আগন্তুক
সবাই চমকে গিয়ে দেখে জটাজুটধারী এক সন্ন্যাসী। কি কাপালিকই হবে। হাতে একটা ত্রিশূলও আছে। চোখ দুটো পাকা লংকার মতো লাল। সে দ্বিতীয়বার বজ্রনির্ঘোষে বললো--ভিক্ষাং দেহি, অন্নং দেহি।
অংকস্যার চপে সস্ মাখিয়ে নিচু গলায় বললেন--ব্যাটা আড়ি পেতে শুনছিলো। ভেবেছে আমরা সংস্কৃতর সমঝদার।
মেজোদাদু ছটফট করে এমন একটা হাতের ভঙ্গি করলেন যার একমাত্র অর্থ- পাশের বাড়িতে হরির লুট দিচ্ছে আর তুমি এখানে, মিঞা?
কিন্তু সন্ন্যাসীটা কটমট করে চেয়ে রইলো। অংকস্যার চাপা গলায় বললেন- দাঁড়ান, এক্ষুনি প্রমাণ পাওয়া যাবে ব্যাটা ভণ্ড কিনা। বলেই চেঁচিয়ে উঠে বললেন- “নরঃ চলন্তি” শুদ্ধ না অশুদ্ধ?
গ্যাঞ্জাম আর গাংলু যাকে বলে ২০০ অবাক। প্রথমত ১০০ অবাক কারণ সন্ন্যাসীকে আবার কোন গেরস্থ কুইজ করে ভিক্ষা দেয়? তার উপরে আরো ১০০ অবাক কারণ অংকস্যারের প্রশ্নটা হয়েছে জলের মত সোজা। নরঃ, নরো, নরাঃ। সুতরাং হওয়া উচিত- নরাঃ চলন্তি। “নরঃ চলন্তি” যে অশুদ্ধ এ তো ক্লাস ফাইভের তোতোনও জানে। কিন্তু ৩০০ অবাক হবার কারণ ঘটলো একটু বাদেই যখন কটমট করে তাকাতে তাকাতেই সন্ন্যাসীটা বললো- শুদ্ধ। আর ওমনি আত্মহারা হয়ে অংকস্যার- আসুন আসুন, আস্তাজ্ঞে হোক, বলে গেট খুলে মহা আপ্যায়ন করে নিয়ে এলেন তাকে। সেই ফাঁকে কুকুরবেশি ধর্মের মত মিচকেও সুট করে ঢুকে পড়লো উঠোনে।
অংকস্যার গ্যাঞ্জাম- গাংলুকে বললেন- দাঁড়িয়ে দেখছিস কী? যা যা ভিতরে গিয়ে খবর দে এক মহাত্মার পায়ের ধুলো পড়েছে। তারপর গ্যাঞ্জামের ভুরুদুটো বেয়াড়া রকমের কুঁচকে আছে দেখে নরম হয়ে বললেন- বুঝলি না? নৃ শব্দটাও তো আছে রে বাবা। না, নরৌ, নরঃ। সুতরাং- নরঃ চলন্তি আর নরাঃ চলন্তি দুটোই শুদ্ধ। Double entendre বলতে পারিস।
খবর পাওয়া মাত্র অবশ্য মা আর দিদিমা এসে প্রণামটনাম করে একাকার। গ্যাঞ্জাম-গাংলুকেও করতে হল। ততক্ষণে অংকস্যার নিজের ভাগের চপগুলো সযত্নে সাজিয়ে দিয়েছেন সন্ন্যাসীটার হাতে।
সন্ন্যাসীটা কোন কথা না বলে চপ ধ্বংস করতে লাগলো আর মেজোদাদুর দিকে কটমট করে চেয়ে রইলো। মেজোদাদু সেদিকে যাতে তাকাতে না হয় সেইজন্য টেবিলের ওপর সাজানো বড় করে আঁকা ক্রসওয়ার্ডের উপর ঝুঁকে পড়লেন একেবারেই তন্ময় হয়ে।
মা এসে জানিয়ে গিয়েছিলো যে মহাত্মা যখন এসেই পড়েছেন তখন খেয়ে যাবেন। সন্ন্যাসীটার হয়ে অংকস্যারই লুফে নিলেন প্রস্তাবটা। কাষ্ঠাসনে অর্থাৎ কাঠের বেঞ্চিতে বসে নিরামিষ ভোজনে কোন দোষ নেই। যত্র, তত্র, অর্থাৎ রেলের ইস্টিশানে এবং গৃহস্থের দাওয়া এই দুই জায়গাতেই তা করা যায়।
সন্ন্যাসীটাকে অনেক পীড়াপীড়ি করেও তার পূর্বাশ্রম সম্বন্ধে কিছু জানা গেল না। অংকস্যার শেষে বললেন- অন্তত কর্মক্ষেত্রের একটা পরিচয় দিন। যাতে বুঝতে পারি কার কাছে মুখ খুলেছি।
তখন সন্ন্যাসীটা ভাবালু হয়ে বললো- দর্শনশাস্ত্রে একটা পি এইচ ডি করেছিলাম। কিন্তু কোন কাজে লাগলো না। এখন হঠযোগ নিরে রিসার্চ করছি।
অংকস্যার তা শুনে- কেয়া খুব, কেয়া খুব বলে আরো চপ তুলে দিলেন তার হাতে।
বৃষ্টিটা থামলো না। আকাশটাও মেঘমেদুর হয়েই রইলো। “খিচুড়ি আর ডিমভা…” বলে চিৎকার করতে গিয়েই অংকস্যার সামলে গিয়ে বললেন, ”… কপিভাজা।” কিন্তু দুপুরে খাওয়ার তখনও দেরি ছিলো আর গ্যাঞ্জাম-গাংলুর কোথাও যাবার ছিলো না। তাই গ্যাঞ্জাম অংকস্যারকে চেপে ধরলো- ভাষার অংকটা কী বুঝিয়ে দিতে হবে। অংকস্যার বললেন- ঠিক তৈরি হয়ে আসিনি, বুঝলি। তাই কিছু সহজ জিনিশ দিয়েই শুরু করা যাক। আড় চোখে গাংলু দেখলো সন্ন্যাসীটা চুপটি মেরে মেজোদাদুর ক্রসওয়ার্ড সমাধান দেখে যাচ্ছে একমনে।
অংকস্যার বললেন- Zipf’s Law-এর নাম শুনেছিস? শুনিসনি তো? তাহলে শোন। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির জার্মান ভাষার অধ্যাপক ছিলেন George Kingsley Zipf. ৩০-এর দশকের গোড়ার দিকে উনি একটা সূত্র বের করেন, যার নাম এখন জিপফের সূত্র।
- সূত্রটা কী? অংকস্যার বললেন- সূত্রটা বুঝতে গেলে একটা উদাহরণ দিতে হবে। ক্যালকুলেটর আমার ঝোলার মধ্যেই আছে, কিন্তু একটু স্ট্যাটিস্টিক্স্ চাই। গ্যাংজাম ভিতর থেকে বাবার তৈরি স্কুল ইন্সপেক্শানের অ্যানুয়াল রিপোর্ট একটা নিয়ে এল। অংকস্যার সেটা উলটে পাল্টে দেখে একটা টেবিল বানালেন।
স্কুলের নাম সনাতন বিদ্যাপীঠ সেন্ট মার্টিন চারুলতা মেমোরিয়াল দেশবন্ধু অ্যাাকেডেমি বিদ্যামন্দির | ছাত্রসংখ্যা / জিপফের সূত্র ১২০০/n ১০৭৮ / ১২০০ ৬১১ / ৬০০ ৪১০ / ৪০০ ৩২৬ / ৩০০ ২২৩ / ২০০ |
- সবচেয়ে মজাটা হল এই যে সহজ কিছু statistical system বা পরিসাংখ্যিক প্রণালীতে জিপফের সূত্র কেন প্রযোজ্য তা অংক কষে দেখানো যায়। কিন্তু জনসংখ্যার মত জটিল ব্যাপারেও কেন এধরনের সূত্র কাজ করবে, বা a, b-র মান কীভাবে পরিসংখ্যান না দেখেই নির্ধারণ করা যাবে তার কোন তত্ত্ব নেই। জিপফের সূত্র নিয়ে আজকাল অনেক গবেষণা হচ্ছে। বিশেষ করে গণিতজ্ঞ Benoit Mandelbrot-এর নাম উল্লেখযোগ্য। আরও মজার ব্যাপার উনি fractal বলে এক ধরনের জ্যামিতিক নকশা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে সেখানেই জিপফের সূত্রের প্রয়োগ দেখতে পান।
- কিন্তু ভাষার সঙ্গে এর সম্পর্কটা কী? জিজ্ঞেস করে গাংলু।
- সেটাই তো আশ্চর্যের ব্যাপার। বললেন অংকস্যার। মনে আছে যে জিপ্ফ ভাষার অধ্যাপক ছিলেন? দেখা গেছে যে ইংরেজিতে একটা বই নিয়ে তার শব্দগুলোকে যদি ব্যবহারের সংখ্যা অনুযায়ী সাজানো হয় তাহলে সেই সিরিজেও জিপফের সূত্র চমৎকার খাটে। এ্রর কারণটা নিশ্চয়ই পরিসংখ্যানগত। এবং তাহলে শুধু ইংরেজি নয়, যে কোন ভাষার ক্ষেত্রেই এটা খাটবে। তবে আলাদা আলাদা ভাষায়, বা একই ভাষায় আলাদা আলাদা লেখার স্টাইলের ক্ষেত্রে, a, b-র মান আলাদা হতে পারে। বাংলায় এ নিয়ে কোন গবেষণা হয়েছে কিনা জানা নেই। না হয়ে থাকলে, শীগ্গিরই হবে, বলে রাখলাম।
গ্যাঞ্জাম মাথা চুলকে বললো- তার মানে অংক ব্যবহার করে বলা সম্ভব যে লেখার স্টাইলটা কেমন? কোনটা রবীন্দ্রনাথ, কোনটা মাইকেল? দারুণ তো!
অংকস্যার বললেন- তবে? এই যে রবীন্দ্রনাথ পড়ে ভালো লাগছে বা গাংলুদের সেই পত্রিকার লেখা পড়ে মনে হচ্ছে যেন কেমন কেমন, এসবের পিছনে কোন অংক নেই নাকি?
ইতিমধ্যে একটা গোলমাল শুরু হয়েছে। মেজোদাদু ক্রসওয়ার্ডের কয়েকটা শব্দ নিয়ে আটকে গিয়েছিলেন। সন্ন্যাসীটা তাঁর হাত থেকে পেন্সিল কেড়ে নিয়ে সেগুলো করে দিয়েছে। মেজোদাদু মুখ লাল করে বললেন- চালাকি পেয়েছো মোহন? সূত্র কখনো বলছে এক কথা আর উত্তর হচ্ছে তার ঠিক উল্টো? ভদ্দরলোকে এসব পারে?
অংকস্যার বাও করে বললেন- ক্রসওয়ার্ডের শিরোনামটা দেখছেন না। সান্ধ্যসূত্র কি আর সাধে বলছি একে?
মা এসে জানালো যে খাবার বাড়া হবে। সবাই উঠে পড়ছিলো। সন্ন্যাসীটা হঠাৎ পেন্সিল চিবোতে চিবোতে বললো- ব্যাসকুট, ব্যাসকুট!
ব্যাস্, আর যায় কোথা। অংকস্যার একলাফে আবার অংক থেকে সংস্কৃতের জগতে।
শর্মিলা ব্যানার্জি
অমর মুখার্জি
শুভ্র রঞ্জন চক্রবর্তী
প্রথম দুজন শব্দশিকারীর জন্য পরবাসের টি-শার্ট পুরস্কার। - সম্পাদক।
অংকস্যারের আগের বারের ক্রসওয়ার্ডের উত্তর এখানে