• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৩ | জানুয়ারি ২০২৪ | উপন্যাস
    Share
  • ডহননাগড়ার কাহন (২) : অংশুমান বিশ্বাস



    ।।৬।।

    রাতে ঘুম না আসাটা এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। আজকে বেড়াতে এসেও তাই। পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা ছোটনাগপুরের এই নির্জন হোটেল এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। ব্যালকনি থেকে এই মুহূর্তে সামনের অঞ্চল যেন ঘোলাটে একটা অন্য পৃথিবী। যে পৃথিবীর সঙ্গে সভ্যতার কোন যোগাযোগ নেই। যে পৃথিবীর আসলে নিজেরই প্রয়োজন নেই এই সভ্যতাকে। রাতের অন্ধকারে সে নিজেকে বাঁচাতে পেরেছে। অন্ধকার আসলে ভালো থাকার উপায়। নিভৃতে গোপন অস্তিত্বে। অন্ধকার আসলে সম্ভাবনার গর্ভ। এই মুহূর্তে তাই একাই ভালো লাগছে। সিগারেট ধরাল একটা। ব্যালকনির দরজা আগে থেকেই বন্ধ। হোটেলের ভেতরে ঘুমোচ্ছে সবাই। হয়তো শান্তিতে। হয়তো নয়। নিজেকে এই মুহূর্তে বিচ্ছিন্ন ভাবতে চেষ্টা করল। সংসার, বন্ধুবান্ধবের দল, এই সভ্যতার সব কিছু থেকে। কোন সম্পর্কই যেন চেনা লাগে না আর। ছোটবেলার বন্ধুদেরও নয়। শুধু বন্ধু, পরিজন, অফিসকাছারি কেন, এই সময়টাই যেন মিলছে না কিছুতেই। মানুষ নিজেকে যে কেন এত মহান করতে চায় সে বোঝে না। মানুষের বানানো সভ্যতাই এর কারণ। বৈদিক যুগের আগে সভ্যতার অহমিকা মনে হয় এমন ভাবে ভারতবর্ষে কখনো ঢোকেনি। কারণ তখন থেকেই সংস্কৃতির বদলে সভ্যতা হয়ে উঠেছিল বেশি সম্মানের। আর তারা ভারতের আদি বাসিন্দাদের বলে উঠেছিল অনার্য, যেন আর্যরাই সেই অমোঘ মানদণ্ড। ধুস্। আবার সেই ভাবনা। এসব ভেবে এই মুহূর্তকে ও নষ্ট করবে না। সে এখন চলে যাবে অন্য কোথাও। কোন সত্যি গুহার পৃথিবীতে।

    বাইরে বৃষ্টি। হাল্কা আগুন জ্বলছে গুহার মুখটাতে। সে আজ দ্বারী। আশপাশে দুটি একটি গুহা আরও আছে। এটিই মূল, সুবিশাল, এখানে মূল পরিবার থাকে আর থাকে সামান্য জমানো খাদ্য। মাংস জাতীয় খাদ্য জমিয়ে রাখার কোন প্রচলন নেই, কিন্তু ফলাদি ও বীজ শুকিয়ে রেখে দেওয়া যায়। যদিও অল্প, অসময়ে তাতে সুবিধে হয়। পাতা ও বল্কলের ভাঁজে রেখে দিতে হয়, থেকে যায় কিছুদিন। বৃষ্টি! সে অতি সুন্দর আবার সে ভয়ঙ্করও বটে। সে সৃষ্টি করে আবার ধ্বংসও করে। ভাসিয়ে নিয়ে যায় গোটা পাহাড়। এই অঞ্চলে প্রলম্বিত রয়েছে প্রাচীন পর্বতশ্রেণী, পাহাড়ে পাহাড়ে চারিদিকে শুধু অরণ্য। অনেক উঁচুতে এই গুহাগুলোর অবস্থান। তবে এ অঞ্চলে হঠাৎ প্লাবন দেখেনি পূর্বজরা। নদী বয়ে গেছে কিছুদূরেই, পাহাড়ের সঙ্গে গা ঘেঁষে চলেছে অনেক দূর। সে ফুলে ফেঁপে কল্লোলিনী হয় এই বর্ষায়। সবুজ হয়ে ওঠে নিশ্ছিদ্র। কিন্তু ভেজা হাওয়ায় সেই শুকিয়ে রাখা জিনিস রেখে দেওয়া যায় না। আর দরকারও হয় না। বৃষ্টি নিয়ে আসে খাদ্যের নিরাপত্তা। পাকা ফল বা ফুল থেকে যে সুরা হয় সে অতি উৎকৃষ্ট। চারিদিকে এখানে মহুয়া ফুলের গাছ। সে ফুলের সুরা পান করেছে আজ সবাই। শেষ করেছে জমানো খাবার। উৎসর্গ করেছে প্রথম বর্ষার শিকার। এক তেজি জংলি গরু। যার ছবি এঁকেছে সে নিজে হাতে। আজ সারাদিন ধরে। দুর্দান্ত গ্রীষ্মের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে প্রথম বর্ষায় তাই আজ উৎসবে মেতেছিল মানুষের দল। সব্বাই এই রাত্রে নিজেকে নতুন করে পেতে চাইছে। এতক্ষণ চলেছে নাচ আর গান। সন্তানরা সব ঘুমিয়ে কাতর একদম গুহার ভেতরে, সে অনেকটা ভেতরে। ওরা আজ সকলেই অনেক কিছু খেয়েছে। বাইরে আহুতি সমর্পিত দেবতা ও পূর্বজর প্রতি। নরনারীরা আজ অতৃপ্তি রাখবে না। আজ থেকে তারা নতুন সঙ্গী নিয়ে বাঁচবে। নিজেদের পূর্ণ সম্মতিতে যতদিন চাইবে। যদি বদল চায় বদলে নেবে আগামী কোন বর্ষায়। সন্তানের দায়িত্ব তো সবার। সন্তান তো শুধু নর নারীর নয়। সন্তান এই পাহাড়ের, এই প্রকৃতির।


    আজ ছিল অনেক রকমের সুরা। হুরোর (ধানের), মহুলো (মহুয়া), জুজুবা (কুল) কত কিছুর। মহুলো সব থেকে পছন্দের কুলাবার। মহুলো উপহার দিয়েছে তারা দূরের দূরের বসতিতে। পেয়েওছে প্রচুর। সব থেকে ভালো মহুলো বানায় উলুখুলার মানুষ জন। ওদের মহুলোর গন্ধই আলাদা। যেমন আলাদা সেখানকার একজোড়া চোখ। যে চোখ বার বার আড়াল থেকে দেখছিল তাকে। যখন সে পাকদণ্ডি পথ বেয়ে বেয়ে চড়তে শুরু করেছিল উলুখুলার পাহাড়ের গভীরে। সে চোখ নজর করছিল তাকেও। কি দুঃসাহস! মেয়ে বলে তার মনে ভয় নেই এতটুকু। সে চোখ ছিল একা। কিন্তু কুলাবারা ছিল জনা পাঁচেক। শক্তিশালী যুবক। নির্বিঘ্নে পৌঁছে দিয়েছিল নতুন জীবনের শুভেচ্ছা প্রতিবেশী পাহাড়ের কাছে। হ্যাঁ তারা পাহাড়ের কাছেই শুভেচ্ছা জানাতে যায়। আশপাশের সব জঙ্গলের কাছে শুভেচ্ছা জানায়। নিচে যে হুলা নদী বয়ে চলেছে তাকে ছুঁয়ে আসে পরম শ্রদ্ধায়। সে শুভেচ্ছা তাদের হয়ে পৌঁছে দেবে উলুখুলার মানুষ উলুখুলার কাছে। কুলাবা বুঝেছিল সে চোখ তাকেই দেখছিল অন্য কাউকে নয়। সেই তার হাতে তুলে দিয়েছিল মাইলি গাছের নতুন চারা। সঙ্কেত যা ভালোবাসার। দুজনে মিলে পুঁতেছিল পাহাড়ের কোলে। ওদের লোকেদের সবার চোখে ছিল প্রশ্রয়, হাসি আর আনন্দ। সেই রাতে ডুবে গেছিল তারা ভালোবাসায়। বলে এসেছিল ফিরবে সে। সেই চোখ অপেক্ষায় আছে। অপেক্ষায় আছে কুলাবাও। ফিরে এসে সারিকে বলেছে সে কথা। সারি আর তার ভালোবাসার দুই সন্তান এখন ঘুমিয়ে আছে এই পাহাড়ের বাকি বাচ্চাদের সঙ্গে। সারিও আজ বেছে নিয়েছে তার নতুন ভালোবাসাকে। নিভৃত আদরে সে হয়ত এখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়েও পড়েছে ভালোবাসার গুহায়, কাছেই। আর কিছুক্ষণ পরে জেগে উঠবে মুগোয়ারা (পূর্বজ)। তখন তাদের সামনে দাঁড়াতে হবে কুলাবাকে। বুকে হাত দিয়ে মাথা নত করে। আশীর্বাদ আসবে বিদ্যুতের ভাষায়। কিন্তু সে এখনও মনে হয় দেরী আছে আরও কিছুক্ষণ। সে আবার ভাবতে থাকে নতুন ভালোবাসার কথা। এবার বদলে যাবে তার জীবন। তাকে চলে যেতে হবে এই পাহাড় ছেড়ে উলুখুলায়। থাকতে হবে সেখানে। ওদের সঙ্গে করতে হবে শিকার, ফল ফুল বীজ আহোরণ। ওদের মতো বানাতে হবে মহুলো। সমর্পণ করতে হবে নিজেকে ওই পাহাড়ের কাছে। ওর নিজের ভালোবাসার কাছে। এর আগে সে পাহাড় বদলায়নি কোনদিন। সারি তো এ পাহাড়েরই মেয়ে। তাই তাকে যেতে হয়নি নতুন কোন জায়গায়, ভালোবাসার পরীক্ষায়। কেমন হবে সে পরীক্ষা? সারিকে সে ছাড়তে চায়নি আগে। কিন্তু কিছুদিন হল সারিই তাকে ডাকত না কাছে। আসলে কুলাবা আঁকতে ভালোবাসে। সারি ডাকাডাকি করলেও সে ভাবতো আঁকার কথাই। কেমন করে একটা তাকত্ওয়ালা ষাঁড়ের ছুটে আসার দৃশ্যে গতি আনা যায়, সেটা সে কল্পনা করে যেত দিন রাত আর ভুলে যেত আশপাশের কথা। এমন আঁকা এখানে কেউতো আঁকেনি আগে, মানে নিজে কখনো দেখেনি এই পর্বতের কোথাও। এখানে কম মানুষই ছবি আঁকে। শুনেছে আরও কোথাও নাকি মানুষ আছে। সেখানেও তারা ছবি আঁকে। বুড়ো কিলুক নাকি সেখানে গেছিল। সে ষাঁড়ের ছবি দেখেছে। আরও অনেক অনেক ছবি নাকি সেখানে আছে। কিলুক কত জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। বাঁধন ছাড়া। আর সব জায়গায় গিয়ে অন্য জায়গার গল্প শোনায়। সে বলেছিল যেদিকে সিংবঙ্গা ডুবে যায় সেখানে নাকি এক পাহাড়ে সবাই ছবি আঁকে। সেটা নাকি ছবির পাহাড়। অন্য পর্বতে। এই পর্বতের শেষে মাঝে নাকি সমান জমি। সেসব পেরিয়ে সে নাকি অনেক অনেক দণ্ড দূরে। কিন্তু কিলুক নিজে ছবি আঁকতে পারে না। গান গায়। আর গানে গানে গল্প বলে। যদি ছবি আঁকতে পারতো তাহলে ওর কাছ থেকে অনেক আগেই জেনে নিত ওই পাহাড়ে ফুঁসে আসা মোষ কেমন করে এঁকেছে তারা। আজ এতদিন পরে সে যা চাইছিল তা পেরেছে। সে ওই ছুটে আসাটা ওর আজকে শেষ করা আঁকাটাতে ফোটাতে পেরেছে পুরোপুরি। সে বলতে চাইছিল সেই আনন্দের কথা তার আসল বন্ধু সারিকে। কিন্তু সারি তো আর তার কাছে নেই। সারি আর ডাকবে না তাকে। কুলাবার মন তাই এক ঝলক খারাপ হল। তারপর আবার তার মনে হল উলুখুলার কথা। এত রাতে কাছেই ডেকে উঠল মায়রা (ময়ূর)। হঠাৎ করেই জ্বলন্ত আগুনের পেছনে ভেসে উঠল একটা মুখ। হ্যাঁ। সে মুখ তার বাপের। মুগোয়ারারা আসতে শুরু করেছে।

    বাপ প্রায় পাঁচ বর্ষা হল মিলিয়ে গেছে পাহাড়ে। বাঘে মিলিয়ে দিয়েছে। আজ আবার তাকে দেখতে পাচ্ছে কুলাবা। কুলাবা গিয়ে দাঁড়ায় মাথা নত করে, বুকে হাত রাখে। বাইরে ঝলকে ঝলকে ওঠে বিদ্যুৎ। কুলাবা বলে যেতে থাকে এই পাহাড়ের কথা, জঙ্গলের কথা, নদীর কথা, গাছের কথা, কোয়েলা পাখির কথা। বলতে থাকে কেমন আছে তারা। আর বলে যেতে থাকে সে এ সব কিছুকে আগলে রাখে প্রাণ দিয়ে, যেমন সে আগলে রেখেছে এতদিন তাদের দলটাকে। ঠিক বাবার মতোই। কুলাবা ঠান্ডা স্পর্শ অনুভব করে মাথায়। তারপর চোখ মেলে তাকায়। দেখে বাপের মুখটা অবিকল তার নিজের মুখ। বাপ ওপর নিচে মাথা নাড়ে। কুলাবা প্রার্থনা করে তার চলে যাওয়ার পরে এমনই যেন থাকে এই পাহাড়। তারপর বলে এই পাহাড়ের কাছে থাকলো তার নিজের দুই সন্তান তারা যেন সম্মান রক্ষা করতে পারে এই পাহাড়ের। কুলাবাকে যেখানে যেতে হবে চলে। সেখানেও যেন সে তেমন কাজ করে যেতে পারে। যেমন করেছিল কুলাবার বাপ। সে এসেছিল দক্ষিণের পাহাড় থেকে, তার মায়ের টানে। বাপ বলত পৃথিবীর সব জঙ্গল রক্ষার দায়িত্ব নাকি মানুষের। বাপ তার মাথাটা কাছে টেনে নেয়, আদর করে। তেমন আদর তাকে কেউ কতদিন করেনি। বাপের গায়ে গন্ধ এখনও টাটকা। ঘামের থেকে বেরতে থাকে হুরোর গন্ধ। বাপ হুরো ভালোবাসতো। গাছের মগডালে উঠে যেত নিমেষে, মগরের থেকে দ্রুত সাঁতার কাটত নদীতে। আর এক টিপে ঢুকিয়ে দিত পাথরের ফলা বসানো শিকার--লাঠি বুনো শুয়োরের বুকে। ভালোবাসতো এই পাহাড় নদী, গাছ, মাটি আর তার মাকে। যে এখন এই দলের নেত্রী। কুলাবা এখন বাপের মতো হতে চায়। ভালোবাসতে চায়। সে জানে ভালো না বাসলে সম্পূর্ণ হওয়া যায় না। ভালোবাসার দেবী শরীরে ভর না করলে আঁকতে পারা যায় না। বাঁচতে পারা যায় না। জীবনে আনন্দ থাকে না। সেই দেবীর আশীর্বাদ যেন তার মাথায় থাকে সেই কথা বলে যায় বাপকে। বাপ তার কেবল ওপরে নিচে মাথা নাড়ে। এর পরে আসে তার ঠাকুমা, ঠাকুরদা। একে একে সবাই তারা জড়ো হয় এই দিনে। উৎসর্গ করা খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করে আর তারপর নাচতে থাকে। দুলে দুলে ধীরে ধীরে সেই নাচ চলতে থাকে মাদলের তালে তালে। আলো আঁধারের মধ্যে সে একাই কেবল এই দৃশ্য দেখতে পারে। আজকের দিনে যে মানুষ গুহার মুখ আগলানোর দায়িত্ব পায় সেই দেখতে পায় এই অদ্ভুত দৃশ্য। আজ কুলাবার মা তাকে এই দায়িত্ব দিয়েছে কারণ সে আর কখনো এখানে আসবে কিনা কেউ জানে না। কুলাবার মধ্যে দিয়ে বাঁধা থাকুক এই পাহাড়ের গোপন কথা প্রকৃতির বুকে। এই পাহাড় জঙ্গল যেন সেই কথাই বলে যায় তার কানে কানে। এ জীবন বয়ে চলার, সেই জীবন যেখানে পাপ কি তা মানুষে জানে না। সে জানলে জানে প্রকৃতি। বিচার করে প্রকৃতি। জন্ম মৃত্যু সেখানে নেই। বদলে যাওয়া আছে। সেখানে ফুল, লতা--পাতা, মেঘ, পাহাড়ের পাথর, বাঘের থাবা, হরিণের রক্ত, মানুষের খিদে সবটাই প্রকৃতিরই রূপ। জন্মের পড় জন্ম ধরে মুগুয়ারা একই কথা বলে। সেই তুমুল বৃষ্টি আস্তে আস্তে কমে আসে। আকাশের কোনায় যেন হাল্কা আলোর রেখা। পাহাড়, গুহা, আগুন, কুলাবা আর তার পূর্বজদের মুখগুলো আস্তে আস্তে হাল্কা হয়ে আসে সেই আলোয়। সূর্য উঠছে। শাল, মহুয়া, হরতকি, পলাশ আর কেন্দুর জঙ্গলটার ঘোলাটে ভাবটা কেটে গিয়ে পাহাড়ের কোলে নতুন একটা দিন আসছে।

    বড় হলঘরটার ভেতরে আলো অন্ধকারের মধ্যে দুটো মাত্র মুখ। দেওয়ালের একপাশে কলবাবু বোসে। সব থেকে বড় গদি আঁটা চেয়ারটায়। চেয়ারটা বড় টেবিলটার ওপারে, একদম মাঝখানে। বাইরে বারান্দা, বাগানে ও গেটে কিছু লোক। এই বাড়িটা কলবাবুর এ অঞ্চলে নতুন। হাল ফ্যাশনের প্রাসাদ বলা যেতে পারে। এছাড়া কলকাতাতে আর অন্যত্রও তার বাড়ি আছে। জমি জায়গা তো অনেকেরই থাকে কিন্তু কলবাবুর উত্থান প্রাথমিকভাবে রাইস মিলের হাত ধরেই। এখন ব্যবসা বেড়েছে, বিভিন্ন ধরনের। তাই বিভিন্ন জায়গায় থাকতে হয়। কলবাবু ঠিক কোথাকার মানুষ সে অবশ্য কেউ জানে না তবে এই অঞ্চলে এলে তিনি এই বাড়িতেই থাকেন। কলবাবু সবাইকেই চেনেন। অনেকেরই খুব কাছের মানুষ। কলবাবুর কাছ থেকে অনেকেই উপকৃত। না বলতেই উনি অনেকের পাশে থেকেছেন। একজন প্রভাবশালী মানুষের যেমন হয়, পুলিশ কাছারিতেও ওর খুব স্বাভাবিকভাবেই সমাদর কম নয়। কিন্তু মজার কথা হল কলবাবু সম্বন্ধে সত্যি তেমন কোন কথা জানা যায় না। তিনি লোকচক্ষুর আড়ালে না থেকেও নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখেছেন। তাই তিনি দৃশ্যমান হয়েও অদৃশ্য। সর্বত্রই তিনি আছেন আবার কোথাও নেই। কিন্তু তাতে তার কাজে তেমন কোন সমস্যা হয়নি। বরং সুবিধেই হয়েছে।

    কুমার আর কলবাবু এই মুহূর্তে মুখোমুখি। কলবাবু মোরশেদকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে এক লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলছেন আর নলেজ সিটির সম্পূর্ণ দায়িত্ব কুমারকে দেওয়ার প্রস্তাব করছেন। কলবাবুর নলেজ সিটি যেখানে একই ক্যাম্পাসে থাকবে প্রাইমারি স্কুল থেকে ইউনিভারসিটি। যা হবে আবাসিক। সঙ্গে থাকবে প্রফেশনাল স্কুল। যেমন বি এড, পলিটেকনিক, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেডিকাল ও নার্সিং। কিন্তু কুমার এতে দরিয়াপুরের নিজের লোকজনের আসল লাভ নিয়ে প্রশ্ন তোলে। শুধু তাই নয় মির্জাহাটির ফার্মা কমপ্লেক্সের জমির সমস্যার কোথাও বলে। কিন্তু কিছুক্ষণ কথা বার্তার পরেই কুমার বুঝতে পারে বিষয়টা অনেকটাই এগিয়ে গেছে প্ল্যানমাফিক। দরিয়াপুর কলকাতার খুব দূরে নয়। ট্রেন বাস সব দিক দিয়েই খুব ভালভাবে কলকাতার সঙ্গে জুড়ে থাকা যায়। তাই বিনিয়োগের আদর্শ জায়গা। প্রশাসনিক ভাবেও সমস্ত ছাড়পত্র এসে গেছে। বি ডি ও ওপর তলা থেকে নির্দেশ পেয়ে গেছেন। কিন্তু এটাও ঠিক কোনভাবে আগে ভাগেই গ্রামবাসীরা জানতে পেরেছে। এটা প্ল্যানে ছিল না। আরও দুতিন মাসের আগে এটা প্রকাশ্যে আসত না, অন্তত ধান ওঠার আগে। কারণ এত কাছে থেকেও কুমার ঘুণাক্ষরে কিছুই জানতে পারেনি। যদিও তাতে আসল লোককে খুব বিচলিত বলে মনে হল না। কলবাবুকে কোনদিন চিন্তায় পড়তে দেখেনি কুমার। বাবা বেঁচে থাকতে একবার দুবার দেখেছিল কলবাবুকে। লোকটা তখন অন্য রকম বাংলা বলত। কথা বলার ধরনটাও ছিল অন্য রকম। কথার মধ্যে একটা পরিশীলন এসেছে যেটা লোক বুঝে ও ব্যবহার করে। প্রচুর বদলে গেছে লোকটা। অবশ্য তেমন কোন কথাই আগে ওর সঙ্গে হয়নি। শুধু জানতো জমিগুলোর দাম বাবা ভালো পাচ্ছে। লোকটা একদম দরদাম করে না। কাগজ পত্রেও নাকি পাকা কাজ করে। আর জানতো এই জমিগুলো রাখার মতো ইচ্ছে বাবা বা পরিবারের কারোরই তেমন ছিল না। কারণ জমি রাখলে যে প্রচুর ঝামেলা পোহাতে হতো সেটা ভোগ করতে তারা কেউই চাইছিল না। কিন্তু একটা ব্যাপারেই বিস্মিত লাগে, যে দক্ষতা অর্জন করতে লোকজন দেশে বিদেশে হন্যে হয়ে ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনিং নিতে ছুটছে, ঠিক সেই কাজগুলো কিভাবে এই লোকটা করে একাই শিখে নিয়েছে। শুধু প্রতিভা আর ইচ্ছে শক্তির জোরে। প্রতিভা না থাকলে কোন দিকেই উন্নতি করা সম্ভব নয়। কুমার যেমন প্রতিভাহীন। সারাজীবন ধরে সে শুধু সে তার পড়াশোনাটা চালিয়ে গেছিল। সেই পড়াশোনা যা দিয়ে মানুষের সত্যি কাজে লাগা যায় না। নিজেকে মাঝে মাঝে জগত থেকে বিচ্ছিন্ন বলেই মনে হতো। এক বুক আশা নিয়ে এদেশে ফিরেও সামনাসামনি দেখল সব পৃথিবীরই ভাষা আদপে ক্ষমতা। বাপ ঠাকুরদার লাটসাহেবির অভ্যেসও সে পায়নি আবার ক্ষমতা বা বিত্তের কারবারিও সে হতে চায়নি। নলেজ সিটির দায়িত্বের কথা শুনে হাসি পাচ্ছে। কি হবে এই নলেজ সিটি দিয়ে! কারা পড়বে এখানে! কেন সে সব ছেড়েছুড়ে এখানে এসেছিল! হাড়হাভাতে দেশে নলেজ সিটির ব্যবসা খুলবে বলে!

    রিসেশন দেখেছে দুনিয়া। বড় ব্যবসায়ীরা জেনেছে কেবলমাত্র দুটো ব্যবসা সারা পৃথিবীতে প্রত্যেকটা মন্দায় শুধু ভালো লাভ দিতে পেরেছে এবং দেবেও। চিকিৎসা আর পড়াশোনা। যেহেতু মানুষ মরতে ভয় পায় তাই শেষ কপর্দক বেচেও চিকিৎসা করায় আর যেহেতু শেষ পর্যন্ত সব মানুষই ভেতরে ভেতরে ব্যর্থ মানুষ তাই তাদের অপূর্ণ স্বপ্নগুলো ছেলেমেয়েদের মধ্যে দিয়ে পূরণ করাতে চায়। তাই তারা মরে বেচেও বাচ্চার পড়াশোনায় খরচ করে। খুব জেনে বুঝেই লোকটা এই দুটো জায়গায় ব্যবসা বাড়াবার জোগাড়যন্ত্র করছেন। এটা পরিষ্কার উনি প্রচুর ইনভেস্টমেন্ট টানতে পারছেন বা পারবেন। নইলে এতটা এগোতেন না। আবার এটাও হতে পারে উনি শুধু জমি কমিট করেছেন। কুমার আজকে বুঝতে পারল আদপে কোন কিছু জানতে না দিয়ে কেন পয়সা দিয়ে কুমারকে এতদিন ওর কন্সালটান্ট হিসেবে রাখল লোকটা। স্থানীয় মান্যগণ্যদের মধ্যে কুমার ও তার পরিবার যেহেতু দরিয়াপুরে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ তাই ছিল শুধুমাত্র একটা ঘুঁটি। কুমারের ফার্মের সঙ্গে টাই আপ ছিল একটা চাল। কুমারের প্রোফাইলটাকে কাজে লাগিয়ে তিনি ভেতরে ভেতরে সব কাজ গুছিয়ে নিয়েছেন।

    নাঃ। কোন ব্যবসায়ীর হাতে নিজেকে ব্যবহার করতে দেওয়ার ইচ্ছে তার মতো আহাম্মকেরও নেই। একটা রাগ হতে শুরু করেছে, বেশ কিছুদিন ধরেই। যে স্বপ্ন দেখে সে দেশে ফিরে এসেছিল সেই কাজই সে করবে। কারোর সঙ্গে সে আপোষ করবে না। কুমার একটা ঘোরের মধ্যে বাড়িতে ফেরে।

    #

    কুমারের নতুনহাটার বাড়িটার পেছনের দিকে এখনো ধানের ক্ষেত অনেকটা। ওখানে ওদের নিজের জমি আছে কিছু। এখন দিদি ওর সব মিলে মাত্র চল্লিশ বিঘে মতো। এক সময় একরের পর একর ওদের সম্পত্তি ছিল। আশপাশের সমস্ত গ্রামেই ওদের জমিদারি ছিল। শহর থেকে একটু ভেতরে এই বাড়ি। পুরনো আমলের বাগানবাড়ি যেমন হয়। এই বাড়িটাই বাবা শুধু বাঁচিয়ে রেখেছিল। এটায় কোন শরিকি ভাগ নেই। তাই এখানে কুমার শান্তিতে থাকতে পারে। কিন্তু শান্তি আসলে একটা বেশ প্রশ্নবোধক শব্দ। যার কোন মাপকাঠি নেই আর যা লাভ করারও সর্বৈবভাবে সত্য কোন রাস্তা নেই। তবে নিজের মনকে লুকিয়ে রেখে শান্তি খোঁজা আর কোন কিছুতে আঘাত না পাওয়ার মতো শক্তি সঞ্চয় করে শান্তি পাওয়ার মধ্যে একটা বড় তফাৎ আছে। প্রথমটা মূর্খেরা সবাই চেষ্টা করে আর দ্বিতীয়টার পথে সিদ্ধি পেতে চায় বুদ্ধিমানরা প্রায় সবাই। কুমার এখনও মাঝখানে আছে। সারাজীবন সে মাঝখানেই আছে।

    --বিনুদের ছাগল ক্ষেতে ঢুকিয়ে দিচ্ছে বার বার এবার কিন্তু মালসাভোগের ব্যবস্থা হবে (এখানে বলে রাখা ভালো মালসাভোগ আসলে ছাগল গরুকে খাবারে বিষ মিশিয়ে মারার এক স্থানীয় পদ্ধতি)।

    --কতটা খাবে রে একটা ছাগল?

    --তুমি বোঝ না, মাথায় তুললেই এরা পেয়ে বসবে, সাক্ষাৎ শয়তান বাউরির বাচ্চাগুলো, তুমি জান না গো।

    --হা হা হা। কুমার উচ্চস্বরে হাসে। বলে -- তা ওরা যদি বাউরি শয়তান হয় তাহলে তুই কম কিসে?

    --আমাদের জাতের মান আছে গো তুমি এসব বোঝ না। সদগোপ কখনো ওই সব ছিঁচকেমি করে না। করতেও দেয় না।

    --তোরা এখনো এইসব কথা কপচাচ্ছিস?

    --জাতের অভিমান থাকতে হয় গো থাকতে হয়, নইলে পূর্বপুরুষের আশীর্বাদ আসে না মাথায়।

    --তা আমার পূর্ব পুরুষরা আমার মাথায় আশীর্বাদ করলে আমার লাভ না ক্ষতি কোনটা বেশি হতো সেটা তুই জানিস নিমাইকাকা?

    --তোমরা মানবে না জানি কিন্তু এসব মানুষের সঙ্গে আসে, সঙ্গে যায়।

    --তা তুই গেলে তো আর কেউ তোর বংশে সদগোপের গোঁফে তা দেবে না। তুই কাকে আশীর্বাদ করবি?

    --আমার নিজের ছেলেপুলেকে যদি নাও করি অন্য সদগোপের কুলে আশীর্বাদ করব গো। আর এই বিনুটাকে শায়েস্তা করেই আমি মরবো।

    --যাক। তোকে মরতে হবে না ওকে আমার নাম করে বলে দিবি। একটা অবলা জীবকে মেরে কি লাভ? মালসা ভোগই দাও আর কলার খোসাই (কলার খোসাও বিষ দেওয়ার আরেক পদ্ধতি) দাও দশদিন বাদে মরলে ও ঠিক তোকেই সন্দেহ করবে।

    --প্রমাণ করতে পারবে?

    --তোকে বলছি যা করতে তাই করবি। আর কাল ভোরে আমি তোর সঙ্গে যাব ক্ষেতে। আমাকে নিয়ে যাবি। কুমারের ক্ষেতের জমিতে একটা ছাগল ঢুকেছে তো কি আমাদের খাওয়া জুটবে না?

    --এই করে করে সব গেছে তোমাদের। আশপাশ এমন নয় গো আশপাশ এমন নয়। তুমি বোঝ না ওইটুকু জমির ওপরেও এখন সবার লোভ। বাড়ির সোমত্থ মেয়ে আর জমিকে লোকের নজর থেকে লুকিয়ে রাখতে হয়।

    --তোর নিজের জমিতে কেমন চাষ দিলি?

    --সেও তো তোমাদেরই জমি। দাঁড়াও পোকার মৌসুম আসুক তারপর বোঝা যাবে কি হল। আগামী কয়েকদিন খুব নজর করতে হয় গো।

    --আমাকে তাহলে প্রতিদিনই নিয়ে যাবি।

    --চাইলেই যাবে। তা তুমি কি কলকাতার কারবার তুলে দিলে?

    --নারে এইতো বাড়ি থেকেই সব চলছে। এখন সব কিছুই দূর থেকে করা যায়। ইন্টারনেট। বুঝলি?

    --ও তুমি বোঝো। যাই বল কি যে ভালো হচ্ছে তাতো কিছু বুঝিনে। শুনি নাকি ওই মোবাইলে ফুল সব পড়ে যায়, পাখি মরে যায়, ডাবে আর সবুজ ধরে না।

    --ধুর পাগল। ওগুলো সব সত্যি নয় রে, কিছু খারাপ তো আছেই তবে সুবিধে প্রচুর।

    --কুমার বাবা, শুনলাম নাকি মির্জাহাটির দিকে ঝামেলা নাকি মেটেনি। তা তুমি ওখানে যাও কেন? ও সব কি আর তোমার জমি? ওদের ঝামেলা মিটিয়ে তোমার কি হবে? মুসলমানগুলো তোমাদের জমি নিয়ে নিলো আর তুমি ওদের কথা ভাবো কেন?

    --আরে ওরা কি জোর করে নিয়েছিল নাকি? সরকার অধিগ্রহণ করে ওদের দিয়েছিল। কত বছর থেকে ওরা চাষ করত। ওরা পেয়েছে। ভালই তো হয়েছে।

    --এই ভালোমানুষির জন্যই তোমাদের সব গেল। সেই সময় কত লোক পঞ্চায়েতের সঙ্গে সাঁট করে বেনামে কত জমি রেখে দিল। হাবাগোবা লোককে বর্গা দিয়ে আসলে সব নিজের কাছেই রাখল। আর তোমার বাপ ঠাকুরদা চুপ করে সব বিলিয়ে দিল। ভালো কথা বলি, তুমি যখন ভুলেই গেছ ওদের ব্যাপারে জড়িও না। দিনকাল ভালো নয়। সে দিন আর নাইগো যে তোমাদের কথা সবাই শুনবে।

    --সে জানি নিমাই কাকা। আরে আমি কিছুই করিনি। এমনি গেছিলাম। সেসব বাদ দে। ওসব ভাবিস না। আর শোন আমাকে এবার চাষের কাজ সব শেখাবি, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে চাষ করব, মাঝে অবশ্য কলকাতায় যাব দুদিনের জন্য। কিন্তু তুই কোন কিছু আমাকে না বুঝিয়ে আগে থেকে করবি না।

    ভোর উঁকি দিয়েছে আকাশের আঁচলের ফাঁক দিয়ে, সে নির্মল সর্বত্রই, যেন শান্তিকে খোঁজে, সে যেন সতত সম্ভাবনাময় আর পেলব। এমন ভোর মানুষের মনকে সহজ করে। ক্ষণিকের জন্য হলেও করে। এই সময় সহজ। সহজ আকাশ ভালোবাসে ফসলের বুক, গ্রামের মাটি আর মানুষের মনকে। আজ ভোরে বৃষ্টি নেই, রোদ ঝলমলে। আল ধরে হেঁটে যাচ্ছে কুমার। নিমাই দূরে ক্ষেতে নেমে ধানের গাছগুলোর গোড়া নিড়োনোর কাজ করাচ্ছে। ওর নিজের অল্প কিছু জমি আর কুমারের সবটার দায়িত্বই নিমাই সাধ্যমতো পালন করে। কুমার অনেক দিন পরে আবার আসছে এই মাঠে। একটা ফিঙ্গে মাঠের মাঝে গেঁথে রাখা লাঠির মাথায় চড়ে বসে সব দিকটা দেখে নিচ্ছে যেন সেই মাঠের চৌকিদার। একটা উড়তে না শেখা বাচ্চা পানকৌড়ি কোনওরকমে ঘষটে ঘষটে এগিয়ে চলেছে আলের ধার ঘেঁষে। চোখের পাশ ঘিরে তার সাদা ছোপ। ভিতু চোখটাকে সেটা আরও ভিতু করেছে। তার স্বাভাবিক যাত্রা এখন জমে থাকা জলের দিকে। আলের ধারেই কোথাও পানকৌড়ি তাহলে বাসা বাঁধে, কুমার জানে না। কিষানরা এর মধ্যেই কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে। ওরা সব ভোরের পাখির মতো। ভোর রাতে উঠে মাঠে গিয়ে সব কাজকম্ম দেখাশোনা করে তাড়াতাড়ি ফিরে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করে। রোয়া আর ধান কাটার সময়ের কথা অবশ্য আলাদা, তখন সারাদিনই কাজ। অনেক কষ্টে নাকি আজ কিষান পাওয়া গেছে। এখন চতুর্দিকে ঠিকা কিষান পাওয়া খুব মুস্কিল বলে নিমাই সারাক্ষণ বলে যায়। একশ দিনের কাজ করে যা দুশ-একশ পায় তা প্রায় না খেটেই। ফলে গায় গতরে নাকি এখন কেউ খাটতেই চায় না। শুধু তাই নয় একশো দিনের কাজ করিয়ে নাকি অনেক ঠিকাদার আর পঞ্চায়েতের লোকেদের অবস্থা পেকে টুসটুসে অবস্থা। এখন এই অঞ্চলে ডি ভি সির খালগুলোর সংস্কার হচ্ছে। কচুরিপানাকে ওষুধ দিয়ে নিকেশ করা হচ্ছে, পাড় বেঁধে দিয়ে জোরদার করা হচ্ছে। তা নিমাইয়ের কথামত সেখানেও কুঁড়েগুলো নাকি সারাদিনে দশ ঝুড়ি মাটিও এদিক থেকে ওদিক করে না। আর চল্লিশ হাজার টাকার কাজে নাকি সাড়ে ছ লাখ টাকা মঞ্জুর হয়েছে। এইসব অনেক কারণ অকারণের বিষয় নিয়ে সারাদিন গজর গজর করে নিমাইয়ের দিন কেটে যায়। দূরের গ্রামগুলো আদিবাসীদের। ওইখানে একসময় বালির খাদান ছিল। এখন সারি সারি পুকুর। লাইন ধরে সেগুলো তৈরি হয়েছিল এক সময় বালি তুলে তুলে। ওই পুকুরগুলোতে ইজারা নিয়ে মাছের চাষ করে আদিবাসীরা। কলবাবুরই সম্পত্তি এখন। এই অঞ্চলে এখনো একটা সরু রেখা বরাবর বালি পাওয়া যায়। কোন নদীর গতিপথ লুকিয়ে আছে ওখানে। পুরনো নৌকোও পাওয়া যায় মাটি খুঁড়ে। পাওয়া যাবে নাই বা কেন। সবই তো গাঙ্গেয় অববাহিকা। গঙ্গার সঙ্গে কত নদীই তো মিশে ছিল। কালের নিয়মে হারিয়ে গেছে। খাদানগুলোর পূর্ব দিকে আদিবাসীদের গোর দেওয়ার জায়গা। আগে সবাই গোর দিত এখন জমিরও দাম বেড়েছে আর বদলে গেছে সংস্কৃতি। আজকাল পুড়িয়ে দেয় বা লুকিয়ে ভাসিয়ে দেয় বডি। শুধু শরীরের আঙুলটাঙ্গুল কিছু একটা অংশ কেটে পুঁতে দেয় মাটিতে, নিয়ম রক্ষা করে।


    ভুবনবাবুকে দেখলো কুমার অনেক দিন বাদে। নিজে দাঁড়িয়ে আছেন নাতিকে পাশে নিয়ে এই ভোরে। বড়ছেলে মনে হয় এসেছে। ভুবনবাবুকে সবাই স্যার বলে। ওঁর জমিতে ধান রোয়া অনেক আগেই হয়ে গেছে। সার দেওয়ার পরে নিড়োনোর কাজও শেষ। গোড়ায় কেঁচোতে মাটি তুলেছে। অন্য জমিতে এত কেঁচোর মাটি নেই। মনে হয় কেমিক্যাল কম দিয়েছেন বা ভারমিকম্পোস্ট দিয়েছেন। ভুবনবাবু কুমারের সরাসরি মাস্টারমশাই নন। কারণ কুমারের পরিবার প্রাইমারির পর কলকাতাতে চলে গেছিল। কিন্তু ভুবনবাবুর ছোটো ছেলে জিতু ওর সঙ্গে পড়ত প্রাইমারিতে। পুজোর ছুটিতে সব্বাই মিলে দরিয়াপুরে এলে হাতে গোনা কয়েকজনের সঙ্গে কুমার কথা বলার জন্য মুখিয়ে থাকত। সব থেকে বন্ধু ছিল জিতু। সে ছিল দারুণ ছাত্র। দরিয়াপুরের মতো মফঃস্বল থেকেও দুর্দান্ত রেসাল্ট করেছিল মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে। কত বিষয়ে খবর রাখত যা কুমার কলকাতার সব থেকে নামী স্কুলে পড়েও অনেক সময় জানতেই পারত না। সহজেই জয়েন্টে চান্স। তারপর যাদবপুরে বি ই পাশ করার আগেই একদিন শুনল ও হারিয়ে গেছে। কেউ জানে না কোথায়। তখন কুমার দিল্লিতে পড়ে। শেষ দিকটায় আসা হত না দরিয়াপুরে। তাই কথাও হত না তেমন। কুমার খুব অবাক হয়েছিল। ধাক্কা খেয়েছিল খুব।

    --স্যার বহুদিন বাদে কেঁচোতে এত মাটি তুলতে দেখলাম।

    --আমি গত দুবার পেস্টিসাইড খুব কম দিয়েছি হয়ত তাই। এবার মোটে দেব না। আমি একা বলে আগেই চাষ দিয়েছি। আশপাশের সবাই মিলে যদি কমাত তাহলে হয়ত আরও হতো। আমি একা করলে তো হবে না। দেখি কতদূর টানতে পারি।

    --আমিও দেখি এবার তাহলে দেব না।

    --জাতটা যে জরুরি, সেটা বুঝে যা করার করো। তোমার তো স্বর্ণ। হবে না। কীটনাশক লাগবে। কিন্তু তুমি কি বিদেশের পাট এক্কেবারে চুকিয়ে দিলে?

    --হ্যাঁ স্যার, এই বেশ শান্তিতে আছি।

    --দেখো থাকতে পারো কি না। বলে ভুবনবাবু এগিয়ে গেলেন নাতির হাত ধরে উল্টোদিকে।

    কথাটা কুমারের বার বার মনে লাগে। সবাই বলে। যে ফুরফুরে ভালো লাগা ভাবটা কুমারের মনে এতক্ষণ ছিল হঠাৎ করেই সেটা কেটে গেল। মাথার ওপরে রোদ্দুর এখন বেশ চড়া।

    #

    কাল রাতে ভাই এসেছিল স্বপ্নে, গায়ে ঝকঝকে জামাকাপড় ছোটবেলার শাহরুখ খান যেন। কত কথা বলল সে ভাইকে আদর করে বসিয়ে, গল্প করল দুইজনে। মোরশেদ ওর মুখে দেখল কি অদ্ভুত হাসি, খুশি খুশি মন যেন। জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিল -- ভাইজান বাড়ির পাশের কারখানায় কাজের সুযোগ পেয়েছি আর কোন চিন্তা নাই। কোন চিন্তা নাই। তারপর উড়ে চলে গেল জানলা দিয়ে। হায় আল্লা এ কিসের স্বপ্ন, এ স্বপ্ন কেন সে দেখল। সে আজকাল বউকে কিছু বলতে পারেনা, মায়ের দিকে তাকাতে পারে না। তবুও তো দাঁতে দাঁত চেপে সময়কে কাটিয়ে যেতে হয়। মির্জাহাটির জীবন বহিরঙ্গে এখনো আগের মতোই, কিন্তু চিন্তিত সকলেই, ভেতর ভেতর মনগুলো এখনো থমথমে। ক্ষেতের চারাগুলোর গায়ে এখন জোর হয়েছে, টেনে লম্বা হচ্ছে। যখন হাওয়া দেয় তখন মনে হয় একদঙ্গল সম বয়েসি ছেলেমেয়ে যেন নিজেদের মধ্যে খেলা করছে। মোরশেদ নিজেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। দিন রাত কাজ করেছে মাঠে, চারাগুলোকে হাত বোলাতে বোলাতে ভেবেছে ভাইয়ের কথা। আর মনে মনে আরও শক্ত করে প্রতিজ্ঞা করেছে, বেঁচে থাকতেই হবে। সে কলবাবুর দেওয়া টাকা নিয়েছে। কৃষক বিমার টাকাও সে পেয়েছে। সে বুঝেছে সে চাইলে এখনো আরও অনেক কিছুই পেতে পারে। কারণ সে জানে এর পেছনে কী কারণ। কিন্তু সে নিজের আত্মাকে বিক্রি করবে না। সে চতুরের সঙ্গে চতুরের মতো করেই লড়বে। শুধু সে নয় তাকে তার পরিবারকে বাঁচাতে হবে, বাঁচাতে হবে কাছের লোকগুলোকে, বাঁচাতে হবে মির্জাহাটির মাটিকে। কিন্তু ভাই তাকে কি বলে গেল? তাহলে কি ভাবে সে জোর পাবে? তার হাত ধরবে কে? তাহলে কি মোরশেদ নিজেও ভুল করছে? তাহলে কিভাবে মানুষ নিজের সম্মান নিয়ে বাঁচবে? আর কি কিছু তার আশপাশের লোকজন শিখেছে যা দিয়ে তারা করে কম্মে খাবে? কম বয়েসি ছেলেগুলোই বা কী ভাবে করে খাবে? ঠিক পথ তাহলে এই মুহূর্তে কী? এই গ্রামে রাজনীতির মানুষ তেমন সুবিধে করতে পারেনি কোনদিনই। ধর্মের ইমান আর রাজনীতি যায়না একসঙ্গে। কিন্তু চারদিকেই কেমন গন্ধ পায় মোরশেদ আজকাল। আদৌ তাদের জীবনগুলো থাকবে তো? শুধু খেতে পড়তে পাওয়া ছাড়া যেখানে বেশির ভাগেরই কোন চাহিদা নেই সেখানে কেন অদৃষ্ট এত পরীক্ষা নেয়!

    ।।৮।।

    কিন্তু আলোকবর্ষ দূরে কাকে দেখা যাচ্ছে? কি অদ্ভুত এই সৃষ্টি। আগে তো দেখিনি তাকে। তার ত্বক আমের পাতার মতো মসৃণ। তার বাহু নদীর পাড়ের মাটির মতো নরম। তার দুই পা সে যেন স্ফটিকের মতো ভাস্বর। তার মুখমণ্ডল সে নিজেই সাজিয়ে চলেছে আপন খেয়ালে এক বিশাল সরোবরের জলের ছায়ায়। কিন্তু সে দেখছে না কিছুই। কত কি আকর নিয়ে বসে আছে পাশে, সেসব সে নিজের মুখে লাগায়, গায়ে লাগায় আর নিজের অজান্তেই কখন ধুয়ে ফেলে। সে নদীর মতো উল্লসিত আবার হিমের মতো দুর্বোধ্য, নিজেই নিজের কাছে। তার চারপাশে সে রচনা করে চলেছে একের পর এক পশ্চাদপট, সে কত রকম ভঙ্গিমায় তার সামনে নিজেকে মেলে ধরে, কখনো দুই বাহু ছড়িয়ে, কখনো দুই করতল দুই গালে রেখে কখনো মুক্ত কেশে বা কখনো উন্মাদের মতো হেসে। সে একা একা কথা বলে আবার চুপ করে থাকে দীর্ঘ সময়, যেন ভাষাহীন। অঙ্গুলিহেলনে সে নিয়ে আসছে কখনো সুস্বাদু ফল, কখনো সুগন্ধি খাদ্য ও মদিরা। কিন্তু সে সন্তুষ্ট নয়। সে সন্তুষ্ট হতে পারছে না কোন কিছুতেই। তাই সে রচনা করল এবার অন্ধকার আর সেই অন্ধকারেই ঘুমিয়ে পড়ল একসময়। সেই সরোবরের ধারেই। পৃথিবীতে যখন অনেক রাত তখন সব জোনাকির দল কত সশস্র আলোকবর্ষ পথ পেরিয়ে তার কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে। বিশ্বে যা কিছু যেখানে ছিল সবাই হাজির হল তার আশপাশে। তার মুখে এখন মৃদু হাসি, শিশুর দেয়ালা। সে কি দেখছে বা ভাবছে আর কিছু বোঝা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ আগে হলে আমার পক্ষে সেখানেও প্রবেশ করতে পারা সম্ভব হত বা এমনও হতে পারে হয়তো সে অপ্রবেশ্য। সে কে হতে পারে? যদিও কিছুই এখনো বোঝা যাচ্ছে না সে আরও কি করতে পারে বা সত্যি কি সে চায় কিন্তু এটুকু বোঝা যাচ্ছে সে অতুল ক্ষমতাবান। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে সেও আসলে চাইছে নতুন কোন অস্তিত্ব। তার কাছে বিশ্বের কোন কিছুই এখন আর মূল্যবান নয়। একসময় সে ঘুম থেকে উঠল। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলো হাঁটুর ওপরে মাথা রেখে। তারপর এক সময়ে সে উঠে দাঁড়াল। সে কি অপরূপ সৌন্দর্য। সে কি দীপ্তি। অঙ্গুলি হেলনে সে এইবার সৃষ্টি করল এক ছোট্ট নৌকো আর তারপর তাতে নিজেই চেপে বসল। বাইতে থাকল দাঁড়। তারপর সেই যে প্রথমেই বলা মাধবীলতার পথ ধরে সে ভেসে চলল। অজানায়। চারপাশে গ্রহ নক্ষত্রের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলল তার তরণী। যেখানে একলা বসে আসলে বইতে থাকল সে নিজেই। তার নাম কি হতে পারে? তার নাম কি হতে পারে ঈশ্বর? বা উদাসীনতা? ভাবতে ভাবতে ঘোর কাটে যেন। সে তো এদিকেই আসছে। তার নৌকো এখন আমার সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটার বাঁকে এসে পড়েছে। ধীরে অথচ নিশ্চিত গতিতে সে এগিয়ে আসছে এই খানেই। নদীর জল আর ভোরের প্রথম আলোর ছটায় সে এখন আরও স্পষ্ট। তার সারা গায়ে এখনও সেই সরোবরের মাটি। বিন্দু বিন্দু স্বেদ অবশ্য তার মুখ থেকে কিছুটা ধুয়ে দিয়েছে সেই মাটি। সে কারণেই বোঝা যায় সে কৃষ্ণবর্ণ, তার স্তন ঝর্নার মতো অফুরান, তার নিতম্ব পৃথিবীর আপন গাম্ভীর্যের মতো ব্যাপ্ত আর বিপুল পথের শ্রান্তি চোখে নিয়ে সে আরও লাবণ্যময়ী। হ্যাঁ তার নাম নারী। সে ধীরে ধীরে এসে আমার সামনে দাঁড়াল আর অদ্ভুত ক্লান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল -- আচ্ছা এখানে ভালোবাসা কোথায়?



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments