• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৮ | এপ্রিল ২০২৫ | উপন্যাস
    Share
  • ডহননাগড়ার কাহন (৯) : অংশুমান বিশ্বাস



    দ্বিতীয় অধ্যায়

    ।।২১।।

    হারু মরে গেল, কোভিডে। প্রশাসন ছুঁতেও দিল না বডি। হসপিটাল থেকে সরাসরি নিয়ে গেল শহরের সীমানা ছাড়িয়ে। পুড়িয়ে দিল আবর্জনার ভাঁটায়। কি করে ওকে এই রোগে ধরল কেউ জানে না। আন্লকে পবনের দোকান আবার খুললেও তেমন ভীড় তো হত না আর অন্য কারো তো সেখানে কিছু ধরাও পড়েনি। তবে সেখানে আগের মতোই রোজ দুবেলা হারু যেত। থাকতও অনেকক্ষণ। কে জানে বেদোই বয়ে এনেছিল হয়ত। হাসপাতালে কোন চিকিৎসাই হয়নি। ভেতরে ভেতরে নাকি কিডনি খারাপ হয়েছিল। জানতোও না হয়তো, জানলেও বলবে কাকে। নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিলনা কলকাতায়। তিনদিনের মধ্যে মরে গেল লোকটা। হারুর কাছাকাছি আসা লোকদের আলাদা করে দিয়েছে। কারখানায় পুরসভা থেকে স্যানিটাইস করে দিয়ে গেছে। বেদো সারাদিন একা একা কেঁদে চলেছে। সে কি খায়, কি পড়ে, আদৌ রান্না করে খায় কিনা কেউ সে খবর রাখে না। কারখানা থেকে বেরোনো বারণ। বেরোনোর ইচ্ছেও তার নেই। সে কোথায় যাবে এখন? কি করবে? একা একা সে এখানে আরেকটা হারুকাকা হয়ে থাকবে? দিলুর সঙ্গে আর কথা হয় না। বেদোর কথা কে শুনবে? বেদো গাল পাড়বে কাকে? মোমের গন্ধওয়ালা ঘরটা এখন নিজেই যেন শ্মশান। চিলতে বিছানাটার পাশে পেতল বেরোনো হলুদ হয়ে যাওয়া এভারেডী টর্চ, নস্যির কোটো আর তামার কানখুস্কি বালিশের পাশে পড়ে আছে। আর ওদিকের একটা ট্রাঙ্ক। সেই ট্রাঙ্কের তালা থাকত কাকার ঘুনসিতে বাঁধা। সে চাবি আর পায়নি হাতে। পেয়ে কি হতো। বেদোকে এখন লুকিয়ে বিড়ি খেতে হয় না। মনে মনে ভাবে বিড়ি খেতে খেতে যেন ওর শুকনো বুক আরও ঝাঁঝরা হয়ে যায়। কেন ভগবান এমন করল। কেন এমন মনে হচ্ছে তার যে সে সত্যি একা। একটা লোক যে আছে কি নেই যা নিয়ে বেদো কোনদিন ভাবতই না। সে মরে গেলে তার কেন এমন কষ্ট হচ্ছে! শুধু কি বেদো? ওই চুপচাপ একা মানুষটার মৃত্যু পাড়ার সকলের কাছেই এক হঠাৎ ধাক্কা। পবন নিজেও যেন চুপ করে গেছে। বিক্রিবাটাও নেই তেমন। খবরের কাগজ সেও বন্ধ ছিল। ফাঁকা ফাঁকা লাগে। পবন নিজে কোনদিন খবরের কাগজ পড়েনি। হারু পড়ত আর পবন সাত রকম কাজ করতে করতে সে খবর শুনত। কত যুগ ধরে সে অভ্যেস। পবন আগে কাগজটা হাতে ধরত একেবারে দিনের শেষে, গাদায় রাখবে বলে। আজকাল পবন এক চিলতে দুধ ফোটায়, তারপর খবরের কাগজ পড়ার চেষ্টা করে, চোখ রাখে, অক্ষরগুলোকে দেখে কিন্তু সেগুলো কোন শব্দ চোখে তৈরি করে না। আর ওদিকে দুধের তলা ধরে যায়। পোড়া গন্ধের দুধ চায়ের কাজে লাগে না। সে দুধ আলাদা করে রেখে ডেচকি মাজতে বসে। বারবার মাজে, বারবার ধোয়। গ্লাসে চা দেওয়া বারণ। মাটির খুরপি গুলোকে ধোয়, সাজায়। তারপর ভেজা কাপগুলোর আস্তে আস্তে শুকিয়ে যাওয়া দেখতে থাকে। শুকিয়ে যায় সব, মন শরীর আর স্মৃতি। একটা লোক প্রতিদিন আসত, একদিন থেকে সে আর আসবে না। কোনদিন তার গলার শব্দ শোনা যাবে না। মাথায় যন্ত্রণা হয় মাঝে মাঝে, মাস্ক পড়ে থেকে হয়তো। খুলে ঝোলায় থুতনির নিচে। ক্বচিৎ কেউ চা চাইলে তুলে নেয় নাকের ওপরে। সুধীর মাস্টার মাস্ক না পড়েই ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে গান গায়, শ্যামা সঙ্গীত। কিন্তু গান ছাড়া কোন কথা বলে না। পবনের দোকানে মাঝবয়েসি আর বুড়োর দল প্রায় কেউ আসে না বললেই হয়। টোটোওয়ালাগুলো চা খায়, বাকিতে। নিজেদের টোটোর হ্যান্ডেলে পা তুলে বসে থাকে বেশিরভাগ সময়। সওয়ার নেই কিন্তু বেরোয়। কম বয়েসিগুলো হয়তো মাঝেমাঝে আসে। তা সেগুলোর সঙ্গে মেলানো যায় না যেন আর। পবন ওদের সঙ্গে কি কথা বলবে। চোখ ফুটেছে নাকি ওগুলোর। আর ফুটবেও না মনে হয়। ওরা কেউ কথা বলে না। মোবাইলে তাকিয়ে থাকে কানে তার গুঁজে। শব্দহীন পৃথিবী। খবরের কাগজ বা মানুষের মুখ বা চায়ের ঠেক কোথাও কোন শব্দ নেই যেন, কোথাও কোন কথা নেই যেন। শব্দকে যেন পুড়িয়ে এসেছে কারা শহরের সীমানা পেরিয়ে, আবর্জনার ভাঁটায়। পবনের বয়েস কম হয়নি কিন্তু সে এতদিন মৃত্যু নিয়ে কোনদিন ভাবেনি। আজকাল খবরের কাগজটায় তাকিয়ে দেখে শুধু মৃত্যুর খবর। মৃত্যু নির্মম আর ফাঁসির আসামি না হলে দিনক্ষণ হীন। এরই মধ্যে কোথা থেকে হারুর দেশের বাড়ি থেকে লোকজন এসে সম্পত্তির হিসেব নিয়ে গেছে, কিছুই পায়নি। পোস্ট অফিসে যা আছে যৎসামান্য তা বেদোর নামে। জমিজমা যা ছিল দেশে লেখাজোকা ছিল না, সে কি আত্মীয়রা ছাড়ে? তার ওপরেও এসেছিল আরও কিছু যদি জোটে।

    সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি মন্দির, মসজিদ সব খুলে গেছে। টি ভি খুললে শুধু একই খবর, পৃথিবীতে যেন কোন খবর আর নেই। এ রোগ কবে কমবে কেউ জানে না। ট্রেন বন্ধ। স্কুল কলেজ কবে খুলবে কেউ জানে না। হারু মারা গেছে বেশ কিছুদিন হয়েও গেছে। কিন্তু দিলু একবারও কারখানার দিকে যায়নি। গিয়ে কি করবে? কি দেখবে গিয়ে? যে চলে গেছে তাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে? বেশ কিছু টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিল বেদোকে। সব মিটে গেলে শ্রাদ্ধ শান্তি করার জন্য। তার এখন নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। আজই তাকে পুজো নিয়ে কথা বলতে হল সকালে। এখন একটা ক্লাব নয় এখন দরিয়াপুরের অনেক ক্লাব থেকেই তার সঙ্গে কথা বলতে আসে। সবাই প্রেসিডেন্ট করতে চায়। দুর্গা পুজোর আর বেশি দেরি নেই। যদি ক্লাবগুলোকে করতে দেয় তবে নমো নমো করেই হবে। কোথাও কোন বাঁশ পড়েনি, কোন ঠাকুর বায়না হয়নি।

    —আপনার কি অতি দীর্ঘ বলে মনে হচ্ছে এই পাণ্ডুলিপি?

    —কাকে বলছেন আপনি এ কথা? যার কোন সময় নেই তার কাছে আর দীর্ঘ বলে কি মনে হতে পারে?

    —কিন্তু কেউ তো পড়বে না এই লেখা।

    —তাহলে তো মিটেই গেল নবীন। আপনি তো আর নাটক রচনা করছেন না। আপনি লিখে রাখছেন আকর যাকে পৃথিবী এক সময় ইতিহাস বলবে। আর ইতিহাস তো শুধু সাল তারিখ নয়। সে যে আপনার নিজের কথাও। নিজের মনের কথাও।

    —আপনি যখন বলছেন তখন হয়তো ঠিক করছি।

    তারপরে আবার সূর্যশেখর পড়ে যেতে থাকেন তার লেখা আর এক মনে শুনে চলেন কলহন। যেমন রাজ্যে ২০২০ অক্টোবর মাস থেকে আট হাজার পুরোহিতকে এক হাজার করে মাসিক ভাতার ঘোষণা করল রাজ্য সরকার। ন বছর আগেই ইমাম আর মুয়াজ্জেন ভাতা ঘোষণা করেছিল এই সরকার। অন্যদিকে কেন্দ্রে কৃষি বিল পাস হয়ে গেল সেপ্টেম্বর, ২০২০। ভোটাভুটি হলে হেরে যেতে পারে এই আশঙ্কায় ধ্বনিভোটে পাশ হল বিল রাজ্য সভায়। শুধু কৃষি বিল নয় বাইশে সেপ্টেম্বর ফাঁকা কক্ষে মোট এগারোটি বিল পাস হয়ে গেল। কখন? যখন অতিমারির জন্য সংসদের কোয়েসচেন আওয়ার রদ করা হয়েছে তখন, যখন কৃষক বিলের প্রতিবাদে লোকসভা বয়কট করছেন বিরোধী সাংসদরা তখন। রাজ্যসভার বিলগুলোর মধ্যে অত্যাবশ্যক পণ্য আইন সংশোধন বিল, ব্যাঙ্ক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন বিল, কোম্পানি আইন সংশোধন বিল, কর ও অন্য আইন সংশোধন বিল রয়েছে। লোকসভার বিল গুলোর মধ্যে শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা বিধি, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা, শিল্প সম্পর্ক বিধি, ও জম্মু কাশ্মীর সরকারি ভাষা বিল রয়েছে। বিরোধীরা সংসদের দুই কক্ষেই প্রতিবাদ করল। পাঞ্জাব হরিয়ানায় কৃষি আন্দোলন শুরু হোল। সেই বিক্ষোভ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল দেশের অন্য প্রান্তেও। পঁচিশে সেপ্টেম্বর কৃষক সংগঠন গুলো লকডাউনের মধ্যেই বন্ধ ডাকল। উত্তর প্রদেশ, বিহার, কারনাটক, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা সহ বিভিন্ন জায়গায় এই আন্দোলন শুরু হল ধর্না মিছিলের মাধ্যমে। দক্ষিণে বাঙ্গালোরে, ত্রিচিতেও বিক্ষোভ দেখায় চাষিরা। কিন্তু দরিয়াপুরে সেই আন্দোলনের আঁচ নেই। একেবারেই নেই।

    #

    শহরে নতুন গড়ে ওঠা টাউনশিপে একটা অফিস। এই অফিসে দিলু বসে আজকাল। এইটাই ওর নিজের কাজের জায়গা। একদম হাল ফ্যাশনের বিজনেস অ্যাপার্টমেন্ট। সুন্দর করে সাজানো। আধুনিক, ছিমছাম। একদম ভেতরের ঘরটায় ও নিজে বসে। তার সামনের ঘরে আছে একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট। পাশের ঘরে তিনজন সাপোর্ট স্টাফ। অফিসে ঢোকার কাঁচের দরজা পেরিয়ে একদম সামনে বসার জায়গা, গেস্ট বা ক্লায়েন্ট অপেক্ষা করতে পারে। কম্প্যাক্ট। এই অফিসেই ও সব কাজ সামলায়। প্রতিদিন এখানে ঢোকার সময় ও নিজেকে বদলে ফেলে। প্রতিদিন ও বিভিন্ন জায়গায় যায়। প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে ও মেশে। এক এক জায়গায় যাওয়ার আগে ও এক এক ভাবে নিজেকে সাজিয়ে নেয়। এ এক তৃপ্তি। ওর কাছে যারা কাজ করছে তারা উদ্যমী, বিভিন্ন বয়েসের মানুষ। শিক্ষিত প্রফেশনাল সবাই। এক একজনকে এক একটা দায়িত্ব দেওয়া আছে। তাদের কাছ থেকে ও বুঝে নেয় প্রতিদিনের কাজ প্রতিদিন। প্রতি সোমবারে মিটিং। পুজোর পর থেকেই এই জায়গাটা নিয়েছে। বিভিন্ন দিকে ওকে যেতে হচ্ছে যদিও কিন্তু এখানে ও প্রতিদিন বেশির ভাগ সময় এখানেই থাকার চেষ্টা করে। থাকতে না পারলেও কাজের খোঁজ নিয়ে নেয়। ডকুমেন্ট্স চেক করে নেয় মোবাইলেই। এখন ও আর থামতে জানে না। খুব মেপে চলতে হচ্ছে দিলুকে। ওর সঙ্গে দেখা করতে একদল একটু বাদেই আসবে। দিলু তার অপেক্ষা করছে। নিজের জমি শক্ত করার জন্য রাজনীতি ও বিজনেস আলাদা কোন কিছু নয়। প্রতিষ্ঠাই তৃপ্তি। পাঁচ বছর আগে এই বিল্ডিংটার ইঁট, পাথর, বালি সাপ্লাইয়ের সময় থেকে সে নিজেকে এখানে ভাবত। কলবাবুর হয়ে সেই সিন্ডিকেট মাসলম্যান থেকে এখানে নিজের অফিসের গদিতে এসে বসা। তাকে সবই করতে হয়েছে নিজের জান লড়িয়ে। তার এখনও কোথাও পৌঁছনো হয়নি। সে আরও অনেক দূরের দেখতে পায়। এই সময় তার সময়। অনেক অপেক্ষা, অনেক পথ, অনেক মুখ, অনেক বিপদ আর অনেক হতাশার পর এই সময় তার সময়। কখনো কখনো মনে হয় কিভাবে হচ্ছে চারপাশে সব কিছু সে যেন কিছুই জানে না। সে যেন আসলে নিজে কিছুই করছে না। কিন্তু এই অফিসে এসে যখন বসে তখন মনে হয় সে ভাবনা তার ভুল। সব তার নিজের বানানো। সে কারিগর তার নিজের ভাগ্যের। পৃথিবীর ইতিহাস কাকে দেখতে চায়? কাকে মনে রাখতে চায়? দিলু সেই প্রশ্নের উত্তর আগে থেকেই জানত। সে নিজেই সমস্ত উত্তর। সেখানে সে কোন পাপ দেখে না। পূণ্যও যেমন সে কিছু খোঁজে নি কোথাও।

    —আপনি নিচুতলা থেকে কাজটা বুঝে এসেছেন। আমরা চাইছি নতুন রক্ত। শুধু সাহসী মানুষ চাই।

    —আপনাদের তো আরেকজনও পছন্দের মানুষ আছে। আর তার তো অগাধ পয়সা আছে।

    —দেখুন উনি পছন্দের ছিলেন, আগে। কিন্তু উনি এখনো জল মাপছেন। আমাদের সঙ্গে এখনো আসেননি। আর ওনার সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা নেই। শুধু পয়সা দিয়েই কি মন কেনা যায়?

    —কিন্তু পরে যদি মত বদলান?

    —দেখুন আসতে চাইলে ফেরানো হবে না কাউকে। তবে ওই যে বললাম নেতৃত্বে আমরা নতুন যুগের মানুষ চাইছি, আমরা দূরের ভাবতে চাইছি। তাছাড়া আপনি এর মধ্যেই খুব তাড়াতাড়ি এই অঞ্চলে আলাদা করে নাম করেছেন আর মুসলমান ভোটারদের মধ্যে আপনার জনপ্রিয়তা আছে। ওটা যত বেশি পাই ততোটাই মঙ্গল।

    —মুসলমান ভোট শুধু পছন্দের মানুষ দাঁড় করিয়ে আসবে না।

    —জানি, কিন্তু কিছু ফ্লোটিং ভোট থাকে, এখন আরও বেশি হয়ে যাচ্ছে। সেই জায়গাটাকে ঠিক করা দরকার।

    —সরাসরি একটা কথা হয়ে যাক। দিলু চোখে চোখ রেখে বলে উল্টোদিকের লোকটাকে।

    —বলুন আপনি কি কথা বলছেন।

    —আমি কি ধরনের সাহায্য পাবো?

    —দেখুন এই কোল্ড স্টোর, রাইস মিল সব জায়গাতে আমরা আপনাকে সুবিধে দেব। আপনি কন্সট্রাক্সনের কাজ ধরছেন ধরুন। আমরা আপনাকে হেল্প করব। ভবিষ্যতের কথা ভাবতে আমাদের হবেই।

    —আর পার্টির তরফে কি ধরনের পদ দেওয়ার কথা ভাবছেন?

    —আমরা তো অনেক দূরের ভাবছি দিলু বাবু। এই মুহূর্তে আপনি অঞ্চল নন, জেলা কমিটির সরাসরি যুগ্ম সম্পাদক হবেন। আপনার সুবিধে হবে, আপনাকে আমাদের পুরনো লোকেরা সাহায্য করবে বেশি কারণ আপনি কোন দল বদল করে আসছেন না। আপনি কাজের মানুষ আর আপনার মনের মানুষ হিসেবেও সুনাম আছে। আপনার গায়ে যে পুরনো কলঙ্ক সে আপনার গয় না। আমরা লোক চিনি ভাই। আপনি আমাদের ভবিষ্যতের সম্পদ। খুব তাড়াতাড়ি সময়টাকে ধরে ফেলতে পেরেছেন আপনি।

    —কুমারবাবুর আশীর্বাদ খুব বড় কথা, কুমারবাবুর আশীর্বাদ যাতে আমি ভবিষ্যতেও পাই তার জন্য আমি আমার মতো এগোব। আর এ বিষয়ে স্বাধীনতা আমার চাই। সেটা সকলের জন্যই মঙ্গল।

    —আমরা দূরদর্শী মানুষ পছন্দ করি।

    —কাজ করার জন্য আমার নিজের ছেলেদেরও কিছু কিছু দায়িত্ব দিতে হবে।

    —নিশ্চয়ই। আমরা তো তাই চাই।

    —এ অঞ্চলে জনসভার ব্যবস্থা আমি করব আর আমি সেই জনসভায় নিয়মিত বক্তব্য রাখব।

    —আপনি কাজ করুন নিজের মতো করে গুছিয়ে। আপনার মতো মাটি থেকে উঠে আসা মানুষ জনগণের মনের কথা বুঝতে পারে বেশী, মানুষের মধ্যে ঢুকে যেতে পারে বেশি। আপনি বলেনও তো চমৎকার। আমাদের রাজনৈতিকভাবে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করাটা সহজে তাড়াতাড়ি করতে হবে। এই হল আদর্শ সময়। মানুষের সামনে আর কোনও কাজ নেই। সবাই ধুঁকছে। কোভিডে ধুঁকছে, ভবিষ্যৎ নেতার অভাবে ধুঁকছে। সামনে স্বপ্ন দেখাতে হবে। আপনি তা পারবেন। আপনার নিজের জীবন তো স্বপ্নের মতো হয়ে উঠেছে। মানুষ আপনার কথা শুনবে।

    —জনসভায় খরচ আমি দেব আর সেখানে হেভিওয়েট আনার প্রতিশ্রুতি আপনি দেবেন। দিলু একটা সিগারেট ধরায়।

    —এ চাহিদা গুলো খুব পসিটিভ চাহিদা দিলুবাবু। এগুলো না হলে সামনের দিনে আমরা এগোব কি করে। কিন্তু দুটো বিষয় দিলু বাবু। কথাটা বলে ওপাশের লোকটা একটু সময় নেয়, হাসে, সামনে রাখা চায়ের কাপটার চা শেষ করে তারপর বলে -- দুটোই আপনার জন্য মঙ্গল। প্রথম এই সিগারেটটা কমিয়ে দিন। আপনি আমার থেকে অনেক ছোটো। অনেক দূর যেতে হবে। পরেরটাও স্বাস্থ্যের জন্য -- একটা ভালো ঘরে বিয়ে করুন। আপনার যে বিয়ে আসলে হয়ইনি সেটাই আপনার সব থেকে বড়ো প্লাস পয়েন্ট। আমি দেখে দিচ্ছি পাত্রী। দারুণ বাড়িটা কিনেছেন। পুরনো হলেও ওর মতো জায়গা দরিয়াপুরে আরও একটাও নেই। নতুন বাড়িতে উঠে যান। জীবন শুরু করুন। আমরা আপনার সঙ্গে আছি।

    দিলুর ভেতরে ভেতরে মনে হল লোকটার গলা টিপে ধরে। মাথা নামিয়ে একপাশে তাকিয়ে থাকলো একপলক। কিন্তু আজকাল ও রাগকে হাসিতে বদলে দিতে শিখেছে। তাই পরমুহুর্তেই সামনে মুখ ফিরিয়ে মৃদু হেসে সে বলে উঠল -- বিয়ের এত তাড়াতাড়ি কি আছে?

    #

    ভানু সাহা যখন থানায় ঢুকছে তখন লক আপে একটা কয়েদি চা খাব চা খাব বলে চেল্লাচ্ছে। সে শব্দ ঢোকার মুখ থেকে শোনা যাচ্ছে। গেটে ল্যাগব্যাগে ধেরেঙ্গা লম্বা মহিলা সেন্ট্রি পূর্নিমা। সে রাইফেল সামলাবে না শাঁখা পলা সামলাবে না স্যালুট করবে সেটা ঠিক করতে করতে সিরিঙ্গে চেহারার ভানুবাবু করিডর পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে থাকলেন। এই মেয়েটাকে দেখলেই বিরক্ত লাগে। চন্দ্রিমা থাকলে দিনের শুরুতে মনটা ভালো হয়ে যায়। এই মহিলা পুলিশগুলোর যে কি দরকার! আবার কি বায়নাক্কা, ডিউটি নিয়ে, পোস্টিং নিয়ে, পোস্টিং পার্টনার নিয়ে। শালা ঝামেলা বাধলে ছেলেগুলোর মতো ঢিল পাটকেল খেতে যেতে তাদের আবার বড় কষ্ট। জীবন অতিষ্ঠ হয়ে গেল। আর কত যে মহিলা পুলিশ এ থানাতেই তার ইয়ত্তা নেই। যেখানে মহিলা সেখানেই ঝামেলা। অবশ্য চন্দ্রিমা থাকলে এই চিন্তাগুলোই আবার অন্য রকম হয়ে যেত। বা অন্য কেউ। কিন্তু এই পূর্ণিমা! খিঁচিয়ে উঠল দারোগাবাবুর মন। দিন ভালো করার একটাই উপায় আছে। এ এস আই ইন্দ্রাণী নন্দীকে একবার ডেকে পাঠানো চেম্বারে। টেবিল ডিউটি করে। চমৎকার দেখতে, কি ফিগার। এ থানার কেন, এ অঞ্চলের সব থেকে সুন্দরী মহিলা পুলিশ। একটু কথা বলে নিলে মনটা খিঁচরে যাওয়া থেকে বাঁচত। কিন্তু কিছু কাজ না জমা হলে তো ডেকে পাঠান যায় না। মেয়েগুলো সব বোঝে। মাল এক একখা না। ইন্দ্রানি আবার মেয়ের বয়েসি। কি না কি রটিয়ে দেবে। ভানু সাহা শেষ জীবনে এসে এসবে জড়াতে চায় না। মনটা শান্ত করার এই মুহূর্তে আর কোন উপায় দেখতে না পেয়ে চেম্বারে ঢুকে, চেয়ারে বসে এক কাপ চা বলে একটা সিগারেট ধরাল। ক্লাসিক। কাল এক পার্টি দিয়ে গেছে। যদিও এটা বিধবা সিগারেট। নেভি কাটের ধারে কাছে আসে না, কিন্তু ওই পড়ে পাওয়া চোদ্দো বা ষোলো বা আঠেরো আনার স্বাদ আবার আলাদা। যা একটু বেশি পাওয়া যায় তাই তো আনন্দ দেয়। প্রত্যেক টানে মনটা শীতল হয়ে আসছে। আর ন মাস। আহা মা আনন্দময়ী। জয় বাবা লোকনাথ। শেষ ভালো হলে সব ভালো হয়। একটাও প্রোমোশন দরকার নেই, যা হয়নি তা হয়নি। ওপরওয়ালা তোমার দয়ায় পেনশন যেন নিজের হাতে তুলতে পারি। এত দিন তো দেখলে তোমরা, শেষটাও দেখো। মনে মনে বিড় বিড় করতে করতে মনটাকে যখন আরও শান্ত করে তুলতে পারছেন ঠিক তখন দরজা খুলে হাসি হাসি মুখে কালো মুষকো গোঁফটাকে মাস্কের ওপরে নিয়ে বিপ্লব দাস হাজির।

    —স্যার। গুড মর্নিং স্যার।

    - মর্নিং।

    - স্যর একটা বিষয় ইনফর্ম করতে এলাম। পারমিশনের তোয়াক্কা না করেই দাস সামনের চেয়ারে বসে আর শরীরটাকে একটু সামনে এগিয়ে কথাটা বলে।

    - কি বিষয়? বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করে ভানু সাহা।

    - স্যার লিফলেট পড়ছে।

    - পরিষ্কার করে বল।

    - লিফলেট পড়ছে। যেমন পড়ে, কিন্তু পলিটিকাল। আর এদিক ওদিক সব জ্বালিয়ে দিচ্ছে। লোকজন মজা পাচ্ছে। কিন্তু এই কিছুদিনের মধ্যেই দুই তিন বা চার তরফ থেকেই এফ আই আর হল বলে।

    - আগে হোক।

    - সে ঠিক কিন্তু স্যার। সব্বাই যদি চেপে ধরে তখন ইউনিফর্ম বাঁচিয়ে, ফ্রিডম অফ স্পিচ বাঁচিয়ে, মানবাধিকার কমিশন বাঁচিয়ে আর সব থেকে বেশি স্যার পোস্টিং বাঁচিয়ে চলতে হবে তো স্যার।

    - কে করছে খবর নাও। চাপ এলে তুলে এনে রগড়ে দিলেই হবে। ইন্টেলেকচুয়ালরা থানায় এলে অনেকে মুতে দেয় প্যান্টে।

    - জানতে পারছি না। খুব গোছানো কাজ। লেখাগুলোও চমৎকার। দারুণ, এক্কেবারে সবার মনের কথা। তবে কেমন যেন। ইস্তেহার নয় ডাইরি নয় গল্পও নয় আবার কবিতাও নয়।

    - তুমি কবিতা বোঝ নাকি?

    - কি যে বলেন! ধুর সে কি আমি বুঝি!। তবে মাঝে মাঝে কেমন যেন ধোঁয়াশার মতো লেখাও থাকে।

    - কিন্তু সে যাই হোক আমার যেন কেমন মনে হচ্ছে ঝামেলা হবে। আর স্যর ফেসবুক ব্যবহার করছে না। আইডেনটিটি ডিসক্লোস করছে না।

    - খবর রাখো।

    - স্যার এ তো বাংলাদেশের ভাড়াটে কিলার নয়। মুখ বাঁধে না। মুখই নেই। কি আর করব। আপনার আদেশ নিয়ে তাহলে খোঁচর লাগিয়ে দিলাম।

    - হুম।

    ভানু সাহা ভাবে। তারপর বলে -- দাস তুমি বড় চিন্তায় ফেলে দিচ্ছ। শোন শেষ দিকে এসে তোমায় বলছি এসব আমার নিতে ভালো লাগছে না। এখন সাধারণ ফালতু বিষয়েও বেশ মনটা দুলে যাচ্ছে। বুঝলে?

    - স্যার আপনার সঙ্গে সব কথা বলা যায়। নইলে আমি আর এত মন দিয়ে কাজ করে কি করব স্যর। এমনিতে পুলিশ ক্লার্ক ছাড়া আর কি স্যর বলুন তো? জগন্নাথ। মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে হয় একটু মাথা খেলাই।

    - খেলাও। তোমার মাথা তো ভালোই।

    - না স্যার ভালো হলে কি আর এখানে থাকি।

    দাসের মুখে তাকিয়ে থাকে ভানু সাহা। কাউকে না কাউকে বিশ্বাস না করলে তো কাজ করা যায় না। এই ছেলেটাকে মনে হয় সব মিলে বিশ্বাস করা যায়। সারাজীবনে কত রকমের লোক দেখেছে সে নিজে। ভালো--মন্দ, পড়াশোনায় খারাপ ভালো। নিজেও তো সাহা ভালো পড়াশোনায় ছিল। কিন্তু ছঅতগুলো ভাইবোনের মধ্যে পড়া চালানোটা কি সহজ ছিল। যাই হোক এখন এসব ভেবে কি হবে। চা দিয়ে গেল এতক্ষণে। বুড়োটা চা টা কিন্তু ভালো বানায়। বিনয়, গাড়িগুলো ধোয় আর চা পাঁউরুটি বানায়, এইভাবেই জীবন চালিয়ে গেল। ভানুসাহার থেকে বড়োই হবে। দাসকেও এক কাপ দিয়ে গেছে।

    —ওই আসামিকে দিয়েছিস চা?

    —হ্যাঁ স্যার। পাগল স্যার। চায়ের পর বাপুজি কেক খাচ্ছে। বিনয় চলে যায়।

    —দাস বাবু আপনার ছোটবেলা কেটেছে কোথায়?

    —স্যার হুগলীর রাধানাগর গ্রামে, বলতে আনন্দ আর লজ্জা একসঙ্গেই হয় স্যার।

    - কেন?

    - ওই স্যার রামমোহনের রায়ের পাড়ায় কি না।

    - আচ্ছা। সেই জন্য লজ্জা? আমিও তো ঈশ্বরচন্দ্রের দেশের লোক। এই জন্যই এত ভরসা করি আপনাকে।

    - স্যার তাই নাকি!

    - আরে জীবনে বেঁচে থাকাটা সাধারণ মানুষের সব থেকে কঠিন কাজ। সে ওঁরাও জানতেন। তোমার আমার দোষ কি বল।

    - ঠিক এই জন্যই স্যর লেখাগুলো এত জনপ্রিয় হচ্ছে। কি লিখছে স্যার। একদম এক একটা কেস স্টাডি। ভেতরের কথা যেন উগরে দিচ্ছে কলমের ডগায়। একদম ল্যাঙটো করে দিচ্ছে দরিয়াপুরের সব পাণ্ডাগুলোকে। এত খবর পাচ্ছে কি করে কে জানে। একা না অনেকে তা বোঝা যাচ্ছে না। যাই হোক তবে নেটওয়ার্ক আছে সাঙ্ঘাতিক।

    - আরে এগুলো তো দেখে দেখে অভ্যস্থ মানুষে।

    - কিন্তু স্যার ধরুন কোন কোল্ড স্টোরে কত কেজি আলু পুড়িয়ে আলুর দাম বাড়ানোর চেষ্টায় আছে। বিধায়ক কত টাকা ট্যাক্স ফাঁকি দিল। বা স্যার সব থেকে বড় কথা কলবাবুর কালো ব্যবসার কথা নথি সমেত বলে দেওয়া এগুলো হলে কি মানুষ মজা পাবে না? আর তারা এফ আই আর লজ করবে না?

    - সাঙ্ঘাতিক কথা।

    - হ্যাঁ স্যার সাঙ্ঘাতিক।

    - আচ্ছা তাই বাবাজি আর নেতাজিরা সবাই ভয় পাচ্ছে।

    - হ্যাঁ স্যর এই সময়ে নেতারা ভয় পায়। ঠিক এই সময়টায়, যখন কিছু ঘটলে সব কিছু থিতোনোর আগে ভোটটা এসে যায়।

    - ছকে চলছে বলছ।

    - হ্যাঁ একদম।

    - তাহলে তো ভাবতে হয়। এক্ষুনি চাপ এল বোলে।

    - সে তো আসবেই। কিন্তু স্যার অন্য ভয়ও আছে।

    - এতদিন নেতাদের নিয়ে লিখছে, এবার যদি পুলিশের ভেতরের খবর নিয়ে লেখে।

    - তুমি খামকা ভাবছ দাস, কেউ কোনদিন ধোয়া তুলসি পাতা ভাবে আমাদের।

    - তা নয় স্যার। যদি স্যার বানানো কেস গুলো ধরুন..., বা..... ধরুন ধামা চাপা দেওয়া কেস ডাইরিগুলো জেনে গিয়ে এবার লিখতে শুরু করে। বাকিদের নাম তো করবেই আপনার আমার নাম যদি করে। তখন?

    - কি বলচ কি দাস, আমার তো আর চাকরীর বেশিদিন নেই।

    - স্যার আপনাকে দেখে যতটা রুক্ষ বলে মনে হয় আপনি একদম নন।

    - দাঁড়াও দাঁড়াও আমার ভালো লাগছে না দাস। তুমি দেখো।

    - স্যার দেখছি তো, স্যার এটাই চালিয়ে যাবেন।

    - কোনটা?

    - এই স্যার 'তুমি'টা।

    - ওঃ তাই বল। দাস আমাদের ভেতরে খোঁচর কে?

    - সব স্যার সব।

    - মেয়েগুলোও?

    - হ্যাঁ স্যর ইন্দ্রাণী থেকে পূর্ণিমা কে নয়। ওদিকে সুনীল থেকে বুধন সব, কাকে কে কি ভাবে ফিট করে আছে সে বড় জটিল নাড়ির টান।

    - ওঃ তুমি ইন্দ্রাণী থেকে পূর্ণিমা এই রকম ভাবে সাজালে কেন?

    - স্যার পুরুষমানুষ স্যর। তবে কন্ট্রোল, কন্ট্রোল। স্যার আপনাকে কেন যে সব বলে ফেলি। আপনি কিন্তু চিন্তা করবেন না। জীবনে স্যার মাঝ বয়েসে এসেছি। এখন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছি।

    - তোমার এই বয়েসটায় পুরুষ মানুষ একটু ইমোশনাল হয় দাস।

    - হ্যাঁ স্যার, মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে এমন যদি আমি লিখতে পারতাম, সমাজের সংস্কার করতাম।

    - তুমি লিখছ না তো দাস?

    - আরে কি যে বলেন, আমার তেমন লেখার হাত আছে না সে সাহস আছে? তবে মাঝে মাঝে সত্যি মনে হয় যেন আমিই লিখছি বুঝলেন।

    - তোমাকে নিয়ে যে মুস্কিলে পড়লাম দাস।

    - না স্যার ভয় পাবেন না। আমরাই লিখব। আমরাই আবার ভুল প্রমাণ করব।

    - জটিল হয়ে যাচ্ছে দাস। এই বয়েসে জটিলতা সহ্য হয় না আর।

    - স্যার আপনার বয়েসটা এমন কিছু হয়নি স্যার। দেখে কিছুই বোঝা যায় না।

    - দেখে তো তোমাকেও মনে হয় না। শরীর ছাড়া তুমি আসলে ঠিক পুলিশ পুলিশ নও।

    - স্যার সেই জন্যই আপনার সঙ্গে আমি কথা বলে আনন্দ পাই। আপনিও ঠিক উর্দিটাকে মনে বসাতে পারেননি।

    - কি বলছ পঁয়ত্রিশ বছরেও আমি উর্দির মাপের হয়ে উঠি নি!

    - না স্যার পারেননি। আমার চোখ আছে স্যার।

    - না না তুমি ভুল জানো। কি যে বলছ। হঠাৎ করে ফোন বেজে ওঠে। খুবই সংক্ষিপ্ত ফোন। ভানু সাহার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। কলবাবু এফ আই আর করতে আসছে।

    #

    শিউলি আজ ভাইফোঁটা দিয়ে এসেছে বেদোকে। কারখানা থেকে বেদো আর কোথাও বেরোয় না। শিউলির বাড়িতেও আসে না। বেদোর শরীর ভালো নেই। বিড়ি খেয়ে খেয়ে আর কিছু রাখেনি। হালকা জ্বর আছে সঙ্গে কাশি। বলল বেশ কিছুদিন ধরে আছে। কাল ওকে জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। কোভিড হতে পারে। আসলে মন ওর ভালো নেই। ওই কারখানা হয়তো আর চালাবে না মালিক। কোন মাল ঢোকেনি গত নমাস ধরে। কমিশন তো দূরের কথা, মাইনেও দেয়নি। কোন রোজগার নেই। শিউলি টাকা দেয় যেটুকু পারে। কিন্তু বেদো নিতে চায় না। উদাস হয়ে থাকে। পোস্ট অফিসের টাকাগুলো ভাঙ্গিয়ে শেষ পর্যন্ত টোটোই কিনবে ভেবেছে কিন্তু এখন কিনে আর কি লাভ হবে। সে ভাবে যাতায়াত করে কে আর। ট্রেন চলা সবে শুরু হল। তাও খুব কম। যদি লোকজনের যাতায়াত বাড়ে তাহলে সামনের বছরের শুরুতে কিনতে পারে। কিন্তু শরীরটা আগে সারানো দরকার। শিউলি নিজের মনে থাকে। একা একাই সময় কাটে। দিলুর হাতে এখন সময় মানে রাতে কোন কোনদিন বাড়ি আসা। এদিক সেদিক, কলকাতা এমনকি দিল্লিও গেছে। গাড়ি কিনেছে বড় একটা। এই বাজারেই চৌধুরীদের বাড়িটাও কিনেছে। একসময় বাড়িটা কুমারদাদের ছিল। দরিয়াপুর শহরের সব থেকে সম্ভ্রান্ত পাড়ায়। কিন্তু শিউলির দিন কাটে না। ও কুমারদার সঙ্গে পড়ানো বাদ দিয়ে কো অপারেটিভের অন্যান্য কাজগুলো করতে চায় কিন্তু দিলু তাতে তেমন উৎসাহ দেখায় না। কাল দিলু বাড়ি আসবে। ও কথা বলবে। শিউলির নিজের জগৎ খুঁজতে হবেতো। ওর তো বেশ কষ্ট হচ্ছে। অনেক দিন হয়ে গেল ও তো কোন কাজ করছে না। ওর নিজের তো রোজগার কিছুই আর নেই। দিলু আর কী কী করবে। এত কি দরকার ছিল। সে নিজেই কি এর জন্য দায়ী। এক জীবনে কত কিছুই বা পেতে হয়। সে বলবেই এ জীবন দিলুর জন্য নয়। এই উত্থান, এই ভয়ঙ্কর সর্বগ্রাসী চাওয়া, এ দিলুর মানায় না।

    শিউলি ক্যাকটাসে জল দেয়। ক্যাকটাস যত ভয়ঙ্কর দেখতে, তত যেন লাজুক। পান থেকে চুন খসলেই এদের দুঃখ হয়। দিলুর যেমন আগে হত। ক্যাকটাসগুলো বেদো আর ও গিয়ে আনলকে কিনে নিয়ে এসেছিল নার্সারি থেকে। বেদো বলেছিল একটা নার্সারি করবে ও আর শিউলি মিলে। ফুল ফোটাবে, গাছ বানাবে, তার পরে সেই ফুল আর সেই গাছ ছড়িয়ে পড়বে চতুর্দিকে। সেখানে থাকবে ওদের ছোঁয়া। আদর, আনন্দ, সৃষ্টির তৃপ্তি। দিলুও তো তেমন কিছুও করতে পারতো। মন আছে দিলুর। কিন্তু নিজের লোকজনের বেলায় এত রাগ কেন। এত পয়সা করছে কিন্তু বেদোর ওপর খামোখা রাগ করে বসে আছে। ওর জন্য কিছুই সাহায্য করছে না। বেদো নিজের মতো কাজ করতে চায় বলে। সে স্বাধীনতা দিলু কেন তাকে দেবে না? শিউলি তো কোন কিছুই জোর করে দিলুকে চাপিয়ে দেয়নি। কোনদিন বলেও নি মুখ ফুটে সে কি চায়। দিলুর পথ এখন মসৃণ মনে হচ্ছে কিন্তু যখন কঠিন হবে তখন নিশ্চয়ই সে তাকে বুঝবে। কিম্বা কোনদিনই বুঝবে না। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আবার সেই বেদোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। কেমন যেন কষ্ট হচ্ছে ওর জন্য।নিজের সন্তান বা নিজের ভাইয়ের জন্য যেমন হয় তেমন। শিউলি কি বুড়ি হয়ে যাচ্ছে, সেই শরৎচন্দ্রের নায়িকার মতো কুড়িতেই বুড়ি। কুড়ি সাল অনেককেই অজান্তে বুড়ি করে ফেললো যেন। দিলুকে নিশ্চয়তা দিতে দিতে কি সে বুড়ি হয়ে গেল?

    দিলু কোন কথা বলে না। অন্তত শিউলির কাছে। রাতে ফেরে। একসঙ্গে খায়। চুপ করে থাকে বাড়িতে। কিন্তু শিউলির খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে। যেমন ইচ্ছে তার সব সময়ই হয়। তার ইচ্ছে হয় আগের মতো বেরোতে। দিলুর বাইকে চেপে নদীর ধারে যেতে। এই বছরে ভেতরে বাইরে কোন ঘটনাই ঘটেনি যেন। জীবনে কোন উত্থান নেই পতন নেই। অথচ এই বছরটাই অন্যরকম হতে পারতো। আগে শিউলি একা ছিল কিন্তু ওর একাকীত্ব ছিল না। এখন ওর জীবনে একাকীত্ব যেন অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠেছে। মাঝেমাঝে তার কাছে সব অসহ্য লাগছে। তার আর যেন কিছুই ভালো লাগছে না। কাল রাতে ও বলেছিল ওরা একটু কোথাও ঘুরতে যেতে পারে কি না। জবাবে দিলু বলেছিল এই সময়ে একটা দিনও নষ্ট করা যাবে না যে। প্রচুর কাজ। শিউলি মনে মনে ভেবেছিল সত্যিই কি সময় নষ্ট? কোন উত্তরই করেনি। কি বলবে? কাজের ক্ষতি করে যাওয়াটা সত্যি হয়তো উচিত নয়। কিন্তু শিউলির আর ভালো লাগছে না। কাল থেকেই ও কুমারদার কাজে লেগে যাবে, সে দিলু যাই ভাবুক। কলিং বেল বাজে। পিনহোল দিয়ে শিউলি দেখে অনভিপ্রেত একজন অপেক্ষা করছে বাইরে -- জয়াদি।

    কতদিন বাদে দেখছে জয়াদিকে সামনাসামনি। জয়াদির শরীরে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। শরীরটাও কেমন জৌলুশহীন বলে মনে হচ্ছে। সেই জয়াদি, রূপবতী, লাস্যময়ী, খানিক নিষ্ঠুর, খানিক সাধারণ আর অনেকটা অজানা সেই মানুষটা সামনে দাঁড়িয়ে। এদিক ওদিক তাকিয়ে হেসে তাকাল জয়াদি, সে হাসিতে অযাচিত স্নেহ যেন। কি কারণে এসেছে? শিউলি যোগাযোগ রাখবে না সে কথা বলেই এসেছিল। তবুও ঠিকানা খুঁজে চলে এসেছে। কি চায়? প্রাথমিক ঔৎফুল্লের পরে শিউলির চিন্তায় সে কথাই এল। মনে পড়ে যেতে থাকল সেইদিনগুলো, অনেকগুলো দিন। কিন্তু সে জীবনের কথা এই মুহূর্তে মনে করলে তেমন খারাপ কিছু তো লাগছে না শিউলির। বরং বেশ আনন্দই হচ্ছে, মাঝে মাঝে ঝগড়া, তারপর মিটিয়ে নেওয়া, পুলিশের উৎকণ্ঠা, দারোয়ান বুড়োটার মজার গল্প, সরস্বতীর মুখ আর নিজের ওই ঘরটা। ভালো লাগছে। স্মৃতি বলেই কি। এই মানুষটা নজরও রেখেছিল ওর ওপরে। ওষুধপত্র, হাতে করে জামা কাপড় কিনে দেওয়া বা পছন্দের সুক্তো বানিয়ে খাওয়ানো। করেছিল তো ওর জন্য, ওদের জন্য। সেই ভদ্রমহিলার শরীরে সেই দীপ্তি কোথায়। ম্রিয়মাণ, এমন জয়াদিকে সে দেখেনি। জয়ার এই হঠাৎ না বলে চলে আসায় যে প্রাথমিক উষ্মা ও দোলাচল তৈরি হয়েছিল তা কেটে গিয়ে এখন যেন কি এক মায়াই তৈরি হল। সে মায়া শিউলির নিজের অতীত না জয়ার এই ম্রিয়মাণতার জন্য সে কথা স্পষ্ট নয়, স্পষ্ট জানার প্রয়োজনও নেই।

    - আমি দরিয়াপুর ছেড়ে চলে যাচ্ছিরে শিউলি। ভাবলাম যাওয়ার আগে একবার দেখা করে যাই।

    - চলে যাচ্ছ কেন গো?

    - সে অনেক কথা। ওসব বাদ দে। তোকে খুব সুন্দর লাগছে রে, কিন্তু একটু কি রোগা হয়েছিস?

    - হ্যাঁগো। বেশ খানিকটা ওজন কমেছে। কিন্তু তুমি চলে যাচ্ছ কেন?

    - তুই তোর বইগুলোকে কি চমৎকার সাজিয়ে রেখেছিস। তোর প্রানভোমরা ওগুলো। ঘরটাও খুব সুন্দর সাজানো হয়েছে, তোর মতোই সুন্দর।

    শিউলি চুপ করে থাকে, কি বলবে খুঁজে পায় না, কি বলতে এসেছে জয়াদি সেও বুঝতে পারছে না। কিন্তু অসৎ উদ্দেশ্য বা ধূর্ততা ওর চোখে নেই। সত্যি কি ওর সুন্দর করে কিছু সাজানো হয়েছে? শিউলি কি সত্যি সাজাতে পারছে সব কিছু? কিন্তু সে তো সাজাবে বলেই চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই ঘর, এই জীবন, দিলুকে ওর চারপাশের সাধারণ মানুষগুলোকে সে চাইছে সাজিয়ে রাখতে আপ্রাণ। কিন্তু কিছুই কি পারছে? শিউলির খুব কান্না পাচ্ছে। এ কি হচ্ছে শিউলির। সত্যি করেই সে কেঁদে ফেলবে? শিউলিকে তো কেউ কোনদিন কাঁদতে দেখে নি, শেষ পর্যন্ত জয়াদির সামনে সে কেঁদে ফেলবে নাকি।

    - দাঁড়াও একটু বোস আমি চা করে আনি।

    শিউলি ছোটে রান্না ঘরের দিকে। কোনরকমে নিজের মনকে বশে আনার চেষ্টা করে। অসম্ভব বুদ্ধিমতী জয়াদি, সামনে যাওয়া যাবে না। মেপে মেপে চায়ের জল বসায় আর প্রচণ্ড জোরে নিজের ঠোঁটে কামড়ে ধরে। সেই বেদনায় যদি কান্না ভুলে থাকা যায়। কিন্তু গড়িয়ে পড়ে অশ্রু নাছোড়, অবাধ্য, অপ্রতিরোধ্য। চায়ের জল ফুটতে থাকে। সে বেরোয় না রান্নাঘর ছেড়ে, দীর্ঘ সময় পার হয়ে যায় যেন, অতি দীর্ঘ সময়। শব্দ করে চা ঢালে, চিনি গোলে। বার করে মুড়ির কৌটো। জয়াদি চায়ের সঙ্গে অন্য কিছুই খায়না, শুধু মুড়ি ভালোবাসে। বাটিতে ঢালে। বাইরে অনেকক্ষণ একা বসে আছে জয়াদি। এই অবস্থায় সে যেতে পারবে না। এভাবে সে দাঁড়াতে পারবে না কারো সামনে। চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। এ কি করছে। একটু সামলায়। সামনে সিঙ্কের জলেই চোখ মুখ ধুয়ে নেয় শিউলি। তারপর রান্না ঘরের তোয়ালে দিয়ে মুখ মোছে। ট্রে সাজিয়ে নিয়ে শিউলি বসার জায়গায় ফিরে আসে অনেকক্ষণ পরে। মনে হয় যেন একটা যুদ্ধের পরে। দেখল জয়াদি তাকিয়ে আছে নিচে, মাথা নামিয়ে, অন্যমনস্ক। এসে বসে শিউলি, চায়ের প্লেট এগিয়ে দেয়, জয়া প্লেট নিজের হাতে নিতে নিতে তাকাল এক ঝলক। তারপর কি চিন্তা করতে করতে চায়ে চুমুক দিল।

    -- ভালো হয়েছে। দারুন চা। জয়া বলে শিউলির দিকে না তাকিয়েই। তারপরে আবার নিঃশব্দ। চুপ করে থাকে দুজনেই। কি কথা বলবে কে তাই হয়তো খুঁজে পাচ্ছেনা কেউ। কিছু একটা বলতে এসেছে হয়তো জয়াদি সেটা বলতে পারছে না। বা হয়ত সত্যি কিছুই বলার নেই। শুধু দেখা করা, শিউলি নিজেও প্রায় শেষ করে ফেলল চায়ের কাপ। আরও কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে জয়া হ্যান্ড ব্যাগ থেকে ছোট্ট একটা বাক্স বার করে। সেখানে একটা গলার হার।

    - তোর জন্য আমি কিছু দিতে পারিনি। এইটা তুই রাখ।

    - একি! না জয়াদি, এ আমি নিতে পারবো না।

    - কেন রে তুইও কি একে কলঙ্ক মনে করিস। নারে, কোন কিছুই কলঙ্ক নয়। পরিশ্রম করে রোজগার। তুইও এমন ভাবিস?

    - না দিদি। আমি বোঝাতে পারব না।

    - আমার ছেলের বউকে এমন একটা দেব ভেবেছিলাম।

    - তুমি কি বলছ আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

    - ওরা ওকে ভালো থাকতে দিল না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে জয়া বলল।

    - কি বলছ আমায় একটু বলবে?

    - আমি তো নিজে থেকে কারোর ক্ষতি করিনি তবে আমার এমন হল কেন বলতে পারিস?

    - তখন থেকে আমি তোমার একটাও কথা বুঝতে পারছি না। তুমি কোথায় যাচ্ছ? কেনই বা যাচ্ছ? কি হয়েছে তোমার?

    - সব কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল রে শিউলি। আমি আর কিছুই মেলাতে পারছি না। পিকলু আমায় ভুল বুঝল। কিন্তু ওর তো জীবন বাকি, ওর যে জীবন শেষ হয়ে গেল। ওর কেন এমন হবে বল তো আমায়? ওর তো কোন দোষ ছিলনা রে।

    শিউলি চুপ করে থাকে। অস্বাভাবিক লাগছে কথাগুলো। অস্বাভাবিক লাগছে জয়াদিকে।

    - এখানে আমায় থাকতে দিল না ক্ষতি নেই। আমার এসবে কিছু এসে যায়না কিন্তু আমার ছেলের কাছে কেন ওরা এসব বলল। আমি তো কারোর কোন ক্ষতি করিনি শিউলি।

    - তোমার ছেলে!

    - আমার ছেলে, কিন্তু তার মা আমি আর নই শিউলি, আমি কারোরই কিছু নই। হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকল জয়া। শিউলি বিস্মিত। ভাবে--তবে কি জয়াদির ছেলে সংসার এসব আছে? কি অদ্ভুত। কিন্তু জয়াদি স্বাভাবিক নেই, যদিও কাঁদতে পারছে, সেটুকু ভালো কথা। তার মানে শিউলির কাছে নিজেকে হালকা করতে চাইছে হয়তো। শেষ বারের মতো কোন আপন মানুষকে পেতে চাইছে। শিউলির মনের কষ্ট আরও বাড়ল। কোথাও কোন মানুষের তাহলে তাকে মনে আছে। যে আবেগকে ও রুদ্ধ করে রাখছিল সে বাঁধ মানল না, সেও কাঁদতে শুরু করল।

    - তুই কাঁদিস না শিউলি, তুই কেন কাঁদছিস? তোর জীবন সুখের হোক, শান্তির হোক, তুই ভালো থাক। কিন্তু আমি কিন্তু খারাপ কিছু করতে চাইনি।

    - আমি জানি জয়াদি, আমি জানি।

    - না তুই জানিস না। কিছুই জানিস না, আমার ছেলে যদি সত্যি আর আমার সঙ্গে যোগাযোগ না রাখে আমি আর বাঁচব না। কি নিয়ে আমি আর বাঁচবো? আমার এ জীবন নিয়ে কি হবে বলতে পারিস? আমি এদের কাকে না খুশি করেছি? এই পিশাচগুলোকে দিন রাত খাবলে, খুবলে খেতে দিয়েছি নিজেকে? বিনিময়ে আমার ছেলেকে মানুষ করতে চেয়েছি। কলজের জান আমার। আমার গতরে কোনদিন ব্যাথা হয়নি। আমার মন জানতো আমি তাকে আগলে রাখতে পেরেছি। কিন্তু আজ যে সে নিজেকে নষ্ট করে দেবে শিউলি। আমি এখন কি করি? আমি এখন কি করি বলত? আমি তো আর এই কাজ করি না। আমাকে এখান থেকে তাড়াতে চেয়েছিস তাড়া, এমন করল কেন আমার সঙ্গে। আমাকে কি করতে হবে একটু বলবি?

    শিউলি তাকিয়ে থাকে আর তার দুচোখ বেয়ে জলের ধারা বইতেই থাকে, কিন্তু সম্পুর্ন নিঃশব্দে। উল্টোদিকে জয়াও সব বলতে থাকে একে একে। ওর এতদিনের সঙ্গী বিভাস ওর পেছনে লেগেছে। বলতে থাকে পার্টির লোক কেমন করে ভেতরে ভেতরে শুদ্ধত্বের প্রচার শুরু করেছে দরিয়াপুর জুড়ে। এসব নোংরা কাজ করতে দেবেনা বলে জয়াকে তাড়িয়ে ছাড়ছে। অথচ দয়ালপাড়ায় কিছুই করে না। সেখানে অনেক ভোটার বলে ঘাঁটায় না। জয়ার যে লোকজনের সঙ্গে ওঠা বসা ছিল, এখন কেউই এই টালমাটাল বাজারে ওকে নিয়ে ভাবতে রাজী নয়। এসব কিছুই জয়াকে দমাতে পারতো না যদি না তারা জয়ার একমাত্র ছেলেকে তার মায়ের কথা সব জানিয়ে আসত। ছেলেকে ওরা দরিয়াপুরে মায়ের আস্তানা পর্যন্ত নিয়ে এসেছিল।

    শিউলি একজন মহিলার হেরে যাওয়াটা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। বিধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছে একজন মা। জীবন যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে একজন মানুষ। শুধু জয়া যেন নয়, হেরে যাচ্ছে সেও, হেরে যাচ্ছে এক একটা সাধারণ মানুষ, এক একটা ছোটো ছোটো স্বপ্ন। এ পৃথিবীতে ছোটো ছোটো স্বপ্নকে সফল করতে বড্ড বেশি মূল্য দিতে হয় যেন। আর যার মেলে না তার যেন কোন কিছু কোনদিনই মেলে না। সবেতেই জট পড়ে যায়। এই জট ছাড়ানোর চেষ্টাটা করাই হয়ত ভুল। যেন সেই জালের মধ্যে মাছ, যত ঝাপটায় তত আটকে যায়। আজ এত কষ্টের মধ্যেও জয়াদি আসায় একটু ভালো লাগছিল কিন্তু সমস্ত কথা শুনে কিছুই যেন ভালো লাগছে না। না, এমন সে ভাববে না। সে ভালো কথা ভাববে। সে জীবনের কথা ভাববে। ডাক্তারবাবু বলেছেন মনকে সতেজ রাখতে। তার এই গাছগুলো ভালো থাকে না যদি শিউলির মন খারাপ থাকে। ক্যাকটাসগুলোর কাঁটাগুলোয় যেন ম্রিয়মানতা আসে শিউলির মন খারাপ থাকলে। যে চড়াই আর পায়রাগুলো বারান্দার রেলিং পার করে ফেলে রাখা গম আর চালের ডানা খেতে আসে রোজ দুবেলা, তারা শিউলির দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। শিউলির নিজের কষ্টে তাদের ঘাড় বেঁকিয়ে চেয়ে থাকায় কষ্ট দেখেছে শিউলি। ওরা খেতে ভুলে যায়, আর আড়চোখে শিউলির দিকে তাকায় আর মুখ দিয়ে আওয়াজ করে বিচিত্র। যেন বলে -- এই মেয়ে তুই কি চাস আমরা সব্বাই তোর মত দুঃখ করে থাকি আর তখন খুব তুই মনে মনে শান্তি পাস। আমাদের দেখে তোর আনন্দ হয় না যখন আর তোর কাছে আসব না।

    দুপুর পেরিয়ে বিকেল আসে। জয়া অনেক কথা বলে যেন ক্লান্ত, চলে যেতে চাইছিল। ওকে অল্প খাইয়ে চুপ করে শুইয়ে রেখেছে শিউলি। বাচ্চা মেয়ের মতো শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে জয়া। কুঁকড়ে শুয়ে থাকা শরীরটাকে অচেনা লাগছিল সম্পূর্ণ। নিশ্চিন্ত, নিরুত্তাপ যেন ক্লান্ত ছিল কতদিন, কতদিন সে ঘুমোয়নি। এদিকে জয়া আসার আগে শিউলি নিজেও আজ না খেয়েই কাটিয়ে দেবে ভেবেছিল। সক্কালবেলা অনেক কিছু রান্না করে সেসব বেদোকে খাইয়ে দিয়ে এসেছিল, সেই রান্না ছিল বাড়িতে। জয়া আর ওর হয়ে গেছে। আর একটু বাদেই বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হবে। ওর ইচ্ছে করছে জয়াকে ও দরিয়াপুর ছেড়ে যেতে দেবে না। মিশিরজি আসানসোলে জয়ার থাকার একটা ব্যবস্থা করেছেন। অন্তত একটা লোক আছে যে এই মহিলার খেয়াল রাখে। বাকি জীবন হয়তো মিশিরজীর মিস্ট্রেস হয়েই থাকতে হবে জয়াকে। কিন্তু সেও মন্দের ভালো। কারণ জয়া নতুন করে কোথাও গুছিয়ে নেওয়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। সন্ধ্যের মুখে জয়া নিজেই উঠল ঘুম থেকে। চা করল শিউলি। জয়া আর তেমন কোন কথা বলল না। যাওয়ার আগে শিউলিকে জড়িয়ে ধরে থাকল অনেকক্ষণ তারপর কপালে একটা চুমু খেয়ে বেরিয়ে গেল একসময়। শিউলি বারান্দা দিয়ে জয়ার চলে যাওয়া দেখল, সন্ধ্যে তখন গাঢ় হয়ে রাতের পোশাক পড়েছে। জয়া আস্তে আস্তে সেই ঘন হয়ে আসা অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

    দিলু এল অনেক রাত করে। স্বভাব মত চুপ করে স্নান করে খেল। শিউলিও খেয়ে নিল। দিলু সোফায় বসে ল্যাপটপে তার কাজ করছিল। শিউলি এসে বসল দিলুর পাশে। ওর হাতটা ধরে হাসি মুখে আদর মাখানো গলায় বলল -- আর কত কাজ করবে বাবু? আমি আছি তোমার পাশে তোমার বউ একথা কি তুমি ভুলে গেলে? এত কি তোমার কাজ? একটা চিঠি তো কোনদিন লিখলে না। এখন তুমি আমার কাছে আছ। আমার সঙ্গে কথা বল।

    দিলু চুপ করে থাকে। তারপর শিউলির চোখে চোখ রেখে বলে -- তুমি এখনো কেন যোগাযোগ রাখছ ওদের সঙ্গে?

    - মানে?

    - জয়া কেন এসেছিল?

    - সে দরিয়াপুর ছেড়ে চলে যাবে। তার আগে দেখা করে গেল।

    - তাকে ঢুকতে দিলে কেন?

    - এ কেমন কথা বলছ তুমি?

    -- তুমি জানো আমার পলিটিকাল কেরিয়ারে এসব ক্ষতি। তাও তুমি এমন ভাব করছ যেন তুমি কিছুই বুঝছ না।

    শিউলি চুপ করে থাকে। কি কথা বলবে সে? সামনে যে তার বসে আছে সে যেন তার অচেনা মানুষ। সে কি মন থেকে এসব কথা বলছে নাকি তার নিজের অস্তিত্বও তার কাছে অস্বস্তির হয়ে উঠেছে। সে বুঝিয়ে দিতে চাইছে।

    - তাহলে আমিও তো তোমার জীবনে ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছি আসতে আসতে।

    দিলু চুপ করে থাকে। সে উঠে যেতে থাকে। মুহুর্তে উন্মাদিনী হয়ে ওঠে শিউলি। ঝাঁপিয়ে পড়ে দিলুর বুকে। তারপর প্রচণ্ড আবেগে দুই হাত দিয়ে আঘাত করতে থাকে দিলুর বুকে। -- জবাব দাও, জবাব দাও। আমি বেশ্যা ছিলাম তাই তোমার এখন সমস্যা হচ্ছে? তুমি আমার কাছে এসেছিলে। তুমি বিয়ে করার কথা বলেছিলে। আমার অস্তিত্ব এখন তোমার কাছে ক্ষতির। তা তুমি স্পষ্ট করে বল। কিন্তু বললেও আমার সঙ্গে এখন তুমি এমন করতে পার না। তোমার এত কী দরকার? এত ক্ষমতা কেন তোমার লাগে? সাধারণ হয়ে বাঁচতে তোমার কি হয়? তুমি জানো না কোথায় তুমি ছুটছ। তুমি এমন মানুষ হয়ো না দিলু। তুমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছ।

    শিউলি তখন পাগলের মতো করছে। তাকে সামলানো যাচ্ছে না। দিলু শিউলির আঘাত গুলোকে সহ্য করে যায়। তারপর শিউলিকে শক্ত করে ধরে থাকে। অনেকক্ষণ। বসায়। দিলু ওর মাথাটাকে চেপে ধরে নিজের বুকে। মাথায় হাত বোলায়। চুলে আঙুল দিয়ে আদর করে। এরপর শুরু হয় শিউলির কান্না। কাঁদতে কাঁদতে সে বলতে থাকে -- আমাকে ছেড়ে যেও না। আমার তুমি ছাড়া কেউনি। আমি তোমায় ছাড়া কিছু ভাবতে পারি না। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত আমি তোমায় নিয়ে বাঁচি। তুমি কাছে থাকলেও বাঁচি। তুমি দূরে থাকলেও বাঁচি। আমি কী নিয়ে থাকবো তুমি আমায় ছেড়ে চলে গেলে? তুমি কেন আমায় ভালোবাসো না? তোমাকে আমি ছাড়া এমন ভালো আর কেউ বাসতে পারবে? আমার কি দোষ ছিল বল? আমি কি অপরাধ করেছিলাম গো? কেন তুমি কোন কথা বল না। কেন তুমি চিঠি লিখলে না আমায় একটাও। আমি কি তোমায় কিছু দিই নি? কেন কথা বলছ না? কেন কথা বলছ না আমার সঙ্গে? শিউলি কাঁপতে থাকে। ওর শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে। দিলু দুহাত দিয়ে ওকে তুলে শোবার ঘরে নিয়ে যায়। শিউলি তখন প্রায় অজ্ঞান।

    ২২

    ক্যালেন্ডারের তারিখ, সাল বদলের সঙ্গে কোন দেশেরই সাধারণ মানুষের ভাগ্য বদলের কোন সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। দুহাজার কুড়ির শেষ দিকে এসে মনে হয় সত্যিই কিছুই বদলায় না। নইলে কৃষি প্রধান দেশ ভারতে খাবার দাম আকাশ ছোঁয়া হয়! আর শিল্পনির্ভর উন্নত দেশগুলোতে খাবারের দাম হয় সস্তা। এই সমস্ত প্রশ্ন মাথায় আসার আগেই মানুষকে ব্যস্ত রাখে অন্য শক্তি, কখনো কখনো রাষ্ট্র শক্তি নিজেই। ব্যস্ত রাখতে হবে আর একইসঙ্গে কোণঠাসা করে ফেলতে হবে মানুষকে এতটাই যে পরদিন ভোরে ঘুম থেকে জেগে সে ভাববে -- ওরেব্বাস বেঁচে আছি। এই বেঁচে থাকা তো সমাজ ও সরকারের দান। তাই আমি ধন্য। আর তুমি প্রণম্য। খাদ্যদ্রব্যের মূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। মানুষের কাজ নেই, জীবনের নিশ্চয়তা নেই। কোভিডের মৃত্যু ভয় থেকে এখন দিনযাপনের ভয় অনেক বেশি। এরই মধ্যে কৃষি আইন সংস্কার নিয়ে কেন্দ্র নাছোড়। এই মহামারির আবহই যেন এই আইন প্রণয়নের জন্য খুব একটা চমৎকার আদর্শ সময় ছিল। পাঞ্জাবের চাষিরা ঘিরে রেখেছে দিল্লির সীমা না। কৃষিতে সংস্কার প্রয়োজন কি প্রয়োজন নয় সে বিষয়ে রাজনৈতিক গণ্ডির বাইরে থাকা পণ্ডিতদের মধ্যেই দ্বিমত রয়েছে। পূর্ববর্তী ভর্তুকি নির্ভর কৃষি আইন তৈরি হয়েছিল খাদ্যাভাবের সময়। কিন্তু এখন খাদ্য শস্য উৎপাদন উদ্বৃত্ত। তাহলে এই আইন কেন বহাল থাকবে? অন্যদিকে ভয়ের কারণ হল কৃষিক্ষেত্রে কোর্পরেটদের ঢুকে পড়ার সমূহ সম্ভাব না। এমনিতেই গত দুই দশকে বিশেষ করে ছোটো ব্যবসায়ীরা সারা পৃথিবীতে হারিয়ে যাচ্ছে, তাই কোন বড় কর্পোরেট সংস্থা কৃষিবাজারে যে মনোপলি তৈরি করবে না সে কে বলতে পারে, কারণ সেই নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নতুন আইন নীরব। এই হতদরিদ্র ভারতর্ষে ব্যবসা করেই অনিল আম্বানি ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে পাঁচজন তাবড় বড়লোকেদের মধ্যে উঠে আসতে পেরেছিলেন। তাছাড়া ইয়োরোপ ও আমেরিকাতেও যদি চাষিদের ভর্তুকি ব্যবস্থা থাকে তাহলে ভারতে থাকবে না কেন?

    কিন্তু দরিয়াপুর চুপ কেন? কারণ দরিয়াপুরে ছোটো চাষিরই ভিড়। পাঞ্জাবের চাষিরা বেশিরভাগই বড় চাষি হওয়ায় তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা অনেক বেশি। ভূমিসংস্কার সেখানে কোনকালেও বলবৎ হয়নি। তাদের সরকার সব ভর্তুকির পরেও যে সহায়ক মূল্যে চাষিদের কাছ থেকে ফসল কেনে তা বাজারের মূল্যের থেকে অনেক বেশি। এমন সত্যিই চিরটাকাল হতে পারে না। পাঞ্জাবের চাষিদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের চাষিদের শ্রেণীবৈষম্য আগে থেকেই ছিল। তাই এই রাজনৈতিক আন্দোলনে পাঞ্জাবের মতো দরিয়াপুরের চাষিদের তত উৎসাহ দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া খাদ্য শস্য যখন উদ্বৃত্ত তখন লোকে শুধু শস্য কত খাবে? এই আইনে শাক সবজি ফলনের উৎসাহ দিয়ে তার বাজার তৈরি করার চেষ্টা নেই। বাংলায় নিজস্ব উর্বর মাটির কল্যাণে, সে সমস্যা এখনো প্রকট নয়। কিন্তু সারাভারতে বিশেষ করে উত্তর, মধ্য ও পশ্চিম ভারতের শাক সবজির বাজার তৈরির প্রয়োজন ছিল। অন্যদিকে বাংলার চাহিদা সবসময়ই উত্তর ভারত নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় চাহিদার থেকে বেশ খানিকটা আলাদা। তাই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও গতিপ্রকৃতিও বাংলায় আলাদা। বাংলা বহুকাল ধরেই দেশের ও বিদেশের বিভিন্ন জায়গার দুয়ার হিসেবে কাজ করেছে, ট্রানসিট পয়েন্ট। ট্রানসিট পয়েন্ট হয় স্বভাবতই বহু সংস্কৃতির মিলন। তাই বাংলা স্বাতন্ত্র্য রেখেও বিবিধের মাঝে মিলনেই বিশ্বাস করে, বহুকাল ধরেই।

    এই অদ্ভুত বছরের শেষের দিকে দল বদলের একটা খেলা খুব প্রকট হয়ে উঠছে। হেভি ও ফেদার ওয়েট নেতাদের দল বদলের ফলে ঠিক কোন দিকে পাল্লা ভারী এখনো সে পরিষ্কার করে বলা সম্ভব হচ্ছে না। কৃষি আইনকে হাতিয়ার করে সব পক্ষ এখন আক্রমণ শানাচ্ছে আর চাষিদের খুব কাছের মানুষ হয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রাচীন দল কংগ্রেসের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। আঞ্চলিক দলগুলো কেন্দ্রীয় ভোটের আগে সব সাজো সাজো রব করে একসঙ্গে লড়তে ছোটে বটে কিন্তু বাকি সময়ে তাদের ঐক্য চোখে পড়ে না, সুতরাং এখন ভারতবর্ষে কোন দ্বিতীয় বা তৃতীয় শক্তিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই অবস্থায় এখন মনোপলি শুধু ব্যবসায় নয় রাজনৈতিক বাজারেও। ব্যবসা যে রাজনীতির সঙ্গে কতোটা অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত তা বোঝা যায় একটা সামান্য তথ্যে, বি জে পির একার যে পরিমাণ অর্থ আছে তা বাকি সব থেকে গুরত্বপূর্ণ তিনটি রাজনৈতিক দলের মিলিত অর্থের দ্বিগুণেরও বেশি। অবশ্যই এ কোন অপরাধ নয়। কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও রাজনৈতিক ক্ষমতা এই দুইয়ের মিলনের এক লক্ষণ তো বটেই। এরই মধ্যে ১২ ই জানুয়ারী সুপ্রিম কোর্ট এই বিল এখুনি চালু করায় স্থগিতাদেশ দিল। সুষ্ঠু আলোচনার জন্য মধ্যস্থতা কমিটির প্রস্তাবও দিল কোর্ট। কিন্তু দরিয়াপুরে সাধারণ চাষিদের মধ্যে কেউই হয়তো জানতে পারছেনা কি ঘটতে চলেছে। কৃষি আইন সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা আছে কিনা সেই নিয়েই যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যদিও কয়েকদল চাষি চাইছে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং আসুক। কারণ সেক্ষেত্রে প্রচুর ফলনের বছরে যখন চাষিরা দাম না পেয়ে মাথায় হাত দেয় তখনো তারা একটা ভালো দাম পাবে। এর মধ্যেই ভুবন নিজেই নাম করা এক কোম্পানির সঙ্গে আলু চাষের চুক্তি করেছেন।

    এদিকে কুমারবাবুর চেষ্টায় কো--অপারেটিভ থেকে আরও কিছু নতুন উদ্যোগ নেওয়া হল। রেডিমেড জামা কাপড় তৈরি করে বাজারে সরাসরি বিক্রি করার চেষ্টা শুরু হল। পি পি ই কিট তৈরিরও উদ্যোগ নেওয়া হল। প্রাথমিক ভাবে আশপাশের গ্রাম থেকে বাছাই করে পঁচিশ জনকে সেলাই মেশিন দেওয়া হয়েছে। কলকাতা থেকে ট্রেনার নিয়ে আসা হল। রেডিমেডের দাপটে যে সমস্ত দর্জি ধুঁকছিল আগে থেকে তারাও যোগ দিল দলে দলে। নিজেদের ব্র্যান্ডকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে তুলে ধরার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন কুমারবাবু। কুমার যে লড়াইটা লড়তে শুরু করেছিল একা এখন যেন সে আর তার একার নেই। নতুনহাটে একটা বড়ো জমি ছেড়ে দিয়েছে সরকারবাবু। সেখানে একটা বেশ বড়ো পাকা ঘর আগে থেকেই ছিল। ক্লাস শুরু হয়েছে সেখানে। সেখানে সেলাই মেশিন, আরও নতুন সব যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে। কম্পিউটারে এক জন দুজন ডিজাইন তৈরি করার গ্রাফিক্স শিখছে। শিউলি আছে, অসাধারণ তার চিন্তাশক্তি, শিল্পবোধ। গ্রামের ছেলে মেয়েদের উৎসাহ প্রবল। সে উৎসাহ হুজুগের নয় সবটা, কারণ তারা খুব মন দিয়ে কাজ শিখছে এবং এরই মধ্যে কেউ কেউ বেশ ভালো কাজ বুঝেও নিয়েছে। বাংলাদেশের মতো এক গরীব দেশে যদি বস্ত্রশিল্পে বিপ্লব ঘটতে পারে তাহলে এদেশেও পারে। এই দরিদ্র মানুষগুলোই ঘটাতে পারে। গুজরাটের বা মুম্বাইয়ের কত দেশীয় ব্র্যান্ড কবে থেকে দারুণ ব্যবসা করে চলেছে। শ্রমিকরা তো করে কম্মে খাচ্ছে। কিন্তু উনি এদের অন্য ভাবে চাইছেন শুধু শ্রমিক হিসেবে নয়। দায়িত্ববান শরিক হিসেবে।

    #

    দুহাজার একুশের শুরুতেই মানুষের মনে একটু আশার সঞ্চার হোল। ১৬ই জানুয়ারী থেকে সরকারিভাবে ভ্যাক্সিনেশন চালু হওয়ার কথা ঘোষণা হল। ভানু সাহাকে আজ বেশ চনমনে লাগছে কারণ তিনি এইমাত্র টিকা নিয়ে এসেছেন। মদ উনি খান না সুতরাং এই টিকার শর্ত হিসেবে সামনের ছয়মাস মদ না খেলে তার কিছু যায় আসবে না, শুধু চাকরী সমেত বেঁচে থাকতে হবে। আজ দিনটা বেশ ফুরফুরে। যা চেয়েছেন সবই হয়েছে। এমনিতেই শীতের সকালে বেশ আয়েশ মেখে থাকে। তারপর সকাল বেলা যার মুখ দেখতে সব থেকে ভালো লাগে তারই মুখ দেখেছেন, রিটায়ারমেন্টের কাগজপত্রও তৈরি হচ্ছে। আর কি চাই। বিপ্লবকে একবার ডেকে আশপাশের খবর টবর নেবেন। এমনই সময় বিপ্লব ঢুকল।

    - কারখানার কাজ তো শুরু হতে চলল স্যার।

    - সেকি! ঝামেলা কিছু হয়েছে নাকি?

    - না না ঝামেলা ঝঞ্ঝাট এখনো কিছু হয়নি। শুধু একটা কথা। পড়ে থাকা জমিগুলোতে প্রচুর বড় বড় গাছ এখন। একটা অঞ্চল জুড়ে যেন বিরাট বন তৈরি হয়ে গেছে। লোকে নতুন জঙ্গল নাম দিয়েছে। সেই জঙ্গল বাঁচানোর কথা বলে লিফলেট পড়ছে। এদিকে কলবাবুর নামে প্রচুর লিফলেট আর পোস্টার পড়েই চলেছে। কিন্তু অদ্ভুত কাণ্ড হল কেউ এই লেখার দায় নিচ্ছে না। লেখাগুলোর ধরনও অদ্ভুত। স্যার, এই দেখুন স্যার লেখাগুলোতে কোন রাজনৈতিক আক্রমণ নেই শুধু ইনফরমেশন আছে। কোন রাজনৈতিক দল সাধারণত এমন করে না। কিন্তু তাহলে কে করছে কেউ ধরতে পারছে না।

    - কলবাবুতো বুঝলাম কিন্তু জঙ্গল?

    - হ্যাঁ স্যর, বেশি দিন আগে ছিল না, এখন সব ভরে গেছে। তাছাড়া উত্তরের দিকে তো একটা জঙ্গল ছিলই। সে জঙ্গলও নাকি বেড়ে চলেছে। কুমারবাবুও প্রচুর গাছপালা লাগাচ্ছেন সেই দেখে, তবে সে সব তো উনি লোকজন নিয়েই করেন। এও স্যর এক জংলি আগ্রাসন। এই দেখুন না। পড়ুন।

    ভাবতে ভাবতেই লিফলেটগুলো ভালো করে চোখ বুলিয়ে পড়তে থাকে ভানু সাহা। কলবাবুর কোন বেনামে জমি কি ভাবে বৈধ হয়ে সরকার কিনে নিয়েছে বা কোন জমি জোর খাটিয়ে নিয়ে নেওয়া হচ্ছে এই সব। কিন্তু এই সব তথ্যের সত্যতা কতটা সে জানা নেই। জেনে পুলিশ কি করবে। দরকার হলে আদালত করবে। আদেশ এলে তখন দেখা যাবে। কিন্তু কলবাবু এরই মধ্যে এফ আই আর করে গেছেন। কিন্তু এই সব তথ্য যদি সত্যি হয় তাহলে আবার কেস ঘুরে যাবে।

    -- স্যার ঝামেলা একটা হবে।

    - কি বুঝছ।

    - স্যার ঝামেলাতেও সে ইন্ডিয়ান প্লুরালিটি।

    - রসিক লোক তুমি। কিন্তু ঠিক করে বল।

    - দুই পক্ষই চাইছে তার আমলে কারখানার কাজটা হোক। কারণ দু দলই ভেবে রেখেছে তারাই ভবিষ্যৎ। কলবাবুর হয়ে কিন্তু কোন রাজনৈতিক দল তেমন চাপ দিচ্ছে না। দেবেই বা কেন ওটা তো দালালের কাজ করছে। আর ওর রেপুটেশন খারাপ হয়ে গেছে। রুলিং এও প্রথম চয়েস সে নয় আর উল্টোদিকে ওর কম্পিটিটর আছে। আর ও মাঝখানে ঝুলছে। টাকা আছে বলে এখনো ঝুলতে পারছে নইলে অন্য কেউ হলে এতদিনে এদিক ওদিক থেকে কেউ না কেউ সুতো কেটে দিত।

    - তাহলে কি করব? ডিলে?

    - অবশ্যই স্যার। প্রচুর চাপ না এলে চুপ করে থাকুন।

    - না না এখন আর আমি একদম চাপ নিচ্ছি না

    - স্যার ভালো করছেন। আপনাকে বেশ ফ্রেশ লাগছে।

    - লাগবেই তো এখন আমি যে নাটক দেখছি।

    - মানে?

    - মানে ভাবছি আমি নাটক দেখছি। এই বিবেকানন্দ, এই নেতাজি নিয়ে কি নাটক দেখেছ না?

    - ওঃ স্যার সবাই তো এখন আমাদের কাছের লোক। শুধু এবার মনে হয় রবি ঠাকুরের বাজার খারাপ যাবে।

    - কেন?

    - ভোটের বছরে রবি ঠাকুর পুজোর সময় হয় না। একই সময়ে পরে যায় যে। নাটকের কথায় কি আর বলবো স্যার ছোটবেলায় আমার পাড়ায় টুলু পাগলাকে চাটনি বোল্লে ক্ষেপে যেত। পাড়ার মুখে বোল না ফোটা বাচ্চাগুলোও তাই ওকে চাটনি বলে পালাত। আর টুলু ওদের পেছনে ছুটত। তখণ ছেলেগুলো আরও বেশি করে বলত। চাটনি, এ চাটনি, চাটনি।

    - তা হলেও এ কিন্তু খুব খারাপ ঘটনা, কি বল, ওই ভাবে সরকারি অনুষ্ঠানে।

    - সে আর বলতে, এই নিয়েই থাকতে হবে। আগে কোন দিন মঞ্চে উঠে নেতাদের তুই তুকারি করতে দেখেছেন? এখন তো দেখেন। বেশ কয়েক বছর ধরেই দেখেন।

    - সে ঠিক। কিন্তু অন্য কথা বল -- কলবাবুর নামে লিফলেট উড়ছে কেন।

    - সেটাই তো প্রশ্ন স্যার। সব্বাই শিওর এখানে ব্যক্তিগত লাভের হিসেব আছে। টিকিট পাওয়ার গল্প আছে। উন্নয়নের লাভের গুড় কে খাবে সেই নিয়ে ভেতরে ভেতরে কিছু একটা হচ্ছে। কিন্তু ভাষাটা যে অন্য রকম স্যর। বামপন্থি নয় ডান পন্থী নয়, হলুদ -- লাল -- গেরুয়া -- সাদা কিচ্ছু রকম নয়। মনের মতো করে লেখা যেন। আহা রে…।

    - তোমার চাকরী করার ইচ্ছে আছে?

    - স্যার আপনাকেই তো বলছি। আপনি লোক ভালো, আমায় স্নেহ করেন, আমি জানি। নইলে এসব কথা আপনিও আমার সঙ্গে কোনদিন বলতেন না। আমাদের আর কি ক্ষতি হবে স্যার। জেনে বুঝেই তো এসেছি এই চাকরিতে।

    - তা ঠিক কিন্তু বুঝলে না শেষটাই আসল। যত শেষের দিকে তত মায়ার দিকে। বড্ড মায়া হচ্ছে এখন নিজের জীবনের ওপর বুঝলে দাস।

    - এ মায়া প্রপঞ্চময়, এ মায়া প্রপঞ্চময়। বাবা গাইতো স্যার। সারাদিন পরে বাড়ি ফিরে মার কাছে অকারণ ঝাড় খেত আর এই গানটা গুণ গুণ করে গাইত। ওই এক লাইন। আর না, আর জানতো না, তাছাড়া বড্ড বেসুরো ছিল।

    - ঠিকই বলেছ। বাড়িতে থাকব কি করে বলতো? এমনিতেই কেউ আমায় সহ্য করতে পারে না, আমিও পারি না, তারপর সারাদিন বাড়ি? কিন্তু এই চাকরিও যে আর সয় না।

    - স্যার দরিয়াপুরে থেকে যান আর ওই কুমারবাবুর দলে নাম লেখান।

    - কুমারবাবু? সেতো শুনি মস্ত লোক আর মস্ত বড় পাগলও।

    - না স্যার পাগল না হলে কি কোন কাজ হয়? কি লোক। প্রনম্য। বাইরে থেকে সবটা বোঝা যায় না স্যার। বিদ্বান, সৌম্য চেহারা। নীল রক্তের মানুষ তো কত হয়, কিন্তু কি আন্তরিকতা।

    - ওকে দলে নিচ্ছে না কেন এদিক বা ওদিক?

    - চেষ্টা কি কম করেছে? এসব লোক কখনো দলবাজি করে। রাজার ছেলে ভিখারির সঙ্গে খায়। ভোটের প্রচারের জন্য নয়। টিভির চ্যানেলের সামনে নয়। আর গরিবব মানুষের ভাত গরিব লোককে দিয়েই রোজগার করায়। ভাবা যায়! এই যুগে।

    - দিলুবাবু তো শুনেছি ওর হাতেই তৈরি।

    - একদম। কিন্তু দিলুতো অন্য পথে চলছে। তবে লোকটা খারাপ না। আর ভয়ঙ্কর বুদ্ধিমান, সব কিছু করতে পারে। ভাগ্যও তেমন। যেন অসাধ্য কিছু নেই। অথচ কি ছিল কিছুদিন আগে। কোথা থেকে কথায় উঠে যাচ্ছে। কি তাড়াতাড়ি। সিনেমার মতো।

    - সেইখানেই তো খেলা। উঠবে আর পড়বে।

    - লম্বা রেসের ঘোড়াও হতে পারে। গুন্ডা তো বটেই। কিন্তু ছেলেটার কোন খারাপ রেকর্ড নেই। খাতায় কলমে। খুব খারাপ কাজ কখনো করেনি। আর বদলেও গেছে। একদম বদলে গেছে। এখন ওর সাহস আর ধারালো বুদ্ধির কাছে সবাই মাথা নত করছে। এমনকি কলবাবুর এই পড়তি বাজারের এক মাত্র কারণ হল দিলু। সব জায়গা দখল করে নিচ্ছে একে একে। আর ওকে ব্যবসা করতে দেবে না। এমনকি মনে হচ্ছে কলবাবুকে নিয়ে লেখাগুলোর পেছনে ও লাগলেও লাগতে পারে। কিন্তু কোন প্রমাণ নেই। কিন্তু এমনও লেখা পাওয়া যাচ্ছে যা দিলুর ইন্টারেস্টের বাইরে। সেইটাই বা হবে কেন তাহলে, মিলছে না। স্যার মিলছে না। এই একটা জায়গা আমার একদম মিলছে না।

    - মেলাও মেলাও দাস। কখন কি হয়ে যায়। মন নরম হয়ে গেলে যেন ভাবনা চিন্তাও আসে না। আমি আর আজকাল জটিল কিছু ভাবতেই পারছি না।

    - আপনি তো ঠিকই আছেন। কোন কিছুই জটিল করে ভাবলে আসলে কিছু মেলেই না। সহজ করে আরও সহজ করে নাকি ভাবলে সব বোঝা যায়। এক্কেবারে জলের মত।

    - ওই জলের মতো ভাবতে পারাটাই তো জীবনের দর্শন।

    - আরেব্বাস! আপনার হবে স্যার।

    - কি হবে?

    - স্যার আপনিও মহান।

    - বাড়াবাড়ি হচ্ছে না দাস?

    - না স্যার। আসলে আপনি তো সেই নারদের তেলের বাটি নিয়ে চলেছেন। আপনার এই চাকরি শেষ হলেই আপনি আবার আসল আপনি হয়ে যাবেন।

    - আসল আমি? দেখো অফিস ঘরে বসে একটা কথা বলছি আসল আমি বলে কিছু হয় নাকি।

    - স্যার আরেকটা! আরও একটা!

    - কি আরেকটা?

    - স্যার আপনি অন্য রকম বা আপনিও হয়তো খুব তাড়াতাড়ি বদলে যাচ্ছেন। কি সব কথা বলছেন স্যর। কি বলছেন স্যর। একেবারে মনের কথা।

    - তোমার মনের কথা তো দেখছি সব্বাই বলে দিচ্ছে। আমি, লিফলেটের অজানা মানুষ, তোমার মন যে সব্বাই পড়তে পারছে …। পুলিশের মন সব্বাই পড়তে পারলে চলবে? তোমায় তো এখনো অনেক দিন টানতে হবে।

    - হ্যাঁ স্যার ঠিক বলেছেন। আমি চাই পড়তে পারুক। ওটাই প্লাস পয়েন্ট। আমায় পড়তে পারলে আমিও যে তাকে পড়তে পারি স্যার, সুবিধে হয়ে যায় কাজে। উলটো দিক নিজের অজান্তেই ওপেন হয়ে যায়।

    - তুমি তো ধুরন্ধর হে। আমাকে নিয়ে তুমি কি করবে গো দাস? কত কিছু জেনে গেছ আমার। নাহ্, তুমি ইন্টেলিজেন্সে যাও দাস, তোমার প্রমোশন হোক, ডিপার্টমেন্ট চেঞ্জ হোক।

    - হ্যাঁ স্যার চান্স পেলে যাবো। স্বপ্ন দেখতে হয়। কুমারবাবু তাই তো বলে বেড়াচ্ছেন চতুর্দিকে।

    #

    অনেকক্ষণ বাদে গাড়িটা থামল। গাড়ি থেকে এই প্রথমবার নামল কুমার। বলা ভালো নামতে দেওয়া হল তাকে। একটা কানাগলিতে এসে দাঁড়িয়েছে গাড়িটা। কোন দিকে এল কোথায় এল কিছুই বুঝতে পারছে না কুমার। গাড়িটার কাঁচটায় কিছু একটা ছিল যে রাতে বাইরেটা কিছুই দেখা যায়নি। এরা অসম্মান কিছু করে নি কিন্তু ঘণ্টা দুই আড়াইয়ের পথে ওর যে খুব স্বাধীনতা ছিল তাও নয়। রাত এখন দশটা বেজে গেছে। কেন কোথায় এভাবে তাকে নিয়ে আসা হল কিছুই বুঝতে পারছে না কুমার। অস্বস্তি হচ্ছে, আশঙ্কাও হচ্ছে। কিন্তু দেখা যাক কি হয়। খুব খারাপ কিছু হবে না আশা করা যায়। অন্ধকার অন্ধকার রাস্তাটার একদম শেষ বাড়িটার গেটে সঙ্গের দুজন লোক তাকে দারুণ অভ্যর্থনা করে ঢোকাল। আরও একজন আগে থেকেই দাঁড়িয়ে ছিল গেটে। নমস্কার জানিয়ে সে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল আগে আগে, মাঝে কুমার আর পেছনে পেছনে ওই দুজন। হলুদ আলো। আবছা। কেন আবছা কে জানে। পুরনো বাড়ি। একটা লম্বা করিডর তার দুপাশে কয়েকটা ঘর একটা ঘরে বসতে বলল তাকে ওরা। বলে গেল -- শ্রীবাস আপনার সঙ্গে দেখা করবেন একটু বাদেই। তার পরে বেড়িয়ে গেল। কে শ্রীবাস? কি চায় সে? এ ঘরটাতেও হলুদ আলো, নিষ্প্রভ নয়। আসবাব নেই বললেই হয়। সাদা চাদর পাতা একটা ছোটো ডিভান। ঘরের একপাশে একটা টেবিল আর চারটে চেয়ার। সব আসবাবই কাঠের, পুরনো। কুমারের মোবাইল ফোন লোকগুলোর কাছেই আছে। নিয়ে রেখেছে। ঠিক কটা বাজে বুঝতে পারছে না তাই। সে জানতে চাইছেও না। কিছু না ভাবারও চেষ্টা করছে। কখনো কখনো উৎকণ্ঠিত হয়ে লাভ নেই। কিছু তো তার এই মুহুর্তে করার নেই। যদিও অনেককেই অজান্তেই শত্রু বানিয়েছে কুমার। সে সব ভাবনা আসছেই কিন্তু কুমার মনকে যতটা পারে শান্ত রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। গরম নেই। তবে বদ্ধ লাগছে। কুমার দাঁড়িয়েই ছিল। তারপর জানলার কাছে এগোল। জানলা খুলতে চেষ্টা করতেই দরজা খুলে একজন ঢুকল। -- ওঃ এরা জানলাটাও খুলে দেয়নি। পেছন ফিরে একঝলক তাকিয়েই কুমার বুঝল যে লোকটা ঘরে ঢুকল সে আর কেউ নয় -- জিতু।

    কাঁচা পাকা দাড়ি গোঁফে মুখ ঢাকা। সাধারণ প্যান্ট আর হাফ শার্ট পরে হাসি মুখে সামনে দাঁড়িয়ে আছে জিতু। তারপর এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল আগে যে, সে জিতুই। প্রচণ্ড আনন্দ আর বিস্ময় নিয়ে কুমার তাকাতে চাইল। কিন্তু সে নিজেকে সামলালো। ইচ্ছে করেই। কারণ কার্যত বন্দী অবস্থায় কোন পুনর্মিলনের সুখানুভূতি প্রকাশ করার কোন কারণ সে অন্তত খুঁজে পাচ্ছে না।

    - বোস্। তোকে খুব জ্বালালাম। জিতু বলল।

    কুমারের তরফে অনেক প্রশ্ন জমা হয়েছিল, বহুদিন ধরেই। সেগুলো বাঁধ ভেঙ্গে যেন সব্বাই একসঙ্গে বেড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করতে শুরু করল। কিন্তু কোন প্রশ্নই কুমার করল না। এটুকু বুঝতে পারল জিতু এখন যেই হোক যাই করুক, এই সাক্ষাৎ কোন নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে ও সে উদ্দেশ্য খুব গোপন।

    - তুইই তাহলে শ্রীবাস।

    মৃদু হাসে জিতু। তারপরে বলে-- দাঁড়া পরে কথা বলছি, আগে আমরা খাব। একটু বেশি রাত হয়ে গেল তোর জন্য। আজ একটু তোর অনিয়ম হবে। কোণায় দরজাটা বাথরুমের। ফ্রেশ হয়ে নে, হাত ধুয়ে আয়, সাবান টাবান আছে ।

    কুমার বাথরুমে ঢুকে ইউরিনাল ব্যবহার করে। তারপর চোখে মুখে জলের ঝাপটা দেয়। তাকায় নিজের মুখে। আয়নার ওপরে সেই হলুদ আলো। জিতু যে একটা গোপনীয়তা বজায় রেখে চলে এই নিষ্প্রভ হলুদ আলোগুলো যেন সে কথাই বুঝিয়ে দেয়। কিন্তু এ নিশ্চয়ই তার থাকার জায়গা নয়। এই বিল্ডিং কেমন ঠিক কোন বাড়ির মতোও নয়। কোন পুরনো আমলের হোটেলের মতো। কত কথা তার মনে পড়ে যাচ্ছে, দ্রুত গতিতে। বেশিরভাগই ছোটবেলার। পুজোর ছুটিতে ওদের সাইকেলে চেপে পুরনো ব্রিটিশ আমলের নীলকরদের পোড়ো বাড়িতে যাওয়া। সেই গা ছমছমে ভাঙা ইটের পাঁজা বার করা দেওয়ালে সাইকেল হেলান দিয়ে রাখা। সাপের গর্ত খোঁজা। আর নীল বিদ্রোহের গা গরম করা ইতিহাস নিয়ে কথা বলা। ওরা তখন নিজেরাই যেন সেই বিদ্রোহী চাষি। আর যেন সেই অত্যাচারী ইংরেজদের কাছ থেকে ওরা দুজনই পারে এই বাংলাকে রক্ষা করতে। সেই অভিযানও ছিল গোপন, বাড়ির লোকজনকে এড়িয়ে। সেই সরল নিষ্পাপ দিন পেরিয়ে এসে এই হলুদ আলো ঘেরা বাড়িতে তারা যেন এতদিন পরে দুই সম্পূর্ণ নতুন মানুষ। ভালো করে হাতে সাবান দিতে দিতে ইদানিং কালের অভ্যেস মতো কুমার মনে মনে বলে এক, দুই, তিন, চার……। কুড়ি পর্যন্ত গোনে। হাত ধুয়ে ফেলে। কুমার ভাবে কোন ভাবেই, কোন পরিস্থিতিতে দুর্বল হওয়া চলবে না। একটা বিষয় পরিষ্কার, কুমার জিতুর কাছে অজানা নয় কিন্তু জিতু সম্পুর্ণ ভাবেই কুমারের কাছে অজা না। তারপর কুমার চিন্তা ভাবনাগুলোকে দূরে সরিয়ে মাথাটাকে পুরোপুরি হালকা করে বাথরুমের দরজা খুলে বেড়িয়ে পড়ে।

    এসে দেখে খাবার এসে গেছে। ডাল, রুটি একটা নিরামিষ তরকারি। আর কিছু ফল। কুমার বসলে জিতু আবার শুরু করল -- খেয়ে নিবি চল। দুজনেই খাওয়া শুরু করে। কে কি বলবে ভেবে পায় না। স্বাভাবিক ভাবেই দুজনের চেহারার পরিবর্তন, খাবারের রুচির পরিবর্তন এই সব নিয়ে খানিক কথা এগোয়। সেকথাও এক সময় মিটে যায়। খাওয়া শেষ হয়। হাত ধুয়ে একটা আপেলের টুকরোতে কামড় দিয়ে চিবোয় জিতু। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে, তারপর বলে -- তুই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছিস তোকে আমি এক বিশেষ কারণে এখানে নিয়ে এসেছি।

    - পারছি। কিন্তু কারণটা জানি না।

    - তুই ইলেকশন এ কম্পিট কর।

    - কেন? এই কথা বলার জন্য ডেকে এনেছিস?

    - তাই বলতে পারিস। কারণ পরে বলছি।

    - না। আমার আদর্শের সঙ্গে এই মুহুর্তে সেটা যাচ্ছে না।

    - ইন্ডেপেন্ডেন্ট ক্যান্ডিডেট হলে কি ক্ষতি?

    - আমি রাজী নই। আমি অন্যভাবে কাজ করতে চাই। তাছাড়া ইন্ডেপেন্ডেন্ট ক্যান্ডিডেটের কি ভবিষ্যৎ সে তুই জানিস।

    - তুই জিতবি।

    - না আমি বলছি তার পরের কথা, আমাকে কোথাও মাথা গুঁজতেই হবে শেষ পর্যন্ত। আর তখন আমি সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাব।

    - তুই আদৌ কি কোন কাজ করতে পারছিস মানুষের জন্য?

    - পারছি না, মেনে নিলাম। কিন্তু ভবিষ্যতেও যে পারব না এই কথা তোকে কে বলল? তাছাড়া তুই কেন এই কথাগুলো বলছিস আমি বুঝতে পারছি না। তোর পলিটিকাল আইডেন্টিটি কি। তা তো আমি জানি না।

    - সে কথা একদিনে আমি তোকে বলতে পারব না। কিন্তু আমি আমার জীবন সাধারণ মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছি বলতে পারিস।

    - কি ভাবে?

    - বললাম তো এখনই সে কথা বলা যাচ্ছে না।

    - ভাল কথা। সে তোর নিজের কাছেই থাক। আমি জোর করছি না। কিন্তু ধোঁয়াশা রেখে তো কোন কথা এগোতে পারে না। একপাক্ষিক ভাবে এ সমস্ত কথা হতে পারে না। তাছাড়া আমিও এ বিষয়ে কোন কথা আর বলতে চাই না।

    - তুই ক্যান্ডিডেট হলে অনেক সহজে কিছু কাজ হত। নইলে দরিয়াপুরে অশান্তি হওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। ভেবে দেখ তার প্রভাব কিন্তু তুই যাদের বাঁচাতে চাইছিস তাদের ওপরে পড়বে।

    - এই কথাকে কিভাবে নেব আমি?

    - অবশ্যই পরামর্শ।

    - তোর এই পরামর্শ আমি মানতে পারছি না। আমি ভালো আছি। সাধারণ মানুষগুলোর সঙ্গে থাকতে পেরে আমি খুশি, আমার কোন ব্যক্তিগত চাহিদা নেই। আমি ওদেতোড় ওই মান্ধাতার আমলের বস্তা পচা, না গান্ধীয়ান না কমিউন কনসেপ্ট। বাস্তবের ওসবের সঙ্গে কোন যোগ নেই।

    - না থাক। লোকগুলো দুমুঠো খেতে পারছে, পৃথিবীটা আসলে কী সেসব জানতে পারছে, নিজের ওপরে ভরসা করতে পারছে। সেই যথেষ্ট। তাছাড়া মান্ধাতার আমল থেকেই খাওয়া পড়া আর একটু মাথা গোঁজার একটা জায়গা ছাড়া আর তো কিছু মানুষের চাহিদা ছিল না। তাই, হোক বস্তা পচা। আমি ওদের সঙ্গেই আছি। এভাবেই থাকব। আমি ভুল করছি না।

    - হা হা হা , তুই ভাবছিস ওইটুকতে ওদের ভালো থাকা বলে?

    - খাওয়া--পরা, থাকা, আর সম্মান নিয়ে বাঁচার জন্য শিক্ষা। এর বেশি আর কিছু এই মুহূর্তে এদের দরকার আছে বলে মনে হয় না।

    - মানে স্বপ্নহীন বাঁচা।

    - তুই এ কথা বলছিস? জিতু এই কথা বলছে? স্বাধীনতার প্রায় পঁচাত্তর বছর পরেও এদের কাছে এইটুকুই যে স্বপ্ন তুই জানিস না? দুটাকা কেজির চালের কৃতিত্ব নিয়ে কেন্দ্রে রাজ্যে খেওখেয়ি হয় কেন বুঝিস না? কেন গরিবিকে সামনে রেখে এখনো ভারতে ভোটে জিততে হয় জানিস না?

    - তুই শিশুই থেকে গেলি।

    - ঠিক আছে থাকলাম। কিন্তু আশা করি তুই আমার এই শিশুসুলভ সিদ্ধান্তকে সম্মান করবি।

    - একটা কথা বলছি তোর ওপরে বিশ্বাস গরীবগুলোর এখনো আছে এই কারণে যে সিস্টেম তোর পেছনে লাগেনি। যদি লাগে তাহলে কিন্তু তুই যা ভয় করছিস তাই কিন্তু হবে। তোর থেকে সাধারণ মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেবে।

    - এটাকেও আমি কি পরামর্শ হিসেবে নেব?

    - নিশ্চয়ই।

    ঘর জুড়ে নিস্তব্ধতা নামে। কুমারের মধ্যে কোন বিরক্তি দেখা যায় না, কোন উত্তেজনাও না, কোন ভর্তসনাও না। সে অনড়, যেন অবিচল হিমালয়। কিন্তু জিতুর মধ্যে খানিকটা বিস্ময় জন্মায়। এ সেই ছেলে! যে তার কথা মন্ত্রের মতো গিলত। সমবয়েসি বন্ধু হলেও শ্রদ্ধার চোখে দেখত। তবে কি সময়? না এমনই হওয়ার ছিল? কোথাও একটা অসহায়তা ফুটে উঠল জিতুর মুখে, তারপরে মুখে একটা মৃদু শ্লেষ।

    - তোর নীল রক্ত তোকে থিওরেটিকাল জগতেই রেখে দিল।

    - তোর বন্দুকের নলে স্বাধীনতার স্বপ্ন নিশ্চয়ই জীবিত আছে। আছেই। নইলে এমন ভাবে আমাকে আমন্ত্রণ করতিস না।

    - সেই তো আসল। অসাম্যের বিনাশ একমাত্র সে ভাবেই হতে পারে।

    - বিনাশ কর। তোর সামনে নীল রক্তের অসাম্য হাজির। আমাকে দিয়ে শুরু কর। দরিয়াপুর ভাসিয়ে দে রক্তে। সাম্য প্রতিষ্ঠা হোক। আমি জানি না তুই কোন সিক্রেট সোসাইটির নেতা কি না। কিন্তু তুই যাই হোস না কেন, সেই পথে আমার বিশ্বাস নেই, সে পথ আমার নয়।

    - আমাকে খুব কঠিন পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দিলি। আমি চাইছি বিনা রক্তপাতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হোক। তাতে অনেক দিক থেকেই অনেকের সুবিধে। তোর কাছে তাই সাহায্য চেয়েছিলাম। কিন্তু এবার শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যদি রক্তপাত দরকার হয় তাহলে কিন্তু তার দায় তোর ওপরেও বর্তায়।

    কুমার কোন কথা বলে না। সে বুঝতে পারছে জিতু একটা বড়সড় গণ্ডগোলের কথা বলছে, কিন্তু যে প্রস্তাব ও দিচ্ছে সে ওর পক্ষে অসম্ভব। নিজের কাছে সে ঠিক থাকবে। সে পারবে না এই দলীয় রাজনীতির মধ্যে ঢুকতে, সে তো সারা পৃথিবীর মানুষের মুক্তির কথা ভাবে না। তার সীমানা যে নির্দিষ্ট, সে তার দরিয়াপুরকে নিয়েই সুখী। নিস্তব্ধতা। নিস্তব্ধতা। পরের মুহুর্তে কি হবে কুমারের জানা নেই। কিন্তু তার মনে হচ্ছে এই কথাগুলো বলতে পেরে সে নিজেকে হালকা মনে করছে। নিজেকে শক্তিশালী বলেও মনে হচ্ছে তার। অন্তত সব কিছু সহ্য করার মতো শক্তিশালী সে।

    -- অকারণ রক্ত কি কারোর ভালো লাগে। তবে তাই যদি হয় তাই হোক। কিন্তু একটা কথা তুই এর পরে আর আমায় দোষ দিতে পারবি না। জিতু বলতে থাকে -- আর কাউকে বাঁচানোর কোন চেষ্টা করার আগেই তোর অনেক দেরী হয়ে যাবে। শুধু মনে রাখিস আমি জীবন দিয়ে বুঝেছি একটা সিস্টেম ছাড়া আমরা এগোতে পারি না। আমরা বাঁচতেই পারি না। এই সিস্টেমের অসংখ্য লেয়ার। মানুষ শুধু পোস্টারের মুখটাই দেখে। কিন্তু তার পেছনে আসলে থাকে অন্য মুখ। তাকে দেখা যায় না, কোনদিনই দেখা যায় না। সে হল ঈশ্বর। আমার ঈশ্বর।

    -- ডিপ স্টেট? কিন্তু ডিপ স্টেটও যে একটা মুখকে বেশিদিন রাখে না জিতু? অদৃশ্য করে দেয়। তোর ঈশ্বরকেও যে বদলে দেয় বারবার। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কুমার জিতুর চোখে।

    -- হা হা হা -- ওরে চা দিয়ে যা। চেঁচিয়ে বলে জিতু। এতক্ষণে লক্ষ করল কুমার বন্ধ দরজার পেছনে একটা লোক ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল। বলার সঙ্গে সঙ্গে সে চলে গেল চাপা একটা শব্দ করে। কিছুক্ষণ বাদে হয়তো সেই লোকটাই চা নিয়ে এল। দুজনের জন্যই। তারপর চলে গেল ঘর থেকে দরজা বন্ধ করে। কুমার চায়ে চুমুক দিল আর তাকিয়ে থাকল কোণের হলুদ স্ট্যান্ড লাইটটার দিকে। তার দৃষ্টি জুড়ে খেলা করতে থাকল যেন দরিয়াপুরের সর্ষে ক্ষেতের রঙ। তারপর খুব আস্তে আস্তে সে রঙ থেকে বেরিয়ে আসতে থাকল সাত রঙ, সেই সাত রঙের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে সে, আর ভেসে যাচ্ছে তার সাধের দরিয়াপুর।

    #

    বহুদিন পরে দিলু কাজ থেকে ফিরছে আজ। সে আজ থাকবে। শিউলি সাজিয়ে রেখেছে ঘর। বইগুলোকে ঝাড়পোঁছ করেছে। তানপুরাকে যত্নে মুছেছে। সারাবাড়ির ধুলো ঝেড়েছে। তার পর স্নান করেছে। শিউলি আজ সেজেছে খুব। সে এনেছে ফুল। সাজিয়ে রেখেছে ঘরে। মাথায় বেঁধেছে খোঁপা। খোঁপাতেও লাগিয়েছে ফুল। বেদো পাগলাটা এসেছিল বিকেলে। কি যে রোগা হয়েছে। হাড় সর্বস্ব। মুখে কিন্তু হাসি লেগেই আছে। বলল সব রিপোর্ট ভাল। ও রেলের কি একটা ঠিকে কাজের সন্ধানে যাচ্ছে। পেলে ভাল। তাই প্রণাম করে গেল। শিউলিকেও প্রণাম করার লোক একটা আছে। পাগল ছেলে এক্কেবারে। শিউলি সেই গানটা আবার গাইছে। এমন সুরটাই সেদিন একটা সাঁওতাল বাড়িতে ও শুনেছে। রেডিওতে বাজছিল, বেদো যখন ওকে নিয়ে গেছিল। কিন্তু এই সুরটা অনেক দিন থেকেই ও করে। কথা ছাড়া, ফিরে ফিরে আসে। আজও তার এইটা ঘুরে বেড়াচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে। সহজিয়া সুর এমনই হয়, একে রপ্ত করতে মন ছাড়া আর কিছু লাগে না। সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হয়ে গেল। কলিং বেল বাজল। দিলু কি? না দিলুর কলিং বেলের আগে স্নিকারস পাপোষে ঘষার একটা শব্দ হয়। শুভ্র বলে ছেলেটা এসেছে। হাতে একটা খাম ধরিয়ে গেল -- দাদা আপনাকে দিয়েছে। বহুপ্রতীক্ষিত সেই চিঠি বুঝি। কিন্তু আজ কেন?

    #

    মেয়েকে চিঠি লেখা শেষ করে সুর্যশেখর। মেল করে পাণ্ডুলিপির শেষ পর্যন্ত যেটুকু লিখেছে তাও পাঠায়। ওইটুকু মেয়ে তাও কি উৎসাহ ইতিহাস পড়ায়। বাবার লেখা কি আনন্দ করে পড়ে। ভালো মন্দ সবই উত্তর দেয়। মতামতও দেয়। একটু দেখা করতে পারলে ভালো হত। সে তো সত্যি করেই আদর্শ পিতা হতে পারেনি। এইটুকুই তার হয়তো মেয়েকে দেওয়ার কথা ছিল। আজ সন্ধ্যেটা অদ্ভুত। ফেব্রুয়ারির শেষে বসন্তের বাতাস যেন বইছে। একটা কোকিলও বুঝি ডাকছে। লোকটা হাজির আবার। শান্ত হয়ে বসে আছে সামনে। চোখটা কি শান্ত। মাঝ রাতের সমুদ্রের মতো। আজ কোন কথাই কেউ যেন বলছে না। লোকটা কোনদিন এত চুপ করে থাকে না। আজ যেন সত্যি বড্ড চুপ করে আছে। একটা অজানা নম্বর থেকে ফোন বেজে ওঠে সূর্যের মোবাইলে। ফোনটা ধরে। ওপার থেকে সাকুল্যে দশ সেকেন্ড কেউ কথা বলে। সূর্যশেখর ফোনটা কেটে দিয়ে ছুটতে ছুটতে বেড়িয়ে পড়ে, যেমন অবস্থায় ছিল তেমন ভাবেই। নিজের মনে বলতে থাকে -- না না, এ হতে পারে না। আমি থাকতে এ আমি হতে দেব না। সে খেয়াল করে না কিচ্ছু। সে খেয়াল করে না সেই বৃদ্ধও তার পেছনে পেছনে তখন ছুটছেন।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | ৯
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments