• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৬ | সেপ্টেম্বর ২০১৯ | উপন্যাস
    Share
  • হারাধন টোটোওয়ালা (৫) : সাবর্ণি চক্রবর্তী


    ।। ৬ ।।

    ভুটভুটিটা ওপারে ছিল। এপারে যখন এল তখন সন্ধে নেমে গিয়েছে। ভুটভুটিতে খুব ভীড়। বেশিরভাগ লোকই বসার জায়গা পায়নি — ঠাসাঠাসি করে কোনরকমে দাঁড়িয়েছে। সুলোচনা আর হারাও বসার জায়গা পায়নি। পাওয়া সম্ভব ছিল না। ভুটভুটি জেটিতে লাগার সঙ্গে সঙ্গে একটা বড় ধাক্কাধাক্কি হয়েছে — যারা নামবে তাদের সঙ্গে যারা উঠবে তাদের। সুলোচনা মেয়েমানুষ, আর হারা এখনও ছোট — ওরা তো ঐ ভীড়ের ভেতর মারামারি ধাক্কাধাক্কি করতে পারে না। ওরা উঠল যখন জেটিতে আর ঠেলাঠেলি নেই। ততক্ষণে বসার সব জায়গা ভরতি, গাদাগাদি করে সব লোক বসে আছে, কেউ কেউ খানিকটা পাশের লোকের কোলে চেপে রয়েছে। ভুটভুটিতে এমনিতেই খুব ভীড় হয়, আর এই খেপটায় তো হবেই। কারণ এটাই আজকের শেষ খেপ। ওপারে গিয়ে নোঙর করবে। ফিরবে আবার কাল কাকভোরে। হারা সামনের দিকে গিয়ে রেলিঙের ওপর ঝুঁকে পড়ে দেখছিল কিভাবে জলের ওপর দিয়ে চলা যানটা নদীর ঢেউ কেটে কেটে এগোচ্ছে। দেখতে কোন অসুবিধে নেই — ভুটভুটির তেকোনা ছুঁচলো মুখটায় একটা জোরালো আলো লাগানো আছে — নদীর জল এখন আলোয় আলো।

    হারা একটা লোকের গলা শুনতে পেল, খোকা, রেলিঙে ঠেস দিয়ে অত ঝুঁকে দাঁড়িয়ো না। জলে পড়ে গেলে এই রাতের বেলায় আর তোলা যাবে না। তাছাড়া এই নদীতে কুম্ভীর আছে। বড় মাপের কুম্ভীর। জলে পড়লেই খপ করে ধরে নেবে — নাচাতে নাচাতে নিয়ে যাবে। কেউ বাঁচাতে পারবে না।

    হারা ঘাড় ফিরিয়ে দেখল। যে লোকটা ভুটভুটি চালাচ্ছে সে ওর সঙ্গে কথা বলছে। লোকটার গায়ের রঙ মিশকালো, মাথায় না আঁচড়ানো বড় বড় ঝাঁকড়া চুল, চোখ দুটো লাল, মুখে খোঁচা খোঁচা গোঁফদাড়ি। লোকটার ঠিক পাশে মোটা কাছি দড়ি তাল পাকিয়ে রাখা ছিল। হারার সঙ্গে চোখাচোখি হতে লোকটা সেই দড়ির তাল হাত দিয়ে হারাকে দেখিয়ে বলল, তুমি এখানে এসে বসো।

    হারার তাতে কোন আপত্তি নেই। সামনে বসে জলের ঢেউ দেখবে আর দেখবে লোকটা কিভাবে ভুটভুটিটা চালায়। হারা সেদিকে এগোল। কয়েক পা মাত্র যেতে হবে, কিন্তু যাওয়াটা সহজ নয়। ঠাসবোঝাই লোকের ভীড়ের কোন ফাঁকফোকর নেই। লোকেদের মাঝখানে মুন্ডু গলিয়ে দিয়ে এগোয়, আর সব লোক ধুৎ, হ্যাৎ, এসব আওয়াজ করে। দু একজন আবার হারাকে ধাক্কা মেরে ঠেলেও দিল — হারার একটু ব্যথা লাগল। শেষ অবধি হারা ভুটভুটির সারেঙের পাশে পৌঁছে গেল, লোকটা ওর হাত ধরে দড়ির তালের ওপর বসিয়ে দিল। বসিয়ে নিয়ে বাঁ হাতে ওর কোমর জড়িয়ে নিল।

    ভুটভুটি খুব একটা জোরে যাচ্ছে না, যদিও আওয়াজ করছে প্রচণ্ড। জোরে হাওয়া সম্ভব নয় — নদীর স্রোতের উল্টোদিকে যাচ্ছে ওরা। তাছাড়া ওরা সোজাসুজি উল্টোদিকের জেটিঘাটের দিকে যাচ্ছে না — তেরচাভাবে জেটিঘাটের থেকে একটু আগে নদীর পাড়ের দিকে তাক করে এগোচ্ছে। এতেই হবে — নদীর স্রোত ওদের ঠেলে ঠিক ঠিক ঘাটে পৌঁছে দেবে। হারার খুব মজা লাগছিল। ঢেউগুলো আসছে উল্টোদিক থেকে — ভুটভুটির ছুঁচলো মুখের ঠিক সামনে পড়ছে — কুমড়ো কাটার মত দুফালি হয়ে কেটে যাচ্ছে। কিন্তু খানিকক্ষণ পরেই একটু অস্বস্তি বোধ করল হারা। সারেঙের হাত, আঙুলগুলো, ওর পেন্টুলের যেখানে ঘোরাফেরা করছে সেখানে তো কারোর হাত লাগানোর কথা নয়। হারা উসখুস করে একটু আধটু ছটফট করতে লাগল। কিন্তু ওঠার উপায় নেই, লোকটা জবরদস্ত শক্ত হাতে ওর কোমর জাবড়ে ধরে রেখেছে।

    কিন্তু একটা সুযোগ এসে গেল। হঠাৎ জোর হাওয়া দিল একটা। ঢেউগুলো বড় বড় হয়ে আসতে লাগল, ভুটভুটি ডাইনে বাঁয়ে একটু দুলতে শুরু করল। লোকটা তাড়াতাড়ি হারার কোমর ছেড়ে দিয়ে দু হাত দিয়ে ধরল ভুটভুটির চাকা — সামনে নদীর দিকে চোখ রেখে সেই চাকায় এদিক ওদিক মোচড় দিতে লাগল। হারা টপ করে উঠে দাঁড়াল, আর তার পরেই পেছনে লোকের ভীড়ের ভেতর ঢুকে গেল। আবার ভীড়ের ভেতর থেকে বিরক্তিকর আওয়াজ উঠল — আরে সেই ছোঁড়াটা আবার বিরক্ত করছে — আরে দুৎ, জ্বালালে একেবারে — কাদের সঙ্গে এসেছে কে জানে, একটা ছাড়া গরুর মত ঘুরছে —

    খানিকটা গিয়ে হারা থেমে পড়ল। ভীড় ঠেলে আর এগোন সম্ভব নয়। এখানে থেকে ও ওর মাকে দেখতে পাচ্ছে — একটা কোণের দিকে একটুখানি জায়গা করে নিয়ে সেখানে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু মায়ের পাশেই একটা লোক — একেবারে মায়ের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা আবার মাকে কি সব বলছে — একেবারে কানের কাছে মুখ নামিয়ে। মা অল্প অল্প হাসছে, লোকটার কথার জবাব দিচ্ছে। হারা অবাক হয়ে গেল। লোকটা কে? মায়ের সঙ্গে ওভাবে কথা বলছে কেন? মা-ই বা ওর কথার জবাব দিচ্ছে কেন?

    ভুটভুটি ঘাটে ভিড়ল। এবার বাস ধরতে হবে। বাসেও ভীড়। কারণ বাসটা আসে অনেক দূর থেকে — রাস্তায় যত লোক পায় ঝেঁটিয়ে তুলে নেয়। যাবে ঐ রেল স্টেশন পর্যন্ত — সেখানে সব লোক উগড়ে দেবে। লোক খালি বাসের পেটের ভেতরেই আছে তা নয়। বাসের পেছনে আড়াআড়ি লাগানো একটা কাঠের চওড়া মজবুত তক্তা — তার ওপর বেশ কিছু লোক বাসের পেছনের খোলা জানালার রড ধরে গাদাগাদি হয়ে দাঁড়ানো। বাসের ছাদেও মালের বস্তা, মালের ঝুড়ি এসব নিয়ে লোকজন ঠাসবোঝাই হয়ে বসে আছে। বাসের ছাদে ওঠানামা করার জন্যে ওটার পেছনে একটা সরু খাড়াই সিঁড়ি লাগানো আছে। কিন্তু কেউই বিশেষ ঐ সিঁড়ি ব্যবহার করে না। প্রথমে বস্তা, ঝুড়ি এসব বাসের ছাদে তুলে দেয় — বাসের ক্লিনার ছোকরাটা, বাসের কন্ডাক্টার ওরা ছাদে উঠে গিয়ে দু হাত বাড়িয়ে সেই মাল তুলে নেয় — তারপর বাসের দরজার সিঁড়িতে এক পা আর দরজার পাশের খোলা জানালায় এক পা দিয়ে হাতের ওপর ভর দিয়ে ছাদে উঠে যায়। ক্লিনারটা কিংবা কন্ডাক্টার লোকটার আর এক হাত ধরে টেনে তুলে নেয়। নামার সময়েও জানালায় পা রেখে লাফিয়ে নেমে পড়া। সব লোকের এই বাসের ছাদে ওঠানামার জন্যে বাসের ভেতর জানালার ধারে বসা লোকেদের হাতে কাঁধে অনেক সময়েই চটিজুতো সমেত পায়ের লাথি লেগে যায়। তবে তাতে কেউই কিছু মনে করে না। বাস থামলেই জানালার থেকে ভেতর দিকে একটু ঝুঁকে বসতে হয়। কেউ যদি তা না করে এক আধটা লাথি খায় তবে সেটা তারই দোষ — যে লোকটা লাথি মারল সে তো জানেই না সে কাকে লাথি মেরেছে।

    সুলোচনা ঐ ভীড়ের মধ্যেও বসার জায়গা পেয়ে গেল। মেয়েদের জন্যে আলাদা করা সীটে। বসে পড়ে একটু সরে, একটু কাৎ হয়ে ইঞ্চি ছয়েক জায়গা বার করে ছেলেকে ডাকল, হারা আয়, এখানে বসবি আয়। সুলোচনার পাশে একটি আধবুড়ি মেয়েছেলে বসেছিল। সেও একবার হারার দিকে তাকিয়ে আরও একটু জায়গা বার করল — পানের রসে লালচে ছোপানো দাঁত দেখিয়ে হারাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। বলল, এস খোকা, ইখানে এসে বস।

    হারা হাত তুলে ওপরের রডের নাগাল পায় না, সেজন্যেও একটা আড়াআড়ি সীটের খাড়াই উঁচু পেছনটা দুহাতে ধরে সেখানে দাঁড়িয়ে গেছে। বাসের ঝাঁকুনিতে পড়ে যাওয়ার ভয় নেই, কারণ মানুষের ভীড় ওকে দুপাশ আর পেছন থেকে ঠেসে এক জায়গায় ধরে রেখেছে। এখান থেকে ওর মায়ের সীটটা, ওর মাকে দেখতে পাচ্ছে হারা। সুলোচনা ওকে ডাক দিয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে, ও মায়ের চোখে চোখে তাকিয়ে ঘাড় নেড়ে না বলে দিল। ওইটুকু তো জায়গা, কি করে বসবে ও? তাছাড়া মেয়েদের সীটে মেয়েদের মাঝখানে বসবে — ওর লজ্জা লাগবে না? শত হলেও ও তো একটা ছেলে। এখনো না হয় ছেলেমানুষ, কিন্তু আর কটা বছর পেরোলেই তো ওর গোঁফ দাড়ি বেরোবে — ও পুরুষমানুষ হয়ে উঠবে। হারা মায়ের ওপর মনে মনে একটু রাগ করে। মা-টা কিছু বোঝে না, পারে খালি ঠাস ঠাস করে গালে চড় বসাতে।

    বাস চলেছে বেশ জোরে। রাস্তা ভাল নয় — মাঝে মাঝেই ছোটখাট গর্ত। গর্ত আসার আগেই অবশ্য বাসের স্পীড কমে যাচ্ছে। তবুও সেগুলোর ওপর দিয়ে যখন বাসের চাকা যাচ্ছে তখন বাস অল্পবিস্তর লাফাচ্ছে, সেই সঙ্গে লাফাচ্ছে বাসে চড়ে থাকা সব লোকজন। লোকের ভীড় হারার চোখের থেকে ড্রাইভারের খুপরিকে আড়াল করে রেখেছে — ওর মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে বাসটা একটা জ্যান্ত জানোয়ার, নিজেই নিজের ইচ্ছেতে এই রাস্তা দিয়ে দৌড়চ্ছে। হারা যে সীটটার পেছনটা ধরে আছে তাতে দুটো লোক বসে আছে, তারপর বাসের খোলা জানালা। হারা জানালা দিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করল। বাইরে অন্ধকার — চাঁদের আলোও নেই — ওই অন্ধকারের ভেতর দিয়ে বাসটা একঘেয়ে ভাবে দৌড়চ্ছে, মাঝে মাঝে রাস্তার পাশে গাছ, ঝোপ — সেগুলো আরও জমাট বাঁধা কালো অন্ধকারের মত দেখাচ্ছে।

    হারা বাসের ভেতরের দিকে মুখ ফেরাল, মায়ের দিকে তাকাল। আরে আরে, মায়ের সামনে দাঁড়ানো ঐ ভুটভুটিতে দেখা লোকটা — মায়ের হাতে কয়েকটা বাসের টিকিট গুঁজে দিচ্ছে। ওদের সঙ্গে এই বাসেই উঠেছে আর ওদের বাসভাড়াটাও দিয়ে দিয়েছে। কেন? কে ওই লোকটা? পরে মাকে জিজ্ঞেস করে হারা সব জেনে নেবে। কিন্তু জিজ্ঞেস করলেই কি আর মা জবাব দেবে? যা দেবে সে তো বেধড়ক মার।

    হারা মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। ও দেখবে মা লোকটার সঙ্গে হাসে কিনা, কথা বলে কিনা। ওকে জানতে হবে মা এখন কি করে। জানবার একটা জোরালো ইচ্ছে এখন ওকে পেয়ে বসেছে, ও মায়ের থেকে চোখ সরাতে পারছে না।

    না:, মা ওই লোকটার সঙ্গে আর কথা বলছে না। মুখ পাশের দিকে ঘুরিয়ে বসে আছে। গম্ভীর মুখে হাসি নেই। হারা খুশি হয়ে উঠল। মা যে লোকটার সঙ্গে আর কথা বলছে না সেটা ওর ভাল লেগেছে। কেন, তা ও জানে না। মনে মনে হারা বলল — ভগবান, মা যেন ঐ লোকটার সঙ্গে আর কথা না বলে।

    আবার জানালা দিয়ে রাস্তা দেখবার চেষ্টা করছিল হারা — একটা হাঁউমাউ চীৎকারে ও চমকে উঠল। চেঁচিয়েছে সুলোচনা — ওর মা। ওরে মারে বলে চেঁচিয়ে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠেছে। কি হল, কি হল, বলে একগাদা লোক ঝুঁকে পড়েছে সুলোচনার দিকে। বাসের কন্ডাক্টার বাসের ভেতর ঘুরে ঘুরে টিকিট বিক্রি করছিল, ও বেচারি মহিলার গলার চীৎকার শুনে তাড়াতাড়ি ভীড় ঠেলে এদিকে আসার চেষ্টা করছে, পেরে উঠছে না। বাসও থেমে গেছে — ড্রাইভার মহিলার চীৎকার শুনে রাস্তার পাশে বাসটাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। নিশ্চয়ই কোন লোক কোন মহিলার গায়ে বদ মতলবে হাত দিয়েছে — নইলে একজন মহিলা খামোকা এরকম চেঁচাবে কেন?

    একটা বড়সড় আরশোলা। কোথায় কোন কোণায় লুকিয়ে ছিল, উড়ে এসে বসে পড়েছিল একেবারে সুলোচনার কোলে। সুলোচনা জবরদস্ত চেহারার মেয়েমানুষ, ইঁদুরকে ভয় পায় না, কিন্তু আরশোলাকে ডরায় একেবারে যমের মত। পতঙ্গটা ওর এই লাফিয়ে ওঠাতে বোধহয় বিরক্ত হয়েই ওর কোলে ছেড়ে ফর্‌র করে উড়ে গেল, সোজা গিয়ে ঠক করে একটা ধাক্কা খেল বাসের ওপরের দিকে লাগানো একটা আলোতে। সেখানে গোঁত্তা খেয়ে সোজা উড়ে এল হারার দিকে।

    হারা খপ করে ওটাকে হাতের মুঠোয় ধরে ফেলল। আরশোলাটা ওর মুঠোর ভেতর ছটফট করছে, পাখা ঝাপটানোর চেষ্টা করছে। মুঠো শক্ত করে হারা ওটাকে থেঁতলে দিল। তারপর বাসের জানালার দিকে ঝুঁকে পড়ে ওটাকে জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে দিল। ততক্ষণে কন্ডাক্টার কাছাকাছি এসে পড়েছে, ও দেখে নিয়েছে আরশোলাটার শেষ পর্যন্ত কি হল। বাসের ভেতরকার চালে দুমদুম করে হাত দিয়ে মেরে ড্রাইভারকে চেঁচিয়ে বলল, যা, যা বেরিয়ে যা। টেনে যা, দেরি হয়ে গেছে। হারার ঠিক সামনে বসা লোকটা হারাকে বলল, ওটাকে একেবারে মেরে ফেললি খোকা?

    হারা মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বলল, মুখে কোন আওয়াজ করল না। পতঙ্গটার শরীর থেকে পিত্ত বেরিয়ে ওর হাতে লেগে আছে, ওর গা এখন ঘিন ঘিন করছে। লোকটা আবার বলল, আহাহা, মারলি কেন? জানালা গলিয়ে বাইরে ছেড়ে দিলেই হত।

    হারা এবারেও কোন জবাব দিল না। মনে মনে লোকটাকে গাল দিল, শালা — আরশোলার ওপর দরদ দেখাচ্ছে। হারা এই বয়েসেই সমবয়সী ছেলেদের থেকে অনেক গালাগাল শিখে গেছে — শালা কথাটা তো নেহাৎ নিরিমিষ গালাগাল। তবে বাড়িতে হারা ওসব কথা কখনও বলে না। মা শুনে ফেললে ধুন্ধুমার পিটাই হবে।

    রেল স্টেশনে পৌঁছে হারা প্রথমেই একটা জলের কলে ওর হাতটা ধুয়ে নিলে। রুমাল টুমাল ওসব তো কিছু নেই, নিজের প্যান্টের গায়েই হাত মুছে নিল। হাতের চটচটে ভাবটা চলে গিয়েছে, এতক্ষণে শান্তি। কিন্তু স্টেশনে পৌঁছতে ওদের দেরী হয়ে গিয়েছিল। ওরা যখন প্ল্যাটফরমে পৌঁছল, তখন ট্রেনটাও ঢুকে পড়েছে। দৌড়ে গিয়ে মায়ে ছেলেতে ট্রেনে উঠল, আর কয়েক সেকেন্ড দেরি হলেই ট্রেনটা বেরিয়ে যেত। পরের ট্রেনটা প্রায় একঘন্টা পরে, সেটা ধরলে বাড়ি যেতে অনেক রাত হয়ে যেত। কিন্তু ট্রেনে উঠেই হারার খেয়াল হল, টিকিট তো কেন হয়নি। টিকিট না কেটে রেলে চড়লে পুলিশে ধরে, অনেক টাকা জরিমানা হয়, জরিমানা না পেলে হাজতে ঢুকিয়ে দেয়। এসব হারা জানে — ইশকুলের ছেলেদের কাছে শুনেছে। একবার নাকি উঁচু কেলাসের কয়েকটা ছেলে বিনা টিকিটে রেলে চড়েছিল। ওরা ধরা পড়ে গিয়েছিল। ওদের কাছে জরিমানার টাকা ছিল না — ওদের হাজতে ভরে দিয়েছিল। সে কাহিনী শোনার পর থেকেই হারার বিনাটিকিটে রেলে চড়ার খুব ভয়। বোকা বোকা মুখ করে ও সুলোচনাকে জিজ্ঞেস করল, মা টিকিট তো কেনা হয়নি? এখন কি হবে?

    আরশোলাটাকে মেরে দেয়ার জন্যে সুলোচনা হারার ওপর বেশ খুশি হয়েছিল। একটু হেসে ছেলের দুগাল টিপে আদর করে দিল। তারপর ওর আঁচলের খুঁট দেখাল, সেখানে দুটো টিকিট বাঁধা রয়েছে।

    হারা চুপ মেরে গেল। মা তো ওর কাছেই ছিল, টিকিট কিনল কখন? নিশ্চয়ই ঐ লোকটা। ঐ লোকটাই ওদের টিকিট কিনে দিয়েছে। কোন এক ফাঁকে মায়ের হাতে টিকিট দুটো ধরিয়ে দিয়েছে, হারা অত লক্ষ করেনি। ও একেবারে মনস্থির করে ফেলল, মাকে জিজ্ঞেস করবে লোকটা কে। মা হয়তো মারবে — তা মারুক, হারা মার খেতে রাজী আছে। কিন্তু হারার জানতেই হবে যে কে ওই লোকটা — মা-ই বা ওকে চিনল কি করে।

    ট্রেনে বেশি ভীড় ছিল না, হারা ওর মায়ের পাশেই বসার জায়গা পেয়ে গেল। রাতের দিকে কলকাতা যাবার গাড়িতে তেমন লোক হয় না। কলকাতা থেকে যেগুলো আসছে সেগুলো একেবারে ভরতি — লোক একেবারে উপচে পড়ছে। হারা সুলোচনাকে ঐ লোকটার কথা জিজ্ঞেস করবে করবে করেও চুপ করে রইল। এখন নয় — রাতে শুয়ে — ওটাই ঠিক সময়। সুলোচনার তখন ঘুম পেয়ে যাবে, ছেলেকে চড় কষাবার ইচ্ছেটা তেমন জোরালো হবে না।

    রেল স্টেশন থেকে বেরিয়ে বাস ধরে ওদের পাড়ায় আসতে অনেক দেরি হয়ে গেল। রাতের দিকে বাস বেশি থাকে না, অনেকক্ষণ পরে পরে এক একটা আসে। ওদের পাড়ার মোড়ে ওরা যখন বাস থেকে নামল তখন রাত দশটা বেজে গেছে। দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে — রাস্তাটা বেশ অন্ধকার। তবে মোড়ের মাথায় বড় ওষুধের দোকানটা খোলা ছিল — ওটা রাতে এগারোটা সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত খোলা থাকে। ওটার ভেতর পেছনের দেয়ালে বেশ উঁচুতে একটা বড় দেয়ালঘড়ি লাগানো আছে, হারা সেটা দেখে নিল। রাত এখন দশটা বেজে কুড়ি মিনিট। বাড়ি যেতে আরও একটু সময় লাগবে, তারপর মা স্টোভে ভাত চড়াবে, ডাল রান্না করবে — খেয়ে উঠতে উঠতে রাত বারোটা। পরের দিন সকালে আবার ইশকুল। যেতে দেরি হলে মাস্টার কেলাসের দরজার বাইরে আধঘন্টা কান ধরে নিলডাউন করে বসিয়ে রাখবে। কেলাসের দরজাটা একেবারে মাস্টারের টেবিলের বরাবর — মাস্টার মাঝে মাঝেই শাস্তি পাওয়া ছেলের দিকে তাকিয়ে দেখে, ছেলেটা কান ধরে না থাকলে নিলডাউন হয়ে থাকার সময়টা বাড়িয়ে দেয়। কাল ইশকুল না গেলে কেমন হয়? বই খাতা নিয়ে সকালে বেরিয়ে গেলে মা ধরতে পারবে না যে হারা ইশকুল যাচ্ছে না। ইশকুলের পুরো সময়টা এদিক ওদিক ঘুরে ঘরে ফিরলেই হবে। পরের দিন অবশ্য মায়ের একটা চিঠি নিয়ে যেতে হবে। তা চিঠিটা হারা নিজেই লিখবে আর মায়ের সইটা বাতাসিকে দিয়ে করিয়ে নেবে। সই করতে গেলে মা খালি ‘সুলোচনা’, এই নামটুকু লিখে দেয়, সেটা বাতাসিকে বলে দিলেই হবে। মা কিছুই জানতে পারবে না। বাতাসিটা আবার মা-কে বলে দেবে না তো? না:, ও সেরকম করবে না। ও গৌরার বোন, লক্ষীমণি মাসির মেয়ে — গৌরা, বাতাসি, ওদের সঙ্গে হারা রোজ বিকেলে খেলা করে — বাতাসি হারাকে বিপদে ফেলবে না।

    ওদের বাড়ি যাওয়ার রাস্তার ওপরেই রয়েছে একটা খাওয়ার হোটেল। দরজার মাথায় লাগানো হলদে রঙের সাইনবোর্ড, সেই হলুদের ওপর গাঢ় লাল দিয়ে বড় বড় অক্ষরে নাম লেখা — অন্নপূর্ণা হোটেল। ঠিক তার নিচে একটু ছোট অক্ষরে লেখা — আমাদের বিরিয়ানি বিখ্যাত। আবার তার নিচে লেখা — আমরা সকল প্রকার অনুষ্ঠানে খাবার সাপ্লাই-এর অর্ডার লইয়া থাকি। রাস্তার অন্যদিকে চার পাঁচটা মোটাসোটা কেঁদো কেঁদো কুকুর মাটিতে থাবা পেতে বসে আছে। ওরা রাতে অন্নপূর্ণা হোটেল বন্ধ হবার আগে রোজ এখানকার ফেলে দেয়া খাবার খেতে পায়। ওরা ঘড়ি দেখতে জানে না, কিন্তু ঠিক কখন ওই হোটেল বন্ধ হবে সেটা জানে। আর ঠিক তার আগে এখানে পৌঁছে যায়। এ ব্যাপারে ওদের নিয়ম একেবারে পাকা, কখনো এদিক ওদিক হয় না। খাবারটা দেয়া হলে সবাই ধীরে সুস্থে তারিয়ে তারিয়ে খায়, নিজেদের ভেতর খ্যাঁক খ্যাঁক করে ঝগড়া মারামারি করে না। কুকুরকুলে ওরা ভাগ্যবান। ওদের কোষ্ঠি করা গেলে নিশ্চয়ই সব রাজযোগ পাওয়া যেত। মানুষ জন্ম পেলে হয়তো এরা সব ছোট বড় নেতা ফেতা হয়ে যেতে পারত।

    হোটেলটার বিক্রী ভাল, এখনও অনেক লোক ভেতরে বসে খাচ্ছে। ওদের বিরিয়ানিটা ভালই বিক্রী হয়। যদিও ওরা যে ঘি দিয়ে বিরিয়ানি বানায় তার সঙ্গে প্রচুর দালদা, চর্বি এসব মেশানো থাকে, তবুও জিনিষটা খেতে ভালই হয়। অবশ্য এছাড়া অন্য খাবার — ভাত, ডাল, ডিম, হাতরুটি এসবও পাওয়া যায়। এই হোটেলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় থমকে দাঁড়িয়ে গেল সুলোচনা। হারা অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়েছিল। ছেলেকে সুলোচনা বলল, আজ আর বাড়িতে গিয়ে রান্না করে কাজ নেই। রাতের খাবারটা এখান থেকে কিনে নিয়ে যাই। কি বলিস?

    হারা কি আর তাতে না বলে? হোটেলের তৈরী খাবার সহজে জোটে না, পেলে কি ও আর ছেড়ে দেবে? সুলোচনার হাতে বেশ কিছু টাকা ছিল, ফিরবার সময় বাস, ট্রেন সে সবের খরচা তো আর লাগেনি। দুপুরের খাওয়াটাও মুফতে হয়েছে — সে খরচটাও বেঁচে গেছে। ও আলুর দম আর রুটি কিনে ফেলল হোটেলের থেকে। হারা নজর করে দেখছিল মা কি কি খাবার কেনে। হোটেলের ভেতর বেশ কয়েকজন খদ্দের বিরিয়ানি খাচ্ছে, চারপাশে তার গন্ধ ভুরভুর করছে। হারার জিভে জল আসছিল। ও মিনমিন করে সুলোচনাকে বলল, মা, একটু বিরিয়ানি কিনে নাও না।

    হারারা দিকে তাকাল সুলোচনা। একটু মায়া হল ছেলের ওপর। আহা, ছেলেটা খেতে চেয়েছে — না পেলে বড্ড নিরাশ হবে। আধা প্লেট বিরিয়ানি কিনে ফেলল সুলোচনা। খাবারটা শুকনো, সেজন্যে একটা কাগজের বাক্সে ভরে দিল হোটেলের লোকেরা। বাক্সটা হারার হাতে দিল সুলোচনা। বলল, নে, ধর্‌ এটা। তারপর একটু ধমকের সুরে বলল, খবর্দার, বাকি সারা মাস আর কিছু খাওয়ার বায়না করবি না। হারা বাধ্য ছেলের মত ঘাড় হেলিয়ে সায় দিল।

    রাতে অন্ধকার ঘরে মায়ের পাশে শুয়ে হারা সুলোচনাকে জিজ্ঞেস করে ফেলল, মা, ঐ লোকটা কে?

    সুলোচনা প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম জড়ানো গলায় বলল, কোন লোকটা?

    সুলোচনার ঘুম এসে গেছে দেখে হারা খুশি হয়ে গেল। এখন মায়ের ঘুম পেয়েছে — মা এখন মারবে না। ও আবার বলল, ঐ যে বাসে রেলে আমাদের টিকিট কিনে দিল।

    একটু চমকে উঠে পুরোপুরি জেগে উঠল সুলোচনা। একবার ভাবল দুই থাপ্পড়ে ছেলের মুখ বন্ধ করে দেয়। কিন্তু তা করল না। ছেলে একদিন বড় হবে। লোকটা কে তখন জানতে পারবেই। এখন মারধর করে চুপ করিয়ে দিলে এই প্রশ্নটা ওর মাথায় থেকেই যাবে, আর বড় হয়ে হয়তো মায়ের ওপর রেগে থাকবে। অন্য পাশ ফিরল সুলোচনা। দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে বলল, ও আমার চেনা লোক। অনেকদিন আগেকার চেনা।

    তারপরেই ছেলেকে একটা ধমক দিল, এত রাত হয়েছে এখনো ঘুমোচ্ছিস না কেন? কাল ইশকুলে যেতে দেরি হয়ে যাবে না?

    হারা চুপ করে গেল। কিন্তু একটা ছোট সন্দেহ ওকে খোঁচা দিতে লাগল — মা কি ওকে সত্যি কথা বলল? সত্যিই কি লোকটা মায়ের পুরনো চেনা? চোখ বন্ধ করে শুয়ে ভাবতে লাগল হারা। ভাবতে ভাবতেই এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল।

    হারার সন্দেহটা ঠিক — সুলোচনা ওকে সত্যি কথা বলেনি। লোকটার সঙ্গে সুলোচনার আগে কোন চেনাই ছিল না। লোকটার নাম বিশু সাঁপুই, সুলোচনার বর ভীমের গাঁয়ের লোক, মোটামুটি ভীমেরই বয়েসী। ও যে ভীমের খুব একটা বন্ধু ছিল তা নয়, তবে জানাশোনা ভালই ছিল। ভীম যখন বৌ ছেলেদের নিয়ে মায়ের কাছে এসেছিল, তখন ও দেখেছিল সুলোচনাকে। মেয়েমানুষের ভেতর সুলোচনার লম্বা চওড়া চেহারা, ওকে একবার দেখলে মানুষের মনে থাকা স্বাভাবিক। আজ ভুটভুটিতে দেখতে পেয়ে ও সুলোচনাকে চেনা দিয়েছে, তারপর এটা সেটা কথা, গল্প। ভীম যে অন্য একটা মেয়েমানুষকে নিয়ে বেপাত্তা হয়েছে, তারপর মেনকার সঙ্গে সুলোচনার তুড়ে ঝগড়া হয়েছে সে খবর ও জানে। গাঁয়ের সব লোকই জানে। গাঁয়ের একজন কেউ অন্য আর একজনের কেচ্ছা জানতে পারলেই বাকিরাও সব জেনে যায়। আর এই জানার ব্যাপারটা বেশ ফুলিয়ে ফাঁপিয়েই হয়। বিশু একথায় ওকথায়, হাবে ভাবে, সুলোচনাকে বুঝিয়ে দিয়েছে ও সুলোচনার সঙ্গে রাস্তার এই দেখা হওয়াটা আরও টানতে চায় — যতদূর টানা যায়। ওর মনের ভাব বুঝতে সুলোচনার দেরি হয়নি। পুরুষ মানুষের আজেবাজে অবান্তর কথার ফাঁকে ফাঁকে দু একটা মনের কথার থেকেই মেয়েরা বুঝতে পারে। আরও বোঝে পুরুষমানুষের চোখের চাউনির থেকে। সুলোচনা বিশুকে হতাশ করেনি। কখনো মুখ টিপে হেসেছে, বিশুর দিকে মাঝে মাঝে দু একটা যাকে বলে কটাক্ষ তাই ছুঁড়ে দিয়েছে, হাসিমুখে কয়েকটা প্রশ্রয় দেওয়া কথা বলেছে। বিশু ওর ঠিকানা চেয়েছে, তা দিয়েছে। সেই সঙ্গে কি করে কি ভাবে সুলোচনার ঘরে আসতে হবে তার নির্দেশ দিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ বিশুকে লাইটা মোটামুটি ভালই দিয়েছে। আর দেবে না-ই বা কেন? আক ক’বছর হয়ে গেল সেই হারামজাদা ওর মরদটা আর একটা মেয়েছেলে নিয়ে বেপাত্তা হয়েছে, সেই থেকে আর কি কোন শরীরের সুখ পেয়েছে সুলোচনা? ওরও তো মাঝে মাঝে ইচ্ছে জাগে একটা পুরুষমানুষের সঙ্গে শুতে? আর সুলোচনার তো এখনও এত কিছু একটা বয়েস হয়ে যায়নি — রাস্তায় বেরোলে এখনও তো পুরুষমানুষে ওর দিকে লোভের চোখে তাকায়। এই তো ওর একটা কাজের বাড়ির কর্তাটা — একটা বুড়ো — ওর কাছাকাছি ছোঁক ছোঁক করে, গায়ে হাত লাগাবার চেষ্টা করে। সুলোচনা অবশ্য বুড়োটাকে একেবারে পাত্তা দেয় না, দূরে দূরে সরে যায়। গিন্নীমার চোখে পড়ে গেলে নিজের কর্তাকে তো কিছু বলবে না, সুলোচনাকেই কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেবে। আর কাজ গেলে নতুন কাজ পাওয়া শক্ত হবে। একেই তো সুলোচনার বদনাম আছে, তার ওপর আজকাল প্রচুর অল্পবয়েসী মেয়ে ওসব বাড়িগুলোতে কাজ করে — তাদের ভেতর কেউ একজন টক করে সুলোচনার খালি হওয়া কাজটা ধরে নেবে, গিন্নীমার কোনই অসুবিধে হবে না।

    তবে বিশুকে লাই দিলে একটা সুবিধে আছে। ওকে নিংড়ে টাকা পয়সা পাওয়া যাতে পারে। এই যেমন বাসভাড়া, ট্রেনভাড়া দিয়ে দিল সেরকম সুলোচনার ঘরভাড়াটা দিয়ে দিতে পারে, মাথায় একটু হাত বোলালে হয়তো মাসের সেই খর্চাটাও বার করে নেয়া যেতে পারে। গাঁয়ে অবশ্য বিশুর বৌ ছেলে মেয়ে আছে — কথায় কথায় সুলোচনা ওর থেকে ওইটুকু আলাপেই জেনে নিয়েছে। কিন্তু তাতে কোন ক্ষতি নেই। ও নিজেও তো বিয়ে হওয়া মেয়েমানুষ, ও তো আর বিশুর সঙ্গে বিয়ে বসতে পারবে না। চারপাশের সব লোকই তো জানে যে ও ভীমের বিয়ে হওয়া ইস্তিরি। এমন তো নয় যে ভীম পাঁচজনকে সাক্ষী রেখে ওকে ছুটকারা দিয়েছে, বা পাকা খবর এসেছে যে ভীম মরে গেছে। তা হলেও নাহয় বিয়েসাদির কথাটা চিন্তা করা যেত। যাক্‌ সে সব অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা হবে — এখন দেখা যাক বিশুর সঙ্গে ব্যাপারটা কদ্দূর এগোয়। বিশুর সঙ্গে এসব সম্পর্কের কথা ভাবতে সুলোচনা কোন পাপ দেখতে পায় না। ভীম বেপাত্তা হয়ে যাবার পর এ পর্যন্ত কোন পুরুষমানুষ ওর দিকে ভালবেসে নজর দেয়নি — বিশু এই দিল। তবে ওরই বা বিশুর সঙ্গে একটু মাখামাখি করলে দোষ কি?

    আবার পাশ ফিরে ছেলের মুখের দিকে তাকাল সুলোচনা। ঘরের জানালাটা খোলা, সেখান দিয়ে দূরে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোটা খুব ঝাপসা হয়ে ওর মুখের ওপর পড়েছে। ছেলে ঘুমিয়ে পড়েছে। স্বাভাবিক, সারাদিন ধরে যা হটরানিটা গেছে। গভীর ঘুম ঘুমোচ্ছে ছেলে — ঠোঁট দুটো অল্প খোলা, ভারি শান্ত আর মিষ্টি দেখাচ্ছে মুখখানা। সুলোচনা হাতের ওপর ভর করে একটু উঠে নিজের মুখ ছেলের মুখের কাছে এগিয়ে নিয়ে এল, তারপর গালে ঠোঁট লাগিয়ে ছেলেকে চুমু খেল। সাবধানে, ছেলের ঘুম ভেঙ্গে না যায়। তারপর নিজে ঘুমিয়ে পড়ল।

    স্কুল থেকে ফিরে রুটি আর শুকনো আলুচচ্চড়ি খেয়ে উঠতে উঠতে হারার শেষ দুপুর হয়ে যায়। আর তার পরে পরেই ও খেলতে বেরিয়ে যায়। তখনও অবশ্য রোদ ভালরকম কড়া থাকে, তবে তাতে ওর আর ওর বন্ধুদের কিছু যায় আসে না। গুলিডাণ্ডা খেলাটা ওদের খুব পছন্দের — দিনের আলো পড়ে এলে এই খেলার সুবিধে হয় না। পরের দিন খাওয়া শেষ করেই হারা খেলতে ছুট দিল। খেলার মাঠে গিয়ে দেখল বাকি সবাই এসে গিয়েছে — গৌরা, জগন্নাথ আর লালন। মেয়েরাও এসেছে — বাতাসি আর ওর বন্ধু বেবি। জগন্নাথের চালু নাম জগা — ও থাকে একটু দূরের একটা ঘিঞ্জি গলির ভেতর খুব পুরনো একটা বাড়ির পায়রার খোপের মত ছোট একটা ঘরে। ওরা পাঁচ ভাই, বাপ মা — সব ঐ একটা ঘরে। ওরা ভাইয়েরা ইশকুলে কয়েক কেলাস পর্যন্ত গিয়ে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে — রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, খালি খাওয়া আর ঘুমের সময়টুকু ছাড়া। ওর বাপ মোটর মিস্তিরির কাজ করে। রাতে মদ খেয়ে বাড়ি ফেরে — যে ছেলেটাকে সামনে পায় তাকেই খানিকটা পিটিয়ে দেয়। ওদের মধ্যে জগাই সবচেয়ে বড়, ও এখন একটু বড় হয়ে গেছে বলে ওকে আর মারে না। খালি ওকে বাপ মা তুলে গালাগাল দেয় ও এখনও কোন টাকা রোজগার করে না বলে। লালন হিন্দুস্থানি ছেলে। ও আর একটু দূরে একটা বস্তিতে থাকে — সেখানে প্রায় সব বাসিন্দাই হিন্দুস্থানি। ও-ও স্কুলে যায় না। ওর বাপ বাসস্ট্যান্ডের কাছে রাস্তার একপাশে ত্রিপল টাঙিয়ে একটা খাবারের দোকান চালায়। নিজে পুরি ভাজে, বৌ পাশের উনুনে সব্জী বানায়। ওরা নিজেরা নিরিমিষ খায়, কিন্তু খদ্দেরদের জন্যে ডিমের মামলেট ভেজে দেয়। বেশির ভাগ দিনই লালন ঐ দোকানে বাপ মাকে সাহায্য করে — খদ্দেরদের হাতে খাবারের প্লেট ধরিয়ে দেয়, তাদের খাওয়া হয়ে গেলে ঐ এঁটো থালা একটা বড় গামলার জলে ডুবিয়ে চট করে ধুয়ে দেয়। ও গৌরা হারার সঙ্গে খেলতে আসার খুব একটা সময় পায় না, মাঝে মাঝে আসে। এখন দুপুরে খাওয়ার সময়টা পার হয়ে গেছে, খদ্দেরের ভীড় একটু পাতলা, তাই ও এখানে এসেছে। ওর বাপের রোজগারপাতি ভাল — নিজেরা এখানে ছাতু খেয়ে থাকে, কিন্তু দেশে জমি টমি কিনে ছোটখাট জোতদার বনে গেছে।

    কিন্তু হারার একটু দেরি হয়ে গিয়েছে — ওরা খেলা শুরু করে দিয়েছে, হারা অপেক্ষা করে রইল, কতক্ষণে ওদের প্রথম দানটা শেষ হয়। ততক্ষণ ওদের খেলা দেখা ছাড়া আর কিছু করার নেই। বেবি আর বাতাসি এক্কা দোক্কা খেলছে — চকখড়ি দিয়ে সুন্দর করে ঘর কেটেছে, এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে খেলছে। গৌরা ডান্ডাগুলিটা ভাল খেলে — ওর একটা মারে গুলিটা অনেকটা দূরে ঢলে গেল, সেখানে বেবি আর বাতাসি খেলছিল। গুলিটা ওদের কারোরই গায়ে লাগেনি, তবুও বেবি গুলিটা পায়ে চেপে ধরল, তারপর চেঁচিয়ে ছেলেদের সঙ্গে ঝগড়া করতে লাগল। গুলি আর ডাণ্ডা, দুটোই যেহেতু গৌরার সেজন্যে ওর ওপরেই বেশি করে চেঁচাতে লাগল। বাতাসিও চেঁচিয়ে গৌরাকে গাল দিল — দাদা বলে কোন রেয়াৎ করার ব্যাপার নেই। যদিও বাতাসি রোগা পটকা, বেবির চেয়েও ওর গলাই বেশি শোনা যাচ্ছিল। তবে ঝগড়াটা একতরফা, ছেলেরা সবাই চুপ করে ছিল। জবাব দিলে মেয়েদুটো আরও চেঁচাবে, বেবি হয় তো গুলিটা আর ফেরৎই দেবে না — খেলাটা ভন্ডুল হয়ে যাবে। মেরে ধরে তো আর গুলিটা আদায় করা যাবে না। মেয়েদের গায়ে হাত দিলে বাড়িতে জবরদস্ত পিটাই হবে, সেটা ওরা জানে।

    একতরফা ঝগড়া খুব বেশিক্ষণ চলে না। একটু পরে মেয়েদুটো থেমে গেল। বেবি গুলিটা ছুঁড়ে দিল ওদের দিকে, খপ করে সেটা লুফে নিল গৌরা। তারপর কিছুই হয়নি এরকম একটা ভাব করে সেটাকে জুৎমত মাটিতে রাখল — ওটার কোণে টেনে একটা ঘা বসাবার জন্যে।

    প্রথম দানটা শেষ হল। কিন্তু তাতেও ওরা হারাকে খেলায় নিতে রাজি নয়। ওদের বাজিটা শুরু হয়েছে আগের দিন, এখনও চলছে। গৌরা হারাকে জিজ্ঞেস করল, কাল আসিস নি কেন?

    খেলতে যেতে কামাই করলে কৈফিয়ৎ দিতে হবে, ইশকুল কামাই করলে যেরকম দিতে হয়। সব কথা বলতে গেলে বিরাট গল্প হয়ে যায় — অত কথা কেউ শুনবে না। হারা ছোট্ট করে সব কিছু বলল। ঠাক্‌মা মারা গেছে বেশ কমাস আগে — হারা আর তার মা এখানে সে খবর সে সময়ে পায়নি। খবরটা শুনেছে এই গত পরশু, শুনেই ওরা ছুটেছিল সেখানে। ঠাক্‌মার অনেক সম্পত্তি ছিল। সব বেহাত হয়ে গিয়েছে — ওখানকার পাজি লোকেরা সব দখল করে নিয়েছে।

    তারপর একটু ডাঁট দেখিয়ে বলল, জানিস, কাল রাতে আমরা বিরিয়ানি খেয়েছি। অন্নপূর্ণা হোটেলের বিরিয়ানি।

    হারার বিরিয়ানি খাওয়ার গল্প গৌরা কানেই নিল না। ওর মা লক্ষ্মীমণির রোজগার ভাল, সে প্রায়ই কিছু না কিছু ভাল খাবার বানিয়ে ছেলে আর মেয়েকে খাওয়ায়। আর লালন তো নিরামিষ খায় — কোন বংগালি ছেলে কবে পচা মাংস দিয়ে রান্না বিরিয়ানি খেল তা নিয়ে ওর কোন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু জগার ব্যাপারটা সেরকম নয়। ওদের ঘরে ডালভাত বা ডালরুটি, এছাড়া বিশেষ কিছু হয় না। হারা বিরিয়ানি খেয়েছে শুনলে ওর একটু হিংসে হওয়া স্বাভাবিক। তার ওপর হারা কথাটা ডাঁট দেখিয়ে বলেছে। ও দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল, এ:, শালা ঠাকমার সম্পত্তি দেখাচ্ছে। গ্যাস দেবার আর জায়গা পাসনি শুয়ার। তোর বাপ তো করত মজদুরি। মায়ের সম্পত্তি থাকলে তা ছেড়ে কেউ কলকাতায় মজুর খাটতে আসে? ওসব চাল অন্য জায়গায় মারবি, এখানে নয়।

    হারার বুকের ভেতর থেকে একটা রাগ উঠে আসছিল। ও একেবারে সত্যি কথা বলেছে, একবর্ণ বাড়িয়ে বলেনি, তাতেও জগা ওকে যা তা বলছে। ওর দু হাত মুঠো হয়ে গেল, শরীরও শক্ত হয়ে গেল। ও একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল জগার দিকে।

    জগা দেখল ওর কথা শুনে হারার রাগ হয়েছে। ও খুশি হয়ে গেল। হারা রেগেছে মানে ও বেশ একটু খোঁচা খেয়েছে। হারাকে আরও একটু খোঁচা দেবার জন্যে ও আবার বলল, শালা আবার বিরিয়ানি দেখাচ্ছে। এঁটো বাসন সাফ করে তোর মা কটা পয়সা পায় রে? তোরা বিরিয়ানি কিনে খেয়েছিস? সব গ্যাস।

    হারার মা এঁটো বাসন সাফ করে টাকা রোজগার করে একথা ঠিক, কিন্তু তাতে জগা শালার বাপের কি? ওর মোদো মাতাল বাপটার কি? হারা মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে বুনো মোষের মত ছুটে গেল জগার দিকে।

    জগা হারার চেয়ে বয়েসে বড়, গায়ে জোরও বেশি। কিন্তু ও ভাবতে পারেনি হারা এভাবে ছুটে আসবে ওর দিকে। প্রথম ধাক্কাতে ও বেশ একটু মার খেয়ে গেল। কিন্তু সেটা অল্প সময়ের জন্যে। তারপরেই ও সামলে নিল হারাকে। কয়েক সেকেন্ডের ভেতর মাটিতে পড়ে গেল হারা। আর জগা চড়ে বসল ওর বুকের ওপর। এবার বেধড়ক পিটবে ওকে।

    কিন্তু সেটা হতে পেল না। গৌরা, বাতাসি, বেবি, ওরা সবাই হারাদের খুব কাছাকাছিই থাকে — বলতে গেলে ওদের ঘরগুলো প্রায় পাশাপাশি। আর জগা থাকে দূরে। জগা ওদের খেলার সাথী হলেও ওদের পড়োশি একটা ছেলেকে পেটাবে, সেটা ওরা বরদাস্ত করবে না। প্রথমে ছুটে এল বাতাসি আর বেবি। জগার চুল ধরে টেনে, গালে খিমচে, পিঠে দুমদাম মেরে ওকে একেবারে বিধ্বস্ত করে দিল। গৌরা প্রথমে জগা আর হারাকে ছাড়াতে আসেনি। ও চাইছিল হারা একটু মার খাক। ওর মা হারাকে খুব ভালবাসে, সেটা ওর একেবারেই পছন্দ নয়। কিন্তু বাতাসি আর বেবি জগাকে পিটছে, এ অবস্থায় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলে মেয়েদুটো পরে ওকে কষে গালাগাল দেবে। কাজেই ও-ও এগিয়ে এল — হাত ধরে টেনে জগাকে তুলে ফেলল হারার ওপর থেকে। জগা আর সেখানে দাঁড়াল না — গতিক সুবিধের নয় দেখে টেনে ছুট দিল নিজের বাড়ির দিকে। লালনও আর সেখানে নেই। ও বুদ্ধিমান ছেলে — হারা আর জগার মারপিট শুরু হতে দেখেই ও হাওয়া হয়ে গেছে সেখান থেকে।

    বাতাসি আর বেবি দুদিক থেকে হারাকে মাটি থেকে তুলতে গেল। হাত নেড়ে ওদের বারণ করল হারা। শত হলেও ও একটা ছেলে — মার খেয়ে ভূঁইয়ে পড়ে গেলেও উঠে দাঁড়াবার জন্যে মেয়েদের সাহায্য নেবে না। শালা গৌরা ওকে তুলে ধরবার জন্যে এগিয়ে আসেনি — একধারে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে। ও নিজেই উঠবে, এত কিছু চোট পায়নি ও। মাটিতে হাতের ভর দিয়ে উঠে পড়ল হারা। কিন্তু উঠেই বুঝল মুখের জায়গায় জায়গায় বেশ ব্যথা হয়েছে, বোধহয় জগার হাতের ঘুষি সে সব জায়গায় লেগেছে। বেবিও বলল, তোর মুখটা বেশ ফুলে গেছে রে হারা। বরফ দে, মুখে বরফ লাগা।

    বেবি তো জ্ঞান দিয়েই খালাস, হারা এখন বরফ পাবে কোথায়? ওর নিজেদের ঘর তো এখন বন্ধ। তালা লাগিয়ে ওর মা কাজে বেরিয়ে গেছে — ফিরবে সেই সন্ধেবেলায়, হারা যখন খেলা শেষ করে বাড়ি ফেরে তখন। তাছাড়া বাড়ি যেতে পারলেও লাভ বিশেষ কিছু হত না, ওদের ঘরে বরফ কোথায়? বাতাসিদের বাড়িতে একটা ঠাণ্ডা মেশিন আছে — কিছুদিন আগে লক্ষ্মীমণি ওটা মাসিক কিস্তিতে কিনেছে। বাতাসি বলল, হারা, আমাদের বাড়ি চল্‌। আমাদের বাড়িতে মেশিনে বরফ আছে। মা তোকে লাগিয়ে দেবে।

    বোনের কথাটা গৌরার পছন্দ হয়নি। ও একটু বাঁকা চোখে বোনের দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না। বাতাসি আর বেবি দু জন হারাকে দুই বাহু ধরে নিয়ে চলল। হারা আপত্তি করল না। সারা মুখটা জোর ব্যথা করছে, ব্যথাটা ক্রমেই বাড়ছে। মাথাটাও সেজন্যে খুব ঘুরছে, পা ফেলতে গেলে মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। গৌরাও ওদের পেছনে পেছনে বড়ি গেল, একা একা তো আর খেলা যায় না। খেলাটা তো হারাই ভেঙে দিল, মারপিটটা তো ও-ই লাগিয়েছিল। এখন আবার ওদেরই বাড়ি যাচ্ছে বরফ লাগাতে — শালা এক নম্বরের হারামি।

    লক্ষ্মীমণি বাড়িতেই ছিল। ও বিকেলে রান্না করতে বেরোয় আর একটু পরে, এই সন্ধের মুখটায়। ও খুব যত্ন করে হারার মুখ ধুইয়ে দিল, তারপর ঠাণ্ডা মেশিন থেকে ছোট ছোট বরফের টুকরো বার করে হারার মুখের ফোলা ফোলা জায়গাগুলোতে খুব মোলায়েম করে ঘষে ঘষে দিতে লাগল। প্রথমে হারার বেশ ব্যথা লাগছিল, কিন্তু ও দাঁতে দাঁত টিপে ব্যথা সহ্য করছিল। বেবি আর বাতাসি এখানে রয়েছে, ওরা জুলজুল করে দেখছে লক্ষ্মীমণি কি কি করছে, ওদের সামনে হারা কিছুতেই ব্যথার উ: আ: আওয়াজ করবে না। কিন্তু একটু পরেই সারা মুখে একটা ঠাণ্ডা ভাব ছড়িয়ে পড়ল, ব্যথাটা আর টের পেল না হারা।

    হারার চোট যে খালি মুখেই লেগেছিল তা নয়। ওর মুখে, হাতে কয়েক জায়গায় নখের আঁচড় লেগেছে, পায়ের কাছে খানিকটা জায়গায় চামড়া উঠে ছড়ে গিয়েছে। ওগুলোও ওষুধ লাগিয়ে ঢেকে রাখার দরকার। লক্ষ্মীমণি উঠে গিয়ে ভেতরের ঘর থেকে টাকা নিয়ে এল। গৌরার দিকে একটা একশো টাকার নোট বাড়িয়ে ধরে বলল, যা, ওই মোড়ের ওষুধের দোকান থেকে ওই যে খুব ছোট ছোট আঠা লাগানো ব্যান্ডেজ আছে, যা গায়ের সঙ্গে চিপকে যায় তা নিয়ে আয়। একটু বেশি করে আনিস।

    হারাকে যে এত খাতির যত্ন করা হচ্ছে গৌরার তা একেবারেই পছন্দ হচ্ছিল না। ও মনে মনে মা আর বোনের ওপর রাগ করছিল। ঐ হারামজাদি বেবিটাও ওদের সঙ্গে জুটেছে, হারাকে সেবা করছে। ও জোরে মাথা নেড়ে বলল, আমি এখন ওখানে যেতে পারব না। আর বলেই দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। মায়ের কথার অবাধ্য হয়ে মায়ের সামনে থাকা বিপজ্জনক। মা মারবে না, মারধোর করা মায়ের অভ্যেস নেই, কিন্তু কান পাকড়ে ধরে মুলে দিতে পারে। বেবির সামনে সেটা একটা বেইজ্জতির ব্যাপার হবে — তা গৌরা কিছুতেই হতে দিতে পারে না।

    ছেলে যে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল লক্ষ্মীমণি একবার রাগের চোখে সেদিকে তাকাল, তারপর মুখ ঘুরিয়ে বেবি আর বাতাসির দিকে তাকিয়ে বলল, দেখলি — কি শয়তান ছেলে। ওকে যাতে আর বলতে না পারি সেজন্যে একেবারে বাড়ি থেকেই বেরিয়ে গেল। এখন আমি ঐ ব্যান্ডেজ পাই কোথায়?

    বেবি চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, মাসিমা, ভাববেন না। আমাকে টাকা দিন আমি নিয়ে আসছি।

    ও টাকাটা লক্ষ্মীমণির হাত থেকে একরকম কেড়েই নিল। তারপর বাতাসিকে বলল, তুই চল আমার সঙ্গে।

    বেবি চটপটে, কাজের মেয়ে। ও যে খালি স্টিকিং প্লাস্টারই কিনে এনেছে তা নয় — সেই সঙ্গে বুদ্ধি করে ওষুধের দোকানে জিজ্ঞেস করে একটা কাটা ঘায়ে লাগানোর মলমও নিয়ে এসেছে। ক্যাশ মেমোও এনেছে, পাই পয়সা হিসেব করে ফেরৎ টাকা পয়সা সব লক্ষ্মীমণির হাতে তুলে দিয়েছে। বেবির ওপর ভারি খুশি হয়ে গেল লক্ষ্মীমণি। গৌরা ওর জায়গায় হলে মলমটা কখনই আনত না। ক্যাশ মেমোও আনত না — কারণ তা হলেই তো ফেরৎ টাকার হিসেব দিতে হয়। কয়েকটা টাকা গৌরা নিজে মেরে দিতই। এই বয়েসেই একটু আধটু বিড়ি সিগারেট খাওয়া শিখেছে ছেলে। বেবিকে জড়িয়ে ধরে ওর দুই গালে চুমু খেয়ে দিল লক্ষ্মীমণি, যদিও বেবি একটু লজ্জা পেল তার জন্যে।

    তারপর আবার হারার সেবা। তুলোতে ডেটল লাগিয়ে লক্ষ্মীমণি ওর কাটা জায়গাগুলো পরিষ্কার করে দিল। সে সব জায়গায় হারার বিলক্ষণ জ্বালা করে উঠল, দাঁত মুখ খিঁচিয়ে সেই জ্বলুনি সয়ে গেল হারা। তারপর লক্ষ্মীমণি ওসব জায়গায় বেবির নিয়ে আসা মলম লাগাল, সবশেষে স্টিকিং প্লাস্টার। এতক্ষণে একটু আরাম বোধ করল হারা।

    লক্ষ্মীমণির স্বভাবে স্নেহটা একটু বেশি। ও হারার কাটা ঘায়ে ওষুধ লাগিয়েই ওকে ছেড়ে দেবে তা কখনই সম্ভব নয়। তাছাড়া বেবি মেয়েটাও এসেছে ওর বাড়িতে — ওকেও ঠিক মত আদরযত্ন না করে লক্ষ্মীমণি ওকে নিজের বাড়ি থেকে যেতে দিতে পারে না। লক্ষ্মীমণি ওদের সবাইকে খেতে দিল। ডালবাটা দিয়ে পেঁয়াজের বড়া আর বেগুনি বানিয়েছিল, তাই ওদের তিনজনকে খেতে দিল। সেই সঙ্গে তেলমাখা মুড়ি — কাঁচা লঙ্কা আর পেঁয়াজের কুচি মেশানো। ছেলের জন্যেও রাখল, যদিও মনে মনে একটু গালাগাল দিল ছেলেকে। হারামজাদা ছেলেটার ওপর ওর রাগ এখনো পুরোপুরি যায়নি। বড় তৃপ্তি করে খেল হারা। ওর কপালে সাধারণতঃ শুকনো মুড়ির বেশি কিছু জোটে না। ওর এত আগ্রহ করে খাওয়া দেখে লক্ষ্মীমণি ওকে আরও বেগুনি আর ডালের বড়া দিল — নিজের জন্যে কিছুই রাখল না। এই বাড়তি খাবারটুকুও চটপট শেষ করে ফেলল হারা। লক্ষ্মীমণি ততক্ষণে চা বানিয়ে ফেলেছে, আধ গেলাস চা খাইয়ে দিল হারাকে। শরীর মন চাঙ্গা হয়ে উঠবে।

    সুলোচনার ফিরতে ফিরতে ভালরকম সন্ধে হয়ে যায়। ততক্ষণ হারাকে ঘরের বাইরেই থাকতে হয়। বন্ধুরা কেউ থাকলে তাদের সঙ্গে খেলে। তবে বেশিরভাগ দিনই বাকিরা সবাই বাড়ি ফেরৎ চলে যায় — হারা একাই এদিক ওদিক ঘুরে সময় কাটায়। আজ বাড়ি ঢুকতে ওর দেরি হল, সুলোচনা ততক্ষণে ফিরে এসেছে। ও ছেলের মুখে, হাতে, পায়ে স্টিকিং প্লাস্টার দেখল। জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে — মারামারি করেছিস?

    মাকে সব কথা বলল হারা। লক্ষ্মীমাসি বরফ লাগিয়ে দিয়েছে, ওসব স্টিকিং প্লাস্টারও লাগিয়ে দিয়েছে, সে কথাও বলল। তবে কি কি খাইয়েছে তা বলল না। বয়েস কম হলেও ও জানে যে মাসির ওকে খাওয়ানোর কথা শুনলে মায়ের রাগ হবে, যদিও কেন মায়ের রাগ হয় ও সেটা বুঝে উঠতে পারে না।

    ছেলের মুখে সব কথা শুনে সুলোচনা চুপ করে গেল। কিন্তু মায়ের মুখ দেখে হারা পরিষ্কার বুঝল মা ভেতরে ভেতরে অসন্তুষ্ট হয়েছে। কেন মা অখুশি হয়েছে হারা ঠিক বুঝল না। ও তো মাকে লক্ষ্মীমাসির ঘরে খাওয়া দাওয়ার কথা কিছু বলেনি। আসলে লক্ষ্মীমণি যে হারাকে এত যত্ন আত্তি করেছে সেটাই সুলোচনার পছন্দ হয়নি। কেন বাপু — পরের ছেলেকে এত আদর যত্ন করা কিসের জন্যে? ওর পয়সা আছে, ঘরে ঠান্ডা মেশিন আছে, তাই বরফ লাগিয়ে দিতে পেরেছে। যাক্‌, বরফ লাগিয়ে দিয়েছে তো দিয়েছে, আবার পয়সা খরচা করে মলম, ব্যান্ডেজ এসব কিনে হারার চোট জখমে লাগাবার কি দরকার ছিল? আসলে এসব আর কিছুই নয়, বড়লোকি চাল ওর যে টাকা আছে, সুলোচনার যে নেই তা দেখানো। তুই না হয় সুলোচনার চাইতে দুটো টাকা বেশিই রোজগার করিস, তাতে কি সকলের মাথা কিনে নিয়েছিস নাকি? ও মাগির পেটে পেটে বদমায়েসি।

    গতকাল রাতে হারা তার মাকে একটা প্রশ্ন করেছিল। আজ রাতে মায়ের পাশে শুয়ে আবার একটা প্রশ্ন করল। আচ্ছা মা, আমার বাবা ঠাক্‌মার সঙ্গে থাকত না কেন? যদি থাকত তাহলে তো ঠাক্‌মার সম্পত্তি এভাবে অন্য লোক নিয়ে যেতে পারত না।

    এসব চিন্তা আগে কখনো হারার মাথায় আসেনি। এসব ভাবনা ভাববার বয়েসও হয়নি ওর। কিন্তু জগার কথার খোঁচাটা খালি ওর গায়েই লাগেনি, মাথাতেও ঢুকেছে। মারামারি করে মাথাটা ঠাণ্ডা হওয়ার পর ওর মনে হয়েছে, সত্যিই তো। মায়ের অত সম্পত্তি থাকতে ওর বাবা কলকাতায় এসে খেটে খেত কেন? তখনই হারা ঠিক করেছে, রাতে মাকে জিজ্ঞেস করবে। মা নিশ্চয়ই জানে ওর বাবার এখানে এসে এভাবে থাকার কারণটা কি।

    সুলোচনা চুপ করে রইল। এই প্রশ্নের উত্তর ওর নিজেরও ভালরকম জানা নেই। ও নিজেও ভীমের থেকে এর কারণ জানতে চেয়েছে। ভীম এড়িয়ে গেছে, উত্তর দেয়নি। তবে একথা ঠিক, ঐ বুড়ি ছেলে, ছেলের বৌকে একেবারেই পছন্দ করত না। যে কবার ভীমের সঙ্গে বুড়ির বাড়ি গেছে, খুব শুকনো, কাঠ কাঠ ব্যবহার করেছে বুড়ি। তবে হ্যাঁ, নাতিগুলো হবার পরে বোধহয় বুড়ির মন গলতে শুরু করেছিল। কিন্তু তারপর কত কি হয়ে গেল। বড় ছেলে দুটো মরে গেল, ঐ হারামজাদা ভীম তার পেয়ারের মেয়েমানুষ নিয়ে গায়েব হয়ে গেল। সব কিছু গোলমাল হয়ে গেল।

    একটা চাপা নিঃশ্বাস ফেলল সুলোচনা। তারপরই ওর খেয়াল হল হারা চুপ করে অপেক্ষা করে আছে ওর প্রশ্নের জবাবের জন্যে। কিছু একটা উত্তর ওকে দিতেই হবে, নইলে ও সারারাত ঘুমুবে না। একটু ভেবে বানিয়ে বানিয়ে সুলোচনা বলল, তোর বাপের সঙ্গে তোর ঠাক্‌মার ঝগড়া হয়েছিল। তোর বাপকে তোর ঠাক্‌মা বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছিল। সেই থেকে আর কখনো তোর বাপ তার মায়ের সঙ্গে থাকেনি।

    হারা চুপ করে গেল। কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে ওর ঘুম এল না। মা যা বলল ব্যাপারটা কি সত্যি সত্যিই তাই? নাকি আরও কিছু আছে এর ভেতর?



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • প্রচ্ছদ | পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০ | পর্ব ১১ | পর্ব ১২ | পর্ব ১৩ | পর্ব ১৪ | পর্ব ১৫ (শেষ)
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments