বিকেলের রোদে ক্লাবের ঢালু ছাত চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। বিলিয়ার্ড টেবিলে বলের শব্দে ওক গাছের পাখিরা এয়ারপ্লেনের মত একসঙ্গে আকাশে উড়ছিল। পশ্চিমে পাহাড়ের মাথায় তখনও হলুদ আভা, নীচে উপত্যকায় অন্ধকার নেমে আসছে শুরু করেছে, মাথার উপর মোমের মত চাঁদ। আমি বসেছিলাম সেইখানেই, আমার পুরনো জায়গায়, লাইব্রেরির পার্টিশনের পিছনে, যেখানে সাহেবজীর সঙ্গে বসতাম। ক্লাবের কথাবার্তার আওয়াজের মধ্যেই তাঁকে টমাস হার্ডি বা জর্জ এলিয়টের উপন্যাস পড়ে শোনাতাম। অর্ধেক চ্যাপ্টার শুনেই তাঁর ছড়ি দোলানো শুরু হত—ব্যাস, এটা বন্ধ করো, অন্য কিছু পড়ো।
এখন তিনি নিজের ঘরে, নিজের ভিতরের আওয়াজ শুনছেন, আর আমি বাইরে এখানে, সারা দুনিয়ার শোরগোলের মাঝে। বাইরে বেঞ্চিতে তিনটে লোক আপন আপন গেলাসে মগ্ন। বার-ম্যান হিম্মত সিং গেলাস ধুচ্ছিল— প্রতিটি গ্লাস যত্ন করে মুছে এক চোখ বুজে কাঁচটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখত, কোনও ময়লা দাগ না থেকে যায়। টিনের ছাতে গাছের ডালের ঠকাঠক শব্দ জানান দিত যে হাওয়ায় বুড়ো ওক গাছটা দুলছে।
নিরঞ্জনবাবু ঢুকতেই আচমকা সব চুপ। আমাকে খুঁজতে হল না। হিম্মত সিং-এর চোখ দেখেই বুঝে গেলেন আমি কোথায় বসে আছি। চটপট আমার কাছে এসে হাতের থলে আর পুঁটলিগুলো নামিয়ে রাখলেন।
“অনেকক্ষণ থেকে বসে আছো বুঝি?”
“না, এই একটু আগেই এলাম।”
আমি তাঁকে দেখছিলাম। দাড়ি আরও একটু সাদা হয়েছে, গলার নীচে চামড়া একটু থলথলে। কিন্তু চোখ আরও প্রাণবন্ত, যেন ছাইচাপা স্ফুলিঙ্গ। চেয়ার টেনে বসে পড়ে হিম্মত সিংকে ডেকে নির্দেশ দিয়ে আমার দিকে ফিরলেন। “আজ হুইস্কি অর্ডার করছি...” তারপরই ভুলে গেলেন কী বলছিলেন। পাইপ আর লাইটার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। হিম্মত সিং দু গেলাস পানীয় আর আইস-বক্স টেবিলে রাখতেই ঢকঢক করে আধ গেলাস গলায় ঢেলে টিসু পেপারে মুখ মুছলেন... “আমি তোমার কাছে মাফ চাইতে এসেছি।”
“কীসের মাফ?” আমি অবাক।
“আমি জানি তোমার উপর কীরকম ঝড় বয়ে গেছে...কিন্তু আমি আসতে পারিনি। জানতাম না যে এরকম হবে বা হতে পারে... কিছু হয়েছিল কি, কোনও রকম শক?”
“না, সেরকম কিছুই না। কিন্তু গত কয়েকদিন তাঁর চালচলন বোঝা যাচ্ছিল না। কখনও কখনও একা বেরিয়ে পড়তেন, মুরলীধর গিয়ে খুঁজে বার করত —কোনও বেঞ্চে বসে আছেন বা গাছের তলায় ঘুমিয়ে, ওঁর বোধ ছিল না উনি বাড়ির ভিতরে না বাইরে।”
“এমনি হঠাৎ? কিছু হয়েছিল নিশ্চয়ই?”
আমি কী বলি? কোনও সময়ে বা ঘটনার উপর আঙুল রেখে বলা যায় ঠিক এই সময়ে একজন চেনাজানা নিরাপদ রাস্তা ছেড়ে একেবারে অজানা পথে চলতে শুরু করে?
বিলিয়ার্ড রুম থেকে দুই যুবক বার-এ এসে আমাদের কোনাকুনি একটা টেবিলে বসল। এই ঠাণ্ডাতেও তাদের পরনে শুধু টি-শার্ট। হিম্মত সিং ওদের টেবিলে দুটো বিয়ার আর গেলাস রেখে দিল।
“আপনি সত্যিই যাচ্ছেন?”
“আপেলের সিজন শেষ... আর ওদের চিঠি আসছে, জানতে চায় আমি কবে আসছি। আমি আর কতদিন ওদের ঠেকিয়ে রাখি?”
“ফিরবেন তো?”
উনি চুপ করে গেলাসের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
“এতদিন আপনার দেখা পাইনি, আমি ভেবেছিলাম আপনি চলে গেছেন।”
“চলে গেছি?” উনি হাসলেন। গেলাসে একটা ছোট্ট চুমুক, “এই কটা দিন তো এখানে আছি...যখন কিছু করার থাকে না। ...আমি ভেবেছিলাম তুমি আসবে আরেকবার, তোমায় দেখাব।” তাঁর চোখে ঝিলিক।
“কী দেখাবেন?” আমি শুধোলাম।
“গেস্ট হাউস। যেখানে তুমি এক রাত ছিলে। এখন আর আগের মত ব্যারাক নেই...পুরো একটা অবজারভেটরি হয়ে গেছে। আমি একটা টেলিস্কোপ লাগিয়েছি, আমার এক বন্ধু প্যারিস থেকে আনিয়েছিল। অনেক বছর আগে এসেছিল এখানে একবার... আমার কুঠিটা এত উঁচুতে দেখে বলেছিল এটা ওর সবথেকে প্রিয় জায়গা। বলত এখানে তুমি দিনের বেলাতেও তারা দেখতে পারো।” গেলাস শেষ করে আবার হিম্মত সিংকে ডাকলেন, দ্বিতীয় গেলাস আসার পর আবার শুরু করলেন, “আমারই ভুল... ফিলসফির বদলে আমার অ্যাস্ট্রোনমি পড়া উচিত ছিল। রাতে যখন আকাশগঙ্গা আর সপ্তর্ষি দেখি, কান্ট আর হেগেল শূন্যে মিলিয়ে যান।”
আমি বুঝতে পারছিলাম না উনি কী জানতে চাইছেন, কীসের সম্বন্ধে? তারপর মনে পড়ল, সেই সম্বন্ধে, যা জানবার জন্য উনি এত বছর এখানে কাটিয়েছেন।
কিছুক্ষণ আমরা চুপ করে ড্রিংক নিয়ে ব্যস্ত।
“মেহরা সাহেবের সঙ্গে দেখা হল না... এই আফসোস। হঠাৎ কী করে হল? ...”
“না, সেরকম কিছু নয়। একদিন সকালে বিছানা থেকে উঠতে পারলেন না... বাঁ দিকে স্ট্রোক ...কিছু বলতেও পারেন না।”
“কিছু হয়েছিল নিশ্চই...না এমনিই হঠাৎ?”
“কিছুই না। তিয়া চলে যাবার পর একটু চুপচাপ থাকতেন। আমাকেও নিজের গল্প আর বলতেন না ...শুধু একবার তাঁর প্রথম স্ত্রীর সম্বন্ধে বলতে গিয়ে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন...”
নিরঞ্জনবাবু চুপ করে বসেছিলেন। আমার কথা শুনছিলেন কি?
একটু পরে মুখ থেকে পাইপ বের করে আমার দিকে চাইলেন।
“আমাদের মধ্যে মেহরা সাহেবই সবচেয়ে সৌভাগ্যবান। তাঁকে আর বিরক্ত করার দরকার নেই। উনি আগে থেকেই সব তৈরি করে রেখেছেন।”
“কী তৈরি?”
“পৃথিবী ছাড়ার। কতজন এরকম করতে পারে, বল তো?”
কে জানে... কাজটা কি অত সহজ? বেঁচে থাকার সময়েই যাবার গোছগাছ শুরু। যেন সে যেকোনও দিন সেই অন্তিম যাত্রায় বেরিয়ে পড়বে আর বাড়ির লোকেরা টেরও পাবে না, ভাববে সে তার ঘরে শুয়ে আছে।
“জানো, কেন আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসিনি?”
নিরঞ্জনবাবুর মুখে এক বিচিত্র হাসি, যেন মাটি থেকে একটা ছায়া বার হচ্ছে, দর্শককে বিচলিত করে দেওয়ার মত হাসি। “আমায় দেখলে উনি থেমে যেতেন, এত সহজে হারিয়ে যেতেন না। সব স্মৃতি মনে পড়ত যা সুখের দিনের সঙ্গে জড়ানো। আমায় দেখে তাঁর আরও মনে পড়ত যেসব কাজ অসম্পূর্ণ রেখে দিয়েছেন।”
“অসম্পূর্ণ কেমন?”
“সুখ কি কখনও সম্পূর্ণ হয়?” উনি মৃদু হাসলেন, “আমি যখন এখানে প্রথম আসি, ভেবেছিলাম আমার নীচের জীবন সমাপ্ত...আবার সবকিছু নতুন করে শুরু করব...নতুন করে?” তিনি আমার দিকে তাকালেন, “এর থেকে বড়ো প্রতারণা আর নেই... যেখান থেকেই শুরু করো, তার গোড়াটা বাঁধা আছে অন্য কোনও গোড়ায়। এমন কি জন্মের সময়টাও 'শুরু' নয়, কে জানে সঙ্গে কত পুরনো পুঁটলি জড়ানো থাকে ...”
উনি কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন, মুখে একটা আবছা ভাব। কিন্তু হাসিটা তখনও সেরকমই, দাড়িতে আটকানো এককুচি বরফের মত। আমার একটু ভয় হল। তিনি গেলাসটা নামিয়ে রেখে আমার সামনে সরে এলেন, একেবারে সামনে... তাঁর নিঃশ্বাস আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল, না, নিঃশ্বাস নয়, তাঁর কথাগুলো, খুব নী্চুস্বরে তাঁর সমস্ত শরীর থেকে বার হচ্ছিল।
“পুঁটলি... জন্মান্তরের পুঁটলি। জানো, কারুকে সাধু হবার আগে কী করতে হয়? তার জন্মের পুঁটলিটা গঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়, সেই জন্ম শেষ হয়ে যায়, সে যা ছিল সব ভুলে যায়।” কিছুক্ষণ চুপ করে আবার শুরু করলেন, “বিস্মৃতি, ভুলে যাওয়া আমরা অনুচিত বা দুর্বলতা মনে করি কিন্তু এটা একটা বিরাট বরও বটে। তোমার মেহরা সাহেব তাই-ই করছেন। তোমার কষ্ট হচ্ছে জানি, কিন্তু আমি বলব এই সময় তাঁকে একলা ছেড়ে দেওয়াই উচিত। এতে তাঁর উপকারই হবে।”
“আপনি কী বলছেন?”
“তুমি কিছুই জানো না।” উনি হিম্মত সিংকে ডেকে আমাদের খালি গেলাসের দিকে ইঙ্গিত করলেন। “মানা কোরো না... আমি কাল যাচ্ছি, জানি না আবার কবে দেখা হবে।”
“আপনি ফিরবেন তো?”
আমার অধীরতা তাঁকে এক পলকের জন্য থামিয়ে দিল। তাঁর হাসিটা—যা এতক্ষণ টিকটিকির মত তাঁর মুখে আটকে ছিল—একটু নড়ল। “কেন? মেহরা সাহেব একাই যথেষ্ট নন?”
স্নেহ না সহানুভূতি, বলা মুশকিল, ভুলে যাওয়া পুরনো বন্ধুত্বের দৃষ্টি তাঁর চোখে, “তোমার মত ঝাড়া হাত-পা নই আমি, যখন নীচে থেকে ডাক আসে, আমায় যেতেই হয়। যখন এখানে থাকি, মনেই পড়ে না তারা কোথায়। আবার যখন সেখানে যাই, কয়েক মাসের মধ্যেই অস্থির মনে হয়, যেন বেঁচে থাকার ক্ষমতাটা কীভাবে হারিয়ে ফেলছি। নিজের বাড়িতেই লুকিয়ে থাকি যাতে কোনও পুরনো বন্ধু বা প্রফেসরের সঙ্গে দেখা না হয়। যখন তাঁরা আমার সঙ্গে দর্শন বা বিজ্ঞানের আলোচনা শুরু করেন, আমি বোকার মত তাকিয়ে থাকি। আমি বুঝতে পারি না এঁরা কেন এসব নিয়ে এত উত্তেজিত, আমার জীবনে এসবের কোনও গুরুত্বই নেই।”
“আপনার জীবনে না থাকলেও, তাঁদের জীবনে হয়তো আছে?”
“কিন্তু তাঁরা কে? আমিও তাঁদের মতই হয়ে যেতাম যদি এখানে না পালিয়ে আসতাম।”
তাহলে নীচে যান কেন? আমার জানতে ইচ্ছা হল কিন্তু কি জানি তাঁর নেশা-ভরা চোখ, ঘরে রুগ্ন মেহরা সাহেব, কিংবা আমি নিজে, যে তাঁর সামনে বসে— সব কিছু সেই সত্য থেকে আমাকে টেনে রাখল, যা নিরঞ্জনবাবু বলতে চাইছিলেন ... এক জায়গার সত্য অন্য জায়গায় ঠিক খাটে না। যেখানে জন্মেছে সেখানেই সঙ্গত। আমাদের কাছে আসতে আসতে সেটা মিথ্যা বলে মনে হয়।
উনি বাকি হুইস্কিটা শেষ করে পকেট থেকে কিছু একটা বার করলেন। খালি গেলাসের পাশে মুঠো হাত রেখে শুধলেন, “জানো তোমায় কেন এখানে ডেকেছি?” মুঠি খুলে দেখালেন তাঁর হাতে একটা লম্বা চাবি… ঘামে ভিজে চকচকে।
“এটা আমার বাড়ির চাবি...মনে আছে একবার তোমায় বলেছিলাম...”
আমি তাকিয়ে রইলাম।
“নাও...নিজের কাছে রাখো। দরকার লাগতে পারে।”
“কেন? আমি এ নিয়ে কী করব?”
“লোকেরা চাবি দিয়ে কী করে?” একটু ভূতুড়ে হাসি, “যখন সব দরজা বন্ধ হয়ে যায়, একটা অন্তত খোলা থাকা চাই, তাই না? তুমি কি ভাবো তুমি সর্বদা মেহরা সাহেবের বাড়িতে থাকতে পারবে?”
“তাঁর বাড়িতে নয়, কিন্তু তাঁর কাছে...” আমি বললাম, “সে তাঁকে আমার কাছে রেখে গেছিল।”
“সে কে?” তাঁর গলায় তিক্ততা। “ওই যে কবরখানায় শুয়ে? তুমি এক মৃত মহিলার কথায় আরেক অর্ধমৃতের সঙ্গে পড়ে আছো?” তাঁর হাসিটা ভয়াল, যার সামনে আমার সব সিদ্ধান্ত গুঁড়িয়ে যায়। “আর যখন তিনি থাকবেন না, তখন?”
“তখন? আমি এঁদের জন্য এখানে আসিনি নিরঞ্জনবাবু। এঁরা আমার কেউ হন না। আমি শুধু কাগজে নোটিস দেখে এসেছিলাম... আমি জানতাম না এঁরা কে। আমি যে অবস্থায় ছিলাম সেসময়, সেখানে কেউ এসব বিষয়ের ধারও ধারে না...আমি এঁদের জন্য না, নিজের জন্য এখানে এসেছিলাম।”
“নিজের জন্য? কে তোমায় এখানে বেঁধে রেখেছে?”
“কেউ না।”
উনি আমাকে লক্ষ্য করছিলেন, দেখছিলেন আমি নিজের থেকে কতদূর চলে গেছি।
“কী রকম লোক তুমি? যদি কারুর জন্য না এসেছ তবে এখানে থাকা বা না থাকায় কিছু যায় আসে না।”
আসে, আমি বলতে চাইলাম। তারা নয়, যাদের কথা ইনি বলছিলেন, কিন্তু সে, যে আমাকে তাঁর দায়িত্ব দিয়ে গেছে। সুখ বা নিরাপত্তা থেকে আলাদা কিছু, যার কাছে আমি এই প্রথম নিজেকে নিংড়ে মেলে দিয়েছি। খোলা আকাশের নীচে নিজেকে দুলতে দেখেছি। ফোঁটা ফোঁটা করে নিজেকে ঝরতে দেখেছি। সে তো আকাশের নীচে শায়িত, কিন্তু আমিও কি সে যে তিন বছর আগে এখানে এসেছিল, এক অন্ধকার অতীত ছেড়ে বর্তমানের আলোয়... যেখানে সব দরজা খোলা, আমি যেখানে ইচ্ছে যেতে পারি? আমার আর কোনও চাবির দরকার নেই।
“নিরঞ্জনবাবু, এবার ওঠা যাক?”
উনি তাকালেন, “দাঁড়াও, আরেকটা অর্ডার দিই...কালকে তো আমায় যেতেই হবে।” কিন্তু আমার মুখ দেখে আর বেশি পীড়াপিড়ি করলেন না। পাইপ আর লাইটার পকেটে রেখে উঠে দাঁড়িয়ে নড়বড়ে পা দুটো সামলে কাউন্টারে এলেন। সেখানে ইতিমধ্যে একটা ছোটখাটো ভিড় জমা হয়েছিল। হিম্মত সিংকে ডেকে বিল সাইন করলেন। চারদিকে আরেকবার দেখে নিলেন— আলো, লোকজন, আওয়াজ, মদ—সব পেরিয়ে আমরা বাইরে এলাম।
বাইরে রাত হয়ে গিয়েছিল। নীচে পাহাড়ের পায়ের কাছে রুপোর বাটির মত উপত্যকা। কিছুদূর আমরা চুপচাপ নিজেদের পায়ের শব্দ শুনতে শুনতে চলছিলাম। পোস্ট অফিসের পাশে ওক গাছের তলায় চায়ের ধাবাটা বন্ধ। সেখানে গতবার আমরা বসেছিলাম। পিছনের কুঠি থেকে আলো আসছিল। মোড়ের কাছে এসে উনি একটু দাঁড়ালেন। আকাশ, তারা, হাওয়ার সরসর, জঙ্গলের নিঃশ্বাস... কিছুক্ষণ আমরা চুপ করে শুনছিলাম, তারপর তাঁর নী্চু গলা শুনলাম।
“জানো আমি কলেজে ফিলসফি কেন নিয়েছিলাম? ছোটবেলায় একটা বইয়ে পড়েছিলাম... মনে নেই কী নাম...মিসটিরিয়াস ইউনিভার্স বা ওই রকম কিছু... তুমি পড়েছিলে? আজ আমি কলেজের ফিলসফি বইয়ের নাম ভুলে গেছি কিন্তু এই বইটার কথা মনে আছে। আমি জানতাম না যে আমি যে পৃথিবীতে থাকি তারও ঘর আছে, আর সেই ঘরেরও ঘর...” তিনি হাসতে শুরু করলেন, “আশ্চর্যের ব্যাপার আমি যখন নীচে নিজের বাড়ি যাই, আমার মনে হয় আর সব ঘরদোর কোথাও মিলিয়ে গেছে। আমার মনে থাকে না যে এই পৃথিবী শুধু কোনও বাড়ির একটি তলা, আর সব ঘরগুলো উপরের তলায়, যা শুধু বাড়ি থেকে বেরুলেই দেখা যায়... তুমি জানতে চেয়েছিলে কেন আমি এখানে এসেছি, এখানে এলে আমার মনে হয় এই পৃথিবীতে থেকেও আমি এর বাইরে বেরিয়ে এসেছি।“
একটু চুপ থেকে আবার বললেন, “আমি জানতাম না এত বছর পর তোমার সঙ্গে এখানে দেখা হবে। কোনও অ্যাস্ট্রোনমার অন্তরীক্ষে নতুন নক্ষত্রের খোঁজ পেলে সেটা বড় খবর হয়, কিন্তু এই পৃথিবীতে হারিয়ে যাওয়া লোকের আবার খোঁজ পাওয়ার থেকে বিরাট ব্যাপার আর কী হতে পারে?” উনি আমাকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলেন... তারপর যেন একটু লজ্জা ঢাকতে আমায় ছেড়ে দিয়েই জোর পায়ে ফিরে চললেন, আর কিছু বললেন না, পিছন ফিরে দেখলেনও না।
নিরঞ্জনবাবু চলে গেলেন। আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে তাঁকে চলে যেতে দেখলাম। বাইরে তারার আবছা আলো, হাওয়ায় অটল দেওদার, দূরে টিলার উপর অন্ধকারে ঢাকা কবরস্থান, অ্যানা-জীর কটেজ...একটা সঘন নীরবতায় চারিদিক ঢাকা, যার শুরুও নেই, শেষও নেই... সময়ের মতই অসীম। হঠাৎ ইচ্ছা হল আমিও ছুটে নিরঞ্জনবাবুর কাছে চলে যাই, গিয়ে বলি... কিন্তু কী বলি? বলি না যেতে, একটু দাঁড়াতে, আমিও যাব আপনার সঙ্গে— কিংবা, শুধু... প্লীজ ,প্লীজ..প্লীজ ... আমি তাঁকে কী বলতে চাই? আমি কিছুই না বলে দাঁড়িয়ে রইলাম আর তিনি মোড়ের মাথায় অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
ফিরে এসে দেখি সারা কটেজে আলো জ্বলছে। একটা ভয়ানক আশঙ্কায় আমি দৌড়তে শুরু করলাম... ব্যাডমিনটন কোর্ট, দালান, বারান্দা ... সব পেরিয়ে দেখি মুরলীধর লন্ঠন নিয়ে আমার দিকেই আসছে।
“আমি আপনার খোঁজেই আসছিলাম।”
“মেহরা সাহেব ঠিক আছেন তো?” আমি হাঁফাতে হাঁফাতে বললাম।
“হ্যাঁ, তিনি ঠিক আছেন। বিটিয়া এসে গেছে।”
“তিয়া? কখন এল?”
“আপনি বেরুবার একটু পরেই। সাহেবের ঘরে বসে আছে। আপনি যান, আরাম করে নিন। যখন বলবে, আমি ডেকে পাঠাব।” মুরলীধর বলল।
সাহেবজীর ঘর বন্ধ। দরজার বাইরে তিয়ার চপ্পল। দেখে মনে পড়ল গতবার এই চটি পরেই সে এসেছিল।
সেই রাতে আমি অনেকক্ষণ নিজের ঘরে যেতে পারলাম না। বাইরে বারান্দায় বসেছিলাম, অর্ধেক বাইরে, অর্ধেক ভিতরে...ঝোপের মধ্যে ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ ... ভিতর থেকে কিছু শোনা যাচ্ছিল না। যেন বাপ-মেয়ে সারা বাড়ি মুরলীধর আর আমার উপর ছেড়ে কোথাও চলে গিয়েছেন। কিংবা হয়তো ওঁদের মনেও নেই যে মুরলীধর ছাড়াও আরও একজন এখনও পর্যন্ত তাঁদের সঙ্গে রয়ে গেছে। আমি যে বাইরের লোক। এই প্রথম আমার নিজের অবস্থিতি সম্পর্কে একটু সংশয় জাগল আমার মনে—এতদিন একসঙ্গে থেকেও আমি তাঁদের পরিবারের লোক নই ...এতক্ষণ ধরে সে ঘরে বসে আছে, আমাকে একবার ডাকার কথাও ভাবল না?
না, এই-ই ঠিক। এতদিন পরে এসেছে, কিছুক্ষণ তো বাপের সঙ্গে একলা থাকবেই, আর দেখবে কীরকম ছিলেন আর কীরকম নেই। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তো অনেক সময় পড়ে আছে, কিন্তু প্রথম দেখার শকটা একলা নিজেকেই সামলাতে হয়। কে সেখানে সাহায্য করতে পারে? হঠাৎ সাহেবজীর দরজায় আলো দেখা দেল, দরজা অর্ধেক খোলা। কারুর ছায়া পড়ল দেয়ালে, সেটা কি তার? আমি যেখানে বসেছিলাম, শুধু তার শালটা দেখা যাচ্ছিল... পুরো শরীরটা নয়, তবু দাঁড়াবার ভঙ্গিমা থেকেই বোঝা যাচ্ছিল সে-ই দাঁড়িয়ে, আর কেউ নয়। চৌকাঠে দাঁড়িয়ে সে বাইরে অন্ধকারের দিকে চেয়ে ছিল। কিন্তু আমায় দেখতে পায়নি। আমি বারান্দায় অন্য একটা অন্ধকারে বসেছিলাম।
হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার। একবার মাত্র, তারপর চুপ। শুধু তার প্রতিধ্বনিটা দূর পাহাড়ে ঠোক্কর খাচ্ছিল। এত আর্ত আওয়াজে বনের নীরবতাও যেন শিউরে উঠল। ঝোপের পিছনে দুটো ঘুমন্ত পাখি ডানা ঝটপট করে উঠল, তাদের ছায়া পড়ল মুরলীধরে লণ্ঠনে—সেও আওয়াজ শুনে বেরিয়ে এসেছে। আমি বারান্দার সিঁড়ি টপকে দরজার সামনে ছুটে এলাম, মুরলীধরও। সে তখনও স্থির দাঁড়িয়ে, আমাদের দেখছিল।
“বাবুজী চলে গেলেন? আমি আসার আগেই?”
“মানে? উনি ভিতরে নেই?” মুরলীধর ওর মুখের সামনে লণ্ঠন তুলে ধরল।
সে কি তিয়া ছিল? না, চেহারাটা ল্যাম্পের আলোয় অন্য রকম দেখাচ্ছিল। কিন্তু তার স্বর আগের মতই, শান্ত।
আমি আর থাকতে না পেরে দরজা ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। তিনি পালঙ্কের উপর চিত হয়ে শুয়ে...একটা হাত নীচে ঝুলছে। চোখ খোলা, কিন্তু চোখের মণি স্থির।
তিনি কোথাও যাননি, ভিতরেই ছিলেন কিন্তু এমন এক জায়গায় লুকিয়েছিলেন যেখান থেকে তাঁকে বার করা কারুর সাধ্য ছিল না।
অধ্যায়— ৩.১
আমি বললাম, ওখানে না, এদিকে দেখুন... ভিজে আঙুলে ছাই লেগে যাবে। তার আঙুলগুলো আধজ্বলা কাঠের মধ্যে এলোমেলোভাবে ঘুরছে। ছাই কালো হয়ে গেছিল। এখানে ওখানে জমা জল, কাল রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। টিপটিপ করে বৃষ্টি তো তখনই শুরু হয়েছিল যখন তাঁর দেহটা কাঠের মধ্যে স্যান্ডউইচের মত রাখা হচ্ছিল, সর্বাঙ্গ কাঠে ঢাকা যাতে শরীরের কোনও অংশ বাদ না যায়। কুয়াশার মধ্যে জ্বালানী কাঠের ধোঁয়া একটা কালো শিখার মত উঠছিল। আগুনের লকলকে শিখাগুলি তাঁর শরীরের প্রতিটি কোণে কানাচে...তাঁর হাতের উপর, যে হাতে আমি হাত বুলোতাম, তাঁর চোখের মধ্যে, যে চোখ দিয়ে বিকেলে আমি আসার পর আমার দিকে তাকাতেন... তিনি কি আলাদা হয়ে তাঁর জ্বলন্ত শরীরটা দেখতে পাচ্ছেন? আর আমরা যারা দশ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে তাঁর শরীরটা জ্বলতে দেখছি, তিনি কি আমাদেরও দেখছেন?
কেউ ঠিকই নাম দিয়েছিল এই জায়গাটার। নির্জন, সমতল ভূমিখণ্ড, মোটর রোডের নীচে শায়িত, কোনও ল্যান্ডস্লাইডের কারণে সৃষ্টি, দুই দিকে সাদা পাথরের লাইন, মাঝখানে সমতল...লোকে বলে অনেক বছর আগে এখানে দেবতাদের প্রসন্ন করার জন্য নরবলি দেওয়া হত। এখানেই দাহ-সংস্কার করা হত। সেই থেকে জায়গাটার নাম 'মুর্দা টিলা'... আকাশ আর পৃথিবীর মাঝখানে এই শ্মশানভূমি। আগে নরবলির সময় দেবতা আকাশ থেকে নীচে নামতেন, এখন জ্বলন্ত মৃতদেহের ধোঁয়া সোজা আকাশে উঠে যায়।
কিন্তু সেদিন কুয়াশা ভেদ করে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। শুধু জ্বলন্ত কাঠ থেকে ওঠা আগুনের লকলকে শিখায় আশেপাশের কয়েকটি চেহারা— অ্যানাজী, ডক্টর সিং, মুরলীধর... তিয়া পুরোহিতের পাশে বসেছিল... মাথায় আধ ঘোমটা, শুকনো মুখ ... সে শূন্য চোখে আগুনের দিকে তাকিয়ে ছিল। তখনই আমার মনে হল, মানুষ জীবনটা হয়তো কাটায় এক জায়গায়, কিন্তু মরার পর সে সবার ভিতরে নিজের জায়গা করে নেয়। তার বেঁচে থাকাটা আবছা হলেও মরার পর সে উজ্জ্বল। এতই উজ্জ্বল আর পরিষ্কার যে মনে হয় আমাদের সবার মধ্যেই সে আছে, স্বতন্ত্র, সম্পূর্ণ। আগুনে সাহেবজীর শব যতই ভস্মীভূত হতে থাকে ...তাঁর নখ, চুল, হাড়-মাংস, তাঁর মাথা... ততই তাঁর অস্তিত্ব আমাদের মনে সম্পূর্ণ হতে থাকে।
কাঠের টুকরোগুলো জ্বলছে। যখনই আঁচ কমে আসে পুরোহিত ঠাকুর এক দলা ঘি চামচে করে কাঠের উপর ছড়িয়ে দেন। নিবুনিবু আগুন আবার ধু-ধু করে জ্বলে ওঠে। কখনও আগুনের একেবারে অন্তঃস্থল থেকে চিড় চিড় আওয়াজের সঙ্গে কয়েকটা স্ফুলিঙ্গ তাঁর অস্থি পিঞ্জর থেকে যেন মুক্তি পেতে বেরিয়ে আসছে। মানুষ মরার পরেও আরও দুবার মুক্তি পায়— প্রথমবার অন্যের কাছ থেকে আর দ্বিতীয়বার নিজের থেকে। মেহরা সাহেব নিজের অস্থি পিঞ্জর থেকে বেরিয়ে এলেন যেন কেউ জ্বলন্ত ঘর থেক বেরিয়ে আসছে—মুক্ত, নির্লোভ, ভারহীন। আমার মনে পড়ল মিসেস মেহরা কফিনে ঢোকার আগে একটু অগ্নি স্পর্শ করতে চেয়েছিল। হয়তো সে জানতে চেয়েছিল এই হাড়-মাংসের গহ্বরে এক কণা বাঁচার ইচ্ছা লুকিয়ে আছে কিনা। সেই ইচ্ছাই তো তার খিলখিল হাসির মধ্যে প্রকাশ পেত।
আজ যদি সে আমাদের সঙ্গে এখানে বসে থাকত? আমাকে জিগ্যেস করত, কোথায় গেল সে, যাকে আমি তোমার হাতে ছেড়ে গেছিলাম? তোমায় কি এইজন্য ডেকেছিলাম? এই দিনটার জন্য? হয়তো সে সাহেবজীকে দেখত কিন্তু আমায় কিছু বলত না, শুধু হাসত, যেমন শবাধারে যাবার সময় হেসেছিল। হঠাৎ অনেক দিনের পুরনো, চেপে রাখা জল চোখ মুচড়ে বেরিয়ে এল। আমি জানতাম না সেটা তার জন্য, যে আমায় এখানে ডেকে এনেছিল না তাঁর জন্য যিনি দশ ফুট দূরে জ্বলন্ত চিতায় পুড়ছেন। জলভরা চোখে সবকিছু অস্পষ্ট দেখায়—মানুষ, পাহাড়, কুয়াশা, অস্থিমজ্জা... হঠাৎ মনে হল কেউ আমার হাত ধরে টানছে...
“উঠুন... বৃষ্টি শুরু হল।”
বৃষ্টিধারার মধ্যে তিয়ার ভেজা চেহারা, ছাতা হাতে অ্যানাজী, মুরলীধর, বংশী, আর চু চু ল্যাজ দোলানো কালী।
আমরা দৌড়ে শেডের তলায় চলে এলাম। শুধু ছাতা মাথায় পুরোহিত তখনও চিতার সামনে বসে, সঙ্গে তিয়া —নীরব চোখে ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে।
“এখনও জ্বলছে?” অ্যানা আমার দিকে তাকাল।
আমি হঠাৎ বুঝতে পারলাম না ও কার বিষয়ে প্রশ্ন করল। হয়তো নিজের মনেই বলছে। একটা ব্রাউন রঙের উলের কেপ পরেছিল...জলে ভিজে রঙটা ওর দু কান বেয়ে গলে নামছিল। ভীষণ অস্থির দেখাচ্ছিল ওকে। মাথায় খোলা ছাতার শিক বেয়ে জল পড়ছিল টুপ টুপ করে।
আমার মনে হল সাহেবজীর ছেলে থাকলে সে-ই বসতো তিয়ার জায়গায়। আগুনের সামনে জলে ভেজা, কাঁপা কাঁপা ধোঁয়াটে আকৃতি। হঠাৎ একটা বিরাট শিখা লাফ দিয়ে উপরে উঠল। হয়তো পুরোহিত মশাই একসঙ্গে সবটুকু ঘি আগুনে ঢেলে দিয়েছেন। আর সেই উন্মত্ত, হিংস্র, পাগল নেশায় আগুনের শিখা অন্ধকারকে ছিন্ন ভিন্ন করছে। কী সেই আওয়াজ, যা আগুনের ভিতর থেকে চিরে বেরল, লকলকে শিখার সঙ্গে, এক দেহহীন আর্তনাদ।
“শুনলে? কী ওটা?” অ্যানা আমার হাতটা ধরে বড়ো বড়ো চোখে তাকালো ... ডক্টর সিং কিছু না বলে রুমাল দিয়ে চশমাটা মুছতে লাগলেন আর চিতার পিছনে মেঘে ঢাকা সূর্যাস্তের ম্লান আলোর ক্লান্ত ছায়াটা পাহাড়ের গায়ে গভীর হতে থাকল। কী ছিল যা জ্বলন্ত কাঠ আর ছাইয়ের ভিতর থেকে বেরিয়েছিল? মৃতের কোনও শেষ ইশারা যা সে জীবিতদের জন্য রেখে গেল? সৃষ্টির কোনও নিজস্ব চিহ্ন, কোনও বিগত সুখের দিন, কোনও ছেড়ে যাওয়া দুঃখ, কিছু পশ্চাত্তাপ, যা শেষবারের মতো আগুনের শিখায় জড়িয়ে ছাই হয়ে যায়? মনেও থাকে না যে মানুষটা একসময় এই পৃথিবীতে এসেছিল। মানুষ খালি হাতে আসে কিন্তু যায় সবকিছু উজাড় করে দিয়ে।
দ্বিতীয় দিন, আমরা যা রয়ে গেছিল তাই খুঁজছিলাম ছাইয়ের মধ্যে।
অস্থিগুলি, যা সূর্যোদয়ের ছোঁয়ায় 'ফুল' হয়ে যায়। সকালবেলা সে এসে আমার দরজায় খটখট করল। কে জানে কতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়েছিল। আমি তাড়াতাড়ি শিকল খুলে দেখি তিয়া। এই প্রথম তাকে সাদা সুতির শাড়িতে দেখলাম। চান করে এসেছে, খোলা চুল কাঁধের উপর। হাতে একটা লাল রঙের থলে।
“আমার সঙ্গে আসবেন?” সে আস্তে বলল।
“কোথায়?”
“ওঁর অস্থিগুলি বাছতে হবে। পুরোহিত মশাই সকাল সকাল আসতে বলেছিলেন।”
কয়েক মুহূর্ত থমকে আমি বললাম, “আপনি বসুন...আমি এখুনি আসছি।”
আমার পরনের কাপড় দেখে নিজেরই লজ্জা করছিল। কাল রাতে শ্মশান থেকে ফিরে জামাকাপড় না ছেড়েই সোজা বিছানায় শুয়ে পড়েছিলাম।
“আমি বারান্দায় বসছি।”
একটু পরে যখন বেরুলাম, ভোরের আলো ফুটি ফুটি করছে। কাল রাতের ঘন মেঘ এখন সাদা তুলোর মতো আকাশে ছড়ানো।
সে বসেনি। বারান্দার থামে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে। আমার দরজা বন্ধর শব্দ শুনে ফিরে তাকাল। আমাকে দেখল যেন অনেকদিন পর দেখছে বা কিছু পরখ করছে। “চলি?”
এইবার পাকা রাস্তা ছেড়ে আমরা একটা ছোটো পাকদণ্ডী ধরলাম। এটা গোল ময়দানের দিকে যাওয়ার শর্টকাট। রাস্তাটা সরু, পাশাপাশি চলা যায় না। সে আগের মতই লম্বা পায়ে চলেছে, যেমন ঝরনায় জল ভরতে যেত।
পায়ে সাদা স্নিকারের জায়গায় চটি। চলতে চলতে সে দুহাতে খোলা চুল জড়িয়ে একটা আলগা হাতখোঁপা করে নিয়েছিল। একবার পিছন ফিরে আমায় দেখে নিয়ে আবার জোর পায়ে চলল। গত রাত্রের বৃষ্টিতে পাকদণ্ডীর জায়গায় জায়গায় জল জমে আছে। ভেজা মাটিতে পা বারবার পিছলে যায়।
একটু পরেই পাকদণ্ডী শুকনো জায়গায় উঠে পাকা রাস্তার সঙ্গে মিশে গেল। দূর থেকে শ্মশানভূমিটা দেখা যাচ্ছিল... সকালের কাঁচা রোদে সাদা পাথরগুলো ঝকমক করছে, এইখানেই আমরা কাল তাঁকে কাঁধে করে এনেছিলাম। কাল এই জায়গাটা অনেক দূর মনে হয়েছিল, আজ এত তাড়াতাড়ি পৌঁছে মনে হল ভুল জায়গায় এসে পড়িনি তো? কখনও কখনও উপরে রাস্তা দিয়ে ট্রাক বা গাড়ি শব্দ তুলে ছুটে যায়, মনে করিয়ে দেয় যে আমরা শহরের কোণেই আছি, কোনও দূর জঙ্গলে নয়।
সে মাটিতে বসে পড়ল, যেখানে কাল রাত্রে বসেছিল। কিছু না করে চুপটি করে বসেছিল, আমি কাছে আসতে মুখ তুলে তাকাল। আমি জানতাম ও কী জানতে চায়। আমি তো এসব আগেও করেছি। আমি আগেই চান করে এসেছি, তবু একটু দূরে রাস্তার পাশে একটা কলে হাত ধুয়ে নিলাম, ওকেও ধুতে বললাম। তাড়াহুড়োয় রুমাল আনতে ভুলে গেছিলাম, তার আঁচলের এক কোনা ধরিয়ে দিল। সেও অন্য কোণে নিজের হাত মুছে নিল। আধপোড়া কাঠগুলো ছাইয়ের গাদা থেকে সরিয়ে আমরা হাত দিয়ে তাঁর অবশেষ টুকরো খুঁজতে শুরু করলাম।
“ওখানে না, এখানে দেখুন, ভিজে হাতে শুধু ছাই লেগে যাবে।”
ছাই তখনও গরম। বৃষ্টির মধ্যেও একটা চাপা উষ্ণতা অনুভব করছিলাম। কোনও বড়ো কিছু হাতে ঠেকলে সে সেটা বের করে দেখত তাঁর শরীরের অস্তিত্ব কেমন একটা শুকনো, সাদা, ঝলসানি টুকরোয় পরিণত হয়েছে। আমরা সেটা বের করে লাল থলের মধ্যে রাখতাম। কখনও কখনও ছাইয়ের গাদায় হাত চালাতে গিয়ে আমার আঙুল তাকে ছুঁয়ে ফেলে, সে এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায়। আমি তাকিয়ে দেখি সে তখনও ছাইয়ের দিকে চেয়ে আছে, যেন অস্থির মধ্যে একটি জীবিত হাত কিছু আশ্চর্যজনক, ভিজে ছাইয়ের মধ্যে এক শুকনো অধীরতা যা সে একটুক্ষণ ছুঁয়েই হাত সরিয়ে পুঁটলিটা আঁকড়ে ধরে আর আমার হাত শূন্য ছাইয়ের গাদায় ঘুরে বেড়ায়। আমার মনে হল যেন ছাইয়ের মধ্যে আমি কত মূল্যবান জিনিশ হারিয়ে ফেলেছি— আর এখন ছাইয়ের মধ্যে তাঁরই চিহ্ন খুঁজছি যিনি আমাকে এত কিছু দিয়ে গেছেন।
“ব্যস, না আরো কিছু বাকি?” সে আমার মুখের দিকে তাকাল।
আমার হাত থেমে গেল। “আপনি সব জায়গা ভালো করে দেখে নিয়েছেন তো?”
সব বার করে নিয়েছিলাম। এতটা লম্বা জীবন এখন এই ছোট্ট থলের মধ্যে।
আমরা উঠে দাঁড়ালাম। রোদ পাহাড় থেকে নেমে এখন আমাদের মাথার উপর। শেডের কাছে আমরা আবার হাত ধুয়ে নিলাম। গত সন্ধ্যায় যে শবযাত্রা শুরু হয়েছিলো তার অন্তিম পর্ব এখন, আজ সকালে।
অন্তিম পর্ব? না, এখনো নয়, এখানে নয়। এখানে উনি নিজেকে ছেড়েছেন। আমাদের এখনও ওঁকে ছাড়তে বাকি।
“এখানে একটু বসি?” তিয়া জিজ্ঞেস করল।
শেডের সবুজ ছাতের নীচে একটা খালি বেঞ্চ, আমরা গিয়ে বসলাম। সে অস্থির থলেটা আমাদের মাঝখানে রেখে দিল। হাড়ের মাঝে মাঝে ছাইগুলো রোদ্দুরে ঝকমক করছে।
“আপনার তো খুব কষ্ট গেছে।”
সে কি আমায় জিগ্যেস করছিল না এমনি বলছিল? আমার কোনও উত্তর দেবার কিছু ছিল না।
“সে কি কখনও—” কথা মাঝপথে থেমে রইল। আমি তার দিকে তাকালাম। তাকে খুব ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে, দুচোখে গভীর ক্লান্তি, যেন অনেক রাত ঘুমোয়নি।
“আপনি কী জিগ্যেস করছিলেন?”
“না, থাক।”
“না, বলুন না, কী বলছিলেন?”
“শেষের দিকে উনি আপনাকে দিয়ে কী লেখাচ্ছিলেন?”
সে কথা বদলে দিল। সোজাসুজি না এসে অন্য দিকে মোড় নিল।
“ডিকেন্স আর হার্ডি...”
সে অবাক হয়ে তাকাল।
“আমি লেখা ছেড়ে দিয়েছি। উনি আমায় পড়তে শেখাচ্ছিলেন।” আমি বললাম, “আপনাকে চিঠিতে কিছু লেখেননি?”
“আপনিও তো লেখেননি।” তার গলা নীচু কিন্তু তবুও একটু উত্তাপ ছিল।
“লিখেছিলাম তো, লাইব্রেরিতে যেতাম, বিকেলে?”
“ওঁর স্ট্রোকের সম্বন্ধে তো কিছু লেখেননি?”
“ডক্টর সিং বারণ করেছিলেন। তিনি তখনও নিশ্চিত ছিলেন না। বলেছিলেন উনি নিজে আপনাকে ফোন করবেন...হয়ত আপনি ওখানে ছিলেন না।”
“আমি রাউণ্ডে গিয়েছিলাম, ফিরে এসে টেলিগ্রামটা পেলাম।”
উপরে বড়ো রাস্তায় একটা বাস শব্দ তুলে চলে গেল। তার প্রতিধ্বনি পাহাড়ে পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়ল।
“কখনও আমার সম্বন্ধে কিছু জিগ্যেস করেছিলেন?” তার স্বর শান্ত, সমতল। উৎসুক নয়, শুধু একটু জিজ্ঞাসা।
“আপনার চিঠি এলে তিনি প্রথমে নিজে পড়ে তারপর আমাকে পড়তে বলতেন।” আমি বললাম, “শেষে সর্বদা জানতে চাইতেন আপনি এখানে আসার সম্বন্ধে কিছু লিখেছেন কিনা। তখনই আপনার কাছে যাবার প্ল্যান করেছিলাম, বাসে সীট রিজার্ভ করেছিলাম...আগের রাতে সবকিছু প্যাক পর্যন্ত করেছিলাম।”
তার হাতটা পুঁটলির দিকে গিয়েও আবার ফিরে এল।
“আপনি এরকমভাবে কেন চলে গেলেন?”
“আপনাকে লিখেছিলাম তো। আপনি আমার নোট পাননি?”
“আমার নয়, আমি ওনার কথা বলছি। আপনি জানেন না আপনার চলে যাবার পর উনি কীরকম হয়ে গেছিলেন।”
আমি আর বেশি বলতে পারলাম না। সেই দিনগুলো একটা ঘূর্ণির মতো আমার মধ্যে তোলপাড় করছিল। সে সময়েই তো আমরা —আমি— তাঁকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। সে কি এসব কখনও জানতে পারবে? না, আমিই তাকে বলতে পারব?
হঠাৎ আমার হাতের উপর তার হাতের ছোঁয়া পেলাম। সে আস্তে আস্তে হাত বুলোচ্ছিল, সেই হাত যা আমি একটু আগে ছাইয়ের ভিতর ছুঁয়েছিলাম। সেই হাত আমার হাতের উপর। যা সে বলতে চেয়েছিল সেই স্পর্শের মধ্যেই ধরা পড়ছিল।
আমরা কিছুক্ষণ অবসন্ন ভাবে ছাইয়ের সামনে বসে রইলাম। মাথার উপর চিলের চক্কর, তাদেরর কালো ছায়া সাদা পাথরের উপর পিছলে নীচের উপত্যকায় হারিয়ে যাচ্ছে। রোদ পাহাড় থেকে নেমে চিতার কালো ছাইয়ের উপর পড়ছিল।
“আপনাকে উনি কিছু বলেছিলেন?” মাথা না উঠিয়েই সে প্রশ্ন করল।
“কী সম্বন্ধে?”
“বেঞ্চে রাখা থলের দিকে চেয়ে বলল, “এর সম্বন্ধে?”
পিছনে ফেলে রাখা তাঁর দেহাবশেষ সম্বন্ধে?
“না। এসব নিয়ে কখনও কিছু বলেননি, কিন্তু...”
সে মুখ তুলে তাকাল, চোখের উপর রোদ।
“আপনাকে নিশ্চয়ই বলেছেন, হয়তো কোনও ইচ্ছা...” আমি বললাম।
সে মাথা নাড়ল, “না, কিছুই না।”
উনি নিজের জীবন নিয়ে এত কথা বলতেন আর এই শেষ চিহ্নটির সম্বন্ধে কিছুই না?
“উনি কি কিছু বিশ্বাস করতেন?” আমি শুধোলাম।
“কী রকম?”
“অন্তিম সংস্কার সম্পর্কে।”
“জানি না উনি শেষের দিকে কী ভাবতেন, আপনি তো জানেন, এসব বিষয়ে উনি কী রকম। দিভার বর্ষপূর্তির সময় অ্যানাজী তাঁকে সিমেটেরিতে যেতে বলত, তিনি সর্বদা না বলে দিতেন।”
মিসেস মেহরা? সে কীভাবে এই দুপুরে সিমেটেরি থেকে শ্মশানভূমিতে চলে এল?
“এই অস্থিগুলি তার পাশে কবর দেওয়া যায় না?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
সে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর অল্প একটু হাসি এল তার মুখে।
“হয়তো অনন্তকাল এত কাছাকাছি থাকতে তাঁদের ভালো লাগবে না।”
সে উঠে দাঁড়িয়ে থলেটা তুলে নিল।
“চলুন, বাড়ি গিয়ে এই নিয়ে ভাবা যাবে।”
আমরা নীচে নামতে শুরু করলাম। মেঘের একটা টুকরো সূর্যকে ঢেকে ফেলেছিল কিন্তু হালকা রোদের মতো আলো ছড়িয়ে ছিল চারিদিকে। সেই আলোটা পাহাড়ের চূড়া, বাড়িঘরের ছাদ আর নীচের উপত্যকায় বেয়ে ধীরে ধীরে নেমে আসছে।
অধ্যায় —-৩.২
সকালের কুয়াশাটা পাতলা হচ্ছে। বাসের হেডলাইটে রাস্তার সাদা পাথরের সারি নীচের দিকে সরে সরে যাচ্ছে। রাস্তার মোড়ের ঝাঁকুনিতে আমি লাল থলেটা আরও ভালো করে জাপটে ধরি। না, ভয়ের কিছু নেই। তিনি আমার সঙ্গেই আছেন। তিনি হয়তো কোনওদিন কল্পনাও করতে পারেননি যে আমায় রোজ তাঁর জীবনের অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী শোনাতেন, তাঁরই শেষ যাত্রা আমার সঙ্গে এই বাসের সীটে হবে।
আয়োজনটা হঠাৎ হয়ে গেল। আমি কখনও ভাবিনি যে আমি আধো ঘুমে এইরকম একটা সিদ্ধান্ত নেব। শ্মশান থেকে ফিরে আমি শুয়ে পড়েছিলাম—ঘুম-আধঘুমের মাঝামাঝি। মনে পড়ছিল কুড়ি বছর আগে—যখন আমি বাবার অস্থি নিয়ে কনখল গেছিলাম... শোক আর সন্তাপ বরফের মতো আমার মধ্যে জমে বসেছিল। তখন আমি বড়জোর আঠেরো বছরের। বয়েসটা প্রথম প্রেমে পড়ার, আর আমি প্রথম দেখলাম মৃত্যুকে—একটি কাছের প্রাণীকে খুব কাছে থেকে দেখা। আর এখন, কুড়ি বছরের গোলকধাঁধা কাটিয়ে এই শহরে এসে আরেকবার তার সামনে দাঁড়াচ্ছি, যে একদিন আমায় এত অসহায় ও অক্ষম করে ফেলেছিল।
আমি কুঠির বাইরে একটিও তারা দেখলাম না, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। শুধু তাঁর কটেজে আলো জ্বলছিল। ...তাঁর অন্তিম শয্যার ঘরে নয়, উলটোদিকে ড্রইং রুমে, যেখানে আমি নোটবুক নিয়ে বসতাম।
সে লম্বা টেবিলটার সামনে বসেছিল—ঘরের শেষ কোনায়। তাই হয়তো দরজায় শব্দ শোনেনি। লম্বা কাঁচের জানলাটা এখন খোলা—আগে সেটা সর্বদা পর্দায় ঢাকা থাকত। দুই পাল্লার মাঝে টেবিল ল্যাম্পের আলোটা তার নত মাথা, ফুলদানি আর টেবিলে রাখা কাগজপত্রের উপর পড়েছিল। আমি খোলা দরজার শেকলে আরও দুবার আওয়াজ করলাম, লোহা আর কাঠের আওয়াজ, তখনই সে মাথা তুলে আমায় দেখল।
“আপনি?” সে তখনও অন্য জগতে, আমাকে দেখেও আমার উপস্থিতিটা ঠিক বুঝতে পারছিল না।
“আপনাকে কিছু বলতে এসেছি।”
সে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল। “বসুন, আমিও আপনাকেই ডাকতে যাচ্ছিলাম।” আমি কোণে রাখা বেতের চেয়ারে বসলাম, সে তখনও দাঁড়িয়ে চুপ করে আমাকে দেখছে।
“কেন...কিছু দরকার?”
সে মাথা নাড়ল। চেয়ারটা আমার দিকে টেনে বসল যেন কোনও সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়।
“আপনি কি কিছু ঠিক করেছেন?” সে বলল। “আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই... আপনি চাইলে না করতে পারেন।”
সে তখনও আমার দিকে তাকিয়ে।
“আমি অনেকদিন থেকেই বাইরে কোথাও যাবার কথা ভাবছিলাম।”
তার চোখে অবাক দৃষ্টি, “বুঝলাম না...বাইরে, কোথায়?”
“উনি বেঁচে থাকার সময় কিছু ঠিক করিনি, কিন্তু এখন উনি সব সহজ করে দিয়েছেন। আমি তাঁর অস্থিগুলো সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি?”
সে চুপ করে রইল। ল্যাম্পের আলো তার চুলের সিঁথিতে পড়ছিল।
“আমি জানি আপনার হয়তো এটা ভালো মনে হবে না...আমি তো তাঁর কেউ নই, আমার কোনও অধিকারও নেই। যখন উনি জীবিত ছিলেন তখনও না, এখন তো আরও নয়।”
“অধিকারের কথা নয়...” তার স্বর খুব কোমল, “উনি আপনাকে খুব সম্মান করতেন...আপনি না থাকলে এই শেষ বছরটা...”
তার গলা এত নীচু হয়ে গেছিল যে আমি ধরতে পারলাম না কোনও শব্দটার উপর সে থামল।
“আপনি কোথায় যাবার কথা ভাবছেন?”
“প্রথমে ভেবেছিলাম হরিদ্বারের কাছে কনখল...কিন্তু সেটা বেশ দূর... তাই ভাবলাম পারুলকোট ...এখান থেকে বাসে আড়াই-তিন ঘণ্টা।”
পারুলকোট? নাম শুনিনি কখনও।”
“ছোট্ট পাহাড়ি জায়গা... গাড়োয়ালের বর্ডারের কাছে। লোকে বলে সেখানের নদী গঙ্গারই ছোট শাখা।
“সে তো এখানে সব নদী-নালাকেই বলে।” তার মুখে একটু হাসি। “আপনি একলা যাবেন?”
আমি অবাক হয়ে চাইলাম, “তাছাড়া আর কে?”
“আমি যেতে পারি আপনার সঙ্গে?”
“আপনি যাবেন?”
এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গেছিলাম যে সে মেহরা সাহেবের মেয়ে। আমার চোখে সে শুধু একটি মেয়ে, যাকে লোকে তিয়া বলে ডাকে। একটা কালো শাল জড়িয়ে সামনে টেবিল ল্যাম্পের নীচে বসেছিল। নামের সঙ্গে সম্পর্ক-পরিচয় কত চট করে অন্য আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে।
“আপনি এলে তো তাঁর খুব ভালো লাগবে। আপনি জানেন না, আমরা দুজনে এই বাসেই আপনার ওখানে যাবার প্ল্যান করেছিলাম...উনি আপনাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলেন।” কথাগুলো কত সহজে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, যেন এই সময়টারই অপেক্ষা করছিল।
“সারপ্রাইজ? তাঁকে দেখে?” সে এমনভাবে বলল যেন কল্পনার সঙ্গে কিছু পুরনো দুঃখও মেশানো ছিল। “হ্যাঁ ..হয়তো” সে হাসল। “আমি যখন হোস্টেল থেকে ছুটিতে আসতাম, দিবা আমায় বলত... তোমার বাবা জানে না যে তুমি আসছ... আমি চাই তোমার বাবা তোমায় দেখে...” তার গলা আটকে গেল, “আমরা সবসময় একে অন্যকে সারপ্রাইজ দিতাম... ক্রিসমাসের উপহারের মতো।” তার গলা বুজে আসছিল। একটু পরে অন্ধকার গহ্বরটা পার হয়ে বলল,
“কবে যাবার কথা ভাবছেন?'
সে চেয়ারে খাড়া বসে আমার দিকে ঝুঁকেছিল... আমি তার মুখটা দেখতে পারছিলাম না, শুধু তার কাছে আসার আভাস...
“কাল সকালে?”
শুধু নীরবতা, সে তার মধ্যে আর আমি তার খুব কাছে। নিজের বুকের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। একটা নিশ্বাস বা শুধু একটু দীর্ঘশ্বাস যা আমারই বুকের গুঞ্জন।
“একটু দাঁড়ান।”
একটা মৃদু শব্দ, আমি দেখি সেই লাল থলেটা আমার কোলে এসে পড়েছে।
“আপনি আমার সঙ্গে আসছেন না?” আমি উঠতে গিয়েও থেমে গেলাম।
“আপনার সঙ্গে উনি আছেন। কিন্তু ওঁর সঙ্গে এখানেও তো কারুর থাকা দরকার।”
“ওঁর সঙ্গে?”
“আপনি যান, এই সময় বাড়ি খালি রেখে যাওয়া ঠিক নয়।” বলে ধীর পায়ে পাশের ঘরে চলে গেল যেখানে তাঁকে শেষ দেখতে পেয়েছিল। উনি আমার কোলে এই পুঁটলিতে যতটা আছেন, ততটাই ওই একলা ঘরে, যেখানে সে চলে গেছিল।
আমি থলেটা নিয়ে দরজার দিকে যেতে গিয়েও থমকে গেলাম। কেউ আমায় ফিরে ডাকেনি কিন্তু একটা বরফশীতল শিহরন আমার দুই পা অচল করে দিয়েছিল। আমি ফিরে এসে তাঁর ঘরে ঢুকলাম —যেখানে আমার যাওয়ার কোনও অধিকার ছিল না। সে দেওয়ালে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে।
আমি তার মাথায় হাত রাখলাম।... সে কিছু বলল না, শুধু এদিক ওদিক মাথা নাড়ছিল যেন ভিতর থেকে একটা ঢেউ চাপবার চেষ্টা করছিল। আমি তার মুখ নিজের দিকে ঘোরাতেই সে দেওয়াল ঘেঁষে আমার দিকে ফিরল... তার সারা মুখ চোখের জলে মাখা, বোজা চোখদুটি নিঃশ্বাসের সঙ্গে খুলছিল...বন্যায় ভাসা...
“তিয়া, এ কী করছ?”
“আপনি যান, প্লীজ।” সে হাত দিয়ে মুখটা মুছে নিল। তারপর হঠাৎ তার মাথায় রাখা আমার হাতটা তুলে আস্তে আস্তে চাপড়াতে শুরু করল। চোখের জলের মধ্যে অসহায় একটু হাসি রোদ্দুরের মতো বেরিয়ে আসছিল।
“আমি ঠিক আছি। আপনি এবার যান। কাল সকালে আবার বাস ধরতে হবে।”
তাঁর মৃত্যুর পরে এই প্রথম সে কাঁদল। বিবশ, পাগলের মতো। মৃত্যু আমাদের বরফের মতো অসাড় করে দেয়। কষ্টটা পরে আসে, কালের উত্তাপে ফোঁটা ফোঁটা হয়ে গলে পড়ে। সেদিন অস্থির থলেটা আমার হাতে দিয়ে সে তাঁর কাছ থেকে শেষ বিদায় নিচ্ছিল।
এখন থলেটা আমার সঙ্গে, পাশের খালি সীটে আমার ব্যাগের উপর রাখা। বাসের ঝাঁকুনিতে দুলতে দুলতে আমার সঙ্গে চলেছে।
জানলা দিয়ে ছোট ছোট পাহাড়ি শহর, গ্রাম পার হয়ে যাই। কোথাও বাসটা দাঁড়ায়, যাত্রীদের নামায়, ওঠায়, তারপর আবার চলতে শুরু করে। আমার মনেও ছিল না কত মাইল পেরিয়ে এলাম। চোখ খুলতে দেখি বাস উৎরাই বেয়ে নামছে, রাস্তা চওড়া হচ্ছে, চীর আর দেওদাররা অদৃশ্য, তার জায়গায় ধুলো আর রোদে ঝলসানো অশ্বত্থ আর নিম গাছ।
আমার পাশের সীটে একটি মেয়ে খালি ঝুড়ি হাতে এসে বসল। আমি থলেটা নিজের কোলে রাখলাম। আমার ভয় ছিল ঘুমিয়ে পড়লে স্টপ মিস হয়ে যাবে, তাই বারবার জানলা দিয়ে দেখছিলাম। বাসের কন্ডাক্টর বুঝতে পেরে হেসে বলল, “ভাববেন না, পারুলকোট এখনও অনেক দূর। আমি সময়মত আপনাকে বলে দেব।”
আমি নিশ্চিন্ত হয়ে জানলার দিকে চেপে বসলাম। বাস যতই নীচে নামছে ততই গরম বাড়ছে। বারবার আমার চোখ বুজে আসছিল। গত রাত্রে তিয়ার বাড়ি থেকে ফিরে অনেকক্ষণ ঘুম আসেনি। একটা বিষণ্ণ ক্লান্তি আমার সারা শরীরে ছড়িয়েছিল। একটু ঘুম এলেই হাজার রকম ছাড়া ছাড়া স্বপ্ন পাখির মতো উড়তে দেখি, তাদের কোনওটার মধ্যে কোনও সম্পর্ক নেই। এখন খালি, জনশূন্য রাস্তায় আমি পিছনে অচেনা কারুর পায়ের শব্দ শুনি...
আপনি কি নিরঞ্জনবাবু? আমি পিছন ফিরে দেখি রাস্তার পাশে সাদা মার্বেলের বেঞ্চি, যেখানে কিছুদিন আগে সাহেব-জী হয়তো বসেছিলেন আর আমরা তাঁকে খুঁজছিলাম।
“আপনি এখানে বসুন। উনি এক্ষুনি ফিরবেন।” মুরলীধর কানে ফিসফিস করল।
তার আওয়াজ অন্ধকারে হারিয়ে গেছিল কিন্তু তার নিঃশ্বাসে দেশী শরাবের কটু গন্ধ, যা আমার পরনের কাপড়ে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। আমি হাত দিয়ে সরাবার চেষ্টা করলাম, সে একটু থামল কিন্তু আবার ছড়াতে লাগল—আমার বুকে, গলায়, বগলে, গালের উপর... একটা ঢিমে উত্তাপের আলিঙ্গন আমার উলঙ্গ শরীরে ধীরে ধীরে তার শুকনো পাখা মেলতে লাগল।
হঠাৎ আমার চোখ খুলে গেল। আমি দেখলাম তাঁর অস্থির থলিটার (যা আমি এতক্ষণ বুকে চেপে রেখেছিলাম) ভিতর থেকে ছোট ছোট লাল পিঁপড়ে বার হচ্ছে। এতই ছোট, প্রায় অদৃশ্য, আমার সারা শরীরে কিলবিল না করলে আমি হয়তো তাদের অস্তিত্ব টেরই পেতাম না।
আমি চারদিক দেখলাম, আমার পাশের সীট খালি। আমার ঘুমের মধ্যে সেই পাহাড়ি মেয়েটি কখন নেমে গেছে। বাসের অন্যান্য যাত্রীরা ঘুমে ঢুলছে। ড্রাইভারের পাশে বসে কন্ডাক্টর জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বিড়ি ফুঁকছিল।
আমাকে কেউ দেখছিল না। আমি থলেটা সীটের উপর রেখে শার্টের বোতাম খুলে ফেললাম। সারা শরীরে ছুঁচ ফুটছিল। একবার সকলের চোখ বাঁচিয়ে আমি থলেটা শুঁকলাম, কোনও গন্ধটন্ধ পেলাম না যা অন্যদের নাকে লাগতে পারে। এমনিতেই সারা বাস সিগারেট, বিড়ি, ধুলো আর ঘামের গন্ধে ভর্তি। আলাদা করে অন্য কোনও গন্ধ পাওয়া অসম্ভব।
থলেটার গিঁট বাঁধতে গিয়ে সবার অলক্ষ্যে আমার হাত থেমে গেল। আমার শার্টের হাতার নীচে ফোলা ফোলা লাল দাগ, যেখানে পিঁপড়েগুলো কামড়েছে। এগুলো এল কোত্থেকে? যাচ্ছেই বা কোথায়? আমার শরীরে এরা কীসের খোঁজে? কালকে তো দেখিনি যখন ছাই থেকে বের করেছিলাম, দুধে ধুয়েছিলাম। তারা কি এতই অধীর যে ডোবার আগে আরেকবার জীবনের নিঃশ্বাস নিতে চায়?
আমার ভয় হল এখুনি বাসের ঘুমন্ত যাত্রীরা জেগে উঠে আমার দিকে তাকাবে, কাছে এসে শুধোবে, এটা কি আপনার থলে? কী আছে এতে? দেখতে পাচ্ছেন না কী সব বেরোচ্ছে এ থেকে?... না, না, তার আগেই... আমি উঠে দাঁড়ালাম, কিছু না ভেবেই, ভরতি বাসে, পাগলের মতো, দরজাটা খোলার চেষ্টা করতে লাগলাম।
“কী করছেন বাবুজী? চলতি বাস থেকে পড়ে মরতে চান নাকি?” কন্ডাক্টর আমার হাত জোরে চেপে ধরল। আমাকে সীটে বসিয়ে দিয়ে আমার মুখে কিছু একটা দেখে স্বর নীচু করল।
“আপনার শরীর খারাপ, বাবুজী?”
আমি মাথা নাড়লাম, তার সামনে কিছু বলতে চাইছিলাম না।
“ব্যাস, আর একটু দেরি। আসছে আপনার ষ্টেশন।”
আমি এই অজ্ঞাত, অচেনা যুবকের উপর কৃতজ্ঞতা অনুভব করলাম। সে সবকিছু দেখেও না-দেখার ভান করছে। বাসের ঝাঁকুনিতে আমার ভিতরের আগুনটা নিভে ছাই হয়ে যাচ্ছিল। ঠিক ওই পুঁটলির মতই।
একটু পরে বাস গতি কমাল। জানলার বাইরে ছোট ছোট কুটিরের আঙ্গিনায় উনুনের ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের গায়ে সকালের কুয়াশা-ভাঙা শীতের উজ্জ্বল রোদ। একটা বস্তির পাশে নালার ধারে বাসটা থামতে কন্ডাক্টর দরজা খুলে দিল, “নামুন বাবুজী, আপনার পারুলকোট এসে গেছে।”
দরজার বাইরে ছোটখাটো ভিড়, সবাই ভিতরে ওঠবার জন্য অধীর। কষ্টেসৃষ্টে নীচে নামতেই উপর থেকে কন্ডাক্টরের গলা, “বাবুজি, আপনার ব্যাগ ...ধরুন” বলেই সে বাস থেকে নীচে ছুঁড়ে দিল ব্যাগটা।
কী অবস্থায় আমি ভিড় কাটিয়ে বাইরে এলাম তা ভাবলে এখনও আশ্চর্য মনে হয়।
বাইরে রোদের হল্কা আমার চোখে কাঁচের মত ফুটছিল। আমার সামনে, পিছনে শুধু ধুলোর মেঘ। আস্তে আস্তে ধুলোটা কমলে কয়েকটা মাটির কুঁড়ে ঘর দেখতে পেলাম। কাছেই একটা লেক রোদ্দুরে ঝকমক করছে। তার কাদাজলে কয়েকটা ধ্যানমগ্ন মোষ গা ডুবিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে। জলের উপর তাদের মাথাগুলো কালো ফসিলের মত দেখাচ্ছিল।
এখানে সেখানে ইট-সিমেন্টের তৈরি কঙ্কালসার বাড়ি—কারা অর্ধেক তৈরি করে ফেলে রেখেছে। দুটো-একটা দোকান, ধাবার বেঞ্চি, মাঝে মাঝে খেতখামারও দেখা যায়, আর বড়সড় ব্যারাকের মত বাড়িও। বোঝা যায় না শহর কোথায় শুরু বা গ্রাম কোথায় শেষ। দুটোই কখনও মিলেমিশে যায়, কখনও আলাদা।
আমি যেন কোনও অজানা রাজ্যে এসে পড়েছি। পাহাড়ের পায়ের তলায় এই জরাজীর্ণ, অবহেলিত ভূখণ্ডে বহু শতাব্দী আগে কোনও পথক্লান্ত যাযাবরের দল এসে পড়েছিল। লম্বা সফরের পর নদীর দর্শন পেয়ে এখানেই তারা বাসা বেঁধেছিল।
আমিও সেই নদীর খোঁজেই এসেছি। এই জঙ্গলের মধ্যেই কোথাও অদৃশ্য হয়ে বইছে। কিন্তু কোথায়? কোথায় সেই সরপা নদীর পবিত্র ধারা?
যাকেই জিগ্যেস করি, বলে ব্যস, কাছেই, পনেরো মিনিট, আধ ঘণ্টা... সময়ের কোনও ধারণা নেই... শরীরের ধারণাও তখনই হয় যখন গলা শুকিয়ে থুতু আটকে যায়। মনে হয় কোনও ধাবায় বসে একটু চা খেলে মন্দ হয় না। কিংবা ঠাণ্ডা জল... কিন্তু তখনই থলের কথা মনে পড়ে, আর সব খিদেতেষ্টা মরে যায়। সকলের অজান্তেই আমার মধ্যে একটা গা-গোলানো ভাব উঠতে থাকে।
তাঁর অস্থি এখন আর আলাদা না থেকে আমার শরীরেরই এক অংশ হয়ে গেছে। ঘামে, ধুলোয় মাখা এই শরীরের সঙ্গেই এঁকে নিয়ে চলেছি। বাসে যে পিঁপড়েরা থলি থেকে বেরিয়ে আমায় কামড়েছিল, অল্প জ্বরের তাপে তারা পালিয়েছে। তার জায়গায় আমার সারা শরীরে এখন বড়ো বড়ো লাল ফোস্কা।
শরীরের তাপ আর বাইরের রোদে আর কোনও পার্থক্য ছিল না। মনে হচ্ছে যেন এই চল্লিশ বছরের শরীরটা ছেড়ে অন্য কোনও দেহ নিয়ে একটা স্বপ্নের মধ্য দিয়ে চলছি। আমি, আমার সঙ্গের থলি ও অস্থির মালিক, তিনজনেরই ইচ্ছা বহতা নদীর জলে ডুব দিই যেখানে সবাই একে অন্যের অন্তিম রূপ থেকে মুক্তি পাই। ঠিক তখনই নড়বড়ে পায়ে ঠোক্কর লেগে নীচে তাকাতে চোখে পড়ল পায়ের নীচের জমিটা বদলে গেছে। এখন সেখানে ঝকমকে সাদা পাথরের নুড়ি আর কাঁকর জুতোর নীচে কিচকিচ করছে।
ঝলসানো চোখে চারদিক দেখলাম, আমি শহরের হট্টগোল আর বাজারের ভনভনানি থেকে অনেক দূর চলে এসেছি। দূরের কুয়াশা-ঢাকা পাহাড়গুলো এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চারিদিক নীরব। এমন অদ্ভুত জায়গা যে একটু অন্যমনস্ক হলেই রূপ বদলে নেয়। অপরিচিত, অজানা জায়গা চেনাজানা মনে হতে থাকে। যেন এখানে আগে এসেছিলাম। আমি একেবারে একলা বা নিরাশ্রিত নই, কেউ আমার সঙ্গে আছে, পিছনে পিছনে আসছে।
না, এটা কোনও ভুল নয়। কেউ সত্যিই আমার পিছনে আসছিল, আমার পায়ের সঙ্গে পা মিলিয়ে। আমি থেমে গেলেই সেও থেমে যায়, আবার চলি যখন সেও আমার মতই পা ফেলে চলে। এটা আমার জ্বরতপ্ত মস্তিষ্ক উদ্ভূত সোনার মারীচ নয় তো? পিছ্ন ফিরলে শুকনো মাটিতে আমার নিজেরই ছায়া দেখি...আর কিছুই নয়। আমি ব্যাগটা নামিয়ে থলেটা শক্ত হাতে ধরে ভালো করে পিছনে দেখলাম।
তিন গজ দূরে সে দাঁড়িয়ে। অশরীরী ছায়া নয়, হাড়-মাংস সমেত জীবিত মানুষ, একটু হতচকিত, যেন জানতো না আমি ওকে পিছন ফিরে দেখব। বিস্মিত, অবাক।
“আপনি?” আমার মুখ দিয়ে আর কিছু বেরোল না।
“আজ্ঞে হ্যাঁ...” তার মুখে একটা চালাক হাসি, “আমিও আপনার সঙ্গেই চলছি।” সে তার হাতের ছাতাটা নীচে করল। তার খুদে খুদে কিন্তু তীক্ষ্ণ চোখ পড়ল আমার ব্যাগ, থলে, ঘামে ভেজা জামাকাপড়ের উপর। সে আমার মত বাইরের লোক নয়। তবে কে?
পরনে পরিষ্কার কাচা ধুতি আর শাদা কুর্তা, কাঁধে নীল ডোরাকাটা সাদা গামছা যার দুই প্রান্তে পোঁটলা বাঁধা —-পুরোহিতের সিধের পুঁটলির মত। ছিপছিপে শরীরে বয়সের আন্দাজ করা মুশকিল, তাছাড়া আমি যে অবস্থায় ছিলাম, কারুর সম্বন্ধে কিছু আন্দাজ করার শক্তি ছিল না। এই নির্জন প্রান্তরে সে যে আমার সঙ্গে ছিল, তাই আমার পক্ষে যথেষ্ট মনে হচ্ছিল।
“সরপা আর কতদূর?” আমি জিগ্যেস করলাম।
“দূর তো বেশি নয়, কিন্তু যতই কাছে আসে ততই চলা মুশকিল হয়ে পড়ে, এই দেখুন না কীরকম পাথর কাঁকর ...” সে তার চটি বার করে ঝাড়তে লাগল, “আপনি জুতো পরে ভালো করেছেন, নইলে পায়ের ছালচামড়া উঠে যেত।”
সে চলতে চলতে কথা বলে যাচ্ছে আর সেগুলো শব্দের ধারা হয়ে বয়ে যাচ্ছিল।
“সরপা নদীর রাগ খুব... একেবারে মা চণ্ডী! আগে তো শহরের একেবারে পাশে বইতো...ঠিক যেখানে আপনি বাস থেকে নেমেছিলেন...” সে আমার দিকে তাকালো, “কে জানে কী নিয়ে নিজের মায়ের সঙ্গে ঝগড়া...মা-গঙ্গার কোল থেকে বেরিয়ে একেবারে অন্য দিকে বইতে শুরু করল। পারুলকোটের চাতাল থেকে দেখলে মনে হবে একটা সাপ রোদ্দুরে ফণা তুলে ধেয়ে আসছে, সেই থেকে নাম সরপা। শোনা যায়, অনেক বছর লোকেরা তার কাছে যেতেও সাহস করত না।”
কথার মধ্যে হঠাৎ সে থেমে গেল, যেন কিছু মনে পড়ল। “আপনিও তো এই প্রথম আসছেন, তাই না?”
“প্রথম বার?” আমিও থামলাম।
“হ্যাঁ, ঠিক না?” সে হাসল, “আমি তো দেখেই ঠিক ধরেছিলাম... কোনও কাজ, অনুষ্ঠানের জন্য?” সে আমায় সন্ধানী চোখে দেখছে, কিন্তু ঠিক ততটুকুই, যতটা আমি সইতে পারি।
“আমার ছাতার নীচে আসুন।” সে আমায় তার কাছে টেনে নিল। “একি? আপনার তো গা পুড়ে যাচ্ছে! শরীর ঠিক নেই নাকি?”
“দেখুন, আমার একটু তাড়া আছে।”
“সে তো আমিও জানি—চলুন। এখুনি পৌঁছে যাব।”
সে ছাতাটা আমার মাথায় ধরে সঙ্গে সঙ্গে চলতে শুরু করল। জ্বলন্ত রৌদ্রে শুধু পাথর, ঝোপ, আর মাটির স্তূপ দেখা যাচ্ছে। সে মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে চটি থেকে যখন কাঁকর ঝাড়ে তখন আমারও একটু দম নেবার অবসর মিলছিল। মনে হল সে বাস স্ট্যান্ড থেকেই আমার পিছু নিয়েছে। কে হতে পারে? চেহারা দেখে তো কিছু বোঝা যায়না— গাইড, পুরুত, কোনও হোটেলের দালাল? হয়তো রুজিরোজগার নেই, ছোট শহরে এইভাবেই খদ্দের ধরে। কিংবা আমার অবস্থা দেখে দয়া করে আমার সঙ্গে চলেছে।
আমি এবার একলাই যেতে চেয়েছিলাম, আমি ভাবিনি এরকম অচেনা জায়গায় কেউ আমার সঙ্গে লেগে যাবে। একটা অক্ষম, বলহীন রাগ আমাকে আরও দীন ও করুণ করে তুলছিল। আমি এক ঝটকায় তার ছাতা থেকে বেরিয়ে বড়ো বড়ো পা ফেলে এগিয়ে চললাম।
আমি তার হাত থেকে ছাড়া পেতে চাইছিলাম।
একটুক্ষণ অন্ধের মত চললাম। খোলা চোখেও কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। রোদ্দুরে ঝলসানো পাথর, ধুলোয় কটা আকাশ, কানের পাশ দিয়ে ঘামের ধারা ভিতর বাইরের মধ্যে মিশে যাচ্ছে। জানি না কতক্ষণ এইরকম বিকার অবস্থায় চলেছিলাম ...
টের পাইনি কখন একটা ঢালু উৎরাই বেয়ে নেমে এসেছি...হাওয়ায় আর অতটা হল্কা নেই, দূরে পাহাড়ের ধূসর রেখা আর নীচে একটা জলের কলকল শব্দ, ভিজে কাদামাটি আমার জুতোয় লাগে যাচ্ছিল।
“সরপা মাঈ কি জয়!”
হঠাৎ পিছনে আওয়াজ শুনলাম। আমি ঘুরে দেখি সেই লোকটা খোলা ছাতা হাতে আমার দিকে দৌড়ে আসছে, দেখাচ্ছে যেন একটা বিরাটকায় কালো পাখি ডানা ছড়িয়ে ধেয়ে আসছে।
“দেখলেন আপনি?”
“কী?”
“আরে, সামনে দেখুন, আমার দিকে নয়।”
ধীরে ধীরে আমার চোখের সামনে থেকে ধুলো ধোঁয়ার পর্দাটা সরে দৃষ্টি পরিষ্কার হয়ে উঠল।
সরপা নদী! একটি শুভ্র, উজ্জ্বল জলের ধারা, পাথর ও শিলাখণ্ডের ফাঁকে ফাঁকে বয়ে চলেছে।
“দেখলেন তো?” সে আমার কানে ফিসফিস করে বলল, যেন সরপা মা শুনে না ফেলে, “একটা পাক্কা জাদুকরী...হঠাৎ চোখের সামনে আবির্ভূত হয়। পাহাড়ের গুহা থেকে যেভাবে বেরোয়, যেন গর্ত থেকে সাপ বেরোচ্ছে...দেখুন, ঠিক সাপের মতই। আমি আপনাকে না দেখালে সে আপনার পা জড়িয়ে ধরত।”
সে আনন্দে হাসছিল, যেন নদীর সঙ্গে তার পুরনো সম্পর্ক। “আপনি তো এই প্রথম এলেন। কিন্তু আমি যখনই আসি, প্রত্যেকবার আশ্চর্য হই...আর অন্য নদীর মত এর আওয়াজ দূর থেকে শোনা যায় না ...চোখের সামনে না আসা পর্যন্ত বোঝা যায় না...”
“আপনি রোজ আসেন?' আমি কিছু বিরক্তি, কিছু কৌতূহল নিয়ে শুধোলাম। সেই অদ্ভুত হাসিটা তখনও তার মুখে লেগে।
“আমি কি নিজে আসি? যখন ডাক পড়ে তখনই চলে আসি।”
“কার ডাক?”
“সরপা মাঈয়ের, আবার কার?”
“আজও ডাক পেয়েছিলেন বুঝি? ”আমি কটাক্ষে চাইলাম, কিন্তু তার মুখ একেবারে নিরীহ।
“আজ না... তিন দিন আগে। কেউ অন্ত্যেষ্টি করতে আসবেন, এই বুঝেছিলাম। আজ আপনাকে বাস থেকে নামতে দেখে বুঝে গেলাম। উনি কে আপনার? কোনও নিকট আত্মীয় বুঝি?”
আমার ভিতরে একটা কিছু মোচড়াচ্ছিল, সামলে নিয়ে বললাম, “যিনি আপনাকে ডেকেছেন তিনি কিছু বলেননি?”
“কেন বলবেন না? কিন্তু হিসেব কি আর মনে থাকে? এই জন্মের আত্মীয় কি গত জন্মেরও ছিল?”
আমি দেখলাম সে আর হাসছে না। নির্নিমেষে নদীর দিকে তাকিয়ে, আমার দিকে নজর ছিল না। কে সে? জ্বরের তাপে প্রশ্নটা বুদবুদের মত উঠেই আবার বিরক্তিতে মিলিয়ে গেল।
আমি ব্যাগটা মাটিতে নামিয়ে সামনে একটা পাথরের উপর বসলাম। হাতে থলেটা ধরাই ছিল। জলের কলকল শব্দের মধ্যেও আরেকটা শব্দ শোনা যাচ্ছিল, একেবারে আলাদা, যেন সরপা নদীর অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসছে, কোনও নাম-না-জানা প্রান্তর থেকে নিয়ে আসা, যেখানে সব কিছু হতে পারে, সবকিছুই সম্ভব। সে কাছে এসে নিজের গামছা দিয়ে আমার মাথা মুছে দিল। আমার মাথার চুল ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে গেছিল।
“আপনার তো সারা শরীর পুড়ে যাচ্ছে! দাঁড়ান, আমি জল নিয়ে আসি।”
এবার আমি আর কোনও প্রতিবাদ করলাম না। সে যেন আমার সব ইচ্ছা ও উদ্দেশ্য নিজের মধ্যে শুষে নিয়েছিল। আমি বশীভূত হয়ে ওকে দেখছিলাম।
ও গামছার কোনায় বাঁধা পুঁটলিটা খুলে তামার ছোট ঘটি আর গেলাস বার করল। চটি খুলে রেখে, ধুতিটা হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে নদীতে তিন চার পা নেমে জল ভরতে লাগল। ফিরে এল মুখে সেই পুরনো হাসিটা নিয়ে।
“এটা খেয়ে নিন... দেখুন কত তাড়াতাড়ি সুস্থ লাগবে। সরপা মা নিজের জলে সব জড়িবুটি গুলে রেখেছেন।” আমি গেলাসটা নিয়ে ঢকঢক করে সব জল খেয়ে নিলাম। জানতাম না কতক্ষণ ধরে এই প্রচণ্ড তেষ্টাটা বাড়ছিল। ঘটিটার দিকে হাত বাড়াতেই সে আমার হাত ধরল।
“এখন না... এই জলটা তাঁর জন্য, যাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। তাঁর তেষ্টা যে আপনার চেয়েও বেশি।”
আমার চারদিকে হাওয়া, পাথর, জল আর আকাশ। আর কিছুই না! কিন্তু আমার নজর পড়ল জলের ধারে একটা পাথরের উপর, যেখানে চারটে ভাতের পিণ্ড রাখা আছে। এগুলো এল কোত্থেকে? ওর গামছার পুঁটলিতে ঘটি গেলাসের সঙ্গে রাখা ছিল নাকি?
আমি হাঁ করে তাকে দেখছিলাম। তার দেওয়া জল আমার সব বিরক্তি ও সন্দেহ শান্ত করে দিয়েছিল...যেন তার ওখানে দাঁড়ানো একেবারেই প্রত্যাশিত, তার মুখ থেকে বেরনো দুর্বোধ্য মন্ত্র যা নদীর জলের শব্দে মিশে আমার তপ্ত শরীরের ভিতরে বয়ে যাচ্ছিল। একবার ভাবলাম থলেটা কোথায়? আমার হাতেই ছিল কিন্তু এখন সেটা তার সামনে খোলা, দেখে আশ্বস্ত হলাম যে উনি এখন আমাদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে গেছেন। এই খোলা আকাশের নীচে, বহতা সরপার ধারে, যেখানে ঘটির জলের ছিটে পড়ছে তাঁর অস্থির আর পিণ্ডের উপর...
হঠাৎ সে উঠে দাঁড়িয়ে ঘটির শেষ জলটুকু পিণ্ডের উপর ঢেলে দিল, তারপর আকাশের দিকে মুখ তুলে অদ্ভুত গলায় ডাকতে লাগল, “আ—-ও, আ—- ও, আ—ও...”
প্রথমে আস্তে, তারপর একটু উঁচু স্বরে, শেষে আরও জোরে... সেই ডাক নদীর কলশব্দ ডুবিয়ে দিয়ে আশেপাশের পাথর, মাটি, পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত প্রতিধ্বনিত হতে থাকল।
আমার মনে হল যে লোকটা বাস স্ট্যান্ড থেকে আমার পিছু নিয়েছিল সে অন্য কেউ আর এই লোকটা যে ঘটি হাতে আকাশের দিকে মুখ তুলে ডাকছে সে আরও একজন।
তার খোলা চোখদুটো কারুর দিকে চেয়ে, হাঁটুর উপর ধুতি হাওয়ায় উড়ছে, মুখ খোলা যেন এক গভীর গুহা যা থেকে থুতু ছিটকে আসছে...আর সে ডাক অনুরণিত হয়ে চলেছে...”আ—ও, আও, আ—-ও...”
এক দরবেশের মত সে আকাশে মুখ তুলে হাত নাড়ছিল... কাকে ডাকছিল? এই নির্জন প্রান্তরে কে তার আবাহনের অপেক্ষায়?
হঠাৎ তার ডাক আস্তে আস্তে নীচু হয়ে থেমে গেল। একটা কাক পাখা মেলে নামছিল ... সঙ্গে সঙ্গে পাথরের উপর জলের ছলকানি তাকে ডেকে আনছিল সুদূর পিতৃলোকের অতিথির পথ প্রদর্শকের মত।
সে আসছিল চারটে ভাতের পিণ্ডের কাছে। দেখতে দেখতে তার পিছনে আরেকটা, তিনটে, চারটে কাক পিণ্ডের চারদিকে গোল হয়ে বসে গেল। শাদা ভাতের উপর তাদের কালো ঠোঁটের চমক, শহুরে কাকের মত সতর্ক বা চৌকস নয় তারা, আমার উপর নিরাসক্ত, নিজেদের খাওয়ায় ব্যস্ত।
যখনই কোনও কাক মাথা তুলে আমাদের দেখে, মনে হয় আমাদের দিকে তাকিয়েও তার দৃষ্টি দূরে অন্য কোথাও। আমাদের উপস্থিতির সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই।
“বলেছিলাম না ওরা আসবে!”
ওর গলা শুনতে পেলাম। খেয়াল করিনি কখন সে আমার পাশে এসে বসেছিল।
“চলুন... অনিষ্ট কেটে গেছে, এখন আর চিন্তার কিছু নেই।”
“কীসের অনিষ্ট?” আমার মনে একটা আশঙ্কা মাথা চাড়া দিল।
“জানতাম আপনি জিগ্যেস করবেন... যারা আসে, সবাই জানতে চায়। এগুলি কি আপনার কাক মনে হয়? ভালো করে দেখুন...”
তার গলা নী্চু হয়ে এল। “আপনি ভাবছেন এরা শুধু খাবারের লোভেই এসেছে... আসলে এরা এসেছে মৃতের ছেড়ে যাওয়া আকাঙ্ক্ষা ও বাসনাগুলি গিলে ফেলতে। এরা না থাকলে অতৃপ্ত প্রেতাত্মারা ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত হয়ে ঘুরে বেড়াত। আপনি কি মনে করেন দেহ জ্বলবার সঙ্গে সঙ্গে মনও পুড়ে ছাই হয়ে যায়? আপনি তো জানেন না, আরও কত কিছুই যে বাকি থেকে যায়। আপনার ভাগ্য ভালো যে আজ ডাকার সঙ্গে সঙ্গে এরা এসে গেল। কখনও কখনও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়, তবুও তাদের দেখা পাওয়া যায় না।”
“আপনার ডাক শুনেই বুঝি...”
“শুধু ডাক নয়, ডাকার ভাবটাও থাকা দরকার। নিজেকে প্রেতাত্মার সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে, যাতে তাঁর কামনা, বাসনা, পিপাসা, আকাঙ্ক্ষা সব আপনার ডাকের মধ্যে এমনভাবে মিলে যায় যে বোঝাই যায় না ডাকটা মৃতর না জীবিতর... ওই দেখুন—”
সে আমার হাতটা ধরে ফেলল।
আমি একটা শিহরন বোধ করলাম, যেন কেউ এক ঝটকায় আমাকে নাড়িয়ে দিল। আমরা দুজনেই চোখ তুলে উপরে তাকালাম। আমাদের অতিথিরা এক সঙ্গে ডানা ঝটপট করে উপরে উঠে একে একে আমাদের মাথার উপর চক্কর দিয়ে গেল—এত কাছে যে ওদের পাখার হাওয়া আমার মাথায়, চুলের ভিতরে সুড়সুড়ি দিচ্ছিল। তারপর ওরা এক সঙ্গে নদীর ওপারে চলে গেল, অত দূরে ওদের আর আলাদা করে দেখা যাচ্ছিল না। একবার বিস্তীর্ণ নীল আকাশের বুকে কালোর চমক দিয়েই পাহাড়ের পিছনে—যেখান থেকে তারা এসেছিল— শেষবারের মত অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপর আর কিছুই দেখা গেল না।
শুধু খালি আকাশ, হাওয়া আর নদীর কলধ্বনি...আর কিছুই না।
“যান... এখানে বসে আর কী হবে... ওনারা তো গেলেন, এবার এটাকেও ভাসিয়ে দিন।” বলে অস্থির থলেটা আমার হাতে ধরিয়ে দিল।
“কী হল আপনার? এমনভাবে বসে আছেন?...এইজন্যেই তো এখানে এসেছিলেন...”
আমি তবু বসে রইলাম, শূন্য, জড়, নিষ্প্রাণ, পাথরের মধ্যে আরেকটা পাথর।
সে আমায় ধরে ঝাঁকাচ্ছিল।
“আপনি কাঁদছেন?”
আমি টের পাইনি, চোখের জলটা কখন, কোথা থেকে বেরিয়ে এল, সেও কি এই সময়েরই অপেক্ষা করছিল?
“আপনি বলেননি, ইনি আপনার কে হন?”
কী করে বলি? উনি আমার কে? সে তো আমি নিজেও জানি না...এ কেমন সম্পর্ক যার কোনও নামই নেই?
আমি থলে হাতে টলতে টলতে নদীতে নামলাম। আস্তে আস্তে পা ফেলে এলাম যেখানে নদীর স্রোত পাথরের গায়ে ছিটকে দুধের মত ফেনা সৃষ্টি করেছে। থলেটা নীচে নামাতেই সরপা বিদ্যুতবেগে এক ঝটকায় আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিল। অস্থিগুলো এক মুহূর্ত জলের উপর দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল।
জলে দাঁড়িয়ে আমি অনেকক্ষণ সেই দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি আর কোথাও ছিলেন না, এক মুহূর্তের জন্য মনে হল আমি একেবারে হালকা, ভারশূন্য হয়ে গেছি, আমার একটা অংশ যেন তাঁর সঙ্গেই ভেসে গেছে। ফিরে যাবার পর আমি আর আগের মত থাকব না যে তাঁকে এখানে নিয়ে এসেছিল বা একদিন তাঁর কাছে এসেছিল।
জানি না মরার পর মানুষ পুনর্জন্ম নেয় কিনা, কিন্তু যারা পিছনে থেকে যায়, তাদের পুনর্জন্মের আশা হয়ে থেকে যায়।
ফেরার পথে সে আমার সঙ্গে সঙ্গে চলছিল। আমি তার গলা শুনতে পাচ্ছিলাম, আমার জ্বরের ওঠানামার সঙ্গে তার গলাও উঠছিল, নামছিল। তার ছাতাটা ধরা আমার মাথার উপর।
এটুকু মনে আছে সে আমায় বিশ্রাম নিতে বলছিল। এত জ্বর নিয়ে যাওয়াটা ঠিক নয়। সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমি তার বাড়িতে থাকতে পারি। থেকেও যেতাম, ওর বাড়িতে না হলেও কোনও হোটেলে বা ধর্মশালায়।
কিন্তু বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে দেখলাম বাসটা একটু পরেই ছাড়বে। আমি তাড়াতাড়ি তার হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে, তার আপত্তি সত্ত্বেও বাসে উঠে পড়লাম। ভাগ্যিস বাসটা প্রায় খালি ছিল। জানলা দিয়ে তাকে ধন্যবাদ জানাতেই বাস ছেড়ে দিল। শুধু তার হাতনাড়া আর ছাতার দুলুনিটা শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল।
বছর কেটে গেছে। আমি আর ওই শহরে ফিরতে পারলাম না। সাহেবজীকে সরপায় ভাসিয়ে দিয়ে আমার নিজের মধ্যেও কিছু একটা ভেসে গেছিল যা এতদিন আমার জগতটা টিকিয়ে রেখেছিল।
তিয়া কি জানত আমি আর ফিরব না? তাহলে ভুল জানত। আমি বারবার রাত্তিরে ঘুমের মধ্যে, দুপুরে রোদ্দুরের মধ্যে, রাস্তায় চলার সময়, টেবিল ল্যাম্পের নীচে একলা পড়ার সময়, সেখানে চলে যাই, যার নাম কোনও ম্যাপে নেই, সাহেবজীর অ্যাটলাসেও না।
একটা হারিয়ে যাওয়া শহর, যেখানে আমি এক সময় নিজেকে খুঁজেছিলাম।
সেগুলো কি এখনও সেখানে আছে? আপেলের বাগানে, নক্ষত্রমণ্ডল দেখার সময়, যেখানে আজও আকাশগঙ্গা বইছে? আর সেই সমুদ্র, ক্লিনিকের জানলা দিয়ে ডক্টর সিং আমায় দেখিয়েছিলেন, এই শহরের লক্ষ বছর আগের অতীতে?
সেজন্যই কি সে মাটির তলায় যাবার সময় হেসেছিল? সে কি কিছু দেখেছিল যা উপরের জীবিত লোকেরা দেখতে পায় না?
শুধু শুনতে পায়, কখনও কোনও বিরল মুহূর্তে, যখন কোনও বসন্তের বিকেলে অ্যানাজী নিজের ঘরে পিয়ানো বাজায়। সেও ঘরছাড়া, পিয়ানোর উপর তার আঙুলগুলি শরণার্থী আত্মাদের কাছে ডেকে আনে। ঠাণ্ডায় কাঁপতে থাকা ভিখারিকে যেমন লোকে ভিতরে ডেকে নেয়।
আমি শুনি আর ভাবি, আমি কি সত্যিই সেখানে গেছিলাম, যেখানে সব কিছুই শেষ হয়ে গেছে?
~ সমাপ্ত ~
সংযোজন
'অন্তিম অরণ্য' পড়ার সময় আমরা দেখি বাইরে থেকে একই সময়-চক্রে বাঁধা থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটি অন্তরমহলে কোনও এক সময়ে বাঁধা পড়েনি। সময়ের বদলে লেখক উপন্যাসটি দিক বা স্থানে রূপান্তরিত করেছেন। গল্পের গঠন স্মৃতিতে নিজস্ব আকার ধারণ করে—সেই স্মৃতি কোনও সময়ের চক্রে বাঁধা পড়ে না, এখানে সবই একসঙ্গে— অজ্ঞেয়র কাছ থেকে শব্দ ধার করে বলা যায় যে এখানে সবকিছুই 'নিরন্তর সাহচর্যর' অবস্থায়। এই নিরন্তর, নিরবধি সাহচর্য কি সময়কে দিক বদলে দেয় না?
এই প্রথা প্রাচীন ভারতীয় কথাশৈলীর এক নতুন রূপান্তর। প্রায় প্রতিটি অধ্যায়ে আমরা একটি নিজস্ব, একক কাহিনী অনুভব করি। কিন্তু প্রতিটি কাহিনী উপন্যাস রচনায় তার অপরিহার্য জায়গা দখল করে রেখেছে। তারা স্বতন্ত্র কিন্তু একই সাথে উপন্যাসের অভ্যন্তরীণ রচনায় আগের অধ্যায় থেকে বার হয়ে পরের অধ্যায়ের সঙ্গে যুক্ত।
এইরকম একটি রচনা যেখানে প্রত্যেক স্মৃতি নিজের মধ্যে স্বতন্ত্রও বটে আবার সম্পূর্ণ কাহিনীর অংশও বটে। এই রূপান্তর শুধু আনুষ্ঠানিক নয় আর সহজে বোঝাও যায় না, কারণ এটি কোনও প্রাচীন যুক্তির পুনরাবৃত্তি নয়। ভারতীয় কালবোধ— সব সময় ও সর্ব জগতের সংসর্গবোধই এই উপন্যাসের ভাবদৃষ্টি।
——নন্দকিশোর আচার্য