শীতের দুপুরে বারান্দায় বসে মেজোদাদু শব্দশিকার করছিলেন। এমন সময় অংকস্যারের সাথে তাঁর বেধে গেছে। অংকস্যারের মত শব্দশিকারীর প্রধান অস্ত্রই হল গণিত। মেজোদাদু বললেন—ক্রসওয়ার্ডের বাংলা কি জানো মোহন? অংকস্যার চুপ। মেজোদাদু বললেন—এইসব হল সায়েবদের খেলা। বাংলা প্রতিশব্দ পাবে কোত্থেকে? আরে ওইসব রেফ, কয়ে মূর্ধণ্য ষয়ে ক্ষ ওয়ালা ভাষায় ক্রসওয়ার্ড বানানো যায় নাকি?
গ্যাংজাম আর গাংলু একটু আগেই দুঘন্টা অংক করে উঠেছে। বেশ ক্লান্ত। কিন্তু অংকস্যারের শরীরে ক্লান্তি নেই। চটে গিয়ে বললেন—বটে? পুরো ব্যাপারটাই যখন অংক তখন ইংরেজীতে করা গেলে বাংলাতেও করা যাবে। ওদের হল্ আর নাইট তো আমাদের যাদব চক্কোত্তি আছেন।
মেজোদাদু বলেন—এই নাও কাগজ আর কলম। বানিয়ে দেখাও দিকি একটা।
ব্যাস্ অংকস্যার দু কাপ চা নিয়ে বসে গেলেন। চৌখুপী করে ছক কাটতে গিয়ে পেন্সিলের সিস ভেঙে গেল একটা। গ্যাংজাম আর গাংলু উঁকিঝুঁকি মেরে দেখলো বেশ সিমেট্রিকাল একটা ছক্ হয়েছে। গাংলুর হাতের লেখা ভালো। সে-ই নতুন কাগজে ক্রসওয়ার্ডটা টুকে মেজোদাদুকে দিল।
(অংক স্যার যাকে কালো ঘর বলেছেন, পরবাসের পাতায় সেই ঘরগুলিকে রঙিন মনে হতে পারে। —পরবাস সম্পাদক।)
ডানদিকে
১) যেখানে আছেন। ৪) পরিচ্ছন্ন। ৭) আত্মজীবনীর উপযুক্ত নাম। ৮) যক্ষ বিশেষ। ৯) আঘাত করা। ১০) পুষ্করিণী। ১১) তাসের দেশের অসম্ভ্রান্ত নাগরিক। ১৪) যতিহীন। ১৬) গিরগিটি। ১৮) যদি। ১৯) দুর্গার আরেক নাম। ২০) গুরু কিম্বা ঠাকুর। ২২) রাধার জন্য নাচে। ২৩) পুরোন জামা
নীচে
১) এ পথিক বসন্তও হতে পারে। ২) যে পথে হেঁটেছেন চে। ৩) অবন্ধুর। ৪) পতন। ৫) কুসুমের যা নেই মনে হয়। ৬) কানা ছেলের নাম। ১২) সোনা ও কালো সোনার খনি এঁরাই আবিষ্কার করেন। ১৩) হীরা কিম্বা নুন। ১৪) নিদ্রিত হতে পারে। ২৫) হয় হনুমান নয় ধর্মগুরু। ১৬) জপ ও ভজনের উপযুক্ত শব্দ। ১৭) যে কাজে চিতা ব্যবহার করা হয়। ২০) হয় থাকিব নয় শুনিব। ২১) প্রাচীন হাতুড়ে।
দেখে তো মেজোদাদু হেসেই অস্থির। —এটা আবার একটা ক্রসওয়ার্ড হল নাকি? দুমিনিটও লাগে না সমধান করতে। বলতে বলতেই শব্দগুলো বসাচ্ছেন। এত অবলীলায় যে গ্যাংজাম আর গাংলু হাঁ হয়ে গেছে। গাংলুর হাতে সমাধানটা ছিল। মিলিয়ে দেখে হুবহু সব ঠিক। মেজোদাদু ঘড়ি দেখে বললেন—দুমিনিটই লাগলো মোহন। অংকস্যার নতুন একটা পাতায় আবার কাটাকুটি করছিলেন। বললেন—বানাতেও বেশিক্ষণ লাগে নি। এবার একটু সময় দিন। তারপর দেখা যাবে। দুপুরের খাওয়াটাও খেয়েই যাবো তাহলে।
পরের ক্রসওয়ার্ডটা তৈরি করতে ঘন্টা দুয়েক লাগলো অংকস্যারের। মেজোদাদু ততক্ষণে ইংরেজি খবরের কাগজেরটা শেষ উসখুস করছিলেন। খাওয়াদাওয়ার পর গাংলুর হাত থেকে নতুন ক্রসওয়ার্দের কপি ছিনিয়ে নিয়ে বসে পড়লেন। অবাক কাণ্ড। এবার কিন্তু আর পটপট করে উত্তর বেরিয়ে আসছে না আর। ইজিচেয়ারে বসে পেন্সিলের পিছন দিকটা কামড়ে সাবাড় করে ফেলতে লাগলেন মেজোদাদু। ক্রসওয়ার্ডটা এরকম:
ডানদিকে
১) মূল শষ্যে সমৃদ্ধ খাবারকে চেহারাও বলা যায়। ৪) চার মাথার চালাকি। ৭) মস্ত আইনজীবির খুনের রহস্য ছিলো বই কি। ৯) আরেকটু আগে হলেই হয়। ১১) ঘরেতে ভ্রমণ চলে গুনগুনিয়ে। ১২) ঘুমোবার সময় বিশ্বম্ভরকে ছোট করে ডিগবাজি খাওয়াবি। ১৩) যে ছলনার বক্ষপট জুড়ে। ১৫) লেজ ভরেছে রসস্থ তাই। ১৭) পড়ার সময় অল্প শব্দ হবে। ১৮) ভবিষ্যতে হয়ে উঠতে পারিস হবনদ্রব্য। ১৯) কিরকম দেখতে বললেই বুঝবে ভালো নয়। ২১) আধখানাতে প্রতিশব্দ জুড়লে ফের এর প্রতিশব্দ। ২৩) উদার হলে জ্বলে, নইলে পাতে গলে। ২৪) এর কথা শুনলে যে অবাক হবে না তা বলাই বাহুল্য। ২৬) নিজের অধিকার কেড়ে নিয়ে উল্টে কিন্তু বলই পাবে। ২৭) কি খাবার লোভ বলতে গেলে কি বলবে? ২৯) চুল পাকলে কাকার কি হে বড়? ৩০) ফেলও করে নি, ধরাও পড়ে নি।
নীচে
১) এখন ডাকছে, আছাড় দিলে বাইবে ঠিক। ২) অংশ না চাইলে দৌড়ে পালা। ৩) গাছের পাতায়, রোদের ঝিকিমিকি, তাকে শক্তি দেয়। ৪) মুহূর্তের মধ্যে কি তেরটিকে ধরা যায়? ৫) তুলনা করলে অত্যুক্তির চেয়ে ভুলই বেশী। ৬) শাক্যমুনির মামারা। ৮) টানা হাতের আঁকিবুকি। ১০) কাঁপছে। ১২) এই অনুষ্ঠান প্রজাপতির নির্বন্ধ তো বটেই। ১৪) সাবধানে পার হ, ঝাঁকালে ফাটবে। ১৬) পাড়াগাঁর বাইরে যেথা জীব সেথা শিব। ১৯) যে ভদ্রলোকের গলিতে পিলু বারোঁয়ার সুর। ২০) নীরস হলে লুপ্তির সম্ভাবনা, না হলেও মজামাটি। ২১) চমৎকার বলতে পারো। ২২) ঘরে বাইরের মাঝখানটা পড়ে সময় কাটানো। ২৫) অথবা লু এর কথা ভাবো। ২৭) পিছিয়ে দিলে কি উদ্বৃত্ত? ২৮) তাকের উপর থাকে এবং হেঁটমুণ্ডু হয়ে কায়দা দেখায়।
মেজোদাদুর এই অবস্থা দেখে গ্যাংজাম আর গাংলু বেশ অভিভূত হয়েছে। অংকটা কিরকম তাহলে? জিজ্ঞেস করে তারা। অংকস্যার বললেন—সবটাই টোপোলজির খেলা। বুঝলি কিছু?
গ্যাংজাম আর গাংলু বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ে—যার অর্থ বুঝতেও পারি আবার নাও বুঝতে পারি।
অংকস্যার আবার বসে পড়ে বললেন—প্রথম ক্রসওয়ার্ডটার সমাধান দিয়েই শুরু করা যাক তাহলে আলোচনাটা।
(অংকস্যারের প্রথম ক্রসওয়ার্ডের সমাধান এখানে)
—প্রথমে ছকটা দ্যাখ। বললেন অংকস্যার। গ্যাংজাম আর গাংলু উপুড় হয়ে পড়লো ছকের উপর। — ৯ বাই ৯-এর ছক। অর্থাৎ ৮১টা ঘর। তার মধ্যে কালো ঘরের সংখ্যা হল ২৩, মানে ফাঁকা ঘরের সংখ্যা ৫৮। বললেন অংকস্যার। —যত বেশি কালো ঘর তত সহজ ক্রসওয়ার্ডটা বানানো। এই ছকটা ভরতে আমার কয়েক মিনিট সময় লেগেছে মাত্র, তাই এটাকে এলেবেলে ছকই বলতে হবে।
গ্যাংজাম বলে-–সেই জন্যই মেজোদাদু এত তাড়াতাড়ি করে ফেললেন।
অংকস্যার খাপ্পা হয়ে বললেন—ওয়েট ওয়েট। ছক এলেবেলে হলেই যে ক্রসওয়ার্ড সহজ হবে তা নয়। বরং উল্টোটাই হওয়া স্বাভাবিক। ব্যাপারটা বোঝ। প্রতিটা শব্দের জন্য একটা সাংকেতিক সূত্র দেওয়া আছে। আবার দুটো শব্দ যেখানে ক্রস করেছে সেখান থেকে একটা জ্যামিতিক সূত্র পাওয়া যাচ্ছে। এবার সূত্রগুলো গুণে দ্যাখ। শব্দ আছে ২৪টা, তাই সাংকেতিক সূত্রও ২৪টা। ভালো করে গুণলেই বুঝতে পারবি যে জ্যামিতিক সূত্রের সংখ্যা ৩৬। যে যে অক্ষরগুলো দুটো শব্দের অংশ সেই সেই অক্ষরগুলোকে গুণলাম শুধু। অংকটা টোপোলজির, পাটিগণিতের নয়। তবু একটা সহজ রুল অব থাম্ব্ হল এই যে কালো ঘরের সংখ্যা বাড়ালে জ্যামিতিক সূত্র কমে যাবে। অবশ্য শব্দসংখ্যাও কমে যেতে পারে।
গ্যাংজাম কথার তোড় সামলাতে না পেরে দুহাত তুলেছে। --একটু আস্তে স্যার। বুঝে বুঝে এগোই। তার মানে এই ক্রসওয়ার্ডে গড়ে প্রত্যেকটা শব্দের জন্য আছে একটা করে সাংকেতিক সূত্র আর দেড়খানা করে জ্যামিতিক সূত্র? জ্যামিতিক সূত্র এত বেশি বলে কি ক্রসওয়ার্ডটা সহজ হয়ে গেল?
অংকস্যার মুগ্ধ হয়ে বললেন—প্রায় ধরে ফেলেছিলি রে। আরেকটু ভাবলেই হয়ে যেত। ক্রসওয়ার্ডের আসল মজাটাই হল এই জ্যামিতিক সূত্রে। ধর জ্যামিতিক সূত্রের সংখ্যা যদি কমতে কমতে শূন্য হয়ে দাঁড়ায়? কী হবে বল দেখি?
গাংলু বললো—সেটা তো ট্রিভিয়াল কেস হয়ে যাবে। ক্রসওয়ার্ড-ই থাকবে না আর, প্রত্যেকটা শব্দের জন্য একটা করে ক্লু। শব্দে শব্দে কোন যোগাযোগই নেই। কুইজ বলা যেতে পারে তাকে।
অংকস্যার গাংলুর পিঠটিঠ চাপড়ে তাকে প্রায় লজ্জায় ফেলে দিলেন। সাধু সাধু। একেবারেই ঠিক কথা। ক্রসওয়ার্ডের আসল রস পেতে হলে এই অংকটা বুঝতে হবে বুঝলি? জ্যামিতিক সূত্র আর সাংকেতিক সূত্রের রেশিওটা বাড়াতে হবে। একটা অংক নে এক্ষুনি। বলে অংকস্যার লিখিয়ে দিতে থাকেন—৯ বাই ৯-এর ক্রসওয়ার্ডে এই অনুপাতের সর্বাধিক মান হতে পারে ৪.৫। প্রমাণ কর।
মেজোদাদু ওদিকে পেন্সিলের পিছনটা ছিবড়ে করে ফেলেছেন। অংকস্যার সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন—দ্বিতীয়টায় জ্যামিক সূত্র আরো বাড়িয়ে করেছি ৫৫। সাংকেতিক সূত্রের সংখ্যা মাত্র ৩১। অনুপাতটা বেড়ে হয়েছে ১.৭৭। মজাটা বেড়েছে কিন্তু সহজ হয় নি একটুও।
গ্যাংজাম বললো—সাংকেতিক সূত্রগুলো কঠিন হয়েছে আগের চেয়ে।
অংকস্যার চোখ টিপে বললেন—ওখানেই সেকেন্ড মজাটা। যত বেশি জ্যামিতিক সূত্র, সাংকেতিক সূত্রগুলো তত কঠিন করে দেওয়া সম্ভব। সংকেতগুলোও অন্য ধরনের। ইংরেজিতে যাকে বলে ক্রিপটিক ক্লু অর্থাৎ সান্ধ্য সূত্র। জ্যামিতিক ক্লু আর ক্রিপটিক ক্লু হল পরস্পরের সম্পূরক। ক্রসওয়ার্ডের দুই হাত। এ দুটোকে মজবুত করাই উদ্দেশ্য।
অংকস্যার ঝোলাটা কাঁধে তুলে উঠে পড়েছেন দেখে গ্যাংজাম—গাংলু হৈ হৈ করে বললো—ক্রিপটিক ক্লু-এর ব্যাপারটা আরেকটু বিশদে বলা চাই স্যার।
অংকস্যার ততক্ষণে উঠে পড়েছেন। — সো মাচ ফর টুডে। বাকিটা পরের বার হবে। অংকটা করে রাখিস। এসে দেখবো।
মেজোদাদু দূর থেকে চেঁচিয়ে বললেন—আর এটার সমাধানটা রেখে যাচ্ছো তো মোহন?
অংকস্যার যেতে যেতেই শুধু ঘাড় ঝাঁকালেন। যার মানে—রেখে যেতেও পারি। আবার নাও রেখে যেতে পারি…।
(অংক স্যারের দ্বিতীয় ক্রসওয়ার্ডের সমাধান আগামী সংখ্যায়। -পরবাস সম্পাদক। )