• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৫ | জুলাই ২০২৪ | উপন্যাস
    Share
  • ডহননাগড়ার কাহন (৬) : অংশুমান বিশ্বাস



    ।।১৬।।

    পশ্চিম দিকের চর ঘেঁষে ওদের নৌকো চলেছে। গঙ্গার পূব দিকে নদীয়া, পশ্চিমে হুগলী। নদীয়ার তীর জুড়ে কলার খেত, ঘন। সেই ক্ষেতের জঙ্গল ভেদ করে কোন কিছুই দেখতে পাওয়া যায় না। একটা ভাঙাচোরা লরি দুলতে দুলতে চলেছে একদম তীরের রাস্তা ধরে। সারা শরীরে কাদা মাখা। হুগলীর দিকের তীর বরাবর সব্জির চাষ করেছে স্থানীয় মানুষ। ছোটো ছোটো নৌকো করে সেখান থেকে সবজি তুলে নিয়ে যায়। তারপর সেখান থেকে সাইকেল করে হাটে বাজারে বিক্রি করে। জোয়ার না ভাঁটা এই মুহূর্তে বোঝা যাচ্ছে না। জল স্থির।

    - কাকা এখন জোয়ার না ভাঁটা?

    -- মাঝমাঝি। ভাঁটা শুরু হবে। এক মনে বৃদ্ধ মাঝি দাঁড় টানে। দিলুর ইচ্ছে করছিল একটু চেষ্টা করে। কিন্তু গঙ্গায় এ কাজ না করাই ভালো। শিউলি আছে সঙ্গে, ভয় পেতে পারে। একেই মন ভালো নেই। সরস্বতীর কথা মেয়েটা মাথা থেকে সরাতে পারছে না। দিলুকে ফোন করে আসতে বলেছিল সকালেই। তারপর হঠাৎ করেই বেড়িয়ে পড়েছে ওরা।

    - আপনি কোন বয়েস থেকে নৌকো চালাচ্ছেন? শিউলি জিজ্ঞেস করে। -

    - ছোট থেকেই, বাবার হাত ধরে। -

    - আর কি করেন? -

    - কি আর করব? মাছ ধরি আর এমন টুরিস্ট নিয়ে বেরোই। -

    - ছোটবেলা থেকেই এখানে? -

    - নদীয়ায় জন্ম। আমার বাপ বাংলাদেশের মানুষ। এখানে আসছি বছর পঁচিশ বয়েস থেকে। -

    - পাড়ের জলে না তাকিয়ে জোয়ার ভাঁটা বোঝেন? শিউলি জিজ্ঞেস করে। -

    - জোয়ার ভাঁটা না বুঝলে জেলে মাঝির জীবন চলে। চোখ বন্ধ করে নৌকোয় শুয়ে শুয়ে বোঝা যায় গো মামনি। জলের সঙ্গে এক সঙ্গে থাকলে সব বোঝা যায়। মানুষের মনের মতো। জোয়ার ভাঁটা আছে বলেই তো এত নোংরা করলেও নদীর জল পরিষ্কার হয়ে যায়। সব বিষ চলে যায়। নইলে কবেই সব জ্বলে পুড়ে যেত। তা জোয়ার ভাঁটা খুব সহজে বোঝা যায় ফাতনা ফেলে। যেদিকে ফাতনা হেলবে বুঝবেন সেদিকে জল যাচ্ছে। নবদ্বীপের দিকে হেললে জোয়ার আর ডায়মণ্ড হারবারের দিকে হেললে ভাঁটা। আর কোনদিকে না হেললে, সোজা দাঁড়িয়ে থাকলে মাঝামাঝি, বঝলেন না মামনি? -

    ওর নাম কানাই। বছর ষাটেক বয়েস। ছোটখাটো রোগা চেহারার মানুষ। খালি গা। গায়ের রঙ কয়লার মতো কালো। সারা শরীর রোদে পুড়ে গেছে বলে মনে হয়। গলায় সাদা কণ্ঠী। ততটাই সাদা। লোকটা কথা বলতে ভালোবাসে বোঝা গেল। সবাই কথা বলতে চায় না, বিশেষ করে বাইরের লোকের সামনে। তবে অনেকে মানুষ আছে যারা কথা বলে টুরিস্টের সঙ্গে, একাত্ম হয়ে কথা বলে। তাতে টুরিস্টেরও ভালো লাগে। ব্যবসা ভালো হয়। কিন্তু এই বয়স্ক লোকটা এত ভেবে চিন্তে হয়তো কথা বলছে না। সহজ স্বভাবেই বলছে।

    -- ওই খালের মুখটায় বাঁশ দিয়ে পুঁতে রাখা জালগুলো কী ধরনের জাল? শিউলি বলে।

    - ওগুলো টানা জাল। ওখানে প্যাঁকাল, পিটুলে বেলে, চিংড়ি এসব পাওয়া যায়।

    - কি রকম করে ধরে?

    - সে এক কাণ্ড। ছোটো নদীতে এ জাল দেওয়া যায়। বড় গঙ্গায় নয়। পশ্চিম দিকের এই ছোটো নদীর মুখে জাল দেখতে পাচ্ছেন কারণ ওখানে নিচ পর্যন্ত বাঁশ পোঁতা যায়। ভাঁটা শুরুর মুখে জালটাকে সার সার বাঁশের নীচে মাটির মধ্যে আর দশ ইঞ্চি গেঁথে দেওয়া হয় নদীর আড় বরাবর। আর জোয়ার পুরো চলে এলে জলের এক ফুট উঁচুতে জাল তুলে বাঁশের ডগায় সে জাল বেঁধে দেওয়া হয়। এর পরে ভাঁটার টানে ফিরতে গেলে সব মাছ ধরা পড়ে একসঙ্গে। জালের তলায় মাছের খাবারের চার দিলে আরও বেশি আসে মাছ।

    - মাছ কী কী পাওয়া যায়?

    - পুঁটি, বান এসব পাওয়া যায় আর গঙ্গায় বড় জাল ফেললে ছোটবড় সব মাছ ওঠে।

    - একটু বলুন না। আপনি খুব সুন্দর বলছেন।

    - বলব মামনি। আপনাদের ভালো লাগছে এই তো আমার সব থেকে আনন্দ। সবাইতো এমন জানতে চায় না।

    লোকটার বলার ধরনে একটা সারল্য আর ঝরঝরে ব্যাপার আছে। তাই শুনতে ভালো লাগছে। সে বলতে থাকে আবার-- আর আছে বেন্দি জাল, ওই জাল যেদিকে জলের গতি সেদিকে পাততে হয়।

    - সে কি রকম?

    - প্রজাপতি ধরে জাল দেখেছেন?

    - দেখেছি। আমি দেখেছি। শিউলি বলে।

    - অমন দেখতে, একদিক মুখ হাঁ করা। দুই দিকে দুই খোঁটা পুঁতে ফেলে রাখা হয়। জালের হাঁ আঠেরো কুড়ি ফুটের হয়। লম্বায় চল্লিশ ফুটেরও হয় আর লম্বার শেষে চার পাঁচ ফুটে সরু করা থাকে সেখানে জলের স্রোতে মাছ ঢুকে পড়ে বেরোতে পারে না।

    - বিরাট জাল তো।

    - আরও বড় জাল আছে, আমাদের বাংলাদেশের ভাষায় বলে ছান্দি জাল, সে জালে ছোটো বেলায় ইলিশ ধরেছি বাপ জ্যাঠার সঙ্গে?

    - আপনারা বাংলাদেশি? বাংলাদেশে ধরেছেন ওই জাল দিয়ে?

    - ওই যে বললাম এইখানেই জন্ম। বাপ বাংলাদেশ থেকে আসছিল। এখানকার আশপাশের নদীর পাড়ের বেশিরভাগ মানুষই বাংলাদেশের। ভাষা ছেড়েছি। জালের নাম ছাড়িনি। এখানেই কত ইলিশ পেতাম ওই ছান্দি জালে। ইয়া বড় জাল। গঙ্গার আড় বরাবর দুপাশে দুই নৌকো দিয়ে মাছ তাড়িয়ে ধরতে হতো।

    - ইলিশ!

    - হ্যাঁ, কত! এখন দু চারটে পাওয়া যায়। ইলিশ মাছ রাজা মাছ।

    - রাজা বলেই বুঝি সুখী। শুনেছি সূর্যের আলো দেখলেই নাকি মরে যায় এত সুখী।

    - না ওসব ভুল কথা গো। ওসব আপনাদের টেবিলের আলোচ না। ইলিশ গভীর জলের মাছ তাই পাতলা আর প্রচণ্ড শক্তিশালী। ও যেদিকে স্রোত তার উল্টোদিকে ছোটে, ছুটে আনন্দ পায়। আসলে গভীর জলের মাছ তো তাই কানকো ছোটো। জল থেকে তুললে হাঁপিয়ে, শুকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মরে যায়। কিন্তু নৌকোর খোলের জলে রেখে দিলে দিব্যি বাঁচে, চার পাঁচ ঘণ্টা বা তারও বেশি।


    একটা ছোটো দ্বীপ। গঙ্গার মাঝে তৈরি হয়েছে, গাছ গাছালিতে সবুজ হয়ে আছে। কানাই ওদের ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। আবার আসবে দুপুর পেরিয়ে। দু একটা ছোটো মাছধরা ডিঙি নৌকো নিয়ে একলা জেলে মাঝি মাছ ধরতে ধরতে চলে আসছে চরের ধার বরাবর। নৌকোর সঙ্গে মাঝি যেন একার সঙ্গে একা। কখনো কখনো তাদের নৌকো থেকে আলাদা করে ভাবা যায় না যেন, একটাই অস্তিত্ব। উত্তরের দিকটায় পর্যটন দফতরের বানানো আট দশটা অসম্পূর্ণ কটেজ। কবে থেকে পড়ে আছে কে জানে। ওরা বসে আছে চরের পূর্ব তীরে, নদীয়ার দিকে মুখ করে। আরও এক একান্ত দিন, একান্ত সময়। কানায় কানায় পূর্ণ করতে মন চায় কিন্তু তৃপ্তি যে কিছুতেই হয় না। দুজনেই বোঝে। দিলুর জন্য কিছু বই এনেছে শিউলি, সেইটা কি বিষয়ে সে বলে যায় আপন মনে, যা জানলে দিলুর বইটা বুঝতে সুবিধে হবে। বেশ কিছুদিন হল দিলু এখন সারারাত জেগে পড়ে, যা পায় পড়ে। শিউলিই বেশিরভাগ বই জোগাড় করে দেয় ওকে, কুমারদাও কিছু কিছু পড়তে দেয়। একবার ধরিয়ে দেওয়ার পরে লেখাগুলো না বোঝার কিছু থাকে না দিলুর কাছে।এর মধ্যেই ও পড়ে ফেলেছে তারাশঙ্করের কবি, সমরেশ বসুর দেখি নাই ফিরে, সুনীলের সেই সময়। দিলু ইংরেজি শিখছে আবার। শুনে শুনে। শিউলি ওকে বলে দিয়েছে ইউটিউব চ্যানেল ঘেঁটে ইংরাজি শেখা কোন সমস্যাই নয়, টি ভি তে বি বি সি আর সি এন এন দুটোই শোনে। কত উচ্চারণ আলাদা। বাংলাই তো কত উচ্চারণে বলা হয়।

    আজ একটা বই শিউলি এনে দিয়েছে যা নাকি এক অদ্ভুত মায়া জগত। বইয়ের নাম নিঃসঙ্গতার একশ বছর। বাংলায় অনুবাদ। আসলে স্প্যানিশ ভাষায় লেখা তাই ইংরাজিও যা বাঙলাও তাই। যদিও অনুবাদকের হাতের গুণ তো আসলে এসব ক্ষেত্রে আসল কথা। শিউলি বলে যায়। শিউলি যখন বইপত্রের কথা বলে তখন ওর মুখ চোখ চকচক করে। পৃথিবীতে এর থেকে বেশি আনন্দ বুঝি আর কিছুতেই সে পায় না। ও আজ খুব সহজ ইংরাজিতে বলে চলেছে লাতিন আমেরিকার কথা, তাদের আদি মানুষরা কারা ছিল। দিলুর ছোটবেলার স্বপ্নের দেশ আর্জেন্টিনা তার সঙ্গে ব্রাজিল, উরুগুয়ে, পেরু, কলম্বিয়া সকলেই তার চেনা, কবেকার চে না। দিলু সব বুঝতে পারছে। ফুটবল খেলাটা নাকি চায়না প্রথম আবিষ্কার করে। কিন্তু দক্ষিণ আমেরিকায় নাকি ফুটবলেরই একটা অন্য রকম রূপ ছিল। সেটা বেশ খানিকটা অন্যরকম। স্টেডিয়াম থাকত। দুপাশে দর্শকরা বসে থাকত। এক পাশে সাধারণ দর্শক আরেক পাশে রাজা--রাজরা আর পুরোহিতরা। ছোটো গোল পোস্ট, একেবারে ছোটো, দু ফুট উঁচু আর তিন ফুট চওড়া দুদিকে দুটো। কোমর আর পেছন দিয়ে সে বল নিয়ে যেতে হত উল্টোদিকের গোলপোস্টের দিকে। হাত আর পা লাগানো চলত না এবং সেই ভাবেই গোল করতে হত। যে দল প্রথম গোল করতে পারবে সেই জিতবে। আর যে সেই গোল করতে পারবে সে পাবে সর্বোচ্চ সম্মান। তার দেখা হবে ঈশ্বরের সঙ্গে, সরাসরি। হ্যাঁ তাকে সেই খেলার পরেই বলি দেওয়া হবে। সে হাসতে হাসতে বীরের মতো সেই সম্মান গ্রহন করবে। পূর্ণ মর্যাদায় রাজা তার পরিবারের দেখভাল করবেন তার পর থেকে। পরিবার ও অন্যান্য সকলের কাছে সে হয়ে থাকবে অমর, আচ্ছেদ্য। ছোটোবেলা থেকেই তাই যারা ভালো খেলত তাদের নিজেদের পরিবার থেকেই উৎসাহ দেওয়া হত, যতদিন না তাদের পঁচিশ বছর বয়েস হয় আর সেই চূড়ান্ত দিন আসে। কি ভয়ঙ্কর বিশ্বাস। দিলু যেন সব দেখতে পাচ্ছে। দেখতে পাচ্ছে আজ থেকে পাঁচশ বছর আগে যখন বাংলায় চৈতন্যদেব নাম গান করে ভালোবাসার ধর্ম প্রচার করছেন তখন পর্তুগাল আর স্পেন থেকে মানুষ গিয়ে কেমন করে দক্ষিণ আমেরিকায় আদি মানুষজনদের খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত করছে। কারণে অকারণে তাদের মারছে, খুন করছে, ধর্ষণ করছে। ইংরেজদের থেকেও তারা বেশি নৃশংস কারণ ভারতে তাও নিজেদের ভাষা সংস্কৃতি বেঁচে আছে। লাতিন আমেরিকায় স্পেনীয়রা সেসব কিছুই বাঁচিয়ে রাখেনি। আদিম নারীর গর্ভে স্পেনীয় পুরুষের যে সন্তানরা জন্মাল তারা হল মুলাতো, দোআঁশলা। লাতিন আমেরিকা জুড়ে এই মুলাতোরাই এখন আছে। প্রত্যেকটা দেশের ভাষা আর সংস্কৃতি যেমন আলাদা হয় তাই তার সাহিত্যের ধরনও নাকি আলাদা, লাতিন আমেরিকার সাহিত্যও তাই ভাষায় স্প্যানিশ হলেও স্বত্বায় আলাদা হয়ে গেল। কিন্তু মজার কথা হলেও এত সবের পরেও সব দেশের সাধারণ মানুষের মনের ভেতরটা এক্কেবারে এক রকম। বাইরের আবরণটা সরে গেলে মন, মনের চাহিদা, আনন্দ দুঃখ লোভ চাওয়া এই সব অনুভূতি গুলো সম্পূর্ণ একইরকম। তাই এক দেশের সাহিত্য অন্য দেশের মানুষের শুধু যে ভালো লাগে তা নয় অনেক সময় নিজের কাহিনী বলেও মনে হয়। নইলে মারাদোনাকে দেখে কেন দিলুর এখনো মনে হয় এই লোকটা আসলে ওর খুব চেনা, খুব কাছের। কই কলবাবুকে তো আর কাছের বলে মনে হয় না।

    অনেকক্ষণ ওরা চুপচাপ। দুপুর পেরিয়ে যাওয়ার মুখে। গাছপালা থাকায় গরম তেমন মালুম হচ্ছে না। স্তব্ধতা চারিদিকে, এই সময়, পাখি, কীট পতঙ্গ সব্বাই সারাদিনের ব্যাস্ততার মাঝে যেন এই সময়ে একটু চুপ করে থাকে। এই স্তব্ধতা বেশ মনে ধরার মতো। দু একটা আশপাশের লোক যারা ঘুরে বেড়াচ্ছিল বিভিন্ন কারণে, কেউ ডাব বিক্রি করছিল, কেউ চা, তাদের আর দেখা যাচ্ছে না। দ্বীপের মুখটাতে কতগুলো খাওয়ার দোকান আছে। ওরা ফেরার সময় ওখানেই কিছু একটা খেয়ে নেবে। খিদে পেল কি না পেল সে সব বোঝা যাচ্ছে না। ওদের কারোর মধ্যেই কোন তাড়া দেখা যাচ্ছে না। এই চরে গরু বেঁধে যায় অনেকে, প্রচুর ঘাস পাতা পায়। তাছাড়া বা দিকে নদী খুব চওড়া নয়, গরু সাঁতরে চলে আসতে পারে। কানাইয়েরও গরু আছে বলেছিল। বলতে বলতেই কানাই হঠাৎ এসে উপস্থিত হল গরুর দড়ি হাতে, বলল -- কোন তাড়া নাই। আমি গরু বাড়ি ঢুকিয়ে ফিরে আসছি। সম্বিত ফেরে ওদের। ওর আর ওর লাল গরুর হেঁটে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল ওরা।

    - কেন সব মানুষ আর ফিরে আসতে পারে না দিলু? -

    - তোমার এখনো কষ্ট হচ্ছে।

    - মাঝে মাঝেই মনে আসছে দিলু। ওই মেয়েটার মতোই তো আসলে আমাদের প্রত্যেকের জীবন তাই না? মূল্যহীন। দিলুর মনে হয় শিউলিকে বুকে টেনে আদর করে, বোঝায়, চুপ করে বসে থাকে, কিন্তু কিছুই করে উঠতে পারে না। তার সেই জড়তা, আসলে হয়তো হীনমন্যতা তাকে গ্রাস করে বসে থাকে।

    - আমি কত বক বক করি তোমার সঙ্গে আর তুমি সে সব ফালতু কথাগুলো শোন। আসলে তোমার মধ্যে একটা শিশু আছে। যতদিন সে ছোট থাকবে ততদিন সে আমার ছাই ভস্ম কথাগুলো গিলবে। তারপর সে একদিন বড় হয়ে গেলে আমি কিছু বললেও সে শুনবে না। অবশ্য আমি কি আর থাকব সেদিন?

    দিলুর বলতে ইচ্ছে করল -- কেন শিউলি থাকবে না। কেন শুনবে না সে শিউলির কথা। শুনবে শুনবে। কিন্তু যথারীতি বলতে পারল না কিছুই। সে তাকিয়ে থাকল শিউলির মুখের দিকে। তার পাশে বসে আছে শিউলি কতক্ষণ ধরে। তার নিঃশ্বাসের সুগন্ধ খেয়াল করলে পাওয়া যাচ্ছে। কি সুন্দর নাক, ঠোঁট, চোখের পাতা। সরোবরের মতো গভীর চোখ। যার দিকে আগে সে তাকিয়ে থাকতে পারত না। কিন্তু আজ যেন সেই চোখে তাকিয়ে থাকতে তার কোন অসুবিধে হচ্ছে না। সে তাই তাকিয়েই থাকে। দেখে চিবুক, গ্রীবা ও কানের লতি, ওপর থেকে নেমে আসা চুলের ঢল। পাতলা ঘাড়ের ঢাল বেয়ে হালকা সবুজ রোমের দল নেমে এসেছে। যেন কচি ঘাসের দল। মসৃণ হাত, ভরাট স্তন, পাতলা কোমর। সর্বত্র ঘন হয়ে আছে সৌন্দর্য। সে সৌন্দর্য অপ্রতিরোধ্য। তাকে অস্বীকার করার ক্ষমতা দিলুর কখনই ছিল না। সে শুধু পালিয়ে বেড়াত সেখান থেকে। আজ পালানোর প্রয়োজন মনে হচ্ছে না। আজ বহুদিন বাদে মনে হচ্ছে সে অসীম ক্ষমতার অধিকারী। মনে হচ্ছে সে যে কাজে নামবে সে কাজ সে উদ্ধার করতে পারবে। সে এই বাধা, এই শেকল, এই জীবনের ভাঙাগড়াকে দুহাতে সামলাতে পারবে। শিউলিকে খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে, আদর করতে ইচ্ছে করছে। রোদ এখন নরম, সে গাছের পাতার মধ্যে দিয়ে সরু ফালির মতো পড়েছে শিউলির বাম গালে। সেই রোদও যেন আদর করছে এই মেয়েকে। তাকেও কি হিংসে হচ্ছে দিলুর। হচ্ছে। সে যদি তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয় তাহলে হচ্ছে।

    #

    চায়ের দোকানে যথারীতি পবন তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সেই খুন নিয়ে বাজার এখনও সরগরম। সবাই জানতে চায় কেন খুন হয়েছে। লোকাল চ্যানেল খবর করেছে। আবার বেশ উত্তাল হয়েছে দরিয়াপুরের চায়ের ঠেক। হারু এসে কোন সকালে বসে আছে। সে কোনদিনই কথা বলে না। আজ খবর পড়া তেমন জমছে না। খবর না পড়লে চুপ করে থাকে। যেন রেডিও। সুইচ অফ করা আছে। কত জায়গা থেকে কত লোক এসে বাস করে দরিয়াপুরে, কে কোন মতলবে এসেছে সে কি বোঝা যায়। এ অপরাধী বার করা কি সহজ কথা।

    - আরে বললাম না পুলিশ চাইলে সব পারে। কিন্তু যদি না চায় তাহলে কিছু হবে না।

    - চা লাগাও নিতাই কাকা, আরও এক রাউন্ড। সত্যদা চা খাবে নাকি?

    - না, এই খেলাম বাড়িতে। সত্য দোকান খোলার প্রাথমিক কাজে ব্যস্ত। সে এখনো শোনেনি কিছুই। তার সঙ্গে আরেক দফা কথা বার্তা শুরু হল ওই একই বিষয়ে।

    - ওই মেয়েটার পরিচয়তো কেউ কিছুই জানে না।

    - ওসব খারাপ মেয়ে। নইলে এতদিনে জানা যেত। খারাপ মেয়ের কোন খবর নেওয়ার লোক থাকে না, তাই খবরও বেরোয় না।

    - শুধু খারাপ মেয়ে রেপ হয়? এই বলছিস তুই? নির্ভয়া মেয়েটা খারাপ মেয়ে ছিল?

    - রাতে ঘোরার কি দরকার ছিল? ভদ্র ঘরের মেয়েরা রাতে বেরোয় না।

    - হদ্দ মূর্খই থাইক্যা গেলি। কলকাতা থেকে কাম--কাজ কইরা রাতের বেলায় কত মাইয়া বাড়ি ফেরে? তারা কি করব? কই যাইবো?

    - দরকার কি বাইরে যাবার?

    - ওরে সুপুত্তুর তুই তো সেই মোগল আমলের লোকের মতো কথা কস দেখি। দরিয়াপুর শহরে ছেলে আর মেয়ের মধ্যে তফাৎ দেখস? আশপাশের গ্রাম সাইডে কিসু আসে যদিও এখনো। তার মধ্যেও তো অখনো অনেকেই এসব কিসু পাত্তা দেয় না। একটা দুইটা কইরা বাচ্চা, তফাৎ রাখব ক্যান?

    - ওই মেয়েটা যদি খারাপই হয় তা হলে এই ছেলেটারো খারাপ হওয়ার কথা? তার বেলা? আরেক জন বলে।

    - ছেলে আর মেয়েদের তফাৎ তো আছেই, করলেও আছে, না করলেও আছে।

    - এসব কিছু নয় কাকা জনসংখ্যা বাড়লে মৃত্যু বাড়বে। মার্ডার কেস কোন কেসই নয় আজকাল।

    - সারা ভারতে কটা মার্ডার হয় তার কি কোন ঠিক আছে, কটা কেস ডাইরি হয়?

    - আরে যার ভাইগ্য মরা থাকে তার সারা জীবনই মরা থাকে, সে চাইলেও কোনদিন উইঠা দাঁড়াইতে পারে না।

    - ভাগ্য আবার কি? মানুষ ভাগ্য তৈরি করে।

    - বয়েস হোক সোনা বুজবা ভাইগ্য কী! ওই যে কিসুক্ষন আগে ওই পিপড়াটারে তুই খাম্খা ডইল্লা মারলি ওডার নিজের কি দোষ ছিল ক। এই মেয়েটা কী নিজেই মরনের ভাইগ্য তৈরি করসিলো? করে নাই। করে নাই।


    এই রকম আলোচনা চলতেই থাকল, যতক্ষণ না সামনের মোড়ে অটো আর টোটোর মধ্যে একটা ছোটো ঝগড়া আস্তে আস্তে বাড়তে বাড়তে ধুন্ধুমার আকার নিল। সব্বাই চলল দল বেঁধে কি হয়েছে দেখতে। আলাদা কিছুই ঘটবে না জানা ছিল। ঘটেওনি। এক অটোওয়ালা টোটো স্ট্যান্ডের সামনে থেকে লোক তুলেছে। কেন তুলেছে? ওটা টোটোর নেওয়ার কথা, অটোয়ালা বলেছে না যাত্রী নিজে দাঁড় করিয়েছে, এই নিয়ে তর্কাতর্কি। দরিয়াপুরে এখন এত বেশি টোটো যে মনে হয় পৃথিবীতে তিন ভাগ জল, একভাগ স্থল আর ছিয়ানব্বইভাগ টোটো। টাটার ন্যানো পারে নি কিন্তু এই উদ্ভট যন্ত্রশকট বাংলায় অবশ্যই বিপ্লব এনেছে। বেচারি অটোওয়ালা! সে আজ সংখ্যালঘু। তার এই যুদ্ধ জেতার কথা ছিলও না। জিতলও না। খেয়ে গেল চড়--থাপ্পড়। পবনরা এসে থামাল। তারপরে ভবিষ্যতে দেখে নেবার দিব্যি দিতে দিতে বিদায় নিলো অটোওয়ালা।

    #

    চুতিয়া ভাগ্য না হলে পুলিশ হয় মানুষ! কে কোথায় মরবে, কে কোথায় হাগবে সব পুলিশের দেখার কথা। যেন পুলিশ বললে তবে হাগবে। যদি নড়ে হাগে তো তা ধরার জন্য দেড় টাকার বালের সাংবাদিকগুলো হাজির। খানকির ছেলেগুলো বাপ মায়ের শোবার ঘরেও মোবাইল নিয়ে বসে থাকে খবর করবে বলে। খবর করছে! চুদির ভাইগুলো খবর করে দেশ উদ্ধার করছে। পুলিশ কি করবে রে বাল। সকলের পোঁদে পোঁদে বন্দুক নিয়ে ঘুরবে! একশ কোটি লোকের পোঁদে একশ কোটি পুলিশ। কে মরল, কেন মরল, কেন পুলিশ থাকে না, কেন এত অসামাজিক হচ্ছে আমাদের শান্ত এলাকা। সব্বাইকে জবাব দাও। এক্কেবারে ভিডিও করে পাঠিয়ে দিচ্ছে খবরের চ্যানেলে। পুলিশ পৌঁছনোর আগেই! আরে বাবা পুলিশকে বল আগে। খুন ছিল না পৃথিবীতে? রেপ ছিল না? বাঞ্চোৎ যেটা ছিল না সেটা ওই মোবাইল ফোন। শালা একটা ফোন থাকলে বোমা তৈরি থেকে চোদন রহস্য সব শেখা হয়ে যায়। আর পুলিশের নাকি সব দোষ। এই যুগে পুলিশের পক্ষে পাল্লা দেওয়া সম্ভব? একটা খবর ভিডিও দিয়ে বাতাসে ছেড়ে দাও ব্যাস, ফোনের পর ফোন। শেষ ফোনটা ভানু সাহার অসহ্য লাগল। যেমন মাঝে মাঝেই লাগে। এস পি সাহেবের ফোন। রীতিমতো ধমক দিচ্ছিল অর্ধেক বয়েসের ছেলেটা। সবে তিন দিন হল ট্রান্সফার হয়ে এসেছে সে। তবুও পুরনো কেস নিয়ে ধমক খেল। ভাগ্য। আর বাকী ক'টা বছর দরিয়াপুরে কোনরকমে শান্তি মতো কাটিয়ে দেবে ভেবেছিল। সে বুঝি আর হল না। ডিউটি অফিসারকে ফোন করল ভানু সাহা।

    - ক্যানালের খুনের রিপোর্ট কতদূর? -

    - আমি জানি না স্যার। -

    - কে জানে? -

    - দাস দেখছিল স্যার। ওর কাছে জানুন। -

    - এক্ষুনি রিপোর্ট করতে বল। -

    নাদা ভুঁড়ি নিয়ে বিপ্লব দাস বলে লোকটা এলো।

    - স্যার বলুন কী হল?

    - আপনার কী মনে হয়? কী হতে পারে?

    - এখনো ধরা পড়ে নি কিন্তু চেষ্টা চলছে। কিন্তু পড়ে কি লাভ স্যার?

    - মানে?

    - মানে স্যর, কিন্তু মোটিভ স্পষ্ট নয়। আমার অন্য কথা মনে হচ্ছে স্যার।

    - কি কথা মনে হচ্ছে বলেই ফেলুন।

    - অনেক দূরের খেলার জন্য।

    - সে দিয়ে আমরা কি করব? মার্ডারার খুঁজে বার করতে হবে। যে করেই হোক।

    - সময় লাগছে স্যার, আশপাশের খুচরো যেকোনো একটাকে তুলে পুড়ে দিলেই আপাতত থিতিয়ে যাবে সব।

    - তারপর?

    - তারপর আর কি! এ যাত্রা তো চাপ সামলে দেওয়া গেল।

    ভানু সাহা ভাবে। খারাপ বলেনি, এমন তো কত করতেই হয়। ভলান্টিয়ারও পাওয়া যায় এ বিষয়ে। জেলে আরামেই থাকে। চার্জশিট পরে হবে। ভানু দাসের শুকনো মাথাটা তেতে ছিল। আস্তে আস্তে ঠান্ডা হতে শুরু করল। সে এতক্ষণ উত্তেজনায় দাঁড়িয়েই ছিল নিজের ঘরে। লম্বাটে গড়ন। কেমন চিমসন গোছের। রোগা নয়। হাড়ে মাসে আবলুশ কাঠ। কাঁচা চুলই বেশী, তাই বয়েস বোঝা যায় না। গায়ের ইউনিফর্ম চেহারার গড়নের জন্যই হোক আর বানানোর জন্যেই হোক কেমন যেন ফিট করে না, কোন কালেই করে না। মনে হয় ভাড়া করা। চোখটা খানিক লাল হয়ে থাকে, ছোটবেলা থেকেই। গেঁজেলদের যেমন থাকে তেমন ঘোলাটে নয়, পরিষ্কার লালচে। সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বার করতে করতে ভানু সাহা গিয়ে বসল চেয়ারে।


    - বসুন। বিপ্লব বসে। মাঝ বয়েসি লোক, বড় চেহারা, মাথায় টাক, বড় চোখ আর বড় গোঁফ। তাকিয়ে থাকে ভানুর দিকে। আগ্রহ নিয়ে। নাম বা চেহারার সঙ্গে অবশ্য বিপ্লবের চরিত্রের কোন সাযুজ্য নেই। কাজ জানা লোক। তবে বেশি কথা বলে। তার কথাটায় বড়বাবু আমল দিচ্ছেন কতটা তার জন্য তাকিয়ে থাকে। তারপর খানিক বাদে আবার বলতে থাকে -- মনে হচ্ছে হাওয়া তৈরির কেস। পেটি কেস নয়। জিইয়ে রাখবে। ভোট এলেই উজাড় করে আন্দোলন হবে। তাই স্যার ইনভেস্টিগেশন করলে যা বেরোবে তাতে শেল্টারের লোক বেড়িয়ে যাবে। তখন কেস উল্টে পুলিশ খাবে। তবে একটা কথা।

    - কি কথা?

    - হাওয়া তৈরি যদি হয় তাহলে হাওয়া বোঝার কেসটাও তো আমাদের দেখতে হয় স্যর।

    পেছনে গান্ধীজীর ছবি হাসছে। তার নিচে বড়সাহেবের মুখটা গম্ভীর। আর অধীর আগ্রহে সেই দিকে তাকিয়ে বিপ্লব দাস। ভানু ভাবছে কতটা প্যাঁচে পড়তে পারে কেস খারাপ দিকে গেলে বা সামনের ভোঁদড়টাই ভানুকে ফাঁসাবে কি না। রিপর্টে নোট ওই মালটাকে দিয়ে লেখাবে। তাহলে জুড়ে থাকবে। সে নিজে ফাঁসবে কতোটা সে পরে দেখা যাবে। কিন্তু এস পি সাহবের হুকুমে আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে কিছু করতে হলে এমনই করতে হবে। তাই একটু ভেবে ভানু সাহা বলল

    - আদিবাসী আর মাইনরিটি বাদ দিয়ে দরকার হলে তেমনই করতে হবে। আপনি প্রাইমারি রিপোর্ট দেবেন।

    - দিয়ে দেব যদি দিতেই হয়।

    লোকটা এক কথাতেই রাজী হয়ে গেল। ঠিকই আছে। পিঠ তো ভানু সাহার একার নয় সকলেরই আছে। কোনরকমে সার্ভিসটা শেষ করতে হবে। শেষ অব্দি এ জীবন যাবে কি না এখন ভাবছে কয়েকদিন হল। এমনই এই ভাবনা পুলিশের থাকে। মাঝে ভয়টা তবু কম ছিল, এখন আবার বাড়ছে ক্রমে বেড়ে চলেছে। সব শালা মোবাইল -- বলতে বলতে একটা ফোন।

    - হ্যালো। ওপার থেকে তীক্ষ্ণ মহিলা কণ্ঠের স্বর মোবাইলের পর্দা ফাটিয়ে বেড়িয়ে আসছে ঘরের উল্টো দিকে, ভানু সাহা কানে একটু কম শোনেন বলে কল ভলুম বাড়ানো আছে, বোঝা যাচ্ছে মহিলা রিপোর্টার।

    - আমরা ইনভেস্টিগেশন করছি, এর বেশি এই মুহূর্তে কিছু বলতে পারব না। ফোন কেটে দিয়ে সামনে কাঠের বোর্ডটার দিকে তাকিয়ে থাকল ভানু সাহা। সেখানে এই থানার অফিসার ইন চার্জদের নামের লিস্ট। চোখ গেল ঠিক সেখানে, যেখানে নিজের নাম আর জয়েনিং ডেটটা সদ্য লেখা হয়েছে। আর ছেড়ে যাওয়ার ডেটটায় আছে একটা ড্যাশ।

    - মাগির গলা কলপাড়ের মেয়েছেলেকেও হার মানায়। দাস, প্যারালাল ইনভেস্টিগেশন চালু রাখতে হবে, সব ঠিকঠাক খবর চাই। সেটাও রেডি রাখতে হবে।

    - জানি স্যার, সে আর বলতে। আমি আছি। জেনে রাখতে তো কোন ক্ষতি নেই, কখন কি কাজে লাগে স্যার। তবে স্যর একটা কথা। এখানে প্রচুর খোঁচর, সর্ষের মধ্যে ভুত যেমন থাকে আর কি, আপনি তো সবই বোঝেন। তাই আমি কি করছি কেউ যেন না জানে। বাকিটা আমি দেখে নেব।

    ১৭

    বেশ অনেক দিন বাদে শিউলি আর দিলু বাইরে। গতবার নদীতে ঘুরতে গিয়ে এমন একটা জায়গায় রাত কাটাবে বলে আব্দার করেছিল শিউলি। সন্ধ্যে নামছে, দল বেঁধে পাখির দল চলেছে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। ওদের কারো বাড়ি এপারে আর কারো বাড়ি ওপারে। মাঝ আকাশে উল্টো মুখো দলগুলো কি কথা বলে জানা নেই, তবে কথা বলে নিঃসন্দেহে। হয়তো পারিবারিক বা হয়তো কেজো। যেমন কোন দিকে খাবার আছে বা শীতের পাখিদের জন্য ওদের নিজেদের কতটা চাপে পড়ে যেতে হবে হয়তো এসব। একটা দুটো ছোট্ট নৌকো নিয়ে মাছ ধরা চলছে এখনো। নদীর ওপরে টানা জাল পাতা। এমন জাল পাতা বৈধ কিনা জানা নেই। ছোট্ট পানসি নৌকোর মাঝি সেই জালের পেছনে আরও অস্পষ্ট। ফড়িংগুলো ঘুরে বেরাচ্ছে এদিক ওদিক, সঙ্গে আরও কত অচেনা পোকা। কিছু জন্মায় জলে। তারা থাকেও জলের ধারের মাটির ভেতর, আটকে পড়া কচুরি পানার ফাঁকে। আর কিছু জন্মায় দুই ধার বরাবর গাছে, বট, ঘাস, কলার জঙ্গলে। এই সময়টা চঞ্চল হয় সবাই। দুনিয়ার সব জীবজন্তুই চঞ্চল হয় সন্ধে নামার আগে। সকালেও হয়। তবে বিকেলের মতো নয়। সকালে রোদ্দুর মনের বিচরণকে করে এক মাত্রিক। বিকেলের মন হয়ে ওঠে যেন খানিক অস্থির। দিন রাতের সন্ধিক্ষণে, মানুষও যেমন ঘরে থাকে না। দলবেঁধে গল্প করে, খেলে বা নিদেন পক্ষে একা একা হাঁটে রাস্তায়, মাঠে ঘাটে। এরাও যেন তেমনই। তবে সব কিছুরই দুটো একটা ব্যতিক্রম আছে। যেমন এই মুহূর্তে একটা সাদাকালো মাছরাঙা বসে আছে একদম জলের ধারে বট গাছটার নুয়ে পড়া ডালের ওপরে। আর মাঝে মাঝেই উড়ে যাচ্ছে মাঝ আকাশে, ভেসে থাকছে এক জায়গায় হেলিকপ্টারের মতো, তারপর হয় হঠাৎ করেই নীচে। সে ধরছে জলের পোকা বা ছোটো মাছ। ছোঁ মেরে এগিয়ে যাচ্ছে একেবারে লম্বালম্বি। এই একমাত্র কাজ এই একা পাখিটার। মহা উৎসাহে একই কাজ বারবার করে চলেছে। শিশু যেমন একই খেলা খেলে যায় ক্লান্তিহীন ঠিক তেমন। একা একা নিজের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, আগের বারের ভুলগুলোকে শুধরে নিচ্ছে পরের বার। আর অনেকক্ষণ এমন চলার পর আবার নুয়ে পড়া ডালে এসে বসছে। দিলু আর শিউলি নদীর কিনারা বরাবর হাঁটতে হাঁটতে কিছুক্ষণ আগেও ওই পাখিটা কেন একা সে বিষয়েও কথা বলেছে। সব পাখি তো আর দলে থাকে না। আর যে সব পাখিরা দলহীন ভাবে থাকে তাদের ভাগ্যেও হয়তো সঙ্গী জোটে না সব সময়ে। মাছরাঙা একাই হয়। মাছরাঙা নাকি অনেক ধরনের হয়। সাদা বুক মাছরাঙা, ছোটো মাছরাঙা, কালো টুপি মাছরাঙা, আর এমন সাদা কালো ডোরা মাছরাঙা। এমন ভাবে আকাশে একজায়গায় সব পাখি ভেসে থাকতে পারে না। সাদা কালো মাছরাঙা পারে। কিংফিশার বা মাছ--রাঙা দুইই, দুটো নামের মধ্যেই জমাট দৃশ্যরূপ রয়েছে। আহা, কি চমৎকার নাম দুটো। নাম দিয়েই কখনো কখনো কেউ যেন পূর্ণতা পায়। এমন নাম কবি না হলে দেওয়া যায় না। এভাবেই কি প্রকৃতির সৃষ্টিকে মানুষ ভালবেসে অমরত্ব দেয়? মানুষই তো অমরত্ব দেয়, কারণ এই সব নিয়ে প্রকৃতির ভাবতে বয়ে গেছে। কিন্তু প্রকৃতিও মনে হয় এমন ভালোবাসায় আনন্দ পায়, প্রকাশে নয়, অনুভবে সেও হয়তো ভরে ওঠে। অস্তরাগের মায়া নিয়ে এই সময় এখন যেমন পূর্ণ হয়ে আছে, আনন্দে। এক ফালি চাঁদ সন্ধ্যে হওয়ার আগে থেকেই আকাশে উঠে বসে আছে। ছোটোবেলায় দিলু কোনদিন এই সময়ের চাঁদের দিকে ফিরে তাকাত না। মরা চাঁদ দেখলে নাকি মা মরে যায়। বহুদিন সে ভয়ের কারণ মিটে গেছে, তার মুখে সে কথা মনে করে মৃদু হাসি। এখন সে চাঁদকে দুচোখ ভরে দেখছে। আর ভাবছে কাস্তের মতো চাঁদের গায়ে কোন কলঙ্ক থাকে না। পূর্ণিমার চাঁদে থাকে। সেই কলঙ্ক থেকেই তৈরি হয় মুখের আদল। যে মুখে লেগে থাকে মায়া।

    -- কি ভাবো? বলেই শিউলি ভাবে এই এক তার বাজে অভ্যেস। সে নিজে যা ভাবে সে কি সে বলতে পারে নাকি বলার মতো হয় সব ভাবনা? তবুও দিলুকে তার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে মাঝেমাঝেই। আর আজকের মতো সময়ে তো আরও বেশি ইচ্ছে করে। দিলুর কাছে এসব জানতে চাইলে দোষ কোথায়। দিলু আজকাল অবশ্য এ কথা শুনে হাসে। সে হাসি নির্মল, দ্ব্যর্থকতাহীন, খানিকটা প্রশ্রয় মেশানো। দিলু ডান হাত দিয়ে শিউলির চুলে আটকে থাকা একটা শুকনো পাতাকে তুলে সরিয়ে দেয়। সেই ফাঁকে দেখে নেয় অবিন্যস্ত চুলের কপাল ছুঁয়ে থাকা, সেই কপালে হালকা স্বেদবিন্দুর পেলব পরশ। যেন এও সযত্ন চর্চিত আভরণ। চিবুকের কাছে ছোট্ট তিল তার দুই চোখের সঙ্গে যেন এক ত্রিভুজ রচনা করেছে। সেই তিল যেন সেই সাম্যবিন্দু যা প্রকৃতি নিজের হাতে শেষ মুহূর্তে তুলি ছুঁইয়ে এই সৃষ্টিকে করেছেন অপ্রতিরোধ্যভাবে সুন্দর। ওরা দাঁড়িয়ে আছে দোতলার ঘরটার লাগোয়া ব্যালকনিতে। আশ পাশ থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ পাওয়া যায় না। সন্ধ্যে ঘোর হয়ে এসেছে কখন। কোন আলোর রেশ নেই আকাশে। সেই অসময়ের চাঁদও নেই। ওদের আজকের ঘর অন্ধকার। আলো জ্বালায়নি ওরা। তবু যে আলো উদ্ভাসিত ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে পড়েছে সে আলো কতোগুলো দল বেঁধে চড়ে বেড়ানো জোনাকির। জোনাকি এবং তারা আসলে দুজনে মিলেই রচনা করে ছায়াপথ। সে কথা আমাদের জানা নেই। এই জানা না থাকাটাই তো সৌন্দর্য। যা অনুচ্চারিত সেই তো সৌন্দর্যের দীপ্তি। যেমন এই নারী, সে সুন্দর কারণ সে আমাদের কাছে অজা না। সে দুহাতের মধ্যে অথচ সে অধরা। তার ছবি আঁকা যায় সহস্রবার, সময় থেকে সময়ান্তরে। কিন্তু তবু সে অচে না। আমরা এখন যদিও সে কথা ভাবব না। না ভেবেই শুধু দেখতে থাকব কি ঘটতে থাকে। যদিও এইটা আমাদের জানা যে এই ঘটনা প্রবাহে আদপে কোন রহস্য নেই। কোন রকম রহস্য ছাড়াও জীবনের মধ্যে এক তৃপ্তি আছে। সে তৃপ্তি লাভ পরিশ্রম সাধ্য। তাই দুর্লভ। যেহেতু পাঠকের নিজস্ব যাপনের সংগ্রামের মতোই সে রহস্যহীন। তাই সে আপাত আকর্ষণহীন। কিন্তু ধ্রুব।

    যাই হোক এই ভাবেই অনেক না ঘটনার মধ্যে দিয়েই আরও কিছু সময় পার হয়ে যায় সময়ের নিজের নিয়মে। শিউলি এখন মোমের আলো জ্বালিয়েছে আজ তার ঘরে, মানে এই হোটেলের ঘরে। এখানে তেমন কোন টুরিস্ট আসে না, টুরিস্ট স্পট হিসেবে তুলে ধরা হয়নি তেমন করে এই প্রাইভেট হোটেলকে, মালিক হয়তো তেমন কেউকেটা নয় বা এমনও হতে পারে আগ্রহও নেই তেমন। এক দলের হাতে এত পয়সা আসছে তারা কোথায় সে টাকা রাখবে সেটাই খুঁজে পায় না। তাই বাড়তে থাকে ক্রমাগত তাদের বিনিয়োগের ক্ষেত্র। বাড়তে থাকে একের পর এক সম্পত্তি। এই হোটেলটা বাড়ির মতো। কারো খানিক পুরনো বাড়িকে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে ভাড়া দিচ্ছে। বড় জমি। একদম নদীর পাড় সমেত জায়গা নিয়ে বাড়িটা। কোণায় একটা পুরনো কুয়ো, গঙ্গার কাছের বাড়িতে কুয়ো কি করত কে জানে। তবে সর্বত্রই একটা বাড়ি বাড়ি ব্যাপার আছে। হয়তো মালিক এটাকে ব্যাবহার করতে চাইছে এভাবে। বা হয়তো বদলে যাবে কিছুদিন বাদে। সব মিলে এক আপন ভাব আছে। সেই বাড়ি আর হোটেলের মাঝামাঝি এমনই এক ঘরে তারা যেন খুঁজে পায় নিজেদের, একান্তে। যাই হোক এই লেখার যেখানে আমরা ছিলাম -- মোমের আলো আর এই জোনাকির আলোর মধ্যে এক অদ্ভুত সখ্য আছে। দুজনেই যেন বাচ্চা মেয়ে, পা ছড়িয়ে গল্প করে একসঙ্গে বসে। কি তাদের আলোচনার বিষয় সে কেউ জানে না। কিন্তু তাদের হাসি আর গুনগুন গানের শব্দে তৈরি হয় এক আবহ যা ছড়ায় স্নিগ্ধতা। সেই স্নিগ্ধতার পরশ নিতে নিতে এক গুটিয়ে থাকা মানুষ আস্তে আস্তে মেলতে থাকে নিজেকে। এক অবলম্বনকে জড়িয়ে। যাকে অবলম্বন করতে চায় সেও আসলে চায় তার এই জড়িয়ে থাকা। সেই 'কি ভাবো’ এই কথার উত্তর আসলে রচনা করে চলেছে দিলু একা নয়, এই স্নিগ্ধ আলো আর শিউলি নিজেও। দিলুর গা ঘেঁষে বসে থাকে শিউলি। শিউলির গায়ের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে আর পাওয়া যাচ্ছে মোমের গন্ধ। দিলুর গায়ের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে কি না তা পরিষ্কার নয়, কিন্তু শিউলি নিশ্চয়ই পাচ্ছে কারণ সে এখন মুখ গুঁজে দিয়েছে দিলুর বুকে। দিলু তাকে জড়িয়ে রেখেছে বুকের মাঝে দুই হাত দিয়ে। দিলু অনুভব করছে শিউলির বুকের ওম আর শিউলি শুনতে পাচ্ছে দিলুর ভেতরে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। সে শব্দে বোঝা যায় জোয়ার এসেছে। সামনের নদীতেও এখন জোয়ার। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে অন্ধকারেও অনেক কিছু দৃশ্যমান হয়। এক্কেবারে নদীর ধার ঘেঁষে যে ডালটায় বসে ছিল মাছরাঙাটা, সেই ডালটার খুব কাছে চলে এসেছে নদীর জল। সেখান দিয়ে চলে গেল এক নৌকো। খোলে তার আলো জ্বালানো। আলোটা চার্জার ব্যাটারির। দাঁড় নৌকো নিয়ে এখনো রাত বিরেতে মাছ ধরা চলে তাহলে। ছোটবেলায় পদ্মা নদীর মাঝি পড়েছিল শিউলি। দিলুও পড়েছে এই সবে। সে জীবন এখন নিশ্চয়ই বদলে গেছে অনেক, আবার কিছু হয়তো একই আছে। জলের জীবন সে আর কতটুকু জানে তারা।

    এখন রাত আরও বেড়েছে। ঘরের মধ্যে দিলু দীর্ঘ আলিঙ্গনে জড়িয়ে আছে শিউলিকে। ভালোবাসার আবেশে গাঢ় হয়ে আসছে ওদের শরীর। মন জুড়ে উঠেছে যেন দু কূল ভাসানো ঢেউ। শিউলি নিয়ে আসে নিজেকে আরও কাছে, মিশিয়ে দিতে চায় দিলুর মধ্যে। সেই চেনা সুগন্ধী নিঃশ্বাস অনুভব করে দিলু। এই গন্ধ ঝিম ধরানো নয়। এই গন্ধ শান্তির। আরও বেশি করে সেই গন্ধ পাওয়ার জন্য নিয়ে যায় শিউলির মুখের কাছে নিজের মুখ। শিউলি আলতো করে ঠোঁট রাখে দিলুর ঠোঁটে। ভেজা সে ঠোঁট শীতল, পাতলা, কি অদ্ভুত মোলায়েম আর হালকা। কাঁপছে যেন ছোটো ভিজে সবুজ পাতা। সেই কম্পন ছড়িয়ে পড়ল দিলুর শরীরে। চোখ বুজে এল সেই আবেশে। কতক্ষণ সে কারোর জানা নেই। চোখ মেলে দেখল কি এক অদ্ভুত সুন্দর শরীর তার সামনে। সে শরীরে নদীর ঢেউয়ের মতো রেখা, যে ঢেউয়ে ভাসিয়ে দিতে হয় সব কিছু। সে শরীর আবেগে নরম, আহ্বানে উষ্ণ, তাড়নাহীন কামনায় মোহময়। এর নাম কি সমর্পণ না অধিগ্রহণ, দিলু ভাবতে চেষ্টা করল, দিলু বুঝতে চেষ্টা করল তুলির এক টানে এই অবয়ব সৃষ্টি করা যায় কিনা, কিন্তু পারল না। আসলে দিলু হারিয়ে যেতে থাকল ধীরে ধীরে ওই রেখাগুলো বা ঢেউগুলোর মধ্যে। ঢেউগুলো কিভাবে যেন পাখির বাসা হয়ে গেল। তৈরি করল দুই স্তন। তৈরি করল পর্বত, গুহা, দিগন্ত বিস্তৃত উপত্যকা। আর সেই মহাব্যাপ্তির মাঝখানে দিলু যেন পাগলের মতো খুঁজতে থাকলো নিজেকে, ঘ্রাণে, স্পর্শে, দর্শনে, স্বাদে এবং শ্রবণে। সেই বিস্তৃতিও ঘিরে ফেলল দিলুকে। ঘিরে থাকা আর ঘিরে রাখার দ্বন্দ্ব থেকে বেড়িয়ে আসতে থাকল তৃপ্তি আর অতৃপ্তি, দুইই। সেই যে ছোঁয়া যায় অথচ যায়না -- সেই অনুভূতিই তো মানব শরীরকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। ঠিক যেন দুই মুখোমুখি ঢেউয়ের মতো। কে ওপরে কে নীচে, কে বেশি শক্তিশালী বা কে কাকে ভাসিয়ে নিচ্ছে এসব কিছুর হিসেব নিকেশ ছাড়াই ঢুকে পড়ে এ ওর ভেতরে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয় তাদের -- কই আমি তো নেই কোথাও। ভাবতে ভাবতেই অনুভব করে নিজের ভেতরে অন্যকে। তখন আরও অস্থিরতা আরও চাওয়া, আরও চাওয়া। এখন সেই চাওয়ার মধুর গল্প রচনা করছে এই দুজন। আর তার আবহ? কেন সেই ছায়াপথের আলো? আবহকে তো কখনোই উচ্চকিত হতে নেই। এই মুহূর্তের গল্পের আবহও তাই উচ্চকিত নয়। মোমের আলো, সে যখন নিভু নিভু তখন পথ চিনে ঢুকে পড়েছিল দুটি জোনাকি। প্রথমে সারা ঘর জুড়ে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে তারা তৈরি করছিল মহাকাশ। সেই মহাকাশ যা দিগন্ত নির্দিষ্ট করে, ব্যাপ্তিকে নির্দিষ্ট করে, অসীমকে নির্দিষ্ট করে। কারণ বিস্তৃতিরও এক কোল থাকতে হয়। তো সেই বিস্তৃতি যখন এই ঘরে রচিত হচ্ছে তখন সেই মহাকাশ তাকে আগলে রাখে। আর যে সত্যি করেই আগলে রাখে সে দৃশ্যত অনুভূতির অতীত। তাই আমরা এখন কোন নীল ছায়াপথ নয়, কোন মহাকাশ নয়, কোন আবহ নয়, কোন বিস্তৃতিও নয় আমরা দেখতে পাচ্ছি ভালোবাসা। যদি বলি এ ভালোবাসা শরীরের? তবে নিশ্চয়ই শরীরের। কারণ শক্তির আধার শরীর, যেমন বিস্তৃতির আধার মহাকাশ। যে শরীরকে দেখতে পাচ্ছি এখন তা অবশ্য পূর্ণ শরীর। সে এখন নারী নয় বা পুরুষও নয়। সে পূর্ণতা। সেই পূর্ণতা যা খুব সংক্ষিপ্ত এবং অতীব বিরল। একাধারে দৃশ্য এবং বিমূর্ত। তাই সেখানে পাপ আর পুণ্য খোঁজার কাজ হাস্যকর ছাড়া আর কিছু না। পূর্ণতা? সে তো অবয়বহীনতার মাঝে হারিয়ে যাওয়াতেই। ওই যে মোমবাতি, সেও তো আদতে অবয়বহীন হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। সে আসলে অবয়বহীন হতে হতে একটা গানও গাইছিল, যে গান এখন জোনাকি দুটো গাইছে বন্ধ ফ্যানের ব্লেডে বসে। ভালোবাসার গান। তারা বলছে একে অপরকে --

    ভালোবাস নদীর ও ঢেউ
    যেমন করে বাসবে না কেউ
    আর কখনই।
    আমি যদি ডুবেই বাঁচি
    যদি আমি তেমন মাঝি
    নাই যদি হই।
    - তোমার জন্মদিন কবে? দিলু জিজ্ঞেস করে।

    -- কেন আজ? দিলু সে কথার মানে বোঝে আর মৃদু হেসে শিউলির কানের কাছে বলে -- হ্যাপি বার্থ ডে। শিউলিও উত্তরে দিলুর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে -- তোমারও আজ জন্মদিন যে। আদর তোমায় বার্থ ডে বয়। বলে নিজের বুকে টেনে নেয় দিলুর মুখ। দিলু মুখ রাখে স্তনে। মিলনোত্তর স্ফীতি নিয়ে সে স্তন এখন আরও নরম, মায়াময়। সে স্তনের গন্ধ এখন বদলে গেছে। দিলু মুখ ঘষে বোঝার চেষ্টা করে এমন গন্ধ সে যেন কোথায় আগে পেয়েছে। মায়ের গায়ের গন্ধ মতো যেন। তা কি করে হবে। এমন হয় নাকি? সে তো পাপ চিন্তা, নাকি নয়। কিন্তু মনে হলে কি করবে সে। সে তো কখনো আগে এ কথা ভাবেনি। এখন ঘর অন্ধকার, কত রাত কেউ জানে না। জোনাকিরা এখন তারা হয়ে জেগে আছে বাইরে। সারা শরীরে সুখের পরশ মেখে এখন জেগে আছে তারাও, ঠিক জেগে থাকা নয়। তৃপ্তির ক্লান্তি নিয়ে আধো ঘুমে বা আধো জাগরণে বলা যায়। ফিসফিস করে কথা বলে যায় দীর্ঘ উচ্চারণে, একে অপরে, খুব ধীরে। দিলুর মনে জড়তা কাজ করে নি আজ সারাদিন, সেই জড়তা কি ফিরে আসছে আবার? না তো! তাহলে এই বদলে যাওয়া গন্ধটা সে কেন পেল। নাই যদি পেয়ে থাকে তাহলে মাথায় বা এলো কেন? এ কি আবার নতুন কোন অপরাধ বোধের জন্ম হোল? সে কেন এই মেয়েকে বারবার গুলিয়ে ফেলে আরও অন্য কারোরও সঙ্গে। মেয়েগুলো কেন মাঝে মাঝে একইরকম হয়ে যায়। সে কি ওর নিজের মনের গলদ। কিন্তু এই নারীকে তার সর্বক্ষণ চাই, সে বেশ বুঝতে পারছে। অসম্ভব কে সম্ভব করতে পারে তার জীবনে এই নারীর উপস্থিতি। দিলুর প্রয়োজন তাকে কিন্তু এই মেয়ের কি ওকে দরকার?

    - আমাকে তোমার কাছে রাখবে?

    - আমি তোমায় কোথায় রাখব?

    - তোমার কাছে।

    - আমি কে তুমি জান না?

    - আমি কে সেও কি তুমি জান না?

    - তুমি একটা খুব খুব খুব ভালো মানুষ।

    - তুমিও তো একটা খুব খুব খুব ভালো মানুষ, তাহলে রাখবে না কেন?

    - আমি ভালো মানুষ? কিন্তু ভালো মেয়ে যে নই।

    - কে বলেছে তোমায় এ কথা? কার এত সাহস?

    - বলতে হয়?

    - কে বলবে? কি বলবে? তুমি আমাকে তোমার কাছে থাকতে দাও।

    - তুমি যে কষ্ট পাবে।

    - কেন কষ্ট পাবো? তোমাকে ছাড়া যে আমি কষ্ট পাই।

    - কিন্তু আমার কাছে তুমি যদি ভালো না থাক?

    - সে কথা এখন ভাবব কেন? আর তেমন হবেই বা কেন?

    - দূরের কথা যে ভাবতে পারে সেই তো দূরদর্শী। সে কথা তোমায় ভাবতে হবে না?

    দিলু চুপ করে থাকে। কি দেবে এর উত্তর। ওর মতো মানুষের দূরের কথা ভাবা সাজে না উচিত? প্রতিদিনের শেষে রাত এলে ভাবে -- আজকের সব থেকে বড় খবর হল এই দিনটা কেটে গেল। ও কেন ভাববে দূরের কথা। যে দিনটা চলছে সেই দিনের কথা ভেবে বাঁচে দিলু এবং সে জানে এটাই তার ধরন। একে ও বদলাবে না। অন্তত এই কারণে তো নয়ই। আর ও নিজেও জানে শিউলিরও এমনই দশা। মুখে বলছে এমন কিন্তু সেও জানে না কাল তার কি হবে। কিন্তু দিলুকে বলতে হবে। শিউলিকে না বললে বলবে কাকে?

    - শিউলি।

    - উঁ।

    - শুনছো?

    - বল।

    - আমায় তোমার সঙ্গে মানায় না? তুমি আমার সঙ্গে কথা বলে আনন্দ পাও না। তাই এমন বলছ?

    - ঠিক বুঝেছ। শিউলি নাক ঘষে দিলুর বুকে। অন্ধকারে কেউ কারো মুখ স্পষ্ট দেখতে পায় না। কিন্তু সে মুখে কী ফুটে উঠছে তা বেশ বুঝতে পারে। শরীর মনকে চেনায় আর মন শরীরকে। সেই চেনা যত বাড়তে থাকে ততই আলোর কাজ কমতে থাকে।

    - আমি ঠিকই বুঝি।

    - এই যে বাবুর মুখ ফুটেছে দেখছি।

    - তুমি তো নইলে আমায় পাত্তা দেবে না।

    - তাই নাকি?

    -- তাই। কিন্তু তোমাকে পাত্তা দিতেই হবে, আসতেই হবে আমার কাছে। বলতে বলতেই দিলু তার বুকে আবার নতুন করে শিউলিকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। তারপর কপালে চুমু খায়। একহাত রাখে কোমরের ভাঁজে আর এক হাত ওর নরম পিঠে। বুকের মধ্যে অনুভব করে শিউলির বুকের কম্পন। গন্ধ নেয়, সে গন্ধ এখন আবার বদলে গেছে। সে নিঃসরিত হচ্ছে এখন আবার সুন্দরী রমণীর গোপন রহস্যের মতো, অনুভূত অথচ অভেদ্য। আবার সে মোহময়ী। আবার সে অস্পষ্ট। সেই অস্পষ্টতা আবার দিলুকে উত্তেজিত করে আর আবার সে শিউলিকে ভালোবাসতে থাকে উন্মাদের মতো। এবার সে যেন প্রবল পরাক্রমী দক্ষ নাবিক, যে ঢেউকে শাসন করতে জানে, যে সাঁতরে পার হতে পারে প্রবল উজান। শিউলি সেই প্রবল শক্তিকে অনুভব করে প্রতিটি রোমকূপে, প্রত্যেক স্নায়ু সজ্জায়, রক্তপ্রবাহে, শরীরের অণু ও পরমাণুর গভীরে। শিউলি নিজেকে হারায়, সম্পূর্ণ ভাবে হারায়।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ |
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments