হারার ঠাক্মার মারা যাবার খবরটা সুলোচনার কানে এসেছিল অনেকদিন পরে।
দুপুরে ইশকুল থেকে ফিরে হারা ভাত খেতে বসেছিল। সকালে মুড়ি খেয়ে গেছে — ফিরে আসার পর এই সময়টাতেই ওর মা ওকে ভাত খেতে দেয়। খাবার বেশি কিছু নেই — মোটা চালের ভাতের সঙ্গে ডাল, আর প্রায় বিনা তেলে ভাজা কয়েকটুকরো আলু আর বেগুন ভাজা। হারা জানে মাস শেষ হয়ে এসেছে বলে ওর মায়ের হাতে টাকাপয়সা কিছু নেই। ঘরে ডাল, তেল এসবও বিশেষ কিছুই নেই। নতুন মাস পড়লে মায়ের কাজের বাড়িগুলো মাইনে দেবে, তবে হারার কপালে একটু ভালমন্দ খাওয়া জুটবে। তখন হয়তো মোড়ের মিষ্টির দোকানটার থেকে দু একদিন বিকেলে ওর মা শিঙাড়া কিনবে, বা তেলেভাজার দোকানটার থেকে বেগুনি ফুলুরি আনবে — সকালে তাওয়াতে গরম করে ইশকুল যাওয়ার আগে মুড়ির সঙ্গে খেতে দেবে। রাতে আবার হাঁড়ির ভেতর রেখে ঢাকনিটার ওপর শিলনোড়াটা চাপা দিয়ে রাখতে হয়, নইলে ইঁদুরে ঢাকনিটা ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে ভেতরের খাবারটা ঠুকরে খেয়ে যাবে, ইঁদুরে খাওয়া বাকিটুকু সকালে ফেলে দিতে হবে। বেশ কিছুদিন আগে সুলোচনা সবকটা বাড়ির থেকে মাইনে একসঙ্গে পেয়েছিল। এরকম সাধারণত: হয় না। একটা বাড়ির গিন্নী মহা কিপ্টে — মাসের সাত তারিখের আগে মাইনে দেয় না। সে মাসে গিন্নী বাড়িতে ছিল না — মেয়ে থাকে বোম্বাই নাকি পুণা, সেখানে বেড়াতে গিয়েছিল। সংসার ছিল ছেলের বৌ এর হাতে — সে মাস পয়লাতেই মাইনে দিয়ে দিয়েছিল। সব কটা টাকা একসঙ্গে পেয়ে সুলোচনা অনেক খাবার কিনেছিল — শিঙাড়া, তেলেভাজা, আলুর চপ। রাতে হাঁড়িতে ঢাকনা দিয়ে রেখেছিল, কিন্তু নোড়াচাপা দেয় নি। মাঝ রাতে মেঝেয় ঢাকনি পড়ে যাওয়ার ঝনঝন আওয়াজ। সারা দিন খাটুনির পর ঘুম হয় যথেষ্ট গাঢ় — উঠতে, আলো জ্বালতে একটু সময় তো লাগে। ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। হাঁড়িটা কাৎ হয়ে মেঝেয় পড়েছে, প্রায় সব খাবারই ঠোকরানো, বেশ কিছু ঠোকরানো অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে, ঢাকনিটা হাঁড়ি থেকে একটু দূরে অসহায় অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে। সুলোচনা সে রাত্তিরেই সব খাবার ধরে ফেলে দিয়েছিল। দুঃখে হারা কেঁদেছিল ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে। অতগুলো খাবার, কিছুই হারা খেতে পেল না। সেদিন সুলোচনা ছেলেকে সান্ত্বনা দিয়েছিল, আদর করে কান্না থামিয়েছিল। খাবার যতই লোভনীয় হোক, মায়ের আদরের চাইতে মিষ্টি তো আর নয়। যাই হোক, চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে, ইঁদুর পালালেও তাই। সেই থেকে ঢাকনিতে নোড়া চাপা দিয়ে রাখার ব্যবস্থা।
লতিকামাসি এসেছিল ওদের ঘরে। সুলোচনার সঙ্গে গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করছিল। যে মাদুরটায় বসে হারা খাচ্ছিল তারই অন্য পাশে ওরা বসেছিল আসনপিঁড়ি হয়ে। হঠাৎ সুলোচনা হারার দিকে ফিরে চেঁচিয়ে উঠল, ওরে হারা, ঐ শোন্ লতিকা কি বলছে। তোর ঠাক্মা নাকি মারা গেছে।
লতিকা হারার ঠাক্মা মরার খবর সুলোচনাকে দেয়ার জন্যে ওদের ঘরে আসে নি। এসেছিল নেহাৎই খানিকটা গল্পগুজব করতে, এ মহল্লার কিছু মেয়েছেলেদের সম্পর্কে কিছু কেচ্ছাকাহিনী নিয়ে কথা বলতে। অবশ্য এসব কেচ্ছার বেশির ভাগ কথাই মিথ্যে, কিন্তু তাতে কি? রসিয়ে রসিয়ে ওসব নিয়ে পাড়াপড়শির মধ্যে গল্প সব মেয়েরাই করে — লতিকা আর সুলোচনাই বা বাদ যাবে কেন? আর এই তো একঘেয়ে সব দিনগুলো, অন্য মেয়েদের নিয়ে একটু কেচ্ছা-গল্প না করলে বাঁচা যায় কি করে?
লতিকার ধারণা ছিল মেনকার মরার খবরটা সুলোচনা জানে। ও নিজে জেনেছে গতকাল। ওর কোন দূর সম্পর্কের আত্মীয় মেনকার গাঁয়ে থাকে। সে লতিকার বাড়িতে এসেছিল, কথায় কথায় বলেছিল ওই গাঁয়ে এক গুরুদেবের আশ্রমের কথা। গাঁয়ের এক বুড়ি ওই আশ্রমের শিষ্যা ছিল — বুড়ির বেশ কিছু টাকা পয়সা, বিষয় সম্পত্তি ছিল। বুড়িটার সব কিছু ঐ গুরুদেব নিয়ে নিয়েছে। আবার একটা কাগজ তৈরী করেছে — বুড়ি নাকি টাকাপয়সা, জমি জায়গা সব ঐ আশ্রমকে দান করে গেছে।
ঐ আশ্রমের কুকীর্তির কথা শোনাতে গিয়ে ঐ লোক বুড়ির নাম বলেছিল। শুনেই লতিকা চিনেছে — আরে, এ তো আমাদের পাশের ঘরের হারার ঠাক্মা গো। আজ কথায় কথায় লতিকা সুলোচনাকে বলছিল — তোর ছেলেটার কি কপাল দ্যাখ্। ঠাকমার অত বিষয় সম্পত্তি — ঠাক্মা মরার পর নাতিটা পেল না, পেল কিনা কোথাকার কোন এক গুরুদেব।
আসলে লতিকা একটু খুশিই হয়েছে — মেনকার বিষয় হারাধন পায় নি। হারার বিষয় পাওয়া মানেই সুলোচনার হাতে ওসব টাকা, জমি এসব এসে যাওয়া। পাশের ঘরে থাকে, গতর খাটিয়ে কাজ করে খায়, হঠাৎ তার হাতে পয়সা এসে গেলে কি আর লতিকার সেটা ভাল লাগত? এমন নয় যে লতিকা সুলোচনা আর হারাকে পছন্দ করে না। কিন্তু সেটা ততক্ষণই যতক্ষণ ওরা লতিকার সমান অবস্থায় আছে, বা লতিকা ওদের চাইতে কিছুটা ভাল আছে। তাই আজ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মেনকার প্রসঙ্গ টেনে এনে সুলোচনাকে জানিয়ে দিল, তুই তোর শাউড়ির টাকা পেলি না, কেমন মজাটা হল? কিন্তু সুলোচনা এসব ভাবে নি। শাউড়ি মারা গেছে, এই খবরের ধাক্কাটা মাথায় ঢুকতেই চেঁচিয়ে উঠেছিল।
লতিকা সুলোচনার চেঁচানি শুনে অবাক। সে কি রে সুলো, তোর শাউড়ি মরেছে তিন চার মাস হয়ে গেল, তুই কিছু জানিস না?
সুলোচনা জানবে কোথা থেকে? কার অত গরজ যে বুড়ির ছেলের বৌ আর নাতির খোঁজ নিয়ে এখানে এসে বলে যাবে? আশ্রমের লোকজন তো তা করবেই না। সুলোচনা যত দেরি করে মেনকার মরার খবর পায় তাদের তো ততই ভাল।
মায়ের চীৎকার শুনে একবার মুখ তুলে হারা আবার খাওয়ায় মন দিয়েছিল। এখন ওর পেটে খিদে, সামনে থালায় রাখা খাবারটা ছাড়া ওর মাথায় এখন আর কিছু নেই। ঠাক্মা বেঁচে আছে কি মরে গেছে তা নিয়ে ওর কোন মাথাব্যাথা নেই। খেয়ে উঠে ও বেরিয়ে যাবে ডাংগুলি খেলতে। ওদের আর এক প্রতিবেশী লক্ষীমণি মাসি — তার ছেলে গৌরা ভাল ডাংগুলি খেলে। কাল ওর কাছে খেলায় হেরে গিয়েছিল হারা, অনেকক্ষণ খাটান দিতে হয়েছিল, আজ তার শোধ তোলার দরকার। ও এক গরাস ডালভাতের সঙ্গে এক টুকরো আলুভাজা মুখে পুরল। সুলোচনার রান্না ভাল নয় — ডাল পাতলা জলের মত, আলুভাজাও একটু কাঁচা কাঁচা রয়েছে। তা হারার ওসব খারাপ লাগে না, অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। চটপট খাওয়া শেষ করে হারা খেলতে বেরিয়ে গেল। একটু পরেই সুলোচনা ঘরে তালা লাগিয়ে বেরোবে — ওর কাজের বাড়িতে যাবে। দুটো নতুন বাড়িতে সন্ধেবেলা কাজ নিয়েছে, নইলে সংসার চলে না। সব জিনিষপত্রের দাম দিন দিন বাড়ছে, কিন্তু পুরনো কাজের বাড়িগুলোর গিন্নিরা একশটা টাকাও মাইনে বাড়াবে না। সুলোচনা মাইনে বাড়াবার কথা বললেই তাদের মুখ ভার হয় — বলে, এখন পারব না বাপু। সে পুজোর পর দেখা যাবে। মর্ মুখপুড়ি — সুলোচনা মনে মনে গাল দেয়। মুখে কিছু বলে না। চাকরি গেলে খাবে কি?
সুলোচনা হারাকে এক ধমক দিল — হাঁ করে তাকিয়ে আছিস কি, চটপট ওঠ। বাটিতে মুড়ি আছে — হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নে। বেরোতে হবে আমার সঙ্গে। অনেকদূর যেতে হবে — তোর ঠাক্মার গাঁয়ে যাব। বুড়ির সব বিত্তান্ত খোঁজখবর নিতে হবে।
সুলোচনা কালকেই ঠিক করেছে সেখানে যাবে — বুড়ির সম্পত্তি বেহাত না হয়ে যায়, তার একটা চেষ্টা করবে। সেজন্যে হারাকেও সঙ্গে নিয়ে যাবে। গাঁয়ের লোকজন, পাড়া প্রতিবেশীদের ডেকে হারাকে দেখাবে। বলবে — তোমরা সবাই সাক্ষী, এই ছেলেই হল গিয়ে সম্পত্তির আসল মালিক।
লতিকা অবশ্য যেতে বারণ করেছিল। বলেছিল, তুই একা মেয়েমানুষ, তোর সঙ্গে খালি তোর এই বাচ্চা ছেলে — তুই কি করে টক্কর দিবি ঐ ধড়িবাজ গুরুমহারাজের সঙ্গে? ওর কত লোকজন, চ্যালাচামুন্ডা — ওরা তোকে পিটিয়ে ভাগিয়ে দিলে তুই কি করতে পারবি? তোকে আর হারাকে ঐ আশ্রমের ভেতর গুম করে ফেললেই বা দেখবে কে?
সুলোচনা লতিকার কথা মেনে নিতে পারে নি। দেশে থানাপুলিস, আইন আদালত আছে — তারা কি হারাকে কোন সাহায্য করবে না? একটা ছোট ছেলের ন্যায্য পাওনা সম্পত্তি অন্য কেউ জালিয়াতি করে মেরে দেবে — তা দেখেও চুপ করে থাকবে? সুলোচনার সঙ্গে ঝগড়ার পর চলে যাবার সময় অবশ্য বুড়ি শাসিয়ে গিয়েছিল, সব সম্পত্তি আশ্রমে দান করে দেবে। কিন্তু সত্যি সত্যিই কি বুড়ি তাই করেছে? আপন নাতি, নিজের পেটের ছেলের ছেলে, তাকে না দিয়ে দানছত্র করে গিয়েছে? টাকা পয়সা নগদের কথা ছেড়েই দাও, জমি জিরেতও তো বুড়ির কম ছিল না। ওর বাড়ির কাছে এক ফলের বাগান, কি গাছ নেই তাতে? আম, কাঁঠাল, নারকেল, সুপুরি, খেজুর, কলা — সব কিছু। ঐ সব গাছের ফলপাকুড় শহরে চালান যায়। খেজুর গাছগুলো গাছিদের জিম্মায় — সে সব খেজুরগাছের রস থেকে হয় গুড়। এ সবের থেকে বুড়ির আয় কি কম ছিল নাকি? গরমকালে, বর্ষাকালে বাগানে আগাছা হয়ে সাপখোপ বিছের উৎপাত না হয় — বুড়ি সেদিকেও নজর রাখত। প্রতি বছর বেশ কয়েকবার করে বাগানের আগাছা পরিষ্কার করত বুড়ি। আগাছা কাটাবার আগে সাপুড়েদের দিয়ে বাগানের সাপ ধরাত। দুটো সাপুড়ে আসত বুড়ির কাছে — প্রতিবারই দু একটা করে সাপ ধরত। অবশ্য বিষের সাপ বুড়ির বাগানে কখনো পাওয়া যায় নি — সাপুড়েরা যা ধরত সে সবই বিষ ছাড়া। সাপুড়েরা আবার নিজেদের কাপড়ের ভেতর সাপ লুকিয়ে রাখে — সেই সাপই বার করে দেখায় নিজেরা ধরেছে বলে। কিন্তু বুড়ির কাছে সে সব কায়দা করার উপায় ছিল না। ও নিজের হাতে তাদের কাপড় ঝাড়া দিয়ে দেখত সাপ লুকিয়ে রেখেছে কিনা। এমনও হয়েছে যে কাপড় ঝাড়তে গিয়ে তা খুলে গিয়েছে আর লোকদুটোর গোপনাঙ্গ উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছে। লজ্জায় জিভ কেটেছে তারা। কিন্তু মেনকার তাতে কোন মাথাব্যাথা হয় নি। বরং ওই লোকগুলোকে জোর গলায় ধমক দিয়েছে, পরনের কাপড় ভাল করে বেঁধে পরিস না কেন? ওদের কাপড় ঝাড়া দেবার সময় বুড়ি আবার নিজের জন্যে সতর্ক হতেও ভুলত না। নিজের কোমরে কাপড়ের ওপর দিয়ে বেঁধে রাখত সাপ তাড়ায় এরকম গাছের শেকড়। ঐ সাপুড়েরাই বুড়িকে জোগান দিত ঐ শেকড়ের।
আরও একটা কাজ করত মেনকা। সাপ ধরলে আর মারলে গোলমাল হতে পারে — কি সব বন্য প্রাণী টানি আইনে ফেঁসে যাওয়ার ভয় আছে। স্থানীয় পার্টি আপিসে যেত ঝুড়ি ঝুড়ি আম, কাঁঠাল, কাঁদি কাঁদি কলা, ডাব। আর যেত স্থানীয় থানাতে। পাড়াগাঁয়ের ব্যাপার, সব সময় কেউ না কেউ ওৎ পেতে থাকে সুবিধে পেলে একটা নালিস ঠুকে দেবে বলে। কাজেই এটুকু নরনারায়ণ সেবা মেনকাকে করতেই হত। তারপর নিশ্চিন্ত। আর কোন আইনের কামড় খাওয়ার ভয় নেই।
পথ অনেকটা। প্রথমে ট্রেন, ট্রেন থেকে নেমে বাস, তারপর ভুটভুটিতে নদী পার হওয়া। সুলোচনা ছেলেকে নিয়ে সকাল সকাল বেরিয়েও যখন নদী পার হয়ে ভুটভুটি থেকে নামল তখন ভালরকম দুপুর হয়ে গিয়েছে। ভুটভুটিটাতেই একটু বেশি দেরি হয়ে গেল — নদীর রেত ঠেলে যেতে হয়েছিল ওটাকে। দুজনেরই এখন বেশ খিদে পেয়েছে। সেই সকালে দু এক মুঠো মুড়ি খেয়ে বেরিয়েছে, তারপর তো পেটে আর কিছু পড়ে নি। সুলোচনা না হয় খিদে সহ্য করে থাকতে পারে, কিন্তু হারা বাচ্চা মানুষ, ওকি আর তা পারে? খিদেয় বেচারির মুখ শুকিয়ে গিয়েছে, খালি মায়ের কাছে মার খাবার ভয়ে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না। সুলোচনা বুঝল সেটা। কিন্তু ওতো সঙ্গে খাবার কিছুই আনে নি — হারাকে এখন কি খেতে দেবে?
গাঁয়ে যাবার একটাই রাস্তা। ভুটভুটি ঘাট থেকে রাস্তাটা বাজারের পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে — কিছুদূর পর্যন্ত পাকা, তারপর ঝামা আর সুরকির রাস্তা। বাজারটার গায়ে একটা খাবারের দোকান। সুলোচনা সেখানে হারাকে চা খাওয়াল, নিজেও খেল। চায়ের সঙ্গে দুটো করে নোনতা বিস্কুট। অন্তত: তেষ্টাটা তো মিটুক। দোকানের সামনে কাঁচের বাক্সে এলোমেলোভাবে রাখা সকালের বেঁচে যাওয়া ঠান্ডা সিঙাড়া, কিছু ভাঙা ভাঙা চেহারার ডালপুরি। আর মোটা মোটা গাঁটের রসে ডোবানো লালচে লালচে জিলিপী — দেখলেই লোভ লাগে। জিলিপীগুলোর ওপর বেশ কয়েকটা বড় বড় চেহারার কালো পিঁপড়ে ঘুরছিল, মাঝে মাঝে শুঁড়ে শুঁড় ঠেকিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল — কি করে এই লোভনীয় খাবারগুলো তাদের ডেরায় চালান করা যায়। চা বিস্কুট খেতে খেতে হারা জুলজুল করে ঐ সব খাবারগুলোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। ছেলের ইচ্ছেটা সুলোচনা ভালই বুঝেছিল। কিন্তু নিজের মনকে শক্ত রেখেছিল — হারাকে ওসব খেতে দেয় নি। প্রথম কথা, সঙ্গে টাকা বেশি নেই। মাসের শেষ, ওর নিজের হাত এখন খালি। লতিকার থেকে পাঁচশো টাকা কর্জ করেছে। যদিও লতিকা সুলোচনাকে এখানে আসতে বারণ করেছিল, টাকাটা ধার দিতে আপত্তি করে নি। সুলোচনার যখন এতই জেদ, ও যাক শ্বশুরবাড়ির ভিটেয়, ঘুরে আসুক একবার। দেখুক কিছু করতে পারে কিনা। এই পাঁচশো টাকার অনেকটাই খরচা হয়ে যাবে দুজনের যাতায়াত ভাড়াতে। যে টাকাটা বাঁচবে সেটা যাবে বাকি মাসটুকু সংসার ঠেলতে। কাজেই রাস্তায় এটা ওটা কিনে খাওয়া যাবে না। তাছাড়া হারার আবার এক রোগ আছে। মাঝে মাঝে যখন তখন ওর পেট ধরে বেগ আসে। সুলোচনা ডাক্তার কবিরাজ দেখায় নি — দেখাবার মত টাকা ওর নেই। কাজেই সকালের বাসী সিঙাড়া, জিলিপী, এসব খেয়ে ও যদি হঠাৎ পেন্টুল খুলে রাস্তার পাশে বসতে চায় তাহলে সুলোচনা ঝামেলায় পড়বে। ও ছেলেকে একটা ধমক দিল। বলল, এই-এই, ওসব খাবারের দিকে আর তাকাতে হবে না — চটপট পা চালিয়ে চল।
কার্তিক মাসের শুরু, শেষ রাতে একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগে। কিন্তু এখন দিনের বেলা, মাথার ওপর ঝাঁ ঝাঁ রোদ। সুলোচনা সঙ্গে করে ওর লাল রঙের ছাতাটা এনেছে — রোদে হোক, বিষ্টিতে হোক, ওটা ওর খুব কাজে লাগে। বছর দুই হয় ওটা কিনেছে — মেয়েদের ছাতা, মুড়ে ভাঁজ করে ছোট করা যায়। কিনতে ওর প্রায় শ তিনেক লেগে গিয়েছে। সে মাসটা খুব কষ্ট করে চালাতে হয়েছে। কিছু ছাতাটা ওর খুবই কাজে লাগছে। গত বর্ষায় একটা শিক বেঁকে গিয়ে ছাতার কাপড়ের সেলাই একটু খুলে গিয়েছিল, রাস্তার ছাতা সারাইওয়ালাকে দিয়ে সে সব সারাই করিয়ে নিয়েছে। এই ছাতায় ওকে অন্তত: পাঁচ বছর চালাতে হবে — বছর বছর নতুন ছাতা কেনার বাবুয়ানি তো ওর পোষাবে না। এখন ছাতাটা খুলে মাথার ওপর ধরে রেখেছে, ছেলেকেও নিজের কাছে টেনে নিয়েছে — ওর মাথাটাও রোদ থেকে যতটা সম্ভব বাঁচানো যায়। শাউড়ি বুড়ির বাড়িটা বেশ একটু দূর — হেঁটে আধঘণ্টা তো বটেই। সুলোচনা একহাতে ছাতার ডান্ডা আর এক হাতে ছেলের হাত ধরে পথ হাঁটছে — ওর মাথায় এখন ঘুরছে একশো চিন্তা। ঝোঁকের মাথায় এখানে চলে তো এসেছে, কাজ কিছু হবে কি? পাড়ার লোক যদি সাহায্য না করে তাহলে ও কিছুই করতে পারবে না। সাহায্য করবে নিশ্চয়ই। একটা ছোট ছেলেকে ঠকিয়ে তার বিষয় সম্পত্তি অন্য লোকে হাত করে নেবে, মানুষজন সেটার প্রতিবাদ করবে না? কিন্তু ওখানকার লোকজন তো হারাকে বিশেষ দেখেই নি। বেশ কয়েক বছর আগে হারা যখন আরও ছোট ছিল তখন ও একবার বাপ মা আর দুই দাদার সঙ্গে ঠাকমার বাড়ি এসেছিল। তাও ছিল মাত্র কয়েকদিন। বুড়ি তো আর সুলোচনাকে ভাল চোখে দেখত না — এখানে কয়েকদিনের বেশি থাকা সম্ভব ছিল না। ঐ সময়ে যদি পড়শীরা হারাকে দেখে থাকে। কিন্তু দেখলেও মনে করে রেখেছে কি? তবে হারার মুখ মনে থাকুক আর নাই থাকুক, যে কোনও ভদ্দরলোকেরই তো উচিৎ এরকম একটা ব্যাপারে এগিয়ে এসে একটা বাচ্চা ছেলের পাশে দাঁড়ানো। কেউ সাহায্য করবে না এরকম ভাবলে তো কোন চেষ্টাই করা যাবে না, আর চেষ্টা না করলে কিছু পাওয়াও যাবে না। আচ্ছা — টাকা পয়সা কিছু যদি উদ্ধার নাও করা যায় বাগানটা কি পাওয়া যাবে? ঐ বাগানটাই তো হচ্ছে আসল কামাই এর জায়গা। তবে বাগান সামলাতে গেলে এখানে এসে থাকতে হবে। শাউড়ি বুড়ির বাড়িটাতেই বেশ থাকা যাবে। একটু আধটু মেরামত করিয়ে নিলেই চলবে। এখানে কাছাকাছি কোন একটা ব্যাঙ্কে হারার নামে একটা খাতা খুলে নিতে হবে। হারা যদ্দিন না বড় হয় সেটা চালাবে সুলোচনা — ব্যাঙ্কের সাথে সেরকম ব্যবস্থা করে নিতে হবে। আঃ, সত্যিই যদি সেরকম হয় — তাহলে এই সাত বাড়িতে ঘর পরিষ্কার করা আর বাসন সাফা আর করতে হবে না, গিন্নীগুলোর মুখ খেতে হবে না। ওর মন বলছে ব্যাপারটা লেগে যাবে, মাথার ওপর ভগবান কি একেবারে মুখ ফিরিয়ে নেবে?
হারার মাথায় এসব কোন চিন্তা নেই। রেলগাড়িতে পাশাপাশি বসে আসার সময় ওর মা ওকে একটু আভাষ দিয়েছে — ওদের নাকি অনেক টাকা পয়সা পাওয়ার কথা। তা নিয়ে ওর কোন মাথাব্যথা নেই। টাকা না থাকলেও ও এখন বেশ আছে — যদি কিছু পায় তাহলেও কি হবে সে সম্বন্ধে ওর কোন ধারণাই নেই। ও মায়ের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার এপাশ ওপাশ দেখছিল। ও যেখানে থাকে সেখানে অনেকদূরে কিছু দেখা যায় না, কাছাকাছি কোথাও গিয়ে চোখের নজর আটকে যায় — একটা দেয়াল, একটা ঘর, রাস্তার এপাশে ওপাশে ছোটবড় ঘরবাড়ি। ও যে মাঠে ডাংগুলি খেলে তারও চারপাশে কিছু না কিছু রয়েছে — হয় দেয়াল নয় বাড়ি। এখানে রাস্তাটার দু ধারে ছাড়া ছাড়া ভাবে রয়েছে ছোট বড় গাছ, জংলা ঝোপ, বাঁশঝাড়, ডোবা। আর সেগুলোর ফাঁক দিয়ে চোখ চলে যায় বহুদূরে — কোথাও আটকায় না। হারা চষা খেত কখনো দেখে নি। এখন সেই খেত থেকে ফসল কেটে নেওয়া হয়েছে, নতুন বীজ শীগগীরই রোয়া হবে। আবার খানিকটা রুক্ষ্ম জমি, তার শেষে একটা ইঁটভাটা, সব লোক মাটি কেটে ঝোড়ায় তুলছে, সেই ঝোড়া মাথায় নিয়ে আর এক দিকে হেঁটে চলে যাচ্ছে। এদের মধ্যে অনেক মেয়েমানুষও আছে — এতদূর থেকে ওসব মানুষ-মেয়েমানুষদের হাঁটা চলা করা ছোট ছোট পুতুলের মত লাগছে। রাস্তার কাছাকাছি অনেক সোনাঝুরি গাছ, মাঝে মাঝে অশথ গাছ আর বাবলার ঝোপ — গাছগুলোর নাম হারার জানা নেই, ও কৌতূহলের চোখে গাছগুলোকে দেখে, প্রকাণ্ড চেহারার অশথ গাছগুলোর দিকে অবাক হয়ে তাকায়। খোয়ার রাস্তা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে একটা আদিকালের বিশাল তেঁতুল গাছ — প্রচুর বিরাট বিরাট ডালপালা এদিক ওদিক মেলে দিয়েছে। এই গাছটার জন্যেই গ্রামটার নাম হয়েছে তেঁতুল-গাঁ। গাছটার পাশে বেশ বড় একটা খালি জায়গা। সেখানে শীতকালে যাত্রা হয় — কলকাতা থেকে যাত্রাপার্টি আসে। পালা হয় — নাগিনীর ছোবল, মা তুমি কার, চার পয়সার দুনিয়া। চার পাশের সব গাঁ গঞ্জ থেকে লোক ভেঙ্গে পড়ে ও সব পালা দেখবার জন্যে। এই যাত্রাপালা খুব লাভের ব্যবসা, পার্টির স্থানীয় নেতা আর ছেলেরা ভাল টাকা রোজগার করে নেয় এই মরসুমে। মাঝে মাঝে অবশ্য লাভের বখরা নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝামেলা লাগে, এমনকি মারপিট খুন জখমও হয়ে যায়। তবে নিজেদের ভেতর খুনখারাপির খবর বাইরে খুব একটা বেরোয় না, নেতারা চেপে দেয়।
গাছটাকে বাঁয়ে রেখে মাটির রাস্তা এগিয়ে গেছে গাঁয়ের ভেতর। হারা এই গাছটার নামও জানে না। ও একবার ভাবল মাকে জিজ্ঞেস করবে ওটা কি গাছ। কিন্তু করল না। মায়ের হয়তো গাছটার নাম জানা নেই। আর তাহলে মা তো আর সেটা স্বীকার করবে না, হয়তো কান মুলে দিয়ে গালে এক চড় বসিয়ে দেবে। মায়ের হাতের থাপ্পড় খেলে বেশ কিছুক্ষণ গালটা জ্বালা করবে। কি দরকার গাছের নাম জানার জন্যে মাকে ঘাঁটিয়ে?
এই রাস্তার বাঁদিকে একটা ছোট মাটির রাস্তা। সেটা দিয়ে এগোলে প্রথমে পড়ে ডানহাতে কলাগাছের একটা বড় ঝাড়, তারপর একটা মাঝারি সাইজের পানাপুকুর, সেটার পরে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে জংলা সব ঝোপ, তারও পরে শাউড়ি বুড়ির বাড়িটা। সুলোচনা ভেবেছিল প্রথমে বুড়ির বাড়িটায় যাবে, কাগজ পত্তর কিছু পাওয়া যায় কিনা তা খুঁজে দেখবে। বাসনপত্র আর লুকোন টাকা পয়সা যদি কিছু থাকে তাহলে সেগুলো তো হারাধনের, অর্থাৎ সুলোচনার। কিন্তু বাড়ির কাছাকাছি এসে ওকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল। এই তিন চার মাসে বাড়ির চারপাশ ঘিরে আগাছার জঙ্গল গজিয়ে গেছে — বর্ষার জলটা পুরো পেয়েছে কিনা। বাড়ির উঠোন, দাওয়া — সব ভরতি।
ছেলের হাত ধরে বুড়ির বাড়ির দিকে হতাশ চোখে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সুলোচনা। এখন কি করা যায়? এতদূর এসে একেবারে কিছু না করে ফিরে যাবে? ঐ আগাছার জঙ্গল ঠেলে এগোবার সাহস ওর নেই — কে জানে কোথায় সাপ খোপ বিছে রয়েছে। তাছাড়া এগোতে পারলেও যে কোন লাভ হত তা নয়। এই দূর থেকেও চোখে পড়ছে ঘরে ঢোকার দরজাটা বন্ধ, বাইরের বন্ধ হুড়কোটায় একটা বড়সড় তালা ঝুলছে। ঐ তালা কে লাগিয়েছে, চাবি কার কাছে আছে, সে সবের হদিশ একমাত্র পাড়ার লোকই হয়তো দিতে পারবে। সুলোচনা একটু চিন্তা করে নিল — কাছাকাছি কারা থাকে? সবাই থাকে মূল রাস্তাটার অন্য দিকটায়। প্রথমে পড়বে পালিতদের বাড়ি, তার পরে পরে মন্ডল, কুন্ডু আর সাঁতরা। ওদের কাছে গিয়ে খোঁজ করা যাক। কিন্তু তার আগে বাগানটার অবস্থা দেখা দরকার। ওটা বেশি দূর নয় — পালিতদের বাড়ির আগেই পড়বে ওটা।
কিন্তু বাগানটার কাছে এসে ওকে আর একটা ধাক্কা খেতে হল। এক মানুষ সমান মজবুত ইঁটের পাঁচিল উঠে গেছে ওটার চারপাশ দিয়ে। পাঁচিলটা নতুন — তার মানে বুড়ি মরবার পরেপরেই ওটা গাঁথা হয়েছে। বাগানে ঢোকা তো দূরের কথা, ভেতরে কি হচ্ছে না হচ্ছে তা জানবারও কোন উপায় নেই। ছেলের মুখের দিকে তাকাল সুলোচনা। বেচারি ছেলেমানুষ, খিদেয় মুখ শুকিয়ে গেছে — দুটো খেতে পেলে ও এখন বর্তে যায়। তবে সুলোচনা অত তাড়াতাড়ি হাল ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়। ছেলেকে নিয়ে ও পাঁচিলের পাশ দিয়ে দিয়ে সামনে এগোল। আগে কোথাও ভেতরে ঢোকার দরজা আছে নিশ্চয়ই।
দরজা মিলল ঠিকই, কিন্তু সে বিরাট লোহার দরজা। আপাতত: বন্ধ — ভেতর থেকে বন্ধ আছে কিনা বোঝা যায় না। দরজার দুপাশে দুটো পেটমোটা ফাঁপা স্তম্ভ, ওগুলোর মাথা আবার ছাতার মত গোল করে বানানো। ও দুটোর ভেতরে দুটো উর্দি পরা ষণ্ডা চেহারার পুরুষ্টু পাকানো গোঁফের লোক চেয়ার পেতে বসে আছে — একজনের হাতে একটা লাঠি আর অন্যজনের হাতে একটা বন্দুক। সুলোচনা কাছাকাছি আসতেই দুজনে লাফিয়ে উঠে ওদের গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে দরজাটা আগলে দাঁড়াল। সুলোচনাও দাঁড়িয়ে পড়ল — ঐ দুটো দারোয়ান রাস্তা না দিলে দরজা ঠেলে খুলবার জন্যে তাতে হাত লাগাতে পারবে না। যে লোকটার হাতে লাঠি সে কড়া চোখে সুলোচনার দিকে তাকিয়ে কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করল, কি চাই?
সুলোচনা একটু ভয় পেল। লোকটার চোখ লাল, মুখে দিশী মদের উৎকট গন্ধ। দুটো লোকেরই চেহারা, চোখের চাউনি একেবারে গুন্ডার মত। ওরা যদি সুলোচনাকে গায়ে হাত দিয়ে ধাক্কাধাক্কি দেয় তাহলে ও কিছুই করতে পারবে না। চেঁচামেচি করেও কোন লাভ হবে বলে মনে হয় না — ধারে কাছে কোন লোক দেখা যাচ্ছে না। গলাটা শুকিয়ে গেছে তবুও ও সাহস করে বলল, এই বাগান আমার এই ছেলের — হাত দিয়ে হারাকে দেখাল সুলোচনা। যে বুড়িমার এই বাগান ছিল এ তার নাতি। আমরা ভেতরে যাব, এই বাগানের দখল নেব। দখল না দিলে কাছারিতে নালিশ করব আমরা।
লাঠি হাতে লোকটা এক পা এগিয়ে গেল, সুলোচনাও এক পা পিছু হটে গেল। লোকটা আরও কর্কশ গলায় বলল, নেশা করে এসেছিস নাকি মাগি? এই বাগান গুরুদেব নিত্যানন্দের আশ্রমের — আর তুই কিনা কোথা থেকে একটা বাচ্চা ছেলে ধরে নিয়ে এসে বলছিস বাগান এই বাচ্চার? ভাগ্ এখান থেকে।
আরও কয়েক পা পিছু হটে গেল সুলোচনা। লোক দুটো মাইনে দিয়ে রাখা গুন্ডা, ওরা যদি সুলোচনাকে ধরে মার লাগায় তাহলে ও মেয়েমানুষ — বেইজ্জতিটা ওরই হবে। এমনকি হারাকেও মার লাগাতে পারে ওরা, বাচ্চা ছেলে বলে ওকে রেয়াৎ করবে না। তার চেয়ে কোন প্রতিবেশীর বাড়ি গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলে কিছু করার চেষ্টা করাটা উচিৎ কাজ হবে। পালিতদের বাড়ি কাছে, ওদের সঙ্গেই আগে কথা বলা যাক।
পালিতদের বাড়ি যাবার জন্যে সুলোচনা সবে পা বাড়িয়েছে, বাগানের দরজা খুলে একজন লোক বেরিয়ে এল। আধবুড়ো, চুল সব পাকা, কিন্তু মজবুত চেহারা — পরণে একটা হাঁটু জোকা ময়লা ধুতি আর ময়লা গেঞ্জি, কোমরে গামছা বাঁধা, আর সেই গামছার একটা ফাঁস থেকে ঝুলছে একটা দা। লোকটা নিশ্চয়ই একটা গাছি, সুলোচনা ভাবল — খেজুর গাছ জমা দেয়া আছে ওর কাছে। লোকটার বয়েস হয়েছে, বোধহয় শাউড়ির আমলের লোক — — ঐ কে না কে গুরুদেব সে বাগানের দখল নেবার আগে থেকেই গাছ জমা নিয়েছে।
সুলোচনার আন্দাজ ঠিক। লোকটার নাম পরাণ সাঁতরা — হারার ঠাক্মা বুড়ির সঙ্গে ওর অনেক বছর ধরে গাছের বন্দোবস্ত রয়েছে। ও হারাকে আগে দেখেছে — হারা যখন একবার বাপ মা আর দুই দাদার সঙ্গে ঠাক্মার বাড়ি এসেছিল তখন। ও হারাকে দেখে চিনতে পেরেছে। হারাকে ডেকে বলল, কে ও, হারাধন দাদা না? কত বড়টি হয়ে গিয়েছ দাদাভাই।
এবার কোন আপত্তি করল না সুলোচনা। ছেলেকে নিয়ে পরাণের সাথে সাথে ফিরতি রাস্তায় চলল।
পরাণ মুখ খুলল অনেকটা দূর চলে আসার পর — এমন দূরত্বে এসে যেখান থেকে দারোয়ান দুটোকে আর দেখা যায় না, যেখানে ওরা স্বাভাবিক গলায় কথা বলতে পারে। কেন এখানে এসেছে তা সুলোচনার থেকে পরাণ শুনে নিল। কিন্তু সব শুনে মাথা নাড়ল। বলল, শোন গো হারাধনের মা, যা ভাবছ তা হবার নয়। সব্বাই জানে ঐ নিত্যানন্দ জালিয়াতি করে বুড়িমার সব কিছু হাতিয়ে নিয়েছে। সব জেনেও সবাই চুপ করে আছে। কেউ কিছু করবে না।
সুলোচনার ভেতরের রাগ আবার ফুঁসিয়ে উঠল, কেন হবে না শুনি? দেশে কি আইন কানুন আদালত কিছু নেই? আমি পুলিশে যাব, নালিশ করব। আমার ছেলের হাতে ওর ঠাক্মার সম্পত্তি আসবে, তবে আমি ছাড়ব।
পরাণ চুপ করে রইল। সুলোচনারও আর কিছু বলার ছিল না। রাগে, উত্তেজনায় ওর ঘন ঘন নি:শ্বাস পড়ছিল, ছেলের হাত শক্ত মুঠোয় ধরে ও হাঁটছিল। গ্রামটা ছাড়িয়ে এল ওরা। বাজার এলাকাটায় রয়েছে একটা ভাতের হোটেল। সেখানে এসে পরাণ দাঁড়িয়ে পড়ল, সুলোচনা আর হারাও দাঁড়াল।
হোটেলের খোলা দরজায় কাঠ দিয়ে বাঁধানো একটা টিনের বোর্ড ঠেসান দিয়ে রাখা আছে। তার ওপর লাল রং দিয়ে কি কি খাবার পাওয়া যায় আর তাদের দাম লেখা আছে। ভাত, ডাল, সব্জী, ডিমের ঝোল, পোনা মাছ, মুরগী। আগে আগে খাসীর মাংসও পাওয়া যেত, পাঁঠা খাসীর দাম বেড়ে যাওয়া ইস্তক ও খাবার আর এখানে তৈরী হয় না। বোর্ডে হাফ প্লেট, ফুল প্লেট, দু রকমের দাম লেখা আছে। তবে বোর্ডে লেখা সব খাবারের তত কিছু চাহিদা নেই — ভাত, ডাল, আলুর সব্জী আর ডিমের ঝোল — এই-ই বেশি বিক্রি হয়। সপ্তাহে দু দিন কাছাকাছি একটা হাট বসে — সে দু দিন অবশ্য মাছ আর মুরগীর পদ দুটোর মোটামুটি চাহিদা থাকে। লম্বা, সরু অনেকগুলো টেবিল, তার সামনে লম্বাটে বেঞ্চি পাতা। পরাণ মা আর ছেলেকে ভেতরে ঢুকিয়ে ঐ বেঞ্চিতে বসাল, নিজেও পাশে বসল। আজ হাটের দিন নয়, ভাতের হোটেলে মাছ বা মুরগী রান্না হয় নি। পরাণ মা আর ছেলের জন্যে ডিমের ঝোল ভাত ফরমাস দিল। ও নিজে এখন কিছু খাবে না — সকালে বেরোবার সময় ভরপেট ভাত খেয়ে বেরিয়েছে, আবার খাবে একেবারে সেই বাড়ি ফিরে। খাওয়ার সময় সব লোক টেবিলে খাবার ফেলে টেবিল নোংরা করে। যে ছোকরা খাবার দেয় সে একই তেল চিটচিটে ময়লা ন্যাকড়া দিয়ে সব কটা টেবিল বারবার মোছে, সেজন্যে টেবিলগুলো সব তেলতেলে নোংরা হয়ে আছে। ছোকরা সুলোচনা আর হারার জন্যে দুটো স্টীলের থালায় ভাত আর ডিমের ঝোল নিয়ে এসে থালাদুটো ওদের সামনে টেবিলের ওপর রাখল — থালার ওপরেই জলের গেলাস রাখা। হারা ছেলেমানুষ, কিন্তু পরাণ ওর জন্যেও ফুল প্লেটই ফরমাস দিয়েছে — কারণ হারার মুখ দেখেই পরাণ বুঝেছে যে ওর খুব জোর খিদে পেয়েছে। হোটেলের ছোকরাটাকে পরাণ একটু তোয়াজ করে বলল, বাবা রে, টেবিলটা খুব তেলতেলে নোংরা হয়ে আছে, একটা শুকনো ন্যাকড়া দিয়ে একটু ঘষে মুছে দিবি?
পরাণের দিকে না তাকিয়ে নির্বিকার, গম্ভীর মুখে ছেলেটা উত্তর দিল, শুকনো ন্যাকড়া নেই। তারপর চটপটে পায়ে হেঁটে অন্যদিকে চলে গেল। হারা ছেলেমানুষ, কিন্তু ওর চোখে পড়েছে থালার কানায় একটা জায়গায় একটু এঁটো লেগে আছে। সেরকম হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়, কারণ বেশির ভাগ খদ্দের খাওয়া শেষ হলে গেলাসের জল দিয়ে থালাতেই হাত মুখ ধুয়ে নেয়। এঁটো থালা ধোয়ার ব্যবস্থাও খুব সরল। একটা বড় গামলায় জল রয়েছে — সেই একই জলে থালা একবার ডুবিয়ে তারপর তুলে নেওয়া হয়, একই ন্যাকড়া থালার ওপর দ্রুত বুলিয়ে নিয়ে সেটা মোছা হয়। কিন্তু হারার পেটে এখন বাঘের খিদে — ওর নজর আবার ফিরে এসেছে থালার খাবারের ওপর — থালার কোণে কোথাও কোন এঁটো লেগে আছে কিনা তা নিয়ে ওর কোন মাথাব্যথা নেই।
ওদের খাওয়া আধাআধি শেষ না হওয়া পর্যন্ত পরাণ অপেক্ষা করে রইল। পেট ঠান্ডা হলে মাথাটাও ঠাণ্ডা হয়, এবার সুলোচনা ওর কথা মন দিয়ে শুনবে। পরাণ বলল, আবার বলি, শোন হারাধনের মা। আশ্রমের হাতে একটা কাগজ আছে। সত্যি হোক, মিথ্যে হোক, ইস্ট্যাম্প কাগজে সব ইংরেজিতে লেখা আছে, তাতে লোক লস্কর, সাক্ষীর সই আছে। তোমার কাছে কি আছে? আইন তো দেখবে খালি কাগজ — সে কাগজ জাল কিনা তা কি করে পেরমাণ করবে তুমি? আর এ সব মামলা কি তাড়াতাড়ি শেষ হয়? বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকবে — তারিখের পর তারিখ পড়বে। প্রত্যেকবার তারিখ পড়বে আর তোমার উকিলবাবুর পাওনা তোমাকে গুণে দিতে হবে। পারবে তুমি এত খরচ করতে? তার ওপর ওরা হাজারটা সাক্ষী নিয়ে এসে দাঁড় করিয়ে দেবে। তারা এসে হলপ করে বলবে বুড়িমা সব কিছু আশ্রমকে দান করে দিয়েছে, ঐ দানপত্তর তৈরী হওয়া তারা নিজের চোখে দেখেছে। তুমি সাক্ষী কোথায় পাবে? কে তোমার হয়ে সাক্ষী দেবে? সে সব ভেবে দেখেছ কি?
সুলোচনার মাথায় ওসব কথা আসে নি। পরাণের কথা শুনে এখন ওর মনে হচ্ছে ওর ছেলের সম্পত্তি উদ্ধার করা সত্যিই কঠিন কাজ। এবার ওর একটু আপশোষ হতে লাগল। শাউড়িটার সঙ্গে ঝগড়া না করে ওকে একটু তেল দিয়ে থাকলেই হত। আগে যখন এখানে এসেছে তখনই তেলটা লাগাবার দরকার ছিল। তাহলে হয়তো আগে ভাগেই হারার নামে সম্পত্তিটা লিখিয়ে নেয়া যেত। আর তেলটা একটু বেশি করে মাখালে বুড়ি হয়তো সেই কাগজ সুলোচনাকেই দিয়ে যেত। আরে দুৎ, এসব কি ভাবছে সুলোচনা? কোথায় সম্পত্তি, কোথায় কি? শাউড়ি বুড়ি মরেছে তিন চার মাস হয়ে গেল, কতকাল আগে পুড়ে ঝুড়ে একেবারে শেষ হয়ে গেছে। এখন ভূত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে হয়তো। কোন কোন তান্ত্রিক নাকি ভূত নামাতে পারে। কিন্তু সে সবই শোনা কথা, কেউই কখনো কোন তান্ত্রিকের নামানো ভূত দেখতে পায় নি। আর সত্যিই যদি বুড়ির ভূত নামানো যায় তাতেই বা কি হবে? ভূত কি আর আদালতে গিয়ে বলবে দানপত্তর হয়েছিল কিনা? আর হয়ে থাকলে কার নামে হয়েছিল? হঠাৎ সুলোচনার রাগ হয়ে গেল ছেলে হারার ওপর। ছেলেটা একেবারে একটা অলক্ষ্মী — নিজের ঠাক্মার সম্পত্তি পাবে, সেই কপালটুকুও করে আসে নি। ছেলের গালে একটা চড় বসিয়ে দেবার খুব জোর একটা ইচ্ছে হল সুলোচনার। কিন্তু পরাণ সাঁতরা বাইরের লোক, সে এখন ওদের সঙ্গে রয়েছে। ইচ্ছেটাকে চাপল সুলোচনা। ফুল প্লেট ডিমের ঝোল নিলে দুটো করে ডিম দেয় — ওর পাতে এখনও প্রায় একটা পুরো ডিম পড়ে রয়েছে। একটা বড়সড় টুকরো ভেঙ্গে নিয়ে মুখে পুরল সুলোচনা।
পরাণ আবার নিজের কথার খেই ধরল, সত্যি কথা বলতে কি, বুড়িমা কোন দানপত্তর করার কোন সুযোগই পায় নি। বুড়িমার হঠাৎ তুড়ে জ্বর এল — একেবারে বেহুঁশ, অচৈতন্যি। আশ্রমে কে খবর দিয়েছিল তা আমার জানা নেই। আমি যখন দেখতে গেলাম তখন ঘরে দুটো মেয়ে রয়েছে — বুড়িমার দেখভাল করছে। দুজনেই আশ্রমের বাসিন্দা। আমি রোজই একবার করে দেখতে যেতাম, তখন দেখতাম আশ্রম থেকে আরও লোকজন মেয়েপুরুষ সেখানে হাজির। ঐ জ্বর থেকে বুড়িমার আর হুঁশই ফেরে নি — দানপত্তর করবে কি করে? পাড়ার লোকও কেউ কেউ দেখতে আসত — ওরাও জানে বুড়িমার হাতে কোন দানপত্তর হয় নি। কিন্তু এখন কেউ মুখ খুলবে না। আমাকে যদি বল সাক্ষী দিতে আমিও তো বাপু হাতজোড় করে বলব আমাকে ক্ষ্যামা দিতে। সত্যি কথা বললে হয়তো আমি ঐ বাগানের ভেতরেই গুমখুন হয়ে যাব, মাটির সাত হাত নিচে পুঁতে ফেলবে আমাকে। তখন আমার পরিবারকে, ছোট ছোট ছাওয়ালপানকে কে খাওয়াবে, তুমিই বল?
সুলোচনার বুক ভরা হতাশা, কিন্তু তার মধ্যেই ওর একটু হাসি পেল। এই আধবুড়ো লোক পরাণ, ওরও নাকি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে রয়েছে। আর তখনি ওর কানে এল, হারা ওর দিকে চোরের মত তাকিয়ে মিন মিন করে বলছে, মা, আমাকে আর একটা ডিম দিতে বলবে?
সুলোচনা রেগে গেল। এত হ্যাংলা হয়েছে ছেলেটা। এক ধমক লাগিয়ে দিল ছেলেকে, না — একদম না। অনেক খাওয়া হয়েছে, আর না। হাত ধুয়ে নে, ধুয়ে উঠে পড়। এবার আমরা ফিরব, ঘরে যেতে রাত হয়ে যাবে।
পরাণ খাবারের দাম দিয়ে দিল। ও বেশ খুশি হয়েছে। ওর কথায় কাজ হয়েছে — সুলোচনা ব্যাপারটা নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি না করে ফিরে যেতে রাজী হয়েছে। ও মা আর ছেলের সঙ্গে ভুটভুটি ঘাট পর্যন্ত এল — ওপারে যাবার দুটো টিকিটও কেটে দিল। কিন্তু ওদের এখন অপেক্ষা করে থাকতে হবে। নদীতে এখন জবর জোয়ারের টান — ভুটভুটি তা ঠেলে যেতে পারবে না। টান কমতে ঘন্টা দুই — তখন ভুটভুটি ছাড়বে। সে একেবারে শেষ বিকেল, সন্ধেও হয়ে যেতে পারে।