• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৩ | জানুয়ারি ২০২৪ | উপন্যাস
    Share
  • ডহননাগড়ার কাহন (৩) : অংশুমান বিশ্বাস



    ।।৯।।

    -তুই আমায় ছেড়ে যাবি ঝুমা?

    -না যাব না।

    -আর ছেড়ে যাবি?

    -কোনদিন যাব না।

    -কেন গেলি ঝুমা?

    -যাইনি তো।

    -কেন গেলি?

    -আমি আছি

    -আমি মারছি এত লাগছে না তোর?


    সে উলঙ্গ, উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে। দিলু উন্মত্ত অবস্থায় প্রবল ভাবে তাকে পেছন থেকে জাপটে ধরে আছে। পাশবিক শক্তিতে সে সঙ্গমরত। তার স্তন পিঠ নিতম্বতে দিলু আঘাতের পর আঘাত করে চলেছে। প্রচণ্ড আক্রোশে মাঝে মাঝে সে খামচে ধরছে তার দুই স্তন। সঙ্গে চিৎকার-- কি রে তোর লাগছে? সে নিরুত্তর, উত্তর না পেয়ে দিলু তার চুল পেছন থেকে খামচে ধরে চাপা গলায় চেঁচায় -- লাগছে? -- আঃ। একটা শব্দ। এছাড়া সে কোন উত্তর দেয় না। দিলু থামে না, পশুর শক্তি তার ভেতরে। সেই শক্তি দিয়ে সে লাঙ্গলের মতো ফুঁড়ে দিচ্ছে ওর যোনি। সে আরাম না যন্ত্রণায় বোঝা যায়না কিন্তু ক্রমাগত গোঙাতে থাকে, দিলু উত্তর না পেয়ে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, প্রচণ্ড জোরে ওর ডান গালে একটা থাপ্পড় মারে, সে চিৎকার করে ওঠে, কিন্তু বলে না লাগছে কি না।

    -- নাম কি বল? কোন উত্তর নেই। পেছন থেকে গালে আবার একটা থাপ্পড় মারে।

    -- তোর নাম কি? -- বল নাম বল। সে তবুও চুপ করে থাকে।

    উপুড় হয়ে আছে বলে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। তাই সে মুখের অভিব্যক্তি চাপা পড়ে গেছে। তার কষ্ট হচ্ছে কি হচ্ছে না সে বোঝার উপায় নেই। ঘরটায় হাল্কা আলোয় সব দেখা যায় কিন্তু সবই আবছা। সেই আবছা আলোয় দেখা যায় না গায়ের রঙ। শুধু দেখা যায় তার ছড়ানো চুলগুলো ছটার মতো ছড়িয়ে আছে। মাথার চারদিকে। বাইরে তখন রাত, বেশি নয়। কান পাতলে একটা দুটো মানুষের গলার আওয়াজ বা রিকশা আর টোটোর হর্নের শব্দ পাওয়া যাবে। কিন্তু ভেতরে কেউই সে সব শব্দ শোনার মতো অবস্থায় নেই। এই দোতলা বাড়িটা শহর ছাড়িয়ে এক ধারে। এমন জায়গায় যে চারপাশে লোক বসতি কিছু বিশেষ নেই। সরকারি বিরাট জমিতে পাশে একটা মাছের প্রজনন কেন্দ্র। লোক জন খুব কমই আসে সারাদিনে। বর্ষাকালে রাতে মাঝে মাঝে লোকজন আসে। মাছে ডিম ছাড়ার সময়ে। প্রণোদিত প্রজননের সময়ে। আজ হয়তো তেমনই একদিন। বাইরে লোকজন একটু আছে। কিন্তু এসব কথা এখন অপ্রয়োজনীয়। বাইরে কি ঘটছে সব এখন অপ্রয়োজনীয়। ভেতরে দিলু ক্লান্তিহীন। দিলু বোধ শক্তিহীন। তার নিজের শরীরে আরাম হচ্ছে কিনা সে কথা নিজেও সে জানে না। কিন্তু এই শরীরটার ওপরে যতই অত্যাচার যত ভাবেই করুক আক্রোশ যেন যাচ্ছে না। আর তার স্খলনের কোন বোধ নেই। সে যেন অক্লান্ত যন্ত্র দানব। দশ মিনিট একটু থামে আবার মদ খায় আবার তাণ্ডব চালায়। হয়তো স্খলন হয়, সে বোঝে না। নতুন করে আবার ভয়ঙ্কর শক্তি ভর করে। কতক্ষণ যে এমন চলতে থাকে কেউ জানে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। হয়তো প্রায় সারারাত। দিলুর মাথায় তখন ঘুরছে এরা মনহীন। পৃথিবীর সব মেয়েছেলেই মনহীন, স্বার্থপর। নেতানো ভাব করে আসলে শুষে নেয় সব। ছেলেদের শরীর, মন, পয়সা, ক্ষমতা, শুষে নিয়ে ফোঁপড়া করে দেয় এক্কেবারে সব। যেখানে ধান্দা সেখানে মাগির দল। দুর্বল নয় আসলে এরাই শক্তিশালী, সব পারে। না ভালবেসে ঢোকাতে দিতে পারে, পেট বাধাতে দিতে পারে, তুলতুলে শরীরে ভর্তি আসলে শক্তি, যে শক্তি আসে ওই অদ্ভুত মন থেকে, যা সোজা নয়, বাঁকাও নয়। আসলে যা নেই। ওদের শুধু শাসনে রাখতে হয়। বাইরে ভেতরে শুধু মারতে হয়। তাতেই ওদের ভালো লাগে, তাতেই ওদের ঠিক রাখা যায়। ঝুমাকে ও আজ শেষই করে দেবে। কোনদিন যাকে ছোঁয় নি পর্যন্ত তাকে আজ এমন শাস্তি দেবে, যাতে সারাজীবন মনে রাখে। সারারাত সারাদিন সারাক্ষণ কষ্ট দেবে। যে অঙ্গগুলো দিয়ে ছেলেদের বশ করে সেই অঙ্গগুলোকে শাস্তি দেবে। কিন্তু দিলুর মনে হচ্ছে ঝুমা ওকে হারিয়ে দিচ্ছে। দিলু ওর সঙ্গে জিততে পারছে না। তাই আরও রাগ বাড়তে থাকে। আরও শক্তি আনে সে শরীরে, লিঙ্গে, হাতের মুঠোয়, উরুতে, হাঁটুতে। সমস্ত শরীর দিয়ে পিষতে থাকে ঝুমার শরীর।

    --তোর নাম নেই নাকি রে খানকি?

    --আমি ঝুমা।

    --ঝুমা তুই আছিস আমার কাছে!

    --আছি।

    --তুই কেন চলে গেলি?

    --আমি তো যাইনি কোথাও

    --তুই গেছিস। একশ বার গেছিস, তোর পেটে বাচ্চা?

    --না আমি যাইনি।

    --তোর বাচ্চাকে আমি নামিয়ে দেব। দিচ্ছি দেখ। দেখ নামিয়ে দিচ্ছি।

    --আঃ। আমার পেটে বাচ্চা নেই।

    --তবে কেন বলেছিলি?

    --ভুল বলেছিলাম।

    --তুই কেন আমায় ভালোবাসলি না ঝুমা?

    --আমি ভালোবাসি।

    --আমি বিশ্বাস করি না, তোদের আমি বিশ্বাস করি না। তোদের কাউকে আমি বিশ্বাস করি না। চেঁচাতে চেঁচাতে আবার মারতে থাকে দিলু এবার মেয়েটির দুটি খোলা ঊর্ধ্ববাহুতে। তারপর আবার শুরু করে প্রলয়ঙ্কর রমণ। মেয়েটি কিন্তু বাধা দেয় না, প্রতিবাদ করে না। বরং শত অত্যাচারের মধ্যেই হাত বুলিয়ে দেয় দিলুর বুকে, গালে, মাথার চুলে। দিলু তাতে ক্ষেপে যায় আরও কিন্তু দিশাহীন হয়ে পড়ে আরও বেশি। এই চূড়ান্ত রমণ ক্রিয়ার মধ্যে প্রথমবার শুরু হয় দোলাচল। এই মেয়েটাকে সম্পূর্ণ ভাবে অস্তিত্বহীন মনে হয়েও হয় না, মনহীন বলে মনে হয়েও মনে হয় না। সে আরও মদ খায়। মেয়েটা তাকে আরও আদর করে যেন কতদিন ধরে এই আদর তাকে করবে বলে বসেছিল। তাকে নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরে রাখে, সে বুক গরম, পাখির বাসার মতো আর ভয়ংকর অত্যাচারে রক্তের স্বাদ মাখানো। দিলুর জিভে সে স্বাদ আসে। দিলু বুকে মুখ ঘষতে থাকে বাচ্চা ছেলের মতো, তারপর ঝরঝর করে কাঁদতে থাকে। সে যে কাঁদতে পারে কোনদিন তা সে নিজে জানত না আগে। কোনদিন মেয়েছেলের মতো কাঁদবে তাও আবার মেয়েছেলেরই নরম বুকে মুখ রেখে এ কথা কোনদিন সে ভাবতে পারেনি। কিন্তু তার কোন লজ্জা নেই। তার কোন বোধ নেই, সে কি করছে সে জানে না। জানতে চায় না। সে শুধু ভাবে তার খুব কষ্ট হচ্ছে, পাগলের মতো কষ্ট হচ্ছে। সে তো হেরে গেছে কবেই। সে আর নতুন করে জিতবে না কারো কাছে। কোনদিন সে জিতবে না। তার জেতার মতো ক্ষমতাই নেই। সে আসলে মেয়েছেলের কাছেই হেরে গেছে। একটা নেকা কুত্তার মতো হয়ে গেছে দিনকে দিন। দিলু ভাবে ঝুমা থাকলে তার কিছু আসে যায় না। ঝুমাকে ও ভালোবাসবে। খুব করে ভালোবাসবে। ও কোনদিন ওর ভালোবাসাকে কষ্ট দিতে চায়নি।

    --ঝুমা তোকে আমি ভালোবাসি

    --জানি।

    --তোর বরকে ছেড়ে চলে এসেছিস আমার কাছে?

    --আমার কোন বর নেই।

    --আমি আছি, তোর আমি আছি, দেখ ঝুমা তোর আমি আছি

    --তুমি আছ।

    --হাঁ আমি আছি, তোর জন্য আমি সব করতে পারি।

    --হ্যাঁ তুমি আমার জন্য সব করতে পারো।

    দিলু তারপর আবার নতুন করে পাগল হয়ে যায়। প্রচুর আদর করতে থাকে ওর প্রেয়সীকে, মারে না। আলতো করে স্পর্শ করে একে একে সমস্ত গোপন ও প্রকাশ্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। উল্টে ফেলে চুমু খায় বুকে, গালে, নিতম্বে, নাভিতে, যোনীতে আর তারপর বলে যেতে থাকে

    --ভালোবাসি তোকে ঝুমা। ভালোবাসি ভালোবাসি। তুই ছাড়া কে আছে আমার বল তো? তোকে আমি ছাড়া কেউ এত ভালোবাসে? কেন তুই বুঝিস না? ভালোবাস ভালোবাস, আমায় ভালোবাস, তোর শরীর কি নরম, কি নরম। কী ভালোবাসা তোর বুকে...

    আরও অনেকক্ষণ ধরে চলতে থাকে সে ভালোবাসা। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্বপ্ন সফল হওয়ার আনন্দে মেতে ওঠে দিলু। ক্রমাগত শরীরে সঞ্চারিত হতে থাকে শান্তি। তারপর একসময় দিলু বুঝতে পারে সে নিঃশেষিত হয় সেই নারীর গহ্বরে, ঘুমে ঢলে আসে, শিশুর মতো মুখ রাখে বুকে। মদের বোতল গুলো হাঁ করে কখন গড়িয়ে ঢুকে গেছে খাটের তলায়, পড়ে থাকা মুর্গির ঠ্যাংগুলোতে ভাগ বসাতে লাইন দিয়ে চলে এসেছে পিঁপড়ের দল। ফ্যানের হাওয়াটা এতক্ষণে পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। একঘেয়ে, খসখসে। গোছানো ঘরটা জুড়ে তখন আলো আঁধারির মায়া। আবছা অন্ধকারে কারোরই তো মুখটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। তাই দেখা যাচ্ছে না সেই নারীর চোখে তখন জল, পদ্মপাতার মতো ডাগর উদাস দুটো চোখে টলটলে জল। সে চোখ নিদ্রাহীন। সে চোখ তো চিরকালের জন্য নিদ্রাহীন।

    সকাল হয়েছে অনেকক্ষণ। ঘরটাতে এখন আলোয় আলো। পর্দার ভেতর দিয়ে আসছে বলে নরম এখনো, আসলে বাইরে রোদ্দুরের তেজ ভালই। দিলু উঠে পড়ে, ঠাহর করতে সময় লাগে কি ঘটেছিল। কটা বাজে বুঝতে চেষ্টা করে। প্রথমে আন্দাজে পরে নিজের হাত ঘড়ি খোঁজার চেষ্টা করে। সেটা খুঁজে পায় না। তারপর দেখে ঘরটার বিরাট জানলাটার ওপরে একটা বড় ঘড়ি তাতে সাড়ে বারোটা। দিলু তারপর বুঝল সে উলঙ্গ। লজ্জা পেল, এদিক ওদিক খুঁজে দেখল টিভির পাশে খোলা কাবার্ড এর থেকে ঝুলছে ওর প্যান্ট আর টি শার্ট। সুন্দর করে জাঙ্গিয়াটা প্যান্টের মাঝে ঢুকিয়ে রাখা। মানি ব্যাগ, মোবাইল আর ঘড়ি বিছানার পাশের ছোটো টেবিলটায় সাজানো। সারা ঘরে কোথাও কোন ধুলো বা কাল রাতের খাবার দাবারের কোন চিহ্ন নেই। জুতোটা দরজার কাছে র‍্যাকে যত্ন করে সাজানো, বিছানার পাশে একটা সাদা তোয়ালে ভাঁজ করে রাখা। হাল্কা একটা সুন্দর গন্ধ ঘরে। আস্তে আস্তে মনে পড়তে থাকে গতকালের সব কথা। সে কি করেছে কাল! মেয়েটা কোথায় গেল! মেয়েটাকে কি অমানুষিক কষ্ট সে দিয়েছে সারা রাত ধরে! কিন্তু গেল কোথায় মেয়েটা? উঠে দাঁড়ালো, তোয়ালেটা জড়িয়ে নিয়ে কোমরে সে টয়লেটটা খুলে দেখল। কেউ নেই। ঘরের দরজা খুলে দুপাশে লক্ষ্য করল সেখানেও কেউ নেই। ওপাশের একটা ঘর থেকে টি ভি চলার জোরে শব্দ আসছে। তারপর আবার ভেতরে ঢুকে গেল সে। দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি দিল। এতক্ষণ সব খোলা ছিল। ছি ছি। ওর নিজের লজ্জা করল। তারপর স্নানে ঢুকল। টয়লেট শ্যাম্পু সাবান সব রাখা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, বড় আয়নার সামনে বাথ টাব। শাওয়ার খুলে দিল। যতটা পারে জোরে। ঠান্ডা জল তার শরীরে এসে পড়তে শুরু করল। আহ। কি দারুণ জলের স্রোত বয়ে যাচ্ছে শরীর দিয়ে। কতদিনের নোংরা আবরণ যেন ধুয়ে ধুয়ে চলে যাচ্ছে সে জলের সঙ্গে। কতদিন পর নিজেকে দেখছে ভালো করে। খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা গালটায় হাত বোলাল। মনে হল নিজেকে দেখেনি আগে কোনদিন। কে সে? সেকি একটা রাক্ষস? ভয়ংকর বলে ভেবেই ভালো লাগে কেন নিজেকে। তারপর মনে হয় কে ভাবছে এ সব কথা? সে কি কোনদিন আগে ভাবত নিজেকে নিয়ে কিছু? বা কোন কিছু? আগুপিছু? কাল বিকেলেও যেমন। সে কি করেছে এতোগুলো বছর? তার কি করার ছিল? কাকে সে কষ্ট দিতে চেয়েছিল? কার পাওয়ার কথা ছিল? ঝুমা চলে যাওয়ার পর এতগুলো দিন কি ভাবে কেটেছে তার? মেয়েটার মুখটা মনে পড়ছে। আজ বহুদিন পরে ওর নিজেকে হাল্কা লাগছে, ও মেনে নিতে পারছে মাঝের দুঃসহ দিনগুলো। এই মুহূর্তে ও সত্যি ক্ষমা করতে পারছে, অনেককেই। কিন্তু কেন এত কষ্ট সহ্য করছিল মেয়েটা? পয়সা পেয়েছে বলে? পয়সা দিয়ে তো বহু আগেও এক দুবার ও মেয়েছেলেদের সঙ্গে যা করার করেছে। কিন্তু ওরা কেউ ওরকম নয়। কিন্তু এর অন্য কিছু ছিল। কি ছিল? নামটা সত্যি জানা হয়নি। কিভাবেই বা ও বলতে পারতো। দিলুতো আসলে তো ওর নাম তো জানতে চায়নি। কিন্তু নামটা জানাটা খুব দরকার ছিল। ওর নাম কি মায়া?

    বাইকটার বেরিয়ে যাওয়াটা দূর থেকে লক্ষ্য করল দুটো চোখ। সে দেখল এদিক ওদিক কাউকে খুঁজতে খুঁজতে লম্বা ছিপছিপে চেহারার লোকটা আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল দূরে। সেকি তাকেই খুঁজছিল। ঘুম থেকে ওঠার পরেও এতক্ষণ কি করছিল ঘরে বসে? অপেক্ষা করছিল ওর জন্য? না তা কি করে সম্ভব? লোকটার তো তাকে মনে রাখার কথা নয়। কেনই বা রাখবে। এতক্ষণ সে নিজেই আড়ালে ছিল কিন্তু এখন আর আড়াল নেই, সে এসে দাঁড়িয়েছে বাড়িটার এক্কেবারে গেটের সামনে। আড়াল রাখার কথাও নয় কিন্তু ঘুরে ফিরে সেই একই কথা মনে আসছে কেন বারবার। কেন মনে হচ্ছে লোকটা তাকে খুঁজছিল। নিজের মনেই হেসে উঠল সেই চোখ। আচ্ছা সে কি বোকা? এসব ভাবছে কেন। সে চলে আসে একতলার পেছন দিকে তার নিজের ঘরে। এই ঘরটা ওপরের ঘরগুলোর মতো অত চমৎকার নয়, কিন্তু ভালোই। প্রয়োজনের অনেক কিছুই ও কিনেছে একটু একটু করে আর কিছু তো ছিলই। এসে বসে কাঠের সোফাটায়। পড়ে আছে টেবিলে বইটা, এতক্ষণ ধরে মন দিতে পারেনি এবার মনে হচ্ছে শান্ত হয়েছে ভেতরটা। বইটা নিয়ে বসে। এই বইটা কেন যে এত দিন এড়িয়ে চলেছিল কে জানে। সরস্বতী আসে। এই সময় একটা সিরিয়াল হয়। জয়াদির ঘরেও টিভি আছে তাও এখানেই আসবে। কিন্তু একদম টি ভি চালাতে দেবে না এখন।

    --তুমি খাবে কখন?

    --একটু বাদে। আরেকবার স্নান করে।

    --তোমায় একটু তেল মালিশ করে দেবো?

    --না তুই যা এখন, আমি দরকার হলে বলবো।

    --তোমার ওষুধ লাগবে কিনা বড়দি জিজ্ঞেস করতেসিলো।

    --দরকার নেই।

    --তোমার শরীর ঠিক আসে?

    --আছে।

    --দিদি একটা কথা কইব?

    --কি কথা?

    --আমার আজ ভয় লাগতেসে।

    --কেন কি হয়েছে?

    --তোমারে দেখে আমার ভয় লাগতেসে?

    --কেন কি করেছি রে?

    --সকালে রক্ত দেখসি তোমার শরীলে আজ। ঘাড়ে মুহে বুকের কাসে এখনো দাগ গুলো লাল হয়ে আসে। বড়দি বলে দেসে আমার আজ পেশা আসে। তিন নম্বর ঘরে। সব কিছু গুসায়ে রাখসি, সারারাতের খদ্দের। কিন্তু আমার ভয় লাগতেসে।

    কিছুক্ষণের নীরবতা। ঘর জুড়ে। মনগুলো জুড়েও। কি বলবে সে? কি কথা বলতে পারে এই বাচ্চা মেয়েটাকে?

    কোন মিথ্যে কথা? না কোন অতি সত্যি কথা? জীবনের ভয়ঙ্করতার অস্তিত্ব এখানে সরস্বতীও জেনে গেছে কবেই। তার পরেও ভয় ভাঙ্গে না সে জানে। এই জীবন তাকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে প্রতিপদে তো ভয় করেই। ভয় যে দেখায় সবাই। ভয়ে ভয়ে না রাখলে সমাজে বাঁধন থাকবে কেন।

    --মনে না লাগলে শরীরে লাগবে না। মনে লাগাস না। ভয় পাস না। কি রান্না করেছিস?

    --সুক্তা, জিঙ্গে বাটা আর চারা পোনার জোল।

    --বাঃ তোর হাতের ঝিঙে বাটা দিয়ে আমি সমস্ত ভাত খেতে পারিরে সর।

    সরস্বতী কোন কথা বলে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে মাথা নিচু করে। ও এই বাড়িতে নতুন আর এই পেশাতেও পোক্ত নয়। ঝাড়খণ্ড থেকে হাত বদল হয়ে এখানে এসেছে। এক্কেবারে হতভাগা। ও নিজেই প্রথম প্রথম জানতো না আসলে বিক্রি হয়ে গেছে। কার কাছ থেকে কে তাকে কিনেছে সে কথা তো নয়ই। বাংলাদশের মেয়ে। শিলিগুরি বর্ডারের কাছে। বিয়ের নামে পাচার হয়ে গেছে। বাড়ির অবস্থা খুব খারাপ। বিয়ে আরও আগেই হয়ে যেত হয়তো কিন্তু তখনো ওপরে দুই দিদি। তাই সারাদিন দারিদ্র, অবহেলা। সেখান থেকে মুক্তির অপেক্ষায় কাটছিল ওর দিন। গরিবের ঘরে মেয়ে তো সব সময়েই যন্ত্রণা। তার ওপরে অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত হলে তার জ্বালা তো দশ গুণ। বিয়েতেই মুক্তি। মেয়ে জন্মের পাপের প্রায়শ্চিত্ত বরের হাত ধরেই যে হয়। শরৎ বাবুর আমলে কেন, এখনো সমান ভাবেই হয়। একমাসের আলাপে স্কুলে পড়তে পড়তেই দুচোখে সেই মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে বিয়ে করে বসেছিল এক রূপবান ছেলেকে। তারপর কলকাতায় শ্বশুরবাড়ি যাবার জন্য বরের সঙ্গে হাওড়ার ট্রেনে উঠে পড়া। ভোরের হাওড়া স্টেশন তখন আবছা, তারপর আর কিছু মনে নেই। চিঠিও লিখে এসেছিল বাড়িতে, তার জন্য চিন্তা না করতে, সে সুখি হবে।

    --আয়। কাছে আয়। বস আমার পাশে।

    সরস্বতী কাছে আসে। কত বয়েস হবে। খুব বেশি হলে ষোল। পৃথিবীটায় এসে যেন ও নিজেই দোষ করে ফেলেছে। এই বাড়িতে আসাটাও ওর নিজেরই দোষ ছিল তাই ও ভাবে। সরস্বতী এসে বসে। তারপর ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে। তাকে বুকের কাছে টেনে নেয় সে। সেই বুকে, যে বুকে অসহ্য ব্যথা। তাও সে সরস্বতীকে আশ্রয় দেয় সেখানেই। অনুভব করে সে ভিজে যাচ্ছে সরস্বতীর চোখ থেকে বেড়িয়ে আসা গরম জলে। সেই জলে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে কেটে ছড়ে যাওয়া শরীর। যদিও বুকের আসল জ্বালা ভেতরে। সেই ভেতরের জ্বালাকে মাথায় চড়তে দিতে নেই। মাংস চামড়ার ব্যথা তেমন কোন ব্যথা নয়। এই বুক শান্ত না রাখলে সে কি কাউকে শান্ত করতে পারবে? শান্তি চাইতেই তো আসে সবাই তাদের কাছে। সেই শান্তি নিজের মধ্যে ধরে রাখতে হয়। অশান্ত হলে তার প্রভাব কাজের ওপরে পড়ে যে। নিজের মনের ওপরে আরও বেশি পড়ে। স্বপ্নহীন বেঁচে থাকতে হলে নিজেকে শান্ত রাখতে হয়। সে আরও কঠিন। এই কঠিন কাজ একটু একটু করে শিখতে হয়। যারা শান্তি পেতে আসে এই শরীরে তারা আসে সমস্ত ফেলে আসাগুলোকে, সমস্ত না পাওয়াগুলোকে পুড়িয়ে ফেলবে বলে। যদিও নিছক শরীরের জন্যই আসে বেশিরভাগ মানুষ। যদিও এ নতুন কথা নয়, কিন্তু এ সত্যিটাকে নিজের জীবনে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে মানিয়ে নেওয়া? সে পৃথিবীর সব থেকে কঠিন কাজ। পৃথিবীতে মাটি শক্ত হতে হতে পাথর হয় কতদিনে? কোটি কোটি বছরে। আর মন তার পাথর হতে কত সময় লাগে কেউ জানে না। পাথর হওয়ার অনুশীলন আছে। সেও সাধ না। গুমরিয়ে ওঠাকে বশ করতে হয়। যারা আসে আনন্দ পেতে তাদের কাছে অশান্ত হয়ে কি লাভ? এই মেয়েটাকে সে কি বলতে পারে? সহ্য করে যাওয়া ছাড়া আর কি উপায়ের কথা বলতে পারে সে এখন? এখন ও কিছুই বুঝবে না। কাঁদুক এখন। তারপর শান্ত হবে একদিন। সে দেখে মাঝে মাঝে আরও দমকে দমকে বাড়তে থাকে সরস্বতীর কান্না। তারপর কেমন নিস্তেজ হয়। তারপর আবার বাড়তে থাকে। সে হাত বোলাতে থাকে সরস্বতীর মাথায়। সেকি এমন কেঁদেছিল কখনো? না। মনে করতে পারছে না।

    --একটা চাটনি রাঁধিস নি কেন রে?

    --কিসু সিলো না তেমন।

    --দিলীপকে বলতে কি হয়েছিল?

    --দিলীপকা ঘুমাইতেসিল।

    --কাকা? হাঃ। ঘুমোলে ডাকিস না কেন? আমরা ঘুমোচ্ছিনা ওই ঢ্যামনার ঘুমের শেষ নেই। জয়া কর্কশ ভাবে বলে যায়। এর পরে শিউলির দিকে তাকায় তারপর বলে --শিউলি তোকে বলি এইবার কথা পাকা করে নিবি কাজের আগে। এমন কাস্টমার এলে ডবল চাইবি। আজ মিশিরজিকে না করতে হবে। বলব তোর জ্বর।

    --আমার অসুবিধে নেই। তুমি আনো।

    --তোর অসুবিধে না থাকলে তো হবে না। এত দিন এই লাইনে এই সামান্য কথাটা বোঝ না। এইখানে কি আমরা পাঁচ টাকার খদ্দের নিয়ে কাজ করি? যতই তুমি সুন্দরী হও, দামি কাস্টমার তোমার আচড়ানো কামড়ানো বুকে মুখ দেবে কেন? তার সঙ্গে বেইমানি হবেনা? তা কালকের লোকটাই রামবাবুকে নামিয়ে দিয়েছিল, জানিস তো? যত খুনি ডাকাত চোর বেইমান। হারামি। ইমানের পরোয়া শুধু এই মাগিগুলোই করবে। যাক্, তুই লোকটাকে ধরে রাখিস। ডবল চাইবি বলে দিলাম। অবশ্য তোর কাস্টমার হাত ছাড়া হবে না সে আমি জানি।

    শিউলি চুপ করে থাকে। সে জানে জয়াদি ভুল কিছু বলছে না। এই বিরাট বাড়ি ভাড়ার খরচ, মালিক, থানা -- পুলিশ, নেতা চামচা সব কিছুকে টাকা--শরীর আরও কত কিছু দিয়ে যে সন্তুষ্ট করে যেতে হচ্ছে প্রতিদিন তার পুরোটা একমাত্র জয়াদিই জানে। শিউলিকে তো তেমন কোন দায়িত্ব নিতে হয় না। কিন্তু সকলেরই দায়বদ্ধতা আছে। নইলে এক রাতের মধ্যে অন্য জায়গায় চলে যেতে হতে পারে। পুলিশ তুলে নিয়ে যেতে পারে। খুন হয়ে যেতে হতে পারে। এই বাড়িতে উটকো লোক খুব কমই আসে। খুব বিশ্বস্ত, বাছাবাছা ক্লায়েন্ট। ও নিজে অবশ্য বিভিন্ন জায়গায় যায়। কলকাতায় যায় একটা দুটো অন্য বড় শহরেও যায়। তাতে সুবিধে বেশি। ঝামেলা কম। এই তল্লাটের প্রিমিয়াম সেক্স ওয়ার্কারের মধ্যে জয়াদি একজন আর ও। আর দু একজন আছে। বাড়িতেই থাকে তারা। সংসারও করে। এখন অবশ্য শিউলি খুব কাজ পাচ্ছে। এখানে টাকা পয়সার পরিষ্কার হিসেব। থাকা খাওয়ার খরচ, আর ক্লায়েন্টপিছু একটা কমিশন দেওয়া ছাড়া বাকিটা শিউলির থাকে। কমিশনের মধ্যে অবশ্য ক্লায়েন্ট রুমের মেন্টেনান্স খরচ ধরা থাকে। শিউলির নিজের পরিচিতি থেকে কাজ করলে পুরোটাই তার কিন্তু সেটা এই বাড়িতে করা যায় না। কিন্তু এ বাড়ির কাজ থাকলে নিজের কাজ নেওয়া যায় না। সরস্বতীর এখানে অত ডিমান্ড নেই। আসলে সরস্বতীকে সেই মানের বলে ধরাই হয় না। তলানি কাস্টমার কিছু এলে তবে ওর কাজ হয়। তাছাড়া ফাই ফরমাশ খাটে আর দিলীপ না থাকলে রান্নাবান্নাও করে। এখানে সরস্বতীর স্ট্যাটাসটা সেই বেশ্যাপাড়ার মেয়েগুলোর মতোই। যেটুকু রোজগার করে প্রায় পুরোটাই জয়াদি নিয়ে নেয় কারণ ও এখানে হাত বদল হয়ে এসেছে। হাতবদল মানে একরকম কিনে নেওয়া। সরস্বতী দেখতে শুনতে ভালোই কিন্তু ওর ভাষায় জন্য সব কাস্টমার দেওয়া হয় না। তাছাড়া এখনো পোক্ত হয়নি তেমন। এখানে ভালো না লাগলেও মেয়েটার কিছু করার নেই। বাড়ি ফিরে যাওয়া তার কাছে চূড়ান্ত অর্থহীন। পাসপোর্ট ভিসা কিছুই নেই। ধরা পড়লে হোমে পচা ছাড়া কিছুই করার নেই। সেখানেও সব্বাই ছিঁড়ে খাবে। সে অভিজ্ঞতাও তার হয়ে গেছে। কিন্তু এতকিছুর পরেও মেয়েটা তাও অনেকটাই বাচ্চাই থেকে গেছে।

    --আজ তোর নাম বলবি আয়েশা। বুঝেছিস? জয়া বলে।

    --ক্যান?

    --মুসলমান কাস্টমার। ক্রুরভাবে ঝাঁঝিয়ে ওঠে সরস্বতীর ওপর। তারপর শিউলির দিকে তাকিয়ে আবার বলতে থাকে জয়া -- একে বোঝা শিউলি। রেফরেন্সে আসছে। নতুন কাস্টমার। কেমন হবে বোঝা যাচ্ছে না। প্রিমিয়াম ভ্যালু যখন দিচ্ছে তখন সব কিছু করাবে। ওকে বোঝা।

    শিউলি দেখে সরস্বতীর মুখটায় আবার মেঘ ঘনিয়ে আসে। শিউলি বুঝতে পারে। ক্লায়েন্ট বিশেষ কোন ধর্মে গোঁড়া হলে নাম গুলো বদলে ফেলতে হয়। বদলাতে হয় হাবভাবও। তাতে খুশি হয় তারা। এই ব্যবসায় একটা বড় অংশ জুড়ে আছে কল্পনার আবেশ। তাই নিজেদের কল্পনাতেও ক্লায়েন্টরা ওদের ধর্মের কাছে পরিষ্কার থাকতে চায়। ওকে আলাদা করে সন্ধেবেলা বুঝিয়ে দিতে হবে। জয়াদি মাঝে মাঝে বড্ড কড়া করে কথা বলে। যদিও বাচ্চা হলেও এই বিশেষ জীবনের কায়দাগুলো ওকে শিখতে হবে। বাঁচতে গেলে ওকে শিখতে হবে। বাঁচতে গেলে কতকিছু শিখতে হয়। ভালো করেও তো বলতে পারে!

    --আসল সময় বাঙাল বলবি না। না পারলে কোন কথাই বলবি না। মুখে শুধু আওয়াজ করবি।

    জয়াদি অবলীলায় বলে যেতে থাকে। এই খাবার জায়গাটার একটা আড়াল আছে দোতলা ও একতলার বাইরের কাম ড্রইং রুম মতো জায়গাটার থেকে। কিন্তু বাইরেই ম্যানেজার কাম কেয়ার টেকার কাম জয়াদির প্রেমিক মিঃ বিভাস দত্ত বসে আছে। লোকটা অবশ্য বাইরে জয়াদির হাসবন্ড বলেই নিজের পরিচয় দেয়। ও চাইলেই এসব কথা শুনতে পারে। রাঁধুনি দিলীপের কান সবসময় খাড়া থাকে। আর পাহাড়াদার লক্ষণ সেও তো এই সময়ে মিঃ দত্তের সঙ্গেই বসে টিভি দেখে লাউঞ্জে। সেও চলে আসতে পারে যে কোন সময়ে। কিন্তু জয়াদির মুখে কিছুই আটকায় না। আসল কথা হল এরা এই সমস্ত কথা নিয়ে একদম মাথা ঘামায় না। সরস্বতী তবুও লজ্জা পায়, কোন কথা না বলে মাথা নিচু করে শুনতে থাকে। ও এখনো বুঝতে পারেনি যে এ বাড়ির পুরুষ মানুষগুলোও আসলে পরোক্ষ ভাবে এই পেশার সঙ্গেই যুক্ত। ওরা আদপে বিশ্বস্ত কিনা সে ভগবান জানে কিন্তু ওরা জানে ওদের পেটের ভাতও এইখান থেকেই আসে। সুতরাং লজ্জা কারোরই পাওয়ার কথা নয়। তবুও সরস্বতীর ফর্সা কান আর গাল লাল হয়ে যাচ্ছে। লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছে যেন। ওর নিজের মাতৃভাষা উচ্চারণের লজ্জা মনে হয় তেমন বড় কিছু নয় এখন আর। ঘৃণা, অপমানে না অভিমানে তার এই মাটিতে মিশে যাওয়া, তার কারণ খোঁজা অন্তত তার জীবনের জন্য অপ্রয়োজনীয়।

    ঘুমিয়েই ছিল দুপুর থেকে। আর শরীরে দিচ্ছিল না। বাইরে বৃষ্টিতে একটা ঠান্ডা ভাব ছিল, সেটা বেশ আরামদায়ক হল। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল বলা যায় না। কটা বাজে? সাড়ে সাতটা? চার ঘণ্টা ঘুমিয়েছে! শরীরটা ভালো লাগছে। ঘুম দরকার ছিল। ঘুমটা কিসের জন্য ভাঙল? ফোন বাজল কি? একটা মিসড কল হয়ে আছে। বীণাপাণি বুক স্টোর। রিং ব্যাক করে শিউলি। জানল ওর অর্ডার দেওয়া বইটা এসে গেছে। বইটা আনতে এখনই বেরোবে বলে ভাবল। এখান থেকে টোটোয় যেতে অন্তত আধ ঘণ্টা। যদি কিছু পায়, তবে এত রাতে শহর ছাড়িয়ে এ অঞ্চলটায় কিছুই পাওয়া যায় না। এই রাতে একা বেরনোর ভয় সে করে না। কিন্তু ওর একটু বেরোন দরকার। শরীরটা যেন নিজেই বন্ধ হয়ে আছে। দরিয়াপুর বাজার থেকে ফেরার কিছু পেয়ে যাবে কিন্তু এখান থেকে কি পাবে। তাছাড়া সরোকে মানে সরস্বতীকেও কিছু শেখান দরকার। ওষুধপত্র কারো কিছু দরকার কিনা জানতে হবে। বাজারটা যেতে গেলে একটা শর্টকাট আছে যেটা দয়ালপাড়ার ভেতর দিয়ে যায়, মানে বেশ্যাপাড়া। ওখানে ওর বন্ধু হয়ে গেছে কয়েকজন। ওখান দিয়েই যাবে। স্কুটার নিয়েই যাবে। সরোকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে জয়াদির আর নিজেরও কতগুলো ওষুধ আর টুকিটাকি কেনার প্ল্যান করে সে স্কুটারটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। এই অঞ্চলে এখন অনেক মেয়েরাই স্কুটার চালায়। ও বছরখানেক হল দরিয়াপুরে এসেছে। শহরটাতে ও রাতের বেলাতেই বেড়িয়েছে বেশিরভাগ সময়। রাতের মানুষ সে। রাতেই সে বেশি ঘুরতে পছন্দ করে। একটা ওড়না দিয়ে গলা আর মুখের পাশটা ঢেকে রেখেছে।। ওখানে দাগগুলো এখন কালসিটে হয়ে গেছে। বৃষ্টি আসবে না মনে হয়। সাইকেল বা স্কুটার চালাতে তার দারুণ লাগে। এই হঠাৎ মুক্তির স্বাদ নিয়ে সে শুনশান রাস্তা দিয়ে ছুটিয়ে দেয় স্কুটার। দারুণ জোরে।

    একটু বাদেই মিশিরজিরা চলে আসবে। তার আগে সব রেডি রাখতে হবে। জয়া নিজের ঘরে বসে ভাবতে থাকে। এখানকার বিজনেস মিটগুলোর ক্লায়েন্টরা জয়ার কাছে এসে তৃপ্তি পায়। ভরসা রাখতে পারে। এরা সব ক্ষমতাবান লোক। আশপাশের সাধারণ লোকেরা এখানে মাথা ঘামায় না। সবাই বোঝে। কিন্তু বলে না কিছু। ক্ষমতার সামনে মাথা উঁচু করে না কেউ। তাতে অবশ্য ওর সুবিধেই বেশি। নইলে মফঃস্বল শহরের কাছে এমনভাবে ও থাকতে পারত না। ওকে সব্বাইকেই পুষতে হয় কিন্তু তার থেকেও বেশি জয়াকে দরকার এখানকারই ব্যবসাদার, পলিটিসিয়ানদের। তাই তেমন কোন সমস্যায় এই দুবছরে ও পড়েনি। পুলিশগুলো পয়সা খায়। চাপে না পড়লে ঝামেলা করে না। চাপ থাকলে পয়সাটাই জলে যায়। বেশ্যা পাড়ায় প্রচুর অসুবিধে থাকলেও একটা সুবিধে আছে। সব এক সঙ্গে থাকে। সংগঠন থাকে। ওদেরকে হেলাফেলা করলেও ভয় পায় পুলিশ আর পার্টি। কলকাতা দিল্লির বড় সংগঠনগুলোর সঙ্গে সরাসরি যোগ হয়েছে ওদের। তাই ওরা অনেক নিশ্চিন্ত হয়ে কাজ করে। কিন্তু জয়াদের অনেক কিছু সামলাতে হয়। সব শহরেই বেশ্যাপাড়ার সকলের আক্রোশ ওদের ওপরে। ওদের লবি জোরালো। বিভিন্ন এন জি ও, মহিলা সংগঠনগুলোও ওদের জন্যই সমব্যথি, জয়াদের সম্পর্কে তারা খুব শীতল। সংগঠনে ঢোকার জন্য চাপও এসেছে কিন্তু এত দলাদলি সেখানে আর পড়াশোনা জানা শহুরে লোকগুলোর প্রভাব সেখানে এত বেশি যে ওদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ না রাখাই ভাল। বেশ্যা পাড়ার ছেলেগুলোও ভয়ঙ্কর। ঝামেলা করার জন্য মুখিয়ে আছে। ওদের ধারণা ওদের রোজগারে জয়ারা ভাগ বসাচ্ছে। এসব সত্ত্বেও এখনো এখানে পরিস্থিতি জয়া সামলে রেখেছে। কত জায়গা থেকে বদলে বদলে এই দরিয়াপুরে এসেছে সে। এই পালিয়ে বেড়ানোয় কোন লজ্জা নেই। পালানোটাও তো বেঁচে থাকারই অঙ্গ। কত জায়গা থেকে কত লোকে পালায়। দিন রাত নিজেদের কাছ থেকে পালাচ্ছে সবাই।

    আজ রাতে সব কিছুই ঠিকঠাকই আছে মনে হচ্ছে। ঊর্মিলাকে বলাই ছিল ও চলে আসছে। মিতা পারবে বলেছে। কিন্তু শিউলি যে কি করে। ও মাঝে মাঝে এমন ইমোশনালি কিছু কিছু জিনিস করে ফেলে যে মাঝে মাঝে অসুবিধেতে পড়তে হয়। যদিও ওর মধ্যে ওটাই রহস্য। ওর সঙ্গে লোকেরা শরীর নিয়ে মেতে যেমন থাকে তেমন কথাও বলতে ভালোবাসে। শিউলিটাকে ওইরকম নরমসরম দেখতে হলে কি হবে ওর মতো ডাকাবুকো মনের মেয়ে খুব একটা দেখা যায় না। যেখানে সেখানে বেরিয়ে পড়ে যখন তখন এমনকি বেশ্যাপাড়াতেও যায়। ওকে নিয়ে কিছু হয়ে গেলেই মুস্কিল। এক বছর এইখানে এসে কাজ করছে, অবাধ্য নয় কিন্তু আবার নিজের মনেই চলতে ভালোবাসে। কেমন যেন অন্যরকম। শিউলি আজ কাজ করতে পারলে খুব ভালো হত। ওর কাছাকাছি তো এ অঞ্চলে কেউ নেই। কিন্তু সত্যিই কি কেউ নেই? আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে জয়া নিজেকে দেখে। কত বদলে গেছে সে। কত বদলে গেছে তার শরীর। শরীরের বদল চোখে পড়ছে। কিন্তু চল্লিশের কাছে এসে সে এখনো সুন্দরী। এখনো তার আবেদন কমেনি। সে নিজেকে আগের মতো ধরে রাখতে পারেনি কিন্তু বদলে গিয়ে যা হয়েছে সেও কম আকর্ষণীয় নয়। যে টুকু ওজন বেড়েছে হিসেব করেই বাড়িয়েছে। নইলে আকর্ষণ থাকে না, চামড়ার চকচকে ভাব রাখতে গেলে সামান্য ওজন রাখতে হয়। কম পয়সার সেক্স ওয়ার্কাররা না বুঝেই ওজন বাড়াতে স্টেরয়েড খায়। এই দয়াল পাড়াতেই ভিটামিনের নাম করে স্টেরয়েড বিক্রি করে দালাল মাসিরা। সে সব খেলে রোগা জিরজিরে মেয়েগুলো আধপেটা খেয়েও মোটাসোটা হয়ে যায়। এই গরীব দেশে বাড়ির বউগুলো সবাই যেখানে হাড়গোড় বার করা, সেখানে পয়সা দিয়ে শুতে এসেও রোগা মেয়েগুলোকে কারো পছন্দ হয়? স্টেরয়েড খেতে খেতে অভ্যেস হয়ে যায়। সহজে বন্ধ করতে পারেনা, খিদে ঘুম সব চলে যায় ড্রাগের মতো। ওর যদিও এসব না ভাবলেও হয়। ওদের ক্লাসটা এক্কেবারে অন্যরকম। ও নিজে সিগারেট, মদ সেসব কিছুই খায় না। খাবারও খুব হালকা খায়। ওর ক্লায়েন্টরাও কেউ ড্রাগ চায়না এখানে। ড্রাগের কাজ ও করে না সে কথা প্রথমেই সে পরিষ্কার করে দেয়। রেফরল ক্লায়েন্টস যারা আসে তারা এসব জেনে বুঝেই আসে। কিন্তু বাকি অনিয়ম অত্যাচার, সে তো কম হয় না। উৎকণ্ঠা, চাপা ভয়, সেসবকে তো হালকা করা যায় না। কিন্তু শরীর কে তো পুষতে হবে। আরও বেশ কিছুদিন থাকতে হবে টিকে। হবেই। যে কোন সময়ে মারাত্মক ব্যাধি ঢুকতে পারে। খুব বেছে চলতে হয়। খুব সামলে চলতে হয়।

    জয়ার কাছে আগের থেকে এখন আরও অনেক বেশি ক্ষমতা। কারণ সে অনেক ক্ষমতাবানেরই অনেক কিছু জানে। কিন্তু জয়া গোপনীয়তা রক্ষা করে। করতেই হয়। কিন্তু পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস নেই। জয়া না থাকলে আবার কেউ নতুন জয়া হয়ে আসবে। ওরাই আনবে। শিউলির বয়েসে সে কেমন ছিল? ওর মত অত ভালো ইংরাজি না জানলেও ফিগার তারও কিছু কম ছিল না। শিউলির বয়েসে সে এক বাচ্চার মা। একসময় ভালো গান গাইতে পারতো নাচতেও পারত। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ সব ঠিক করতে করতে আসল জায়গাতেই ভুল করে বসে। সেও ভুল করেছিল। জীবনে সে কি চেয়েছিল সে বিষয়ে আর সে আফসোস করে না। পিকলুকে কোলে নিয়ে সে যখন বেরিয়ে এল তখন সবাই তাকে আহা উহু করেছিল। কিন্তু রাখতে চায়নি কেউ। দাদা নয়। কোন বন্ধু নয়। কি করত সে? পড়াশোনা শেষ করার আগেই বিয়ে করে ফেলেছিল। যে চাকরি সে পাচ্ছিল তাতে কলকাতায় থেকে ছেলে মানুষ করে জীবন ধারণ করে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা অসম্ভব ছিল। ওইসব ফালতু চাকরিতেও সহকর্মী পুরুষদের দিনরাত সব অসহ্য প্রস্তাব আর মহিলাদের অকারণ হিংসে তার জীবন নরক করে তুলেছিল। তার কাছে একটাই রাস্তা খোলা ছিল। তার কোন আফসোস নেই। সে সম্মান নিয়ে বেঁচেছে। ও কোথাও ছেলের কোন ছবি রাখে না। কোন ছবি রাখতে নেই। ছেলের বদলে যাওয়া মুখগুলো ও মনে মনে দেখার চেষ্টা করে। ওর যে ছেলে আছে সে কথাই কেউ এখানে জানে না। জানাতে নেই।

    পিকলুটা এক্কেবারে অন্যরকম। কি চমৎকার দেখতে হয়েছে! শান্ত, মার্জিত, লম্বা, ফর্সা। দাড়ি রাখে ইদানিং। সকলে বলে মাতৃমুখি পুত্র নাকি সুখি হয়। মনে মনে বলতে থাকে জয়া-- সুখি হোস বাবা। তোর মতো বয়েসে আমাকে বেড়িয়ে পড়তে হয়েছিল অনিশ্চিত পথে। ঈশ্বরের অসীম কৃপা তুই ছেলে হয়ে জন্মেছিলি। নইলে মেয়ে হলে আমি এভাবে মানুষ করতে পারতাম না। জয়া মনে মনে ভাবতে থাকে। ওর ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেই চাকরী করবে না, আরও পড়বে। ছেলে বলে বিদেশে ফেলোশিপ পাওয়া নাকি ওর পক্ষে খুব কঠিন নয়। আচ্ছা বিদেশেও তো কত মেয়ে থাকে ওর মতো। এত পালাতে হয় তাদের? এত অসম্মান হয় তাদের প্রতি পদে? নিশ্চয়ই হয়। সব জায়গাই সমান তাদের জন্য। কত কিছু ভাবতে থাকে জয়া। যাদবপুরে যেদিন ছেলেকে ভর্তি করিয়েছিল সেদিন ফিরে এসে একা একা সারাদিন কেঁদেছিল আর ভগবানকে ধন্যবাদ জানিয়েছিল। সে যে কখনো আশা হারিয়ে ফেলেনি তার এটাই সব থেকে জয়। সে আর কি করতে পারতো? ডাক্তার তার মেধা, মোক্তার তার বুদ্ধি আর জয়া বেঁচে থাকে তার সৌন্দর্য দিয়ে। সমাজ তো তার দায়িত্ব নেয়নি। তাই সে পুলিশকে ভয় পায়নি, গুন্ডার চোখ রাঙ্গানিকেও পাত্তা দেয়নি। তার কাজ এখন অনেকটাই হয়ে গেছে। বাকিটার জন্য সে এই যুদ্ধ থামাবে না।

    সে উঠে দাঁড়ায়। এক্ষুনি হয়তো ঊর্মিলা আসবে। ওর মেক আপের হাতটা চমৎকার, খুব ভালো করে সাজিয়ে দিতে পারে আলতো করেই। নিজেও খুব সুন্দর সাজে। স্নান করে আসবে এখন। তার আগে বিভাসকে সব কথা বলে দিতে হবে। ও ব্যবস্থা করবে। শিউলি কি ফিরল? ওর শরীর কেমন আছে কে জানে। বলেছিল একবার পারবে বলে। আসলে লোক দেখে বোঝা যায় না। পুরুষ ভাবে পয়সার বিনিময়ে তাদের সব কিছু ভাবেই চাওয়া যায়। চরম সময়ে সেটাই মনের মধ্যে ওদের ঘুরতে থাকে। কাল যেমন একটা ভয়ঙ্কর লোক শিউলিকে সাঙ্ঘাতিক অত্যাচার করে গেছে। ওর হাঁটা দেখেই ওর ব্যথার কথা বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু শিউলি এসব নিয়ে কিচ্ছু বলেনি। দারুণ শক্ত মেয়ে। অবশ্য সেই বা কাকে কি বলতে পেরেছিল। জয়াকেও কতবার এমন ক্লায়েন্ট সামলাতে হয়েছে। এখানে কি কাউকে কিছু বলা যায়! আজ ও শাড়ি পড়বে। সিল্কের শাড়িতে ওকে সব থেকে ভালো লাগে। কোন শাড়িটা পড়বে? এখনই বেছে রেখে দিতে হবে। নীল রঙ পছন্দের বলে নীল রঙের সিল্কের শাড়ি অনেক হয়ে গেছে। এইবার মিশিরজীরই দেওয়া ময়ূরকণ্ঠী নীল শাড়িটা পড়বে। উনি খুশি হবেন। মিশিরজি আসার পর থেকে এখন ওকে আর অন্য কারোর সঙ্গে কাজ করতে হয় না। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়িটা বদলে যাবে। মিশিরজির সঙ্গে পয়সা নিয়ে কোন বাড়তি কথা বলতে হয় না। ওর কাজে বাড়তি কোন অশান্তিও থাকে না।

    #

    একটা জিনিস শিউলি মেলাতে পারছে না। বইয়ের দোকানে ওই ছেলেটা কি করছিল। নিশ্চিতভাবে ওই ছেলেটাই। লম্বা, ছিপছিপে, শ্যামলা। ওর ঢোকা আর ছেলেটার বেরিয়ে যাওয়ার মুখোমুখি দেখা। শিউলিকে ও চিনতে পারেনি সে ব্যাপারে ও নিশ্চিত। কিছু একটা একমনে ভাবছিল ছেলেটা। কিন্তু শিউলি ভুল করেনি। এ সেই। জয়াদি বলছিল আজ এক সঙ্গে অনেককে চাই। শিউলি ফিরছে। শরীর এখন ফিট। -- আঃ। হেলমেট না পড়েই হাওয়া খেতে খেতে স্কুটার চালিয়ে দিল সে। অন্য কিচ্ছু ভাববে না সে। সে উড়ছে, তার মন উড়ছে, এই আলো আঁধারির শহরের রাস্তা তার কাছে মোহময়। সে পার করে যাচ্ছে কত লোক, কত মুখ, কত সময়। পাড় করে যাচ্ছে এই দীর্ঘ শুনশান রাস্তা, যার বুক ধরে কিছুক্ষণ পরেই সে পৌঁছবে তার নিজের ঘরটাতে, যেখানে সে সাজিয়ে রেখেছে তার পছন্দের জগত নিজের মতো করে। যদি এখান থেকে চলে যেতে হয় তাহলে বইগুলোকে নিয়ে যেতে পারবে?

    #

    বাড়ির সামনে একটা বাইক আর তার ওপরে একটা লোক যার মুখটা বোঝা যাচ্ছে না আলো পেছনে থাকার জন্য। শিউলি যখন স্কুটার থামালো, বাইক থেকে নেমে এল একটা লম্বা শক্তিশালী চেহারা, এসে তার সামনে দাঁড়ালো। সেই চেহারাই তো! সেই মুখই তো! ওই রাতের পরে একটু আগে যাকে বইয়ের দোকানে দেখেছিল। কি চায় এখন? কেন এসেছে? দাঁড়িয়ে আছে তার জন্য? তবে কি ওকে চিনতে পেরেছিল? ফলো করছিল? জানত কিছুক্ষণেই ফিরবে, তাই আগেই এসে দাঁড়িয়ে আছে। মদ খেয়ে আছে? এসব ভাবতে ভাবতেই একদম সামনে এসে দাঁড়ালো সেই শরীর, মাথা নিচু করে। কয়েক মুহূর্ত কোন কথা নেই। ঘটনার আকস্মিকতায় সেই কয়েকমুহূর্তই মনে হচ্ছে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি দীর্ঘ। একটা বুড়ো কুকুর বাইকটার পেছনের চাকাটা শুঁকে তারপরে প্রস্রাব করে চলে গেল। চলে গেল যে পথে এসেছিল সে পথেই। এরও কিছুক্ষণ পরে যেন এক যুগের নীরবতা ভেঙ্গে সেই শরীরে থেকে কোন কথা বেরোতে চাইল। কিন্তু কোন শব্দই বেরোল না। শুধু দাঁড়িয়ে থাকল পরিচিত আর অপরিচিতর মাঝামাঝি থাকা দুটি মানুষ। মুখোমুখি। আর থাকল সেই নীরবতা। তারপর কোন এক সময় ধীরে ধীরে সেই শরীর মাথা নিচু করে চলে গেল বাইকের দিকে। কিছক্ষণের মধ্যেই বাইকটা মিলিয়ে গেল দূরে।

    ।।১০।।

    এবারের তরুণ সঙ্ঘের গণেশ পুজোর জমকই আলাদা ছিল। দিলু আর বেদো খুব খেটেছিল। গত কয়েক বছরের গণেশ পুজোয় এবারেই প্রথম এত জাঁকজমক হল। সাত দিন টানা হই হুল্লোড় তো ছিলই তার মধ্যে সব থেকে বড় চমক ছিল বিধায়কের ফিতে কাটতে আসা। গণেশপুজোর ব্যাপক সফলতার পরে দিলুকে এবার দুর্গা পুজোর সেক্রেটারি করেছে ক্লাব কর্তারা। পুরোদমে দুর্গা পুজোর কাজ শুরু হয়ে গেছে। আর তো মোটে দেড় মাস। সামনের বারে রামবাবুর মতো হনুমান পুজোও তাকেই করতে হবে, বলে দিয়েছে সব্বাই। রামবাবুই বছর সাত আটেক হল এই অঞ্চলে বড় করে হনুমান পুজো শুরু করেছিল। বেদো বলত রামের হনুমান পুজো। ওর দেখাদেখি এখন অনেক ক্লাবেই হনুমান পুজো হচ্ছে। পার্টিও চাইছে পুজো--আচ্চা হোক। দিলু কোন কিছু না ভেবেই এই সময়টায় নিজেকে এই সবের মধ্যে ডুবিয়ে রাখতে চেয়েছিল। তার আর অন্য কিছু ভাবার মতো ইচ্ছে ছিল না। যত ব্যস্ত থাকা যায় তত ভালো থাকা যায়। ঝুমাকে ধীরে ধীরে মুছে ফেলতে চাইছিল সে। দিলুও অবাক হয় আর ভাবে। কোন দিকে যে তার জীবন চলেছে! এত দায়িত্ব নিয়ে সে যে এসব কাজ উতরে দিতে পারবে সেটা কি আগে থেকে ভেবেছিল? বা কোন দিন গণেশ পুজো বা হনুমান পুজো করবে ভেবেছিল! তাছাড়া এসবে শুনেছিল নাকি আগে? দিলুতো ছোটোবেলা থেকেই এদিক ওদিক ঘুরেছে পশ্চিমবঙ্গের অনেক জায়গায়, তেমন কোন দিন কোথাও দেখেনি। কারখানায় বছরে দুবার মালিকের ছোটো ছেলে আসত, এক বিশ্বকর্মা পুজোয় আর একবার হালখাতায়। সেটাই তো গণেশ পুজো বলে জানত। কিন্তু হনুমান সে তো কস্মিনকালেও না। অবাঙালি এখানে অনেক আছে, তবুও আগে দেখেনি। কুমারদারাও তো বাঙালি নয়। তারা তো দুর্গাকেই পুজো করত, এখনো করে ছোটো করে। কুমারদা সেদিন বলছিল এখন ঠাকুর দেবতার পুজো এত বেড়েছে পশ্চিমবঙ্গে যে এবার তেত্রিশ কোটি দিন লাগবে বছরে। কুমারদার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে, কথা বলা মানে অবশ্য শুধু ওর কাছ থেকে শো না। কত কিছু জানে, খুব ভালো মনের মানুষ। বেদোকেও দিলুর আজকাল খুব বুদ্ধিমান মনে হয়। নিজেকেই কেমন নির্বোধ লাগে। বোকা লাগে। হনুমান কি খুব বুদ্ধিমান ছিল? না ওর মতো ছিল! ওর মতো গায়ের শক্তি দিয়ে সবকিছু জয় করার চেষ্টা করত?

    দিলু বোঝে ও আজকাল অনেক বেশি ভাবে, ভাবতে শিখেছেও অনেক। আগে ভাবতে ভয় পেত। অস্বস্তি হত। এখন আর ভাবতে গিয়ে ও পিছিয়ে আসে না। যে কোন ধরনের ভাবনা, যে কোন বিষয়ের ভাবনা যাই হোক যতদূর পারে ভাবনাটাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এই বছর থেকে যেন খুব তাড়াতাড়ি সে বদলে যাচ্ছে। আসলে তার মনটা বদলে যাচ্ছে। কুমারদা বলে ভাঙলে তবেই না গড়া যায়। সে খুব সত্যি কথা। অমন ভাবে না ভাঙলে দিলু বদলাতে পারত না। কুমারদার সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা না হলে ও হাঁফিয়ে ওঠে। ও এদের সঙ্গে মেশে কিন্তু সত্যি বলতে বেদো ছাড়া ওর কারো সঙ্গেই ভালো লাগে না। এদের সঙ্গে না মিশলেই নয়। এটাই তো ওর কাজ। এটাই তো পেশা হয়েছে এখন। কত রকম করে যে মানুষের পেট চলে সে কথা নিজের পেট না থাকলে ও জানতেও পারত না। পুজো করেও যে রোজগার হতে পারে এটা ও আগে বোঝেনি। পুজোর টাকা আসার অভাব হয় না আজকাল। ছোটবেলায় দেখত বাবা চাঁদার হাত থেকে বাঁচতে কত কিছু করত কিন্তু এখন চাঁদার টাকায় পুজোর কিসসু হয় না। দিলু নিজেই তো কত স্পনসর ধরছে। গায়ে পড়েও আসছে কত।

    দিলু মনে রাখার মতো কোন কাজ করছে? ও যদি মরে যায় বা ও যদি এখান থেকে চলে যায় কেউ ওকে মনে রাখবে? প্রতিদিন কত মানুষ জন্মায় আর মরে দিলু তাদের মতোই একজন? এই লোকগুলো প্রত্যেকেই কি বেওয়ারিশ নয়? দিলু একটা বেওয়ারিশ লাশ হয়ে থাকবে? হারুকাকা, বেদো ছাড়া কেউ মনে রাখবে না? কেন করছে এসব? ও কিছুর মানে খুঁজে পাচ্ছে না। মানে ছাড়া বাঁচা সম্ভব? না দিলু মানে খুঁজেই বাঁচবে, মানে নিয়েই বাঁচবে। কিন্তু এমন দম বন্ধ করে নয়। আনন্দ করে বাঁচবে। ও মন ভালো রাখার জন্য এখন সব কিছু করবে। মন আর শরীর কেমন যেন জড়িয়ে। ঝুমাকে ও ভুলেই গেছে এখন। বছর খানেক ওর নিজেকে পাগল পাগল লাগত। মন শরীর সব কিছু নষ্ট হয়ে গেছিল যেন। এখন অনেক সামলেছে। বেদো আর ওই মেয়েটা সামলে দিয়েছে। বেদোই বলেছিল যেতে।

    --তোর লালি কেমন আছে রে বেদো?

    --হেব্বি আছে, একটা টাট্টু করেছে।

    --সেটা কি রে?

    --পিঠে একটা ছোট্ট ছবি। মোছে না। দেখিস নি মেসির হাতে?

    --আরে ওটা ট্যাটু। টাট্টু কি রে।

    --ওই হল। লালি ওটাকে টাট্টু বলে হি হি। আমাকেও টাট্টু ঘোড়া বলে। কিছুক্ষণ থেমে থাকে ভালো করে দিলুর দিকে তাকায়। বোঝার চেষ্টা করে দিলুর মনের ভাব। তার পর এক গাল হেসে সে বলে

    --কি রে শিউলির কাছে আর যাবি না?

    --এত টাকা দিয়ে যেতে পারি বারবার?

    --আরে মেয়েটাকে পটিয়ে ফেল।

    একটু চুপ করে থাকার পরে দিলু হঠাৎ বেদোকে জিজ্ঞেস করে-- তোর কি মনে হয় হনুমান কি খুব বুদ্ধিমান ছিল? না কি আমার মতো ছিল?

    --সেকিরে কী হল রে? আমি কী বললাম? বেদো অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে দিলুর দিকে। আর ভাবতে থাকে হনুমান দিলুর মতো কিনা সে তো জানে না তবে ও নিজেই তো হনুমানের মতো। লাংপ্যাঙ্গে ডিগডিগে প্রভুভক্ত হনুমান, যে দিলুকেই রাম বলে জেনে এসেছে ছোটো থেকে।

    #

    কুমার একটু আগেই মাঠ থেকে ফিরেছে। মোরশেদ আসবে বলে একটু আগেই ফিরেছে। এখন আর মাঠে প্রতিদিন তেমন কারো কাজ নেই। সার দেওয়া, কীটনাশক দিয়ে এখন শুধু খেয়াল রাখা প্রতিদিন। মনের আনন্দে মাঠে এখন বেড়ে উঠেছে সবুজের দল। সকালের দিকটা আরাম থাকে তাই ভোরবেলাতেই সকলে জমির তদারকিতে বেরিয়ে পড়ে। ওই দিকে নিমাই আলাদা করে জমি রেখেছে এক খা না। সেই জমিকে নিমাই আলাদা যত্ন করে। চাষির অল্প কিছু জমি রাখা থাকে যেখানে ওরা নিজেদের জন্য শাক সবজি চাষ করে। সেই জমির শাক সবজিতে সারা বছর নিজেদের খাওয়া দাওয়াটা বেশ চলে যায়। এইসব চাষে ওরা কীটনাশক বা অজৈব সার দেয় না। তাই ফলন কম হয়, কিন্তু নিশ্চিন্তে খাওয়া যায়। নিমাইয়ের সঙ্গে কুমার যখন ফিরল তখন দেখল মোরশেদ আর কয়েকজন এসে বসে আছে ওদের বাড়ির বিরাট দালানে। স্নান করে ওদের সঙ্গে কথা বলতে বসল কুমার।


    --দেখ সরকার চাইলে জমি নিতে পারে। কিন্তু তোমরা না দিতে চাইলে ব্যাপারটা অতো সহজ নয়।

    --লোভ দেখাচ্ছে তো সবাই মিলে। জমির দাম সরকার ভালো দেবে বলেছে। কিন্তু আরও অনেক সুবিধে দেবার লোভ দেখাচ্ছে কলবাবুর লোকজন। এই লোভ সামলাতে কজন পারবে কুমারবাবা?

    --সেক্ষেত্রে কি করা যাবে? সারা পৃথিবীতেই তো এই অবস্থা, সে যাই হোক আইনি লড়াইয়ে তো পয়সা লাগে, মনের জোর লাগে, সাহস লাগে। সে সব করতে গেলেও তো তোমাদের একমত হতে হবে। একসঙ্গে লড়তে হবে।

    --লড়ার জন্য কি করতে হবে? আপনি যদি আমাদের সাহায্য করেন।

    --কিভাবে?

    --কোন উকিল যদি ঠিক করে দেন, উকিলের সঙ্গে কথা বলেন।

    --তোমরা আমায় ভরসা করবে কেন?

    --আপনি সিংহ বাড়ির মানুষ। আপনার শরীরে লোভ নেই কুমার বাবা। আপনি ভুল বলবেন না।

    --আইনের পথ একটা লম্বা উপায়। সে খুব বিরক্তিকর, কঠিন। তোমাদের মধ্যেই সবাই সে জেদ ধরে রাখতে পারবে না। তাছাড়া যারা লড়বে তাদের বেশি করে লোভ আর ভয় দুটোই দেখানো হবে। তখন কী হবে? কুমার তারপর নিমাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে -- এদের চায়ের আর কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করো।

    --জমির ঊর্ধ্বসীমা আছেনা কুমারবাবা? মোরশেদ বলে।

    --শোন শিল্পের জন্য বড় অকৃষি জমি সরকার দিতেই পারে কাউকে। সেক্ষেত্রে ঊর্ধ্বসীমা থাকে না। সে শিল্পপতি হোক আর কোন কোম্পানিই হোক। তবে কৃষি জমিকে নেওয়া অত সহজ নয়। কিন্তু কৃষি জমিতে তোমাদের মালিকানাই যদি না থাকে তাহলে তোমরা কি করবে?

    --আমাদের অনেকেরই মালিকানা আচ্ছে। আবার অনেকেরই নাই কুমারবাবা।

    --যাদের নেই তাদের সত্যি কিছু করার নেই।

    --কিন্তু কুমারবাবা যে জমি অকৃষি--জমি বলে সরকারী খাতায় লেখা আছে তার অনেক জমিতেই চাষ হয়।

    --ও সব কথায় কোন কাজ হবে না। আমি যতদূর জানি তোমাদের ইন্ডাস্ট্রির জমিটার বেশিরভাগটাই জোগাড় হয়ে যাচ্ছে অকৃষি--জমি হিসেবে। তার লাগোয়া কৃষি জমিগুলো পেলে প্রকল্প আরও বাড়বে তাই মির্জাহাটির কারো কারো জমি ওরা চাইছে। খুব বেশি জমি আর ওদের প্রয়োজনও নেই। কারখানার জন্য যথেষ্ট বড় জমি ওদের আছে। সেটাতেই দরকার হলে ওরা কারখানা করে নেবে।

    --সে করুক। আমরা যারা চাইছি না তারা দিব না। জান থাকতে দিব না। একদল চাষি একসঙ্গে বলে ওঠে।

    --সে ভালো কথা কিন্তু তোমাদের যে জমিগুলো প্রস্তাবিত কারখানার সামনে বড় রাস্তার একদম লাগোয়া সেগুলো ওরা যে কোন উপায়েই জোগাড় করবে বলেই ঠিক করেছে। নইলে অনেকটা ঘুর পথে ঢুকতে হবে ওদের।

    --আপনি থাকেন কুমার বাবা, আমাদের হয়ে ।

    --কুমারবাবা আপনাদের অনেক জমি বেনামে কলবাবুর নেওয়া ছেল। ওগুলোর এখন অনেক বেশি দাম। আপনারা নিজেও খুব ঠকেছেন। এর বিহিত আপনি করবেন না?

    কুমারের কিছু বলার নেই। ওর কাছে কোন উত্তর নেই। ওকে ওরা বিশ্বাস করছে। গরিব লোকগুলো এই আধুনিক সময়েও পড়াশোনা জানা লোককে নির্ভর করতে বাধ্য হয়। কুমার জানে ওর পরিবারের প্রচুর জমি বেহাত হয়েছে,।কিন্তু আজ এত বছর পরে সে কথা ভেবে কি লাভ! এই মানুষ গুলোকে ও কিই বা বোঝাবে। ও নিজে কোন পথে চলবে, এদের সঙ্গে থাকলে এর শেষ কি, এসব ভাবার চেষ্টা করে। সে নিজে নেতৃত্ব দিতে পারার মতো লোক তো নয়। সে হঠাৎ করে পারবে নেতা হতে? তার নিজের মন কি বলছে সেটাই কুমার বোঝার চেষ্টা করে। মুষ্টিমেয় কয়েকজন প্রান্তিক মানুষ কী করতে পারে! সংখ্যায় হয়তো এরা কুড়ি পঁচিশ বড় জোর, তাদের নিয়ে কোন আন্দোলন গড়ে তোলা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে কোন রাজনৈতিক নেতা নয় যে এটাকেই তুরুপের তাস মনে করে মাঠে নেমে পড়বে আর একেই একটা গণ আন্দোলনের রূপ দিয়ে দেবে।

    কুমারের অসহায় লাগে। যত দিন যাচ্ছে তত বেশি অসহায় লাগছে। সারা পৃথিবীতেই শিল্পের দিকে মানুষের এখন ঝোঁক বেশি। পৃথিবীব্যাপী অত্যাধুনিক শিল্পের বাজারে, বিপন্ন হয়ে পড়েছে সনাতন জীবিকায় জড়িয়ে থাকা মানুষজন। গরিব দেশে এই সমস্যা আরও বেশি। সব বড়লোক দেশ গরিব দেশের বাজার ধরতে চায়। উল্টোদিকে গরিব দেশের উন্নতিশীল হয়ে ওঠার মাপকাঠি হল মানুষের কেনার ক্ষমতা বৃদ্ধি। সামাজিক সচেতনতা আর নীতিবোধের বিষয়গুলো নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। ব্যবসা বাড়ছে, ইনডেক্স বাড়ছে। খাবার উদ্বৃত্ত হলেও খাবারের দাম বাড়ছে। তুলনা করলে উন্নত দেশগুলোর থেকে অনেক গুণ বেশি বাড়ছে। কিন্তু উল্টোটাই হওয়া উচিত ছিল। ইউ এস এ তে কুমার যখন মোটে দু হাজার ডলারের ফেলোশিপ পেত। তখন বারোশ ডলার তাকে দিতে হতো বাড়ি ভাড়ায়। কিন্তু মোটে তিনশ ডলারে খাবারের খরচ দিব্যি চলে যেত। এ দেশে পাঁচ হাজার বাড়ি ভারা হলে পাঁচ হাজার খেতে লাগে। অবশ্য খাবারের জন্য ব্যস্ত হয়ে থাকলেই তো রাজনৈতিক দলগুলোর সুবিধে। সরকার গরিব মানুষগুলোকে বিনামূল্যে চাল ডাল আটা দিয়ে মহান হয়ে যায়। মানুষ বুঝতেই পারে না দু টাকা দরে চাল বা আটা আসলে কোন উন্নয়ন নয়, পিছিয়ে পড়ার রাস্তা। শিক্ষা ব্যবস্থাও এমন যে তা প্রশ্ন করার মতো ক্ষমতা তৈরি করে না। তাই কৃষি এখন সব রকম ভাবে ব্রাত্য, প্রাচীন, পরিশ্রম সাধ্য এক পেশা যাতে কোন ভবিষ্যৎ নেই। অন্তত পশ্চিমবঙ্গে। কুমার বোঝে এখন কৃষির স্বার্থে গণ আন্দোলনে সাড়া পাওয়া কঠিন।

    কুমারের নিজেকে নিজেকে খুব ছোটো বলে মনে হতে থাকে। নিজে এই হতভাগ্য মানুষের কষ্ট সহ্য করতে পারে না আবার এদের মুক্ত করতেও এগিয়ে যেতে পারে না। এদের ভালো রাখার জন্য কোন আদর্শ সমাজ আসলে তৈরি করাই অসম্ভব, কারণ মানুষ আসলে ক্ষমতার উল্টে আরও এক নতুন ক্ষমতা কেন্দ্রের জন্ম দিতে চায়। যেমন এই হতভাগাগুলো এখন ওর কাছে এসেছে। ওকে কেন্দ্রে রেখে ওরা একটা জোর পেতে চাইছে। এও তো এক নতুন ক্ষমতা কেন্দ্র তৈরীর অবচেতন লক্ষণ। উল্টোদিক যাকে মাথা তুলতেই দেবে না।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments