এখানে দিন নেই। এখানে রাতও নেই। এখানে আগমন নেই তাই অপেক্ষাও নেই। আলো বা অন্ধকার কোনো কিছুই এখানে আলাদা নয়। প্রয়োজন হয় না। ওই যে দূরের শূন্য যাকে কেউ আকাশ বলে, তার গায়ে জড়িয়ে থাকা ছায়াপথ যেন এক মাধবীলতা। সে জড়িয়ে থাকে তার প্রেমিক বা প্রেমিকার গায়ে নিশ্চিন্ত অবিচ্ছেদ্যতায়। আর তারই পাশে ওই অতলান্ত জলরাশি যা ছুঁয়ে যাচ্ছে ওই মহাশূন্যকে, বার বার, অমোঘ ছন্দে, তাকে কেউ বলেনি তোমাকে এ কাজ করতেই হবে। সে আসে আর যায় নিজের আনন্দে বা খেয়ালে বা কিছুই না বুঝে। শূন্যতা বা পূর্ণতা নিয়ে সে ভাবে না কিছুই, হয়তো। বা এমনও হতে পারে সেই অতল বারিস্থিতি থেকে জলকণাগুলো যখন ধোঁয়া হয়ে উঠে যেতে থাকে এক অদ্ভুত আনন্দে, যাকে হয়তো মুক্তি বলে সবাই, তাকে মনে করেই ভেসে যায় মুহূর্তেরা, সেই অলঙ্ঘ্য ছন্দের তালে তালে। কিন্তু যাকে ছুঁয়ে যেতে যেতে এত কথা সেই পটভূমি সে তো একা আবার বহুধা। আচ্ছা কোথাও কি মনে হচ্ছে তরল অস্তিত্ব ভেসে আছে বিন্দু বিন্দু? বিন্দু বিন্দু করে যেমন হয় ওই মেঘ? ওড়নার মতো ঢেকে রাখে সে ওই পর্বতমালা বা বিন্দু বিন্দু করে পর্বতমালা নিজেই হয়ে ওঠে গগনচুম্বী?
না, এ কোন আচ্ছন্ন অস্তিত্ব নয়। এ কোন সুপ্তি নয় বা এ কোন জাগরণোত্তর সময়ও নয়। এ এক অতন্দ্র সময়হীনতা। আচ্ছা যদি এমন হয়, ঠিক এই অবস্থায়, কি ছিল পেছনে বা কি থাকতে পারে সামনে সেই কথা কেউ তোমায় বলে যায় কানে কানে? তেমন হলে ভালোই হত কিন্তু কথাটা হল -- কে বলত? যদি এই অসীম পটভূমিকেই এ সব তোমায় বলতে বলা হয় তাহলে সে বলবে -- ''আমি তো এসব ভাবিনি কখনো! আমি তো জানিই না আমি কে, কোথায় আছি, কেন আছি বা আদৌ আছি কি না। তাই আমি কী বলব তোমায়? বরং তুমি যদি আমার কানে কানে বলে যাও নিজে কি বুঝছ তাহলে হয়তো আমি আমাকে বুঝে ওঠার একটা চেষ্টা করতে পারি।'' এইসব বলেটলে, তোমার দিকে তাকিয়ে যদি সে খানিক মুচকি হাসে। তখন? যাক গে। সময়ের কথা যখন এসেই পড়েছে, তাহলে প্রশ্ন আসে-- সময় কাকে বলে? সেও কি বিন্দু না কোন বিস্তারিত প্রবাহ? না চক্রের মতো ঘূর্ণায়মান? পুনরাবৃত্তিতে অভ্যস্ত? নাকি সময় শুধুই কল্পনা? তার উত্তরেও হয়তো কেউ কিছু বলবে না। কারণ সত্যি করেই এখানে এসব নিয়ে কেউ ভাবে না।
তাহলে সব শেষে যদি তুমি নিজেই এর উত্তর খোঁজ? কি বললে? খুঁজবে? আচ্ছা বেশ। কাজটা তোমার অসম্ভব নয়। কঠিন। কারণ এই উত্তর তোমাকে খুঁজতে হবে একা। তারপর সেসব তোমাকে বাঁধতে হবে শব্দে বা শব্দহীনতায়। কারণ যা তুমি বুঝলে সেসব কথা মনের মধ্যে পুরে রেখে দিলে হবে না। তোমাকে লিখতেও হবে। তুমি কিন্তু তখন সব কিছু গুছিয়ে লিখো। বুঝতে বুঝতে আর লিখতে লিখতে যদি ক্লান্ত হয়ে যাও তবে তুমি, ওই যে সবুজ আবরণ, সেখানে কিছুক্ষণ থাকতে পারো চিত হয়ে। যদি চাও ঘুমোতে তাহলে ঘুমোতেও পারো। আর যদি তুমি চাও তবে ভেসেও থাকতে পারো এই অগাধ ব্যাপ্তির মাঝে। বিন্দুর মতো। ঢুকে পড়তে পারো অণু-পরমাণুর নিজস্ব কক্ষে। প্রথম দিন ভাসতে শেখার রোমাঞ্চ নিয়ে তোমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করতে পারো সেই শাশ্বত স্পন্দন। কি বলবে তুমি সেই স্পন্দনকে? প্রাণ? বলতে পারো। সে শব্দ শুনতে ভাল। কিন্তু যদি তুমি তাকে বলতে ঝরনা, তাতেও কোন ক্ষতি ছিল না বা যদি বলতে সবুজ পাতা বা ধুলো বা বিদ্যুৎ বা বৃষ্টি, কোনোটাতেই ভুল ছিল না। কারণ কত যুগ ধরে প্রজাপতির দল উড়তে উড়তে বলে গেল সেই একই কথা। বলে গেল-- দেখো পড়ে আছে শয়ে শয়ে খোলস, সেও সত্যি আর আমিও সত্যি। তাই কি লিখবে, কেমন করে লিখবে সে তো তোমার স্বাধীনতা। তুমি যা বলবে শুনবে সবাই। তোমার কথা সত্যি না মিথ্যে? সে সব নিয়ে এখানে ভাবে না কেউ। চিন্তা কোরো না, সবকিছু তুমি নিজেই বুঝে যাবে সময়মতো। তাহলে এমনই কথা রইল। হ্যাঁ, কথা রইল ঠিকই কিন্তু সেও নিঃশর্ত। কারণ ওই যে আগেই বলেছিলাম, এখানে সবাই মুক্ত, তাই তুমিও মুক্ত ও দায়হীন।
রামবাবুর ভাল্লুকের মতো চেহারাটা আস্তে আস্তে বড় হতে হতে এগিয়ে আসছে দিলুর দিকে। খানকির ছেলেটার পেছনে দুজন ঝিটকে সাগরেদ। আরও অন্য মোটামুটি চেহারার দুজন মিলে বেদোকে খামচে ধরে আছে। বেদোটা জলঢোঁড়ার মুখে চিংড়িমাছের মতো পা দুটো শূন্যে তুলে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে আর চিৎকার করছে -- দিলুদা পালা, দিলুদা পালা। সাদা জামা আর সাদা প্যান্টে রামবাবু তখন আরও কুচ্ছিত। অশথ্ গাছটার গোড়ায় এক গামলা থকথকে পিক ফেলে খিস্তি শুরু করল রামবাবু। কোমরের পেছনে হাত দিতে দিতে এগিয়ে আসতে থাকল দিলুর দিকে। কোমরের পেছনে কি আছে সেটা মাইটানা বাচ্চাও জানে। দিলুর বুকে তখন বিরাট বিরাট ধাক্কা, নিজেরই কলজের। কিন্তু যে মালটা রামবাবু বার করতে চাইছে, সেটা বেরচ্ছে না, কিছুতে আটকে গেছে, মনে হয় কোমরে ঘুনসি বাঁধা কারে। মুহূর্ত সুযোগ। দিলু পিছিয়ে না গিয়ে আগুপিছু কিছু না ভেবেই হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ল জন্তুটার দিকে। তারপর চোখ বন্ধ করে সব শক্তি দিয়ে ডান হাতে একটা ঘুষি চালালো রামবাবুর ঠিক বুকের বাঁ-দিকে। হাতটা ডুবে গেল, যেন হাওয়ার মধ্যে ঢুকল। ঠিক সঙ্গে সঙ্গেই পট করে নিম গাছের ডাল ভাঙার মতো একটা শব্দ শোনা গেল।
দিলুর ভাগ্যও বদলে গেল ওই শব্দটা থেকেই। এখন একডাকে দিলুকে সবাই চেনে। শুধু চেনে তাই নয়, ভয় পায়। বদনা-বাঁকা বেদোকেও লোকে মানে। এখন কলবাবুর কাছের লোক ওরা। কলবাবুই ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছিল থানা থেকে। এখন দিলুর বলতে নেই ভাগ্য খুলেছে। ওর নিজেকে বেশ কেউকেটা বলে মনে হয়। কত সম্মান। কত খাতির। নিজের বাপ শালা কোনদিন ভাবতে পেরেছিল ও এমন জায়গায় যাবে। নেভি কাটে সুখ টান দিতে দিতে ভাবে। বেদো গাধাটা বিড়িটা কিছুতেই ছাড়ল না। কেমন হাবাক্যালানের মতো তাকিয়ে দেখছে দিলুর সিগারেট খাওয়া! দিলু আজকাল কম কথা বলে। যদিও কমই বলত, আরও কম বলে। ও জানে দামি লোকেরা বেশি কথা বলে না। আর একটা কারণও আছে, আজকাল ওর ঝুমাকে বেশি মনে পড়ে। ঝুমার বাপকে মনে মনে আরও অনেক খিস্তি করতে করতে সিগারেটের শেষটাকে ছুড়ে ফেলে দেয় দূরে।
--দিলু কি ভাবিস?
--কিছু না।
--আমি জানি।
--কি জানিস?
--এই তুই কি ভাবিস।
--কি ভাবি?
--তোর মায়ের কথা।
--তুই কি কুত্তার গু খাস? এমন বুদ্ধি আসে কি করে মাথায়?
বেদো দমে যায়, আকাশের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে কি নিয়ে এত চিন্তায় থাকে দিলু।
বেদো চার বছরের ছোটোই হবে দিলুর থেকে। মোমবাতির কারখানায় হারুকাকাই নিয়ে এসেছিল নিজেদের গ্রাম থেকে। স্কুলে যায়নি কোনদিন। বাপ মা কেউ ছিল না। দিলুর ছিল। মা যতদিন বেঁচে ছিল স্কুলেও গেছিল। ক্লাস এইটের পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। বাপ আবার বিয়ে করার পর ছমাসের মাথায় একদিন রাতে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল। দুদিন হেঁটে, ট্রেন-বাসে ঘুরতে ঘুরতে এক হকারের সঙ্গে এখানে। মোমবাতির কারখানায় কাজ। তখন দিলু চোদ্দ। বেদো সারাদিন প্যারাফিন গলানোর বিরাট কড়াটার সামনে বসে থাকত। দিলু এক মাস ছিল কড়ার সামনে বসে, তারপর কিছুদিনের মধ্যেই ডাইসে সুতো লাগানো, গলানো প্যারাফিন ঢালা, ডাইসের ভেতর মোম জমে গেলে সুতো কেটে মোমবাতি আলাদা করে বের করে সাজানো, প্যাকেট করা, লেবেল লাগানো, সবটাই শিখে গেছিল। কিন্তু দিলুর এসব ভালো লাগত না। মোমের গন্ধটাকেই ও সহ্য করতে পারত না। পাম্পের ঘরটাতে রাতে বেদো আর ও শুয়ে থাকত। সারাদিন বলদের খাটনির পরেও দিলুর ঘুম আসত না। বেদো কিন্তু ঘুমোত অঘোরে। ও মালটার মোমের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক। মোম গলাতে গলাতে ওর মাথার চুল, চোখের পাতা, ভুরু সবেতেই মোম। বেদো মোমের কাজ সব পারে, কিন্তু বিরাট বড় কড়াটার সামনে বসে মোম গলানোর কাজ করতে সব থেকে ভালোবাসে। বেদো তাই ওখানেই ভালো আছে। কারখানাতেই কাজ করে, তেমনি থাকে খায়। হারুকাকার বয়েস হয়েছে। মালিক তাড়ায়নি, অন্য লোকও নেয়নি, বেদোই চালায়। তাছাড়া এখন মোমবাতির বাজার নেই। ওই যা আছে একটু-আধটু সে সব উৎসব-পরবে। আর কেউ মরলে। যদিও ফ্যান্সি মোমবাতি অবশ্য চলে, তা সেসব ডাইস মালিক কেনে না। দিলু ঠিক করে রেখেছিল হাতে কিছু টাকা এলে একটা ফ্যান্সি মোমবাতির কারখানা খুলবে। ঝুমাকে বলেছিল সেকথা। বড় বড় চোখ করে জবাবে ঝুমা জিজ্ঞেস করেছিল -- নাম কি দেবে গো কারখানার?
-- ঝুমা ক্যান্ডেল ফ্যাক্টরি। আগে থেকে ভাবাই ছিল।
-- ক্যান্ডেল মানে মোমবাতি বুঝি?
কারখানার থেকে বেশ খানিকটা দূরে বস্তি, এখন প্রায় সব বাড়িই অল্পবিস্তর পাকা। আজ কয়েক বছর হল বড় রাস্তা পেরিয়ে গলির ভেতরের এক বাড়িতে দিলু ভাড়া থাকে। একটাই ঘর। গত বছর থেকে বাড়ির মালিক একটা বাথরুম পায়খানা ছেড়ে দিয়েছে আলাদা করে। দিলুর যাতে অসুবিধে না হয়। দিলুকে সেও এখন সন্মান করে। এই ঘরে ভেতরের দেওয়ালে প্লাস্টার নেই। আলমারি, টেবিল, ফ্যান, খাট সব আছে, এমনকি ফ্রিজও কিনেছে মাস তিনেক, বিয়ার ঠান্ডা না হলে জমে না। ঝুমা পালিয়ে এলে নতুন বাড়িতে উঠে যাবে। বস্তির উলটো দিকে। শঙ্করদা অবশ্য পকিয়ে যাচ্ছে, ঘরদোর প্লাস্টার করে দিয়ে পুরো একতলাটায় দিলুকে ছেড়ে দেবে বলেছে। চুতিয়া শালা বিষ ধান্দাবাজ। আজকাল ওর বউ গায়ে পড়ে কচুর লতি, লাউ চিংড়ি বা চিকেনের ঠ্যাং দিয়ে যায় রাতে। বউটা কোমরের কাছে ভেতরের জাঙ্গিয়ায় নাইটি গুঁজে রাখে। খাবার দিতে এলে ইদানিং ওড়না দিয়ে আসে বুকের ওপরে। তারপর দরকার ছাড়াই বুকের ওপর ওড়নাটাকে বার বার ঠিক করে। এতে প্রথম প্রথম দিলুর খারাপ লাগত। বাসে ট্রেন-এ সামনে বসে মেয়েছেলেগুলো বুকের শাড়ি ঠিক করলে নিজেরই খারাপ লাগে। এতে ওর নিজের অপমান হয়। কিন্তু এখন আর এসবে পাত্তা দেয় না। বউটার দাঁতগুলো কুচিকুচি আর চোখটা কটা। ঘামলে গা থেকে বিশ্রী গন্ধ বেরোয় আর লদলদে পাছার ওপর নাইটিটা ভিজে লেপটে থাকে। মনে হয় বউটা সারাক্ষণই ঘামে আর রাজ্যের ঘাম নিয়েই ওর কাছে আসে। হাইওয়ের কৃষ্ণা ধাবার পেছনে চুল্লুর ঠেকটা শঙ্করের চামকী চলছে। কলবাবুর সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা করতে যায়। কলবাবু সামনের বার ভোটে দাঁড়াবে। খুব চেষ্টা করছে। তবে চাইলেই কি দাঁড়ানো যায়। তবে উনি ছাড়া এত টাকা খরচ করার মুরোদ আছে কার? এতগুলো কোল্ডস্টোর আর চালকলের মালিক। তাই না কলবাবু নাম। তাছাড়াও লরি, চারচাকা, ম্যাটাডর, বাচ্চা হাতি, কত কী যে খাটে কলবাবুর। জমি জিরেত কত আছে তা নিজেও জানে না মনে হয়। ভক্তি হয়। ভক্তি হয়। এমন লোক দিলুকে সবার সামনে বলে আপন ভাই। নিজের বাড়িতে পাশে বসিয়ে খাইয়েছে। দিলু কোনদিন কোথাও লজ্জা পায় না। কিন্তু কলবাবুর এমন ভালোবাসায় পায়। কলবাবু দিলুকে সত্যি ভালোবাসে। কোথা থেকে তুলে কোথায় নিয়ে চলেছে তাকে। নইলে এক সময়ে লাথি-ঝাঁটা খাওয়া দিলুকে পাড়ার মোড় থেকে আজকাল গাড়ি নিতে আসে! একটা পুরনো পালসারও না বলতেই দিয়েছে কলবাবু। দিলু কলবাবুর কাজ খুশি মনে করে। জান লড়িয়ে দিতে পারে কলবাবুর জন্য। বিশেষ কিছুই করতে হয় না যদিও। কলবাবু মাঝে মাঝে দরিয়াপুরে আসে। তখন কলবাবুর সঙ্গে থাকতে হয়। কখনো কখনো একই গাড়িতে। কখনো অন্য গাড়িতে। এখন দিলু হালকা তবে কাজ বাড়বে। দিলু জানে, কলবাবু বিশ্বাস রাখতে যখন শুরু করেছে তখন কাজ বাড়বে। কাজ বাড়লেই দিলু ভালো থাকবে। এমনিতেই লোকটার প্রচুর ছোটাছুটি। তারপর একবার যদি টিকিট পেয়ে যায় তাহলে দিলু মনে হয় আর নাওয়া খাওয়ার সময় পাবে না। কলবাবুর জন্য আর একটা লোককেও চিনেছে দিলু। সে বেশ ভদ্র। কুমার প্রতাপ সিং। ওর গায়ে নাকি রাজবংশের রক্ত আছে। অবাঙালি কেবল নামেই। ওদের বহু পুরুষের বাস এখানে। এম বি এ পাশ, ডক্টরেট। লন্ডন না কোথা থেকে পড়াশোনা করা। এমন যে কুমারদা তাকেও কখনো কলবাবু আপন ভাই বলেনি। দিলুকে বলে। কুমারদাও দিলুকে পছন্দ করে। দিলুর সঙ্গে বেশ মন খুলেই কথা বলে। কুমারদার ড্রেস পরা, কথা বলা, তাকানো দিলুর বেশ পছন্দ হয়। ওর থেকে বড়। মোবাইল ফোনে কি করে কি করতে হয় সব কিছু শিখিয়ে দিয়েছে কুমারদা। কিন্তু কলবাবুর অনেকদিনের সঙ্গী গগনবাবু, সে ওকে দেখতে পারে না মোটে। দিলু বোঝে, দিলু বুঝতে পারে কে ওকে চায় আর কে ওকে চায় না। লোকটা সিড়িঙ্গে, প্রায় দিলুর মতো লম্বা, তবে দেশলাই কাঠির মতো। কলবাবুর সঙ্গে সারাক্ষণ থাকে ওকে বেদো তাই বলে কলকাঠি। ও কলবাবুর কাছে চাকরি করে। কলকাঠির মনে হয় ভাগও আছে বেশ কিছুতে। ঝুমার ব্যাপারটা কলবাবুকে একদিন বুঝিয়ে বললে কিছু একটা ব্যবস্থা হবেই। যাইহোক, তাপ খেতে খেতে ভুট্টা যেমন আহ্লাদে পপকর্ন হয়ে যায় এই সব ভাবতে ভাবতে তেমনি দিলুর মনটাও আস্তে আস্তে তিলেময়না হয়ে যেতে থাকল আর কারণে অকারণে পিড়িং পিড়িং করতে শুরু করল। ঝুমার ফর্সা মুখটার পাশ থেকে নেমে আসা চুলের গোছা যেটা কানের পাশে এসে শেষ হয়েছে, তাকে লক্স বলে। ও নিজেই ঝুমাকে বলেছিল লক্স রাখতে। কালো টিপ আর শাড়ি পরে ওকে যা লাগে তা বলার নয়। ঝুমা ওকে বোঝার চেষ্টা করে, যদিও সব কথা যে ও দিলুর বুঝতে পারে তেমন নয়। কি কথাই বা ওকে বলতে পেরছে যে বুঝবে সব? আর বোঝারই বা কি দরকার? ঝুমা থাকলে সব ঠিকঠাক হয় দিলুর। ওকে মনে রাখলে ওর মন ভালো থাকে। ঝুমা ওকে ভালোবাসে বলেই না এত জোর আসে ওর মনে আর শরীরে। ঝুমা আর কলবাবু ওর জীবনে থাকলে আর কি চাই?
দিলুর লম্বা, শক্ত, কালো শরীরটা জুড়ে শিশুর তন্দ্রা জড়িয়ে আসতে থাকে ধীরে ধীরে। এখন দিলু কোথায়? দিলুর বাড়িটা কোথা থেকে এল এখানে। বাড়ির উঠোনের ওই কাঠটগরের গাছ, গাছ-ভর্তি কাঠপিঁপড়ে। উঠোন পেরিয়ে চৌধুরীদের পুকুর। তার পর সবুজ মাঠ। সেইখানে বাবুয়া, মঙ্গল, সুবীর কাদা পায়ে এগিয়ে আসছে ওর দিকে! যতই ওরা উঁচু ক্লাসের ছেলে হোক দিলুর সঙ্গে ওরা পারে? দিলুর পায়ে বল আঠার মতো লেগে, মাঠের বাঁ-দিক বরাবর তীরবেগে উঠে আসছে ও, সঞ্জীব স্যার পাশ থেকে চিৎকার বলছে দিলু ড্রিবল করে মাঝে আয়। মাঝে এসে গোলার মতো শট...গোওওওওল। মাঠের পাশের লোকগুলো সব্বাই চিৎকার করতে করতে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু ও কোন শব্দ শুনতে পাচ্ছে না। ওকে নিয়ে ছেলেরা লোফালুফি করছে শূন্যে... বেশ হাল্কা... হাল্কা...আকাশটা, মাঠের দুধারের পামগাছগুলোর ডগাগুলো মাঝে মাঝে কাছে আসছে আর দূরে যাচ্ছে। কিন্তু ও কেন কিছু শুনতে পাচ্ছে না। শব্দ হচ্ছে না কেন কোথাও। ছবিগুলো তো আছে, শব্দেরা কোথায় যায়!
বেদোটা বড় দেরি করে। সারাক্ষণ এত কি বালের কাজ করে কে জানে। বাইকের স্টার্ট বন্ধ করে গন্ধওয়ালা কারখানাটায় সেই ঢুকতেই হল দিলুকে। দেখল হারুকাকা সেই কোণটায় বসে মোমবাতির প্যাকেটগুলোয় লেবেল লাগিয়েই যাচ্ছে। ঘরের মাথায় একটা ডুম লাইট। সাদা প্লেট-এর মতো শেড থেকে ঝুলছে কবে থেকে। পোড়া মোম মাখা কালো ভুসো রং। রাতের বেলায় একটা আবছা আলো হয়ে জ্বলে। দিনের বেলাতেও অনেক সময় জ্বলে। এই কারখানায় কেউ উন্নতির কথা ভাবে না। এখানে মোমবাতির গন্ধের মধ্যে সময় আটকে গেছে। বেদো পায়খানায় ঢুকেছে। বর্ষাকালে ওর হাগার ধুম বাড়ে।
--হারুকাকা এবার একটা মোবাইল ফোন কেন।
--আমি আর কিনে কি করব। ওই বেদোর কাছে আছে ওতেই তো চলে যায়।
--বেদো কি সারাজীবন থাকবে? ওর জীবন এই কারখানাতে কাটবে? তুমি নয় চালালে। কবে এ উঠে যাবে তখন কি হবে?
--ও যখন হবে তখন হবে।
--এই তোমাদের দোষ জানো তো? একটু বেশি দূরের ভাবতে চাও না তোমরা।
ঘোলাটে চোখে হারু তাকিয়ে থাকে দিলুর দিকে। বেশ কিছুক্ষণ। তারপর বলে -- বেশি চাইতে নেইরে দিলু। তাতে শান্তি থাকে না। তারপর কিছুক্ষণ থামে। দিলু বলতে গিয়েও কিছু বলে না।-- একদিন খেয়ে যাস। আজ সয়াবিন রান্না করেছিলাম, তোর পছন্দের। তার পর কিছুক্ষণ থেমে আবার শুরু করে -- বেদোটা তোর সঙ্গে ঘোরে। কিন্তু ও কি তোর মতো পারে? তুই সব ছেড়ে দে দিলু। ফিরে আয়। এতেই চলে যাবে। মালিক আমাদের ভালো। খেয়ে-পরে চলে যাবে।
বহুদিন পরে লেবেলগুলো চেয়ে দেখে দিলু। একইরকমভাবে জিভ বার করে কালী চেয়ে আছে। জিভের ওপর দাঁতগুলো কুটিকুটি। শঙ্করের বউয়ের মতো। কিন্তু চোখটায় বেশিক্ষণ তাকানো যায় না। কেমন ঠান্ডা। নিচে লেখা মহাকালী মোমবাতি। আঠার বারকোশটায় আঠা ঢালা। দিলু ব্রাশটা টেনে নিয়ে আঠা লাগায় একটা লেবেলে তারপর সেটা সেঁটে দেয় একটা প্যাকেটে। একটা এক ঘেয়ে সি সি শব্দ করে মাথার ওপর পাখাটা চলছে। বেদো হেগে চলে এসেছে।
-- চলো দিলুদা। মনে তো হয় খাল্লাস হোল। কাকা রাতে খেয়ে নিও। আমি খেয়েই আসব।
-- খেয়ে আসিস কিন্তু গিলে আসিস না বাপ।
প্রথমবার এই ধাবাটায় এল। ফাঁকাই রয়েছে এখনো। বর্ষাকাল তাই হয়তো। এই জায়গাটায় দিলু এখন আর আসে না। কাল কিছু টাকা কলবাবু দিলুকে দিয়েছে। আজ তাই একটু মাল খাবে। দিলু হিসেব করেই চলে। ওর ব্যাঙ্ক আকাউন্টে ও টাকা জমা রাখে। শেয়ার বোঝার চেষ্টা করে। কুমারদা হেল্প করে।
--কালুয়া আর টনু খুব লেগে আছে। ওদের কাজ দরকার। তাছাড়া সুনীল আর আলিও তো তোর কাছে এসেছিল।
--আমি আর এইসব খুচরো কাজে নেই। তাছাড়া আমি তো এখন কলবাবুর কাছে কাজ করি।
--কিন্তু দিলুদা নিজের একটা দল রাখলে তোরই সুবিধে। নিজের কাজও তো করা যায়। রামবাবুর পর ফাঁকা মাঠে কেউ নেই। তুই এমন সুযোগ ছাড়িস না।
--আমি কি কোনদিন রামবাবুর মতো শকুন পচা হারামি ছিলাম? আমার জন্য কলবাবুর প্রেস্টিজ পাংচার হলে তখন কি হবে?
--আরে বেছে বেছে হারামিগুলোকেই একটু নাচিয়ে দেব। লোকে ধন্য ধন্য করবে। তাছাড়া রামবাবুও তো কলবাবুরই লোক ছিল। এত ভাবিস না। তোর নামেই এখন কাজ হয় দিলুদা। কিছুদিন কামাই। তারপর দুপয়সা জমিয়ে ছেড়ে দেব এ লাইন। তুই আর আমি ব্যবসা করে চালাব। তোর সেই ফেন্সি মোমবাতির কারখানা।
বেদোর একটুতেই নেশা চড়ে যায় তারপর প্রচুর ভুলভাল কল্পনা করতে থাকে। তবে তার ভাবনাগুলো কোনটাই দিলু, হারুকাকা আর মোমবাতির বাইরে বেরয় না।
--এ দিলু। খানিকটা লজ্জা আর খানিকটা উৎসাহ নিয়ে বেদো জিজ্ঞেস করে -- দিলু লোম তোলার মোম কোথায় পাওয়া যায়?
--কেন তোর কোথাকার লোম তুলবি?
--নারে বল না মাইরি, দরকার।
--কি দরকার তুই আগে বল।
--একজনকে দেব।
--আরে না... বেদো ওস্তাদ, এক্কেবারে লোম তোলার মোম পর্যন্ত চলে গেছ লুকিয়ে লুকিয়ে। কাকে দেবে?
--না দিলুদা। সে আছে। তুই বলবি কিনা বল। টেনে টেনে বলতে থাকে বেদো। খুব উত্তেজিত থাকলে সে দিলুকে দিলুদা বলে। ছোটবেলা হারুকাকা শিখিয়েছিল। কিন্তু পুরোটা বসেনি। তাই কখনো দিলু আর কখনো দিলুদা বলে।
--কে আছে বল। নইলে হারগিস বলব না।
--তুই না বললে আমি চললাম।
দিলু বেদোর দৌড় জানে। বলল -- যা তুই হেঁটে হেঁটে যা। পাঁচ কিলোমিটার তো মোটে পথ। হেঁটে হেঁটে যা।
বেদো দেখল মুশকিল। জ্ঞান হারায়নি কিন্তু টাল হারিয়েছে। তাছাড়া বলতে ইচ্ছে যে করছে না তা নয়। ছোটবেলা থেকে কোন্ কথাই বা দিলুকে না বলে থেকেছে। দিলু কোনদিন বেদোকে ওর সহ্যের বাইরে খেপায়নি। ওর শরীর ওর বুদ্ধি নিয়ে অসম্মানও করেনি। সবসময় আগলে রেখেছে। ও ছাড়া কোন বন্ধুও এ জগতে নেই। বেদো ভাবতে থাকে। কিছু বলে না, চুপ করে থাকে। বেশি খেলে হয়তো বলে দেবে কিন্তু যদি তখন শরীর খারাপ হয়ে যায়, বমি করে, তাহলে গালাগালি খাবে বেধড়ক। মালের গ্লাসে একটা ছোট্ট চুমুক দিল বেদো আর ফস করে একটা বিড়ি বার করে ধরাল। লালির গাটা পুরো মাখনের মতো। সবাই লালিকে কালো বলে কিন্তু পাশাপাশি হাত রেখে মিলিয়ে দেখেছে -- কি ফর্সা কি ফর্সা। তাছাড়া মাইয়ের চামড়া কি দারুণ! যে কোন হুরি পরিকেই হার মানিয়ে দেবে লালি। কিন্তু সত্যি কথা হল ওকে ছাড়া কোন মেয়ের মাই তো খুলে দেখেনি বেদো। মাই মানেই সুন্দর। টিপলে আরও সুন্দর। লালির মাইদুটো একজোড়া কবুতরের মতো। গরম আর নরম। লালির হাড়গুলো একটু জিরজিরে, দুধের নিচের পাঁজরগুলো গোনা যায়, তবে বেদোর মতো নয়। ওখানে আঙুল বোলালে উঁ উঁ করে আওয়াজ করে লালি। সুড়সুড়ি লাগে। মোমবাতি বানায় শুনে কি হাসি, হেসেই কুটিপাটি, তারপর হাসি সামলে বলে লালিও নাকি মোমবাতির কারবার করে। আট আনা, এক টাকা, পাঁচ টাকার সব মোমবাতি। দশ টাকার মোমবাতির নাকি টেরান্সপোরট এ অসুবিধা, বলে আরও হাসে। বেদোর কান কালো বলে বোঝা যায় না লাল হল কি না হল। কিন্তু কান গরম হয়ে যায় লজ্জায়। নিজেই বুঝতে পারে। একটাই জিনিস লালির খারাপ। নিচের লোম। তা সে নাকি বিউটি পার্লারে ওদের তোলে না। বেলেড এ চাঁচলে নাকি খোঁচা খোঁচা হয়। কাস্টমার ঝামেলা করে।
-- তোমার এত লোমের বাতিক কেন? কেউ তো বলে না। এত যখন মোমের কারিগর নিয়ে এস লোম তোলা মোম, কম গরমে গলে যায় ওখানেও কষ্ট হয় না, এমন মোম। লালি বলেছিল সেদিন ঝাঁঝিয়ে। ওর কাছে লালি আজকাল মাঝে মাঝে কম টাকা নেয়। ওর থেকে বেশি টাকা খরচ করার দরকার বা ক্ষমতা অবশ্য বেদোর নেই।
দিলু একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে বেদোর দিকে। মনে মনে হাসে, কিন্তু মুখে কিছু বলে না। বেদো সরাসরি দিলুর দিকে তাকাচ্ছে না আর কিছু বলছেও না। রাত নটা বেজে গেছে। রুটি আর চিকেন কষা লাগাতে বলল কিছুক্ষণ পর। আর তার মাঝে এখনই এক প্লেট পেঁয়াজি দিতে বলল। পেঁয়াজিটা এরা হেব্বি করে। বোতলে এখনো অনেকটা মাল রয়েছে। আস্তে আস্তে গিলতে হবে। রাত বারোটার মধ্যে বেদোকে কারখানায় ঢোকাতে হবে নইলে কাকা ঘুমোবে না। যে কদিন বেদো বাইরে রাত কাটায় হারুকাকা জেগে থাকে। মালটা এখনো ন্যাকা সেজে আছে। একটা সিগারেট ধরিয়ে মালের বোতলটা নিজের দিকে টেনে, নিজের গ্লাসে দু পেগ মাল ঢেলে বোতলটাকে নিজের কাছেই রাখল দিলু। নিশ্চিত জানে এই শেষ চালটায় কাজ হবে।
-- না বললে তোকে বোতলে হাত দিতে দেব না আজ।
মুহূর্তের মধ্যে দিলু একটা ধাক্কা খেল। মনে হল এক ঘুষিতে মুখটা আরও বেঁকিয়ে দেয় বেদোর। কিন্তু সামলে নিয়ে বলল -- কোন জায়গায় যাস?
--দয়াল পাড়ায়। মাসিদের বাড়ি। আর কোথায় যাব?
--বাঞ্চোত, মেয়ে পেলি না? খানকি পাড়ার মেয়ে?
--এমন করছিস কেন দিলু। আমি কি প্রেম করতে যাচ্ছি? কোন মেয়েছেলে আমার সঙ্গে প্রেম মাড়াবে বল। বুঝিস না বাল এই শরিল আর এই বদন দেখে কারো প্রেম হয়। আমি বাল চুদতে পারি কিনা সেটা জানাতে কোন ভদ্দরলোকের মেয়ে মাগনায় পেতাম?
দিলু কোন জবাব না দিয়ে চুপ করে থাকে। ঘেন্না করতে থাকে বেদোকে হঠাৎ। প্রেম ছাড়া একটা মেয়ের শরীর কি করে ভোগ করা যায় সেটা বুঝতে পারে না। প্রেম ছাড়া একটা মেয়ে নিজেও কি করে তার শরীর অন্যের কাছে তুলে দিতে পারে সেটাও ও স্পষ্ট ধারণা করতে পারে না। মদের বোতল থেকে গ্লাস ভর্তি করে মদ ঢালে তারপর চুপ করে গিলতে থাকে। বিরক্তি থেকে মনে একটা চিনচিনে ব্যথার বোধ আসতে থাকে দিলুর। যেটার মানে ও বোঝে না। এর মানে কি দিলু তা ভাববে না বলেই দিলু ঢক ঢক করে মাল খায়। দিলুর মাথার মধ্যে আবার ঝুমা ঘুরতে থাকে। ঝুমার সঙ্গে দেখা করে ফাইনাল করতে হবে। ও ওর বরকে ছেড়ে আসবে কিনা সেটা জানা খুব দরকার দিলুর। ঝুমা শেষবারও বলেছিল ও দিলুকে ছাড়া থাকতে পারছে না। ঝুমা কি এখন করতে দেয় ওর বরকে? ঝুমা শেষ বার বলেছিল দেয় না। দেবেও না কোনদিন। কিন্তু একঘরের তলায় না করে থাকতে পারে এক জোড়া জোয়ান পুরুষ আর মেয়েমানুষ। যদি করে তাহলে ঝুমাও ভালো না বেসেই করে। তাহলে আর ওই খানকি মেয়েছেলেটাকে দোষ দিয়ে কি লাভ। দিলুর ভাবনায় আর কিছু আসছে না। তার রাগটা আস্তে আস্তে পড়তে থাকে। খাওয়ার ইচ্ছেটা নেই। আরও পরে দিতে বলে খাবার। ঝুমাকে ফোন করে এর মধ্যেই দেখা করতে বলতে হবে। চলে আসতে বলে চাপ দিতে হবে। পুলিশকাছারি হলে মুশকিল হবে। কত লোকেরই তো বউ পালায়, কত বউয়ের বর বউকে ছেড়ে নতুন বিয়ে করে, সবাই কি পুলিশে যাচ্ছে? ঝুমাকে সব কিছু জিজ্ঞেস করে দেখতে হবে। কি হতে পারে কি না হতে পারে ওই সব থেকে ভালো বলতে পারবে। ঝুমাকে ও বিয়ে করে রাখতে পারবে না এমন কথা কোনদিনই বলেনি। এক বছর আগেও যখন ওর পেট চলত না, যখন ওকে বাড়ি থেকে বিয়ে দিয়ে দিল তখনো বলেনি, ভাবেইনি। সব সময়ে ভেবেছিল যে ভাবেই হোক ঝুমা সঙ্গে থাকলে ও গায়ে গতরে খেটে ঠিক ওকে সুখে রাখবে। ও জানত ও একদিন রোজগারপাতি ভালোই করবে। ঝুমারই বা কী করার ছিল। ওর বাবাই চায়নি। বাবার বিরুদ্ধে যেতে পারেনি। কিন্তু প্রচুর ভালবেসেছে দিলুকে। দিলু তাই ভুলতে পারে না। ভুলবেই বা কেন। ঝুমা তো বলেনি ওকে ভুলে যেতে। বলেছে দিলুর সংসার করতে ও চলে আসবে খুব তাড়াতাড়ি। কিন্তু ও লুকিয়ে এখন আর তেমন দেখা করতে পারে না। ও বলে বাপের বাড়ি থেকে সহজেই লুকিয়ে বেরোন যায়, কিন্তু শ্বশুরবাড়ি থেকে নাকি লুকিয়ে বেরোন মেয়েদের কাছে হেবি চাপের। দিলু চাইলে এখুনি তুলে নিয়ে আসতে পারে ওকে। কিন্তু দিলু চায় না কারো সম্মান নষ্ট হোক। তার নিজের, ঝুমার বা কলবাবুর কারোরই না। পুলিশ কাছারি না হলেই ভালো। সে চায় ঝুমা নিজে থেকেই ওর কাছে চলে আসুক। ঝুমা পাশে থাকলে ও সব পারবে। ওর মধ্যে অসুরের শক্তি আসে ঝুমার কথা ভাবলে। ঝুমাই পারে সেই শক্তিকে কাজে লাগাতে। দিলুর মাথায় একটা হাল্কা ঠান্ডা স্রোত শত সহস্র ঢেউ তুলে ঢুকে পড়তে থাকে। আদর করতে থাকে। যেন ঝুমা। ঝুমার হাতগুলো কি চমৎকার, নরম, শাঁখাপলা পরা হাতগুলো দেখতে কি সুন্দর। কিন্তু সেই শাঁখাপলা তো ওর জন্য নয়, ওর কথা ভেবে নয়। সে নিজে ওই হাতকে সুন্দর করতে পারেনি। না না সে এসব আবার কি ভাবছে! সেই হাতই তো ওকে আদর করছে। ওর মাথায় চুলে সেই হাতের আঙুলই তো সব যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিচ্ছে। ঝুমা ছাড়া এমন ভাবে কে ওকে ভালোবাসতে পারে। ঝুমা ঝুমা ঝুমা…। দিলুর মুখটায় তখন দ্বিধা নেই, রাগ নেই। আছে শুধুই শান্তি। আর সেই প্রশান্ত মুখ বেদোর পৃথিবীটাকে তখন নরম মোমের আলোয় ভরিয়ে দিয়েছে।
এই বর্ষায় সহস্র ডালপালা মেলে প্রকৃতি ভালোবাসছে ধরিত্রীকে। মোলায়েম আদরে ভরিয়ে দিচ্ছে তার বুক। সে বুক তৃষ্ণার্ত। সে তৃষ্ণা দীর্ঘ বিচ্ছেদের, অপেক্ষার আর অনেকটা অভিমানের। অভিমান যা গাঢ় হয়েছিল প্রেমিক প্রেমিকা উভয়েরই মনে, ধুলো আর ধোঁয়ার মতো, তা আজ যেন ভেঙ্গে যেতে চায় তীব্র আলিঙ্গনে। আকাশ নিকষ অন্ধকার, সে দেয় নিভৃত গোপনীয়তা। মিলনের শিহরন বা অন্তরঙ্গ ফিসফিসানি সবই যেন নিবিড় ও অন্তহীন হতে থাকে সেই অন্তরালের নিশ্চয়তায়। ভালোবাসুক ওরা, ভালোবাসায় তৃপ্ত হোক এ সময়। সবুজে সবুজে ভরে যাক ধরণীর কোল। সুধাপানে তৃপ্ত হোক কীটপতঙ্গের অন্তস্থিত প্রাণ, ঘন হোক শৈবাল-ছত্রাকের দল, গভীরতর হোক বন্য জীবন আর ভরে উঠুক গৃহস্থের ছোট্ট সুখের ঘর। এমনই এক অন্তহীন ভালোবাসার দিনে দরিয়াপুরের রিটায়ার্ড হেডমাস্টার ভুবনবাবুর ছোটো ঘর এখন অতিতচারী। ঠিক এমনই দিনে যেন মনে হয় মুছে যাওয়া বলে আসলে কিছু হয় না, সবই থাকে গোপনে, নিভৃতে, অন্তঃপুরে। যেন হাতের ছোঁয়ায় ধরা যাচ্ছে সেই ডহননাগড়ার আঁটি, এমনই বর্ষায় বাবার সঙ্গে মাঠে ধান রুইবার দিনে। সেই ডহননাগড়া, কার্ত্তিকে যে গাছের মাথায় হাত দেওয়া যায় না। শত সহস্র শুঁয়োপোকারা সে গাছ রক্ষা করে। সরু চালের ধান, যার মাথার শিষে শুঁয়োপোকার মতো শোঁয়া, যা বেয়ে হেমন্তের শিশির নামে। শিশিরে শিশিরে সে ধান হয় পুষ্ট। শালি জমি জুড়ে সে কত ধরনের ধান। শালি জমি মানে যে জমিতে আমন ধান হয়। ছিল ঝিঙ্গেশাল, যার ফলন বিঘে প্রতি পাওয়া যেত ডহননাগড়ার থেকে একটু বেশি। একটু উঁচু জমিতে হত ডাঙ্গালি ঝিঙে। আর জলাজমিতে হত লাঠিশাল। সেগুলো জলের ওপরেও শক্ত হয়ে জেগে থাকত আরও তিন চার ফুট। বৃষ্টি বাদলের ক্ষমতা ছিল না এগুলোকে নুইয়ে দিতে পারে। ছিল দক্ষিণে নাগরা, রাজ ঝিঙ্গে শাল, কাজল কলমা আর ঢুলী। সবার বাড়িতে তখন ঢুলী চালের মুড়ি, যে যার নিজের বাড়িতেই মুড়ি ভেজে নিত। সে মুড়ির কি স্বাদ। বিঘে প্রতি ছয় আট মন ধান হেসেখেলে এগুলো থেকে পাওয়া যেত। এগুলো সবই ছিল আমন ধান। আউশ ধান হত সোনা জমিতে। উঁচু জমি, যে জমিতে কোনমতেই জল বাঁধা যায় না। ছিল কালা আউশ আর সাদা আউশ। কালা আউশ ধানের রং কুচকুচে কালো। দরিয়াপুরে ঘরে ঘরে তখন ঢেঁকি। সেই কালো ধান ঢেঁকিতে ভেঙ্গে বেরত লাল চাল। সে চাল মাটির হাঁড়িতে ফোটানোর সময় বেরত এমন সুগন্ধ যা রাস্তা দিয়ে লোক গেলে বুঝত, আজ খুব হচ্ছে বটে এক রান্না। সে গন্ধ হাল আমলের ইন্ডিয়া গেট-এর মতো নয়, মায়াময় এবং এই বাঙলার একদম একান্ত নিজের। রাতে শুধু ফ্যানভাতেরই রেওয়াজ ছিল। সেই চালের ফ্যান ছিল মোটা, পেটে থাকত অনেকক্ষণ ও স্বাদ ছিল অমৃত। ভোর হলেই মাঠে বেরিয়ে পড়া। কিষেন মুনিষের জড়ানো শব্দের কথাবার্তা আর বিড়ির গন্ধে ভরে থাকত সকালের মেজাজ। অভ্যেসেই হোক আর কাজের শর্তেই হোক পাঁচ কিষেনে দেড়বিঘে জমি রুয়ে দিত। একহাতে দুটো গুঁজি নিত যদিও। এখন দেড় বিঘে জমিতে ধান রুইতে এগারো কিষেন লাগে। যদিও একহাতে চার গুঁজি নেয় তারা। এখন অবশ্য ধানের ফলন বাড়ানোর জন্য চারা রোপণের দূরত্বও কমেছে। সারাদিনে কাজের সময়ও কমেছে। ধান কাটার সময়েও একই কথা ছিল, হই হট্টগোল, কারণে-অকারণে চিৎকার, চটুল গালাগালি, রসের গপ্পো আর প্রচুর পরিশ্রম। ধান কাটা হয়ে গেলে গরুর গাড়িতে চাপিয়ে সে ধান বাড়ি নিয়ে আসা, ধান ঝাড়িয়ে গোলায় ভরা আর ঘরে ঘরে নবান্নের উৎসব। বছরে পাঁচ মাস কেমন ধুন্ধুমার করে কেটে যেত। আমন ছাড়া তেমন অন্য চাষ তখন হত না। বছরে বাকি সাত মাস থাকত অঢেল সময়। বোরো ধানের চাষ এসেছিল একাত্তরের পরে, চায়না থেকে, তাইচুং চালের চাষ থেকে। সেই সাতমাসে পাড়ায় পাড়ায় চণ্ডীমণ্ডপে আড্ডা, তাস, পরনিন্দা-পরচর্চা, গুজব, হরিনাম, ভিক্ষে সবই চলত। আর চলত শখের যাত্রা দল। গ্রামে গ্রামে তখন যাত্রা দল। যাত্রার মরশুম চলত সারা শীত জুড়ে। ওই সাত মাস ঘরে-পালা গরু-বাছুর নিয়ে কাটত গৃহস্থের জীবন। দুধ ঘি খেয়ে, বেচে, একটু শাক সবজি চাষ করে চালিয়ে নিত তারা। আর ছিল পোস্ত, সে ছিল নিতান্তই গরিবের খাবার। আটষট্টি সালে পোস্তর কিলো ছিল চার টাকা। ভাদ্র, আশ্বিন, কার্ত্তিক জুড়ে চলত পোস্ত খাওয়া। আলুপোস্ত, পেঁয়াজপোস্ত, ঝিঙেপোস্ত, পোস্তর বড়া কত কি। মানুষের জীবন ছিল সহজ, যদিও জীবন ধারণ সহজ ছিল না। ছিল জাতের অভিমান, জাতব্যবসার প্রতি আস্থা এবং হয়তো অপারগ নির্ভরশীলতা। সমাজে চাকরির রেওয়াজ ছিল না বললেই চলে। পড়াশোনার রেওয়াজই বা কতটা ছিল। চাকরি মানে তখন সরকারি চাকরি। চাকরির জীবন চিরকালই নিরাপত্তার কিন্তু একমুখী। নিরাপত্তার চাহিদাই আসলে যুগ যুগ ধরে মানুষকে সমাজমুখি করে তুলেছিল। তাই মূলত খুব বেশি ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রজাতি হয়েও মানুষ হয়ে উঠেছিল সামাজিক। কিন্তু সেই সমাজও বদলে যায়। কখনো ধীরে ধীরে, সম্পূর্ণ অলক্ষ্যে আর কখনো খুব দ্রুত যা চোখে পড়ে। কোন মানুষ দীর্ঘায়ু হোলে সেই পরিবর্তন সে দেখতে পায় অনেক বেশি। যতক্ষণ সেই পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে সে তাল রাখতে পারে ততদিন সে থাকে যুবক, যখন সে পারে না তখন সে হয় বৃদ্ধ, কিন্তু সে যখন চায় না তখন সে হয় পরিত্যক্ত। ভুবন তাঁর বৃদ্ধত্ব মেনে নিয়েছেন, অনেক আগেই। জগতও দেখেছেন অনেক কিছু। বুঝেছেন নিজের মত করে। সাজিয়েছেন সারা জীবন ধরে অনেক প্রশ্ন আর তাদের সম্ভাব্য উত্তর। কিন্তু সবটাই নৈর্ব্যক্তিকভাবে। আর এও বুঝেছেন সমাজ নৈর্ব্যক্তিকতা পছন্দ করে না। তাই তিনি উত্তরগুলোকে নিজের মনেই জমিয়ে রাখেন আর সেগুলো নিয়ে নিজের মনেই বলতে থাকেন। বয়স হবার পর ভাবার সময় বেশি। তাই একই কথা বেশি ভাবেন, প্রতিদিন ভাবেন এবং প্রায় সবসময়ই ভাবেন। কত বদলে গেল এই দরিয়াপুর। নদীর মতোই। দরিয়াপুর ছোট জনপদ থেকে আস্তে আস্তে পুরসভা শহর হয়েছিল অনেক আগে। সেখান থেকে এখন মাঝারি শহর। মূলত কৃষিনির্ভর হলেও ছোটছোট কারখানাও দু একটা তৈরি হয়েছিল আস্তে আস্তে। কিন্তু সে তেমন কিছু নয়। কিন্তু দরিয়াপুর বদলে যাচ্ছে যেন খুব তাড়াতাড়ি। সবেতেই তো বদল হচ্ছে। দরিয়াপুর কিছু রেখেছে কাছে আর কিছু ফেলে এসেছে পেছনে। বদলেই তো যেতে হয়। স্রোতে ভাসিয়ে রাখতে বদলে যেতে হয়। নইলে হারিয়ে যেতে হয় চিরকালের মতো। নিজেকে নিজের এই ভাসিয়ে রাখাটাও তো একটা খেলা। এই খেলাটাকে উপভোগ করতে করতেই পৌঁছে যাওয়া সেই অনিশ্চিতের দিকে।
সে এক দিন ছিল। মনে তখন জোশ, শরীরে তখন যৌবন। এই তো সেদিনের কথা। সত্তরের দশক। একটাই শব্দ -- পলিটিক্স। সাধারণ মানুষের পলিটিক্স। সাধারণ মানুষের জন্য পলিটিক্স। ভুবন তখন নেতা। কত কথাই ভুবন কত মিটিং-মিছিলে শুনেছেন, বলে এসেছেন। কিন্তু আজ এতদিন বাদে মনে হয় মানুষের সমস্যা আদৌ বদলেছে কি কিছু? নাকি বদলের নামে নতুন করে বাঁধা পড়ে গেছে মানুষ আবার। আশপাশ কত কিছু বদলাল। চাষির ছেলে ভুবন দেখল কত বদল শুধু চাষের দুনিয়াতেই। প্রকৃতি বদলালে চাষ আবাদ বদলায়। কিন্তু ভারতে চাষের ধরন বদলে গেছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের জন্য। বাংলায় ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ তো প্রথম থেকে বেশি ছিলই। কিন্তু তারই সঙ্গে সত্তরের দশকে আস্তে আস্তে শিল্পগুলোও বাংলা থেকে ক্রমাগত গুটিয়ে চলে যেতে থাকল দক্ষিণ ভারতে, মহারাষ্ট্রে। বাংলা তাই হয়ে থাকল কৃষিকেন্দ্রিকই শুধু নয় হল কৃষিনির্ভর। অগণিত মানুষের জীবিকার সমস্ত চাপটা পুরোপুরি গিয়ে পড়ল জমিতে। হাজার হাজার বছরের অভিজ্ঞতালব্ধ তথাকথিত অবৈজ্ঞানিক চাষ-আবাদের পদ্ধতিকে ফেলে দিতে হল রাতারাতি। লাঙ্গল বলদ ছেড়ে মেকানাইজেসন হল মাঠে। এল রাসায়নিক সার। তার আগে জৈব সারই ভরসা ছিল। জমির প্রকৃতি খুব তাড়াতাড়ি বদলে যেতে লাগল। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে নদীতে বাঁধ দিয়ে সেচের ব্যবস্থা হল। তার আগে সেচ বলতে ছিল আউশের চাষে বড়জোর পুকুর থেকে ডোঙ্গায় করে খানিক জল দেওয়া। এছাড়া শ্যালো পাম্প চালিয়ে চলল শীত কালেও ধানের চাষ। বারবার বিয়োনো গরুর মতো জমি ক্লান্ত হয়ে পড়ল। এর ওপরে এল উচ্চফলনশীল নতুন বীজ। দেশি ধান বা শাকসবজিতে কোনদিন পোকা মারার ওষুধ দিতে হত না, সেটা যে কি তাই জানা ছিল না। পোকা মারার আর আগাছা মারার ওষুধ ছাড়া আজ আর চাষ হয় না। তখন আমন ধান উঠে গেলে পেঁয়াজিলতা বলে এক ধরনের লতানে গাছ জমিতে ছড়িয়ে পড়ত, ভুবনের বাবা বলতেন ওই গাছ ক্ষতিকর, জমির সার চুরি করে। কিন্তু তাকে মারতে বিষের কথা ভাবতে হত না। আশ্বিন মাসে দল বেঁধে আসত এক ধরনের কালো পোকা। পেঁয়াজিলতা খেয়ে সাফ করে দিত। কিন্তু উলটে পোকা মারার বিষে ধীরে ধীরে সাফ হয়ে গেল কতরকম উপকারী পোকার দল। নষ্ট হয়ে গেল প্রাণী ও উদ্ভিদের হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা যৌথ প্রাকৃতিক বোঝাপড়া। মানুষের সঙ্গে উল্টে পোকামাকড়ের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল তখন থেকে। সে যুদ্ধে কখনো মানুষ জেতে কখনো তারা। তাই দেশি ধানের বীজগুলো সব হয়ে পড়ল সেকেলে, অচল। হারিয়ে গেল ডহননাগড়ার পৃথিবী। ভুবন কি একা পারতেন তাকে বাঁচিয়ে রাখতে? ছোটো পরিবার ছাড়া কোন কিছু ‘ছোট'ই আর বাঁচছে না যেন। বাঁচবে না যেন। ছোটোবেলায় মনে হতো অল্প পেয়েই বেশিরভাগ মানুষ সুখে থাকত। কিন্তু আজকাল মানুষের মনে ধীরে ধীরে আরও একটু বেশি চাওয়ার ইচ্ছে জাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। হাতের কাছে সব কিছু এমন করে আনা হচ্ছে যে মানুষ সব কিছুই নিজের কাছে রাখতে চাইছে। যাকে ভোগবাদ বলে। আসলে মানুষের মধ্যে অন্তর্নিহিত থাকে ভোগবাদের বীজ, তাকে শুধু উস্কে দিতে হয়। শুধু নতুন নতুন চাওয়াকে সামনে ধরতে হয়। তারপর তাকে চাইতে চাইতে মানুষ আস্তে আস্তে কোথায় হারিয়ে যায়।
যত বয়স হচ্ছে তত যেন বেশি করে মনে হচ্ছে যেন সব হারিয়ে যাচ্ছে। বয়েস বাড়লে এমনই হয়তো হয়। কিন্তু হারিয়ে কেন যায় সব কিছু? কোথায় হারিয়ে যায় সব কিছু? সারাদিনের চিন্তার পর আবার কেন সেই শূন্যতাই চলে আসে ভুবনের বুকে। বৃষ্টি তো থামেনি। ভালোবাসার দিন তো শেষ হয়নি এখনো। ফসলের মাঠ সে তো আবার সবুজ হবে। গ্রামের মানুষ আবার কয়েকদিন একটু কাজ করবে একটু খুশি খুশি আশার মধ্যে থাকবে। কিন্তু ভুবনের কি হবে? সেকি আর কোনদিন ফিরে পাবে তার আদরের ফসল জিতুকে?
কিন্তু এবার একটা আধার প্রয়োজন। যে আধারের সন্ধানে আমি ভেসে আছি। আমি ভেসে আছি অনন্তকাল। কিন্তু কেন আমি ছুঁতে পারি না আমায়? কেন বাঁধা হল না এখনো আমাকে কোন নির্দিষ্টতায়? আমি কতদিন এভাবে থাকব? এই নিবিড় চিন্তার জগতে আমার কোন আনন্দ নেই কেন? কেন মনে হয় এই অস্তিত্ব সেও যান্ত্রিক। এও তো এক প্রবল কারাগার। এই কারাগার আমার চাই না। আমি মুক্তি চাই বন্ধনে। আমাকে না বলা হয়েছিল আমি মুক্ত? তাহলে মুক্তি কোথায়? আমি এই অনন্তকাল চাই না। মুহূর্তকাল চাই আমি। আমার ক্ষণকালের অবগাহন চাই, আমার ডুবে যাওয়ার জড়ত্ব চাই, আমার ক্ষয়ে যাওয়ার শরীর চাই। আমার ক্লান্তি চাই। আমার নিদ্রা চাই। পাখির ঠোঁটের আঘাতে নেমে আসা সজনে-আঠার বন্ধনে বাঁধা পড়ুক আমার সবকিছু। আমার সব কিছু বাঁধা পড়ুক ওই সবুজ পাতায়, ওই শিশিরে, ওই উত্তপ্ত বালুকণার অসহনীয়তায়।
একি হল! হঠাৎ করেই এখন আর কিছু দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। কোন শব্দও শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না। ঠিক যেন নতুন করে শুরু হল নতুন কোন শূন্যতার জন্ম। হঠাৎ করেই লুকিয়ে থাকা আলোর কণাগুলো এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটাল যেন। তারপর তারা ছড়িয়ে পড়ল দূরে দূরে, চোখের সামনে যত দূর দৃষ্টি যায় তত দূর, এমনকি ছড়িয়ে পড়ল চোখের ভেতরে। এইভাবে যে কতক্ষণ গেল বা যাচ্ছে জানলাম না কেউ। তবে ধীরে ধীরে সে আলোর বিস্ফোরণ হয়ে এল স্তিমিত। সে এখন মৃদু ও সহনীয়। তবে কি এই নিরন্তর কথা বলাই আস্তে আস্তে হয়ে যাচ্ছে এক শরীর?
হ্যাঁ। শরীর। কোন এক অদ্ভুত না লিখে রাখা দিনে, কোন এক অত্যাশ্চর্য প্রক্রিয়ায় এসে উপস্থিত হলাম তুমি বা আমি, যে প্রক্রিয়াকে আপাতত বলছি জন্ম। জন্ম হল 'আমি তুমির'। যেমন যে আলোর রূপ নিল সে হল তুমি। আর আমি হলাম অন্ধকার। আলো আর অন্ধকারের মত মিলেমিশে যাওয়া এবং পরস্পরে বদলে যাওয়ার চিরকালীন সম্ভাবনা নিয়ে এখন আমি এই ‘আমি’। আমার হাঁটুতে এখন এই পৃথিবীর বালুকণা। ঠিক এই সময়, আমাকে কেউ কানে কানে বলল-- “দেখো এই তোমার পৃথিবী”। এখানে জলরাশির রঙ নীল, শূন্যের রঙও নীল। আমার সামনে সবুজ মহীরুহের ব্যাপ্তি, শ্যাওলা ঘেরা সরোবর, আর নদী। আমি মনে করতে পারছি আমি ছিলাম ভাসমান। স্বেচ্ছায় এসেছি এখানে, এসেছি এই সকালে। সে সকাল ছিল নির্মল। ঠিক যেমন আমি চেয়েছিলাম। আমি আনন্দিত। ধন্যবাদ জানাই এই পৃথিবীকে। ধন্যবাদ জানাই আমার পূর্ব-অস্তিত্বকেও।
সন্ধ্যের আকাশে এখন আমি কিছুক্ষণ শুকতারার সঙ্গে কথা বলে নেব পূর্ব অভ্যেসমতো। আমি জানি তাকে হিংসে করে অন্য গ্রহ তারারা। তাই সে একা, তার আবর্তন উল্টো, সে বিচ্ছিন্ন। কিন্তু মজার কথা হল এই যে সেই বেখাপ্পা শুকতারাই আমাকে জানাল শুভেচ্ছা, নতুন পৃথিবীতে। আর বলল ‘আমার অসাধ্য কিছুই নেই’ -- এমন অহংকার না থাকলে নাকি এই পৃথিবীতে টিকে থাকা যাবে না। আমি একটু অবাকই হলাম। সে কেন এমন কথা বলে! শুকতারা আমার মনের কথা বুঝেই হয়তো মুচকি হেসে বলল -- এত তাড়া কিসের? তুমি এখন সময়ের কবলে ঢুকে পড়েছ। তাই সময় নিজেই উন্মুক্ত করবে ধীরে ধীরে সব কিছু তোমার কাছে। এ কথা বলেই শুকতারা ডুবে গেল ঝুপ করে। ডুবতে ডুবতে বলল -- এই যে আমি যেখানে মিলিয়ে যাচ্ছি, সে হল দিগন্ত। তোমার দিগন্ত কিন্তু আলাদা। আসব আবার কাল। আমি খানিক চেয়ে থাকলাম আর ভাবলাম সত্যিই তো! এই দ্রুততা বা গতি, তাকে তো অনুভব করি নি আগে কখনো। আর এই গতির সঙ্গে তাল রাখতে পারি কি না পারি সেই কথা ভেবে মনে কি যেন একটা হচ্ছে। অস্বস্তি? হ্যাঁ এই অস্বস্তিও তো প্রথম বোধ করলাম একই সঙ্গে। তবে? আরে! এই তো বন্ধন! আহা! বন্ধন আমার। তোমাকেই তো চেয়েছিলাম আমি একান্ত বাসনায়।
দিলু আজকাল মাঠে আসছে, দরিয়াপুরে আসার পর থেকে কোনদিনই চাষের ক্ষেতে এতক্ষণ সময় কাটায়নি দিলু। এর আগে এসেছে ঘুরতে, কাছাকাছি পিকনিক আর ফুর্তি করতে। কলবাবুর প্রচুর জমি ছড়িয়ে আছে আশপাশের অনেক গ্রামে। এই গ্রামে কলবাবু নিজে চাষ দেন। নিজে মানে নিজে থেকে নয়। দেখাশোনা করে গগন। বাকি জমিগুলো মনে হয় ইজারা দেওয়া আছে। সে কথা পরিষ্কার করে জানা নেই দিলুর। কলবাবু বলে দিয়েছে মাঝে মাঝে বড় টিম নিয়েও যেতে। দুদিন আগে বেদো, সুনীল, আলি, প্রতাপ এদের নিয়ে এসেছিল, কিছু টাকাও এর জন্য আগে থেকে পেয়েছিল। আজ শুধু ও আর বেদো। কলবাবুর লেবারদের একটু চোখে চোখে রাখা ওর কাজ। এগুলো মহাচোর আর অলস। কলবাবুকে যদিও এরা মহাজন বলে। গগনের নিজের লোকও আছে কিছু, দেখাশোনা করার জন্য। লোকগুলোকে দেখলেই কেমন মিনসে শয়তান বলে মনে হয়। এদের সঙ্গে লেবারদের তেমন মেলামেশা হয় না। লেবারগুলোই এদের সঙ্গ এড়িয়ে চলে অথচ একই গ্রামের লোক। এখানে কেউ কাউকে কিছু বুঝিয়ে দেয় না। হাতে ধরে কাজও শেখাতে দেখছে না কাউকে। দিলু এখানে বিশেষ কিছুই বুঝতে পারছে না। শুধু বুঝতে পারছে রোয়াবে থাকতে হবে। নইলে ভয়ে রাখা যাবে না। এদের ভাষার ধরন আলাদা। স্থানীয় লোক হলে সবসময় সুবিধে। দিলুর নিজের ভাষা আদৌ দরিয়াপুরের মতো নয়, আলাদা। ওর কোনদিনই এখানকার মতো ভাষা ছিল না। বেদো, হারুকাকারও না। মাঠে ভোরবেলাই চলে আসতে হয়। প্রচুর লোক জমা হয়ে যায়। একেক জায়গায় জমির কূলকিনারা দেখতে পাওয়া যায় না। মানুষ কত খায় এই জায়গায় না এলে বোঝা যায় না। জমির কাজে বলদের খাটনি। এখন বলদ নেই কিন্তু কিষানগুলোর মধ্যে সবসময়ই একটা বলদ বলদ ভাব। যদিও সব থেকে বড় বলদ মালিক। কলবাবুর কথাটা আলাদা। তিনি তো আর যে সে মালিক নন। দিলু সারাক্ষণ এখন মাঠে ঘুরে বেড়ায়। দুপুর পেরিয়ে বিকেল গড়িয়ে যায় মাঝে মাঝে। আশপাশের অনেক ক্ষেতেই চাষিরা চলে যায় আগে। ওগুলো কলবাবুর ক্ষেত নয়। এই লেবারগুলো এখন বীজ ভাঙার কাজ করছে। বীজ ভাঙা মানে বীজতলা থেকে চারাগুলোকে তুলে একসঙ্গে আঁটি বেঁধে রাখা পরবর্তীকালে রোয়ার জন্য। বেদো খুব মন দিয়ে দেখে। দিলুও দেখে কিন্তু বুঝতে দেয় না। মাথায় চড়ানো যাবে না। মাথায় চড়িয়েছ কি এগুলো ফাঁকি মারবে। বীজ ভাঙা কাকে বলে দিলুও আগে জানত না। অনেক কথাই আছে যেগুলো শুধু চাষারাই বোঝে। এরা কিন্তু তেমন কথা বলে না, খাওয়ার সময়ে একে ওপরের সঙ্গে কিসব গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করে। মাঝে মাঝে বিড়ি ধরায় আর ফুক ফুক করে ধোঁয়া ছাড়ে। কেউ কেউ আকাশে দিকে চায়। কি কারণে চায় বোঝা যায় না। হয়তো দেখে বৃষ্টি কতদূর। বৃষ্টিতে যদিও কাজ থামে না। একটু আরাম হয়। বর্ষাকালের মাঠে রোদ সাঙ্ঘাতিক, পোড়ায় না একেবারে গলিয়ে দেয়। মাঠে মেয়েছেলে লেবার কম নয়। ওগুলো তিন ধরনের। বেশিরভাগ আদিবাসী, কিছু বিহারী আর দুটো একটা ক্বচিৎ বাঙালি। আদিবাসী আর বিহারী মেয়েছেলেগুলো বিড়ি খায় আর নিজেদের মধ্যে কীসব বলে কিসসু বোঝা যায় না। সারাক্ষণ খাটে, ব্যাটাছেলেগুলোর থেকে কোন অংশে কম নয়। সব বয়সের মেয়েরাই কাজে আসে। একটা দুটো কমবয়সের আদিবাসী মেয়ের মুখগুলো এখনো দুধের বাচ্চার মত ফোলা ফোলা। চোখের মণিগুলো বড় বড় আর কুচকুচে কালো। আদিবাসী মেয়েগুলো ফুলহাতা শার্ট পরে। শাড়ির ওপর। পাশের পাড়ায় এদের বাস। একসময়ে সিংভুম থেকে বাঁকুড়া হয়ে আদিবাসীরা এখানে কাজের সন্ধানে এসেছিল। তারপরে কখন মিশে গেছে বাংলার মূল স্রোতে।
এই অঞ্চলটায় এখন বীজ রোপণ হচ্ছে। জ্যৈষ্ঠের পনেরো তারিখের মধ্যে মাঠে এখানে বীজ ফেলা হয়ে গেছে। মানে বীজতলার তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। চারাটে চাষ হচ্ছে এখানে। চারাট পদ্ধতিতে চাষে খরচা বেশি কিন্তু ঝুঁকি কম। চারাটে বীজতলায় বীজ ফেলার পর যখন চারা বেরোয় সেগুলোকে নিয়ে একটা জমিতে রোয়া হয় যে জমি সার দিয়ে আগে থেকেই তৈরি করা থাকে। পঁচিশ দিন থেকে এক মাস সময়ের মধ্যে তারা ওখানেই গায়েগতরে বাড়ে, উচ্চতাও ভালো হয়। তারপর তাদের গিয়ে আবার রোপণ করা হয় তৃতীয় আরেক জমিতে। এতে আসলে দুবার রোয়া হচ্ছে একই ধান। কিন্তু সুবিধে হল যদি কোন কারণে আষাঢ় মাস জুড়ে বর্ষা না হয় তাহলেও এরা ঝিমিয়ে পড়ে না। কারণ অল্প সেচের ব্যবস্থা ওই মাঝের জমিতে থাকে। এতে বীজের পরিমাণ কম লাগে। বিঘেপ্রতি মাত্র দু কেজি। আর অন্য পদ্ধতি যাকে বীজে চাষ বলে, তাতে বীজতলায় বীজ ছড়ানোর পর এক মাস পরে চারা বেরোলে, তাদের সরাসরি রুয়ে দেওয়া হয় নতুন জমিতে। সে জমিও সার ইত্যাদি দিয়ে আগে থেকে তৈরি থাকে কিন্তু অনাবৃষ্টির জন্য তৈরি থাকে না। যদি টানা বৃষ্টি না হয় তাহলে সে ধানের গাঁট মোটা হয়, ঝাড় হয়ে যায় আর ধান গাঢ় হয়ে যায়। আগরাডাগরা বেরিয়ে ফসল ধারণের ক্ষমতা কমে যায়। এক্ষেত্রে বিঘেপ্রতি প্রায় ছ কেজি ধান লাগে বীজ তৈরির জন্য। কিন্তু লেবার কম লাগে বলে খরচ অনেকটাই কম। তা কলবাবুর খরচের হাত ভালোই। লেবারগুলো নিজেরাই সব কাজ করে চলেছে। আমন ধানের হাই ইল্ডিং ভ্যারাইটিগুলোর মধ্যে এখন স্বর্ণ মাসুরির খুব চাহিদা। এছাড়া নীলাঞ্জনা, যমুনা, রঞ্জিত আরও অন্যান্য আমন চলে খুব। মাসুরিকে স্বর্ণও বলে। এই অঞ্চলের জমিগুলোতে তারই চাষ হচ্ছে। দিলুকে কুমারদা বলেছে মাসুরি আসলে মিসোউরি থেকে অপভ্রংশ হয়ে এসেছে। যেমন নীল নদের তেলাপিয়া যাকে নিলোটিকা বলে সে মাছ এদেশে এসে কখন যেন হয়ে গেছে নাইলনটিক্কা। বক্কলি আসলে ব্রকলি। সাধারণ মানুষ নামগুলো কেমন সব নিজের মতো করে নিতে পারে।
দিনের এই মুহূর্তে খুব কাজের গতি এসেছে। একেকটা সময় আসে যখন সবাই একসঙ্গে জোরকদমে কাজ করতে শুরু করে, মনে হয় এতগুলো লোকের যেন একটাই প্রাণ। আর সেই শক্তিশালী প্রাণ যেন সারা মাঠ জুড়ে কাজ করে চলেছে। আবার কাজের গতি কখনো যায় ঢিমে। গগন শুধু মাঝে মাঝে কোন জায়গাটায় আগে ছড়া বসবে, কে কোথায় যাবে সেটা বলে দিচ্ছে। কিন্তু বীজ পোঁতা নাকি খুব সহজ কাজ নয়, হাত নরম হতে হয়। মানে পোঁতার সময় নরম করতে হয় মন আর তবেই নাকি চারা মাটির বুকে নাড়ী ধরতে পারে। শুনে ন্যাকামি মনে হলেও কাজটা কঠিন ও মনের সংযোগ লাগে। এত খেটে এরা কত পায় দিলুর মনে প্রশ্ন জাগে। কিন্তু সে জানে এসব জিজ্ঞেস করা বোকামি। একবার মনের ভুলে গগনকে সে অবশ্য জিজ্ঞেসও করেছিল -- এদের রোজ কত? গাল-ঝোলা হুলো বেড়ালের মতো যেন শুনতেই পায়নি এমন ভাব করে চলে গেছিল। দিলুরই ভুল হয়েছিল। কলবাবুর লোকরা কেউই প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথাবার্তা বলে না। মির্জাহাটির দিকে এখনো জমি পুরোপুরি তৈরি হয়নি। ট্র্যাক্টর চলছে, এবার ওদিকে যেতে হবে। গগন এখানেই থাকবে, বেদোকে নিয়ে দিলু বাইকে স্টার্ট দিল। রাস্তায় বেদো একবার জিজ্ঞেস করল -- আমাদের এখানে ঠিক কী কাজ কিছু বুঝছিস দিলু? দিলু জবাব দিল না। আরেকবার জিজ্ঞেস করল -- লোকগুলো তো ভালোই কাজ করে? আমরা না থাকলে কি কাজ করে না? নাকি গগন কাজ করে না? দিলু এ কথারও কোন উত্তর দিল না। আসলে দিলু এই কথাগুলোর উত্তর জানে না, সেও বেদোর মতোই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে।
মির্জাহাটি খুব কাছেই, দরিয়াপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে আট কিলোমিটার, মাঝে নতুনহাটা। সব গ্রামগুলোই দরিয়াপুর থানার মধ্যে। কোলকাতা বা বাইরের অন্যান্য লোকদের কাছে আশপাশের গ্রামের লোকেরা ঠিকানা বলতে দরিয়াপুরের নামই বলে। কারণ সবাই দরিয়াপুরের নাম জানে। মির্জাহাটিতে মুসলমানের সংখ্যা বেশি আর নতুনহাটায় হিন্দুর। বহুপুরুষ ধরে এখানে এদের বাস। অন্যান্য অঞ্চলের মতো এখানে সবাই প্রায় চাষি। বেশিরভাগই মাটির বাড়ি। মাটির দোতলা বাড়ি যাদের তাদের একটু ক্ষমতা বেশি। আর পুরোপুরি পাকা বাড়ি যাদের তাদের অবস্থা বেশ ভালো। বাড়ি দেখলেই হিন্দু মুসলমান তফাত খানিকটা করা যায়। সব অঞ্চলেই একটু বয়স্ক লোকগুলো লুঙ্গি পরে, কমবয়েসিদের মধ্যে প্রায় সবাই প্যান্ট আর গেঞ্জি মানে টি-শার্ট পরে। এখানে চাষাদের দলে মোরশেদ বলে একটা নেতা আছে সে বেশ চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে। আগে কয়েক দিন দিলুর সঙ্গে ঠুকে ঠুকে কথা বলছিল। লম্বা শক্ত দোহারা চেহারা। প্যান্ট গেঞ্জি পরা থাকে। আজ কিছু বললে দিলু শান্ত থাকবে না। গ্রামের রাস্তা বড় রাস্তা থেকে ঢুকে এঁকেবেঁকে চলে গেছে ক্ষেতের দিকে। এই রাস্তা এখন পাকা আর বড় গাড়ি যেতে পারার মতো চওড়া। চাষের ক্ষেতের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে মনে হবে বিরাট বড় একটা সমুদ্র যেন, যার প্রায় একুল ওকুল দেখা যায় না। আধুনিক দরিয়াপুর শহরের উত্তরে এখনো বিরাট চাষজমি আছে। সেই চাষজমির সঙ্গে, নতুনহাটা, মির্জাহাটি, মাঝেরগাঁ, সনকা সব কটা গাঁয়ের ক্ষেত জুড়ে যেন একটাই বিরাট চাষের অঞ্চল। সব মিলেই এই দরিয়াপুর। গ্রামগুলোর একদিকে ক্ষেত আর একদিকে বড় রাস্তা। এখন রাস্তাঘাট সবই ভালো। যাতায়াতের সুবিধে হয়েছে অনেক বেশি। দরিয়াপুর শহরের একদম পেছনে নতুনপাড়ায় কলবাবুর তিনতলা বাড়ি। সেই তিনতলা বাড়ির ছাদে ওয়াচ টাওয়ারের মতো বানানো। দিলু উঠেছিল ওর ওপরে। সেই মাথায় চড়ে দূর থেকে এই বিরাট আবাদকে কিছুদিন আগে মজে যাওয়া লেকের মতো লেগেছিল। কিন্তু দিলুর এসব জীবন ভালো লাগে না। ও চায় কিছু টাকা জমিয়ে ব্যবসা করতে, তার জন্য যা করতে হয় করবে। গরিব হয়ে বাঁচার কোন মানে হয় না। এই চাষাভুষোগুলোর খাটনির তুলনায় লাভ খুব বেশি হয় বলে মনে হয় না। এগুলোকে পৃথিবীতে কেঁচোর মতো মনে হয় ওর। থাকলেও কি না থাকলেও কি। ক্ষমতা না থাকলে কেউ কাউকে পোঁছে না কোনদিন। ক্ষমতা দিলুর দরকার। লাথি-ঝ্যাঁটা খাওয়ার দুনিয়ায় ও আর ফিরে যাবে না।
ওরা পৌঁছে দেখল কুমারদা সেখানে এসেছে, একাই। ও আসবে বলে দিলু জানত না। ওর সঙ্গে একদল চাষা কথা বলছে। সবার মাঝে মোরশেদ। সকলের মধ্যেই একটা বিনয়ের ভাব। দিলু এসে থামতেই সকলের কথা কয়েক মুহূর্তের জন্য একটু বন্ধ হল। মোরশেদের তাকানোয় যথারীতি একটা ঘৃণা। ওপাশের মাঠে বেশ কয়েকটা ট্র্যাক্টর জমি তৈরি করছে। মাঠে অন্য মুনিষও রয়েছে। কথা শুনতে পেল কিছুটা।
--আমরা মহাজনরে মানি কুমারবাবা। কিন্তু একবার ভাবেন পেটের কথা। কি খেতে দেব বাড়ির কাচ্চা বাচ্চাগুলোয়? আমাদের চাষ দিতে হবে।
--আমরা যাব কোথায়? আশপাশের লোকগুলো কেউ করজোড়ে মিনতি করছে, কেউ চিৎকার করছে।
--তোমাদের সব কথা তো শুনলাম, আমি সব গিয়ে বলব। আলোচনা করব। আলোচনায় এ পৃথিবীতে সব হয়। আর এসব কথা ঠিক নাও হতে পারে। আমি নিজে এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। তোমাদের মনের কথা আলাদা করে শুনব বলে আমি একা এসেছি।
--আপনার কথা আলেদা। আপনার পূর্বপুরুষদের অন্ন পেটে পড়েছিল আমাদের বাপ ঠাকুরদার। কিন্তু একটা কথা বলি কুমারবাবা এসব কুত্তাগুলা যেন গ্রামে না আসে। শেষের কথাটা মোরশেদ সরাসরি দিলুর দিকে তাকিয়ে বলে।
দিলুর মাথায় রক্ত চড়ে গেল ফস করে। লাফিয়ে মোরশেদের গেঞ্জির কলারটা ধরে চিৎকার করে বলল -- আমায় তুই কুত্তা বলিস। দিলুকে কুত্তা বলিস। নিজেকে কি ভাবিস? বাঘ? কলবাবুর জমিতে খাস আবার তার বিরুদ্ধে বলিস। তোকে আজ পুঁতে ফেলব। বলতে বলতেই মোরশেদেকে সে এক থাপ্পড় কষায়। মোরশেদও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়, সেও সমান বলশালী। দিলুর মুখে সে মারল পালটা ঘুষি তারপর দুজনেই পড়ল মাটিতে উল্টে। যেন শুরু হল দুই সিংহের লড়াই। কুমার কিছু বুঝে ওঠার আগে মুহূর্তের মধ্যেই ঘটে গেল এই ঘট না। কুমার চিৎকার করে ওদের ছাড়ানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু কোন লাভ নেই। কোন ভাবেই কাউকেই থামানো যাচ্ছে না। গোঁ গোঁ করে দুজন মুখে বীভৎস আওয়াজ করে মারামারি করছে। কোন কথা নেই। শুধু নিশ্বাস প্রশ্বাস এর ফোঁস ফোঁস শব্দ আর ঘাম, লালা, কাদা আর রক্তের ছিটে মাখা দুটো বীভৎস শরীরের ঠোকাঠুকি। মাঠের কাছাকাছি যারা ছিল তারা সব কি হচ্ছে দেখতে ছুটে ছুটে আসছে। কুমার ওদের থামাতে এবার নিজেই ওদের মাঝে গিয়ে পড়ল। এমন সময় ঘটে গেল আরও এক ঘট না। একটা কমবয়েসি ছেলে সে কিছু খেয়াল না করেই এদিকে ছুটে আসছিল মাঠ বরাবর কি হচ্ছে দেখবে বলে। হঠাৎ করেই তার গায়ে হুরমুড়িয়ে এসে পড়ল পাশ থেকে আসা এক ট্র্যাক্টর।
দুরন্ত গতিতে গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কুমার। ছেলেটাকে কোলে করে পেছনে বসে আছে মোরশেদ। রক্তে ভেসে যাচ্ছে সব কিছু। সেই রক্ত দৃশ্য দেখে কুমার প্রথমে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল। তারপর সামলে গেছে। শরীরে নিচের অংশটার ওপরে ট্র্যাক্টর চলে গেছে। একটা পা ট্র্যাক্টরের ফলার নিচে ছিন্নবিচ্ছিন্ন। আর একটা পায়ের ওপর চাকা গেছে কিন্তু ফলা যায়নি, তার আগে ট্রাক্টর থামাতে পেরেছিল ড্রাইভার। আর কোথায় কি লেগেছে এই মুহূর্তে বোঝা যাচ্ছে না। গাড়িতে তোলার সময় তখনো জ্ঞান ছিল। প্রথমে চিৎকার করছিল, তারপর গোঙাচ্ছিল আর এখন মনে হয় আর হুঁশ নেই। মোরশেদ ছেলেটার গালে হাল্কা চাপড় মেরে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিল। বার বার চেঁচাচ্ছিল -- মোশারাফ, মোশারাফ, ভাই এ ভাই দেখ আমার দিকে। ঘুমোসনা ভাই। ঘুমোস না। এখন আর কিছু বলছে না। ছেলেটার মাথা কোলে নিয়ে বাইরে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তিন চারটে বাইক গ্রাম থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছে। সবার আগে দিলু আর বেদো। দিলুই একজনের গামছা নিয়ে ছেলেটার পায়ের কাটা জায়গাটার ওপরে শক্ত করে বাঁধন দিয়েছে। এতে রক্ত পড়া একটু হলেও কমে। এ রকম রক্তারক্তি দিলু সারাজীবনে প্রচুর দেখেছে।
জেলা হাসপাতালে ভর্তি করানো গেল। এখনো প্রাণ আছে। কুমার থাকায় কিছুক্ষণের মধ্যেই অপারেশনও করা সম্ভব হোল। পাঁচ বোতল রক্তের মধ্যে তিন বোতল জোগাড় করা গেল আর বাকি দু বোতলের জন্য সঙ্গে থাকা কারোরই রক্ত মিলল না, মিলল বেদো আর দিলুর। ছেলেটা মোরশেদের আপন ভাই। হাসপাতাল চত্বরটা যেমন হয়, ওষুধ -- অ্যালকোহল -- ব্লিচিং আর অসংখ্য মাছি ও হাড়হাবাতে মানুষের ভনভনানিতে নিজেই একটা পেকে ওঠা দগদগে ঘা। এখন সন্ধে পেরিয়েছে, মশার সংখ্যা বাড়ছে। কুমার চলে গেছে। বলে গেছে কোন কিছু দরকার হোলেই ফোন করতে, সব সময়ে ফোনে পাওয়া যাবে। মোরশেদের মুখে কোন কথা নেই। তার গ্রামের দুজন রয়ে গেছে। আর রয়ে গেছে দিলু আর বেদো। দিলু কেন রয়ে গেল নিজে জানে না। সবাই বাইরে গিয়ে খেয়ে এসেছে। মোরশেদ ছাড়া। রাত বাড়তে থাকে। ওরা মেন বিল্ডিঙ পার করে মূল দরজার পাশে গাড়ি রাখার শেড দেওয়া জায়গাটায় বসে আছে। ওয়ার্ডের আলোগুলো আস্তে আস্তে নিভে যায় কিন্তু বাইরের আলোগুলো নেভে না। এইখানেই গামছা পেতে লোকদুটো নমাজ পড়ল। তারপর একসময় ঘুমিয়েও পড়ল। বেদোও ঘুমিয়ে পড়েছে, মুখে একটা রুমাল চাপা দিয়ে। রুমালের ওপর দিয়ে বোঝা যাচ্ছে ওর মুখটা হাঁ হয়ে আছে সেখানে রুমালটা একটা শুকিয়ে যাওয়া ছোটো পুকুরের মতো অবতল তৈরি করেছে। তার ওপরেই একটা মাছি বসে এদিক ওদিক করছে। এখানে দিলু ঘুমোতে পারবে না। দিলু কোনকালেই যেখানে সেখানে ঘুমতে পারে না। একবার ও তাকাল কোনাকুনি, উলটোদিকের দেয়ালে হেলান দিয়ে ঠায় বসে থাকা মোরশেদের মুখে। সে চোখেও ঘুম নেই, দিলু অবশ্য বুঝলনা সে চোখে কোন ভাষাও নেই। উঠে গিয়ে একটা সিগারেট এগোল মোরশেদের দিকে। মোরশেদ নিল, ঠোঁটে রাখল, দিলু ধরিয়ে দিল আগুন।
হুটার বাজিয়ে একটা হঠাৎ অ্যাম্বুলেন্স ঢুকল। দিলু ধড়মড়িয়ে জেগে ওঠে। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল। রাত এখন দুটো বেজে গেছে। বেদোর মুখের রুমাল হাওয়া, লালা গড়িয়ে পরছে কষ বেয়ে। অন্য দুটো লোক পাল্লা দিয়ে নাক ডাকছে। মোরশেদকে দেখতে পেল না। উঠে পড়ল। বাইরে বেরিয়ে ড্রেনটায় পেচ্ছাপ করল। দোকান গুলোতে হাল্কা ভীড়। চা বিক্রি হচ্ছে। চা খাবার ইচ্ছে হল। তারপর আবার কি মনে করে মোরশেদকে খুঁজতে ঢুকল হাসপাতাল চত্বরে। দেখল মেন বিল্ডিঙের সামনে বড় বকুল গাছটার তলায় গোল করে বাঁধানো বেদিটাতে মোরশেদ বসে আছে। কাছে গিয়ে দাঁড়াল দিলু। ইশারায় মোরশেদ তাকে বসতে বলল পাশে। দিলু বসল। দিলুর হাতটা নিজের দুহাতে নিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে মোরশেদ বলল-- তোর রক্ত এখন আমার ভাইয়ের গায়ে। বিড়বিড় করে বলে যেতে থাকলো -- খোদা জানেন কোন দিন একদানা ধানও আমরা কম দেই নাই। এক পাল্লা আলুও কম মাপতে দিই নাই। আমি থাকতে মির্জাপুরের মুসল্লি হিন্দু কেউ মহাজনরে ঠকায় নাই। কিন্তু দিলু যথারীতি কিছুই বুঝছে না। তার কিছুই জানা নেই। তবে আজ সারাদিন ধরে যা ঘটেছে তাতে অনেক কিছু প্রশ্নই তার মনে আসছে। কিন্তু প্রশ্ন করে সে কি করবে। সে তো এর কোন সমাধান করতে পারবে না, সে চায়ও না। কোনদিনই ঘটতে থাকা ঘটনা গুলোর ওপর তার নিজের নিয়ন্ত্রণ তেমন ছিল না আর সে নিয়ন্ত্রণ করবেই বা কেন। সে রোজগার করতে চায়। তার সাহস আর শক্তিতে সে অনেক কাজ করেছে। একা কত ফুটবল ম্যাচ জিতিয়েছে, গ্যালন গ্যালন মোম গলিয়েছে, এক পুকুর মাটি কেটেছে, হকারি করেছে, দূর পাল্লার বাস চালিয়েছে, মাছের লড়ি টাইম মতো কাঁটায় ঢুকিয়েছে, এক কোপে মুরগি--ছাগল জবাই করেছে, এমনকি খানকির ছেলে মানুষও মেরেছে। কিন্তু কোন কাজও খুব ভেবেচিন্তে করেনি। হয়ে গেছে। হাঁ দিলু স্বার্থপর, ধান্দাবাজ। হোক সে ধান্দাবাজ কিন্তু জেনেবুঝে ক্ষতি বা উপকার সে করেনি কখনো। আজও সে এত ভেবেচিন্তে এদের সঙ্গে নেই। হয়তো কোথাও একটা কিছু খারাপ লাগছিল। হয়তো কোথাও দায়িত্বও ছিল। কলবাবুর জমির চাষি এরা। এদের কাছে থাকা মানে কলবাবুর হয়েই কাজ করা। আর কলবাবু ওকে ভাই বলেছে। কলবাবুর মতো লোক ওকে ভাই বলেছে। -- মোশারফকে আমি বাপ মরে যাবার পর কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি। ওর রক্তে আজ আমার আদরের খেত রাঙা হোল। ও না বাঁচলে এ জমির ধান আমার পেটে ঢুকবে না। আমি কি ভাবে চাষ দেব। হাউ হাউ করে দিলুকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে মোরশেদ। দিলু কোন কথা বলে না। কি বলবে সেটাই ভেবে পেল না।
ছেলেটা বাঁচল না। দুটো পা বাদ দিতে হয়েছিল। বুকে মাথাতেও চোট পেয়েছিল ভেতরে। জ্ঞান আসেনি আর। তৃতীয় দিন ভোরবেলায় খবর পেল শেষরাত থেকে আর নিশ্বাস পড়েনি। মোরশেদ আর দিলু কেউই হাসপাতাল থেকে নড়েনি ওই দুদিন। বেদোকে দিলু আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিল দরিয়াপুর। দুপুরবেলা মির্জাপুরে লাশ দাফন করে রাতে দিলু ফিরল নিজের ঘরে। রাতেই ফোন পেল ঝুমার, হাসপাতালে থাকার সময় বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছিল দিলু, ঝুমা ফোন ধরেনি। প্রথমে খুব কান্নাকাটি করছিল। কিছুই বলছিল না। তারপর অনেকক্ষণ বাদে বলল বহুদিন পরে ও দরিয়াপুরে বাপের বাড়িতে এসেছে। আবার কাঁদল তারপর আবার বলল ও আর দেখা করতে পারবে না কোনদিন। দিলুকে ভুলতেও পারবে না কোনদিন। দিলু যেন ওকে ভুলে যায়। ওর পেটে এখন বাচ্চা।