এক সওয়ালের দুই জবাব
মেজোদাদু পেন্সিলে কামড় দিয়ে বললেন- রিবাস, যতই শক্ত দাও না বাপু, ঠিক ফেঁড়ে ফেলবো।
অঙ্ক স্যার নাকটা ধরে একটু টেনে বললেন- বিষয়টা আরো চ্যালেঞ্জিং হয়ে যাচ্ছে। মুশকিল হল ধ্বনিভিত্তিক বা phonetic লিপিটা অক্ষরভিত্তিক বা alphabetic লিপির মত flexible নয়। ফলে anagram-টা যুৎসই করে লাগাতে পারছি না।
গ্যাঞ্জাম বললো- কেন, কি রকম উলটে দ্যাখো= মকর এরকম একটা সূত্র যদি বানাই তাহলে সেটা অ্যানাগ্রাম নয়?
অঙ্কস্যার এক ঢোঁক চা গিলে বললেন- এটাও অ্যানাগ্রাম, তবে একটু নীচু জাতের। উঁচু জাতের অ্যানাগ্রাম করতে গেলে অক্ষরগুলো শুধু এদিক-ওদিক করলেই হবে না, পুরো সূত্রটাই অ্যানাগ্রামের মধ্যে দিয়ে বলতে হবে। তার জন্য ভাষার প্রচুর flexibility চাই।
গাংলু বলে- একটা উদাহরণ দিন তো।
অঙ্কস্যার খাতা টেনে নিয়ে লিখলেন:
IT’S NOW SEEN LIVE=?
IT’S NOW SEEN LIVE=TELEVISION NEWS
অঙ্কস্যার মুখ ব্যাজার করে বললেন- দুটোই খুব বিখ্যাত। প্রথমটা ফেঁদেছিলেন William Grossman. দ্বিতীয়টা বানিয়েছিলেন The New York Times-এর ক্রসওয়ার্ড সম্পাদক Will Shortz. ওনার আবার enigmatology বলে নতুন একটা বিষয়ে রীতিমত ডিগ্রী আছে। পৃথিবীতে আর কারো ওই ডিগ্রী নেই।
গাংলু গালে হাত দিয়ে ভাবছে। অঙ্কস্যার বললেন- বাংলায় এরকম কিছু খুঁজে পেলে জানাস। ভাষার কিছু কিছু সীমাবদ্ধতা তো থাকতেই পারে। কিন্তু চেষ্টা ছাড়া তো সেগুলো জানাও যায় না। আবার ভাষার জোরগুলোকে কি আমরা পুরোপুরি চিনতে বা ব্যবহার করতে পারছি? না পারলে সেটাই দুঃখের। ক্রসওয়ার্ড নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে দেখলাম চমৎকার সব আইডিয়াগুলো আগেই ওরা পশ্চিমের দেশে সব আবিষ্কার করে ফেলেছে।
গ্যাঞ্জাম জিজ্ঞেস করে- যেমন?
অঙ্কস্যার বললেন- যেমন ধর double- entendre বা এক সওয়ালের দুই জবাব। সান্ধ্যসূত্রের মজাটা তো বুঝেই গেছিস। একটা সূত্রের একাধিক মানে থাকতে পারে। লুকোনো মানেটাই সাধারণত ঠিক। এবার এটাকে আর এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যা। মনে কর এমন একটা ক্রসওয়ার্ড যার প্রত্যেকটা সূত্রেরই দুটো উত্তর। এবং দুটোই ঠিক। অর্থাৎ পুরো ক্রসওয়ার্ডের সম্পূর্ণ আলাদা দু-দুটো সমাধান।
গাংলু প্রথমেই বলে- অসম্ভব!
অঙ্কস্যার বললেন- আইডিয়া চমৎকার, তাই না? কিন্তু পুরনো। ১৯২৪ সালেই Warner Fite নামক Princeton University-র এক লজিকের প্রফেসার তাঁর ছাত্রদের একটা double- entendre বানাবার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দ্যান। ছাত্ররা কেউ পারেনি, কিন্তু পরে সান্ধ্য ক্রসওয়ার্ডের পণ্ডিতেরা কেউ কেউ পেরেছেন। বাংলায় কিন্তু আজও দেখিনি সেরকম কিছু।
গাংলু ঠোঁট উলটে বলে- দেখবেনও না।
অঙ্কস্যার হাসতে থাকেন।
মেজোদাদু বোধহয় ক্রসওয়ার্ডটা করে ফেলেছিলেন। কাগজ পেন্সিল সরিয়ে রেখে স্মিত হেসে বললেন- বাংলায় ওসব হবে না মোহন। আশা ছেড়ে দাও। বাংলার সলতে পুড়ে গেছে। সেদিন চৌধুরীদের পোষা ময়নাটাকে বললাম- বলতো দেখি হরে কৃষ্ণ! সে যেন চমকে উঠেছে এমন ভাব দেখিয়ে বললো- এক্সকিউজ মী! তারপর থেকে আমাকে দেখলেই না দেখার ভান করে থাকে।
একটু থেমে মেজোদাদু আনমনা হয়ে বললেন- সে ছিলো শশধরদের কাকাতুয়া। ওরকম সজ্জন পাখি না কোনদিন হয়েছে, না হবে। “শুধু বিঘে দুই ছিলো মোর ভুঁই…” বলে যখন আবৃত্তি শুরু করতো, শশধরবাবু চোখের জল মুছতেন। যেরকম নির্ভুল উচ্চারণ, সেরকম সমৃদ্ধ ভোকাবুলারি। আর কী সুন্দর ব্যবহার।
পাখির কথা উঠতেই প্রসঙ্গ পালটে গেল কিছুক্ষণের জন্য। কোকিলের ডাকটাও থেমেছে। কিন্তু চৌধুরীদের বাড়ি থেকে একটা ক্ষ্যাপাটে হি-হি হাসির শব্দ আসছিল। গ্যাঞ্জাম জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো যে শশধরদের কাকাতুয়া সিরাজকে শেষপর্যন্ত গুডিন সায়েব স্বদেশে ফেরার সময় বাংলা কথা বলার একটা সঙ্গী হবে বলে সঙ্গে করে নিয়ে যান। মেজোদাদু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন- কোথায় সেই গুডিন সায়েবরা? কোথায় সেই সব সিরাজ? যে দিন গেছে তা তো ধরে রাখা যায় না মোহন।
অঙ্কস্যার কোন জবাব দিলেন না। খাতা কলম নিয়ে এতক্ষণ কী সব আঁকিবুকি কাটছিলেন। এবার খাতাটা খুলে সবার সামনে রাখলেন। একটা নকশা দেখা গেল। অনেকটা এরকম:
মেজোদাদু বেচশমা এবং সচশমা ছবিটা ভালো করে দেখে বললেন- বাঃ, বেড়ে ছবি হয়েছে তো। নতুন কোন খেলা নাকি?
অঙ্কস্যার বললেন- ওল্ড গেম। সিন্ধু সভ্যতার ক্রসওয়ার্ড কেমন হত তার একটা নমুনা দিলাম। রিবাস ফিবাস কিরকম শক্ত হত সে যুগে ভাবুন। ষাঁড়ের রিবাস করতে গেলে বলতে হয়--
চাট্টিখানি কথা নাকি? রিবাস বলে কিছু ছিলই না হয়তো। আর অ্যানাগ্রাম? তার কথা ভেবেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।
মেজোদাদু ভড়কে গিয়ে বললেন- এসব কি আজগুবি কথা বলছো মোহন? সিন্ধু সভ্যতায় ক্রসওয়ার্ড ছিলো নাকি?
অঙ্কস্যার গম্ভীরভাবে বললেন- ছিলো না তার প্রমাণ কী? ওদের কিছু কিছু সীল দেখে তো আমার ক্রসওয়ার্ডের সমাধান বলে মনে হয়। তবে আসল যে কথাটা বলতে চাইছি তা হল এই যে সিন্ধু সভ্যতা বা চীনেদের চিত্রভিত্তিক লিপির চেয়ে তো আমাদের হরফ অনেক বেশি নমনীয়। সুতরাং একেবারে ভেসে যাইনি আমরা। Double entendre-র আশা পুরোপুরি ছেড়ে দেবেন না ঘোষবাবু। কেউ না কেউ ঠিক বের করে ফেলবে একদিন।
মেজোদাদু ঠিক মানতে পারলেন না। বললেন- কেন করবে মোহন? কীসের উদ্দেশ্যে? এখন সব চৌধুরীদের ময়না হয়ে যাচ্ছে হে। বাংলাই একদিন সিন্ধুলিপির মত লোপাট হয়ে যাবে বলো।
অঙ্কস্যার বললেন- করবে ঘোষবাবু। বাংলার খাতিরে না হোক, অংকের খাতিরে করবে। ভাষার মধ্যেও তো একটা অঙ্ক আছে। খুবই কঠিন অঙ্ক। তার প্রশ্নগুলোই আমরা সবে আবিষ্কার করতে শুরু করেছি। উত্তরের কথা ছেড়ে দিলাম। মনে করে দেখুন double entrende-র চ্যালেঞ্জটা যাঁর মাথায় প্রথম আসে তিনি ভাষাবিদ্ ছিলেন না- অংকের লোকই বলা যায় তাঁকে।
গ্যাঞ্জাম মনে মনে ভাবে- তাহলে কি অঙ্ক শেখাবারই একটা নতুন কায়দা এটা? শব্দতত্ত্ব, অ্যানাগ্রাম, রিবাস, পান এসব চোখে দেবার ধুলো?
মুখে সে বলে- কী ধরনের অঙ্ক তার একটা আভাস দেবেন স্যার?
মেজোদাদুর সমাধান হয়ে গেছে। অঙ্কস্যার সেটাই হাতে নিয়ে দেখছিলেন। গ্যাঞ্জামকে বললেন- দেবো। কিন্তু আজকে নয়। আজ বরং আরো একটা ক্রসওয়ার্ড দিয়ে যাই। বাংলায় এটাও একটা নতুন ধরনের। কীভাবে করতে হবে, কী বৃত্তান্ত কিছুই বলবো না। ছকটা দেখে বুঝে নিতে হবে।
অঙ্কস্যারের নতুন ক্রসওয়ার্ড
১) উপন্যাস হয়, কালিদাস কয়। ৯) সাপগ্রস্ত রাজার উৎপত্তিতে জিত। ১০) কালিমায় হয়ত পাদপ পাবে। ১১) গাঙ পেলেন স্বামীর বোন। ১২) শশধর ননদে বাতাসের ডাক। ১৩) প্রস্থিত সাদা ফুলে আলো। ১৪) গুঁড়ি কলবরে কীর্তিকলাপ। ১৮) সেবা দূর্গের মধ্যে তারা। ১৯) আয়ুষ্কাল বাজীকর বনে। ২১) পামর হিতের নেই কোন তুষারঝড়। ২২) কত যে বলে। ২৩) যে দর পায় না বিষ্ণুভক্ত হলে সে বানচাল। ২৪) নিশি ফুরোনোর মধ্যেই এক নিষ্ক তুক্ষকের রায়। ২৬) পাঁচজনের একজন। ২৮) বিলক্ষণ রামেরই জন্য এই বিরতি। ৩০) তেরতলার ছাতে বাস, ষোলোতলারও ছাতে। ৩২) বাচাল বেগমের ঘর। ৩৩) ঘাঁটালে কিন্তু ঘোড়ার চেয়ে গাধাই ভরসা। ৩৪) ঢাকে বেল পড়লে কে ফেলবে তরল। ৩৬) করমে ধরন। ৩৭) বৃহৎ কিছু করতে গেলে প্রথমে কাটবি তারপর রায় দিবি।
নীচে
১) তেঁতুল পাতায় আঁটে নি। ২) তুলার মর্যাদায়ই শাস্তি। ৩) শরমে জড়িত রাধার কান্ত। ৪) লোক দিয়ে। ৫) বেত যত পায়..। ৬) অপহৃতা পরমা সুন্দরী। ৭) শহর-পদ্মনিবাসে, কাক তালি দিয়ে কলা দেখাও মলয় বাতাসে (৪,৫)। ৮) কিভাবে বিকায় রাশভারী অভিনেতা? ১৩) ভিতরে (?) উপর সাদা প্রমুখ, আসক্ত-ভায়ার্ত (৩,২)। ১৪) নজীর হারান কার চাবিতে মহামান্যের ন্যায়। ১৫) গান মানে কামান, কিন্তু কামান মানেই…. । ১৬) থাকতো বা নেই। ১৭) খেতে বললে খামখা, তাই চেটে মুখ বন্ধ করি। ২০) খারাপ লোকে দিলেন মুখ। ২৪) মৃত্যু মৃত্যু হোক সুন্দর সুন্দর। ২৫) রাতে ভক্ষ ইতস্তত ঘায়ে ভর্তি কিছু। ২৭) যে করবে টকবে শিকার। ২৯) ধূনো বালকেরা। ৩০) সরসের নেই- চাটুনি। ৩১) পাট করে রাখা রকের হাউই। ৩৫) কালের ঢালের সরল অক্ষরগুলি দিয়ে যে শহর…।
অঙ্কস্যার বললেন- একদিকে শব্দতত্ত্ব, অন্যদিকে cruciverbalism, সামনে emigmatology, পিছনে অঙ্ক। আমরা যে কোনদিকে যাচ্ছি।
গাংলু সবার আগে চটপট উঠে পড়ে বলে- আমি জানি আমি কোথায় যাচ্ছি। আমি যাচ্ছি ক্লাবের ফাংশানে। কোকিলাদির নাচ বোধহয় শেষ হয়ে গেল। আপনাদের ইচ্ছে হলে আসতে পারেন।
অংশুমান গুহ
ভাস্কর সেনগুপ্ত
শর্মিলা ব্যানার্জি
বৈদূর্য ভট্টাচার্য