বেবির ঘরটা বেশ বড়, আসবাব দিয়ে সাজানো। বড় একটা খাট, তার ওপর পুরু গদির বিছানা, কবাটে আয়না লাগানো দুটো বড় বড় আলমারি। সাজবার টেবিল একখানা আছে, সেটা তিন আয়নাওয়ালা। চারজন বসে খেতে পারে এরকম একটা খাওয়ার টেবিল রয়েছে, সেই সঙ্গে গোটা তিনেক চেয়ার। একটা বড় সাইজের টিভি দেয়ালে লাগানো রয়েছে। বেবির ব্যবসা রমরমিয়ে চলছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
বেবির ঘরে ঢুকে ওর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ওর ঘরদোর মন দিয়ে নজর করে দেখছিল হারা। পাঁজরায় একটা আঙুলের তীক্ষ্ণ খোঁচা খেয়ে ও চমকে গিয়ে পাশের দিকে তাকাল। বেবি ওর পাশে দাঁড়িয়ে মিটি মিটি হাসছিল। হারা ওর দিকে ফিরে তাকাতে ওকে বলল, হাঁ করে আমার ঘরে কি দেখছিলি? ওসব দেখার জন্যে পরে অনেক সময় পাবি। এখন আগে জুতো খুলে ওপাশে জুতোর র্যাকটায় রাখ। তারপর গিয়ে হাত পা মুখ ধুয়ে আয়। ঘরের পেছনের দরজাটার বাইরেই কলতলা। ওখানে হাত মুখ মুছবার তোয়ালেও পাবি। দড়িতে টাঙানো আছে।
আঙুল দিয়ে ঘরের পেছনের দিকে একটা ছোট দরজা দেখিয়ে দিল বেবি। আঙুলটায় বেশ বড় ছুঁচলো একটা নোখ আছে। সেজন্যেই খোঁচাটা অত জোরে লেগেছে। বেবিটা অল্প বয়েসে একটা ঘোর বিচ্ছু ছিল। এখনও বিশেষ বদলায় নি।
হারা জুতোর র্যাকে নিজের স্যান্ডেলজোড়া রাখল। তারপর বেবির দিকে ফিরে তাকিয়ে একগাল হেসে জিজ্ঞেস করল, তোর সব খদ্দেরকেই কি জুতো খুলে এই র্যাকে রেখে তোর ঘরের ভেতরে ঢুকতে হয়?
বেবি বিছানার ধারে পা ঝুলিয়ে বসে পা দোলাচ্ছিল। সেভাবেই বলল, মোটামুটি সেরকমই। তবে কয়েকটা মাতাল কিছু মানে না। জুতো পায়েই টলতে টলতে ভেতরে এসে বিছানায় আমার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
হারা আর কথা না বাড়িয়ে পেছনের দরজা খুলে বাইতে কলতলায় গেল। বেবির কথাটা ওর কানে খট করে বেজেছে। হঠাৎই বেবি ওকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে বেবির বিছানায় মাতালরা ওর ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বেবির কাছে ব্যাপারটা কিছুই নয়। ও খুব সাধারণভাবেই হারাকে কথাটা বলেছে। কিন্তু কথাটা শুনতে হারার ভাল লাগে নি। ওর সেই ছেলেবেলার খেলার সাথি বেবি, তার বিছানায় এখন মাতালরা রাজত্ব করে, এটা ওর একটু কিরকম যেন লেগেছে। অথচ হারা জানে এটাই স্বাভাবিক, বেবির যা ব্যবসা তাতে এরকমই হওয়ার কথা। তবুও —। যাকগে, মরুকগে, এই তো দিব্যি কলে জল — এতক্ষণ রোদে রোদে টোটো চালিয়ে মাথা মুখ সব গরম হয়ে গিয়েছিল, ভাল করে মুখ হাত পা ধুয়ে নিল হারা।
কলতলা থেকে ফিরে এসে হারা বেবির বিছানায় বসল। বেবি এর মধ্যে জামা বদলে নিয়েছে, ঘরের আটপৌরে পোষাক পরেছে। ও ঘুরে ঘুরে ঘরের টুকিটাকি কাজ করছিল। হারা ওর বিছানার ধারে বসেছিল — পা ঝুলিয়ে দিয়ে। বেবি ওর সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল, তারপর ওর বুকে হাতের তালুর ধাক্কা মেরে ওকে বিছানায় শুইয়ে ফেলল। বলল, ওভাবে কাঠ হয়ে বসে থাকার দরকার নেই। এতক্ষণ ধরে তোর ওই তিন চাকা চালিয়েছিস, থকে গেছিস নিশ্চয়ই। আরাম করে আমার বিছানায় একটু গড়িয়ে নে। আমি গা ধুয়ে আসি। তারপর তোর সঙ্গে আজ প্রাণ খুলে গল্প করব। কতদিন পরে তোর সঙ্গে দেখা, তোকে আজ সহজে ছাড়ছি না।
সত্যি, কতদিন পরে বেবির সঙ্গে দেখা। দিন তো নয় — বছর। হারা হিসেব করল, বারো তেরো বছর তো হবেই। হারার বয়েস তখন বোধহয় দশ এগারো, বেবির চোদ্দ পনেরো। দেখা হয়েছিল বেবিদের ঘরে। কি অদ্ভুত ছিল সেই দেখা হওয়াটা।
ঘটনাটা শুরু হয়েছিল বেবির সঙ্গে ওই দেখা হওয়ার আগের দিন। ছুটি হওয়ার আগেই ইশকুল পালিয়েছিল হারা। তখনও ছুটি হতে পুরো তিনটে ঘন্টা বাকি — অঙ্ক, বাংলা আর ভূগোল। তা হারার পক্ষে অঙ্ক যা ভূগোলও তাই, বাংলাতে কিছু হেরফের নেই। আরও কয়েকটা কি কি সব বিষয় ওদের পড়ানো হয়, অত কিছু হারার মাথায় থাকে না। আর সে জন্যেই তো তখন তিনের কেলাসে হারা বছর দুই ধরে গড়াচ্ছে। ওদের ইশকুলই মাঝে মাঝে ওকে ওপরের কেলাসে ঠেলে তুলে দেয়, নইলে হারা এখানেও আসত না। মা দোকানে কিছু কিনতে পাঠালে টাকা পয়সার লেনদেনের হিসেবের জন্যে একটুখানি যোগবিয়োগ লাগে, সেটুকু হারা ততদিনে শিখে নিয়েছে। তাছাড়া ও পড়াশোনা করবে কী? ও বই খাতা ধরলেই সেসব ছিঁড়ে যায়, কেমন করে তা হয় ও সেটা জানে না। আর ওই দজ্জালনি মা-টা আবার ওর ছেঁড়া বইখাতা দেখতে পেলেই ওর কান ধরে থাপ্পড় লাগিয়ে দেয়। যত্ত ঝামেলা। ইশকুলে যাওয়া ছেড়ে দিলেই তো হয়। এই তো লক্ষ্মীমাসির ছেলে গৌরা, ও আর ইশকুল যায় না। ওর বোনটা, বাতাসি, ও তো অনেকদিন আগেই ইশকুল ছেড়েছে। ওদের মা কি ওদের কান ধরে থাপ্পড় লাগিয়েছে? আর ওর মা খালি ঠেলে ঠেলে ওকে ইশকুলে পাঠাবে। হারা ওদের কেলাসের বেঞ্চিতে নিজের জায়গায় বসে থাকে ঠিকই, কিন্তু ওর পড়াশোনা তো হয় কচুপোড়া। মাস্টাররা কেলাসে আসে, কিছু পড়ে, মাঝে মাঝে কেলাসের কালো বোর্ডটায় চক দিয়ে কিছু লেখে, অনেকসময় আবার নিজের চেয়ারটায় বসে ঘুমিয়ে পড়ে। কোন কোন ঘন্টায় কেলাসে মাস্টার আসেই না, সারা ঘন্টাটা ধরে ছেলেরা গোলমাল করে। হারা ওই গোলমালটুকুই করতে পারে, মাস্টাররা কি পড়ায় না পড়ায় সে সব ওর মাথায় ঢোকে না। হারা প্রায়ই ভেবেছে, ইস্, ইশকুলের সময়টায় যদি ওদের ঘরের কাছের মাঠটায় গিয়ে কাঁচের গুলি নিয়ে খেলা যেত। ডান্ডাগুলি খেলায় হারা একটু কাঁচা, কিন্তু গুলি খেলায় ওর হাতের টিপ এখন বেশ পাকা হয়ে গেছে।
কিন্তু চাইলেই ইশকুল পালানো যায় না। বুড়ো দারোয়ানটা ইশকুলে ঢোকার বেরোবার গেটটা অল্প একটু খুলে রাখে যাতে লোকজন ইশকুলের আপিসঘরে আসতে পারে। কিন্তু নিজে গেটের ঠিক ভেতরে একটা টুল পেতে বসে থাকে, খৈনি খায় আর পান চিবোয়। ওর শকুনের চোখ ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া কোনমতেই সম্ভব নয়। ইশকুল বাড়িটার চারপাশে পাঁচিল, তার লাগোয়া একটা বড় গাছ আছে। ওটার ডালপালা ঝাঁকড়া পাতা সুদ্ধ পাঁচিলটার ওপর দিয়ে বাইরে ঝুঁকে পড়েছে। ঐ গাছে উঠে পাঁচিলের বাইরের দিকের ডাল ধরে ঝুলে পড়ে নামতে পারলে হয়। কিন্তু গাছটার জায়গায় জায়গায় লাল পিঁপড়ের বাসা আছে। তাছাড়া ডাল ছেড়ে দিয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়বার সময় একটু বেকায়দায় পড়ে গেলে হাত পা ভাঙতে পারে, এমনকি মাথাটাও ভাঙতে পারে, যদি কপাল সেরকম খারাপ হয়।
তবে সেদিনটায় একটা সুবিধে হয়ে গিয়েছিল। কেলাসে মাস্টার আসে নি, ওরা সব গোলমাল করছিল। ওর কেলাসেরই এক বন্ধু এসে চুপি চুপি খবর দিল, ইশকুলের গেট খোলা, আর দারোয়ানটা ওর টুলে বসে নেই। চুপি চুপি, কারণ একথা জোরে বললে চারপাশে সবাই শুনবে, আর একপাল ছেলে পালাবার জন্যে গেটের দিকে ছুটবে। জোর একটা হাল্লা হবে আর সব ভণ্ডুল হয়ে যাবে। ওরা দুজনে মিলে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে কেলাসঘরের পেছনদিকের দরজা দিয়ে টুক করে বেরিয়ে পড়ল। সত্যিই গেটটা অল্প একটু খোলা, দারোয়ানটা ধারে কাছে নেই। নিশ্চয়ই কানে পৈতে জড়িয়ে পেচ্ছাপখানায় গিয়ে বসেছে। ব্যাটা আবার বামুন, সবসময় একগোছা সাধা ধবধবে পৈতে গলায় ঝুলিয়ে রাখে। ওরা চটপট বাইরে বেরিয়ে গেল। আর বেরিয়েই দে ছুট। ওরা পালাচ্ছে দেখতে পেলে দারোয়ান ব্যাটা নালিশ ঠুকে দেবে, আর ওদেরকে কেলাসঘরের দরজার বাইরে নিল ডাউন হয়ে থাকতে হবে।
ওদের ঘরের কাছাকাছি আসতে ওর চোখে পড়ল, ওদের ঘরের দরজাটা বন্ধ। আরও কাছে এসে দরজায় লাগানো একটা তালাও দেখতে পেল। তার মানে মা ঘরে নেই। থাকার কথা নয়, হারা ইশকুল থেকে ফেরার সময় কোনদিনই থাকে না, কোন একটা বাড়িতে কাজ করতে যায়। হারার পকেটে ঐ তালার আর একটা চাবি রয়েছে। ও রোজই তালা খুলে ঘরে ঢোকে। গুড় মুড়ি রাখা থাকে, তা-ই খায়। ভাত কিম্বা রুটি, আর আলুচচ্চড়ি, সেসব পাওয়া যায় মা ফিরলে পরে, প্রায় দুপুর গড়িয়ে যায় তখন। হারা অবশ্যি গুড় মুড়ি খেয়ে নিয়ে আবার আলুচচ্চড়ি ভাতের জন্যে ঘরে বসে থাকে না। পকেটে কাঁচের গুলি নিয়ে একদৌড়ে কাছের মাঠটায় চলে যায়। মাথার ওপর তখন ঝাঁঝা রোদ, খেলার বন্ধুরাও কেউই তখন আসে না। ও একাই খেলে। কিছুদিন হল বিষুন বলে একটা বিহারী ছেলে ওদের সঙ্গে খেলতে আসছে। ওর মুখটা একটু গোলগাল আর গায়ের রঙ কালো, সবাই মিলে ওর নাম দিয়েছে ভূত কা নাতি। ঐ নামেই ওকে ডাকে সবাই। কিন্তু ভূতই হোক বা তার নাতিই হোক্ ব্যাটা দারুণ গুলি খেলে, ওর হাতের টিপ অসম্ভব ভাল। যদিও হারার হাতের টিপ এখন বেশ একটু পাকা হয়েছে। এ পর্যন্ত একদিনও ও ভূত কা নাতিকে গুলিখেলায় হারাতে পারেনি, সবসময় হেরেছে। অবশ্যি ও একা নয়, সব ছেলেরাই ঐ ভূত কা নাতির কাছে হেরে ভূত হয়ে যায়। বেবি আর বাতাসি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলা দেখে। হারা আর ওর বন্ধুরা যখন ঐ ছেলেটার সঙ্গে খেলায় হারে তখন হাততালি দিয়ে হাসে আর ওদের দুয়ো দেয়।
আজ একা একাই হাতের টিপ অভ্যেস করবে, টিপ পাকা করতেই হবে, ভাবতে ভাবতে আনমনে পকেট থেকে চাবি বার করল হারা। তালায় লাগিয়ে ঘুরোল। চাবি ঘুরল না, তালাটাও খুলল না। কী হল? এরকম তো হয় না।
মাথা নামিয়ে হারা তালাটাকে ভাল করে নজর করে দেখল। এটা ওদের তালাটারই মত, কিন্তু অন্য একটা তালা। তালাটাকে ছেড়ে দিয়ে ও এবার সোজা হয়ে দাঁড়াল। ও বেমালুম বোকা হয়ে গিয়েছে। মা হঠাৎ তালা বদলে ফেলল কেন? আর যদিই বা বদলাল নতুন তালাটার চাবি হারাকে দিল না কেন?
হারা একটা আওয়াজ শুনতে পেল। খুব অস্পষ্ট ক্ষীণ আওয়াজ। ওর মনে হল আওয়াজটা নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের। ওটা ওদের ঘরের ভেতর থেকেই আসছে না? হ্যাঁ, মনে তো হচ্ছে তাই। কিন্তু ব্যাপারটা কী? ঘরের দরজার বাইরে তালা লাগানো অথচ ভেতর থেকে খুব আস্তে, প্রায় বোঝাই যায় না এরকম আওয়াজ। হঠাৎ হারার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ও একটু ভয় পেয়েছে। ভূতুড়ে ব্যাপার নয় তো? কিন্তু এখন তো দিনের বেলা, দিনের আলো থাকতে তো ওসব হয় না। ভাল করে আওয়াজটা শোনবার জন্যে হারা দরজার পাল্লাদুটো একটু ঠেলল। তালাটা খুব টাইট করে লাগানো। পাল্লাদুটো একটুও ফাঁক হল না। হারা তখন দুই পাল্লার জোড়াটায় একটা কান লাগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওই আওয়াজটা কি তা ওকে জানতেই হবে।
কিন্তু হারা ওভাবে বেশিক্ষণ দাঁড়াবার সুযোগ পেল না। সবে কান লাগিয়ে দাঁড়িয়েছে, অন্য কানে একটা জবরদস্ত মোচড় পড়ল। যে লোক ওর কান মুচড়েছে সে ওর মাথাটাকে একটা হ্যাঁচকা টানে দরজা থেকে হাতখানেক দূরে সরিয়েও নিয়েছে।
কিন্তু তাতেই বা কি রেহাই আছে? লতিকামাসি আবার হারার কান ধরল, তাতে পাকের পর পাক, সেই সঙ্গে বকুনি, তালা বন্ধ দরজায় ওভাবে কান লাগিয়ে আড়ি পাতছিলি কেন, হারামজাদা ছেলে? জানিস ওরকম আড়ি পাতলে ছোট ছেলেমেয়েদের কী হয়?
হারার কান লতিকার দু আঙুল সাঁড়াশি হয়ে চেপে ধরে আছে, ওর কথা বলবার মত অবস্থা নেই। ও চুপ করে রইল।
লতিকাই আবার বলল, রাতের বেলা ভূতে ধরে।
হারা এবারও চুপ। ও পরিষ্কার বুঝেছে লতিকামাসি বাজে কথা বলছে, কিন্তু সে কথা তো বলা যাবে না। তাছাড়া এখন ওর ভূতে ধরার ভয় নেই, যে জ্যান্ত মেয়েছেলে ভূতটা ওর কান পাকড়ে ধরেছে, সেটা ওর কান ছাড়লেই ও বেঁচে যায়।
আর কখনো এরকম করবি? লতিকা ওকে জিজ্ঞেস করছে, হারা শুনতে পেল। ও এখন একটা কান দিয়ে শুনছে, লতিকার হাতে ধরা কানটায় খালি ভোঁ ভোঁ আওয়াজ হচ্ছে। ও কোনরকমে মাথা নাড়ল, ও আর কখনো এরকম করবে না।
ওর কান ছেড়ে দিল লতিকা। বলল, এখন আমার ঘরে বোস। আমি একটু শুয়ে নিচ্ছি। তোর মা ফিরে এলে পরে তোকে ছেড়ে দেব।
ঘরের একপাশে চৌকি, তার ওপর বিছানা পাতা। লতিকা তার ওপর লম্বা হল, আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল। কারণ চৌকির ওপর থেকে ভেসে আসা ভোঁস ভোঁস শব্দ হারার কানে আসতে লাগল।
লতিকামাসির ঘরটা ওদের ঘরের থেকে অনেক বড়। চৌকির অন্য দিকটায় মেঝেয় একটা মাদুর পাতা আছে। হারা গিয়ে তার ওপর বসল। লতিকামাসিকে আসল কথাটা বলা হল না। ওদের ঘরের দরজায় অন্য একটা তালা, ঘরের ভেতর ঐ প্রায় না শুনতে পাওয়ার মত আওয়াজ। বলার সুযোগ পেল কোথায়? যেভাবে মায়ের এই বন্ধু কানে পাক লাগিয়েছে — বাপরে বাপ্। তাছাড়া আরও একটা প্রশ্ন হারার মাথায় এসেছিল। মা ফিরলে নাকি মাসি ওকে ছেড়ে দেবে — কিন্তু মা কখন ফিরবে সেটা মাসি জানবে কি করে? দিব্যি তো ভোঁস ভোঁস করে ঘুম দিচ্ছে। তবে একথা মাসিকে জিজ্ঞেস করার ওর সাহস নেই। কানটা বেশ ব্যথা করছে। আবার যদি ধরে পাক লাগায় তাহলে ওটা হয়তো ছিঁড়ে আসবে। কানে একটু জল দিতে পারলে হয়তো একটু আরাম লাগত। লতিকার বড় মেয়েটা পাশের রান্নাঘরে টুকটাক কাজ করছিল। ছোট ভাইদুটোকে হারা দেখতে পাচ্ছিল না, বোধহয় ইশকুল গেছে। মেয়েটাকেও মাসি ইশকুলে দিয়েছিল, কয়েক কেলাসের পর ছাড়িয়ে দিয়েছে। ওকে দিয়ে এখন সব ঘরের কাজ করায় আর নিজে শুয়ে বসে আরাম করে। মেয়েটার সঙ্গে হারার ভাবসাব আছে। রান্নাঘরের দরজায় গলা বাড়িয়ে হারা ওকে ডেকে বলল, এই আরতি, আমাকে একটু জল দিবি রে? কানটায় একটু জল দেব। বড্ড জোরে মুলে দিয়েছে মাসি। আর একটু মুড়িও দিস। জোর খিদে পেয়ে গেছে।
আরতি এ ঘরে এল। হাতে এক গেলাস জল। ওর অন্য হাতে একটা বাটি। জলটা হারার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, এই নে। তারপর বাটিটা হারার পাশে মাদুরের ওপর রাখল। বাটিটা বেশ বড়, তাতে ভর্তি তেল মুড়ি, পেঁয়াজকুচো আর কাঁচালঙ্কার ছোট ছোট টুকরো দিয়ে মাখা। হারার মনটা খুশি হয়ে উঠল। লতিকামসিটা খচ্চর, কিন্তু ওর মেয়েটা বড় ভাল।
হারা কানের ওপর জল দিয়ে তার ওপর আঙুল বোলাল। আঃ, ঠান্ডা জলটা দিয়ে কানে বেশ আরাম লাগছে। তারপর তেলমুড়ি খাওয়ায় মন দিল। আরতি মুড়িটা মেখেছে ভাল। কিন্তু কাঁচালঙ্কার জন্যে বেশ ঝাল। গেলাসের জল সবটা খেয়েও এর জিভ মুখ অল্প অল্প জ্বালা করছিল। ও আরতিকে প্রায় হুকুমের গলায় বলল, এই আর একটু জল দে।
আরতি সাপসিঁড়ি লুডোর ছক মাদুরের ওপর পাতছিল। হারার ফরমাসে বেশ বিরক্ত হল। বলল, ভারি জ্বালাতন করিস তুই। কিন্তু উঠে পড়ল ঠিকই। মুড়ির খালি বাটি আর জলের খালি গেলাস নিয়ে রান্নাঘরে গেল। আবার ফিরে এল ভরা জলের গেলাস নিয়ে।
জলটা পুরো খেয়ে নিয়ে হারা বলল, আঃ, এতক্ষণে মুখের জ্বলুনিটা কমল। তারপর গেলাসটা আরতির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, আয়, এবার খেলি।
লতিকামাসির হাতে ওরকম জবরদস্ত কানমলা খেয়ে হারার মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ও কিছুতেই বুঝতে পারছিল না ওর দোষটা কি ছিল, কেন ওর কানটাকে ওরকম দুরমুশ করা হল। কানটা মাঝেমাঝেই ব্যথায় কটকট করছিল। কিন্তু একবাটি তেলমাখা মুড়ি খেয়ে আর লুডো খেলতে বসে ওর মন খারাপটা কেটে গিয়েছিল। হারা লুডো খেলতে খুব ভালবাসে, কিন্তু ওর খেলার সুযোগ বেশি হয় না। ওর বাড়িতে লুডোর ছক আর ঘুঁটি থাকলে একটা কথা ছিল। বেবি কিম্বা বাতাসি, ওদের কাউকে ডেকে নিয়ে হারা খেলতে পারত। কিন্তু ওর মা তো আর এসব কিনে দেবে না। এই যে ও কাঁচের গুলি কয়েকটা কিনেছে সে তো ইশকুলে জলখাবার কেনার দু-চার পয়সা বাঁচিয়ে তা দিয়ে। বাপ থাকলে হয়তো দিত। কিন্তু বাপ তো বেপাত্তা। কাজেই হারাকে এসব কে কিনে দেবে?
সাপসিঁড়ি খেলতে খেলতেই হঠাৎ একটা প্রশ্ন হারার মাথায় উঁকি দিল। লুডোর ছক থেকে মুখ না তুলেই ও আরতিকে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁরে, আমি ইশকুল থেকে ফিরে এসেছি তা লতিকামাসি জানল কী করে?
আরে আমিই তো মাকে বললাম, আরতি বলল। আমি তো আমাদের ঘরের জানালা দিয়ে তোকে দেখতে পেয়েছিলাম — তুই রাস্তা দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে ইঁটের টুকরো দিয়ে ফুটবল খেলতে খেলতে আসছিলি। তাই শুনেই তো মা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল, তারপর তোকে কান ধরে টানতে টানতে নিয়ে এল।
তার মানে ওর কানের ওপর যে অত্যাচারটা হয়েছে তার জন্যে এই মেয়েটাই দায়ী। হারা লুডোর ছক থেকে চোখ তুলে আরতির দিকে কটমট করে তাকাল। তারপরই আবার চোখ নামাল ছকের দিকে। ওর অবস্থা এখন সঙ্গীন। ওর ঘুঁটিটা লম্বা একটা সাপের মুখে পড়েছিল, সড়াৎ করে নেমে গিয়েছে প্রায় পঞ্চাশ ষাট ঘর। ওদিকে আরতির ঘুঁটি অনেকটাই এগিয়ে আছে, গোটা দুই সিঁড়ি পেয়ে গিয়ে টকাটক ওপরে উঠে গিয়েছে। ও-ই বোধহয় এই দান-টা জিতে যাবে।
লতিকামাসির নাকের ফড়াৎ ফোঁৎ থামল প্রায় ঘন্টা দুই পরে। উঠে বসে জোরে আওয়াজ করে হাই তুলল, তারপর চৌকি থেকে নামল। মাসির ঐ দশাসই লাশ, চৌকি থেকে নামার সময় চৌকিটা মচমচ করে উঠল। হারা ভেতরে ভেতরে রেগে আছে ওর ওপর, মনে মনে বলল, শালী খালি শুয়ে বসে খায় আর মোটা হয়।
লতিকা এবার দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। ওর শাড়ির আঁচলে বাঁধা এক গোছা চাবি, হারা মুখ তুলে তা দেখে নিল। ওর দান ফেলবার পালা ছিল, দান দিতে দেরী হয়ে গেল। আরতি একটা মৃদু ধমক দিল, এদিক ওদিক তাকিয়ে কি দেখিস — দান দিতে দেরি করিস কেন?
লতিকা ফিরল একটু পরেই। একটা হাত আঁচলের তলায় ঢোকান, কিছু একটা ধরে আছে মনে হয়। দান ফেলতে দেরি হলে আরতি বিরক্ত হবে, তবুও হারা আড়চোখে তাকিয়ে লতিকাকে নজর করে দেখে নিল। ওর মনে হল ওদের দরজায় যে তালাটা ঝুলছিল সেই মাপেরই একটা জিনিষ মাসি হাতে করে আঁচলের তলায় ধরে রেখেছে। ঐ তালাটাই কি? হতেও পারে, হারা ভাবল। ওর চাবিটা হয়তো মাসির আঁচলের খুঁটে বাঁধা গোছার মধ্যেই আছে।
ঘরে ঢুকে লতিকা চৌকিতে বসে পড়ল। আবারও শব্দ করে হাই তুলল। তারপর দয়া দেখানো গলায় বলল, ঘরে যা হারা। তোর মা বোধহয় ফিরে এসেছে এতক্ষণে।
হারা সাপসিঁড়ি খেলায় সমানে হেরে যাচ্ছিল। ওর ইচ্ছে ছিল অন্তত একটা দান আরতিকে হারিয়ে দেয়। এই দানটায় ওর ঘুঁটি আরতির ঘুঁটির থেকে অনেকটা এগিয়ে ছিল। ওর ইচ্ছে হচ্ছিল এই দানটা শেষ করে আরতিকে হারিয়ে তারপর ঘরে যায়। কিন্তু আরতিটা বদমায়েসি করল। ওর মায়ের কথা শুনতে পেয়েই তাড়াতাড়ি খেলাটা ভেঙে দিল। বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, এখন ঘরে যা। তোর ফিরতে দেরি হলে আবার সুলোচনামাসির ভাবনা হবে।
ওদের ঘরের দরজা আলতো করে ভেজানো ছিল। হারা চাপ দিতেই খুলে গেল। ও ভেতরে ঢুকল।
ঘরটা অন্ধকার, কারণ জানালাটা বন্ধ। দরজা খুলতে একটু আলো হল। সুলোচনা শুয়েছিল বিছানায়, হারা ঘরে ঢুকতে উঠে বসল। হাত দুটো ওপরে ছড়িয়ে দিয়ে আড়মোড়া ভাঙল। তারপর বলল, হারা এসে গেছিস — জানালাটা খুলে দে তো বাবা।
মায়ের ব্যবহারটা আজ খুব নরম — এরকম বিশেষ হয় না। হারা পায়ের স্যান্ডেল খুলে দরজার কাছে রাখল, কাঁধের বইখাতার ব্যাগ ঘরের কোণে যেখানে ওটা থাকে সেখানে নামিয়ে রাখল। তারপর জানালাটা খুলে দিল। এক ঝলক দুপুরের রোদ এসে ঘরে পড়ল। ও ফিরে তাকাল মায়ের দিকে। সুলোচনা বসেই আছে বিছানাতে, হারাকে বলল, ভাত, ডাল, ভাজা সব রাখা আছে, থালায় বেড়ে নিয়ে খা। একটু থেমে কৈফিয়ৎ দেবার মতো করে আবার বলল, আমার আর উঠতে ইচ্ছে করছে না, শরীরটা ঠিক জুতের লাগছে না। সেজন্যে কাজের বাড়ি থেকে ফিরে এসে একটু শুয়েছি।
মাকে দেখে, মায়ের কথাবার্তা শুনে হারার কিন্তু মনে হচ্ছিল না যে মায়ের শরীর খারাপ। বরঞ্চ কথাবার্তায় কিরকম একটা খুশি খুশি ভাব। ও ভাবল মাকে জিজ্ঞেস করে, আজ দরজায় অন্য তালা লাগানো ছিল কেন? তাছাড়া দিনের এই সময়টায় হারা ফিরে এসে নিজে তালা খুলে ঘরে ঢোকে, মা তো ঘরে থাকে না। আজ মা বিছানায় শুয়ে আছে কী করে? কিন্তু এসব কোন প্রশ্নই করল না। কারণ তাহলেই কথা উঠবে হারা কি করে এত তাড়াতাড়ি ইশকুল থেকে ফিরে এসেছে? এখন কোন একটা মিথ্যে কথা বলে পার পেয়ে যাওয়া যেতেও পারে, কিন্তু কখনো না কখনো ইশকুল পালানো কথাটা বেরিয়ে পড়বেই। ব্যস্, তাহলে আর দেখতে হবে না। মা প্যান্টুল নামিয়ে গরম খুন্তি দিয়ে পেছনে ছেঁকা দেবে। কাজেই এসব প্রশ্ন চেপে যাওয়াই ভাল।
বিকেলে হারা একটু তাড়াতাড়ি খেলতে গিয়েছিল। তখনো কেউ আসে নি, বেবি ছাড়া। ও একা একাই এক্কা দোক্কা খেলছিল। কেউ একজন আসছে টের পেয়ে ও খেলা থামিয়ে মুখ তুলে তাকাল। তারপর বলল, কি রে হারা, আজ এত তাড়াতাড়ি এসেছিস যে?
হারা ভেবেছিল আজ তাড়াতাড়ি গেলে তখনো কেউ আসবে না, গুলি খেলাটা ও একা একা অভ্যেস করবে। কেউ এসে গেলে সে-ও খেলতে চাইবে, হাতের টিপের অভ্যেস করাটা আর হবে না। ও বেবিকে দেখে একটু চটেই গেল। বেবির প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নিজেই একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, তুই এত তাড়াতাড়ি এসেছিস কেন? তোর বাড়িতে কাজ নেই।
বেবির মা নেই, ওর অল্প বয়েসে মারা গেছে। সেজন্যে ওকে অনেক ঘরের কাজ করতে হয়। বাড়িতে আর কোন মেয়েমানুষ নেই, আছে খালি বুড়ো বাপ, আর দুটো বড় বড় দাদা। সেজন্যে এতগুলো লোকের জন্যে রান্না করাটাও ওরই ঘাড়ে চেপে আছে। লক্ষ্মীমণি ওকে খুব পছন্দ করে, সেজন্যে প্রায়ই ওদের বাড়ির সবার জন্যে কোন একটা সব্জী বা মাছ রান্না করে ওদের ঘরে পাঠিয়ে দেয়। বেবির সুবিধে হয়, খালি একটা ডাল, আর খানিকটা ভাত রাঁধলে বা একগোছা রুটি বানালেই ওর কাজ হয়ে যায়। বাতাসি, গৌরা, হারা সবাই এসব কথা জানে। কিন্তু ওরা কেউ এসব নিয়ে বেবিকে কিছু বলে না। বললেই বেবি চটে যায়, আর ঝগড়া করতে শুরু করে দেয়। আজ হারা বেবিকে রাগানোর জন্যে ইচ্ছে করে ওর বাড়ির কাজের কথা জিজ্ঞেস করেছে।
বেবি হারার দিকে একবার কটমট করে তাকাল, তারপর হেসে ফেলল। একটু মিনতি করে অন্য কথা বলল, আজ তোদের সঙ্গে আমাকে গুলি খেলতে নিবি? রোজ রোজ এক্কা দোক্কা খেলতে ভাল্লাগে না।
ওঃ, এই ব্যাপার। আজ শালীর গুলি খেলার শখ হয়েছে, তাই হেসে হেসে কথা বলছে। কিন্তু ওকে খেলতে নিয়ে কি হবে? ও গুলি খেলতে পারে না কি? তুই আবার কি গুলি খেলবি? খুব তাচ্ছিল্য করে হারা বলল। তুই মেয়েছেলে, ওই এক্কা দোক্কাই খেল্।
বেবির এখন চোদ্দ পনেরো বছর বয়েস, যে বয়েসে ছেলেমেয়েরা তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠে। ও বয়েসের তুলনায় বেশ একটু লম্বা, ওর হাতদুটোও লম্বা। চট করে সেই হাত বাড়িয়ে দিয়ে ও হারার মাথায় চটাং করে এক চাঁটি বসিয়ে দিল।
হারারা মাথায় বেশ লেগেছিল। একবার ভাবল বেবিকে ফিরে মারবে, কিন্তু ওর সাহস হল না। বেবিরও হাত পা ভালই চলে, ওর গায়ে জোরও আছে যথেষ্ট। ও একটু সরে গিয়ে নিজের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে চেঁচিয়ে বেবিকে গাল দিল, শালী শয়তান মাগি, আমাকে মারলি কেন?
বেবি আবারও হাত বাড়িয়েছিল, হারাকে আর একটা চাঁটি বসাবে বলে। পারল না। এবার হারা সতর্ক ছিল। লাফ মেরে বেবির নাগালের বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। বেবি একবার ভাবল ওকে তাড়া করে, কিন্তু তারপরেই ও ভাবনা মন থেকে তাড়াল। হারা ভাল ছুটতে পারে, ওর পেছনে দৌড়ে ওকে ধরা যাবে না। ও হারার ওপর চেঁচাল, তুই আমাকে গাল দিচ্ছিস কেন, শুয়োর কোথাকার? আর আমাকে খেলতে নিবি না বলছিস কেন? তুই কি ভাবিস আমি গুলি খেলতে পারি না? আমি তোদের অনেকের চেয়ে ভাল খেলতে পারি।
এ্যাঃ, বাজে কথা — বলার সাথে সাথে দু হাতের বুড়ো আঙুল দেখাল হারা। তুই খেলতে পারিস না কচু।
বিশ্বাস হচ্ছে না? বেবি বলল। আচ্ছা এই দ্যাখ।
বেবির ফ্রকের দুদিকে দুটো পকেট। ডান দিকেরটায় হাত ঢুকিয়ে ও দুটো রঙচঙে মার্বেল গুলি বার করে আনল। তারপর ঐ ধুলোময়লা ভরা রুক্ষ্ম মাঠে নিলডাউন হয়ে বসে পড়ল। ওর ফ্রকের সামনের দিকে পুরো নিচটায় ধুলো লেগে নোংরা হয়ে গেল, ও তাতে কোন মাথাই ঘামাল না। মাটির ওপর একটা গুলি গড়িয়ে দিল, বেশ খানিকটা গড়িয়ে গিয়ে সেটা থেমে গেল। ও তখন বাঁ হাতের মাঝের আঙুলটায় অন্য গুলিটা লাগিয়ে নিয়ে ডান হাতের দুটো আঙুল দিয়ে গুলিসুদ্ধ বাঁ হাতের মাঝের আঙুলটা পেছন দিকে টেনে ধরল, বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল টান করে রেখে তার ডগাটা উল্টো করে নিজের উরুর ওপর চেপে ধরল, আর ডান হাতের আঙুলগুলো ছেড়ে দিল। গুলতি থেকে ছিটকে বেরোনোর মতো ওর আঙুল থেকে গুলিটা ছুটে গেল, সোজা গিয়ে লাগল মাটিতে রাখা গুলিটাতে।
হারার চোখ গোল হয়ে গেল। বেবির হাতের টিপে এত ভাল! এ যে একেবারে ঐ ভূত কা নাতির মতো। চট করে ওর মাথায় খেলে গেল, বেবির সঙ্গে জোড়ি বেঁধে খেলে দেখলে হয়। তাহলে বোধহয় ভূত কা নাতি ওদের হারাতে পারবে না। কিন্তু বেবিকে সে কথা বলতে গিয়ে অন্য একটা কথা ওর মাথায় এল, সেটাই ওকে বলে ফেলল, তুই খাসা নিলডাউন হয়ে বসতে পারিস তো?
বেবি দাঁড়িয়ে উঠে ওর ফ্রক থেকে ধুলো ঝেড়ে ফেলছিল। মুখ বাঁকিয়ে নিচের ঠোঁট উল্টে জবাব দিল, ও আমার অভ্যেস আছে।
হারার কৌতূহল বেড়ে যাচ্ছিল। বেবি গুলি খেলার সাথে সাথে নিলডাউন হওয়াও অভ্যেস করেছে? কেমন করে? — ও বেবিকে জিজ্ঞেস করল।
ইশকুলে আমাকে প্রায়ই নিলডাউন হতে হয় — আবারও তাচ্ছিল্যে মুখ বাঁকিয়ে দিল বেবি। আমি তো শেষের বেঞ্চিতে বসে মাস্টারনিকে মুখ ভ্যাংচাই, জিভ দেখাই। মাঝে মাঝে মাস্টারনি দেখে ফেলে। আর দেখতে পেলেই দরজার বাইরে নিলডাউন করে বসিয়ে দেয়।
ওর কথা শুনে হি হি করে হাসছিল হারা। বেবি ওকে ধমকে উঠল, দাঁত বার করে উল্লুকের মতো হাসিস না। আমাকে আজ তোদের সঙ্গে গুলি খেলতে নিবি কিনা বল্!
হারা হাসি থামাল, কিন্তু বেবির কথার জবাব দিল না। ওর মাথায় হঠাৎ অন্য একটা চিন্তা এসেছে। আজ ইশকুল থেকে ফিরে ওর একটা আজব অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা ওর মনে বেশ কয়েকটা প্রশ্ন তৈরি করেছে। তার কোন জবাব ও পায় নি। ঐ প্রশ্নগুলো মাঝেমাঝেই ওকে খোঁচাচ্ছিল — বার কর, এসবের উত্তর বার কর। ঐ অভিজ্ঞতাটার ঘটনাগুলো এখন আবার ওর মাথায় এসেছে, সেই সঙ্গে এসেছে একটা নতুন ভাবনা। আচ্ছা, বেবিকে ঘটনাটা বললে কেমন হয়? বললে কি ও হারাকে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিতে পারবে? এখন শেষ দুপুরের রোদ ধূ ধূ করছে, দূরে এককোণে ঐ লম্বা ঝাঁকড়া গাছটা ভূতের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে, মাঝে মাঝে অল্প অল্প গরম হাওয়া দিচ্ছে, তাতে ওদের পায়ের নিচের মাঠের ধুলো উড়ে উড়ে যাচ্ছে, চারধারে হারা বেবিকে ছাড়া আর কোন মানুষজন দেখতে পাচ্ছে না — দুম করে হারা ঠিক করে ফেলল বেবিকেই সব কথা বলবে। বেবি ওদের সকলের চাইতে বয়সে বড়, অনেক কিছু জানে বোঝে, ইশকুলে মাস্টারনিকে জিভ দেখিয়ে মুখ ভ্যাংচানোর সাহস রাখে। মাকে এসব কথা জিজ্ঞেস করলে মা পিঠের ছাল ছাড়িয়ে নেবে। লতিকা মাসিকেও বলা চলবে না — মাসি কান ছিঁড়ে নেবার চেষ্টা করবে। বেবির থেকে তো ওসব কোন ভয় নেই। দেখাই যাক না ওকে ব্যাপারটা বলে।
এই শোন্, তোকে একটা কথা বলব, হারা বেবিকে বলল। কিন্তু খবরদার, আর কাউকে একথা বলবি না।
বেবি ওর দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল। ও বলতে যাচ্ছিল, তোর আবার এমন কি কথা? কিন্তু বলল না। ওর কৌতূহল হয়েছে হারার গোপন কথাটা জানবার জন্যে। আচ্ছা বল্, ও বলল হারাকে।
না, আগে বল আর কাউকে বলবি না।
বেবি অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছিল। ঠিক আছে, ঠিক আছে, বলব না — ও বলল। এবার বল্ কি কথা।
হারা বেবিকে বলল সব কথা। ঘরের দরজায় একটা অচেনা তালা, ঘরের ভেতর খুব ক্ষীণ অস্পষ্ট আওয়াজ, লতিকামাসির এসে কান ধরে নিজের ঘরে টেনে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখা। তারপর বেবিকে জিজ্ঞেস করল — এ সব ব্যাপার কি হল রে?
ব্যাপারটা যে আসলে কি তা বেবি আগে থেকেই জানত। এসব খবর চাপা থাকে না। বেবি সব শুনছে ওখানকার মেয়েমহলের কেচ্ছা থেকে। বেবির অবশ্য এখনও মহিলাদের আসরে ঢুকে এসব কেচ্ছা শোনার বয়েস হতে একটু দেরি আছে। এসব বয়েসের মেয়েরা সাধারণত মেয়েমহলের আসরে ঢুকতে গেলে ধমক খায়। কিন্তু বেবির বাড়ন্ত গড়ন, ওর চেহারা দেখে ওর বয়েসের থেকে ওকে অনেকটা বড় মনে হয়। কাজেই সে সব আসরে ও জায়গা পেয়েছে আর সব ব্যাপারটা জেনে নিয়েছে। হারার মা একজন পীরিতের লোক জুটিয়েছে। সেই লোক মাঝে মাঝে ওর ঘরে আসে। হারা যে সময়ে ইশকুলে থাকে সেই সময়। সুলোচনা তাকে ঘরে ঢুকিয়ে নিয়ে দরজায় খিল দেয়। লতিকা ওকে সাহায্য করে। দরজায় খিল দেবার আগে সুলোচনা ওর ঘরে গিয়ে ওকে ইঙ্গিত দিয়ে আসে, ও নিজের একটা তালা নিয়ে গিয়ে বাইরে থেকে সুলোচনার ঘরের দরজায় লাগিয়ে দেয়। কয়েক ঘন্টা পরে আবার সেটা খুলে দেয়। সুলোচনার ভাবের লোক চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যায়। হারাদের পড়শি মেয়েদের মধ্যে এ ব্যাপারটা নিয়ে খুব জোর তর্কবিতর্ক হয়েছে। অনেকেই বলেছে এরকম কুচরিত্তিরের মেয়েমানুষকে আর ওদের ওখানে থাকতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু সুলোচনাকে ওখান থেকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা করে কে? লতিকা যে ওর পক্ষে রয়েছে। ওখানকার মেয়েদের বেশিরভাগই দরকার পড়লে লতিকার থেকে শ-দেড়শ টাকা ধার নিয়ে থাকে। সেই লতিকাকে চটানো কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে? তাদের ঘরের পুরুষরাও সুলোচনার কেচ্ছা শুনেছে, মেয়েরাই নিজের নিজের কর্তাদের বলেছে। পুরুষরাও সবাই তাদের গিন্নীদের সঙ্গে একমত হয়েছে, বলেছে, ঠিক ঠিক, ওকে এখান থেকে তুলে দেয়া উচিত। কিন্তু কাজে কেউ-ই এগোয় নি। বরঞ্চ নিজের মনে মনে ভেবেছে — আহা, সুলোচনা যদি তাকেও কখনো-সখনো ওর ঘরে এইভাবে ঢোকবার সুযোগ দিত।
বেবি হারাকে বলল না যে ও হারা বলবার আগেই এই ব্যাপারটা জানত। বরং মুখ গম্ভীর করে এমনভাবে হারার কথা শুনে গেল যে মনে হল এই প্রথম এসব কথা শুনছে। হারার সব কথা শুনে নিয়ে বিজ্ঞের মতো বলল, ঘরে তোর মা ছিল।
মা? হারা অবাক হল। কিন্তু অন্ধকার ঘরে মা কি করছিল? আর দরজার বাইরে ওরকম একটা অচেনা তালাই বা এল কি করে?
তালাটা তোর লতিকামাসি লাগিয়েছিল। ও-ই বাইরে তালা লাগায় আবার খুলে দেয়। তুই ইশকুল থেকে ফেরার আগেই খুলে দেয়। তোর মা তখন আবার দরজায় নিজেদের তালা লাগিয়ে কাজে বেরিয়ে যায়। আজ তুই ইশকুল থেকে অনেক তাড়াতাড়ি ফিরেছিস বলে দরজায় তোর লতিকামাসির তালা দেখতে পেয়েছিস।
কিন্তু কেন? মা যদি ঘরের ভেতরেই ছিল তাহলে লতিকামাসি দরজার বাইরে তালা লাগিয়ে মা-কে ঘরে বন্ধ করেছিল কেন?
আরে বুদ্ধু, এটাও বুঝলি না? তালাটা লাগানো হয় যাতে বাইরে থেকে কোন লোক এসে বিরক্ত না করে। তোর মা ঘরের ভেতর বেবুশ্যেগিরি করছিল কিনা! ঘরের ভেতর একটা লোক ছিল।
হারা একদম বোকা হয়ে গেল। বেবুশ্যেগিরি? সে আবার কি?
হারার প্রশ্ন শুনে বেবি হারার চোখে চোখ রেখে বেশ কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল। কিছু একটা ভেবে নিচ্ছে — ওর চাউনি থেকে হারার সেরকমই মনে হল।
এদিক ওদিক একবার তাকাল বেবি। এখনও আর কেউ খেলতে আসে নি, এখানে খালি ওরা দুজনই আছে, ধারেকাছে আর কেউ নেই। তবুও গলা নামাল বেবি, হারাকে বলল, তুই এক কাজ কর। কাল ইশকুল থেকে ফিরে খেয়েই চটপট আমাদের ঘরে চলে আয়। আমি ঘরে একা থাকব, বাকি সবাই কাজে বাইরে থাকবে। তখন তোকে সবকিছু বুঝিয়ে দেব।
একটু থেমে আবার বলল, খবরদার, কাউকে বলবি না যে আমি তোকে আমাদের ঘরে আসতে বলেছি। যদি বলিস তাহলে কিছুই তোকে বোঝাব না, আর পিটিয়ে তোর পেছনের চামড়া তুলে দেব।
হারা আরও অবাক হয়ে গেল। ওদের ঘরে হারাকে কি বোঝাবে বেবি? বেবি কি ওকে কোন কথা বলবে। কি এমন কথা যে এখানে এখন বলা যাবে না? কিন্তু এখন বেবিকে কিছুই জিজ্ঞেস করল না হারা। বেবি চটে যেতে পারে। আর চটে গেলে ও কিছুই বলবে না, আর হারার-ও কিছু বোঝা হবে না। ও ঘাড় নেড়ে বেবির কথায় রাজী হয়ে গেল। পরের দিন দুপুরে ও বেবিদের ঘরে যাবে, আর এসব কথা কাউকে বলবে না।
আজ গুলি খেলা জোর জমে গিয়েছিল। গৌরা, জগা, লালন, ভূত কা নাতি, ওরাও সবাই ছিল। খালি বাতাসি হাঁড়ির মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে ওদের খেলা দেখছিল। ও এই খেলা খেলতে পারে না। হারা কিন্তু খেলায় মন দিতে পারে নি, খালি খালি হেরে যাচ্ছিল। বেবির কথা ওর মাথায় ঘুরছিল। ওর মা কি সত্যি ঘরের ভেতর ছিল? বিশ্বাস হয় না। বেবুশ্যেগিরি — ব্যাপারটা কি? বেবি বলল, ঘরে নাকি লোক ছিল। যাঃ, তা কখনই সত্যি নয়। বেবি এসব জানল কি করে? ও বোধ হয় কিছুই জানে না — ঢপের চপ দিচ্ছে। কিন্তু ও যদি সত্যি সত্যিই ব্যাপারটা জানে? যদি ও সত্যি কথা বলে থাকে? তাহলে — তাহলে, লোকটা কে? সেই লোক কি? ওই যে ঢ্যাঙামত চেহারা — ঠাকুমার বাড়ি থেকে ফেরার সময় ইস্টিমারে, বাসে মায়ের সঙ্গে কথা বলছিল, ওদের ট্রেনের টিকিট কেটে দিয়েছিল?
রাতে শুয়েও হারার ঘুম আসতে চাইছিল না। লতিকামাসির কানমলার ব্যথাটা এখনও পুরোপুরি যায়নি। পাশে শুয়ে মা দিব্যি ঘুমোচ্ছে, নাক থেকে মাঝে মাঝে বেশ ঘড় ঘড় আওয়াজও বেরোচ্ছে। কাল দুপুরে বেবি নাকি ওকে সব কিছু বোঝাবে। ওকে কি বোঝাবে বেবি?
পরের দিন সকালটা, ইশকুলের সময়টুকু হারা আনমনা হয়ে রইল। বেবিদের ঘরে যাওয়ার সময় যত এগিয়ে আসছে ওর কৌতূহল তত বাড়ছে — ওর মনে এখন আর কোন চিন্তার জায়গা নেই। আবার সেই সঙ্গে একটা সন্দেহও ক্রমে জোরালো হয়ে উঠছিল — সত্যিই বেবি ওকে কিছু বোঝাবে তো? না কি খালি ওকে বোকা বানাচ্ছে, হারা ওদের ঘরে গেলে হি হি করে হাসবে আর বলবে — কিচ্ছু বোঝাবার নেই, কেমন ঠকান ঠকিয়েছি তোকে। ওকে কিছু বিশ্বাস নেই, ও যেরকম বিচ্ছু। কিন্তু ওদের ঘরে না গেলে তো আর ওর মতলবটা বোঝা যাবে না। গিয়ে দেখাই যাক না ওর পেটে কি আছে — শয়তানি করার ইচ্ছে না অন্য কিছু। এই যে চিন্তাটা এখন হারার মাথায় চেপে বসে আছে, তার থেকে তো রেহাই পাওয়া যাবে।
বেবির কথামতোই কাজ করেছিল হারা। ইশকুল থেকে ফিরে কোনমতে একমুঠো মুড়ি চিবিয়ে নিয়ে দৌড়েছিল বেবিদের ঘরে। বেবি ঘরে একাই ছিল, আগের দিন হারাকে যা বলেছিল তাই। হারাকে ঘরে ঢুকিয়ে নিয়ে ছিটকিনি লাগিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল বেবি।
তারপর বেবি যা কিছু করেছিল সেসব হারার তখন বড় অদ্ভুত লেগেছিল। কেন বেবি ওসব করছিল তা হারা কিছুই বলতে পারে নি। বেবি ওর শরীর নিয়ে এক আজব খেলা খেলছিল, ও এত অবাক হয়ে গিয়েছিল যে ওর মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোচ্ছিল না, কেন বেবি ওসব করছে তা জিজ্ঞেস করা তো দূরের কথা। ওর নিঃশ্বাস ঘন ঘন পড়ছিল, ওর দু কান গরম হয়ে উঠে ঝাঁ ঝাঁ করছিল, বুকের ভেতর কিরকম দুপদাপ করছিল। শরীরে একটা আশ্চর্য নতুনরকম সুখের সোয়াদ, সেটাও টের পাচ্ছিল হারা। কিন্তু সেই সঙ্গে একটা তীব্র লজ্জা আর অপরাধবোধ ওকে চেপে ধরেছিল। ওর হাত পা কিরকম অবশ আর ভারী লাগছিল, ওর মনে হচ্ছিল ওগুলো ও আর নাড়তে পারবে না।
তবে এরকম অবস্থা বেশিক্ষণ চলে নি। বেবি হঠাৎ ওকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। বলেছিল, দূর, তুই এখনও বড্ড ছোট। তোকে এসব বোঝানো যাবে না। যা, বাড়ি যা।
বেবি ওর প্যান্টুলের বোতাম সব খুলে দিয়েছিল। বোতাম লাগাতে লাগাতে হারা বেবিদের ঘর থেকে বেরিয়ে আসছিল। দরজা খোলবার জন্যে ছিটকিনিতে হাত দিয়েছে, পেছন থেকে বেবির গলার আওয়াজ শুনতে পেল, আর শোন, এসব কথা কাউকে বলবি না। খবর্দার।
হারা ওর কথার কোন জবাব না দিয়েই বেরিয়ে এসেছিল। সোজা নিজেদের ঘরে চলে গিয়েছিল। কিন্তু বেবিদের ঘরে আসার সময় এসেছিল তাড়াহুড়ো করে, প্রায় দৌড়ে দৌড়ে। এখন ঘরে ফিরল আনমনে — আস্তে আস্তে হেঁটে। ওর মাথায় তখন একটাই চিন্তা — বেবি ওসব কি করল? কেন করল?
সেদিন বিকেলে বেবি খেলতে এলো না। হারা ভেবেছিল দুপুরের ঐ ব্যাপারটার পর বোধহয় ওর মেজাজ খারাপ হয়েছে, তাই বিকেলে আসে নি। পরের দিন ঠিক এসে হাজির হবে। কিন্তু পরের দিনও বেবি এল না। তার পরের দিনও না। তারপর বাতাসি খবর আনল। ও জেনেছে ওর মা, অর্থাৎ লক্ষ্মীমাসির থেকে। বেবিরা ওখান থেকে উঠে গেছে, অনেক দূরে কোথায় চলে গেছে। বেবি আর এখানে খেলতে আসবে না।
বেবিদের ওখান থেকে চলে যাওয়া তখন হারার মনে কোন দাগ কাটতে পারে নি। একজন খেলার বন্ধু চলে গেছে, তাতে কি? আর একজন কখনও না কখনও এসে জুটে যাবে। আর হয়েছিলও তাই, নতুন নতুন সব ছেলে এসে গিয়েছিল ওদের দলে। কিছুদিনের মধ্যে বেবির কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল হারা।
বেবির কথা ওর নতুন করে মনে পড়তে শুরু করেছিল বেশ কয়েক বছর পরে। তখন ওর সেই বয়েস যখন ছেলেদের গলা ভাঙতে শুরু করে, ঠোঁটের ওপরে নাকের নিচে হাল্কা লোমের আভাস দেখা দেয়, যখন তারা চার পাশের হাওয়া বাতাস থেকেই ছেলে আর মেয়েতে তফাৎ কি এবং কেন তা জেনে যায়, যদিও অনেক ভুলভাল কথাও তাদের মাথায় জায়গা করে নেয়। বেবির ঐ ব্যবহারের অর্থ তখন ওর কাছে একেবারে পরিষ্কার। তখন বার বার ওর মনে হয়েছে, ইস্, বেবিটা যদি এখন এখানে থাকত! খেলাটা যদি ওর সঙ্গে আবার একবার খেলা যেত। আপশোষ, বড় আপশোষ, বেবি এখন আর এ তল্লাটে নেই। ওর মায়ের ব্যবহারটাও ওর কাছে তখন পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। ও জেনে ফেলেছিল যে ঐ ইস্টিমার আর ট্রেনে আসা লোকটাই ওর মায়ের কাছে ভরদুপুরবেলায় আসত। আসত, এখন আর আসে না। তার কারণ কয়েকবছর ওদের ঘরে ওরকম ব্যাপার চলেছিল, তারপর ওসব বন্ধ হয়ে গিয়ে আবার নিজে থেকেই পুরোনো ব্যবস্থা চালু হয়ে গিয়েছিল। মাঝের ঐ কয়েক বছর মায়ের মেজাজটা একটু নরম হয়ে গিয়েছিল। তারপর আবার যে কে সেই, আগের মতই খিটখিট, খালি খিটখিট।
বেবির বিছানায় শুয়ে হারা চোখ বুজে পুরোনো কথা ভাবছিল। হঠাৎ ওর মুখ দিয়ে অঁক করে একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল, চোখও খুলে গেল। বেবি কখন খাটে উঠে এসে ওর পাশে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছে, হারা টের পায় নি। বেবি ওর নাকের ডগায় একটা ছোট কিন্তু জোরালো কামড় বসিয়ে দিয়েছে। হারা হাত দিয়ে নাক ডলতে ডলতে বেশ একটু রাগ রাগ গলাতে জিজ্ঞেস করল, কি হল, হঠাৎ আমার নাক কামড়ে দিলি কেন?
বেবির সারা মুখে একটা দুষ্টু হাসি। ও বলল, রাগ করিস না। তোর নাকটা দেখে এমন লোভ লাগল যে নিজেকে সামলাতে পারলাম না। চোখ বুজে শুয়ে কি ভাবছিলি রে?
তোর কথাই ভাবছিলাম, হারা বলল। ও হাত দিয়ে নাক ডলা থামিয়ে হাত নাক থেকে নামাল। নাকে কামড়ের যে ব্যথাটা লেগেছিল তা এখন একটু কমে এসেছে। তারপর বলল, তোর সঙ্গে সেই শেষ দিনের দেখা হওয়ার কথাটা, তোর সঙ্গে সেই একটা খেলার কথা, যেটা তুই শেষ হবার আগেই ভেঙে দিয়েছিলি।
হি হি করে হাসতে লাগল বেবি। হাসতে হাসতেই খাটের এপাশ থেকে ওপাশে গড়াতে লাগল। তারপর হাসি থামিয়ে হারার বুকের ওপর লম্বা হয়ে ওর মুখোমুখি হয়ে শুয়ে পড়ল। বলল, সত্যি, কি বোকাই না তখন ছিলি। তা এখন তো তুই জোয়ান মরদ, বিয়েটিয়েও করেছিস নিশ্চয়ই, তার মানে খেলাটা তো এখন ভাল করেই শিখে গেছিস। আয়, সেদিনের খেলাটা আজ শেষ করি।
বেবির শরীরটা বেশ ওজনদার, হারার দম নিতে একটু কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু ওর বড় ভাল লাগছিল বেবিকে এভাবে বুকে নিতে। বেবির মুখটা ঠিক ওর মুখের ওপর — ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হারা ওর ঠোঁটে ঠোঁট রাখল।