• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৯ | জুলাই ২০২৫ | উপন্যাস
    Share
  • অন্তিম অরণ্য (৬) : নির্মল ভার্মা
    translated from Hindi to Bengali by ছন্দা চট্টোপাধ্যায় বিউট্রা
    | | | | | ৬


    অধ্যায়--২.৪

    সেদিন বিকেলে বাড়ি এসে বারান্দায় মুরলীধরকে দেখে আশ্চর্য হলাম। লন্ঠন নিয়ে সিঁড়িতে বসেছিল, আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো, "সাহেবজীকে দেখেছেন?"

    "নিজের ঘরে নেই?"

    সে মাথা নাড়ল। "আমি সারা ঘর খুঁজেছি, কোথাও পেলাম না, তাই ভাবলাম হয়তো বেড়াতে বেরিয়েছেন।"

    আমি দৌড়ে কটেজে গেলাম। সব ঘরের দরজা খোলা, আলো জ্বলছে। তাঁর ঘর ঠিক তেমনি আছে যেমন আমি লাস্ট দেখে গেছিলাম। তেপায়ার ওপর জলের জাগ, ভিটামিনের ট্যাবলেটের শিশি, চেয়ারের নিচে তাঁর চপ্পল, আলমারিতে ভাঁজ করা কাপড়, টেবিলে তাঁর নোটবুকগুলো। শুধু বিছানাটাই খালি।

    মুরলীধরও আমার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি ঘরের কোণকানাচ, বাথরুম, পেছনের বাগান সব খুঁজল। এ যেন একটা লুকোচুরি খেলা-- সাহেবজী সবার চোখের আড়ালে কোনো দরজার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন।

    কোথায় যেতে পারেন এই সময়? "তুমি শেষ কখন দেখেছিলে তাঁকে?” আমি মুরলীধরকে জিজ্ঞেস করলাম।

    "বিকেলে...আমায় জিগ্যেস করলেন আপনি কোথায়। আমি বললাম আপনি নিরঞ্জনবাবুর সঙ্গে বেরিয়েছেন... একটু পরে আমায় বললেন, তুমি বাড়ি যাও। আমার দরকার পড়লে ডাকব।"

    "তারপর?"

    "তারপর যখন তাঁর জন্য সূপ নিয়ে এলাম, দেখি ঘরে নেই! লাঠি আর জুতোও নেই। তাই ভাবলাম হয়তো অ্যানাজীর বাড়ি গেছেন। সেখানে গিয়ে দেখি বাড়ি তালা বন্ধ..."

    বুঝতে পারলাম না কী করে সম্ভব। উনি এতদিন ঘরের বাইরে পা ফেলেননি, আজ হঠাৎ সবার চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে গেলেন? নিজের ওপরেই রাগ আর ক্ষোভ হতে লাগল। আমার তাঁকে ছেড়ে যাওয়া উচিত হয়নি। হয়তো মনে আঘাত পেয়েছেন যে নিরঞ্জনবাবু এলেন, কিন্তু তাঁর সঙ্গে দেখা না করে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। তিয়া চলে যাবার পর থেকে ছোট ছোট ব্যাপারে তাঁর অভিমান হয়। আমার এই সব মনে পড়তে লাগল, যা আগে ভাবিনি, তুচ্ছ মনে করে সরিয়ে রেখেছি... কোনো কোনো রাতে বলতেন "রেজিস্টারটা নিয়ে এসো তো। (আমার নোটবুকটা উনি 'রেজিস্টার' বলতেন), আজ একটা জরুরী কথা মনে পড়লো। তাড়াতাড়ি করো, নইলে ভুলে যাবো।" আমি রেজিসটার নিয়ে বসে থাকতাম আর উনি বিছানায় চোখ বুজে।

    "চলুন বাবুজি, বাইরে গিয়ে দেখি। হয়তো বেশি দূর কোথাও যাননি।"

    "কোথায় দেখব?" আমি হতাশ সুরে বললাম।

    "আপনি ওপরে পোস্ট অফিসের রাস্তাটা দেখুন... আমি নিচে বাজারের দিকে যাই। এই লন্ঠনটা আপনি রাখুন। আমি এমনিই চলে যাবো।"

    লন্ঠনের দরকার ছিলো না। ওপরে তারার জাল বিছানো। সারা পাহাড় আবছা আলোয় ভেসে যাচ্ছে। রাস্তা জনশূন্য। একটা অজানা আতঙ্ক আমায় দখল করে ফেলছিল। যদি হাঁটতে হাঁটতে কোনো গভীর খাদে পড়ে যান? কেউ জানতেও পারবে না কোথায় পড়ে আছেন। যদি কোনো শেয়াল-নেকড়ের চোখ পড়ে? এই সময় শীতের শুরুতে তারা প্রায়ই গুহা ছেড়ে খাবারের খোঁজে নিচে নেমে আসে। কিন্তু এ সব ছাড়িয়েও যে চিন্তাটা সবচেয়ে বেশি ভয়ের, তা হল-- তিয়াকে নিয়ে। তাকে আমি কী করে আমার মুখ দেখাব?

    পোস্ট অফিসের শূন্য ঘর, চীর গাছের সরসর আওয়াজ, তারার আলোয় পাকদণ্ডী চলে গেছে গাঁয়ের দিকে ...আমি সব ছাড়িয়ে হাঁটছিলাম, কোথাও ওঁর দেখা পেলাম না। এখন অ্যানা আর ডক্টর সিং-এর বাড়ি বাকি। ওখানে গেলে তাঁরা নিশ্চয়ই আমাদের খবর দিতেন। ক্লান্ত আমি সামনে ডিসপেনসারির একটা বেঞ্চিতে বসে পড়লাম। দিনের বেলায় এখানে রোগীরা বসে। আমার মনে হল আমিও তাদেরর একজন। কোনো বিরল রোগে আক্রান্ত, যা কেউ এখনও ধরতে পারেনি। ধরবে কি, আমি তো বাইরের একজন, তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, যিনি নিজের বাড়ির সামনেই হারিয়ে গেছেন।

    অনেকদিন আগে মিসেস মেহরা আমাকে এই শহরের এক ডাকপিওনের গল্প বলেছিল... সে রোজ ব্যাগ-ভর্তি চিঠি নিয়ে বেরুত কিন্তু চিঠি সবাইকে দেবার বদলে নীচের মাঠে ফেলে দিতো... সেই জায়গাটারই নাম হয়ে গেল 'ভ্যালি অফ ডেড লেটারস'! মরা চিঠির উপত্যকা। হয়তো কারুর ভাগ্যই এরকম একটি চিঠির মত, সারাজীবন অন্য চিঠিদের সঙ্গে থেকেও সবার কাছ থেকে হারিয়ে থাকে।

    তারার আলোয় বসে সেই রাতে আমি শহরটা দেখছিলাম... ওপরে নিরঞ্জনবাবুর ফলের বাগান, নীচে অ্যানার পুরনো কুঠি, মেহরা সাহেবের কটেজ, চৌকিদারের অফিসের পেছনে কবরখানার ইউকালিপটাসের ঝাড়--আর সবাইকে ঘিরে পাহাড়, জঙ্গল, নদী, নালা, পাথুরে শিলাভূমি যার মধ্যে চাপা দেওয়া অগুনতি জীবের ফসিল ও কঙ্কাল, তাদের ভেতর কোন প্রাচীন সময়ের ঘড়ি টিকটিক করে চলছে, জানিয়ে দিচ্ছে যা আগে থেকেই ঘটে গেছে। আমার মনে হল হয়তো মেহরাসাহেবও ওই কালচক্রের অন্তহীন চক্র থেকে মুক্তি পাবার জন্যই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন।

    কিন্তু কোথায় যেতে পারেন?

    তখনি দূর থেকে একটা লন্ঠন দেখতে পেলাম। অন্ধকারে মনে হল লন্ঠনটা আপনাআপনি হেঁটে আসছে। একটু পরে তার পেছনে কালীর ছায়া--যেটা দৌড়ে আমার পায়ে পড়ে চেঁচামেচি শুরু করলো। পরমুহূর্তে মুরলীধর আমার সামনে উপস্থিত।

    "...চলুন, সাহিবজী এসে গেছেন।"

    "কোথায় পেলে?" আমি উত্তেজনায় ওর কাঁধ চেপে ধরলাম।

    "তারা দেবীর মন্দিরের সিঁড়িতে বসেছিলেন।"

    "তারা দেবী? সেখানে কী করে?"

    মুরলীধর চুপ করে রইল। তার চেহারায়া আতঙ্কের ছায়া। যেন তারা দেবীর ডাক যে কোন সময়, যে কারুর জন্য আসতে পারে।



    আমি উঠে দাঁড়ালাম। সামনে মুরলিধরের লন্ঠন, তারপর কালী আর তার ছায়া, সবশেষে আমি ...সবাই ঘরমুখো চললাম।

    অধ্যায়--২.৫

    সেই দিন থেকেই তাঁর রাস্তা খুলে গেল। যখনতখন কাউকে কিছু না বলেই বেরিয়ে যেতেন। ঘরের দরজা খুলে দেখতাম কেউ নেই। চেয়ার, টেবিলগুলো আমার দিকে অভিমান ভরে তাকিয়ে, তারাও জানে না তিনি কী করে তাদের হাত এড়িয়ে পালিয়েছেন। ভাগ্যি ভালো, তাঁর খোঁজে আমাদের বেশিদূর যেতে হত না। মুশকিল যে উনি রোজ তাঁর লুকোবার জায়গাটা বদলাতেন। একদিন নালার ধারে বসে তো আরেক দিন ফরেস্ট হাউসের পেছনে ঢালু জমিতে শুয়ে, আমাদের দেখে অবাক হয়ে যান যেন আমরা অন্য গ্রহের বাসিন্দা, হঠাৎ তাঁর সামনে দেখা দিয়েছি। আমি তাঁর হাত ধরে তাঁর পাশেই বসে পড়তাম। তিনি হাত ধরে রাখতে দিতেন কিন্তু মুখে কিছু বলতেন না।

    সেসব দিনে উনি কথা খুব কমই বলতেন। যাতে উনি একা না বেরিয়ে পড়েন, আমিও তাঁর সঙ্গে যাওয়া শুরু করলাম। রাস্তায় চলতে চলতে ওঁর ঠোঁট নড়ে, যেন নিজেকে কিছু বলছেন। পরে বুঝলাম নিজেকে নয়, নিজের মধ্যেই, অনেকটা ধ্যান অবস্থার মত। হয়তো তাঁর জীবনের কোন রহস্যময় অধ্যায়--যা এর আগে কাউকে বলেননি, এখন কোন অদৃশ্য স্টেনোগ্রাফারকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছেন। সে আমারই প্রতিদ্বন্দ্বী, তাঁর সঙ্গে ছায়ার মত চলে অথচ আমি তার সম্বন্ধে কিছুই জানি না। কখনো কখনো দু-একটা ছুটকো শব্দ কানে আসে, "আপনি কিছু বললেন?" আমি জিগ্যেস করি। তিনি চলতে চলতে থেমে যান যেন আমি তাঁর স্বগত বার্তালাপে বাধা দিচ্ছি। এরপর আবার চলতে থাকেন আর আমি শুনি আবার কোন কথা যা মাছের মত জলের ওপর লাফ দিয়ে উঠে আসে-- কোন ভুলে যাওয়া বন্ধুর নাম, পুরনো কোন শহর, বা এক গভীর দীর্ঘশ্বাস যা বিদ্যুতের মত তাঁর বুক চিরে ঝিলিক দিয়ে যায়। কোনোদিন জানাচেনা পরিষ্কার কথা শোনা যায়--যেমন Great Expectations... আমি কৌতূহল নিয়ে তাকাই, বলেন, পড়েছ? আমি বলি, ডিকেন্স? উনি হাসেন, ডিকেন্স না তো কি? হার্ডি? ক্লাবের লাইব্রেরিতে আছে। গিয়ে দেখাবো।

    ক্লাবের লাইব্রেরিটা বেশ নিরালা জায়গা। ইংরেজদের সময় হয়তো খুব রমরমা ছিল। তাদের বিবিরা এখানে অনেক সময় কাটাতো। রিটায়ার হয়ে দেশে ফেরার সময় নিজেদের বইগুলো সমুদ্রপারে সঙ্গে নিয়ে যাবার বদলে লাইব্রেরিতে দান করে যেতো। অনেক বইয়ের প্রথম পাতায় তাদের নাম দেখা যায়। মিশনারিদের স্মৃতিকথা, শিকারিদের রোমাঞ্চ কাহিনী, ওয়াল্টার স্কট, আর এল স্টিভেন্সন, কিপলিং-এর উপন্যাস... বইয়ের নাম থেকেই সেই অফিসার বা তাঁর স্ত্রীদের রুচির পরিচয় পাওয়া যায়। বইয়ের আলমারির পাশে খালি দেওয়ালে বাঘ, সিংহ বা চিতার ছাল টাঙানো। জীর্ণ, ধুলোভরা চামড়াগুলি কোন প্রাচীন গুহাচিত্রের মত দেখায়। যেন জীবন্ত প্রাণীটি মরার পর ওই চামড়ায় রূপান্তরিত হয়েছে।

    ওই সময় আমি কতদিন সাহিবজীর সঙ্গে এই সব বই, বাঘ আর শিকারিদের মধ্যে কাটিয়েছি। লাইব্রেরিতে ঢুকেই তিনি কোনো আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে যেতেন। তাঁর সব জানা ছিল, কোন তাকে কোন বই রাখা। তাঁর ছড়ির ডগা সেই ধুলোভরা তাকে ঘুরতো, ভেতরে মরক্কো চামড়ায় বাঁধানো বইয়ের মলাটে মাকড়শার জালের মত সোনার জলে নাম লেখা। কখনো কোন ওয়েলস বা কনরাড তাঁর ছড়ির ডগায় উঠে আসতো, তিনি সেখানেই একটা টুলে বসে পড়তে শুরু করতেন। পড়তে পড়তে একটা হাসির আভাস মুখে দেখা দিতো, যেন অতীতের কোন সুখস্মৃতি বইয়ের পৃষ্ঠায় নেমে এসেছে। তিনি ভুলে যেতেন যে আমিও তাঁর সঙ্গে।

    একদিন হঠাৎ বই থেকে মুখ তুলে আমার দিকে তাকালেন, "তুমি এখনও এখানে বসে আছো?"

    "আপনি পড়ুন। আমার তাড়া নেই।"

    "শোনো, একটা কাজ করো... যতক্ষণ আমি এখানে পড়ছি, তুমি বার-এ গিয়ে একটা ড্রিঙ্ক নিতে পারো। হয়তো ডক্টর সিং-কেও পাবে সেখানে।"

    “আমার এখানে বসাটা ভালো লাগছে না?"

    একটু উদাস হাসি, "ভালো কেন লাগবে না? তোমায় দেখেই আমার নিজের কথা মনে পড়ে -- তিয়া যখন ছুটিতে আসতো, এইখানে বসে নিজের কাজ করতো। আর আমি বার-এ বসতাম। লাইব্রেরি বন্ধ হবার পর আমরা একসঙ্গে বাড়ি ফিরতাম।”

    "আপনি একটু সুস্থ হয়ে উঠুন, তারপর আমরা তিয়ার সঙ্গে দেখা করতে যাবো। বাসে মাত্র পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা--"

    "তিয়ার সঙ্গে?" তাঁর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল যেন আমার কথা বিশ্বাসই হচ্ছে না।

    "আমাদের দেখে এত চমকে যাবে... আমরা বলব, এইবার আমরা তার সঙ্গে ক্রিসমাস কাটাতে এসেছি।"

    কিন্তু পরমুহূর্তে তাঁর মুখে ছায়া নেমে এল।

    "কে জানে। ও আবার রাগ করবে না তো?" উনি আশ্বাস পাওয়ার জন্য বাচ্চার মত আমার দিকে তাকালেন।

    "রাগ করবে কেন?"

    "আমাদের এইরকম হঠাৎ পৌঁছনো--"

    "আপনি চান তো আগে একটা চিঠি লিখে দিতে পারি।"

    তিনি অনিশ্চিতভাবে চুপ করে রইলেন। বইটা আলমারিতে তুলে রেখে বললেন, "ঠিক আছে, দেখা যাবে।" আমার দিকে তাকিয়ে, "চলা যাক।"

    আমরা বেরিয়ে এলাম। গেটের সামনে চীর গাছের সরু পাতার ফাঁকে তারা দেখা যাচ্ছিল। তিনি নিজের ছড়ি নিয়ে চলতেন, কখনো আমায় তাঁর হাত ধরতে দেননি। ছড়ির খটখট আর ঝিঁঝিঁর টান... এদের যুগলবন্দী শুনতে শুনতে মনে থাকতো না যে আমরা শুনছি কোন আদিম জগতের ছন্দ। হাঁটতে হাঁটতে উনি হঠাৎ থেমে যান--তারাদের নীচে, চীরের সরসর শব্দে প্রকৃতির কোন বার্তালাপ শোনার চেষ্টায়। সেই আলাপের কোন আদি বা অন্ত নেই, যেকেউ যেকোন সময় শুনতে পারে ।

    কয়েকদিন পরে, ক্লাব থেকে ফিরবার পথে উনি হঠাৎ আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, "সেদিন দুপুরে তুমি আমায় যা বলেছিলে, তা কি শুধু আমাকে ভুলোবার জন্যই?"

    "কী কথা? কোন দুপুরে?"

    উনি একটু বিরক্ত হলেন, "তোমার কিচ্ছু মনে থাকে না, যাকগে!" লাঠি ঘুরিয়ে জোর পায়ে চলতে শুরু করলেন। আমি তাড়াতাড়ি এগিয়ে শুধলাম, "বলুন না, কীসের কথা বলছেন?"

    তিনি কিছু না বলে চলতে থাকলেন। একটু পরে নিজেই থামলেন, "আমি জানতাম না তোমার মেমরি এতো দুর্বল... আমার কথা না হয় বাদ দাও, তোমার নিজের কথা কিছু মনে রাখতে পারো?"

    "কোন কথা ....যে আমার মনে নেই?"

    "আমরা কি সত্যিই তিয়ার সঙ্গে দেখা করতে পারি?"

    তাঁর তখনো মনে ছিল, যদিও আমি সেটা কথার কথা ভেবে ভুলে গেছিলাম।

    "সে তো খুব ভালো কথা, কিন্তু আগে একটা চিঠি লিখে জানিয়ে দেওয়া উচিত, না?"

    "না, না," তিনি মাথা নাড়লেন, "আগে থেকে জানিয়ে দিলে সারপ্রাইজ কি থাকবে?"

    আমি একটু ইতস্তত করে দাঁড়িয়ে রইলাম, উনি নিজের ভয়টা সারপ্রাইজ বলে চালাচ্ছেন, তাই তাঁকে এত উত্তেজিত লাগছিল। সে সময় কিছু বলা বেমানান হবে মনে করে আমি চুপ রইলাম।

    "কী ভাবছ?" উনি আমার কাঁধে হাত রাখলেন।

    "ঠিক আছে... কিন্তু আপনি এই অবস্থায় বাস জার্নি করতে পারবেন?"

    "কোন অবস্থায়?"

    "ডক্টর সিংকে একবার জিগ্যেস করলে হয় না?"

    "কেন? সে তো গত সপ্তাহেই দেখে গেছে।"

    "না, তাঁর আসার দরকার নেই। আমি নিজে গিয়ে জিগ্যেস করে আসবো আপনি এই জার্নি করতে পারবেন কিনা।"

    "তুমিই তো বললে পাঁচ ঘণ্টার জার্নি।"

    আমি আর বেশি আপত্তি করলাম না।

    "ঠিক আছে...আমি জেনে আসব ডিলাক্স বাস কখন ছাড়ে... সেই হিসেবে প্ল্যান করা যাবে।"

    উনি আমার দিকে তাকালেন, আমি আবার ওঁর মন ভোলাচ্ছি না তো। লোকে বলে বুড়োবয়সে লোকে বাচ্চার মত হয়ে যায়। কিন্তু ওই শহরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে মেহরাসাহেবের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মনে হল শৈশব আর বার্ধক্য ছাড়াও আরেকটা ষ্টেশন আছে -- যেখানে মানুষ বয়সের খুঁটি ছেড়ে সব স্টেজ একসঙ্গে পার হয়ে যায়, কোন আগুপিছুর খেয়াল থাকে না... যেকোন জায়গায় পা পড়তে পারে, যেকোন সময়ে যেকোন শিলার ওপর দাঁড়িয়ে দুনিয়াটা দেখে নিতে পারে।

    আর সেই দুনিয়াও এক জায়গায় স্থির নয়। ক্লাবে বসে যখন আমি সাহেবজীকে বইয়ে মগ্ন দেখি, তো মনে হয় এটা সে দুনিয়া নয় যেখানে তিনি বিছানায় শুয়ে শূন্যদৃষ্টিতে ছাতের দিকে তাকিয়ে থাকতেন ...আর সেই দুনিয়াও নয় যেখানে আমার সঙ্গে রাস্তায় চলতে চলতে খাদের নীচে ঝর্নার কলধ্বনি, আর ঝিঁঝিঁপোকার ঐকতান শুনতেন। তিনি কি সেই দুনিয়ার কথা ভাবেন যেখানে আমিও আছি তাঁর সঙ্গে?

    নিশ্চয়ই ভাবেন, কারণ সেই রাত্রে বাড়ি পৌঁছে তিনি সোজা ভেতরে চলে গেলেন না... আমাকে তাঁর কাছে একটুক্ষণ বসতে বললেন। "তোমার ঘুম পাচ্ছে না তো?"

    উনি অন্দরে না গিয়ে, জালে ঘেরা বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে পড়লেন। আমি সামনে দাঁড়িয়ে, যেখান থেকে মুরলীধরের কুঠির আলো দেখা যাচ্ছিল। আমাদের সামনে ছিল না কোন কোনো ডেস্ক, টেবিল, রেজিস্টার বা অন্য কিছু যা পুরনো দিনগুলি মনে করাতে পারে। আমরা যেন কোনো জঙ্গলে ঘেরা রেস্ট হাউসের বারান্দায় বসে আছি। অন্ধকার ঘন হয়নি, তারার আবছা আলো খোলা প্রান্তরের ওপর ছড়িয়ে আছে। হাওয়ায় একটা জংলী গন্ধ। আমার মনে পড়লো মিসেস মেহরাও তার শেষ দিনগুলিতে এই বারান্দায় বসত আর আমি জানলা দিয়ে তাকে দেখতাম।

    "তোমার ঠান্ডা লাগলে ভিতরে গিয়ে বসতে পারি।"

    "না, আমি ঠিক আছি, আপনি?"

    উনি কিছু বললেন না। ঠান্ডা থেকে অনেকদূরে কোন ভাবনায় ডুবে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে চুপ করে বসে থাকতে আমার ভালোই লাগত। কাছে বসলেই যে কথা বলতে হবে তার কোনো মানে নেই। কখনো কখনো আমাদের মনেই থাকে না যে আমরা চুপ করে বসে আছি। আমার মনে হয়, যখন দুজন অনেকদিন একসঙ্গে থাকে, তারা একটি কথাও না বলে একে অন্যের কথা শুনতে পায়।

    আমি আস্তে তাঁর হাত ছুঁয়ে বললাম "আপনি কি কিছু বলতে চান?"

    তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন...তারপর যেন কিছু মনে পড়লো, "তারা কি সত্যি সত্যিই মানুষের মাংস খেত?"

    "কারা?" আমি আশ্চর্য হয়ে শুধলাম।

    "সেই দিন, তুমি যে আমায় বই দেখিয়েছিলে... মেক্সিকো না কোথাকার...?

    "আমি অনেকবার ভেবেছি... তুমি বলেছিলে তারা সবথেকে প্রিয় মানুষটি বলি দিতো। তাই-ই উচিত... দেবতাকে তো সেইরকম উপহারই দেওয়া চাই। ওই বইটা আমাদের লাইব্রেরিতে রাখা দরকার।"

    কিছুক্ষণ আবার চুপ। বারান্দায় ঝিরিঝিরি হাওয়া, গাছপালার শিহরন। কিন্তু দূরে দেওদারের লাইন একেবারে নিশ্চল দাঁড়িয়ে। হাওয়া তাদের ছুঁয়ে গেলেও নড়াতে পারে না।

    "একটা কথা জিগ্যেস করতে পারি?" তিনি আচমকা প্রশ্ন করলেন, "এইরকম বই পড়ে তুমি কী জানতে পারো?"

    "কী সম্বন্ধে?"

    "নিজের সম্বন্ধে, আবার কার? তুমি কি মনে করো ওই হাজার বছর আগের লোকেদের রীতি-রেওয়াজ এখনও আমাদের মধ্যে বেঁচে আছে?"

    "আপনি কী মনে করেন?"

    "আমার মনে হয়, আমরা এখনও মানুষ বলি দিই, শুধু তাদের মাংসটা খাই না, এই যা।"

    আমার মনে একটা চিন্তা পাক খেয়ে গেল। ইনি এসব কী ভাবছেন? কোথায় অ্যাজটেক আর কোথায় এই পাহাড়ি শহর-- দুইয়ের মধ্যে ইনি কীরকম সম্পর্ক খুঁজছেন? মাথায় আবার কোন পোকা ঢুকেছে যে তাঁকে স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছে না?

    "আপনি কি মনে করেন," আমি বললাম, "মানুষের স্বভাবে কোনো পরিবর্তন হয়নি? হাজার বছর পরেও আমরা একই রয়ে গেছি?"

    তিনি ঘাড় হেলিয়ে আমাদের দিকে তাকালেন।

    "তুমিই বলো, তুমি তো অনেক বই পড়েছো। তুমি নিজের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখতে পাও?"

    "আমার মধ্যে?" আমি অবাক হলাম, "আমি ভাবছি আপনি ইতিহাসের কথা বলছেন।"

    উনি হাসলেন। "নিজের ইতিহাসটাই দেখো না। তুমি কি মনে করো তুমি ঐরকমই আছো, যেমন ছিলে ইউনিভারসিটিতে, বা ছোটবেলায়, বাবা-মার সঙ্গে?"

    মানুষ কি সত্যিই নিজের জীবন বিশ্লেষণ করতে পারে? সে কী ছিল, এখন কী হয়েছে? ছোটবেলায় আমরা পেন্সিল দিয়ে দেয়ালে দাগ দিতাম কতো বড়ো হয়েছি। এখন সত্যিসত্যি 'বড়ো' হবার পর সেই দাগগুলো কীরকম ছেলেমানুষি মনে হয়।

    "জানো, তুমি যখন আমার গল্পগুলি লিখে আমায় পড়ে শোনাও, আমার মনে হয় আমি সে মানুষ নই যার জীবনে এতসব ঘটেছিল। যারা আত্মজীবনী লেখেন তাদেরও বোধহয় এইরকম সন্দেহ হয়।"

    "কীরকম সন্দেহ?" আমি তাঁর পিছনে রাতের অন্ধকার দেখছিলাম, উড়ন্ত ফুটকির মত জোনাকির ঝাঁক।

    "নিজের ওপর... সে কি এক সম্পূর্ণ মানুষ না আলাদা আলাদা টুকরো জোড়া দেওয়া? আমার এক বন্ধু ছিল, সে কখনো বিশ্বাস করত না যে মানুষ ভালবেসে বিয়ে করে আর সে-ই যখন পরে স্ত্রীকে ছেড়ে চলে যায়, দুজন একই মানুষ। সে বলত তারা আলাদা মানুষ --যদিও তাদের নাক-মুখ, হাত-পা সব একইরকম। এটা কি আশ্চর্য নয় যে কারুর সঙ্গে প্রেম করে সে তাকে হত্যাও করতে পারে! আর, মারার পরেও তার ধারণা সে আগের মতই আছে, হত্যাকারী আর তার মধ্যে কোনো তফাত নেই।"

    তিনি বলেই যাচ্ছিলেন যেন কিছু কনফেস করতেই আমাকে সে রাতে ডেকেছিলেন--কোন নিউট্রাল জায়গায়, ঘরের বাইরেও নয়, ভেতরেও নয়, মাঝামাঝি বারান্দায় বসে।

    কিন্তু এ কীরকম কনফেশন যাতে উনি নিজের ছাড়াও সবাইয়ের হয়ে বলছেন, যেমন এক অ্যাক্টর আর সবাইয়ের পার্ট আউড়ে যাচ্ছেন ...পুরোনো বন্ধু, পাগল প্রেমিক, খুনি স্বামী...

    আমি দু'পা পিছিয়ে গেলাম, এত কাছে থাকাটা ভালো মনে হচ্ছিল না।

    "কী? ভয় পেয়ে গেলে?" একটু ভয় দেখানো হাসি তাঁর মুখে।

    "আপনি এইজন্য আমায় এখানে ডেকেছিলেন বুঝি?"

    "তোমায়..." অবজ্ঞাভরে বললেন, "তুমি যে আমার কাহিনী লিখে এত খাতা ভরিয়েছ, বলতে পারো, কেউ সেগুলো পড়লে আমার সম্বন্ধে কী ভাববে?"

    আমি চুপ করে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম।

    "হ্যাঁ, আমি... তাদের চোখে কেমন দেখাব? আমি যদি বেঁচে না থাকি, আমার কোন চেহারাটা তাদের কল্পনায় ফুটে উঠবে? তারা কি কখনো জানতে পারবে এগুলো একজন খুনির কাহিনী?..."

    "আপনি এসব কী বলছেন বাবুজি?"

    উনি আবার হাসতে শুরু করলেন, "না, না, সত্যি নয়... ওসব তো কাঁচা লোকদের হয়, যাদের হাতে রক্ত লেগে থাকে... দ্যাখো, আমার হাত একেবারে পরিষ্কার ..কোথাও কোনো দাগ নেই যাতে কারুর সন্দেহ হতে পারে।"

    উনি দুই হাত আমার সামনে বাড়িয়ে ধরলেন যেন দুটি কর্তিত বাহু। দেখতে দেখতে আমার মনে হল এই হাত, হাতের তালু, আঙুল -- এদের অনেক গোপন, অন্ধকার বাসনা আছে, আলাদা জীবন আছে যার আঁচ সারা দেহেও পাওয়া যায় না। দেহের অংশ হয়েও এরা দেহের থেকে আলাদা। একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল আমার শিরদাঁড়ায়, দেখলাম সেই নির্জীব হাতদুটো কোন জাদুবলে ধীরে ধীরে ওপরে উঠছে, তাঁর মুখের দিকে, হঠাৎ তাঁর চোখদুটো ঢেকে ফেললো! তাঁর সারা শরীর কাঁপছিল ... আর সেই কাঁপুনির সঙ্গে ছিল কান্না!

    তিনি কাঁদছিলেন আর আমি সেই নিস্তব্ধ রাতে পাথরের মতো বসেছিলাম। কিছু শোকের সামনে মানুষ পাথর হয়ে যায়। তখন আমার মনে পড়লো (স্মৃতিও এইরকম অন্ধকারেই তার পাক খোলে) যে অনেক আগে তিনি একবার বলেছিলেন তিয়ার মার সম্বন্ধে আমাকে কিছু বলবেন। সে কি কোনো অদৃশ্য কোণে এসে লুকিয়ে বসেছিল? তাঁর কান্নার শব্দ শুনছিল? কান্নার বাঁধ তো তখনই ভাঙে যখন পালাবার আর সব রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়।

    আমি আস্তে আস্তে তাঁর শীর্ণ, কম্পিত বাহুতে হাত বুলোচ্ছিলাম, বুড়ো বয়সে চোখের জল কোন অজানা কুঠুরি থেকে বেরিয়ে আসে! বুক ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা সেই অশ্রুকে সান্ত্বনা দিয়ে থামানো অসম্ভব, তবু আমি চেষ্টা করছিলাম—

    "বাবুজি, দেখুন, আপনার মনে আছে? -- কাল আমরা তিয়াকে দেখতে যাবো... বিটিয়ার কাছে ...কাল সকাল সকাল উঠবো... আমি ডিলাক্স বাসের টাইম দেখে নিয়েছি। শুধু পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা... আমি সাতটায় আসবো আপনাকে উঠিয়ে দিতে। ঠিক? এখন চলুন, শুয়ে পড়ুন..."

    আমি বলেই যাচ্ছিলাম, আমাদের অস্ত্র তো এইসব সাধারণ কথা যা দিয়ে আমরা অন্ধকার খাদের পাড়ে দাঁড়ানো মানুষকে নিরাপদ জায়গায় টেনে আনতে পারি।

    আমি তাঁকে চেয়ার থেকে তুলে শোবার ঘরে বিছানায় শুইয়ে কম্বল ঢেকে দিলাম। জলের জাগ, গেলাস, ঘড়ি সব ঠিকমতো রাখলাম।

    "বাতি নিভিয়ে দিই?”

    "না থাক। আমি এইরকমই শুই একটু।"

    "তাহলে আমি চলি। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।"

    আমি দরজা পর্যন্ত পৌঁছেও কী মনে করে থেমে পিছন ফিরে তাকালাম। উনি চুপ করে বিছানায় শুয়েছিলেন। কান্নার পর মুখেচোখে শান্ত ভাব। হঠাৎ চোখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকালেন, যেন জানতেন আমি ওখানে দাঁড়িয়ে আছি। আমি চমকে উঠলাম, হয়তো আগেও আমাকে উনি এভাবে দেখেছেন? ইশারা করে আমাকে কাছে ডাকলেন। আমি তাঁর পাশে গেলাম, "কিছু দরকার?" আমি শুধোলাম।

    উনি কিছু না বলে আমায় দেখছিলেন... ঠোঁটদুটো একটু নড়ে উঠলো। আমি আরও কাছে ঝুঁকলাম। "আমার সব জিনিস প্যাক করে নিয়েছি," উনি যেন কিছু গোপন কথা বলছেন, "তুমি?"

    "আমি এখনি গিয়ে করবো।"

    "তোমার ঐ বইগুলো নিও, কলকাতা থেকে পাঠানো..."

    তাঁর কথা শুনে মনে হচ্ছিলো তিনি কোনো লম্বা জার্নিতে যাচ্ছেন।

    "তুমি ওকে কিছু বলোনি তো?"

    তাঁর মুখ দিয়ে তিয়ার নামটা বেরুল না কিন্তু আমি বুঝেছিলাম তিনি কী বলছেন। আমি মাথা নেড়ে দিলাম, যেন আমিও তাঁর ষড়যন্ত্রের শামিল।

    "শোনো..." তাঁর স্বর কোমল হয়ে এলো। "ও তোমায় দেখে খুব খুশি হবে।"

    আমি হাসলাম, "আর আপনাকে দেখে হবে না?"

    উনি দুই হাত দিয়ে আমার মাথাটা কাছে টেনে নিলেন, কাঁপা কাঁপা ঠোঁট থেকে একটাই অস্পষ্ট শব্দ বেরুল... থ্যাংকস! কীসের জন্য? আমি ঠিক শুনলাম তো? ইংরেজির এই ছোট্ট শব্দ, একটু উষ্ণতা মাখা... এই প্রথম তাঁর মুখে শুনলাম।

    তখন কি জানতাম এটাই তাঁর মুখের শেষ কথা!

    অধ্যায়--২.৬

    যার প্রতীক্ষায় আমি মেহরা সাহেবের কাছ থেকে সেই রাতে বিদায় নিয়েছিলাম, সেই সকালটা আর এল না। শুধু সেই সুখটা মনে আসে যার ওপর ভর দিয়ে আমরা নিজের নিজের ঘরে ঘুমিয়েছিলাম। অতীতের সুখের তুলনায় ভবিষ্যতের সুখ সর্বদা পরিষ্কার ও উজ্জ্বল মনে হয়। তাতে এখনও সময়ের ধুলো পড়েনি। সে কখনো ময়লা হয় না।

    সে রাতটা কি খুব লম্বা ছিল, না আমাদের প্রতীক্ষা তাকে লম্বা করে তুলেছিল? আমি বার বার উঠে আলো জ্বালিয়ে ঘড়ি দেখছিলাম, জল খাচ্ছিলাম তারপর আবার শুয়ে পড়ছিলাম। নিদ্রা আর জাগরণের মাঝে আমার তার মুখটা মনে পড়ছিল -- সে দূরে কোনো ঘরে ঘুমিয়েছিল, জানতো না যে পরদিন সকালে আমরা তার বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়াবো। আমাদের দেখে কী ভাববে সে? কোনো খবর, চিঠি, ফোন, কিচ্ছু না। আমার নিজের উৎসাহে আমি কোন ভুল করছি না তো? কোনো পাগলামি, যার জন্য পরে পস্তাতে হবে?

    আমার তার মুখ মনে পড়ল, একাটা মুখ নয়, সব কটি মুখ যেগুলো সে আমার কাছে ছেড়ে গেছিল -- উৎসুক, নীরব, চিন্তামগ্ন, কথা বলার সময়, চলার সময়, রৌদ্রতপ্ত লাল গাল, বালতি হাতে ঝর্নার দিকে হাঁটছে... কিন্তু আমি যখন তাকে ভালো করে দেখতে পাশ ফিরি তখন ওকে নয় আমার নিজেরই বয়সের সীমারেখা দেখতে পাই, কুয়াশায় ঘেরা, কিন্তু এত কাছে যেন আমার পাশেই রাস্তার বেঞ্চিতে বসে... তার বুকের ধুকপুক শুনতে গিয়ে মনে হল অন্য একটা শব্দ কানে আসছে... আমি ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। কয়েক মুহূর্ত অন্ধকারে দম নিয়ে আবার দরজায় শব্দ শুনে আর কোনো সন্দেহ রইল না।

    আমি দরজার কাছে এসে তখুনি খুললাম না, ডাকলাম, "কে?" তারপর একটু ধাক্কায় দরজা খুলে গেল। সামনে লন্ঠন হাতে মুরলীধর।

    "সকাল হল নাকি?"

    মাঝরাতে সকাল? সে অবাক হয়ে তাকালো, "আমার সঙ্গে আসুন, বাবুজি।"

    "দাঁড়াও, আমি হাত মুখ ধুয়ে আসি, তুমি আমার সুটকেসটা বাইরে নিয়ে এসো। সাহেবজী তৈরি?"

    "তিনি তো চলে গেছেন।" লন্ঠনের হলুদ আলোয় তার চেহারায় একটা অজানা আতঙ্কের সূচনা।

    "চলে গেছেন? কোথায়?" আমি এগিয়ে আসতে ও ভয় পেয়ে এক পা পিছিয়ে গেল। আমি বেরিয়ে এসে দেখলাম আকাশ ভর্তি তারা ...সকালের নামগন্ধও নেই। কটেজে তাঁর শোবার ঘরে একটা বাতি জ্বলছে।

    "কী হয়েছে মুরলীধর?" আমি আবার শুধোলাম, "উনি ঘরে নেই?"

    "আছেন, কিন্তু তাঁর ভেতর আরেকজন কেউ... বুঝতে পারছি না কী বলছেন..."

    আমি কটেজের দিকে দৌড়লাম। সবকিছু ঠিক আগের মতই... ফুলের বাগান, ব্যাডমিনটন কোর্ট, বারান্দা, তাঁর কামরা, ওক আর চীর গাছের সারি...



    উনি অর্ধেক বিছানায়, অর্ধেক মাটিতে লুটোচ্ছিলেন, যেন কেউ তাঁকে একটা ধাক্কা দিয়েছে আর তিনি পড়তে পড়তে সামলে নিয়েছেন। এক চোখ খোলা, মুখ থেকে কশ গড়াচ্ছে থুতনি পর্যন্ত... গলা দিয়ে একটা জান্তব শব্দ, যেন কোন বন্য প্রাণীর আর্তনাদ...

    আমি তখনো পর্যন্ত তাঁর মৃত্যুর ভয় করেছিলাম, জানতাম না যে মানুষের আসল যাত্রা মৃত্যুর অনেক আগেই শুরু হয়ে যায় যখন সে বাঁচবার পাকা সড়ক ছেড়ে কোনো অজানা পাকদণ্ডীতে মোড় নেয়, জীবন আর মৃত্যুর মাঝামাঝি।

    সকালেই আমি ডক্টর সিংকে ডাকিয়ে এনেছিলাম। তিনি দেখে রায় দিলেন। দেহের বাঁ-দিকে পক্ষাঘাত হয়েছে, তার প্রভাব জিভেও। চিন্তার কিছু নেই। উনি একটা ইনজেকশন দিয়েছেন, রোগী এখন ঘুমোচ্ছেন।

    "বিটিয়াকে খবর দিয়েছ?" ডক্টর সিং আমার দিকে তাকালেন।

    "না। আমরা তো তার কাছেই যাচ্ছিলাম।"

    "কবে?"

    "আজ সকালেই।"

    উনি আমার কাঁধে হাত রাখলেন, "আমি ক্লিনিক থেকে ওকে ফোন করে দেবো। তুমি এঁর সঙ্গে থাকো। প্রথম কটা দিন একটু সতর্ক থাকতে হবে... কোনো অবহেলা না হয়।" একটুক্ষণ অবাক হয়ে আমায় দেখলেন, "এসব হল কেমন করে?"

    কেমন করে? আমি যদি বলি গত কয়েকদিনের কাহিনী, ডক্টর সিং বুঝবেন কি? যখন উনি ক্লাবে বসে বিকেলের ড্রিংক সেবন করেন, আমি ও মেহরাজি তখন লাইব্রেরির বইয়ে, ঝাপসা আলোয়, কোন বনস্থলীর কল্পনা করছিলাম... তা কি কোনো পরিচ্ছন্ন প্যাকেটে বেঁধে ফেলা যায়? আর গত রাত্রে, যখন কিছু একটা তাঁর ভেতর থেকে উগরে আসছিল, যেমন লাভা উদ্‌গীরণের সময় সমস্ত পৃথিবী কাঁপে, আর আমি তাঁর কাঁপন চোখ বড় বড় করে দেখছিলাম। তখনও জানতাম না যে এসব কিছুই বদলানো যায় না। ডক্টর সিং চলে যাবার পর আমি অনেকক্ষণ মেহরাজীর বিছানার সামনে বসে রইলাম। উনি কথা বলার চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে শুধু হাতের ইশারায় নিজের প্রয়োজন জানিয়ে দিলেন। একটু পরে মুরলীধর এল, কাঁধে তোয়ালে, হাতে গরম জলের গামলা, পাউডার, সাবান, যেন সে মেহরাসাহেবের ভেতরের এই মানুষটির প্রতীক্ষাতেই ছিল -- মূক, বিবশ, পক্ষাঘাতগ্রস্ত... সাহেবের অতর্কিত পরিবর্তন মুরলীধর কতো সহজেই স্বীকার করে নিয়েছিল -- যেমন পাহাড়ি লোকেরা প্রাকৃতিক পরিবর্তন -- ঝড়, বৃষ্টি, তুষারপাত -- স্বীকার করে নেয়। তার চোখে এটা কোনো রোগ নয় শুধু দেহের একটা আলোড়ন, যা নিজের লয় ও গতিতে চলে। তাতে আশ্চর্য হবার কী আছে?

    "আপনি একটু বাইরে বসবেন? আমি এঁর হাত মুখ ধুইয়ে দিই," মুরলীধর তাঁর কাপড় খুলছিল। পুরোনো চাকরদের এরকম অধিকার থাকে যেমন শিশুর ওপর মা'র অধিকার, এর সামনে কিছু গোপন রাখা যায় না।

    আমি বারান্দায় এসে বসলাম। নভেম্বরের উজ্জ্বল দিন, শীত পড়ার আগে আবহাওয়া এক পা পিছিয়ে গত গ্রীষ্মের উষ্ণতা ফিরিয়ে দিচ্ছে। হালকা রোদ্দুর, ব্যাডমিন্টন কোর্টের পাথরের বেঞ্চটা শিশির পড়ে এত ভিজে দেখাচ্ছে যেন কাল রাতে বৃষ্টি হয়ে ছিল...

    কাল রাতে? এখনও তো বারো ঘণ্টাও হয়নি। ঘটনার কি কোনো আলাদা সময়-স্থান থাকে, যেখানে তাড়া বা দেরির কোনো হিসেব নেই? আমি কি আগে ভেবেছিলাম যে এইসময় আমি এখানে বারান্দায় বসে থাকবো, কাল বুক করা বাসের সীটে তাঁর সঙ্গে নয়? সেই বাস এখন খালি সীট নিয়ে চলে যাচ্ছে তাঁর বিটিয়ার শহরের দিকে। ভালোই হয়েছে আমরা তাকে আগে থেকে কিছু জানাইনি।

    তিয়া তাঁকে আমার ওপর ছেড়ে গেছিল। সে ভাবেনি যে লোকটা শুধু তার মায়ের ডাকে এসেছিলো, সে তার বাপের শেষ দিন পর্যন্ত পাহারা দিতে পারবে?

    বারান্দায় বসে রৌদ্রোজ্জ্বল শহরের দিকে তাকিয়েছিলাম, পাহাড়ে ছড়ানো কিছু ঘরবাড়ি, হাসপাতাল, প্রাইমারি স্কুল, বাস স্ট্যান্ড, রেল লাইন যা অন্য দিক থেকে এসে এখানেই শেষ হয়ে যায়, ওপরে চড়া যায় শুধু বাস বা গাড়িতে, সেখানে জংলী নালা, ঝরনা, আপেল আর আখরোটের বাগান, তার মধ্যে দিয়ে রাস্তা চলে যায়... যেখানে আমাদের যাবার কথা ছিল, যেখান থেকে এখন সে আসছে আমাদের কাছে।

    কিন্তু সে এল না। সেদিন নয়, তার পরের দিনও না। তৃতীয় দিন যখন ডক্টর সিং দেখতে এলেন, তখন জানা গেল যে সে আশেপাশের কোনো গাঁয়ের ডিসপেনসারিতে গেছে। হাসপাতালে কেউ জানে না কবে ফিরবে।

    সে হয়তো আমাকে কিছু বলতে চায় কিন্তু আমি তার জন্য তৈরি ছিলাম না। আমি একটি বোকা। আর সব বিশ্বাসী বোকাদের দলের পেছনে পড়ে থাকি। আমাকে কি বিশ্বাস করা যায়?

    তখন আমার মনে হল তাঁর এই অসুখ হয়তো একটা ইঙ্গিত, ঠোঁটে আঙুল চেপে ইশারা, যার সামনে লেনা-দেনার সব ঝামেলা শেষ।

    তাই কি তাঁকে এত শান্ত দেখায়? এরকম আমি আগে কখনো দেখিনি।

    না, শান্ত ঠিক নয়, শান্তিতে একধরনের পরিপূর্ণতা থাকে... তাঁর চেহারায় একটা স্থিরতা ছিল, দুই শব্দের মাঝে এক বিরাম, মাঝপথে থেমে থাকা--যেমন মাঝরাতে অচেনা প্রান্তরে ট্রেন থেমে যায়... ভিতরে যাত্রীরা জানতে পারে না যে তারা কোথাও যাচ্ছে না বা এর পরে কোথাও যাওয়ার নেই। ভয়টা ট্রেনের থামা নিয়ে নয়, নিজের গন্তব্যে পৌঁছোনো নিয়ে।

    আমি যখনই ঐ দিনগুলি কথা ভাবি, সামনে একটা পর্দা পড়ে যায়। ঐ দিনগুলি যেন জমাট বরফ -- পরতের পর পরত বাড়তে থাকে কিন্তু নিজের জায়গা থেকে এক ইঞ্চিও নড়ে না। সময় দাঁড়িয়ে থাকে না কিন্তু নিজের গভীরে এত জোরে ঘোরে যে মনে হয় দাঁড়িয়েই আছে।

    পুরোনো নোটগুলো যখন দেখি তো সে পাতায় চোখ আটকে যায় যেখানে তিনি সেই বন্যার গল্প শুনিয়েছিলেন, অনেক বছর আগে কোনো দেহাতি গ্রামে বন্যার জলে সব ডুবে গেছিল। অথৈ জলে সাঁতার কেটে পোস্টম্যান টেলিগ্রাম এনেছিল... বিটিয়ার এই পৃথিবীতে আসার খবর। তিনি তখন বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন, ফাইলের জগতে মগ্ন ছিলেন। সময় কেমন ঘুরে আসে! আজ আমরা বিটিয়ার আসার অপেক্ষায়, সে জানেও না এর মাঝে কত বন্যার জল বয়ে গেছে।

    পরদিন, যখন মুরলীধর সাহেবের কাছে বসে আর আমি বারান্দায় পুরোনো নোট পড়ছি, অ্যানাকে আসতে দেখলাম। আমি দূর থেকেই ওকে গেটের নীচে নামতে দেখেছিলাম। পরনে একটা ব্রাউন রঙের লম্বা স্কার্ট, কালো উলের টুপি আর হাতে লাঠি। সঙ্গে তার পাহাড়ি ঝিও ছিল, তার হলদে রঙের চুড়িদার দূর থেকেই ঝকমক করছিল। অ্যানা একহাতে তাকে ধরে, অন্য হাতে লাঠি নিয়ে আস্তে আস্তে চলছিল। উৎরাই শেষ হতেই অ্যানা হাত ছাড়িয়ে বারান্দার সামনে এসে পিটপিট করে আমার দিকে তাকালো।

    "কেমন এখন?" তার তীক্ষ্ণ প্রশ্ন। তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই সিঁড়ি পার হয়ে বারান্দার চেয়ারে বসে পড়লো। সে হাঁপাচ্ছিল। একটু জিরিয়ে আবার প্রশ্ন করলো, "ওনার সঙ্গে কে এখন?"

    "মুরলীধর," আমি বললাম, "এখুনি নাস্তা নিয়ে গেল।"

    "কী দিলে নাস্তায়?"

    "দুধ আর পরিজ, দুপুরে আর রাতে সূপ।"

    সে কিছু না বলে চীর গাছের দিকে তাকিয়ে রইল।

    "কালকে নিরঞ্জনবাবুর কাছে শুনলাম।"

    "নিরঞ্জনবাবু?" আমি অবাক, "তিনি কী করে জানলেন?"

    "হয়তো ক্লাবে ডক্টর সিংকে দেখেছিলেন। এখানে আসেননি?"

    "না, এখনও না।"

    তার নীল চোখ দুটো তখনও পপলার গাছের মাথায় নিবদ্ধ। আমি জিগ্যেস করলাম, "আপনি ভেতরে গিয়ে দেখা করতে চান?"

    সে একটু চুপ করে লাঠি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো, "এখন ঘুমোচ্ছেন না তো?"

    "না। গিয়ে দেখতে পারেন।"

    সে একটু ইতস্তত করল। গতবার যখন তাকে দেখেছিলাম, বার্ধক্য তখন সবে তার শরীরের কোণেকানাচে বাসা বাধছিল, সে হয়তো নিজে জানতো না। আমিও জানতাম না যদি না সে ভীত চোখে আমায় প্রশ্ন করতো, "যদি আমায় চিনতে না পারেন?"

    "নিশ্চয়ই পারবেন। অনেকবার আমাকে আপনার কথা বলেছেন।" আমি মিথ্যা বললাম। হয়তো পুরোটা মিথ্যা নয়। তাঁর গলার অস্পষ্ট শব্দে যে কোন নাম কল্পনা করা যায়।

    আমি দরজাটা খুলতেই সে আমার হাত ধরে বলল, "না, তুমি নয়। আমি একাই যাবো।"

    আমি বারান্দায় ফিরে এলাম। নীচে গাছের তলায় অ্যানার ঝি বংশীর মায়ের সঙ্গে বসে গল্প করছে। তাদের হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। বংশী একটা কালো সোয়েটার পরে কালীর সঙ্গে ব্যাডমিন্টন কোর্টে দৌড়োদৌড়ি করছে।

    কালী মনের আনন্দে লম্বা ল্যাজ দুলিয়ে দৌড়োয়, আবার দু'পায়ে ভর দিয়ে বসে পড়ে, আবার লাফ দিয়ে বংশীর পেছন ডাকতে ডাকতে দৌড়োয়। ওর মা এক পলক দেখে নিয়ে আবার গল্পে মগ্ন হয়ে যায়।

    ভেতরে ঘর নিস্তব্ধ। কারুর গলা শোনা যাচ্ছিল না। আমি সাবধানে দরজা খুলে উঁকি দিলাম। বাইরের রোদের পর চোখে অন্ধকার দেখছিলাম। আস্তে আস্তে নজরে এল। মুরলীধর বিছানায় সাহেবের পা টিপে দিচ্ছে। আনা চেয়ারে বসে সাহেবের হাত ধরে, উনি দু'চোখ খুলে অ্যানাকে দেখছেন।

    আমি দরজাটা ভেজিয়ে আবার বারান্দায় এসে বসলাম।

    একটু পরে লাঠি ঠুকঠুকিয়ে অ্যানা বেরিয়ে এল। অন্যমনস্কভাবে আমার দিকে তাকালো, যেন তার মন অন্য কোথাও, যেন সে অনেক দূর থেকে ফিরে আসছে। কিছুক্ষণ কোনো কথা বললো না।

    "অ্যানা," আমি তার হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিলাম। সে বসলো কিন্তু সেই তন্দ্রা ভাবটা তখনো কাটেনি।

    "এইভাবেই শুয়ে থাকেন?" সে তাকালো আমার দিকে।

    "হ্যাঁ।"

    "কিছু বলতে পারেন না?"

    "বলেন, কিন্তু কী বলছেন সেটা বোঝা যায় না। শুধু একটা শব্দ বেরোয়।"

    সে মাথায় হাত রেখে বসে রইল। হতাশারও একটা সীমা আছে যা পার করা অসম্ভব। একটু পরে কিছু মনে আসতে সে মাথা তুললো।

    "কে জানতো তাঁর এই অবস্থা হবে... আমি আসবো তাঁর কাছে আর তিনি আমায় চিনতে পারবেন না!" অ্যানা হতাশ গলায় বলল, "খুব দেরি হয়ে গেছে, না?"

    "দেরি?" আমি তাকালাম।

    "তিয়া আসবে তো কী দেখবে?" সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো, "তিনি এত কথা বলতেন, এখন তাঁকে এক একটা শব্দের জন্য যুদ্ধ করতে হবে।"

    না, তা নয়। আমি বলতে চাইলাম, তিনি এসব থেকে ছাড়া পেয়ে গেছেন, যা বার বার তাঁর বুক ফেটে বেরোতে চাইত... কিছু বলতে না পারা, শব্দের গণ্ডীর বাইরে এসে যাওয়া... এর থেকে বড়ো মুক্তি আর কী হতে পারে?

    কিন্তু আমি কিছু বললাম না। তাঁর হয়ে আমি কী বলতে পারি, তিনি নিজেই যে মূক হয়ে গেছেন।

    "ডক্টর সিং কী বলেন?"

    "বলেন, লাইট স্ট্রোক হয়েছে, ব্লাড প্রেশার বেশি হলে যা হয়। কিছু দিন খুব সাবধানে রাখতে হবে।"

    "তুমি একলা সামলাতে পারবে?"

    "সব কাজ তো মুরলীধরই করে দেয়। আমার কাজ শুধু তাঁর সঙ্গে বসা, যা আমি আগেও করতাম।"

    সে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

    "আমি আগে ভাবতাম তুমি এখানে থেকে তোমার জীবনটা বরবাদ করছো, এখন দেখছি দিভা মরার আগে ওঁর জীবন তোমার হাতেই দিয়ে গেছে।"

    আমার হাতে? আমার ইচ্ছা হল বলি কেমন করে উনি আমাকে তাঁর হাতে তুলে নিয়েছিলেন, এক অন্ধকার সুড়ঙ্গ থেকে টেনে বার করেছিলেন, নয়তো আমার নিজের সাহসই হতো না। তিনি আমায় যা শিখিয়েছিলেন তাই তো আমি আজও নোটবুকে টুকে রাখছি।

    অ্যানা আমার হাতটা ধরল। সকালের সুন্দর রোদ ওর সাদা চুলে পড়ছিল।

    "এখন কী হবে?"

    "অ্যানাজী," আমি ওর হাতে হাত বুলিয়ে দিলাম, "আর শুধু কয়েকটা দিন... উনি আস্তে আস্তে সামলে নেবেন।"

    "তুমি জানো না... এই শহরে আমি ওঁর ওপর কত নির্ভর করি। কত বছর আগে, যখন এসেছিলাম... ওঁকে রাস্তায় দেখতাম কিন্তু কাছে গিয়ে কথা বলার সাহস হতো না। বেড়াতে গিয়ে সামনে পড়লে আমি মুখ ঘুরিয়ে পাহাড়টা দেখতাম যেন ওঁর সঙ্গে চোখাচোখি না হয়ে যায়।"

    উনি ভেতরে শুয়েছিলেন। অ্যানার কথা শুনতে পাচ্ছিলেন কি? আমার মনে হচ্ছিলো আমরা অন্য কারুর কথা বলছি, সে দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে-- একজন ভেতরে শুয়ে আর অন্যজন যার কথা অ্যানা বলছে। এইভাবেই কি মানুষ শেষ পর্যন্ত ভাগ হয়ে যায়? এর লাস্ট, ফাইনাল কপিটা কোথায় যায় কে বলতে পারে?

    অ্যানা নিজের গল্পে মজে ছিল।

    "আমি যখন নতুন আসি, কাউকে জানতাম না। সে সময় হাত খালি থাকলে পিয়ানো চর্চা করতাম। এখন আর অভ্যেস নেই। পিয়ানো বাজাবার সময় ভুলে যেতাম যে আমি আমার দেশে নেই, অন্য কোন দেশে। একবার দরজায় শব্দ শুনে বাইরে এসে দেখি মেহরাসাহেব। বললেন, আমি বেড়াতে বেরিয়েছিলাম, আপনার রেডিওতে খুব সুন্দর মিউজিক শুনতে পেলাম! রেডিও? আমি হেসে ফেললাম। ভেতরে এসে পিয়ানোটা দেখে তো অবাক! বললেন, আপনি বাজাচ্ছিলেন? তারপর তো প্রতি তিন-চার দিন অন্তর আসতেন, কোণে চুপ করে বসে আমার বাজানো শুনতেন। একবার বললেন, আপনার পিয়ানো শুনলেই মনের সমস্ত খোসাগুলো ঝরে পড়ে, ভিতরে শান্তির প্রলেপ লাগে... এ কেমন সঙ্গীত যা আপনার পিয়ানো থেকে বেরোয়... আমি হেসে বলতাম, মেহরাসাহেব, আপনি ওভারকোট পরে আমার পিয়ানো শুনুন..."

    একটা বিকট গোঁ গোঁ আওয়াজ দরজা ভেদ করে শোনা গেল, যেন কোনো আহত পশুর আর্তনাদ। অ্যানা উঠবার চেষ্টা করতেই আমি তার কাঁধ ধরে বসিয়ে দিলাম, "আপনি বসুন, আমি দেখছি।"

    ভিতরে গিয়ে দেখি সাহেব বিছানা থেকে ওঠবার চেষ্টা করছেন আর মুরলীধর তাঁকে ধরে শোয়াতে চাইছে। উনি বার বার হাত ছাড়িয়ে উঠতে যান আর সে আবার তাঁকে বিছানায় টেনে আনে...

    "বাবুজি!" আমি চেঁচিয়ে উঠে তাঁর হাত দুটো ধরে ফেললাম আর তিনি বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকালেন। তাঁর চোখেমুখে একটা গভীর লজ্জা। মুরলীধরের কাছে যা করেন তিনি আমাকে দেখতে দিতে চান না।

    উনি আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়লেন। দুই কনুই তুলে মুখ ঢেকে ফেললেন। আমি সরে এলাম। এভাবে কি লজ্জা ঢাকা যায়?

    "আমার সঙ্গে বাচ্চা ছেলের মতো জেদ করেন আর আপনি এলেই একেবারে চুপ।" মুরলীধর বলল।

    সে হয়তো জানতো না, রোগ মানুষকে দুর্বল করে দেয়, আপনজনের সঙ্গে রাগ-অভিমান করে কিন্তু বাইরের লোকের সামনে নয়। তাদের সামনে শুধু লজ্জা, অসহায়তা আর লাঞ্ছনা যা চব্বিশ ঘণ্টা সহ্য করতে হয়।

    আমি চাদর দিয়ে তাঁকে ঢেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম।

    "কী বলছিলেন?"

    "এই একটু অস্থির ভাব। এখন ঠিক আছেন।"

    "এভাবে কেউ চিৎকার করে? উনি নিশ্চয়ই কিছু চাইছিলেন।"

    "কী জানি অ্যানাজী। কে কী চায় আমরা কি বলতে পারি? না কিছু করতে পারি?"

    আমার ভেতরে যেন গত কয়েকদিনের একটা বেলুন ফেটে পড়লো। আমার গলাটাও তাঁর মতই কর্কশ শোনালো। আমি দেখলাম ভেতরের আর বাইরের পর্দাটা কত পাতলা, এক ঝটকায় ফালাফালা হয়ে যায়।

    অ্যানা শান্ত চোখে আমায় দেখছিল, দুই নীল চোখ সূর্যের আলোয় জ্বলছিল।

    "আমি তোমায় একটা কথা বলব বলে এসেছিলাম।" তার গলা সংযত।

    "যতদিন তিয়া না আসে, আমি এখানে থেকে যাই? তোমায় কী আর সাহায্য করবো, কিন্তু ওঁর সঙ্গে তো বসতে পারি। আমারও মন ভালো হয়ে যাবে, ঘরেও তো একলাই পড়ে থাকি।"

    "অ্যানাজী, এখন না... কাল ডক্টর সিং আবার আসবেন, তারপর আমি আপনাকে জানাবো... হয়তো ওঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।"

    "হাসপাতাল? ডক্টর সিং তাই বলছেন নাকি?"

    "এখুনি না। আসছে দু-তিন দিনে উন্নতি না হলে হয়তো যেতে হবে। উনি এখানে মিলিটারি হাসপাতালের ডাক্তারকে জানেন।"

    অ্যানার মুখ কালো হয়ে গেল। সন্দেহ, ভয়, আশঙ্কা, সব একসঙ্গে ছড়িয়ে পড়লো।

    "তুমি তো বললে লাইট স্ট্রোক, ব্লাড প্রেশার থেকে যা হয়?"

    "ডক্টর সিং তো তাই বলেন।"

    "তাহলে?"

    "কাল এসে দেখবেন, তারপর বলা যাবে।"

    সে শূন্য চোখে বসে রইল। সামনে পাহাড়ে মেঘের ছায়া নামছিল।

    "মেমসাহেব, আরও থাকবেন?" বারান্দার নীচে নেপালি ঝিয়ের গলা শোনা গেল।

    "এই আসছি।"

    সে ছাতা খুলে সিঁড়ি দিয়ে নামল, আমি তার সঙ্গে গেট পর্যন্ত গেলাম। যাওয়ার আগে পিছন ফিরে একটু ইতস্তত করে বলল, "তিয়া আসার আগে কিছু কোরো না যেন, জানোই তো ওকে।"

    আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ওকে আর ওর নেপালি ঝিকে হেঁটে যেতে দেখলাম।

    ঘরে এসে দেখি মুরলীধর দরজায় দাঁড়িয়ে। আমায় দেখে ঠোঁটে আঙুল রেখে বলল, "ঘুমোচ্ছেন। আপনিও আপনার কুঠিতে গিয়ে একটু আরাম করুন। আমি ওর সঙ্গে আছি।"

    "দরকার পড়লে ডেকো কিন্তু। আমি ঘরেই থাকবো।"

    অ্যানা ফিরে যাবার পর আমিও নিজের কুঠিতে চলে এলাম। গত রাত্রের ভাঙা ভাঙা ঘুম আবার আমার চোখে নামছিল। সারা শরীর ভারী। যেমন ছিলাম তেমনি খাটে শুয়ে পড়লাম।

    পাহাড়ি শহরের দুপুর। শীতের ফিকে রোদ--আর চারদিক নীরব। দূর জঙ্গলের অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসা নিঃশ্বাস আমার ঘুমের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল। খোলা দরজা থেকে আকাশে ওড়া চিলগুলোর কালো ফুটকি আমার স্বপ্নের মধ্যে এসে যাচ্ছিল--যেন পুরোনো কোন ফিল্ম... চিলের তীক্ষ্ণ চিঁ-চিঁ আওয়াজ গোমরান গোঁ গোঁ শব্দে বদলে গেল যেন নালার নোংরা জল বন্ধ দরজার পেছনে কোন চৌবাচ্চায় জমা হচ্ছে... চোখ খুলে দেখি ঘেমে নেয়ে উঠেছি... আধ ভাঙা ঘুমের মধ্যে দেখি এক চেনাজানা মুখা... আমি একে জানি কিন্তু ঠিক চিনতে পারছি না... মাথায় গোল টুপি, খাকি রঙের পাজামা, ধুলোমাখা শুঁড়তোলা পাহাড়ি জুতো আর ঠোঁটে চতুর হাসি...

    "আরে, ননকু তুমি? এখানে কেন?" আমি তড়বড় করে উঠে বসলাম।

    "সাহিবজীর খবর শুনলাম। এইমাত্র মুরলীধরের কাছ থেকে আসছি।"

    "নিরঞ্জনবাবু কেমন আছেন?"

    "তিনিই তো আমায় পাঠালেন। নিজেই আসতেন কিন্তু যাবার আগে এত কাজের চাপ..."

    "যাবার আগে?"

    "হ্যাঁ... কালকের বাসে যাচ্ছেন। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।"

    নিরঞ্জনবাবু চলে যাচ্ছেন... দুপুরের স্বপ্নের খবর কি এভাবেই আসে ননকুর বেশে, যার ইঙ্গিত দূর থেকে দেখা যায় না?

    "কখন বাড়ি থাকবেন?"

    "বাড়িতে না... উনি বাজারে কিছু কেনাকাটা করতে গেছেন... ফেরার সময় ক্লাবে যাবেন, আপনি সেখানেই তাঁর দেখা পাবেন। আপনাকে ওপরে চড়তে হবে না।"

    তাঁর চলে যাওয়ার খবরের শকটা এখনও কাটাতে পারিনি, আমি হাঁ করে ননকুর দিকে তাকিয়েছিলাম।

    "ননকু, আমি আর মুরলী ছাড়া সাহেবের সঙ্গে যে আর কেউ নেই।"

    "বাবুজি, আপনি চলে যান। আমি থাকব সাহেবের কাছে।" দরজার পেছনে মুরলীধর, কে জানে কখন এসে দাঁড়িয়েছে।

    "আপনি কিছুক্ষণ ঘুরে আসুন বাবুজি। উনি যাবার আগে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।"



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • | | | | | ৬
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments