প্রতিবারই বছর শেষের কেকের গন্ধ ফুরোতে না ফুরোতেই নতুন বছর আসে। কিন্তু এবারের সালটা যেন জীবনের নতুন ধাঁচের সঙ্গে মিলিয়ে এসেছে। ২০২০, সহজে টোয়েন্টি টোয়েন্টি। সুনীল গাওস্কর থেকে রোহিত শর্মায় বদলে গেছে সময়। সূর্যশেখরের পাণ্ডুলিপি লেখার কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে চলে গেছে বেশ কয়েক বছর। আর শেষ ঘটনাটির পরে আরও প্রায় বছর চার পাঁচেক। তার মানে প্রথমে যে ছিল পঁচিশ-- ছাব্বিশ সে হয়েছে তিরিশ আর যে ছিল মধ্য তিরিশের সে ছুঁয়েছে চল্লিশের কোঠা। সময়ের নিজের বয়েস বাড়ে না। শীতের শিশির এখনো জমে আলু পাতায়। দরিয়াপুরের গায়ে যেমন জমে থাকে মফঃস্বলি গন্ধ। চোখ না ফোটা কুকুর ছানাদের মৃদু ডাকে শীতের সকাল আসে। শীত জমে ওঠে মাফলার, হনুমান টুপি আর সস্তার জ্যাকেটে। ফেলে আসা দিনের আঁচে হাত গরম করতে করতে বুড়ো হয় মানুষ। এর মধ্যেই ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতে টানা দ্বিতীয় বারের জন্য কেন্দ্রে নির্বাচিত হয়েছে এন ডি এ সরকার। পশ্চিমবঙ্গেও তাদের প্রভাব বেড়েছে। আগস্ট মাসে কাশ্মীরের সেই বিতর্কিত ৩৭০ ধারা বাতিল করা হয়েছে। কাশ্মীর কেন সারা ভারত তাই আবার অশান্ত। শেষ ডিসেম্বরে পাশ হয়েছে সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট। কেন্দ্রের উল্টো দিকে থাকা সমস্ত পার্টির তরফ থেকে সারা ভারত জুড়ে জোর কদমে শুরু হয়েছে এন আর সি ও সি এ এ বিরোধী আন্দোলন। বেশির ভাগ মানুষ অবশ্যই এবারও কিছু না জেনেবুঝেই কোন এক পক্ষকে মুণ্ডুপাত করা শুরু করে দিয়েছে। জল্পনা-কল্পনা, চিন্তা, দুশ্চিন্তা সব ঢুকে পড়েছে মনে। চিন্তা তো হবেই। রাতারাতি একসময়ে যেমন একটা গণ্ডি বিদেশি করে দিয়েছিল বাংলার এপারের ওপারের মানুষকে, তেমন যদি রাতারাতি দেশের ভেতরেই ভিনদেশি বলে জেলে চলে যেতে হয়। চতুর্দিকে কতগুলো নতুন শব্দ, এন আর সি, সি এ এ, এন পি আর। কেউ বুঝে উঠতে পারছে না কি হতে চলেছে, সাধারণ মানুষ তো কখনোই কিছু বুঝে উঠতে পারে না আর তাদের না বুঝতে চাওয়ার রাস্তাটাকেই সস্তা রাজনীতি খোলা রাখতে চায়। এপক্ষ ওপক্ষ সব্বাই। অসমে অনেক আগেই এসব নিয়ে মাতামাতি, আইন আদালত হয়ে গেছে। এর মধ্যে সেখানে ১৯ লক্ষ বৈধ মানুষ নাগরিকত্ব হারিয়েছেন। তাদের অনেকের জন্ম ও বেড়ে ওঠা আবার অসমেই। মানুষ তাই ভয় পাচ্ছে। গরিব মানুষের ভয় আরও বেশি। চারপাশের এই পরিস্থিতে নিজেদের অজানা ভবিষ্যৎ নিয়ে তাই তারা চিন্তিত। আইন তৈরি হলেই অবশ্য তার প্রয়োগ নাও হতে পারে। সারাভারতে এর প্রভাব কি হবে সে ভবিষ্যৎ জানে। কিন্তু একটা অদৃশ্য চকচকে খাঁড়া যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে মাথার ওপরে, আলোতে আর রাতের অন্ধকারে।
এবারে শীত যেন কামড়ে ধরে আছে। আলু তোলার সময় এসে পড়েছে। কিছু জমিতে শুরু হয়েছে আর কিছু জমিতে শুরু হবে। আর হবে শীতের ধান। আর এসবের মধ্যেই এক নতুন খবরে অফিস কাছারি, স্কুল কলেজ, বাজার ঘাট, চায়ের দোকান সরগরম। চায়না থেকে ইউরোপ আমেরিকা হয়ে ভারতে করোনা ভাইরাস ঢুকে পড়েছে। এ দেশে তিরিশে জানুয়ারি প্রথম কেস পাওয়া গেছে। মারাত্মক ছোঁয়াচে সে রোগ, মৃত্যু অবধারিত। ওলাওঠা আর প্লেগের মতো ভয় নাকি ফিরে আসছে সারা পৃথিবী জুড়ে। ভারতের মানুষের শরীরের ইমিউনিটির জোর, চায়নার মুণ্ডুপাত থেকে গোচোনার শক্তি সবই আসছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। মানুষের জীবনে আবহাওয়া ছাড়াও খেজুরে আলাপের এক নতুন বিষয় হাতে এসেছে। ভালই চলছে যা যেমন চলার। হারুর মোমবাতির কারখানা, পবনের চায়ের দোকান, ভুবনের খেত আর বেদোর প্ল্যান ভেঁজে যাওয়া সেসব যেমন চলার কথা ছিল তেমনই চলছে। ভুবন এই শীতেও ধান, আলু বা সবজি কোন চাষেই কীটনাশক ব্যবহার করেননি। সোলার লাইট ট্র্যাপ, ইয়েলো স্টিকার আর ফেরোমন ট্র্যাপ দিয়ে পোকা দমন করে চলেছেন। কাজও দিচ্ছে বেশ। আর অন্যদিকে টুকটাক ঝামেলার মধ্যেও ভানু সাহা বেশ ভালই সামলে দিচ্ছে। নলেজ সিটির নাম হয়েছে গ্লোবাল এডুকেশন ভিলেজ। সেখানে পড়াশোনা শুরু হয়ে গেছে জোরকদমে। কারখানার বিষয় নিয়ে যদিও ধোঁয়াশা পরিষ্কার হয়নি। ভারতীয় আইনি ব্যবস্থার মন্থরতায় কুমারদের শাপে বর হয়েছে। সব পক্ষই চুপ করে আছে। যে জমি সরকার নেয়নি সে জমিতে চাষবাষও চলছে। আর কারখানার জন্য সরকার অধিগৃহীত জমিতে তৈরি হয়েছে জঙ্গল। বেশ বড় জঙ্গল। কুমারের স্কুলেও পড়াশোনা চলছে। সেখানে একদম পিছিয়ে পড়া পরিবারের ঘরের ছেলে মেয়েরা প্রতিদিন পড়তে আসে, জাত ধর্ম নির্বিশেষে। সপ্তাহ শেষে বড় ছোটো সবার জন্য ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকে চাষ আবাদ, আবহাওয়া, ঋণ ও সামাজিক অধিকার ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে। এছাড়া স্পোকেন ইংলিশ, কম্পিউটার ও হিসেব রক্ষণ সম্বন্ধে সপ্তাহান্তে নিয়মিত ক্লাস হয়। সেখানে দিলু থাকে। দিলু প্রাইভেটে মাধ্যমিক পাশ করেছে। সে বদলে গেছে অনেক। ওর নিজের জড়তা কেটেছে, নিজের ওপর আস্থা বেড়েছে, আত্মবিশ্বাস এসেছে ওর নিজের কথা বার্তা আর চালচলনে। পরিকল্পনা বা ব্যবসা বাণিজ্যের হিসেব সবকিছুই সে নিজের দায়িত্বে করতে পারে। শেয়ার বাজার থেকে শেষের কবিতা সবেতেই তার নিজের কিছু মতামত সে দিতে পারে। সকলের সামনেই পারে। সে এখন অন্য কোথাও সময় কাটায় না বিশেষ। ক্লাব বা দল সব কিছুরই ওপরে তার নিয়ন্ত্রণ বেড়েছে। কলবাবুর প্রভাব তার ওপরে তেমন নেই কারণ কলবাবু শেষ ভোটে দাঁড়িয়েও জেতেননি। বরং সরাসরি স্থানীয় বিধায়কের সঙ্গে দিলুর পরিচিতি বেড়েছে। কুমারের ব্যবস্থায় ট্রান্সপোর্টের ব্যবসার লাইসেন্স নিয়েছে। ওর নিজের মালিকানায় কন্সট্রাক্সনের কাজ শুরু করেছে। বালি, ইট, সিমেন্টের ব্যবসার ঘাঁতঘোত তো সে জানতোই। নিজের পরিচিতির জগত তৈরি করতে পেরেছে সে। কুমার ওর মধ্যে এই বিরাট পরিবর্তন দেখে মুগ্ধ। বুদ্ধির সঙ্গে ইচ্ছে আর মেধা থাকলে কেউ যে স্বশিক্ষিত হয়ে উঠতে পারে দিলুই তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। দিলু ছাড়া দরিয়াপুরের মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে কারোরই তেমন পরিবর্তন হয়নি। বেদোর তো এক্কেবারেই নয়। সে দিনকে দিন পোড়ো কারখানাটার অংশ হয়ে উঠছে যেন। কিন্তু তার এ বিষয়ে কোন হেলদোল নেই। হারু, ভুবন, পবন, সত্য আরও এমন বাকি মানুষের জীবন একই রকম আছে। কুমারের নিজের ফার্ম অবশ্য ভালো চলছে। যার ফলে দরিয়াপুরের কাজেও মনোনিবেশ করতে পারছে আর খরচের জোগানও চালিয়ে যেতে পারছে। দেশ বিদেশের বন্ধুরা ওকে সাহায্য করছে ও করবে বলে কথাও দিয়েছে। কিন্তু ওর নিজের মনে কেন জানা নেই সামনের সময়টাকে খুব অস্থিরতার সময় বলে মনে হচ্ছে। সারা পৃথিবীতে যে ভাবে করোনা নিয়ে আতঙ্ক, বিভ্রান্তি ও মৃত্যুভয়ের আশঙ্কা শুরু হয়েছে তাতে সামনে এর ঢেউ ভারতে খুব তাড়াতাড়ি এসে পড়বে বলে মনে হচ্ছে। সবটাই গ্লোবাল পলিটিক্সের ট্রেন্ড আর গ্লোবাল মেডিকাল ও ইকনমিক স্ট্রাটেজির ওপর নির্ভর করবে বলে মনে হচ্ছে। চায়না লকডাউন করেছে, বাকি ক্ষমতাবান দেশ গুলোও হয়তো করতে চলেছে। এই অবস্থায় ভারত কি করবে সেই দেখার। কিন্তু লক ডাউন করলে কীভাবে চলবে সাধারণ মানুষের। এই মুহূর্তে ইন্টারন্যাশনাল বর্ডার বন্ধ করে দিলে ভালো হয়, প্রথম কেসের আগেই ফ্লাইট বন্ধ করে দিলে ভালো হতো। ছড়ানোটা আটকে দেওয়া যেত। যে সব দেশে ছরিয়েছে সেখানে মানুষগুলোর জীবনে যে কি হচ্ছে কে জানে। ওর বিদেশি বন্ধুরা আতঙ্কে রয়েছে। এমন দিন আসতই। মানুষ প্রকৃতিকে রীতিমতো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। প্রকৃতির হয়ে কোন রাজনৈতিক দল একটাও কথা বলে? প্রকৃতি যদি বলে এই কীট--পতঙ্গ, গাছ--পালা, নদী--পাহাড়, মারবেল রক বা হিরের খনিতে মানুষের কোন অধিকার নেই। সেই কথা কেউ মানবে? মানবে না। তাই এমনই হবে। সচেতন মানুষরা অনেকেই ভাবছে এমন কথা আর এর মধ্যে দিয়েই দিন কাটছে এক এক করে। এমন করতে করতেই মার্চের মাঝামাঝি সরকারি হিসেবে কোভিডে তিন জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেল। ঘটনাচক্রে এরই মধ্যে দিলু একটা ট্রান্সপোর্টের কাজ পেয়ে গেল। নতুনহাটের চাষিরা সরাসরি চাল পাঠাচ্ছে বম্বে ডকে। স্পেশাল বাসমতি। ওর কাছে এ এক দারুণ সুযোগ। বেশ কিছু লড়ি জোগাড় করে ও কাজ শুরু করে দিল। কিন্তু সব দিক সামলাতে হলে সঙ্গে দিলুকে যেতে হবে। ফেরার পথে ট্রাকগুলো মাল ভর্তি করে নিয়ে আসতে পারলে আর কে দেখে। দিলু বেড়িয়ে পড়ল। আর শিউলি?
-- আসুন।
সূর্যশেখর এসে দাঁড়ায় ঘরটার ভেতরে। তারপর একটু দেখে নেয় চারপাশ। নিস্তব্ধ রাত। গরম নেই, বরং হালকা ঠান্ডা। মৃদু হলুদ আলোয় অন্ধকারও মৃদু। তাকায় শিউলির দিকে। শিউলির গায়ে সাদা শাড়ি। সে সাদা রঙও মৃদু। নীল টিপ, নীল ব্লাউসের সঙ্গে শাড়ির পাড় আর আঁচলেও নীল চিকনের কাজ। শাড়ি সিল্কের তাই শরীর ছুঁয়ে। সেই শরীর যা তার চেনা বা হয়তো অচেনা।
—দাড়িয়ে কেন বসুন? সূর্যশেখর সোফায় বসলে শিউলিও বসে। জিজ্ঞেস করে -- কতদিন বাদে এলেন! কেমন আছেন আপনি?
—চলে যাচ্ছে।
সে দেখল শিউলির চোখ মুখে আনন্দ। সে আনন্দে উচ্ছলতাও আছে। আগে এমন করে তাকে দেখেনি কখনও সে। কারণ মনের ভাবের প্রকাশ তার কখনো ছিল না। সে করত না। শিউলির মুখে উচ্চকিত আনন্দ তার নিজের মধ্যে ঘুরতে থাকা চিন্তাকে আরও তীব্র করল। অভ্যেস মতো শিউলির দিকে সে তাকিয়ে থাকতে চাইছিল, কিন্তু সে পারছে না। তার কষ্ট হচ্ছে। চোখ রাখল সোফার কোণায়। সোফার কভারের ওপরে সূক্ষ্ম করুগেশনের মতো। সারি সারি লম্বা লম্বা। সেই করুগেশনের দিকে তাকিয়ে থাকল এমনিই। এমন কভার ছোটবেলাতে ও দেখেছে, পিসির বাড়িতে। পিসির বাড়িতে চোরের মতো গিয়ে পরে থাকত শুধু বই পড়বে বলে। বয়েস তখন কত। সাত কি আট। অসংখ্য বইগুলো কেউ কোনদিন পড়ত না। শিশুসাথি, আলোর ফুলকি, সন্দেশ বাড়িতে কে দিত আর তাকে। পিসির বাড়িতে বই সাজান থাকত থরে থরে। যেমন সাজান থাকত পিয়ানোটা বা বিদেশি মদের দামি দামি বোতল। কোনোটাতেই কাউকে সে কোনোদিনও হাত দিতে দেখেনি। বড়লোকের বাড়িতে অনেককিছু সাজিয়ে রাখাটা যে ব্যবহার করার থেকে বেশি গুরত্বপূর্ণ সে কথা বুঝতে পেরেছিল তখন। গ্রামের স্কুলে পড়া ছেলের পার্ক স্ট্রিটের বিরাট বাড়িতে ঢুকতে বাধো বাধো ঠেকত, শুধু বইয়ের লোভে ঢুকে পড়ত বুকে পাথর চাপা দিয়ে। তারপর পেছনের চিলতে বারান্দায় ছোট্ট শেডের নিচে গ্যাসের সিলিন্ডারের পাশে বসে বসে পরে ফেলত একের পর এক বই। শেডের ওপরে টবে নিম গাছ। টবে নিম গাছ সে আর কোথাও দেখেনি। আর বসার ঘরে সোফার পাশেই পাম গাছের একটা বনসাই। বাড়তে না পারার দুঃখ নিয়ে বসে থাকা সেই গাছ মহিমান্বিত করে যেত ঘরের দৃশ্যপট। এখানেও তেমন একটা কিছু গাছ। কি অদ্ভুত মিল। চীনেমাটির শেড থেকে নেমে আসা হলুদ বাল্বের আলোয় মিলে যেত বাইরের ট্যাক্সি আর ট্রামের আওয়াজ। গ্রামের ছেলের কানে সেগুলো আসত বারবার। সে ছিল সাজানো জগত। শহরের গর্ব নিয়ে আসত স্বপ্নের হাতছানি। সে কেন যেত সেখানে! কেন সে এসেছে এখানেই! জানে সে এসেছে টানে, যে টানকে পরাহত করার ক্ষমতা তার কেন, সৃষ্টিকর্তারও নেই। সে আসবে না তো কে আসবে। কিন্তু তার যে কষ্ট হচ্ছে। না পাওয়ার কষ্ট হচ্ছে। কবে থেকেই তো সে জানে -- থাকেনা কিছুই কাছে। শুধু সে আছে মূল্যহীন। তার নিজের সময়কে মূল্যবান করার তাগিদে। এ এক নিজেকে জা না। প্রত্যেক অক্ষরে নিজেকে জা না। নিজের ইচ্ছেগুলোই তো বেড়িয়ে আসে শব্দ হয়ে। কখনো প্রচণ্ড বিস্ফোরণে, কখনো পেলব আদরে। কখনো নির্মোহ পদচারণায় এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। কেউতো তাকে বলেনি এমন হতে, কিন্তু সে হয়েছে। সে হয়ে চলেছে দিনকে দিন এক পাগল। নিজেকে পাগল ভাবতে কারো কারো ভালো লাগে। বেশ গর্বের কারো কারো কাছে। কিন্তু এ তার নিজের গোপন কথা। সে বলবে কাকে। বলার যে মানুষ সে যে চলে গেছে আস্তে আস্তে দূরে। তার নাগালের বাইরে। তাকে যে আর চাইলে পাওয়া যায় না, রাখা যায় না কাছে, ধরা যায় না এই দুহাতে। খুব কষ্ট হচ্ছে যে সূর্যশেখরের। কি ভাবে আর লিখবে সে। যে জন্য সে বেঁচে আছে প্রতিদিন তার কি হবে। সে কেন আবার সেই ছোটো ছেলের মতো করছে? কেন তার এমন হল এই পরিণত বয়েসে? কেন সে এই ক্ষরণ থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারছে না। কিসের জন্য সে দুর্বল হয়ে পড়ছে? এই মেয়ে কে তার? কেউ তো নয়। তাহলে এত কষ্ট পাচ্ছে কেন? ঈর্ষা না হেরে যাওয়া? না সত্যি করেই হারিয়ে ফেলার বেদ না। সে কেন এমন দুর্বল হয়ে পড়ল। সে কেন আগের মতো শিউলির দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছে না। কেন তার বলতে ইচ্ছে করছে -- যেও না তুমি কোথাও।
—আপনার জন্য চা আনতে বলছি। সম্বিৎ ফিরল শিউলির কথায়। শিউলি এগোল ঘরের অন্য প্রান্তে বিছানার পাশে থাকা ফোনের উদ্দেশ্যে। তার ওঠা, তার হেঁটে যাওয়া চেয়ে দেখে সূর্য। যেন শান্ত সরোবরের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে তরঙ্গ উঠল হঠাৎ। রাজহংসীর মতো গ্রীবা উঁচিয়ে সে চলে গেল শান্ত সন্তরণে। এই নারী তার কেন নয়!
—আপনার কী হয়েছে?
—কিছু না। তোমার কথা বল।
—কিছু তো হয়েছেই। আমার কথা তো আপনি জানেন।
—না সব জানি না। আন্দাজ করতে পারি। তুমি বল।
—পয়লা বৈশাখ আমি বিয়ে করছি। ঝকঝকে চোখে বলে উঠল শিউলি।
—আচ্ছা।
—ও ফিরে আসবে সাত তারিখে। এই দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হবে হয়তো।
—এত দেরি করলে কেন তবে?
—সবাইকেই তো তৈরি হবার সময় পেতে হয়।
—কী করবে বলে ভাবছ? কীভাবে চলবে?
—কেন! চলে তো যাচ্ছে। বেশ কয়েক বছর আমি কুমারবাবুর স্কুলে পড়াচ্ছি। আরও কিছু সংস্থার সঙ্গে আছি। দিলুর ব্যবসা সংক্রান্ত কাজও দেখাশোনা করব ঠিক হয়েছে। চলে ঠিক যাবে।
—বেশ। এটা তো ভাড়া বাড়ি। বিয়ের পরে কোথায় থাকছ?
—দিলু একটা ফ্ল্যাট কিনেছে। সেখানেই উঠে যাচ্ছি। আপনার কথা বলুন।
সূর্যশেখর চুপ করে থাকে। যেমন ছিল তেমন। শূন্যতা। সর্বগ্রাসী শূন্যতায় ভরে যাচ্ছে তার মন। সে কাকে বোঝাবে সে কথা। সামনের যে নারী যাকে সে মানস প্রতিমা মনে করেছে তাকে? তার তো নিজের জীবন আছে। তাকে বিব্রত করে কি লাভ? নিজের খবর জানিয়ে কি হবে। আগের মতো একই রকম ভাবে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে যতবার ততবার সেই ইচ্ছে দ্রুত অপসৃত হচ্ছে, বারবার। তার ঈর্ষা তার মনকে অধিকার করেছে। সে বুঝতে পারছে কিন্তু বেরতে পারছে না। নিজেকে ভবিষ্যৎহীন বলে মনে হচ্ছে। সেই বুড়ো কলহনের হাসিটা কানে আসছে। আসলে অপদার্থ সে নিজে, নিজেকে এক লবঙ্গলতার মতো মনে হয়। না এমন ভাবে থাকলে হবে না। ঘুরে দাঁড়াতে হবে। এ দৃশ্য যে আজকে আসবে সে তো নিজে জানত। তবুও সে এমন করছে কেন, আর এতদিন বাদে এখানে এলই বা কেন। এই আত্মপীড়নের কী প্রয়োজন ছিল তার? অতলে ডুবে যাওয়া ছাড়া আজকের এই অভিজ্ঞতার তাকে আর কি দেওয়ার আছে। সে কি ফিরে যাবে? এক্ষুনি? সেই ভাল। মনকে শক্ত করে। কিন্তু না। সে বড্ড হাস্যকর হবে। এই পোক্ত বয়েসে এসে সে যদি কিশোরের মতো আচরণ করে তাহলে সে কি শোভা পায়! এই নারীর কাছে সে হাস্যকর হয়েই বা উঠবে কেন। কিন্তু এই নারী যে তার সব জানে। তাকে নিয়েই যে সে জীবন যাপন করেছে, শয়নে স্বপনে জাগরণে। তাহলে তার কি কোন অধিকার জন্মায় না।
চা এসেছে। পোক্ত হাতে শিউলি চা বানায়। সে জানে সূর্যশেখরের পছন্দ। এগিয়ে দেয়। সূর্যশেখর নেয়। চায়ে চুমুক দেয়। শিউলিও নিজে নেয়। তারপর তাকিয়ে থাকে কৌতূহলী চোখে সূর্যের দিকে।
—আপনি ক্লান্ত, চা খেয়ে নিন। নতুন কি পড়ছেন বলুন আমাকে। আমি পড়ব। আপনি কতটা লিখলেন পড়াবেন না?
—কী লাভ?
—এমন কেন বলছেন? কী হয়েছে আপনার? আমার ভালো লাগছে না আপনাকে এমন অবস্থায় দেখতে। আপনি বিশ্বাস করুন।
—বিশ্বাস কেন করব না তোমায়। তোমাকে ছাড়া আমি কাকে বিশ্বাস করব শিউলি। কিন্তু আমি যে বলতে পারি না।
&mdash:কী কথা আপনি বলতে পারেন না? আপনি সুস্থ আছেন তো? নাকি লিখতে পারছেন না?
সূর্য তাকিয়ে থাকে আবার শিউলির চোখে। একটা তীব্র কষ্ট বুকের কাছে জমতে থাকে। তারপরই ততোধিক রাগ। মুখ বদলে যেতে থাকে দ্রুত, সে চোখে ঘৃণা। -- সে আমার ব্যক্তিগত কথা।
—আচ্ছা। আমার এভাবে জিজ্ঞেস করা উচিত হয়নি। সত্যিই উচিত হয়নি। শিউলি খানিকটা অবাক আর খানিকটা বিব্রত হয়ে বলে। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে -- আমাকে তাহলে কি করতে হবে বলুন।
—আমি যা বলব তাই করতে হবে। —আচ্ছা। বলুন।
—আমি ভালোবাসা চাই। আগের মতো ভালোবাসা চাই।
—আচ্ছা। আমি যে পেশা ছেড়ে দিয়েছি তা আমার পক্ষে আবার শুরু করা অসম্ভব। কিন্তু আজকে এ আমার গুরুদক্ষিণা হোক। শিউলি উঠে দাঁড়ায়। সূর্যশেখরের সামনে আসে। ধীরে ধীরে নিজেকে উন্মুক্ত করতে থাকে। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে আসে, সামনে বসে, সুর্যশেখরের মাথাটা টেনে নিয়ে রাখে তার উন্মুক্ত বুকে। সূর্যশেখর সেই নরম আদরে ডুবছিল, তার শরীরে ঝিম ধরছিল কিন্তু হঠাৎ করেই সে এক ঝটকায় দূরে সরিয়ে দিল শিউলিকে। -- ছোঁবে না আমায় একদম ছোঁবে না আমায়। তারপর খানিক স্তব্ধতা। এরপর একবার ছাড়া যে দৃশ্য আমরা এতদিনে কখনো দেখিনি তাই দেখলাম। অশ্রু নামল শিউলির দুচোখ বেয়ে। নিঃশব্দে। চোখ বন্ধ করে আছে সূর্য শেখর আর সেই ভাবেই কেঁদে চলেছে শিউলি। কত সময় অতিবাহিত হয় আমরা জানি না। কেউ জানে না। তারা নিজেরাও জানে না। টং টং করে ভারী ঘণ্টা বাজিয়ে খুব জোরে চলে যেতে থাকে একটা গাড়ি, দমকলের গাড়ি। আগুন লেগেছে কোথাও। চোখ মেলে সূর্যশেখর। দেখে শিউলির চোখে তখনো জল একই ভাবে বইছে। শিশুর মতো যেন, এক্কেবারে শিশু। সূর্যশেখরের নিজের চোখে এবার জল নামে। সে টেনে নেয় শিউলির হাত। শিউলি চলে আসে কাছে, পরম স্নেহে নিজের বুকে টেনে নেয় সূর্যশেখর, হাত বুলিয়ে দিতে থাকে মাথায়, পিঠে, ঘাড়ে। তাতে শিউলির কান্না আরও বাড়ে।
—আমাকে ক্ষমা কর তুমি, দয়া কর, আমায় ক্ষমা কর তুমি।
—না না আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। আমি যে ঠিকানা চেয়েছি, সে যে বড় লোভ আমার।
—আমি জানি শিউলি। আমি বুঝি। কিন্তু আমার লোভও তো কম নয়।
—আপনি খুব কষ্ট পাচ্ছেন আমি জানি। কিন্তু আমি আর কতদিন এভাবে অনিশ্চিত জীবন কাটাব বলুন তো, আমার তো ভয় করে। আমার খুব ভয় হয়। আমি চেপে থাকতে থাকতে আর যে পারি না, আপনি তো সব জানেন। আমার কি দোষ বলুন তো।
—কেঁদো না। কান্না পুরুষকে দুর্বল করে, কিন্তু আমি জানি তুমি তেমন মেয়ে নও যাকে কেঁদে জয়ী হতে হয়। এস আমাদের শেষ দিনকে আমরা দারুণ আনন্দে কাটাই।
—জানিনা কি হবে। কেউ কি সামনে কি আছে দেখতে পায়, তবে আপনারা দুজনেই যে একদম এক হয়ে গেছেন ধীরে ধীরে। ওর কথা বলার ধরন, ওর ভাবনা চিন্তা, ওর ভালোবাসা একেবারে আপনার মতো হয়ে গেছে। হুবহু এক। হয়তো আমি ওকে আপনার মতো করে গড়ে তুলেছি। আমি জানি না আমি কি করেছি। আমি কি করতাম বলুন তো, আমি কি করতাম।
এই শূন্যতার মধ্যেও সুর্যশেখরের মনে তৃপ্তি নেমে আসে। সে যা করতে চেয়েছিল তাহলে সবটাই বৃথা হয়নি। এক্কেবারে ফেলে দেওয়ার মতো কাজ সে তাহলে করছে না। কিন্তু কষ্ট? সে তো যাচ্ছে না, বুকের মধ্যে শানিত ছুরির মতো যেন গেঁথে গেছে। বিঁধে থাকলেও অসহ্য যন্ত্রণা, বের করলেও ভলকে ভলকে রক্ত ক্ষরণ।
—আমাকে মনে রাখবে তুমি শিউলি?
—এ কথার কি উত্তর হয় বলুন তো।
—কেন? যা তোমার মনে হয় তাই তুমি বল।
—আমি যদি বলি থাকবে না তাহলে আপনি কষ্ট পাবেন। আর যদি বলি থাকবে তাতেও আপনার কোন লাভ হবে না।
—কিন্তু আমি কী করে বাঁচব?
—আপনি লিখবেন, আপনি লিখবেন, আপনি লিখবেন আর আমি যেখানেই থাকি সে লেখা পড়ব। যেমন করে আপনি আমায় প্রতিদিন শিখিয়ে গেছেন সেই কাজ চলতে থাকবে তখনো। আপনি বেঁচে থাকবেন আরও কত মানুষের মধ্যে, শুধু আমার মধ্যে নয়। আমি তো সীমাবদ্ধ। আপনি তো নন।
—তোমাকে নিয়ে যে আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম।
—কিন্তু সামনে কি হবে আমরা তো কেউ কিছু জানি না। জেনে কী লাভ?
—আচ্ছা তাহলে আমি যাই।
—আরেকটু থেকে যান। আপনাকে দেওয়ার মত কোন কিছুই নেই আমার। ইচ্ছেও নেই। শুধু আপনি আরও একটু থাকুন। আমার কাছে থাকুন।
সূর্যশেখর কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু কিছুই বলতে পারল না। সে আবার তাকিয়ে থাকল সেই সোফাটার কভারের করুগেশনের দিকে আর ফিরে চলে গেল আবার সময় ছাড়িয়ে অন্য কোথাও। আবার তার মনে পড়তে থাকল সেই পিসির বাড়ির বইয়ের র্যাকগুলোর কথা। কচি কচি হাতে একটা গাঁয়ের ছেলের সে র্যাকের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা, ঘণ্টা দুই আড়াই তিন, ঠায়। তার যে লোভ। কখন কেউ এসে তাকে একটা বই বার করে দেবে, কারণ বইয়ের আলমারিতে হাত দেওয়া তার যে বারণ।
কুড়ি তারিখ থেকে মহারাষ্ট্রে, চব্বিশ তারিখ থেকে সারা ভারতে লকডাউন হয়ে গেল। মাল খালাস করেই আটকে গেল দিলু। নতুন মাল আনবে কি, গাড়ি বার করতে পারবে কিনা, আদৌ ফিরতে পারবে কিনা সব অনিশ্চিত হয়ে গেল। সম্পূর্ণ স্তব্ধ মুম্বাই। ফ্যাক্টরি, অফিস কাছাড়ি সব বন্ধ হয়ে গেল। শুনছে করোনা ছেয়ে গেছে অলিতে গলিতে। সুনসান রাস্তা, বিদেশ বিভূঁই। চাইলেই সব কিছু ব্যবস্থা করা এই অবস্থায় বেশ কঠিন। এক সপ্তাহ কেটে গেল। কুড়িটা গাড়ির লোকজন সবাই মিলে কোনরকমে খাবার ফুটিয়ে চালিয়ে নিচ্ছে। গাড়িতেই শুয়ে কাটাচ্ছে। কিন্তু দিলুকে ফিরতে হবে। শিউলির কথা মনে পরে সারাক্ষণ। আটকে গেলে এদিকে এতগুলো গাড়ির এই খরচ কে দেবে? মালিকেরা তাদের ড্রাইভার আর খালাসির এতদিনের থাকার টাকাকড়ি দেবে কেন। ও নিজে যদি দেয় তাহলে আর লাভ কি থাকবে। পুলিশ প্রচণ্ড কড়া ধরপাকড় করছে, প্রয়োজনের থেকেও বেশি। লোকে করোনার ভয়ে বাড়ির মধ্যে গুটিয়ে আছে। কয়েকদিন পরে হয়তো অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ে বেড়িয়ে যেতে পারবে কোন কোন গাড়ি। কিন্তু মারাঠি লবি রয়েছে। যে অল্প মাল উঠছে সে ওদের লরিতেই উঠছে। ও নিজে নতুন। তারপরে এক্কেবারে চুনোপুঁটি। কিছু করতে পারছে না। পয়লা বৈশাখের মধ্যে ফিরবে কি করে। কোন উপায় ও দেখতে পাচ্ছে না। হাজারে হাজারে শ্রমিক বাড়ি ফেরার জন্য রেল স্টেশনে, বাস টার্মিনাসে হাজির। কিন্তু সব বন্ধ। সারা ভারত থেকেই অসংখ্য শ্রমিক মুম্বাইতে যায় কাজ পেতে। বিহার, উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা কোথাকার নয়। তাদের নতুন নাম হল পরিযায়ী শ্রমিক। তারা এই অভূতপূর্ব অবস্থায় সকলেই নিজেদের বাড়িতে ফিরতে চাইছিল। কোভিড নাকি মৃত্যুরই আরেক নাম, তাই তারা মরতে হলে নিজেদের মাটিতেই মরতে চাইছে। কিন্তু রোগ ছড়ানোর আশঙ্কায় তাদের অন্য রাজ্যে ফিরে যাওয়া নিষিদ্ধ হল। তা সত্ত্বেও বেশ কিছু মানুষ মাথায়, পিঠে বোঁচকা নিয়ে হাজার হাজার কিলোমিটার পথ শুধু হেঁটে ফেরার চেষ্টা করতে শুরু করল। কিন্তু অভাগা লোকগুলো স্টেট বর্ডার গুলোয় ধরা পড়ে গেল আর চালান হয়ে গেল ক্যাম্পে। রাস্তাঘাটে ওদের ওপর এলো পাথারি লাঠি চালিয়ে, মাথা থেকে রক্ত বার করে, বাক্স পেঁটরা ভেঙ্গে দিয়ে, পুলিশ বাহাদুরি করল। রেল স্টেশনে হাজার হাজার শ্রমিক ভিড় করল এই ভেবে যদি ফেরার কোন ট্রেন পাওয়া যায়। তাদের স্টেশন থেকে মেরেধরে তাড়িয়ে দিল প্রশাসন। দিলু চোখের সামনে দেখল ভাঙা ট্রাঙ্ক, ছেঁড়া চপ্পল আর কোলের শিশু বুকে একলা মা শুয়ে আছে শুনশান স্টেশন চত্বরে। যুদ্ধের পরে যেমন হয়। ঠিক তেমন। দিলুর কাছে এখান থেকে ট্রাক ভর্তি করে ফিরে যাওয়া এখন অলীক স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে। তবুও ভাগ্য সাহসীদেরই সঙ্গে থাকে। একটা অবাঙালি ছেলের সঙ্গে ওর ভাব হয়ে গেল এর মধ্যে। ছেলেটা বেশ অন্যরকম, মনোজ শুক্লা। কাজের সূত্রে কলকাতা ও মুম্বাই তো বটেই, সারাভারত ঘুরে বেড়ায়। ডক এলাকায় সব স্তরেই ওর প্রচুর চেনাজানা। ওর কথা শোনেও সবাই। একটা চুম্বকের মতো আকর্ষণ আছে ছেলেটার। জমিয়ে আড্ডা দেয় সকলের সঙ্গে। দিলুর সঙ্গে ওর জমে উঠেছে ভাল। ও আছে বলে সময় কেটে যাচ্ছে কোনরকমে। মনোজ দিলুকে মাল তোলার ব্যবস্থা করে দেবে বলেছে। বিনিময়ে কিছু মানুষকে লুকিয়ে নিয়ে যেতে হবে। দিলু লুফে নিল। পুলিশের রিস্ক আছে কিন্তু সারা পৃথিবীর পুলিশই পুজো পেলে চোখ বুজে থাকে। ঠিক হল মাল নিয়ে সব ট্রাক একসঙ্গে ছাড়বে। কিন্তু সব ট্রাকে নয় কেবল চার পাঁচটা ট্রাকেই কিছু লোক মালের আড়ালে নেওয়া হবে।
এই মুহূর্তে রাত। দিলু একটা ট্রাকের পেছনে ঢাকা জায়গাটাতে শুয়ে। বাইরে জ্যোৎস্না। সে রয়েছে শিউলির সঙ্গে ভিডিও কলে। আমরা তাদের কথা শুনতে পাচ্ছি কিছু কিছু আবার কিছু পাচ্ছিও না। যেটুকু পাচ্ছি তার খানিকটা লেখা থাকছে। শিউলি বলছে-- তুমি খাওয়া দাওয়া করছ ঠিক করে?
—হ্যাঁ। শোন, আমি আর পাঁচ দিনের মধ্যে পৌঁছে যেতে পারব বলে মনে হচ্ছে। তুমি সাবধানে থেকো।
—আমি সাবধানেই আছি। তুমি মাস্ক পড়ে থেকো সব সময়। আমি তোমার জন্য বানাচ্ছি বেশ কয়েকটা।
—গিয়ে পড়ব, এমনিতেও পড়ে আছি। কি অদ্ভুত অবস্থা চারদিকে। মনে হচ্ছে শ্মশান। সব বদলে গেছে যেন।
—তুমি কেমন করে আসবে? সব তো বন্ধ।
—ওসব ভেবো না। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
—আমার কিন্তু চিন্তা হচ্ছে।
—চিন্তা করা তোমার স্বভাব। তুমি চাইলে সারাদিন চিন্তা কর।
—করছিই তো। সারাদিনই তোমার কথা ছাড়া অন্য কথা ভাবি?
—তোমায় দেখতে খুব সুন্দর লাগছে। একটু আগে স্নান করেছ না?
—হ্যাঁ স্নান করে এসেই তোমায় কল করলাম।
—তাও ভালো। ভিডিও কল হলেও তোমায় দেখতে অন্তত পাচ্ছি। তুমি চিন্তা কোর না ঠিক সময় মতো পৌঁছে যাব।
—আমায় সব গল্প করবে ফিরে। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে।
—সব বলব।
—তুমি একটা কথা জানো?
—কী কথা ম্যাডাম?
—আমার তোমার জন্য গর্ব হয়।
—ওঃ এই কথা। আমি ভাবলাম অন্য কিছু।
—অন্য কিছু আবার কি? ওঃ বুঝেছি। সে পরে হবে।
—আমি ভেবেছিলাম তোমার জন্য কিছু নিয়ে ফিরব কিন্তু সব যে বন্ধ।
—তুমি নিজে ফেরত এস। কি কিনবে আমার জন্য, আমার তুমি ছাড়া আর কী কিছু চাই?
—স্কুল কবে খুলবে?
—কেউ জানে না।
—আচ্ছা।
—তুমি কিন্তু সাবধানে থেকো। তুমি রিচার্জ করে নিও দুটো নম্বরেই। না হলে বোলো আমি করে দেব। ভিডিও কলে যাও বা পাচ্ছি দেখতে। দুধের স্বাদ ঘোলে। টাকা ভরা না হলে সেটাও হবে না।
—আমার তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। চারিদিকে সবাই এত অসহায় এই মুহূর্তে কিন্তু আমি ভালো আছি। আমি শুধু তোমার কথা ভেবে ভালো আছি।
—আমার যে কি করছে তোমাকে কি বলি, কষ্ট হচ্ছে, ছটফট করছি। পড়তে পারছি না। বইগুলোকে দেখেও কষ্ট হচ্ছে। চাইছি শুধু তুমি থাকো পাশে।
—আমারও পাগলের মতই লাগছে। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। এই রাস্তা যে আমায় টানত তাকেও ভালো লাগছে না। তোমার সঙ্গে চুপ করে ঘরের কোণে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে।
—একটা সত্যি কথা বলব?
—বল।
—এই ভয়ঙ্কর দুঃসময়ে না পড়লে তুমি আমার সঙ্গে কোনদিনই এত কথা বলতে না দিলু।
—আমি যে মনে মনে তোমার সঙ্গে কত কথা বলি সে যদি তুমি বুঝতে। আমার বাইরের চুপ থাকাটাই দেখো শুধু।
—আমি তোমার সব বুঝি।
—আমার কোনো দিন যা হয়নি আজকাল তা হচ্ছে। আমার কোথাও একটা কষ্ট হচ্ছে। এই রাত যেন মনে হচ্ছে গিলে খেতে আসছে। মনে হচ্ছে একটা অন্ধকার যেন শত্রু, এই চাঁদ যেন শয়তানের মুখোশ। আমাদের গিলতে আসছে।
—আমারও তোমাকে ছাড়া কিছু ভালো লাগছে না দিলু।
—বাইরে এখানে একটা ঠান্ডা হাওয়া। কিন্তু শিউলি সেটাও মনে হচ্ছে একটা ফাঁদ, সেটা আমাকে মেরে ফেলতে পারে। তুমি সঙ্গে থাকলে মনে হত কেউ আমায় কিচ্ছু করতে পারত না।
—আমি তোমার সঙ্গেই আছি। সব সময়ে আছি। শুধু তুমি দেখতে পাও না।
—আছো বলেই হয়তো ভয়। চারদিকের এই মৃত্যু এই অসহায়তায় আমার ভয় নেই। কিন্তু এ ভয় তবে কেন শিউলি?
পাদানিন্দোরমৃতশিশিরাঞ্ জালমার্গপ্রবিষ্টান্নিমীলিত চোখে আবৃত্তি করে চলেন বৃদ্ধ। তারপর নিজের মনেই বলতে থাকেন। কালিদাস, কালিদাস। এই সময় কত নির্মম অথচ কত উপভোগ্য। আমার প্রিয় কবি স্বয়ং বুঝেছিলেন প্রেমের এই মর্ম। পেলবতা, মাধুর্য আর আবেগে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই অনন্ত সত্য -- মিলনে যে চাঁদের আলো আনন্দের, বিরহে সেই অসহ্য। শরতের স্থলকমল প্রভাতের আলোয় পূর্ণ বিকশিত হয়। কিন্তু সে শরতেরই মেঘলা প্রভাতে থাকে আধফোটা, অবিকশিত। এই দিন যেন অমুকুলিত, যেন না বোজা না ফোটা। আমায় মার্জনা করবেন নবীন। এই মুহুর্তে আর কিছু যে আর আমার মনে পড়ে না। এই মুহূর্তের রসাস্বাদনের তৃপ্তি আমায় কেবল কালিদাসই দিতে পারেন। আহা -- তিনিই আমার কাছে মহাকবি, কবি শ্রেষ্ঠ। সেই মানুষই তো কবি যিনি পূর্ণতা পান প্রকাশে। ফলাফলে নন। প্রবহমান মুহূর্তকে মূল্যবান করতে পারেন যিনি তিনিই তো মহাকবি।
পূর্বপ্রীত্যা গতমভিমুখং সন্নিবৃত্তং তথৈব।
চক্ষুঃখেদাৎ সলিলগুরুভিঃ পক্ষ্মভশ্ছাদয়ন্তীং
সাভ্রেহহ্নীব স্থলকমলিনীং নপ্রবুদ্ধাং নসুপ্তাম্ ।।
—কিন্তু কালিদাসের অন্তিম যে লঘু।
—লঘু হোক। অন্তিম তো কবির সৃষ্টি নয়। সে কাজ বিধাতার।
চোখ বুজে থাকেন বৃদ্ধ। পাঠ করে চলেন সুর্যশেখর। আমাদের চোখের সামনেও যেন চলতে থাকে সেই শাশ্বত গাথার ধারাবিবরণী
—তোমার কাছে একটা জিনিস চাইব? শিউলি বলে।
—কি বল।
—একটা চিঠি লিখবে আমায়?
—ওঃ সেই চিঠি? আচ্ছা লিখব।
—একটা বড় চিঠি। কতদিন ধরে বলছি তোমায়। তুমি আমার কথা কিছুতেই শোন না।
—আচ্ছা। এবার অবশ্যই লিখব। এই পথে যেতে যেতে লিখব।
—ভালোবাসি তোমায়।
—তোমাকে আমিও ভালোবাসি।
—চিঠি লিখো অবশ্যই, এসে নিজের হাতে দেবে।
—দেব।
—ঠিক দেবে?
—দেব।
রাতের খাওয়া হয়ে গেছে দিলুর, বাকি লোকগুলো খাচ্ছে হই--হল্লা করতে করতে। লরির পেছনটা ঢাকা, নির্জনতা দিয়েছে, সেখানে এক কোণে বসে থাকে দিলু। রাত্তির হলে ভিডিও কল করে এখানে বসে। তার নিজের মুখে থাকে অল্প আলো, যতটুকু ফোনের নিজের আলো দিতে পারে, কারণ ত্রিপল ঢাকা দেওয়া ভেতরটা বেশ অন্ধকার। শিউলি দেখতে পায়না তাকে পরিষ্কার কিন্তু সে শিউলিকে পায়। যেমন একান্ত সময়ে হয়, শিউলি চোখ বুজে থাকে আর ও রাখে খোলা। এই সময়ে একে অপরকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে। কি যে হয়ে গেল হঠাৎ করে। চতুর্দিক জটিল হয়ে আছে। ফোন চার্জ করাটাও ঝকমারি। হোটেল বন্ধ। থাকবে কোথায়। সব কিছু ঠিক থাকলে কাল লোড হবে মাল। রাতেই গাড়িগুলো ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু যাই হোক এখন ভালোয় ভালো ফিরতে পারলে হয়। প্রথমবার খারাপ রোজগার হবে না। যদিও বসে থাকতে থাকতে ফালতু টাকা গুণতে হয়েছে বেশ কিছুদিন, তবুও। মনোজ ফোন করে কনফার্ম করে দিয়েছে। অন্য সময়ে হলে ও চারদিকটা ঘুরে আসত। এখন বেশ কড়াকড়ি হয়েছে। জাহাজগুলোর মধ্যে থেকে দুসপ্তাহের আগে লোক নামতে দেবে না। তাই খালাস করা মালের লাইন ধরতে প্রচুর দামি কোম্পানির সঙ্গে ওর পেরে ওঠার কথা ছিল না। দেখা যাক, না আঁচালে বিশ্বাস নেই। দূর থেকে জাহাজের হর্নের শব্দ পাওয়া যায়। ডকে লোক জনের ব্যস্ততা হয়ত আছে। দূর থেকে বোঝা যায় না। ওরা আছে জাহাজঘাটা থেকে অনেক দূরে। ভোরবেলায় অনেক কাজ। সব আশা করি ঠিকঠাক থাকবে। ছেলেটা সাহায্য করছে, কিন্তু লুকিয়ে কয়েকটা লোক নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছু উদ্দেশ্য আছে বলে মনে হয় না। ও নিজেও তো আটকে গেছে। সাবধানে তো সব সময়েই চলতে হয় কিন্তু রাস্তায় আর ব্যবসায় বিশ্বাস না রাখলে এক পাও এগোন যায় না। এসব ভাবতে ভাবতে কখন দিলুর চোখ লেগে আসে সে নিজেও জানে না।
বহুদূরে দরিয়াপুরে শিউলি চুপ করে বসে থাকে একা, একরাশ অপেক্ষা নিয়ে। আর দুই নিশাচর ঘুরে বেড়ায় রাস্তা থেকে রাস্তায়। দেখে সারা দুনিয়ার মানুষগুলো আজ রাতে যেন হয়ে গেছে ইঁদুর। তবে শুধু আজ রাত কেন, কবে থেকেই তো তারা হয়ে গেছে ইঁদুর আর লুকিয়ে পড়েছে তাদের গর্তে।
—এইটি আমার জন্য অনেক দিন বাদে একটা বড় পরিবর্তন হল। আমাকে কেমন লাগছে এই পোষাকে? আমি অনেকদিন ধরেই চেয়েছিলাম এমন যদি হত। আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি না থাকলে আমি এ সাহস করতাম না।
—আপনাকে বেশ লাগছে, এই পোশাক আমার থেকে আপনাকে মানিয়েছে বেশি কারণ আপনার দেহ সুগঠিত আর দীর্ঘ।
—যাক, লোকে তাহলে চিনবে না।
—না কেউই চিনবে না, পোশাক বদল না করলে হয়ত অবাক হত। কিন্তু তবু চিনতে পারত না। এখন এই যুগে কে কলহনকে দেখে চিনতে পারবে বলুন তো? কোন ছবি বা মূর্তি তো আপনার নেই। আপনি অশোক নন, আকবর নন। এমনকি গান্ধি বা নরেন্দ্র মোদিও নন। লোকজনের ভাবতে বয়ে গেছে। সবাই কি আমার মতো নাকি!
—ঠিক। ঠিক কথা। কিন্তু একটা কথা আমায় বলুন তো নবীন, আপনি কেন আমায় নিয়ে পড়লেন। আমার সঙ্গে আলোচনা করে আপনার কী লাভ? ভারতে তো আর যুগে যুগে মহাজ্ঞানীর অভাব ছিল না।
—এর দুটো কারণ। তার মধ্যে আমার কাছে একটা বেশি জোরালো। আর জোরালো কারণটাই আপনার কাছে দুর্বল মনে হতে পারে। আমার যখন তিন বছর বয়েস তখন আমার বাড়িতে খুব অল্প বয়েসি দুই কাশ্মীরি ছেলে শাল বেচতে এসেছিল। কাশ্মীরিদের বাঙালিরা যে কারণে সবাই মনে রাখে তেমনি কারণেই মনে আছে। টকটকে ফর্সা, ছিপছিপে আর কালচে সবুজ হালকা দাড়িতে ঢাকা গাল। ওদের তখন কত বয়েস হবে উনিশ কুড়ি। মনে হয়েছিল দক্ষিণারঞ্জনের রাজপুত্র আর মন্ত্রীপুত্র। আমার মা খুব কষ্ট করে জমানো পয়সায় ওদের কাছ থেকে একটা লাল শাল কিনেছিল। সে শালের দাম ছিল একশ টাকা। মা ওদের খেতে দিয়েছিল পিঠে পুলি। সেদিন আমার জন্মদিন ছিল। যাওয়ার সময়ে আমার হাতে ওরা দিয়ে গেছিল এক টাকার একটা ঝকঝকে নতুন নোট আর বেশ কিছু আখরোট। ব্যস, সেদিন থেকেই কাশ্মীরিরা আমার নিজের মানুষ হয়ে গেছিল। আর অন্য কারণ যা তার উত্তর আপনি নিজেই জানেন। আপনাকে ছাড়া এ লেখা কোন ঐতিহাসিককে পড়িয়ে যাচাই করতাম? আপনি ভারতবর্ষের প্রথম ঐতিহাসিক। মহাচার্য।
—কিন্তু আপনি তো ইতিহাসের ছাত্রই নন। তাও এই নিষ্ঠা আমাকে মুগ্ধ করেছে।
—আমি যে ইতিহাসের ছাত্র নই সে কথা আপনার সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের আগে পর্যন্ত আমায় বেশ তাড়িয়ে বেড়াত। কষ্ট দিত। কিন্তু এখন ভাবি, সে নয় কাগজে কলমে নাই হলাম তাতে কি আসে যায়, আপনার কাছে তো বেশ প্রশ্রয় পাচ্ছি।
—একদম ঠিক। একদম ঠিক।
বৃদ্ধ বেশ চমৎকার উপভোগ করছেন এই নতুন জায়গা আর তার নতুন পোষাক। কলহনের পরনে শার্ট প্যান্ট। বলা বাহুল্য তিনি এখন সুর্যশেখরের ডাকে আমাদের সময় এবং আমাদের বাংলাতেই এসেছেন। দুই অর্বাচিন যেন কাউকে না পরোয়া করেই চালিয়ে যাচ্ছে তাদের নৈশ অভিযান। কোনরকম জড়তা ছাড়াই তিনি ঘুরছেন কথা বলছেন। এমনকি সূর্যশেখর ওঁকে সিগারেট খেতে দিলেও উনি পিছপা হলেন না। যদিও বেশ কিছু টান দেওয়ার পরে উনি বললেন -- আপনার এই তামাক আমি একদম পছন্দ করছি না। এই সিগারেট জিনিষটা বেশ কটু ও নিকৃষ্ট।
—সে আর বলতে! কিন্তু আমি নিরুপায়। আর তো আমার কাছে নতুন কিছু নেই যার সঙ্গে আমি আপনাকে নতুন করে পরিচয় করাতে পারতাম। আমার সময় জানতে হলে এটাকেও যে জানতে হবে রাজন। তবে হ্যাঁ, গঞ্জিকা বা গাঁজার স্বাদ আপনি পেলে আপনি হয়তো তৃপ্ত হতেন। কিন্তু সে এখন নিষিদ্ধ। যদিও লুকিয়ে চুরিয়ে যে পাবার সে পায়।
—সে আমি জানি। সে অতি উৎকৃষ্ট। কিন্তু নিষিদ্ধ কেন?
—সে নাকি মানুষের মন আর শরীরের ক্ষতি করে।
—ঠিক নয়। একদম ঠিক নয়। বরং নীরোগ থাকা যায় এমন আমি দেখেছি। আমার সময়ে তো এই ভেষজ নিষিদ্ধ ছিল না। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি কোন শুষ্ক উপলব্ধি--দ্রব্য পছন্দ করি না। তাই মদিরা ছাড়া আর তেমন কিছু ভালোবাসতে পারিনি। কিন্তু যাক এ কথা, যে কথা আমরা বলছিলাম। এই মড়ক মানুষ তো বহু আগে থেকেই প্রত্যক্ষ করছে। প্লেগ, কালাজ্বর, পীতজ্বর এমনকি এই শ্লেষ্মা ঘটিত ব্যধি সবই মানুষের ইতিহাসে ছিল। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে সে তো এই সমস্ত ছোঁয়াচে ব্যাধি সামাজিক ও রাজনৈতিক পালাবদলও ঘটিয়েছে। কিন্তু মানুষের জীবন তাতে থেমে থাকেনি। সে এগিয়েই গেছে। বেশিরভাগ মানুষ এমনিতেই মরে বাঁচে, তাদের কাছে মরনও যা জীবনও তা। আমি আশা করছি আধুনিক মানুষ এর ভেতর দিয়েই নিজেকে চঞ্চল রাখবে। তবে আমার এও আশঙ্কা হচ্ছে যে কিছু মানুষ এই পরিস্থিতির অবৈধ সুযোগও নেবে। কারণ এমন নমুনা আমি অনেক পেয়েছি।
—তার জন্যই তো আমাদের সামনের দিকে তাকিয়ে থাকা। আমরা দেখব কেমন করে এই পরিস্থিতি মানুষকে কোনদিকে নিয়ে যেতে পারে।
—কিন্তু একটা কথা আপনাকে বলি। আপনি আমার কাছে একদিনে বেশ স্নেহের মানুষ হয়ে উঠেছেন। আপনি যদিও আমায় বলেন নি, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি আপনি নিজে ভালো নেই। আপনার প্রথম দিকের সেই ঔজ্জ্বল্য আমি দেখতে পাচ্ছি না। অবশ্য যদি সে কথা আপনার ব্যক্তিগত বিষয় হয় তাহলে আপনি আমায় নাই বলতে পারেন। কিন্তু কাউকে তো বলতে হয়।
—না তেমন কিছু না।
—বুঝতে পারছি আপনি বলতে পারছেন না। কিন্তু আপনাকে দেখে আমার নিজের কথা মনে পড়ছে।
—আপনি স্নেহ সম্পৃক্ত হয়েছেন তাই এমন কথা বলছেন। কিন্তু আপনার সঙ্গে আমার কোন তুলনাই নেই। আপনি তো প্রামাণ্য ইতিহাসের কাজ করছেন আর যা আমি করছি তাকে বলতে পারেন ছেলেখেলা। মানুষের মনের খবর তো কখনো ইতিহাস হতে পারে না। আসলে আমি মনে হয় কিছুই করতে পারছি না।
—ইতিহাস কাকে বলে তাহলে? ইতিহাস তৈরি হয়ে উঠতে কী প্রয়োজন হয়? শুধু দিন, তারিখ, সাল, রাজা, ক্ষমতা, সীমানা সে সব? তার জন্য তো আপনাদের কাছে এখন অন্তর্জাল আছে। তাহলে আপনি যা করছে সে ছাড়া এখন নতুন কাজ কী হতে পারে?
—না আমি হয়তো তেমন কিছুই করছি না। আমি আসলে অকাজ করছি। ভয়ঙ্কর অকাজ। যার কোন অর্থ নেই। প্রকাশ নেই। কোন মীমাংসা নেই। যার কোন প্রশংসাও নেই।
—আপনি তো প্রশংসা পাওয়ার জন্য ব্যকুল হওয়ার মতো পাত্র নন। হলে আপনি আমার কাছে পৌঁছতে পারতেন না। আপনি ছুটতেন আপনার সমসাময়িক কারোর কাছে। যে আপনাকে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারত। যুগ সন্ধিক্ষণ আমার সময়েও ছিল। আমি রাজ অনুগ্রহ পেয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু না পেলেও আমি আমার কাজ যেটুকু পারি, যেমন করে পারি, করতাম। আমি জানি আপনিও তেমন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়েই কাজ করে যাবেন।
—না প্রশংসাও নয় আর ভালোবাসাও নয়। আসলে আমি কেন এই কাজ করছি এখন আর আমি বুঝতে পারছি না।
—তাহলে আমি যা আন্দাজ করছি তাই হয়তো ঠিক। আর তা সঠিক হলে তার কোন প্রতিবিধান আমার কাছে নেই।
চুপ করে থাকে সূর্যশেখর। কোন উত্তরের আশা অবশ্য বৃদ্ধ করছেন না। এই সময়ও করছে না। মাঝ রাতে হিমেল হাওয়া এখনো বেশ আছে। চক্রাকারে ঘুরতে থাকা সপ্তর্ষি মণ্ডল এখন দিকশুন্যপুরে অন্তর্হিত। স্টাফ কোয়ার্টারের বারান্দা দিয়ে যতদূর দৃষ্টি যায় দেখতে পাওয়া যায় নির্মল আকাশ। কালিমাহীন যেন। সব কিছু বন্ধ থাকায় যানবাহন চলাচলও প্রায় বন্ধ। তাই আকাশ পরিষ্কার। তারপর এই রাতের নিমগ্নতা। আকাশের মানচিত্র হাজার বছরেও তেমন কিছু বদলায় না। আর বদলায় না বলে সেখানে ফেলে আসা বলে কিছু নেই। যা প্রাপ্তি হয়, তা কোথায় যে বিলীন হয়ে যায় এই সর্বময় ব্যাপ্তির কাছে সে ধারণার অগম্য। বৃদ্ধ সেই আকাশের দিক থেকে খানিক চোখ ফেরান, তাকান সূর্যশেখরের দিকে, তারপর আবার দৃষ্টিক্ষেপ করেন সেই দিকে যেদিকে উনি তাকিয়ে ছিলেন এতক্ষণ। সে দৃষ্টিতে কি আছে তা এই অন্ধকারে বোঝা সম্ভব নয়। অস্ফুটে বলতে থাকেন…
—বিন্দুশিলা। দাসকন্যা। আমি কি তাকে ভুলতে পেরেছি আজও? সেই শ্যামল নয়নযুগল, সেই মেধা, সেই বোধ, সেই চঞ্চলতা। সেই সমস্ত অসম্ভব সময়যাপন। সে আমার শান্তিমথিত স্মৃতি। কি জানেন? আমি বৃদ্ধ হয়েছি কিন্তু তিনি এখনো সেই ষোড়শ বর্ষীয়া তরুণীই হয়ে আছেন। সময় কত ছলনাময় বুঝতে পারছেন সূর্যশেখর? সময় এক একজনকে একেকরকমের প্রবাহ দেয়। যা আপনাকে দেয় তা আমাকে দেয় না। বিন্দুশিলাকে একরকম দিয়েছিল যার সঙ্গে আমি তাল রাখতে পারিনি। সে হাত ধরেছিল তার পূর্বনির্দিষ্টের আর আমি তখনো বয়ে চলছিলাম অনির্দিষ্টে। একটু থামেন বৃদ্ধ। তারপরে আবার বলতে শুরু করেন -- সে ছিল কিশোরী, অথচ প্রবল জিজ্ঞাসু, চঞ্চল অথচ তীক্ষ্ণ। খেলার ছলেই সমাধান করতে পারত জটিল জ্যোতির্বিজ্ঞানের রহস্য। আর আমি তখন তারুণ্যের শেষ সীমায়। সেই অসচেতন কিশোরী আমায় সাহায্য করত বিভিন্ন ব্যাখ্যার সঠিক সংযোজনে। আমার ধারণা হয়েছিল সেই কাজ আমি তার জন্যেই করছি, তার উদ্দ্যেশেই বুঝি আমার এই জন্ম। আমি ভুল ছিলাম না। তার উদ্দেশ্যেই আমার জন্ম ছিল। আর কিছুর জন্য নয়। সে আমাকে পূর্ণ করেছিল। কিন্তু সময় আমায় দিয়েছিল এই আসক্তিহীন করণিকের ভাগ্য। সেই নারীর ছিল বয়ে যাওয়া, পাহাড় থেকে উপত্যকায়, উপত্যকা থেকে সাগরে, সাগর থেকে ওই দূর আকাশে। আজ বুঝি, সে কোনদিনই আমার মতো পূর্ণতা চায়নি। সে চেয়েছিল অন্তহীন বয়ে চলা। তার চলে যাওয়ার পর আমি আর কোনদিন নিজেকে নিয়ে ভাবিনি নবীন। তার পরে আমি আর নিজের ভাগ্যের ভালো মন্দ বিচার করিনি। বুঝলেন? যন্ত্রের একটা নিজস্ব রীতি আছে। তাকে কাজ করে যেতে হয়। মুক্তিহীন ভাবে, বেদনাহীন ভাবে, ভবিষ্যৎহীনভাবে কাজ করে যেতে হয়। আমি যন্ত্র হয়ে গেছিলাম। আমি সেই ভাগ্য মেনে নিয়েছিলাম। আর সেই মেনে নেওয়ার পর থেকে আমার অন্তরে কোন কষ্ট আর কখনো অনুভূত হয়নি। কারণ আমি বিশ্বাস করেছিলাম বিন্দুশিলাকে, তার সর্বব্যাপী অস্তিত্বকে। আমি তাই বলি আপনি যাকে ভালবেসেছেন তাকে বিশ্বাস করুন সূর্য। আপনি তাকেই প্রশ্নাতীত ভাবে বিশ্বাস করুন, দেখুন আপনি শক্তি পাচ্ছেন। দেখুন আপনি কাউকে হারাননি। কেউ আপনাকে ছেড়ে যায়নি। আপনাকে কারোর জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। আপনাকে কারোর কাছে ব্যাখ্যা দিতে হচ্ছে না। নিজেকে হালকা করুন।
—সূর্যশেখর চেয়ে থাকে আকাশের দিকে। তার সারাদেহে সে অনুভব করছে শীতল হাওয়ার ছোঁয়া। ছোটবেলায় শীত বিদায় নেওয়ার সময় সোয়েটার ছাড়া, মায়ের বকুনি ছাড়া শুধু জামা গায়ে যে রাতে প্রথম বেরোনো যেত, সেই রাতে রাসমন্দিরের ঘণ্টার শব্দের সঙ্গে এই শীতলতা সে অনুভব করত। তীব্রতাহীন কিন্তু অনুভূত। অন্তর্হীত অথচ উপলব্ধ।
রাতে ট্রাক চলাও বন্ধ। তাই সারাদিন সারারাত মাল লোড করে পরদিন আলো না ফোটা ভোরে বেড়িয়ে পড়ল দিলুরা। লাইন দিয়ে ট্রাকগুলো শহরের ভেতর দিয়ে এগোল। কয়েকদিনের অনিশ্চয়তার পরে ফেরার পালা। ড্রাইভার, খালাসি সকলেরই মনে বেশ আনন্দ। অন্যসময় তেমন আলাদা অনুভূতি হয় না। বিশেষ করে যারা পোড় খাওয়া ড্রাইভার খালাসি তারা ঘরে ফেরা নিয়ে তেমন ভাবে না। তবে কম বয়েসি ড্রাইভার খালসিদের বাড়িতে বাচ্চা থাকে, নতুন বউ থাকে। ফেরার টানও থাকে বেশি। কিন্তু এবারের ঘটনা সম্পূর্ণ আলাদা। সবাই ফিরতে চায়। মাঝের এক ট্রাকে দিলু আর মনোজ বসেছে। ওদের ট্রাকের একদম ভেতরে পার্টিশন করে আট ফুট এদিক ওদিক জায়গা বার করা হয়েছে। ওই খানেই দশটা লোক কোনরকমে গাদাগাদি করে বসানো। ওপরে পিচবোর্ড দিয়ে ঢাকা। তার ওপরে আবার মাল। নল দিয়ে বাতাস যাওয়ার রাস্তা। আরও চারটে ট্রাকে এমন আছে। দুর্দান্ত চেকিং। খাবারের জন্য বেরোনো অসম্ভব তো বটেই, পায়খানা পেচ্ছাব সব ভেতরে করতে হবে দরকার হলে। ক্যান রাখা আছে। মই ছাড়া ওপর দিয়ে বেরোনো অসম্ভব। অত্যন্ত সন্তর্পণে ওরা চলেছে। লোকগুলো সব সাধারণ মানুষ। এক এক জন এক কারণে এখানে এসে ফেঁসে গেছিল বলে বলল মনোজ। রিস্ক আছে যদি ধরা পরে। ধরা পড়লে মালিক দিলুকে ছেড়ে কথা বলবে না কারণ ড্রাইভার ছাড়া সেও কেস খাবে। এন এইচ সিক্স এ উঠে নাগপুর হয়ে ছত্তিসগড় পার করে জামশেদপুর দিয়ে ঢুকবে। মুম্বাই থেকে নাগপুর প্রায় আটশ কিলোমিটার। প্রাইভেট গাড়ির জ্যাম। সব্বাই পালাতে চাইছে মুম্বাই ছেড়ে। পুলিশ কি করবে। পিলপিলিয়ে গাড়িগুলো ঠেলে ঠুলে কোনরকমে ধীর গতিতে এগোচ্ছে। নাসিক, ধুলে হয়ে নাগপুর। ফোর ওয়ে রাস্তায় উঠে অনেকটা স্বস্তি, গতি বাড়ল। দূরে পাহাড়ের সারি। দুই পাশে কোন সবুজ নেই। ধুলের রাস্তা ধুলোর মতোই ঊষর। লোকাল লোকেরা বাইকে করে যাচ্ছে বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে। দুপুরের পর থেকে টানা চলল গাড়ি। রাস্তা শুনশান। যাই হোক আশঙ্কা আর দোলাচলের সঙ্গে রাস্তার দুপাশের চমৎকার দৃশ্য আর সবার ওপরে শিউলির কাছে ফিরতে পারার আনন্দে দিলুর মন ফুরফুরে, বিন্দাস। মনোজ পড়াশোনা জানা, ইঞ্জিনিয়ার। দিলুর প্রথমে মনে হল কি কথা বলবে তার পর দেখল ওর কোন অসুবিধে হচ্ছে না। ছেলেটার মন আছে।
—কিতনা বিরান হ্যাঁয় ইয়ে দুনিয়া দেখো দিলুজি। সবকে সব ঘর মে ব্যঠে হুয়ে হ্যাঁয়। সব সুনসান। মালুম হো রহা হয় কে এক স্বপ্না হ্যায়।
—ধাবা ভি সব বন্ধ হ্যাঁয়। খানা নেহি মিলনেওয়ালা।
—মেরে পাশ কুছভি নহি হ্যায়
—মেরে পাস হয় শুক্লাজি। মিলকে খা লেঙ্গে।
—সমঝদার হো।
পাশে বসে থাকা ড্রাইভার বলে -- হামকো তো সব আদত হয়। ঔর শাম মে যব সব গাড়ি একসাথ হো জায়েঙ্গে তব তো কুছ ইন্তসাম হো যায়গা।
—মৈঁ ইসকে বারেমে সোচ হি নহি রাহা হু। ম্যায় সোচ রাহা হুঁ কিতনে দিন ইয়ে চলেগা। অগর এক মাহিনা দো মাহিনা হো তো আম আদমি সহ্ লেঙ্গে, ফির? মর জায়েঙ্গে ভুখে।
—মরনে দিজিয়ে মনোজজি, আয়সেহি আম আদমি কউন জিন্দা হ্যায়। হর দিন জিন্দা রহনে কেলিয়ে ভাগতে হ্যাঁয়, দৌড়তে হ্যাঁয়। সমঝনেকি কোই ওয়াক্ত নহি হয় কে ও ক্যা জিন্দা হয় ইয়া মুর্দা। ফির একদিন ও সচমুচ জিন্দা নেহি রহতা। ইস ওয়াক্ত উসকো সোচনেকা অওসর মিল রহা হয়। উসকো শোচনে দিয়া হয় করো না।
—বাতে অচ্ছা করতে হয় আপ দিলুদাদা।
—দিলসে বোল রহা হুঁ। আপকা ভি দিল হ্যায় ইস লিয়ে আচ্ছা লগ রাহা হয়। শুননেওয়ালা তো খুদা হোতা হয় মনোজজি।
—কেয়া বাত বোলা। দিল খুশ কর দিয়া। ঔর ইয়ে ভি মান লিয়া কে আপকা নাম দিলু কিঁউ হ্যাঁয়।
হাসির দমক ওঠে। গাড়ি চলতে থাকে। শহরগুলোতে ঢোকার আগে আর পরে নাকা চলছে প্রবল। কাগজ পত্র ছাড়াও প্রত্যেকটা গাড়ি ত্রিপল সরিয়ে চেক করা হচ্ছে। সময় লাগছে। স্টেট বর্ডারে কি করে কে জানে। কথা বার্তা বলতে বলতে চলেছে বলে এসব কিছুই মনে থাকছে না। এক এক জায়গায় দুপাশে ক্ষেতের পর ক্ষেত। এদের ক্ষেতের মাটির ধরন, চাষের ধরন, বাড়ির ধরন, সব আলাদা। গ্রামে অবশ্য কোন কিছু বোঝা যাচ্ছে না। সবই চলছে। দু একটা ট্রাক্টরে করে প্রচুর লোক চলেছে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। স্টেটের ভেতর এভাবেই চলে যেতে পারবে ভেতরের গ্রামের পথ ধরে। হাই রোডেও পারছে। সামনে পুলিশ থাকলে মোবাইলে খবর হয়ে যাচ্ছে। এক জায়গায় চারদিক শুনশান্। মনোজ ফোন করে জানল ভেতরের লোকগুলোর খবর। তারা বেরোতে চায়। দিলু খানিক থামাল গাড়ি। খালাসি খুব খেটেখুটে ওদের বার করল। দশ মিনিট বাদে ওদের আবার ভেতরে তুলে গাড়ি চলল। লোকগুলোর অবস্থা কাহিল। মরে যদি নাও যায় সুস্থ দেহে বাড়ি পৌঁছন কঠিন। সন্ধ্যে হয়ে গেলে। নাগপুর পেরিয়ে গিয়ে একটা বন্ধ ধাবায় গাড়ি গুলোকে দিলু দাঁড় করিয়ে দিল। সন্ধ্যের পর অন্ধকারে যেন পরিত্যক্ত এক অঞ্চল। ওদের গাড়িগুলো সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দু তিনজন গেল খোঁজ করতে, যদি কেউ রান্নার জ্বালানী দেয়। কেউ নেই। একটা বাচ্চা ছেলে তার দাদুর সঙ্গে সাইকেল করে যাচ্ছিল। তাদেরকে বলতে তারা গ্রামে গেল আর যখন ফিরল তাদের সঙ্গে গ্রামের অসংখ্য দেহাতি লোক। হাতে লাঠিসোটা। তারা রীতিমতো ধমকে গাড়িগুলোকে নিয়ে এখান থেকে চলে যেতে বলল। এর থেকে নাগপুরে রাতে থাকলেই ভালো হতো।
আরও এক ঘণ্টা চলার পরে পুলিশের চেকিং। সেখানে খানা তল্লাশি। এমন সময়ে দিলুর গাড়ির লুকনো লোকগুলোর ভেতরে কারো একটা মোবাইল বেজে উঠল। একটা হাবিলদার আশপাশ ঘুরে কিছু বুঝতে চেষ্টা করল। এমন সময় পেছন থেকে পুলিশেরই কারো হোমরা চোমরার গাড়ি এসে যাওয়ায় তাড়াতাড়ি সরতে শুরু করল গাড়ি। দিলু এ যাত্রা বেঁচে গেল। কিন্তু বেশিক্ষণ আর চালান যাবে না, রাতে গাড়ি চালাতে দিচ্ছে না এই রোডে। এবার একটা ধাবা খোলা দেখল। ব্যস। দাঁড়িয়ে পড়ল ওরা। প্রচুর ট্রাক দাঁড়িয়ে। প্রচুর খাবার লাইন, বোঝা গেল কত ট্রাক এই সময়েও চলছে। এখানে কোন অসুবিধে নেই। কারো কোন মাস্ক নেই, আর থাকবেই বা কি এসব অঞ্চলে মাস্ক কে দেখেছ কোন দিন। গ্রামের মানুষরা এসব লাগে না বলে ভাবে। হয়তো সত্যি করেই ইমিউনিটি বেশি থাকে গ্রামের মানুষের। শহরের গরিব মানুষেরও তাই। এইখানে দেখা গেল প্রচুর খাবার ব্যবস্থা, অনেকেই এই ফাঁকে রোজগার করতে নেমেছে। রুটি আর ডাল খেয়ে নিল পেট পুরে। গাড়ি দূরে রাখা। লুকনো লোকগুলো অনেকক্ষণ বাদে বেড়িয়ে বাতাস পেয়ে এবার একটু চাঙ্গা হয়েছে, সারারাত এখন ওরা খোলা আকাশের তলাতেই থাকতে চাইবে কারণ বন্দী হতে হবে আবার ভোর রাত থেকে।
দুপুর গড়াল। নিয়ম ভেঙ্গে একটা হোটেল খোলা। ভেতরে চারটে পুলিশ নিজেরাই খাওয়া দাওয়া করছে। ওদের দলের এক ড্রাইভারকে ডেকে এক অফিসার বলল দুজন মহিলাকে তুলে নিতে। সম্বলপুর যাবে। সে দিলুকে দেখিয়ে দিলে দিলু কথা বলল স্বয়ং অফিসারের সঙ্গে। আর অবশ্যই সাগ্রহে রাজী হয়ে গেল। সঙ্গে এই আশ্বাসও পেয়ে গেলে ওড়িশা বর্ডারে কোন ঝামেলা হলে যেন ওকে ফোন করে। পুলিশগুলো নকল নয় কথা বার্তায় বুঝে গেল দিলু। এ বাজারে কত কি হয়। ও নিজেই জা করছে! সন্ধেবেলা সম্বলপুর এলে মনে হল বাড়িতেই যেন ঢুকে গেছে। এখানেই ওরা এই রাত কাটাবে।
অভ্যেস মতো এক কোণায় গিয়ে শিউলির সঙ্গে কথা বলে দিলু। দিলুর গলার স্বর, কথার ধরনে বোঝা যাচ্ছে সে আনন্দে আছে। পায়চারি করতে করতে হোটেলের পেছনটায় কথা বলে দিলু। সারাদিন যা দেখেছে বলতে থাকে। মানুষের বদলে যাওয়া যে সর্বত্র এক নয়। মনোজ ছেলেটার কথা, সে কতটা সাহায্য করেছে দিলুকে এ যাত্রা, লুকনো লোকগুলোর কথা আর ভালোবাসার কথা। শিউলি শোনে। কোন কথা বলে না। মনে মনে কত কি যে ভাবে সে আমরা জানতে পারছি না। হয়তো ভাবে যার মুখ দিয়ে একটা শব্দ বেরত না আজ সে কত কথা বলছে।
—বহেনজি ক্যায়সি হ্যায়?
—ঠিক হ্যায়।
—দিলুজি ইয়ে জিন্দগি বহুত আজিব চিস হ্যায়।
—ক্যয়া সোচ চল রাহা হয় দিমাক মে শুক্লাজি?
—ইয়ে যো রাস্তে হ্যাঁয় ইয়ে ভি জীন্দগি যায়সি হ্যাঁয়। কুছ লোগ আতে হ্যাঁয়, কুছদুর তক হম সাথ চলতে হ্যায়। ফির জুদাই। ফির নয়ি মুলাকাত, নয়ি ইরাদেঁ। কিতনী অজিব কাহানি হ্যায় ইয়ে জিন্দগি।
—ও হি তো হয়। লেকিন কুছ রিশতা তো হোতা হ্যয় জিন্দগি ভর কে লিয়ে।
—জিন্দগী ভর কা রিস্তা হোতা হ্যয় সির্ফ রাস্তে কি সাথ। এই কথা শুনে দিলু ভাবে কিছুক্ষণ চুপচাপ তারপর বলে
—আপকো তো শায়ের বননা থা শুক্লাজি, ইঞ্জিনিয়ার নেহি।
—দেখিয়ে ইস পলনে হাম, আপ সবকো ক্যয়সে শায়ের বনা দিয়া। আপভি তো বহত ফিলসফিকাল হো।
—ইশ খুশি পে পিতে হয় থোড়া? ক্যা বোলতে হ্যাঁয় আপ? দিলু হেসে বলে।
—মিলেগা কাহাঁ?
—ও আপ দিলুপে ছোড়িয়ে। দিলু জোগাড় করে আনল ওই দোকানে থেকেই, দ্বিগুণ দামে। মদ বিক্রি বন্ধ, কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে এভাবেই। দুজনে লড়ির আড়ালে গিয়ে খেতে থাকল অল্প অল্প করে আর গল্প চলতে থাকল তার সঙ্গে।
—আপ হামারে উহাঁ আইয়েগা।
—জায়েঙ্গে। ঔর হামারে পার্টনারশিপ তো চলতা রহেগা। তারপর প্লাস্টিকের গ্লাস উঁচিয়ে শুক্লা বলে -- টু আয়ার পার্টনারশিপ। তারপরে কিছুক্ষণ পরে দিলুর দিকে তাকিয়ে সে গম্ভর স্বরে বলল -- এক বাত আপকো বতা রাহা হুঁ দিলুজি।
—বোলিয়ে।
—There will be stratification for ever.
—Can't catch you Sir -- দিলু বলে।
—There will never be an equal distribution of power, food, money, intelligence…… Too few are meant to be powerful. Commoners will continue to die like stray dogs. This is reality. And hard reality. Do I sound cruel?
—I am thinking Sir
—You have the potential to be a strong man, real powerful man. Don’t be a common man. Don’t spoil your life. Chase your identity. You will come to know what I mean today. One day …….not so far away. You are chosen.
দিলু ভাবতে থাকে কেন এ কথা হঠাৎ করে বলছে মনোজ। দিলুর মনের কথাই যদিও সে বলেছে। সে কী কিছু বলতে চাইছে? শুক্লা তো বেশি মদও খায়নি!
সম্বলপুর থেকে ভোরবেলা ট্রাকগুলো ছেড়ে দিয়ে বিকেলের মধ্যে ঢুকে পড়ল হাওড়ায়। সারারাত ধরে মাল খালাস হল। মাল বুঝে নিয়ে নিলো পার্টি। মনোজ এখান থেকে ওর লোকজন নিয়ে চলে গেল। লেখাপড়া জানা লোক এমন ভাবে সবার সঙ্গে মিশতে পারে, মাটিতে নেমে কথা বলতে পারে আগে কখনো দেখেনি। কিন্তু ছেলেটা সবেতেই আছে কিন্তু সবার থেকেই নিজেকে আলাদা করে রাখতে পেরেছে। এই ট্রিপে পুরোটাই প্রায় লাভ। মাঝের কয়েকটা দিনের খরচ কিছুই না। মনোজকে দেবদূত বলে মনে হচ্ছে এখন। খুব শিগগিরি ওদের দেখা হবে বলে গেল। কাল রাতের কথাগুলোও ও ভুলতে পারছে না, ঘুরপাক খাচ্ছে। ও চলে যাওয়ার পরে দিলুর মনটা একটু ভারী হোল। কিন্তু সেই মন খারাপ কিছুক্ষণের মধ্যেই বদলে গেল আনন্দে। এবার দরিয়াপুরে ফেরার পালা। এই ট্রাক এখন আর ওদিকে যাবে না। ওর চেনা লরিকে খুঁজতে হবে, কে ওকে নিয়ে যেতে পারে। শেষটা সব থেকে কঠিন হয়। তবে এতদূর যখন এসেছে তখন বাকিটা কোন ব্যাপার নয়। আজ ওর মনে হচ্ছে ওর নিজের ফেরার একটা জায়গা আছে। যা আগে কোনদিন ও অনুভব করেনি। দরকার হলে বাকি কয়েক পঞ্চাশ, একশ, দুশো হাজারে হাজারে কিলোমিটার ও হেঁটেই পার করবে। দিলু পারবে, চাইলে দিলু অনেক কিছুই পারবে। মনোজের কথাগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে মনে। কেন? ও কেন? তারপরে ভাবে-- ও নয়ই বা কেন?