অধ্যায়--১.২
আজ বিকেলে আমার ছুটি। ওঁর কাছে যেতে হবে না। অন্য দিন হলে ঘরে বসে ওর নোটগুলো অন্য খাতায় টুকে রাখতাম। কিন্তু বাতি চলে যাওয়ায় একটা বিষণ্ণ অন্ধকার ঘরের মধ্যে। বাইরে বারান্দায় এসে দেখি টেবিলের উপর চায়ের ট্রে, আমি ভিতরে ঘুমোচ্ছিলাম ভেবে নিশ্চয় মুরলীধর রেখে গেছে। আমি অবাক হলাম ট্রের নীচে একটা কাগজের টুকরো দেখে। খুলে দেখি অ্যানার পরিষ্কার হাতের লেখা -Please come this evening. A surprise is waiting for you. A.
প্রথমদিন কোর্টে খেলা শেষ হবার পরেই অ্যানা আমার হ্যান্ডশেক করেছিল, অ্যানা সেইরকমই এক জার্মান মহিলা। ব্ল্যাক ফরেস্ট-এ তার ছেলেবেলার গল্প শোনাতো অনেক। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগে ভারতে আসার পর তার গল্পগুলো কেমন যেন ধাঁধার মতো জটিল হয়ে যাচ্ছে। কয়েক বছর ফরিদকোটের রাজপরিবারে গভর্নেসের কাজ করে রাজস্থানের থর মরুভূমিতে কিছুদিন কী করেছে জানা নেই। শেষে হিমালয়ের এই ডেরায় গত বছর তার আবির্ভাব। এখন এখানে একাই থাকে। তার সম্বন্ধে গুজবের কোনো কমতি নেই। শোনা যায়, জার্মান নাগরিক বলে যুদ্ধের সময় তার উপর কড়া নজর রাখা হতো। এটা আমায় মিসেস মেহরা হাসতে হাসতে বলেছিল, "তোমার কি মনে হয় আমাদের অ্যানা এক স্পাই? মেমসাহেব মাতাহারি?"
অ্যানার কাছ থেকে হাতে-লেখা কোনো গোপনীয় বার্তা পেলেই মনে হয় এইজন্যই ইংরেজরা তার উপর সন্দেহ করত। যাই হোক, সেদিন টিকোজীর তলায় তার কাগজের টুকরোটা দেখে আমি একটু স্বস্তি হল। বাইরে বেরোবার একটা ছুতো পাওয়া গেল। কিন্তু ওই 'সারপ্রাইজ' শব্দটা একটু ভাবনায় ফেলল-- এরকম পাহাড়ি জায়গায় ‘সারপ্রাইজ’-এর মানে তো হয় কোনো জংলি বাঘ ক্যান্টনমেন্টের রাস্তায় দেখা গেছে কিংবা আশপাশের জঙ্গলে আগুন লেগেছে।
আমি পোশাক বদলে বেরোবার আগে টর্চটা সঙ্গে নিয়ে নিলাম।
বাইরে মেঘ মেঘ আকাশ। যখন ঘুমোচ্ছিলাম হয়তো তখন কোনো জলভরা মেঘ আমাদের এলাকায় এক পশলা বৃষ্টি ঝরিয়ে অন্য পাহাড়ের দিকে উড়ে গেছে। ভেজা ছাতের ফাঁকে ফাঁকে ঘাসগুলো চকমক করছে। অ্যানার ঘর একটি ছোট পাকদণ্ডীর উপরে। চড়াই বেয়ে ওঠার সময় দু-পাশের ওক গাছগুলোকে মনে হয় যেন সারিবদ্ধ সান্ত্রী, কিন্তু রাত্রে নীচে নামবার সময় তাদেরই সন্ন্যাসীর মতো দেখায়।
পাকদণ্ডীর মাথায় একটা চওড়া চাতালে দুটো লম্বা বাঁশের মাঝে এখনো একটা দাঁড়িপাল্লা টাঙাবার মাচামতন দেখা যায়, হয়তো ইংরেজদের সময়ে এটা একটা টোলবুথ ছিল। নীচে গাঁ থেকে লোকেরা উপরে শহরে যাবার সময় তাদের জিনিসপত্র ওজন করে পয়সা দিয়ে যেত। দাঁড়িপাল্লা আর নেই কিন্তু টাঙাবার বাঁশটা এখনো আছে। আর চৌকিদারের একটা কুটিরও আছে যেখানে আগে কোনো সরকারি অফিসার বসত।
গরমের দুপুরে কখনোসখনো এদিকে বেড়াতে এসে ক্লান্ত হয়ে গেলে আমি এখানে বিশ্রাম করি। কুটিরের ভিতরে বেশ ঠান্ডা। পিছনে পাহাড়ি ঝরনার ঝরঝর আওয়াজ ... চীর গাছে ঘেরা নিচু পাথরের দেয়াল ঘেরা চাতালের নীচে কবরখানা...সেখানে গেলে আমার মিসেস মেহরার কথা মনে পড়ে...তাঁর সমাধিকে পিছনে ফেলে অ্যানার বাড়ির দিকে যাবার জন্য আমার পা আপনা আপনি জোরে চলতে শুরু করে। বৃষ্টির ছাঁট বাঁচিয়ে চড়াই পার হলেই অ্যানার ঘরের সামনে বেড়ার পাশে ক্যান্টনমেন্ট রাস্তা। ফটক খুললেই আমি অ্যানার বাগানের সীমানায় …
আজ কিছুক্ষণ আমি ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। ছাতের চিমনি দিয়ে ধোঁয়া উঠছে। গেটের উপর একটা সবুজ পতাকাটা উড়ছে। তার মানে অ্যানা বাড়িতে আছে। প্রথমবার অ্যানার বাড়ি এসে একটু আশ্চর্য হয়েছিলাম, ভেবেছিলাম এই পতাকা হয়তো অশুভ দৃষ্টি তাড়াবার জন্য কোন জার্মান প্রথা, এদেশে যেমন মঙ্গলকামনায় মন্দিরের উপরে পতাকা ওড়ানোর রেওয়াজ আছে। পরে জানলাম সেরকম কিছু নয়, গেট থেকে বাড়ির দরজা পর্যন্ত বেশ এবড়োখেবড়ো রাস্তা পেরোবার কষ্ট করার পরেও যাতে কোনো অতিথি নিরাশ হয়ে গৃহকর্ত্রীর অনুপস্থিতির কারণে ফিরে না যান, তারই সঙ্কেত ওই সবুজ পতাকা। অশুভ আত্মা তাড়ানোর জন্য নয়, বন্ধু-মেহমানকে অভ্যর্থনার জন্য এই ব্যবস্থা।
পাপোশে জুতো ঘষতে ঘষতে সন্দেহ হল--আমিও কি ওইরকম এক মেহমান? ওর সঙ্গে একলা দেখা করতে আমার একটু ভয় ভয় করে, যেন আমি এমন জলে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছি যার গভীরতা জানা নেই-- জল কম থাকলে তো হাড়গোড় ভাঙবে, আর গভীর হলে কোথায় যে তলিয়ে যাব… ।
এইজন্যই কি সে ব্ল্যাক ফরেস্ট থেকে এখানে এসেছে? তাকে জার্মান নয়, এক বনদেবীর মতো মনে হয়। সাদা চুল, নীল নির্মল চোখ, চোখের নীচে বয়সের চিহ্ন, কিন্তু তাতে তার বয়স বোঝা যায় না। নিশ্চিত না হলেও আমার অনুমান সে বেশ কয়েক বছর কোনো রাজপরিবারে গভর্নেস ছিল। সে নিজের মুখে না বললে সঠিক আর জানব কী করে, সেটা তো তখনোই জানতে পারি যদি -- যেমন মেহরাসাহেব নিজের জীবনকাহিনী বলে যান আমার কাছে। অ্যানা কখনো নিজের সম্বন্ধে কিছু বলেই না, যদি খেয়ালের বশে কখনো কিছু বলেও তো সেগুলো যেন জলে ভাসা ছোটো ছোট কাঠের টুকরো, দু-একটা আমি ধরে ফেললেও বাকিগুলো অর্থহীন স্রোতে কোন্ অজানার দিকে ভেসে যায়… ।
সবুজ ঝাণ্ডাটা উড়ছে, মানে সে বাড়িতে, আর চিমনির ধোঁয়ার অর্থ ফায়ার প্লেসে আগুনও জ্বালিয়েছে। দরজায় টোকা দিতে ভিতর থেকে গলার জোর আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি একটু চমকে গেছিলাম কিন্তু পরক্ষণেই খোলা দরজা দিয়ে পুস্কি ল্যাজ দুলিয়ে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল! সামনেই নিরঞ্জনবাবু, সোফায় বসে, তাঁর হাসিটি চোখ থেকে নেমে দাড়ির ভিতর লুকোচুরি খেলছে।
আহ্-- এই-ই তাহলে অ্যানার 'সারপ্রাইজ'! না, এটা আমি কল্পনাও করিনি।
"কবে এলেন?" আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
"এই, গত সপ্তাহে…"
নিরঞ্জনবাবু কথা শেষ করার আগেই অ্যানা ফুটকি কাটল, "এঁকে জিজ্ঞেস করুন, এতদিন কোথায় ছিলেন?"
নিরঞ্জনবাবুকে যতই শান্ত, নির্লিপ্ত মনে হোক না কেন, তাঁকে দেখলেই আমার মনটা কেমন যেন অস্থির হয়ে ওঠে। অ্যানার কটেজ থেকে দু'কিলোমিটার উপরে নিরঞ্জনবাবুর আপেলের বাগান। মে মাসের শুরুতেই তিনি এসে যান, ফিরতে ফিরতে নভেম্বর। এবার একটু দেরিতে এসেছেন। তবে তাঁর মালী তাঁকে বাগানের খবরাখবর দেয়। আমি প্রথমবার তাঁকে যখন দেখেছিলাম, তখন টুপি মাথায় কোনো বিদেশী টুরিস্টের মতো দেখাচ্ছিল--আধা হিপি, আধা অ্যারিসটোক্র্যাট। ক্রমশ তাঁর অন্যান্য অনেক গুণের সঙ্গে পরিচয় হয় আমার।
পুস্কি এখনো আমার পায়ে লুটোচ্ছে ।
"অ্যানার কাছে শুনলাম তুমি এখানে।" নিরঞ্জনবাবুর গলায় হালকা মজার সুর... মুখ খুশিতে উজ্জ্বল। তাঁর কি মনে আছে গত বছরেও তিনি আমাকে একই প্রশ্ন করেছিলেন? ঠিক এইভাবেই?
অ্যানার পাহাড়ি কাজের মেয়ে যমুনা ট্রে-তে চা-টা নিয়ে এলো। কেকের সুগন্ধে পুস্কির লাল টুকটুকে জিভটা বেরিয়ে পড়েছে। অ্যানার পরনে উলের স্কার্ট, সে দিকে ঠাট্টার ভঙ্গিতে দেখছে। আমি জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
"আপনি তো এদিকের ধারই মাড়ান না, তাই ভাবলাম এঁকে দেখতে নিশ্চয়ই আসবেন," অ্যানা নিরঞ্জনবাবুর দিকে রাগত চোখে তাকিয়ে বললো, "মেহরাসাহেব আজকাল নিজের বায়োগ্রাফি লেখাচ্ছেন এঁকে দিয়ে... কি, আপনি তাতে নেই?"
নিরঞ্জনবাবু দাড়ির আড়ালে পাইপটা জ্বালাতে জ্বালাতে একটু হাসলেন, "আমি? আমি কেন থাকব তাতে?"
"সবাই তো আছে... কেবল আপনিই কেন বাদ যাবেন?"
"সেটা তো পড়ার পরেই জানা যাবে। উনি কি কোথাও থেকে পাবলিশ করাচ্ছেন লেখাটা?"
দুজনেই আমার দিকে তাকিয়ে, যেন মেহরাসাহেবের বিগত জীবনের আর্কাইভের চাবিকাঠি আমার হাতে।
আমি কী আর বলব, একটু হাসলাম শুধু। এভাবে এরা আমার চাকরি খেতে পারে না। তবে ঝামেলা করতে চায় ঠিকই।
ধু-ধু করে উনুনে কাঠ জ্বলছে। দেয়ালে আগুনের শিখার সাপের মতো ছায়াটা দুলছে। নিরঞ্জনবাবু এতক্ষণ চুপ করে বসেছিলেন, প্রশ্নগুলো এড়াতেই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, "আমার বাড়ি কবে আসছ? তোমরা তো আমার গেস্ট হাউসটা দেখইনি।"
"সেটা কি শেষ হয়ে গেছে?" অ্যানা তার দিকে তাকাল।
"ব্যস, ধুলোবালি পরিষ্কার করাটাই যা বাকি। গতবার যখন এসেছিলে, তখন তো শুধু একটা উইং তৈরি ছিল।"
স্বাভাবিকভাবেই কথাবার্তা এক রাস্তা থেকে আরেক রাস্তায় চলে গেল। আমাদের নির্জন বীহড়ের মধ্যে নিরঞ্জনবাবুর আকস্মিক আবির্ভাব যেন পরিপার্শ্বকে উষ্ণ শ্যামলিমায় ভরিয়ে দেয়। আমাদের সবার টেম্পারেচার এক ডিগ্রি উপরে উঠে যায়... অ্যানা তো একটু বেশিই উত্তেজিত হয়ে পড়ে, পুস্কিও টের পেয়ে অযথা ভোউ ভোউ শুরু করে দেয়। এর মধ্যে নিরঞ্জনবাবুই শুধু নির্বিকার। এসবের কোন প্রভাব তাঁর উপর পড়ে না। আমাদের মনে হয় তিনি নীচ থেকে কিছু খবর এনেছেন, কিন্তু মুখে বলেন না কিছুই। তাঁর আসাটাই আমাদের কাছে একটা ঘটনা। এখানে অন্য পরিবেশে তাঁকে দেখে আমার খেয়াল থাকে না যে একই কলেজে আমিও পড়েছি এককালে।
তিনি পাইপটা মুখ থেকে বের করে আগুনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, "মেহরাসাহেব কেমন আছেন?"
"তুমি… দেখনি তাঁকে?” অ্যানা উত্তর দিল, “দেখা হলে চিনতেই পারবে না। প্রতিদিন সন্ধ্যেয় এই দুজন কে-জানে কোন অচেনা জায়গার খোঁজে বেরিয়ে পড়ে... কী? হাসছ কেন? আমি কিছু ভুল বলছি?" অ্যানা রাগতমুখে আমার দিকে তাকাল।
"আমার একটা কথা মনে পড়ল।" আমি বললাম।
"কী কথা?"
"তিনি বলতেন, তাঁর মেয়ের জন্ম হয়েছিল যখন তিনি পৃথিবীর একদম শেষ প্রান্তে ছিলেন। রীতিমতো সাঁতার কেটে পোস্টম্যান ওঁর টেলিগ্রাম নিয়ে এসেছিল।"
"তিনি কি তোমায় দিয়ে তার জীবনের সমস্ত কাহিনী লিখিয়ে নেন?" অ্যানার নীল চোখে বিদ্যুৎ।
"কতটা ঘটেছিল আর তার কত অংশ আমাকে দিয়ে লিখিয়েছেন তা আমি কী করে বলব?"
"হয়তো লেখাবার সময় তিনি অন্য এক জীবনে ছিলেন?" নিরঞ্জনবাবু কিছু ভেবে বললেন।
"অন্য জীবন মানে?" অ্যানা ঘাড় বেঁকিয়ে তাকাল।
"ওই… যে জীবনটা দৃশ্যমান নয় কিন্তু আমরা ভিতরে ভিতরে বয়ে নিয়ে চলি।"
কিছুক্ষণ সবাই চুপ। তারপর অ্যানা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, "আমি ওঁর কথা বুঝি... এইবয়সে লোকের মাথায় একটু খেয়াল চাপে। কিন্তু তুমি... তোমায় আমি বুঝতে পারি না। তিনি কীরকমভাবে বেঁচে আছেন জানি না, কিন্তু তুমি? তুমি কেন তোমার জীবনটা বরবাদ করছ?" আমার কাঁধে একটা চাপড় মেরে সে উঠে দাঁড়াল।
প্লেটের পেস্ট্রি শেষ হয়ে গেছে, আগুনে কাঠগুলোও প্রায় শেষ। অ্যানা এই সময়টার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। এটা কি ওর জার্মান অভ্যেস, যে অন্ধকার না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে?
"আপনাকে কী দেব?" ও পাহারাদারের মতো দাঁড়িয়ে, হঠাৎ যেন ওর কর্তব্যটা মনে পড়ে গেল, "আপনার আগমন আজ তো সেলিব্রেট করতে হবে।"
অ্যানা ভিতর থেকে একটা কালো রঙের চৌকোমতো বোতল নিয়ে এলো। আমি এটা আগে কখনো দেখিনি। এমনিতে আমি তার ঘরে নানারকম পানীয় চেখেছি। এই বোতলটা একটু অন্য রকম। আকারে একটা বইয়ের মতো, স্পাইনে নাম লেখাঃ 'ওয়াটার অফ লাইফ'! সঞ্জীবনী জল!
"সারপ্রাইজ!" সে হাসতে হাসতে বলে, "তুমি কি ভেবেছিলে নিরঞ্জনবাবুই সারপ্রাইজ? উনি তো কতবার যাতায়াত করেন। কিন্তু এটা তুমি আগে কখনো দেখোনি।"
তিনটে ছোট ছোট কাটগ্লাস ভর্তি করে সে নিজেরটা তুলে ধরল, "নিরঞ্জনবাবু, এই টোস্ট আপনার জন্য।"
"না, উপস্থিত সবার জন্যই।"
"আর যারা উপস্থিত নেই, তাদেরকেও।" অ্যানা বলে উঠল।
সবাই গ্লাস ওঠাল। আমি অ্যানার দিকে তাকালাম, ওর উদ্দেশ্যটা কী? আমি জিজ্ঞেস না করলেও কিন্তু ও বুঝতে পেরেছে। এক লম্বা চুমুক দিয়ে সে আমার দিকে তাকাল, তার মুখে ছায়ার খেলা, "উনি কি কখনো দিভার কথা বলেন?"
"মিসেস মেহরা? কখনোসখনো, কিন্তু..." আমি থেমে গেলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম না কেন সে এসব জানতে চাইছে।
"কিন্তু কী?" নিরঞ্জনবাবুর চোখও আমার উপর।
"কখনো কখনো তাঁর মনে থাকে না যে সে আর নেই।" আমি বলে ফেললাম।
"মানে?" অন্ধকারে ওর গলা অবাক শোনাল, "তিনি কি এত তাড়াতাড়ি তাকে ভুলে গেছেন?"
"না, না," আমি ভুল শুধরে নিলাম, "তাঁর মনে থাকে না যে দিভা আর এই পৃথিবীতে নেই।"
কিছুক্ষণ আবার চুপচাপ। নিরঞ্জনবাবু একটা দেশলাই ধরালেন, কিন্তু পাইপ না জ্বালিয়ে নেভানো কাঠিটা ফায়ার প্লেসে ফেলে দিলেন। "তিনি কি এখনো মনে করেন সে জীবিত?"
"না, তা নয়। যখন আমাকে দিয়ে নোট লেখান... আমার মনে হয় দিভা যেন পাশের ঘরে বসে আছে আর মিস্টার মেহরা তাঁর জীবনী আমাকে নয়, তাকেই শোনাচ্ছে।"
বাইরে ঝিঁঝিঁ ডেকেই চলেছে।
"সে যখনই এখানে আসত, ওই চেয়ারটায় বসত, যেখানে নিরঞ্জনবাবু বসে আছেন।"
অ্যানা ডানহিলের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বার করল। দ্বিতীয় গ্লাস শুরু করার আগে সে সর্বদাই একটা সিগারেট খায়। নিরঞ্জনবাবু একটু ঝুঁকে তার সিগারেটটা ধরিয়ে দিলেন। অ্যানা আরাম করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল।
"এরকম সুন্দরী মহিলা আমি খুব কমই দেখেছি। যখন প্রথমবার মেহরাসাহেবের সঙ্গে দেখেছিলাম তাকে আমি তাঁর মেয়ে ভেবেছিলাম। পরে জানলাম যে ... দ্বিতীয় স্ত্রী। আপনি তো জানেনই।"
"কোনো কোনো সম্পর্ক উপর থেকে দেখা যায় না।" নিরঞ্জনবাবু বললেন, "আমি তো কল্পনাই করিনি যে তিয়া ওদের কেউ হয়।"
"আপনি কী ভেবেছিলেন?"
"ভেবেছিলাম কোনো সামার টুরিস্ট, গরমের ছুটি কাটাতে এসেছে। এখন আপনি যে বাড়িতে থাকেন ওই বাড়িতেই সে থাকত।”
আমার মনে হল জবরদখল করেই আমরা সবাই আমাদের যে-যার জায়গাটুকুতে আছি।
অ্যানা আমাদের গেলাস আবার ভর্তি করতে যাচ্ছিল কিন্তু নিরঞ্জনবাবু বাধা দিলেন, "আর না। আমায় এবার যেতে হবে।"
"আরে! আপনার জন্যই তো সেলিব্রেট করছি। এত তাড়া কীসের?"
ফায়ার প্লেসের আগুন নিভে গেলেও অ্যানার বোতলের আগুনটা তখন আমাদের শরীরে জ্বলতে শুরু করেছে।
"উনি কি নিজের রোগ সম্বন্ধে জানতেন?" আমি জিজ্ঞেস করলাম।
"কেন জানবে না?" অ্যানার ফরসা মুখে স্মৃতির ছায়া, "তার প্রথম অপারেশনটার পরে একবার একলা আমার কটেজে এসেছিল...। হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করল--অ্যানা, তুমি তো জানো আমি ক্রিশ্চান। আমি হেসে বললাম—তাতে কী এসে যায়? -...যায়, সে বলল, আমার ভয় হয়... -- ক্রিশ্চান হবার জন্য? আমি জিজ্ঞেস করলাম...---না, সে বলল, যদি আমার শরীরে প্রাণ থাকতে থাকতে আমায় মাটির নীচে কবর দেওয়া হয়? আমাকে পুঁতে দেবার আগে একটু আগুনের ছোঁয়া পেতে চাই, হয়তো নড়ে উঠব। ...একবার কবরের ভিতর গেলে কেউ তো আর আমার আওয়াজ শুনতে পাবে না...কীরকম পাগল বলুন তো?"
"আপনার কী মনে হয়?"
"আমি হলে বলতাম, মাটি থেকে আবার আওয়াজ বেরোয় নাকি? বেরোলেও শুনবে কে? কার এত সময়?... আমি কতবার কবরখানার পাশ দিয়ে গেছি, আমার তো মনেই থাকে না যে সে ওইখানে একটি গাছের তলায় শুয়ে...আমি দিভাকে বলতাম সে ভাগ্যবতী... অন্তত নিজের মাটির নীচে সে তার জায়গা পেয়েছে..."
অ্যানা সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে একবার নিরঞ্জনবাবুর গেলাসের দিকে তাকাল; সেটা তখনো ভর্তি। অ্যানা বোতলটা টেবিলে রেখে দিল।
"আপনার কি বাড়ি ফিরতে মন চায় না?" আমি অ্যানাকে শুধোলাম।
"মন?" সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, "মনের কথা তো আমি অনেকদিন শোনা বন্ধ করে দিয়েছি। মনের কথা শুনলে কি আজ আমি তোমাদের এখানে বসে থাকি? এই হতচ্ছাড়া জঙ্গলে? এতে কি মন সায় দেয়?"
"আজ যখন আপনার বাড়ি আসছিলাম..." নিরঞ্জনবাবু শুরু করলেন, "তো হঠাৎ ভীষণ ভালো লাগল ভেবে যে যতই দেরি করে এই শহরে আসি না কেন...আপনার বাড়ি যে-কোন সময় আসতে পারি ...আপনি সর্বদা এখানে থাকবেন... যখন আমি জয়পুর যাই তো এরকম মনে হয় না... যদিও আমার পরিবার সেখানে...বউ-বাচ্চা, সব।"
"এ আমার জন্য নয়," অ্যানা কিছু ভেবে বলল, "এটা সারা জগতের ব্যাপার। আমি যখন লম্বা সফরের পর বাড়ি ফিরে দরজার সামনে দাঁড়াই আমার মনে হয় বাড়িতে কেউ আছে...যার কাছে আমি যেতে পারি...যদিও ভিতরে সারা ঘর তো খালিই থাকে...কখনো কখনো ঘরগুলোই লোকেদের জায়গা নিয়ে নেয়, তাই না?"
আমার গেলাসে ব্র্যান্ডি ঢালতে ঢালতে সে আমার দিকে তাকিয়ে থেমে গেল। "তুমি জানতে চেয়েছিলে, তাই বলছি। হ্যাঁ আমি গিয়েছিলাম, কোলোনে, ওখানে আমার মা-বাবা...তারা তখনো বেঁচে ছিল... কিন্তু আমাদের বাড়িটার চিহ্নমাত্র ছিল না... এলাকার সব বাড়িঘর যুদ্ধে ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল। তখন আমি বুঝতে পারি যে যদি মনের লোক কেউ না থাকলে যেখানে আমরা থাকতে চাই, সেখানে সবাই, এমনকি মা-বাবাও অপরিচিত হয়ে যায়-- তাদের পরিচয় ওই ইটের টুকরোর তলায় হারিয়ে যায়...।"
"কিন্তু তা বলে, এতদূরে…? একেবারে হিন্দুস্তানে?"
"তোমাদের কাছে হিন্দুস্তান, আমার কাছে এই পাহাড়ি শহরই সবকিছু। এ-ই আমার বাড়ি। তোমার হিন্দুস্তান আমার কাছে জার্মানির মতই দূর।"
আমি তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, সে চুপচাপ সিগারেটে টান দিয়ে যাচ্ছে। পায়ের কাছে পুস্কি, ঘুমোচ্ছে। অ্যানার চোখ বাইরের দিকে। কে এই মানুষটা? এর সম্বন্ধে কতটুকু জানি? এ কেমন করে স্বদেশের সব ঝামেলা এড়িয়ে এখানে এসে নিজের মাটিটুকু দখল করে নিল, সেই মাটি, যার নীচে দিভা শুয়ে?
সে মুখ তুলতে দেখলাম তার দুচোখে ঝিকিমিকি, ঠোঁটে একচিলতে হাসি।
"যে বছর আমি এখানে আসি, তোমরা কেউই এখানে ছিলে না। আমি একবার বাইরে বেরুচ্ছিলাম তো মেহরাসাহেবের সঙ্গে দেখা হল... তিনি হাঁটছিলেন, সঙ্গে ঘোড়ার পিঠে ডক্টর সিং। আমায় দেখে ঘোড়া থেকে নেমে আমায় বললেন, 'আপনি উঠুন, আমরা পায়ে হেঁটে যাব।...' --'কিন্তু আমি তো আপনাদের চিনি না,' আমি বললাম। --'তাতে কী হয়েছে, ঘোড়া তো আপনাকে চেনে, এর বাপ-দাদাও জার্মানি থেকেই এসেছে, দেখুন, কেমন তাকাচ্ছে আপনার দিকে?' বললে হয়তো বিশ্বাস করবে না কিন্তু আমি সত্যিই ওদের ঘোড়ায় চড়ে সেদিন ওদের সঙ্গে ক্লাবে গেছিলাম। আমি জানতাম না যে এরকম ছোট্ট শহরেও একটা ইংলিশ ক্লাব থাকতে পারে। পরে জেনেছিলাম যে ওই সময় অনেকেই আমাকে জার্মান স্পাই মনে করত... ক্লাবের লাইব্রেরি থেকেও আমাকে বেছে বেছে ডিটেকটিভ নভেলগুলো পড়তে দিত।"
নিরঞ্জনবাবু হেসে ফেললেন, "তাই তো বলি, আপনার চোখে ধুলো দিতে পারার ক্ষমতা এখানে কারই বা আছে?"
অ্যানা কিন্তু হাসছিল না, "আচ্ছা নিরঞ্জনবাবু, আপনি কেন এখানে এসেছেন? ইউনিভারসিটির এত বড়ো চাকরি ছেড়ে সত্যি শুধু আপেলের চাষ করতে?"
"তাই ভেবে নিন।"
"কিন্তু কারণটা কী?" অ্যানা নাছোড়বান্দা।
"সব কিছুরই কি কারণ থাকা চাই?"
"আমি জানি!" সে হাসছিল, "কিন্তু বলব না।"
এইরকম সময়ে তাকে সত্যি সত্যি এক বয়স্কা জাদুকরী বলে মনে হয়...কোন প্রাচীন জার্মান বা বন্য উপজাতির সম্রাজ্ঞী, যার অঙ্গুলিহেলনে সারা রাজ্যের জীবজন্তু ও প্রকৃতি দুলতে থাকে...
আমি অবাক হয়ে তাকে দেখছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, "ঠিক বলিনি? আপনার সব কিছু জানেন!"
নিরঞ্জনবাবু উঠে দাঁড়ালেন, "দেরি হয়ে গেছে, আমি চলি।"
"আরে বসুন না ..." অ্যানা ব্যস্ত হয়ে উঠল, "এই তো সবে সন্ধ্যে হল...নাইট ইজ স্টিল ইয়ং, তাই না?" বলে আমার দিকে সমর্থনের জন্যে তাকাল।
"আপনি কবে আসছেন?" নিরঞ্জনবাবু টেবিল থেকে পাইপ আর লাইটার তুলে নিলেন।
"অত্তো উঁচুতে... বাব্বা!" অ্যানা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, "আমি আর চড়াই উঠতে পারি না। ডক্টর সিংকেও ডেকে নেন তো তাঁর ঘোড়ায় চড়ে আসতে পারি।"
"রাজি!" আমার দিকে ফিরে নিরঞ্জনবাবু প্রশ্ন করলেন, "তুমি কি আরও কিছুক্ষণ বসবে?"
"না। আমিও আসি।" আমার কোন তাড়া ছিল না কিন্তু নিরঞ্জনবাবু যেরকম তড়বড় করে উঠে পড়লেন, এর পর আমার বসে থাকাটা ভালো দেখায় না। আমি অ্যানার কাছে বিদায় নিয়ে বাইরে এলাম।
নিরঞ্জনবাবুর রাস্তা উপরের দিকে চলে গেছে, আমারটা নীচে। কিন্তু কিছুক্ষণ আমরা সোজা রাস্তায় একসঙ্গে চললাম। মাথার উপরে তারার জাল বিছানো, আর চারদিকের আবছা আলোয় ঝোপঝাড়, গাছপালা, বাড়ি, সবকিছু ভূতুড়ে দেখাচ্ছে। নিরঞ্জনবাবুর লম্বা ছায়াটা দেখে আমি ভাবছিলাম যে নিজে অসম্পূর্ণ, তারই ছায়া সম্পূর্ণ, সুডৌল মনে হয়, কিন্তু নিরঞ্জনবাবু? তাঁর তো কোনো ভাঙাচোরা কিছু নেই। বছরে কয়েক মাস এখানে কাটান, তারপর নীচের পৃথিবীতে তাঁর স্ত্রীর কাছে ফিরে যান। তাঁর বড়ো মেয়ে দিল্লীতে কোনো খবরের কাগজের অফিসে চাকরি করে। ছোট ছেলে রুড়কিতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। একটা ভর-ভরন্ত পরিবার, ঠিক তাঁর আপেলের বাগিচার মতই ... তাঁর অনুপস্থিতি সত্ত্বেও ফলে-ফুলে সমৃদ্ধ।
এই উপলব্ধিটাই কি তাঁকে কষ্ট দিচ্ছিল?
"তোমার বয়স কত?" নিরঞ্জনবাবু হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, যেন আমার মনের কথাটা তাঁকেও স্পর্শ করেছে।
"কেন? হঠাৎ?"
"এমনি... না চাইলে বোলো না।"
"সাঁইত্রিশ।"
"এমন কিছু বেশি নয়।" বলে আবার চলতে শুরু করলেন।
রাস্তার শেষে দেওদার গাছের মাথায় জোনাকির ঝিকিমিকি... ঝিঁঝিঁর দল শান্ত... হয়তো ক্লান্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে... তাই আমাদের পায়ের শব্দটা পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে।
"আপনি হঠাৎ আমার বয়স জানতে চাইলেন কেন?"
"কোন বিশেষ কারণ নেই, এমনি মনে হল।" হাঁটার সময় কথা বলা মুশকিল বলে তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন। রাস্তা এত সরু যে পাশাপাশি চলা যায় না। তিনি আগে দাঁড়িয়ে কথা বলেন আর আমি পিছনে দাঁড়িয়ে শুনি। এতে মনে হয় যেন উনি নিজের মনে বলছেন আর আমি আড়ি পেতে শুনছি।
"এমনি কী রকম?"
"এখানে সবাই তাদের জীবনের শেষ দিকে আসে। তুমি দেখছি শুরুতেই এসেছ।"
"আমার শুরু তো অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে।" আমি আনমনে বললাম।
"কী বললে?" তিনি থেমে গেলেন।
"বললাম যে, সাঁইত্রিশ বছর আবার কী রকম শুরু?"
"অনেকের শুরু এই সময়েই হয় ...জিসাস ক্রাইস্ট, গৌতম বুদ্ধ, উইটগেনস্টাইন..."
তিনি আবার হাঁটতে শুরু করলেন। আমিও পিছন পিছন।
"তোমার কাজ কেমন চলছে?"
"আপনি তো জানেনই..."
"তোমায় দিয়ে কি রোজ লেখান?"
"না, লেখান না... যখন ইচ্ছা হয়...আমি পরে নোট করে নিই।"
"তুমি কি এই কাজটা ওনার ইচ্ছায় করছ না নিজের শখে?"
"প্রথমে তো কিছুই ছিল না। যখন আমি এলাম, মিসেস মেহরা বলেছিলেন যে মেহরাসাহেব প্রতিদিন আমার সঙ্গে এত গল্প করেন, সেসব আমি লিখে রাখি না কেন? তাতে তাঁরও সময়টা কাটবে আর আমারও ভালো লাগবে।"
"তোমার ভালো লাগে?"
"ওই… একটা রুটিন... তার মৃত্যুর পর ছেড়ে যাওয়াটা ঠিক মনে হয়নি।"
তার মৃত্যুর পরে? আমার তো মনে হয় সে এখানেই আশপাশে কোথাও ঘুরছে, এখুনি এসে বলবে কই, আজ কতটা কাজ হল? আমরা সবাই ঘুরতে ঘুরতে তারই কাছে চলে আসি, অ্যানার ঘরের খালি চেয়ারটার সামনে।
"নিরঞ্জনবাবু, আপনি কি ওটা পড়তে চান?"
তিনি হঠাৎ থেমে গেলেন। "কী বললে, কী পড়ব?"
"ওইসব। যা মেহরাসাহেব লিখিয়েছেন।"
"না, না! এ তুমি কী বলছ? আমার ওসব পড়ার কোন অধিকার নেই।"
"এমন কিছু ব্যক্তিগত কথা নেই ...কখনো কখনো ওঁর কথা শুনে মনে হয় তিনি নিজের নয়, অন্য কারুর জীবনকাহিনী শোনাচ্ছেন।"
"অন্য কারুর...? মানে?"
"আমি ঘরে এসে নোটগুলো যখন পড়ি তো মনে হয় যেন একটা নভেল পড়ছি।"
"তুমি বলছ সব কাল্পনিক?"
"কে জানে? কাল্পনিক হয়ও যদি তো কী এসে যায়! তাঁরই তো মনের কথা।"
"গল্প...ফেয়ারি টেল ...কিপলিং জাঙ্গল স্টোরিজ লিখেছিল, তুমি এই পাহাড়ের স্টোরিজ লিখছ। আমার এক বন্ধু আছে। লেখক, অনেক উপন্যাস লিখেছে, তাঁকে আমি একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি কী করে একটার পর একটা উপন্যাস লিখে যাও? সে বলল, নিজের জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে লিখি, তাতে কোনো ক্ষতি আছে?"
তিনি দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। আমরা দেওদারের তলা থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। এখান থেকে ওঁর চড়াই শুরু আর আমার উতরাই। বাজারের দোকানগুলো বন্ধ। নিচে কোন হোটেলের কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে।
"আপনি চান তো আমি আপনার সঙ্গে কিছুদূর যেতে পারি। আমারও একটু বেড়ানো হয়ে যাবে।"
তিনি একটু ইতস্তত করে বললেন, "আমি এখনি বাড়ি যাচ্ছি না।"
আমি বললাম, "ও। ডাক্তার সাহেবের ওখানে বুঝি?"
তিনি ডক্টর সিং-এর বাড়ি যখন খুশি যেতেন।
"না, তার বাড়ি না, ক্লাবে ডেকেছে। চলো না, তুমিও চলো। ও তোমায় দেখে খুশি হবে। আমি যেমন তোমার সারপ্রাইজ ছিলাম, তুমিও আমার সারপ্রাইজ হবে।"
অন্য কোনো দিন হলে আমি যেতাম, কিন্তু আজ এখানে তাঁর প্রথম দিন আর ডাক্তার তাঁর পুরনো বন্ধু। আমি তাদের মধ্যে ঢুকতে চাইছিলাম না। আমি বিদায় নিয়ে পাকদণ্ডী ধরে নিচে নামতে শুরু করলাম।
অধ্যায়--১.৩
এক-একটা মোড় পেরিয়ে লোকটা যতই নীচে নামছে গাছের ফাঁক দিয়ে তার পাগড়ি-পরা চেহারাটা ক্রমশ বড়ো হচ্ছে। গাছের তলা থেকে বেরিয়ে আসতে তার বেল্টে তামার বাকলটা রোদ্দুরে চকমক করে উঠল। আগের শতকে ডাকাতেরা হয়তো ঘণ্টি বাজিয়ে এইভাবে আসত, এখন ঘণ্টির বদলে একটা হুইসিল ওর হলদে দাঁত আর মোটা গোঁফের আড়াল থেকে দীর্ঘশ্বাসের মতো বেরিয়ে আছে।
সে যে কতক্ষণ ফটকের বাইরে দাঁড়িয়েছিল আমি খেয়াল করিনি।
"আপনার চিঠি।" হীরালাল এমনভাবে বলল যেন চিঠি নয়, ও কোনো শমন নিয়ে এসেছে। এই প্রথম সে এখানে এলো। সাধারণত আমার বাড়ির নীচে দিয়ে ও সোজা মেহরাসাহেবের বাড়ি চলে যায়।
"ভিতরে এসো হীরালাল, দরজা খোলা আছে।"
সে ফটকের বাইরে ডাকের থলেটা রেখে একটা ব্রাউন কাগজে মোড়া প্যাকেট নিয়ে বারান্দায় উঠে এলো। আমি সেখানেই বসেছিলাম। বাইরের পৃথিবী থেকে আমার নামে যে কোনো চিঠি আসতে পারে দেখে আমার মতো সে-ও অবাক।
"আমি এই স্ট্যাম্পটা রাখতে পারি?" সে আমার দিকে তাকাল। মোটা গোঁফের নীচে একটু হাসি।
কলকাতার এক পাবলিশার পাঠিয়েছেন প্যাকেটটা, তার উপর অনেকগুলো স্ট্যাম্প এখানে-সেখানে সাঁটা।
"তুমি স্ট্যাম্প জমাও বুঝি?" আমি টিকিটগুলো না ছিঁড়ে পুরো মোড়কটাই ওকে দিয়ে দিলাম।
"জী। মেহরা সাব একটা অ্যালবাম দিয়েছিলেন, তাতেই আটকে রাখি।"
হীরালালের চোখ আমার বইটার উপর। উজ্জ্বল রোদে মলাটের উপর কোন আদিম দেবতার ছবি, তার রক্তিম চোখদুটো দূর দিগন্তে প্রসারিত।
"আমি একটু দেখতে পারি?"
আমি বইটা ওর হাতে দিলাম। ও বারান্দার সিঁড়িতে বসে বইয়ের ছবিগুলো দেখতে লাগল। কলকাতার এক সেকেন্ড-হ্যান্ড বইয়ের দোকানদার আমাকে প্রায়ই এরকম বই পাঠায়। আমার পছন্দ কীরকম সে জানে, আমার যে বইগুলো ভালো লাগে রেখে দিই আর বাকিগুলো ফেরত যায়। আমার কাছে সে জেনে নেয় বইগুলো কত পুরনো বা দুর্লভ, সেই অনুসারে সে চড়া দামে বিক্রি করে।
"আপনি কী কাজ করেন, বাবুজী?" হীরালাল পোস্টম্যান মলাটের হিটাইট দেবতার থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে তাকাল, যেন ওই তিন হাজার বছরের দেবতা তাকে আমার কথা মনে করিয়ে দিল।
"আমি সাহেবের কাজ করি।"
"আমাদের সাহেবের?" সে মেহরাসাহেবের কটেজের দিকে ইঙ্গিত করল। বাড়িটা দুপুরের শান্ত রোদে যেন ঘুমিয়ে আছে। "কেন? উনি আপনাকে ডেকেছিলেন বুঝি?"
"না হীরালাল, উনি ডাকেন নি ... কিন্তু আমি এখন এখানে, যতদিন উনি চান এখানেই থাকব।"
"তাই। আমিও ভাবছিলাম, এই সুনসান জায়গায় কে এসে থাকতে পারে?"
সে বইটা আমায় ফেরত দিয়ে বাক্সের বেল্টটা টাইট করল, "বাবুজি, আপনার বাল-বচ্চা?"
"এখনো পর্যন্ত কেউ নেই, হীরালাল।"
সে সর্বজ্ঞের মতো মাথা দোলাল, যেন তাও ঠিক। হুইসিল বাজাতে গিয়ে মুখ খুলতে বিড়ির ছোপ-ধরা দাঁতগুলো দেখা গেল। হঠাৎ ওর মনে পড়ল, "ওহ্, আপনার একটা চিঠিও আছে।" আমার দিকে চিঠিটা বাড়িয়ে ধরল, "প্যাকেটের সঙ্গেই এসেছে।"
আমি ঠিকানাটা দেখলাম, ঠিকই লেখা, নামও ঠিক, শুধু নীল অক্ষরে লেখাটা অচেনা মনে হল।
"হীরালাল, চা খাবে?"
ও একটু হতভম্ব হয়ে গেল। "আপনি বানাবেন?"
"হ্যাঁ, চট করে হয়ে যাবে।"
"না, আজ না। আবার আরেক দিন আসব।"
চিঠিটা মেহরাসাহেবের মেয়ে তিয়ার। আমার কাছ থেকে ওর বাবার খবরাখবর জানতে চায়। কোন চিন্তার কিছু নেইতো ? যা-ই হোক, আমি যেন তাকে লিখতে না ভুলি। আর প্রতি মাসে যদি তাঁর স্বাস্থ্য সম্বন্ধে একটা ছোট রিপোর্ট পাঠাই তো খুব ভালো হয়। সে নিজে ক্রিসমাসের ছুটিতে আসার চেষ্টা করবে, যদি হাসপাতালে কোন এমারজেন্সি না হয়...
সতেরোটা লাইন। আমি গুনলাম। নীচে তার নাম। সরকারি হাসপাতালের প্যাডে তাড়াহুড়ো করে লেখা। আমার একটু আশ্চর্য লাগল, সে জানে আমি এখানে তার বাবার কাছে আছি, তাহলে খমোখা এত উদ্বেগ কীসের? চিন্তায় ভেজা অক্ষরগুলোর উপর যেন ওর গম্ভীর মুখটা দেখতে পেলাম।
আমি তাকে শুধুমাত্র দুবার দেখেছি। প্রথম বার, কবরখানায়; যখন আমি তার পিছনে দাঁড়িয়েছিলাম। সে বাবার হাত ধরে দেখছিল কফিনটা নীচে নামানো হচ্ছে। আর দ্বিতীয়বার, সিরসা গ্রামে...ও যখন দিল্লী থেকে আসছিল, আমি সেখানে শুধু এক ঘণ্টা থেমেছিলাম।
সেও এক অদ্ভুত দেখা! মেহরাসাহেবের জন্য কিছু ওষুধ আনতে গেছিলাম। তখন তার সঙ্গে ভালো করে পরিচয়ও হয়নি। বাস স্টেশন থেকে সোজা তার হাসপাতালে গিয়ে শুনলাম সে ওষুধ নিয়ে পাশের গ্রামে ডিসপেনসারিতে গেছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে যখন লাস্ট বাস ধরব ধরব করছি, তখন গেটের সামনে হাসপাতালের ভ্যানে ওকে দেখলাম।
ভ্যানের সিটে তিয়া, রৌদ্রক্লান্ত মুখে হাসির ছায়া, কবরখানায় সে মুখ আঁচলে ঢাকা ছিল। আমি চট করে ওষুধগুলো আর মেহরাসাহেবের জন্য আনা কিছু ফল আর পেস্ট্রি ওর হাত থেকে নিয়ে নিলাম। সে হাসপাতালে ক্যান্টিনে লাঞ্চ খেতে যাচ্ছিল। আমিও কি একটু বসে যেতে পারি না? ও জিজ্ঞেস করল। যখন বললাম আমার শেষ বাস এখুনি ছাড়বে, ও আমার মুখের দিকে চেয়ে হেসে ফেলল, “নিশ্চয়ই আপনার জন্যই সেটা অপেক্ষা করছে।” "আপনি কবে আসবেন ওদিকে?" আমি শুধোলাম। "এখনো কিছু জানি না। বর্ষাকালে এখানে খুব জ্বরজারি হয়...হয়ত সেপ্টেম্বরে ...আমি চিঠিতে জানাব। চলুন, আপনাকে বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দিই।"
সে তার ভ্যানে আমাকে কাঠগোদাম পর্যন্ত নিয়ে এসেছিল। সেখানে বাস স্ট্যান্ডে বাসটা তখনো দাঁড়িয়ে। সেই ছোট মফস্বল শহরের রোদে-ভরা স্টেশন...
এখন ভেবে অবাক লাগে যে সেদিন সে আমাদের কবরখানায় প্রথম সাক্ষাতের কোন উল্লেখই করেনি। আমার সামনে দাঁড়িয়ে দেখছিল কেমন করে তার মা মাটির নীচে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। সে কি একথা মনে করতে চায় না, নাকি সে ভুলেই গেছে যে আমি ঠিক তার পিছনেই দাঁড়িয়েছিলাম।
সেই দিন। কী ভাবে এত সময় কেটে গেল! হাওয়ার মতো। চিরকালের মতো। মাটির নীচে। অন্ধকারে। সে কি এখনো ভয় পায়?
আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পাহাড়ি রোদ্দুরে আলস্যের ঘুম। পায়ের আওয়াজে চোখ খুললাম। সামনে মুরলীধর, গোঁফের ফাঁকে হাসি, "সাহেব ডেকেছেন।"
"এই সময়!"
এরকম কমই হতো। সকালবেলা তিনি ডাকতেন না, আগের রাতের ঘটনার সঙ্গে পরের দিনের আলোর কোনো সম্বন্ধ তিনি রাখতে চাইতেন না। আমার চোখেও দেখতে পারতেন না আগের রাত্রে বর্ণিত কাহিনীর ছায়া। বন্যার জল সকাল হতেই নেমে যেত।
তবে আজ এই ডাক কেন?
ভিতরে যাবার দরজা বন্ধ বলে আমি বাইরে বারান্দায় বসেছিলাম। জঙ্গলের ওপারে দেওদারের তেরচা লাইন। ভিতরে চুপচাপ। একলা তিনি কী করছেন? পূজা-পাঠ করার কেউ নেই। ঈশ্বর, মৃত্যু, পুনর্জন্ম, এসব নিয়ে কখনো কিছু ভাবেন? হয়তো। কিন্তু আমার সঙ্গে এসব নিয়ে কোনো কথা হয় না। এসব আমাদের সম্পর্কের সীমানার বাইরে পড়ে, যেমন অন্দরের ও বাইরের সব ব্যথাবেদনার সাক্ষী পুরোনো চিঠিপত্র বন্ধ বাড়ির বাইরে ফেলা থাকে। তারপর একদিন কেউ এসে সব ঝাঁট দিয়ে সরিয়ে দেয়। কিছুই থাকে না। বুড়ো বয়সে, খালি উঠোনে...
কখন তিনি আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন...আমার কাঁধে হাত রাখতে খেয়াল হল। আমি উঠে দাঁড়াতে তিনি নিজে বসে আমাকেও বসতে ইঙ্গিত করলেন। তাঁর বুক থেকে হুইসিলের মতো সাঁই-সাঁই করে শব্দ শোনা যাচ্ছে।
"তুমি কি আজ বেরুচ্ছ কোথাও?"
"আপনি বলুন।"
"যদি যাও তো একটা চিঠি রেজিস্টার করে দিতে পারো?"
মেহরাসাহেব আমার হাতে একটা লম্বা খাম ধরিয়ে দিলেন। সরকারি দপ্তরের মতো, ভিতরে ভারী কিছু। আমি একটু আশ্চর্য হলাম, এ কাজ তো মুরলীধরও করতে পারত। কিন্তু কিছু না বলে উঠে পড়লাম। পাশ থেকে ওঁর মুখটা দেখলাম--চোখ ফ্যাকাসে, দাড়ি কামাননি, সাদা তুলোর মতো চুল গালে, থুতনিতে।
আমি নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলাম, "ডক্টর সিংকে একটা খবর দিই?"
"কেন?"
"একটু দেখে যেতেন, দু মাস তো হয়ে গেল।"
ডক্টর সিং মাসে একবার দেখে যান। মিসেস মেহরার সময় থেকেই এই নিয়ম চালু।
"ওকে বিরক্ত করে কী লাভ? যখন ও সময় পাবে, নিজেই এসে যাবে।"
তিনি ভিতরে যাবার সময় আমি বললাম, "আপনার মেয়ের চিঠি এসেছে।"
"তিয়ার?" তিনি থমকে গেলেন, "কী লিখেছে সে?"
"আপনার খবর জানতে চেয়েছে ..."
"আমার খবর?" একটু শুকনো হাসি। দাড়ি না কাটার দরুন মুখে সাদা চুলগুলো দেখাচ্ছে যেন শেভ করার পর সাবানটা মুছতে ভুলে গেছেন।
"রাত্তিরে আসবে যখন সঙ্গে নিয়ে এসো।" আর কিছু না বলে ঘরে ঢুকে গেলেন।
আমি খাম হাতে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। বাড়ি আবার চুপচাপ। বাইরে দেওদার গাছগুলো রোদ্দুরে উজ্জ্বল।
আমি বাড়ি এসে বারান্দাতেই বসে পড়লাম। বাগানে গঙ্গু মালী খুরপি দিয়ে কেয়ারির উপর ঝুঁকে ফুলগাছের মধ্যে মাটি খুঁড়ছে। খুচ, খুচ, খুচ। মাথায় একটা গোলাপি রঙের তোয়ালে। পাইপ থেকে সাপের মতো জলের ধারা ঘাস ভিজিয়ে দিচ্ছে।
আমি বাইরে বেরিয়ে পড়লাম।
যখনই আমার মনটা আনচান করে, আমি পাকদণ্ডী ধরে সোজা উপরে চড়তে থাকি। দু-পাশে ওক গাছের সারি, ফাঁকে ফাঁকে আকাশের টুকরো, এদের মাঝে কিছুক্ষণের জন্য আমি নিজেকে ভুলে যাই। দেহটা ঘামে ভিজে, হাঁপালেও মনটা বেশ শান্ত হয়ে যায়। বুকের ধুকপুক মনে হয় অনেক দূর থেকে আসছে। এ-ও ভুলে যাই কোন সমস্যাটা এতক্ষণ যন্ত্রণা দিচ্ছিল। শিরায় শুধু রক্তের শব্দ, আর জঙ্গলের শব্দ যেমন জঙ্গলের ভিতরেই কেবলমাত্র শোনা যায়। শহরে এসব শোনা যায় না। সেখানে শুধু মনের চাকাটা ঘুরতেই থাকে, দিন-রাত, রাত দিন। তার গুড়গুড় আওয়াজে আর সব শব্দ গুঁড়িয়ে যায়। যেদিন বাবার অস্থি নদীতে ডুবিয়েছিলাম, মনে হয়েছিল বাইরের সব শব্দ ওই পুঁটুলির মধ্যে ভরে ডুবিয়ে দিয়েছি, আর তখনি নিজেকে শুনতে শুরু করেছি। লোকে এখানে জীবনের শেষ প্রান্তে আসে...নিরঞ্জনবাবুর কথায়... তুমি জীবনের শুরুতে এসেছ... সে যদি জানত আমি শুরুটা কত পিছনে ছেড়ে এসেছি...
কিন্তু সবকিছুই কি ছেড়ে আসা যায়? কিছু তো অবশিষ্ট থেকেই যায়... ফেলে রাখা এটা-সেটা। আমার পক্ষে বাবা-মা থাকা-না-থাকা একই। বাবার মৃত্যুর পর মা খালি বাড়িটা আমার কাছে রেখে ছোট ভাইয়ের কাছে অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেছিল। যখন সে সঙ্গে ছিল তখনোই তো সে-বাড়ি খালি খালি লাগত। যখন অ্যানা হেসে আমায় জিজ্ঞেস করেছিল, মেহরাসাহেবের সঙ্গে তোমার নিজেকে অকেজো, খালি লাগে না, আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম, সে কোন খালির কথা বলছে? সঙ্গে কেউ থাকলেও যেরকম খালি লাগে, সে কি আগে থেকে টের পাওয়া যায়?
"আপনি এখানে?"
আমি চমকে তাকালাম, প্রথমে ঘোড়াটা দেখা গেল, যেন আমায় দেখে হাসছে, তারপর ডক্টর সিং-এর আসল হাসিটা দেখতে পেলাম। আমি বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম, "আপনার শতায়ু হোক। আমি আপনার সঙ্গেই দেখা করব ভাবছিলাম।"
"চলুন তবে আমার সঙ্গে... আর একটা রোগী দেখা বাকি, তার পর ক্লাবে যাব।"
"আপনি যান, রোগী দেখে আসুন, ততক্ষণে আমিও আমার কাজ সেরে নিই।"
"কী কাজ?"
"এই চিঠিটা পোস্ট করতে হবে।" আমি খামটা দেখালাম।
"ক্লাবেও লেটারবক্স আছে।"
"এটা জরুরি চিঠি, রেজিস্টার পোস্টে দিতে হবে।"
আমি সেন্ট সিবাস্তিয়ানের ঘাড় চাপড়ে দিলাম। সে লেজ দিয়ে কিছু মাছি তাড়িয়ে দিল। চড়াই ওঠার পরিশ্রমে তার নাক ফুলে ফুলে উঠছে, মুখে একটু সাদা ফেনা। তার ভাবসাব অনেকটা ডক্টর সিং-এর মতই। লম্বা চেহারা, চিন্তিত চোখ, ভালমন্দ বিচারে গম্ভীর। হয়তো এই জন্যই অ্যানা তাকে 'সেন্ট' আখ্যা দিয়েছিল। এই ব্যাপারে ডক্টর সিং তার ঘোড়ার থেকে একটু পিছিয়ে, কারণ তাঁর চেহারায় সেই সমঝদার সেন্ট ভাবটা নেই।
"দেরি কোরো না কিন্তু।" ঘোড়া পিছু ফিরল, "মেহরা সাব ভালো আছেন তো?"
আমি উত্তর দেবার আগেই সেন্ট সেবাস্তিয়ান এগিয়ে গেছে। পাহাড়ের মোড়ে এক পলকের জন্য তাদের দেখা গেল।
ডক্টর সিং এইরকমই। তিনি সারা দুনিয়ার লোক কিন্তু দুনিয়ার মধ্যে তিনি কখনো নেই। নিজের দুনিয়াটা নিজের সঙ্গে নিয়ে চলেন। তিনি এখানে না থাকলে আমি মেহরা পরিবারের কাছে বাঁধা পড়ে যেতাম। তিনি-ই আমাকে বাইরে টেনে এনেছিলেন। আর্মির ডাক্তার হওয়ার দরুন তাঁর নানা শহরে পোস্টিং হয়েছে। রিটায়ার হয়ে এই শহরেই প্র্যাকটিস শুরু করেন। নীচের বাজারে তাঁর ক্লিনিক, তবে বাড়ি উপরে। ঘোড়ায় চড়ে তিনি রোজ ওঠানামা করেন।
ডক্টর সিং মাসে একবার করে মেহরাসাহেবকে ভিজিট করতে আসেন। বয়সে বড়ো হওয়া সত্ত্বেও মেহরাসাহেব ডাক্তারকে বেশ খাতির করেন। ডাক্তার আসার দিন ঘরদোর সাফাই হয়, মেহরাসাহেব নিজেও পরিষ্কার জামাকাপড় পরে, টাই বেঁধে রীতিমতো সাজগোজ করেন, যেন কোথাও বাইরে যাচ্ছেন। গেটে সেন্ট সিবাস্তিয়ানকে দেখামাত্র মুরলীধরের ডাক পড়বে। সে একহাতে লাগাম আর এক হাতে ডাক্তারি ব্যাগ ধরতেই ডক্টর সিং এক লাফে নেমে বাগানের মধ্যে ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে বারান্দায় উঠে আসবেন।
বেশ কিছুক্ষণ কাটান তিনি এখানে। শুধু পরীক্ষানিরীক্ষায় না পুরনো দিনের গল্পগুজবে তা বলা মুশকিল। ঘন্টা দেড়েক পরে যখন বেরিয়ে আসবেন তখন মেহরাসাহেবকে দেখা যাবে না। মুরলীধর ঘোড়া নিয়ে দৌড়ে এলেও ডাক্তারবাবু তক্ষুনি ঘোড়ায় চড়বেন না। লাফ দিয়ে বাগান পেরিয়ে সোজা আমার ঘরের দরজায় ছড়ি দিয়ে খটখট করবেন।
আমি আগেই জানলা দিয়ে তাঁকে দেখে নিয়েছি। জানতাম এখন ওঁর সঙ্গে ক্লাবে যেতে হবে। প্রতি মাসে একই নিয়ম। ঘড়ি-বাঁধা ডাক্তারি নিয়ম...কোনো ব্যতিক্রম নেই। তিনি এলেই আমাকে ক্লাবে নিয়ে যাবেন। তিনি যাবেন ঘোড়ার উপর, মুরলীধর ব্যাগ নিয়ে পিছন পিছন আর আমি সেন্ট সেবাস্তিয়ানের সঙ্গে পা মিলিয়ে...
একটা ছোট কারাভ্যানকে পাহাড়ে চড়তে দেখা যাবে।
চড়াইটা খুব খাড়া নয়। একটু ওঠার পর উতরাই। চীর গাছের পিছনে ক্লাবের হলদে ছাত, জানলার লম্বা কাঁচগুলো রোদ্দুরে ঝকমক করত। এখানে এসে সেন্ট সিবাস্তিয়ানের গতি কমে ধীর হয়ে আসবে, মুরলীধর দৌড়ে পুরনো গেটের পাল্লা খুলে একটু পিছু হটে অ্যাটেনশন ভঙ্গিতে দাঁড়াবে; ভাবটা এমন, যেন আমাদের আসার অনেক আগে থেকেই সে ওইভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
আজ মুরলীধর সঙ্গে নেই। দুপুরে ক্লাব খালি, দু-একজন বিলিয়ার্ড খেলায় ব্যস্ত, লাইব্রেরির রিডিং রুমে কিছু রিটায়ার্ড অফিসার খবরের কাগজ বা ম্যাগাজিনে মুখ ডুবিয়ে বসে... বার-টা পিছনে, দরজা খুলে লনে যাওয়া যায়। সব জানলা দিয়ে পিছনে সূর্যস্নাত পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছে।
সেখানেই, এক কোণে টেবিলে ডক্টর সিং বসে। প্রতি দুপুর, একই টেবিলে। "আমি ক্লিনিকে অন্যদের দেখি, এখানে দেখি নিজেকে," তিনি জানালেন।
আমায় দেখে হাত নেড়ে ডেকে ইঙ্গিতে একটা খালি চেয়ার টেনে বসতে বললেন। তাঁর মুখ-ভরা স্যান্ডউইচ। আমি বসলাম।
"পোস্ট অফিস হয়ে এলে?"
"হ্যাঁ।"
"কিছু খাবে?"
আমি মাথা নাড়লাম। তিনি আমার জন্য একটা বিয়ার অর্ডার করে দিলেন। বিয়ার আর স্যান্ডউইচ, এ-ই তাঁর নিজের দুপুরের খাবার।
বারে কেউ নেই। চেয়ারে, টেবিলে শুধু দুপুরের রোদ।
কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞেস করলেন, "তুমি বলেছিলে, আমার সঙ্গে কিছু কথা ছিল?"
"আপনি অনেকদিন আসেননি। একবার ওঁকে দেখে যেতেন--"
"দেখব," তিনি আমার চোখে তাকালেন, "চিন্তার কিছু?"
"আপনি তো জানেন। মেহরাসাহেব নিজের কথা কাউকে বলেন না।"
তিনি বিয়ারে একটা চুমুক দিলেন। "তুমি যা লেখ, সে কি তাঁর নিজের কথা নয়?"
তিনি কি হাসছেন? দেখে বলা যায় না। তাঁর স্বর একই রকম--- বিয়ারের কোনো প্রভাব পড়ে না। ওঁকে দেখে আমার হিংসে হয়।
"ওঁর কি কোনো কষ্ট…?'
"কষ্ট? না, কষ্ট নয়। হয়তো আপনাকে কিছু বলতে চান যা আর কাউকে বলা যায় না। আপনি ওঁকে অনেক বছর ধরে চেনেন।"
"ডাক্তারি পেশাটাই এইরকম। জানবার কিছু নেই...দুই আর দুইয়ে চার, ব্যস। কখনো কখনো পাঁচ হয়ে যায়, আমরা তাকে অলৌকিক বলি... তুমি অলৌকিকে বিশ্বাস করো?"
এইরকমই হয় তাঁর সঙ্গে। কথা সোজা রাস্তায় না গিয়ে উল্টোপাল্টা চলে যায়। আমি দাঁড়িয়ে থাকি এক জায়গায়, আর তিনি আমাকে অন্য জায়গা দেখাতে থাকেন।
"আপনি বিশ্বাস করেন?
"নিশ্চয়ই...তোমার মনে আছে, যখন প্রথমবার আমার কাছে এসেছিলে?"
"আমি না। মিসেস মেহরা আমায় এনেছিল।"
"হ্যাঁ। সেই তো," হাসতে হাসতে বললেন, "এক অসাধারণ মহিলা। আমার কাছে নানারকম জীবজন্তু আনত, কিন্তু তুমি সবথেকে আলাদা।"
"আপনি তো বড়জোর দশ মিনিট আমায় দেখেছিলেন।"
"আমার তা-ই যথেষ্ট। জানো, পুরাকালে বদ্যিরা শরীরের রং দেখে রোগ ধরে দিত?"
"আপনি আয়ুর্বেদে বিশ্বাস করেন জানতাম না তো।"
"শরীরটা তো চিনতে পারি।"
"আমার শরীরে কী দেখেছিলেন?"
"আমি ভেবেছিলাম, তুমি মাস কাবার হতে-না-হতেই এখান থেকে পালাবে।"
"ভুল ভেবেছিলেন! দেখুন, আমি এখনো--"
"এটাই তো অলৌকিক!"
তিনি একটা সিগারেট ধরিয়ে চেয়ারে হেলান দিলেন। বাইরে গাছের ছায়া লম্বা হয়ে আসছে।
"মেহরাসাহেব কেন আমাকে ডেকেছেন জানো?" আধবোজা চোখে প্রশ্ন করলেন।
"কেন?"
"তিনি জানতে চান আর কতটা সময় বাকি।"
"কীসের সময়?"
"বাঁচবার।" তাঁর চোখ এবার খুলে গেল, "কত দিন, মাস, বছর।"
আমি একটু কেঁপে উঠলাম।
"হয়তো তাঁর বয়সে সবারই এমন হয়।"
"বয়সের কথা নয়। আমরা কি চব্বিশ ঘণ্টা আমাদের বয়স নিয়ে ভাবি? যা মনে রাখবার কথা তা আমরা ভুলে যাই।"
"কী কথা?"
"যেমন...,” তিনি আস্তে করে আমার বুকে একটা টোকা দিয়ে বললেন, "হৃদয়, দেহ, প্রাণ, রোগ, শোক...এই সব! ভাবো তো, যা আমাদের সঙ্গে সবসময় রয়েছে তার সম্বন্ধেই আমরা ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করি, বা জ্যোতিষীকে।"
"আপনাকে তিনি বিশ্বাস করেন যে।"
"বিশ্বাস করলে কি আর আমার কথা শুনত না? কতবার বলেছি মেয়ের কাছে গিয়ে থাকেো। সেও তো ডাক্তার।"
"তবে?"
"তবে আর কি? বলেন, আমি তার উপর বোঝা হতে চাই না।" ডক্টর সিং সিগারেটটা যেন রেগেমেগে অ্যাশট্র্রেতে গুঁজে দিলেন, "আসল কথা, সে এখান থেকে যেতেই চায় না।"
"কেন বলুন তো? এখানে তো তাঁর কেউই নেই।"
"আছে। মিসেস মেহরা।"
আমি একবার তাঁর দিকে তাকালাম, নেশাটেশা হয়নি তো!
"না আমি সিমেটেরির কথা বলছি না। সেখানে তো সে মাটির নীচে। আমি বাড়ির কথা বলছি, সেখানে সে এখনো আছে। ওই বাড়ি ছেড়ে যাওয়া কি সহজ?"
তিনি জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন। সূর্যের উপর একটা মেঘ আটকে আছে। সারা শহরে একটা ক্লান্ত ছায়া।
"আমি চলি..." ওয়েটারকে ডেকে বিলটা সাইন করে আমার দিকে তাকালেন ...
"তুমি হয়তো ভাবছ আমি আজেবাজে বকছি, কিন্তু এমনই হয়। লোকের শরীর চলে যায়, কিন্তু তার মানে এ নয় যে প্রাণটাও বাড়ি ছেড়ে দেয়... মেহরাসাহেব তাকে কী করে একলা রেখে যেতে পারে?"
গেলাসে শেষ চুমুক দিয়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন।
"আমার একটু তাড়া আছে...কিন্তু তুমি বসো --আর ওঁকে বোলো, চিন্তার কোনো কারণ নেই, আমি দু একদিনের মধ্যেই যাব।"
একটু পরে আমিও বেরিয়ে পড়লাম। ক্লাবের পিছনদিকে একটা কাঁচা রাস্তা ফরেস্ট রেস্ট হাউসের দিকে যায়। কিছুদূর গিয়ে একটা উঠোন পড়ে, তার চারিদিকে উঁচু চীর গাছ আর মাঝখানে রোদ ভরা ঘাস। কেউ এর ঠিক নাম দিয়েছিল--পাইন গ্রোভ। গরমের সময় টুরিস্টরা পিকনিক করতে আসে, কিন্তু এখন জায়গাটা খালি। আমার বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। তাই একটু বসে পড়লাম। বিয়ারের হালকা নেশা আর পাইন পাতার মদির গন্ধ আমায় ছেয়ে ফেলছে, বসতেই মনে হল শুয়ে পড়ি। শোওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমের চাদর আমার সর্বাঙ্গ ঢেকে দিল। কিছুক্ষণ চোখের পাতায় রোদের আলোর ফুটকিরা নাচছিল, ধীরে ধীরে সেগুলো ফুরফুরে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। একটা শিরশির শব্দ, যা শুধু বীচের জঙ্গলেই শোনা যায়, এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে।
হঠাৎ ঘণ্টির শব্দে আমার চোখ খুলে গেল। রোদ মরে এসেছে, একটা পাহাড়ি মেয়ে মাথায় ঘাস আর ডালপালার বোঁচকা নিয়ে কোথায় যাচ্ছে, তার আগে আগে একটা ছেলে লাঠি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আশপাশে ভেড়া-ছাগলদের ডাকছে আর তারা ঘণ্টি বাজিয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। আমিও উঠে পড়ে পাকদণ্ডী ধরে নীচে নামতে শুরু করলাম।
অধ্যায়--১.৪
বাড়ি ফিরতেই অন্ধকারে মুরলীধরের লন্ঠন দেখতে পেলাম। আমার ঘরের সিঁড়িতে বসে বিড়ি খাচ্ছিল। আমায় দেখতেই চট করে উঠে দাঁড়াল।
"কোথায় ছিলেন আপনি? সাহেব কতক্ষণ ধরে ডাকছেন।"
"এত তাড়াতাড়ি?" আমি একটু ধাক্কা খেলাম। সব খবর ভালো তো!
"আসুন আমার সঙ্গে," বলে আমার হাতটা ধরল, "নয়তো উনি নিজেই চলে আসবেন।"
মেহরাসাহেবের ওখানে পৌঁছবার পর অস্বাভাবিক কিছু দেখলাম না। কটেজটা অন্ধকারে নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে। বারান্দায় বাতি জ্বলছে, জানলায় পর্দার পিছনে আলোর আভাস। সব কিছু শান্ত, নিঃশব্দ।
আমি ভিতরে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে এলাম। পেন্সিল আর নোটবুক সঙ্গেই ছিল। কে জানে, এতদিন পর অতীতের কোন মোড়ে কী দেখেছিলেন যা এক্ষুনি আমায় জানাতে হবে। তিনি ইজি চেয়ারে বসেছিলেন। চোখদুটো বোজা, হয়তো কিছু ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছেন। টেবিলের আলোটা ওঁর মুখ অবধি পৌঁছতে পারেনি, নিজের মধ্যেই মিলিয়ে গেছে।
"এসেছ? তোমারই অপেক্ষা করছিলাম।"
তিনি চোখ খুলে, শাল থেকে হাত বার করে টেবিল ল্যাম্পের শেডটা একটু উঁচু করে দিলেন, "চিঠিটা পোস্ট করে দিয়েছ?"
"হ্যাঁ," আমি ওঁর কাছে সরে এসে বললাম, "ক্লাবে গেছিলাম, ডক্টর সিং-এর সঙ্গে দেখা হল। উনি বললেন শিগগিরই আসবেন।"
তিনি কোন কৌতূহল দেখালেন না। অন্য দিন হলে আমায় সারা দিনের হিসেব দিতে হতো। কিছুক্ষণ ঘরের মধ্যে নীরবতা, বাইরে একটা কুকুর ডাকাডাকি করছিল।
"আজ অ্যানা এসে অনেকক্ষণ কাটিয়ে গেল।" তিনি জানালেন।
"কিছু দরকার ছিল?
"না, দরকার আর কি? দিভার কবরে তাজা ফুল রাখতে যায় যখন আমার এখানেও একটু ঘুরে যায়। ও বলছিল, তুমি ওর বাড়ি গেছিলে।"
"হ্যাঁ, সে ডেকেছিল, নিরঞ্জনবাবুর সঙ্গে দেখা করতে।"
"সে ফিরেছে বুঝি?"
"এই ক'দিন আগে।"
"তুমি একটা কাজ করবে? আসছে বার যখন অ্যানার বাড়ি যাবে তো ওর বইগুলো ফেরত নিয়ে এসো--দিভার কাছ থেকে যেগুলো ধার নিয়েছিল।"
"কোনো বিশেষ বই?"
"বিশেষ নয়, একটু অদ্ভুত। তুমি হয়তো পড়েছ। ‘Confessions of a Country Priest.’... এক জেসুইট ফাদার আমায় পড়তে দিয়েছিল। ...আজ তার কথা মনে আসতে বইটার কথাও মনে পড়ল। কোনো কোনো বইয়ের সঙ্গে আশ্চর্যভাবে এক-একটা লোক জুড়ে যায়। তোমারও কি এরকম মনে হয়?"
"ফাদারের সঙ্গে কোথায় দেখা হয়েছিল?"
"তিনি কেরালার লোক, কিন্তু আমাদের দেখা হয় রাঁচিতে, তখন আমার নতুন কালেকটরের পোস্টিং ....আর তিনি আদিবাসীদের জন্য একটা স্কুলে পড়াতেন। কোন কিছুর দরকার পড়লে আমার কাছে আসতেন। আমিও অনেক সময় কাজ সেরে তাঁর বাড়ি চলে যেতাম। সারা রাত গল্প করে... তখনও আমার বিয়ে হয়নি...আর তিনি তো চিরকুমার। আমাদের গল্প করার বিষয়ের অভাব ছিল না... না ছিল সময়ের অভাব, না মহুয়ার মদের। আমার জন্যে ওটা তিনি কখনো আনতে ভুলতেন না। জেসুইট পাদ্রী আর মহুয়ার মদ -- এর থেকে শক্তিশালী মিক্সচার আর কী হতে পারে!"
মেহরাসাহেব হাসছেন।
একটু পরে আবার শুরু করলেন, "ফাদার আমার থেকে বয়সে ছোট কিন্তু আমি তাঁকে খুব সম্মান করতাম। তাঁর সঙ্গে কথা বলে আমি শান্তি পেতাম। এক রাত্তিরে আমরা এমনি বসেছিলাম...আমি তাঁকে ঈশ্বর সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করি... তিনি কি আছেন?... ফাদার কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমায় পাল্টা জিজ্ঞেস করলেন, আমার কি কোন কষ্ট হয়?... কষ্ট কীসের? আমি জিজ্ঞাসা করতে তিনি বললেন, ঈশ্বরের অভাব বোধ করি কি? ... যখন কোনো কাছের লোক আমাদের ছেড়ে চলে যায়, সেরকম অভাব নয়...এমন একটা জিনিশের অভাব যা কখনো দেখিইনি ... যেমন নিঃসন্তান মায়ের সন্তানের অভাবে কষ্ট।"
"তো আপনি কী বললেন?"
“কিছু না। আমি ভুলেই গেছিলাম। ওই সময় মদের নেশায় আমরা যা বলি তা কি আর পরে মনে থাকে?"
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলতে শুরু করলেন, "ঈশ্বরের অস্তিত্বহীনতার কষ্ট! জানি না তিনি আমার কাছে কী জানতে চেয়েছিলেন। তুমি কি জানো, দিভা ক্রিশ্চান ছিল?"
"হ্যাঁ।"
"কী করে জনলে?" তিনি সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন ।
"অ্যানা বলেছে আমায়।"
"ও! সে হয়তো বলেনি মরার সময় সে কত কষ্ট পেয়েছিল। পেটে টিউমার ছিল। মরার পর যখন পেট থেকে বার করল... এই এত বড়ো... একটা টেনিস বলের মতো। কিন্তু যতদিন বেঁচেছিল, ব্যথার একটি শব্দও মুখ দিয়ে বেরোয়নি। উলটে আমায় আশ্বাস দিত যখন আমি আকুল হয়ে পড়তাম। তুমি যখন এলে, ও একটু ভালো ছিল। তোমাকে আমরা কিছু বলতে চাইনি... এই জন্য তোমায় ডেকেছিল...যাতে ও যাবার পর ..."
মেহরাসাহেব একটু পিছু হটলেন, যেন স্মৃতির ঝাপটার সামনে নিজেকে সামলাতে পারছেন না। সামলাতে চানও না, ওই ঝড়ের পিছনে যদি কোন 'খবর' থাকেও, তা কি তিনি আমায় প্রথমবার শোনাচ্ছেন?
"আমার ভিতর সেই সময় একটা অদ্ভুত চেঞ্জ হচ্ছিল।" তাঁর গলা নিচু শোনালো, "সে সময় দিনগুলো একসঙ্গে মিশে যাচ্ছিল ... আমি বুঝতাম না আমার মধ্যে কী হচ্ছে ... আমার শুধু মনে হতো, যদি কেউ এত ব্যথা এমন হাসিমুখে সহ্য করতে পারে, তো সে এর চেয়েও কঠিন ...খুব কঠিন নয়, শুধু একটু কঠিন, যাতে পা দিয়ে সে নিজেকে উঠিয়ে নিতে পারে? আর আমি ব্যথার কথা বলছি...শুধু শারীরিক পীড়া... ক্যান্সারের কথা আলাদা... তুমি কখনো মাইগ্রেনের রোগী দেখেছ? বা হাঁপানির রোগী? বেচারাদের একটা নিঃশ্বাস নিতেই কী কষ্ট... আমাদের পুরাকালের তীর্থযাত্রীদের মতো...এক পা এক পা করে হাঁপাতে হাঁপাতে কেদার-বদরিনাথের চড়াই ভাঙে। যন্ত্রণাও একধরনের যাত্রা ...তাই না?"
তিনি একটা লম্বা শ্বাস নিলেন, যেন কোনো গভীর অন্ধকারে ঝাঁপ দেবার আগে নিজেকে তৈরি করে নিচ্ছেন। "এক রাতে আমি হঠাৎ জেগে দেখলাম তার খাটটা খালি। ভাবলাম হয়তো বাথরুমে গেছে। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম, আবার জাগলাম, তখনো দেখি বিছানা খালি। আমি জোরে ডাকলাম, কোন উত্তর নেই, আমি দৌড়ে বাথরুমের দরজা খুললাম, কেউ নেই... বাড়ির সব ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজলাম, ভাঁড়ার ঘর, রান্নাঘর, দালান, আমি তাকে দিল্লীতে এক নার্সিং হোমে নিয়ে গেছিলাম, সে তার এক বন্ধুর সরকারি বাংলোতে ছিল। তুমি তো নতুন দিল্লীর সরকারি বাংলোগুলো দেখেছ, তুমি তো দিল্লীরই লোক, বাড়িগুলোর চারদিক সবুজ লনে ঘেরা, যেন সবুজ সমুদ্রে সাদা স্টিমারের মতো...অন্ধকারে মনে হয় তুমি জাহাজে চড়ে কোথাও চলেছ ... আধো ঘুমে দরজা খুলে পা বাড়ালেই সামনে লন অথবা পিছনে কিচেন গার্ডেন। আমি বুঝতেই পারিনি কখন ফুলের কেয়ারি পেরিয়ে আমি একটা কুয়োর কাছে চলে এসেছি-- যেখানে বাগানের মালী আর আউটহাউসের চাকররা জল তুলত।
"আমার পা আপনা আপনিই থেমে গেল। অন্ধকারে দেখা যাচ্ছিল না কিন্তু কিছু জিনিশ দেখার জন্য চোখের দরকার হয় না। যার সঙ্গে তুমি এত বছর আছ, তার গন্ধই তোমায় টেনে নিয়ে আসে। আমি যদি মাত্র পাঁচ মিনিট দেরিতে পৌঁছতাম তাহলে হয়তো সারারাত ওকে খুঁজেই মরতে হতো। কিন্তু আমি ওকে হারাইনি, ওর ইশারা ধরে ওর কাছে এসে গেছিলাম। ও কুয়োর পাড়ে বসেছিল। সে আমাকে দেখতে পেল। 'এখানে কী করছ?' আমি তাকে ওঠাবার চেষ্টা করলাম...সে আমার হাত ধরে পাশে বসাল। 'তুমি কি আমার সুখ চাও?' আমার মনে হল ওর আওয়াজটা কুয়োর তলা থেকে আসছে... তুমি যদি চাও তো আমাকে এখুনি একটা ধাক্কা দাও, ব্যস, একটু হালকা ধাক্কা, বাকিটা আমি করে নেব।' সে এতদিন তার ব্যথা থেকে আমায় সরিয়ে রেখেছে, সে-ই আজ ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে আমার কাছে ভিক্ষা চাইছিল।
"আমি ওকে টেনে ঘরে নিয়ে এলাম। তার পেটের নলটা কাদা আর জলে মাখামাখি হয়ে গেছিল। বিছানায় শুইয়ে দিতে আমার দিকে চেয়ে রইল। কে জানে কী ছিল সেই চোখে। মুখে কিছু বলল না। তুমি তো দেখেছ, সেই শেষ দিনগুলিতে, সকালে এই বারান্দায় চেয়ারে শুইয়ে দিতাম আর সন্ধ্যাবেলায় ঘরে নিয়ে আসতাম। জানো ওই সময় তাকে দেখে আমার কী মনে হতো?"
আমি চুপ করে থাকলাম।
"আমি ভাবতাম, কেন ওকে থামিয়েছিলাম--কেন যেতে দিইনি?"
"আপনি এ কী বলছেন?"
"শোনো, আমরা যাকে বেদনা বলি মরা বা বাঁচার সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। তার একটা সুতো প্রেমের সঙ্গে বাঁধা। সুতোয় টান পড়লে ব্যথার ঢেউ ওঠে। 'তুমি যদি আমায় চাও,' সে বলেছিল। আমার মনে হয়, তার বিশ্বাস ঈশ্বরে নয়, আমার উপর ছিল। আর আমি সে বিশ্বাস রাখতে পারিনি।"
রাত গভীর হয়ে গেছে কখন আমাদের খেয়ালই ছিল না। দরজায় মৃদু খটখট। মুরলীধর লন্ঠন নিয়ে খাড়া। আমি উঠে পড়লাম। যাবার আগে ভাবলাম ওঁকে জিজ্ঞেস করি--আজকের কাহিনীটাও কি নোটবুকে টুকে রাখব?
সে রাতে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। সকালে সবটা মনে ছিল না। শুধু টুকরো টুকরো কিছু...
আমি দেখলাম, আমি কবরখানায় দাঁড়িয়ে, সে নীচে নামছে আর আমার কানে কানে বলছে--দেখো, সে রাতে তো বেঁচে গেছিলাম, কিন্তু আজ সত্যিই যাচ্ছি। তার শরীরটা বাক্সের ভিতরে নয়, খোলা হাওয়ায় মধ্য দিয়ে নামছিল। আপনি এখানেই থাকবেন? তিয়া, তাদের মেয়ে, জিজ্ঞেস করছে, আপনি ওর সঙ্গে চলে যান, আপনাকে ঠিক পথ দেখিয়ে দেবে।
সে কে? আমি দেখতে থাকি। পাইন গাছের পিছনে ও কে? নিরঞ্জনবাবু? আমি কাছে গিয়ে ভুল টের পাই। লম্বা চোগা পরিহিত এক বৃদ্ধ--সাদা চুল, লম্বা দাড়ি। আপনি কি সেই জেসুইট ফাদার? রাঁচিতে যিনি থাকেন? হ্যাঁ, কিন্তু মেহরাসাহেব কোথায়? আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি যে ।
মেহরাসাহেবকে কোথাও দেখা গেল না...স্বপ্নেও নয়।