• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৬ | অক্টোবর ২০২৪ | উপন্যাস
    Share
  • অন্তিম অরণ্য (৩) : নির্মল ভার্মা
    translated from Hindi to Bengali by ছন্দা চট্টোপাধ্যায় বিউট্রা
    | | ৩

    অধ্যায় --১.৫

    দু মাইল উঁচু চড়াই, দম হারিয়ে ফেলি। শ্বাস নিতে একটুক্ষণ দাঁড়াই। চীর আর ওক গাছগুলো নীচে ফেলে এসেছি। এখানে শুধু দেওদার, হাওয়ায় মাথা নাড়াচ্ছে। অ্যানাকে এখন আমার হিংসে হচ্ছে। সে সাফ বলে দিল যাবে না আমার সঙ্গে, "নিরঞ্জনবাবুকে বলে দিয়ো, তুমি গেলে যাও, ঈশ্বর যখন ডাকবেন আমি একবারই উপরে যাব।" ঈশ্বর যে আমায় কবে ডাকবেন তা জানি না কিন্তু নিরঞ্জনবাবুর কোঠায় পৌঁছতে গিয়ে মনে হল হয়তো আর নীচে পৃথিবীতে নামতেই পারব না।

    নামার দরকারই বা কী?

    নিরঞ্জনবাবু না থাকলে আমি একলা এই নির্জনে থাকতে পারতাম কি? তবে, তিনি বছরে কদিনই বা থাকেন? চার-পাঁচ মাস বড় জোর... কিন্তু যখন থাকেন, একটা ভরসার খুঁটি হয়ে থাকেন। যেন আসন্ন শীতের হাত থেকে বাঁচবার জন্য একটা উষ্ণ কম্বল, যা গায়ে জড়ানো যায়, বিছানায় পেতে তার উপর শোওয়া যায়, দরকার হলে মুখো ঢেকে রাখা যায়। ... কাঁদবার জন্যও কি সেটা?

    আমি শুধু তাঁকে নিজের কাছে গচ্ছিত রাখতাম, যখন দরকার, তার থেকে কিছু বার করে নিতাম। বন্ধুত্বের নক্ষত্রখচিত ধন। কখনো কখনো, একটু-আধটু--বেঁচে থাকার উল্লাস, কাউকে ভালোবাসা, নিজের মৃত্যু... এসবের কি কোনো হিসেব রাখা যায়? সব পরীক্ষা ডিঙিয়ে আমরা এখন এই স্টেশনে পৌঁছেছি। যখন ইউনিভারসিটিতে ছিলাম, পরীক্ষার আগের ছুটির দিনগুলিকে 'তৈরির দিন' বলে ভাবতাম। এখন আর কিসের তৈরি? কিসের পরীক্ষা? আমার কথা নাহয় ছেড়েই দিলাম, কিন্তু নিরঞ্জনবাবু? সবাই ভেবেছিল তিনি ফিলসফিতে এম এ করার পর অনেক দূর যাবেন, অনেক উঁচু চূড়ায় পৌছবেন। উঠেওছিলেন অনেক উঁচুতে, কিন্তু সবাই যেমন ভেবেছিল ঠিক সেরকম নয়। পাঁচ হাজার ফুট উঁচুতে তিনি আপেলের বাগিচা বানাবেন তা কে জানত? তিনি নিজেও কি জানতেন?

    আমার থেকে বয়সে কয়েক বছর বড়ো হলেও সেটা কোনো বাধা ছিল না। প্রত্যেকবার দেখা শুরু হতো লাস্ট বিদায়ের শেষ দিন থেকে। মাঝের দিনগুলি শূন্যে মিলিয়ে যেত। মনে হতো তিনি ওইরকমই আছেন ...ইউনিভারসিটির লনে... যেখানে কুড়ি বছর আগে আমি তাঁকে কফি হাউসের সামনে ছেড়ে এসেছিলাম... তাঁর হাতে ছিল লাইব্রেরি থেকে আনা বইয়ের বান্ডিল। তখন কে জানত আমাদের পথ এতদূর সরে যাবে...আর আবার যখন দেখা হবে, একেবারেই অকস্মাৎ, এমন এক জায়গায়? যেটা না তাঁর, না আমার! কাগজে মিসেস মেহরার বিজ্ঞাপনটা না পড়লে তো আমি জানতেই পারতাম না যে সে এরকম একটা নির্জন জায়গায় আছে, যেখানে আমাকেও আসতে হবে। কে সে দেবতা যিনি যোগাযোগের ধাঁধার মধ্যে একে অন্যের হাত ধরিয়ে দেন?

    শেষ পর্যন্ত, হাঁফাতে হাঁফাতে পাহাড়ের মাথায় উঠে আসার পরে তাঁকে দেখতে পেলাম। আমার দিকে পিছন ফিরে একটা দোলনায় বসে মৃদু মৃদু দোল খাচ্ছেন। আমার পায়ের শব্দ শুনে দোলনা থামিয়ে পিছন ফিরে তাকালেন।

    "অ্যানা কোথায়?" আমার পিছনে ঝোপের দিকে তাকিয়ে শুধলেন, যেন অ্যানা ঝোপের পিছনেই লুকিয়ে আছে।

    "আমারই এই হাল, সে বেচারা তো একেবারেই উঠতে পারত না। ঐ ফাঁসিটা কার জন্য টাঙিয়েছেন?" আমি গাছ থেকে ঝোলানো দড়িটা এক টানে উপরে তুলে দিলাম। নিরঞ্জনবাবুর দাড়িটা হাওয়ায় ফুরফুর উড়ছিল।

    "এটা খুকির জন্য ঝুলিয়েছিলাম, তখন ও ছোট ছিল। এখন আমি এতে দুলি। ভিতরে এস।"

    "না। বাইরেই ভালো। এখানেই বসি একটু।"

    গাছের চারদিকে ইট দিয়ে বাঁধানো চাতাল। আমি সেখানেই বসে পড়লাম। একটু দূরেই টেবিল-চেয়ারে সজ্জিত তাঁর কটেজের বারান্দা। দরজার কাঁচে বিকেলের রোদ ঝলকাচ্ছে। ঢালু ছাত, চিমনী, জানলা সব আলোয় ঝলমল করছে। অন্ধকার নামার আগে রোদ্দুরের শেষ স্টেশন যেন তাঁর কটেজটা। কিন্তু আমরা যেখানে বসেছিলাম, সেখানে কিকর গাছের ছায়া তখনই এত ঘন হয়ে এসেছিল যে ডালপালার ফাঁক দিয়ে একটু একটু আলোর ফোঁটা চুঁইয়ে পড়ছিল শুধু। কিছু নড়ছিল না, কেবল দোলনাটা ছাড়া, আর তিনি তাতে চুপ করে বসেছিলেন।

    খানিকক্ষণ চুপচাপ। ভালোই হল, আমার হাঁফানিটা ধরে এসেছিল। এখন আমি ঠিকমতো কথা বলতে পারছি। সামনে লম্বা বিকেল, হয়তো বা রাতও ... যদি আমি থেকে যাই...

    "গেস্ট হাউসটা কোথায় বানিয়েছেন?" আমি জিজ্ঞেস করলাম।

    তিনি দোলনায় বসে... ঘুমোচ্ছিলেন কি?

    "দেখাব।" তিনি বললেন, "এখনো পুরোটা হয়নি, তবে থাকার মতো অবস্থায় আছে। একটু হাঁটতে হবে।"

    "এই আইডিয়াটা কোত্থেকে এল?... গেস্ট হাউসের?"

    "আমার না। বিজুর একটা স্কুল বানাবার ইচ্ছে ছিল। আপেলের বাগানটা তো তুমি দেখেছ, তার উপরের জমিটা... খালি পড়েছিল, শুধু ইট-পাথরে ভরতি...একটা কাঠের শেড ছিল, সেটা অনেক বছর থেকেই খালি।"

    "তো গেস্ট হাউসটা এল কোথা থেকে?"

    "ওই শেডটা দেখেই মাথায় এল।" তিনি হাসতে শুরু করলেন। "ওটা না থাকলে কারুর খেয়ালই হতো না যে ওখানে কিছু একটা তৈরি করা যায়।"

    "আর স্কুলটার কী হল?"

    তিনি চুপ করে দোলনায় বসে রইলেন। হাওয়ায় দড়িটা আস্তে আস্তে দুলছিল।

    "সে আর এখানে আসতে চায় না।"

    "আসতে চায় না, মানে?"

    "বলা মুশকিল, বোঝা আরও বেশি শক্ত।" একটু উদাস হাসির ছায়া পড়ল মুখে, “আমি তো ফিলসফি এমনিই ছেড়ে দিয়েছিলাম, সেটা যত দেয়, তার থেকে বেশি বাদ দিয়ে রাখে।"

    এবার আমিও চুপ। বন্ধুদের মধ্যে নীরবতার নিজস্ব মানে থাকে। কথার মধ্যে একটি যতি। আমরা তার মাঝেই শুনে নিই--যা মুখে বলা যায় না। একটা দীর্ঘশ্বাস -যা একটু হাত বুলিয়ে ফিরে যায়।

    "তবে কি এখানে একলাই থাকবেন?"

    "একলা কোথায়? আমি তো কয়েক মাস অন্তর আসি। আপেলের সীজন আর কতদিন চলে?"

    "স্কুল খোলার প্ল্যান বদলালেন কেন?"

    "কারণ, যার প্ল্যান, সে-ই যে ছেড়ে গেল।"

    আমি তাকিয়ে রইলাম। "বুঝলাম না।"

    তিনি আস্তে করে আমার কাঁধে হাত রাখলেন। "তুমি কি করে বুঝবে? তুমি এখানে এলে যখন সব কিছু শেষ হয়ে গিয়েছিল।" একটু পরে সহজ ভাবে বললেন, "মিসেস মেহরার এখানে খুব একা লাগত। তারই প্ল্যান ছিল একটা স্কুল খোলার। এই জায়গাটাও তার খুব পছন্দ ছিল। বিজুকে বলতে সেও হ্যাঁ বলল। পড়ানোর কাজ জয়পুরে যেমন, এখানেও তেমনি। এখানে আরও সুবিধা... আসা যাওয়ার ঝামেলা কম।"

    তিনি কিছুক্ষণ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলেন, "যে দিন মিসেস মেহরা স্কুলের প্রথম ইটটা বসালেন...সব্বাই এসেছিল। অ্যানা, ডক্টর সিং, মেহরা-সাহেব, ওদের মেয়ে তিয়াও হাসপাতালে ছুটি নিয়ে এসেছিল... এখানেই বসে সবাই পিকনিক করি ... সেদিন প্রথমবার আমি মিসেস মেহরাকে সুখী দেখেছিলাম... সত্যিকারের সুখ... তার এখানে থাকবার একটা সুন্দর কারণ জুটে গেল। তখন কে জানত তার শরীরের ভিতর কী রোগ বাসা বেঁধেছে। আশ্চর্য, না? সেদিন আমরা একটি অতিথিকে দেখতে পাইনি--সে তার ভিতরে লুকিয়ে ছিল, যার সঙ্গে তাকে চলে যেতে হয়েছে।"

    আমি একটু শিউরে উঠলাম... মৃত্যু, সে কি এইভাবেই আসে? অতিথিদের মধ্যে লুকিয়ে বসে হাসে? তিনি আমার কাঁপুনি দেখে বললেন, "ভিতরে চলো, ঠান্ডা লাগছে নিশ্চয়ই?"

    "না, ঠান্ডা কোথায়? এই ভালো। আরেকটু বসি?”

    "তো বসো। আমি ননকুকে ডাকি।"

    তিনি ভিতরে উঠে গেলেন। আমি বসে রইলাম। যে কেউ এখানে আসে, সবাই বাইরে এইরকমভাবে বসে। তাঁর স্ত্রী বিজু, মেয়ে যে দিল্লীতে থাকে, অ্যানা যখন সে মিসেস মেহরার সঙ্গে আসত। নিরঞ্জনবাবুর দালানে সবাই নিজের নিজের জীবন থেকে ছুটি পেয়ে যায় ...

    কটেজ থেকে বুড়ো চৌকিদার ননকু বেরিয়ে এল। হাতের ট্রেতে জলের গেলাস, জাগ আর এক প্লেট নমকিন। তেপায়ার উপর রেখে অনুযোগ করল, "এবার আপনি অনেকদিন বাদ এলেন, সাব।"

    "কী করি? তোমার সাহেব এত উঁচুতে বাসা বেঁধেছেন যে উঠতেই প্রাণ বেরিয়ে যায়।"

    সে হাসছে। অতিথি এলেই খুশিতে তার মুখের চেহারা পালটে যায়। যেন লম্বা ঘুমের পর জেগে উঠেছে।

    "অ্যানা-জীও তাই বলে। সেও অনেকদিন আসেনি।"

    অ্যানা ননকুর প্রিয় মানুষ। যখনি আসে ওর জন্য কিছু হাতে নিয়ে আসে।

    "তুমিও তো তার সঙ্গে দেখা করতে পারো।"

    "আমি?" সে দুকানে হাত লাগাল যেন আমি বেফসকা কিছু বলে ফেলেছি, "আমার তো আজকাল মরবারও ফুরসত নেই, নীচে যাওয়া তো দূর..."

    তা সত্যি। ননকু ছাড়া নিরঞ্জনবাবুর এক পাও চলে না। সে পুরনো মানুষ-- আপেলের ম্যানেজার, চৌকিদার, সেক্রেটারি, সব কিছু... সীজনের পর নিরঞ্জনবাবু চলে গেলে সে বাড়ি আর বাগানের তদারকি করে। সময় পেলে মুরলীধরের সঙ্গে দেখা করে আসে। ননকুর মেয়ে মুরলীধরের বউ। মেয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য ও যখন নীচে আসে আমার সঙ্গেও একটু কথাবার্তা করে যায়।

    "সাব, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?" কটেজের দিকে এক পলক দেখে নেয়।

    "কী ব্যাপার ননকু?”

    "এবার সাহেবের সঙ্গে বিবি আসেননি?"

    আমি একটু সঙ্কোচে পড়লাম। মালিকের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনা করাটা ঠিক নয়। "হয়তো কোনো কাজে আটকে গেছেন, তোমায় কিছু বলেননি?"

    "আমায় কখনো কিছু বলে নাকি? আসার আগে একটা চিঠি পাঠিয়ে দেয়, ব্যস।"

    "হয়তো পরে আসবেন।"

    সে একটা শ্বাস ফেলল। "আর কিছুর দরকার তো নিয়ে আসি?"

    "না ননকু, সাহেব কোথায় গেলেন?"

    "এই আসছেন।"

    নিরঞ্জনবাবু যখন ফিরে এলেন বিকেলের আলো একেবারে মরে গেছে। হাতের লন্ঠনটা তেপায়া থেকে একটু দূরে রেখে দিলেন। আলো দেখলেই হাজার পতঙ্গ ধেয়ে আসে।

    "খাবারের দেরি আছে। কিছু পানীয়...?”

    "কী আছে?"

    "রাম, হুইস্কি, ... একটু ব্র্যান্ডিও... গত বছর এনেছিলাম। এখনো ওইরকমই পড়ে আছে।"

    তিনি কাপড় ছেড়ে এসেছিলেন, এখন কুর্তা, পাজামা আর উপরে একটা শাল। তাঁর মুখে-চোখে একটা অদ্ভুত শান্তি, যেন সারাদিন খাটাখাটুনির পর এখন একটু অবসর মিলেছে। দাড়িতে সাদা কালোর চমক, কলেজে পড়ার সময়কার যৌবনে ভাঁটা পড়লেও বয়স্ক বয়সের সম্মোহনটা এখনো আছে। একটা চাপা আভা তাঁর সারা শরীর জুড়ে …

    আমরা কিছুক্ষণ চুপচাপ চুমুক দিচ্ছি, চারদিকে শুধু গাছের ভিতরে হাওয়ার শব্দ। উঁচুতে থাকার এই সুবিধে। ধীরে ধীরে সারা আকাশ তারায় ছেয়ে গেল। একটা আবছা আলো ছড়িয়ে রইল গাছে, লনে, কটেজের উপর... দোলনাটা হাওয়ায় আপনা আপনি দুলছে।

    "এবার তো থাকবেন কিছুদিন?" আমি তাকালাম তাঁর দিকে।

    "দেখি... সেই ভেবেই তো এসেছি।"

    "এখান থেকে ফিরে যেতে কেমন লাগে?" আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

    তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন।

    "সেখানে আমার ঘর... স্ত্রীর সঙ্গে থাকতে সময়ের ঠিক থাকে না।" তিনি হাসলেন, "এখানে এসে টের পাই আমি নিজের থেকে কতদূর সরে এসেছি।"

    "এরকম হয়তো সবারই মনে হয়।" আমি বললাম।

    "হ্যাঁ, কিন্তু যে দু-জায়গায় থাকে তার আরও বেশি মনে হয়। এখানে আসামাত্র আমার জয়পুরের জীবনটা একেবারে অবাস্তব মনে হতে থাকে... যেন সেটা অন্য কারুর জীবন। আর যখন আমি এখান থেকে যাই, কিছুদিন পরে ভাবতেও অবাক লাগে যে আমার এখানে একটা বাড়ি আছে বা আপেলের বাগান… তুমি, অ্যানা, ডক্টর সিং, মেহরা-সাহেব... " রাম-এর গ্লাসে এক চুমুক দিয়ে আমার দিকে তাকালেন, "কখনো কখনো তো ঠিক করতে পারি না কোনটা আসল আর কোনটা নয়।" কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে মৃদুস্বরে বললেন, "হয়তো কোনোটাই নয়।"

    তাঁর কথার মধ্যে কোনো অস্থিরতা ছিল না। বেশ শান্ত। দুই শহরের মধ্যে আসা-যাওয়ার এক যাত্রী। তীর্থযাত্রী? তাঁর এই নিঃসঙ্গতা আমায় আবিষ্ট করে ফেলছিল।

    "এখানে আসতে ভালো লাগে?"

    "রিটার্ন টিকিট পকেটে থাকলে মানুষ যেকোনো জায়গায় থাকতে পারে। কিন্তু সেটা আসল থাকা নয়।"

    "আসল থাকাটা তাহলে কী?"

    "এটা তো তোমারই জানা উচিত। তুমি সবকিছু ছেড়েছুড়ে এখানে এসেছ। তোমার মনে তো কোন সন্দেহ থাকা উচিত নয়।"

    "যদি পিছনে ছাড়বার কিছু না থাকে?"

    "তবে এখানে কেন থাকছ? এখানে আসার সিদ্ধান্তটা তো তুমিই নিয়েছিলে?"

    "স্রেফ যোগাযোগের কারণে।" আমি বললাম, "যদি স্টেটসম্যানে সেই বিজ্ঞাপনটা না দেখতাম তো আজ আমি এখানে বসে থাকতাম না।"

    "যাই হোক, তোমায় দেখে আমি অবাক হয়ে যাই।"

    "কেন?"

    "তুমি মেহরা-সাহেবের সঙ্গে থাক... তোমার কখনো নীচে গিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না?"

    "নীচে?"

    "নীচের দুনিয়ায়।"

    "আর এটা কি দুনিয়া নয়?"

    তিনি হাসলেন, "হ্যাঁ তা ঠিক। এক রিটায়ার্ড অফিসার, এক জার্মান বুড়ি জাদুকরী, এক জোকারের মতো ডাক্তার, আর আমি... এক গরহাজির বাড়িওয়ালা... এরকম দুনিয়া আর কোথায় পাবে?"

    "আর আপনি? ইউনিভারসিটিতে কখনো ভেবেছিলেন ফিলসফি ছেড়ে আপেলের চাষ করবেন?"

    "কেন? আপেল ভালো লাগে না? যে প্রথম আপেল খেয়েছিল, জ্ঞান তারই হয়েছিল। সব ফিলসফির তো সেখানেই শুরু। তাই না?"

    ওঁর হাসিটা অন্ধকারে দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু গলার শব্দ ঠিক ইউনিভারসিটির কফি হাউসে যেমন শুনতাম --একটা শুষ্ক আমোদ... উদাস নয়, কিন্তু উদাসীন ...দুনিয়ার ভোগ বিলাসের থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা...

    "যদি এভাবেই জ্ঞান হয় তো এখানেই থেকে যান না কেন?"

    "আমি যে তোমার মতো একলা নই ভাই; স্ত্রী, মেয়ে, এসব সুখেরও দাম চুকোতে হয় যে।"

    "কীরকম সুখের কথা বলছেন?"

    "পরিবারের সুখ, এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সুখ, লোকে কি এরই জন্য মারামারি করে না?"

    "যাকে আপনি জ্ঞান বলছেন, তাও কি ওই মারামারির ভিতর দিয়েই আসে না?"

    "আসে, কিন্তু বড্ড দেরি করে। তখন আর লোকের যোগ্যতা থাকে না। তখন শুধু চিমটে দিয়ে সুখ নয়, শুধু তার ছাই ওঠানো যায়।"

    আমি গেলাস থেকে মুখ তুললাম। তিনি কি নিজের কথা বলছেন? না আমাদের সবার? অবশ্য ছাইটা কীসের তাতে কীই বা এসে যায়?

    হাওয়া বাড়লে গাছের পাতার খরখরানি বাড়ে। ভিতরে একটা ঠান্ডা শিহরন বয়ে যায়। একটা বিষাদ। মনে হচ্ছিল বিগত বছরগুলোর অদৃশ্য ছায়াগুলো আমাদের মাঝখানে এসে বসেছে আর আমরা তাদের সরাতে পারছি না।

    "একটা কথা... তুমি বিয়ে করোনি কেন?" তাঁর আচমকা প্রশ্নে আমি থতমত খেয়ে গেলাম।

    "আমি নিজেই জানি না। কোন কোন জিনিশ হয় না, ব্যস!"

    "কখনো ভাবোনি?"

    "না।"

    "কখনো মিস করোনি? কোন অভাববোধ?"

    "যা কখনো হয়ইনি তার আর অভাব কীসের? তবে কখনো কখনো একটু ঈর্ষা হয়..."

    "ঈর্ষা? অন্যের সুখের?"

    "ঠিক সুখ নয়। কোন কোন লোককে দেখে নিজেকে ছোট মনে হয়, যেন তারা অন্য গ্রহের বাসিন্দা। শুরুতে মিসেস মেহরাকে দেখে এই রকম মনে হয়েছিল, সে যেন আমাকে এই দেখাতেই ডেকে এনেছে।"

    "কী দেখাতে?"

    "নিজেকে।" আমি অন্ধকারে একটু ইতস্তত করে বললাম, "তাকে দেখে আমার নিজের উপর লজ্জা হত।" আমার খেয়াল নেই আমি কী বলছি, কিন্তু তার জন্য কোনো চিন্তা ছিল না। আমি খুশি যে আমার ভিতরের ঘন কুয়াশাটা একটু কাটাছেঁড়া করতে পারছিলাম, "কেউ কেউ এইরকমই হয়। তাদের দেখে নিজের জীবন, কৃতিত্ব সবকিছুই তুচ্ছ মনে হয়।"

    তিনি চুপ করে বসেছিলেন। গেলাসটা তুলেও নামিয়ে রাখলেন।

    "তুমি তো জানো... সে যখন শেষ এখানে এসেছিল।"

    আমি অবাক হয়ে তাকালাম, "মিসেস মেহরা? এখানে একলা? কবে?"

    "তখন তার সদ্য টেস্ট হয়েছিল। তখনো রোগের কোনো ধারণা ছিল না। হয়তো সে জানত কিন্তু আমাকে বলেনি। হ্যাঁ, সেদিন একলাই এসেছিল। সচরাচর অ্যানাকে সঙ্গে নিয়ে আসত, সেদিন তাকে একলা দেখে অবাক হয়েছিলাম।"

    "কিছু বলেছিল আপনাকে?"

    "প্রথমে তো হাসছিল, যা তার স্বভাব। বলছিল--একবার আমি স্কুলটা দেখতে চাই, কতদূর তৈরি হয়েছে। তখন শুধু একটামাত্র ঘর তৈরি হয়েছিল।"

    "তার কি কিছু আঁচ পেয়েছিল?"

    "কীসের সম্বন্ধে?"

    "নিজের রোগ নিয়ে..."

    "হতে পারে... কিন্তু তার মুখ দেখে বোঝা যেত না। আমি বললাম ভিতরে আসতে, কিন্তু সে বাইরে দাঁড়িয়েই কথা বলছিল, এটা-সেটার নিয়ে। তার মন ছিল অন্য কোথাও। যাবার সময় আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকাল, যেন কিছু জানবার জন্যই এতদূর আসা...তাও পদক্ষেপটা নিতে পারছিল না।"

    "কী জানতে চেয়েছিল?"

    "জানি না। কিন্তু যখন মানুষ জানতে পারে তার ভাগ্যে কী আছে, সে নিজেকে অন্যের চোখ দিয়ে দেখতে শুরু করে। হয়তো সে কিছুই জানতে চায়নি। আমার কাছে এসেছিল কারণ আমাদের অনেক বছরের চেনাশোনা... কেন? তোমায় কিছু বলেনি? তুমি তো ওদের সঙ্গেই থাকতে।"

    "হ্যাঁ... কিন্তু ওইসময় সে তিয়ার সঙ্গেই সারাক্ষণ কাটাত। এখন ভাবি সে এইজন্যই আমায় ডেকেছিল যাতে স্বামীকে আমার হাতে দিয়ে সে মেয়ের সঙ্গে শেষদিনগুলি কাটাতে পারে।"

    "কিন্তু কেন?"

    এর কি কোনো উত্তর আছে? শেষদিনে আমরা কী করি, কার হাত থেকে বাঁচতে চাই, সেসবের উত্তর সে নিজের সঙ্গে নিয়ে গেছে, মাটির নীচে। সেখানে তাকে প্রশ্ন করার কেউ নেই।

    চারদিক নিস্তব্ধ। গাছের মাথায় তারার আবছা আলো। কখনো দু-একটা পাখি ডানা ঝটপট করে ওঠে। শুধু ঝিঁঝিঁপোকার ডাক ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না।

    হঠাৎ একটা ছোট আলোকবৃত্ত কাছে আসতে দেখে আমাদের ধ্যানভঙ্গ হল। সামনে লন্ঠন হাতে ননকু দাঁড়িয়ে।

    "খাবার লাগিয়ে দিই? না আরও দেরি আছে?"

    "ব্যস, আসছি এখুনি।" নিরঞ্জনবাবু কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক বসে রইলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন, "চলো, ভিতরে যাই। পরে কথা হবে।"

    ভিতরে ফায়ার প্লেসের আগুনে শুকনো কাঠের শিখা লকপক করে উপরে উঠছে। খাবার আগেই টেবিলে রাখা, রান্নাঘরটা একটু দূরে, ননকু অন্ধকারে দৌড়ে দৌড়ে গরম রুটি আনছিল। মনে হচ্ছিল আমরা অন্ধকারের মধ্যে একটা গুহায় বসে আছি। নিরঞ্জনবাবু তাঁর বাগানের কথা বলছিলেন, আলাদা আলাদা রকমের আপেল, তাদের দেখাশোনা করা, পাহাড়ি চৌকিদারদের আলস্য, মালীদের মদের নেশা...

    "প্রথম প্রথম বৃষ্টির সময় এত কষ্ট হত...মনে হতো সব ছেড়ে-ছুড়ে শহরে ফিরে যাই। তারপর আবার ভাবতাম ফিরে গিয়েই বা কী করব? ইউনিভারসিটির হাল তো চোখে দেখা যায় না। সারা জীবন কি ওখানেই পড়াতে হবে? যেখানে আমার নিজেরই বিশ্বাস নেই।"

    “কিন্তু এখানে? এখানে কি আপনার সেই বিশ্বাস ফিরে পেয়েছেন?"

    "এখানে অন্তত এটুকু জানি যে আমি নিজেকে ঠকাচ্ছি না। আসলে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এত কাজ থেকে যে আর কিছু ভাবার সময়ই পাই না, রাত্তিরে বিছানায় শুয়ে পড়াটা একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার বলেই মনে হয়।

    আগুনের হলুদ আলোয় তাঁকে একটু ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। আমার থেকে বয়সে সামান্যই বড়ো। পুরনো বন্ধুর মুখে আমরা নিজেদের চেহারাই দেখি। বলিরেখা, টাক মাথা, সাদা চুল...সেগুলোর মধ্যে আমাদের নিজেদেরই অতীতের আত্মাদের দেখা পাই।

    কিছুক্ষণ আমরা ফায়ার প্লেসে ধিকিধিকি আগুনের দিকে চেয়ে রইলাম। দেয়ালের গায়ে ছায়াগুলো নাচছে। চিমনীর মধ্যে বাইরের হাওয়ার শোঁ শোঁ আওয়াজ। হঠাৎ কী ভেবে তিনি আমার দিকে তাকালেন, "একটা কথা... জানি না তুমি কী ভাববে..."

    আমি হেসে বললাম, "ড্রিঙ্কের পর সর্বদা নতুন চিন্তা মাথায় আসে... বলুন, কী ভাবছেন?"

    "তুমি এই বাড়িতে এসে থাকো না কেন? আমি তো বছরে আট-ন মাস নীচেই থাকি।

    "আর মেহরা-সাহেব? তাঁর কী হবে?"

    "তুমি কি তার দেখাশোনা করতে এসেছ এখানে?"

    "সেরকমই ধরুন, সে জন্যই মিসেস মেহরা আমাকে ডেকেছিলেন।"

    "সে না থাকলেও?"

    "সে আলাদা কথা। তখন তাঁর মেয়ে ঠিক করবে... হয়তো এখানে এসে থাকবে।"

    নিরঞ্জনবাবু মাথা নাড়লেন, "এখনও এল না, পরে এসে আর কী করবে, যখন এখানে আর কেউ রইল না।"

    "সে কেন এখানে থাকতে চায় না? এখানেও তো প্রাকটিস করা যায়।" আমি বললাম।

    "কে জানে।" তিনি আবার মাথা নাড়লেন, "একবার গৃহত্যাগের পর আবার ফিরে আসা কঠিন।"

    আবার দুজনে চুপ। হঠাৎ তিনি ব্যস্তসমস্ত হয়ে বললেন, "বড্ড দেরি হয়ে গেছে। চলো, তোমায় গেস্ট হাউসটা দেখিয়ে দিই। আজ তুমি ফিরছ না।"

    তিনি আমায় গেস্ট হাউস পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন। বারণ করলেও শুনলেন না। টর্চ জ্বালিয়ে আগে আগে রাস্তা দেখিয়ে চলছিলেন। এর কোন প্রয়োজন ছিল না। হালকা হলুদ চাঁদের আলোয় সবকিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে--দেওদারের সমাধিস্থ শাখা, ওক গাছের নীচে দড়ির দোলনা, বেড়ার ঝোপের ওপাশে বিস্তৃত উপত্যকা। সবকিছু নিস্তব্ধ, শুধু দূরে কোথাও একটা কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে।

    গেস্ট হাউসের বারান্দায় একটা ধোঁয়াটে বাতি জ্বলছে। গেটের সামনে এসে আমি বললাম, "এবার আপনি ফিরে যান। আমি নিজেই চলে যাব।"

    তিনি অন্যমনস্কভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, যেন আমায় কিছু বলতে চান, সন্ধ্যেটা কোনো একটা সীমান্তে টেনে আনেন, কিন্তু কোথায়?

    "তুমি এসে ভালো করেছ," সসঙ্কোচে বললেন, যেন মুখ ফুটে বলতে লজ্জা, তারপর চট করে কথা ঘুরিয়ে নিলেন। "দুটো কম্বল আর লেপ রাখা আছে। আরও লাগবে?"

    "কেন? বরফ পড়বে বুঝি?"

    তিনি হাসলেন, "আচ্ছা, আমি আসি তাহলে, সকালে ননকু চা নিয়ে আসবে।"

    তিনি চলে যাবার পরেও আমি অনেকক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলাম। হাওয়ায় গাছপালার শিরশিরানি, অন্ধকারে কোনো পাখির ঝটপট শব্দ চরকির মতো ঘুরতে ঘুরতে মিলিয়ে যায়। আবার সব নিশ্চুপ।

    ঘরে এসে প্রথমেই নজর পড়ল পালঙ্কটার উপর। এত পরিষ্কার আর নতুন দেখাচ্ছে যেন কেউ হাতই দেয়নি, শোয়া তো দূরের কথা। বালিশের উপর সুন্দরভাবে ভাঁজ-করা তোয়ালে, পায়ের কাছে কম্বল, পাশে তেপায়ার উপর জলের জাগ আর গেলাস। লাগোয়া বাথরুম থেকে ফিনাইলের গন্ধ আসছে। ওদিকে আরেকটা ঘর, তালাবন্ধ। সমস্ত বাড়িটা একটা লগ কেবিনের মতো, কাঠের তক্তা দিয়ে বানানো, পরিচ্ছন্ন ও সংক্ষিপ্ত। একটাও অনাবশ্যক জিনিশ নেই।

    শুধু আমি ছাড়া... আমিই এখানে অনাবশ্যক। আমি শুয়ে পড়লাম বটে কিন্তু অনেকক্ষণ ঘুম এল না। ভিতরে কিছু একটা আটকাচ্ছিল। মনে পড়ল, এটা তার স্কুল ছিল, যা সে অসমাপ্ত রেখে চলে গিয়েছিল। শেষবার এল যখন...কী দেখতে? আমাকে যদি এখন দেখত তো আরও হাসত ... তুমি ঠিক সেখানেই আসো, যেখান থেকে আমি চলে যাই…সেটা হাসি না তার উলটো? আমরা তো সময়ের তলানিতে বাকি জীবনটুকু ক্ষইয়ে যাচ্ছি পরজীবী প্যারাসাইটের মতো, যার অস্তিত্ব শুধু অন্যের দেওয়ালেই টাঙানো থাকে।

    আমি আর ঘরের ভিতর থাকতে পারলাম না। বাইরে বেরিয়ে এলাম।

    বারান্দায় আবছা চাঁদের আলো। ঝোপের উপর জোনাকি উড়ছে, টিমটিমে তারার মতো। নিরঞ্জনবাবুর কটেজটা যেন কুয়াশায় ঘেরা প্রাগৈতিহাসিক গুহা, জঙ্গলের গাছপালাগুলো নিশ্চল খাড়া, শুধু দড়ির দোলনাটা ধীরে ধীরে দুলছিল, নিজেকেই দোলাচ্ছিল।

    আমি আবার ভিতরে এসে কম্বল জড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। এবার আর ঘুমের প্রতীক্ষা করতে হল না। সে নিজেই এসে গেল। সকালে চোখ খুলে দেখি চারদিকে খটখটে রোদ। ঘাস, গাছের পাতা, ঝোপঝাড় সব শিশির লেগে ঝকমক করছে। জানিই না কখন ননকু চায়ের কেটলি টিকোজীতে ঢেকে টেবিলে রেখে গেছে। আমি চা খেয়ে বাইরে এলাম। নিরঞ্জনবাবু হয়তো অনেক আগেই আপেলের বাগানে চলে গেছেন।

    সমস্ত বাড়ি নির্জন।

    দেওদার গাছের তলায় একটা পাথরের বেঞ্চিতে একটু বসলাম। গত রাত্রের স্মৃতিগুলি আস্তে আস্তে ফুটে উঠছিল। কথাবার্তার মধ্যে কত নির্জন নীরবতা লুকিয়ে ছিল। আর তার পিছনে ছিলেন নিরঞ্জনবাবু। আমি কখনোই সেই দেয়াল পার করতে পারব না। কিন্তু কৌতূহল ছিল কেমনভাবে তিনি ওই দেওয়ালের পিছনে থাকতে পারেন।

    তিনি সন্ত বা সন্ন্যাসী কিছুই নন। পুরোপুরি গৃহস্থ। আমার মতো একলাও নন। ইচ্ছে করলে ইউনিভারসিটিতে ভালো চাকরি করতে পারতেন। তাই তাঁর এখানে এসে থাকাটা আমার কাছে একটা রহস্য। তাঁর কী মনে কোন কষ্ট আছে যা কাউকে বলতে পারেন না, আর সেটাই সামলাতে এখানে চুপচাপ থাকার সঙ্কল্প নিয়েছেন? বাইরে থেকে তো কিছু বোঝা যায় না। শুধু কখনো কখনো তাঁর মুখে একটা ছায়া পড়ে। হয়তো এমন কিছু পিছনে ছেড়ে এসেছেন, যে বিষয়ে আমার কোন ধারণা নেই। আমার মনে পড়ল, ডক্টর সিং বলতেন, 'তোমরা এমন বয়সে এখানে এসেছ যখন জীবনের সব কিছু প্রায় শেষ, শুধু একটুখানি বাকি রয়ে গেছে।' কিন্তু সেটা কী?

    সেইটা জানবার জন্যই কি লোকে এত উঁচুতে উঠে আসে? এখানে দাঁড়িয়ে নীচে নিজের অতীতের ধ্বংসাবশেষটা পুরো দেখতে পায়?

    সূর্য উপরে চড়ছে। নীচে সারা উপত্যকা রোদ্দুরে ঝকমক করছে। গাঁয়ের কুটিরগুলো থেকে নীল ধোঁয়ার রেখা উপরে সাদা মেঘের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল।

    আমিও আস্তে আস্তে উৎরাইয়ের পথ ধরে নীচে নামতে শুরু করলাম।

    অধ্যায় -- ১.৬

    বাড়ি এসে শুনলাম ডক্টর সিং এসেছিলেন। মুরলীধর বলল তিনি অনেকক্ষণ মেহরা-সাহেবের ঘরে বসেছিলেন। কতক্ষণ? আমি জিজ্ঞাসা করতে সে কিছু বলল না, শুধু মাথাটা নাড়িয়ে দিল। আমার জন্য কোনো মেসেজ? তখন ওর মনে পড়ল। পকেট থেকে দোমড়ানো মোচড়ানো একটা কাগজের টুকরো বার করল... তাতে শুধু ডক্টর সিং-এর নামই লেখা, আর কিছু না।

    মেহরা-সাহেবকেও দেখা গেল না। কটেজের দরজা বন্ধ। বারান্দায় চেয়ারগুলো খালি। আমার কোয়ার্টারে ফেরবার সময় দেখলাম ফুটপাথের নুড়ির উপর ঘোড়ার বিষ্ঠা রোদ্দুরে শুকোচ্ছে। সেন্ট সেবাস্তিয়ান তার উপহার রেখে গেছে।

    আমি ভাবছিলাম কী করে ডাক্তার সিং-এর কাছে যাওয়া যায়। মুরলীধরকে দিয়ে খবর আনানো যায়, কিন্তু কী লাভ? বলবার মতো কোন খবর থাকলে তিনি চিরকুটে লিখে দিতেন নিশ্চয়ই। কিন্তু কোনো খবর না থাকলে শুধু নাম লিখে যাওয়ার কী দরকার ছিল? হয়তো আমাকে কিছু বলতে চান কিন্তু আগে থেকে ভয় দেখাতে চান না।

    কিন্তু ভয় আবার কীসের? কাকে?

    ডক্টর সিং-এর বাড়িটা রোদে মাখা, দরজা বন্ধ কিন্তু জানলার কাঁচের পাল্লায় রোদ ঠিকরোচ্ছে। পিছনে, জঙ্গলের ওপারে মুরলীধরের কোয়ার্টারে ধোঁয়া দেখা যায়। তারও পিছনে, খানাখন্দের মধ্যে থেকে ছাগল-ভেড়াদের ম্যা-ম্যা শোনা যাচ্ছিল। যখন বাইরেটা পরিষ্কার, ভিতরের ধুকপুক একটু অদ্ভুত শোনায়, যেন কোনো ম্যাজিক শব্দ।

    আমি সাহস করে দরজা খটখট করে কড়া নাড়লাম, কিন্তু ভিতর থেকে কোন আওয়াজ পেলাম না। মাঝখানের বড়ো ঘরে বাতি জ্বলছে। বাড়িটা ভরদুপুরেও অর্ধেক রোদে ভরা, অর্ধেক অন্ধকার। আমি কখনো দিনের বেলা তাঁর বাড়ির ভিতরে আসিনি। যদি কোন কাজ থাকত তো বাইরের বারান্দায় বসেই কথাবার্তা হতো। আমি আসার আগে তিনি কী করছিলেন বা আমি যাওয়ার পরে কী করবেন সে সম্বন্ধে আমার কোন ধারণা নেই। আমার চোখে তিনি একজন নিশাচর প্রাণীর মতো, দিনের আলোয় তাঁকে একটু অচেনা মনে হয়। এই প্রথমবার আমি বিনা আমন্ত্রণে দিনের বেলায় ওঁর দরজায় কড়া নাড়ছি।

    কেউ বাইরে এল না। কেউ দরজা খুলল না। আমি যখন পিছন ফিরে বারান্দার সিঁড়ি ধরে নামছি, আমার মনে হল কেউ যেন দরজার পিছন থেকে আমায় দেখছে। কিন্তু আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি না।

    এটা কি শুধু দৃষ্টিভ্রম? না চিরকুটে না-লেখা সেই ভয়টার ছায়া? আমি আর দাঁড়ালাম না। যেন কোন অলক্ষণ এড়াতে যত তাড়াতাড়ি পারি বেরিয়ে এলাম।

    ব্যাডমিন্টন কোর্ট পর্যন্ত এসে থামলাম। মনে পড়ল, এখানেই প্রথম তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। এই শহরে আমার প্রথম দিন, যখন আমি সুটকেসে আমার সব অতীত ভরে নিয়ে এখানে দাঁড়িয়েছিলাম। সেসব থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য নয়, বরং সেগুলো একটু ভেবে দেখার জন্য। যেমন এক যাত্রী রাস্তার পাশে বেঞ্চে বসে ফেলে আসা রাস্তাটা দেখে নেয়। কোর্টের এক কোণে ওই বেঞ্চটাও খালি পড়েছিল। কিছু হলদেটে ঝরা পাতা হাওয়ায় উড়ে এসে পড়ছিল। সবকিছু এত নীরব আর নির্জন যে নীচে ছড়ানো নীল জঙ্গলের নীরব পদধ্বনি পর্যন্ত শোনা যায়...তার কটেজ আর আমার কোয়ার্টারের মধ্যে এক অদৃশ্য পুল ধরে চলছে। একটু আগের সেই ভয়টা অনেক দূরে মিলিয়ে গেছে। আমার 'আমি'-টা ধীরে ধীরে আমার হাত ছেড়ে এখানে চলে এসেছে, এই ব্যাডমিন্টন কোর্টে। দুপুরের রোদে সব নিঝুম। কোর্টের বাইরে থেকে শাটল-ককটা আমি তার হাতে তুলে দিয়েছিলাম --আর সে আমায় অবাক হয়ে দেখছিল...যেন মৃত সে নয়, আমিই, আমিই পিছনে পড়ে আছি, এমন একজন যে খায়, হাঁটে, দেখে, কিন্তু জীবন্ত নয়। না, প্রাণ আছে ঠিকই, কিন্তু অন্য জীবিতদের মতো নয়। না, মৃতও নয়, শুধু এমন একটা অস্তিত্ব, যার কথা মিসেস মেহরা অ্যানাকে বলেছিল, যে কবর দেওয়ার আগে সে পরীক্ষা করতে চায় যে সে সত্যি সত্যিই মৃত না একটু জীবিত, বা একটু মৃ্‌ত, বা হয়তো কোনটাই নয়।

    সে কি আমার পরীক্ষা নিয়েছে কখনো? তার কাছে আমি কতটা জীবিত বা কতটা মৃত হয়ে এসেছিলাম? সে হয়তো জানত যে তার স্বামীর কাছে সে-ই থাকতে পারে যে আগে থেকেই সব কিছু ছেড়ে এসেছে। সে নিশ্চয়ই বুঝেছিল যে আমি সেই পরীক্ষায় উতরে যাব। এক এমন পদপ্রার্থী যার ফিরে যাবার কোনো আশাই নেই।

    নিজের অজান্তেই আমি আমার বারান্দায় বসেছিলাম। হয়তো অনেকক্ষণ। রোদে ঘুম এসে গিয়েছিল। দিবানিদ্রা জাগা না-জাগার মধ্যে দোলে। আমাকে দুই গ্রহলোকের মধ্যে দোলায়, এক, এখানে আসার আগেকার জীবনে, সেখান থেকে এই রোদ, এই হাওয়া, এই ব্যাডমিন্টন কোর্ট সব অন্য গ্রহের বলে মনে হয়। দুটোই একসঙ্গে বইছে, নদীতে দুটি হিমশৈলের মতো, যখন দুটো ধাক্কা খায় আমার ঘুম ভেঙে যায়। মনে হয় আমার জাগ্রত জীবনটা ঘুমের মধ্যে উলটো দিক থেকে আমার কাছে আসছে। সে আমার মতোই, কিন্তু হুবহু এক নয়। আমার থেকে আলাদা। সে আমার প্রতিটি অন্ধকার কোণ থেকে --যেখানে আমি লুকিয়ে থাকি-- আমায় হিঁচড়ে টেনে বের করে এই ব্যাডমিন্টন কোর্টের বেঞ্চের উপর ঝরাপাতার মাঝখানে বসিয়ে দিয়েছে।

    আমি ঘরে ঢুকে সটান খাটে শুয়ে পড়লাম। একটু পরে দরজায় শব্দ শুনে চট করে উঠে পেন্সিল আর নোটবুক বার করলাম, ভাবলাম আবার ডাক পড়েছে। কিন্তু বাইরে মুরলীধরের ছেলে বংশী দাঁড়িয়েছিল। হাতে খাবারের থালা।

    "বাইরে খাবেন, না ভিতরে লাগিয়ে দিই?"

    "তোমার বাবু কোথায়?”

    "সে তো সাহেবের কাছে।"

    আমি সন্দেহভরে তাকালাম ওর দিকে, পাহাড়ি, ময়লা, গোলগাল মুখের অভিব্যক্তিতে কিছু অনুমান করা যায় না। আমি বাতি জ্বেলে ওকে ভিতরে আসতে দিলাম। টেবিলে খাবার রেখে যাবার সময় ওকে বললাম, "মুরলীধর এলে বোলো আমি ওকে ডেকেছি।"

    ও যাওয়ার পরেও আমি অনেকক্ষণ বারান্দায় বসে রইলাম। কটেজে আলো জ্বলছে কিন্তু কোনও আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। একবার মনে হল আবার যাই ডক্টর সিং-এর কাছে। কিন্তু গেলাম না। কোন জরুরি খবর থাকলে নিশ্চয়ই আমায় জানাত। আমি অনেকক্ষণ মুরলীধরের অপেক্ষায় বসে রইলাম কিন্তু সে রাতেও এল না।

    দ্বিতীয় দিনেও না, তৃতীয় দিনেও না। আমার মনে হল, ওরা দুজনই আমাকে ভুলে গেছে। যেন আমি আর এখানে নেই। নোটবুক খালি পড়ে আছে, আমি শুধু তারিখ লিখে যাই। সাদা পাতায় খালি দিনগুলি ধীরে ধীরে বয়ে যায়। প্রবাসে এই প্রথম একটা অজানা ভয় আমায় ভর করছিল। যেন আমার অজান্তে কিছু একটা হয়ে চলেছে যা আমি ছাড়া আর সবাই জানে। বাইরে বেরুবার সময় মনে হয় খানাখন্দের গহ্বর, জঙ্গলের শ্বাসপ্রশ্বাস, পাহাড়ের নিশ্চলতা, সবকিছু মাথা উঁচিয়ে আমায় দেখছে, আমার পায়ে পায়ে চলছে আর হাসছে। কিন্তু পিছনে তাকালেই ঝট করে সরে যায়, আর কিছুই দেখা যায় না। শুধু খালি তারিখের মাঝে থমকে পড়া সময় আবার বয়ে যায় আগের মতো।

    হয়তো সেটা চতুর্থ দিন। আমি হঠাৎ মনস্থির করলাম, ঘর থেকে বেরিয়ে পাকদণ্ডি ধরে নীচে গ্রামের বাজারের দিকে যাব।

    ডক্টর সিং-এর ক্লিনিক বাজারের ভিতরে হলেও আলাদা মনে হয়। সমতল রাস্তা থেকে কয়েক ধাপ সিঁড়ি নীচে। উপর থেকে দেখলে মনে হয় যেন বাজারের একটা অংশ ভূমিকম্পের ফলে নীচে ধসে গেছে। কিন্তু আসলে তা নয়। দুটো দোকানের মধ্যে ডক্টর সিং লোহার রেলিং লাগিয়েছিলেন যাতে রোগীরা সহজে দোকানের নীচে বেসমেণ্ট ওয়েটিং রুমে ঢুকতে পারে। সেখানে কিছু চেয়ার, টেবিল, বেঞ্চি রাখা আর এক কোণে পর্দার পিছনে ডক্টর বসেন আর তার সামনে রাওয়াত-জী একটা টুলের উপর। যখন মিসেস মেহরার সঙ্গে আমি প্রথমবার আসি, তখনো তাকে ওইভাবেই বসে থাকতে দেখেছিলাম। তার চওড়া ধুতির নীচে টুলটা একেবারে ঢাকা পড়ে যেত, বোঝা যায় না সে টুলে বসে আছে না চেয়ারে। বেঁটেখাটো লোকটাকে বসে থাকতে দেখে এতই অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম যে বাইরে বাজারে দেখলেও মনে হতো সে যেন টুলে বসেই বাজারে চলে এসেছে। পর্দার ভিতর থেকে এক রোগী বেরিয়ে এলেই সে পরের রোগীর নম্বর হাঁকত। কেউ লাইনের বাইরে যেত না। তার মাথায় তিলক, কাঁধে হলদে শাল, তাকে দেখে মনে হতো, ডাক্তার নয়, তার পিছনে এক দেবতা বসে আছেন, যাঁর দর্শন তার কৃপা ছাড়া সম্ভব নয়। পর্দার পিছনে বোর্ডে হাতে লেখা Rules and Regulations... দশটা হিন্দিতে আর শেষ নম্বরটা ইংরেজিতে —Please bear with us...তলায় ''সামন্ত সিং রাওয়াত' এমন ভাবে লেখা যেন একটা বেড়াল দুটো ইঁদুরের পিছনে দৌড়চ্ছে।

    আমায় দেখেই সে নিয়ম ভেঙে আমায় ইশারায় ভিতরে যেতে বলল। আমিও ইশারায় না বললাম। কিন্তু সে মানবে না। কিছুক্ষণ রোগীদের মাথার উপর আমাদের দুজনের ইশারায় মূকাভিনয় চলতে থাকল। শেষে হার মেনে সে নিজের জায়গায় বসল, আমি আমার সিটে। বেশিরভাগ রোগী আশপাশের গ্রামের লোক। সবার পোশাক একই রকম--পাজামা, উপরে কামিজ বা বুশ শার্ট, বুকে একটা চাদর। একটু সম্পন্ন লোকেদের মাথায় চৌকোমতো টুপি। সবার জুতো এত ধুলোয় ভর্তি যে আসল রংটা চেনাই যায় না। তারা সবাই নীচের গাঁয়ের লোক, এখানে আসার আগে বাজারে কিছু কেনাকাটা করেছে, বগলে ভরা ঝোলা। তাদের পক্ষে বোর্ডে লেখা নিয়মগুলির মধ্যে সবচেয়ে কষ্টকর হল ধূম্রপান বারণ। সেই জন্য থেকে থেকে সবাই উঠে বাইরে ব্যালকনিতে গিয়ে সিগারেট-বিড়ি খেয়ে আসছিল।

    সেই ব্যালকনিটাই হচ্ছে আমার আসল ওয়েটিং রুম। ভিতরে দমবন্ধ আবহাওয়া থেকে ছাড়া পেতে আমি এখানে এসে বসতাম। বাজারের মধ্যে ওই ব্যালকনিটা দেখলে মনে হবে একটা দোলনা, হাওয়ায় থেমে আছে। নীচে সবুজ উপত্যকা ছড়ানো, লম্বা লম্বা দেওদার গাছ, গাঁয়ের খেত, ঝোপঝাড়। মোটর রাস্তায় ট্রাকের উড়ন্ত ধুলো। যখন বাজারের কোন লড়ঝড়ে ট্রাক, লরি বা রোডওয়েজের বাস যায় তো মনে হয় দোলনায় সবাই উঠছি, ডক্টর সিং, রাওয়াত-জী, রোগীরা, আমি, সবাই... দোলনাটা যেন বাজার আর পাহাড়ের মাঝখানে একটা খোলা, উড়ন্ত ক্লিনিক।

    "সব রোগীদের হয়ে গেছে?" আমি তাকালাম। রাওয়াত আমার সামনে দাঁড়িয়ে।

    "ক-খন! আমি ভাবলাম আপনিও চলে গেছেন। আসুন আমার সঙ্গে।"

    আমি তার সঙ্গে আবার ভিতরে ঢুকলাম। পর্দার পিছনে শেষ রোগীটি বাইরে বেরুচ্ছিল। সমস্ত বেঞ্চ, চেয়ার খালি, যেমন ফিল্ম শো-এর পর সিনেমা হলের মতো-- জনশূন্য। রাওয়াত পর্দা ওঠাতেই ডক্টর সিং বাইরে বেরিয়ে এলেন। আমায় দেখে হাসলেন না, গম্ভীর হয়ে ভাবছিলেন-- আমি কী কারণে আসতে পারি।

    "বসো।" যেন আমিও তাঁর একটি রোগী। একটু থেমে জিজ্ঞেস করলেন, "এখানে কী মনে করে?"

    "আপনি কয়েকদিন আগে মিস্টার মেহরাকে দেখতে গিয়েছিলেন না?"

    "হ্যাঁ, তা তো গেছিলাম। তুমি সেদিন বাড়ি ছিলে না।"

    "আমি নিরঞ্জনবাবুর ওখানে গেছিলাম। ফিরে এসে শুনলাম আপনি এসেছিলেন।"

    তিনি চুপ করে হাতের পেনটা দিয়ে প্যাডে আঁকিবুঁকি কাটছিলেন। তারপর কিছু মনে করে পেনটা রেখে উঠে দাঁড়ালেন।

    টেবিলের পিছনে, দেয়ালের এক কোণে একটা সুইচ টিপলেন। নীচে হাত ধোয়ার বেসিনের উপর একটা আয়নাতে ওঁর মুখটা দেখতে পাচ্ছিলাম, সকাল থেকে দাড়ির নীলচে ছোপ গালের উপর ছায়া ফেলছে। তিনি বেসিনের কল খুলে সাবান দিয়ে হাত ধুলেন, একবার, দুবার, খুব ঘষে ঘষে ... আমার ভেবে অবাক লাগে যে ডাক্তারদের এত হাত ধোয়ার বাতিক কেন? রোগীদের না ছুঁয়েও হাত ধোবার তাড়া... সবই কি জীবাণুদের হাত থেকে পালাবার তাগিদে?

    তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলেন, "বাড়ি থেকে আসছ?"

    আমি একটু অবাক হলাম। তিনি আমার দিকে না ফিরে, আয়নার মধ্যে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করছিলেন।

    "হ্যাঁ, বাড়ি থেকেই," আমি পকেট থেকে মুরলীধরের দেওয়া চিরকুটটা বার করলাম, "এটা মুরলীধরের হাতে দিয়ে গেছিলেন?"

    "আমায় কী জিজ্ঞাসা করতে চাও?"

    "তাঁর সম্বন্ধে... আপনি কী মনে করেন?"

    তিনি পিছন ফিরে ঘরের জানলাটা খুলে দিলেন। আমি অবাক হয়ে দেখলাম জানলার বাইরে আরেকটা প্লাটফর্ম, চারদিকে লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা। সামনে আকাশে পাহাড়গুলো মাথা উঁচু করে খাড়া, উপরে রৌদ্রের আভাস।

    "এইটা আমার আরামের জায়গা। এস, এখানে বসি।"

    সত্যিই একটা হাওয়ায় ঝোলানো দোলনা, উপরে সবুজ শেড, নীচে একটা চৌকি আর বেতের চেয়ার।

    "রোগীরা চলে গেলে আমি এখানে একটু আরাম করি।"

    তিনি আমার পাশে বসেছিলেন, সামনে নয়। ভালোই হল, সোজাসুজি মুখ দেখতে হবে না।

    "এবার বলো, কী জানতে চাও।"

    "মেহরা-সাহেব কেমন আছেন?"

    "রুটিন চেক-আপ, আর কিছু না।"

    আমি মন দিয়ে তাঁকে দেখলাম। তাঁর চোখে-মুখে কিছুই ছিল না, থাকলেও তা পড়ার ক্ষমতা আমার নেই।

    "আপনার মতে চিন্তার কিছু নেই তাহলে?”

    "কীসের চিন্তা? আমি তো চিন্তার কিছুই দেখিনি।"

    "এমন কিছু, যা আগে ছিল না?"

    "আমি খালি চোখে শরীরটাই দেখি, দরকার পড়লে এক্স-রে করি, কিন্তু মনের ভিতরটা দেখার কোন যন্ত্র তো আজও আবিষ্কার হয়নি।"

    ডক্টর সিং উঠে রেলিং ধরে দাঁড়ালেন, "এদিকে এস।"

    আমি তাঁর পাশে দাঁড়ালাম। ঠান্ডা হাওয়ায় চীর গাছের মাথাগুলি কাঁপছে। বাজার থেকে উঠে আসা আওয়াজটা গুঞ্জনের মতো শোনাচ্ছিল। আধো রোদ, আধো ছায়ায় প্লাটফর্মটা কোন অলীক পাখির মতো দেখাচ্ছিল--কাঠের পাখা মেলে হাওয়ায় অচল হয়ে রয়েছে।

    "দেখছ?" আমার কাঁধে হাত রাখলেন, "এই শিলাভূমি, এই উপত্যকা যা পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে, জানো, এ সব একসময় সমুদ্রের নীচে ছিল? আর, যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, কে জানে কত জলপ্রাণী আমার ক্লিনিকের চারদিকে ঘোরাঘুরি করত। কোথায় তারা এখন? তাদের জীবন, তাদের অস্তিত্বের কোনো সূত্র কি আর পাওয়া যায়? কে ছিল তারা? কোথায় গেল সব?..."

    একটু দম নিয়ে ... "সব এখানেই আছে কিন্তু আমরা তাদের দেখতে পাচ্ছি না। তুমি জানো এই পাহাড়ের পরতে পরতে কত ফসিল জমা রয়েছে, এইসব মৃত পশুর হাড়-পাঁজরাই সময়কাল পরে শিলাভূমির রূপ নেয়। জীব আর মাটিতে কোন ফারাক নেই। একটা বিরাট রূপান্তর --মেটামরফোসিস -- সবকিছু বদলে দেয় কিন্তু থাকে একই জিনিশ, যেমন লক্ষ বছর আগে ছিল। শেক্সপীয়ারের নাটকে যেমন অ্যাক্টররা স্টেজে আলাদা আলাদা রূপ ধারণ করে...আমাদের মনে হয় এও এক অ্যাক্টর, অন্য বেশে আগেও স্টেজে এসেছিল...যাকে তুমি রূপান্তর বল, সবকিছুই ভিতর থেকে বয়ে চলা লীলা... রামলীলা!"

    তিনি হেসে আমার সঙ্গে মজা করছিলেন, এটাই তাঁর স্বভাব। আমি তাঁকে ভালো দেখতে পাচ্ছিলাম না, পাহাড়ের অন্ধকার কুয়াশার মতো বন-জঙ্গলের সঙ্গে তাঁকেও জড়িয়ে ধরছিল। দুতিনটে বাতি জোনাকির মতো জ্বলছে, কুয়াশার মধ্যে চীর গাছের মাথাগুলো দ্বীপের মতো জেগে, মন দিয়ে যেন ডক্টর সিং -এর কথাগুলো শুনছে।

    যতক্ষণে ডক্টর তার 'চিরন্তনতার' কথা বলছিলেন, ততক্ষণে সারা বন পোশাক বদলে অন্য রূপে সেজে উঠেছিল। সেখানে ছিল না কোন পাহাড়, কোন পাথর, না কোন জঙ্গল বা গাছপালা... নিবিড় নীল বিস্তার শুধু ঘন অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে ক্রমশ।

    "কিছু দেখতে পাচ্ছ?" ডক্টর সিং-এর গলা শুনতে পেলাম, "যেখানে কিছু শোনা যায় না সেখানেই হয়তো কিছু হচ্ছে...কাল সকালে উঠে দেখবে তো অবাক হয়ে যাবে। জঙ্গলের ভিতর তোমার চোখের আড়ালে কত কিছু হয়ে যায় তুমি কল্পনাও করতে পারো না। এখানে সব সময়েই ড্রামা ... শুধু বাইরে না, মানুষের শরীরের ভিতরেও... অস্থির ভাঙচুর, রক্তচাপের ওঠানামা, হার্টের ধুকপুক কোলাহল... একটা শরীরে এত নিঃশ্বাসের ফোঁসফোঁস, ভাবতে পারো? আর তুমি মেহরা-সাহেবের কী হয়েছে তাই নিয়েই অস্থির!"

    একটু থেমে, একটা বড়ো শ্বাস নিয়ে শুরু করলেন, "সত্তর বছরের কাঠামোয় কত কিছুই তো বয়ে যায়, বদলে যায়, শুকিয়ে যায় ... কী করে বলি তোমায়? যদি তার কোন অসুখ হয়, জ্বরজারি, ব্যথাযন্ত্রণা, টিউমার বা কিছু ... তাহলে তার শরীরে উঁকি মেরে দেখতে পারি কোথায় কোন কলকব্জা বিকল হয়েছে ...কিন্তু সেরকম কিছু যদি না থাকে, যদি সব কিছু নর্মাল দেখায়, তাহলে এমন কোনো দরজা নেই যেটা খুলে তুমি তার মনের ভিতর ঢুকতে পারো। এক্স-রে দিয়ে দেখা যাবে ভাবছ? না ভাই, সেটা একটা বিরাট ইলিউশন। তোমার মনে হয় সব কিছু নর্মাল, সেটাও একটা ছলনা... কারণ সত্যি বলতে কি ... কিছুই কখনো নর্মাল থাকে না, যাকে আমরা নর্মাল বলি সেটা জন্মের মুহূর্ত থেকেই আমাদের হাতের বাইরে চলে যায়। নর্মাল হতে চাই কিন্তু কখনোই হই না। দেহের শেষ বার্তাটা মৃত্যুর সামনে খোলা হয় আর মৃত্যু সেটা বেড়ালের মতো ছিনিয়ে নিয়ে শূন্যে অদৃশ্য হয়ে যায়… অ্যালিসের চেশায়ার বেড়ালটার মতো, শুধু তার হাসিটা হাওয়ায় ভেসে থাকে।" ডক্টর সিং হাসছিলেন আর তখনি পর্দা সরিয়ে ম্যাজিকের মতো রাওয়াত-জীর আবির্ভাব।

    "সার, আমি যাই? না আরও কিছু..." সে একটু ইতস্তত করে বলল।

    "আপনি এখনও এখানে?" ডক্টর সিং অপরাধী মুখে তাকালেন, “আপনি চলে যান, আমি ক্লিনিক বন্ধ করে দেব। আর...আপনি ঘোড়াতে যান, আজ আমি হেঁটেই বাড়ি যাব।"

    রাওয়াত টুপিটা ঠিক করে যাওয়ার সময় বলল, "কিছু নমকিনের দরকার? আমি বাজার থেকে..."

    "না, না, কিচ্ছু না। আমরাও একটু বাদেই বেরিয়ে পড়ব।"

    রাওয়াতজির যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আবহাওয়া বেশ হালকা হয়ে গেল। প্লাটফর্মের বাইরে হাওয়ায় কুয়াশা ভাসছে, বাজারের শব্দের গুঞ্জন অনেক আগেই থেমে গেছে, শুধু থেকে থেকে ঝিঁঝিঁর ডাক উপরে উঠে নীরবতাকে আরও গাঢ় করে তুলছিল।

    ডক্টর সিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা ফ্লাস্ক বার করলেন। আর দুটো গেলাস। আমার গেলাসে ব্র্যান্ডিটা ঢেলে যা বেঁচেছিল নিজের গেলাসে ঢেলে নিলেন। "এখন ভালো লাগছে তো?" আমায় বললেন, "তুমি যখন আমার অফিসে এলে, তোমার চেহারা দেখে আমি তো চমকে গেছিলাম।" একটা লম্বা চুমুক দিয়ে, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, "তুমি একটা ভীষণ ভুল করেছ।"

    আমি অবাক হয়ে বললাম, "কীসের ভুল?"

    "তুমি যখন এখানে এসেছিলে, ঠিক ছিলে, কিন্তু মিসেস মেহরা মারা যাবার পর তোমার ফিরে যাওয়া উচিত ছিল --এসব থেকে বেঁচে যেতে।"

    "কীসের থেকে?"

    "ওই যা সব ছেড়ে রেখে গেছে।" আরেকটা চুমুক দিয়ে রুমালে মুখটা মুছে নিলেন, "তোমায় বলেছিলাম না, সে আমাকে কেন ডেকেছিল? জানতে চায় তার আর কতদিন বাকি আছে।"

    আমি হাঁ করে তাকিয়েছিলাম, "উনি কি কোথাও যাচ্ছেন?"

    তিনি হাসলেন, "এখান থেকে আর কোথায় যাবে?"

    "তাঁর মেয়ের কাছে?" আমি বললাম।

    "মেয়েও তো এখানেই থাকে। এই পৃথিবীতেই।" তিনি আকাশের দিকে তাকালেন, চারিদিকে মুঠো মুঠো তারা, গ্রহ আর নক্ষত্রমণ্ডলী, "না, সে এই পৃথিবীর কথা বলছিল না।"

    একটা অজানা ভয় আমার শরীরে ছড়িয়ে পড়ল, "তবে… কীসের কথা?"

    "হয়তো নিজের সম্পত্তি, জিনিশপত্র থেকেই," তাঁর গলা নরম হয়ে এলো, "যেমন হোটেলের ঘর ছাড়বার আগে আমরা শেষবারের মতো চোখ বুলিয়ে নিই-- ওয়ার্ড্রোবে কাপড়চোপড় ফেলে রাখিনি তো, আন্ডারওয়ার, ময়লা রুমাল...বাথরুমে শেভ করার সাবান, এমন কিছু যার জন্য পরে লজ্জায় পড়তে হয়।... তোমায় ও কিছু বলেছিল কি?"

    "না তো। এসম্বন্ধে কিছুই না।"

    "হয়তো সে এক-এক কাজ এক-এক লোককে দিয়ে করায়। তোমাকে দিয়ে নিজের অতীত সম্বন্ধে লেখায়, আমাকে দিয়ে তার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে।"

    "কিন্তু কেন?"

    "প্যাটার্ন।" ডক্টর সিং অল্প হাসলেন। "ভাগ্যও। সে নিজের ভাগ্যটা জেনে নিতে চায়--যা কেটে গেছে আর যা এখনও হয়নি। তুমি তো জানো সে একজন উঁচু পোস্টের অফিসার...তার সই ছাড়া কোন ফাইল চলত না। শুধু এখন তার মনে থাকে না যে শেষ ফাইলটার উপর তার নয়, অন্য একজনের সই চাই...যা ছাড়া প্যাটার্নটা অসমাপ্ত রয়ে যাবে।"

    তিনি উঠে ফ্লাস্ক আর গেলাসদুটো বেসিনে নিয়ে গিয়ে ঘষে ঘষে ধুতে শুরু করলেন। ঠিক যেমন আগে নিজের হাত ধুচ্ছিলেন।

    আমিও উঠে পড়লাম।

    "আমি তাহলে আসি।"

    তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে আমার দিকে ফিরলেন, "কোথায় চললে?"

    "বাড়ি।" আমি ছোট্ট উত্তর দিলাম।

    কিছু ভেবে কাছে এসে আমার কাঁধে হাত রাখলেন, "একটা জিনিশ দেখাই তোমায়।"

    আমার হাত ধরে আবার প্লাটফর্মে নিয়ে এলেন।

    "দেখো, সামনে কী দেখতে পাচ্ছ?”

    কুয়াশাটা সরে গিয়েছিল। প্রত্যেকটি পাহাড়ের চূড়া আলাদা আলাদা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে, অ্যানার কটেজে আলো টিমটিম করছে, যেন কোনো তারা আকাশ থেকে পড়তে পড়তে আটকে গেছে। উপরে কোন পাহাড়ের কোলে নিরঞ্জনবাবুর বাগান কুয়াশায় মাখা... ওই দুটোর মাঝখানে মেহরা-সাহেবের ঘর ... তার তিনটি চিমনী অস্পষ্ট দেখা যায়... সেগুলো আমার কোয়ার্টার থেকে কত বড়ো দেখায় কিন্তু এখান থেকে দেশলাইয়ের কাঠির মতো দেখাচ্ছে, এক হাওয়ার ঝাপটায় উড়ে যেতে পারে।

    আমার চোখ হঠাৎ এক জায়গায় আটকে গেল। একটা চৌকো, সাদা মার্বেলের চাতাল, চারপাশে গাছ দিয়ে ঘেরা ...

    "ওটা কী?"

    "সিমেটেরি," জবাব দিলেন। ওই জায়গাটা শুধু এখান থেকেই দেখা যায়। শহরের সবচেয়ে পুরনো বিশ্রামস্থল।"

    তিনি আবার হাসছিলেন। আমি শুনছিলাম না। আমি একটা অন্য সময়ে চলে গেছিলাম। সে যখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে রুমালে চোখ মুছছিল।

    "কী হল? দাঁড়িয়ে পড়লে যে?"

    "কিছু না... একটা জিনিশ মনে পড়ল।"

    "সিমেটেরি দেখে? সেখানে তোমার কে আছে যাকে মনে করছ?"

    কেউ না। শুধু তার হাসি, যখন সে মাটির নীচে নামছিল।

    একটু পরে তিনি বললেন, "চলি?"

    "হ্যাঁ, চলুন।" আমি বললাম।

    অধ্যায় --১.৭

    গত রাত্রে অনেকক্ষণ পর্যন্ত ঘুম আসেনি। দূরে পাহাড় থেকে ধাঁই-ধাঁই শব্দ আসছিল, যেন কেউ টার্গেট প্রাকটিস করছে। বাইরে বারান্দায় এসে দেখলাম শব্দটা অ্যানার কটেজের দিক থেকে আসছে। সে কি বন্দুক নিয়ে শেয়াল তাড়াচ্ছে? কখনো কখনো শেয়ালরা খাবারের খোঁজে পাহাড় থেকে নেমে আসে বটে।

    অ্যানা একলা থাকে। একলা বাড়ির একটা নিজস্ব ভয় আছে। তাকে আটকানোর কোন সীমা নেই। সে যে-কোন সময় লাফ মেরে ঘরে ঢুকতে পারে, অ্যানার ঘুম ভাঙাতে পারে, বিছানা থেকে উঠিয়ে দিতে পারে, যেন সে-ই ঘরের মালিক। অ্যানা বন্দুক নিয়ে বুনো জন্তুদের ভয় দেখাতে পারে কিন্তু যে ভয় বাইরে না, ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকে, তাকে কি তাড়াতে পারে?

    কাকে ভয় পায় অ্যানা?

    অনেক বছর আগে সে এই কটেজটা এক বাঙালি আই সি এস অফিসারের কাছ থেকে কিনেছিল। বাবু পুজোর ছুটিতে এখানে এসে থাকত। তার কোন ছেলেপিলে ছিল না। তাই, তার বউ মারা যাবার পর এখানকার পাট চুকিয়ে কলকাতায় ফিরে গিয়েছিল। আমার মতো অ্যানাও বিজ্ঞাপন পড়ে এখানে এসেছিল। তফাৎ এই যে, আমি এসেছিলাম অন্যের দেখাশোনা করতে আর সে এসেছিল নিজের জন্য। "তুমি জানো সেই বাঙালি বাবু আমায় কী বলেছিল?" অ্যানা হেসে হেসে বলত, "ম্যাডাম, আপনি কি ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করেন?" আমি বললাম, "না বাবা, আমি সেসব দেশে ছেড়ে এসেছি।" বাবুকে অবাক হতে দেখে সে খুব হেসেছিল। সেই বাঙালি বাবু কি অ্যানাকে কিছু বলতে চেয়েছিল? না বুড়িটার খ্যাপাটে হাসি দেখে চেপে গিয়েছিল?

    সেসব অনেক বছরের কথা...আর আজ? আজ অ্যানা নিজেই একটা জ্যান্ত 'স্পিরিট'।

    হাতে বন্দুক, পায়ের উপর পুস্কি, মাথায় স্কার্ফ, দূর থেকেও মনে পড়ায় যে সে একদা রাজমহলে কাজ করত।

    গভর্নেস, মিস্ট্রেস? না স্রেফ এক চতুর, চালাক জার্মান মহিলা যে তার সাদা চামড়ার সাহায্যে তরুণ রাজকুমারদের আদিরসে ট্রেনিং দিয়েছিল হয়তো। হয়তো ট্রেনার, মিস্ট্রেস দুই-ই ছিল। শুধু কল্পনাই করা যায়। সে নিজের মুখে কখনো কিছু বলে না। তার অতীতের দরজায় লাল ঝাণ্ডা লাগানো আছে। সেখানে যাওয়া সবার নিষেধ। শুধু মিসেস মেহরা যেতে পারত, কিন্তু সে তো এখন সব দরজা পেরিয়ে মাটির নীচে শয়ান।

    আমি বারান্দা ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। চারদিকে চাঁদের শান্ত, শীতল আলো। ঘন জঙ্গলের অন্তঃস্থল থেকে একটা নেশা ধরানো গন্ধ দীর্ঘশ্বাসের মতো উঠে আসছিল। আমার খেয়াল ছিল না কখন চলতে চলতে আমি মেহরা-সাহেবের কটেজের নীচে চলে এসেছি। সেখানে মুরলীধরের কোয়ার্টারে আলো জ্বলছে। ভিতর থেকে পাহাড়ের নৈঃশব্দ ভেঙে হাসি, কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল। আমি দরজার কাছে আসামাত্র আওয়াজ একটু কমে গেল, ভিতর থেকে কেউ আধ খোলা দরজার বাইরে উঁকি দিতেই আমি চট করে সরে গেলাম। আমি ফিরেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু মুরলীধর বেরিয়ে এসে আমায় দেখে হকচকিয়ে গেল।

    "বাবুজী, আপনি?"

    "এমনিই, মুরলীধর," আমি কৈফিয়তের সুরে বললাম, "এই একটু বেড়াতে বেরিয়েছিলাম আর কি, তুমি কিছু শুনেছ?"

    তার হাঁ-করা মুখে একটু বিস্ময়, "ওই বন্দুকের আওয়াজ? ও তো অ্যানা বাঈয়ের বন্দুক। গত বছর বাঁদরের দল তার বাগান লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল ...গুলি নেই, খালি বন্দুক চালায়, ওদের ভয় দেখানোর জন্য। ভিতরে আসুন না। দেখুন কে এসেছে।"

    আমি কিছু বলবার আগেই সে নেশার আনন্দে আমার হাত ধরে টানতে টানতে ভিতরে নিয়ে এল। লন্ঠনের ধোঁয়াটে আলোর সঙ্গে হুঁকো, বিড়ি, আর ছিলিমের ধোঁয়া মিশেছে, তার পিছনে দেখলাম--ননকুকে।

    "ননকু তুমি এখানে?"

    "হ্যাঁ, গাঁ থেকে ফিরলাম। মেয়েটা আজ এখানেই থেকে যেতে বলল।"

    "জামাই বলেনি বুঝি?” আমি হেসে মুরলীধরের দিকে তাকালাম। তার ছোপ-খাওয়া পাহাড়ি দাঁতগুলো প্রসন্ন হাসিতে উজ্জ্বল।

    "ভালোই হল আপনি এলেন। আমি কালই আপনার কাছে যাচ্ছিলাম।"

    "কেন, মুরলীধর?"

    "বসুন, বলছি।"

    মুরলীধর কিছু বলবার আগে তার রঙ্গমঞ্চ তৈরি করে নেয়। হয়তো তার মালিক মেহরা-সাহেবের কাছ থেকেই শিখেছে। মেহরা-সাহেবের গল্প শুনতে শুনতে সে দৃশ্যগুলো মনে মনে মঞ্চস্থ করত। সে ভিতর থেকে একটা ধোয়া গেলাস আর পেতলের থালা নিয়ে এল। থালার উপর কয়েকটা ছোট ছোট ভাজা মাছ।

    "আমি গাঁ থেকে এনেছি। এখানে তো এসব পাওয়াই যায় না। সাহেবের জন্যও এনেছি।"

    "নিরঞ্জনবাবু খান বুঝি?”

    "হ্যাঁ, ভীষণ ভালোবাসে। যখনই গাঁ থেকে আসি, সবার আগে জিজ্ঞেস করে মাছ আর কমলার বোতল এনেছি কিনা।"

    "কমলা, লেবু নাকি?” আমি বুঝলাম না।

    মুরলীধর হাসতে শুরু করল। ননকু ভগতের হাসিটা ওর পাকা গোঁফের মধ্যে বেড়ালের মতো লুকিয়ে ছিল।

    "কমলার রস, বাবু।" মুরলীধর খাটের তলা থেকে একটা বোতল বার করে আমার গেলাসে একটু ঢেলে দিল।

    "খেয়ে দেখুন... টের পাবেন এর তেজ কত!"

    বুঝলাম, আমার অপ্রত্যাশিত আগমনের আগে এই তেজেরই চেষ্টা চলছিল। আমি গেলাসটা তুলে তীব্র গন্ধটা ডিঙিয়ে একটা ছোট চুমুক দিলাম। দুই জোড়া উজ্জ্বল চোখ আমার দিকে তাকিয়ে, যেন বোমা ফাটবার প্রতীক্ষায়। জোর করে মুখে একটু হাসি আনলাম, "তেজ তো বেশ, মুরলীধর..." আমি বললাম।

    পর্দার পিছনে খিক-খিক হাসি। মুরলীধরের বউ রাধা সব দেখছিল।

    কিছুক্ষণ পরে আমার মনেই রইল না আমি কোথায় বসে আছি। দম আটকানো ধোঁয়া আর গন্ধের মধ্যে আমি ধীরে ধীরে আমার সেই দুনিয়াটা ভুলে গেলাম, যেটা চব্বিশ ঘণ্টা আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকে কিন্তু এখন কোন অন্ধকার নালায় লুকিয়ে পড়েছে। তার জায়গায় জঙ্গলের গর্ভস্থল থেকে বেরিয়ে এল কোনো প্রাচীন জীবাত্মা... আমারই ভগ্নাবশেষ হয়তো... যার ধড়, মাথা, পা আলাদা আলাদা, দেখে বোঝা যায় না তার আসল চেহারাটা কেমন। আমি কে, যে লন্ঠনের মরা আলোয় মদ খাচ্ছে এদের সঙ্গে? নিজেকে হারিয়ে আবার নিজেকেই খুঁজছে? আমি কি সে, যে কিছুদিন আগে ডক্টর সিং-এর ক্লিনিকে সূর্যাস্ত দেখছিল? কমলা লেবুর সাত রঙের বন্যায় ডুবে যাবার আগেই আমি মাথাটা তুললাম।

    "তুমি আমায় কিছু জিজ্ঞেস করবে বলেছিলে, মুরলীধর?"

    মুরলীধর চুপ করে রইল। ননকু ওর দিকে তাকিয়ে বলল, "যা বলবার বলে দে বাবুকে। লুকিয়ে কী লাভ?"

    আমি একটু চিন্তিত মুখে তাকালাম, "কী হয়েছে মুরলীধর?"

    "ওকে আগে কখনো এরকম দেখিনি।"

    "কীরকম দেখনি?' আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, "সাফ সাফ বলো না।"

    "বাবু, আমি তাকে ছোটবেলা থেকেই দেখছি। কিন্তু এখন যেরকম... আগে এরকম কখনো দেখিনি। মেমসাহেব মরার পরেও না। মাঝরাতে উঠে আমায় ডাকে, বলে বাইরে গিয়ে দ্যাখ কে দরজায় টোকা দিচ্ছে ...আমি সারা উঠোন চক্কর দিয়ে আসি...দেখি সে বারান্দায় বসে... আমাকে দেখে অবাক হয়ে বলে আমি এত রাতে তার কাছে কেন এসেছি... ভুলে যায় যে সে-ই আমাকে ডেকেছিল।"

    লন্ঠনের আলোয় তার ভয়-পাওয়া বাচ্চা ছেলের মতো মুখখানা আমার দিকে তাকিয়ে।

    "এটা তার বুড়ো বয়সের ভুলো মন, মুরলীধর...ভয়ের কিছু নয়।"

    "আমি ভয় পাচ্ছি না বাবুজি, পুরো জীবনটা তো তার সঙ্গেই কাটিয়ে দিলাম, তাকে চিনব না? কিন্তু এবার মনে হচ্ছে এটা আলাদা। আমার মনে হচ্ছে সে অন্য কোথাও চলে গেছে।"

    "কী বলছ মুরলীধর, কোথায় আবার যাবে?"

    ননকু লম্বা শ্বাস ফেলে গেলাসে চুমুক দিল। দুজনেই আমার দিকে তাকিয়ে।

    "সে আর এখানে নেই বাবুজি।" মুরলীধরের গলা অশ্রুসিক্ত।

    আমি বুঝতে পারছিলাম না ওরা কী বলছে, ওদের কথাগুলো কোন নদীতে ভেসে যাচ্ছে।

    "এখানে নেই ... তো কোথায় আছে?"

    "জানি না... কখনো কখনো সে আমার পাশ দিয়ে এমনভাবে চলে যায় যেন আমি একটা দেয়ালের খুঁটি বা থাম, আমাকে না দেখেই এমনভাবে চলে, যেন সে জানে কোথায় যেতে হবে কিন্তু ভুলে গেছে সেখানে কী করে পৌঁছনো যায়।"

    মুরলীধর চুপ করে গেল...যেন নেপথ্যে কোথাও চলে গেছে। একটু পরে যখন ফিরল তার গলা খুব নিচু... "একটা কথা বলব বাবুজি... আমাদের গাঁয়ে নওরাত্রির সময় এক সাধু আসত... দিনরাত একটা গাছের তলায় বসে থাকত। গাঁয়ের লোকেরা পালা করে বিকেলে কিছু খাবারটাবার দিয়ে যেত। এক রাতে, আমার পালা... আমি আটা, ডাল, তেল, নুন একটা থালায় নিয়ে এসেছি, দেখলাম..." মুরলীধর হঠাৎ চুপ করে গেল। ননকু নেশা-ভরা চোখ খুলে বলল, "কী দেখলি তুই?"

    "আমি থালিটা রেখে চলে আসছিলাম...পিছন ফিরে দেখলাম বটগাছের ডালপালার মধ্যে আগুনের শিখাটার আকার একেবারে সেই সাধুর মতো...আর বাবাজি আশপাশে কোত্থাও নেই!"

    কিছুক্ষণ সবাই চুপ। তারপর ননকু বলল, "এরকম হয়... লোক চলে যায় কিন্তু নিজের আকারটা ছেড়ে যায়... আমরা জানতেও পারি না সে এখানে আছে না নেই। মরার ঠিক আগে সে আরেক বার জ্বলে ওঠে, ছাই-চাপা আগুনের মতো। আমার দাদু তো রাস্তায় কোনো লোককে দেখেই বলে দিতে পারত সে জ্যান্ত না মারা গেছে, শুধু তার শরীরটা চলে বেড়াচ্ছে।"

    হাওয়ায় কুঠির দরজাটা নড়ছে... যেন তার কাঠের শরীরটা কাঁপছিল। দূরে ঝোপের মধ্যে থেকে ঝিঁঝিঁর সুর চাঁদের আলোয় ভেসে আসছে।

    "আমার তো অ্যানা বাঈকে দেখেও ওইরকম মনে হয়। পাশ দিয়ে যাবার সময় আমার শরীরে কেমন একটা কাঁপুনি লাগে।" মুরলীধর কান থেকে একটা বিড়ি বার করে দেশলাই দিয়ে ধরাচ্ছিল, যতক্ষণ না চিড়চিড় শব্দে জ্বলে ওঠে। বলল, "যখন ছোটো ছিলাম, তার ঘরের সামনে দিয়ে দৌড়ে পার হতাম, যাতে আবার আমায় ডেকে না বসে।"

    "কেন? কীসের ভয় পেতে?”

    "তার সাদা চামড়া তো নয়?" ননকু হাসল, "তাতে আর ভয় কী? সে তো মায়ের পেট থাকে জন্মের সঙ্গেই পাওয়া... ভয় তখনি যখন আমরা পেট থেকে এক রূপে জন্মাই আর পৃথিবীতে পা রেখেই অন্য রূপে বদলে যাই। পরে আর মনেই থাকে না কোন রূপে জন্মেছিলাম আর এখন কী হয়ে গেছি।"

    "মানুষ কি সত্যিই এত বদলে যায়?" আমি হেসে তাকালাম ননকুর দিকে।

    "আলবত! যে জন্মায় সে কি মরার সময়ও একই থাকে? না। মরার সময় সে অন্য কেউ, যার জন্য আমরা চোখের জল ফেলি।"

    মৃত্যু-- একটাই ব্যাপার যা আমরা সবাই জানি... কিন্তু সেও কি শেষে আমাদের ধোঁকা দেয়? আমরা জানতেও পারি না সে কাকে তার সঙ্গে নিয়ে গেল ...যাকে আমরা জানতাম, না অন্য কাউকে, যাকে জানবার সময়ও পাইনি?

    "তোমার বিবিজীও কি এইভাবেই মারা গিয়েছিল, মুরলীধর?”

    "মেমসাহেব?"

    তার মুখে এক অদ্ভুত হাসি খেলে গেল, যেন মিসেস মেহরার নাম মুখে আনামাত্র ভিতরের কোনো বন্ধ দরজা খুলে যায়।

    "তার কথা আলাদা। আমি তার মতো কাউকে দেখিনি। আপনি তো জানেন আমি যখন এখানে এসেছিলাম তো এর মতোই ছোট ছিলাম," সে ননকুর কোলে ঘুমন্ত ছেলের মাথায় হাত বোলাল। "সে সময় আমার বাপ কোঠিতে চাকরি করত...গাঁয়ে দুই ক্রোশ দূরে থাকত। সে সময় আপনার এখনকার কোয়ার্টারও ছিল না। একবার বিমার হয়ে কিছুদিন কাজে যেতে পারল না। একদিন গাঁয়ে হইচই পড়ে গেল, পুলিশটুলিশ এলে যেমন হয়, কিন্তু পুলিশ আসেনি, এসেছিল মেমসাহেব, একেবারে ঘোড়ায় চড়ে! আমি এখনও তার চেহারাটা চোখের সামনে দেখতে পাই, যেমন আপনাকে দেখছি। এসেছিল বাবা কেমন আছে জানতে। যখন শুনল বাবার জ্বর, ঘোড়া থেকে নেমে ভিতরে এল আর একটু পরে দেখলাম বাবাকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে!"

    "সঙ্গে মানে?"

    "সঙ্গে মানে ঘোড়ার উপরে... মেমসাহেব লাগাম ধরে সামনে আর বাবা পিছনে বসে..."

    "ঘোড়া না একটা টাট্টু ....ভারি মিষ্টি..." ননকু বিড়ি খাওয়া হলদে দাঁত বের করে বলল,"সবাই ওকে 'প্যারী পোনি' বলে ডাকত। গাঢ় বাদামি রং, বড়ো বড়ো চোখ, মাথায় একটা সাদা তিলক, যেন মন্দির থেকে লাগিয়ে এসেছে। চড়াই উঠে আসবার সময় তার সারা শরীর ঘামে ভিজে যেত ... মেমসাহেব আমার হাতে লাগাম ধরিয়ে দিতেই সে খুশি হয়ে চিঁহিঁহিঁ করে উঠত --জানত এবার তার ঠান্ডা জল আর মিষ্টি গুড় মিলবে।"

    ননকু একটানা স্বরে বলে যাচ্ছিল, যেন চোখ খুলেই সে স্বপ্ন দেখছে।

    "ননকু, মেমসাহেব কি নিরঞ্জনবাবুর সঙ্গেও দেখা করতে আসত?"

    আমার মনে হল হয়তো এই প্রশ্ন তাকে স্বপ্ন থেকে জাগিয়ে দেবে, কিন্তু উলটে তার স্বপ্নটা অন্য খাতে বইতে শুরু করল।

    "পোনি থেকে নেমেই সে দোলনায় চড়ে বসত। আপনি দেখেছেন দোলনাটা... সে এত জোরে জোরে দুলত যে বটগাছটাও থরথর করে কাঁপত...বলে ননকু এমন জোরে শরীরটা বটগাছের মতো দোলাল যে কোল থেকে বংশী মাটিতে পড়ে কেঁদে উঠল। কিন্তু চোখ খুলে নানাজিকে দেখে কান্না থামিয়ে দেখতে থাকল। গাছ, গাছের ডালে বাঁধা দোলনা, দোলনার উপর মিসেস মেহরা। ননকুর নেশালু চোখে পুরোনো স্মৃতির মিছিল।

    তখুনি আমার হুঁশ ফিরে এল। হাওয়ায় ঘণ্টির টুনটুন আওয়াজ, মেহরা-সাহেবের ঘণ্টি, মুরলীধরকে ডাকছেন।

    আমরা তড়িঘড়ি উঠে পড়লাম। বাইরে সব নিস্তব্ধ। লনের ঘাস, ফুলের কেয়ারি, ঝোপ সব চুপ। শুধু মেহরা-সাহেবের বাড়িতে সব কটা আলো জ্বলছে।

    মুরলীধর চটপট পোশাক বদলে, লন্ঠন হাতে লম্বা লম্বা পায়ে কটেজের দিকে চলল। আমরা সবাই খোলা দরজায় প্রতীক্ষা করতে লাগলাম... আমি, ননকু, বংশীর হাত ধরে রাধা...সবাই শ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষায়...

    কিছুক্ষণ বাদে মুরলীধর ফিরল, আমাদের চৌকাঠে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক ... তারপর একটু হাসি...

    "ভয়ের কিছু নয়। তিয়া বিবি বাড়ি এসেছে..."

    আমাদের দেখে হাসি থামিয়ে বলল, “বাস লেট ছিল। তাই দেরি হল। এইমাত্র কুলির সঙ্গে বাস স্ট্যান্ড থেকে এল।"



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • | | ৩
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments