভীমের কাছে সিগারেট ধরানোর জন্যে দেশলাই নেই, ও দোকানির কাছে দেশলাই চাইল। দোকানি বিহারী, ও দোকানের সামনে দাঁড়ানো এক গাঁওয়ালা ভাই এর সঙ্গে খোশগল্প করছিল, ভীমের কথা শুনে একটু বিরক্ত হয়ে ওর দিকে তাকাল, তারপর ভীমের কথার উত্তর না দিয়ে আঙুল দিয়ে দোকানের সামনের ল্যাম্পপোস্টটা দেখিয়ে দিল। সেখানে একটা নারকেল ছোবড়ার দড়ি জড়ানো আছে, তার ডগায় ছোট্ট একটুকরো লাল আগুন। লোকজন সিগারেট কিনে দোকানদারকে যাতে দেশলাই-এর জন্যে বিরক্ত না করে সেজন্যে এই ব্যবস্থা। ভীম সিগারেট খায় না, কিন্তু সিগারেট ধরাতে জানে। ও ওই নারকেল ছোবড়ার দড়ির মুখের আগুনে সিগারেট ধরাল। বিস্বাদ ধোঁয়ায় ওর মুখ ভরে গেল, অনভ্যস্ততার জন্যে একটু যে কাশিও পেল না তা নয়। ও তাড়াতাড়ি মুখ থেকে ধোঁয়াটা বার করে দিল, রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে গিয়ে কাশলে সব লোকজন ওকে উজবুক ভাববে। ও সিগারেটটা হাতের দু আঙুলে ধরে বাসস্টপের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল। এখান থেকে দিব্যি দেখা যাবে অষ্টুমী বাস থেকে নামল কিনা। ও ভেবেছিল সময় কাটাবার জন্যে সিগারেটটায় মাঝে মাঝে টান দেবে, কাশি আসার ভয়ে তা আর করল না। সিগারেটটা নিজের মনে জ্বলে জ্বলে ক্ষয় হতে লাগল।
অষ্টুমী বেশি দেরি করেনি। ভীমের হাতঘড়িতে তখন চারটে বেজে দশ মিনিট, ওদের পাড়া থেকে আসে এরকম একটা বাস এসে স্টপে দাঁড়িয়ে গোঁ গোঁ গরগর আওয়াজ করতে লাগল, কন্ডাক্টারের ঘন্টি শুনলেই ড্রাইভার হুশ করে বাস নিয়ে বেরিয়ে যাবে। সেটার থেকেই টুক করে নেমে পড়ল অষ্টুমী। একটু সাজগোজ করেছে — ভাল করে চুল বেঁধেছে, পরণের শাড়িটাও দেখতে খারাপ নয়, কপালে একটা ছোটো টিপ দিয়েছে — ও যেরকম দেখতে তার চাইতে অনেকটাই ভাল দেখাচ্ছে। ভীম ওকে জিজ্ঞেস করল — এত সাজগোজ করেছ, তোমার সৎমা জিজ্ঞেস করেনি এসব কেন করছ?
ও মাগি কাজে গেছে — একটু হেসে জবাব দিল অষ্টুমী। যখন আমি ফিরব তখনও ও বাইরেই থাকবে।
একটু থেমে অষ্টুমী আবার একটু খোলসা করার মতো করে বলল, আমাদের ঘরের তালার দুটো চাবি। একটা ঐ ডাইনির কাছে থাকে। আর একটা আমার কাছে।
ভীম ওর কথা শুনল, কিন্তু ও ভাবছিল অন্য কথা। অষ্টুমীকে নিয়ে ওর পালানোটা যদি হয়ে ওঠে তাহলে ওর মালিকের কাছে যাবার সময় মেয়েটার এরকম সাজগোজ করা চলবে না। তাহলে হয়তো মালিক ওকে বার বার ডাকতে থাকবে। তাহলে তো বিপদ।
ওরা রেস্টুরেন্টে ঢুকল। এই সময়টা খাওয়ার লোকের ভিড় নেই, অনেকগুলো টেবিল খালি। ভিড়টা হবে আর একটু পরে, সন্ধের সময় থেকে। ওরা বেশ একটু ভেতরে একটা টেবিলে বসল, রাস্তা থেকে ওদের যাতে দেখতে না পাওয়া যায়। ভীম ভেবেছিল অষ্টুমীকে নিয়ে একটা পর্দা ঢাকা কেবিনে বসবে, কিন্তু এই রেস্টুরেন্টটায় সেরকম কোনো কেবিনের ব্যবস্থা নেই। চা আর চপের অর্ডার দিল ভীম। নিরিমিষ চপ — অষ্টুমীই ভীমকে ঐ চপ নিতে বলল। এই সবে একটা জোরদার অসুখে ভুগে উঠল ভীম, ওর এখন মাংসের চপটপ না খাওয়াই ভাল।
চটপট চা আর চপ এসে গেল। দুই-ই গরম। এ সময়টায় এই রেস্টুরেন্টে এসব তৈরিই থাকে। চায়ে ছোটো একটা চুমুক দিল অষ্টুমী। তারপর উৎসুক চোখে ভীমের দিকে তাকাল। অর্থাৎ এবার বল কি খবর।
ভীম বলল। ওস্তাদ যা বলেছে সবই। খালি শর্তটুকু চেপে রাখল। ওর মাথায় আসছে না কি করে এই কথাটা ও অষ্টুমীর কাছে ভাঙবে। ওর গলা মুখ শুকিয়ে গেছে, সেজন্যে ও বার বার চায়ে ছোটো ছোটো চুমুক দিচ্ছে। সময় নেবার জন্যে ও একটু একটু করে চপ ভেঙে খায় আর ভাবে, অষ্টুমী কি রাজী হবে? হবে কি রাজী?
প্লেটের চপ আর কাপের চা দুই-ই যখন ফুরিয়েছে ভীম তখন মরিয়া। এইবার ও কথাটা বলবে, যা থাকে কপালে। ভীমের ভাগ্য আর ঠাকরুণের দয়া। ও কয়েকবার ঠাকরুণকে মনে মনে ডাকল, তারপর অষ্টুমীকে শর্তটা বলে ফেলল।
ভীমের কথা শুনে মুখ নামাল অষ্টুমী। ডান হাতের নখ দিয়ে বাঁ হাতের নখ খুঁটতে লাগল।
ভীমের বুকে হাতুড়ির ঘা পড়তে থাকে। অষ্টুমী মুখ না তোলা পর্যন্ত অনিশ্চয়তা, কিন্তু তবুও তা যতক্ষণ থাকে ততক্ষণই ভাল। সামনে বসা মেয়েমানুষটা মুখ তুলে তাকালেই মামলার রায় বেরিয়ে যাবে — ফাঁসি হবে না বেকসুর খালাস। যদি ও মুখ তুলেই ভীমের গালে সপাটে এক চড় বসিয়ে দেয়? সঙ্গে সঙ্গে লোক জড়ো হয়ে যাবে — রাস্তার লোকও গোলমাল শুনে ভেতরে ঢুকবে। অষ্টুমী তো পাশের চেয়ারে রাখা ওর ব্যাগটা তুলে নিয়ে গটগট করে বেরিয়ে যাবে, ওদিকে ভীড়ের সব লোক ভীমকে ধরে হাটুরে মার লাগাবে। ভীমের কোনো কথাই তারা শুনবে না — আরে মশায়, মেয়েছেলেকে অপমান করেছেন আবার কথা বলছেন — থাপ্পড়, ঘুষি, লাথি — ওঠ শালা ওঠ — গালে মাথায় চপ্পলের চটাচট মার — একটা শক্তপোক্ত হাত ভীমের ঘাড় চেপে ধরল — সেটা পুলিশের হাত তা বোঝাই যায় — ওদের মানুষের ঘাড় টিপে ধরার কায়দাই আলাদা — চল শালা, থানায় চল। সেখানে টাকাপয়সা দিয়ে খালাস পেলেও ঘরে সুলোচনা আছে। ওর কানে খবরটা উঠবেই। কাজেই ভীম ঘরে ফিরলেই সুলোচনা ওর ওপর হাতা খুন্তি এসব ব্যবহার করবে। বেড়াল তাড়ানোর লাঠিটাও কাজে লাগাতে পারে। হে মা চৌধুরিপুকুরের ঠাকরুণ, এই বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দাও মা। মেয়েমানুষটা ওই বিকট শর্তে রাজী হোক বা না হোক, এই যে মেনকার ছেলে ভীম, লখনা পাইকের রক্তের ছিটেফোঁটা যার শরীরে আছে, সে যেন কোনো বিপদে না পড়ে মা। অষ্টুমী বিগড়ে গিয়ে নিজের রাস্তায় চলে গেলেও ভীম যাতে ধীরেসুস্থে চা আর চপের দাম মিটিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে শান্তিতে ঘুমোতে পারে সে ব্যবস্থা করে দাও মা।
অষ্টুমী কতক্ষণ মুখ নিচু করে হাতের নখ খুঁটছিল তা ভীমের খেয়াল নেই। পাঁচ মিনিট হতে পারে আবার কয়েক বছরও হতে পারে। ও যখন মুখ তুলল তখন ভীমের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল, বুকের ভেতর হাতুড়ির ঘা আরও জোরে জোরে পড়তে লাগল। অষ্টুমীর মুখ, অষ্টুমীর মুখ দেখেই বোঝা যাবে ওর কি উত্তর। এইবার ও ভীমের দিকে তাকিয়েছে, এইবার মামলার রায় বেরোবে — ঠাকরুণ গো, এই মামলাটায় জিতিয়ে দাও মা।
অষ্টুমীর চোখ শান্ত, ঠান্ডা। মুখের কোণে একটু হাসির ছিটে। এইটুকু ছোটো একটু সময়ের ভেতর ও অনেক কিছু ভেবে ফেলেছে। পিছিয়ে যাবে? গেলে তো সেই পুরোনো জীবন, খালি দুঃখ আর কষ্ট। অন্যদিকে একটা রাত — সে রাতে সম্পূর্ণ অচেনা একটা লোককে শরীর দিতে হবে, সারা গায়ে নোংরা লাগবে। কিন্তু শরীরে তো কত সময় কত নোংরা লাগে, তার দাগ কি চিরদিন থাকে! সমাজ ছি ছি করবে? ওখানে ওই লোকটাই তো সমাজ, ও-ই তো আইন। নতুন জীবনটার নিশ্চিন্ত আশ্রয়, সুখ, আনন্দ, সে সবের দামটুকু ধরে দিতে হবে ওই একটা রাতে। দামটা কি খুব বেশি?
সেই যে কয়েক মুহূর্তের সময়, যা ওকে ভীমের সঙ্গে পালিয়ে যেতে রাজী করিয়েছিল, সেই সময়টা ফিরে এসে ওকে আবার একটা ধাক্কা দিল। ভীম শুনতে পেল অষ্টুমী বলছে, একটা রাতের ব্যাপার তো। কোনোরকমে চোখ বুজে কাটিয়ে দেয়া যাবে।
একটা বড় নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল ভীমের বুক থেকে। দয়া, ঠাকরুণের দয়া। আর চিন্তা নেই, সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে। আর এক কাপ করে চায়ের ফরমাস দিল ভীম। সেই সঙ্গে আবার একটা করে চপ। উৎকন্ঠায় আগেরটা ভাল করে খাওয়া হয়নি, এবারেরটা শান্তিতে তারিয়ে তারিয়ে খাওয়া যাবে। অষ্টুমী আপত্তি করেছিল। ওর পেট ভরে গেছে, আর খেতে পারবে না। ভীম ওকে বলল, যতটা পার খাও। বাকিটা আমি সেরে দেব। ****
কিন্তু পালাতে হলে টাকা চাই। দুজন লোকের রাহাখরচ আছে, অচেনা জায়গায় যাবে, সেখানেও ভাল খরচাপাতি আছে। ভীম টাকার জোগাড় শুরু করে দিল। দু’হপ্তা কামাই করেও ও সে সময়কার মাইনে পেয়েছে, ও সে টাকা সুলোচনাকে দিল না। সুলোচনা ঘ্যান ঘ্যান করছিল। নতুন মাস পড়ে যাবে, লতিকার টাকা শোধ দিতে হবে। ভীম ওকে ভোগা দিল। বলল, উপায় নেই। কামাই-এর সময়কার মাইনে কাটা গেছে, আরও এক দু হপ্তা কাজ না করলে মাইনে পাওয়া যাবে না।
অবশ্য ওই কটা টাকায় অত দূরে দুজনের পাড়ি দেওয়া চলে না। ভীম টাকা ধার করল ভৈরবের কাছ থেকে। ছুতোটা একই। কাজ কামাই করেছে, মাইনে কাটা গেছে। চারধারে বেশ কয়েকজন পড়শির কাছে ধার হয়ে গেছে, ওদের টাকা ফেরৎ দিতে দেরি করলে চলবে না। ভৈরবের এই কথা অবিশ্বাস করার কোনো কারণ ছিল না। ওর তো এই কারখানার নিয়মকানুন খুব ভালই জানা। কিন্তু এবারে ভীমের টাকার পরিমাণটা একটু বেশি ছিল, সেজন্যে ভৈরব টাকাটা দিতে একটু গাঁইগুঁই করছিল। ভীম নানা অজুহাত দাঁড় করাল। পড়শিদের ধার শোধ তো আছেই তার ওপর আরও অনেক কিছু জুড়ে দিতে লাগল। ওর অসুখের সময় হাতে টাকা ছিল না, ভূধর ডাক্তার ধারে চিকিৎসা করেছে, অবশ্য ডাক্তারটা হাতুড়ে বলেই তা সম্ভব হয়েছিল, কিন্তু বাড়ি এসে চিকিৎসা করেছে, সেই ভিজিটের টাকা এখন চাইছে, তার সঙ্গে আছে ওষুধের দাম, ডাক্তারকে তো চটানো চলে না, তাহলে আর ওদের চিকিৎসা করবে না, হারাটার প্যান্টুল ছিঁড়ে গেছে, উদোম হয়ে ঘুরে বেড়ায়, ওর দুটো প্যান্টুল কেনা এক্ষুনি দরকার, ভৈরবদাই তো আপদেবিপদে ভরসা, এবারে ভীমকে একটু বেশি টাকা ধার না দিলে তো বড় মুস্কিলে পড়বে ভীম।
ভৈরব টাকাটা দিল। কিন্তু টাকার পরিমাণটা বেশি বলে সুদটা আরও অনেক বেশি। ভীম এক কথায় রাজী। মনে মনে বলল, লেখ্ শালা, তোর খাতায় যা ইচ্ছে লিখে রাখ। ভীম তোর কাছে আর আসবে নাকি তোর টাকা শোধ দিতে?
তবে এত নগদ টাকা কোথায় রাখবে তাই নিয়ে ভীম একটু চিন্তায় পড়েছিল। নিজের ঘরে লুকিয়ে রাখারও বিপদ আছে, সুলোচনার চোখে পড়ে যেতে পারে। তাহলে সব কিছু গোলমাল হয়ে যাবে। অষ্টুমীরও নিজের কোনো কিছু রাখার জায়গা নেই, সৎমা বুড়িটার হাতেই সব কিছু। ওরা দুজনে মিলে এই সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাল অনেকক্ষণ ধরে। শেষে অষ্টুমীরই মাথার থেকে বুদ্ধিটা বেরোল। ভীমের ওস্তাদের কাছে এই টাকাগুলো জমা রাখলে কেমন হয়? সে এত সাহায্য করছে আর এইটুকু করবে না?
আবার গিয়ে ওস্তাদের পায়ে ধরল ভীম। ওস্তাদ হা হা করে হাসল। তারপর ভীমকে বলল, সাল্লা চুহা কাঁহিকা, মরদ হয়ে তোর বিয়াহি আওরাৎটাকে ইতনা ডর করিস?
ভীম চুপ করে কাঁচু মাচু মুখ করে ওস্তাদের সামনে দাঁড়িয়ে রইল। একথার তো কোনো জবাব হয় না, ভীম তো সত্যি সত্যিই সুলোচনাকে ডর খায়। তাছাড়া ওস্তাদের কথার মুখে মুখে জবাব দেবে এমন বুকের পাটা ভীমের নেই, বলতে গেলে কারখানার কোনো শ্রমিকেরই নেই।
ওস্তাদ হাত বাড়িয়ে বলল, দে, টাকাটা দে। ভীম একটা বড় শক্ত খামে ভরে টাকাগুলো এনেছিল, ওস্তাদের দিকে এগিয়ে দিল। ওস্তাদ খামটা নিয়ে নিজের টেবিলের ড্রয়ারে রেখে চাবি লাগিয়ে দিল। তারপর ভীমকে বলল, আখুন ভাগ। আপনা কাম কর।
দশ পনেরো দিনের ভেতর ওস্তাদের চিঠির জবাব এসে গেল। ওস্তাদের দোস্ত রাজী হয়ে গেছে। রাস্তা পরিষ্কার, এবার দুজনে মিলে ভেগে গেলেই হয়। ওস্তাদ ভীমকে নিজের দোস্তের চিঠিটা দিল। বলল, এটা সামলেসুমলে নিজের কাছে রাখ। ওখানে গিয়ে এটা আমার দোস্তকে দিখাবি, তাহলে ও তুর কথা ইয়াদ করবে। ও বহুত বড়া আদমী হ্যায়, তোর কথাও মনে রেখে বসে থাকবে না।
কবে পালাবে তা ভীম আর অষ্টুমী দুজনে মিলে ঠিক করে ফেলল। কদিন পরেই নতুন মাস পড়বে, তার প্রথম শবিবারটাতেই ওরা ভাগবে। কাজের বাড়িগুলোর থেকে অষ্টুমী সেদিনই টাকাগুলো নেবে। সেদিন মা জগত্তারিণীর মন্দিরে পুজো দেবে এই অজুহাত কাজের বাড়িগুলোতে দেবে। কাঙালি বিদায়ের মানত করেছে, কাজেই খরচাটা তো ভালই হবে। শনিবারের আগে মাসমাইনে নিলে টাকাটা খরচা হয়ে যেতে পারে। ভীমও ওর কারখানার তলব সেদিনই তুলবে। আর ওস্তাদের থেকে টাকার প্যাকেটটা। সেটা তো নিতেই হবে।
শনিবারে ওরা ওই রেস্টুরেন্টের কাছেই দেখা করল। চারটে নাগাদ, যে সময় ওরা সাধারণত দেখা করে। সোজা গেল ওদের নিজের নিজের কাজের জায়গার থেকে। ভীম কারখানার থেকে ওর মজুরি আর ওস্তাদের থেকে ওর টাকার খাম নিয়েছে কিন্তু ওস্তাদের কাছ থেকে দক্ষ শ্রমিকের কোনো সাট্টিফিকেট পায়নি। ওস্তাদ মানা করে দিয়েছে। বলেছে, হামি তোকে ঐ কাগজ দিলে পেরমাণ হয়ে যাবে যে হামি জানতাম কি তু এই কারখানা ছেড়ে ভাগ্ যাবি। কাগজ উগজ হামার থেকে মিলবে না। তু ভেগে যাচ্ছিস, যা।
ওরা এক কাপড়ে চলে এসেছে, সঙ্গে কোনো জামাকাপড় নেই। সে সব পরে কিনে নিতে হবে। ব্যাগে করে জামাকাপড়গুলো নিলেই লোকজনের চোখে পড়বে। আর তক্ষুনি হাজারটা প্রশ্ন — কোথায় যাচ্ছ? ও-ও, বেড়াতে যাচ্ছ? তাই নাকি? বৌ বাচ্চা যাচ্ছে না? বন্ধুদের সঙ্গে যাচ্ছ — ও আচ্ছা। তখনি তখনি বানিয়ে বানিয়ে এসবের জবাব দিতে হবে। বিরক্তির একশেষ। ওর মনে পড়ে গেল — যেদিন গাঁ থেকে ভোরবেলা বেরিয়ে এসেছিল, তখনও এরকম এক কাপড়েই বেরিয়ে এসেছিল। তখন ভীম পালিয়েছিল একটা মেয়েমানুষের কাছ থেকে, এখনও তাই। তখন ছিল ভূতনি, এবারে সুলোচনা। এখন আবার সঙ্গে পালাচ্ছে একটা মেয়েমানুষ। আবার কি ভীমকে তার থেকে পালাতে হবে? এই প্রশ্নের উত্তর ভীমের জানা নেই। অন্তত এখন তো নেই।
রেস্টুরেন্টের ওখান থেকে বাসে উঠে সোজা হাওড়া স্টেশন। ভীম প্ল্যাস্টিকের বোতলের খাবার জল কিনল, আর কিছু শুকনো খাবার। দু দিন দু রাত ট্রেনে মোটর বাসে কাটবে, এসব সঙ্গে থাকার দরকার। এগুলো বয়ে নিয়ে যাবার জন্যে সঙ্গে কিছু নেই, ভীম স্টেশনেরই একটা ফিরিওয়ালার থেকে একটা কাঁধে ঝোলা ব্যাগ কিনে নিল। দামটা অবশ্য বিলক্ষণ বেশি নিল, কারণ যাদের খুব হঠাৎ করে দরকার পড়ে তারাই এভাবে ফিরিওয়ালাদের থেকে ব্যাগ-ফ্যাগ কিনে নেয়। ওদের দুজনের কারোর কাছেই তো এরকম কিছু ছিল না — ওরকম কিছু সঙ্গে থাকলেই তো লোকজনের চোখে পড়ে যেত।
পশ্চিমের দূরপাল্লার এক্সপ্রেস ট্রেন অনেক রাতে। ওরা হাওড়া স্টেশনে অপেক্ষা করল না, একটা লোকাল ট্রেন ধরে খড়গপুর চলে গেল। সন্ধে পার হয়ে গেলেও ওরা ফিরবে না, তখন খোঁজাখুঁজি শুরু হতে পারে। বিশেষ করে অষ্টুমীর জন্যে তো ওর সৎমা খোঁজ শুরু করতেই পারে। বুড়ি তো হাঁ করে বসে আছে অষ্টুমীর এ মাসের মাইনের টাকাগুলো হাতিয়ে নেবার জন্যে। আর খোঁজ নিতে গেলে লোকের হাওড়া বা শিয়ালদা স্টেশন, দূর পাল্লার বাসের স্ট্যান্ড, এ সব জায়গার কথাই প্রথম মনে পড়ে যায়।
খড়গপুরে নেমেও হাতে অনেক সময়। ওরা খাওয়াদাওয়া করে নিল। ট্রেনে উঠে আবার কখন খাওয়ার সুবিধে হবে কে জানে। ওদের উঠতে হবে সাধারণ কামরায়, ওদের তো রিজার্ভেশন নেই। আর রিজার্ভ করবেই বা কী করে? করলে তো ওদের নাম রেলকোম্পানির কাছে থেকে যেত, খোঁজ নিলেই জানা যেত ওরা কোথায় কোন মুলুকে গিয়েছে। কিন্তু সাধারণ কামরায় প্রচণ্ড ভিড় হবে, ওঠা মুস্কিল হতে পারে। ভীম একটা কুলিকে দুশ টাকা দিল। একজন গোঁফওয়ালা লম্বা চওড়া চেহারার সেপাইজি কাঁধে বন্দুক ঝুলিয়ে প্ল্যাটফরমে পায়চারি করছিল। তাকে দিল পাঁচশ টাকা। এই টাকা দেওয়াটা কাজের কাজ হয়েছিল। গাড়ি এসে প্ল্যাটফরমে দাঁড়াতে সেপাইজি কামরার দরজার সামনে দাঁড়ানো লোকের ভিড় ঠেলে কামরায় ঢুকে ওদের জন্যে রাস্তা করে দিল — ভীম নিজে কখনোই ওই ভিড় ঠেলে গাড়ির কামরাটায় ঢুকতে পারত না। আর সেপাইজির তৈরি করা রাস্তায় কুলিটা ভীম আর অষ্টুমীর হাত ধরে টেনে কামরায় উঠিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে নিল। কিন্তু ওরা বসবে কোথায়? জায়গা কই? প্রতিটি সীট এমনকি ওপরের বাঙ্কে ঠাসাঠাসি করে লোক বসে আছে। কামরার মেঝেটাও লোকে ভর্তি, সব মানুষ সেখানে বসে আছে, এগোতে গেলে তাদের পায়ে মাড়িয়ে যেতে হয়। কামরার মেঝেয় অনেকটা জায়গা জুড়ে একটি দেহাতি কিন্তু পয়সাওয়ালা ঘরের দম্পতি বসে আছে। তাদের সঙ্গে প্রচুর মালপত্র, সেসব মেঝের অনেকটা জায়গা দখল করে আছে। সেই দম্পতির থলথলে চেহারার বিপুলবপু এবং বিপুলউদর সম্পন্ন নারীটি তার শিশুপুত্রটিকে কামরার মেঝেতেই বড় কাজ করিয়েছেন এবং তা পরিষ্কার করার কোনো চেষ্টা না করে সে বস্তুর সঙ্গে উদাসীন শান্তিতে সহাবস্থান করছেন। সেপাইজি মেঝেয় বসা লোকেদের একে-ওকে তাকে বুটের ঠোক্কর এবং বন্দুকের কুঁদোর গুঁতো দিয়ে সরিয়ে একটু এগোতেই ঐ দম্পতিকে, তাদের শিশুপুত্রকে এবং সেই পুত্রের শরীরনির্গত বস্তুকে দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে সে নাক কুঁচকে দাঁড়িয়ে পড়ল এবং তার মুখ দিয়ে একটি সশব্দ স্বগতোক্তি বেরিয়ে এল, রাম রাম, এ সালেলোগ তো সত্যনাশ করকে রাখ্খা হ্যায়। তারপর সে পেছনে ঘুরে তার পেছনদিকে যে সব লোক ছিল তাদেরই তার বন্দুকের কুঁদো দিয়ে সরিয়ে দুজনের কোনোরকমে বসবার মতো একটুখানি জায়গা করল, আর কুলিটা সেইটুকু ফাঁকা জায়গায় ওদের দুজনকে ঠেসেঠুসে চেপেচুপে বসিয়ে দিল। ভীম আর অষ্টুমী তাতেই খুশি। ওরা তো আর কামরার সীটে বসতে পাওয়ার আশা করেনি।
পশ্চিমের গাড়ি খড়গপুর স্টেশনে দশ মিনিট দাঁড়ায়। ঠিক দশ মিনিট পরে গাড়ি ছেড়ে দিল। শক্তিশালী ইলেকট্রিক ইঞ্জিনে গাড়ি টানে, দেখতে দেখতে স্পীড তুলে স্টেশন থেকে বেরিয়ে গেল ট্রেন।
কিছু হৈ চৈ খোঁজাখুঁজি হয়েছিল। সৎমা খুঁজেছিল অষ্টুমীকে। সৎ মেয়ে হলেও টাকা তো রোজগার করে এনে বুড়িকে খাওয়াত। এখন তো বুড়িকেই রোজগার করতে হবে নিজের থাকা খাওয়ার জন্যে। এর ওর তার কাছে গিয়ে বিলাপ, আমার মেয়েটা কোথায় গেল গো, তোমরা কেউ ওকে খুঁজে এনে দাও, পুলিশ দিয়ে ওর খোঁজ করাও, ওর বুড়ি মাটাকে জলে ভাসিয়ে দিয়ে কোথায় হারিয়ে গেল গো—। পড়শীরা সবাই ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দুটো মিষ্টি কথা বলে ওকে ঘরে ফেরৎ পাঠিয়ে দিয়েছিল। আড়ালে সবাই আলোচনা করেছিল, বেশ হয়েছে, সৎ মেয়েটা একটা মরদ পাকড়ে নিয়ে পালিয়ে গেছে। এবার বজ্জাত বুড়িটা বুঝবে ঠ্যালা।
ভীমকে খুঁজেছিল ভৈরব। শুয়োরের বাচ্চা এতগুলো টাকা ধার নিয়ে পালিয়েছে। তার ওপর ওর ভৈরবের কাছে পুরোনো ধারও তো রয়েছে। ভৈরব টাকা ফেরত চেয়েছিল বোনের থেকে। সুলোচনার হাতে কোনো টাকা ছিল না, থাকলেও ও ভৈরবকে একটা টাকাও দিত না। তুমুল ঝগড়া হয়েছিল দুজনে। শেষ পর্যন্ত সুলোচনা দাদাকে নিজের ঘর থেকে বার করে দিয়েছিল। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ঘরে ফিরেছিল ভৈরব। তারপর ভীমের কাছে পাওনা টাকা ফেরত চেয়েছিল মেনকার কাছ থেকে। তেঁতুলগাঁয়ে মেনকার বাড়ি যেতে সাহস হয়নি, খুব রাগ দেখিয়ে চিঠি লিখেছিল। মেনকা তার কোনো জবাব দেয়নি। ভৈরবের সঙ্গে ওর দরকার ফুরিয়ে গিয়েছিল, আর দরকার ফুরোবার পর ভৈরবের অস্তিত্ব স্বীকার করবে মেনকা সেরকম মেয়েমানুষ ছিল না।
সুলোচনা খোঁজাখুজির কোনো চেষ্টা করেনি। ও জানত, তাতে কোনো লাভ নেই। ভীম অনেক ভেবেচিন্তে আটঘাট বেঁধে তবে পালিয়েছে। দু’এক দিন নিজের ঘরে একা বসে অল্পস্বল্প কেঁদেছিল। দুঃখে নয়, রাগে। লোকটা এভাবে পথে বসিয়ে দিয়ে গেল, সেই রাগে।
অবশ্য পাড়ার লোক কিছুদিন খুব ছি ছি করেছিল। ভীমের পাড়া, অষ্টুমীর পাড়া, দু জায়গাতেই উত্তেজিত সব জল্পনা কল্পনা হয়েছিল। ওরা কোথায় গিয়ে থাকতে পারে তা নিয়ে অনেকেই মাথা ঘামিয়েছিল। কেউ বলেছিল দিল্লী, কারোর মতে মুম্বাই। কেউ আবার বলেছিল ওরা কলকাতাতেই কোথাও লুকিয়ে আছে। মেয়েরা মোটামুটি একমত হয়েছিল যে ভীম কিছুদিন পরেই অষ্টুমীকে ফেলে পালাবে। আর তখন অষ্টুমীকে লাইনে নেমে রোজগার করতে হবে। গিন্নিবান্নি দু চারজন বয়স্কা মহিলা এই মতটাকে প্রমাণ করার জন্যে গুটিকয়েক উদাহরণও দিয়েছিল। সে সব নাকি তাদের চোখে দেখা ঘটনা। কয়েকজন অল্পবয়েসী মেয়ে আবার সে সব ঘটনায় বিশ্বাস না করে ঐ বয়স্কা নারীদের কিছু কূট প্রশ্ন করেছিল। তাতে বয়স্কাদের দল উত্তেজিত হয়ে পড়ে আর ঝগড়া শুরু করে দেয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য এ কথা বেরিয়ে পড়েছিল যে সে সব ঘটনা ঠিক তাদের চোখে দেখা নয়, কানে শোনা।
ভীমের পাড়ার পুরুষেরা আবার অনেকেই ভীমকে সাবাসি দিয়েছিল। অবশ্যি মুখে নয়, মনে মনে। মুখে ভীমকে সাবাস বললে ঘরে ঝগড়া-মারপিট হবার সম্ভাবনা। সেই সঙ্গে কিছুটা ঈর্ষাও ছিল। লোকটা একটা জলজ্যান্ত মেয়েমানুষ পটিয়ে তার সঙ্গে পালিয়ে গেল! দেখতে খুব একটা ভাল না হলেও বা কী? মেয়েমানুষ তো। আমি তো পারছি না সেরকম করতে! আমি যা পারলাম না তা ওই শালা ভীম পেরে গেল?
মেয়েরাও সুলোচনার দুর্ভাগ্যে খুব একটা ওর কাছে আহা উহু করতে আসেনি। মাগিটা যা খান্ডার, ওর সঙ্গে একটা পুরুষমানুষ এতদিন ঘর করেছে এই যথেষ্ট। একমাত্র লতিকা ওকে কিছুটা স্বান্ত্বনা দিয়েছিল। কিছুটা, কারণ সুলোচনার সোয়ামি পালাতে ও একেবারে খুশি হয়নি তা নয়। তবে ও ভীমকে পছন্দ করত না, সেজন্যে সুলোচনার গায়ে পিঠে হাত বোলানোর সঙ্গে সঙ্গে ও ভীমের নিন্দাও করত। সুলোচনা চুপ করে থাকত। লতিকার সহানুভূতিটা ওর ভাল লাগত, কিন্তু ভীমের নিন্দাটা নয়। ও নিজে ভীমকে গালাগাল দেবে, ওর সেই হক্ আছে। ও ভীমের বিয়ে করা বৌ, ভীমের বাচ্চা ও পেটে ধরেছে। এই মাগিটার ভীমের নিন্দা করার সেই হক্ আছে কি?
ভৈরব তার টাকার শোক সহজে ভুলতে পারে নি। প্রায়ই ও কারখানার অন্য শ্রমিকদের কাছে গিয়ে নালিশ করত — হারামির বাচ্চা ভোগা দিয়ে এতগুলো টাকা নিয়ে পালিয়েছে। প্রথম দিকে শ্রমিকেরা মুখে সহানুভূতি দেখাত, আর মনে মনে হাসত। বেশ হয়েছে শালা, তোর সুদ খাওয়া টাকা মারা গেছে। তারপর একটা সময় এল যখন ওরা ওকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিতে শুরু করল। তখন ভৈরবের কাঁদুনি থামল।
ভীম আর অষ্টুমী নিখোঁজ হয়েই রইল। আর লোকজনও ওদের সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়ল। ওরা একটা পুরুষ আর একটা মেয়েমানুষ ছিল। তারা ভাব ভালবাসা করে একসঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল। তার চাইতে বেশি কিছু মনে রাখার দরকার কোনো লোকেরই ছিল না।