• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৮ | এপ্রিল ২০২৫ | উপন্যাস
    Share
  • অন্তিম অরণ্য (৫) : নির্মল ভার্মা
    translated from Hindi to Bengali by ছন্দা চট্টোপাধ্যায় বিউট্রা
    | | | | ৫


    দ্বিতীয় পর্ব

    অধ্যায়—২.১

    সে বাইরে দাঁড়িয়েছিল। জানলার আলোয় তার ছায়া পড়ল। এইসময় কে আসতে পারে? এল তো বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? ভিতরে আসতে ভয় পাচ্ছে নাকি? তিনি বিছানা থেকে উঠে, পা টিপে টিপে জানলার কাছে গিয়ে ফট করে পাল্লাটা খুলে দেন। কেউ নেই। কিংবা জানলা খুলতেই পালিয়ে গেছে? বুকে একটু গুড়গুড় শব্দ। সেটা কি ধমনীতে রক্তের শব্দ, শরীরের অন্ধকারে বয়ে চলেছে?

    রক্ত, কীসের রক্ত? ডক্টর সিং তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, কী শোনেন আপনি, কোনও পশুর গোমরানো, ঝোপের ভিতর পাখির ঝটপটানি? কিছু তো বলুন, জবাব দিন। যদি চুপই থাকবেন তো আমায় ডাকলেন কেন?

    তিনি বিভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে থাকেন। কী জবাব দেবেন? তাঁর তো মনেও পড়ে না কখন তিনি ডক্টর সিংকে ডেকেছিলেন। হয়তো মুরলীধর বলেছে তাকে, অথবা গভর্নর বাবু ... ক্লাবে ডক্টরের সঙ্গে বিয়ার খেতে খেতে আমার সম্বন্ধে কিছু বলে থাকবে। আজ রাত্তিরে এলে জিজ্ঞেস করতে হবে। কতবার বলেছি, আমায় একলা থাকতে দিন... দয়া করে... লীভ মি অ্যালোন! প্লীজ!

    "কিছু বলছেন?" ডক্টর সিং ঝুঁকে বলল, "কষ্ট হচ্ছে? জোরে বলুন, বিড়বিড় করে নয়।"

    শরীরে কষ্ট? শরীর তো নিজেই একটা কষ্ট। উঠি তো ওঠে, চলি তো চলে, এক-একবার ভাবি ওর চোখ এড়িয়ে যদি কোথাও লুকোতে পারি, তখন দেখব কী করে আমার পাত্তা পায়। কিন্তু কেউ কি নিজের শরীরের চোখে ধুলো দিতে পারে? যে জন্ম থেকে জোড়া, তাকে কী করে ছাড়ানো যায়? তাইতো জন্ম থেকেই কান্নার শুরু। ... কখনও আপনি বাইরে থেকে নিজেকে দেখেছেন? যেমন, আপনার শরীরটা শুয়ে আছে আর আপনি জানলার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছেন? আমি বিছানা ছেড়ে তার কাছে যাই...আমরা একসঙ্গে দুইজন... এক আমি যে সে, আর আরেক সে যে আমি। আর দুই ভাগই বা কেন, ছোটবেলা থেকেই আমরা কত ভাগে ভাগ হয়ে যাই—পাহাড়ি জোঁকের মতো— প্রত্যেক ভাগ আবার জ্যান্ত হয়ে চলতে শুরু করে। একটু পরে কোন দেহটা প্রথম ছিল তা আর বোঝা যায় না। ...মানুষের সঙ্গেও এই-ই হয়, কিন্তু উল্টো ভাবে, দেহটা একই থেকে যায় কিন্তু সে নিজেকে টুকরো টুকরো করে সবাইকে বিলিয়ে দেয়। বাইরে থেকে মনে হয় একজনই আছে—সেই এক মাথা, দুই কান, দুই চোখ...চোখের রঙও সারা জীবন একই থেকে যায়, কালো চোখ কখনও নীল হয় না। কিন্তু মুখের চেহারা—সে কি একই থাকে? আপনিই বলুন, আশ্চর্য নয়? চোখদুটো একই রকম থাকে কিন্তু পরমুহূর্তে মনে হয় বদলে গেছে। পুরনো চেহারার সম্পর্ক অন্ধকারে মিলিয়ে যায়, যেন সে কোনওদিনই ছিল না, চোখে ধুলো দেয়, মনের ভ্রম, ধুলো, ছাই, মাটি ... বুঝতে পারছেন আমি কি বলছি?

    আলো কমে আসে, নভেম্বরের রোদ পাহাড়ের গা দিয়ে ঝরে পড়ে। হাওয়ায় চীর পাতার তীব্র নেশার গন্ধ। কিছু জ্বলছে নাকি? সে চোখ খোলে, ঘরের ভিতর নীল ধোঁয়া। না, কিছু না ... বংশীধর বাইরে শুকনো পাতা জ্বালাচ্ছে। শুকনো পাতার পটপট শব্দ, পটকার মতো, আর নীলচে ধোঁয়া সাপের মতো জড়িয়ে জড়িয়ে উঠছে ... মাঝখানে আগুনটা ডুবন্ত সূর্যের মতো লাল। বুঝতে পারি না ঘড়ির কাঁটা কেন এমন দৌড়চ্ছে... সকালের অন্ধকার আলো হয়ে ফুটছে না সন্ধ্যার রাত অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে? নাকি হাজার বছরের পর্দায় দুই সূর্য একইসঙ্গে দৃশ্যমান?

    মেহরা সাহেব কিছুই বুঝতে পারছেন না। মনে হচ্ছে এতদিন ধরে সময়ের সাহায্যে এত দূর উঠে এসেছেন, এখন নিচে ঝুঁকে নিজের সাফল্য নয়, অন্যের কষ্টটাই চোখে পড়ে...প্রত্যেক কষ্ট এক-একটা পাথরের মতো... পা রাখলেই চিৎকার শোনা যায় আর তিনি তক্ষুনি পা তুলে নেন । কী অদ্ভুত, যে রাস্তাটা তাঁকে এতদূর নিয়ে এসেছিল, সেটাই এখন তাঁকে এমন জায়গায় এনেছে যে তিনি নিজেকে আর খুঁজে পাচ্ছেন না।

    তাইতো তিনি দড়িতে টান দিয়ে ঘণ্টি বাজান ...আর মুরলীধর হাঁপাতে হাঁপাতে সামনে হাজির হয়। তিনি জিজ্ঞেস করেন আগুন কোথায় জ্বলছিল? কিন্তু মুরলীধরের উত্তরটা তিনি শুনতে পান না। একটু পরে চুপ করে গেলে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন, যেন কথা বলার সময় সে অদৃশ্য হয়ে গেছিল এখন চুপ করামাত্র সে আবার দেখা দিয়েছে।

    "ডক্টর সিং চলে গেছেন?" তিনি শুধোলেন।

    "সে তো অনেকক্ষণ।" মুরলীধর তাকে দেখতে থাকে, "আপনি জানেন না?"

    "এখনই তো ছিল।"

    "জী, দু'ঘণ্টা হলো চলে গেছেন। আপনি হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।”

    "আর গভর্নর বাবু?"

    "সে বাজারে গেছে... ডাকটার সাহেব কিছু দাওয়াই লিখে দিয়েছিল, তাই আনতে গেছে। এলেই আপনার কাছে নিয়ে আসব। আপনার কিছু চাই এখন?"

    "না, কিছু না... শুধু, আমার বালিশটা একটু উঁচু করে দেবে?"

    সে বিছানার কাছে আসতেই মেহরা সাহেব তার পরনের কাপড় থেকে সেই পুরনো গন্ধটা পেলেন। বিড়ি আর জ্বালানির ধোঁয়ার গন্ধ। শীতের শুরুতেই অন্ধকার ঘরের লুকনো কোণ থেকে বেরিয়ে আসে, বাড়ির চাকরবাকরদের কাপড়ে মিশে যায়। একটা প্রাচীন গন্ধ যার আওতায় এলে নিজেকে কেমন সুরক্ষিত মনে হয়। যেন এখানে তাঁর কোন বিপদ-আপদ হবে না... মৃত্যুও না।

    "আপনি ঠিক তো, সাহেব জী?” মুরলীধর বালিশ উঁচু করে তাঁর মাথাটা ঠিক করে দিল। এখন তিনি জানলা দিয়ে চীর গাছের সারি দেখতে পাচ্ছেন, পাহাড়ের মাথায় একটা কালো মেঘ, সূর্যাস্তের লাল রঙ মাখা।

    "দিভা, এবার কি আমার পালা?"

    "কিছু বলছেন, সাহেবজী? কীসের পালা?"

    তিনি চোখ খুলতে চীর গাছ নয়, মুরলীধরের ভয়ার্ত মুখ দেখতে পেলেন।

    "আমি ভেবেছিলাম তুমি চলে গেছ, মুরলীধর।”

    "আপনি কিছু বলছিলেন?"

    "না তো..."

    "আপনি বিবিজীকে ডাকছিলেন।”

    তিনি হাসার চেষ্টা করলেন কিন্তু কোন শব্দ বেরোল না। শুধু বুকের ওঠাপড়া... ক্লান্ত হয়ে থামলে মুখের কোণ দিয়ে থুতু গড়িয়ে বালিশে পড়ল। মুরলীধর তক্ষুনি রুমাল দিয়ে মুছে দিল। সে সামনে মেঝেতে বসে রইল যদি আবার কাশি আসে। কিন্তু তাঁর আর ভয় ছিল না। তিনি এখন চোখ বুজে নিশ্চল। কিন্তু শান্ত নন, চোখেমুখে একটা আকুলতা, যেন কিছু একটা বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে কিন্তু রাস্তা পাচ্ছে না।

    মুরলীধর তাঁকে দেখে ভাবছিল কে জানে তাঁর মনে কী হয়ে যাচ্ছে, একটা ফোঁড়ার মতো—না শুকোচ্ছে, না ফেটে উঠছে। এই সময় মনে হয় বিটিয়াকে একটা চিঠি লিখে দেওয়া উচিত। কিন্তু তার সাহস হচ্ছিল না। আজ পর্যন্ত সাহেবের অনুমতি ছাড়া সে কোনও কাজ করেনি। এখন শেষ সময়ে—যখন তিনি বিছানায় বেহুঁশ— তাঁকে কি ধোঁকা দিতে পারে? তিনি মাফ করলেও মুরলীধর নিজেকে কখনও ক্ষমা করবে না।

    "মুরলীধর?" খাট থেকে হঠাৎ তাঁর গলা শোনা গেল, “তুমি এখনও যাওনি?"

    "জী, এই যাচ্ছি। কিছু দরকার আছে?"

    "দিল্লির বাবু এসেছেন?"

    "এখনও না। আমি দেখে আসি?"

    "না থাক। তাড়ার কী। সে আসবে নিজের সময়।”

    সময়ের কি কোন ঠিক আছে? ঘরের ভিতর থেকে বোঝা যায় না সে কোথায় লুকিয়ে আছে, আদৌ আছে না নেই? খোলা জানলায় ব্যাডমিন্টন কোর্টের উপরে আকাশে একটা-দুটো তারা দেখা যায়, ঘরের ভিতর বিছানায় তখনও রোদ্দুরের তাপ, কোথাও দূরে পাহাড় থেকে ঘরে-ফেরা ছাগলদের গলার ঘণ্টি শোনা যাচ্ছিল।

    "অ্যানা এসেছিল?" মেহরা সাহেব পাশ ফিরে চোখ খুললেন।

    "দুদিন আগে, নিরঞ্জন বাবুর সঙ্গে।”

    "আর আমি কোথায় ছিলাম?" তিনি উঠবার চেষ্টা করতেই মুরলীধর তার কাঁধ ধরে শুইয়ে দিল।

    "আপনি ঘুমোচ্ছিলেন।”

    "আমায় জাগালে না কেন?"

    "জাগিয়েছিলাম...আপনি অ্যানাজীর সঙ্গে কথাও বললেন। ওই দেখুন সে আপনার জন্য বই রেখে গেছে—আপনি চেয়েছিলেন...মনে পড়ছে?"

    দিভার বই, যেগুলো অ্যানা নিয়ে যেত। তাঁর মনে পড়ল... আজকাল প্রায়ই এরকম ভুল হয়, অনেক পুরনো ঘটনা মনে পড়ে যেন ঠিক কাল ঘটেছিল, আর যেটা কাল হয়েছিল তা আর মনে থাকে না। জীবন বয়ে যায়, ভুলে যাওয়া খালি জায়গাগুলো পুরনো ঘটনায় ভরতে থাকে। একটা বয়সের পর মানুষ বেঁচে থাকে একরকম আর জেগে থাকে আরেকরকম। যখন সত্যিই জাগে তখন দেখে বাঁচার অর্থটা কে জানে কখন হারিয়ে গেছে...এটা কি সবার বেলাতে হয়? না শুধু তাঁর সঙ্গেই?

    বাগানে হাওয়াটা পড়ে এসেছে, কিন্তু ধোঁয়ার গন্ধটা তখনও কড়া লাগছিল।

    "জানলাটা বন্ধ করে দিই?"

    "না, এখনও না... এখনও তো আলো আছে... তুমি কোথায় বসে?"

    "জী এইখানে, আপনার বালিশের কাছে..." মুরলীধর তার মাথায় হাত বুলোচ্ছিল যেন সে সত্তর বছরের বুড়ো নয়, সাত বছরের ছেলে। যখন মানুষ নিজের শরীর ছেড়ে অন্য কোথাও বিচরণ করে, কোন অজানা প্রদেশে, যেখানে প্রত্যেক ব্যাধির নিজের গলি, প্রত্যেক স্মৃতির নিজস্ব অঙ্গন, প্রত্যেক অনুশোচনার নিজের উঠোন ... রোগীর সামনে বসা আত্মীয় জানতেও পারে না সে কোন যাত্রায় পাড়ি দিয়েছে, সেখান থেকে আদৌ ফিরবে কিনা... মুরলীধর ভয় পেয়ে তাঁর কাঁধ ধরে নাড়া দিল...

    "সাহেব, আপনি এখানে আছেন তো?"

    তিনি হেসে চোখ খুললেন, "এখানে থাকব না তো কোথায় যাব?" স্নেহভরে তিনি মুরলীধরের কাঁধে হাত রাখলেন।

    "একটা কথা বলি সাহেবজী?"

    "বলো, মুরলীধর...কী বলতে চাও?"

    "তিয়াবিবিকে ডেকে পাঠাব?”

    তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইলেন, "কেন...আমার সময় হয়েছে বুঝি?"

    "সময়ের কে জানে বাবুজী, সে কি আর ঘণ্টা বাজিয়ে আসে?" মুরলীধর একটু ক্ষুব্ধ।

    "হ্যাঁ আসে। যখন বিবি গেছিল, তোমরা সবাই কি তার যাওয়ার আওয়াজ শোননি? তুমি কত মানত করেছিলে, হল কিছু?"

    "হয়েছিল, সাহেবজী।”

    "সে কি বেঁচেছিল?”

    "জী, বেঁচেছিল। কখনও কখনও মৃত্যুরও দয়া হয়, যন্ত্রণা থেকে রক্ষা করে... তার কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছিলাম না।”

    কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। তারপর সাহেব বললেন, ভাঙা গলায়, "তুমি আমার জন্য কোনও মানত করেছ?"

    "না তো ...ভাবিইনি কখনও ।”

    "কেন না?"

    "আপনার কীসের অভাব? আপনার তো সবকিছুই আছে।”

    সব কিছু?

    মেহরা সাহেব আবার চোখ বন্ধ করলেন। তিনি ভিতরে চেপে রাখা 'সব কিছু'-টা আর দেখতে চান না।

    ধীরে ধীরে ঘরে অন্ধকার নেমে এল। আর কোনও কথা হল না। মুরলীধর পা টিপে টিপে বাইরে এল। পাতার আগুনটা নিভে আসছিল, শুধু তীব্র গন্ধটা তখনও ছিল। নিজের কুঠিতে যাওয়ার আগে সে দিল্লীর বাবুর খবর নিতে গেল...এতক্ষণে তার এসে যাবার কথা।

    আজকাল মুরলীধর বাবুকে একলা থাকতে দেয় না... নিজে কোথাও গেলে বংশীধরকে বসিয়ে রেখে যায়। তার ভয় সাহেব যদি জেগে উঠে ঘরে কাউকে না পায়? সন্ধ্যার সময় দিল্লীর বাবু এসে বসে, কখনও কখনও রাত্রেও সোফায় ঘুমিয়ে থাকে। মুরলীধর তার জন্য ওখানে বিছানা করে দিয়েছে।

    কোঠির বারান্দায় আলো জ্বলছিল। মনে হচ্ছে ডক্টর সাহেবের ওষুধ নিয়ে ফিরেছে... তাহলে এখানে কেন আসেনি? নিজের ঘরে কেন বসে আছে?

    অধ্যায়—২.২

    রাত, দিন। দিন আর রাত।

    আমি তাঁর পাশে বসে থাকি। আমি তাঁকে এত বড়ো কটেজে একা একা ফেলে রাখতে চাই না। তিনি চলেছেন এক অজানা দেশের দিকে। সে যাত্রায় একলা, সঙ্গীহীন হওয়ার থেকে ভয়ানক আর কী হতে পারে? শেষ পর্যন্ত অবশ্য কেউই সঙ্গ দিতে পারে না, কিন্তু কিছুদূর তো যাওয়া যায়। প্রত্যেক দিন আমার মনে হয় আমি তাঁর সঙ্গে আরও আগে চলে এসেছি। আমার ভয় একদিন তিনি এত আগে চলে যাবেন যে আমি জানতেও পারব না কোন পাহাড়ের পিছনে তিনি লুকিয়ে পড়েছেন।

    কিন্তু এখন নয়... এখন তিনি যখন চোখ খোলেন, আমাকে দেখে একটু আশ্চর্য হন, যেন কোন লম্বা জার্নির পর বন্ধুকে প্ল্যাটফর্মে একই জায়গায় বসে থাকতে দেখছেন।

    "তুমি রেজিস্টারটা এনেছ?"

    "দাঁড়ান। এখুনি নিয়ে আসছি।” আমি উঠতে যাচ্ছিলাম কিন্তু তিনি আমার হাত ধরে বসিয়ে দিলেন, "দাঁড়াও, আমার এমন কিছু বলার নেই। আমি শুধু একটা জিনিশ দেখলাম। প্রথমে মনে হল স্বপ্ন, কিন্তু চোখ খোলার পরেও সেটা দেখতে পাচ্ছিলাম। ...তোমার কী মনে হয়? কোন রকম সংকেত?"

    "কীসের সংকেত?”

    "আমি তার ভিতরে ঢুকলে সেটা অদৃশ্য হয়ে যায়, কিন্তু সরে গেলে আবার তাকে দেখতে পাই।”

    তিনি কিছুক্ষণ শূন্যের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর আস্তে আস্তে পাশ ফিরলেন।

    "তুমি কখনও এই সম্বন্ধে কিছু ভেবেছ?"

    "কী সম্বন্ধে? আপনি কীসের কথা বলছেন?"

    "নিজের, আর কার?" তাঁর চোখ দুটো দিনের শেষ রৌদ্রে উজ্জ্বল, "আমার মনে হয়...কোনও কোনও জিনিশ খুব কাছে থেকে দেখা যায় না। তুমি করবেটের স্মৃতিকথা পড়নি, সে এখানকার জঙ্গল নিয়ে লিখেছিল... এক জায়গায় লিখেছিল, সে যখন বন্দুক নিয়ে গভীর জঙ্গলে হাঁটে, তার মনে হয় আশপাশে অনেকগুলো চোখ তাকে দেখছে। 'আমার পায়ের শব্দ শুনেই তারা লুকিয়ে পড়ে'— সে লিখেছিল—আর আমার মনে হয়, যেন..." তিনি একটু থামলেন, "যেন সে অন্য কারও এলাকায় এসে পড়েছে।”

    কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর আবার কিছু ভেবে বললেন, "এমনও হতে পারে যে আমরা ভুল করে এখানে এসে পড়েছি, হয়তো আমাদের জায়গা অন্য কোথাও?" তার গলায় এমন কিছু ছিল যে আমি চমকে উঠলাম।

    "কোনটা আসল জায়গা? এই পৃথিবী ছাড়া আর কোনও জায়গা আছে?"

    "জানি না। কিন্তু এখানে যে তুমি আছ, আমি আছি, নিরঞ্জন বাবু আছে... একটু ভাবো, আমরা কি সবাই ঠিক জায়গায়? নিরঞ্জন বাবু একবার আমায় একটা অদ্ভুত গল্প শুনিয়েছিল ... তুমি তো জানো সে ফিলসফি ছাড়লেও সাধুসন্ন্যাসীদের সঙ্গে মেলামেশা করত। কাউকে পেলেই তাদের সঙ্গে গল্পে জুড়ে দিত। একবার এক বুড়ো ভিখারিকে তার বাগানের পিছনে ঝোপড়িতে থাকতে দেখেছিল...সে বসে গেল গল্পে...কিন্তু ভিখারি অনেকক্ষণ তার প্রশ্নের কোন জবাব দিল না। নিরঞ্জন বাবু তবুও ছাড়বে না...শেষে সাধু বলল, "আগে এই কুঠিতে তোমার নিজের জায়গায় গিয়ে বসো।” নিরঞ্জন বাবু চুপ করে উঠে এক কোণে গিয়ে বসল। কিন্তু একটু পরেই উসখুস করতে লাগল। সে উঠে অন্য এক কোণে গিয়ে বসল, কিন্তু সেখানেও মনে হল কিছু অস্বস্তি... আবার উঠে অন্য জায়গায়... কিন্তু নানা জায়গায় বসেও তার অস্থিরতা বাড়তেই থাকল...তারপর তার মনে হল শুধু একটি জায়গা তার পক্ষে শ্রেষ্ঠ... দরজার চৌকাঠের বাইরে... আগে জায়গাটা অন্ধকার ছিল, কিন্তু এখন রোদ পড়েছে...সেখানে বসতেই তার মনে হল—শুধু এক মুহূর্তের জন্য— এই জায়গাটা ঠিক তার জন্যেই রাখা, যাকে সে আজ অবধি খুঁজে বেড়াচ্ছে। জানো, সেখানে বসে তার কী মনে হল?...একটা শান্তির ভাব ...তার সাধুকে আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই...সব প্রশ্নের উত্তর মিলে গেছে... সব চিন্তা, সব ভয় দূর হয়ে গেছে। সে যেমন গেছিল, তেমনি বাইরে বেরিয়ে এল।”

    তাঁর মুখটা অন্ধকারে ঢাকা, বাইরে অবশ্য তখনও শেষ রোদ পড়ে ছিল চীর গাছগুলির মাথায়।

    "তুমি জানো ...দিভা তোমায় এখানে ডেকেছিল— কখনও ভেবেছ কী জন্য? ...আমার জন্য। তাই না?" তিনি বালিশের তলা থেকে হাত বের করে আমার হাতটা ধরলেন। "কিন্তু যখন আমি আর থাকব না, তখন? ভেবেছ কিছু? জানো, এই পৃথিবীতে কত জায়গা চিরকাল খালি থেকে যায়, আর লোকে ভুল জায়গায় বসে সারা জীবন কাটিয়ে দেয়। আমি চাই না তুমিও এরকম ভুল করো।”

    "আর যে তার ঠিক জায়গা পেয়ে যায়? সে সুখী হয়?"

    "সুখ?" একটু ফুঁ দেওয়ার মতো আওয়াজ, "আমি সুখের নাম শুনেছি বটে, কিন্তু দেখিনি কখনও।”

    তিনি বালিশে মাথা ফেরান। আমি জানলার পর্দা টেনে দিই। ছোট টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দিই। ঝুঁকে দেখি তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। যে-কোন সময়ে জাগতে পারেন। ঘুম যেন একটা ছোট্ট পুকুর, তিনি এক ডুব দিয়েছেন, আর আমি পাড়ে বসে তাঁর উঠে আসার প্রতীক্ষায়।

    না, তাঁর এমন কোন অসুখ হয়নি যা ডাক্তারি খাতায় নথিভুক্ত করা যায়। এমন কোন বিশেষ কষ্ট নেই যার জন্য তিনি ছটফট করছেন। সবকিছু আগের মতোই—শুধু তাঁর চেহারায় একটা পরিবর্তন, চোখ বোজা থাকলেও আধ খোলা, অর্ধেক ভিতরে, অর্ধেক বাইরে। অনেকদিন দাড়ি না কামানোর জন্য মুখে একটা জীর্ণ শুভ্রতা, তার ভিতরে নাকটা খাড়া হাড়ের মতো উঁচু... চোখ আর নাকের মাঝে একটু কৌতূহল চমকে ওঠে--তিনি কি কিছু দেখছেন যা আমি দেখতে পাচ্ছি না? স্বপ্ন নয়। স্বপ্ন দেখার সময় তাঁর মুখে শিশুসুলভ একাগ্রতা দেখি, মুখ একটু খোলা, যেন একমনে কিছু শুনছেন—সে সময় আমার মনে হয় যেন তাঁর শরীরটা এই বিছানায় নেই, উড়ে গেছে তাঁর ছোটবেলার বা যৌবনের দিনে। সেই দিনগুলি এখন সিনেমার পরদায় সিনের মতো ... ঠিক একেবারে আগের মতো নয়, যে সময়টা জীবনের তাড়াহুড়োয় হারিয়ে গেছিল, সেটা এখন আঠা দিয়ে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এইটা তিনি আমায় দিয়ে লেখান, দ্বিতীয় জীবনের নিচে জোড়া দেওয়া এক তৃতীয় জীবন যা এতদিন তলায় পড়ে ছিল, এখন সুযোগ পেয়ে জিওল মাছের মতো খলবল করে উপরে উঠে এসেছে।

    এই সুযোগে তিনি আমার হাত ধরে ফেলেন, বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে চেয়ে বলেন, “দেখলে তুমি...?"

    "কী দেখব বাবুজি? কী বলছেন?" এইরকম সময়ে আমার মুখ দিয়ে অজান্তেই 'বাবুজি' বেরিয়ে আসে। হয়তো হাত ধরার জন্য আমাদের দূরত্বটা মুছে গেছিল—শরীরের ছোঁয়ায় এরকমই হয়, কোনও অজানা জাদু সম্পর্ক বদলে দেয়। একটু পরে তাঁর হাত আবার ঢিলে হয়ে যায়, ঘুমের চাদর ধীরে ধীরে তাঁকে ঢেকে ফেলে। যে মাছ উপরে ঝাঁপ দিচ্ছিল সে আবার গভীর অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। থেকে যায় শুধু কিছু দীর্ঘশ্বাস, তাঁর বিছানা, বালিশের উপর ল্যাম্পের আলো আর শিয়রে বসা...আমি।

    পরদিন ডক্টর সিং তাঁকে দেখতে এলেন। অনেকক্ষণ বসে রইলেন তাঁর সঙ্গে। আমি এই সুযোগে বাইরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বন্ধ দরজার পিছনে কথাবার্তার ক্ষীণ আওয়াজ। অন্য দিন ডক্টর বাইরে এসে আমায় সব সময় কিছু অর্ডার দিয়ে যান, প্রেসক্রিপশন হাতে ধরিয়ে দেন, ওষুধ আনতে বলেন, ব্যস্তভাবে শুধু কাজের কথা ছাড়া আর কিছু বলেন না। কিন্তু এবার বারান্দায় আমার সামনে দাঁড়িয়ে কিছু ভাবলেন, "কাল কিছু হয়েছিল কি?"

    "না, আমার সঙ্গে একটু কথা বলে ঘুমিয়ে পড়লেন।”

    "কোনও উত্তেজনা...?”

    “না, তেমন কিছু না। আপনি তো জানেনই, তিয়া চলে যাবার পর থেকেই একটু বিরক্ত থাকেন।”

    "বিরক্ত কেন?" উনি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেন।

    "উনি জানতেন না তিয়া এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে। আপনাকে কিছু বলেছিলেন কি?"

    ডক্টর সিং হাসতে শুরু করলেন। উনি যখন হাসেন, ওঁর সারা শরীর হাসিতে যোগ দেয়। হাত, মাথা, চোখ সবাই একে অন্যকে গোপন ভাষায় ইশারা করতে থাকে।

    "একদিন ক্লাবে আসতে চান। জানো উনি ক্লাবের সবথেকে পুরনো মেম্বার? তুমি একদিন নিয়ে যাও ওঁকে তোমার সঙ্গে?"

    "এই অবস্থায়?" উনি কি আমার সঙ্গে মস্করা করছেন?

    "অবস্থা খারাপ কি, উনি ঠিকই আছেন। দেখো, আইনের চোখে সবাই নির্দোষ যতক্ষণ না তারা দোষী প্রমাণিত হয়। ডাক্তারি সায়েন্সে ঠিক উল্টো। সবাই রোগী, যতক্ষণ না তারা নিজেদের সুস্থ অনুভব করে।”

    "তাহলে আপনি ওঁর অবস্থার কোন চেঞ্জ দেখছেন না?"

    "বলা মুশকিল। এক খুঁটি থেকে আরেক খুঁটি... লাস্ট খুঁটিটা না আসা পর্যন্ত কী করে বলি জল কত কাছে এসেছে?"

    ওঁর আসল অবস্থা আমার কাছে চেপে রাখার জন্য উনি কখনও কখনও এইরকম হেঁয়ালি করে কথা বলেন।

    উনি সিঁড়ি দিয়ে নামলেন। আজ খাকি পোশাক পরে এসেছিলেন, মাথায় টুপি, দেখাচ্ছিল ঠিক আর্মি অফিসারের মতোই।

    মুরলীধর সেন্ট সেবাস্তিয়ানের লাগাম ধরে রোদ পোয়াচ্ছিল। ডাক্তারকে দেখে কাছে এগিয়ে এল। উনি সিঁড়ি থেকেই লাফ দিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়লেন, যেন খেলার ঘোড়া, বসতেই সে-ও চলা শুরু করল। আমিও সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছিলাম, কিছু কথা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছিল...মাঝখানের খুঁটি—-যা পার করা দরকার। মুরলীধর ফটক খুলতেই উনি আমার দিকে চেয়ে মুচকি হাসলেন—

    "চলো, আমার সঙ্গে ক্লাবে আসবে?"

    "আর কোন রোগী দেখা বাকি নেই?"

    "ব্যস, লাস্ট তুমি। তোমাকে 'বারেই' দেখে নেব।”

    তাঁর হাসি দেখে মনে হল ওঁকে ছাড়া বাইরের পৃথিবীটা একেবারে অন্যরকম। "... তো বলো, আসবে?"

    ভাবলাম চলে যাই। কিছুক্ষণের জন্য তো ছুটি পাওয়া যাবে। তারপর কুকুরের চেনের মতো কেউ আমাকে টেনে থামিয়ে দিল। এই লাইনের ওপারে যেতে পারব না। "আজ থাক," আমি বললাম, "আবার একদিন যাব, অনেকক্ষণ কাটাব আপনার সঙ্গে।”

    সেন্ট সেবাস্তিয়ান হাওয়ায় লম্বা লেজ দুলিয়ে চড়াই চড়তে শুরু করে কিছুক্ষণের মধ্যে পাকদণ্ডীর মোড়ে সে আর ডাক্তার সিং মেঘের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। গেট বন্ধ করে ফেরার সময় এক মুহূর্ত থামলাম। কুয়াশার মধ্যে মেহরা সাহেবের কটেজটা আবছা দেখাচ্ছে। বোঝা যায় না কেউ সেখানে আছে কি না। মাটি আর পাথরে ঘেরা আত্মা, সময়কে চার দেয়ালে আটকে জোঁকের মতো চুষছে।

    আর কোথাও যাওয়ার নেই। আমি বারান্দায় বসে ওঁর ডাকের অপেক্ষা করছিলাম। কখনও ডাকেন, কখনও মুরলীধরের মারফত খবর পাঠান। এক দুপুরে হঠাৎ আমার কুঠিতে এসে বারান্দায় চেয়ারে বসে পড়লেন। অনেকদিন পর পোশাক বদলে এসেছেন, কোট, প্যান্ট, পালিশ করা মচমচে জুতো। শুধু চেহারাটা ভীষণ ফ্যাকাসে ও দুর্বল দেখাচ্ছিল। অনেকদিন পর দাড়ি কামানোর জন্য মুখের হাড় বড্ড উঁচু আর নগ্ন মনে হচ্ছিল।

    "দাঁড়ান, আমি চা নিয়ে আসি।” আমি তাড়াতাড়ি বললাম।

    "বসো ..." উনি আমার দিকে একটা চেয়ার ঠেলে দিলেন, "চা-টা ছাড়ো, এইটা দেখো," বলে একটা লম্বা সাদা খাম আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন।

    আমি খাম খুলে দু পাতা কাগজে হাতের লেখা দেখেই বুঝে গেলাম কার চিঠি।

    "পড়ো।” তাঁর গলা শুনলাম।

    আমি তিয়ার চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম, উনি চেয়ারটা আমার পাশে টেনে এনেছিলেন। আমি কোথাও আটকে গেলেই অধীর হয়ে বলতেন, "ছাড়ো, আগে পড়ো।” আর আমি লাইন টপকে এগিয়ে যেতাম... পড়তাম সেইসব গ্রাম ও উপনগরের নাম যেখানে তিয়া গেছিল। আমি কখনও এসব জায়গার নাম শুনিনি। চিঠিতে পুরনো বিবাদের ছায়ামাত্র নেই, সে মেহরা সাহেবের মন টানতে চাইছিল যেখানে তিয়া এতদিন কাটিয়েছে... কমিউনিটি সেন্টার, সরকারি ডিসপেনসারি, প্রাইমারি স্কুল... আমি ভুলে যাচ্ছিলাম কী পড়ছি, অক্ষরের পিছনে আমি তাকে দেখতে পাচ্ছিলাম, তার জুতোয় কাদার ছোপ... সে কোমরে দোপাট্টা জড়িয়ে আমার সঙ্গে সারা রাস্তা বকবক করতে করতে ঝরনায় জল আনতে যাচ্ছে। আমি তার কথা পুরোটা শুনতেও পেতাম না।

    আমার মনে হচ্ছিল যেন আমি সাহেবকে চিঠি পড়ে শোনাচ্ছি না, আমি নিজেই তার গলা শুনতে পাচ্ছি, চিঠির মধ্য দিয়ে সে-ও আমাদের কাছে চলে এসেছে। শেষ লাইনে আমার নিজের নাম পড়ে আমি থমকে গেলাম। সে জানতে চেয়েছে আমি কেমন আছি, তিনি কি আমায় এখনও তাঁর পুরনো জীবনের কাহিনী শোনাচ্ছেন... আমি পড়া থামিয়ে তাঁর দিকে তাকালাম, কিন্তু তাঁর দৃষ্টি বাইরে, দুপুরের রোদে-ভরা পাহাড়ের মাথায়। আমি চুপ করতে তিনি আমার দিকে তাকালেন, "কবে আসবে কিছু লিখেছে?"

    "না, কিছু দেখলাম না।” আমি জানি তিনি নিজে আগেই চিঠিটা পড়েছেন। তিনি কি জানেন না কি লেখা আছে বা নেই? হয়তো মনে করেন যেটা উনি দেখতে পাননি আমি সেটা খুঁজে নেব।

    তিনি আমার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে ধীরে ধীরে নিজের কটেজের দিকে রওনা দিলেন। দিনের আলো কমে আসছিল, সূর্যটা মেঘের পিছনে টিমটিম করছিল।

    অধ্যায়—২.৩

    এক অবসন্ন দুপুরে দরজায় খটখট আওয়াজ শুনে বাইরে এসে দেখি নিরঞ্জন বাবু বারান্দায় বসে। দুপুরের রোদে চেহারাটা ম্লান, খাকি টুপির উপর ধুলো, দাড়িটাও আগের চেয়ে আরও শাদা দেখাচ্ছে, যেন কোন প্রাচীন যুগের ঋষি লম্বা তপস্যার শেষে বাইরে বেরিয়ে এলেন।

    "ভিতরে আসুন।” আমি বললাম।

    "না, না। বারান্দাতেই বসি। একটু জল খাওয়াবে?"

    আমি তাড়াতাড়ি জল নিয়ে এলাম, যেন উনি সত্যিই পর্বত লঙ্ঘন করেছেন।

    "কোত্থেকে আসছেন?”

    "বাজার থেকে ... আমার বোঝাটা দেখছ না?" তিনি তিনটে আপেলের ক্রেটের দিকে ইশারা করলেন, "একটা মেহরা সাহেবের আর দ্বিতীয়টা তোমার জন্য।"

    "আর এটা?" আমি তৃতীয়টার দিকে দেখালাম।

    "যদি পারো তো এটা অ্যানাজীর ঘরে পৌঁছে দিয়ো। জানি না কবে ওর সঙ্গে দেখা হবে।”

    আপেলের ক্রেট দেখে আশঙ্কা হচ্ছিল তাঁর বাড়ি ফেরার দিন নিঃশব্দে এত কাছে এসে গেল আর আমি টেরও পেলাম না!

    "তুমি বাড়ি থেকে বেরোও কখনও?"

    "মেহরা সাহেবের কাছে থাকতে হয় যে।”

    "উনি আছেন কেমন?"

    "তিয়া যাওয়ার পর থেকেই উনি শয্যাশায়ী, বাইরে আর বেরোন না।”

    "ডক্টর সিং দেখছেন?"

    "হ্যাঁ, কিন্তু বলেন না কিছু। আমাদের বলেন ওঁকে একলা না ছাড়তে। তাই মুরলীধর আর আমি পালা করে ওঁর সঙ্গে থাকি।”

    "তোমায় কিছু বলেন না?"

    "বলেন, কিন্তু আমাকে নয়। আমার মনে হয় তিনি এখন অন্য কোনও রাজ্যে; আমরা সেখানে পৌঁছতে পারি না।”

    কিছুক্ষণ আমরা চুপ করে রইলাম। উনি ঠান্ডা চোখে রৌদ্রে ঝলমল কটেজটার দিকে তাকিয়েছিলেন।

    "আপনি বসুন, আমি চা নিয়ে আসছি।”

    তিনি যেন হঠাৎ জেগে উঠে চারদিকে তাকালেন—বারান্দা, আমার ঘর, ঘরের ভিতর অন্ধকার... বললেন, "এখানে তো তুমি সারাক্ষণ থাকো, চলো একটু বাইরের হাওয়া খেয়ে আসি। আসতে পারবে?"

    আমি ঘড়ি দেখলাম। অনেক সময় আছে। মুরলীধর সন্ধ্যে পর্যন্ত বাবুর সঙ্গে থাকে। আমার রাত্রে ঘুম আসে না তাই রাতের শিফটটা আমি নিয়েছি। কিন্তু কখনও কখনও একটা ভয় ধরে—ওঁর ঘরের, আমার কুঠির, কটেজের নীরবতা...

    "হ্যাঁ, চলুন।” আমি উত্তর দিলাম।

    উনি হাসলেন, "কোথায় যেতে চাও?"

    "সেটা আপনার মর্জি!"

    "এমন দিনে চুন্নিলালের চওবারা সব থেকে ভালো। বাইরে হাওয়ায় বসা যাবে।”

    চুন্নিলালের দোকানটা এক ধরনের হাওয়া-ঘর। চায়ের দোকান আর হাওয়া-ঘর একসঙ্গে। নিরঞ্জন বাবু একে 'উড়ন্ত খাট' নাম দিয়েছিলেন। দূর থেকে মনে হয় যেন একটা বুড়ো অশ্বত্থ গাছের নিচের দোকানটা যেন গাছের ভিতর থেকে মুখ বাড়িয়ে মাটি আর আকাশের মাঝামাঝি লটকে আছে। চুন্নিলাল পিছনে যে কুঁড়েতে থাকে তার টিনের ছাদে পাকা লংকা আর বড়ি শুকোতে দেয়। নিচে দরজার সামনে তার বউ লাল ঘাগরা ছড়িয়ে বসে—পান বেগমের মতো। অশ্বত্থ গাছের পাতাগুলো টিনের ছাত আর ধাবার টেবিলের উপর ফরফর করে ওড়ে।

    টেবিল একটাই, দুপাশে দুটো বেঞ্চ। কাছে মাটির উনুনের উপর ঢিমে আঁচে চায়ের কেটলি টগবগ করে। উনুনের উপর একটা কাঠের তাকের একদিকে ঝকঝকে পেতলের গেলাস আর অন্য দিকে শিশি-ভর্তি বিস্কুট, মঠরি আর টফি। শিশির ঢাকনায় পাখির বিষ্ঠার সাদা দাগও দেখা যায়।

    সারা শহর নিচে বিছয়ে রয়েছে।

    চুন্নিলাল আমাদের দূর থেকে আসতে দেখেছিল। ওর বউ চটপট আঁচল দিয়ে টেবিলের পাতাগুলো ঝেড়ে ফেলে দু গেলাস জল কেটলিতে চড়িয়ে দিল।

    বেঞ্চিতে বসে নিরঞ্জন বাবু এক লম্বা শ্বাস ফেললেন।

    "যেদিন এই শহরে প্রথম এসেছিলাম, এই দোকানে বসে চা খেয়েছিলাম। সেদিন ভাবতেই পারিনি যে এখানেই ডেরা বাঁধব।”

    "আপেলের বাগানটা তখনই কিনেছিলেন?"

    না... সে অনেক বছর পরে... প্রথমে তো কয়েকটা দিন থাকবার জন্যই এসেছিলাম, তারপর ভাবলাম, থাকবই যদি তো কিছু একটা কাজ চাই..."

    "আমি তো অনেকদিন জানতামই না যে আপনি এখানে... আমরা সবাই ভেবেছিলাম আপনি বাইরে কোনও ইউনিভারসিটিতে পড়াচ্ছেন...যেমন আপনি চুপ করে বন্ধুদের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যেতেন, আমরা ভাবতাম এখানেই তো ছিলেন, আবার কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেলেন?"

    তিনি হাসলেন না। মুখে একটা বিষাদের ছায়া, যেন পুরনো দিনের জগৎ থেকে অনেকদূর চলে এসেছেন, এখন আর ওসব মনে করতে চান না।

    গাছের পিছনে চুন্নিলালের বউ বাসন ধুচ্ছিল আর জলের সরু ধারা আমাদের সামনে দিয়ে নালায় বয়ে যাচ্ছিল।

    চুন্নিলাল দু গেলাস চা এনে আমাদের সমাধি ভঙ্গ করল, "কেমন আছেন মেহরা সাহেব?"

    "ওই একরকম। চলাফেরা করেন না। ঘরেই থাকেন।"

    "কী করেন সারাদিন?"

    "শুয়ে থাকেন, যখন কিছু বলেন তো সব বোঝা যায় না, যেন কোন পুরনো দিনের খাতা খুলেছেন যা আগে কখনও দেখিনি।"

    "নিজের কিছু লেখান?"

    "জিজ্ঞেস করেন রেজিস্টার এনেছি কিনা...তারপর নিজের গল্প পড়ে নিজেই হাসেন।”

    "হাসেন বুঝি?"

    "হ্যাঁ... পড়তে পড়তে হাসেন।”

    "এরকম হল কী করে? এই কিছুদিন আগেও তো সব ঠিক ছিল। আমি তাঁকে এখানে-ওখানে বেড়াতে দেখতাম। কিছু হয়েছিল কি?"

    "বিটিয়া এসেছিল।"

    "কবে? আমায় কেউ খবর দেয়নি তো?”

    "অল্প ক'দিনের জন্য। সাহেবকে দেখতে এসেছিল।"

    নিরঞ্জন বাবু চায়ের গেলাস সরিয়ে কামিজের পকেট থেকে পাইপ বার করলেন। তামাক ভরতে ভরতে বললেন, “যদি এখানে থাকতেই না চায়, কে জানে সে আসে কেন? তুমি ওকে লিখেছ ওঁর অবস্থা সম্বন্ধে?"

    "লিখেছি। প্রতি সপ্তাহে লিখি।”

    "অদ্ভুত মেয়েটা! নিজের রাগ বাপের উপর তুলছে।”

    "কীসের রাগ?" আমার মনে হল উনি কিছু লুকোচ্ছেন।

    তিনি তৃতীয় দেশলাই কাঠি জ্বালাচ্ছিলেন, মুখ থেকে পাইপটা সরিয়ে বললেন, “আমি কী জানি? একটি একলা মেয়ের সঙ্গে কত কিছু হয়, কেউ জানে? আর দিভা তো তার আসল মা-ও ছিল না।”

    সে নয় তো কে ছিল? সে, যে তিয়াকে দরজার বাইরে ছেড়ে চলে গেছিল? "আপনি তার মাকে দেখেছেন কখনও?"

    "সাহেবের প্রথম স্ত্রীকে? একবার এসেছিল...কেউ জানত না স্রেফ দিভা ছাড়া, সে জানত।” দাড়ির মাঝে একটু ক্রুর হাসি, "সে সব জানত, তার কবর খুঁড়লে কত কেচ্ছাকাহিনী বেরিয়ে আসবে। তোমার ভাগ্য ভালো, তুমি যখন এলে, সবার পার্ট শেষ হয়ে গেছিল।”

    উনি কী বলছেন? কীসের পার্ট? অর্ধেক কথা বলে কেন মাঝপথে থেমে যান? কিন্তু তাঁকে পুরোটা জিজ্ঞেস করার সাহস আমার ছিল না। ইচ্ছাও নয়।

    মেঘ নিচে নেমে আসছে। নালায় তখনও জলের ছিরছির আওয়াজ।

    "তুমি জানো?” পাইপটা ঝেড়ে টেবিলে নামিয়ে রাখলেন, "আমাদের বাগানে এমন আপেল আছে যা বাইরে থেকে দেখায় লাল টুকটুকে, ভিতরে কাটলেই পোকা... কবে ভিতরে ঢুকে বসে ছিল। বাইরে আসে না, ভিতরটা কুরেকুরে খায়, খেয়ে একেবারে ঝাঁঝরা করে ফেলে। কখনও কখনও পুরো গাছটাই এভাবে নষ্ট হয়ে যায়। যখন আমি মেহরা সাহেবকে দেখি..." আর কিছু না বলে পাইপ ধরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কী বলতে চেয়েছিলেন? কত লোক তো হেসে-খেলে বেড়ায় ... সবার ভিতরেই কিছু না কিছু বিষ আছে, পোকা আছে। এর থেকে বাঁচতেই তো আমি এতদূর এসেছি। তখন আমার মনে পড়ল সেই সাধুর গল্পটা... যিনি নিরঞ্জন বাবুকে 'নিজের জায়গা' খুঁজে নিতে বলেছিলেন। পেয়েছেন কি সেই জায়গাটা, না এখনও খোঁজা চলছে?

    চুন্নিলাল আমাদের একলা ছেড়ে নিজের কুঠিতে চলে গেছে। পড়ন্ত রোদ হাওয়ায় কাঁপতে থাকা গাছের পাতা আর মেঘ ভেদ করে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ছিল। পাহাড়ের উপর এক অলৌকিক হলুদ সোনার আভা--যেন দেবতাদের জন্য তৈরি, মানুষের হাতের ছোঁয়ার বাইরে, নিজস্ব জ্যোতিতে জ্যোতির্ময়।

    "এই সময়টা আমার অদ্ভুত মনে হয়," নিরঞ্জন বাবু বললেন, "আপেলের সিজন শেষ... নিজেকে একেবারে বেকার লাগে। এখানে থাকতে ভালো লাগে না, আবার নিচে যেতেও ইচ্ছা করে না। কখনও কখনও আমার মনে হয় এখানে লোক আসে থাকতে নয়, অপেক্ষা করতে।”

    "কীসের অপেক্ষা?"

    উনি হাসলেন। পাইপের জমা তামাকটা টেবিলে ঠুকে ঠুকে ঝাড়তে লাগলেন।

    "নিজের, আবার কীসের? যে বয়সে লোক এখানে থাকতে আসে, নিজেকে ছাড়া আর কার অপেক্ষায় থাকবে? তাই তাদের নিচে নামতেও ভয়।”

    "ভয় কেন?"

    "নিজেকে হারিয়ে ফেলার ভয়। এখানে থাকতে অন্তত এটুকু ভরসা যে যদি কিছু হয় তো আমরা সামনেই থাকব। নিচে শহরে আমরা নিজেদের ভুলিয়ে রাখি, যতক্ষণ না কেউ এসে আমাদের ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দেয়।”

    উনি চুন্নিলালকে ডেকে আরও দু গেলাস চা অর্ডার দিলেন, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে শুরু করলেন, "যখন ছোট ছিলাম, প্রতি বছর বাবার ট্রান্সফার হতো অন্য শহরে। প্রত্যেক বার পুরনো জায়গা ছাড়তে আমাদের ভাই-বোনদের খুব মন খারাপ হতো ...কে জানে আবার কখনও ফিরব কি না। স্টেশনে যাবার আগে আমরা কোন স্পেশাল কোণে-কানাচে আমাদের দু-একটা প্রিয় জিনিশ লুকিয়ে রাখতাম— যেমন কুলের ঝোপের মধ্যে একটা খেলনা, বা জলের ট্যাংকের পিছনে একটা সিকি পয়সা, কোনও গাছের শিকড়ের নিচে চুলের ক্লিপ বা কাঁচের গুলি—যাতে ফিরে আসার পর দেখতে পারি সেই জিনিশগুলো আগের মতোই রয়েছে কি না। সেগুলি আমাদের সেখানে থাকার চিহ্ন, আমাদের ফিরবার অপেক্ষায়। কিন্তু কয়েক বছর পরে যদি কখনও ফিরতাম তো মনেই থাকত না কোন জিনিশ কোথায় লুকিয়েছিলাম। জিনিশগুলো চুপ করে আমাদের ফেরার অপেক্ষা করত আর আমরা তাদের পাশ দিয়ে চলে যেতাম...কখনও ভাবতাম না যে আমাদের জীবনের একটা ছোট্ট টুকরো ওই ঝোপের মধ্যে, বা জলের ট্যাংকের পিছনে আমাদের জন্যেই অপেক্ষা করছে..."

    "এখানে বসে কি ওইসব ফেলে আসা জিনিশগুলো মনে পড়ছে?” আমি শুধোলাম।

    "না... না," উনি বললেন, "আমরা তো নিজেরাই ওই জিনিশগুলোর মধ্যে শামিল হয়ে গেছি ... আমাদেরও কেউ এখানে ছেড়ে রেখে ভুলে গেছে যে আমরা তারই অপেক্ষায় বসে।”

    মেঘের মতো কুয়াশা আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছিল— মনে হচ্ছিল উনি তার মধ্যে লুকিয়ে পড়েছেন, শুধু তাঁর কথাগুলো শোনা যাচ্ছিল।

    "তাই বুঝি আপনি এখানে থেকে যান? আর কোথাও যান না?"

    "না। সেজন্য এখানে আসিনি, তবে থেকে যাচ্ছি সেইজন্যই।”

    তাহলে থেকেই যান না, নিচে যাবার তাগিদ কেন? আমার ইচ্ছা হল জিজ্ঞেস করি কিন্তু কিছু একটা আমায় থামিয়ে দিল। তাঁকে অনেক দূর মনে হচ্ছিল। কত বছর জানি নিরঞ্জনবাবুকে, কিন্তু তাঁর ভিতরে কত খালি জায়গা, কেউ তার খবর রাখে না। কেমন হঠাৎ ফিলসফি ছেড়ে তিনি গায়েব হয়ে গেলেন, কত বছর পর এখানে দেখা...যেমন এখন সামনে বসে আছেন, ফলের বাগিচার মালিক, ইউনিভারসিটিতে যাঁকে জানতাম, ইনি তাঁর থেকে অনেক আলাদা। তাই পা বাড়িয়েও পিছু হটতে হল। প্রথম নিরঞ্জন বাবুকে অনেকদিন আগে জানতাম, আর ইনি দ্বিতীয়জন, যিনি সামনে বসে চা খাচ্ছেন আর পাইপ সামলাচ্ছেন।

    চুন্নিলাল একটা লন্ঠন জ্বালিয়ে আমাদের টেবিলে রাখতেই খেয়াল হল কথায় কথায় কীরকম অন্ধকার হয়ে এসেছে। দূরে জঙ্গল থেকে ঝিঁঝিঁর শব্দ আর টিটিরের ডাক শোনা যাচ্ছিল। অশ্বত্থ গাছের চাতালে কেউ একটা প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছে, হাওয়ায় শিখাটা ঝাপটা দিচ্ছিল।

    "আরও চা আনি?”

    "না, আমরা উঠি।” নিরঞ্জন বাবু চায়ের পয়সা চুকিয়ে দিলেন কিন্তু উঠি উঠি করেও উঠলেন না। আরও কিছু বলা বাকি ছিল তখনও।

    "তোমার মনে আছে আমি একবার তোমায় বলেছিলাম?"

    "কীসের কথা?'

    "আমার মনে হয় এবার আমার ফিরতে দেরি হবে ...তুমি যদি চাও তো আমার কটেজে এসে থাকতে পারো ... আমি ননকুর কাছে চাবি রেখে যাব।”

    "অনেক ধন্যবাদ... কিন্তু আমার মনে হয় না তার দরকার হবে।”

    উনি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। "তোমার মর্জি ...কিন্তু দেখো... যে সিদ্ধান্তই নাও, আমাকে জানাতে ভুলো না ..."

    সিদ্ধান্ত? গাছের অন্ধকারে তাঁর মুখে ওই শব্দটা হঠাৎ আমায় কাঁপিয়ে দিল। তখন জানতাম না যে-সিদ্ধান্তই নিই না কেন, অন্ধকার রাস্তা আর ভাগ্যের নক্ষত্রের মধ্যে সেটা আগেই ঠিক হয়ে গেছে।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • | | | | ৫
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments