অধ্যায়—১.৮
তিয়ার আচমকা আবির্ভাবটা সবার মনে থাকবে। কারণ সেদিন থেকেই গরমের শুরু, যদিও সরকারিভাবে গ্রীষ্ম ঋতু অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছে। এই সময় শহরটা সারাদিন জ্বরে ভোগে। নীচের উপত্যকায় গরু-বাছুর চরানোর মাঠগুলি শুকিয়ে কাঠ। ফলে গাঁ থেকে ভেড়া-ছাগলের দল উপরে ঘাসের খোঁজে উঠে আসে। পাহাড়ে পাহাড়ে ওদের গলার ঘণ্টির টুং-টাং প্রতিধ্বনি। কখনো কখনো তারা ঝোপের মধ্যে ঢুকে পড়লে মুরলীধরকে ওদের লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে বার করতে হয়।
মনে থাকার আরও একটা কারণ, সেই সময় শহরে জলের অভাব শুরু হয়েছিল। কল, পাইপ সব শুকনো, কেয়ারি করে লাগানো ফুলের গাছ মরো-মরো, লনের ঘাস দেখলে মনে হবে যেন আগুনে পুড়ে গেছে--জায়গায় জায়গায় কালো, ঝলসানো। বাগানে গরু এলে ওই শুকনো, মরা ঘাস খেয়েই খিদে মেটাতে পারে।
কিন্তু সব বিপদই সঙ্গে কিছু আশীর্বাদও নিয়ে আসে। সেই সময় আমি তিয়ার সঙ্গে ভালো করে পরিচিত হবার সুযোগ পেলাম। যদিও আমি তাকে আগেও দেখেছি কিন্তু ভালো করে পরিচয় হল ওই জলের এমারজেন্সির সময়। আমাদের সবাইকে বালতি হাতে নীচের নালায় যেতে হত। ভাগ্যিস নালাটায় তখনো জল ছিল-- যদিও থার্মোমিটারের পারার মতোই ক্ষীণ, সরু ধারা। নালাটা কটেজের নিচে শিলাভূমিতে খানাখন্দের ভিতর দিয়ে বয়ে যেত। জলের স্রোতে আশপাশের পাথরগুলি মসৃণ, ঝকঝকে হয়ে গেছে। অনেক আগে জঙ্গলের বুনো প্রাণীরা এখানে জল খেতে আসত। আজও কাঠুরে আর মেষপালকেরা আশপাশে প্যানথার বা নেকড়েবাঘের চিহ্ন দেখতে পায়। লোকে বলে কোনো গডউইন নামক ইংরেজ এই নালাটা আবিষ্কার করে এবং তার নাম দেয় 'গডউইন ফলস'। পরে সময়ের প্রভাবে সেটাই 'গুডবি নালা' হয়ে যায়।
এই গুডবি নালা থেকে আমরা বালতি, পিপে, বোতল ভর্তি করে জল নিয়ে যেতাম। এজন্য, কটেজ, আউট হাউস, গেস্ট হাউস সবার বাসিন্দাদের একজোট হয়ে কাজ করতে হত। অ্যানার জলটা আলাদা বালতিতে পাঠানো হত, বিটিয়া সেই কাজের ভার দিয়েছিল মুরলীধরকে।
সবাই তাকে তিয়া বা তিয়া বিটিয়া বলে ডাকত। ছোটবেলা থেকেই এই নাম চলে এসেছে। তাকে দেখা যেত সব জায়গায়--কখনো মালীর সঙ্গে বাগানে ফুলের পরিচর্যা করছে, কখনো ব্যাডমিন্টন কোর্টের পাশে বেঞ্চিতে বসে কিছু পড়ছে, অথবা সন্ধেবেলায় মেহরা সাহেবের সঙ্গে হাঁটতে বেরিয়েছে। আমার ঘরের সামনে দিয়ে গেলে সে দু-তিন মিনিট দাঁড়াত, আমায় বলত সময় পেলে নিশ্চয়ই এসে একটু বসবে...
সময় পেল যখন কলের জল বন্ধ হয়ে গেছে। সে সক্কালবেলা দু' হাতে বালতি ঝুলিয়ে আমার দরজায় টোকা দিত --চলুন, সবাই আপনার জন্যই দাঁড়িয়ে... আমি আধো ঘুমচোখে ওকে দেখতাম, স্লেট রঙের সালওয়ার কামিজ, পায়ে রবারের জুতো, মাথায় শাদা ক্যানভাসের টুপি-- ওকে দেখাত ঠিক স্কুলের গার্ল গাইডের মতো। বাইরে লাইন দিয়ে মুরলীধর, তার বউ রাধা, তাদের ছেলে বংশীধর, আর কুকুর কালী ... আমি চটপট কাপড় বদলে, বাথরুম থেকে আমার ভাগের বালতি, জাগ আর ঘটি নিয়ে তাদের মিছিলে শামিল হতাম।
আমরা লাইন করে পাকদণ্ডী বেয়ে নীচে গভীর জঙ্গলে নেমে আসতাম--যেন কোনো অভিযানে চলেছি। নির্জন জঙ্গলে আমদের বাসনপত্রের কর্কশ শব্দ শুনলে মনে হবে যেন গ্রামবাসীরা বাঘ তাড়া করার জন্য কাড়া-নাকাড়া বাজাচ্ছে। চলতে চলতে মুরলীধর হেসে ফেলত, বলত, "বিটিয়া, এটা কিন্তু তোমারই কেরামতি!"
"আমার কীরকম?" সে আস্তিনে মুখের ঘাম মুছে জিজ্ঞেস করত।
"তুমিই তো নীচে থেকে গরমটা নিয়ে এসেছ। তুমি আসার আগে কী সুন্দর আবহাওয়া ছিল এখানে।"
"তাহলে আমি চলে যাই?" বলে সে হাসতে শুরু করত। সেই সময় ওকে দেখে আমার মনে হত ও নীচে থেকে শুধু গরমই নয়, মিসেস মেহরার হাসিটিও সঙ্গে নিয়ে এসেছে। অবাক কথা যে মিসেস মেহরা তার নিজের মা না হলেও তাদের হাসিতে দারুণ মিল ছিল। ঠিক সেই রকম নিষ্পাপ, আপনভোলা হাসিটি, যা পরে বিষাদে শুকিয়ে গেছিল। তাদের চেহারাতেও বেশ মিল ছিল। হাসির সময় দুটি চেহারাই মিলেমিশে যেত। প্রথম প্রথম আমার অদ্ভুত লাগত যে একই শরীরে দুই চেহারা--যেন একদিকে রোদ আর অন্য দিকে অন্ধকার--না, পুরো অন্ধকার নয়, আধো ছায়ার মতো... পরে তাকে ভালো করে জানার পরেও তার হাসি ও মুখের ভাব আমার একেবারে অনন্য মনে হত।
সেই জন্যই কি সে সবসময় চলতে চলতে আমার সঙ্গে গল্প করত? মুরলীধরের বাহিনী যখন আগে আগে চলত আর আমরা পিছনে পড়ে যেতাম...তখন সে আপন মনে কথা বলত... হাঁপাতে হাঁপাতে কখনো একটা বা দুটো কথা শুনতাম, তুলো ধোনার শব্দের মতো... একটা শুনি তো দ্বিতীয়টা ফসকে যায়-- সিনেমার সাব টাইটেল পড়ার মতো, পড়তে গিয়ে শুনতে ভুলে যাই—দু-একবার তাকে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে দেখেছি সে বিরক্ত হয়। তখন বুঝেছি যে আমার পক্ষে বোঝার চেয়ে শোনাটাই বেশি জরুরি। আমাদের মতো অল্প পরিচিতদের মধ্যে কথার মানেটা তত গুরুত্বপূর্ণ নয় যতটা আওয়াজ শোনার।
তাই, কথা বলতে বলতে সে এগিয়ে গেলেও আমার মনে হত সে তখনো আমার পাশেই আছে আর আমি তার কথা শুনতে পাচ্ছি... যদিও হাওয়ার শনশনানি, বাসনকোসনের ঝনঝন, জোর নিশ্বাসের শব্দ, সব ছাপিয়ে কিছু শোনাও মুশকিল। সেও বুঝত, যখন দাঁড়িয়ে পড়ে পিছনে দেখত তো তখন টের পেত যে সে একা-একাই বকবক করে যাচ্ছে। এতে সে অপ্রস্তুত হত না... শান্তভাবে আমার জন্য অপেক্ষা করত আর আমার দিকে তাকিয়ে দেখত...
তার দেখাটাও আরেক ব্যাপার, যা আমি কখনো বুঝিনি। তার চোখদুটো কি সর্বদা ওইরকম? দেখছে অথচ দেখছেও না। আমি কাছে এলে ভুরু কুঁচকিয়ে তাকাত যেন আমার পুরোটা ফোকাসে আনতে চাইছে, যেন আমার কিছু অংশ ওর দৃষ্টির বাইরে, দেখতে পাচ্ছে না, যেমন খারাপ ফোটোয় কখনো কখনো কারুর হাত, পা, মাথা কাটা যায়।
এটা হয়তো তার চোখের দোষ নয়, আমারই মনের ভ্রম। সে আমাকে পুরোটাই দেখেছিল, আমিই তার সামনে নিজের কিছু অংশ হারিয়ে ফেলতাম যা সে জানত না। সেইজন্য তার চোখের সামনে আমার অস্বস্তি হত, আমার মনে হত ও আমাকে যত না দেখছে তার থেকে বেশি শুষে নিচ্ছে, আর সেই দেখার সঙ্গে মুখের কথার কোনও সম্পর্ক নেই।
কিন্তু কেন? এতে তার কী লাভ? সে কি আমার অজান্তে কোনো পরীক্ষা করছিল? যেমন জলে ঝাঁপ দেবার আগে লোকে এক পা ডুবিয়ে দেখে নেয় করে জল কত গভীর, বা পা টিপে-টিপে এগোবার সময় বুঝতে পারে না কত কাছে এসে গেছে, আমার কাছে, বা সেই লোকটার কাছে, যে কবরস্থানে তার পিছনে দাঁড়িয়ে মিসেস মেহরার অবতরণ দেখছিল।
সেই লোকটা কে? আমার নিজের উপরেই লজ্জা হয়, যেন সে আমাকে নয়, আমার কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেখছে... জিজ্ঞেস করতে চাইছে--'আপনার কী হয়েছে?' কিন্তু সেই শেষ পদক্ষেপটা নেওয়ার আগেই পিছিয়ে যেত।
আমি নালা পর্যন্ত পৌঁছে জোরে জোরে দম নিতাম। মুরলীধর সবার বাসনপত্র ঝরনার নীচে রাখত আর গুবগুব শব্দে সব ভরে যাওয়ার পর সে, রাধা আর বংশী হাতে হাতে উপরে নিয়ে আসত। আমরা ঝরনার পাশে বসে ওদের উপরে আসার অপেক্ষা করতাম।
সেদিনও আমরা ওইরকম অপেক্ষা করছি, একসময় সে এক অদ্ভুত প্রশ্ন করল... আমার দিকে না তাকিয়ে ঝরনার জলে হাত ডুবিয়ে বলল, "আপনি কী মনে করেন? মেহরা সাহেবের শরীর কি সত্যিই খুব খারাপ, যেরকম ডক্টর সিং বলছেন?"
সে 'মেহরা সাহেব' বলেছিল, 'বাবা' নয়, সম্পর্কের আর্দ্রতা ছিল না, ছিল এক ধরনের শুকনো ক্লিনিকাল ভাব...
"ডক্টর সিং আপনাকে কী বলেছিলেন?"
"তার কথা ছাড়ুন, আপনি কী মনে করেন? আপনি তো দিনরাত ওঁর সঙ্গে থাকেন।"
সে তখনো মাথা নিচু করে জল নিয়ে খেলছিল। জলের শব্দ ছাড়া আর সব নিস্তব্ধ। আমার মনে হল সে যেন আস্তে আস্তে আমাকে একটা অন্ধকার গুহার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে।
"জানি না। খুব খারাপ মানে কী বলেছেন ডাক্তার?"
"সে কথা নয়, আপনার কী মনে হয়?"
আমি ভিতরের রাগটা চেপে বললাম, "আপনি এতদিন পরে এলেন, আপনার কি কোনো পার্থক্য চোখে পড়ে?"
তার হাতটা জলের নীচে স্থির হয়ে গেল। হাতের উপরে জল বয়ে যাচ্ছে। হাওয়ায় একটা গুড়গুড় আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল।
"আমি এলেই সে এত উৎসাহী হয়ে ওঠে যে আমি টের পাই না আমি আসার আগে সে কেমন ছিল..." ওর গলাটা অস্পষ্ট শোনাল, "আমি জানতে পারি না আমায় ছাড়া তার দিনগুলো কেমন কাটে..."
"আপনি থেকে যান না কিছুদিন," আমি সাহস করে বললাম, "তাঁরও ভালো লাগবে।"
এবার সে মুখ তুলল। ওর চুলের উপর রোদ পড়ে একটা আভা সৃষ্টি করছিল।
"আপনি তো আছেন..." একটু থেমে বলল, "আপনাকে চাচী এইজন্যই তো ডেকেছিল।"
তার গলায় একটু হালকা বিদ্রূপ, আমি তার মুখে 'চাচী' শুনে তাকালাম।
"আমার কথা আলাদা। আপনি তাঁর জন্য যা করতে পারেন আমরা কেউই পারি না।"
সে অসম্মতভাবে মাথা নাড়ল, কিন্তু মুখে কিছু বলল না।
এটাই আমার অপছন্দ... সে কখনো খুলে বলে না তার কী ভালো লাগে বা লাগে না, শুধু তার মুখ দেখে বুঝতে হয় যে আমার উত্তর তার প্রশ্ন থেকে অনেক দূর। তার তো কোনো দরকার ছিল না আমার পরামর্শ নেবার, তাহলে কী জানতে চেয়েছিল সে?
"আপনার এখানে কোন কষ্ট হচ্ছে না তো?" সে আমার দিকে তাকাল।
"না... কীসের কষ্ট?" আমি সামান্য অবাক।
"আমি দূরে থাকি, তাই কিছু টের পাই না। আপনি চিঠিতেও কিছু জানান না, শুধু বাবার হেলথ বুলেটিন পাঠান।"
এই শহরে লেখবার মতো কোন খবরই হয় না।" আমি হাসলাম।
"বাবা আপনাকে খুব বিরক্ত করে না তো?" একটু সলজ্জ হাসি।
"তা একটু করেন..." আমি বলি, "যখন তিনি ভুলে যান যে আমিও এখানেই থাকি, দিনের পর দিন কেটে যায়, তাঁর আমার সঙ্গে দেখা করার কথা মনেই থাকে না।"
তার মুখে আবছা ছায়া পড়ল।
"কেন?... চাচী তো বলত আপনারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করতেন?"
"সেটা তাঁর মুডের উপর নির্ভর করে ... মাঝে মাঝে অনেকদিন আমায় ডাকেন না।"
"কী করে সারাদিন?"
"দিনের বেলার খবর মুরলীধরই জানে। বিকেলে বেড়াতে বেরন, কখনোসখনো ডক্টর সিং আসেন..."
"আর আপনি..."
"আমি?" আমি ওর দিকে তাকালাম।
"আপনি ওই খালি দিনগুলো কী করে কাাটান?"
আমি কী করি, তাকে কী বলি... সেই খালি দুপুরগুলো? তার বিবরণ তো আমার অর্ধেক জীবনের কাহিনী... কাউকে বুঝিয়ে বলা মুশকিল। কারুর মামুলি প্রশ্নের উত্তরে যদি তার চোখের মধ্যে তাকাই তো অতীতের সব অ-মামুলি জিনিশগুলো দেখতে পাই...আমি হেসে বললাম, "কিছুই না... সে দিনগুলো আমার ছুটির দিন।"
কিছুক্ষণ আমরা দুজনেই চুপ, শুধু নালায় জলের শব্দ।
"এখানে আপনার কোনো বন্ধু নেই?" সে তাকাল, "চাচী বলেছিল নিরঞ্জনবাবু আর আপনি এক কলেজে পড়তেন?"
"শুধু এক বছরের জন্য। আমি যখন ইউনিভারসিটিতে জয়েন করি সে এমএ ফাইনাল দিচ্ছিল। আমাদের সাবজেক্ট আলাদা ছিল কিন্তু আমরা প্রায়ই দেখাসাক্ষাৎ করতাম।"
"তিনি এখানে আসেন না?"
তার স্বরে কিছু তীক্ষ্ণতা ছিল বা অস্থিরতা যা আমায় অবাক করল। "না, অনেকদিন আসেননি।"
"আপনি যান ওঁর বাড়ি?"
"একবার গেছিলাম...আমাকে ওঁর গেস্ট-হাউস দেখাতে চেয়েছিলেন..."
"গেস্ট-হাউস?" সে উৎসুক।
"ওই... যেখানে আগে স্কুল করার প্ল্যান ছিল, আপনি দেখেছেন নিশ্চয়ই।"
সে শুধু মাথা নাড়ল। ওর কপালে ঘামের ফোঁটা চকচক করছে। দুপুরের নিস্তব্ধতা ভেদ করে শুধু একটা কাকের কা-কা শোনা যাচ্ছে।
"অ্যানাজীও কি আপনার সঙ্গে গেছিল?"
"কোথায়?"
"নিরঞ্জনবাবুর ওখানে?"
"না... সে অত উঁচু চড়তে পারে না।"
"স্কুলের আইডিয়াটা অ্যানাজীর ছিল। সে বাচ্চাদের জার্মান শেখাতে চেয়েছিল।" তিয়ার মুখে হঠাৎ উজ্জ্বল হাসি।
"আমি যখন ছোট ছিলাম, অ্যানাজীর ছড়ি ধরে আগে আগে চলতাম...বিকেলে বেড়াতে... সে আমাকে জার্মান শেখাত... আমি যদি কোন জিনিশের ঠিক জার্মান নাম বলতাম, সে চীর গাছের একটা সূচলো পাতা নিজের স্কার্টে গেঁথে রাখত। পরে বাড়ি এসে সেগুলো গুণে ঠিক ততগুলো টফি আমায় দিত। আমাকে 'টফি' বলে ডাকত ... চাচী বারণ না করলে তো আমার টফি নামটা হাইস্কুলেও চালু হয়ে যেত।"
তার ডুবনো পায়ের উপর দিয়ে ঝির ঝির করে জল বয়ে যাচ্ছিল।
"আপনি কখনো গেছেন ওর বাড়ি?"
"প্রথমে না... কখনো কখনো গেটের সামনে দেখা হলে ভিতরে ডেকে নেয়। মুড ভালো হলে পিয়ানো বাজায়... আমার মনে হয়, মিসেস মেহরা মারা যাবার পর থেকে সে ভীষণ একলা হয়ে গেছে।"
এই প্রথম মিসেস মেহরার অভাবটা মুখে বললাম। তার অনুপস্থিতি সব সময় আমাদের মধ্যে উপস্থিত থাকে। সেটা লুকোবার জন্য সে নিচু হয়ে জলে মুখ ধুচ্ছিল। ঘাড়ের খোঁপাটা আলগা হয়ে গেছিল, মুখ সোজা করে আবার চুলটা টাইট করল।
ঝরনা থেকে মুখ তুলতেই তার ভিজে মুখে আলোর মতো হাসি, যেন কিছু পুরনো মজার কথা মনে পড়ল, "সে কি এখনও বাঁদর তাড়াতে ফাঁকা বন্দুক চালায়?... প্রথমে যখন এসেছিল, বুনো জন্তুদের ভীষণ ভয় পেত।" সে হাসছিল, সে হাসিটা তার নিজস্ব...যখনি কিছু লম্বা কথা বলে হাসি দিয়ে তার ফাঁকফোকর ভরিয়ে দেয়। সে একটু থেমে হাসে, যেন কিছু মজাদার মনে পড়েছে... "আপনি তো দেখেছেন পুস্কিকে...তার একটা বুড়ো বাবা ছিল, অ্যানাজী তাকে ভীষণ ভালোবাসত। একদিন তাকে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছে, একটু বাদে পিছন ফিরে দেখে সে গায়েব! অনেক খোঁজখবরের পর জানা গেল যে একটা নেকড়ে বাঘ তাকে ধরে নিয়ে গেছে। বাঘটা নাকি অনেকদিন তক্কে-তক্কে ছিল। সে সময় শহরে কুকুরগুলো ছিল নেকড়ে বাঘের জন্য তৈরি কাবাব! একটু চোখের আড়াল হল কি গেল। এক মুহূর্ত রাস্তার উপর, পর মুহূর্তেই অদৃশ্য। সেজন্যই পুস্কিকে বাইরে কোথাও বেরুতে দিতে চায় না।"
আমি আলো-ছায়ায় ভরা তার মুখে তাকিয়েছিলাম। "আপনি আসার পর তার সঙ্গে দেখা করেছেন?"
"একবার গেছিলাম। গেটে লাল ঝান্ডা দেখে ফিরে এলাম। হয়তো আমার উপর নারাজ..."
"আপনার উপর? আপনি জানেন না, আপনি যখন এখানে থাকেন না, ও কত কথা বলে আপনার সম্বন্ধে--"
"জানি..." সে মাথা দোলাল, "তাতে কিছু এসে যায় না।"
হাসির জায়গায় তার চোখে এখন একটা অভাবের রেশ। যেন কোনো পুরনো ব্যথায় টান পড়েছে।
"নারাজ ঠিক নয়... আমার উপর নারাজ হয়ে তার কী লাভ... আমি তো তার শূন্য জায়গাটা ভরতে পারি না।"
"কীসের শূন্য জায়গা?" আমি শুধলাম।
"চাচীর জায়গাটা... আপনি জানেন না সে কত জায়গা খালি করে গেছে। আমি কি সেসব ভরাতে পারি?"
তার প্রশ্নটা হলদেটে, ম্লান রোদে মিশে গেল।
"আপনি কখনো এখানে পাকাপাকি থাকার কথা ভেবেছেন?'
"এখানে?" সে ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে চারদিকটা দেখল-- দুপুরের রোদ, বয়ে যাওয়া নালা, জলে ভেজা পাথরের নুড়ি... শেষে তার চোখ আমার উপর এসে থামল। আমাকে এমনভাবে দেখছিল যেন আগে কখনো দেখেনি... এবার চোখ কুঁচকে নয়, খোলাখুলি আমার চোখে, "কী জন্য?"
তার গলা এত নিচু যে আমার মনে হল হয়তো ভুল শুনছি, এক নিঃশ্বাসে শব্দগুলো হাওয়ায় মুছে গেল ...
দূরে বাসনের ঝনঝনানি। আমাদের কথা মাঝপথেই থেমে রইল।
মুরলীধর খালি বালতি নিয়ে আসছে।
"তিয়া বিবি, তোমাকে সাহেব ডাকছেন।"
"আমাকে!"
"হ্যাঁ।" মুরলীধর ওর দিকে না তাকিয়েই বালতিগুলো জলে ডুবিয়ে দিল।
তিয়া উঠে দাঁড়িয়ে, একটু অপ্রস্তুতভাবে আমার দিকে তাকাল।
"আপনি চলুন... আমি মুরলীধরের সঙ্গে বাসনগুলো নিয়ে আসব।" আমি বললাম।
আর কিছু না বলে, সে জুতোর ফিতেটা টাইট করে ঘাস কাদা একটু সাফ করে নিল, তারপর ঝরনার পাশের পাকদণ্ডী ধরে উপরে চড়তে শুরু করল। তার পায়ের শব্দ অনেকক্ষণ শুনতে পাচ্ছিলাম।
অধ্যায়--১.৯
সেই আওয়াজ আমি রাত্তিরেও শুনতে পাচ্ছিলাম, বিছানায়, যখন আমি ঘুমের অপেক্ষায়। কখনো সেটা কাছে আসে, কখনো-বা দূরে সরে যায়। সেই গরমের দিনগুলি আমার মনে আছে...তখনি প্রথম আমি নিজেকে তার চোখ দিয়ে দেখতে শুরু করেছিলাম আর নিজের সম্বন্ধে কিছু কিছু বুঝতে পারছিলাম, যেমন গৃহকর্তা অতিথিকে ঘরদোর দেখাবার সময় নিজেও অতিথির চোখ দিয়ে ঘরের আসবাবপত্রগুলো দেখতে পায়। সে যখন কোনো স্ট্যাচু ছোঁয় তো মুহূর্তে শহরের সেই গলিটা মনে পড়ে যেখান থেকে মূর্তিটা কিনেছিলাম, কিংবা যখন সে আমার তাক থেকে কোনো বইয়ের পাতা উলটোয় তো আমার চোখের সামনে সেই দিনটা ভেসে ওঠে যখন আমি একটা গাছের তলায় বসে প্রথম বার বইটার পাতা উলটেছিলাম। তার দৃষ্টি যেন আমার ঘরের জিনিশের উপর নয়, আমার অতীতের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার চোখ দিয়ে আমি শুধু নিজেকেই দেখছি না, আমার অতীতটাকেও দেখছি। সেখানে সবকিছু আগের মতোই মনে হয় অথচ সব বদলে গেছে।
সব থেকে বদলে গেছেন মেহরা সাহেব নিজে। তাঁর দিকে তাকিয়ে আমার প্রথম দিনের কথা মনে পড়ে, সেইরকম হাসিমুখ, হালকা মেজাজ, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। মেয়ের সঙ্গে যখন বিকেলে বেরোন তো কে বলবে তাঁর কাঁধে বয়সের বোঝা বা রোগের আশংকা। তিয়া হাঁটে সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু তাঁর হাত ধরে নয় বা কাঁধে ভর দিয়েও নয়। তারা বাগানে একটা চক্কর লাগায়, তারপর দুই, তিন...যতক্ষণ না আকাশে তারাগুলো বেরিয়ে আসে আর কটেজটা অন্ধকারে ডুবে যায়। কখনো কখনো একলা বেরিয়ে আমার কোয়ার্টারের সামনে এসে দরজায় শব্দ করেন। আমি বাইরে এলে বারান্দায় সিঁড়িতেই বসে পড়েন। আমি ভিতরে আসতে বললে মাথা নেড়ে না বলে দেন, চেয়ার নিয়ে এলে দেখেনও না। শেষে আমিও তাঁর পাশে সিঁড়িতেই বসে পড়ি।
"কী, গভর্নর সাহেব? দেখছি মেয়ে আসার পর থেকেই আমাকে ভুলে গেছ!"
গভর্নর! আমি হাসি। মিসেস মেহরা যখন বেঁচে ছিল, তখন থেকেই এই নামের শুরু... একদিন কথাবার্তার পর যখন আমি নোটবুক নিয়ে উঠে পড়ছি তিনি আমায় থামালেন। সেদিন আমার কাজে তাঁকে বেশ খুশি লাগছিল, বললেন, "প্রত্যেকদিন তুমি আমায় প্রশ্ন করো, আজ আমি একটা প্রশ্ন করব... সেই মহিলাদের কী বলে, যাদের বাচ্চাদের দেখাশোনা করার জন্য রাখা হয়?" আমাকে চুপ দেখে বললেন, "গভর্নেস, তাই না?" তারপর স্নেহভরে আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, "আর এই যে তুমি এই বুড়োর দেখাশোনার ভার নিয়েছ, তোমাকে কী বলি? গভর্নর! আমাদের এখানে দুই-ই আছে, অ্যানা হল গভর্নেস আর তুমি গভর্নর!"
অনেকদিন পর আমি তাঁকে এরকম হাসতে দেখলাম। পুরনো দিনের হাসি, যখন আমি নতুন এসেছিলাম আর মিসেস মেহরা বেঁচে ছিল। আমার মনে হল আমাদের অতীত কোনো ছেড়ে যাওয়া রেল স্টেশনের মতো নয় যে একবার দেখার পরই হারিয়ে যায়। সে পাশে পাশে চলতে থাকে, জানলা দিয়ে দেখা যায়। মেহরা সাহেবকে দেখে মনে হত তাঁর অতীত--যা তার স্ত্রীর সাথেই শেষ হয়ে গেছিল-- তারই এক টুকরো তিয়ার সঙ্গে ফিরে এসেছে। যখন তাকে বাইরে লনে বা গাছের নীচে দেখি, মনে হয় বাপ-বেটি অল্প কিছুক্ষণের জন্য আমাদের শহরে এসেছে। বেশিক্ষণ থাকবে না। আর যখন চলে যাবে আমার এই শহরটা আরও খালি হয়ে যাবে।
মানুষের মন কী বিচিত্র! সুখের দিনে আমরা অনিষ্টর ছায়াটা সবথেকে স্পষ্ট দেখতে পাই। যেন আমাদের এত সুখে বিশ্বাসই হয় না। আমরা সুখকে ছুঁতেও ভয় পাই পাছে ময়লা হয়ে যায়! আর ওই ভয়ের জন্যই আমরা বিধাতার দেওয়া সুখটা হারিয়ে ফেলি। দুঃখ থেকে বাঁচা মুশকিল, কিন্তু সুখকে হারিয়ে ফেলা কত সহজ! আমি সেইদিনেই টের পেয়েছিলাম।
যখন মেহরা সাহেব আমার দরজায় শিকল খটখট করেন, আমার মনে হয় তিনিও একটু সুখ নিয়ে এসেছেন আমার সঙ্গে ভাগ করে নেবার জন্য। তিনি সোজাসুজি কিছু জিজ্ঞেস না করে আমার দুনিয়ায় ঢুকে একটু উজ্জ্বল করে দেন। হেসে জিজ্ঞেস করেন, "কী গভর্নর সাহেব, কলকাতা থেকে কাবাড়িওয়ালারা নতুন কী আবর্জনা তোমার জন্য পাঠিয়েছে?"
আমি তাঁকে বইগুলো দেখাতাম। তিনি সিঁড়িতে পা ছড়িয়ে বসে বিরাট বিরাট বইগুলোর পাতা ওলটাতেন। একবার একটা পুরনো মায়াসভ্যতার বই দেখে অনেকক্ষণ আমার সঙ্গে অ্যাজটেক লোকেদের সম্বন্ধে আলোচনা করলেন। তারা কি সত্যি সত্যি মানুষখেকো ছিল? ক্যানিবালিজম! তিনি মুখ খুলে নকল দাঁতটা ঠিক করে নিতেন। না, না, এটা তাঁর একটা রিচুয়াল ছিল। আমি তাঁকে বোঝাতাম আমরা যেমন দেবতাকে পশুবলি দিই আর তার 'ভোগ' খাই, এটাও সেই রকম। "মানুষের মাংসের ভোগ?" তিনি অবাক হয়ে শুধোলেন। "না," আমি বললাম, "তারা মশলাপাতি দিয়ে মাংসটা রান্না করত যাতে মানুষের গন্ধ না আসে।" তিনি মাথা নেড়ে বলতেন, "তাই হবে। সেই জন্যই লাতিন আমেরিকার রান্নায় এত মশলা ঝাল! একবার আমার বন্ধু এক মেক্সিকান রেস্তরাঁয় খাইয়েছিল ...আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়েছিল। ওয়েটার আমায় জিজ্ঞেস করে, ‘সাহেব তোমার কি কোনো কষ্ট হচ্ছে?’ আরে, মানুষ মানুষের মাংস খাবে তাতে তার কষ্ট হবে না?"
তিনি বইয়ে একটা ছবি দেখে মাথা নাড়ছিলেন, একটুক্ষণ ভেবে বললেন, "একবার আমার বেঙ্গলে পোস্টিং হয়েছিল। যে জেলার মাজিস্ট্রেট ছিলাম, তার কাছেই একটা নদী ছিল। পাড়ে একটা শিব মন্দির। আর একটু দূরে তান্ত্রিকদের সমাধিস্থল। আমার বাঙালি বন্ধু বলেছিল এখানেই নাকি বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর কপালকুণ্ডলা লিখেছিলেন। হয়তো তিনি আমারই মতো মাজিস্ট্রেট ছিলেন।" তাঁর হাসিতে একটু গর্বও ছিল।
"হতেই পারে! আপনি কোনো খোঁজখবর করেননি?"
"কীসের খোঁজ? আমি তো এই প্রথম বঙ্কিমবাবুর নাম শুনলাম, বইটাও অনেক পরে বিবির বইগুলোর মধ্যে পেয়েছিলাম।"
"বিবি?"
সে হঠাৎ বর্তমানে ফিরে এল। "তিয়ার মা...আমি যখন বাইরে যেতাম, সে এইসব বই পড়ত।"
এই প্রথম তিনি তার প্রথমা স্ত্রীর উল্লেখ করলেন। তা-ও ভুল করে, অন্যমনস্ক হয়ে। যেমন, চলতে চলতে কোনও বন্ধ দরজার সামনে এলে যখন পায়ের চেনা শব্দেই দরজা খুলে যায়... তিনি পিছু হটে আমার দিকে তাকালেন, মুখে শুকনো হাসি।
"তিয়া তখন খুব ছোট... যখন সে মারা যায়। তোমায় আগে বলিনি কখনো?"
"না...তাঁর বিষয়ে কিছুই না।"
তিনি বইটা বন্ধ করে নিজের কটেজের দিকে তাকালেন। বিকেলের রোদে বাড়িটা ঝকমক করছে। দেওদারের শাখাগুলি হাওয়ায় দুলছে অল্প অল্প।
"তুমি আমাদের কথাবার্তার যে নোট করো, সেগুলো কোথায় রাখ?"
আমি একটু আশ্চর্য হয়ে বললাম, "টেবিলের ড্রয়ারে। কেন?"
"না, এমনি।" তাঁর গলায় সন্দেহের সুর।
"আপনি কি সেগুলো দেখতে চান?"
"না, না। আমি দেখে কী করব?" তিনি তাড়াতাড়ি বললেন, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "তিয়া কি এসব সম্বন্ধে তোমায় কিছু জিজ্ঞেস করেছে?"
"না...কিন্তু..."
"কিন্তু কী?"
"সে জানে।" আমি বললাম।
"জানা এক কথা আর পড়া অন্য। আমি যা মনে আসে বকে যাই, কিন্তু এসব অন্য কারুর পড়ার জন্য নয়।"
তিনি কি নিজের মেয়েকে 'অন্য কেউ' বলে ভাবেন ? নাকি আরও কিছু তাঁকে চিন্তিত করছে? তিনি কি মনে করেন আমায় যা যা বলেছেন তা আর কারুর জন্য নয়? তাহলে আমাকেই বা বলা কেন? এটা ঠিক যে অনেকে অপরিচিত লোককে অনেক কিছু বলে ফেলে যা নিজেদের আপন লোককে বলতে পারে না। আপন লোকের জাজমেন্ট মনের মধ্যে কাঁটা হয়ে ফোটে। যে তোমায় ভালোবাসে সে কখনো তোমায় মাফ করতে পারে না।
সে জন্যই কি নিজের মেয়েকে তাঁর এত ভয়?
কিন্তু আমি যখন জানলা দিয়ে ওঁদের একসঙ্গে দেখি, ভয়ের কোন ছায়া তো দেখতে পাই না! তাঁরা নিজেদের কথায় এত মজে থাকেন যে চুপ থাকলেও মনে হয় ওঁদের মধ্যে একটা কথার স্রোত বয়ে যাচ্ছে, যা শুধু ওঁরাই শুনতে পান। তিয়ার লম্বা, ছিপছিপে শরীরের সামনে মেহরা সাহেবকে ছোট মনে হয় কারণ তিনি কোমর ঝুঁকিয়ে চলেন। কিন্তু তিয়ার কথা শোনার সময় মাথা উঁচু করে --ঠিক স্কুলের ছাত্রদের মতো, যেন সোজা দাঁড়িয়ে টিচারদের বক্তৃতা শুনছেন। এটা বেশিক্ষণের জন্য নয়, একটু পরেই দুজনে আবার চলতে শুরু করেন। কথার সঙ্গে ঠোঁট ও হাতের নড়াচড়া, আর চোখের দৃষ্টিতে চলচ্চিত্র আঁকা হয়ে যায়। ওঁদের দেখে আমার মনে পড়ে যখন মেহরা সাহেব তাঁর স্ত্রীর হাত ধরে আস্তে আস্তে সাবধানে লনে হাঁটতেন। আমার মনে হত যেন ঘুমের মধ্যে হাঁটছেন, চোখদুটো পরিষ্কার খোলা, কিন্তু জানতেন না সামনে কী দেখছেন।
সেই সময় আমি একটা জিনিশ বুঝেছিলাম, এক অনাবিষ্কৃত সত্য, সত্য ঠিক নয়, সত্যের একটা আভাস, যা আমাদের ভিতর এঁটে বসে যায়। খোলে শুধু অন্য কারুর ছোঁয়ায়, সে স্পর্শও এক ধরনের অনুভব বা আবিষ্কার। আবিষ্কার হয়তো একটা বড়ো কথা, কিন্তু এই ব্যাপারটা খোলে ঠিক একটা রহস্যর মতোই। যখন আমি তাঁকে তিয়ার সঙ্গে বেড়াতে দেখি, বিকেলের রঙিন রোদ যখন ব্যাডমিন্টন কোর্টের উপর এসে পড়ে, আমার জানলা থেকে ওঁদের আস্তে আস্তে হাঁটতে দেখে আমার মনে হয় যেন কিছুই বদলায়নি। সব একই রকম আছে, যেমন আগে ছিল, যখন মিসেস মেহরা বেঁচে ছিল, অ্যানাজী এত বুড়োয়নি আর আমি অন্য শহরে দিন কাটাচ্ছিলাম। এমন একটা জায়গায়, যেখানে সব কিছু আগেই হয়ে গেছে… আমরা শুধু তার কপি করে যাচ্ছি, যেমন আমি মেহরা সাহেবের নোটগুলো কপি করি। কিন্তু তাহলে সময়? সেটা কি কিছুই নয়? না, সে-ও আছে, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে-- যেমনভাবে তাকে মনে করি--যেমন এই লন, এই রোদ, কটেজের ছাতের উপর ঝুঁকে পড়া দেওদারের শাখা... সময় ওই সব জায়গায় আছে, যেখানে আমরা কাটিয়েছি। আমাদের সাক্ষী স্টেশন-- যা আমরা চলে যাবার পরেও এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে...
দুদিন ধরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। ঘরের ভিতর থেকে তার ঝিরিঝিরি, ঝুপঝুপ শব্দ শোনা যায়। বাইরে কুয়াশার পর্দা ভেদ করে কিছুই দেখা যায় না। যেখানে আগে চীর, দেওদারের পাতা ভরা শরীরগুলো পুরো দেখা যেত, সেখানে এখন শুধু কুয়াশায় ঢাকা আবছা কঙ্কাল। এখন আর বালতি, বোতল নিয়ে জল আনতে হয় না, জল নিজেই ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। কটেজ আর আমার কোয়ার্টারের মধ্যে এত জায়গায় জল জমে গেছে, ব্যাডমিন্টন কোর্টটা তো একটা সুইমিং পুল বলে মনে হয়। উপরে গাছের পাতা, ডালপালা, এমনকি দুএকটা জংলী বিছেও সাঁতরাতে দেখা যায়।
যতদূর দেখা যায় কোনো পশুপাখির চিহ্ন নেই। মনে হয় বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই আর। কটেজের আলো দিনের বেলাও জ্বালা থাকে কিন্তু ভিতরে কাউকে দেখা যায় না। শুধু আলোর প্রতিবিম্ব ব্যাডমিন্টন কোর্টের নোংরা জলের মধ্যে দপদপ করে। কখনো কখনো আরেকটা ছায়া দেখা যায়, মুরলীধর এক হাতে ছাতা, আর আরেক হাতে ঢাকা দেওয়া ট্রে নিয়ে ছপছপ করে আসছে। একটু পরেই সে আমার দরজার সামনে, আমি চট করে ওর হাত থেকে ট্রেটা নিয়ে নিই, আর ও কম্বল জড়িয়ে বারান্দায় বসে পড়ে।
একটা বিড়ি জ্বালিয়ে জিজ্ঞেস করে, "বাবুজি, আপনার ঘরে আগুনটা জ্বালিয়ে দিই?"
আমি মানা করে দিই। শীতের দিন এখনও বহুদূর। আর ও যেভাবে আলুথালু হয়ে বসে, আগুন জ্বালানোর কথাটা নেহাতই ভদ্রতা। এই বৃষ্টির মধ্যে খাবার নিয়ে এসেছে এই-ই যথেষ্ট।
আমারা বারান্দায় বসে কুয়াশা আর বৃষ্টি দেখছি। মুরলীধরের শ্বাসে একটু শোঁ শোঁ আওয়াজ। "তোমার শরীর ঠিক আছে তো?" আমি জিজ্ঞেস করি।
"কোথায় ঠিক, বাবুজি, এই বৃষ্টির সময়, হাঁটুর ব্যথাটা চাগিয়ে ওঠে।"
আমি বুঝে নিলাম এই 'ব্যথাটা' কীসের।
"একটু ব্র্যান্ডি চলবে? ব্যথাটা কমতে পারে।"
"কমবে আর কোথায় বাবুজি, কিন্তু আপনি নিলে আমিও একটু নিতে পারি।"
আমি ভিতর থেকে দুটো গেলাসে ব্র্যান্ডি ঢেলে আনলাম।
"আপনার খানা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, আমি ওটা হট-প্লেটে বসিয়ে আসি। সে তাড়াতাড়ি উঠে ভিতরে গেল। দেখলাম তার হাঁটুর 'ব্যথাটা' তখনকার মতো সেরে গেছে!
ও বাইরে এলে আমি গেলাসটা ওর হাতে ধরিয়ে দিলাম। আমি বলা সত্ত্বেও সে পাশের চেয়ারটায় বসলো না, কম্বলটা অর্ধেক মাটিতে পেতে, অর্ধেক গায়ে জড়িয়ে বসলো। বৃষ্টির ধারা অন্ধকারে আর দেখা যাচ্ছে না--শুধু শব্দটা শোনা যাচ্ছিল।
"এখন আর জলের জন্য মিছিল করে যেতে হবে না।" মুরলীধর হেসে বলল, "এখন আপনি আরামসে দেরি করে উঠতে পারেন।"
"দেখো, কতদিন এরকম থাকে।"
"ভাববেন না, একবার এই বৃষ্টি শুরু হয় তো আর থামতে চায় না। এখানে আমরা একে হেঁচকি বৃষ্টি বলি। এই হেঁচকি চলতেই থাকে, দুদিন বন্ধ, আবার শুরু, বন্ধ, আবার শুরু... একবার তো বেচারা তিয়া বিবি হেঁচকির জন্য আটকে গেল। যখনই যাওয়ার তৈরি করে, হেঁচকি শুরু হয়ে যায়।" সে হাসছিল।
"কবেকার কথা?"
"অনেক বছর আগে। সে যখন এখানে আসত, আপনার এই কুঠিতে থাকত।"
"এই কুঠিতে?" আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম।
"হ্যাঁ। সাহেব মানা করত, কিন্তু তার একলা থাকা পছন্দ ছিল। বলত, এখানে সবার মধ্যে থেকেও একলা থাকা যায়। আমার তো ওর কথা বেশ অদ্ভুত লাগে।"
"কী কথা?"
"এমন কিছু না। আমার শুধু মনে হয় সে যেন এখানকার নয়, আমার সঙ্গে এমন ভাবে কথা বলে যেন আমি তার মা-বাবার লোক, তার নই। সে বাইরের লোক। আমাকে দিয়ে কখনো নিজের কাজ করাতো না...সব নিজে নিজেই করত। ...কিন্তু এখন আর না..."
মুরলীধর অন্ধকারে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইল, "আম্মা জী গত হওয়ার পর সেও বদলে গেছে। আগে একা একা অনেকক্ষণ বাইরে ঘুরত, ক্লাবের লাইব্রেরিতে যেত, আমায় গিয়ে ডাকতে হত...এখন সাহেব একলা হওয়ার দরুন, বেশি সময় তার সঙ্গেই কাটায়।"
"কিন্তু তিনি তো একলাই থাকেন যখন মেয়ে চলে যায়--"
"একলা কোথায়? আপনি রয়েছেন তো। আপনার উপর তার খুব ভরসা।"
“তাহলেও, আমি তো বাইরের লোক। ঘরের লোকের সাহায্য আমার কাছে কোথায় পাবে?"
"কী যে বলেন!" মুরলীধর ধরা গলায় বলল, আপনিই বলুন, আম্মাজী কি আপনাকে বাইরের লোক মনে করতেন?"
"সে আর কোথায় এখন, মুরলীধর।"
"এখানেই আছেন। ঘরের লোক ঘর ছেড়ে কোথায় যাবে?"
আমি ওর দিকে তাকালাম। যেদিক থেকে ওর গলা শুনছিলাম। সেখানে কিছুই নেই! শুধু বৃষ্টিভেজা অন্ধকারে তার আবছা আভাস। সেও কি এই রকমই ছিল? শুধু একটা আভাস, কিন্তু ভালো করে দেখা যায় না?
হঠাৎ মুরলীধরের আওয়াজে চমকে উঠলাম।
"একটা কথা জিজ্ঞেস করি, বাবুজি? আপনার কি কেউ পিছনে আছে?"
"পিছনে?"
"মানে...যেখান থেকে আপনি এসেছেন--সেখানে কেউ, যে আপনার উপর নির্ভর করে?"
"না। কেন জিজ্ঞেস করছ?"
"এইজন্য যে, কেউ যদি না থাকে তো আপনি এখানেই থেকে যান না?"
"তাইতো আছি, এখানেই।"
"না, মানে বরাবরের জন্য।"
সে কি একটু বেশি ড্রিঙ্ক করে ফেলেছে? কিন্তু তার প্রশ্নে কোন চাতুরি ছিল না। শুধু সরল, শিশুসুলভ জিজ্ঞাসা।
"কেউ কি চিরকাল থাকতে পারে?"
"আপনি চান না?"
"তাতে কী লাভ?"
"আপনি জানেন না...অনেক লাভ! আপনি এখন তার ধারণাও করতে পারবেন না।" আমার মনে হল, অন্ধকারে তার চোখ আমার উপর স্থির, অন্য কোন অন্ধকার ভেদ করছে, যা আমার দৃষ্টির বাইরে।
বাইরে বৃষ্টি একটু ধরে এসেছিল। কিন্তু ডালপালা থেকে টপটপ এখনও শোনা যাচ্ছিল।
"আপনার দারুটা ঠিক ওষুধের মতো। সব ব্যথা গায়েব!"
আমি বুঝলাম সে কী চায়। আমারও ইচ্ছা সে আরও একটু বসে যায় আমার সঙ্গে। এই বর্ষাভরা সন্ধেয় একলা ঘরে আমি ওর কথাগুলোর সঙ্গে থাকতে চাইনি। সেই কথাগুলো এখনও হাওয়ায় ভাসছে, ও গেলেই আমার উপর ভেঙে পড়বে।
"আরও একটু নাও মুরলীধর। বৃষ্টিটা থামুক, তারপর যেও।"
সে কিছু বলল না। শুধু বুকের ভিতর থেকে একটু গুড়গুড় শব্দ বেরোল। আমি যখন গেলাসটা বাড়ালাম, সে আমার হাত ধরে ফেলল।
"ওদিকে দেখুন তো।" সে ইশারা করল।
আমি বুঝলাম না কী দেখাতে চাইছে, কিন্তু তাকালাম সেদিকে। শাদা কুয়াশার পিছনে আলো ভরা কটেজটা ঝিলমিল করছে...নিজের আলাদা দুনিয়ায়।
"দেখলেন তো বাবুজি?" সে আমার হাত ছেড়ে একটা লম্বা নেশালু শ্বাস ছাড়ল। "আপনি ভাবতে পারেন কে সেখানে? কে? সাহেব জী? আর যখন সে থাকবে না, তখন?"
"তখন কী?" আমার শরীরে এক শিহরন বয়ে গেল।
"আপনি কি ভাবেন বিটিয়া থাকবে এখানে?" সে হাসল, একটা ফুৎকারের মতো হাসি যা আমি আগে কখনো শুনিনি-- "যেমন আম্মাজী মাটির নীচে, তেমনি ওই বাড়িও মাটির নীচে চলে যাবে। তাই কি চান আপনি?"
এই প্রথম আমার একটু ভয় মতো মনে হল। ভয় ওকে নয় কিন্তু সেই অশরীরী কথাগুলো যা ভবিষ্যতের খোঁজে বেরিয়ে আসছে--পাহাড়ের ল্যান্ড স্লাইডের মতো, যার গুড়গুড় আওয়াজ প্রথমে শোনা যায়, ভাঙন, পতন, ধ্বংস, সব পরে শুরু হয়।
সে আর কিছু বলল না। এমন নয় যে ওর সব কথা শেষ, আসলে, যা বলা হয়নি তাও বিনা শব্দেই বোঝা যাচ্ছিল। কখন বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেছিল আমরা টেরও পেলাম না। ছেঁড়া তুলোর মতো মেঘের ফাঁকে ফাঁকে আকাশে তারা দেখা দিয়েছে। মুরলীধর চট করে উঠে পড়ল। যেন বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে ওর কথাও শেষ। "আমি চলি, বাবুজি..." কম্বলটা ঝেড়ে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে, ছাতা হাতে, লম্বা লম্বা পায়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমার মনে ছিল না মুরলীধর কী বলছিল। এও মনে ছিল না যে আমি সেই রকমই, যেমন একটু আগে বসেছিলাম। মনে হচ্ছিল যেমন পরিষ্কার মেঘ আর তারার আলোয় এই সৃষ্টি তার পুরনো চেনা আকার ছেড়ে এক নতুন অবতার হয়ে নেমেছে। তার রূপ একই রকম থাকে কিন্তু পরিচয় বদলে যায়। মানুষেরও কি এমন হয় যখন আমরা পরিচিত পৃথিবীর আকার ছেড়ে মৃত্যুর ওপারে পা দিই?
অধ্যায়-১.১০
পরদিন আকাশে মেঘের চিহ্নও রইল না। ঝকঝকে সোনালি রোদে সারা জঙ্গল উজ্জ্বল। পাতার ফাঁকে ফাঁকে রোদ ঠিকরে পড়ছে। দুপুর পার না হতেই মুরলীধরের ছেলে বংশী তার কালী কুকুর নিয়ে সোজা আমার কুঠিতে দরজা খটখট করল।
"আপনাকে ডেকেছেন...তাড়াতাড়ি," সে হাসল, "মেম সাহেব এসেছেন!"
বলেই সে পিছন ফিরে ছুট। কালী একটু হতাশ হল, সে আমার সঙ্গে খেলতে চেয়েছিল কিন্তু বংশীকে ছুটতে দেখে সেও জিভ বার করে পিছন পিছন দৌড় লাগাল।
অ্যানার আগমন একটা ঘটনা বটে। অন্য কোনও দিন হলে তার আসাটা একটা উৎসবের মতো হত। একটা আলাদা রোদ, হালকা উত্তাপ তার সঙ্গে আসত। কিন্তু সেদিন তার আসাটা অন্যরকম ছিল। গতরাতে মুরলীধরের কথাগুলো... সে কি আমার মনের ভুল?... তার হঠাৎ আসার সঙ্গে একটু ভয় ধরিয়ে দিল।
কতদিন বাদে তাকে তার কুঠির বাইরে আসতে দেখলাম। সে ইজি চেয়ারে একটা সাজগোজ করা পুতুলের মতো বসে ছিল। পরনে হলদে রঙের লম্বা উল স্কার্ট, গলায় কালো ফুটকি দেওয়া সাদা মাফলার, মুখে হালকা পাউডার, আর ঠোঁটে গোলাপি লিপস্টিক। মাথার সাদা চুলে বাঁধা স্কার্ফ, চওড়া মুখে ম্যাপের নদীর মতো বলিরেখা। আমাকে প্রথমে খেয়ালই করেনি, চায়ের পেয়ালায় ডুবিয়ে ডুবিয়ে বিস্কুট খাচ্ছিল। তিয়া পাশে টুলে বসে ছিল আর স্কার্ট থেকে বিস্কুটের গুঁড়োগুলো রুমাল দিয়ে ঝেড়ে দিচ্ছিল।
এটা কি একটা ছবি না স্মৃতি? না পোরট্রেট, যাতে আমিও বসে আছি, পাশে সোফায় অর্ধশায়িত হয়ে মেহরা সাহেব। তিনিই আমাকে সবার আগে দেখেছিলেন, মুখে তৃপ্তির হাসি, যেন এইবার ছবিটা সম্পূর্ণ হল। তিনি আমার দিকে একটু ঝুঁকলেন, কিছু বলতে না শুধু আমার উপস্থিতিটা স্বীকার করতে-- আমি তাঁর বুকে ঘরঘর শ্বাস শুনতে পেলাম।
আমি আস্তে করে তাঁর হাঁটুর উপর আমার হাত রাখলাম।
আমার এই ছোট্ট ইশারাটা সারা ছবির শান্ত জলে ঢেউ তুলে দিল। তিয়া মুখ তুলে আমায় এক পলক দেখেই মুখ নামিয়ে নিল। কিন্তু ওই এক পলকেই কোন আন্দোলন ছিল যাতে অ্যানা কথা বন্ধ করে আমার দিকে তাকাল। এক মুহূর্ত চিনতে পারল না, তারপর "তুমি এসে গেছ?" সে হাসছিল, তার নীল চোখে আমার ছবি, সে আশ্বস্ত হল। চিনতে পেরেছে, আমি তারই লোক। কথাবার্তা আবার আরম্ভ হল।
আমার এখন আর মনে নেই, সেদিন অ্যানা কী বলছিল। শুধু মনে আছে আমরা সবাই তার কথার ঘেরাটোপে বসে, তার উত্তাপে হাত সেঁকছিলাম। জানলার পর্দা খোলা, দেয়ালে ডালপালার ছায়া, নীচে ফায়ারপ্লেসে জ্বালানি কাঠ মজুদ, কিন্তু মুরলীধর তখনো জ্বালায়নি। ইলেকট্রিক বাল্বের আশপাশে পতঙ্গের গুনগুন, নীচে মেঝের উপর তাদের ভস্মীভূত দেহ, গরম বাল্বে ধাক্কা খেয়ে পুড়ে মরে।
তিয়া আমার কাঁধে চাপ দিতেই আমার মনোযোগ ফিরল, "অ্যানাজী আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করছেন..."
আমি যেন ঘুম ভেঙে উঠলাম।
"আপনি কিছু বলছেন আমায়, অ্যানাজী?"
"হ্যাঁ, তোমাকে না তো কাকে? তিয়া এতদিন হল এসেছে, তুমি তার জন্য কী করেছ?"
"কী করার ছিল?"
"বেচারাকে দিয়ে নালা থেকে জল আনানো, আর কি?"
মেহরা সাহেব হাসতে শুরু করলেন।
"আমি রোজ আমার বারান্দা থেকে তোমাদের ওঠানামা দেখতাম। এই করার জন্য বুঝি ওকে এখানে ডাকা হয়েছে?"
"অ্যানাজী, এসব তো কিছুই না" তিয়া হাসতে হাসতে বলল, "যখন আমি ছোট ছিলাম, আপনি আমায় বিছানা থেকে টেনে তারাজীর মন্দিরে নিয়ে যেতেন, মনে আছে?"
"তারা দেবী?" অ্যানার প্রাচীন চোখে কোন পুরনো স্বপ্ন ভেসে এল। "সে এক দেবী ছিল বটে! ওর দিকে তাকালেই আমার মনে হত সেও আমাকে দেখছে। তার চোখের গর্তে নীল পাথর দুটো চমকাত। তাকে দেখলেই আমার বুড়ি দাদির কথা মনে পড়ত--নীল পাথুরে চোখ। আমি ভাবতাম হয়তো সে জার্মানি থেকে উড়ে এখানে চলে এসেছে। তোমার মনে আছে সেই বঙ্গালী বাবা? যে তোমাকে প্রসাদ দিত?"
"সে তো অনেক আগেই মারা গেছে। তার নাতি এখন পুরোহিত।"
"মারা গেছে? কবে? তুমি আমায় বলোনি তো ?"
"আমি এখানে ছিলাম না, অ্যানাজী।"
"কিন্তু আমি তো ছিলাম। কেউ তো আমায় বলতে পারত!"
তার গলাটা রুদ্ধ, যেন কেউ তাকে বড়োরকম ধোঁকা দিয়েছে। তিয়া নালিশের মুখ করে তার বাপের দিকে তাকাল, মেহরা সাহেব দেয়ালে কিছু একটা দেখছিলেন।
প্রসঙ্গ পালটাতে তিয়া বলল, "প্রসাদ অনেকক্ষণ পরে পাওয়া যেত। আমায় বলত, প্রথমে দেবীর পরিক্রমা করো। আমি যখন জিজ্ঞেস করি পরিক্রমা কী, সে হাত ঘুরিয়ে দেখাত রাউণ্ড অ্যান্ড রাউণ্ড... সাতবার ঘোরার পর আমায় কাঁধে তুলে ঘণ্টা বাজাত... শেষ ঘণ্টার প্রতিধ্বনি শুনে বলত, শুনলে? এটা তারা দেবীর আওয়াজ...বলছে মুন্নিকে প্রসাদ দাও, ও অনেকক্ষণ ধরে ঘণ্টি বাজিয়ে আমায় ডাকছে... আমি ভাবতাম সে সত্যি বলছে, বুঝতাম না যে এসব খেলার জন্য বলা।"
"খেলা কোথায়, পাগলি?" অ্যানার মুখ গম্ভীর, "সে তো সত্যি বলছিল। আমিও তো ঘণ্টা শুনেই প্রথমবার মন্দিরে গেছিলাম। সেদিন না গেলে তোমাদের সামনে আজ অ্যানা বসে থাকত না।"
"কী বলছেন, অ্যানা জী?"
"যা বলছি ঠিকই বলছি ... সেই সময় আমার মনে হত সারা শহর আমায় গিলে ফেলবে, নিজেকে শাপ দিতাম, কী করে এই শহরে এলাম... ডক্টর সিং আমায় ডিপ্রেশনের ওষুধ দিচ্ছিল কিন্তু কিছু ফল হচ্ছিল না। একদিন বিকেলে যখন ওর ক্লিনিকে গেলাম, সে আমায় চুপ করে অনেকক্ষণ দেখল যেন কিছু দেখছে যা আগে ছিল না।"
সারা ঘর চুপ।
"কী দেখেছিল আপনার শরীরে?" মেহরা সাহেবের গলা শোনা গেল। তিনি সোফায় উঠে বসেছিলেন। টেবিল ল্যাম্পের আলো তাঁর কুঁকড়ানো শরীরে পড়ছিল।
"তা আমি জানি না--কিন্তু কিছু নিশ্চয়ই দেখেছিল। আমার কাঁপা-কাঁপা হাত ধরে বলল-- "অ্যানা, তুমি কি জার্মানি ফিরতে চাও?”
"জার্মানি? আমার মনে হল সে আমায় এক থাপ্পড় কষিয়েছে ! আমি হাত ছাড়িয়ে নিলাম। আর কিছু না বলে সোজা বেরিয়ে এলাম।"
সে চুপ করে রইল। একটু পরে মুচকি হেসে তিয়ার দিকে তাকাল, "আমি কী বলছিলাম?"
"তারা দেবী?"
"ও হ্যাঁ! দেবীর ঘণ্টা।" অ্যানার নীল চোখদুটো সিরিয়াস। "না সেই বাবা গল্প বলছিল না। ঘণ্টার শব্দ শুনে তারা দেবী যেখানেই থাকুন, তক্ষুনি নেমে আসেন। এমনই হয়। আমি নিজেও দেখেছি। সেদিন ডক্টরের ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে আমার মনে হল আমি একটা কুয়াশার মধ্যে দিয়ে চলছি। আমি চলছিলাম কিন্তু জানতাম না কোথায়। দূরে একটা ঘণ্টার আওয়াজ শুনলাম। যেন আমায় কাছে ডাকছে, ঠিক যেরকম ছোটবেলায় দাদির হাত ধরে চার্চে যেতাম ঘণ্টা শুনে...হঠাৎ দেখি সামনে সাদা মার্বেলের সিঁড়ি, উপরে অন্ধকারের মধ্যে একটা আলো। আমি সিঁড়ি চড়তে শুরু করলাম, যত উপরে উঠি আলোটা বড়ো হতে থাকে...তারপর দেখি আমি মন্দিরের দরজায়! অন্য দিন হলে আমি ভিতরে যেতাম না কিন্তু সেদিন ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে আমার ভিতরটা অবশ লাগছিল। কিছু না ভেবেই আমি ঢুকে পড়লাম। ভিতরে আরতির পর লোকেরা বেরিয়ে আসছিল, প্রত্যেকে বেরুবার সময় দরজার উপর ঘণ্টাটা বাজিয়ে দিচ্ছিল। আমি এক কোণে লুকিয়ে দাঁড়ালাম। যখন সবাই বেরিয়ে গেছে আমিও ভিতরে ঢুকলাম... চোখ তুলে দেখি ঠিক যেন আমার দাদি বসে আছে... ধূপ, চন্দন, কর্পূর মাখা, ধোঁয়ায় ঢাকা, উঁচু সিংহাসনের উপর...আমার দিকে স্নেহ ভরে তাকিয়ে, যেন সে জীবিত আর আমি ছোট্ট মেয়ে ... আমি মন্দিরের চৌকাঠে বসে কাঁদতে শুরু করলাম। আমার মনে হল আমার ভিতরে একটা বিরাট ফোঁড়া ফেটে গেছে...কে জানে কতদিন ধরে সেটা পাকছিল।"
অ্যানার গলা একটু কেঁপে গিয়ে থামল। একটু পরে আবার যখন বলতে শুরু করল, তখন ওর গলা একেবারে স্বাভাবিক।
“আমার মনে নেই কতক্ষণ মন্দিরের দোরগোড়ায় বসে কেঁদেছিলাম। এও মনে নেই আমি সত্যিই কাঁদছিলাম না বাইরে থেকে নিজের কান্নার শব্দ শুনছিলাম। জীবনে কখনো কখনো নিজেকে বাইরে থেকে দেখবার সুযোগ আসে। নিজের শরীর, নিজের কান্না। তাই যখন কাঁধে একটা হাতের ছোঁয়া পেলাম, আমি ভাবিনি যে আমার ও আমার মধ্যে তৃতীয় আরেক জন আসতে পারে। কিন্তু সে আমার কাঁধ নাড়াল, আস্তে করে আমার মুখ তুলে ধরল, আর কান্নার ভিতর দিয়েই আমি একটি শান্ত, শালীন মুখ দেখলাম... যাকে আমি আগে কখনো দেখিনি--
"আমার সামনে তোমার চাচী দাঁড়িয়েছিল!"
"দিভা?" মেহরা সাহেবের নিঃশ্বাসের সঙ্গে নামটা ছিটকে বেরোল।
অ্যানার মুখে এই নামটা এতই অপ্রত্যাশিত ছিল যে প্রথম মুহূর্তে একটা বাদুড়ের মতো নামটা আমাদের সবাইকে ছুঁয়ে উড়ে বেরিয়ে গেল। একটা ঠাণ্ডা শিহরন, পরমুহূর্তেই নামটা ফিরে এল এক সজীব শরীর নিয়ে, "সে কি সত্যিই চাচী ছিল?" তিয়া উৎসুক।
অ্যানা তিয়ার দিকে চেয়ে এক অদ্ভুত হাসি হাসল, "জঙ্গলের তারা দেবী আর আমার জার্মান দাদির মাঝখানে সে ছাড়া আর কে হতে পারে? হয়তো এক কোণে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছিল, আমার কান্না শুনছিল, আমার কাঁধে নাড়া দিচ্ছিল। আমি শুধোলাম, "আপনি কে? তো হেসে বলল, ‘আমি আপনার কটেজের ঠিক নীচে থাকি। আমার মেয়ে আপনাকে চেনে।‘” "আপনার মেয়ে? আমি আরও অবাক। ‘হ্যাঁ। আপনি তাকে টফি দেন।’ তখন মনে পড়ল। আমি জানতাম না এইভাবে তোমার মার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হবে--মন্দিরের প্রাঙ্গণে, বাচ্চার মতো কাঁদবার সময়।"
কিছুক্ষণ আমরা নিস্তব্ধ। আমার মনে হল কেউ এসে চুপ করে আমাদের মাঝখানে বসে পড়েছে। আমরা সবাই তাকে নিজের নিজের জায়গায় দেখছি, তার নিজস্ব জায়গাটি খালিই পড়ে আছে... মরার পরেও মানুষ কত লোকের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়!
"কিন্তু দিভা... সে তো কোনোদিন মন্দিরে যায়নি।" মেহরা সাহেব অবিশ্বাসের সুরে বললেন।
"সে হয়তো সেদিন এমনিই চলে গেছিল। যেমন আমি গেছিলাম। কে জানে ঘণ্টার শব্দ কাকে ডাক দেয়? আমাকে কে টেনে নিয়ে গেছিল? দিভা না দেবী, তাতে কী এসে যায়?”
মেহরা সাহেব শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, "আমি এখানে এতদিন আছি, তারা দেবীর কোনো মন্দিরের নাম এই প্রথম শুনলাম। তুমি দেখেছো?" তিনি আমার দিকে তাকালেন।
"আমি পাশ দিয়ে গেছি কিন্তু ভিতরে যাইনি।"
"চলো, একদিন পিকনিক করতে যাব।" অ্যানা খুশি মুখে তালি বাজাল। এটা তার পুরনো অভ্যাস। কোন কিছুতে মজা পেলে সে তালি বাজিয়ে তা প্রকাশ করে। "ডক্টর সিং-কেও তলব পাঠাব। সে আসবে সেন্ট সেবাস্তিয়ানকে নিয়ে, আমি আর অত দূর হাঁটতে পারব না, দেবী যতই ঘণ্টা বাজান না কেন।"
"কবে যাওয়া ঠিক হবে?" মেহরা সাহেবের গলায় এক নতুন উৎসাহ, যেন নিজের বয়স ভুলে আবার পুরনো যৌবনে ফিরে যেতে চান।
"তুমি বলো না--" অ্যানা তিয়াকে বলল, সে এতক্ষণ চুপ করে সবাইয়ের কথা শুনছিল, "কী হল?"
"এবার আমায় মাফ করবেন অ্যানাজী। আমায় তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। ছুটি কবেই ফুরিয়ে গেছে। আপনারা সবাই যান না।"
অ্যানার মুখের আলো নিভে গেল।
"তুমিও বেশ তো! এসব তো তোমার আসার আনন্দেই করা হচ্ছে। আমরা তো এখানে বারোমাসই থাকি।"
কিছুক্ষণ আবার সবাই নীরব। তারপর মেহরা সাহেবের গলা শোনা গেল। "একথা তুমি আমায় আগে বলোনি তো।"
"তুমি তো জানোই, এইসময় আমার কত কাজ।"
"তাহলে তুমি না এলেই পারতে।"
মেহরা সাহেব সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখে একটু আগের উৎসাহের চিহ্নও নেই। ধীর পায়ে, কারুর দিকে না তাকিয়ে তিনি নিজের ঘরে চলে গেলেন।
তিয়া উঠতে গিয়েও উঠল না। শুধু দরজার দিকে চেয়ে রইল। ঘন নিঃশব্দে শুধু ঝিঁঝিঁর ডাক শোনা যাচ্ছিল, আর আমাদের নিঃশ্বাসের শব্দ।
"তিয়া, তুমি কি আরও কয়েকটা দিন থেকে যেতে পারো না? ওর জন্য?" অ্যানার গলায় মিনতি।
"ওর জন্য?" তিয়ার গলা ভারী, "ও-ই সবকিছু নয়, অ্যানাজী।"
"এ তোমার জেদ, আর কিছু না।"
তিয়া শুকনো হাসি হাসল, যেমন লোকে নিজের উপর হাসে, "আমার জেদ হত তো আমি এখানে কখনোই আসতাম না। তাকে অন্যের হাতে ছেড়ে দিতাম।"
"অন্য? কে অন্য?"
"আপনি, এ, আর সেই চাচী যে এখান থেকে চলে গেছে... তার কি কোন দায়িত্ব নেই, কাউকে পিছনে ছেড়ে যাওয়ার?"
"কী বলছ তিয়া? তোমার কি মাথা খারাপ হল?"
তিয়া উঠে জানলার কাছে গেল ...তার কাঁধের উপর খোঁপাটা আলগা হয়ে গেছিল। জানলার কাঁচে তার ক্ষীণ শরীরের ছায়া, যেন সে ভিতরেও আছে আর বাইরেও।
"আমার মাথা ঠিক আছে অ্যানাজী ...এতই ঠিক যে ভেবে পাই না আমি কেন এখানে? কেন বার বার ফিরে আসি?"
"কী বলছ? এটা তোমার ঘর। তুমি এখানে আসবে না তো কোথায় যাবে?"
"আমার ঘর?" তিয়া জানলা থেকে ফিরে অ্যানার সামনে দাঁড়ালো। "কীরকম ঘর এটা?" সে হাসল, "আপনি তো জানেন, আমি কীভাবে এখানে এসেছিলাম। আমায় কেউ এখানে ডাকেনি... আমি কারুর আওয়াজ শুনিনি... আমি নিজেকে অন্যের ঘরের সিঁড়ির উপর পেয়েছিলাম... একে আপনি আমার ঘর বলেন?"
সে হাঁটু মুড়ে সেখানেই বসে পড়ল, অ্যানার চেয়ারের হাতলে মাথা ঠেকিয়ে। খোঁপা খুলে চুল এলিয়ে পড়ল। অ্যানা তার নীল পাথুরে চোখে তাকে দেখছিল...তারপর আস্তে আস্তে তার শুকনো আঙুল তিয়ার মাথায় বুলিয়ে দিতে লাগল। সময় কেমন তার দিক বদলে দেয়... যন্ত্রণার দুই কূলের মাঝে উল্টো দিকে বইতে শুরু করে। সেই দিন ওদের দেখতে দেখতে আমার মনে পড়ল যখন তিয়ার জায়গায় অ্যানা মন্দিরে মাটিতে বসেছিল আর তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল সে যে এখন কবরের মাটিতে মিশে গেছে। এইরকমই কি হয় আর আমরা ভুল করে ভাবি যে আমাদের সাথে এই প্রথম হচ্ছে?
"বড্ড দেরি হয়ে গেছে। আমি চলি।" অ্যানা উঠে দাঁড়াল। কিন্তু তিয়া তখনো মাটিতে বসে, নিশ্চল শরীরে। অ্যানা ধীর পায়ে দরজা পর্যন্ত গিয়ে আমার দিকে ফিরল, "আমার সঙ্গে আসবে?"
বাইরে মুরলীধর আগে থেকেই লন্ঠন নিয়ে খাড়া। উপরে আকাশে একটা দুটো তারা। হালকা হাওয়া ঘুমন্ত গাছের পাতাগুলো নাড়িয়ে যাচ্ছে। আমরা দুপা এগোতেই পিছন থেকে তিয়ার গলা শোনা গেল। মুরলীধর দৌড়ে ঘরে ফিরে গেল আর আমরা আকাশ, তারা, মেঘের নীচে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু পরে টর্চ নিয়ে তিয়াকে আসতে দেখলাম। সে টর্চটা আমার হাতে ধরিয়ে অ্যানার হাত ধরে নিল, "চলুন...দাঁড়িয়ে আছেন কেন?"
এটাও কি ছবির আরেকটা দিক? যা স্থির থেকেও চলমান। এক চলমান স্টিল লাইফ যার চারদিকে জঙ্গলের গন্ধ। আমরা তিনজনে গাছে ঢাকা পাকদণ্ডী দিয়ে চলছিলাম। আমি আগে আগে টর্চ হাতে, তারা দুজনে আমার পিছনে তাদের ছায়ার সঙ্গে সঙ্গে। দু-একটা পাখি আমাদের মাথার উপর ডানা ঝাপটিয়ে ওড়ে, তাদের পাখার উষ্ণ হাওয়া আমাদের ছুঁয়ে যায়।
রাস্তার একপাশে লোহার রেলিংএর সামনে একটা ছোট বেঞ্চিতে অ্যানা দম নিতে বসলে আমি আর তিয়া রেলিং ধরে নিচে উপত্যকায় গ্রামের ঘরগুলো দেখছিলাম... সেখানে ছোটছোট আলোগুলি নীরব, নিমগ্ন, উপরের আকাশের তারার মতোই।
"শোনো।"
অ্যানার গলা শোনা গেল। আমাকে নয়, যাকে ডাকছিল সে তাড়াতাড়ি বেঞ্চের কাছে চলে এল। অ্যানা তার হাত টেনে পাশে বসিয়ে নিচু স্বরে কিছু বলছিল। আমি শুনতে পাচ্ছিলাম না। শব্দগুলো আমার কানে পৌঁছোবার আগেই জঙ্গলের ফিসফিসানিতে মিশে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ কোন শব্দ না পেয়ে আমি ভয় পেয়ে তাদের কাছে এলাম-- দেখলাম তিয়ার মাথা অ্যানার কোলে, আর অ্যানার ক্লান্ত চোখদুটো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে।
আমরা নীরবে চলা শুরু করলাম। ফটকের কাছে এসে পুস্কির ডাক শুনতে পেলাম, মালিক কাছে আসার আগেই তার চেনা পায়ের শব্দ পেয়ে গেছিল। বন্ধ গেটের ওপাশে দাঁড়িয়ে কে জানে কতক্ষণ সে অপেক্ষা করছিল। অ্যানা তার মুখে চুমো দিল, তারপর তিয়াকে জড়িয়ে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। শেষে গেট খুলে আমাদের বলল, "তোমরা চলে যাও, আমি এখন যেতে পারব।"
কিন্তু সে দাঁড়িয়ে রইল আরও কিছুক্ষণ, আমরাও দাঁড়িয়ে রইলাম-- পুস্কির অধীর ডাক ছাড়া আর কোন শব্দ ছিল না। তারপর সে বাড়ির দিকে ফিরে যেতে আমরা নীচে নামতে শুরু করলাম।
কিছুক্ষণ চুপচাপ চলছি। অন্ধকারে আকাশের তারাগুলি আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। পায়ের তলায় শুকনো পাতার মচমচ শব্দ। চলার সময় কখনো কখনো ওর কাপড় বা হাত আমায় আলতোভাবে ছুঁয়ে যায়। আর আমার মনে হয় সে এখানে, এই মুহূর্তে, আমার সঙ্গে হাঁটছে। তখুনি আমার মনে আসে গত চল্লিশ বছরের জীবন, যে বন্য জন্তুর মতো, কারুর পায়ের শব্দে সতর্ক খাড়া হয়ে ওঠে, আমাকে খেয়াল করায়--সেও আকাশের তারাগুলির মতো আমাদের সাথে সাথে চলছে, কখনো এক পা এগিয়ে যায়-- ভবিষ্যের অন্ধকার খাদের কিনারায়, যেখানে টর্চের আলোটা তার পায়ের ঠিক সামনে। অতীতও কি এমনি ভাবেই ছিটকে অন্য কোথাও চলে যায়, যার খোঁজ পাওয়া যায় অনেক, অনেক পরে...?
কিন্তু সে-রাতে নয়। সে রাতে আমার এও মনে ছিল না যে আমার সঙ্গে কে চলছে। খেয়াল হল যখন আমার কুঠির সামনে এসে গেছি।
হঠাৎ আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। সে টর্চটা সোজা আমার মুখে ফেলেছে, "কী হল আপনার?"
সে আমার সামনে এসে আমাকে দেখছে, হায়, আমিও যদি তার চোখে নিজেকে দেখতে পেতাম।
"আমায় মাফ করবেন, জানি না তখন আমার কীরকম হয়ে গেছিল।" সে শান্ত স্বরে বলল।
আমি বিমূঢ় হয়ে ওর দিকে তাকিয়েছিলাম।
"চলুন না, আপনার দেরি না হলে একটু বেড়িয়ে আসি?"
সে টর্চ নিভিয়ে, আমার কুঠির দিকে না গিয়ে তারার ফিকে হলুদ আলোয় সোজা চলতে শুরু করল। আমার ভিতরে ঘূর্ণিঝড়টা আস্তে আস্তে থামতে লাগল, শুধু একটা স্তব্ধতা, যা আমার নিজের পায়ের শব্দে সচকিত হচ্ছিল।
আমরা যখন অন্য কারুর অতীতে উঁকি দিই, আমাদের অন্য কোনো মুখ চোখে পড়ে। এ কোন তিয়া, যে আমার সঙ্গে চলছে? যে বকবক করতে করতে আমার সঙ্গে ঝরনার জল তুলতে যেত? না, যে একটু আগে অ্যানা ও মেহরা সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করছিল? সবকিছু ভুলে সে এক অন্য অতীতে চলে গেছিল, যার কথা কেউ বলতে চায় না ...আর আমিও জানি না... সে আমার সঙ্গে, কিন্তু নিজের মধ্যে, তারার ছায়ায় মগ্ন।
আমরা কিছুদূর নীরব চলেছি। হঠাৎ ও থেমে আমার দিকে ফিরল। মুখে হাসি, যা দেখলে আমার কেমন ভয় করে।
"আপনাকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে। আসুন, একটু জিরিয়ে নিই।"
রাস্তার পাশে, ল্যাম্পপোস্টের নীচে একটা বেঞ্চি। সে আলগা হাতে আমার কনুই ছুঁয়ে বসে পড়ল।
সামনে একটা পুরনো কনভেন্ট স্কুলের খেলার মাঠ। মাঝে একটা দোলনা, কাঠের স্লাইড, মেরি-গো-রাউণ্ড-এর চাকা, ব্যাডমিন্টনের নেট হাওয়ায় একটু একটু দুলছে।
"কী ভাবছেন?"
"আপনি যখন নিজের মার কথা বলেন, আমার শুধু দিভাজীকেই মনে পড়ে। ভাবতেই পারি না আর কারুর সঙ্গে আপনার সম্বন্ধ আছে।"
সে একটু চুপ করে রইল। তারপর কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বলল, "সম্পর্ক এমনি হয় না, তৈরি করতে হয়। ফোঁড়াটা ফুলে না ওঠা পর্যন্ত জানা যায় না কতটা পেকেছে... এত বছর হয়ে গেল, আমি জানিই না সে কোথায় আছে।"
আমি অবাক হয়ে তাকালাম, "আপনি কোনও খবর নেননি?"
"আমি খুব ছোট ছিলাম যখন আমাদের ছেড়ে চলে গেছিল। কাউকে কিছু বলে যায়নি।"
"মেহরা সাহেবকেও না?"
"সে তো অনেক আগে থেকেই আলাদা হয়ে গেছিল, যখন দিভার সঙ্গে থাকতে শুরু করে।" একটা অচেনা হাসি তার মুখে দেখা দিল, "এখনও যখন আমি আশপাশের গাঁয়ে ওষুধ বিলি করতে যাই, ভাবি হয়তো দেখা হবে তার সঙ্গে।"
একটুক্ষণ আমরা কুশায়ায় ঢাকা পাহাড়ের উপর টিমটিমে আলোগুলোর দিকে চেয়ে রইলাম।
"দিভা কিছু জানতেন না?"
"জানত নিশ্চয়ই, কিন্তু কী করার ছিল? আমার মনে হয় ও ভিতরে চেপে রাখত, ওই ক্যান্সারের মতোই ওটাও ভিতরে ভিতরে পেকে উঠেছিল। জানি না সে কী চাইত।"
"আপনাকে," আমি তাকালাম তার দিকে, "আপনি জানেন না?"
সে বেঞ্চের উপর একটা সাদা মূর্তির মতো নিশ্চল বসে ছিল। আধো কুয়াশা, আধো চাঁদের আলোয় এক অদ্ভুত হাসি ওর ঠোঁটে খেলা করছিল।
"আপনি কী করে জানলেন?"
"সে যখনই আপনার কথা বলত, মনে হত... কোনো একটা খুব দামি, ভঙ্গুর জিনিশের কথা বলছে... খুব সাবধানে, যত্ন করে, যাতে ভেঙে না যায়..."
"আমার উপর বিশ্বাস ছিল না। আমাকে ভয় করত।"
"কী রকম ভয়?"
সে খুব সহজেই বেঞ্চিতে রাখা আমার হাতের উপর নিজের হাত রাখল। "যখন আপনি কাউকে খুব চান... সেই রকম ভয়।"
তার শীতল হাতের নীচে আমার হাত, নিশ্চল।
"মেহরা সাহেবও আপনাকে খুব ভয় করেন।" আমি বললাম।
"সে অন্য রকম... তাকে আমিও ভয় পাই।" সে হাসল, "তাইতো এখানে বেশি দিন থাকতে পারি না।" তার গলায় একটু দুঃখ, হাসির মধ্যেও শোনা যাচ্ছিল। "কিন্তু এখন আপনি এখানে, আমার আর আগের মতো চিন্তা হয় না।"
আমার ভিতরের বোঝাটা বাড়ছিল, "তার জায়গা কে নিতে পারে? সে যাবার পর থেকেই আমার মনে হয় আমি একটা ভুল জায়গায় এসে পড়েছি। জানি না এখানে কী করছি!"
সে হাতটা সরিয়ে বসে রইল। তার নীরবতা আমায় ধীর ধীরে গ্রাস করছিল। আমি নিশ্চয়ই কিছু ভুল বলেছি, আর এখন কথা ফেরত নেবার উপায় নেই। মানুষ যখন নিজের জীবনে অনিশ্চিত, অন্যের থেকেও এইরকম কষ্ট পায়।
"আপনি ঠিকই বলেছেন। এখন দিভা নেই তো আপনি যেখানে ইচ্ছা যেতে পারেন। কিন্তু সে আপনাকে যার জন্য ডেকেছিল, সে তো এখনও আছে। আপনি কি তাকে ছেড়ে যেতে পারেন?"
আমি চুপ করে রইলে সে হাসতে শুরু করল। আমার দিকে ঘুরে বসে বলল, "আপনি ভাবছেন আমি আপনাকে ব্ল্যাকমেল করছি, তাই না?"
তার হাসিতে আগের চাপা ভাবটা ধুয়ে গেছিল, কিন্তু একটু কাঁকর তখনো আটকে ছিল।
"সত্যি বলুন তো, আপনার এখানে থাকাটা কি খুবই অসহ্য মনে হয়?"
"না, এখানে থাকা নয়... যে কোনো জায়গায় থাকা... আমি নিজেকে তাই বলি, যেখানেই যাই, এই অবস্থাই হবে।"
"আপনার কোনো আলাদা কিছু মনে হয় না?"
"সে তো এখান থেকে যাওয়ার পরেই বোঝা যাবে।" আমি হেসে কথাটা এড়ালাম। কিন্তু জানতাম এটা হাসির নয়।
সেও তাই জানবার জন্য আমার দিকে তাকিয়েছিল।
"কিছুই কি নয়?" অস্পষ্ট শব্দগুলো মুখ থেকে ঝরেই মরে যাচ্ছিল।
"আপনি কিছু বললেন?"
সে উঠে দাঁড়াল, " চলুন, বাড়ি ফিরি...দেরি হয়ে যাচ্ছে।"
আমরা ফিরলাম। আমার শরীরের মধ্যে, একটা অচেনা গহ্বরে ধুকপুক শুনছিলাম, এই প্রথম। কিছু চাওয়ার ভয় কি শরীরের মধ্যে এমনি করেই বসন্তের কচিপাতার আন্দোলন তোলে? আলোর সব রং একসঙ্গে ঢেলে দেয়?
ভয়ের মাঝেই ফুটে ওঠে ফুল... যাকে আমি এই প্রথম আমার মরুভূমির মতো শূন্য জীবনে ফুটতে দেখলাম। সে কি তাকে সেই রাতের কুয়াশার ভিতর দিয়ে দেখতে পেয়েছিল? না নিজের ভাবনাতেই মগ্ন ছিল সে?
পরদিন সকাল হল নিয়মমাফিক, প্রতিদিনের মতোই। বালতির ঝনঝনানিতে ঘুম ভাঙার দরকার নেই। বৃষ্টির কারণে সব কলে, পাম্পে জলের গরগর আওয়াজ আমি বিছানা থেকেই শুনতে পাই। তবু মনে হল আরেকটা শব্দ--বাথরুম থেকে নয়, বাইরে দরজা থেকে আসছে। আমি চট করে পোশাক বদলে বেরিয়ে এলাম।
কেউ খুব আস্তে আস্তে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিল।
দরজা খুলে দেখি...মুরলীধর! আমি হাসলাম, "দেখেছ? আজ কি রকম জল এসেছে?"
"জী, দেখেছি।" বলে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
"কী হল? মুরলীধর?"
সে পকেট থেকে একটা দোমড়ানো চিরকুট আমার হাতে দিল, "ছোটবিবি পাঠিয়েছে।"
"কী এটা?" আমি ওর মুখে তাকালাম।
"দেখুন। যাবার আগে সে আমাকে দিয়ে গেল।"
"যাবার আগে...কোথায়?
"সে আজ সকালের বাসে চলে গেছে। আমি এইমাত্র তাকে বাস স্ট্যান্ডে ছেড়ে এলাম।"
আমি চিরকুট হাতে দাঁড়িয়ে রইলাম।
পরে ঘরে এসে খুলে দেখি শুধু চার লাইন লেখা। তার যাওয়ার খবর ঘরের আলোটাও মাঝরাস্তায় আটকে দিয়েছে। তাড়াহুড়োয় লেখা অক্ষরগুলোর পিছনে আমি তার গলা শুনতে পেলাম, যেন সে নিজেই পড়ে শোনাচ্ছে--
"আজ জল আসছে। যাওয়ার শুভ সময়। আমায় আর আপনাকে সকালে ওঠাতে আসতে হবে না। জানতাম না এই দিনটা কেমন কাটবে। আপনার উপর ভরসা, যখনই দরকার পড়ে, আপনি আমায় ডেকে পাঠাবেন। আশা করি দরকার পড়তে এখনও দেরি আছে। তারা দেবীর কাছে আমার হয়ে ক্ষমা চেয়ে নেবেন। আসছে বার নিশ্চয়ই যাব।"
তারপর আর কিছু লেখা নেই। শুধু তিয়ার নাম। এ কি তারই নাম, যার সঙ্গে গত রাত্রে চলতে চলতে আমার মনের ভিতরে সেই গোপন সাড়া শুনতে পেয়েছিলাম?
আমি বাইরে এলাম। কোর্টের উপর দুপুরের মলিন রোদ। দেওদার গাছগুলো কোন্ পুরনো রোদের স্বপ্নে দাঁড়িয়েছিল। নীচে ঝরনার কলধ্বনি। অন্য দিনে আমাদের বানরবাহিনী বাসন ঝনঝনিয়ে লাইন করে নীচে নামত। কিন্তু আজ পাকদণ্ডী বর্ষার জলে ধোয়া, হালকা মেঘ ঝরনার উপর আকাশে উড়ছে।
কাঁচা রোদ্দুরে ভেজা দিন... কারুর বিদায়ের পর আবহাওয়া ঠিক আগের মতো থাকে না। কিছু একটার অভাব রয়ে যায়। আমি হাঁটতে হাঁটতে থেমে যাই...যেন কেউ পিছন পিছন আসছে। পিছন ফিরে দেখি আমার পরিচিত বাড়িঘর পিছনে আসছে। আমি দাঁড়ালে তারাও দাঁড়িয়ে যায়। আমার জানলার পিছনে কেউ আমায় দেখে, হঠাৎ উড়ন্ত কুয়াশার আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। শুধু একটা পর্দার মতো দোলে, রোদ আর ছায়ায়।
আমি ভেবে আশ্চর্য হই যে এই শহর...আমি এখানে তিন বছর আছি। আমার আগের জীবনের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই। কিংবা ততটাই আছে যেমন থাকে শরীরের সঙ্গে পরনের কাপড়ের। বছরের পর বছর, কাপড়গুলো জীর্ণ হয়ে যায়, বুড়ো হয়ে যায় অথচ আমি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকি। ধীরে ধীরে আমার শরীর কফিনে ছাইয়ের মতো হয়ে যায়--দেখলে তখনো শরীরের আকার, কিন্তু হাতে নিলে একেবারে ছাই।
পা থামলে, চোখ তুলে দেখি আমি কবরস্থানের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। আমার পা দুটো আপনা আপনি পোষা কুকুরের মতো পুরনো স্মৃতি শুঁকতে শুঁকতে এখানে চলে এসেছে। পুরনো, উই খাওয়া কাঠের গেট, আধখোলা। পুরোটা খোলার দরকার পড়ল না। সামনেই চৌকো, সাদা পাথরের ফলকগুলি, চারপাশে ঘাসে ঘেরা। দূর থেকে বোঝা যায় না কোন ফলকের নীচে কে শুয়ে আছে, কার নাম কোথায় খোদাই করা, কোন নামের তলায় কার চেহারা লুকনো আছে।
চীর গাছের হলদে হয়ে যাওয়া পাতাগুলো এক কবর থেকে আরেক কবরে উড়ে যাচ্ছিল। আমি একটু সময় কোনো অচেনা নামের পাথরের উপর বসে শহরের শব্দ শুনছিলাম। নীচের কোন পাতাললোক থেকে শব্দটা উঠে আসছিল। কবরের উপর প্লেন গাছের ঘন সবুজ পাতার ছাউনি। এখানেই কোথাও তার কবর। কয়েক বছর আগে আমি তার পিছনে দাঁড়িয়েছিলাম। সে আমাকে দেখে হাসত... ঠিক প্রথম দিনের মতো... আমার হাত ধরে শুধোত, "তুমি এখনও এখানে?" আর আমি বলতাম, "মিসেস মেহরা, আপনিই যদি যাচ্ছেন তো আমায় এখানে ডাকলেন কেন?” তখনি বুঝলাম বাইরের এই সব কবরগুলো আমাদেরই মৃতদেহের। আমরা জীবনভর তাদের কথা শোনার প্রতীক্ষায় এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াই। আমরা জানতে পারি না যে তারা তাদের উত্তর অনেক আগেই আমাদের কাছে রেখে গেছে।
ধীরে ধীরে রোদ পড়ে এল। আকাশে আবার মেঘ। হাওয়ায় কবরের উপর লম্বা ঘাস আর ঝরাপাতার আন্দোলন।
বাড়ি ফেরার সময় বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে তিয়া এখানে নেই। আজ মেহরা সাহেবের সঙ্গে আমার কুঠির সামনে দিয়ে বেড়াতে বেরোবে না। সকালে বালতি বাজিয়ে আমায় জাগাবে না।
আমি কুঠির সামনে শূন্যমনে দাঁড়িয়ে রইলাম, যেমন দুপুরবেলা সিমেটেরির গেটের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম।